1 of 2

ভাড়াটে বাড়ি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

ভাড়াটে বাড়ি – গজেন্দ্রকুমার মিত্র

উপরে নীচে মোট বারোখানি ঘর কিন্তু তেরো ঘর ভাড়াটে থাকে বাড়িটিতে। বাড়ির ভিতর দিকে পশ্চিমের যে বারান্দা তাহারই একটা খাটাল চটের পর্দা দি ঢাকিয়া শীতাতপ হইতে আড়াল করা হইয়াছে এবং সেই অতি সংকীর্ণ-পরিসর স্থানের মধ্যেই আবও সরু তক্তপোষ পাতিয়া কালীপদ নিজের বাসস্থান ঠিক করিয়া লইয়াছে; দক্ষিণ দিকে দেওয়ালে পেরেক ও দড়ির সাহায্যে আলনা টাঙ্গাইয়া তাহাতে সে রাখে কাপড় জামা এবং তাহার বাকি ‘এস্টেটপত্র’ অর্থাৎ একটা ভাঙা তোরঙ্গ আর জোড়া দুই অতিশয় জীর্ণ জুতা, থাকে তক্তপোষের নীচেই।

এ বুদ্ধি নাকি কালীপদর নিজেরই, সে ঘর খুঁজিতে আসিলে বাড়িওয়ালা প্রতাপবাবু তাহাকে বলিয়াছিলেন, ঘর না তৈরি করলে আর দিতে পারব না, সব বোঝাই।

সে জবাব দিয়াছিল, ঠিক এই রকমই খুঁজছি আমি। চলুন দেখি, আমি ঘর বার করতে পারি কি না—

হতভম্ব প্রতাপবাবু প্রশ্ন করিয়াছিলেন, তার মানে?

সে কহিয়াছিল, মানেতে দরকার কি, চলেই আসুন না!

এবং তাঁহার হাত ধরিয়া প্রায় টানিতে টানিতে ভিতরে লইয়া গিয়া তাহার প্রস্তাবটা বুঝাইয়া দিয়াছিল। প্রতাপবাবু আরও বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু এর প্রয়োজন কি? কলকাতাতে কি আর ঘর নেই?

কালীপদ উত্তর করিয়াছিল, ঢের, অভাব কি? অভাব যেটা হচ্ছে সেটা আমার টাকার—একটা ঘর নিলে তো আর ছ’সাত টাকার কম পাব না, মেসে সিট নিলেও চার টাকা অন্ততঃ দিতে হবে। অথচ আমার দুটি টাকার বেশি সঙ্গতি নেই। আপনারও ধরুন এটা স্রেফ উপরি তো? যা পেলেন তাই লাভ।

বলা বাহুল্য আর একটু বিবেচনার পর প্রতাপবাবু রাজি হইয়াছিলেন। সেই হইতে কালীপদ তাহার এই অদ্বিতীয় ঘরকন্না পাতিয়া এইখানেই আছে। তাহার এই আবিষ্কারের জন্য তাহার গর্বেরও সীমা ছিল না, প্রায়ই লোককে ডাকিয়া কহিত, বাবা, প্রতাপ দত্তের চেয়েও আমার বিষয়বুদ্ধি! দিলুম ওর দুটো টাকা আয় বাড়িয়ে।

কালীপদর বয়স বছর কুড়ি বাইশ হইবে কিন্তু এই বয়সে কেহ যে এমন অলস হইতে পারে, তা এ বাড়ির কাহারও জানা ছিল না। এ বিষয়ে সে ছিল অদ্বিতীয়; কী একটা ছাপাখানায় সে চৌদ্দো টাকা মাহিনায় চাকরি করিত, সকাল দশটা হইতে অপরাহ্ন ছয়টা পর্যন্ত সেখানে কাজ করিবার কথা। সে প্রত্যহ ঠিক সাড়ে নয়টা পর্যন্ত সকালে ঘুমাইত, বাকি সময়টার মধ্যে তাহাকে স্নান প্রভৃতি সারিয়া খুচরা দরের হোটেল হইতে ভাত খাইয়া দশটার মধ্যে হাজিরা দিতে হইত। তাড়াতাড়িতে কোন দিনই ভাল করিয়া খাওয়া হইত না, তবু সে একটি দিনও সাড়ে নয়টার আগে শয্যাত্যাগ করিত না, কেহ অনুযোগ করিলে বলিত, উঠে কি করব? ভোর হতে না হতে কল পাইখানা নিয়ে যা কাড়াকাড়ি আর ঝগড়াঝাটি, তার চেয়ে সকলের সারা হলে নিই, এই আমার ভাল।

কিন্তু সন্ধ্যাবেলাও অফিস হইতে বাহির হইয়া কোনমতে একটা উড়ের দোকান হইতে দুই পয়সার রুটি কিনিয়া আহারটা সেইখানেই সারিয়া লইত, তাহার পর বাসায় ফিরিয়াই সটান শয্যাগ্রহণ। অর্থাৎ অফিসের আট ঘণ্টা আর এদিকে ওদিকে আরও ঘণ্টাখানেক, এই মোট ন’ঘণ্টা ছাড়া সে একটি মুহূর্তও বৃথা অপব্যয় করিত না; চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে পনেরো ঘণ্টাই তাহার কাটিত বিছানায়। অন্য কোন রকম বাড়তি আয়ের চেষ্টা তো করিতইনা, প্রেসেই কোন দিন ‘ওভার টাইম’ খাটিতে বলিলে সে সোজাসুজি অস্বীকার করিত। বলিত, দেখুন পয়সাটাই বড় কথা নয়, শরীরটার দিকেও দেখতে হবে তো? এই যা খাটুনি, কোন দিন পড়ব আর মরব।

বাসার কেহ অনুযোগ করিলে বলিত, কী হবে আমার বেশি পয়সায়? চারটে টাকা গুদোম ভাড়া দিতে হয়, আর বাকি দশ টাকাতেই আমার বেশ চলে যায়। মায়ের পেটে দশ মাস ছিলুম, ওটার ভাড়া দেওয়া দরকার, বুঝলেন না? আর কাউকে দেখবার আমার দরকার কি? দেশে যা আছে তার ওপর আর চারটে টাকা হলেই মায়ের বেশ চলে যাবে, চাই কি যদি একটু টেনে চালাতে পারে ত হাতে দু’পয়সা জমবেও—

এমনকী উপরের মহিমবাবু তাহাকে অনুরোধ করিয়াছিলেন তাহার ছেলেটিকে সামান্য অ-আ শিখাইতে, তাহার জন্য মাসিক এক টাকা হারে, পারিশ্রমিক দিতেও প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু কালীপদ তাহাতেও রাজি হয় নাই। মহিমবাবু বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিয়াছিলেন, কিন্তু সন্ধ্যাবেলা তো তুমি শুয়ে শুয়ে গল্পই কারো, ও যদি তোমার কাছে এসে পড়ে যায় ত তোমার ক্ষতি কি? অথচ একটা টাকা আয়ও তো বাড়ত!

উচ্চাঙ্গের হাসি হাসিয়া কালীপদ জবাব দিয়াছিল, একটা টাকা আয় বাড়লে তো আমার দুঃখ ঘুচবে না মহিমবাবু। ওটা কিছু নয়—কিন্তু এই সারাদিনের হাড়ভাঙা খাটনির পর, আবার এসে বকতে শুরু করলে কি আর শরীরে কিছু থাকবে মনে করেন? না, মহিমবাবু, ওটা মাপ করতে হল।

অথচ এই একটি বিষয়ে আলস্য তাহার কোন দিনই দেখা যায় নাই। বকিতে পারিত সে অসাধারণ; যতক্ষণ সে বাসায় থাকিত এবং জাগিয়া থাকিত, ততক্ষণ আর কাহারও শান্তি থাকিত না। অবিরাম গতিতে সে কাহারও না কাহারও সহিত বকিয়া চলিত। বক্তৃতার বিষয়বস্তুরও কোন দিন তাহার অভাব হইত না। সে বাসায় কাহারও খবরের কাগজ লইবার বদ অভ্যাস ছিল না, সুতরাং কালীপদ যতটা সংবাদ প্রেসের অন্যান্য কর্মচারীদের নিকট হইতে সংগ্রহ করিত, তাহার সহিত চতুর্গুণ ভেজাল মিশাইয়া সে অম্লানবদনে ইহাদের কাছে চালাইত। এ বিষয়ে তাহার প্রত্যুৎপন্নমতিত্বও ছিল খুব বেশি, নমুনাস্বরূপ তেতলার বামুন পিসির কথাই ধরা যাক—

বামুন পিসি বিধবা মানুষ, বিধবা কন্যা লইয়া থাকেন, সামান্য কিছু টাকা তেজারতিতে খাটাইয়া তাঁহার দিন চলে; সহসা একদিন নিজের বিছানা হইতে চিৎকার করিয়া কালীপদ তাঁহাকে সংবাদ দিল, আর খবর শুনেছ মাসি, কোম্পানি কি নতুন আইন করছে?

বামুন পিসি প্রথমটায় অতটা গ্রাহ্য করেন নাই, একটু তাচ্ছিল্য সহকারেই প্রশ্ন করিলেন, কি রে কালীপদ?

কালীপদ জবাব দিল, সোনার দাম হু হু করে বেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের বড় ক্ষতি হচ্ছিল বলে কোম্পানি আইন করে দিচ্ছে, সোনা আর কেউ পনেরো টাকা ভরির বেশি বেচতে পারবে না!

বামুন পিসির মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল, তাঁহার মূলধন শুদ্ধ চলিয়া যায়; তিনি ছুটিয়া আসিয়া কহিলেন, ওমা সে কি সর্বনেশে কথা রে, আমি যে তা হলে দাঁড়িয়ে মারা যাব।

কালীপদ সমবেদনা জানাইয়া কহিল, কিন্তু কি করা যায় মাসি, এধারে যে অনেক লোকের সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নীচের ঘরে তখন সুরেশবাবু অফিস হইতে আসিয়া কাপড় ছাড়িতেছিলেন, তিনি হাঁকিয়া কহিলেন, এ খবর কবেকার কাগজে দিয়েছে কালীপদ।

কালীপদ জবাব দিল, কেন আজকের।

সুরেশবাবু কহিলেন, কিন্তু আমি তো অফিসে আজকের কাগজ আদ্যোপান্ত পড়লুম, তাতে তো কৈ এ খবর পেলুম না।

কালীপদ কহিল, কি কাগজ পড়েছেন আপনি?

সুরেশবাবু কহিলেন, আমি দুখানা বাংলা কাগজ পড়েছি—

কালীপদ অম্লানবদনে জবাব দিল, এসব খবর ত বাংলা কাগজে থাকে না, ইংরিজি সব কাগজেই বেরিয়েছে—

সঙ্গে সঙ্গে সারা বাড়িটায় হুলুস্থূল পড়িয়া গেল। বামুন পিসি তো মড়াকান্না জুড়িয়া দিলেন। তিনি ভরিকরা কুড়ি পঁচিশ টাকা ধার দিয়াই বসিয়া আছেন, সুদশুদ্ধ আরও বাড়িয়াছে। অবশেষে সুরেশবাবু বাহিরে গিয়া চার পয়সা দিয়া একটা ইংরিজি কাগজ কিনিয়া আনিলেন এবং সকলে মিলিয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া সংবাদটা খুঁজিতে লাগিলেন।

তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও যখন এ খবর মিলিল না, তখন কালীপদ বেশ সহজ কণ্ঠেই কহিল, তাই তো। বাবু বললেন কি না, আমি ত আর কাগজ পড়ি না, সময় কোথা বলুন! তাহলে বাবুই বোধ হয় ভুল শুনেছেন কিংবা ঠাট্টাই করেছেন।

কিন্তু তবু তাহার পর তিন রাত্রি বামুন পিসির ভাল করিয়া ঘুম হইল না।

আর একদিন হয়তো মহিমবাবু সারাদিনের পর বিশ্রাম কবিতে বসিয়াছেন, তাহাকে ডাকিয়া কহিল, এবারে ভাইসরয় কাপের খবর জেনেছেন কিছু?

মহিমবাবুর রেস সম্বন্ধে দুর্বলতা সর্বজনবিদিত, তিনি ব্যস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিয়া কহিলেন, কি খবর ভাই কালীপদ?

কালীপদ জবাব দিল, এবারে এত বেশি লোক ফাইনালিস্টের ওপর বাজি ধরেছে যে, ওরা ঠিক করেছে যে, এবার কিছুতেই ওকে জিততে দেওয়া হবে না—

মহিমবাবুর মুখ শুকাইয়া গেল, তিনিও মনে মনে ঐ ঘোড়াটা আঁচিয়া ছিলেন। তিনি রুদ্ধনিঃশ্বাসে প্রশ্ন করিলেন, তুমি কার কাছে এ খবর শুনলে?

কালীপদ হাসিয়া কহিল, বিলক্ষণ! আমাদের ম্যানেজারবাবুর কাকার সহিস হল লাট সাহেবের রাঁধুনির আপনার মেলোমশাই! তার মুখ থেকেই বাবু শুনেছেন, আমি আবার বাবুর মুখে শুনলুম, নইলে আমি আর ওসব ঘোড়া-ফোড়ার খবর কোথাথেকে পাব বলুন?

এযুক্তি অকাট্য বলিয়াই মহিমবাবুর বোধ হইল। ফলে তাঁহার চোখের সামনে দিয়া তাঁহার অনেকগুলি টাকা ডুবাইয়া ঐ ঘোড়াটাই ফার্স্ট হইল। তিনি ফিরিয়া আসিতে কালীপদ সংবাদ শুনিয়া কহিল, কি করবেন বলুন, ওরা তো তিন ভরি আফিং খাইয়েছিল শালা ঘোড়া যে আফিংশুদ্ধ হজম করবে তা কে জানে!

এইভাবেই তাহার দিন চলে। কোন দিন আসিয়া বলে, সেই যে হনুলুলুতে একটা ঘোড়ার পেটে তিনটে মানুষের ছানা হয়েছিল, তারই একটা আজ মরে গেল।

কোন দিন বা শুষ্কমুখে সংবাদ দেয়, দেরাদুন এক্সপ্রেস পড়ে যেতে সেদিন যা লোক মরেছিল, তার নাকি সব এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। কাল নাকি একটা মড়া মাটি খুঁড়ে বার করেছে—এইসা ধাক্কার চোট যে, একেবারে মাটির মধ্যে পুঁতে গিয়েছিল!

ইদানীং তাহার কথা সবটা প্রায় কেহই বিশ্বাস করিত না! ভাল করিয়া সেদিকে কেহ কানও দিত না। কিন্তু দৈবাৎ তাহার একটি ভাল শ্রোত্রী মিলিয়া গেল। মহিমবাবুর অফিস আলিপুরে উঠিয়া যাওয়ায় তিনি ঐ অঞ্চলে বাসা দেখিয়া চলিয়া গেলেন, আর তাঁহারই ঘরে ভাড়া আসিলেন চন্দ্রনাথবাবু। ভদ্রলোক একটা মনোহারীর দোকানে কাজ করেন, টাকা ত্রিশেক মাহিনা, অথচ ছেলেপুলে সর্বশুদ্ধ সাত-আটটি হইবে। এই চন্দ্রনাথবাবুরই বড় মেয়ে টেঁপি বাড়ির মধ্যে কালীপদর সবচেয়ে বড় ভক্ত হইয়া উঠিল।

টেঁপির বয়স বছর চৌদ্দ কিংবা পনেরো হইবে কিন্তু দেখিলে মনে হয় আরও ছোট, এমনিই তাহার দৈহিক গঠন। শ্রীছাঁদ কোথাও কিছু নাই, বেঢপ চেহারা তাহার উপর বাপের নাই পয়সা, এমতাবস্থায় তাহাকে পার করা যে কি দুঃসাধ্য ব্যাপার সেই কথাটা কল্পনা করিয়াই বোধকরি টেঁপির মায়ের মাথা খারাপ হইয়া যাইত। তিনি কন্যাকে দেখিলেই কারণে অকারণে তিরস্কার করিতেন। তাঁহারই বাক্যযন্ত্রণা হইতে নিষ্কৃতি পাইবার জন্য সে ফাঁক পাইলেই ছোট ভাইটাকে কোলে করিয়া কালীপদর বিছানার সামনে বারান্দায় আসিয়া বসিত এবং বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে কালীপদর মুখের দিকে চাহিয়া অখণ্ড মনোযোগের সহিত তাহার চমকপ্রদ সংবাদাদি শুনিত।

বলা বাহুল্য এমন শ্রোত্রী পাইয়া কালীপদরও উদ্ভাবনী শক্তির দ্রুত উন্নতি হইতে লাগিল, তখন সংবাদ খোঁজ খবর করিয়া সংগ্রহ করেও বেশি এবং ভেজাল চালায় তাহার আট গুণ। ঝোঁকের মাথায় এমন কথাও বলিয়া বসে, উড়োজাহাজ হয়ে কি সুবিধেই হয়েছে বল দেখি টেঁপি, আমাদের রাজা রোজ কামস্কাটকায় মাছ ধরে বাড়ি ফেরবার পথে বসরা থেকে গোলাপ কিনে নিয়ে যায়। আগে কি আর এত সুখ চলত?

টেঁপি সব কথাই নির্বিচারে বিশ্বাস করিত। এমনকী কোন দিন কথা প্রসঙ্গে এইরূপ কোন সংবাদ তাহার বাবার কাছে দিতে গেলে তিনি যখন উপহাস করিতেন তখন সে তাঁহাকেই মূর্খ ভাবিয়া মনে মনে দুঃখিত হইত। চন্দ্রনাথবাবু দোকান হইতে গোপনে ছেলেমেয়েদের জন্য মধ্যে মধ্যে বিস্কুট লজেঞ্জুস প্রভৃতি লইয়া আসিতেন, টেঁপি আবার তাহারই মধ্য হইতে দুই একখানা কালীপদর জন্য সংগ্রহ করিয়া আনিয়া হয়তো কহিত, বাবাটা কিচ্ছু খবর রাখে না, জান কালীদা, বোম্বেতে ভূমিকম্প হয়ে সেই যে সমুদ্দুরের মাছ ছিটকে লাট সাহেবের খাবার টেবিলে গিয়ে পড়েছিল—সেই কথাটা বলতে গেলুম বাবাকে, বাবা হেসে উড়িয়ে দিলে!

কালীপদ অনুকম্পাভরে কহিত, খবরের কাগজ তো পড়তে পায় না বেচারা, খবর রাখবে কি করে বল?

টেঁপি কহিত, বলি এরপর বিয়ে-থা করতে হবে না, ঘর সংসার পাততে হবে না? এমনি করেই বুড়ো বয়স পর্যন্ত ভেসে ভেসে বেড়াবে?

বিস্মিত হইয়া কালীপদ জবাব দিত, বিয়ে-থা? আমি বিয়ে করব?…তুই কি ক্ষেপেছিস টেঁপি?

টেঁপিও বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিত, সে কি, বিয়ে করবে না তো চলবে কি করে। অসুখ-বিসুখ হলেই বা দেখবে কে, ভাত জলই বা দেবে কে? হোটেলে খেয়ে ক’দিন শরীর থাকবে? সংসারী হতে হবে না?

কালীপদ হাতজোড় করিয়া বলিত, মাপ করো রাজা, আমার আর সংসার পেতে দরকার নেই। এই বেশ আছি!…….সে বড় ঝঞ্ঝাট!

টেঁপি রাগ করিয়া চলিয়া যাইত।

কিন্তু সহসা একদিন দেখা গেল যে, কালীপদর এই অপরিসীম ঔদাসীন্য কিছু কমিয়াছে। টেঁপি নিজের ঘর হইতে ছুঁচ-সুতা লইয়া আসিয়া বারান্দায় পা ছড়াইয়া বসিয়া কালীপদরই একটা ছেঁড়া কাপড় সেলাই করিতেছিল, হঠাৎ মুখ তুলিয়া কহিল, আমার যে বিয়ে হচ্ছে কালীদা!

কালীপদ সহসা যেন একটা ধাক্কা খাইল। চমকিয়া উঠিয়া প্রশ্ন করিল, সে কি? কার সঙ্গে? কবে?

টেঁপি দাঁতে করিয়া সুতা ছিঁড়িতে ছিঁড়িতে কহিল, কবে এখনও কিছু ঠিক হয়নি।…ঐ যে নীচে বাইরের ঘরে বুনো মোষের মতো দেখতে দুটো ভাই থাকে তাদেরই বড়টার সঙ্গে। ওর নাকি আমাকে বড় পছন্দ; মুখে আগুন!

লোকটিকে কালীপদর মনে পড়িল। রাস্তার উপরের ঘর ভাড়া করিয়া দুটি ভাই থাকে, কোন এক বড় দপ্তরিখানায় দু’জনে কাজ করে, যেমন কালো, তেমনি মোটা, তেমনি বেঁটে—দু’টি ভাই-ই একরকম দেখিতে।

কালীপদ যেন একটু অসহিষ্ণু ভাবেই কহিল, কিন্তু তার যে প্রায় চল্লিশের ওপর বয়স হল!

টেঁপি গম্ভীরভাবে কহিল, তা কি করবে, বাবা পয়সা-কড়ি তো দিতে পারবে না, ওর চেয়ে ভাল পাত্তর কোথা পাবে? দয়া করে যে নিতে চাচ্ছে ঐ ঢের!

কালীপদ আরও খানিকটা চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কিন্তু থাকে তো ঐ একটা ঘরে, বিয়ে করবে কোথা?

টেঁপি কহিল, সবাই কি আর তোমার মতো চিরকাল একরকম কাটায়, ওরা আলাদা বাসা নিচ্ছে। ঐ ছুতোরপাড়ার গলিতে একটা মাটির বাড়ি ভাড়া করেছে, এই মাসেই উঠে যাবে।

কালীপদ আর কথা কহিল না। ইহার দিন দুই পর সত্য সত্যই সেই দুটি ভাই অন্যত্র উঠিয়া গেল। কালীপদ নিঃশব্দে চাহিয়া দেখিল, কিন্তু কি করিয়া যে কি করা যায় কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না। অবশেষে তিন চারদিন পরে একটা মতলব তাহার মাথায় খেলিয়া গেল, সে মনিবের নিকট হইতে দুটি টাকা ধার করিয়া একটা লটারির টিকিট কিনিয়া ফেলিল।

টেঁপি সন্ধ্যার সময় হ্যারিকেন জ্বালিয়া তাহার বিছানার সামনে নখ কাটিতে বসিল, সে মুখ তুলিয়া চাহিয়া দেখিল, কালীপদ কেমন একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাহার দিকেই চাহিয়া আছে, সে একটু বিস্মিত হইয়া কহিল, এমন করে চেয়ে আছ যে?

কালীপদ জবাব দিল, ভাবছি।

তাহার পর গলাটা নামাইয়া সহসা কহিল, টেঁপি আমি যদি তোকে বিয়ে করি?

ফ্যাঁস করিয়া নরুনটা মাংসের মধ্যে বসিয়া গেল। জোর করিয়া কাটা স্থানটা চাপিয়া ধরিয়া বিবর্ণ মুখে টেঁপি করিল, ও আবার কি ঠাট্টা?

কালীপদ কহিল, ঠাট্টা নয় সত্যি। ভাবছি কদিন। ঐ বুনো মোষটার সঙ্গে বিয়ে হলে বড় কষ্ট পাবি তুই—

টেঁপি ঈষৎ বিদ্রূপের স্বরে কহিল, রাখবে কোথায় আমাকে বিয়ে করে? এইখানে?

কালীপদ মাথা নাড়িয়ে বিজ্ঞভাবে বলিল, সে ব্যবস্থাও করছি। আজ একটা লটারির টিকিট কিনেছি দুটাকা দিয়ে। দেখবি?

ফার্স্ট প্রাইজ না হয় নাই পেলুম, অন্য প্রাইজও ত আছে? তাহাতেই কলকাতায় একটা ছোটখাট বাড়ি কিনে এমনি করে সব ভাড়াটে বসিয়ে দেব, বুঝলি না। দিব্যি বসে খেয়ে চলে যাবেখন।…ইস তোর পাটা অমন করে কেটে গেল কি করে রে? রক্তে ভেসে যাচ্ছে যে!

ইহার পর সাতটা আটটা দিন টেঁপির কোথা দিয়া কাটিয়া গেল তাহা সে নিজেই বুঝিতে পারে না। কালীপদ রোজ তাহাকে বক্তৃতা দিয়া বুঝাইয়া দেয় যে, লটারির টাকা তাহার না পাইবার কোন কারণ নাই, টেঁপিও ক্রমে তাহা বিশ্বাস করিয়াছে।

কিন্তু আটদিনের দিন কালীপদ বাসায় ফিরিতে উদ্‌গ্রীব হইয়া ছুটিয়া গিয়া দেখিল, তাহার সারা মুখে কে যেন কালি মাড়িয়া দিয়াছে। সে আর কোন প্রশ্ন করিল না, শুধু বাঁশের রেলিংটা ধরিয়া বহুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর আস্তে আস্তে কহিল, এখনও পনেরো কুড়ি দিন সময় আছে, একটা ভাল কাজ টাজ খুঁজে দেখ না!

শুষ্ক কণ্ঠে কণ্ঠে কালীপদ কহিল কে আর আমাকে বেশি মাইনের কাজ দেবে? পনেরো না হয় আঠারো এই তো!

টেঁপি জবাব দিল বেশি টাকাতে দরকারই বা কি। এইতো আমার বাবা তেত্রিশ টাকা মাইনেতে সংসার চালাচ্ছে—

সে আর দাঁড়াইল না। দ্রুতপদে চলিয়া গিয়া একেবারে বিছানায় শুইয়া পড়িল। মাকে কহিল, মাথা ধরেছে মা বড্ড, আজ আর আমি খাব না—

এই প্রথম তাহার কালীপদর দক্ষতা সম্বন্ধে মনে সংশয় দেখা দিয়াছে এবং সে আঘাত বড় কঠিন।

কালীপদ ফিরিল ন’টার অনেক পরে। টেঁপি আসিয়া অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর যেন কতকটা অপরাধীর মতোই চলিয়া আসিল, যদিও তাহার অপরাধটা যে কোথায়, তাহা সে বুঝিতে পারিল না।

মা প্রশ্ন করিলেন, হ্যাঁরে আজকাল কালীপদকে যে বড় চুপচাপ দেখছি!

টেঁপির মুখ অকারণ আরক্ত হইয়া উঠিল, সে মাটির দিকে মুখ করিয়া কহিল, এইবার একটু কাজে কর্মে মন দিয়েছে, বোধ হয় সংসারী হবার ইচ্ছে।

মা মুখে একটা শব্দ করিয়া কহিলেন, হ্যাঁ, ও হবে সংসারী, পোড়া কপাল! বিশ্বকুঁড়ে আর মুখ সর্বস্ব! শেষ অবধি দেখিস ওকে ভিক্ষে করে খেতে হবে।

টেঁপি একটু উষ্ণ কণ্ঠেই কহিল, মায়ের যেমন কথা, ভিক্ষে করবে কি দুঃখে? কাজ করছে না ও? এই ত কাল ওভারটাইম খেটে এল—

মা আর কথা কহিলেন না। কিন্তু টেঁপির তখন মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে; সে মনে মনে কল্পনা করিতে লাগিল কালীপদ সকাল হইতে রাত্রি পর্যন্ত খাটিতেছে অর্থের জন্য এবং—হাঁ, এবং তাহাকে সুখে রাখিবার জন্য; টেঁপি তাহাদের ছোট্ট গৃহস্থালিতে তাহারই জন্য রাঁধিয়া বাড়িয়া বসিয়া আছে, কালীপদ অফিস হইতে ফিরিবার পথে কত কি কিনিয়া আনিয়াছে। টেঁপি অনুযোগ করিতেছে, কি দরকার এত খাটবার, এত বেশি টাকায় আমাদের কি হবে, এই তো দুটি প্রাণী আমরা, কুড়িটা টাকা মাসে হলেই হবে।

কিন্তু কালীপদ ঘাড় নাড়িয়া কহিতেছে, না না তুমি বোঝ না, তোমার সাধ আহ্লাদ কিছুই মেটাতে পারছি না, কি আর দিতে পারছি তোমায় বলো?……তা ছাড়া আজই দুটি প্রাণী আছি, চিরকাল কি থাকবে—ছেলেপুলে হবে না! হাতে দু’পয়সা হওয়া দরকার।

লজ্জায় রাঙা হইয়া টেঁপি হয়তো পাখাখানা ঠকাস করিয়া ফেলিয়া রাখিয়া অন্যত্র চলিয়া যাইতেছে—

সহসা তাহার জাগ্রত স্বপ্ন ভাঙিয়া গেল কালীপদর পায়ের শব্দে। সে সেদিনও কাহারও সহিত বাক্য ব্যয় না করিয়া একেবারে সটান নিজের শয্যায় গিয়া শুইয়া পড়িল। টেঁপি পাশের ঘরের ঘড়ির দিকে চাহিয়া দেখিল তখন মোটে আটটা; কি একটা অজ্ঞাত আতঙ্কে তাহার বুকটা যেন ঢিপ করিয়া উঠিল। সে ধীরে ধীরে কাছে দাঁড়াইয়া প্রশ্ন করিল এরি মধ্যে ওভারটাইম শেষ হয়ে গেল?

কালীপদ দেওয়ালের দিকে মুখ করিয়া শুইয়াছিল, খানিকক্ষণ তেমনিই শুইয়া থাকিয়া বিরস কণ্ঠে জবাব দিল, ও আমি পারব না। বড় খাটনি, অত করে খাটলে মরে যাবো—

টেঁপি শক্ত করিয়া রেলিংটা চাপিয়া ধরিয়া যেন নিজেকে সামলাইয়া লইল। কি যেন বলিতেও গেল, কিন্তু ঠোঁট দু’টিই থর-থর করিয়া কাঁপিল, কণ্ঠ ভেদিয়া কোন শব্দ বাহির হইল না। মিনিট খানেক নিঃশব্দে দাঁড়াইয়া আবার নিজের ঘরে ফিরিয়া গেল।

তাহার বাবা ও মা তখন লণ্ঠনের কাছে উপুড় হইয়া পড়িয়া একছড়া সোনার হার আলোকে মেলিয়া ধরিয়া নিরীক্ষণ করিতেছিলেন, টেঁপিকে দেখিয়া মা মুখ তুলিয়া কহিলেন, জামাই গায়ে হলুদ দেবে বলে এরই মধ্যে হার গড়িয়েছে। দেখ দেখি পছন্দ হয় কিনা, তোকে দেখাবার জন্যই পাঠিয়েছে।— আমার তো বাপু বেশ পছন্দ!

টেঁপি যন্ত্রচালিতের মতো হারটা তুলিয়া লইয়া শূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ সেদিকে চাহিয়া রহিল, তাহার পর সেটা ধীরে ধীরে আবার মায়ের হাতেই ফিরাইয়া দিয়া কহিল, বেশ হয়েছে মা!

২১ এপ্রিল ১৯৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *