ভাবনার সময় এসেছে
যুদ্ধ বিগ্রহ, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবিদ্বেষ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, কথায়-কথায় খুন-রাহাজানি পৃথিবীর সাধারণ মানুষ কোনওভাবেই পছন্দ করে না। কিছু স্বার্থান্বেষী লোক, চিরকালই যারা সংখ্যায় কম, তারাই পৃথিবীর শান্ত বাতাবরণকে চঞ্চল করে তোলে। এখানে যুদ্ধ, ওখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে বসে থাকে। জোর করে বিশাল সংখ্যক মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয় ভয়, উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ। জঙ্গি শাসকরা পছন্দ করেন যুদ্ধ। নিজের দেশকে সব সময় যুদ্ধে লিপ্ত রাখতে পারলে দেশের সাধারণ মানুষের নানা অভাব, অভিযোগ ধামাচাপা সাম্প্রদায়িকতার উস্কানি দিলেন। ধর্মান্ধ মানুষদের কাজে লাগালেন। একই সঙ্গে শুরু হল সংখ্যালঘু নিপীড়ন ও শোষণ। আমদানি করা হল বিদেশি টেররিজম। রাজনীতির বৃত্ত ছেড়ে পালাতে লাগলেন ভদ্রলোক। নির্বাচন হয়ে দাঁড়াল প্রহসন। শোনা যেতে লাগল নতুন এক শব্দ ‘রিগিং’। সবাই বলতে শুরু করলেন অশিক্ষিতের দেশে গণতন্ত্র চলে না। ক্ষমতার স্বপ্নে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। রাজ্যের মধ্যে তৈরি হল খণ্ডরাজ্য। সীমান্ত হয়ে উঠল অশান্ত। সংবিধান রইল, সাংবিধানিক অপরাধীদের কোনও সাজা দেওয়ার ব্যবস্থা রইল না। রাজনীতি হয়ে দাঁড়াল খুনের নীতি।
ভারতের বর্তমান অবস্থায় স্বামী বিবেকানন্দ আর রবীন্দ্রনাথই একমাত্র ভরসা। বাঙালিকে যাঁরা কোণঠাসা করতে চেয়েছিলেন, তাঁরা ভুল করেছিলেন। দেশের সংস্কৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। লাভ হয়েছে ব্যবসায়ীদের আর সমাজবিরোধীদের। সারা বিশ্বে নতুন করে শুরু হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ ও গান্ধীচর্চা। স্বামীজি, গান্ধীজি, ঋষি বঙ্কিমের সমম্বয়ে নতুনএকটা মডেলে দেশ গঠনের চেষ্টা না হলে আমাদের বিচ্ছিন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ হবে না, বন্ধ হবে না পশ্চাৎ যাত্রা। আদর্শ ছাড়া অগ্রগতি অসম্ভব। নির্লোভ কর্মযোগী ছাড়া বৈষম্য ঘুচবে না। এদেশে মিশনারিদের মতো ভিসনারি চাই; যারা মানুষকে জাগাবেন, মিথ্যা স্তোকবাক্যে মানুষকে ঘুম পাড়াবেন না।
বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের যাঁরা কর্ণধার, তাঁরা শক্তির পাল্লাকে নিজেদের দিকে ঝোঁকাবার জন্যে বিশ্বের দুর্বল রাষ্ট্রের গলায় সোনার শিকল বেঁধে রাখেন। সব ব্যাপারেই গুঁজে দেন তাঁদের লম্বা নাসিকা। বিখ্যাত মনস্তাত্বিক কার্ল জুঙের একটি উক্তিতে আমার ভাবনার প্রতিফলন খুঁজে পাই ‘যত দিন যাচ্ছে ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু অনাহার নয়, রোগজীবাণু নয়, নয় ক্যান্সার, মানবজাতির পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক হল মানুষ নিজেই। মনোবিকলনের মহামারী থেকে মানুষকে নিরাপদ রাখার কোনও ব্যবস্থা তেমন নেই। বিকৃত মনের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়েও অনেক বেশি ক্ষতি সাধন করতে পারে।’
যত দিন যাচ্ছে পৃথিবীর পরিস্থিতি হয়ে উঠছে ততই ঘোলাটে। পৃথিবীর কথা বাদ দিয়ে ভারতের কথায় আসি। সর্বত্র অশান্তি। সর্ব ক্ষেত্রে অশান্তি। স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র কয়েক বছর ভারতে জাতীয় চেতনার কিছু রেশ ছিল। পণ্ডিত জবাহরলাল ছিলেন স্বপ্ন দেখার মানুষ। শতকরা একশো ভাগই খাঁটি। তাঁর কল্পনা ছিল, দূরদৃষ্টি ছিল। দেশ জুড়ে লাগিয়ে দিয়েছিলেন বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। জীবনের শেষভাগে দেখা গেল তিনি এক হতাশ মানুষ, বিব্রত মহানায়ক। তাঁর শান্তির বাণী, ভ্রাতৃত্বের আবেদন উপেক্ষিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র আঘাত হেনে বসল সীমান্তে। বিপর্যস্ত করে দিয়ে গেল আমাদের আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি। পেছিয়ে পড়ল আমাদের পরিকল্পনার কাজ। সৎ জবাহরলালের ক্ষমতার বৃত্তে ঢুকে পড়ল একদল সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদী মানুষ। যাঁরা বিকল করে দিতে চাইলেন প্রশাসন যন্ত্র। সোস্যালিজম-এর বদলে মাথা চাড়া দিয়ে উঠল ক্যাপিটালিজম। তাঁর আস্থাভাজন ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা হয়ে উঠলেন লোভী। দেশে বইতে শুরু করল কালো টাকার স্রোত। তৈরি হল সমান্তরাল অর্থনীতি। সরকারি কর্মচারীরা মানুষের আস্থা হারালেন। সর্বত্র চালু হল ঘুষ। ভারত-রূপকার সেই স্বাধীনতা সংগ্রামী মানসিক আঘাতে ফুরিয়ে ফেললেন তাঁর জীবন। এই শেষ থেকেই হল শুরু।
ভারতের অস্থির চালচিত্রের এই হল শুরু। লাল বাহাদুরের সামান্য সময়, তারপরেই পটভূমি কম্পমান। অস্থির রাজনীতি, গদি দখলের লড়াই। কংগ্রেস ভাঙতে-ভাঙতে, নতুন সদস্য ঢুকতে-ঢুকতে প্রাচীন স্বদেশি আদর্শ আর রইল না। শক্ত সুন্দর একটা কাঠামো শিথিল হয়ে গেল। এটা বার্ধক্যের লক্ষণ নয়, এটা অর্ন্তঘাত। সত্তরের দশকে এদেশে এত রাজনৈতিক দল গজিয়ে উঠল যে সাধারণ মানুষ হাসাহাসি করত। একটা মানুষ একটা দল, এমন সম্ভাবনাও দেখা গেল। শুরু হল দলবদল বা ফ্লোর ক্রসিং। রাজনীতি হয়ে গেল দলবাজি। হাস্যকর এক তামাশা। নেতারা ক্রমশই আস্থা হারাতে লাগলেন। মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার আসন থেকে টলে পড়ার পর তাঁদের চেহারা হয়ে উঠল মাফিয়াদের মতো। তাঁর ক্ষমতা দখলের জন্য আশ্রয় নিলেন সমাজবিরোধী শক্তির।