ভাব-ভালবাসা
কঠিন সমস্যা। ধর্ম আমাদের ফ্যাশন! না, ধর্ম আমাদের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা। এইরকম কি? জল থেকে মাছকে ডাঙায় তুললে যেরকম ছটফট করতে করতে মরে যায়, আধ্যাত্মিক পরিবেশ থেকে বিচ্যুত হলে আমরাও কি ঐরকম ছটফট করব! ধর্ম কি আমাদের প্রাণবায়ু! কে নাড়ি টিপে বলবেন, জপের নাড়ি তৈরি হয়েছে কিনা! নিজের পরীক্ষা নিজেকেই করতে হবে। অ্যাসিড টেস্ট। সংসার হলো অ্যাসিডের গামলা। তার মধ্যে পড়ে আছি আমি। সংসার আমাকে হজম করে ফেলেছে; না, পারেনি বলে উগরে দিয়েছে! পরীক্ষা তো নিজেকেই করতে হবে!
ঠাকুর বলছেন, লক্ষ্য কর, তোমার মধ্যে কি কি লক্ষণ ফুটছে। বিষয়-কথায় বিরক্তি আসছে কি? বিষয়ী মানুষের কাছ থেকে কি ছিটকে চলে আসতে ইচ্ছা করছে! যদি করে, তাহলে বুঝতে হবে জমি তৈরি হয়েছে। রুচি আসছে। সময় হয়েছে ধারণ করার। কি ধারণ? বীজ ধারণ। এই মনে বীজমন্ত্র নিক্ষিপ্ত হলে, বিশ্বাসের অঙ্কুর বেরোবে। কোন্ বারি সিঞ্চন করতে হবে! ঠাকুর বলছেন : “আমার আগে রামপ্রসাদ তো বলে গেছেন—’ভক্তিবারি তায় সেঁচো না।’ “ ভক্তিই তো সার কথা। ভক্তি কেমন? তারস্বরে চিৎকার! না, ভক্তি হলো, তাঁর কথা শোনামাত্রই, তাঁর চিন্তা মনে উদিত হওয়া মাত্রই বুক ভেসে যাবে চোখের জলে। ভক্তি আর প্রেম অঙ্গাঙ্গী। শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রেম একই সঙ্গে উচ্চারিত। একটা টানলে আরেকটা আসে।
ঠাকুর বলছেন : “যদি রাগভক্তি হয়—অনুরাগের সহিত ভক্তি—তাহলে তিনি স্থির থাকতে পারেন না। ভক্তি তাঁর কিরূপ প্রিয়-খোল দিয়ে জাব যেমন গরুর প্রিয়—গবগব করে খায়।” ঠাকুর এইবার স্তর বিভাজন করছেন : “রাগভক্তি—শুদ্ধাভক্তি—অহেতুকী ভক্তি। যেমন প্রহ্লাদের।” এইবার অহেতুকী ভক্তি কেমন? ঠাকুরের সুন্দর উপমা–”তুমি বড়লোকের কাছে কিছু চাও না- কিন্তু রোজ আস—তাকে দেখতে ভালবাস। জিজ্ঞাসা করলে বল, আজ্ঞা, দরকার কিছু নেই—আপনাকে দেখতে এসেছি। এর নাম অহেতুকী ভক্তি। তুমি ঈশ্বরের কাছে কিছু চাও না—কেবল ভালবাস।”
উদ্ধব এসেছেন শ্রীবৃন্দাবনে। ব্রজগোপীরা সব ছুটে এসেছেন ব্যাকুল হয়ে— দেখা করবেন। খবর নেবেন সখা কৃষ্ণের। সকলেই জিজ্ঞেস করছেন : ‘শ্রীকৃষ্ণ কেমন আছেন?” “তিনি কি আমাদের ভুলে গেছেন? তিনি কি আমাদের নাম করেন?”
তাঁরা প্রশ্ন করছেন, আর তাঁদের দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে। তাঁরা উদ্ধবকে বৃন্দাবনের নানা স্থান দেখাচ্ছেন। “এইখানে শ্রীকৃষ্ণ গোবর্ধন ধারণ করেছিলেন, এখানে ধেনুকাসুর বধ, এখানে শকটাসুর বধ। এই মাঠে গরু চরাতেন, এই যমুনাপুলিনে তিনি বিহার করতেন, এখানে রাখালদের সঙ্গে খেলা করতেন, এই কুঞ্জে গোপীদের সঙ্গে লীলা।” দেখাচ্ছেন, বলছেন আর কাঁদছেন।
উদ্ধব বলছেন : “আপনারা কৃষ্ণের জন্য অত কাতর হচ্ছেন কেন? তিনি সর্বভূতে আছেন। তিনি সাক্ষাৎ ভগবান। তিনি ছাড়া কিছুই নেই।”
গোপীরা তখন বলছেন : “আমরা ওসব বুঝি না। আমাদের লেখাপড়া নেই। আকাট মূর্খ। কেবল আমাদের বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে জানি, যিনি এখানে নানা খেলা করে গেছেন।” উদ্ধব বলছেন : “তিনি সাক্ষাৎ ভগবান, তাঁকে চিন্তা করলে এ-সংসারে আর আসতে হয় না। জীব মুক্ত হয়ে যায়।”
গোপীরা তখন সারকথা বলছেন : “উদ্ধব! মুক্তিটুক্তি আমরা বুঝি না। আমরা মুক্তি চাই না। আমরা শুধু আমাদের প্রাণের কৃষ্ণকে দেখতে চাই।”
ঠাকুর গান গেয়ে বলছেন : “আমি মুক্তি দিতে কাতর নই। শুদ্ধাভক্তি দিতে কাতর হই গো।।”
এমন ভক্তি আসবে কোথা থেকে? এস, বললেই তো আসবে না। তাঁর লীলাচিন্তা করতে হবে। লীলা দেখছি, তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। এই সেই মাঠ, এই সেই কুঞ্জ, যমুনাপুলিন, তিনি কোথায়! এই সেই পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, তারা, ঘটি, বাটি, কম্বল। একা ঘুরছি, তিনি কোথায়! লীলা দেখতে দেখতে একটা অভাববোধ।
ঠাকুর বলছেন, তোমার ফিলজফিতে কেবল হিসাব-কিতাব করে। কেবল বিচার করে। ওতে তাঁকে পাওয়া যায় না। তাহলে কেমন করে তাঁকে পাওয়া যাবে? যদি সত্যিই তাঁকে পেতে চাই? সেই পিতাকে, প্রিয়কে, সখাকে। ঠাকুর বলছেন : “শোন! ভক্তিই সার। ঈশ্বরকে বিচার করে কে জানতে পারবে। আমার দরকার ভক্তি; তাঁর অনন্ত ঐশ্বর্য অত জানবার আমার কি দরকার? এক বোতল মদে যদি মাতাল হই শুঁড়ির দোকানে কত মণ মদ আছে, সে-খবরে আমার কি দরকার? এক ঘটি জলে আমার তৃষ্ণার শান্তি হতে পারে; পৃথিবীতে কত জল আছে, সে খবরে আমার প্রয়োজন নাই।”
তিনি আছেন—অনল, অনিলে, ভূধর, সলিলে গহনে। কিন্তু আমার পাশে নেই, প্রাণে নেই। আমার প্রাণের প্রাণে নেই। এই হলো আমার বিরহ। প্রেম, বিচ্ছেদ, বিরহ, মিলন। এই হলো পথ। অর্থাৎ চিন্তা। অর্থাৎ ভাবে থাকা। ঠাকুর গাইছেন—
“যে ভাব লাগি পরম যোগী,
যোগ করে যুগ-যুগান্তরে।
হলে ভাবের উদয় লয় সে যেমন
লোহাকে চুম্বকে ধরে।।”
“তাঁর অভাববোধে চোখে জল আসবে। চৈতন্যদেবের কৃষ্ণনামে অশ্রু পড়ত।”
ঠাকুর শুধু ভক্তি বলছেন না। বলছেন নিষ্ঠা। “গোপীদের কি নিষ্ঠা! মথুরায় দ্বারীকে অনেক কাকুতি-মিনতি করে সভায় ঢুকল। দ্বারী কৃষ্ণের কাছে তাদের লয়ে গেল। কিন্তু পাগড়ি-বাঁধা শ্রীকৃষ্ণকে দেখে তারা হেঁটমুখ হয়ে রইল। পরস্পর বলতে লাগল, এ পাগড়ি-বাঁধা আবার কে! এর সঙ্গে আলাপ করলে আমরা কি শেষে দ্বিচারিণী হব! আমাদের পীতধড়া, মোহনচূড়া-পরা সেই প্রাণবল্লভ কোথায়! দেখেছ, এদের কি নিষ্ঠা!” ঠাকুর বলছেন, গৃহের বধূটি সকলকেই ভালবাসে, তবে নিজের স্বামীকে সবচেয়ে বেশি। একটু অন্যভাবে। ভক্ত, কবি, গায়ক প্রয়াত মাতুল জহর মুখোপাধ্যায়ের গান স্মরণ আসছে—
“দারা-পুত্র-পরিজন, সকলেরে বাসি ভাল।
তারও চেয়ে বাসি ভাল শ্যামা তোরে সর্বনাশী।।”
মামা গাইতেন আর দুচোখ ভেসে যেত জলে। ঠাকুর বলছেন, এই অশ্রুধারাতেই তিনি আসেন। আর বলতে হয়, দেওয়ার মতো নেই কিছু মোর, আছে শুধু নয়নের জল। দুর্যোধন অনেক রাজ-ঐশ্বর্য দেখালেন। শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু দীন পাণ্ডবপক্ষকেই বেছে নিলেন। তাই তো তিনি দীনবন্ধু!