ভাবচিত্রকর সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষ

ভাবচিত্রকর সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষ

সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষ একটি চলমানতার নাম, সংগীত সৃষ্টির গতিশীলতায় এক দায়বদ্ধ, গভীর, নবীনত্বের অন্বেষ্টা৷ সুর রচয়িতা নচিদার সমস্ত অনুভবের স্পন্দন জুড়ে অবিরাম বেজে যেত রবীন্দ্রনাথের কবিতা— ‘হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথা অন্যখানে৷’ বৈষ্ণবের অন্বেষক অভিসার যেমন রোমাঞ্চকর, নচিদার সুরস্রষ্টা অনুসন্ধানী মনপ্রাণ তেমনি আন্তরিকতায় সম্পৃক্ত৷ মনে পড়ে, একদিন নলিনী সরকার স্ট্রিটের গ্রামোফোন কোম্পানির মহলাবাড়ির ভেতর থেকে কপালের দুটি রগ টিপতে টিপতে বারান্দার দরজা অতিক্রম করতে করতে বেরিয়ে এসে বললেন— ‘অভিজিৎ, it is a very difficult profession.” আমি তখন চাকরি করি অর্থাৎ সুর দিয়ে রোজগার করা তখন আমার প্রত্যক্ষ পেশা নয়৷ তাই নচিদার যন্ত্রণার তীব্রতা তীব্রভাবে অনুভব না করে একটা পুঁথিগত দর্শনের বাণী আওড়ে দিলাম— ‘এটাকে পেশা ভাবছেন কেন! ভাবুন না সংস্কৃতি-সাধনা৷’ আজ বুঝি, সেই অস্থিরতা তাঁর অর্থগত ছিল না, ছিল মর্মগত৷ অনেক পরে বুঝেছি নচিদার অনুভবে সংগীত স্রোত এতটাই বেগবতী যে, প্রতিবন্ধকের পাহাড় ভেঙে চলাই তাঁর সৃষ্টির আবেগ৷ বহমান ধারার পুনরানয়ন কখনওই তাঁর আগ্রহের বা পছন্দের মনে, হৃদয়ে, প্রাণে স্থান পায়নি৷ যার জন্য নচিদার সুর রচনায়, নচিদার অনুভব কখনই অনুবর্তনের পশ্চাতে ধাবমান নয়৷ বিবর্তনের প্রগতির মুক্তধারায় গতিময়৷ তাই তাঁর এই হৃদয়-তরঙ্গ৷ আমার সমস্ত সাংগীতিক বোধ দিয়েও তাঁর কোনও সৃষ্টির পর্দা ব্যবহারের আগাম ভাবনাকে ধরতে পারিনি৷ রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা গানে এই অপ্রত্যাশিত স্বর সাজানো, অন্য এক দিকপাল সুরস্রষ্টা অনুপম ঘটক ছাড়া কারও মধ্যে তেমনভাবে দেখা যায় না৷ এমনকি বাংলা সংগীত রচনার বিপ্লবী সুরস্রষ্টা সলিল চৌধুরির মধ্যেও না৷ সলিলদা ইউরোপীয় সিম্ভনি সংগীতের প্রয়োগে এক রবীন্দ্র-অনুসারী পথিক৷ রবীন্দ্রনাথ যে-পথ ধরে পাশ্চাত্য সংগীতের পরিকাঠামো দিয়ে দ্বান্দ্বিক অনুভূতিকে সুরারোপিত করেছেন ভারতীয় মার্গসংগীত, লোকসংগীত, কীর্তন প্রভৃতিকে দিয়ে, সলিল চৌধুরিও তাই করেছেন৷ কেবল যন্ত্রসংগীত প্রয়োগে ও অধিক বিদেশি অনুভূতিতে সলিলদা রবীন্দ্র-অঙ্গন ছেড়ে স্বকীয়৷ তবু এই দুই মহান স্রষ্টাকে তাঁদের সৃষ্টির মধ্যেই তাঁদের সৃষ্টি-স্বভাবকে খুঁজে পাওয়া যায়৷ কিন্তু নচিদা ও শ্রদ্ধেয় অনুপম ঘটককে বিশেষ কোনও আঙ্গিক ধরে চিহ্নিত করা অসম্ভব৷ ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’-র স্রষ্টার সঙ্গে ‘মৌ বনে আজ মৌ জমেছে’ স্রষ্টার আত্মিক সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া গেলেও ভাবা যায় না এই স্রষ্টারই অন্য একটি রচনা ‘ভাঙ ভাঙ পাথর ভাঙ’৷ তুলনামূলক কিছু বিচার না করলে একজনের উৎকর্ষ সাধ্যমতো অভিপ্রেত উৎকর্ষে চিহ্নিত করা যায় না৷ তাই স্বর্ণযুগের পথিকৃৎ শ্রদ্ধেয় সলিল চৌধুরির কথা বারবার আনতেই হচ্ছে৷ কারণ ‘মেঘ কালো’ বা ‘মৌ বনে আজ’ গানের মধ্যে যে লোক আঙ্গিক ব্যবহৃত— তা সলিল-সংগীতেও আছে আবার নচিদার ‘পাথর ভাঙ’ গানে যে গণসংগীতের আবেশ পাওয়া যায়, তা গণসংগীত রচনার অগ্রদূত সলিল চৌধুরির সংগীতেও আছে, কিন্তু আমার সুরশিল্পীমন অনুভব করে সলিলদাকে তাঁর রচিত দুটি সংগীতেই এক স্রষ্টা হিসেবে ধরতে পারি, সে ক্ষেত্রে নচিদার ওই দুটি সংগীতে আমি দুটি সত্তার প্রকাশ অনুভব করি৷ জানি না শ্রদ্ধেয় পাঠক-পাঠিকার কাছে আমি নিজেকে কতটা পরিষ্কার করতে পারলাম, তবে আমার কাছে এটা জ্বলজ্যান্তভাবে ধরা পড়ে; unpredictable পর্দা ব্যবহার করেও সলিলদার পরিকাঠামোয় সলিলদাকে identify করা যায়৷ সে ক্ষেত্রে unpredictable পর্দা ব্যবহার করেও নচিদা নিজেকে বিশেষ রূপে ধরা দেননি৷ এখানেই তাঁর মৌলিকতা, তাঁর অসাধারণ বৈশিষ্ট্য৷

ছন্দের কারুকাজ নচিকেতা ঘোষের এক অনন্য বৈশিষ্ট্য৷ নিজে খুব বড় মাপের তবলাবাদক ছিলেন৷ শাস্ত্রীয় সংগীত-শিল্পীদের সঙ্গে বহু সঙ্গত করেছেন৷ একদা Inter College তবলা প্রতিযোগিতায় তিনি Champion হয়েছিলেন৷ গানে নতুন রস, অভিনবত্ব সৃষ্টি করতেন, বাণীর বৈশিষ্ট্য মেলোডির আন্তরিকতা ও সর্বোপরি ছন্দের জাদুতে৷ মেলোডি এবং রিদম— এই দুটো অগ্রাধিকার পেত ঠিকই, কিন্তু কোনও সময় বিষয়বস্তুর ভাব ও আবেশকে অতিক্রম করে নয়৷ পরন্তু বাণীর মর্মবোধ ও আবেগকে বাহন করেই নির্মিত হত তাঁর Melody ও Scan-এর বৈচিত্র্য৷ মনে পড়ে, একদিন ওই নলিনী সরকার স্ট্রিটের মহলাবাড়ির বারান্দাতে দাঁড়িয়ে আমায় একটা জিনিস শেখালেন৷ বললেন— ‘বুঝলি কোনও একটা ছন্দ নিয়ে যেই মজা শুরু করলি,— সেই ছন্দটাকে জমিয়ে, phonetically bore করার আগেই ভেঙে দিয়ে আবার rebuilt করবি৷’ কথাটা এসেছিল ‘ইন্দ্রাণী’ ছবির গীতা দত্ত গীত ‘ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজে’ গানটাকে কেন্দ্র করে৷ ছবিটি ও তার গানগুলো তখন অসম্ভব জনপ্রিয়৷ পাঠকবর্গ গানটা বাজিয়ে শুনলে বুঝবেন গানটির স্থায়ী অংশ অর্থাৎ ‘ঝনক ঝনক কনক কাঁকন বাজে’ থেকে ‘কুঁড়ি ফোটে লাজে’ পর্যন্ত ছন্দের নৃত্য ভাব— আর যেই অন্তরা এল, ‘এবার আমায় জাগিয়ে দাও’— ছন্দটা ভেঙে গিয়ে সমস্ত melodyটা flatভাবে এক উদাসী আকাশের পানে হৃদয় বিস্তার করল৷ আবার cross lineটা অর্থাৎ ‘কিসের সাড়া পেলাম জানি না যে’-র ছন্দবৈচিত্র্যের মধ্যে দিয়ে গানের মুখের ছন্দকে re-establish করান হল৷ এটা একটা অসম্ভব পথপ্রদর্শক শিক্ষা বলে আমি গ্রহণ করেছি এবং পরে সেই প্রয়োগ কৌশল আমার সৃষ্টিতে ব্যবহার করেছি ও অন্যকে ব্যবহার করতে দেখেছি৷ নচিদার কথায় আমি সেদিন এতটাই প্রেরণা পেয়েছিলাম যে, পরবর্তী সময়ে আকাশবাণীর নববর্ষের এক মধ্যরাত অনুষ্ঠানে শম্পা ও শ্রীকান্তকে দিয়ে গানটি গাওয়াই— যার ছন্দিত অংশ গেয়েছিল শম্পা আর ভাসানো অংশটা গেয়েছিল শ্রীকান্ত৷ নচিদার সেই প্রেরণায় গানটি সাজিয়ে গানটি এক ভিন্ন মাত্রা পেল৷

নিজেকে মৌলিকভাবে প্রকাশ করার কতটা আন্তরিক তাগিদ তাঁর ছিল, সে প্রসঙ্গে একটা ঘটনার উল্লেখ করছি৷ ঘটনাটি নচিদার পুত্র সংগীত-পরিচালক সুপর্ণকান্তির মুখে শোনা৷ যাঁরা অনুভবে গতিশীল, নবসন্ধানী, তাঁদের মধ্যে নতুন নতুন পথে হাঁটার যেমন প্রবণতা থাকে, তেমন থাকে নতুন নতুন কিছু শেখার, জানার ইচ্ছা৷ এমনই প্রাণ-প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নচিদা পিয়ানো শিখতে শুরু করলেন, কিন্তু ২/৩ মাস পর হঠাৎ ছেড়ে দিলেন শেখা, কারণ হিসেবে বললেন— ‘ওভাবে কর্ড নির্ভরতায় চলতে গিয়ে দেখছি আমার সব গান সলিলের মতো হয়ে যাচ্ছে৷’ এই কারণে তাঁর পিয়ানো শেখা স্থগিত রইল৷ কিন্তু পৃথিবীর বাতাসে, যখন জীবনের সমস্ত প্রাঙ্গণে, বোধ বিনিময়ের যুগ সমাগত এবং বাংলা সংগীতেও ইউরোপীয় সংগীত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন নচিদার মতো চলন্ত জীবনপথিক কি নিছক Native puritan হয়ে থাকতে পারেন? কখনই না৷ আমি জানি না তিনি তখন অজস্র বিদেশি সংগীত শোনা শুরু করেছিলেন কিনা— কিন্তু দেখলাম সেই সময়ে অনেক গান রচনা করলেন, চলচ্চিত্র তো বটেই, এমনকি বেসিক গানেও যেখানে সুদক্ষভাবে প্রয়োগ করলেন বিদেশি পরিকাঠামোর সুর৷ আর Orchestration-এ এমন এমন যন্ত্রানুষঙ্গ সংযোজন করলেন, যার অবয়ব সম্পূর্ণ symphony-র মতো৷ এ প্রসঙ্গে ‘আজ কেন, ও চোখে লাজ কেন’, ‘লজ্জা মরি মরি এ কি লজ্জা’ প্রভৃতি গান যেমন আছে, তেমন আছে এ সব গানের যন্ত্রানুষঙ্গের প্রয়োগ৷ চলচ্চিত্রে Hotel Snowfox-ই এ বিষয়ে একটি জীবন্ত উদাহরণ৷

নচিদা আমার কাছে অনেক সময়েই শিক্ষক হয়ে উঠেছেন তাঁর স্বকীয় সাংগীতিক প্রয়োগ কৌশলের কারণে৷ ছায়াছবি প্রসঙ্গে যেমন যন্ত্রানুষঙ্গের বিষয় বললাম, তেমন গান-প্রয়োগের কথাও বলতে ইচ্ছে করছে৷ কী ভাষায় প্রকাশ করব বুঝতে পারছি না৷ ডাকাবুকো বা বাপের ব্যাটা এই শব্দগুলো যথেষ্ট সাংস্কৃতিক নয়, তবু এই ধরনের কথা ব্যবহার না করলে তাঁকে দুঃসাহসিক নাবিক বলা যাবে না৷ ছবিটির নাম ‘চাওয়া পাওয়া’৷ ছবিতে মোট ওই দুটিই গান৷ ছবির নায়ক উত্তমকুমার, নায়িকা সুচিত্রা সেন৷ গানে সুর করার সময় বুক কেঁপে যাওয়ার কথা৷ কারণ দুটি গান একই Sequence-এ পরপর৷ প্রায় প্রশ্ন উত্তরের মতো৷ বুক চিতিয়ে দুটো গান করলেন৷ যার একটি ‘এ তো খেলা নয়’, অন্যটি ‘যদি ভাবো ভুল সে তো শুরুতেই’— দ্বিতীয় গানটি সম্পূর্ণ তাল ছাড়া৷ প্রথম গানটির পর্দা চয়নে অনেকটাই দেশজ সুর ব্যবহৃত৷ কিন্তু ছন্দ ও scan-টা ঠিক দেশজ নয়৷ অদ্ভুত লাগে শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদ, পণ্ডিতদের সঙ্গে তবলা বাজনো ব্যক্তি, inter college তবলা প্রতিযোগিতায় champion হওয়া শিল্পী, ছন্দ ও তালকে প্রয়োগ করতে গিয়ে বৈয়াকরণের মতো ওস্তাদি বা পাণ্ডিত্যের কারাগারে নিজেকে বন্দী করেননি বা fanatical patriot-এর মতো হৃদয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সাংগীতিক বিনিময়ের দরজাটা বন্ধ করে দেননি৷ বরং শিল্প সৃষ্টির নন্দনানুভূতিকে যথাযথ চিত্রাঙ্কন করতে দক্ষ রূপকারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন৷ অতবড় তবলাবাদক দ্বিতীয় গানটি তাল ছাড়া করে তৈরি করলেন৷ কি সাহস, কি পরিমিতি বোধ, কি বিচার বিবেচনা৷ অথচ এই নচিকেতা ঘোষ ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবিতে আরতির কণ্ঠে যে গান গাওয়ালেন ‘যা যারে পাখি’— তার মধ্যে তবলার ছন্দের, যাকে বলে জাদুকরি প্রয়োগ, তার দ্বারা নায়িকা চরিত্রের সমস্ত ‘চঞ্চলতা ও উদাসীনতা’-কে মূর্ত করে তুললেন৷ Technic is the slave of content,— এই প্রয়োগ দর্শন থেকে নচিদাকে কখনও এক চুলও বিচ্যুত হতে দেখিনি৷ এ প্রসঙ্গে আর একটি গানের কথা মনে পড়েছে৷ ইলা বসুর গাওয়া ‘ঝিম ঝিম নেশা নেশা’৷ সমাজ-সচেতন, জীবন-সচেতন, সংস্কৃতিমনস্ক সুরস্রষ্টা নচিকেতা ঘোষ যতদিন দেহে ছিলেন ততদিনই পূর্ণ সজাগ, সতর্ক সমাজ মননশীল ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখে গেছেন৷ নব বিশ্বায়নের অশুভ মুহূর্তে যখন মার্কিনি সভ্যতার অনুপ্রবেশের যুগ- সন্ধিক্ষণে Quality শব্দটা Kwality হিসেবে লিখিত হওয়া শুরু হয়েছে, Fundamental-কে ‘ফান্ডা’ উচ্চারণ করার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান, আজকের band music-এর বীজ অনুপ্রবেশকারী rap-এর মিশ্রণ বাংলা গানে শুরু হয়েছে৷ তখনই নচিকেতা ঘোষ দেখিয়ে দিয়েছেন, মূল্যবোধে বিশ্বাসী মরমী, প্রগতি বিশ্বাসী সুরস্রষ্টা হয়েও তিনি মন ও আত্মাস্পর্শ করা সুর সংযোজন করতেও যেমন জানেন, সমাজ বিকলাঙ্গ করার পথটাও তাঁর অজানা নয়৷ ‘আগামী পৃথিবী কান পেতে তুমি শোন’-র রচয়িতা সচেতনভাবে জানতেন ইউরোপীয় সভ্যতার Symphony আর মার্কিনি rap-এর প্রয়োগ-কৌশল৷ আমার মনে আছে নচিদা বলেছিলেন with full motive ওই গানটিতে কোনও অশ্লীল শব্দ না ব্যবহার করেও ছন্দে, শিল্পীর অভিব্যক্তিতে গানটিতে ঘনিষ্ঠভাবে Sex impulse-কে প্রয়োগ করব৷ পাঠকবর্গ দয়া করে গানটি শুনে যদি দেখেন, দেখবেন মনে হবে একটি কামাসক্ত নারী সহবাস-সঙ্গী না পাওয়ার কারণে কোলের ওপর বালিশ রেখে, বুক চেপে তার কামস্পৃহাকে সংবরণ করার চেষ্টা করছে৷ এই দুঃসময়ের যুগে যখন ছত্রে ছত্রে সংগীত রচনায়, চলচ্চিত্রায়নে, এমনকি বিভিন্ন সিরিয়ালে Sex and crime-কে motive করছে, তখন নচিদার এই গানটা শুনতে শুনতে এই প্রজন্মকে বলতে ইচ্ছে করে— তোমরা দেখ আজন্ম পরিশীলিত রুচিবোধের সংগীত সাধক, একজন শিক্ষিত চিকিৎসক তিনি দক্ষতার সঙ্গেই পারতেন শিল্পে, মানস বিকারকে প্রকাশ করতে কিন্তু তা তিনি করেননি৷ শুধু একটা নমুনা রেখেছেন মাত্র৷ কারণ তিনি যে ‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্রা’-র সপ্রাণ ঋত্বিক৷

পাঠকবর্গ মাপ করবেন, নচিদার কথা লিখতে লিখতে, বলতে বলতে আমার অনুভূতি, আবেগ সাগরের জলোচ্ছ্বাসের মতো উদ্বেলিত হয়ে পড়ে৷ তবু মনে হয়, কত সঙ্গ, কত শিক্ষা, কত মানবিক বোধের কথা যেন বলা হল না৷ সত্যি বলতে কি,— বলা যায়ও না৷ যতটুকু ভাবা যায়, যতটুকু বোঝা যায়, তার কতটুকুই বা প্রকাশ করা যায়! অনুভূতির অধিকটাই তো অনুচ্চারিত, আবার এ-ও সত্য নীরব সম্ভোগের মজাই আলাদা৷

নিছক আলোচনার প্রেক্ষাপটেই দু’জন সার্থক, অতি জনপ্রিয় দুজন সুরকারের নাম বলব৷ একজন রাহুল দেববর্মন ও আর একজন সুধীন দাশগুপ্ত৷ যাঁদের অসাধারণ সৃষ্টি-মুগ্ধতা আকাশকে স্পর্শ করেছে৷ কিন্তু এই দুজন সুরস্রষ্টার সঙ্গে সলিলদা ও নচিদার সৃষ্টির একটা মৌলিক তফাত পাই সৃষ্টি ভাবনায়৷ রাহুল দেববর্মন বা সুধীনদার সুরে যতটা আন্তরিক মেলোডির ছোঁয়া আছে, [অন্তত আমি যা বুঝি] ততটা জীবন সংগ্রামের ছাপ পাই না৷ সেখানে সলিলদা ও নচিদার সুর শুনলে মনে হয় you cannot get a light without fire and you can not create a fire without friction. দেশলাই কাঠি ও দেশলাই বাক্স থাকলেও ঘর্ষণ ছাড়া জীবনে আলো জ্বলে না৷ কাউকে ছোট না করেও বলতে পারি, music-এ struggle না থাকলে তা আমায় আকর্ষণ করে না৷ তাই নচিদার ‘চাওয়া পাওয়া’-র দুটি গান পরপর আসার শিক্ষা আমায় ‘চেনা অচেনা’ ছবিতে দুটি গান পরপর ব্যবহার করার চিন্তাভাবনাকে পথ দেখিয়েছিল৷ আর সলিলদা তো আমার সংগীত-জীবনের দিশারি, তাঁর কথাই আলাদা৷ তাঁর সংগীত সৃষ্টির দ্বন্দ্ববাদ আমার সমস্ত সৃষ্টিতে প্রদীপের মতো আলো জ্বেলে দিয়েছে৷

নচিদার প্রয়াণ হল তখন, যখন তিনি জনপ্রিয়তা, সৃষ্টিশীলতার মধ্যগগনে৷ কিন্তু এই সীমিত সময়ের কর্মকাণ্ড প্রকৃত অর্থে সীমিত নয়৷ বিশেষ করে, যে-সব স্রষ্টার মধ্যে বিচিত্রগামিতার পরিধি ব্যাপ্ত, তাঁদের পরিমাপও কষ্টসাধ্য এবং পূর্ণাঙ্গ বিচার করা সত্যিই কঠিন৷ তাই আরও যেন অনেক কিছু লেখা বাকি রয়ে গেল৷ যেমন ছড়ার গানে তাঁর অবদান৷ শিশুসুলভ মনকে শিশুর মনের কাছে পৌঁছে দিয়ে, ‘হাট্টিমাটিমটিম’, ‘ময়নার মা ময়নামতী’ বা ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ সৃষ্টি করা৷ তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এই সার্থক স্রষ্টা যখন যা সৃষ্টি করেছেন, তখন সেই সৃষ্টি-সূত্রর অঙ্গনে অভিসারী হয়েই, তাঁর সত্য আবেগকে হৃদয়ে মনন করেই তবে তা সৃষ্টি করেছেন৷ বোধের সংস্কারে একটা স্বতঃস্ফূর্ত সত্যানুভূতি না থাকলে এমন সৃষ্টি করা যায় না৷ মননের বীজের মধ্যে সৃষ্টির যেমন ভ্রূণ থাকবে ফসল তো তেমনই হবে৷ এই বিচারে নচিদার সৃষ্টিতে তাঁর অন্তরবোধ একশো ভাগ বোধিতে উত্তীর্ণ৷

একজন সুরকার হলেই ট্রেনার হন না৷ বা সংগীত পরিচালক হন না৷ নচিদা যতটা সার্থক সুরকার, ততটাই সার্থক ট্রেনার, ততটাই পূর্ণাঙ্গ সংগীত-পরিচালক৷ একটি সংগীত যদি Basic record হয়, তখন তিনি সংগীতের চিত্রায়ন করেছেন৷ যদি চলচ্চিত্রের গান হয়, তবে তিনি বিশেষ দৃশ্যকে সংগীতায়ন করেছেন৷ আর যখন কাউকে গান ট্রেনিং করেছেন তখন সেই শিল্পীকে মনে হয়েছে অসাধারণ তারকা৷ অথচ অন্যের তত্ত্বাবধানে ওই একই শিল্পী গান করে নক্ষত্র হওয়া তো দূরের কথা একটা প্রদীপ হয়েও জ্বলতে পারেননি৷ আর তিনি গিনি সোনা ও খাদ মেশানো সোনার তফাত বুঝতেন৷ মেগাফোন [গ্রামোফোনও নয়] রেকর্ডসে মাধুরী চট্টোপাধ্যায়কে এমন দুটি গান দিয়ে মাধুরীর জীবনের সূত্রপাত ঘটালেন যে, মাধুরীকে আর কখনও পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি৷ গান দুটি— (১) ‘অলি অমন করে নয়’, (২) ‘তোমার আমার প্রথম দেখা’৷ একটি শিল্পীর নতুন আত্মপ্রকাশের মুহূর্তে ‘অলি অমন করে নয়’-এর মতো গান নির্বাচন করা বুকের পাটা কার আছে বা ছিল বা থাকবে জানি না; অন্তত আমার তো আজও নেই৷ প্রণাম নচিদা৷ আপনার চরণে শতকোটি প্রণাম৷ জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও আমি আপনার আশীর্বাদে ধন্য হতে চাই৷ একদিন গ্রামোফোন কোম্পানির মহলাবাড়িতে আমার সৃষ্টি ‘তোমার দু’চোখে আমার স্বপ্ন আঁকা’ (শিল্পী— প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়) শুনে আমায় চুম্বন করেছিলেন, সেই চুম্বনে ছিল অনেক ভালবাসা, অনেক আশীর্বাদ৷ আমি আজও সেই অন্তরের স্পর্শ পেতে আকাঙ্ক্ষিত৷ শুনেছি বিখ্যাত সংগীত পরিচালক জয়কিষানজি, ও পি নায়ার— এঁরা সার্থক কাজ করার সুবাদে সোনার চেন, হাতের ঘড়ি খুলে দিতেন৷ এই মানসিকতা আপনারও ছিল৷ স্বার্থপর বা কুক্ষিগত মনোভাব আপনার উদার বক্ষে কখনও স্থান পায়নি৷ ‘মধুমতী’ ছবি রিলিজের দিন দেখেছি আপনি সলিলদার সাফল্য কামনায় ছটফট করছেন, বলছিলেন— ‘অভিজিৎ ‘মধুমতী’ না চললে সলিলকে বোম্বে থেকে চলে আসতে হবে৷’ এইসব শুভ-আত্মীয়তা কি সলিলদার সাফল্যের পথে কোনও অবদান রাখেনি? কী জানি, অধিক জড়-বিজ্ঞানীদের অনুভবে হয়ত আমার এই চিন্তা অবাস্তব, কিন্তু আজও আমি এই চেতনায় সমৃদ্ধ হই৷

নচিদা হঠাৎ একদিন বললেন— ‘বুঝলি, If you like to satisfy others with your own creation, try to satisfy yourself first. নিজেকে কখনও ঠকাবি না— দেখবি তোর কাজে তখন নিজেও ঠকবি না৷’ ভাবলাম বা আজও ভাবি কী অপূর্ব realisation. এই realisation-এর ভিত্তিভূমি চেনা দরকার, বোধের ব্যাখ্যা দরকার৷

মানুষের স্বীকৃত ধারণা— শিক্ষা কর, সাধনা কর, ফল পাবে৷ এই শিক্ষা ও সাধনার বিশ্লেষণ চাই, বিচার চাই৷ রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাকে বলেছেন ‘কমল হীরে’, কিন্তু তার থেকে ঠিকরে পড়া আলোকে বলেছেন ‘কালচার’৷ এই Culture-বিহীন বিদ্যা অনেক মানুষের জীবনের সমস্ত উৎকর্ষ ও শিল্পকে ব্যাকরণ করে রেখেছে৷ তাঁরা নন্দন বোধে নিতে পারেনি নিজেদের প্রয়োগকে৷ তাঁরাই সার্থক, যাঁরা আঙ্গিক তত্ত্বকে আত্মীকরণ করে, শিক্ষাকে সৌন্দর্যবোধে নিমগ্ন করে, শিল্পী হতে পেরেছেন৷ যেমন আমির খাঁর গান শুনলে মনে হয় সংগীত-ঋত্বিক৷ রবিশঙ্করজির আত্মমগ্ন সেতার বা আমজাদ আলি খাঁ সাহেবের সরোদ কোনও বাজনা নয়, এ যেন মানুষের হাসি-কান্না-মিলন-বিরহ-প্রেমের পদাবলি৷ এই নন্দন বোধের অভাবে আজ ধর্মও ধর্মান্ধতায় পর্যবসিত— ধর্ম যেন পুঁথি, ধর্ম যেন বোধহীন অনুশীলন ও অনুকরণ৷ আমাদের সংগীতেও এই বোধহীনতার পর্দার সার্কাস, প্রাণের সুরকে কর্কশ করে তুলেছে৷ আর এই বোধ, অনুভবই নচিকেতা ঘোষকে এক মহান সুরস্রষ্টা হিসেবে প্রকাশ করেছে৷ জীবনকে অস্বীকার করে জীবনশিল্প অসম্ভব৷

সেদিন নচিদার দীর্ঘদিনের বন্ধু প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল৷ দ্বিজেনদা বলছিলেন— নচির সাংগীতিক শিক্ষার পুঁথিগত মান যা ছিল, তার থেকে অনেক বেশি তার প্রয়োগ-সাফল্য৷ আর একটা কথা বললেন যে, নচি অসম্ভব নানা ধরনের গানবাজনা শুনত৷ এই কথাটা যে কতখানি সত্য-সম্পৃক্ত তা বোঝা যায় নচিদার বিভিন্ন যন্ত্রসংগীত ব্যবহার ও গানে অভাবিত পর্দা ব্যবহার দেখে৷ ওই যে পিয়ানো শিখতে শিখতে আর শিখলেন না, গানটা সলিলের মতো হয়ে যাবে বলে— এই তাঁর স্বকীয়তা রক্ষার ধ্যান ও তপস্যা, তারই একটা জ্বলন্ত উদাহরণ৷ অথচ শুনে শুনে কানটা এমনই পাকা করে ফেলেছিলেন যে, সেই কান ও তাঁর বোধকে বাহন করে অসাধারণ সব সৃষ্টি করলেন৷ নচিদার বোধ সবসময় বোধিতে উত্তীর্ণ ছিল৷ তাঁর সৃষ্টিতে ব্যাকরণের দাসত্ব নেই৷ যা আধুনিক বাংলা গানের জনক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের চিন্তারই প্রতিধ্বনি৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সংগীতের উদ্দেশ্যই ভাব প্রকাশ করা৷’ নচিদা most religiously এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই কাজটা করতেন৷ তার সঙ্গে যুক্ত ছিল তাঁর মৌলিকতার মুক্ত ভাবনা৷ কথাটা পরিষ্কার করার জন্য অন্য কয়েকজন সুরস্রষ্টার প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি৷ যেমন সলিল চৌধুরি৷ তিনি অসাধারণ বৈপ্লবিক এক সুরস্রষ্টা— পর্দা ব্যবহারে, সাংগীতিক শিক্ষায়, বোধের বোধিতে সবসময় অপ্রতিদ্বন্দ্বী শিক্ষিত স্রষ্টা৷ কিন্তু তিনি তাঁর প্রকাশের নিজস্ব ভাবমূর্তির পরিকাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বা চাননি৷ ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত বিখ্যাত সার্থক সুরকারই তাঁদের নিজস্ব আঙ্গিক পরিকাঠামোর কারাগারে বন্দী৷ তাই চেনা যায় নৌশাদজিকে, চেনা যায় শচীন দেববর্মনকে, চেনা যায় সলিল চৌধুরিকে, জয়দেবকে, মদনমোহনকে, রোশনকে৷ এক একজন এক এক ধারার৷ কিন্তু চেনা যায় না অনুপম ঘটককে, নচিকেতা ঘোষকে, আর ডি বর্মনকে৷ Unpredictable সরণিতে বিচরণ সবারই আছে, বিস্তৃতির দিক থেকে শঙ্কর জয়কিষণ তো বোধহয় সর্বকালের কিংবদন্তি৷ তবু তাঁদের চেনা যায়৷ আমি অনেক ভেবেছি— বিচিত্র ভাবনার, অনুভবের প্রতিফলন তো সবারই সৃষ্টিতে আছে, তবে অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, আর ডি বর্মনকে কেন আমার এরকম বোধ হয়? এর কারণ আমার মনে হয়, সলিলদা যখন শাস্ত্রীয় সংগীত অবলম্বন করে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘ঝনন ঝনন বাজে’ বা ‘লালপাথর’-এ ‘ডেকো না মোরে’ বা লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে ‘না যেও না’ করেছেন তখন তাঁর চলনে সলিল চৌধুরিই জ্বলজ্বল করে দীপ্যমান৷ সেখানে নচিদা শাস্ত্রীয় সংগীত সেভাবে চর্চা না করেও তাঁর বোধের বোধিসত্ত্বে যখন ‘বেঁধো না মালা ফুল ডোরে’ বা ‘বনে নয় মনে’ করেছেন তখন মনে হয় না Rigidly composer গানে তাঁর নিজের প্রভাব বিস্তার করেছেন৷ অথচ এটাই তাঁর নিজস্বতা৷ ‘ছোট্ট পাখি চন্দনা’ বা ‘ময়নার মা ময়নামতী’তে আমরা শিশুমনের যে আত্মীয়তা পাই অর্থাৎ সেখানে নচিদা তাঁর অনুভূতিকে যেভাবে বেঁধে রেখেছেন; শিশুর মেধা, বুদ্ধি, শিক্ষার বোধের সুতোয়— সেখানে অনেকের সৃষ্টিতেই তা দেখা যায় না৷ তিনি তাঁর নিজেকে অতিক্রম করে কেবল বিষয়টির প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছেন৷ নচিদা পিয়ানো শিখলেন না— শিখলেন না সিম্ভনি কিন্তু তাঁর বোধের আকাশে বিস্তৃত করলেন তাঁর বোধিসত্ত্ব অনুভবের Saxophone, Trumpet, পঞ্চাশ বাজনদারের Group Violin৷ এমন দুঃসাহসী Music Director কম দেখা যায়৷ যেমন ‘চাওয়া পাওয়া’র দুটি গান, তেমনি চার্চে মানুষ হওয়া পিয়ানো বাজানো দাড়িওয়ালা চরিত্রের মুখে ‘মানুষ খুন হলে পরে’ মতো অসাধারণ গান সৃষ্টি করলেন৷ অনেক ভেবেছি গানটার চলনে পুরো Concept ভেঙে পর্দায় Symphony movement রাখলেন অথচ তালের চলনে কিন্তু সনাতন ভারতীয় তালযন্ত্রের মতো Scan করলেন৷ আমি হলফ করে বলতে পারি, আমি যদি ওই গানটা ওই দৃশ্যে ওই চরিত্রের মুখে গাইবার জন্যে তৈরি করতাম, হয়ত নিজেই শেষ পর্যন্ত বাতিল করতাম৷ বারবার মনে হত চার্চের ফাদারের কাছে মানুষ হওয়া ব্যক্তির মুখে এই গান অচল৷ Church-এর Canvas বড় হয়ে তখন ছবিটার মূল ভাব ব্যাহত হত— অথচ নচিদা সেখানে বোধ ও প্রয়োগের ঐকতান সৃষ্টি করলেন৷

নচিকেতা ঘোষ এমনই এক সুরস্রষ্টা যাঁর সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করা জরুরি৷ কেবল তাঁর মূল্যায়ন করার জন্যে নয়, নিজের শিক্ষার প্রয়োগের মান বাড়িয়ে নিজেকে দক্ষতার পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে৷ একজন পূর্ণাঙ্গ সংগীত পরিচালক হতে গেলে প্রয়োজন বিভিন্ন ধারার সংগীতচর্চা৷ সুরযন্ত্র, তালযন্ত্রকে আপন বোধে সম্পৃক্ত করা৷ সাহিত্য কাব্য জীবন-দর্শনের সম্পর্কে বোধিত হওয়া৷ এইরকম বিভিন্ন পথ পরিক্রমার প্রয়োজন, কিন্তু কেবল হাঁটতে শিখলেই হাঁটা যায় না৷ সার্থক হাঁটা হয় না৷ জানতে পারলেই জানা হয় না৷ সবচেয়ে বড় প্রয়োজন এই সমস্ত দেখাশোনা পরিচয়ের মধ্যে দিয়ে এক স্বকীয় ভাবনার জগতে নিজেকে সত্য-সম্পৃক্ত করা৷ নিজের পথে চলার ‘দক্ষতা অর্জন’ করা না হলে সব শিক্ষাই ভস্মে ঘি৷ এই বিচারে আঙ্গিককে কম আয়ত্ত করেও সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্যকে অনেক বড় পরিধিতে ছড়াতে পেরেছিলেন নচিদা, কেবলমাত্র তাঁর পৃথিবীর তথ্য সমগ্র সৃষ্টির স্পন্দনের সঙ্গে আত্ম ভাবাবেগ গ্রোথিত করতে পেরেছিলেন বলে৷ যে কোনও Art-ই ছবি আঁকা, রঙ তুলি ক্যানভাসের যথাযথ প্রয়োগে৷ নচিদা তা-ই করেছেন৷ তাঁর সমস্ত ছবি আঁকার Canvas তাঁর বিস্তৃত বোধ আর রঙ-তুলি তাঁর দাসত্বহীন আঙ্গিকের ভাব মিশ্রিত রঙ মিশ্রণ৷ কেন তিনি এক বিস্ময়কর— এত স্বতঃস্ফূর্ত, চলমান, কেন তিনি আজও জীবিত, কেন তিনি আজও প্রাসঙ্গিক, তাঁকে তিল তিল করে বুঝলে এক নব প্রজন্মের স্রষ্টার কাছে তিনি হয়ে উঠবেন আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্রহ্মামূর্তি৷ যা সৃষ্টিশীলতার স্বকীয়তার অদম্য সাহসের— বাংলা গানের গতির আবেগের, আরও কত কী, আরও আরও আরও… কত কী-র আদর্শ প্রতীক৷

নচিপুত্র সুপর্ণকান্তির কাছে শুনেছি নচিদা সুরারোপিত বহু গানের বাণীর idea ও মুখ নচিদার দেওয়া৷ যখন যে-কাজে যে গীত-রচয়িতার ওপর তিনি ভর করতেন তার হাল খারাপ হয়ে যেত৷ তাঁর কাছে সৃষ্টির সময়— সকাল বিকেল সন্ধ্যা রাত— এমনকি মধ্যরাত বা ঊষা প্রভৃতিরও কোনও স্পষ্ট মুহূর্ত ছিল না৷ চব্বিশ ঘণ্টার যে কোনও সময় তাঁর প্রসববেদনা দেখা দিত৷ গঙ্গাপারের পুলকবাবু সালকিয়াবাসী, তাতে কী! এক্ষুনি চলে আসতে হবে সালকিয়া থেকে শ্যামবাজার৷ আসলে বাণী ও তার জীবনদর্শন— সমগ্র গানটির একটি ছবি মনে মনে তৈরি হয়ে গেলে তিনি এক ধৈর্যহীন দুরন্ত শিশু৷ এ-হেন মানুষ বম্বে থেকে কলকাতায় ফিরে এসে পড়লেন মহা বিপদে৷ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখার্জি প্রমুখ অনেকের গান করে তিনি আবার বম্বে ফিরে যাবেন— কারণ তখন তিনি ফিল্মালয়ের চুক্তিবদ্ধ সংগীত পরিচালক৷ এদিকে কিছু আইনি কারণে তাঁর প্রিয় দুই গীত-রচয়িতা পুলকবাবু ও গৌরীদার রচনা সুর করতে পারবেন না৷ কী করেন? তখন আমি শিবদাসবাবু প্রমুখ অনেকেই সেই আইনের আওতায় পড়ি না৷ নচিদা আমাদের নিয়ে কাজ শুরু করলেন৷ যার দুটি সাফল্যের ফসল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গীত (১) মায়াবতী মেঘে (শিবদাসের), (২) তারা ঝিলমিল (আমার)৷ আমি ওই গানটা ছাড়াও দ্বিজেনদার জন্যও একটা গান লিখেছিলাম৷ নচিদা তখন যেন মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো কাব্য-রচয়িতা হয়ে এঘর-ওঘর করছেন৷ এক একজনকে এক একটা সুর দিয়ে লিখতে বসিয়েছেন৷ আমার মনে আছে নচিদার সুরে গান লেখা মানে নিজেকে graded করা৷ যিনি ছন্দের জাদুকর, তাঁর scanning-এ গান লেখা খুবই শক্ত৷ আমি মনে মনে স্থির করলাম, আমি religiously exacting করার চেষ্টা করব তাঁর রচিত সুরের scan-কে৷ তিনি আমায় একটা হিন্দি গানের বাণী দিলেন, ‘তারোঁ ঝিলমিল ধড়কে এ দিল মিঠে ধুন শুন শুন চম্পক সই কলি জাগ চলিরে’৷ আমি কথা দিলাম— ‘তারা ঝিলমিল স্বপ্ন মিছিল ঘুমে ঢুল ঢুল ঢুল চম্পক ছায় অলি জাগলো কিরে৷’ আর একটা scan দিয়েছিলেন ‘তাম তাম তাতামতা’ আমি কথা লিখেছিলাম— ‘এই মন আচমকা৷’ তাঁর সঙ্গে কাজ করে বড় তৃপ্তি পেয়েছিলাম৷

নচিদা এক বিচিত্র প্রকৃতির মানুষ ছিলেন৷ যাকে পছন্দ করতেন প্রাণ থেকে, যাকে অপছন্দ করতেন তাও প্রাণ থেকে৷ যেমন সলিলদাকে তিনি সত্যিই আন্তরিক ভালবাসতেন৷ সে সৌভাগ্য অবশ্য আমারও হয়েছে৷ আমি ভাল করে কাজ করব এই কারণে যেমন শিক্ষা দিয়েছেন, তেমন আমার কাজের সাফল্যে একেবারে অন্তর থেকে আনন্দবোধ করেছেন৷ যেমন ‘তোমার দু’চোখে’ শুনে যে আমায় চুম্বন করেছিলেন, সেই কথা তো আগেই বলেছি৷ একটা ঘটনা মনে পড়ে, আমাদের মধ্যে এক স্বনামধন্য গীত-রচয়িতা নচিদাকে দিয়ে একটা ছবি করাতে চান, নচিদার ইচ্ছা তিনি মধ্যস্থতা করে ছবির কাজটা আমায় দিতে৷ আমার নিজের কানে শোনা৷ তিনি যখন আমার পক্ষে প্রচণ্ড সওয়াল করছেন তখন আমি শুনছি গীত-রচয়িতা ব্যক্তিকে বলছেন— ‘কেন ছবিটা ওকে দিবি না— তুই কি জানিস ও কতটা দক্ষ?’ শেষে সেই ব্যক্তি নিজে নচিদার সঙ্গে কাজ করার প্রেরণা থেকে কিছুতেই সরল না৷ তখন নচিদা বিরক্ত হয়ে সেই সময়ের আর্থিক বিনিময়ের যা প্রাপ্তি হয় তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ দাবি করলেন, আর বললেন গান recording-এর দিনই পুরোটা একসঙ্গে দিতে হবে৷ এই ধরনের কাজ নজিরবিহীন৷ সলিলদা, হেমন্তদা ছাড়া অনুজদের প্রতি অগ্রজের এই হৃদয়াবেগ প্রায় দেখাই যায় না৷ সলিলদার মতো তিনি স্বতঃস্ফূর্ত নন, কিন্তু যেখানে তাঁর প্রাণ কাজ করবে, সেখানে হৃদয় পেতে দেবেন৷ এই মর্মবোধ তাঁর একটা স্বভাব-ঐশ্বর্য৷ কাজের আন্তরিকতা তাঁকে সবসময় আকর্ষণ করত যার স্থান ছিল আর্থিক অঙ্কের অনেক ওপরে৷’ ‘অসমাপ্ত’ ছবিতে পাঁচজন সুরকার সুর করেন৷ নচিদাও তার মধ্যে একজন৷ নচিদা নিজের পারিশ্রমিকের পয়সা খরচ করে বম্বে গিয়ে হেমন্তদা ও লতাজিকে দিয়ে গান করিয়ে আনলেন৷ সেই ছবিতে তাঁর গানই জনপ্রিয় হল, ‘কান্দো ক্যানে মন’৷ এই গানটার একটা না-জানা ইতিহাস সুপর্ণকান্তির কাছে জানলাম৷ — ‘অসমাপ্ত’ ছবিতে আরও যে গান ছিল লতাজির গাওয়া তিনি তার জন্যে কোনও পারিশ্রমিক নেননি কারণ একটি মারাঠি ছবিতে লতাজি ওই সুরটা ব্যবহার করার জন্যে নচিদার অনুমতি নেন ও হেমন্তদাকে দিয়েই গাওয়ান৷ এই বিনিময়ের সময় নচিদা একটা রুপোর model বীণা লতাজিকে উপহার দেন৷ এই ঘটনাগুলো স্রষ্টা মানুষটির হৃদয়বৃত্তির পরিচায়ক৷ শিল্প সৃষ্টির জন্যে প্রতিটি স্রষ্টার মধ্যেই এরকম স্বকীয় কিছু ভাব থাকেই৷

শিল্পবোধের হৃদয় নচিদার কাছে সত্যিই একটা বীণার তারের মতো সুরেলা হয়ে থাকত৷ তার নিশ্চিত-প্রমাণ শিল্পী বিশেষে তাঁর গান নির্বাচনের দৃষ্টিভঙ্গি৷ এক্ষেত্রে একটা চিন্তা আমার আর নচিদার মধ্যে সমমর্মিতায় বাঁধা৷ কারও গান করাবার সময় আগে এ শিল্পী কী ধরনের গান করেছেন এরকম ভাবনায় তিনি নিজেকে জড়াতেন না৷ তিনি দেখতেন শিল্পীটির মধ্যে কী কণ্ঠ-ঐশ্বর্য ও মাধুর্য আছে৷ অনুভবে প্রকাশে কতটা সে loud বা কতটা sophisticated, কতটা delicate, কতটা intimate in feeling. সেইভাবে তাকে দিয়ে সেইরকম গান করাতেন৷ এক্ষেত্রে tone characterisation একটা বড় ভূমিকা পালন করত৷ উদাহরণস্বরূপ বলব, তরুণদার ‘চল রীনা’৷ ইলা বসুর— ‘ঐ কোকিল শোনায় চৈতি হাওয়ার কথকথা’৷ ‘ঝিম ঝিম নেশা’৷ পিন্টুর তাজমহল, নির্মলার গান এমন একটি ঝিনুক স্বপ্না দাশগুপ্তর কণ্ঠে ‘প্রজাপতি বসলে এসে গায়’ [ননীগোপালের বিয়ে]৷ আরতির ‘জলে নেবো না’ প্রভৃতি গান নির্বাচন বিস্ময়কর৷ হেমন্তদার ‘আমার গানের স্বরলিপি’-র শিল্পী তো তাঁর প্রিয় পুরুষকণ্ঠ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ কিন্তু ‘পুতুল নেবে গো’ জনপ্রিয় করালেন শ্যামল মিত্রের কণ্ঠে৷ মানবদার কণ্ঠে ‘আঙুল কাটিয়া কলম বানাই’৷ আবার মান্না দে-র বাংলা ছবিতে যখন আবির্ভাব ঘটল ‘মউ বনে আজ মৌ জমেছে’র সুরকার তখন রূপ বদলে গান শুরু করলেন ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজা’৷ আবার প্রায় একই ছবি ‘কা তব কান্তা’-র শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷ এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় একটা ঘটনা৷ ‘বন্ধু’ ছবির প্রথম গান ‘মউ বনে আজ’ গানটি হেমন্তদা শিখলেন৷ যেই ‘মালতী ভ্রমরের’ গানটি নচিদা গাইলেন— হেমন্তদা তড়াক করে উঠে পড়লেন৷ বললেন— ‘ও বাবা এ আমি পারব না, আপনি মানবকে খবর দিন৷’ কিন্তু অনুভবী সংগীতকার নচিদা জানতেন skill-কে ছাপিয়েও impulse-এর প্রভাব অনেক বেশি; দক্ষতার চেয়ে আওয়াজের চরিত্রের নিজস্ব আকর্ষণী শক্তি অধিক৷ হেমন্তদা হার স্বীকার করে গাইলেন, হয়ত খামতি হল skill-এর, কিন্তু শিল্পের মূল সত্য ও তত্ত্বের communication-এ নচিদা একশোভাগ উতরে গেলেন৷

আজ সমস্ত সংগীত মহলের কাছে আমার আবেদন, দৃষ্টান্ত-সহ নচিদার সৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করুন৷ নচিদার গান নিয়ে সংগীতের আসর বসান, archival importance-কে বর্ধিত করুন৷ সেটাই হবে একাধারে যথার্থ শ্রদ্ধা নিবেদন ও অন্যদিকে আত্মশিক্ষার প্রসারণ৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *