ভাঙা মন্দিরের অভিশাপ
মানুষের জীবনে এমন এক একটা ঘটনা ঘটে, যা তার আপাত সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ভেতরে ভেতরে তছনছ করে দেয়। বাইরে থেকে দেখে তা বোঝা না-গেলেও যার ওপর দিয়ে ঝড়টা যায়, তার পক্ষে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোটা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। না, এসব দার্শনিক ভাবনা অকারণে আমার মাথায় আসেনি। গত কয়েকদিন ধরে আমার বন্ধু সমুদ্রর ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে, তার খুব ঘনিষ্ঠ সাক্ষী হিসেবে আমি আর অন্য বন্ধুরা তিলে তিলে উপলব্ধি করেছি এই কথাগুলো। হেঁয়ালি না করে স্পষ্ট করেই ঘটনাটা বলি তাহলে।
পাড়ার রকবাজ বখাটে ছোঁড়া বলতে মধ্যবয়স্ক কাকু জ্যেঠুরা যাদের বোঝান, আমি আর আমার বন্ধুরা এককথায় তাই। ঘরের খাই আর সারাদিন বনের মোষ তাড়াই। অবশ্য বনের মোষ তাড়ানোর মধ্যে রাতবিরেতে ওই কাকু জ্যেঠুরা অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে দৌড়নো থেকে শুরু করে তাঁদের জন্য রক্ত দেওয়া অবধি সবই পড়ে। আমাদের মধ্যে কেউ স্কুলের গণ্ডি পার করেনি, কেউ বা গ্র্যাজুয়েট। তবে ওসবে আর কিছু যায় আসে না। অন্ধকার আমাদের ভবিষ্যতের গণ্ডি ছাড়িয়ে বর্তমানকে আবৃত করে ফেলেছে। অজানা অচেনা যে কেউ আমাদের দেখে বলে দেবে এদের সামনে এক বিশাল শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই নেই। বাড়ির লোকেরাও আর আমাদের কাছ থেকে কিছু আশা করে না। তিনবেলা অসম্মানের ভাত খেয়ে জীবনধারণ করাটাও আমাদের কাছে অভ্যাস হয়ে গেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে আড্ডা দিয়ে শুরু হয় আর শেষ হয় রাত এগারোটা অবধি একচিলতে ক্লাবঘরে ক্যারাম পেটানো দিয়ে। গত তিন বছর ধরে এই রুটিন চলছিল। ব্যাপারটা একটু অন্য চেহারা নিল আমাদের বন্ধু সমুদ্র প্রেমে পড়ার পর। না, একটু ভুল হল। প্রেমে পড়াটা আমাদের কাছে নতুন নয়। পাড়ায় নতুন ভাড়াটে এলে বা নবনির্মিত ফ্ল্যাটবাড়িতে নতুন বাসিন্দা এলে আর তাদের ঘরে কোনও আমাদের কাছাকাছি বয়সের মেয়ে থাকলে তার প্রেমে পড়াটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক একজনের, অথবা একসঙ্গে দু’জনের প্রেমে ওঠাপড়া লেগেই থাকত। কখনো সে প্রেম মেয়ের ষণ্ডাগুন্ডা বাবাকে দেখে অথবা দামি বাইকে চড়া বাইসেপ বাগানো বয়ফ্রেন্ডকে দেখে কিংবা মেয়ের তাচ্ছিল্যের সামনে আস্তে আস্তে বিন্দু হতে হতে মিলিয়ে যেত। এর কোনওটাই যদি না হত, সেক্ষেত্রে কপালটা নেহাতই খারাপ হত। কারণ পথ পরিষ্কার দেখে প্রেমিকটির সাহস যেত বেড়ে আর বেশিরভাগ সময়েই প্রেমের প্রস্তাব দিতে গিয়ে হাতের চড় অথবা মুখের ঝড়ের সামনে পড়ে পালাবার পথ পেত না। এসব জেনেও বারবার প্রেমে পড়াটাই ছিল আমাদের একঘেয়ে জীবনের বিনোদন।
সমুদ্রর প্রেমটাও এমনই হত যদি না… যদি না অঙ্কিতা, মানে সমুদ্রর প্রেমিকা আচমকা তার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেত। আমাদের পাঁচজনের বড় বড় বিস্মিত চোখের সামনে অঙ্কিতা সমুদ্রর প্রস্তাবে এককথায় সলজ্জ হেসে ‘হ্যাঁ’ বলল। আমরা তো আমরা, সমুদ্রও প্রথমটায় কেমন ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইল। তারপর যখন বুঝল ব্যাপারটা ঠাট্টা নয়, তখন টলতে টলতে এসে বসে পড়ল আমাদের পাশে। ততক্ষণে অঙ্কিতা চলে গেছে। এরপর দিনের পর দিন আমাদের গবেষণার একটাই বিষয় ছিল, অঙ্কিতার মতো সুন্দরী বিদুষী সমুদ্রর মধ্যে কী দেখল! মনে মনে আমারও একটু আফসোস হয়েছিল বইকি, আমি যদি আগে প্রস্তাব দিতাম তাহলে হয়তো…। আমি হলফ করে বলতে পারি বাকিদেরও এমনই কিছু মনে হচ্ছিল। যাই হোক, শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে সমুদ্র আর অঙ্কিতার প্রেম গভীর হচ্ছিল। সমুদ্র আস্তে আস্তে কেমন সিরিয়াস টাইপ হয়ে যাচ্ছিল। আড্ডায় আসা কমিয়ে দিয়েছিল।
একদিন ওকে বাড়িতে ডাকতে গিয়ে নিজের চোখে দেখলাম ওর বিছানার ওপর উপুড় করে রাখা কম্পিটিটিভ পরীক্ষার বই। আমাদের মনে ওর জন্য বিতৃষ্ণা জমা হচ্ছিল। বাকি পাঁচজন আড়ালে সমুদ্রর নামের বদলে মজনু, মীরজাফর এসব বলে সম্বোধন করতে শুরু করলাম। নিয়ম করে দিনের একটা সময় আমাদের কাছে আসত বটে ও, কিন্তু খেয়াল করে দেখেছি সে সময়টায় অঙ্কিতা থাকত কলেজে। মোটের ওপরে সমুদ্র আস্তে আস্তে আমাদের বন্ধুবৃত্ত থেকে ছিটকে যাচ্ছিল। আমরাও ওকে এড়িয়ে চলছিলাম।
এরকম প্রায় মাস ছয়েক চলল। তারপর একদিন বিকেলে একটা খবর এল আমাদের কানে। রেলস্টেশন আমাদের পাড়া থেকে হেঁটে সাত মিনিটের পথ তাই পাড়ার সবাই মোটামুটি হেঁটেই যাতায়াত করত। সেরকমই অফিসফেরতা কারো মুখে শুনলাম এক মর্মান্তিক ঘটনার কথা। অঙ্কিতা কোথাও থেকে ফিরছিল। রেললাইন পার হওয়ার সময় ডাউন লাইনে থ্রু ট্রেন অ্যানাউন্স হয়েছিল। ট্রেন অনেক দূরে ছিল বলে সে তাড়াতাড়ি পার হয়ে যেতে চেয়েছিল। হয়তো হয়েও যেত। কিন্তু তাড়াহুড়োয় তার পা পড়ে যায় দুটো লাইনের ফাঁকে। লক্ষ্য করেছি, ট্রেন কাছাকাছি এলে খুব দ্রুত লাইনের ওই ফাঁক বুজে যায়। অঙ্কিতার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। তার একটা পা লক হয়ে গেল লাইনের ফাঁকে পড়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে মেয়েটা দেখেছিল থ্রু ট্রেন ছুটে আসছে বিভীষিকার মতো। প্রত্যক্ষদর্শীরা যদিও বলছিল অঙ্কিতা নাকি একটুও চিৎকার চেঁচামেচি বা ছটফট করেনি। বরং চুপ করে দাঁড়িয়ে যেন অপেক্ষা করছিল ট্রেন আসার, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস হয়নি। সেও কি সম্ভব! বলাই বাহুল্য, কোনওভাবেই আর বাঁচা সম্ভব হয়নি অঙ্কিতার। খবর পেয়ে আমরা যখন পৌঁছলাম, অঙ্কিতার ছিন্নভিন্ন দেহটাকে আর মানুষের বলে চেনা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ পরে রেলের ডোম একটা পলিথিন প্যাকেটে ভরে নিল অঙ্কিতাকে। মানে ওর দেহাবশেষ। নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে ডোমটা কুড়িয়ে নিচ্ছিল অঙ্কিতাকে। লাইনের পাশে বসে পড়ে হড়হড় করে বমি করেছিলাম আমি।
সমুদ্রকে এর পর দিন সাতেক কেউ খুঁজে পায়নি। ওর বিধবা মা পাগলের মতো আমাদের কাছে ছুটে এসে হাত ধরে অনুরোধ করেছিলেন ওকে খুঁজে আনার জন্য উনি বলার আগে থেকেই আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম আমাদের বন্ধুকে। কিন্তু সমুদ্র যেন গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমরা পুলিশেও মিসিং ডায়েরি করেছিলাম। কিন্তু একটা কাঠবেকার পাড়ার জঞ্জাল ছোঁড়ার জন্য পুলিশেরও তেমন মাথাব্যথা ছিল না। আস্তে আস্তে থিতিয়ে পড়ছিল ঘটনাটা। শুধু সমুদ্রর মা আর আমরা পাঁচজন ভুলতে পারছিলাম না।
ঠিক সাতদিনের দিন মাঝরাতে টোকা পড়ল আমার ঘরের দরজায়। আমার ঘরটা আমাদের বাড়ির মধ্যে একটু একটেরে। ইচ্ছে করেই এই ঘরটা বেছে নিয়েছি থাকার জন্য। বাইরে থেকে এসে বারান্দায় উঠে বাঁদিকে সরাসরি আমার ঘরের দরজা। আর ডানদিকে বেঁকে বৈঠকখানা পেরিয়ে অন্যান্য ঘরগুলোতে যাওয়া যায়। আমার ঘরের মধ্যে সিগারেট খেলেও আমার হিটলার বাবার নাকে গন্ধ যাওয়া সম্ভব নয়। মা অবশ্য মাঝে মাঝে ঘর পরিষ্কার করার সময় খিটখিট করে, তা মাকে ম্যানেজ করা কঠিন না। তাই মাঝরাতে আমার ঘরের দরজায় টোকা কেন, কেউ যদি এসে ঢুকেও পড়ে, কারও পক্ষে জানতে পারা সম্ভব নয়। প্রথমে টোকার আওয়াজ পেয়ে ভেবেছিলাম আবার বোধহয় পাড়ার কেউ অসুস্থ হয়েছে। হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডাক এসেছে। কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে দ্বিতীয় টোকাটা কানে এল। তখন একটু সন্দেহ হল। টোকাটা মোটেই তাড়াহুড়োর নয়, বরং খুব ক্লান্তভাবে থেমে থেমে কেউ দরজা খোলার অনুরোধ করছে যেন। সেটার মধ্যে স্বার্থের দাবি নেই, গভীর আকুতি আছে। কৌতূহলী হয়ে লাইটটা জ্বালিয়ে দরজাটা অল্প ফাঁক করতেই চমকে উঠলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সমুদ্র। এক মাথা উসকোখুসকো চুল, সাতদিন আগেও যে টি শার্টটা পরে ওকে শেষবার দেখেছিলাম, এখনও ওটাই পরনে। আমি দরজা খুলতেই কোনও ভূমিকা না করেই বলে উঠল, “একটা সাহায্য করবি ভাই?” ঠিক যেন রাত দেড়টার সময় কারোর বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তাকে ঘুম থেকে তুলে এটা বলাটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক। অবাক আমি আগেই হয়েছিলাম, কিন্তু ওকে দেখে একটু মানসিক ভারসাম্যের অভাব রয়েছে বলে মনে হওয়াতে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “নিশ্চয়ই। আয় না, ভেতরে আয়।” আমার মনে হচ্ছিল, কোনওরকমে ওকে ঘরে ঢোকাই, আবার কোথাও চলে যেন না যায়। সকাল পর্যন্ত যেভাবেই হোক ওকে ধরে রাখতেই হবে। তারপর আমার বন্ধুদের খবর দেব। হস্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে সমুদ্র বলল, “আমার সঙ্গে যাবি একটা জায়গায়?”
ওর কথাগুলো আমার ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল না। তবু প্রশ্ন করলাম, ‘কোথায় যেতে চাস?”
সমুদ্র খাটের ওপর বসে পড়ে হাত দিয়ে ওর পাশের জায়গাটা দেখিয়ে আমাকে বসতে ইশারা করল। তারপর খাটের পাশে রাখা জলের জগ থেকে ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক জল শেষ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে-পড়া জলের ধারা হাতের চেটোর পেছন দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, “পুরুলিয়া।”
আমার মুখ হাঁ হয়ে গেল। বলে কী! হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, পুরুলিয়া! মুখে বললাম, “সে না হয় যাব। কিন্তু ব্যাপারটা একটু খুলে বল দিকি। এতদিন কোথায় ছিলি? এখন এত রাতেই বা এলি কোত্থেকে? বাড়িতে গেছিলি? মাসিমা তো খুব কান্নাকাটি করছেন। তাছাড়া পুরুলিয়া যেতে চাইছিস কেন?” সমুদ্রকে দেখে মনে হচ্ছিল না আমার একটা কথাও ওর কানে ঢুকছে। মিনিট খানেক পর উত্তর এল। তাই বুঝলাম ও সবই শুনেছে।
“এখন যাব না মায়ের কাছে। গেলে আটকে পড়ব। পুরুলিয়া থেকে ফিরে একবারে যাব।” আবার নীরবতা। কয়েক মিনিট পর মুখ খুলল।
“তুই হয়তো জানিস না অঙ্কিতা ফোকলোরিস্টিক্স নিয়ে পড়াশুনা করছিল। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে দেখা হত, তার বেশ অনেকটা সময়ই কাটত ওর মুখে এসব শুনে। লেখাপড়া-পাগল মেয়ে ছিল। ওর সঙ্গে মিশে আমার মধ্যেও নতুন করে চারিয়ে যাচ্ছিল পড়াশোনার ইচ্ছেটা।” বলতে বলতে দু’চোখ জলে ভরে এল সমুদ্রর। নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলতে থাকল সে, “ওর কাছেই শুনেছিলাম পুরুলিয়ার এক আদিবাসী গ্রামের রহস্যের কথা। যদিও সেই আদিবাসী সম্প্রদায় খুব সন্তর্পণে বাকি পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে তাদের এই রহস্য। কিছুদিন আগে অঙ্কিতা আর ওর কয়েকজন সহপাঠী কলেজ থেকে এক্সকারশনে গিয়েছিল এই গ্রামে। সেখানে দু’দিন থাকার সুবাদে ওরা এ কথা জানতে পারে।”
আমি অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কিন্তু রহস্যটা কী?”
সমুদ্র আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই গ্রামে এক আদিবাসী দেবীর মন্দির আছে। সেই মন্দিরের দরজা বহুবছর ধরে বন্ধ। কেউ জানে না মন্দিরের ভিতরে কী আছে। বাইরে থেকেই পূজিত হন দেবী। মন্দিরের দরজার ঠিক বাইরে একটা বড় পাথর রাখা থাকে। সেই পাথরকেই দেবীজ্ঞানে পুজো করা হয়। অদ্ভুত ব্যাপারটা হল, কেউ ওই দেবীর নাম জানে না। বহু বছর ধরে তাঁর পুজো প্রচলিত। তাই এখনও সবাই ভয়ে, ভক্তিতে পুজো করে চলেছে। আদিবাসীরা বিশ্বাস করে ওই মন্দিরের দরজা খুললে তার ওপর নেমে আসবে এক ভয়ংকর অভিশাপ। দরজা খোলার কয়েকদিনের মধ্যে এক মর্মান্তিক ও শিউরে ওঠার মতো সাংঘাতিক মৃত্যু হবে তার। শুধু তাই না, তার আত্মা চিরকালের জন্য বন্দি হয়ে পড়বে সেই মন্দিরের বন্ধ দরজার পিছনে।”
সমুদ্রের কথাগুলো শুনে বিশ্বাস তো অবশ্যই হচ্ছিল না, তবে একটা সন্দেহ জাগছিল। ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “সমু, অঙ্কিতা কী….” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সমুদ্র নিজের দু’হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ মৃণাল, হ্যাঁ। অঙ্কিতা ওই মন্দিরের দরজা খুলে ফেলেছিল। ও পুরো ব্যাপারটাকে একটা লোককথা হিসেবেই দেখেছিল। ওর বন্ধুরা নাকি অনেক বারণ করেছিল ওকে। কিন্তু ও কোনও কথা শোনেনি। যেদিন ওরা ওখানে পৌঁছায়, সেদিন রাতেই অঙ্কিতা ওর আরও দুই বন্ধু রাহুল আর নীরজকে কোনওমতে রাজি করিয়ে যায় ওই মন্দিরে। যে গেস্ট হাউসে উঠেছিল, সেখানকার চৌকিদারকে টাকা খাইয়ে দুটো শাবল জোগাড় করেছিল। তারপর মন্দিরের তালা ভেঙে ফেলেছিল ওরা। ফিরে এসে ঘটনাটা রসিয়ে বর্ণনা করেছিল আমাকে অঙ্কিতা।” আবার বাধা দিলাম সমুদ্রকে, “তার মানে ওর দুই বন্ধুরও তো এতদিনে মারা যাওয়া উচিৎ।”
“আমিও ঠিক এটাই ভেবেছিলাম জানিস! তাই অঙ্কিতা মারা যাওয়ার পর এই ক’দিন পাগলের মতো ঘুরেছি ওদের সন্ধানে। ওদের কলেজে গিয়ে জানতে পারলাম, অঙ্কিতার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকে ওরা কলেজ আসা বন্ধ করেছে। জানতে পারলাম ওরা দু’জনেই হস্টেলে থাকে। একজনের বাড়ি বর্ধমান, অন্যজনের মুর্শিদাবাদ। হস্টেলে গিয়ে শুনলাম দু’জনের কেউই হস্টেলে নেই। বাড়িতে গেছে। অগত্যা একে একে দু’জনের বাড়িতে গেলাম। দু’জনেই শারীরিকভাবে সুস্থ আছে, যদিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। আমি ওদের জিজ্ঞেস করে যা উদ্ধার করলাম তা হল- ওরা তিনজনেই মন্দিরের দরজা ভেঙেছিল ঠিকই, কিন্তু একদম শেষে গিয়ে কিছুতেই তালার বাকি অংশটুকু ভেঙে পড়তে চাইছিল না। তখন অদ্ভুতভাবে অঙ্কিতা শাবলের চাপ দিতেই ভেঙে পড়ে সম্পূর্ণ তালাটা। অঙ্কিতাই দরজা খোলে হাতের চাপে। কিন্তু ভেতরে চাপ চাপ অন্ধকারে কিছুই দেখতে পায়নি। এইসময়ে রাহুল আর নীরজ পুরোপুরি বেঁকে বসে। তখন বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয় অঙ্কিতাকে। কিন্তু সেভাবে দেখতে গেলে অঙ্কিতাই মন্দিরের দরজা খুলেছিল। তাই অভিশাপ ওর উপরেই নেমে এসেছে।”
আমি অবিশ্বাসের কণ্ঠে সমুদ্রকে বললাম, “তুই এসবে বিশ্বাস করিস?”
সমুদ্র প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল, “সেটাই তো। বিশ্বাস করতে চাই না বলেই একবার যেতে চাই ওখানে। দেখতে চাই সবকিছু নিজের চোখে। তুই জানিস না, এ-ক’দিন দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাচ্ছি শতাব্দীপ্রাচীন এক মন্দিরের ভাঙাচোরা দরজা, আর ভেতর থেকে ভেসে আসছে একটা করুণ চিৎকার… আর সেই গলাটা অঙ্কিতার। জানি এ সবই আমার দুর্বল মনের কল্পনা, কিন্তু তবু একবারের জন্য চক্ষু কর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে চাই। এটা মনে আসার পর তোর কথাই আমার সবার আগে মনে পড়েছিল। যাবি তো মৃণাল?”
আমি মনে মনে অন্য কথা ভাবছিলাম। অঙ্কিতার মৃত্যু আর মন্দিরের দরজা খোলার বিষয়টা সম্পূর্ণ কাকতালীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি যদি যেতে অস্বীকার করি তাহলে হয় সমুদ্র একাই যাবে, নয়ত সারাজীবন এই কৌতূহল ওকে কুরে কুরে খাবে। হতে পারে ও আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। তার চেয়ে একবার যদি নিজের চোখে দেখে আসতে পারে অঙ্কিতার আত্মা ওখানে আটকে নেই, সবটাই একটা অন্ধবিশ্বাস, তাহলে হয়তো সহজে জীবনে ফিরতে পারবে সমুদ্র। পরদিন সকালেই পুরুলিয়া যাওয়ার ট্রেন ধরব বলে কথা দিলাম ওকে। সমুদ্র আশ্বস্ত হয়ে শিশুর মতো বাকি রাতটা আমার পাশে শুয়ে ঘুমোলো। একবারও স্বপ্ন দেখে জাগতে বা চিৎকার করতে দেখলাম না। বুঝলাম আমি সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছি, শুধু যাওয়ার কথাতেই ও নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একবার ওখান থেকে ঘুরে এলে অঙ্কিতাকে পুরোপুরি ভুলে যেতে সময় লাগবে না সমুদ্রর।
*****
আদিবাসী গ্রামটা সোনপাহাড়ি নামে একটা ছোট টিলার উপরে। চারিদিক সবুজে সবুজ, আশেপাশে এরকম আরও বেশ কিছু ছোট ছোট টিলা দেখা যায়। দুপুর দুপুর পৌঁছে গিয়ে আমরা উঠলাম সেই গেস্ট হাউসে, যেখানে অঙ্কিতারা উঠেছিল। অবশ্য এটা ছাড়া আর কোনও জায়গাও নেই থাকার। বেড়াতে আসার জন্য খুব একটা জনপ্রিয় নয় এই গ্রাম। গেস্ট হাউসে জিনিসপত্র রেখে আর দুপুরের জন্য গরম গরম বনমুরগির ঝোল আর ভাতের অর্ডার দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মন্দিরের উদ্দেশে। গেস্ট হাউসে আমরা ছাড়া আর অতিথি নেই। বুঝলাম সারা বছর এরা প্রায় মাছিই মারে। আমি রিসেপশনে বসা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গিয়ে খাবারের অর্ডার দিতে দিতে নানারকম গল্প করছিলাম। ভদ্রলোকের বয়স বছর পঁয়তাল্লিশ। কথায় পুরুলিয়ার আঞ্চলিক উপভাষার টান স্পষ্ট। কথায় কথায় ওঁকে জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারলাম, কিছুদিন আগে কলকাতার কলেজের একটা টিম এসেছিল এখানে। ওরা যেদিন এখান থেকে চলে যাবে, সেদিন সকালে মন্দিরের দরজার তালা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। মন্দিরের বাইরে দুটো শাবল মেলে। ম্যানেজারবাবুও দেখতে গিয়েছিলেন। তারপরেই আবিষ্কৃত হয় গেস্ট হাউসের দুটো শাবল গায়েব। সন্দেহ পড়ে কলেজের ছেলেমেয়েগুলোর ওপরেই। কিন্তু ততক্ষণে ওরা রওনা হয়ে গেছে স্টেশনের উদ্দেশে। গেস্ট হাউসের চৌকিদারও নিখোঁজ। সম্ভবত মন্দিরের দরজার তালা ভাঙার সংবাদ পেয়েই সে পালিয়েছে। কারণ শাবল দুটো তার ঘরেই রাখা থাকত। হয়তো টাকাপয়সার লোভেই সে ওগুলো দিয়েছিল। গ্রামের লোক খুব ক্ষেপে গিয়েছিল। তারা ছেলেমেয়েগুলোকে তাড়া করে স্টেশনে অবধি যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মন্দিরের পুরোহিত বাধা দেন। তিনি ওদের বুঝিয়ে বলেন, যে বা যারা এ কাজ করেছে, তারা তো এমনিই শাস্তি পাবে। অভিশাপ তো তাদের ছাড়বে না। আর এ কাজের ফলে গ্রামের বা গ্রামবাসীর কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাহলে কেন শুধু শুধু ঝামেলা পাকানো। এ কথা শুনে আদিবাসীরা ক্ষান্ত দেয়।
যদিও ভদ্রলোক বেশ অবাক হলেন আমরা কীভাবে এসব জানলাম, আমি কোনওমতে এ কথা বলে ম্যানেজ করলাম যে আমার এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছি। সাংবাদিকদের কাছে সব রকমের সংবাদ থাকে এ কথা তো সবাই জানে।
আমি আর সমুদ্র মিনিট দশেক এবড়োখেবড়ো পথে হেঁটে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সামনে। একটা ছোটো টিলার উপরে পুরনো জরাজীর্ণ মন্দিরটাকে দেখলে দিনের বেলাতেও একটু গা ছমছম করে। চারিদিকে বড় বড় গাছ। তাদের ছায়া দিনের আলোকে প্রখরভাবে মন্দিরের চারপাশে প্রবেশ করতে দেয়নি। একটা ছায়া ছায়া মাদকতা ঘিরে রেখেছে মন্দিরের আশপাশ। মন্দিরের চত্বরে পৌঁছতে হলে অল্প একটু পথ চড়াই উঠতে হয়। পথটা পায়ে হাঁটা শুঁড়িপথ। আমি আর সমুদ্র সেই পথে পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সামনে। লালচে ইটের তৈরি মন্দিরের পিছনের অংশ প্রায় ধ্বসে এসেছে। সামনের দিকের অংশও যে কোনও দিন ভেঙে পড়তে পারে। এবার আমি বুঝতে পারছিলাম মন্দিরে প্রবেশ করা সম্পর্কে এত অভিশাপ ইত্যাদির গল্প ছড়িয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করার কারণ। সাধারণত ধর্মীয় কুসংস্কারের পিছনে প্রায়শই কোনও না কোনও পার্থিব ভিত্তি থাকে। মন্দিরে প্রবেশ করলে যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে অভিশাপের কথা ছড়িয়ে কৌতূহলী মানুষকে বেঁধে রাখার চেষ্টা আর কী! দেখলাম মন্দিরের দরজায় নতুন তালা ঝুলছে। বোঝাই যাচ্ছে ঐ ঘটনার পর এই তালা লাগানো হয়েছে। এছাড়া দরজার সামনে একটা বেশ বড়সড় পাথর শক্তপোক্ত করে বসানো যার সর্বাঙ্গে সিঁদুর মাখানো। সেটাকে দরজাসুদ্ধ বেশ মোটা একটা শিকল দিয়ে বেড়া দেওয়া হয়েছে। এটা বোধহয় আগে ছিল না। আমরা মন্দিরের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। হঠাৎ সমুদ্র আমাকে বলল, “তুই গেস্ট হাউসে ফিরে যা মৃণাল। আমি একটু পরে আসছি। আমি এখানে একটু নির্জনে বসতে চাই। একা। দেখতে চাই অঙ্কিতা সত্যিই এখানে বন্দি কিনা। ও এখানে থাকলে আমি ঠিক বুঝতে পারব। ওর শ্বাসপ্রশ্বাসও আমি অনুভব করতে পারব।”
এবার একটু ভয় পেলাম। সমুদ্রকে একা রেখে যাব! যদি আবেগপ্রবণ হয়ে কিছু করে বসে! নিজেকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না। তাই ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ারই চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু অনেকক্ষণ বোঝানোর পরও যখন ওর শক্ত চোয়াল আলগা হল না, তখন মাথায় দুশ্চিন্তা নিয়েই ফিরে চললাম গেস্ট হাউসে। তখন বেলা প্রায় তিনটে। খিদেয় পেটে ইঁদুর ছুটোছুটি করছে। এত রাগ হচ্ছিল সমুদ্রর উপর যে গেস্ট হাউসে ফিরে স্নান করে একাই খেয়ে নিলাম। খেয়ে উঠতে উঠতে বেলা প্রায় সোয়া চারটে বাজল। তখনও সমুদ্রর দেখা নেই। গত রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ক্লান্তিতে বিছানায় গড়িয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমে চোখ জুড়ে এল তা নিজেও বুঝতে পারিনি। ঘুম যখন ভাঙল তখন ঘড়ির কাঁটা ছটা ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রথমেই মনে এল যে কথা, তা হল, সমুদ্র কী ফেরেনি, নাকি আমি এত গভীর ঘুমিয়েছি যে দরজায় করাঘাত শুনতে পাইনি! ধড়মড় করে উঠে দরজায় খিল দিয়ে নীচে গেলাম। রিসেপশনে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সমুদ্র ফেরেনি। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। নিজের উপরেই রাগ হচ্ছিল। কীভাবে আমি এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারলাম। ঘুমিয়ে পড়লাম কী করে!
কোনওরকমে ঘরে ফিরে জামাপ্যান্ট পালটে বেরিয়ে পড়লাম। শুধু সঙ্গে নিলাম একটা তিন ব্যাটারির টর্চ। একবার ভাবলাম, গেস্ট হাউসে জানাবো কিনা! তারপর বুঝলাম, সেটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। একে সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে গ্রামের হাওয়া গরম রয়েছে, তার মধ্যে আবার এ কথা জানলে না জানি এরা কী করবে। চাই কি পুলিশ ডেকে ধরিয়েও দিতে পারে। গিয়ে যদি দেখি সমুদ্র বহাল তবিয়তে ওখানে বসে আছে, তখন এসব পাঁচকান করার জন্য হয়তো আফসোস হবে। কাজেই একাই চললাম সমুদ্র উদ্ধার অভিযানে। সেই মুহূর্তে সমুদ্রকে সামনে পেলে আমি হয়তো টেনে এক চড় মারতাম ওকে। পাগলামি ঘুচিয়ে দিতাম ওর।
মন্দিরে পৌঁছনোর পুরো রাস্তাটাই অন্ধকারে ঢাকা। আমি বারবার টর্চ জ্বালিয়ে নিভিয়ে যেতে লাগলাম। সবচেয়ে ভয় করছিল সাপখোপের কথা ভেবে। যাই হোক, নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম মন্দিরের সামনে। আগেই চারদিকে ঘুরে দেখলাম সমুদ্রকে দেখা যায় কিনা। কিন্তু না, কোথাও নেই সে। তারপর গলা ছেড়ে ওর নাম ধরে ডাকতে থাকলাম— “সমু, সমু তুই কোথায়? প্লিজ সাড়া দে।”
আমার গলার স্বর অন্ধকারে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল আমারই কাছে। আমি মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক টর্চের আলো ফেলে দেখার চেষ্টা করছিলাম সমুদ্রকে দেখা যায় কিনা। একটা অজানা আশঙ্কায় হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি অনেক গুণ বেড়ে গেল। সহসা টর্চের আলো মন্দিরের দরজার উপর পড়তেই আমি চমকে উঠলাম। দরজাটা খোলা। পুরো হাট করে খোলা নয়, একটা দরজা বন্ধ, অন্যটা অর্ধেক খোলা। দেখেই মনে হল কেউ যেন ওই খোলা অংশ দিয়ে ভেতরে ঢুকেছে। সমুদ্র ছাড়া আর কেই বা হতে পারে। সামনের পাথরটা যথাস্থানে রয়েছে, তাকে ঘিরে বেড়ার মতো করে লাগানো মোটা শিকলটাও আছে। দরজা দিয়ে ঢুকতে গেলে পাথরটার গা ঘেঁষে গুড়ি মেরে এগিয়ে শিকলের ঘেরাটোপের তলা দিয়ে ঢুকতে হবে। আগে যখন শিকল ছিল না, তখন কাজটা এখনকার থেকে সহজে করা যেত বলেই মনে হয়। কিন্তু এখন সমুদ্র রোগাপাতলা চেহারা নিয়ে গলে যেতে পারলেও আমার লম্বা চওড়া পেটানো শরীর গলতে নিঃসন্দেহে বেগ পেতে হবে। কিন্তু আপাতত এ ছাড়া আর কোনও উপায় আছে বলে মনে হল না।
টর্চটা শিকলের নীচ দিয়ে হাত বাড়িয়ে জ্বলন্ত অবস্থাতেই আগে দরজার কাছাকাছি পৌঁছে দিলাম। আলোর দিকটা আমার দিকে করে কোনওমতে স্থির করে রাখতে সক্ষম হলাম, যাতে গড়িয়ে না যায়। তারপর শুয়ে পড়ে প্রায় বুকে হেঁটে ঘেঁষটে হেঁচড়ে অবশেষে পৌঁছতে পারলাম দরজার কাছে। এই প্রথম দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সত্যিকারের ভয় কাকে বলে অনুভব করলাম। সামনে একটা আধখোলা দরজা, যার ভিতরে কী আছে তা কেউ জানে না; একটা ভ্যাপসা স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ আধখোলা পাল্লার ভিতর থেকে এসে জোরালোভাবে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে। পিছনে বিশ্বচরাচর পরিব্যাপ্ত করা অন্ধকার। মাঝে মাঝেই গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ সম্পূর্ণ পরিবেশটাকেই কেমন যেন অপার্থিব করে তুলছে। টর্চটা হাতে তুলে নিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু কেন যেন দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরে আলো ফেলতে কেমন দ্বিধা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল অনধিকার প্রবেশ করে মন্দিরের ভিতরে বসবাসকারী এত বছরের অন্ধকারকে, ঢাকা পড়ে থাকা সত্যি অথবা মিথ্যেটাকে জানার কোনও অধিকার আমার বা অন্য কারও নেই। হঠাৎ খুব রাগ হল অঙ্কিতার উপর। কী প্রয়োজন ছিল ওর মন্দিরের এত বছরের চাপা পড়ে থাকা রহস্যকে জানার! নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল। মনে মনে কার কাছে ক্ষমা চাইলাম জানি না, কিন্তু বিড়বিড় করে বলে উঠলাম, “তোমার একান্ত নিজস্ব অন্দরে অনধিকার প্রবেশের জন্য আমায় ক্ষমা করো।” প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একহাতে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেললাম একদিকের বন্ধ পাল্লাটা। আর্তনাদ করে দরজাটা খানিকটা ফাঁক হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু ভেতরের অন্ধকার এতটুকুও হালকা হল না। আমি মুখটা ভেতরে গলিয়ে গলা তুললাম, “সমু, তুই কী এখানে?” উত্তর পাওয়ার আশা ছিল না। কিন্তু উত্তর এল। “আয় মৃণাল। আমি জানতাম তুই আসবি। ভেতরে আয়।”
সমুদ্রর গলা শুনে আমার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। চৌকাঠ ডিঙিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই কোন এক ম্যাজিকে আমার হাতের টর্চের আলো নিভে গেল। আমার মন বিশ্বাস করতে চাইছিল মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চাইছেন না, তাঁর রহস্য কেউ দেখে ফেলুক, জেনে ফেলুক। কিন্তু মাথা বলছিল, হয়তো টর্চের ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে অথবা অন্য কোনও টেকনিক্যাল সমস্যা। ডানহাতে টর্চটা ধরে বাঁ হাতের তালুর ওপর ঠুকে ঠুকে জ্বালানোর চেষ্টা করছিলাম, এমন সময় কানে এল একটা সমবেত চাপা হাসির শব্দ। ইয়ে… মানে একটাই শব্দ, তবে একাধিক কণ্ঠস্বরে। বুঝতে পারছি খুব অদ্ভুত শোনাচ্ছে, কিন্তু হাসিটার বর্ণনা করতে গেলে আর কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি সমুদ্র হাসছে। অথচ ওর গলা থেকে একই সঙ্গে দুটো শব্দ বেরোচ্ছে। মোটা ও মিহি দুটো গলা একই সঙ্গে একইভাবে হাসলে যেমন শোনাতে পারে আর কী! একটু আগেও ও যখন কথা বলছিল, তখন আমার খুব চেনা গলার স্বরটাই শুনতে পেয়েছিলাম। অবাক হয়ে হাসির শব্দ লক্ষ্য করে সেদিকে তাকাতেই দেখলাম আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে সমুদ্র। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে ওর চোখদুটো। ঝকঝকে সাদা দাঁত বের করে হাসল ও। তারপর বলল, “ভয় পেলি নাকি?”
সেই গলা। একজন সমুদ্রর ভেতর থেকে যেন দু-জন মানুষ কথা বলছে। এক মুহূর্তের জন্য আমার মনে হল সমুদ্রের শরীর থেকে যে কথা বলছে ও অঙ্কিতা। সারা শরীর শিউরে উঠল। একবার পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকালাম। কখন সে দরজা বন্ধ হয়ে গেছে জানি না। কে বন্ধ করল তাও জানি না। এদিকে সমুদ্র সেই অপার্থিব কণ্ঠে বলে চলেছে “ভয় পাস না মৃণাল। বাইরের পৃথিবীর সব নিয়ম, সব প্রযুক্তি এই মন্দিরের ভেতরে অচল। এখানে সময় থমকে রয়েছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সেইজন্যই তোর টর্চ এখানে কাজ করবে না।”
আমার পা দুটো কাঁপছিল। ইচ্ছে করছিল সমুদ্রর হাত ধরে টেনে এক ছুটে বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু কাকে নিয়ে বেরবো? এই সমুদ্র কি সেই সমুদ্র? আর ওকে ফেলে রেখেই বা পালাই কী করে? কাঁপা গলায় বলে উঠলাম, “তোর কী হয়েছে সমু? তুই এভাবে কেন কথা বলছিস?” আবার সেই অমানুষিক হাসল সমুদ্র। তারপর বলল, “বুঝতে পারলি না? অঙ্কিতা আছে তো আমার সঙ্গে। একই দেহে একই মনে। আর আমরা দু-জন আলাদা হব না। অঙ্কিতাকে আমি এখান থেকে নিয়ে যাব। যেজন্য এখানে এসেছি আমরা, তা পুরোপুরি সফল মৃণাল। তুই না থাকলে এসব কিছুই হত না। তোর কাছে আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকব।”
আমার কেমন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। এই অন্ধকার যেন আমার গলা টিপে ধরছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলে উঠলাম, “তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে সমু। কী সব বলছিস? কোথায় অঙ্কিতা? তুই এখান থেকে চল, আমি তোকে কলকাতায় ভালো ডাক্তার দেখাবো। তুই ভালো হয়ে যাবি। সব তোর মনের ভুল।”
সমুদ্রর চোখদুটো ধক করে জ্বলে উঠল। তারপর একটা মেয়েদের কণ্ঠস্বর কানে এল, “ভুল না মৃণাল, সমুদ্র যা বলছে সব সত্যি। আমি আছি, ওর সঙ্গে একই দেহে।” সমুদ্রর ঠোঁট এতটুকুও নড়ছে না। ও শুধু নির্নিমেষ চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। অথচ অঙ্কিতার গলা ভেসে আসছে ওরই শরীর থেকে। আমি কি স্বপ্ন দেখছি? কোনও দুঃস্বপ্ন? নাকি সমুদ্র ভেনট্রিলোকুইজম করছে? কিন্তু এতবছরে কক্ষনো শুনিনি এই বিদ্যা ও জানে বলে। তার উপর এত সুন্দর পারফেকশনের সঙ্গে করছে কাজটা!
“আমি এখান থেকে মুক্তি চাই মৃণাল। খেলাচ্ছলে আমার জীবন, আমার সব স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ সবকিছু নষ্ট করে ফেলেছি। আমার শরীর শেষ হয়ে গেছে, আত্মা আটকে পড়েছে এই চির অন্ধকারে। কিন্তু এবার আমি এখান থেকে মুক্তি চাই। আর সেজন্য আমার তোমার সাহায্য চাই।”
“আমি কীভাবে সাহায্য করব?” সমুদ্র আমার হাত ধরল। বরফের মতো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে শিউরে উঠলাম।
“আমি যে মুহূর্তে মন্দিরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছিলাম, সেই মুহূর্তে আমার শরীর থেকে আত্মা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আমার শরীরটা পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। রাহুল আর নীরজ সেই দৃশ্য দেখে আমাকে মৃত ভেবে তক্ষুনি পালিয়ে যায় গেস্ট হাউসে। গভীর রাতে আমি একা ফিরেছিলাম। ওরা যা ভেবেছিল ঠিকই ভেবেছিল। আমি তখন মৃতই। আমার আত্মাহীন শরীরে প্রবেশ করেছিল না জানি কবে থেকে এখানে বন্দি অন্য এক আত্মা! কেউ বুঝতে পারেনি। কলকাতায় পৌঁছনোর দু-একদিনের মধ্যেই ট্রেনের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় আমার শরীর, আর মুক্তি পেয়েছিল সেই আত্মা।”
আমি অঙ্কিতার কথায় বাধা দিয়ে বলে উঠলাম, “দাঁড়াও দাঁড়াও। আমাকে তো সমুদ্র এত কথা বলেনি। আর তাছাড়া ও বলেছিল তুমি ওকে ফিরে গিয়ে বলেছ এ ঘটনা। কিন্তু ততদিনে তোমার দেহে তো অন্য আত্মার বাস।”
“ঠিক ধরেছিস। আসলে এখানে আসার আগেই অঙ্কিতা এই মন্দিরের সম্পর্কে জানত। ও তখনই আমাকে বলেছিল, সুযোগ পেলে ও মন্দিরে ঢুকে দেখতে চায়।
“ সমুদ্রর সেই দ্বৈত কণ্ঠ শোনা গেল। ওর মুখ নড়ছে এবার, “অঙ্কিতা এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পর আমার সঙ্গে একটি বারও দেখা করেনি। তখনই সন্দেহ হয়েছিল আমার। তারপর ওর সেই ভয়াবহ মৃত্যু… আমি তখনই দেখা করি ওর বন্ধুদের সঙ্গে। তোকে এসব বলিনি, যদি ভয় পেয়ে আসতে রাজি না হতিস! সেটুকুই বলেছি, যতটা বললে তোর পক্ষে কাকতালীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে।” “কিন্তু সমুদ্র, আজ যে তুই এ দরজা খুলে ঢুকলি, অভিশাপ থেকে তো তুইও রক্ষা পাবি না। আর আমি তোদের কীভাবে সাহায্য করব?”
আমার আরও কাছে ঘেঁষে এল সমুদ্র। ওর ঠান্ডা নিঃশ্বাস আমার গাল বেয়ে গলা ছুঁয়ে নেমে যাচ্ছে। ফিসফিসে খসখসে দ্বৈত কণ্ঠে বলে উঠল, “রেহাই পেতে চায় কে? আমি এসেছি এখান থেকে অঙ্কিতাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। ওকে নিয়ে বেরিয়ে যাব। তার কয়েকদিনের মধ্যে কোনও বীভৎস মৃত্যু নেমে আসবে আমার ওপর। তারপর দুজনেই মুক্ত। কেউ আর বন্দি করে রাখতে পারবে না আমাদের। আর এই জন্যই তোকে প্রয়োজন মৃণাল। তুই সাহায্য করবি অঙ্কিতাকে এখান থেকে বেরোতে।”
আমার গলা শুকিয়ে আসছে। শ্বাসকষ্ট বেড়েই চলেছে। কোনওরকমে বললাম, “কীভাবে?”
“তুই বোধহয় খেয়াল করিসনি আমি আর তুই দু’জনেই এখন মন্দিরের ভেতরে। আমাদের দু’জনের আত্মাও বন্দি হয়ে গেছে এখানে। তাই মন্দিরের দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। এবার এই দরজা খুলবে তখনই যখন কোনও আত্মা অন্যের শরীর ধারণ করে বেরিয়ে যাবে। এই মুহূর্তে এখানে তিনটে আত্মা আর দুটো শরীর। আত্মা নিজের শরীরে আর প্রবেশ করতে পারবে না। তাই আমার আত্মা ঢুকবে তোর শরীরে আর অঙ্কিতার আত্মা আমার শরীরে তো আছেই। এভাবে আমরা বেরিয়ে পড়ব এখান থেকে। ক’দিন পর তোর দেহের জন্যও আসবে এক ভয়াবহ মৃত্যু। কি করবি বল, তোর কাছে তো আর কোনও পথ নেই।”
আমার সারা শরীরে ঘামের বন্যা। চোখদুটো খুলে রাখতে পারছি না। জন্মের ঘুম এসে চেপে ধরেছে আমাকে। এদিকে চোখ বুজলেই দেখতে পাচ্ছি নানারঙের আলোর রোশনাই। জোর করে চোখ খুললাম। সামনে মেঝেতে পড়ে রয়েছে আমার অচেতন দেহ। আমি বেশ কিছুটা ওপর থেকে নিজেকে দেখছি। আমার দেহের সামনে দাঁড়িয়ে সমুদ্র। কয়েক সেকেন্ড। আমি, মানে আমার দেহটা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এল সমুদ্রর দিকে। সমুদ্রকে আলিঙ্গন করে গভীর চুম্বন করল সে। তারপর দু’জনে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। আরও বিস্ময়! দরজাটা খোলা আর বাইরে থেকে হাজার সূর্যের আলোর ছটা যেন দেখা যাচ্ছে। অথচ সেই আলো এতটুকুও কমাতে পারছে না ভেতরের অন্ধকার। ওরা বেরিয়ে যেতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এ দরজা এবার শুধু বাইরে থেকেই খুলবে। আমার গলা চিরে বেরিয়ে এল বুকফাটা আর্তনাদ। ভুল বললাম, গলা, বুক… এর কোনওটাই কি আত্মার থাকে?