ভাবমূর্তি
১
রাত্তির অনেক হয়েছে। আশপাশের বাড়িতে অন্ধকার। কোনও কোনও বাড়ির কোনও কোনও ঘরে রাত-আলো জ্বলছে। অনেক নীচে পিঁপড়ের সারির মতো. গাড়ির স্রোত আর দেখা যায় না। গাছেরাও কি এখন ঘুমোয়? না কি ওরা সব সময়েই জেগে, আবার সদাই ঘুমিয়ে! তবে গাছের ওপরে যারা বাসা বেঁধে থাকে সেই পাখিরা এখন ঘুমে। তাদের ছোট্ট জীবনের প্রতি-দিনকার নিশ্চিন্ত, নিচ্ছিদ্র ঘুম। বৈভবই এসে বসল প্রথম। তার চুল একটু এলোমেলো, পরনের পাজামা পাঞ্জাবি একটু লাট-খাওয়া, দেখলেই বোঝা যায় সে শুয়েছিল। ঘুমোতে পারেনি, উঠে এসেছে। বৈভব একটা সিগারেট ধরাল অন্যমনস্কভাবে, তারপরে শিউরে উঠে সিগারেটটা ছাইদানে ঘষে ঘষে নিভিয়ে দিল। সিগারেটের গন্ধ রাতের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ঘরে ঢুকবে, জাগিয়ে দেবে সবাইকে, যেটা বৈভব চায় না।
বৈভব বছর ত্রিশের এক সুদর্শন, সুকাঠামো যুবক। রঙ বাঙালির মতো, শ্যামলা। তার মুখে গভীর দুশ্চিন্তা, কপালে ভাঁজ পড়েছে ঠিক সেই জায়গায় যেখানে তার সামনের মাল্যভূষিত ফোটোগ্রাফটির কপালে পড়েছে। তফাত এই, ওই ছবির পুরুষের কপালের ভাঁজ গভীর, তাকে কিছুতেই ওঠানো যাবে না, বৈভবের কপালেরটা কিছুক্ষণ পরেই হয়তো মিলিয়ে যাবে? না কি যাবে না? এখন থেকেই আস্তে আস্তে গভীর হতে থাকবে, সবার অলক্ষ্যে? বৈভবেরও অলক্ষ্যে? বৈভব শিউরে উঠল। নিজেকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে হাঁটু বদলিয়ে বসল।
বাঁ দিকে দেয়াল জোড়া বুকশেলফ। বই, বই, বই। ইংরেজি, বাংলা, ফরাসি, জার্মান, উর্দু, হিন্দির অভিধান। সামনে নিচু বুকশেলফ। বড় বড় আর্ট অ্যালবাম, মোটা মোটা বিদেশি পত্রিকা, তলায় ঠাসা দেশি পত্রিকার গোছা। ডানদিকে আবারও শেলফ, সরু, নিচু। ক্যাসেট, ক্যাসেট, ক্যাসেট, কাচ-বন্দি। ওপরের চওড়া তাকে বাবার নিজস্ব টেপ রেকর্ডার, মিউজিক সিসটেম, টাইপ-রাইটার, বাংলা ইংরেজি, ইদানীং বাবা পি. সি. ব্যবহার করার কথা ভাবছিলেন। বাবা, বৈভবের বাবা। ফোটোতে। সবে উত্তর-ষাট। অতি সুদর্শন। ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক নাসা, গভীর, সুদূর বিপুল সুদূর চোখ। ইষৎ ভারী ভুরু। কঠিন চিবুক। এবং নমনীয়, অত্যন্ত কমনীয় ওষ্ঠাধররেখা। সুদর্শন বললে কম বলা হয়। মাথার সুবিন্যস্ত কাঁচা-পাকা কেশ সমেত অতি অসামান্য। একটি অসাধারণ মানুষের ছবি। অসাধারণ? তাই। অসাধারণ বলেই তো বৈভব জানত। জানে। জানে? সত্যি?
তিনদিকের নানান মাপের শেলফগুলোর মাঝে মাঝে কৌচ। পুরোপুরি ডুবে বসে থাকা যায় এমনি। আবার পিঠখাড়া করে মাথার দিকটা হেলানো যাবে আস্তে আস্তে এমন। রিভলভিং। যখন যেটা দরকার। যেমন ভাবে দরকার। সেইখানে। তেমনি। আর এদিকে? দরজার দিকে? সারি সারি সোফা কৌচ, গদিঅলা, হাতলঅলা চেয়ার। সামনে ছোট ছোট শক্তপোক্ত টেবিল। লেখা যায়, এমন। পলকা না। পাশের দিকে অ্যারিকা পাম, ওদিকে বামন শিরীষ। এদিকটায় ছোটখাটো প্রেস কনফারেন্স পর্যন্ত বসেছে। আড্ডা, সাক্ষাৎকার এসবের তো কথাই নেই। বাঁ দিকে কোণ ঘেঁষে একটা সরু লম্বা দরজা আছে, রান্নাঘর, খাওয়ার ঘর, ইত্যাদির দিকে যাওয়ার দরজা, ওইখান দিয়ে তিনতাকওয়ালা ট্রলি ঢুকে আসত। তাতে সুদৃশ্য অভঙ্গুর সব কাপে চা। প্লেট ভর্তি করে বিস্কিট, বিস্কিট, বিস্কিট, যা দোকানে পাওয়া যায় না। এই চা খেতে বা এই বিস্কিট খেতে কারও কখনও আপত্তি হত না। হওয়ার কথা নয়।
বৈভব নিজেকে টাইপ-রাইটারের সামনে দেখতে পেল। কত ছোট থেকে ওইখানে বসে সে প্রেস কপিগুলো তৈরি করেছে। তখনও জেরক্স-এর অত চল হয়নি। ইদানীং, বাবা বললেও সে আমল দিত না। তৈরি হচ্ছে লেখাগুলো, শব্দ বদলাচ্ছে, যতিচিহ্ন পাল্টে যাচ্ছে। বাক্যবন্ধ, শব্দবন্ধ এক ছিল, হয়ে উঠছে আর, কিম্বা হচ্ছে না। সেই আদি জন্মমুহূর্তে যা ছিল, অন্তিম পর্বেও তাই-ই থাকছে, সমস্তটাই একটা বিস্ময়। বৈভব পাণ্ডুলিপি হাতে উঠে যাচ্ছে। ‘বাবা, এখানে প্যারা বদল হবে বোধহয়।’ বাবা কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে গান শুনছেন, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে এখন। ওয়াকম্যান খুলে ফেললেন। পাণ্ডুলিপির ওপর আঙুল বৈভবের। মুহুর্তে বুঝে নিয়েছেন ব্যাপারটা। অপরাহ্ন গমগম করে উঠছে—‘সমারসেট মম নামে ভদ্রলোক, ওই যিনি “পেইন্টেড ভেইল” উপন্যাসটি লিখে আমার কাছে প্রিয় হয়ে আছেন, তিনি এক সেক্রেটারি রেখেছিলেন। মেয়েটি বেশ ভাল লেখাপড়া জানা। সে তাঁর পাণ্ডুলিপি আগাগোড়া ঠিকঠাক করে নিয়ে এল। সিনট্যাক্স বদলেছে, পাঙ্কচুয়েশন বদলেছে, প্যারাগ্রাফিং বদলেছে…বৈভব, তুই তো জানিস ক্রিয়েটিভ রচনা কলেজ এসে নয়।’ বৈভব চলে আসছে। —‘ওকি, চলে যাচ্ছো? জানবে না, কেন? বুঝবে না?’ বৈভব বাবার বাধ্য ছেলে, বাধ্যতর সেক্রেটারি, দাঁড়িয়ে পড়েছে। —‘আসলে বিষয়বস্তুর অ্যাঙ্গল যে বদলে যাচ্ছে সেটা প্যারা বদলে আমি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে চাইছি না, বোঝ বিভু, কোনও প্রস্তুতি দেবে না পাঠককে, সে সোজাসুজি ওই বদলের ভেতরে ঢুকে পড়বে, কিছুটা পড়ে যাবে, তারপরে চমকে আবার হটে আসবে, এই দ্বিতীয়বার পড়ার পর তার বোঝাটা সম্পূর্ণ হবে।’ বৈভবের চোখে বিস্ময়, শ্রদ্ধা, স্বপ্ন, —“বাবা তুমি এই সমস্ত এফেক্টটা ভেবে লেখো? আশ্চর্য!’ —‘না, না বিভু, আমি ওভাবে লিখি না। শিল্পকলা আর কারুকলাতে পার্থক্য আছে। এটা পরে ভেবেছি। লেখবার সময়ে আপনাআপনি এসে গেছে।’
‘বাবা, তুমি কী ভাবে লেখো, লিখতে, বলবে? আজ সত্যি সত্যি বলবে? মনে মনে এভাবে বলতে বলতে বৈভব উঠে দাঁড়াল, অনিশ্চিত পায়ে সামনের দিকে হেঁটে গেল যেন তাকে ভূতে পেয়েছে। মাঝখানের দূরত্বটা পার হতে তার সময় লাগছে। তার চোখ সামনের ফোটোগ্রাফটির ওপর নিবদ্ধ। সে সেই দিকে চেয়ে চলেছে, কোনখান দিয়ে হাঁটছে, কার্পেট আছে কি না, টেবিল মাঝে পড়ছে কি না এ সব আন্দাজে বুঝে নিয়ে, যেন এক ভূতগ্রস্ত সাইকেল-চালক। বাবার চোখ, সুদূর বিপুল সুদূর, বাবার নাসা তীক্ষ, ওষ্ঠাধরে ঢেউ খেলে গেছে, চাঁচা ছোলা গাল, মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল, কমে যাওয়ার লক্ষণ নেই। বাবার চিবুকের ওপর কঠিন আঙুল রাখল বৈভব, বাবার চোখের দিকে সে সোজা চেয়ে রয়েছে, সে আজ কিছুতেই নত হবে না, দৃষ্টি নত করবে না, আমার মাথা নত করে দাও হে আজ নয়—‘বাবা, তুমি কীভাবে লিখতে?’
—‘তুমি নিজে তার সাক্ষী বৈভব। নিজে তুমি আমার পাণ্ডুলিপির ছড়ানো পাতা গুছোতে, টাইপ করতে, বদলগুলো কী ভাবে হত নিজের চোখে দেখেছ, দেখেছ আমার মত বদল, মুড বদল…’
—‘দেখেছি। সে কথা বলছি না।’
—‘কি তাহলে?’
—‘বি…বি…বিষয়! সবই কি তোমার অপ্রত্যক্ষ জ্ঞানভাণ্ডার, মরমী হৃদয়, দরদী মস্তিষ্ক দিয়ে লেখা? বাবা?’
ছবি চুপ করে রইল। ছবি কখনও কথা বলে না। ছবি যে কথা বলে, তা জানাশোনা মানুষদের হৃদয়ে, মস্তিষ্কে, স্মৃতিতে তার যে সত্তা ধরা আছে সেই সত্তার কথা। অন্য কিছু নয়। অন্য কিছু নয়। কিচ্ছু নয়।
বৈভব চাপা অথচ জোরালো গলায় ডাকল—‘বাবা! বাবা!’ তার দ্বিতীয় বাবা’টা যেন গর্জনের মতো শোনাল। —‘বলো বাবা! বলো! আমি আমার সমস্ত কৈশোর, যৌবনের অর্ধেক তোমার পেছনে দিয়ে দিয়েছি, আমার কিছু নেই, কেউ নেই শুধু তুমি ছিলে, বাবা তুমি বলো, তোমাকে বলতেই হবে—এ।’
তার উদ্যত ঘুঁষিটা কেউ পেছন থেকে ধরে ফেলল। ভীষণ চমকে বৈভব পেছন ফিরল। ঐশী। ঐশী এমনিতেই খুব লম্বা, রোগা, বৈভবের মাথায় মাথায়, বৈভব পেয়েছে বাবার ঠোঁট, কপাল, রঙ, ঐশী পেয়েছে বাবার দৈর্ঘ্য, কাঠামো, নাক, লম্বাটে সাজানো দাঁতের সারি।
—‘কী করছিস?’ ঐশী ফিসফিস করে বলল।
—‘কিছু না’, বৈভব নিশ্বাস ফেলে পায়ে পায়ে নিজের জায়গায় এসে বসল। ঐশী তার থেকে আট বছরের ছোট। তার চোখ মায়ের চোখ। সে তার একমাত্র ছোট বোন। ছোট্ট। কোলে করে ঘুরেছে কত। দেখিয়েছে বন্ধুদের গর্ব করে—‘এই দ্যাখ, অরিন্দম, মথুরেশ, উদ্দালক—এই দ্যাখ আমার বোন।’ সে কী করে ঐশীকে বলবে, ঐশীকে বোঝাবে! কী করে তার সামনে রাগ করবে, প্রশ্ন করবে, ভয়ানক ক্রোধে কাঁদবে? কেমন করে?
ঐশী তেমনি ফিসফিসিয়েই বলল—‘দাদা বোস।’ আর একটু পরে, দুজনে পাশাপাশি কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবার পর বলল—‘তুই হাত জোড় করছিলি না ঘুঁ মানে ঘুষি তুলেছিলি বুঝতে পারছিলুম না।’
বৈভব উত্তর দিল না। সে ঘামছিল। ঐশী চলে গেলে সে বাঁচে। একটু পর নিরুত্তর নীরবতা যখন বড্ড অসহ্য হয়ে উঠছে মনে হল সে বলল, —“তুই উঠে এলি যে! রাত কত জানিস!’
ঐশী চুপিচুপি বলল—‘মা যে কদিন কাগজ দেখা বন্ধ করেছে এটা একটা আর্শীবাদ, বল! নইলে কী যে করতুম!’
বৈভব চমকে মুখ তুলে তাকাল। তাহলে ও জানে। দুজনের মাঝখান থেকে জানা অজানার আড়ালটা চট করে খসে পড়ল। সে বলল—‘আমি তো কাগজগুলো সকালে নিয়েই লোপাট করে দিয়েছি, তুই…?’
নিচু গলায় ঐশী বলল—‘ব্রিটিশ কাউন্সিল যাওয়ার পথে জোর খবর জোর খবর করে হাঁকছিল, তখনই কিনে…’
বৈভব আবার একটা নিশ্বাস ফেলল। সে আলো জ্বালেনি। রাস্তার একটা আলো এমন জায়গায় আছে যে এ ঘরে আলো যেন টেলি-ফোটো-লেনসের ভেতর দিয়ে নরম হয়ে ঢোকে। সেই আলোয় আসবাব পত্র, ঐশী, ওদিকে ফোটোটা স-বই খুব নরম, রহস্যময় এমন কী অলৌকিক লাগছে। সে বলল—‘শুতে যা বুবু।’
—‘তুইও তাহলে যা।’
—‘আমার এমন রাতজাগা বহু অভ্যেস আছে।’
—‘জানি। সে জাগা আর এ জাগা এক নয় দাদা। ’
—‘শুলে তো আমি ঘুমোতে পারব না!’
—‘আমি যে পারব। তাই-ই বা ভাবছিস কেন?’
এরপর অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না! চমকালো আলোজ্বালার শব্দে। খুট করে কেউ দাঁড় বাতিটার আলো জ্বেলে দিয়েছে। মৈনাক। রিভলভিং চেয়ারের পাশে আলোটা, বাঁদিকে। সে চেয়ারে এসে নিঃশব্দে বসেছে। তারপর চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিয়ে, বইয়ের সারির পেছন থেকে অব্যর্থ শক্তিশেলের মতো কাগজটা বার করেছে, বাবা ঠিক যেভাবে বসত, সেভাবে বসেছে। ওদের দিকে প্রায় পেছন করে, বাতি জ্বালিয়ে পড়ছে কাগজটা, খুঁটিয়ে, ঠিক বাবার ভঙ্গিতে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে তলায় আঙুল বুলিয়ে পড়া শেষ করে মৈনাক হঠাৎ দু হাতে মুখ ঢেকে গুঙিয়ে উঠল। ভাষাহীন তীব্র গোঙানি। যেন তার বুকের ভেতরটা অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় মুচড়িয়ে যাচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হতে পারে বাবা, বৈভব-মৈনাক-ঐশীর বাবা অংশুমান সেনগুপ্তই ছবি থেকে নেমে এসে কাঁদছেন, গোঙাচ্ছেন। কারণ তিন ভাই বোনের মধ্যে মৈনাকই বাবার আকৃতি পেয়েছে সবচেয়ে বেশি। ওইরকম দীর্ঘ, কঠিন কাঠামো, লম্বাটে ভরাট মুখ, অবয়বগুলো বাবার, যেন কেউ কৈশোরের বাবার ছবিটাকে হাতে নিয়ে ওকে গড়েছে মিলিয়ে মিলিয়ে। খালি রঙটা ওর মায়ের মতন সুগৌর। সর্বকনিষ্ঠ ভাইয়ের এই অব্যক্ত গোঙানি কিছুক্ষণ ঘাড় হেঁট করে শুনল বৈভব। তারপর অসহায় চোখে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল ঐশীর দুগাল ভেসে যাচ্ছে জলে। সে ঠোঁট কামড়ে প্রাণপণে উদগত কান্না চাপবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সফল হচ্ছে না। বৈভব কাঁদতে পারছে না। ছেলেরা পারে না। বৈভবের মতো সদ্য ত্রিশ যুবাও না মৈনাকের মতো তরুণও না এমন কি।
কিছুক্ষণ পর বৈভব দেখল ঐশী উঠে যাচ্ছে, সে মৈনাকের মাথাটা নিজের বুকের ওপর চেপে ধরেছে। —‘টুবু, টুবু, চুপ কর, চুপ কর প্লীজ, মা যদি শুনতে পায়!’
মন্ত্রের মতো থেমে গেল মৈনাকের গোঙানি। সে ভাঙা গলায় বলল—‘তুই কখন এলি, দিদি?’
—‘অনেকক্ষণ, দাদাও রয়েছে।’
—‘দাদা!’
ঐশী মৈনাককে ছেড়ে দিয়েছে। বোবা যন্ত্রণা, ভয়, লজ্জা, ক্ষোভ, দু চোখে নিয়ে মৈনাক জ্যোৎস্নার মতো সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে বৈভবের দিকে তাকাল। বৈভব স্থাণু হয়ে বসে আছে। সে দেখল যেন অন্ধকার পার হয়ে তার দিকে বিদ্ধ হয়েছে বাবার দৃষ্টি। বাবাই যেন তার দুই অতল চোখে গভীর কাতরতা নিয়ে তার মুখোমুখি হয়েছে এই মাঝরাতে। সদ্য তরুণ বাবা। তার পূর্ণ তারুণ্যের মোহময় সৌন্দর্য সমেত, হয়তো যে বাবাকে যে সময়ে তার মা প্রথম দেখেছিল, দেখেছিল অনেক আগেই। কিন্তু সেই প্রথম দেখেছিল কোন সর্বনেশে মাসের গোধূলিবেলার রাঙা আলোয়। যে দেখা থেকে আস্তে আস্তে তারা—বৈভব, ঐশী, মৈনাক।
সে আবারও ঘাড় হেঁট করে ফেলল। ওই দৃষ্টি, ওই আকৃতি সে সইতে পারছে না। সইতে পারছে না। সইতে পারছে না।
—‘তুমি কখন এলে?’
—‘অনেকক্ষণ।’
—‘আমি তো টের পাইনি।’
—‘তুমি এলে কিন্তু আমি ঠি-ক টের পাই।’
—‘কী ভাবে? সেন্টিমেন্টাল না হয়ে ভেবে চিন্তে বলো তো!’
—‘সেন্টিমেন্টাল না হয়ে? আচ্ছা, তবে ভাবতে দাও। ভাবতে দাও অহনা। তুমি কোনও বিশেষ পার্ফ্যুম ব্যবহার করো?’
হাসতে হাসতে—‘বিশেষ ছেড়ে কোনও পার্ফ্যুমই ব্যবহার করি না।’
—‘তবে তেল। মাথার তেল।’
—‘আমি তেল মাখিই না। মাখি সপ্তাহে একদিন, রাতে। পরের দিনই ধুয়ে ফেলি।’
—‘তবে? তুমি চুড়ি পরো না যে রিনঠিন শুনব…তাহলে ডোন্ট মাইন্ড অহনা—এ নিশ্চয় নারীত্বের গন্ধ নারীর গন্ধ, মানে কোনও, ডোন্ট মাইন্ড, যৌন গন্ধ।’
—‘ছিঃ, ছিঃ, অংশু আমি আপাদমস্তক পরিষ্কার থাকি, দিনে তিনবার চান করি, দুরন্ত গরমেও আমার চট করে ঘাম হয় না, তা জানো? ছিঃ!’
—‘তুমি আমাকে সেন্টিমেন্টাল হতে বারণ করেছিলে, মনে করো, ছি ছি করবার আগে মনে করো অহনা!’
—‘সেই জন্যেই যৌন গন্ধ খুঁজতে হবে? ব্যক্তিত্বের গন্ধও তো বলতে পারতে! নারীত্বের গন্ধটুকুতে থেমে গেলেও আমার…আমার ভাল লাগত।’
—‘কোনও মেয়ে শুধু ব্যক্তির বদলে বেশিটা নারী হতে ভালবাসে অহনা, তাই না?’
—‘ওঃ টুলু। থামাও তো তোমার যত বদ শব্দ, বদ গন্ধ, বদ প্রসঙ্গ, পত্রিকার কতদূর?’
অহনা পাশ ফিরে শুলেন। তাঁর চুল সম্পূর্ণ সাদা। বালিশের একদিকে গোছা করা সেই গোল করে কাটা চুল এলিয়ে রয়েছে। তাঁর চোখ বোজা। পাতা দুটি কাঁপছে। মুখে হাসি। খুব মৃদু, সুখের, সামান্য লজ্জার, কেমন গভীর গোপন হাসি এ। কারও সামনে এ হাসি হাসা যায় না, শুধুমাত্র একজন, একজনই এ হাসি দেখতে পারে, গভীর গোপন চোখে, ঘন হয়ে, বিভোর হয়ে, রাত যদি মাঝরাত হয় তবে উত্তাল হয়ে, উদ্দাম হয়ে। এখন কি সে দেখছে? তেমনি করে দেখছে? তাই অহনার হাসি ক্ৰমে গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। লজ্জা! ছি ছি লজ্জা! সে দেখছে কি না কে জানে। কিন্তু তিনজন দেখছে বুবু, টুবু আর বিভু। অহনার তিন ছেলে মেয়ে। বাবাকে, বাবার ছবিকে, বাবার স্মৃতিকে অসহ মনে হওয়ায় ওরা মার কাছে এসেছে। মাকে দেখছে। হালকা রাত-আলোর মায়া অন্ধকারে মাকে দেখছে। তাদের ষাটোত্তর মা। মাথায় শ্বেতশুভ্র কেশভার গায়ের রঙের সঙ্গে যেন খাপ খেয়ে গেছে। ছোটখাটো মানুষটি মা। নীল পাড় সাদা শাড়ি। মুখটা ঈষৎ চৌকো ভাবের, ব্যক্তিত্বব্যঞ্জক। ঘুমের ঘোরে মা যখন হাসছিল তখন ঠোটের দু পাশ থেকে, চোখের দু পাশ থেকে সরু সরু মাকড়সার জালির মতো ছড়িয়ে পড়ছিল বয়স, বয়স, শোকে যে বয়সের আরও বাড় বেড়েছে। ঠোঁট দুটি যেন শুকনো পাতার মতো। নাকের পাটা ঘুমের ঘোরে ফুলছে। খালি হাত, খালি গলা, খালি কান। আহা মা! মা! আহা মাগো!
বুবু-টুবু-বিভু জানে, বিশেষ করে বিভু জানে তার মার বৈধব্যের পর আভরণহীন হতে বিশেষ অসুবিধে হয়নি। মা চিরদিনই নিরাভরণ ছিল। দুই পরিবারের প্রবল আপত্তিতে মা বাবার বিয়ে হয়েছিল, মার কিছু ছিল না, কিন্তু মায়ের দিদিমা এক পাঁজা সেকেলে সোনার গহনা নাতনিকে অনেক আগেই দিয়ে গিয়েছিলেন। বাবাকে প্রতিষ্ঠিত করতে, সংসারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সেগুলি একে একে গেছে। অলংকারহীনতাই মায়ের অহংকার, আভরণহীনতাই মায়ের সবচেয়ে বড় আভরণ। ডানহাতে একগাছি সোনার চুড়ি কখনও সখনও, গলায় সরু হার ইচ্ছে হলে, কানে খুব ছোট্ট মুক্তো ছাড়া কখনও কিছু নয়। বাবার যখন অনেক হয়েছে, চারদিক থেকে অনেক টাকা, অনেক উপহার আসছে, বাবা মাকে গোছা গোছা সোনার চুড়ি করিয়ে দিয়েছিলেন, কানে বহুমূল্য হিরের টপ, গলার রকম রকম হার। মা সেগুলো পরে একদিকে আয়না, একদিকে তিন ছেলে মেয়ে স্বামী…বলছে—‘দ্যাখো আমাকে কী রকম গরুচোরের মতো দেখাচ্ছে। একদম মানাচ্ছে না। ঠিক আছে লকারের চাবিটা একটা সরু সো-রু হারের সঙ্গে গলায় পরব, লোকে জানবে অংশুমান সেনগুপ্তের স্ত্রীর গয়না আছে। কী? কী বলো? তোরা কিছু বল্ল্?’ টুবু তখন অনেক ছোট, বিভু অতো গয়না-ফয়না বোঝে না। বাবা বলেছিল—‘অন্তত হিরে দুটো কানে পরো, অন্তত ও দুটো…।’ বাবার গলায় যেন একটু অভিমান! অভিমান কি? মা বাবাদের কথা-বার্তার সব টান-টোনের মানে বোঝা যায় না, এও হতে পারে বাবা মা-র কথা মেনে নিল, সত্যিই এতদিনের অনভ্যাসের পর গয়না পরে মাকে কেমন-কেমন লাগছিল—এটা বাবা মেনে নিয়েছিল। এখন ঘুমন্ত অনতিবৃদ্ধা মায়ের মুখে কানের সেই মুক্তোদুটোর মতোই কেমন একটা লাবণ্যমাখা হাসি। এই হাসির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না ওরা। টুবুর ইচ্ছে করছে মায়ের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে—নেই-আঁকড়া ছোট ছেলের মতো কাঁদতে হাউ-হাউ করে। বিভুর মনে হচ্ছে সে মাথার চুলগুলো ছেঁড়ে, দু হাতে ছেঁড়ে। ঐশীর মনে হচ্ছে তার কান্না-ভেজা লবণাক্ত ঠোঁট দিয়ে মায়ের হাসি-ভেজা ঠোঁটে, গালে গভীর স্নেহের, প্রেমের, প্রতিশ্রুতির চুমো দিতে। যে স্নেহ, প্রেম, প্রতিশ্রুতির মূল্য সে রাখবে।
কিন্তু কোনওটাই না করে, সব ইচ্ছে গিলে নিয়ে ওরা তিনজনে যেমন পা টিপে টিপে মার ঘরে ঢুকেছিল, তেমনি পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল। ঐশী মার ঘরেই শোয়, পাশেই তার খাট, সে সেখানে ফিরে যেতে পারল না। বিভু-টুবু শোয় একই ঘরে, বাবার ঘরের সংলগ্ন সেটা। ওরা গেল না। রাত শেষ হয়ে আসছে। অন্ধকারের ঘোলাটে রঙ দেখে বোঝা যায়। ওরা চলে গেল বাবার থেকে অনেক দূরে, মায়ের থেকে অনেক দূরে। পুবের বারান্দায়। প্রথম সূর্যের আলো এই বারান্দায় এসে পড়বে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, বিভ্রান্ত, ক্ষুব্ধ, ভীত তিনটি নবীন প্রাণকে যদি ওই সূর্য এমন কোনও আলো দিতে পারে যা তাদের সূর্যপ্রভ বাবা দিলেন না, দিতে পারলেন না ব্যর্থ-তপস্বিনী করুণ মা তাদের, যা কেড়ে নিল, রূঢ় হাতে কেড়ে নিল সংসার, সংবাদ, সাংবাদিক, সাংবাদিকের লোভ, এবং—এবং—পরস্পরের মুখের দিকে ওরা তাকাতে পারছে না, তাই যেখানে সূর্য উঠবে সেই পূর্বাচলবিন্দুতে দৃষ্টি রাখল। মনে মনে বলল—‘আলো দাও।’
২
ভোরবেলাতে, সম্ভবত সূর্য ওঠার লগ্নেই করবী চ্যাটার্জির একবার ঘুম ভাঙে। কারণ তার পুব দক্ষিণের ঘরের ডবল জানলা দিয়ে সূর্য অনাহুত ঢুকে পড়ে, পড়বেই। করবী বিরক্তিকাতর, ব্যথাকাতর শব্দ করতে করতে বিছানায় এ পাশ ও পাশ করতে থাকে, খুব তাড়াতাড়ি সে আওয়াজ পৌঁছে যায় পাশের ঘরে, মিনু এসে পর্দাগুলো টেনেটুনে ঘর আবার অন্ধকার করে দিয়ে যায়। করবী সারারাত ঘুমোতে পারে না, ছটফট করে, ওষুধ খেয়েও কড়িকাঠে ভেড়াগুনেও, এমন কী মনে মনে হরি ওম্, হরি ওম্ বলতে বলতেও করবীর চোখে ঘুম আসে না। কঠোর সাধনার শেষে দেবতার বরের মতো ঘুম আসে শেষ রাতে, শেষ যামে। তখন সে অঘোরে ঘুমোয়, ঘুমের হাতে নিজেকে আপাদমস্তক সমর্পণ করে দেয়। মিনু বারবার এসে দেখে তার রাতজামা মার্বেলে-গড়া পা দুটোর ওপর থেকে অনেকটা উঠে গেছে। হাতদুটো মাথার দিকে এলিয়ে কেমন অসহায়ভাবে, দুই হাতের ঘেরে মুখখানাও ঠিক তেমনি অসহায়। যারা বলে, ওই দু হাতে, ওই মুখে অনেক বিধ্বংসী শক্তি আছে তারা এখন দেখুক এসে। ঘুমের মধ্যে, সারারাত জাগরণের পর এই অতলসমর্পী ঘুমের মধ্যে দিদির আসল চেহারা। মিনু কিছুদিন আগে পর্যন্তও দিদিকে হিংসে করত। হাত পা ওয়্যাক্স করে, চুল শ্যাম্পু করে, দিদির বাতিল কিমোনো পরে লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভেংচি কাটত। যতই কেন সাজগোজ করিস না মিনতি দাস, তোর দিদিমণি না দিদির মতো দেখাতে হলে তোকে কয়েক জন্ম ঘুরে আসতে হবে। ভগবান কেন এমন একচোখো গো? একজনকে দেবে তো দেবে ছপ্পর ফুঁড়ে দেবে, কী রঙ! চামড়ার কী জলুশ! চুলের কী বাহার! চোখ মুখ সে যে কেমন, ব্যাখ্যা করা যায় না প্রচলিত ব্যাকরণ দিয়ে, কিন্তু অসামান্য। এই চোখ-মুখ, এই লাবণি বহিয়া যায় অঙ্গ এর আকর্ষণে কে না আসছে! কী না আসছে! মিনতি দাস করবীদি বা দিদির সঙ্গে প্রায় তার মুখ ফোটার বয়স থেকে আছে। দিদির চাকরি করতে তাকে একটা পাশ দিতে হয়েছে। হাওড়া-আমতাই বাগ্-ভঙ্গি ভুলতে হয়েছে। সাজগোজ করাতে এবং করতে শিখতে হয়েছে। অনেক কেতাও রপ্ত করতে হয়েছে। ফোন তুলে ‘হালো-ও’, দরজা খুলে সরল-সুন্দর চোখে— ‘মেম সাব তো এখন বাড়িই নেই!’ কিম্বা চোখ বাঁকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে—‘আসুন, আসুন। নিশ্চয়ই, বসুন, উনি এখুনি এসে পড়বেন।’ সব শিখেছে জেনেছে মিনু, সে জানে দিদির অনেক গোপন কথা গোপন ব্যথা, সে দেখেছে, দিদিকে জামাইবাবুর হাতে প্রচণ্ড মার খেতে খেতে অবশেষে ফুঁসে উঠতে, দেখেছে পিউকে হোস্টেলে রেখে এসে দিদির প্রচণ্ড কান্না, যেন ভয়ংকরী বন্যায় সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। দেখেছে মাতালগুলোর সঙ্গে দিদির অসহ্য মাতলামি, আবার বিন্দুমাত্র জ্ঞান ফিরে এলে সব কিছু, সব্বাইকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা।
গরম জলের গ্লাসে লেবু আর মধু মিশিয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখল মিনু। মাথার দিকের পর্দাগুলো দু পাশে সরিয়ে দিল। তারপর দুটো তিনটে বালিশের মধ্যে ডুবে থাকা মসৃণ কপালটায় আলতো একটু স্পর্শ দিল।
—‘দিদি! দিদি!’
পলকে একটা বাতাসে-ভাসা লম্বা বেলুনের মতো ও পাশ ফিরে গেল করবী। মাথার কাছে টাইমপীসটায় ন’টা। আর দেরি করলে চলবে না।
—‘দিদি।’ মিনু গলা চড়াল। —‘জলটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
আবার সেই একই ভঙ্গিতে এ পাশ ফিরে করবী চোখ তুলে তাকাল। এখন তার চোখে নেই কোনও আই-শ্যাডো, আই-লাইনার, ম্যাসকারা, কি কোনও নকল পল্লবের প্রসাধন। কিন্তু ঘণ্টা পাঁচেক ঘুমের পর সেই চোখ এখন তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যে সতেজ। সে উঠে বসে নানা রকম ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙল। তারপর হাত বাড়িয়ে মিনুর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে অল্পঅল্প চুমুক দিতে থাকল।
মিনু এখন বেরিয়ে গেছে। করবী তার স্নানঘরে ঢুকবে, সুগন্ধি ঠাণ্ডা গরম জলের চৌবাচ্চায় শুয়ে হাতে শাওয়ারের নমনীয় নলটা নিয়ে। ওপর থেকেও ঢালবে জল কানের পেছনে, গলার ভাঁজে, বুকের ভাঁজে। অনেকক্ষণ ধরে স্নান। বাথটবের পাশের ছোট্ট আসনটিতে বসে সে শুকনো শরীরে বডি লোশন স্প্রে করবে, তারপর লম্বা লম্বা আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে মাসাজ করবে, তিনদিকের আয়নায় তার শরীর প্রতিফলিত হবে। কোথাও বাদ পড়ছে কি না, কোনও অঙ্গে শৈথিল্য এল কি না, এ সব দেখা হবে নানা কোণ থেকে, তারপর সম্পূর্ণ নগ্ন একটি ভেনাসের মতো সে স্নানঘরের সংলগ্ন সাজঘরে যাবে, পোশাক পরবে, বাড়ির জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি আলগা পোশাক। খাবার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে যেতে যেতে করবী অদূরে গাছেদের নড়াচড়া দেখতে পেল। সূর্য এখন অনেকটা ওপরে উঠে গেছে। ব্যালকনির পেছনদিকের দেয়ালে কোণঠাসা হয়ে পড়ে রয়েছে। গাছগুলোর মাথায় মাথায় রোদ্দুর খুব নরম। সেই স্নাত সবুজের দিকে পরম আরামে চেয়ে বুঁদ হয়ে বসে আছে করবী। এই ভাল। কেউ নেই। সেবক সেবিকা ছাড়া নিভৃত অবসরে ভাগ বসাবার কেউ নেই। স্বামী না, সন্তান না, মা-বাবা-ভাই-বোন, কোনও প্রিয়জন না। আজকাল পিউ এলেও যেন সে ঠিক সহজ হতে পারে না। পিউ কত বড় হয়ে গেছে। পিউ আর তার মাঝখানে ঠাসবুনোট হয়ে থাকে পিউয়ের নতুন জগৎ যা তার মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে নাড়ি-ছেঁড়া কষ্টের পর আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে উঠেছে। থাকে করবীর নিজের একাচোরা অভ্যাসের জগৎ, যাতে সে বহুদিন ধরে এমনভাবে অভ্যস্ত হয়েছে যে এখন নিজের গায়ের চামড়ার মতো তাকে আর ত্যাগ করতে পারে না। কেউ নেই। মারতেও নেই, বকতেও নেই, আদর করতে, ভালবাসতেও নেই। কেউ নেই তবে অনেক কিছু আছে। আসবাব, পোশাক, অলংকার, চিত্র, মূর্তি, গাছ, ফোটো। জিনিস অনেক আছে। এই ভাল।
হাতে দুধের গ্লাস, প্লেটে ফল, করবী সকালটাতে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে চমকে উঠল, ভীষণ জোরে বারকয়েক তার দরজার পাখি ডেকে উঠেছে। একবার চমকে উঠেই সে আবার নিস্তরঙ্গ, স্থির হয়ে যায়, মিনুকে বলা আছে— সকালবেলায় সে কারও সঙ্গে দেখা করে না। ওই অসহিষ্ণু, অভব্য বেল কোনও অন্য প্রয়োজনের মানুষের হাতে বাজছে। তবে ওভাবে বাজার কথা নয়। প্রয়োজনের মানুষেরা সব জানে। সকালে তারা আসে না। করবী তার নরম ইচ্ছা-হেলন চেয়ারে আরও একটু হেলে যায়। রোদটা কপালের ডান দিকে এসে পড়ছে। সে টেবিলের ওপর রাখা সান-গ্লাসটা তুলে নিল। বাইরের চিত্র রোদ-ঝলমলে হয়ে উঠেছে, বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখে অন্ধকার দেখতে হবে, চোখ ক্লান্ত হবে।
—‘দিদি!’
মিনু ডাকছে। সামনে গাছের মাথার ওপর চোখ রেখেই করবী জিজ্ঞেস করল- ‘কী ব্যাপার?’
—‘একটি খবরের কাগজের লোক এসেছে। কিছুতেই যেতে চাইছে না। বলছে ভীষণ দরকার।’
—‘এখন আমি কারও সঙ্গে দেখা করি না, বলেছিলি?’
—‘সবই বলেছি। বলছে— ভীষণ জরুরি ব্যাপার। বলছে তোমার মান-সম্মানের প্রশ্ন।’
চেয়ারটা ঘুরিয়ে মিনুর মুখোমুখি হল করবী। নিজের লম্বা নখগুলোর দিকে তাকাল। কোলের ওপর তাকাল। —‘মান সম্মান? আমার? আছে নাকি?’ যেন মিনুকে নয়, অন্য কাউকেও নয়। নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল করবী। শুধু চোখ-ঝলসে দেওয়া রূপের জোরে যখন জবরদখল কলোনি থেকে চাটুজ্জে বাড়িতে স্থান পেয়েছিল? তখন মান-সম্মান ছিল? যাদবপুরে তাদের জবরদখল কলোনির পাশেই এক জ্যান্ত ঠাকুরের আশ্রম। সেখানে ভজন, কীর্তন, আরাধনা, উপাসনা। সব-হারানো-খোয়ানো মা-বাবা-ভাই আর তাকে নিয়ে প্রায়ই যোগ দিতেন সেই সব আসরে। চক্ষে দরবিগলিত ধারা। বাবা যেন গরুড়াবতার। হাত জোড় করেই আছেন। একদিন কীর্তনের শেষে ঝমঝমে গহনা পরা ফর্সা মহিলা দু চোখে বিপুল বিস্ময় নিয়ে কাছে এসে বললেন ‘কে? এ কে ঠাকুর? এ কে?’
ঠাকুর পরিচয় দিলেন। কীভাবে একান্ন সালে মৈমনসিং থেকে এক জামা-কাপড়ে পালিয়ে এসেছিলেন মা-বাবা। কীভাবে এখানে তার জন্ম, দাদাকে কিছুতেই মানুষ করা যাচ্ছে না। সেসব কথা অর্ধেক শুনলেন। অর্ধেক শুনলেন না মহিলা। শুধু বললেন মুখুজ্জে? মুখুজ্জে? বাঃ, —করবীর মায়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আমার ছেলে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেত গেছে। মাঝে এই ফাগুনেই ডাকিয়ে আনাব। তারপর আপনার মেয়েকে আমার ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে যাব।’
—‘সে কী? আমার তো কিছুই?…’
ভদ্রমহিলা একেবারে মাছি তাড়ানোর মতো করে ও সব কথা উড়িয়ে দিলেন। ষোলো বছরের করবীর বিয়ে হয়ে গেল, সেই তামাটে সাহেবটার সঙ্গে। বিয়ের আগে বাড়ি পাকা করতে টাকা পেল বাবা। তুলে দিয়ে গেল চাটুজ্জেদের লোক। দাদার কোর্টে পেশকারের কাজ হল। বউ নিয়ে যেতে স্বয়ং চাটুজ্জে গিন্নি এলেন। হাতের দু গাছি দু গাছি সোনার চুড়ি মট মট করে ভেঙে পরালেন কঙ্কণ, জড়োয়া বালা, ষোলো গাছা চুড়ি, বাউটি আর্মলেট। গলায় চিক, নেকলেস, মফ চেন, সীতাহার, মাথায় সোনার মুকুট, কানে জড়োয়া কান ঝুমকো, আট আঙুলে আটটা আংটি। সোনার সিঁথি পাটি। অত গয়নাতেও করবীর রূপ ঢাকল না। কিন্তু সেই ভাঙা সোনার চুড়ি, তার মটাস মটাস আওয়াজের সময়ে করবীর মান সম্মান , করবীর মায়ের মান-সম্মান কোথায় ছিল? তাঁরা অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটাই জাগ্রত ঠাকুরের দয়া বলে নিয়েছিলেন।
চাটুজ্জে বাড়ির বউ হয়ে চলে যাওয়ার পর একটা রাত্তিরও আর যাদবপুরের জবরদখল কলোনিতে নতুন তৈরি বাড়িতে থাকতে পায়নি করবী। বিয়ের দুদিন পরই তামাটে সাহেবটা সাগর পারে চলে গেল করবীকে একটু নেড়ে চেড়ে চেখে দেখে। একটু নাক সিঁটকে ছিল। মুখের ভাষার আভিজাত্য, বাচনভঙ্গির আভিজাত্য এসব যাতে ফিরে এসে দেখে মাকে সেইমতো নির্দেশ দিয়ে চলে গেল। যে আসামান্য রূপের সামনে তার চোদ্দ পুরুষ বনেদি, তালশাঁসের মতো শাশুড়ি পর্যন্ত থমকে দাঁড়িয়ে বলে ফেলেছিলেন ‘কে? এ কে?’ সেই রূপকে কোনও গুণ বলে আদৌ স্বীকার করল না সাহেবটা। তখন করবীর অপমান হয়নি? তার হাঁটু পর্যন্ত ঢেউ খেলানো চুল, ভরন্ত শরীর, ফোটা ফুলের মতো মুখ সমস্ত এক পলকে দেখে নিয়ে বলেছিল, ‘রাসটিক। নো সফিস্টিকেশন!’
—‘বলিস কি রে? তোর পছন্দ হল না? এ যে একেবারে প্রতিমার মতন।’
—‘প্রতিমা ওই চালচিত্তিরেই চলে। খারাপ না। তবে চালাতে হলে এখন অনেক পালিশের দরকার!’
সেই পালিশ চলল। যা কিছু ব্যবহারিক জীবনে সাফল্যের জন্য দরকার বোধহয় ওই সময়েই শিখেছিল করবী। সন্দেহ নেই। চাটুজ্জে বাড়ির সে বাবদে ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু সম্মান? ওই হামবাগ স্নবগুলো প্রতিটি জাগ্রত মুহূর্ত তাকে খালি অবজ্ঞা, তাচ্ছিল্য আর অপমান করেছে!
—‘ডেঙড়-ডাঁটার চচ্চড়ি ভাল রাঁধো এ কথা আর কাউকে বলবার দরকার নেই করবী।’
—‘কুচো চিংড়ির টক খেতে চেয়েছ? বামনীর কাছে? তোমার লজ্জা করল না?’
—‘শোনো কাজের লোকেদের সঙ্গে হুকুম ছাড়া অন্য কথা বলবে না।’
—‘মার কাছে যাওয়ার জন্য রাত্রে কেঁদেছ? খাও নি? ঠিক আছে আজ বিকেলবেলা গাড়ি নিয়ে যাবে। কিন্তু কই তোমার মা-ও তো খোঁজ করে না। মেয়েকে পর ঘর করে দিয়েই খালাস? আর হবে নাই বা কেন?…
—‘মা, তুমি আর আমার নেই! মা, তুমি আমার খোঁজ করো না, তোমার বুকে হাত দিয়ে না শুলে যে আমার ঘুম আসত না মা।— আমি পাশে না থাকলে তুমিই কি ঘুমোতে পারতে?’
আপাদমস্তক মহার্ঘ অলঙ্কারে, শাড়িতে এই কমাসেই চেহারায় উদ্ধত আভিজাত্যের ফণা, দেখে হতচকিত মা এবার দ্রুত ছুটে এসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তার পরেই দূরে সরে যান। —‘হলুদের দাগ লেগে গেল না তো রে শাড়িতে?’
—‘লাগুক গে।’
—‘কী শাড়ি রে এটা?’
—‘আমি জানি না।’
—‘কে দিলে এই বিছে?’
—‘কেউ দিয়েছে, জানি না মা।’
—‘কী সুন্দর তোকে দেখাচ্ছে পুতুল, ঠিক যেন অন্য কেউ। যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছিস!’
অন্য কেউ! আকাশ থেকে নেমে এসেছে! মায়ের চোখে সমভ্রম, দাদার চোখে ঈর্ষা, বাবার চোখে ভয়।
—‘যাব কী তোর শ্বশুরবাড়িতে। দেউড়ির সামনে দাঁড়াতেই ভয় করে।’
যার বাবা-মা-দাদা শেষ পর্যন্ত বাবা-মা-দাদা থাকে না, তার সম্মান আসবে কোথা থেকে?
ঠাকুরের দয়ার এক ধাক্কায় যার সব নিজস্ব জিনিস হারিয়ে যায় তার শেষ পর্যন্ত কী থাকে?
সাহেবটা যখন ফিরে এল তখন করবীর আঠারো। লোকটাকে দেখলেই কেমন রাগ ধরত, গা গুলোত করবীর। খুব ঠাণ্ডা গলায় মাপা মাপা কথা বলত। কোথাও নিয়ে গেলে একটা চোখ করবীর ওপর ফেলে রাখত। তারপর বাড়ি ফিরে হত তার সমালোচনা। এটা ও ভাবে নয়, ওটা ওভাবে! ছিঃ! ছি! ছি!
যখন ধরম কাপুর টিভি সিরিয়ালে নামবার প্রস্তাবটা দিল, সাহেব মানে তার মালিকটা তখন দূরে দাঁড়িয়ে, হাতে মদের গেলাস। তার নিজের হাতেও, সে খিলখিল করে হেসে বলল— ‘ঠিক আছে, করে দেখি।’
সেই প্রথম বাড়ি এসে সাহেবটা তাকে এক চড় মারল। প্রথমে জিজ্ঞেস করল, ‘কাপুর তোমার কাছে টিভির সিরিয়ালে হিরোইনের রোল করার কথা বলেছে?
—‘বলেছে।’
—‘তুমি নাকি রাজি হয়েছ!’
—‘হয়েছি।’
—‘আমাকে না বলে? আমাকে একবারও জিজ্ঞেস না করে?’
—‘আমার ইচ্ছে হল। মনে হল তোমারও ভাল লাগবে দেখতে যে আমিও কিছু পারি।’
পেছন থেকে দু কদমে সামনে এসে সাহেবটা এক চড় মেরেছিল তখন!
প্রথমটা সে অবাক হয়ে যায়। গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে লালচে মুখটার দিকে।
—‘ধ্রুব চ্যাটার্জির স্ত্রী অভিনয় করবে?’
—‘বাঃ, তোমার বন্ধু হালদারের স্ত্রী সামান্য কি একটা সাইড রোলে করেছে বলে তো তোমরা তাকে নিয়ে নাচানাচি করো। আমি ভাবলুম অতএব তোমার সম্মতি আছে।’
আস্তে আস্তে কথাগুলো বলতে বলতে, করবী বুঝতে পারছিল তার গলার স্বরে অন্য কিছু মিশছে। তিক্ততা না ব্যঙ্গ, না চতুর চালাকি! সে ততক্ষণে মনে মনে পণ করে ফেলেছে যা-ই হোক কাপুরের ফিলমে সে অভিনয় করছেই।
—‘ইডিয়ট! একেবারে স্টুপিড।’ সাহেব এবার হাত সামলে নিয়েছে। মুখ চালাচ্ছে। করবী ভাবছে—‘নাও এবার কী যুক্তি দিয়ে বোঝাবে, বোঝাও।’
চাটুজ্জে বাড়ির সাবেকি কেতার সঙ্গে মিলছে না বলে ইতিমধ্যেই তো আলাদা বাড়ি হয়েছে। চাটুজ্জে বাড়ির সম্মানের কথা তুলুক! তুলুক না!
‘না, তুলল না। বলছে— ‘ঠিক আছে, ডি, চ্যাটার্জির স্ত্রীর কথার দাম আছে। সেই দাম রাখতে কোনওমতে এটা সেরে দিতেই হবে।’ সাহেবটা এখন ঘর থেকে চলে গেছে।
করবী আয়নার সামনে একটা লাল গাল নিয়ে বলছে— ‘দাঁড়াও এবার। দাম রাখতে কোনমতে সারতে হবে, না? দেখাচ্ছি কাকে সারা বলে!
ধ্রুব চাটুজ্জে ধারণাও করতে পারেনি পর্দায় করবী ওই রকম অসামান্য হতে পারবে। চলায়, বলায়, নড়া-চড়ায়। কাপুর বুঝতে পেরেছিল। করবী নিজেও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু সাহেবটা তাকে প্রথম থেকে এমন ছোট চোখে দেখেছিল যে তার অসাধারণত্বটা কোন দিন মাপতে পারেনি। যখন পারল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। একটার পর একটা অফার আসছে। করবী সেগুলো দুহাতে সই করে যাচ্ছে। করবীর সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে না পেরে অবশেষে সেই চাটুজ্জেটা তাকে মেরে ধরে গালাগাল দিয়ে নিজের গায়ের চামড়ার নীচে যে বর্বরটা আছে তাকে প্রকাশ্যে এনে ফেলে অবশেষে এক সময়ে কুঁকড়ে পালিয়ে গেল নিজের পুরনো কোটরে। করবী ব্যারিস্টার চাটুজ্জের সেই বাড়ি ফেলে তার নিজের রোজগারে ভাড়া করা, তারপরে কেনা বাড়িতে মেয়েকে বুকে করে চলে এল। অবশেষে মান-সম্মান। কিন্তু এই মান-সম্মানের পেছনেও যে অনেক দাসত্ব-দাসখত্, অনেক আপসের অসম্মান রয়েছে। রয়েই গেছে। আর কেউ না জানলেও করবী তো জানে। তার সারা জীবনটা একটা অসম্মান থেকে আরেকটা অসম্মানের পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে বয়ে চলেছে।
—‘এইখানে ডাকো!’ —মিনুকে নির্দেশ দিল করবী।
—‘এইখানে?’ মিনু অবাক। এখানে কাউকে, কক্ষনো দিদি ডাকে না। তার ওপর কোনও প্রসাধন নেই, গায়ে একটা আলগা আঙরাখা। মিনুর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে নিজের বুকের খাঁজের দিকে আলগা তাকাল করবী। মিনু দৌড়ে একটা পোশাক নিয়ে এল, শুদ্ধু ওপরের পোশাক, আলগা ওয়েস্ট কোটের মতো। কিন্তু এই সাদা আঙরাখার ওপর ওই নীলচে ওয়েস্ট কোটটা পরলেই পোশাকের মধ্যে একটা পোশাকি ভাব এসে যাবে। এ সবই করবীর নিজস্ব পরিকল্পনা। ডান হাতটা গলিয়ে নিতে নিতে করবী সামনের পুফে পা দিল, সরিয়ে একবার উঠে দাঁড়াল, নিজেকে কয়েকটা ঝাঁকুনি দিল। ওমনি সিল্কের সাদা পোশাকটা অপূর্ব সব ভাঁজে তার সারা শরীরের চারদিকে ঘিরে লুটিয়ে পড়ল।
—ছেলেটি অল্পবয়স্ক। সদ্য তরুণ। মুখে যেন এখনও দুধ লেগে রয়েছে। সেই দলের যাদের সপ্রতিভতাটা স্বভাবের অন্তর্গত নয়, চেষ্টা করে আয়ত্ত করতে হয়েছে। যে কোনও অপ্রত্যাশিত চমকে বা ধাক্কায় সপ্রতিভতার মুখোশটা ফটাস করে খুলে গিয়ে পায়ের তলায় অসহায়ের মতো গড়াগড়ি খায়। এখন ওর সেই মুখোশটার দিকে সামান্য বিদ্রুপের চোখে তাকিয়ে আছে করবী। আর ছেলেটি তার মুখোশ, মুখোশের তলার মুখ, ঠোঁটে দুধের দাগ সমস্ত ভুলে তাকিয়ে রয়েছে করবীর দিকে। সে করবীর ফোটো দেখেছে, দেখেছে তাকে নানান ফিল্মে। কিন্তু এ সবের বাইরে আসল করবীকে সে এই প্রথম দেখল। শীতকালের সকালের রোদের মতো যে করবী। মোমের মতো মুখ হাত পা-র যে করবী, চড়া রঙে রঙে যার ঠোঁটের রং জ্বলে জ্বলে এখন প্রায় সাদাটে। চোখের পাতার রং খয়েরি। খয়েরি রঙের ব্যঞ্জনা-অলা ঈষৎ ভিজে চুল যার চেয়ারের পেছনে ঘেরাটোপের মতো ঝুলছে। কিছু নেই, কোনও চালাকি নেই, —একেবারে শীতের সকাল কিংবা শরতের দুপুরের মতো করবী। আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা। আকাশ থেকে নীল চুঁইয়ে পড়ছে। জল থেকে উঠছে খুব স্নিগ্ধ বাষ্প। গায়ে তাপ লাগছে। সে তাপ খুব মৃদু। মুগ্ধকর।
করবী কথা বলছে না, তাকিয়ে আছে। সেই চাউনিতেই তার প্রশ্ন, ঠোঁটের সামান্য মোচড়ে সেই প্রশ্নের প্রতি অবহেলা, আঙুলগুলো প্রশ্ন কর্তার প্রতি অল্পস্বল্প করুণায় নিজের চুলের গোছা নিয়ে খেলা করছে। বসতে বলেনি, তাই বসতেও পারছে না ছেলেটি। এই রকমই তার অভ্যাস। এই রকমই তাকে শেখানো হয়েছে। কিন্তু এই চমকটার মুখে দাঁড়িয়ে সে কিছু-কিছু শিক্ষা কিছু কিছু অভ্যাস ভুলে যাচ্ছে। ‘অংশুমান সেনগুপ্ত সম্পর্কে বান্টি আলুওয়ালিয়া যা বলেছে পড়েছেন নিশ্চয়ই। মিস আলুওয়ালিয়া ওঁর একটা কাহিনীর ফিল্মে কাজ করেছেন, আপনি সেখানে পাঁচটায়। পাঁচটাই ইনফিনিটলি মোর সাকসেসফুল দ্যান-এনিথিং’… তড়বড় করছিল ছেলেটি।
—‘বাণ্টি?’ যেন ঘুমের মধ্যে থেকে বলে উঠল করবী। যেন বান্টি তার প্রথম, প্রধান প্রতিদ্বন্দিনী নয়, যেন সে এক্ষুনি বলবে ‘হু ইজ বান্টি?’
তরুণের ধারণা ছিল, অর্থাৎ তাকে বলা হয়েছিল বান্টি আলুওয়ালিয়া আর করবী চ্যাটার্জি দুটো বাঘিনীর মতো পরস্পরকে ছিঁড়তে খুঁড়তে ভালবাসে, এবং সেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ থেকে বেশ কিছু ফিল্ম পত্রিকার, মেয়েদের পত্রিকার প্রচ্ছদ কাহিনী হয়ে যায়। কাজেই বান্টির নাম করলেই জ্যা-যুক্ত ধনুর মতো ছিটকে উঠবে করবী চ্যাটার্জি। তাই তরুণ তার সামনে ঢাল রেখেছিল একটা, বিরাট একটা কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্সের ঢাল। কিন্তু করবী যেন এক মোহন সুপ্তির ঘোর থেকে মৃদুমন্দ হাওয়া বইয়ে দিল। ‘বান্টি?’
এবার তরুণ জানে না সে কী করবে। তাই সে ইতস্তত করছে, অপেক্ষা করছে। তার হাতের তাস সাজানো, কোনটা খেলবে বোঝবার জন্যে বোকার মতো সে প্রতিপক্ষের দিকে চেয়ে রয়েছে।
—‘কী বলেছে বান্টি?’ বেশ কিছুক্ষণ পর হাওয়ায় ভেসে এল। তরুণ মোটে বাইশ, জন্ম সপ্রতিভ রেজিমেন্টের কেউ নয়, মূলত মুখচোরা বাহিনীর, রুজির জন্য বাধ্য হয়ে…। যা লেখা যায়, তা মুখে সব সময়ে বলা যায় না, অন্তত মুখোমুখি না। কফি কি চায়ের কাপ সামনে নিয়ে কাগুজে দাদার সঙ্গে কফি হাউসে যা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল, সেই স্কুপের পেছনে দৌড়তে দৌড়তে এখন সেই স্কুপের মুখোমুখি, সোজাসুজি। সে শুধু কাগজের কাটিংটা তার ফাইলশুদ্ধ এগিয়ে দিল। চোখে বিস্ময়। এঁরা কি কিছুই পড়েন না? আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে দেখেই জীবন কাটিয়ে দ্যান!
ফাইলটা নেওয়ার জন্যে হাত বাড়াচ্ছেন না করবী চ্যাটার্জি। ফাইলটা এগিয়ে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে তরুণ। কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে ঢুকছে কেউ। তরুণের সামনে রাখছে, তার প্রসারিত হাতের তলায়। মৃদুস্বরে বলছে বসুন। চেয়ার টেনে তার পেছনে রাখছে। এইবার করবী হাত বাড়ালেন। ফাইলটা নিচ্ছেন। হাতের দিকে চুম্বকের মতো দৃষ্টি আটকে গেছে তরুণের। কী অদ্ভুত হাত! রক্ত মাংস হাড় শিরা ধমনী পেশী, চর্বি এই সমস্ত দিয়েই তো তৈরি হাত! কিন্তু ঈশ্বর এখানে আর্ট লাইজ ইন কনসীলিং আর্ট করেছেন, রক্ত মাংস, হাড়, চর্বি, শিরা ধমনীর কবিতা তবে এই হাত! ছন্দোময়। হাতের পাতার বাইরেটা শুভ্র। ভেতরটা লালচে। মোচার কলির মতো অজন্তা হাত। কী আশ্চর্য! কী পরম পরমাশ্চর্য! নন্দলাল বোস, ওরিয়েন্টাল আর্ট এসবও সত্যি হয়ে থাকে কোথাও কোথাও!
—‘আপনি কোন কাগজ থেকে?’ অদ্ভুত সেই বর্ণহীন, অবর্ণ্য ঠোঁটদুটির ভেতর থেকে বলছেন।
—কোনও কাগজ থেকে নয়, ফ্রি লান্স্। ‘প্লীজ, অন্য কেউ এসে পড়বার আগেই আপনি আমাকে…’
‘বাঃ,’ করবীর ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি ফুটতে না ফুটতেই মিলিয়ে গেল। আমাদের নিজস্ব জীবন, গোপন জীবন, মানুষদের , মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক সবই স্কুপ! একেবারে কুরে বুকের মধ্যে থেকে তুলে নিয়ে যাবে! প্লীজ! রুজি। ফ্রি লান্স্! রুজি। কেউ এসে পড়বার আগেই! বাঃ।
—‘কী আছে এতে!’ ফাইলের পাতায় বান্টির ছবির দিকে চোখ রেখে প্রশ্নটা করল করবী। বান্টি! যার মাথার থেকে পা পর্যন্ত মস্তিষ্ক, হৃদয়, এমনকী উদর, জরায়ু, সমস্ত সমস্ত নকল!
‘অংশুমান সেনগুপ্তর সঙ্গে ওঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিষয়ে’… তরুণ কথা শেষ করে না।
ফাইলটা না দেখেই করবী প্রায় টুসকি মেরে যেন সেটা তরুণের হাতে ফিরিয়ে দেয়। — ‘বান্টি? অংশুমান? বান্টির সঙ্গে অংশুমানের কোনও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে না।’ অনুত্তেজিত, একঘেঁয়ে সুরে কথাগুলো বলল করবী।
—‘জানি। সেই জন্যেই তো! তাই তো আপনার কাছে আসা। করবীদি’, সাহস করে দিদি ডেকে ফেলল, ‘আপনার চেয়ে বেশি ভাল করে কেউ, মানে আপনাদের ওয়ার্ল্ডে ওঁকে মানে অংশুমান সেনগুপ্তকে… অথচ বান্টি আলুওয়ালিয়া বলছেন “শীতে-বসন্তে”র অউটডোরে মানে সিমলাতে ওঁরা রাতে ড্রিঙ্ক নিয়ে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এই যে আপনি পড়ে দেখুন না …’ করবীর চোখ গরম হতে শুরু করেছে তরুণটি বুঝতে পারছে না। গরম চোখে সে দাগ-দেওয়া জায়গাগুলো পড়ে গেল: ‘অংশুমানের বুকের ওপর আমার মাথা ঢুলে পড়েছে ঘুমে। অংশুমান হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন মাথায়… ঘুমোও বান্টি ঘুমোও আমি জানি তুমি কত ক্লান্ত। সারারাত এইভাবে অংশুমানের বাহুবন্ধে কাটিয়ে যখন ভোর হল, এই দেখুন আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, দেখলাম কত ক্লান্ত ওঁর ঘুমন্ত মুখটাও, যেন আকাশের ঈগল এতদিনে আশ্রয় পেল। রাত্তিরবেলা কথা-বার্তার ফাঁকে ফাঁকে উনি আমায় বলেছিলেন, ঠিক আমার জন্যেই যেন লেখা “শীতে বসন্তে”র নায়িকা লরার চরিত্রটা, কোনওদিন ভাবেননি তাঁর কল্পরাজ্যের মানসীর দেখা পাবেন এমনি সামনা সামনি। লেখার মধ্যে মানুষ নিজেকেই বারে বারে খোঁজে, লরার প্রেমিকও সেই হিসাবে উনিই।’
—‘রাবিশ।’ মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলল করবী।-‘কী প্রমাণ আছে এসবের? বান্টি কি এই সাক্ষাৎকার বাংলায় দিয়েছে? ওকে তো সব সময়ে ডাব্ করতে হয়।’
—‘না, অনুবাদ করা হয়েছে।’
—‘হ্যাঁ, বান্টি নিজে কোনও ভাষাই জানে না। কিচির মিচির করে খানিকটা বুকনি কপচায়। শী কান্ট কমিউনিকেট। ওকে অনুবাদ করাও কাজে কাজেই খুব কষ্টসাধ্য। ও নিজেই জানে না কী বলতে চায়। তবে সারাটা রাত কারও বাহুবন্ধে কাটাবার মেয়ে ও নয়। তাহলে ওর চুল খোসার মতো খসে আসবে, চোখের পাপড়ি গালে এঁটে যাবে, মুখের পট্টি খসে পড়বে, ওর দাঁত, নখ, ওর সবটাই এক্সপোজড্ হয়ে যাবে, মিঃ আপনার নাম কী?’
—‘কৌশিক, কৌশিক গুহ।’
—‘হ্যাঁ মিঃ কৌশিক গুহ বুঝলেন? শী ইজ এ কনজেনিট্যাল লায়ার। পার্সেন্টেজ বাদ দিতে পারেন না? সিমলায় শীতে ড্রিংক-ফিংক হাতে নিয়ে বসা পর্যন্ত হয়তো ঠিক। তারপরটুকু ওর চতুর উর্বর মস্তিষ্কের ভেতরে ঘটেছে।’
—‘না, মানে এই পরিপ্রেক্ষিতে আপনার কিছু বলবার নেই?’
—‘না। যেগুলো বলেছি কোট করতে পারেন। মানহানির মকদ্দমা করলে ওকেই প্রমাণ করতে হবে ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত জাল নয়।’
—‘আপনার কথা কিছু বলবেন না! করবীদি! এই প্রেক্ষিতে?’ কৌশিক গুহ যেন আর্তনাদ করছে।
প্রেক্ষিত? করবী এই দৃঢ়, ঘনপিনদ্ধ সকালের মধ্যে কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার মতো সন্ধে ঘনিয়ে আসছে দেখতে পেল। ‘কাট্’। কোথায় কে চেঁচাল। এখন ওই বিশাল দানবের চোখের মতো আলোর হাত থেকে মুক্তি। পেছনে অন্ধকার, ধাঁধানো চোখে আরও গাঢ় লাগছে। লাঞ্চ রেডি, মিনু তার ঘরে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে অন্ধকারের গায়ে ছোট ছোট রঙের বিন্দু নাচানাচি করছে। সে পা বাড়াচ্ছে, দীর্ঘদেহী মানুষটি সামনে এসে দাঁড়ালেন, তাকিয়ে রয়েছেন সোজা। ‘ইনিই লেখক।’ কেউ বলল। যখন অভিনয় করছিল! দাউ দাউ জ্বলন্ত আলোর সামনে পুড়তে পুড়তে। তখনও এক গভীর সমুদ্রের তলার মতো দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করেছিল, সে বুঝতে পেরেছিল। “নাম রেখেছি কোমল গান্ধার”। গম্ভীর গলায় শুধু বললেন, তারপর তাঁর গলার আওয়াজ, মর্মভেদী মর্মস্পর্শী চাহনির কিছু গুটিয়ে নিয়ে, কিছু বা দিয়ে, চিরকালের মতো দিয়ে চলে গেলেন।
জীবনটা শুরু হয়েছিল বড্ড ছোটবেলায়। প্রথম অপমানের ঠোক্কর দারিদ্র্য, তারপর আবার অপমান রকমারি পুরুষের চোখের, হাতের ঠোক্করে, তাতেও কি শেষ হল? অভিজাত ঘরে গরিব-বাড়ির মেয়ের বউ হয়ে যাওয়ার অপমান, সাহেবের উপযুক্ত মেমসাহেব না হতে পারার অপমান। প্রযোজকের পাশ ঘেঁষে ছবি তুলতে বাধ্য হওয়ার অপমান। অবশেষে কশাহত শরীরে শীতল জলের ধারাবর্ষণ! নাম রেখেছি কোমল গান্ধার। কী মানে? কী বলতে চেয়েছিল? কোনওদিন জিজ্ঞেস করেনি। হয়তো তার সেই নাটকীয়তাহীন, শুধু চোখের মুদ্রা, ওষ্ঠাধরের স্ফুরণ, মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ানোয় অনেক কথা বলার অভিনয়কে উনি অভিনন্দিত করলেন। হয়তো সেই মুহূর্তে তার করুণ, কোমল, কমনীয় ব্যক্তিত্বকে।
—‘আমার যা বলার আছে তা ওভাবে বলা যায় না। এভাবে আমি শ্রাদ্ধ করি না।’ করবী উঠে দাঁড়াচ্ছে।
—‘কিছু তো বলার আছে! সেটা যখন আপনার বলতে ইচ্ছে হবে দয়া করে আপনি আর কাউকে বলবেন না। আমার কেরীয়ার! মানে, দিদি এই যে টেলিফোন নম্বর’ কার্ড এগিয়ে দিচ্ছে কৌশিক গুহ, আমাকে আপনি একটিবার ডাক দেবেন। এক্সক্লুসিভ ইনটারভিউ ম্যাডাম প্লীজ। আমি আপনাকে দেখিয়ে নেব।’
—প্লীজ দয়া করে, প্লীজ দয়া করে, এক্কেবারে ইঁদুর একটা। কৌশিক গুহকে তার ফাইল এবং ক্যামেরাসহ ব্যালকনির দরজা দিয়ে ছোট্ট হয়ে চলে যেতে দেখতে দেখতে দাঁতের তলায় বলল করবী ‘ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর একটা। প্লীজ দয়া করে। দয়া করে প্লীজ’ এভাবে ভিক্ষে চেয়ে বড় হওয়া যায় না, যেমন যায় না দুপা ফাঁক, হাতে চাবুক নিয়েও। ব্যালকনি রোদে ভরে গেছে এখন। করবী, ঘরের ভেতরে চলে গেল।
৩
রোদ চলকাচ্ছে। পুবের দিকের জানলাগুলো হাট করে খোলা। অহনা একটু পরে স্নান করেন। মুখ ধুয়ে এক কাপ চা নিয়ে জানলার উল্টো দিকে মুখ করে বসলেন। বসার ঘরে। ছবির মুখোমুখি। চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সামান্য একটু চোখ তুলে দেখে নিচ্ছেন। ইংরেজি কাগজটা সামনের টেবিলে গুছিয়ে রাখা। তুলে নিলেন। তলায়, বাংলাটা নেই। ইংরেজিটা পড়তে পড়তে মৃদুস্বরে ডাকলেন বিভু, বুবু!’ কদিনই বাংলাটা পাচ্ছেন না।
ঐশীর জবাব শোনা গেল না, ও বোধহয় একেবারে ওদিকের ঘরে আছে। বৈভব ঘুরে ঢুকল। অহনা বললেন— ‘বাংলা কাগজটা কি তুই পড়ছিস বা তোরা কেউ?’
—‘না, বাংলাটা আজ দেয়নি মা।’
—‘আশচর্য! এরকম ভুল তো হয় না। কদিনই দিচ্ছে না যেন।’
—‘হয়তো পরে দিয়ে যাবে। আমি খোঁজ করব।’
কাগজের চিঠিপত্রগুলো পড়তে পড়তে আবার সামনের দিকে তাকালেন অহনা। চোখ ভারী হয়ে যাওয়া বুক ভারী হয়ে আসা-এসব এখন কমে গেছে। প্রথম দু’ মাসের সেই আঘাত, ধাক্কা একের পর এক শোক সান্ত্বনায় যা আরও সজীব হয়ে উঠছিল, সে কথা এখন ভাবলে ভয় হচ্ছে। প্রথম অনেকদিন তো একেবারে বিশ্বাসই হতে চায় না। বারবার এই ঘরের টেবিলের সামনের রিভলভিং চেয়ারটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। ওই তো, ওই তো বসে আছেন অংশুমান! না, নেই। প্রস্তুতি ছিল না বলেই ধাক্কাটা আরও বেশি। কিন্তু নিজের অন্তরের দিকে তাকিয়ে অহনাকে স্বীকার করতেই হয় এইরকম যাওয়াই অংশুর পক্ষে ঠিক যাওয়া হয়েছে। অংশু শুয়ে আছে দিনের পর দিন অসহায় বোবা মস্তিষ্কহীন। না, না ভাবা যায় না। অহনা চিরদিন প্র্যাকটিক্যাল মানুষ। অংশুর ছিল ভাবাবেগের আধিক্য, সেই আধিক্যের স্রোত বেয়েই তো এতগুলো সৃষ্টির নৌকা ভেসে এল।
তাঁদের যৌথ জীবনের আদিতেও এই ভাবাবেগ ক্রিয়া করেছিল। তিনি, অহনা তো রাজি হনইনি, ভেবেছিলেন চিরকুমারী ব্রত নেবেন। এমন কিছু শক্ত ছিল না সেটা তাঁর পক্ষে। অন্তত তখন তাই-ই মনে হয়েছিল। নিজের কাজ, নিজের চাকরি তো ছিলই। কিন্তু অংশু? অংশুর সঙ্গে পেরে ওঠা খুব শক্ত ব্যাপার ছিল। তারপর তাঁর মনে হল, অংশুকে আশ্রয় দেওয়া দরকার। সারাদিন নিশ্ছিদ্র খাটুনি খেটে ও লেখার সময় পায় না। ওকে নিশ্চিন্ত করবার জন্যেও অহনা পক্ষ বিস্তার করলেন। প্রেয়সীর কাছে আবেদন যদি বা ব্যর্থ হয়, জননীর কাছে তো হয় না! এখন এসব কথা অহনা স্পষ্ট বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন তাঁর ভেতরের বহুমুখী নারীত্বের ঠিক কোনখানটায় অংশুর প্রার্থনা ঠিকঠাক পৌঁছেছিল। কতগুলো বছর কেটে গেল। এই সাত তলার ফ্ল্যাটটাকে তিনি অংশুমান-রূপ মনীষা-কল্পনা-প্রতিভার আধার হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণপণ করেছেন। নিজেকেও তাই করেছেন। ছেলে মেয়েদের কথা তাকে ভাবতেও দেননি। আয়-ব্যয়ের হিসেব নিকেশের কথা ভাবতে দেননি। অবশ্য অংশু খুব মায়াবী পিতা ছিল তা সত্বেও। ঐশীকে নিয়ে তার কত কাহিনী! শিশুদের বালক-বালিকাদের একটা নতুন জগৎই খুলে দিল বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক। বিভুকে হাতে করে মানুষ করেছেন, শিখিয়েছেন একজন সাহিত্যিকের কর্মজগতের করণ-কৌশল। বাবা চলে যাওয়ার পর ও-ই সবচেয়ে নিরাশ্রয়। কিন্তু ও-ই সবচেয়ে দক্ষ হাতে বাবার প্রকাশনার সাম্রাজ্য পরিচালনা করতে পারবে। কে জানে ও আর কিছু করতে পারবে কি না, ওর দরকার হবে কি না। এমন মনোমত কাজ কি ও আর কখনও পাবে? টুবু ছিল ওর বাবার বিস্ময়। টুবুর মধ্যে নিজের নতুন হয়ে সন্তানের মধ্যে ফিরে আসার ব্যাপারটা খুব সম্ভব ও প্রত্যক্ষ করত। টুবুর ওপর ওর ছিল এক ধরনের অন্ধ ভালবাসা আর প্রশ্রয়। বিভু যদি নিরাশ্রয়, টুবু তবে কী? টুকু বয়সে সবচেয়ে ছোট, বাবার ভালবাসা, বাবার গৌরব ওকে একেবারে ছেয়ে ছিল। টুবুই বোধহয় সত্যিকার অনাথ হল এখন। বিভু, বুবু, টুবুর কথা ভাবতে গিয়ে নিজের কথা ভাববার মতো মানসিক অবসর পান না অহনা। মনে হয়, অনেক দিন পৃথিবীতে আসা হয়ে গেল, অনেক দিয়েছে পৃথিবী, জীবন দু হাত ভর্তি করে দিয়েছে তাঁকে। ঠিক উপচে-পড়বার আগেকার নদীর মতো তিনি। ভরা বর্ষায় টইটম্বুর। দিনে দিনে অংশুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে। একটা চলমান, প্রতি-নিয়ত-নতুন-হয়ে ওঠা সম্পর্ক। এই সঞ্চয় এই ভরা মৌচাক জীবন নিয়ে তিনি অংশুর মৃত্যুর পরেও তাই পরিবারের চারজনের মধ্যে সবচেয়ে অচঞ্চল, সবচেয়ে স্থিতধী।
তাঁর ভারী আশ্চর্য লাগে যখন দেখেন ছেলেমেয়েরা তাদের জোড়া জোড়া বাহু বিস্তার করে এখন তাঁকে কেমন আগলাচ্ছে। হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখেন বুবু বসে আছে, টুবু সরে গেল। টেলিফোনে কাদের যেন খুব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করছে বিভু— ‘না, মা পারবেন না, এখন কিছুদিন না। এটা আপনাদের বুঝতে হবে।’ ভাল। এইভাবে ওরা পরস্পরের কাছে কাছে ঘুরছে। ভাগ করে নিচ্ছে শোক, দুঃখ, উৎকণ্ঠা। এটা ভাল। বুবু ঢুকল। এখনও মেয়েটা তৈরি হয়নি কেন? কলেজের আগে ও একটা যোগের ক্লাসে যায়। কিছু শারীরিক সমস্যা আছে ওর। যোগ-ব্যায়ামেই একমাত্র ভাল কাজ হচ্ছে। তা নয়তো ওষুধ খেয়ে খেয়ে হয়রান হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। এখন অনেক সুস্থ। কিন্তু এভাবে এসব কাজে অবহেলা করা ঠিক নয়। আর কেন? এবার প্রাত্যহিকতায় ফিরে আয় তোরা। জীবনের ছন্দের বাইরে চলে গিয়েছিলি, আবার তাল মিলিয়ে মিলিয়ে চলে আয়। অহনা ডাকলেন —‘বুবু।’ ঐশী সকাল থেকে এখান দিয়ে বার কয়েক যাতায়াত করেছে। পাহারা। সন্তর্পণে দেখে নেওয়া মা কী করছে, কী পড়ছে।
—‘বুবু, যোগ ক্লাসে যাবি না? কলেজ?’
—‘আজ যেতে ভাল লাগছে না মা,’ সাবধানে বলল ঐশী। দাদার নির্দেশ আছে আজ যেন মাকে চোখে চোখে রাখে।
—‘এরকম করিসনি বুবু। কাজকর্ম আরম্ভ করে দে।’ অহনা বললেন।
ঐশী যেন অবহেলায় আলমারি থেকে একটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকস্ বার করল। মা খুব ভালবাসে এই ম্যাগাজিনটা, তারপর খুঁজে খুঁজে একটা ওডহাউজ। একবার যদি এগুলোয় মন বসে যায়, আর বাংলা কাগজের অভাব নিয়ে মাথা ঘামাবে না মা। পরশুরামের রচনাসংগ্রহটাও বার করল। সে তার বুদ্ধিতে যা আসছে করে যাচ্ছে। অহনা বললেন—‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক্স্ এটাই কী লেটেস্ট?’
—‘হ্যাঁ মা। দেখবে?’
—‘থাক। পরে দেখব। অতগুলো বই নাবাচ্ছিস কেন?’
—‘পড়ব।’
—‘এখন? হঠাৎ?’
—‘এখন নয়। একটু পরে।’ অহনা অন্যমনস্ক চেহারায় উঠে দাঁড়ালেন। এবার চলে যাচ্ছেন রান্নাঘরের দিকে। বইগুলো টেবিলের একধারে রেখে ঐশী মায়ের পেছন-পেছন গেল। মা জগন্নাথকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছে। ‘ওপরের তাকটা অত নোংরা হয়েছে কেন জগন্নাথ। আজকেই পরিষ্কার করে ফেলো।’
‘আচ্ছা মা।’
—‘তুমি খেয়েছ?’
—‘চা খেয়েছি মা।’
—‘আর কিছু খাওনি?’
জগন্নাথ কিছু বলছে না। মা এতদিনে রান্নাঘরে আসেননি। কিছু দেখেননি। বাড়িতে কেউ ভালভাবে খাওয়া-দাওয়াও করছে না। সে-ও তাই নিজে নিয়ে সেভাবে খেতে পারেনি। এতদিন মায়ের তার তত্ত্ব নেওয়ার সময় হল, মন হল। জগন্নাথের চোখ ছলছল করছে।
অহনা বললেন— ‘আমি আটা মেখে দিচ্ছি। রুটি করে নাও জগন্নাথ। এখুনি হয়ে যাবে।’
হাঁ হাঁ করে উঠল ঐশী। —‘আমি দিচ্ছি, আমি তো আছি।’ জগন্নাথ কাঁচুমাচু মুখে বলল—‘পাঁউরুটি আছে মা, দুধটা জ্বাল দিয়েই খেয়ে নিচ্ছি। আপনি যান।’
রান্নাঘরের দিকে পিছন ফিরে অহনা বললেন— ‘আমি কি তবে কিছুই করব না?’
ঐশীর দিকে তাকিয়ে বললেন—‘আমার পেছন-পেছন ঘুরতে হবে না বুবু।’ একটু থেমে বললেন- ‘আমি ঠিক আছি।’
ছেলে-মেয়েরা আসলে তাঁকে বুঝতে পারছে না। তিনি সংযম হারিয়ে ফেলেননি একবারও। যখন শবদেহ নিয়ে যাওয়ার, নিয়ে যেতে দিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা শোকে পাগল-পাগল হয়ে গেলে, সামলেছেন। কিন্তু কথা হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর মুখ থেকে। কথা বলতে পারেননি অনেকদিন। আসলে যেই ঘটনাটা ঘটল, তাঁর চৈতন্য এক তটস্থ ঐতিহাসিকের মতো বলে উঠল, শেষ হল। কালের বিন্যাসে একটা অধ্যায়, একটা পর্ব শেষ হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মন পেছন ফিরল। ত্রিশ বছর আগে, পঁয়ত্রিশ বছর আগে। যখন প্রথম। যখন শুরু। যখন সংগ্রাম। কী অসামান্য ঐশ্বর্যে ভরা সেইসব দিন। প্রত্যেকটি দিন তখন এক একটা ছোটগল্প। প্রত্যেকটা সন্ধে, রাত কবিতামালা। অংশু লিখে যাচ্ছে। কলমের আগে চলছে মস্তিষ্ক, এত দ্রুত আসত চিন্তাগুলো, শব্দগুলো, দুজনে মিলে সেগুলো পড়বার সময় ফেলে-যাওয়া শব্দের খানাখন্দে হোঁচট খেয়ে কী হাসি। বিভু ইদানীং যা করছিল, অহনা সেই সময়ে সেই কাজ করেছেন। পাণ্ডুলিপি, প্রুফ, প্রকাশক, সম্পাদক আপ্যায়ন।
তা ছাড়াও ছিল নিজের কলেজ। কোচিং। অনিয়মিত উপার্জন অংশুর। তাছাড়া ও কখনও চাপের মধ্যে কাজ করতে পারত না। প্রকাশক বা সম্পাদকের তাড়ায় ও বিভ্রান্ত হয়ে যেত, খেই হারিয়ে যেত কল্পনা-মনীষার। সেসব তাড়া তাই অহনার কাছে জমা থাকত। যেমন যেমন শেষ হত, অহনাই পাঠাতেন সব গুছিয়ে। আসলে এতদিন নিজের জীবনই পরিক্রমা করছিলেন অহনা মনে-মনে। তাই চুপ করেছিলেন। একেবারে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলেন তাঁর জীবনের সেই দীর্ঘ সময়টায়। তখন তাঁর নীরবতা দেখে ছেলেমেয়েরা ভয় পেয়েছে খুব। আহা! টুবু তো বড্ডই ছোট, বুবুও। আর বিভুর বয়স বাড়লে কী হবে? বাবার প্রতি অত নির্ভরশীল! তবু, অহনা বুঝতে পারেন এবার ওদের স্বাবলম্বী হওয়ার সময় হয়ে এল। বাবার হঠাৎ-চলে-যাওয়া থেকে ওরা বুঝুক। এবার এরকম ঘটনা আরও একটা ঘটতে পারে। নিজের পায়ে দাঁড়াক।
অহনা ডাকলেন-‘বুবু!’
ঐশী কাছেই কোথাও ছিল, বেরিয়ে এল। —‘কী মা!’
—‘তুই য়ুনিভার্সিটি যা বুবু, বাড়িতে এভাবে বসে থাকিস নি। যোগ ক্লাসটা তো আজ গেলই।’ একটু থেমে বললেন— ‘আমি ঠিক আছি। এদিকটা দেখতে পারব।’
অহনা চান করতে ঢুকে গেলেন। গায়ের ওপর বহুধারায় জল পড়ছে। অহনার মনে হল কিছু যেন ধুয়ে যাচ্ছে। জীবনে একটা সময় ছিল, যখন অংশুময় ছিলেন না। অংশু তখনও আসেনি। আবার এই একটা সময় এল যখন অংশু নেই। দুটো সময় কত আলাদা! এখন অংশু নেই, তবু তাঁর মধ্যে সে রয়েছে। খুব সম্ভব যতদিন তিনি বাঁচবেন ততদিন থাকবেও। তাঁদের মধ্যে যেন এখন একটা জীবন বিনিময় হয়েছে। সমস্ত ইন্দ্রিয় মেলে পৃথিবী ও পার্থিব জীবনকে ভোগ করার দায় এখন থেকে তাঁর, তাঁর মধ্যে সূক্ষ্মভাবে থেকে অংশুর কোনও অপরিবর্তনীয় অংশ, অংশুর অবশেষ, কিংবা তাঁর মধ্যে গড়ে ওঠা অংশু সেই জীবনের স্বাদ অহনার মধ্য দিয়ে পাবে।
জীবন চতুর্দিকে প্রসারিত করে দিয়েছে তার শেকড়। যারা এখনও জীবিত, তাদের সে আস্তে আস্তে নিজেদের অজান্তেই চেতিয়ে তোলে। কিছুতেই কাউকে শূন্যে অথবা স্মৃতিতে সমর্পিত হতে সে দেবে না। কিছুক্ষণ, কিছুদিন, কয়েকমাস থাকতে পারো, তারপরে? তারপরে অহনা চান করে ধবধবে সাদা, ফিরোজা পাড় শাড়ি পরে, তাঁর কোঁকড়া পাকা চুল আঁচড়ালেন, কপালে যে জায়গাটায় টিপ পরতেন, একটা গোল দাগ হয়ে গেছে, কী ভেবে একটা খয়েরি টিপ লাগিয়ে দিলেন সেখানে, তারপরে ডাকলেন বিভু! বুবু! টুবু!
৪
ঐশী এদিকটা ভাবেনি। বিখ্যাত মানুষের মেয়ে বলে তাকে অনেক বিড়ম্বনাই সইতে হয়। যেখানেই যাবে ফিসফিস, অংশুমান সেনগুপ্তর…। জানিস, আমার কাজিনদের বলছিলাম অংশুমান সেনগুপ্তর মেয়ে আমাদের সঙ্গে পড়ে, বিশ্বাসই করতে চায় না। আজ একটা সই-টই দিয়ে দে তো! তিত্তি-র গল্পগুলো সব তোকে নিয়ে লেখা? কী সুন্দর! ছোটবেলায় তো আমার বিশেষ প্রিয় ছিলই। এখনও, কিছু ভাল না লাগলে তিত্তি-কে নিয়ে বসি। কিশোরী তরুণী যে-সব ক্যারেক্টার আছে, সেগুলোরও বোধহয় মডেল তুই? না? সে কি বলা যায়? তিত্তি-র কি সবটা আমি? ওভাবে হয় না রে। ওভাবে ক্রিয়েশন হয় না। বলে বোঝানো যায় না। মানুষেরা নিজেরা অত জটিল, সংসার-চক্রও জটিলতর, অথচ সৃষ্টির পথ যে নানান কল্পনায় ভরা, বহুদিকে বহু বাঁক নেয়। সেটাই যে সৃষ্টির পক্ষে সবচেয়ে স্বাভাবিক সেটা এই জটিল মানুষ বুঝতে চায় না। এই নিয়ে ঐশীর অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে।পাঠক, সাধারণ পাঠক বড় কৌতূহলী। লেখকের আলমারির কোন তাকে কী আছে না জানা পর্যন্ত স্বস্তি নেই তার। এই পাঠককে ভয় করে ঐশী। করত। তারপর উদাসীনতা, মুখে একটা না-রাম-না-গঙ্গা হাসি এ অভ্যেস হয়ে গেল। আচ্ছা, ‘মুসাফির’-এ উনি নিজের কথাই লিখেছেন, না?’— ‘কে জানে?’— এখন উদাসীন উত্তর— ‘অত সহজে বলা যায় না।’ আচ্ছা ‘কালচক্র’র মধুশ্রী? এমন জীবন্ত! নিশ্চয়ই ওঁর চেনা কেউ। তোর মা না কি রে? জানি না, আমি জানি না, আমি জানি না…।
বয়ঃসন্ধির সময়টা বাবার লেখা পড়তে ভীষণ অস্বস্তি বোধ হত ঐশীর। মাকে বলা যায় না, বন্ধুদের সঙ্গে আর সব আলোচনা চলে, এটাই শুধু চলে না, দাদা অনেক বড়। তাছাড়া ছেলে। টুবুটাও তাই। নিজেই নিজের মনের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে হঠাৎ একদিন ঐশী আবিষ্কার করল না, কোনও অস্বস্তি নেই। এইসব উপন্যাসের লেখক কারও বাবা নয়, এটুকু বোধে পৌঁছনো চাই। লেখক যখন লেখক, তখন তিনি তটস্থ একজন মানুষ, কখনও কখনও একেবারে তন্ময়। জীবনে জীবন প্রবিষ্ট করে দিয়েছেন, কিন্তু কারুর পিতা, এই পরিচয় তাঁর তখনকার লেখক-পরিচয়ের বিশালত্বের মধ্যে হারিয়ে গেছে। তারপর গর্ব এল। আমি অংশুমান সেনগুপ্তর মেয়ে। সেটাও বেশিদিন টেকেনি। এত গৌরব, এত খ্যাতির দরুণ একটা আবেশ, সে তো আছেই। কিন্তু ঐশী যথাসম্ভব তার সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে যে পরিচয় তার আবহই পছন্দ করে।
সারা ক্লাসেই খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। যেন অন্যদের অস্বস্তি তাকে থেকে থেকে বিঁধছিল। হঠাৎ ঐশীর মনে পড়ে গেল। তাই তো! বাংলা কাগজের ওই বিবৃতি অথবা বিকৃতি তো অনেকেই পড়েছে। যারা পড়েছে, তাদের থেকে অন্যদের কাছে মুখে মুখে ছড়িয়ে গেছে রসালো খবর। বিকেল তিনটে নাগাদ ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই সে বেরিয়ে এল।
—‘ঐশী, কোথায় যাচ্ছ?’
পেছন পেছন সায়ক এসে জিজ্ঞেস করল। আরও কয়েকজনকে একটু দূর থেকে আসতে দেখতে পেল ঐশী। রূপা, পৌলোমী, তীর্থংকর।
—‘বাড়ি যাচ্ছি।’
—‘এত তাড়াতাড়ি!’
—‘কাজ আছে।’
সায়ক আহত চোখে চেয়ে বলল— “কী কাজ আমাকে বলা যায় না? ততক্ষণে ওরাও এসে গেছে। ঐশীর সঙ্গে একতালে চলছে। ঐশী সিঁড়ি দিয়ে নামছে। ওরাও নামছে। ঐশী বাস-স্টপে। ওরাও।
—‘কী ব্যাপার? তোমরা কি আমার বাড়ি যাচ্ছ না কি?’
—‘উঁহু। কিছু কথা আছে।’ তীর্থংকর বলল। তীর্থংকর খুব ডাকাবুকো ধরনের ছেলে। খুব সাহস তো বটেই। মার খেতে, মার দিতে ওস্তাদ। সায়ক বলল— ‘চল, কফি হাউসে একটু বসা যাক।’
—‘না।’বলে ঐশী মুখ ফেরাল অন্য দিকে।
পৌলোমী বলল— ‘হাতের কাছে আমার বাড়ি থাকতে, অন্য কোথাও যেতে হবে কেন?’
চারজন বলিষ্ঠ, নিজেদের সংকল্পে অটল বন্ধুর হাতে অসহায়ের মতো ঐশী। ওরা ওকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আমহার্স্ট স্ট্রিটে পৌলোমীর বাড়ি। কেন? আজ যে মাথার মধ্যে ক্রমাগত একটা পোকা কুরে কুরে খাচ্ছে। আজ কোনও কিছুতেই উৎসাহ নেই। দু একবার নিজেকে ওদের হাত থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে শেষে ও ছেড়ে দিল।
পৌলোমীদের বাড়ির একতলার বসবার ঘর এখন ফাঁকা। ওরা বসল, দরজা থেকে পৌলোমী কাকে ডাকল। দোকান থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই চা, গরম সিঙাড়া এসে গেল। সায়ক বলল— ‘উই কান্ট টলারেট দিস।’
—‘ওদের একটা শিক্ষা দিতে হবে,’ তীর্থংকর বলল।
পৌলোমী বলল— ‘দাঁড়া। দাঁড়া। তোরা ভয়ানক ইমপালসিভ। আগে ঠিক কর কী করবি? আদৌ কিছু করবি কি না।’
—‘আদৌ কিছু করবি কি না, মানে? অফ কোর্স করব।’ তীর্থঙ্কর তেড়ে উঠল।
রূপা আস্তে বলল— ‘ঐশীকে জিজ্ঞেস কর। ওর মত নে। এটাই সবচেয়ে আগে করা দরকার।’
সায়ক বলল —‘ঐশী, মত তোকে দিতেই হবে। জার্নালিস্টদের শকুনি-বৃত্তির একটা সীমা থাকা দরকার। দে মাস্ট নো হোয়্যার টু স্টপ।’
পৌলোমী বলল— ‘তাছাড়া একজন মানুষের মৃত্যুর পর যখন তিনি কোনও কিছুই ভেরিফাই করতে আসছেন না, তখন তাঁর সম্পর্কে এ ধরনের কিছু বলার এক্তিয়ার কারো নেই। যারা বলে তারা কাওয়ার্ডস, যারা ছাপে তারা দুর্জন।’
ঐশীর চোখ গরম হয়ে উঠেছে, আবেগে গলার কাছটা ব্যথা করছে। বন্ধু, একমাত্র বন্ধুরাই পারে সেই প্রসঙ্গ তুলতে। অন্যরা যা ছুঁতেও সংকোচ বোধ করে।
রূপা যেন ঐশীর হয়েই বলল— ‘কী ভাবে শিক্ষা দিবি?’
সায়ক বলল— ‘কাগজের অফিসে ফোন করব, ভয় দেখাব।’
পৌলোমী বলল— ‘চিঠি লিখব প্রতিবাদ করে।’
তীর্থঙ্কর বলল—‘লাশ ফেলে দেব।’
ঐশী এতক্ষণে নিজেকে সংবরণ করতে পেরেছে। সে বলল— ‘কী যা তা বলছ সবাই?’
রূপা বলল— ‘ঠিক। একমাত্র চিঠিটাই আমার কাছে একটা উপায় বলে মনে হচ্ছে। অন্যগুলোতে ওদের রোখ চেপে যাবে।’
পৌলোমী বলল— ‘কিন্তু রূপা, ওরা লিখেছে এই কলামে আরও অনেকের সাক্ষাৎকার ছাপা হবে, তার মধ্যে উর্মিলা কাশ্যপ আছেন, ওই যে রে কবি, খুব নাম করেছেন, করবী মুখার্জি আছে, কাকুর পাঁচটা বইয়ের ফিল্মে নায়িকা সেজেছে। ওরা হিন্ট দিয়েছে বান্টি আলুওয়ালিয়ার মতো চাঞ্চল্যকর বিদঘুটে তথ্য অন্য কেউ কেউও দিতে পারে। এক্ষেত্রে…।’
সায়ক বলল— ‘তুই বাড়ি যা ঐশী। আমরা দেখছি কী করতে পারি।’
ঐশী উঠে দাঁড়াল। খুব ক্লান্ত স্বরে বলল—‘ছেলেমানুষি করিস নি। তোরাও বাড়ি যা। আমার মত চেয়েছিলি। মত দিলাম না।’ সে আর দাঁড়াল না। সে এখন বাড়ি ফিরে যাবে। দাদা যে দায়িত্বটা দিয়েছিল, সেটা সে পালন করতে পারেনি। মা বুঝছে না, মার কাছে কাছে থাকা তার কেন দরকার। মা ভাবছে ছেলেমেয়েরা তাকে আগলাচ্ছে। আসলে যে তারা একটা কাগজ, কিছু বিবৃতি, কিছু সংবাদ থেকে তাঁকে বাঁচাতে চাইছে তা তো মা বুঝতে পারছে না। বুঝলে, পুরো প্রচেষ্টাটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। রেডিও, দূরদর্শন যা-যা প্রচার মাধ্যম আছে সব কিছু থেকেই কয়েকদিন আড়াল করতে হবে মাকে। কে জানে, কোথায় কার হঠাৎ নাম কেনার প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে! কে তাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেবে!
ঐশী যখন বাড়ি ফিরল, রান্নাঘর থেকে চায়ের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে তখন বাতাসে। বসবার ঘরে, বাবার ছবির সামনে দাদা, মা। মা বলল— ‘বুবু এলি? ভালই হল, আজ একটা নতুন রান্না মানে জলখাবার করেছি, বই দেখে দেখে। গরম গরম না হলে ভাল লাগবে না। টুবুটা তো এখনও ফিরল না।’
দাদা ঐশীর দিকে চাইল, চোখে তিরস্কার। এখন উত্তর দেওয়া যাবে না। কিন্তু মা নতুন রান্না করেছে? এক্সপেরিমেন্ট? তার মানে মা ফিরে আসছে? ভেতরটা একটা হঠাৎ-স্বস্তির, হঠাৎ-আনন্দের আলোয় ভরে উঠছে, টের পেল ঐশী। সে চটিটা যথাস্থানে ছেড়ে এসে, কার্পেটের ওপর বসে মায়ের কোলে মুখ রাখল— ‘নতুন করেছ, মা?’
—‘হ্যাঁ রে, একটা নতুন ধরনের ওমলেট। ভাজতে বলি জগন্নাথকে?’
—‘বলো। এখান থেকে চেঁচিয়ে বলো।’ ঐশী একইভাবে মায়ের কোলের ওপর মাথা রেখে আছে। মাকে উঠতে দেবে না। অনেক দিন পর এভাবে মায়ের ওপর নির্ভর করতে পারছে। আনন্দে, আবেগে তাই চোখে জল আসছে, কিংবা তার চেয়েও বেশি। ঘুম। ঘুম আসছে। কতদিন যে শোকার্ত থাকতে থাকতে, নিরাশ্রয় অনুভব করতে করতে, ইদানীং সতর্ক থাকতে থাকতে ভাল ঘুম হয় না।
টুবু ফিরল রাত নটা করে। বৈভব ঐশী দুজনেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মা ভেতরের ঘরে বই নিয়ে। বই একমাত্র আশ্রয়। টুবু কেমন উশকো-খুশকো। বৈভব বলল ‘টুবু, এত দেরি?’
টুবু বলল না কিছু। লালচে চোখ মেলে একবার দাদার দিকে চাইল।
ঐশী বলল—‘কোথায় ছিলি টুবু?’
টুবু প্রথমে জবাব দিল না, তারপর আস্তে বলল— ‘রাস্তায়।’
—‘রাস্তায়?’
—‘রাস্তায়, রাস্তায়।’ বলল টুবু মুখ নিচু করে।
বৈভব হঠাৎ নিচু গলায় বলল— ‘টুবু, মা এখনও আছে।’ টুবু কেঁপে উঠল। সে মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে নিল, যেন কিছু একটা ফেলে দিতে চেষ্টা করছে মাথার থেকে। তারপর মায়ের ঘরের দিকে চলে গেল।
ঐশী বলল—‘দাদা, ওকে ওভাবে বললি?’
—‘ওকে একটু আঘাত দেওয়া দরকার ছিল।’
—‘আর কত আঘাত?’
—‘বুবু, ও ছেলেমানুষ হতে পারে, কিন্তু ও ছেলে, তাছাড়াও ও মানুষ। পাগলামি করাটা ওকে শোভা পায় না। এ কী করছে ও? আমি তো ঠিকই বলেছি, মা রয়েছে। মা-ই এখন বর্তমান। মায়ের কথা ভাবুক ও!’
৫
রাত দশটা নাগাদ ফোনটা আবার বাজল। আটটায় প্রথম বাজে। মিনু বলেছিল— ‘কে বলছেন, নাম বলুন, উনি এলে বলে রাখব।’। নটায় দ্বিতীয়বার বাজল। মিনু এবারও এক কথা বলল। ও পক্ষ নাম বলল না, শুধু রুক্ষ গলায় বলল— ‘কটায় ফেরেন?’ এ কথার কোনও জবাব মিনু স্বভাবতই দেয়নি। কত রকমের ফোন আসে, অচেনা-অজানা লোকের ফোন ধরতে হলেই তো হয়েছে। করবী আজ সাতটাতেই বাড়ি ফিরে এসেছে। আর ঠিক চারদিন পরেই নৈনিতাল যেতে হবে লোকেশন শুটিং-এ। আজকাল সে কাজ কমিয়ে দিচ্ছে। কোনও তৃপ্তি পাওয়া যায় না কাজ করে। থিয়েটারের ওপর কোনও আকর্ষণ নেই করবীর। যাত্রা তো নয়ই। ঘটনাচক্রে ফিলমের জগতে এসে পড়েছিল। ভাগ্য জোরে কিছু খুব ভাল ছবিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। তাই নাম, যশ, অজস্র সম্পদ। তবুও লেগে আছে। একটু ভাল মানের ছবি, ভাল পরিচালক পেলেই সে সম্মতি দেয়। তার কারণ একটাই। আর কিছু নেই যাতে মনোনিবেশ করতে পারে, আর কিছু নেই জীবনে। একজনও ভাল বন্ধু পর্যন্ত জোগাড় হয়নি। আছে অনেক পরিচিত ইতস্তত। সাধারণভাবে তাদের বন্ধু-বান্ধব বলা যেতে পারে। কিন্তু কেউ নেই যে তেমন করে সঙ্গ দেবে। যার সঙ্গে থাকলে জীবনটাকে জীবন বলে মনে হয়। আসলে সম্পর্ক ছাড়া জীবন হয় না। সম্পর্ক মানে পরিবার, আত্মীয়, কর্মক্ষেত্রের বন্ধু, বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত বন্ধু। এসব কিছুই যার হয়নি সে বড়ই দুর্ভাগা। করবী সেই দুর্ভাগাদের একজন। তার কেউ নেই। সত্যিকারের গভীর বন্ধুত্ব, সমঝোতা, এসবের স্মৃতি একটাই আছে একটাই মাত্র। দশটায় ফোন বাজলে মিনু যখন একই বাঁধা গৎ গাইতে যাচ্ছিল, কী মনে হল করবী ইশারা করল, মিনু বলল—‘এই মাত্র উনি ফিরলেন। কী প্রয়োজন বলুন।’
—‘প্রয়োজনটা ওঁকেই বলব সোজাসুজি।’ ওপাশ থেকে পুরুষকণ্ঠ বলল।
করবী ফোনটা ধরল, মধুমাখা গলায় বলল— ‘বলুন।’
—‘অংশুমান সেনগুপ্তর সম্পর্কে কোনও বিবৃতি দিচ্ছেন?’ সতর্ক হয়ে উঠল করবী।
—‘কেন বলুন তো? আপনার কী দরকার?’ ফ্রি-লান্স করে সেই ছেলেটির কথা মনে পড়ল। যদিও তার ভিক্ষুকবৃত্তি ভাল লাগেনি, তবু তার সেই মরিয়া অনুরোধ, কাতর চাউনি, ‘আর কাউকে দেবেন না, আমাকে ডাকবেন, আমাকে’ মনে পড়ল। করবী শুনতে পেল ওপারের কণ্ঠ বলছে,
—‘বান্টি আলুওয়ালিয়ার মতো কোনও বিবৃতি দেওয়ার আগে আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি।’
—‘মানে?’
—‘মানে, একজন নামী ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে বিকৃত রুচির গপ্পো ফাঁদতে আপনাদের প্রবৃত্তি হতে পারে, কিন্তু আমাদের শুনতে প্রবৃত্তি নেই। বুঝলেন?’
—‘কী বললে? কে তুমি? কে আপনারা? স্পর্ধা তো কম নয়?’ করবী আত্মসংযম হারিয়ে ফেলেছে।’
—‘যা বললাম, তা শুনেছেন। আমরা কে? আমরা ভদ্রলোকের বাড়ির ছেলে, কিন্তু নোংরামির বিরুদ্ধে দাঁড়াবার স্পর্ধা রাখি।’ ফোনটা স্তব্ধ হয়ে গেল।
করবী তখনও বলে চলেছে—‘কী করবে তোমরা আমার? কী করবে?’
ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে করবী পাশের সোফাটায় বসে পড়ল। রাগে তার সর্বাঙ্গ কাঁপছে। কে এরা? দুটো তিনটে কণ্ঠ কথা কইছিল। একবার এ ধরছে, একবার ও ধরছে! মানে কী এর? কী দুঃসহ স্পর্ধা! ‘মিনু! মিনু!’
মিনু বলল— ‘অত জ্ঞানহারা হলে চলবে কী করে? নিশ্চয়ই সেই একই লোক। আটটায় করল, নটায় করল।’ কেন কী বৃত্তান্ত মিনু শুনতে চাইল না। সেটা তার এক্তিয়ারের বাইরে। তবে করবী যদি নিজে থেকে কিছু বলে অবশ্যই সে কান পেতে শুনবে। মতামত চাওয়া হলে, দেবেও। এই সমস্ত সীমারেখাগুলো মেনে চলতে পারে বলেই মিনু মিনু হতে পেরেছে।
—‘আমি কার সম্পর্কে কী কথা বলব, ঠিক করে দেবে বাইরের লোকে? রাত দশটার সময়ে চোখ-রাঙানি ফোন করে?’ করবী ফুঁসতে ফুঁসতে বলল। যেন জামাইবাবুর সামনে পড়েছে। মানুষটা তাকে অপমান করছে, আর দিদি তার জবাব দিচ্ছে। অনেকদিন পর করবীর এইরকম আপাদমস্তক রাগী চেহারা দেখতে পেল মিনু। সে অপেক্ষা করে আছে যদি দিদি আর কিছু বলে, কিন্তু করবী আর কিছু বলল না, দৃপ্ত ভঙ্গিতে রানির মতো চলে গেল লাইব্রেরির দিকে। ইদানীং দিদির পড়ার ঝোঁক হয়েছে খুব। আগেও পড়ত, নানান রকমের পত্রিকা। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক। কিন্তু এখন মোটা মোটা বাংলা ইংরিজি বই খুলে বসে থাকে করবী— ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
মিনু নিজের কাজে চলে গেল। কার সম্পর্কে কথা বলা নিয়ে এত বাগ্বিতণ্ডা হচ্ছে?
করবী তার হেলান চেয়ারে বসে পিঠের কুশনটা ঠিক করে নিল। তারপর চেয়ারের পাশে টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিল বইটা। এই উপন্যাসটার নাম ‘হে নবীনা’। একজন পুরুষ ক্রমশ প্রৌঢ়ত্বের শেষ ধাপটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ তিনি আবিষ্কার করলেন তিনি জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, একমাত্র যখন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্কদের সঙ্গে কাজকর্ম, চলাফেরা, গল্পস্বল্প করেন, যারা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় না তাঁর বয়স হয়ে যাচ্ছে, তখনই তিনি জীবিত বোধ করেন। উপন্যাসটার মধ্যে কতকগুলো ভিন্ন ভিন্ন স্তর আছে। খানিকটা দার্শনিক, কিছুটা রোম্যান্টিক। ‘হে নবীনা’ বলতে যদিও অংশুমান চিরনবীন প্রকৃতি-শক্তিকে বুঝিয়েছেন, তবু করবী বুঝতে পারে সেই প্রকৃতির প্রতিনিধি হিসেবে যে ‘কল্পা’ নামে মেয়েটিকে তিনি বিশেষভাবে উপস্থিত করেছেন সে করবী। যে সব কথা করবীকে বলতেন, যে অপূর্ব রোম্যান্স নিয়ে তার জীবনে অংশুমান এসেছিলেন, সে সব ‘হে নবীনা’র পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে। উৎসর্গ-পত্রে কার নাম? আগে দেখেনি সে। এখন কৌতূহল হতে পাতা উল্টে দেখল। ‘চিরসাথী অহনাকে।’ হঠাৎ সমস্ত শরীর জ্বলতে লাগল করবীর। এ বই দেওয়ার কথা ছিল করবীকে। একমাত্র করবীকে। করবীকে উৎসর্গ করলে, বইটার মধ্যে আগাগোড়া যে একটা রহস্য-বলয় আছে, সেটা ভেদ করতে অসুবিধে হত না। যে তোমাকে প্রেরণা দিল, যে তোমার এই বিখ্যাত উপন্যাসের সমস্ত ডিটেল জুগিয়েছে, তাকে উৎসর্গ করতে তোমার বেধে গেল কেন অংশুমান? ছলনা? ছলনার আশ্রয় নিয়েছ? কার কাছে? কার জন্য? জেনে রেখো অংশুমান, সমালোচক তোমায় ছেড়ে দেবে না। আজকাল কোনও শিল্পীকে আর মেঘলোকের মানুষ করে দেখা হয় না। তাকে টেনে নামিয়ে সে সারাটা দিন কখন কখন বাথরুমে যেত, স্ত্রীকে বকাবকি করত কি না, কে তার চৌকাঠের ওধারে শুয়ে থাকতে চেয়েছিল, কতবার বউ-এর হাতে ধোঁকা খেয়েছে— এসব আজকাল জানতে চাওয়া হয়, জানা হয়। তারপর, সেই কঠিন উলঙ্গ তথ্যের আলোতে বিচার হয়। নতুন করে বিচার হয় সব। এলিয়ট ফ্রিজিড ছিলেন, প্রুস্ত কোথায় কী পোশাক পরতে হয় জানতেন না, অডেনের ছাত্রজীবনে সমকামে ঝোঁক ছিল, পোপকে কোনও মেয়ে পাত্তা দেয়নি এ সমস্ত খুঁজে খুঁজে খুঁড়ে খুঁড়ে বার করা হয়েছে। অনেকে তো নিজেরাই নিজেদের সবরকম কীর্তি-অপকীর্তির কথা সাফ সাফ বলে যায় যেমন রুসো, টলস্টয়, নেরুদা। কিন্তু হার্ডির মতো আলমারির কংকাল লুকোতেও অনেকে তো প্রাণপাতও করে। বিশেষত এদেশে। কিন্তু থাকবে না। কিছু লুকোনো থাকবে না অংশুমান। যে যখন যা তথ্য চাইবে আমার কাছে, সব দিয়ে দেব। তুমি সামান্যতম স্বীকৃতিও আমাকে দাওনি। রাজনৈতিক নেতারা যেমন ছেলের নামে ব্যবসার কথা, কি রক্ষিতার কথা সাবধানে লুকিয়ে রাখে তেমনি করে আমাকে লুকিয়ে রেখেছ। অথচ আমি কোনওদিন তোমার কাছ থেকে কোনও মূল্য নিইনি। তুমি আমার জীবনকে, আমাকে মূল্যবান মনে করেছিলে বলে। তোমাকে আমি কিছুই দিতে বাকি রাখিনি অংশুমান। তোমাকে নবীন করতে, উজ্জীবিত, উদ্দীপিত করতে যা কিছু প্রয়োজন। কেউ জানে না সেসব কথা। অভিজ্ঞ অপরাধীর মতো নিজেদের পায়ের ছাপ, হাতের ছাপ মুছে মুছে ফেলেছি সব সময়ে। তখন মনে করতাম আমার জন্য করছি। আমার বিখ্যাত মুখ, আমার জনপ্রিয়তা। আমার পেছনে জোড়া-জোড়া কৌতূহলী চোখ। তাই। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি চতুর তীরন্দাজ তুমি এ সমস্ত ব্যবস্থা দেখে গোপনে হাসতে। এক ঢিলে দুই পাখি মারা হত, চমৎকার!
আর বসে থাকতে পারল না করবী। কী অসাধারণ এই উপন্যাস ‘হে নবীনা।’ কিন্তু কী জ্বালাময় বৃশ্চিক দংশন এখন এর পাতায় পাতায়। যা আমি প্রেম বলে দিয়েছি, বন্ধুত্ব বলে দিয়েছি, তা কি তুমি গোপন রোগের গোপন ইনজেকশনের মতো গ্রহণ করেছিলে? প্রাণের মধ্যেকার সুধা হিসেবে নাওনি? তাহলে তো বান্টির বিবৃতিও সত্য হওয়া অসম্ভব নয়! সুধা যদি না-ই চাও তাহলে কোনও সুধাশ্যামলিম পারে যাওয়াও তোমার হবে না অংশুমান। মনে মনে দংষ্ট্রা শানিয়ে ক্ষিপ্তের মতো বলল করবী।
মিনু দুবার ঘুরে গেল। ক্ষুধাবোধ নেই আজ করবীর। মিনুর দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।
ভয়ে ভয়ে অবশেষে মিনু বলল— ‘দিদি খাবে না?’
করবী উত্তর দিল না। ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে আছে। অর্থাৎ কথাটা শুনছে, মাথায় পৌঁছচ্ছে না। এরকম অবস্থা খুব মাঝে মাঝে হয় করবীর। কোনও সর্বগ্রাসী অপমানে বা সর্বগ্রাসী চিন্তায় তার স্মৃতি হারিয়ে যায়। চারপাশে কী ঘটছে সে বুঝতে পারে না। মিনু ভয়ে ভয়ে আবার ফিরে গেল। দুধটা ঠিক করল। একটু চিন্তা করল দুধের মধ্যে ওষুধ দিয়ে দেবে কি না। না। ভীষণ বিপজ্জনক অভ্যাস হবে সেটা। এই ধরনের মহিলাদের জীবনে কখন কী মেজাজ আসে কিছু বলা যায় না। তখন মিনুর এরকম অভ্যাস ছিল জানা গেলে বিপদ হতে পারে। সে দুধের পাত্রটা ট্রের ওপর বসিয়ে আস্তে আস্তে লাইব্রেরির দিকে গেল। —‘দিদি ঘুমোতে যাবে না? তোমার দুধ এনেছি।’ সাহস করে একটু জোর গলায় বলল মিনু।
করবী মুখ তুলে তাকাল—‘বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে ওষুধগুলো এনে দে।’
হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মিনু। ওষুধের পাতাগুলো এনে দাঁড়িয়ে রইল। ওষুধ খাওয়া, দুধ খাওয়া, জল খাওয়া সব শেষ হলে , বলল— ‘শোবে চলো। এখন করবী শোবে। মিনু মাসাজ করবে। সপ্তাহে চার দিন সে এটা করে ডাক্তারের নির্দেশে। শিখে নিয়েছে। খুব ভাল কাজ দেয়। অন্যদিন ঘুমোতে খুব দেরি হয় করবীর। কিন্তু মাসাজের দিনে সে অনেক আগে ঘুমিয়ে পড়ে। আজকে দিন নয়। তবু মিনু ঠিক করল আজ মাসাজ করতে হবে। করবীর দিনক্ষণ খেয়াল না থাকলেই ভাল।
ঘরে নীচের দেওয়ালের কোনও লুকোনো অংশ থেকে মৃদু আলো ছড়িয়ে পড়েছে। করবী নিজেকে মিনুর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। সম্পূর্ণ সমর্পণ। মিনুর নিপুণ আঙুলগুলো তার শরীরের সব বিশেষ বিশেষ স্নায়ুসম্মেলনের জায়গাগুলোতে চাপ দিতে দিতে সংবাহন ক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। হাতে সামান্য তৈলাক্ত ক্রিম। তার পাকস্থলীর মধ্যে কবোষ্ণ সুগন্ধ দুধ ঘেরাফেরা করছে। মাথার মধ্যে ওষুধের ক্রিয়া। করবী নিমজ্জিত হয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। না, ঘুমে নয়। এক অদ্ভুত স্বপ্নে। স্বপ্নও নয়, ইচ্ছাপূরণের খেলায়।
সামনে দীর্ঘদেহী, সুদর্শন পুরুষ এক। করবীর সামনে সে নতজানু হল।
—‘আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক সে কি অপরাধ?’
—‘না তো!’ পুরুষের মুখে হাসি।
—‘তাহলে পায়ের ছাপ মুছতে অত ব্যস্ত কেন? এমন কি প্রেতের টেলিফোন পর্যন্ত?’
পুরুষের মুখ কুঁকড়ে যাচ্ছে।
করবীর নির্দেশ পুরুষের পিঠের ওপর শপাঙ করে বেত্রাঘাত হল। এক, দুই, তিন কিন্তু স্বপ্নের চরিত্রের পিঠ থেকে সব সময়ে রক্ত পড়ে না।
—‘আমার পদচিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে তোমার পায়ের ছাপও তো মুছেছে। সেটা কি তোমার লাভ নয়?’ অবিচলিত পুরুষ বলছে।
—‘তখনকার মতো লাভ ছিল। তখন চোখ, ক্যামেরা, কলম অনুসরণ করত। মাটি হয়ে যেত সব। এখন আর লাভ নেই। ক্ষতি হয়ে গেছে। যাচ্ছে।’
—‘কেন?’
—“কেন?” তুমি জানো না “হে নবীনা”র নায়িকা কে? জানোনা “শঙ্খমালা”য় কার মুখ এঁকেছ? কার প্রেরণায় “ক্ষমা নেই। ক্ষমা নেই”! জানো না সাহিত্যের প্রেরণা হওয়ার সম্মান এক দুর্লভ সম্মান! জানো না যারা আমাকে শুধু একজন সুন্দরী, সুদক্ষ অভিনেত্রী অর্থাৎ পরিচালকের বাধ্য মেয়ে বলে জানে তারা দেখত অনেক গভীর, গাঢ় জীবন রসে, জীবনচেতনায় মগ্ন আমি, কবির সহমর্মিণী! এ গৌরব আমার প্রাপ্য নয়! কেন যা আমার প্রাপ্য তা স্ত্রীকে দিয়ে যাচ্ছ?’
—‘সে কী?’
‘—তা না তো কী? উৎসর্গ করেছ অহনাকে, চিরসাথীকে। তার মানে কী?’
—‘তাতে কী আসে যায়। যা তোমার তা তোমারই যা তার তা তারই থাকবে।’
—‘অত সহজ নয়। কামোফ্লাজ। আগাগোড়া তুমি সবাইকার সঙ্গে ছলনা করে গেছ। ছলনা! চালাকি! ফাঁকি! বিশ্বাসঘাতকতা! কৃতঘ্ন! জুয়াচোর!’
করবী চমকে জেগে উঠল। বাইরে আকাশের গায়ে তারা দেখা যাচ্ছে অগণিত। আকাশটা আশ্চর্য নীল। ঘড়িতে রাত তিনটে বেজে পাঁচ। আর একটু পরেই যাকে বলে ব্রাহ্ম মুহূর্ত। কৌশিক গুহ? গুহই তো, না নিয়োগী! সেই ছেলেটির নাম! কার্ড রেখে গেছে, রাত্রিবাস লুটোতে লুটোতে জাগ্রত এক আর্টেমিসের মতো লাইব্রেরি ঘরে গেল করবী। ড্রয়ার খুলে কার্ডটা বার করল। টু সেভেন ফোর জিরো নাইন ফাইভ। বসার ঘরে গেল। ‘নম্বর টিপল। টু সেভেন ফোর জিরো নাইন ফাইভ। রিং হচ্ছে। অনেকক্ষণ। ঘুম ঘুম গলায় কে ধরেছে।
—‘কৌশিক গুহর সঙ্গে কথা বলতে পারি?’
—‘ওকে তো…ও তো আমাদের স্টাফ নয়! সকাল দশটায় আসবে খবর দিয়ে দেব। কী নাম বলব?’
—‘করবী চ্যাটার্জি।’ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল ও পাশের লোকটি।
—‘করবী চ্যাটার্জি, মানে করবী দেবী, মানে ইয়ে…’
ততক্ষণে করবী ফোন রেখে দিয়েছে।
ভোরের মায়াময় আলোয় করবী ধীরে ধীরে বারন্দার দিকে এগিয়ে গেল। কতদিন সূর্য ওঠা দেখা হয় না। আজ উষা অনাবৃত করুক তার আবরণ। সূর্য উঠুক তার আপন চেহারায়। সৌর কলঙ্ক সে কী রকম? কলঙ্কও শোভা। করবী চ্যাটার্জি, ন তাত, ন মাতা, ন বন্ধু, ন ভ্রাতা, ন পতি, ন কন্যা করবী চ্যাটার্জি। কোনও বলবার মতো পরিচয় নেই। কোনও পরিচয়ে কোনও প্রাপ্তি, কোনও আনন্দ নেই। আনন্দ রূপে যে করবী বিভালাভ করবে সে বরেণ্য সাহিত্যিক অংশুমান সেনগুপ্তর জীবনাংশু। আদিত্যপ্রভা। তাঁর সাহিত্য-জীবনের শেষ পনেরো বছর অন্তত তাঁর সমস্ত প্রেরণা, সমস্ত উজ্জীবন তিনি গ্রহণ করেছিলেন এই অসামান্য উর্বশীর কাছ থেকে। উপন্যাসের পর উপন্যাসে এই গভীর সম্পর্কের কথা নানা ভাবে, নানা ছলে বলা আছে।
সূর্য দিগন্তের সামান্য ওপরে। এখনও লাল আঙরাখা পরে। কাংস্যোজ্জ্বল হতে বেশ দেরি, মিনু এসে বলল— ‘দিদি একটি ছেলে এসেছে। দেখা করতে চায়।’
—‘নিয়ে এসো এখানে। আগে আমার জ্যাকেটটা দিয়ে যাও।’
মিনু অবাক হয়ে গেল। এখন ভোর পাঁচটার কাঁটা সবে ছাড়িয়েছে। প্রথমত দিদি এত সকালে উঠে বারান্দায় আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা দেখছে। দ্বিতীয়ত এত ভোরে অতিথি। এবং দিদি এক কথায় তাকে আসতে বলে দিচ্ছে।
জ্যাকেট পরে প্রস্তুত হয়ে করবী বসেছে। ঠিক কয়েক দিন আগেকার মতো। এক মহিমময়ী দেবীমূর্তি। সেদিন উদাসীন, প্রস্তরবৎ ছিল। আজ দণ্ড হাতে আর্টেমিস। আবার একই সঙ্গে কোন গভীর গোপনে মুগ্ধনয়ান-পেতে-আছি-কান আফ্রোদিতে।
—বলিষ্ঠ পায়ে ঘরে ঢুকল যুবক। পায়ের দিকেই প্রথমে চোখ পড়েছিল। কৌশিক গুহর মতো যেন নয় পা-জোড়া। সোজাসুজি চামড়ার চপ্পল পায়ে, মসৃণ পায়ের পাতা। কৌশিক গুহ আজকালকার ফ্যাশনের স্পোর্টসওয়্যার পরে যেন! করবী মুখ তুলে তাকাল। তাকিয়েই সে চিত্রার্পিত হয়ে গেল।—‘কে? কে তুমি?’ সে যেন কোনও অশরীরীকে এইমাত্র রূপ পরিগ্রহ করতে দেখছে।
—‘আ… আমি মৈনাক সেনগুপ্ত… অংশুমান সেনগুপ্তর ছেলে।’
ভাগ্যিস বলল! না হলে এই সদ্যফোটা ভোরের আলোয় মনে হতে পারত মৃত্যুর পরে পরলোক থেকে যৌবন ছিনিয়ে নিয়ে অংশুমান আবার অবতীর্ণ হয়েছেন ইহধামে। যযাতির মতো আরও একটা পুরো জীবন। অংশুমান কোনওদিন তাঁর ছেলে মেয়ে স্ত্রী কারও কথা বলতেন না, আলোচনা করতেন না করবীর সন্নিধানে। করবীরও কোনও কৌতূহল ছিল না। মৈনাক নামে যুবক না কি কিশোর? কিশোরটির চোখ দুটি আরক্ত। ফর্সা মুখ যেন নীলচে হয়ে আছে। করবী বলল— ‘বসো।’ সামনে পিঠঅলা চেয়ার ছিল। কিন্তু মৈনাক একটা মোড়ায় বসল। সোজা হয়ে। সোজা হয়ে বসা সত্ত্বেও মনে হতে লাগল সে ভেঙেভেঙে যাচ্ছে।
—‘কী ব্যাপার বলো?’ করবী অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে এইটুকু বার করতে পারল। সে এখন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে ওই কিশোর অংশুমানের দিকে। আর্টেমিস এখন পুরোপুরি আফ্রোদিতে। বলিষ্ঠ অথচ নরম, পৌরুষব্যঞ্জক অথচ সুকুমার, কমনীয়-এ রূপ একমাত্র কৈশোরই পায়। আর কেহ পায় না তাহাকে।
মিনু খাবার এনে রেখেছে। —‘খাও’। করবী বলল। খবরের দিকে তাকাল না মৈনাক। সে সম্বন্ধে কোনও কথাও বলল না। অনেক চেষ্টা করে যেন বলল শুধু—‘আপনি… বাবাকে… চিনতেন?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘আমার বাবা… উনি… কেমন ছিলেন?
থেমে থেমে কথাগুলো শেষ করল মৈনাক।
—‘আমার কাছে জানতে চাইছ? তুমি তো ওঁর ছেলে। জানো না?’
—‘জানি, জানতাম… বাবাকে জানতাম। অংশুমান সেনগুপ্ত… সাহিত্যিক… তাঁকে হয়তো জানতাম না। আপনি বেশি জানেন।’
করবী হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠল। বলল— ‘তুমিই কি কালকে ফোন করেছিলে?’
—ফোন? আমি? না তো?’ আয়নার মতো চোখে অকপট বিস্ময়। ‘কী ফোন? কী জন্য?’
—অবহেলার সঙ্গে করবী বলল— ‘তেমন কিছু না। জানতে চায়। ছাপতে চায় বোধ হয়।’
সোজা হয়ে বসল মৈনাক। —‘আপনি কী বলবেন?’
—তোমায় সেটা বলতে হবে কেন? করবী যথাসম্ভব ভাবলেশহীন গলায় বলল।
—‘বলতে হবে না। কিন্তু যদি বলতেন! জীবন মৃত্যুর প্রশ্ন এটা। বলে হঠাৎ ঝাঁকড়া-চুল ছেলেটি মুখ নিচু করে ফেলল।
—‘কী বলছ?’
—‘যা বলছি তা আমি জানি। কাগজে কদিন আগে যে ধরনের বিবৃতি বেরিয়েছে, তাতে… মানে আমরা কাগজটা সাবধানে মায়ের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছি। আমার বাবা… মানে বাবাকে আমি’ থেমে যাচ্ছে মৈনাক, গলার কাছে পিণ্ড উঠে আসছে। করবী অপেক্ষা করছে। … ‘আমি ভগবানের মতো দেখতাম, মা বাবাকে … বাবাকে…’ মৈনাক থেমে গেল। তার বুকে যেন কেউ গুলি চালিয়ে দিয়েছে, এমনি যন্ত্রণার কাটাকুটি, রক্ত তার মুখে। সে আর বলতে পারছে না। হঠাৎ বুক পকেট থেকে সে একটা ছবি বার করে করবীর দিকে বাড়িয়ে দিল, বলল— ‘এই যে, মা।’ যেন করবী সেটা চেয়েছিল। ছবিটা হাতে নিয়ে একজন প্রৌঢ় মহিলাকে সে দেখতে পেল। অংশুমানের মৃত্যুর পর এঁর ছবি কিছু কিছু দেখেছে কাগজে। কিন্তু এটা যেন অন্যরকম। কীরকম শান্ত, আত্মস্থ, কল্যাণময় ‘—বাবা চলে যাওয়ার পরে মা এতদিন কথা বলেননি। মা-ও চলে যাচ্ছিলেন। এসব এ বিবৃতি, আপনারটা পড়লে মা আর’ উদগত কান্না যেন গিলে নিল মৈনাক। অনেক ক্ষণ চুপচাপ।… ‘মা না থাকলে বাবা আজ যা হয়েছেন, হতে পারতেন না। অনেক অনেক লড়াই সেসব।’ কিছুক্ষণ চুপ। করবী বলল— ‘আমি বিবৃতি দিলে তোমার মা কষ্ট পাবেনই এ কথা ভাবছ কেন?’
—‘আর কী-ই বা আমাদের আশা করার আছে? যা বেরিয়েছে তার পর?’ মৈনাক একবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল করবীর দিকে, তার পর চোখ নামিয়ে নিল। করবী একটু রুক্ষ সুরে বলল —‘কী ভেবেছ কি তুমি আমাকে?’
মৈনাক কিছু বলছে না। করবী আদেশের স্বরে বলল—‘যাও বাড়ি যাও।’
খাবারগুলো যেমন ছিল অস্পৃষ্ট পড়ে রয়েছে। মৈনাক চলে গেছে। করবী চেয়ার হেলান দিয়ে চোখ বুজে যেমন পড়েছিল তেমনই। ব্রেকফাস্টের সময় পেরিয়ে গেল। মিনু দু একবার এসে ফিরে গেল। অসময়ে দিদি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চয়ই রাত্রে অত ওষুধ, অত সংবাহনের পরও ঘুম হয়নি। রোজকার মতো ভোরেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সকাল গড়িয়ে চলেছে।
ঠিক এগারোটার সময়ে ভীষণ ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কৌশিক গুহ এল। হাতে মস্ত ব্যাগ। ভেতরে ক্যামেরা টেপ রেকর্ডার। সে দাড়ি কামাবার সময় পায়নি। মিনু তাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। সে বারবার বলছিল— করবী দি তাকে নিজে ফোন করে আসতে বলেছেন। রোদে সমস্ত বারান্দাটা টই-টম্বুর। করবী এলিয়ে বসে। সাদা আঙরাখার প্রান্ত মেঝের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে। রেডি? ঘাড় হেলিয়ে সে জানাল রেডি.। দুটো স্ন্যাপ নিল কৌশিক।
প্রথম প্রশ্ন : ‘অংশুমান সেনগুপ্তকে আপনি কবে থেকে চিনতেন?’
উত্তর : ‘আলাপ হয় “অন্তবিহীন”-এর সেটে। সেই প্রথম আমি ওঁর লেখা উপন্যাসের চিত্ররূপে নায়িকার কাজ করি।’
দ্বিতীয় প্রশ্ন : ‘তার পর?’
উত্তর : ‘তারপর গত পনের বছর ধরে খুব সুন্দর একটা সখ্য গড়ে ওঠে আমাদের।
উনি প্রধানত ওঁর লেখার কথা বলতেন, বিশেষত আমি জিজ্ঞেস করতাম বলে। আমার খুব কৌতূহল ছিল। লেখকদের সম্বন্ধে।’
প্রশ্ন :—‘অনেকে বলে— “হে নবীনা”র কল্পা আপনি এবং নায়ক লেখক স্বয়ং। এ সম্বন্ধে আপনার মত?’
উত্তর : —‘আমি গ্রন্থ সমালোচক নই। বলতে পারব না। তবে ওঁর সব নায়িকার মধ্যে কোথাও না কোথাও অহনা দেবীর একটু ছোঁয়া থেকে যায়।’ অবাক হয়ে করবীর দিকে তাকিয়েছে কৌশিক গুহ। এটার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না।
প্র : ‘করবী দেবী আপনি একটা ঐতিহাসিক মন্তব্য করলেন সেটা বুঝতে পারছেন কি? এটা দলিল হয়ে থাকবে।’
উত্তর (অত্যন্ত অবহেলার সঙ্গে) ‘—ঐতিহাসিক? ছায়া ছবির একজন অভিনেত্রীর মন্তব্য যদি সাহিত্য-সমালোচনার এলাকায় দলিলের মর্যাদা পায় তো সে আমার সৌভাগ্য। তবে সৃজনের ব্যাপারটা অত সরল নয়, অংশুমানই বলতেন। জীবনে দেখা সমস্ত উপকরণ মিলে মিশে একটা অন্যতর রূপ নেয় শিল্পে। তার মধ্যে তথ্য থাকে না সত্য থাকে। রাইট?’
হতাশ গলায় জিঘাংসা মিশিয়ে কৌশিক তার তুরুপের তাস বার করল। ছেলেমানুষ হতে পারে। কিন্তু সে-ও জার্নালিস্ট। বাঘের বাচ্চা বাঘই হয়।
‘অষ্টআশিতে কেদারের পথে শূটিংএর শেষে আপনারা দুজনে পিছিয়ে পড়েছিলেন। প্রায় চার ঘণ্টা পর আপনাদের খুঁজে পাওয়া যায়। ওই ঘটনাটা বলবেন?’
হিংস্র কণ্ঠে করবী বলল— ‘আপনি যদি পাহাড়ে গিয়ে থাকেন তো বুঝবেন পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখবার জন্যে শুধু চোখ নয়, সাহসও দরকার হয়। অনেক সময়ে ঝুঁকি নিতে হয়। নইলে পাহাড় ধরা দেয় না। যদ্দূর মনে পড়ছে রামস্বামী বলে একজন ক্যামেরাম্যান আর নীলেন্দু বলে কেটারারের একটি ছেলেও ওই রকম পিছিয়ে যায়।’
কৌশিক গুহ ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বলল, ‘নিজে থেকে যা ইচ্ছে হয় সেটুকুই বলুন।’
—‘অংশুমানের মতো প্রতিভা বিরল। তাঁর সংলাপ, তাঁর চিত্রনাট্য এসব অভিজ্ঞতার পর অন্য কারো সংলাপ বলা, আর কোনও চিত্রনাট্যে কাজ করা আমার কাছে বিরক্তিকর বলে মনে হয়। ভীষণ সমঝদার, সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। আমার যে দাদা আজ পনেরো ষোলো বছর হল মারা গেছেন, তাঁকেই যেন ফিরে পেয়েছিলাম তাঁর মধ্যে। তাঁর হাতেই আমার প্রকৃত শিক্ষা।’
—‘বান্টি আলুওয়ালিয়ার বিবৃতি সম্পর্কে আপনার কী মত?’
—‘আগের দিনই তো বলেছি, বান্টি একজন সাক্ষী দাঁড় করিয়ে রাখলে পারত সে রাত্রে’— অবহেলার সঙ্গে উচ্চারণ করল করবী, ‘তাছাড়া উনি খুব রুচিমান মানুষ ছিলেন।’ তার গলায় ডবল দাঁড়ি উপলব্ধি করতে পেরে যন্ত্র বন্ধ করে দিল কৌশিক।
খুব উজ্জ্বল মুখে তার দিকে চেয়ে করবী বলল— ‘এক্সক্লুসিভ ইনটারভিউ। শুদ্ধু আপনার কেরিয়ারের কথা ভেবে। ’ তারপর চলে যেতে যেতে ঘাড় ফিরিয়ে প্রায় জিভের ডগা থেকে টুসকি মেরে ছুঁড়ে দিল— ‘খুশি?’