১.
পরীক্ষার প্রশ্নপ্রত্র ফাঁসের ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নজরে আনার জন্য আমি অনেকদিন থেকে চেষ্টা করে আসছিলাম, খুব একটা লাভ হয় নি । তাই শেষ পর্যন্ত আমাকে গত শুক্রবার একটি নাটকীয় কাজ করতে হল, আগের দিন পত্রিকায় একটা লেখা পাঠিয়ে, আমি সেখানে লিখলাম বিষয়টার প্রতিবাদ হিসাবে পরের দিন শুক্রবার আমি শহীদ মিনারে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকব। তখন অনেকেই আমার কাছে জানতে চাইল কখন কিভাবে আমি সেখানে যাব। সাংবাদিকেরা, টেলিভিশন চ্যানেল গুলো আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল কিন্তু আমি কারো কোন প্রশ্নের উত্তর দিলাম না। পুরো বিষয়টি ছিল একান্তভাবেই আমার ব্যক্তিগত প্রতিবাদ, সেখানে আমি নিজে থেকে কাউকেই ডাকতে পারি না। কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারি না। নিজের উদ্যোগে কেউ চলে আসলে সেটি ভিন্ন কথা।
শুক্রবার অনেকেই শহীদ মিনারে চলে এল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা আছে, স্কুলের শিশুরা আছে, এইচ এস সি পরীক্ষার্থীরা আছে, বেশ কিছু শিক্ষক আছেন, এক দুইজন গৃহিণীও আছেন। কিছুক্ষনের ভেতর সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশনের সাংবাদিকেরাও চলে আসতে শুরু করলেন। বৃষ্টিতে ভিজতে আমার খুব ভাল লাগে আর সত্যি সত্যি ঝুম বৃষ্টি শুরু হল, অন্যদের বৃষ্টিতে ভিজতে কেমন লাগে আমি জানি না, কিন্তু শহীদ মিনারে প্রায় সবাই সেই বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে গেল। (আমি অনেককে বৃষ্টিতে ভেজার কথা শুনলে আতকে উঠতে দেখিছি। কিন্তু সবাইকে বলে রাখি আমাদের দেশের বৃষ্টির মত সুন্দর আর কিছু নেই। বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয় আমার জীবনে সেটি কখনো ঘটেনি।)
শহীদ মিনারে একটা প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমার বসে থাকার কথা ছিল, আমি তাই খুব যত্ন করে একটা প্ল্যাকার্ড তৈরি করে সেখানে লিখে নিয়ে গেলাম “প্রশ্ন ফাঁস মানিনা মানবনা ছেলে মেয়েদের স্বপ্ন ধ্বংস হতে দিব না।” আজকাল ক্যামেরার কোন অভাব নেই তাই সেখানে প্রচুর ছবি তোলা হল এবং আমি প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে আছি সেই ছবিটা নিশ্চয়ই ফেসবুককে ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্ত আমি আসলে এই বিষয়টার কথা বলতে যাচ্ছি না, অন্য একটা কথা বলতে চাচ্ছি। প্লে-কার্ড হাঁতে আমার শহীদ মিনারে বসে থাকার ছবিটি নিয়ে একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। কোন একজন ছবির প্ল্যাকার্ড এ আমার লেখার নামে খানিকটা পরিবর্তন করে সেই ছবিটা ফেসবুক এ ছেড়ে দিল। এখন এই ছবিটা দেখলে যে কেউ ভাববে আমি যে শুধু মাত্র প্রতিবাদ করছি তা নয় প্রশ্ন ফাঁস হওয়া পরীক্ষা গুলো বাতিলও করার দাবি জানাচ্ছি।
প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার এই মহা বিপর্যয়ের জন্য ঠিক কি করতে হবে আমি কিন্তু সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ঠ একটি দুটি কথা বলেছি। কাউকে সব পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার পরামর্শ দেইনি। কিন্তু আমি সেটাই দাবী করছি কিছু মানুষ এই সংবাদটা প্রচার করার জন্য খুব ব্যস্ত। কারনটা কি সেটি এখনো আমার কাছে রহস্য। আমার জীবনে এটি নতুন কোন রহস্য নয়, একসময় স্বাধীনতা বিরোধী ধর্মান্ধরা আমার বিরুদ্ধে লেগে থাকত, এখন অন্যরাও তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে।
যাই হোক শহীদ মিনারে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে থাকার কারনে একটা খুব বড় কাজ হল, হটাৎ করে সারা দেশের সব মানুষ জানতে পারল দেশে খুব বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে। যারা দীর্ঘ দিন থেকে মেনে নিয়েছিল যে, “পরীক্ষা মানেই হল প্রশ্ন ফাঁস” তারাও এবার নড়ে চড়ে বসলো। যে সব সংবাদপত্র এতদিন ভুলেও প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে একটি লাইন ও লিখেনি তারা সম্পাদকীয় লিখতে শুরু করল, যে টেলিভিশন চ্যানেল প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কিছু প্রচার করেনি তারা আমাকে কিংবা আমার মত শিক্ষকদের টক শোতে ডাকতে শুরু করলো, এমনকী শিক্ষাবিদেরাও প্রশ্ন পত্র ফাঁস নিয়ে কলাম লিখতে শুরু করলেন। একটা সমস্যার অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়া হলেই শুধু মাত্র সেই সমস্যার সমাধান করা যায় – মনে হল শিক্ষা মন্ত্রনালয় সেটি পুরোপুরি স্বীকার করে না নিলেও দেশের মানুষ সেটা স্বীকার করে নিয়েছে। কাজেই বিষয়টাকে আর সম্ভবতঃ ধামা চাপা দিয়ে রাখা যাবে না।
তবে সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ে আমার এখন কিছু বক্তব্য রয়েছে- তাদের দায়িত্বটি আমি এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারছি না। এবারে যে ব্যাপক ভাবে প্রশ্ন পত্র ফাঁস হয়েছে সেটি নিয়ে আমার কিংবা পরীক্ষার্থীদের মাঝে তিল পরিমান সন্দেহ নেই। পরীক্ষার আগে যে প্রশ্নটি এসেছে দুদিন পর সেই প্রশ্নটিই পরীক্ষায় আসছে এখানে সন্দেহ করার জায়গাটি কোথায় ? কিন্তু সংবাদ মাধ্যম গুলো কেন জানি পুরো বিষয়টি এখনো নিশ্চিত সত্য বলে স্বীকার না করে এটি অভিযোগ বলে গা বাঁচিয়ে সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে। এটি শুধুমাত্র একটা অভিযোগ নাকি সত্যি সত্যি এটা ঘটেছে সেটি প্রমাণ করার দায়িত্ব কার? আমার নাকি সংবাদ মাধ্যমের? আমি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার পরও সংবাদ মাধ্যম কেন সেটি বিশ্বাস করে এটাকে একটি সত্য ঘটনা হিসেবে প্রচার করে না? কেন তারা এটাকে শুধুমাত্র একটা অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করে?
যাই হোক, প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে এই চেঁচামেচিতে কিছু কাজ হয়েছে। বুয়েট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র-ছাত্রী প্রতিবাদ হিসেবে শহীদ মিনারে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছে। খবরের কাগজে দেখতে পেলাম আগামী ১১ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার ব্যাপারে আলোচনা করার জন্যে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব শিক্ষাবিদদের ডাকা হয়েছে। সরাসরি এখনো বলা হয়নি যে তাদেরকে প্রশ্ন ফাঁস নিয়েই আলোচনা করার জন্যে ডাকা হয়েছে কিন্তু আমি আশা করছি এই সময়ে দেশের বড় শিক্ষাবিদদের ডাকা হলে তাঁরা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারটা তুলে আনবেন। আমি এখন খুব আগ্রহ নিয়ে এই এগারো তারিখের মিটিংয়ের জন্য অপেক্ষা করে আছি।
২.
শুক্রবার ভোরবেলা আমি শহীদ মিনারে বসে ছিলাম, বিকেল বেলা এক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আমার মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর সাথে দেখা হল। প্রশ্ন ফাঁসের মত এত বড় বিপর্যয়ের জন্য কেউ না কেউ নিশ্চয় দায়ী, যেহেতু কাউকে সেই দায় নেবার জন্য এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই দায়টুকু শিক্ষামন্ত্রীর ঘাড়েই এসে পড়বে। পুরস্কার বিতরণীর সেই অনুষ্ঠানেও তখন তাকে শিশু সাহিত্যের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কিছু কথা বলতে হল। মঞ্চে অনেকে বসে ছিলাম তার মাঝে বেছে বেছে শুধু আমাদের দুজনের ছবি তুলে সেই ছবিটা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। শুনেছি সেই ছবি নিয়ে ফেসবুক জগতে অনেক ধরনের সমালোচনা হয়েছে । আমি কখনই ফেসবুক এর আলোচনা সমালোচনা দেখি না, দেখার সুযোগ ও নেই তাই ঠিক কোন বিষয়টিকে সমালোচনা করা হয়েছে জানি না। কিন্তু কোন বিষয়ে কারো সাথে সাময়িক মত পার্থক্য থাকলে আমি তার পাশে কেন বসতে পারব না আমি সেটা বুঝতে পারিনি। বিশেষ করে যখন একটা পুরস্কার দেবার জন্য আমাকে সেখানে ডেকে নিয়ে আয়োজকরা আমাকে সেখানে বসিয়েছেন।
আমার সাথে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর খুব ভালো সম্পর্ক তাই সেদিন ও নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তৈরী করে দেওয়া তদন্ত কমিটির সাথে ফোনে কথা বলে তখন তখনই আমার সাথে কথা বলার জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন।
আমি সিলেট থাকি, শুক্র শনিবার কিংবা ছুটি ছাটায় ঢাকা যেতে পারি। তাই তদন্ত কমিটিকে পরেরদিন শনিবারেই তাড়াহুড়ো করে আমার সাথে দেখা করতে হলো। ঢাকা শহরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোথাও হাজির হওয়ার মতো বিড়ম্বনা আর কিছুতে নেই, তাই ছুটির দিনে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন সদস্যদের এক জায়গায় উপস্থিত হতে তাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। তদন্ত কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ সময় বসে আমার কথা শুনলেন, আমার রাগ দুঃখ ক্ষোভ হতাশা সবকিছুই খুব সমবেদনার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। আমি আমার কথাগুলো শুধু পত্রপত্রিকার কলাম লিখে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলাম, এই তদন্ত কমিটির সদস্যদের দিয়ে সেটি সঠিক জায়গায় পৌছাতে পারলে নিজেকে অনেকটা হলেও সান্তনা দিতে পারব।
৩.
আমি এক সময়ে অনিয়মিত ভাবে পত্রপত্রিকায় লিখতাম। আজকাল নিয়মিতভাবে লিখি। নিয়মের বাইরেও যদি কিছু একটা লিখি পত্রপত্রিকাগুলো সাধারণত সেগুলো ছাপাতে আপত্তি করে না। মজার ব্যাপার হল আমি যা লিখি বা যেভাবে লিখি এই দেশের অসংখ্য মানুষ তার চাইতে অনেক সুন্দর করে অনেক গুছিয়ে লিখতে পারে। আমি বিশেষভাবে চমৎকৃত হই যখন দেখি কমবয়সী তরুণ-তরুণী কিংবা কিশোর-কিশোরীরা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কিছু একটা লেখে। প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাপারে অনেকেই আমার কাছে অনেক কিছু লিখেছে সবই ব্যক্তিগত চিঠির মত, আমি সেগুলো থেকে তাদের মনের কিছু কথা পাঠকদের জন্যে তুলে দিচ্ছি।
ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন পেয়ে একজন লিখেছে, “… আমার প্রথম পত্র পরীক্ষা ভয়ঙ্কর খারাপ হয়েছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন এসেছে দেখে লিখতে ইচ্ছে হয়নি। ঘেন্না লেগেছে। এখনো পড়ছি না, রুচি হচ্ছে না। কি হবে পড়ে বলবেন? আমার আর কিছুতেই কিছু এসে যায় না। এই সিস্টেম আমার জীবনকে তছনছ করতে পারবে না। আমি এত সস্তা না। আর পারলে করুক!”
এ রকম একটা চিঠি পেলে কেমন লাগে সেটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়। তারপরও আমি ছেলেমেয়েগুলোর মনের জোর দেখে চমৎকৃত হই। আরেকজন লিখেছেন, “…. আমার ছোট ভাই চাকরির পাশাপাশি প্রাইভেট পড়ায়। তার একটা ভয়ানক অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমি ভীষণ মর্মাহত হয়েছিলাম। গত ২০১৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার সময় হিসাব বিজ্ঞান পরীক্ষার পূর্বের রাতে সে দেখে তার এক ছাত্র বাজারে ঘুরছে। সে তাকে পরীক্ষার কথা স্মরণ করে দিলে সে বলে যে তার পড়তে হবে না কারণ প্রশ্ন তার হাতে এবং প্রস্তুতি শেষ। আমার ভাই তাকে বলে, সে প্রশ্নের বিশ্বাসযোগ্যতা কি? ছাত্রের উত্তর ছিল, “স্যার গণিত পাইছিলাম হুবহু কমন, ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র ১০০%, অতএব হিসাববিজ্ঞান নিয়া চিন্তা নাই, অবশ্যই কমন পড়বই।” পরের দিন দেখা গেল ঐ ছাত্রের কথাই সত্যি এবং সে হিসাব বিজ্ঞানে এ প্লাস এবং মোট জিপিএ ৪.৮৮ পেয়েছে। অথচ এই ছাত্র পাস করবে কি না তা নিয়ে সবাই চিন্তিত ছিল। এই হলো বাস্তবতা।”
এই চিঠির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কী সবাই লক্ষ্য করেছে? আমরা শেষ পর্যন্ত এই বছরের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে হইচই করছি। এই চিঠিতে কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার কথা বলা হয়েছে- শুধু তাই নয় গত বছরের এসএসসি যার অর্থ প্রশ্ন ফাঁস আসলে হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া একটা বিপর্যয় নয়, এটা একটা নিয়মিত ঘটনা। আমি যতদূর জানি শুধু এসএসসি নয়, পিএসসি এবং জেএসসিতেও এটা ঘটছে। যখন ভয়ঙ্কর অন্যায়কে নিয়মিত গ্রহণযোগ্য ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়া হয় তার চাইতে সর্বনাশা কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।
এবারে একজন মায়ের লেখা একটা চিঠি: “…নিরুপায় হয়ে আপনাকে লিখছি। আমার মেয়ে একজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। প্রথম পরীক্ষার পরের দিন থেকেই জানতে পারি প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। শুধু অভিভাবক হিসেবে নয়, নীতিগত কারণে এবং বিশ্বাস থেকেও বললাম বিভ্রান্ত হয়ো না, মিসগাইড করার জন্যও কেউ কেউ বিভ্রান্তি ছড়ায়। তখনও জানি না আমার জন্য কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে। ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার পরীক্ষা দিয়ে এসে বলল, আম্মু আমার আশেপাশে ম্যাক্সিমাম মেয়ে প্রশ্ন পেয়েছে।” জিজ্ঞাসা করলাম কিভাবে? বলল ফেসবুকে। … এরপর ওকে বললাম সেখানে ঢুকলেই যদি প্রশ্ন পাওয়া যায় তুমি নাও। দেখলাম মেয়ের চোখে পানি। আমাকে বলল, আমি তো পড়েছি, আমি কোন প্রশ্ন দেখব না। বললাম, তুমি যদিও মনে করছ এটা অপরাধ আমি মনে করছি এটা অপরাধ নয়।… আমি বা তুমি কারও শরণাপন্ন হচ্ছি না বা টাকা খরচ করছি না। ফেসবুকের মতো গণমাধ্যমে এটা প্রচার করা হচ্ছে। এটা সবার দেখার জন্য। সবাই প্রশ্ন দেখে পরীক্ষা দেবে, তোমার থেকেও ভালো রেজাল্ট করবে তখন কষ্ট হবে। তাছাড়া ভর্তির ক্ষেত্রে তো তুমি পিছিয়ে যাবে। মেয়ে রাজি হলো না। আমি ওর মনের ওপর চাপ দিলাম না। ফিজিক্স সেকেন্ড পেপার আশপাশে সবার পরীক্ষা ওর থেকে ভালো হলো ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়ে। এরপর ১৭ দিন গ্যাপ তারপর কেমিস্ট্রি পরীক্ষা। পরীক্ষার আগের রাতে নেটে গেলাম রাত একটায় দেখলাম প্রশ্ন চলে এসেছে। ল্যাপটপ নিয়ে মেয়ের পাশে যেয়ে বললাম একটা লুক দাও। মেয়ে কড়া সুরে ২ বার বলল ‘না’ – চলে আসলাম। আর কিছু ওকে বলিনি। ম্যাথ ফার্স্ট পেপার পরীক্ষায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। প্রশ্ন ফাঁস। সবার পরীক্ষা এক্সিলেন্ট ওর পরীক্ষাও ভাল তবে যেহেতু হলে বসে চিন্তা করে করেছে সময়ে কুলাতে পারেনি। ৪ নম্বর ছেড়ে আসতে হয়েছে। চেহারায় কষ্টের ছাপ। সাথে ২/১ জন বান্ধবী ছিল যারা প্রশ্ন দেখত না। তারাও সেদিন দেখেছে। ভয় পেলাম কি জানি নার্ভাস ব্রেক ডাউন না হয়ে যায় …। আপনার কাছে আমার জিজ্ঞাসা, আমার মেয়ে কি সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা দেওয়া ছেলেমেয়েদের দলে পড়ে গেল না? ও কি সেই বদনাম থেকে কলঙ্ক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে যাদের দিকে মানুষ আংগুল তুলে দেখাবে ওরা ২০১৪ সালের ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে এইচএসসি পাস করেছে। …”
এই চিঠিটা থেকে বোঝা যায় কিভাবে অভিভাবকেরা না চাইলেও শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের কাছে অসহায়ভাবে মাথা নত করতে বাধ্য হয়ে যান। তবে যে বিষয়টি এখনো আমাকে আশা নিয়ে বাঁচতে শেখায়, সেটি হচ্ছে শত প্রলোভনেও কমবয়সী একটা মেয়ে মাথা উচু করে সৎ থেকে যায়।
আমার কাছে এ রকম অসংখ্য চিঠি আছে, আমি পড়ি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
৪.
প্রশ্ন ফাঁসের এই ব্যাপারটি এতো জটিল এবং এতো পরিপূর্ণ একটি বিপর্যয় যে এখান থেকে কিভাবে বের হয়ে আসা যাবে আমি সেটা ভেবে ভেবে কোন কূল কিনারা পাই না। তবে আমি মনে করি অবশ্য অবশ্যই এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে উচ্চ পর্যায় থেকে তিনটি কাজ করা উচিত। সেই কাজ তিনটি হচ্ছে:
ক) এই দেশের লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে খুব মন খারাপ করে বসে আছে, তাদের মনটি ভালো করে দেয়ার জন্যে কিছু বলতে হবে। তাদেরকে কী বলা হবে সেটি ভাবনা চিন্তা করে ঠিক করা যেতে পারে, কিন্তু কিছু একটা বলতেই হবে। বিশেষ করে যারা প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাবার পর সুযোগ পেয়েও সেই প্রশ্ন দেখেনি তাদেরকে একটা স্যালুট দিয়ে বলতে হবে, তোমরাই এই দেশের ভবিষ্যত।
খ) সামনেই বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা। যারা এবারে এইচএসসি দিয়েছে তাদেরকে আশ্বস্ত করতে হবে যে ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসি এর ফলাফল যেন কোন বড় ভূমিকা রাখতে না পারে সেটি নিশ্চিত করা হবে। সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সম্মিলিতভাবে এই কাজটি করতে হবে।
গ) তৃতীয় বিষয়টি আমার কাছে সবচেয়ে জরুরী, এই দেশের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারকে ঘোষণা দিতে হবে অতীতে যা হবার হয়ে গেছে, কিন্তু ভবিষ্যতে এই বাংলাদেশে আর কোনদিন কোন প্রশ্ন ফাঁস হবে না। প্রশ্ন যেন ফাঁস না হতে পারে সেজন্যে তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে দেশের সকল উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে সবাই মিলে ব্যবহার করবে, কিন্তু প্রশ্ন আর কখনও ফাঁস হবে না।
আমাদের প্রিয় দেশটির ভবিষ্যত যে কত সুন্দর সেটি সবাই অনুমান করতে পারে কী না আমি জানি না। অল্প কিছু দায়িত্বহীন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসে থাকা মানুষের জন্যে আমরা আমাদের সেই সুন্দর ভবিষ্যতটি কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। যদি কেউ চেষ্টা করে কাজ হোক আর না হোক ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো আমি চিৎকার করতেই থাকব!