ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই
ভাববাদ অনুসারে মানুষের মাথা নেই, তবু বুদ্ধি আছে । কথাটা লেনিনের । আজগুবি শোনালেও উপায় নেই, কেননা সহজ কর্মজীবনের কাছে যা আজগুবি ভাববাদ তাকে ভয় করে না । এই মতবাদ অনুসারে বুদ্ধির অতিরিক্ত বাস্তব বস্তু কোথাও কিছু থাকতে পারে না, তাই মানুষের মাথাও নয়। শুধু বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা বা চিন্তা–যে নাম দিয়েই তার বর্ণনা করা যাক না কেন–সবচেয়ে চরম সত্য। ফলে মাথা নেই, তবু বুদ্ধি আছে। লেনিন বলছেন, এ-যেন এক মাথাহীন দর্শন ।
অথচ, দর্শনের ইতিহাসে এমনই রহস্য যে, মাথা বলে কোনো পদাৰ্থ এই মতবাদ অনুসারে বাস্তব না হলেও একে দেখতে লাগে শুম্ভ-নিশুম্ভের সেই পৌরাণিক সেনাপতির মতো-যার মাথা কেটে ফেললেই মরণ হয় না, কাটা মাথা থেকে ছিটকে-পড়া প্ৰত্যেক রক্তবিন্দু জন্ম দেয় এক একটি সমতুল্য দৈত্যের ।
ভাববাদের এই অদ্ভূত লীলাখেলাকে বর্ণনা করতে বসলে দেশ-বিদেশের নানান পৌরাণিক উপাখ্যান মনে ভিড় করতে চায় ; মনে হয় ভাববাদ বুঝি মিশরের সেই পাখি, যুগে যুগে নিজের ভস্মাবশেষ থেকে যে লাভ করে নবজন্ম ; মনে হয় মৃত দেবতার পুনরুজ্জীবন-কাহিনীতেও অবাক হবার কিছু নেই, কেননা দর্শনের পূত মন্দিরে আপাত তেত্ৰিশ কোটি দেবদেবীর মধ্যে যার উপাসনা প্ৰায় তৈলধারার মতো অবিচ্ছিন্ন, তারও মৃত্যুতে জীবনের পরিসমাপ্তি নয়, নবজীবনের সংকেত ।
কেননা, ভাববাদকে বহুবার বহুভাবে খণ্ডন করা হয়েছে। তবুও মরণ হয়নি তার। বরং যাঁরা চণ্ডবিক্রমে একে খণ্ডন করতে এগিয়েছিলেন, তাঁরাই শেষ পর্যন্ত এর মহিমায় পঞ্চমুখ। শুনতে অবাক লাগে, কিন্তু আগেই বলেছি, আজগুবিকে ভিন্ন করলে, আর যাই হোক, ভাববাদকে বোঝবার জো থাকবে না ।
ভাববাদের যেটা মোদ্দা কথা, সহজ বুদ্ধির সঙ্গে সত্যি যে তার মুখ-দেখাদেখি নেই, আর নেই বলে বর্কালির মতো ভাববাদীকে মাথা খুঁড়ে মরতে হয় ভাববাদের সঙ্গে সহজবুদ্ধির সংগতি প্ৰাণপণে প্রমাণ করতে। সহজবুদ্ধির সাধারণ মানুষ মনে করে স্ত্রী-পুত্র-পরিবার নিয়ে তার সংসার। কিন্তু ভাববাদী বলবেন, সংসার কোথায় ? আছে তো শুধু সংসারের ধারণা। এদিকে, ধারণার দৌলতে সত্যিই সংসার চলে না : পকেট-বোঝাই ধারণাকে উজাড় করে দিলেও মেছুনী এক টিকলি মাছ দেবে না, কিংবা ফাকা দু’নম্বর বাসের ধারণায় চেপে সাড়ে পাঁচটার সময় অফিস-ভাঙা ভিড় এড়িয়ে আরামে বাড়ি ফেরা, হায়, অসম্ভব । উত্তরে ভাববাদী বিরক্ত হয়ে বলবেন, আসলে মাছটাও যে মাছ নয়, বাড়িটাও বাড়ি নয়, মাছের আর বাড়ির ধারণামাত্র । কিন্তু সহজ মানুষ একেবারো যেন নাচারী-মাছের ধারণা খেয়ে পেট নাকি কিছুতেই ভরে না ! ভাববাদী মাথা না মানলেও এমনতর বেয়াদপির কথা শুনে নিশ্চয়ই মাথা গরম করে বলবেন-আসলে পেট বলে জিনিসটেও যে সত্যি নয়, আর পেট ভরানো বলে ব্যাপারটাও যে নেহাত স্থূল কথা, যাকে ধ্রুব সত্য বলা যায়, তা শুধু পেটের ধারণা আর পেট ভরানোর ধারণা ! এহেন চরম জ্ঞানের কথা শুনেও মানুষের মাথা যদি শ্ৰদ্ধায় নুয়ে না পড়ে, তাহলে সন্দেহ করতে হবে যে, ভাববাদীর রকম-সকম দেখে মাথা বলে জিনিসটা সম্বন্ধেই সে শ্ৰদ্ধা হারিয়েছে ।
তাই বলে সমস্ত যুগের সমস্ত দার্শনিকই যে ভাববাদীর এ-সব কথা মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন, তাও মোটেই সত্যি কথা নয়। দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদ সম্বন্ধে উৎসাহ যতখানি, ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহ বুঝি তার চেয়ে কম নয়। অনেকবার অনেক দার্শনিক ভাববাদকে খণ্ডন করতে চেয়েছেন । কিন্তু, যেটা সবচেয়ে আশ্চৰ্য কথা, শেষ পৰ্যন্ত তাঁরা নিজেরাই ভাববাদের দীক্ষা নিলেন এবং বিধর্মে দীক্ষিত হবার পর যেন হয়ে দাড়ালেন এক একটি মূর্তিমান কালাপাহাড়,–ভাববাদেরই চরম নৃশংস প্রচারক। ভাববাদ তাই মরেও মরে না, যমালয় থেকে ফিরে আসে নতুন বর নিয়ে, নচিকেতার মতো । একদিকে ভাববাদকে তীব্র, তীক্ষ্ণ আক্রমণ, অপরদিকে সেই ভাববাদের কাছেই করুণ আত্মসমৰ্পণ । এ-কথা যে-সব দার্শনিকের সম্বন্ধে সত্য, তাদের “দুর্বলচেতা” বলে উড়িয়ে দিতে যাওয়া নেহাত আত্মপ্ৰবঞ্চনা হবে । কেননা, দর্শনের ইতিহাসে তাঁরাই হলেন দিকপাল-বিশেষ। স্বদেশে শঙ্কর, প্ৰাচীন গ্রীসে সক্রেটিস, আধুনিক যুরোপে কাণ্ট এবং সাম্প্রতিক যুগে অভিজ্ঞতাবিচারবাদীদের (Empirio-Critics) থেকে শুরু করে প্রয়োগবাদী (Pragmatists), বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী (Realist) ) পৰ্যন্ত-যুগে যুগে এঁরাই তো যুগান্তকারী দার্শনিক বলে স্বীকৃত । অথচ এঁরা সকলেই প্ৰবল উৎসাহে ভাববাদকে খণ্ডন করার পর প্রবলতর উৎসাহেই ভাববাদের মাহাত্ম্যে মেতে উঠেছেন ।
আচাৰ্য শঙ্করের “বিজ্ঞানবাদ খণ্ডন” ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে সুপ্ৰসিদ্ধ ! ( প্ৰাচীন ভারতীয় দর্শনের পরিভাষায় “বিজ্ঞান’ শব্দটার অর্থ হলো মনের ধারণা, Science নয় ; তাই বিজ্ঞানবাদ আসলে আমরা যাকে ভাববাদ বা Idealism বলে উল্লেখ করছি তাইই। বৌদ্ধ দার্শনিকদের মধ্যে একটি সম্প্রদায় ছিল, যার নাম বিজ্ঞানবাদী এবং যার মতবাদ-ও এমন-কী যুক্তি-প্ৰায় হুবহু য়ুরোপীয় দার্শনিক বার্কলির মতোই ) । এই বিজ্ঞানবাদকে খণ্ডন করতে বসে শঙ্কর, আর যাই হোক, তথাকথিত বৈদান্তিকসুলভ নিম্পূহ সংযমের পরিচয় দেননি, এমন-কী তাঁর ভাষার সহজ প্ৰসাদগুণকে ছাপিয়ে উঠেছে প্ৰত্যক্ষ বিতৃষ্ণ । শঙ্কর বলেন, বিজ্ঞানবাদীর দল যে এমনতর আজগুবি কথা বলতে সাহস পায়, তার আসল কারণ তাদের মুখের মতো অঙ্কুশ নেই ! অর্থাৎ অঙ্কুশের ভয় থাকলে অমন নির্লজ্জ মিথ্যে বলতে তারা সাহস পেত না । শঙ্কর বলছেন, বহির্জগৎকে উড়িয়ে দেবে কেমন করে ? তার অনুভূতি যে অবিসংবাদিত ! দিব্বি এক পেট খেয়ে এবং রীতিমতো পরিতৃপ্ত হয়ে যদি কেউ বলে “কিছুই তো খাইনি, কই পরিতৃপ্তও তো হইনি,”–তাহলে তার কথা যে-রকম মিথ্যে হবে, সেইরকমই মিথ্যে বিজ্ঞানবাদীর কথা । ইন্দ্ৰিয়ের সঙ্গে বহির্বস্তুর সন্নিকর্ষ হবার পর, এবং স্বয়ং অব্যবধানে বহির্বস্তুকে অনুভব করার পর, বিজ্ঞানবাদীও বলে “বহির্বস্তু যে কী, কই তা তো জানি নে, কখনো তা দেখিনি–মনের বাইরে সত্যি কিছু নেই।” বিজ্ঞানবাদীর দল নিজেদের কথাটা হয়তো আর একটু শুধরে নিয়ে বলবে, বিষয়ের অনুভূতিকে আমরা অস্বীকার করতে যাব কেন, আমরা শুধু অস্বীকার করি তার বাহ্যত্বরূপ-বিজ্ঞেয় পদার্থরাশি অন্তর্বর্তী ধারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। উত্তরে শঙ্কর বলছেন, এ হলো গায়ের জোরের কথা । অনুভূতির সময় আমরা তো এই বলেই অনুভব করি।– এটা হলো স্তম্ভ, ওটা হলো কুড্য । কই এমন তো কখনো অনুভব করিনে যে, এটা হলো স্তম্ভের মানস রূপ, ওটা হলো কুড্যর মানস-রূপ ! তাছাড়া, বহির্বস্তু বলে কোনো জিনিস। যদি কোথাও কোনোকালে না থাকে, তাহলে অন্তর্বর্তী ধারণাকেই বা কেমন করে “বহির্বৎ” হিসাবে অনুভব করা সম্ভব ? আসলে, “বহির্বৎ” বলে ধারণাটা এল কোথা থেকে ? এমন কথা তো মুখ-ফুটে কেউ বলতে পারে না যে, বিষ্ণুমিত্রের চেহারাটা ঠিক বন্ধ্যাপুত্রের মতো !
এই তো শঙ্করের ভাববাদ খণ্ডন। কিন্তু তারপর ? তাঁর নিজের মতবাদ ? ব্ৰহ্ম সত্য, এবং ব্ৰহ্ম মানে বিশুদ্ধ চৈতন্য । এর চেয়ে চরম ভাববাদ-চেতনকারণবাদ-পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো দেখা দেয়নি । যে বহির্বস্তুর অবিসংবাদিত সত্তা নিয়ে এত তর্ক, তার হলো কী ? সমগ্র জগৎ–যে জগতে ভাববাদীর মুখের মতো চাবুক নেই বলে শঙ্করের এত অনুশোচনা–রজ্জুতে সৰ্প-প্ৰতিভাসের মতো মিথ্যে হয়ে গেল। ( মিথ্যা হিসাবে রজ্জু-সৰ্প আরও এক কাঠি সরেস, কিন্তু তাই বলে ব্যবহারিক পৃথিবী তার চেয়ে এক চুলও বেশি নয়। অদ্বৈত মতে মিথ্যার তারতম্যকে সত্যের তারতম্য বলে ভুল করলে চলবে না ) । সহজবুদ্ধির সঙ্গে সামান্যতম। আপসটুকুও নেই : ভাববাদ-খণ্ডন পরিণতি পেল চুড়ান্ত ভাববাদে।
দর্শনের এই আজব গোলক-ধাঁধায় ঘোরা–ভাববাদের হাত থেকে মুক্তি, পেতে গিয়ে ভাববাদের জালেই জড়িয়ে পড়া–একে শুধু দিশি দার্শনিকের খামখেয়াল বলে উড়িয়ে দেওয়াও চলে না । প্ৰাচীন গ্রীসে মহৎ দার্শনিকের মধ্যেও একই ঘটনার পুনরুক্তি। সক্রেটিসের কথা ধরা যাক। তাঁর দর্শন, এমন-কী তাঁর জীবনকেও বোঝবার একমাত্র সূত্র হলো সফিস্টদের ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহ । সফিস্টরা তর্কে ধুরন্ধর ; তারা প্ৰমাণ করতে চায় যে, ব্যক্তিগত মানুষের মনের ওপরেই পরমসত্তার একান্ত নির্ভর । মানুষের ভালোলাগা-না-লাগাই সত্যবিচারের অভ্রান্ত কষ্টিপাথর। ভাববাদের এই মূল দাবিকে নিছক জ্ঞানের গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখে সফিস্টদের সন্তোষ নেই, নৈতিক এবং রাজনৈতিক জীবনেও তারা এর জের টানতে চায়–সুনীতি আর দুর্নীতির মধ্যে আসলে কোনো তফাত নেই, আপনার যা রোচে, সেটাই আপনার কাছে সুনীতি ; প্ৰেয় আর শ্ৰেয়, একেবারে নিছক এক । রাষ্ট্ৰীয় আইন-কানুনের বেলাতেও ওই এক কথা-এ-সব আইন-কানুন মানতে যদি মন্দ না লাগে, তাহলে মন্দ কী ? কিন্তু মানতে যে হবেই, এমন কোনো কথা নেই।
সক্রেটিস দেখলেন, ভাববাদের এই দাবি সমাজজীবনের পক্ষে একেবারে দুর্বিষহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ভাববাদকে খণ্ডন করবার জন্যে তিনি প্ৰায় মরিয়া হয়ে উঠলেন । তার খণ্ডন-পদ্ধতি আপাত বিনয়ের পরাকাষ্ঠা, কিন্তু তার পেছনে যে তীব্র বিদ্রুপ আর তীক্ষ্ণ বিদ্বেষ লুকানো, সে-কথা তার ভক্তদের লেখা ভালো করে পড়ে দেখলেই বুঝতে পারা যায়। হাটবাজার থেকে শুরু করে বড়লোকের খানাপিনার আসর পর্যন্ত সর্বত্রই তার দুর্ধর্ষ দ্বন্দ্ব-আহবান,–অমনটাই ছিল তখনকার দিনের ব্যাপার ।
কিন্তু তারপর ? তাঁর নিজের মতবাদ ? তিনি নিজে অবশ্য কোনো দার্শনিক গ্ৰন্থ রচনা করেননি । তাঁর দর্শনের যেটুকু পরিচয় পাওয়া যায়, তা শুধু তার ভক্তবৃন্দের–প্রধানত প্লেটাে ও জেনোফেন-এর–গ্ৰন্থাবলী থেকে। এবং টীকাকারদের মধ্যে এ নিয়ে অনেক তর্ক আছে যে, প্লেটো নিজের গ্রন্থে সক্রেটিসের মুখে যে দার্শনিক মতবাদ বসিয়েছেন, তা তাঁর গুরুদেবেরই মতবাদ, না নিজের মতবাদ ভক্তিভরে গুরুদেবের নামে প্ৰচারিত মাত্ৰ ! কিন্তু এ-কথা নিয়ে তর্ক যতই থাকুক না কেন, এবং গুরুশিষ্যের মধ্যে মতের প্রভেদ ঠিক কী এবং কতটুকু, এ-বিষয়ে টীকাকাররা নিঃসন্দেহ হতে পারুন আর নাই পারুন,- অন্তত এক বিষয়ে মতভেদের কোনো প্ৰশ্নই ওঠে না ! প্লেটোর দর্শনে সক্রেটিক বিশ্বালোচনের পূর্ণ বিকাশ। এবং গ্ৰীক যুগে প্লেটোর পৌরোহিত্যেই এই ভাববাদের সবচেয়ে জমকালো অভিষেক । ভাববাদ-খণ্ডন এইভাবে ভাববাদেই পরিণতি পেল ।
দর্শনের সেই পুরোনো গোলক-ধাঁধাই ! তবু নেহাত একে প্রাচীনদের সেকেলে ভ্ৰান্তিবিলাস ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দেওয়াও সম্ভব নয়। য়ুরোপের ইতিহাসে বিজ্ঞানের দিগ্বিজয় শুরু হবার পরও যে দিগ্বিজয়ী দার্শনিকের জন্ম হলো, এবং যার বৈজ্ঞানিক বুৎপত্তি অতি-বড় বিপক্ষও অস্বীকার করতে পারেন না, তিনিই বা এই অদ্ভুত আবর্তকে এড়াতে পারলে কই ? ইম্যানুয়েল কাণ্ট–কোএন্স্বের্গের সেই ঋষি ইম্যানুয়েল কাণ্ট,-যাঁর কথা বলতে গিয়ে কোলরিজের কবিকণ্ঠও আবেগে গদগদ হয়ে পড়ে। পাছে তাঁর দার্শনিক মতবাদকে টীকাকারেরা ভুল করে ভাববাদ বলেই চালিয়ে দেন, এই ভয়ে কান্ট তাঁর প্রধান গ্ৰন্থ “শুদ্ধবুদ্ধির বিচার”-এর দ্বিতীয় সংস্করণে একটি নূতন অংশ জুড়ে দিলেন, আর সেই অংশের নাম দিলেন “ভাববাদ-খণ্ডন” । তাঁর মতো পারিপাট্য-প্রিয় দার্শনিক ভাববাদকে খণ্ডন করার সময় এলোমেলোভাবে অগ্রসর হবেন, এমন কথা নিশ্চয়ই ভাবা যায় না ; কাণ্ট এলোমেলোভাবে এগোননি । প্ৰথমে তিনি প্ৰচলিত ভাববাদের শ্রেণীবিভাগ করে নিয়েছেন : একদিকে বার্কলির গোড়া ভাববাদ এবং অপরদিকে দেকার্ত-এর সংশয়াত্মক ভাববাদ । বার্কলি সম্বন্ধে তাঁর বক্তব্য সামান্যই-দেশ এবং কালের বাহ্যসত্তা অপ্ৰমাণ করে, এ দুটিকে মানব অনুভূতির মূল কাঠামো বলে প্ৰমাণ করে, কাণ্ট নাকি আগেই এই গোড়া ভাববাদের মূল উচ্ছেদ করেছেন ( কীভাবে যে তা সম্ভব হয়, তাই নিয়ে অবশ্য টীকাকারদের মধ্যে অনেক বিতর্ক আছে) । আপাতত কাণ্টের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেকার্ত-এর সংশয়াত্মক ভাববাদ খণ্ডন করা । দেকার্ত-মতে একমাত্র আত্মার সত্তাই অবিসংবাদিত সত্য, তাকে সংশয় করতে গেলেও স্বীকার করতে হয়। অপরপক্ষে, বহির্বস্তুর সত্তা ভগবানের দোহাই না দিয়ে মানবার জো নেই। এ কথা খণ্ডন করতে গিয়ে কাণ্ট দেখালেন যে, তথাকথিত অবিসংবাদিত আত্মাকে মানতে গেলে বহির্বস্তুর সন্তা না মেনে উপায় নেই। কেননা, আত্মা সম্বন্ধে আমাদের যেটুকু উপলব্ধি, তা নিছক চেতনা-প্রবাহের উপলব্ধি, এবং প্রবাহকে প্ৰবাহ হিসেবে বুঝতে গেলে স্থির ও নিত্যর সাহায্য নিতেই হবে । কিন্তু স্থির ও নিত্যর কোন হদিশ মানস-জগতে মেলে না । তাই বহির্জগতে তার সত্তা না মেনে উপায়ই নেই । আর এই কথা প্ৰমাণ করার পর কাণ্টে প্ৰায় উল্লাস করে বললেন : ভাববাদীর মরণ-মন্ত্র ভাববাদের বিরুদ্ধেই চেলে দেওয়া গেল, কেননা ভাববাদ অনুসারে একমাত্র অন্তর্বস্তুর যাথার্থই অধিসাংবাদিত, অথচ প্ৰমাণ করে দেওয়া গেল যে, অন্তর্বস্তুর অনুভূতি একান্তভাবে বহির্বস্তুর মুখাপেক্ষী!
ভাববাদ খণ্ডন করলেন কাণ্ট । কিন্তু তারপর ? তাঁর নিজের মতবাদ ? তা নিয়ে অবশ্য টীকাকারদের মধ্যে অজস্ৰ মতভেদ আছে ; এবং মতভেদ এতই বেশি যে, তাঁদের মধ্যেই একজন, একজন শ্ৰদ্ধেয় টীকাকার, শেষ পৰ্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলেন যে, কাণ্ট তাঁর সমসাময়িক দর্শনের যে দুৰ্গতির বর্ণনা দিয়েছেন, কাণ্ট-দর্শনের উপর টীকার দুৰ্গতি তার চেয়ে কম নয় । সমসাময়িক দর্শনের দুৰ্গতি বর্ণনা করতে গিয়ে কাণ্ট বলেছিলেন-এ যেন এমন এক মল্লক্ষেত্র, যেখানে কিনা ভুয়ো মারপিটে হাত পাকাবার দেদার সুযোগ ।
কাণ্ট-এর টীকা নিয়ে যে এত শোরগোল, তার আসল কারণ অবশ্য কাণ্ট নিজেই এক অদ্ভুত দোটানায় পড়েছিলেন। একদিকে ভাববাদ খণ্ডন করা সত্ত্বেও ভাববাদের কাছেই করুণ আত্মনিবেদন, অপরদিকে বৈজ্ঞানিক বিবেকের দংশনে অন্তত খিড়কি দোর দিয়ে বস্তুবাদের মূল কথাকে সসংকোচে আমন্ত্রণ। এক বিশেষ যুগের, এক বিশেষ সমাজের জীব হিসাবে কাণ্ট যে কেন এমন দোটানায় পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, সে প্রশ্নের জবাব মার্কসীয় আলোচনায় পাওয়া যায় ; কিন্তু এ-কথায় কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না যে, তার দর্শনের সচেতন দিকটুকু স্পষ্টই ভাববাদী : তার মতে এই মূর্ত ও দৃশ্য জগৎ বুদ্ধি-নির্মাণ ।
কাণ্ট-এর দর্শনের ঐতিহাসিক পরিণতির দিকে চেয়ে দেখলেও বোঝা যায়, ভাববাদের প্রতি তার দর্শনের ঝোঁক কী দুর্নিবার, কত নিঃসন্দেহ ! উত্তর কাণ্টীয় দার্শনিকেরা কাণ্ট-এর দর্শনকে প্ৰতিজ্ঞ হিসেবে ব্যবহার করে একটানা এগিয়ে চললেন সোজা ভাববাদের পথে । জ্যাকবি, ফিক্টে, হাৰ্বার্ট, সেলিঙ এবং শেষ পর্যন্ত হেগেল। হেগেলের সর্বগ্রাসী পরব্রহ্ম–সে যেন এক চিন্ময়, ভয়ঙ্কর আদিম দেবতা, তার ক্ষুধা কিছুতে মিটতে চায় না, সমগ্ৰ মানব-ইতিহাসকে গ্ৰাস করবার পরও না ।
শুধু ঐতিহাসিক পরিণতির কথাই বা কেন, কাণ্ট থেকে হেগেলীয় ভাববাদে পৌঁছবার পথ যে সোজা, তার নৈয়ায়িক তাৎপৰ্যটুকুও স্পষ্ট ও প্ৰত্যক্ষ । সাম্প্রতিক পরব্রহ্মবাদীরা তাই কাণ্ট থেকেই শুরু করেন এবং শেষ করেন হেগেলে । গ্রীন, কেয়ার্ড, এমন-কী এ যুগের অতবড় ভাববাদী ব্রাডলি পৰ্যন্ত এ কথার ব্যতিক্ৰম নন।
শেষ পর্যন্ত য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে যেন এক অসম্ভব অবস্থার সৃষ্টি হলো । হেগেলের সর্বগ্রাসী ভাববাদ দার্শনিক মহলে যেন সহজবুদ্ধি হয়ে দাঁড়াল। তাকে প্রমাণ করবার দরকার বুঝি নেই, তাকে খণ্ডন করবার অস্ত্ৰ বুঝি পাওয়া অসম্ভব। অথচ উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকে শুরু করে দার্শনিকেরা অনুভব করতে লাগলেন যে, ভাববাদের আবহাওয়ায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক চেতনার শ্বাসরোধ হবার উপক্রম হয়েছে। তাই আবার শোরগোল পড়ে গেলা-ভাববাদকে খণ্ডন করতে হবে, যেমন করেই হোক। দেখা গেল, একের পর এক দার্শনিকের দল মেতে উঠছে ভাববাদকে খণ্ডন করবার উৎসাহে, খোলা হচ্ছে একের পর এক আক্রমণকেন্দ্ৰ । অভিজ্ঞতা-বিচারবাদ ( Empirio Criticism), প্রয়োগবাদ ( Pragmatism ), নব্য-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ ( Neo-Realism )–এইসব খাঁটি আধুনিক মতবাদ। প্ৰত্যেকটিরই একান্ত উৎসাহ ভাববাদ খণ্ডন। অথচ তলিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, এইসব অতি-আধুনিক দার্শনিকেরা ভাববাদের বিরুদ্ধে নানা রকম কটূক্তি করবার পরও শেষ পর্যন্ত যেন গোপনভাবে ভাববাদের কথাই আত্মসাৎ করতে চাইছেন ।
অভিজ্ঞতা-বিচারবাদের প্রধান নায়ক হলেন ম্যাক । বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে, নানান রকম দুরূহ পরিভাষার জাদু দেখিয়ে, সাড়ম্বরে তিনি দর্শন শুরু করলেন । এতদিন ধরে চিৎ ও অচিতের মধ্যে যে দুর্লঙ্ঘ্য প্ৰাচীর গড়ে উঠেছে, তাকে ভূমিসাৎ করতে পারলেই নাকি দর্শনের আসল মুক্তি। প্ৰথম কাজ তাই মনোবিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের মিলন ঘটিয়ে এক বৰ্ণসঙ্করের জন্ম দেওয়া, সেই বৰ্ণসঙ্করেরই নাম হবে দৰ্শন–এবং এই দর্শন অনুসারে জড়পদার্থও পরমসত্তা নয়, মানস-পদার্থও পরমসত্তা নয়, এক তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা পরমসত্তা। ম্যাক তার নাম দিয়েছেন element, অর্থাৎ মৌলিক সত্তা । অথচ, দর্শনের ক্ষেত্রে এই অভিনব নামধারী আগন্তুকটি, এই তথাকথিত তৃতীয় অপক্ষপাতী সত্তা, আসলে ভাববাদীর পুরাতন মানস-অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ম্যাক-প্ৰমুখের এই সাড়ম্বর অতি-আধুনিক দর্শন আসলে বার্কলির মতবাদের ওপর নতুন রঙ চাপিয়ে তাকে অভিনব দর্শন বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাই। লেনিন তাঁর প্রধান দার্শনিক গ্রন্থে “বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতা-বিচারবাদ”-এ এই বিষয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন । এবং এই সিদ্ধান্ত এমন নিঃসংশয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তারপর আর তাই নিয়ে সংশয়ের অবকাশ থাকে না ।
তারপর ধরা যাক প্রয়োগবাদীদের কথা । তাঁদের দর্শনের মূল উৎসাহ যে হেগেলীয় ভাববাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি খোঁজা, এ কথা তাঁরাই জোর গলায় জাহির করছেন। ভাববাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দর্শন গড়ে তুলতে হলে প্ৰথম দরকার দর্শনের মূল ভিত্তিটারই বদল করা। দর্শনকে আর শুদ্ধবুদ্ধির গজদন্তমিনারে কুমারী ব্ৰতচারিণী করে রাখলে চলবে না, তাকে নামিয়ে আনতে হবে ধুলোর পৃথিবীতে, যেখানে কাজের মানুষের কাঁধ ঘোষাঘোষি, যেখানে প্রয়োগের নগদ মূল্য চুকিয়ে তবেই কিছু কেনা-বেচা । তাই কোন বিশেষ দার্শনিক মতবাদ বা ধারণা, নিছক নিজের জোরে যথার্থও নয়, অযথার্থও নয়,–যাথার্থ্য-দাবির একটি আবেদনমাত্র। ব্যবহারিক জীবনে তার প্রয়োগবৃত্তির ওপর যাথার্থ্য নির্ভর করে ; উক্ত ধারণা বা মতবাদ যদি জীবনে সুখানুভূতির সন্ধান দেয়, তবেই তাকে যথাৰ্থ বলে মানা যাবে, যদি না দেয়, তাহলে বলতে হবে তা ভ্ৰান্ত। হাজার বাকবিতণ্ডায় যে-তর্কের মীমাংসা নেই, প্ৰয়োগের জাদুস্পর্শে নিমেষে তার মীমাংসা হয়ে যায়। এই সহজ কথাটুকু এর আগে দার্শনিকেরা ধরতে পারেননি, তার কারণ এতদিনকার একটানা বুদ্ধিবাদের মোহে তাদের দৃষ্টি আচ্ছন্ন ছিল।
সহজ কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু নতুন কথা কোথায় হলো ? প্রয়োগের প্ৰসঙ্গটা অবশ্যই নতুন, তবু এ তো সুস্থ প্রয়োগের ওপর নির্ভর করা নয়, প্রয়োগের দোহাই-পাড়া মাত্র। কেননা, প্রয়োগবাদীদের মতে এই তথাকথিত প্রয়োগের আসল তাৎপৰ্য শেষ পর্যন্ত ঠিক কী ? সুখানুভূতি-শেষ পর্যন্ত অনুভূতিই, মানস-অভিজ্ঞতাই ! যাথার্থ্য বা সত্যের একান্ত নির্ভর রুচিমাফিক অনুভূতি বা অভিজ্ঞতাই। মানুষের মধ্যে যেটা সবচেয়ে খামখেয়ালী, সবচেয়ে ব্যক্তিগত দিক-তারা ভালো-লাগা-না-লাগা–প্ৰয়োগবাদীর মতে তার উপরই পরমসত্তার চরম নির্ভর । সহজ কথা সন্দেহ নেই, কিন্তু এমন কিছু নতুন কথা নয়। গ্ৰীক যুগে সফিস্টদের মুখেও এই কথাই শুনতে পাওয়া গিয়েছিল, শোনা গিয়েছিল, সমস্ত সত্যের চরম কষ্টিপাথর হলো ব্যক্তিগত মানুষের ভালো-লাগা-না-লাগা ; কেবল তারা এমন আধুনিক ভাষায় প্রয়োগ শব্দের দোহাই দিতে জানতেন না । ভাববাদের পুরোনো কথাটুকুই, কেবল বাইরের দিকটাই নতুন। শুধু নবকলেবর।
ভাববাদীর ভাষা যেন গঁদের সঙ্গে করাতগুঁড়ো মিশিয়ে একটু ঘন করা হয়েছে, বললেন সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদী । অন্তত সাত সাতটা সরল অনুপপত্তির ওপর ভাববাদের ভিত, বললেন নব্য-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর দল। মনে হয়, মেজাজটা এবার রীতিমতো কড়া, আশা হয় এবার আর কোনো রকম আপসের কথাই উঠবে না। ঠিক হলো, ভাববাদকে খণ্ডন করতে হবে রীতিমতো দল পাকিয়ে, সভা ডেকে । সভা ডাকলেন নব্য বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা ; সভা ডাকলেন বৈচারিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীর দল-বড় বড় নামজাদাদের সভা । ঠিক হলো, এমন-কী ন্যায়শাস্ত্রকেও সমূলে সংস্কার করতে হবে-পুরোনো ন্যায়শাস্ত্রের আবর্জনায় ভাববাদের আগাছা জন্মেছিলো, তাই সংস্কৃত বৈজ্ঞানিক নব্যন্যায় চাই। প্ৰবর্তিত হলো “গাণিতিক” নব্যন্যায় ।
অনুষ্ঠানের এতটুকুও ত্রুটি নেই। আয়োজন দেখে মনে হয়, ভাববাদের পরমায়ু এবার সত্যিই শেষ হবে। ভাববাদ তবুও যেন মিশরের সেই পৌরাণিক পাখিই, নিজের ভস্মাবশেষের মধ্যেই তার নবজন্মের নিঃসন্দেহ সুচনা । সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের এত তোড়জোড়, এত শোরগোল, শেষ পৰ্যন্ত তারও পরিসমাপ্তি ভাববাদেই ! জানি, একথা প্ৰমাণ করা পরিসরসাপেক্ষ, বিশেষত এই কারণে যে, সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা জানেন, নিজেদেরওই গোপনভাববাদকে ঢাকবার জন্য জটিল তর্ক আর দুরূহ পরিভাষার ঠাসবুনোনি দিয়ে কী অপূর্ব আচ্ছাদন বুনতে হয়। সহজ কথাকে কঠিন করে প্রকাশ করবার দুর্লভ মেধা তাদের। সুখের বিষয়, মরিস কর্নফোর্থ তার গ্ৰন্থ “বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ভাববাদ”- এ এই আচ্ছাদনকে ছিন্নভিন্ন করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, অত দুরূহ জটিলতার পেছনে মোদ্দা কথাটুকু বার্কলিরই কথা । সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীদের তথাকথিত গাণিতিক নব্যন্যায়ের স্বরূপও তিনি উদঘাটন করেছেন । আসলে সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা এই নব্যন্যায়-এর চারপাশে এমন দুৰ্বোধ্যতার আর জটিলতার আবহাওয়া সৃষ্টি করেছেন যে, সাধারণ পাঠক একে দূর থেকে সন্ত্রম করেন, কাছ-ঘোষবার সাহস বড় কারুর হয় না। কর্নফোর্থ এর গ্ৰন্থ পড়ার পর বুঝতে পারা যায়, এ যেন এক অতি আধুনিক দিল্লির লাডু-শুধু যে না-খেলেই পস্তাতে হয় তাই নয়, খেতে গেলেও পস্তাতে হয়, কেননা খেতে গেলে শুধুই দাঁত ভাঙে, কিন্তু ভাববাদের চর্বিতচর্বণ ছাড়া নতুন কোনো আস্বাদ জোটে না।
কর্নফোর্থ এর গ্রন্থ ছাড়াও এখানে শুধু একটা উদাহরণ দেওয়া যাক । সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদের গুরুদেব হলেন ইংরেজ দার্শনিক মূরি। “ভাববাদ খণ্ডন” নামে তাঁর ছোট প্ৰবন্ধ হালের য়ুরোপীয় দর্শনের ইতিহাসে নাকি যুগান্তর এনেছে। উত্তর-বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদীরা সকলেই তার কাছে প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋণী। ভাববাদের বিরুদ্ধে গালিগালাজ করবার সময় মুর-এর কণ্ঠ সতেজ, যুক্তি যেন দুর্ধর্ষ। জ্ঞানের বিষয় জ্ঞাতার মনের ওপর নির্ভর করে, এ কথা বলা, মূর-এর মতে, নেহাতই নির্বোধের লক্ষণ। কিন্তু এ সমস্তই তো নেতিবাচক কথা। প্রশ্ন ওঠে, জ্ঞানের বিষয় তাহলে ঠিক কী রকম ? উত্তরে মূর ইন্দ্ৰিয়োপাত্ত (Sense-datum) নামের এক জাতীয় সত্তার আমদানি করলেন । এই ইন্দ্ৰিয়োপাত্ত হল দর্শনের জগতে অভিনব-তম আজব-চিড়িয়া, অভিজ্ঞতাবিচারবাদীর element-এর সাক্ষাৎ বংশধর । লেনিন দেখিয়েছিলেন, element জিনিসটা বার্কলির percipii ছাড়া আর কিছুই নয়। মুর-এর ইন্দ্ৰিয়োপাত্তর বেলাতেও হুবহু একই কথা । এই ইন্দ্ৰিয়োপাত্তর স্বরূপ নিৰ্ণয় করা নিয়ে যতই তিনি মাথা ঘামিয়েছেন, ততই তাঁকে বস্তুস্বাতন্ত্র্যবাদ ছেড়ে পেছু হটতে হয়েছে। বার্কলি-হিউমের ভাববাদের দিকে। মুর-এর দর্শনে এই যে বিপৰ্যয়, একে নিছক তাঁর ব্যক্তিগত খেয়ালখুশিও বলা চলে না ; সাম্প্রতিক বস্তুস্বাতন্ত্রাবাদীরা প্ৰায় প্ৰত্যেকেই এই দিক থেকেও গুরুদেব মূর-এর চরণচিহ্ন অনুধাবন করেন। জ্ঞানবিজ্ঞান (Epistemology) নিয়ে তাঁদের অন্য অজস্র বিতর্কের পেছনে তাই ভাববাদেরই বিচ্ছুরিত হাসি ।
প্ৰাচীন মিশরে দেবতা আসিরিসের জীবন-মরণ-কাহিনী নিয়ে প্ৰতিবছর মরমী নাট্যের অভিনয় হতো। দেবতার পীড়ন, দেবতার মৃত্যু, তারপর আবার দেবতার পুনরুজ্জীবনের পর দেবতা দেখা দিতেন হয় তাঁর নিজের মূর্তিতেই, আর না হয় তো পুত্র হোরাস-এর মূর্তিতে। কিন্তু মূর্তি যারই হোক, মূলে সেই দেবতাই, সেই অসিরিস। দর্শনের ইতিহাসেও যেন একই নাটকের অভিনয় । ভাববাদের পুনরুজ্জীবনও চিরকাল একই মূর্তিতে নয়, কিন্তু বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে আপাত পার্থক্য যতই হোক না কেন, মূলে সেই পুরাতন ভাববাদই । তাই পূর্বপক্ষ এ কথা বলতে পারবেন না যে, একজাতীয় ভাববাদ খণ্ডন করে শঙ্করপ্রমুখ দার্শনিকেরা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র জাতের ভাববাদ প্রবর্তন করেন। আসলে বিভিন্ন ভাববাদের মধ্যে বৰ্ণভেদটুকু আপাতত যতই গুরুত্ব বলে মনে হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা নেহাতই অগভীর। একথা মূর এবং পেরীর মতো দার্শনিকদের দৃষ্টিও এড়ায়নি, যদিও তারা যে যুক্তি দিয়ে কথাটা প্ৰমাণ করবার চেষ্টা করেন, সে যুক্তি শেষ পর্যন্ত বিচারসহ নয়। ভাববাদের সামাজিক উৎস নিয়ে আলোচনা করবার সময় এ বিষয়ে দীর্ঘতর মন্তব্যের অবকাশ পাব ।