ভাঙ্গলে কিছু গড়তে তো হবে
কোথায় যাবে মা তুমি? কার ঘরে, প্রবীণারা বলেন, মেয়ে হল পরের সম্পত্তি। খাইয়ে, দাইয়ে, শিক্ষা দিয়ে, একদিন খাঁচা খুলে উড়িয়ে দাও। সেদিন এক প্রবীণ মানুষ কাগজ পেনসিল নিয়ে হিসেব করছিলেন। এ বাজারে একটি মেয়ে পার করতে, নম: নম: করে কত লাগতে পারে। কম করেও সোনা লাগবে দশ ভরি। একটি হার, দু’গাছা চুড়ি, একটি বাউটি অথবা তাবিজ, বোতাম এক সেট, দু’টি আংটি, সোনার ভরি দু’হাজার, ভরি প্রতি বানি দুশো টাকা, তার মানে বাইশশো টাকা। এইতেই চলে গেল বাইশ হাজার। একটি খাট বিছানাসমেত চার থেকে পাঁচ হাজার। সাতাশে উঠল। এরপর ড্রেসিং-টেবিল, আলমারি, অন্যান্য সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ষাট হাজার টাকার ধাক্কা।
বড় সাংঘাতিক কথা। সংসারে দুটি মেয়ে মানে এক লাখ বিশ হাজার। দিন -আনা দিন-খাওয়া মানুষ কোথায় পাবে এত টাকা। এখন তো সকলেই প্রায় শিক্ষিত, আলোকপ্রাপ্ত। মেলামেশারও বাধা নেই। প্রেমের ছড়াছড়ি। তবু এই আতঙ্ক কেন? কন্যাসন্তান জন্মালে পরিবারের মুখের হাসি মিলিয়ে যায় কেন? নারী ছাড়া সংসার অচল। অথচ নারীকে সংসারস্থ করতে লাখোপতি হতে হবে কেন?
হিসেব শেষ করে প্রবীণ মানুষটি করুণ মুখে তাকালেন। বললেন, ‘জানাশোনা ঘর ছাড়া উটকো কারুর হাতে মেয়েটিকে তো তুলে দিতে পারব না। সে সাহস আর নেই।’
‘কেন?’
‘দিন-কাল যা পড়েছে, খুব জানা ঘর না হলে মেয়ের জীবন নিয়ে টানাটানি। মেরে হয়তো ঝুলিয়েই দিলে। বললে আত্মহত্যা করেছে।’
‘মিছে ভাবছেন। শিক্ষিত ছেলেরা তা করবে কেন?’
‘শিক্ষিত?’ ভদ্রলোক হাসলেন, ‘হালফিলের একটা ঘটনা তোমাকে বলি। ছেলে আর মেয়ে দুজনে ইঞ্জিনিয়ার। পড়তে পড়তে আলাপ। আলাপ থেকে প্রেম। প্রেম পাকল বিয়েতে। ছেলেটি চাকরি পেল বোম্বাইতে। বছর না ঘুরতেই শুরু হল মেয়েটির আর্তনাদ। ছেলেটি এক গুজরাতি রমণীর প্রেমে হাবুডবু। স্ত্রীর ওপর অত্যাচার, মারধোর।’
‘সে কী?’
‘হ্যাঁ বাবাজি। শিক্ষা কী করবে! শিক্ষার চেয়ে, প্রেমের চেয়ে, দেহ বড় জিনিস। এক প্রেম শুকিয়ে আর এক প্রেমের উদয়। মেয়েটি শেষে পালিয়ে এল কলকাতায়। ডিভোর্স হয়ে গেল। সাত বছর হয়ে গেল, সেই মেয়ের এখনও বিয়ে হয়নি। কে বিয়ে করবে একজন ডিভোর্সিকে। বিদ্যাসাগর তো বিধবা বিবাহের জন্যে অনেক লড়েছিলেন। হল কিছু? বিধবা, বিধবাই রয়ে গেল। আমাদের সব আধুনিকতা মুখে। মনে সেই প্রাচীন সংস্কার। অতএব বুঝতেই পারছ। পাত্র নির্বাচন, বিবাহ খুব সহজ নিরুদ্বেগ ব্যাপার নয়। জীবনে জীবনধারণ এমন এক জটিল প্ল্যাস্টিক সার্জারি, শেষ না হলে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলা যায় না। দশ বছর ঘরসংসার করার পরও সংসার ভেঙে যেতে পারে।’
মেয়ের বিয়ে না দিলেই হয়। লেখাপড়া শিখিয়ে স্বাবলম্বী করে ছেড়ে দাও। বলা সহজ। প্রস্তাবটি মোটেই বাস্তব-সম্মত নয়। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ জোহারে সুন্দর একটি উক্তি আছে। God creates new worlds constantly, In what way? By causing marriages to take place. ঈশ্বর অনবরতই নতুন জগৎ কীভাবে সৃষ্টি করছেন? বিবাহের দ্বারা। দুটি হাতে দুটি হাত মিলিয়ে ছেড়ে দেন।
জোহার বলছেন, আত্মা যখন স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে নামে, তখন একক অবস্থায় নামে না। নেমে আসে জোট বেঁধে, একটি পুরুষ আত্মা, একটি স্ত্রী আত্মা। পুরুষ গ্রহণ করে পুরুষের শরীর, নারী গ্রহণ করে রমণীর শরীর। এরপর ঈশ্বর নির্বাচিত পুরুষ আর নারীকে বিবাহবন্ধনে বেঁধে দেন। এরই নাম পুনমির্লন। পুণ্যাত্মা বিবাহিত পুরষকে আশ্রয় করে। কারণ অবিবাহিত পুরুষ কখনও সম্পূর্ণ মানবের স্বীকৃতি পায় না, অর্ধ সম্পূর্ণ। পুণ্যাত্মা অসমাপ্ত বস্তুতে আস্থা রাখে না।
সব দেশের শাস্ত্রই বিবাহকে পুণ্যবন্ধনের মর্যাদা দিয়েছেন। ম্যারেজ মেকস এ কমপ্টি ম্যান—শুনে শুনে আমাদের কান পচে গেছে। অথচ বিবাহ এখন সবচেয়ে ভীতিপ্রদ ব্যাপার। কী হবে কোনও পক্ষেরই জানা নেই। প্রতিদিন সংবাদপত্র খোলা মাত্রই একাধিক বধূহত্যার খবর সভ্যতাকে স্তব্ধ করে দেবে। পুণ্যাত্মা যদি বিবাহিত ব্যক্তিকেই ভর করবে, তাহলে সে আত্মা কেন ছুরি-ছোরা নিয়ে একটি নিরীহ রমণীকে জবাই করার জন্যে তেড়ে যায়! মানুষ এগোচ্ছে না পেছোচ্ছে! মানুষ ক্রমশই অতিমানুষ না হয়ে বনমানুষ হয়ে যাচ্ছে। রামরাজ্য দ্বিতীয়বার আর প্রতিষ্ঠিত হল না। শ্রীকৃষ্ণ সেই যে গেলেন আর এলেন না। মামেকং শরণং ব্রজ। কেউ শুনলে না। গৌতমবুদ্ধ, শ্রীচৈতন্য দ্বিতীয়বার আবির্ভূত হলেন না। সময় ওইভাবেই আমাদের ছলনা করে আসছে। হীরক যুগ চলে গেল, ফিরে আর এল না। ঐতিহাসিকরা বৃথাই আশ্বাস দিলেন —হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ। ফিরে ফিরে যুদ্ধ আসে, বন্যা আসে, দুর্ভিক্ষ আসে, মহামারী আসে, রাবণ আসে, রাম আর আসেন না। যুধিষ্ঠির সহ ভ্রাতারা সেই যে গেলেন আর নেমে এলেন না, এদিকে পাড়ায় পাড়ায় কুরুক্ষেত্র। পঞ্চপাণ্ডব কোণঠাসা। কৃষ্ণ কোথায়। কে হবেন রথের সারথি!
মেয়ে বড় হচ্চে। বাপমায়ের প্রাণ শুকোচ্ছে। বাড়ির সামনে সিটি মেরে যাচ্ছে নবকুমার। ফ্রী-সেক্সের বাতাস বইছে। আমেরিকান কায়দায় মেয়ে বলছে আমার ডেট আছে। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ঝুলছে, পাঁচ মিনিটেই গর্ভমোচন। মনুর কথা বা বিধান এখন কথার কথা। ব্রহ্মচর্যং সমাপ্য গৃহী ভবেৎ। গৃহী ভূত্বা বর্নী ভবেৎ। বনী ভূত্বা প্রব্রজেৎ। (জাবাল উপনিষদ) প্রথমে ব্রহ্মচারী অর্থাৎ ছাত্র। জীবনে দ্বিতীয় পর্বে গৃহী। তৃতীয় পর্বে বনী অর্থাৎ গৃহত্যাগ। চতুর্থ পর্বে সন্ন্যাস। ভারত এখন আর নিজের কণ্ঠস্বর শুনতে পায় না। জেট-এজে ঋষিরা সব বনমানুষ। রাজনীতি-চটকানো শিক্ষাব্যবস্থা আর কোনও দিন বলবে না, বৎস মানুষ হও, ইস্পাত-কঠিন চরিত্র তৈরি করো। বলবে শিক্ষিত জন্তু হয়ে বৈভব উৎপাদন করো। বিবাহ মানে আত্মার মিলন নয়, সেক্স। বংশের, দেশের মুখ-উজ্জ্বলকারী সন্তানের সাধনা নয়, পরিবার পরিকল্পনার ফাঁক গলে বেরিয়ে আসা দুয়েকটি পেটের শত্রু। স্বেচ্ছায় বানপ্রস্থ বা সন্ন্যাস নয়, ঝেঁটিয়ে বিদায়। আধুনিকা জিন্দাবাদ। কম্পিউটারের হাসি, কম্পিউটারের কাশি। জীবন হাড়মাসের যন্ত্র। গৃহ আর আশ্রম নয়, আস্তাবল। নাও বোঝো ঠ্যালা। বোম্বাইসে আয়া মেরা দোস্ত! হিন্দি সিনেমা জীবনের পাঠশালা। রং ঢং, ভাষা, হাঁটাচলা সবেতেই পরদার প্রভাব। রেডিও অষ্টপ্রহর কানে প্রেম আর বিরহের আরক ঢালছে। টিভির পরদায় নায়িকা নাচছে। ভাঁড়েদের তোতলামি, নায়ক আর ভিলেনের ফিষ্টি-ফাইট। সামনে এক সার পেঙ্গুইন-দর্শক। একটা ক্ল্যাসিক্যাল জাতের কী বিচিত্র উত্তরণ। বেদ-বেদান্ত, উপনিষদ থেকে বচ্চন, খান্না। এই পরিবেশে ঘরে অনূঢ়া মেয়ে রাখার ঝুঁকি কী কম!
বিধায়ক মনু সেই যুগেই সাহস করে বলতে পারেননি। মেয়েকে ঘরে পুষে রাখো পাত্রের অভাবে। গৃহস্থের যৌন জীবনের প্রয়োজনীয়তা তিনি বুঝতেন। জ্ঞানের কথা, যোগের কথা বলে মানুষকে প্রবৃত্তি-মার্গ থেকে সরানো যাবে না। পরদারাসক্ত হয়ে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে চুরমার করে দেবে। মনু বললেন, ঋতুকালাভিগামী স্যাৎ স্বদারনিরত: সদ্য। ঠাকুর রামকৃষ্ণের কথা, কামিন। কাঞ্চন একেবারে ত্যাগ। সংসারীর পক্ষে সম্ভব নয়। ঈশ্বরে মন, প্রয়োজনে ওই স্বদারা সহবাস। মনুর বিধান, নারী নিজপতি-নিরতা থাকবে। কালেহদাতা পিতা বাচ্যো, বাচ্যশ্চানুপযন পতি:। যোগ্যকালে কন্যাকে পাত্রস্থা না করলে, পিতা আর ঋতুকালে পত্নীতে উপগত না হলে, পতি নিন্দার্হ। ইহুদি শাস্ত্রের নির্দেশ আরও সাংঘাতিক, বিবাহযোগ্য কন্যার পাত্রসন্ধানে পিতা ব্যর্থ হলে, কৃতদাসের সঙ্গেই কন্যার বিবাহ দাও। [If your daughter is connubile and you cannot find a husband for her, manumit your slave and marry her. মনু আমাদের গার্হস্থ্য জীবনের শুচিতা নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন। গৃহিণী না হলে গৃহ গৃহই নয়। ন গৃহং গৃহম ইত্যাহুর্গৃহিণী গৃহম উচ্যতে] কন্যা ঋতুমতী হওয়ার তিন বছরের মধ্যে পিতা যদি তার বিবাহ না দেন, তবে মনুর বিধানে ওই কন্যা নিজের পতি নিজেই নির্বাচন করে নিতে পারবে। ব্যাভিচারের সাংঘাতিক শাস্তির বিধান তাঁর নির্দেশে আছে। স্ত্রী যদি পরপুরুষে আসক্তা হয়, তাহলে রাজা তাকে সর্বসমক্ষে কুকুর দিয়ে দংশন করাবেন। [ভর্তারং লঙ্ঘয়েদ যা তু স্ত্রী জ্ঞাতিগুণদর্পিতা। তাং শ্বভি: খাদয়েদ রাজা সংস্থানে বহুসংস্থিতে।] আর পরস্ত্রীগামী পুরুষের বেলায়? রাজা তাকে অগ্নিতপ্ত লৌহশয্যায় শয়ন করিয়ে ঝলসে মারবেন। [পুমাংসা দাহয়েৎ পাপং শয়নে তপ্ত আয়সে। অভ্যাদধুশ্চে কাষ্ঠানি তত্র দাহ্যেত পাপকৃৎ।।]
বাপরে, কি সংঘাতিক বিধান? সমাজ সময়ের স্রোতে আজ কোথায় চলে এসেছে। জনৈকা আধুনিকাকে বলতে শুনেছি, ‘আমি যে লোকটার সঙ্গে থাকি -না, সে সাড়ে সাতটার সময় অফিস থেকে ফেরে ভাই।’ স্বামী হল লোক। বিবাহ হল থাকা। বিদেশি বাতাস জোর বইছে। সেখানে The matrimonial instinct is lossing ground. Women refuse to be mothers.অত:পর কী হবে? খুবই ভাবনার কথা। মানুষ তাহলে কোন মায়ের পেটে জন্মাবে? আমাদের পিতৃপরিচয় থাকবে তো! না, জারজে পৃথিবী ভরে যাবে! না, দশ মিনিটে গর্ভমোচনের দাওয়াইয়ে পৃথিবী জনশূন্য হয়ে যাবে! কী যে হবে অ্যাটম বোমাই জানে।
আমরা যারা সাবেক কালের পাঁঠা, মাঝে মাঝে তাদের মনে নানা প্রশ্ন ভিড় করে আসে। সুস্থ একজন পিতা আর সুস্থ একজন মাতা দুয়ার খুলে কোল পেতে না দিলে আধুনিক কাল আসবে কি করে? আমরা তো স্বয়ম্ভূ নই। কিছু একটা ভাঙলে কিছু একটা গড়তে তো হবে! সিটি মেরে, শাড়ির আঁচল টেনে যে আধুনিকতা প্রকাশ করছে, তারও তো একটা গর্ভের প্রয়োজন হয়েছিল। প্রয়োজন হয়েছিল একবিন্দু বীর্যের। তার মুখেও তো মা স্তন গুঁজে দিয়েছিলেন। মাঝরাতে ভিজে কাঁথা পালটেছিলেন। ছেলেকে বিয়ের পাল্লায় তোলার সময় পিতা কী তাঁর নিজের কন্যার কথা ভাবেন?
এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। পৃথিবী চিরকালই বোধশূন্য। মেয়ে বড় হয়। পিতামাতার নিদ্রা চলে যায়। প্রেমিক যুবকও পিঁড়েয় বসার আগে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। খাট? সেগুনের তো! ফ্রিজ? ইনবিল্ট স্টেবিলাইজার আছে তো! হাতঘড়ি? ডে, ডেট, কোয়ার্জ তো! মেয়েটিকে তো আগেই যৎপরোনাস্তি বাজানো হয়েছে। তবু তবু মধ্যরাতে ব্রিজের ওপর দিয়ে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের মতো একটি মেয়ে ছুটে চলেছে। আর্ত চিৎকার—বাঁচাও, বাঁচাও। পুরুষজাতির হাত থেকে আমাকে বাঁচাও। হায় মনু! হায় জোহার!