ভাঙা ডানা [দ্য ব্রোকোন উইংস]
পূর্বকথা
ভালোবাসা যখন তার জাদুকরি রশ্মিতে আমার চোখ খুলে দেয় এবং তার উত্তেজিত আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে আমার হৃদয় তখন আমার বয়স আঠারো এবং সেলমা কারামি হল প্ৰথম নারী যে আমার আত্মাকে জাগিয়ে তোলে তার সৌন্দর্য দিয়ে এবং আমাকে নিয়ে যায় ভালোবাসার সেই বিশাল বাগানে যেখানে দিনগুলি পার হয়ে যায় স্বপ্নের মতো এবং রাত্রিগুলি বিয়ের উৎসবের মতো।
সেলমা কারামি হল একমাত্র নারী যে আমাকে শিখিয়েছিল ভালোবাসার উপাসনা করতে এবং আমার কাছে প্রকাশ করেছিল ভালোবাসার গোপনীয়তা এবং সে-ই প্রথম আমাকে শুনিয়েছিল প্রকৃত জীবনের কবিতা।
প্রতিটি মানুষ তার জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে স্মরণ করে এবং চেষ্টা করে পুনরায় দখল করতে সেইসব বিস্ময়কর মূহূর্ত ও স্মৃতি, যা তার গভীরতম অনুভূতিকে পরিবর্তন করেছিল এবং এর রহস্যের যাবতীয় তিক্ততা সত্ত্বেও তাকে পরিণত করেছিল সুখী মানুষে।
প্রতিটি যুবকের জীবনে একজন ‘সেলমা’ আছে যে হঠাৎ করেই তার সামনে আবির্ভূত হয় যখন জীবনের বসন্তকাল শুরু এবং তার নির্জনতা রূপান্তরিত হয় সুখের মূহুর্তে এবং রাত্রির নির্জনতাকে পরিপূর্ণ করে তোলে সংগীতে।
আমি সবসময় গভীর চিন্তায় ডুবে থাকতাম এবং উপলব্ধি করতে চেষ্টা করতাম বাইবেলের নূতন নিয়মের প্রকৃতি ও তার গুপ্ত রহস্যের অর্থ, যখন সেলমার ওষ্ঠে ভালোবাসা আমার কানে ফিসফিস করে কথা বলত। আমার জীবন ছিল একটা আচ্ছন্নতা, স্বর্গের আদমের মতোই শূন্য, যখন আমি দেখলাম সেলমা আমার সামনে আলোর স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে ছিল আমার হৃদয়ের ঈভ এবং হৃদয়কে পূর্ণ করে দিয়েছিল বিস্ময় ও গোপনীয়তায় এবং আমাকে জীবনের অর্থ বুঝিয়েছিল।
প্রথম ঈভ আদমকে স্বর্গ থেকে বহিষ্কারের ব্যাপারে নেতৃত্ব দেয় নিজের ইচ্ছায়, যখন সেলমা আমাকে তার ইচ্ছায় প্রবেশ করতে দেয় সৎগুণ ও শুদ্ধ ভালোবাসার স্বর্গে, কিন্তু প্রথম মানুষের ভাগ্যে যা ঘটেছিল আমারও তাই এবং যে উদ্যত তরবারি আদমকে তাড়া করেছিল সে রকম একটি জ্বলজ্বলে ধারালো তরবারিই আমাকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল এবং আমাকে বাধ্য করেছিল আমার ভালোবাসার স্বর্গ থেকে বেরিয়ে যেতে কোনো অবাধ্যতা অথবা নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়া ছাড়াই।
বহু বছর পার হয়ে গেছে। সেই চমৎকার স্বপ্নের বাইরে আমি কিছুই ফেলে আসিনি বেদনার্ত স্মৃতিগুলি ছাড়া, যে তার অদৃশ্য পাখা ঝাপটাচ্ছে আমার চারপাশে, বেদনায় পূর্ণ করে দিচ্ছে আমার হৃদয়ের গভীরতম প্রবেশ এবং আমাকে কাঁদাচ্ছে। আমার প্রিয়তমা, সুন্দরী সেলমা এখন মৃত এবং তাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সে কিছুই ফেলে যায়নি, আমার ভেঙে যাওয়া হৃদয় এবং সাইপ্রেস গাছে ঘেরা একটা সমাধি ছাড়া। ঐ কবর এবং ভাঙা হৃদয়ই হল সেলমার যাবতীয় বিষয়ের সাক্ষী।
কবরকে পাহারা দিয়ে রাখে যে নীরবতা তা কফিনের অন্ধকারের ভেতরে ঈশ্বরের গোপনীয়তাকে প্রকাশ করে না এবং শাখার খসখসানি শরীরের সেইসব উপাদানের শিকড়কে শুষে নেয় যা কবরের রহস্যকে প্রকাশ করে না, কিন্তু আমার হৃদয়ের মর্মবেদনাজনিত দীর্ঘশ্বাস জীবন্তদের কাছে ঘোষণা করে সেই নাটক যেখানে ভালোবাসা, সৌন্দর্য ও মৃত্যু অভিনয় করেছে।
হে আমার যৌবনের বন্ধুরা, যারা বৈরুত শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছ, পাইনগাছের কাছাকাছি কবরস্থানটি যখন তোমরা অতিক্রম করে যাও, তখন নীরবে সেখানে প্রবেশ করো এবং আস্তে হাঁটো, তাহলে তোমার ভারী পদশব্দ মৃতদের সুখনিদ্রা ভাঙাবে না এবং বিনয়ের সঙ্গে থামো সেলমার কবরের পাশে এবং অভিবাদন জানাও সেই মাটিকে যা তার মৃতদেহকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে এবং গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারণ করে মনে মনে বলো, ‘এখানে জিবরানের সমস্ত আকাঙ্ক্ষা শুয়ে আছে, যে বেঁচে আছে ভালোবাসার বন্দি হয়ে সমুদ্রের ওপরে, যা সমাহিত হয়েছিল। এইখানেই সে তার সুখকে হারিয়েছিল, ঝরেছিল তার অশ্রু এবং বিস্মৃত হয়েছিল তার হাসি।’
কবর থেকে সাইপ্রেস গাছের সঙ্গে একত্রে বেড়ে ওঠে জিবরানের দুঃখগুলো এবং সেলমার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতিরাতে তার আত্মা কবরের ওপর মিটমিট করে জ্বলে। গাছের শাখারা যোগ দেয় তার বেদনার্ত হাহাকারের সঙ্গে এবং বিলাপ করতে থাকে তার চলে যাওয়ার জন্য, জীবনের ঠোঁটের ওপর যে ছিল গতকাল একটা চমৎকার সংগীত এবং আজ সে মাটির বক্ষস্থলে একটা নীরব গোপনীয়তা।
হে আমার যৌবনের বিশ্বস্ত বন্ধু, সেই সব কুমারীর নামে শপথ করে আমি তোমার কাছে আবেদন করছি তোমার হৃদয় যাদেরকে ভালোবাসত, তারা সবাই ফুল হয়ে ঝরে পড়েছে আমার প্রিয়তমার কবরের ওপরে, যেন বিবর্ন গোলাপের পাঁপড়ির ওপর ঝরে পড়া ভোরের শিশির।
১. নীরব দুঃখ
তোমরা, আমার প্রতিবেশীরা আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করো যৌবনের ভোরবেলা এবং তা চলে যাবার জন্য আক্ষেপ করো, কিন্তু আমি স্মরণ করি তা একজন বন্দির মতো যে তার কারাগারের বেড়ি ও হাতকড়াকে আহ্বান জানায়। তোমরা শৈশব ও যৌবনের সেইসব বছরগুলি সম্পর্কে কথা বলো যা ছিল অবরুদ্ধতা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত এক সোনালি যুগ, কিন্তু আমি সেইসব বছরগুলিকে বলি নীরব দুঃখের যুগ, যা একটা বীজ হিসেবে পতিত হয়েছে আমার বক্ষে এবং বেড়ে উঠেছে দুঃখের সঙ্গে এবং জ্ঞান ও বিচক্ষণতার পৃথিবীতে তা বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ খুঁজে পায় না, যতক্ষণ ভালোবাসা না আসে এবং উন্মুক্ত করে হৃদয়ের দরজা এবং আলোকিত করে তার প্রতিটি বাঁক। ভালোবাসা আমাকে প্রস্তুত করেছিল একটা জিভ এবং অশ্রুজল দিয়ে। তোমরা স্মরণ করো সেই বাগান ও ঝোপঝাড়গুলি, সাক্ষাতের জায়গা ও রাস্তার বাঁকগুলি, যা তোমাদের ভালোবাসার সাক্ষী এবং তোমরা শোনো তোমাদের নিষ্পাপ ফিসফিসানি আর আমিও স্মরণ করি উত্তর লেবাননের সেই চমৎকার জায়গাগুলি। প্রতিবারই আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই সেইসব উপত্যকা যা মর্যাদা ও জাদুতে পরিপূর্ণ এবং সেই পাহাড়গুলি যার মহিমা ও বিশালত্ব চেষ্টা করছে আকাশে পৌঁছাতে। প্রতিবার আমি কান বন্ধ করলে শুনতে পাই নদীর কুলুকুলু এবং বৃক্ষশাখার খসখস আওয়াজ। যেসব সৌন্দর্য সম্পর্কে আমি কথা বলছি এখন এবং তা দেখার জন্য আমার আকাঙ্ক্ষা হল সেই শিশুর মতো যে তার মায়ের স্তনের আকঙ্ক্ষায় ব্যাকুল। আমার আত্মা আহত এবং যৌবনের অন্ধকারে তা অবরুদ্ধ, যেভাবে প্রশস্ত আকাশে স্বাধীনভাবে উড়তে থাকা পাখির ঝাঁকের দিকে তাকিয়ে একটা খাঁচাবন্দি বাজপাখি কষ্ট পায়। ঐসব পাহাড় ও উপত্যকাগুলি দগ্ধ করে আমার কল্পনাকে কিন্তু তিক্ত ভাবনাগুলি আমার হৃদয়ের চারপাশে বরণ করে হতাশার জ্বাল।
প্রতিবারই আমি শস্যক্ষেত থেকে ফিরে আসি হতাশা নিয়ে কোনো উপলব্ধি ছাড়াই যা আমার হতাশার কারণ। প্রতিবারই আমি ধূসর আকাশের দিকে তাকাই এবং অনুভব করি আমার হৃদয়ের যোগাযোগ। প্রতিবারই আমি পাখিদের গান এবং বসন্তের গুঞ্জন শুনি কোনো উপলব্ধি ছাড়াই এবং সেটাই আমার কষ্টের কারণ। বলা হয়ে থাকে যে সারল্য একজন মানুষকে শূন্য করে দেয় এবং এই শূন্যতা তাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করে। এটা সত্য হতে পারে সেইসব মানুষের ভেতরে যারা মৃত অবস্থায় জন্মেছিল এবং যারা হিমায়িত মৃতদেহের মতো প্রস্থান করেছে। কিন্তু সেই সংবেদনশীল বালক যে সবচেয়ে বেশি অনুভব করে এবং অল্পই জানে এবং সে-ই হল সবচেয়ে দুর্ভাগা প্রাণী এই সূর্যের নিচে কারণ দুটি শক্তির দ্বারা সে ছিন্নভিন্ন হয়। প্রথম শক্তি তাকে উত্তোলন করে এবং স্বপ্নের মেঘের ভেতর দিয়ে তাকে সৌন্দর্যের অস্তিত্ব দেখায়, আর দ্বিতীয় শক্তি তাকে মাটিতে শক্ত করে বেঁধে রাখে, ধুলোয় পূর্ণ করে দেয় তার চোখ এবং পরাভূত করে তাকে অন্ধকার ও ভীতির সাহায্যে।
নির্জনতার রয়েছে কোমল রেশমি হাত কিন্তু তার শক্তিশালী আঙুলগুলি আঁকড়ে ধরে তার হৃদয় এবং বেদনায় তাকে করে তোলে ব্যথাতুর। নির্জনতা হচ্ছে বেদনার মিত্র পাশাপাশি আধ্যাত্মিক পরামানন্দের সঙ্গী।
বালকের আত্মা দুঃখের বিড়ম্বনাকে অতিক্রম করে যায় ভাঁজখোলা সাদা পদ্মফুলের মতো। এটা মৃদুমন্দ বাতাসে শিহরিত হয় এবং হৃদয় উন্মুক্ত করে ভোরবেলা এবং পাঁপড়িগুলো মুড়ে নেয় রাত্রির ছায়ায়। যদি সেই বালক তার গতি পরিবর্তন না করে অথবা কোনো বন্ধু কিংবা সঙ্গী এই খেলায় যোগ না দেয় তাহলে তার জীবন হবে সংকীর্ণ কারাগারের মতো যার ভেতর সে কিছুই দেখতে পারে না মাকড়সার জাল ছাড়া এবং কিছুই শুনতে পারে না হামাগুড়ি দেওয়া কীটপতঙ্গের শব্দ ছাড়া।
সেই দুঃখ যা আমার যৌবনের দিনগুলোকে পীড়িত করেছিল কিন্তু তা হাস্যকৌতুকের অভাবের জন্য নয়, কারণ আমার বন্ধুর অভাব ছিল না। আমি ইচ্ছে করলেই তাদেরকে খুঁজে নিতে পারতাম। সেই দুঃখ ছিল অন্তরাত্মার অসুস্থতার কারণে যা আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিল নির্জনতা। এটা মারা গিয়েছিল আমার ভেতরে খেলাধুলা ও বিনোদনের আকাঙ্ক্ষার কারণে। এটা অপসারণ করেছিল আমার যৌবনের পাখাগুলি আমার কাঁধ থেকে এবং আমাকে তৈরি করেছিল পাহাড়ের ভেতরে অবস্থিত একটা পুকুরের জলের মতো, যা এর শান্ত উপরিভাগে প্রতিফলিত করে ভূতের ছায়া এবং মেঘ ও গাছের রঙ, কিন্তু খুঁজে পায় না বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ, যার ভেতর দিয়ে গান গাইতে গাইতে সে সমুদ্রের দিকে যাবে।
আঠারো বছর বয়স হওয়ার আগে এটাই ছিল আমার জীবন। আমার জীবনে ঐ বছরটি ছিল পাহাড়ের চূড়ার মতো, কারণ তা আমার ভেতরে জাগিয়ে তুলেছিল জ্ঞানের আলো এবং উপলব্ধি করিয়েছিল মানবজাতির উত্থান-পতন। সেই বছরই আমার পুনর্জন্ম হল এবং যতক্ষণ একজন মানুষের জীবনে তার আবার জন্ম না হয় ততক্ষণ তা রয়ে যাবে অস্তিত্বের গ্রন্থের একটা শূন্যপাতার মতো। সেই বছর থেকে আমি দেখতে পেলাম স্বর্গের দেবদূতেরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে সুন্দরী নারীদের চোখের ভেতর দিয়ে। আরও দেখতে পেলাম নরকের দানবেরা খারাপ মানুষের ভেতরে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে আছে। যে জীবনের সৌন্দর্য ও অশুভ কামনার ভেতরে দেবদূত ও দানবদেরকে দেখতে পায় না সে জ্ঞান থেকে বহুদূরে অপসারিত হবে এবং তার আত্মা হবে ভালোবাসাশূন্য।
২. নিয়তির হাত
সেই বছরের চমৎকার বসন্তে আমি ছিলাম বৈরুতে। বাগানগুলি ভরে ছিল নিশান ফুলে, মাটি ঢেকে গিয়েছিল সবুজ ঘাসের গালিচায় এবং এই সবকিছুই মাটির গোপনীয়তার মতো প্রকাশিত হল স্বর্গের সম্মুখে। কমলা ও পাইন গাছগুলোকে দেখাচ্ছিল পরীর মতো অথবা পাখির মতো এবং তাদেরকে পাঠিয়েছে প্রকৃতি কবিদেরকে অনুপ্রাণিত করতে এবং উত্তেজিত করতে কল্পনাকে এবং তারা পরিধান করেছিল ফুটে থাকা সুগন্ধি ফুলের পোশাক।
বসন্ত সর্বত্রই সুন্দর, কিন্তু তা সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে লেবাননে। বসন্ত হচ্ছে একটা আত্মা যা পৃথিবীর যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়, কিন্তু তা স্থির হয়ে ভেসে আছে লেবাননের ওপরে। কথা বলছে রাজা ও নবীদের সঙ্গে। নদীগুলোর সঙ্গে গাইছে সোলেমানের গান এবং পুনরাবৃত্তি করছে লেবাননের পবিত্র সিডার বনের প্রাচীন মহিমার স্মৃতি। বৈরুত হচ্ছে শীতের কাদা ও গ্রীষ্মের ধুলো থেকে মুক্ত। বৈরুত হচ্ছে বসন্তের পাখির মতো অথবা মৎস্যনারীর মতো, ছোট্ট নদীর ধারে বসে আছে এবং সূর্যালোকে শুকিয়ে নিচ্ছে তার মসৃণ ত্বক।
একদিন আমি একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম যার বাড়ি শহর থেকে কিছু দূরে। আমরা যখন কথা বলছিলাম, তখন এক সম্মানিত লোক ঘরে ঢুকল। তার বয়স প্রায় পঁয়ষট্টি বছর। তাকে অভিবাদন জানাতে আমি হাত তুললাম এবং তখনই আমার বন্ধু তাকে পরিচয় করিয়ে দিল। তার নাম ফারিস ইফান্দি কারামি। বৃদ্ধ লোকটি আমার দিকে এক মূহূর্তের জন্য তাকাল। তারপর নিজের হাতের আঙুল দিয়ে নিজের কপাল স্পর্শ করল যেন সে স্মৃতিতে কিছু ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করছিল। তবে সে হাসতে হাসতে আমার কাছাকাছি এল এবং বলল, ‘তুমি আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধুর পুত্র। তোমাকে দেখে খুবই খুশি হলাম।’
তার কথা শুনে আমিও তার প্রতি আকর্ষিত হলাম একটা পাখির মতো, যার জন্মগত প্রবৃত্তি তাকে নেতৃত্ব দেয় ঝড়ের আগেই বাসায় ফিরে যেতে। আমরা বসলাম এবং সে তার বন্ধু অর্থাৎ আমার পিতা সম্পর্কে বলতে শুরু করল। ফিরিয়ে আনল স্মৃতিতে তাদের একসঙ্গে কাটানোর দিনগুলি। একটা বৃদ্ধ মানুষ তার যৌবনের স্মৃতির ভেতরে প্রত্যাবর্তন করতে চায় আগন্তুকের মতো, যে দীর্ঘকাল ধরে প্রতীক্ষা করছে তার অতীতের গল্প বলতে একজন কবির মতো যে আনন্দ পায় তার শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আবৃত্তি করতে। সে আধ্যাত্মিকভাবে বেঁচে থাকে অতীতের ভেতরে কারণ বর্তমান দ্রুত চলে যায় এবং ভবিষৎকে তার কাছে মনে হয় কবরের বিস্মৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। পুরোনো স্মৃতিতে পরিপূর্ণ একটি ঘণ্টা কেটে গেল ঘাসের ওপর গাছের ছায়ার মতো। ফারিস ইফান্দি চলে যাবার সময় তার বাম হাত আমার কাঁধে রাখল এবং আমার ডান হাত ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘বিশ বছর হয়ে গেছে আমি তোমার পিতাকে দেখি না। আমি চাই তুমি ঘন ঘন আমার বাড়িতে আসবে এবং তার জায়গাটা তুমি দখল করবে।’ আমি পিতার একজন বন্ধুর প্রতি দায়িত্ব পালন করার প্রতিজ্ঞা করলাম।
বৃদ্ধ লোকটি চলে যাওয়ার পর আমি আমার বন্ধুকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল, ‘আমি তাকে ছাড়া বৈরুতে আর কোনো লোককে চিনি না যার সম্পদ তাকে দয়ালু করেছে এবং তার দয়া তাকে সম্পদশালী করছে। সে হল সামান্য কয়েকজনের ভেতরে একজন যে পৃথিবীতে এসেছে এবং এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে কারও কোনো ক্ষতি করা ছাড়া, কিন্তু এ-ধরনের মানুষেরা সাধারণত দুঃস্থ ও নিপীড়িত হয়ে থাকে, কারণ অন্যের কূটকৌশল থেকে নিজেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট চতুর নয়। ফারিস ইফান্দির এক কন্যা। তার চরিত্রও তার মতো। তার সৌন্দর্য ও শোভনতা বর্ণনার চেয়েও বেশিকিছু এবং সে দুর্গত হবে কারণ তার পিতার সম্পদ ইতিমধ্যেই তাকে দুর্গতির প্রান্তে পৌছে দিয়েছে।’
একথা বলতে বলতে তার মুখে মেঘ জমে উঠল। তারপর সে আরও বলল, ‘ফারিস ইফান্দি একজন চমৎকার বৃদ্ধ মানুষ যে হৃদয়ের দিক থেকে সৎ, কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তির অভাব রয়েছে। মানুষ তাকে পরিচালনা করে অন্ধের মতো। তার কন্যা তাকে মান্য করে তার অহঙ্কার ও মেধা থাকা সত্ত্বেও এবং এটাই ছিল সেই গোপনীয়তা যা পিতা ও কন্যার জীবনের মাঝখানে ওৎ পেতে থাকত। এই গোপনীয়তা আবিষ্কার করেছিল একজন খারাপ মানুষ, যে একজন বিশপ এবং যার অন্যায়গুলি লুকানো থাকত বাইবেলের ছায়ার ভেতরে। সে মানুষকে বিশ্বাস করাত যে সে একজন দয়ালু ও সৎ মানুষ। ধার্মিকদের ভূমিতে সে হচ্ছে প্রধান ধার্মিক। মানুষ তাকে মান্য করত। সে মানুষকে পরিচালনা করত কসাইখানার পশুর পালের মতো। বিশপের একজন ভ্রাতুষ্পুত্র ছিল যে পুরোপুরি একজন ঘৃণ্য ও দুর্নীতিবাজ মানুষ। দেরিতে হোক যা তাড়াতাড়িই হোক সেইদিন আসবেই যেদিন সে তার ভ্রাতুষ্পুত্রকে বসাবে তার ডানপাশে এবং ফারিস ইফান্দির কন্যাকে বসাবে বামদিকে এবং তার অশুভ হাত তুলে সে আশীর্বাদ করবে তাদের বিয়েতে। একজন শুদ্ধ কুমারীকে বেঁধে ফেলবে নোংরামি ও অধঃপতনের সঙ্গে। দিনের হৃদয়কে স্থাপন করবে রাত্রির বুকের ভেতর।
‘ফারিস ইফান্দি ও তার কন্যা সম্পর্কে আমি যা জানি তার সবই তোমাকে বললাম। সুতরাং আমাকে আর কোনো প্রশ্ন কোরো না।’
একথা বলে সে তার মাথা দরজার দিকে ঘোরাল যেন সে পৃথিবীর সৌন্দর্যের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার মাধ্যমে মনুষ্য অস্তিত্বের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছিল। বন্ধুর বাড়ি থেকে চলে আসার সময় আমি তাকে বললাম যে, কয়েক দিনের ভেতরেই আমি ফারিস ইফান্দির বাড়িতে যাচ্ছি আমার কথা রাখতে এবং আমার পিতার সঙ্গে তার বন্ধুত্বের খাতিরে। সে কয়েক মূহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি তার প্রতিক্রিয়া পরিবর্তিত হতে দেখলাম। মনে হল আমার কিছু শব্দাবলি তার কাছে কোনো নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছিল। তারপর সে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকাল—ভালোবাসা, ক্ষমা ও আতঙ্কের দৃষ্টি— একজন নবীর দৃষ্টি যিনি অনেক কিছু আগাম জানতে পারেন যা অন্য কেউ পারে না। তারপর তার ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপতে লাগল কিন্তু সে কিছুই বলল না। তার বিষ্ময়কর দৃষ্টি, যার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না, যতক্ষণ আমি অভিজ্ঞতার জগতে প্রবেশ না করলাম, যেখানে হৃদয় পরস্পরকে সহজজ্ঞানে উপলব্ধি করে এবং যেখানে আত্মা জ্ঞানের দ্বারা পরিপক্ক
৩. তীর্থস্থানে প্রবেশ
কয়েকদিনের ভেতরে একাকিত্ব আমাকে অতিক্রম করে গেল। আমি একটা গাড়ি ভাড়া করে ফারিস ইফান্দির বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। পাইন বনের কাছে পৌঁছানোর পর ড্রাইভার একটা ব্যক্তিগত পথ ধরল। এই পথের দুপাশে উইলো গাছ এবং পথটা প্রায় অন্ধকার। লোকজন এখানে পিকনিক করতে আসে। এই জায়গা পেরিয়ে যাওয়ার পর দেখা গেল সবুজ ঘাস, আঙুর বাগান এবং বহু ধরনের রঙিন ফুল।
কয়েক মিনিটের ভেতরে গাড়িটা একটা নির্জন বাড়ির সামনে থামল। বাড়িটা একটা চমৎকার বাগানের মাঝখানে। জুঁই এবং গোলাপের গন্ধে বাতাস পরিপূর্ণ হয়ে ছিল। আমি গাড়ি থেকে নেমে বাগানের ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম ফারিস ইফান্দি এগিয়ে আসছে। সে আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল এবং আমার পাশে বসল। সুখী মানুষের মতো যেন তার নিজের ছেলের সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। সে হেসে হেসে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে লাগল জীবন, ভবিষ্যৎ এবং শিক্ষা সম্পর্কে। আমি তার কথার জবাব দিলাম, আমার কণ্ঠস্বর ছিল উদ্দীপনায় পরিপূর্ণ, কারণ আমি শুনতে পাচ্ছিলাম আমার কানে বেজে যাচ্ছে গৌরবের স্তোত্রগীতি এবং আমি আকাঙ্ক্ষার স্বপ্নের শান্ত সমুদ্রে পাল তুলেছিলাম। এমন সময় মখমলের পর্দার পেছন থেকে জাঁকজমকপূর্ণ সাদা গাউন পরা এক সুন্দরী যুবতী এগিয়ে এল আমাদের দিকে। আমরা দুজনেই উঠে দাঁড়ালাম।
বৃদ্ধলোকটি বলল, ‘এই হল আমার কন্যা সেলমা।’ তারপর তার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল এবং বলতে লাগল, ‘ভাগ্য আমাকে তার ছেলের মাধ্যমেই আমার পুরোনো ও প্রিয় বন্ধুকে আমার কাছে বহন করে এনেছে।’ সেলমা আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল যেন সন্দেহ হচ্ছে তাদের বাড়িতে আসলেই কোনো অতিথি এসেছে না চেনা কেউ। সেলমার হাত ছিল সাদা পদ্মফুলের মতো।
আমরা বসেছিলাম এবং নীরবতা চলাচল করছিল আমাদের আত্মার ভেতরে। কিছুক্ষণ পর সেলমা আমার দিকে তাকিয়ে হাসল এবং বলল, ‘বহু সময় আমার পিতা আমার কাছে তার যৌবন ও পুরোনো দিনের কাহিনী পুনরাবৃত্তি করেছে যার ভেতরে বার বার ফিরে এসেছে তোমার পিতার কথা। একইভাবে তোমার পিতা যদি তোমার কাছে তা বলে থাকে তাহলে এটা আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ নয়।’
বৃদ্ধলোকটি তার কন্যার কথা বলার ধরনে উৎফুল্ল হয় এবং বলে, ‘সেলমা খুবই আবেগপ্রবণ। সে আত্মার চোখ দিয়ে সবকিছুই দেখতে পায়।’ তারপর সে সতর্কতার সঙ্গে এবং অত্যন্ত কৌশলে আমার সঙ্গে আবার কথা বলতে শুরু করে, যেন সে আমার মধ্যে কোনো মোহনীয় আকর্ষণ খুঁজে পেয়েছে যা তাকে স্মৃতির পাখায় করে বার বার নিয়ে যায় অতীতের দিনগুলিতে।
আমি যখন আমার পুরোনো দিনগুলির স্বপ্ন দেখছিলাম, তখন সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে উঁচু গাছের মতো এবং সূর্যালোক ছায়া নিক্ষেপ করছে একটা ছোট্ট চারাগাছের ওপর যা ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে দুলছে।
সেলমা নীরব ছিল। মাঝে মাঝে সে প্রথমে আমার দিকে তারপর তার পিতার দিকে তাকাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে জীবনের নাটকের প্রথম এবং শেষ অধ্যায় পাঠ করছে। দিনের আলো মিলিয়ে গেল বাগান থেকে এবং আমি জানালা দিয়ে দেখলাম সূর্যাস্তের ভৌতিক হলুদ চুম্বন লেবাননের পাহাড়গুলির ওপর। ফারিস ইফান্দি তার অভিজ্ঞতা হাতড়াতে লাগলেন এবং আমি শুনতে পেলাম প্রবল উৎসাহের প্রবেশ ও কথোপকথন যা তার বেদনাকে পরিবর্তন করল সুখে।
জানালার পাশে বসে ছিল সেলমা। কোনো কথা বলছিল না, যদিও সৌন্দর্যের রয়েছে নিজস্ব স্বর্গীয় ভাষা, ওষ্ঠ ও জিভ, কথার চেয়েও যা উচ্চতর। এটা হচ্ছে সময়হীনতার ভাষা, সমস্ত মানবজাতির জন্য সাধারণ, যেন একটা শান্ত লেক যা গান গাইতে থাকা ছোট্ট নদীকে আকর্ষণ করে এর গভীরতার দিকে এবং তাকে নীরব করে তোলে।
শুধুমাত্র আমাদের আত্মা উপলব্ধি করতে পারে সৌন্দর্য অথবা বেঁচে থাকা এবং এর সঙ্গে বেড়ে ওঠা। এটা আমাদের মনকে হতবুদ্ধি করে দেয়। আমরা এটা কথায় বর্ণনা করতে অক্ষম। এটা একটা সংবেদনশীলতা যা আমাদের চোখ দেখতে পায় না, কিন্তু তা আহরণ করে দুজনের কাছ থেকে- একজন, যে পর্যবেক্ষণ করে এবং অন্যজন যে কেবলই তাকিয়ে দেখে। প্রকৃত সৌন্দর্য হল একটি রশ্মি, যা প্রবাহিত হয়ে আসে আত্মার পবিত্রতম প্রকোষ্ঠ থেকে এবং তা আলোকিত করে তোলে শরীর, যেভাবে মাটির গভীরতা থেকে উঠে আসে জীবন এবং ফুলকে দেয় রং এবং সুগন্ধ। প্রকৃত সৌন্দর্য থাকে আধ্যাত্মিক মতৈক্যের ভেতরে, যাকে ভালোবাসা বলা হয় এবং যা একজন নারী ও পুরুষের মাঝখানে অবস্থান করে।
আমার ও সেলমার আত্মা কি পরস্পরের কাছে পৌঁছেছিল যখন আমরা সাক্ষাৎ করেছিলাম এবং আমার আকুল আকাঙ্ক্ষা কি সূর্যের নিচে তাকেই সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে গ্রহণ করেছিল? অথবা আমি কি আচ্ছন্ন ছিলাম যৌবনের মদে, যা আমাকে কল্পনাপ্রবণ করে তুলেছিল যা কখনই আকার নেয় না
আমার যৌবন কি আমার স্বাভাবিক দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিয়েছিল এবং শিখিয়েছিল কল্পনা করতে তার চোখের উজ্জ্বলতা, মুখের মধুরতা এবং দেহ সৌষ্ঠবের সাবলীলতা? অথবা এটা কি ছিল তার উজ্জ্বলতা ও মধুরতা এবং মর্যাদা, যা আমার চোখ খুলে দিয়েছিল এবং দেখিয়েছিল ভালোবাসার সুখ ও দুঃখ?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন, কিন্তু আমি সত্যি সত্যিই বলি যে, সেই মূহূর্তে আমি একটা আবেগ অনুভব করেছিলাম যা আমি আগে কখনও অনুভব করিনি। নতুন একধরনের ভালোবাসা শান্তভাবে বিশ্রাম নিচ্ছিল আমার হৃদয়ে, পৃথিবীর সৃষ্টিকালে জলধারার ওপরে স্থির হয়ে ভেসে থাকা আত্মার মতো এবং সেই ভালোবাসা থেকে জন্মেছিল আমার সুখ এবং দুঃখ। এভাবেই শেষ হয়ে যায় সেলমার সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ এবং এভাবেই স্বর্গ আমাকে মুক্ত করে যৌবন ও নির্জনতার বন্ধন থেকে এবং আমাকে ভালোবাসার মিছিলে হাঁটতে দেয়।
পৃথিবীতে ভালোবাসা হচ্ছে একমাত্র স্বাধীনতা কারণ এটা আত্মাকে উত্তোলন করে যা হচ্ছে মানবতার আইন এবং প্রকৃতির ঘটনা এর গতিকে পরিবর্তন করে না।
আমি চলে আসার জন্য যখন উঠে দাঁড়ালাম, ফারিস ইফান্দি আমার কাছে এল এবং শান্ত সুরে বলল, ‘হে আমার পুত্র, এখন এই বাড়ির পথ তোমার চেনা। তুমি এ বাড়িতে প্রায়ই আসবে এবং মনে করবে যে তুমি তোমার পিতার বাড়িতে আসছ। আমাকে বিবেচনা করবে তোমার পিতা হিসেবে এবং সেলমাকে বোন হিসেবে।’ একথা বলে সে সেলমার দিকে তাকাল যেন সে তার বক্তব্যের সমর্থন চায়। সে মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে। তারপর আমার দিকে তাকাল এবং হাসল।
ফারিস ইফান্দি কারামির উচ্চারিত এই শব্দাবলি আমাকে ভালোবাসার বেদির মুখোমুখি তার কন্যার পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। ঐ শব্দগুলি ছিল স্বর্গীয় সংগীত যা শুরু হয়েছিল পরমানন্দের সঙ্গে এবং যা শেষ হয়েছে দুঃখের সঙ্গে। এই সংগীত আমাদের আত্মাকে উত্তোলন করেছিল আলোকিত এলাকায় জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ভেতরে। এই সংগীতগুলি ছিল সেই পাত্র যা থেকে আমরা পান করেছি সুখ ও তিক্ততা।
আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। বাগানের সীমানা পর্যন্ত বৃদ্ধলোকটি আমাকে এগিয়ে দিল এবং আমার হৃদয় তখন ঢিপঢিপ করছিল তৃষ্ণার্ত মানুষের শিহরিত ওষ্ঠের মতো।
৪. শ্বেতশুভ্র মশাল
আমি নিয়মিত ফারিস ইফান্দির বাড়িতে যাতায়াত করতে লাগলাম এবং নিয়মিত দেখা হতে থাকল সেলমার সঙ্গে সেই চমৎকার বাগানে। আমি স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, বিস্মিত হতাম তার বুদ্ধিমত্তায় এবং নীরবতার ভেতরে শুনতাম তার বেদনার গুঞ্জন। আমি অনুভব করতাম একটা অদৃশ্য হাত আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে তার কাছে।
প্রতিবার পরিদর্শনে আমি তার সৌন্দর্যের নতুন অর্থ জানতে পারতাম এবং নতুন অন্তর্দৃষ্টি উপলব্ধি করতাম এবং আত্মার মধুরতার ভেতরে যতক্ষণ পর্যন্ত সে একটা গ্রন্থে পরিণত না হয়, যার পৃষ্ঠাগুলি পড়ে আমি কিছু বুঝতে পারতাম এবং গাইতে পারতাম প্রশংসা-সংগীত, কিন্তু যা আমি পড়ে কোনোদিনই শেষ করতে পারব না। একজন নারী যার দূরদর্শিতা লালিত পালিত হত আত্মার সৌন্দর্য ও সত্যের শরীরের সঙ্গে, একই সঙ্গে উভয়ই উন্মুক্ত এবং গোপন, যা আমরা শুধুমাত্র ভালোবাসার মাধ্যমেই উপলব্ধি করতে পারি এবং স্পর্শ করতে পারি সদ্গুণের মাধ্যমে এবং যখন আমরা এরকম নারী সম্পর্কে বর্ণনা করার উদ্যোগ নিই, তখন সে অদৃশ্য হয়ে যায় বাষ্পের মতো।
সেলমা কারামির শারীরিক ও আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য ছিল, কিন্তু কীভাবে আমি তা অন্যের কাছে বর্ণনা করি যে তাকে চেনে না। একজন মৃত মানুষ কি স্মরণ করতে পারে নাইটিংগিলের গান, গোলাপের সুগন্ধ এবং ছোট ছোট নদীদের দীর্ঘশ্বাস? হাতকড়া ও বেড়ির ভারে ভারাক্রান্ত কোনো বন্দি কি অনুসরণ করতে পারে ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস? নীরবতা কি মৃত্যুর চেয়ে অধিক বেদনাদায়ক নয়? অহঙ্কার কি আমাকে প্রতিরোধ করে সাধারণ শব্দাবলিতে সেলমা সম্পর্কে বর্ণনা করতে, যতক্ষণ আমি তাকে উজ্জ্বল রঙে চিত্রায়িত করতে না পারি? মরুভূমিতে একজন ক্ষুধার্ত মানুষ শুকনো ফল খেতে অস্বীকার করবে না যদি স্বর্গ তাকে ঈশ্বরপ্রদত্ত খাদ্যে পরিপূর্ণ করে দেয়।
সাদা রেশমি পোশাকে সেলমা ছিল জানালা দিয়ে আসা জোছনালোকের মতো হালকা-পাতলা। সে চলাফেরা করত মার্জিতভাবে এবং তার মধ্যে একটা ছন্দ ছিল। তার কণ্ঠস্বর ছিল মৃদু এবং মধুর। তার ঠোঁট থেকে শব্দ ঝরে পড়ত ফুলের পাঁপড়ি থেকে ঝরে পড়া শিশিরের মতো, বিশেষ করে যখন তা বাতাসে বাধাপ্রাপ্ত হত।
কিন্তু সেলমার মুখমণ্ডল! কোনো শব্দই এর প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে না, প্রথম তাতে প্রতিফলিত হচ্ছে বিশাল অন্তর্গত দুর্ভোগ, তারপর স্বর্গীয় পরমানন্দ।
সেলমার মুখের সৌন্দর্য ঐতিহ্যের অনুসারী ছিল না। এটা ছিল গুপ্ত তথ্য প্রকাশের মতো একটি স্বপ্ন যা পরিমাপ করা যেত না অথবা বেঁধে ফেলা যেত না কোনো বন্ধনে অথবা তৈরি হত না কোনো প্রতিলিপি কোনো চিত্রকরের তুলির সাহায্যে অথবা তা খোঁদাই করতে পারত না কোনো ভাস্কর। সেলমার সৌন্দর্য ছিল না তার সোনালি চুলে, কিন্তু সদ্গুণ ও শুদ্ধতা তাকে ঘিরে রাখত, সৌন্দর্য ছিল না তার বড় বড় চোখে কিন্তু তা সেই আলোর ভিতরে ছিল যা সেই চোখ থেকে প্রবাহিত হয়ে আসে; সৌন্দর্য ছিল না তার লাল ঠোঁটে কিন্তু তার কথার মধুরতার ভেতরে ছিল; সৌন্দর্য ছিল না তার জলন্ত গ্রীবায় কিন্তু যখন মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাত তখন সৌন্দর্য প্রকাশিত হত। সৌন্দর্য ছিল না তার নিখুঁত শরীরে কিন্তু তা ছিল তার আত্মার সততায় যা আকাশ ও মাটির মাঝখানে পুড়ে যাচ্ছে শ্বেতশুভ্র মশালের মতো। তার সৌন্দর্য ছিল কবিতা উপহার দেওয়ার মতো, কিন্তু কবিরা হচ্ছে অসুখী মানুষ, কারণ তাদের আত্মা যতই উঁচুতে উঠুক না কেন, তারা অশ্রুজলের খামের ভেতরে রুদ্ধ হয়ে থাকে।
সেলমা বাচাল ছিল না, সে সবকিছু গভীরভাবে চিন্তা করত এবং তার নীরবতা ছিল একধরনের সংগীত যা একজনকে নিয়ে যেত স্বপ্নের পৃথিবীতে এবং তাকে মনোযোগ দিয়ে শোনাত হৃদয়ের ঢিপঢিপ শব্দ, দেখাত তার চিন্তার ভূত এবং তাকে সামনে দাঁড় করিয়ে তাকিয়ে থাকত তার চোখের দিকে।
সে পরিধান করত তার জীবনের ভেতর দিকে বয়ে যাওয়া গভীর দুঃখের ছদ্মবেশ, যা তার বিস্ময়কর সৌন্দর্য ও মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, যেমন একটি বিকাশিত গাছ অধিক সুন্দর যখন ভোরের ধোঁয়াশার ভেতের দিয়ে তা ধরা পড়ে আমাদের চোখে।
বেদনা তার হৃদয় ও মনের ভেতরে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল, যেন একজন অন্যজনের মুখ দেখতে পেত যা অনুভব করত হৃদয় এবং শুনত লুকিয়ে রাখা একটি কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি। ঈশ্বর একজনের ভেতর তৈরি করেছিলেন দুটো শরীর এবং পৃথকীকরণ মর্মবেদনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।
বেদনার্ত আত্মা বিশ্রাম খোঁজে যখন একই ধরনের অন্য আত্মার সঙ্গে মিলিত হয়। তারা মিলিত হয় প্রেমের ভেতরে যেভাবে একজন আগন্তুক উদ্দীপিত হয় যখন সে অন্য একজন আগন্তুককে দেখে কোনো এক অচেনা ভূমিতে। দুঃখের ভেতর দিয়ে যে হৃদয় ঐক্যবদ্ধ হয়, সুখের গৌরবের দ্বারা তা পৃথক হবে না। যে ভালোবাসা চোখের জলে পরিচ্ছন্ন হয় তা চিরদিন সুন্দর ও শুদ্ধ থাকবে।
৫. প্রচণ্ড ঝড়
একদিন ফারিস ইফান্দি তার বাড়িতে নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানাল। আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম, কারণ আমার আত্মা ঐশ্বরিক রুটির জন্য ক্ষুধার্ত ছিল স্বর্গ যা স্থাপন করেছিল সেলমার হাতে—আধ্যাত্মিক রুটি যা খাবার জন্য আমাদের হৃদয় অধিকতর ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। এটা হল সেই রুটি, কবি কায়েস, দান্তে এবং সাফো যার স্বাদ নিয়েছিল, এই রুটি প্রস্তুত করে ঈশ্বরের ঈশ্বরীরা চুম্বনের মধুরতা ও অশ্রুজলের তিক্ততা দিয়ে।
ফারিস ইফান্দি’র বাড়ি পৌঁছে দেখি সেলমা বাগানে একটা বেঞ্চিতে বসে আছে এবং একটা গাছের সঙ্গে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। রেশমি পোশাকে তাকে একটা পাখির মতো মনে হচ্ছিল।
নীরবে এবং শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি তার কাছে গেলাম এবং তার পাশে বসলাম। আমি কথা বলতে পারছিলাম না, সুতরাং আমি নীরবতাকেই ফিরিয়ে আনলাম, যা কেবলই হৃদয়ের ভাষা, কিন্তু আমি অনুভব করলাম সেলমা আমার শব্দহীন আহ্বান শুনছে এবং আমার চোখের ভেতর দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে আমার আত্মার প্রেতাত্মাকে।
কয়েক মিনিটের ভেতরে বৃদ্ধলোকটি বাইরে এল এবং আমাকে যথারীতি অভিবাদন জানাল। যখন সে আমার দিকে হাত বাড়াল তখন আমার মনে হল সে সেই গোপনীয়তাকে আশীর্বাদ করছে যা আমার ও তার কন্যার হৃদয়কে একত্রিত করেছে। তারপর সে বলল, ‘হে আমার সন্তানেরা, খাবার প্রস্তুত, চলো খেতে যাই।’ আমরা তাকে অনুসরণ করলাম। সেলমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কারণ তার পিতা ‘আমার সন্তানেরা’ বলে আহ্বান জানানোর বিষয়টি তার ভালোবাসায় নতুন হৃদয়ানুভূতি যোগ করল।
আমরা টেবিলে বসে খাবার উপভোগ করতে লাগলাম এবং চুমুক দিতে লাগলাম পুরোনো মদে, কিন্তু আমাদের আত্মা বসবাস করছিল দূরবর্তী এক পৃথিবীতে। আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম ভবিষ্যৎ এবং এর দুর্ভোগ সম্পর্কে
চিন্তায় তিন ব্যক্তি আলাদা কিন্তু ভালোবাসার ভেতরে তারা একত্রিত হয়েছে। প্রচুর উপলব্ধিসহ তিনজন নিষ্পাপ মানুষ কিন্তু জ্ঞান খুবই সামান্য; একটা নাটক অভিনীত হচ্ছিল একজন বৃদ্ধের দ্বারা, যে তার কন্যাকে ভালোবাসে এবং তার সুখের প্রতি সে যত্নশীল। বিশ বছরের এক যুবতী দুশ্চিন্তা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং একজন যুবক স্বপ্ন দেখছে এবং দুশ্চিন্তায় ভুগছে, যে জীবনে মদ অথবা সিরকা কোনোটারই স্বাদ গ্রহণ করে নাই এবং চেষ্টা করছে জ্ঞান ও ভালোবাসার শিখরে পৌঁছাতে কিন্তু নিজেকে উত্তোলন করতে সে সক্ষম নয়। আমরা তিনজন গোধূলিবেলায় ঐ নির্জন বাড়িতে বসে পানাহার করছিলাম। আমাদেরকে পাহারা দিচ্ছে স্বর্গের চোখ, কিন্তু আমাদের গ্লাসের তলায় লুকিয়ে ছিল তিক্ত এবং নিদারুণ যন্ত্রণা।
আমরা খাওয়া যখন প্রায় শেষ করে এনেছি এমন সময় একজন চাকরানি এসে জানাল, একজন লোক ফারিস ইফান্দির সঙ্গে দেখা করতে চায়। বৃদ্ধলোকটি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে সে?’ চাকরানি বলল, ‘বিশপের দূত।’ ফারিস ইফান্দি এক মুহূর্তের জন্য কন্যার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল একজন নবীর মতো যে স্বর্গের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে এর গোপনীয়তা সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করতে। তারপর সে চাকরানিকে বলল, ‘তাকে ভেতরে নিয়ে এসো।’
চাকরানি চলে যাবার পর প্রাচ্য দেশীয় পোশাক পরা এক লোক এসে উপস্থিত হল, যার বিশাল গোঁফের প্রান্তগুলি কোঁকড়ানো। সে বৃদ্ধলোকটিকে অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘মহামান্য বিশপ তার ব্যক্তিগত বাহন পাঠিয়েছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য। তিনি কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে চান আপনার সঙ্গে।’ বৃদ্ধলোকটির মুখমণ্ডল মেঘচ্ছন্ন হয়ে উঠল এবং তার হাসি মিলিয়ে গেল। এক মুহূর্ত গভীর চিন্তার পর সে আমার কাছে এল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘আশা করছি আমি ফিরে আসা পর্যন্ত তুমি থাকবে। কারণ এরকম নির্জন জায়গায় সেলমা তোমার সঙ্গ উপভোগ করবে।’
একথা বলে সে সেলমার কাছে এগিয়ে গেল এবং তার দিকে তাকিয়ে হাসল। সেলমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, কিন্তু তার চিবুক লাল হয়ে উঠল এবং বীণার তারের চেয়ে অধিকতর মধুর কণ্ঠে সে বলল, ‘আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্ট করব আমাদের অতিথির যত্ন করতে।’
সেলমা গাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল বিশপের দূত তার পিতাকে নিয়ে চলে না যাওয়া পর্যন্ত। তারপর সে ফিরে এসে সবুজ রেশমি কাপড়ে ঢাকা ডিভানে বসল আমার মুখোমুখি। তাকে দেখাচ্ছিল ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে সবুজ ঘাসের গালিচার ওপর বাঁকা হয়ে পড়ে থাকা পদ্মফুলের মতো। এটা ছিল স্বর্গের ইচ্ছা যে, আমি সেলমার সঙ্গে তার চমৎকার বাড়ির ভেতরে রাত্রিবেলায় একা হব, যেখানে নীরবতা, প্রেম, সৌন্দর্য এবং সদ্গুণ একত্রে বসবাস করে।
আমরা দুজনেই নীরব ছিলাম এবং প্রত্যেকেই আশা করছিলাম অন্যজন কথা বলবে, কিন্তু দুটি আত্মার ভেতরে বক্তব্যই উপলব্ধির একমাত্র মাধ্যম নয়। এটা কোন বর্ণ নয় যা ওষ্ঠ থেকে আসে এবং জিভ তা একত্রে বহন করে নিয়ে যায় হৃদয়ের কাছে।
মুখ যা উচ্চারণ করে তার চেয়েও বৃহত্তর এবং শুদ্ধতর কিছু একটা আছে। নীরবতা আমাদের আত্মাকে উদ্ভাসিত করে, ফিসফিস করে হৃদয়ের সঙ্গে এবং তাদেরকে একত্রে বহন করে আনে। নীরবতা আমাদেরকে পৃথক করে আমাদের কাছ থেকে, আমাদেরকে দিয়ে আত্মার শূন্যতার ভেতরে নৌকা ভাসায় এবং আমরা পাল তুলে দিই। আমাদেরকে নিয়ে যায় স্বর্গের কাছাকাছি অনুভব করতে যে, শরীর বন্দিত্বের চেয়ে অধিক কিছু নয় এবং এই পৃথিবী নয় শুধুমাত্র নির্বাসনের স্থান।
সেলমা আমার দিকে তাকাল এবং প্রকাশ করল তার হৃদয়ের গোপনীয়তা, তারপর শান্ত স্বরে বলল, ‘চলো আমরা বাগানে যাই এবং গাছের নিচে বসি। পাহাড়ের পেছনে এখন চাঁদ উঠবে।’ আমি আমার আসন ছেড়ে উঠলাম, কিন্তু নিজেকে দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল। আমি বললাম, ‘চাঁদ ওঠা ও বাগানে আলো ছড়িয়ে না পড়া পর্যন্ত এখানে বরং বসে থাকা যাক। গাছ এবং ফুল দুটোই অন্ধকারে লুকিয়ে আছে। আমরা কিছুই দেখতে পাব না।’
সেলমা বলল, ‘অন্ধকার গাছ ও ফুলকে আমাদের চোখ থেকে লুকিয়ে রাখে, কিন্তু তা ভালোবাসাকে গোপন করতে পারবে না আমাদের হৃদয় থেকে।’
অদ্ভুত কণ্ঠে এসব কথা উচ্চারণ করে সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। আমি নীরবে তার কথাগুলি ভাবছিলাম এবং প্রতিটি অক্ষরের প্রকৃত অর্থ পরিমাপ করছিলাম। তারপর সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন সে যা বলেছে তার জন্য সে অনুতপ্ত এবং এখন চেষ্টা করছে তার জাদুকরি চোখ দিয়ে তার কান থেকে তা বের করে নিতে। কিন্তু তার সেই দৃষ্টি ভুলে যাওয়ার পরিবর্তে আমার হৃদয়ের গভীরে তা পুনরাবৃত্তি করল অধিক স্পষ্ট ও কার্যকরভাবে যা ইতিমধ্যে অনন্তকালের জন্য আমার স্মৃতির ভেতরে সমাহিত হয়েছে।
এই পৃথিবীর প্রতিটি সৌন্দর্য এবং গুণসম্পন্নতা সৃষ্টি হয়েছে মানুষের ভেতরের একটি আবেগ যা চিন্তার দ্বারা। আজ যা আমরা দেখি তা তৈরি করেছিল আগামী প্রজন্ম এটা আবির্ভূত হওয়ার আগেই পুরুষের একটি চিন্তা অথবা নারীর হৃদয়ের একটি তাড়না। যে বিপ্লব প্রচুর রক্ত ঝরিয়েছে এবং মানুষের মনকে ঘুরিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার দিকে, তা ছিল একটি মানুষের ধারণা যে হাজার মানুষের ভেতরে বেঁচে ছিল। যে ভয়ানক যুদ্ধ সাম্রাজ্য ধ্বংস করেছে তা ছিল একটা চিন্তা যা রয়ে গেছে একটা নির্দিষ্ট ব্যক্তির মনে। যে সর্বময় শিক্ষা মানবতার গতি পরিবর্তন করেছিল তা ছিল একজন মানুষের ধারণা, যার সৃজনীক্ষমতা তাকে আলাদা করেছিল পরিবেশ থেকে। একটা নির্দিষ্ট চিন্তা পিরামিড নির্মাণ করেছিল, প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসলামের গৌরব এবং পুড়িয়েছিল আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার।
একটা চিন্তা তোমার কাছে আসবে রাত্রির অন্ধকারে যা তোমাকে উত্তোলন করবে মর্যাদা পর্যন্ত অথবা তোমাকে নিয়ে যাবে নিরাপত্তার ভেতরে। নারীর চোখ থেকে নিক্ষেপ করা একটি দৃষ্টি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষে পরিণত করবে। পুরুষের মুখের একটি কথা তোমাকে পরিণত করবে ধনী অথবা দরিদ্র্যে।
সেই রাতে সেলমা যে-কথা উচ্চারণ করেছিল তা আমার অতীত ও ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাকে গ্রেফতার করে রেখেছিল যেন মধ্যসমুদ্রে নোঙর করা একটা নৌকা। সেইসব কথা আমাকে জাগিয়ে রেখেছিল যৌবনের সুখনিদ্রা ও নির্জনতা থেকে এবং আমাকে স্থাপন করেছিল সেই মঞ্চের ওপর যেখানে জীবন এবং মৃত্যু তাদের নিজস্ব ভূমিকায় অভিনয় করে।
.
ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসে মিশে ছিল ফুলের সুগন্ধ, যখন আমরা বাগানে এলাম এবং একটা জুঁইফুলের গাছের কাছে চুপচাপ বসলাম। একটা বেঞ্চির ওপর শুনছিলাম ঘুমন্ত প্রকৃতির শ্বাসপ্রশ্বাস এবং তখন নীল আকাশে স্বর্গের চোখ ছিল আমাদের নাটকের প্রত্যক্ষদর্শী।
মাউন্ট সেন্নাই-এর পেছন থেকে চাঁদ উঠে এল এবং উজ্জ্বল করে তুলল তীরভূমি। ছোট ছোট ঢিবি ও পাহাড়গুলো এবং আমাদের চোখে ভেসে উঠল উপত্যকার সীমান্তের গ্রামগুলি, ভূতের মতো। আমরা দেখতে পেলাম লেবাননের সমস্ত সৌন্দর্য চাঁদের রুপালি আলোর নিচে শুয়ে আছে।
পশ্চিমের কবিরা ভাবে লেবানন হচ্ছে লৌকিক উপাখ্যানসমৃদ্ধ একটি ভূমি এবং তারা ভুলে যায় দাউদ, সোলেমান ও অন্যান্য নবীরা এই ভূমি অতিক্রম করে গেছে, যেমন স্বর্গের উদ্যান হারিয়ে গিয়েছিল আদম ও ঈভ পতিত হওয়ার পর। পাশ্চাত্যের সেইসব কবিদের কাছে ‘লেবানন’ শব্দটি হল পাহাড়ের সাথে সম্পর্কিত একটি কাব্যিক ব্যাখ্যা, যে পাহাড়ের খাঁজগুলি পবিত্র সিডার গাছের গন্ধে ডুবে আছে। লেবানন তাদেরকে মনে করিয়ে দেয় তামা ও মর্মর পাথরের মন্দিরগুলি অনমনীয়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে এবং হরিণের পাল চরে বেড়াচ্ছে উপত্যকা জুড়ে। সেই রাতে আমি একজন কবির চোখে স্বপ্নের মতো লেবাননকে দেখেছিলাম। বিভিন্ন জিনিস আবির্ভূত হয়ে আবেগ অনুযায়ী পরিবর্তিত হচ্ছিল এবং আমরা দেখছিলাম তার ভেতরে জাদু এবং সৌন্দর্য, যা প্রকৃতঅর্থেই আমাদের ভেতরে ছিল।
চাঁদের আলো উজ্জ্বল করে তুলেছিল সেলমার মুখ, গ্রীবা ও বাহু। হাতির দাঁতের ভাস্কর্যের মতো দেখাচ্ছিল তাকে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চুপ করে আছ কেন? কেন তোমার অতীত সম্পর্কে আমাকে কিছুই বলছ ন।’ আমি তার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকালাম। আমার নীরবতা অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি আমার ঠোঁট খুললাম এবং বললাম, ‘তুমি কি শোনো নাই এই কুঞ্জবনে এসে আমি কী কী বলেছি? সেই আত্মা যা ফুলের ফিসফিসানি ও নৈঃশব্দের গান শোনে, সে আরও শুনতে পারে আমার আত্মার আর্তনাদ ও হৃদয়ের উচ্চ কলরব।’
সে হাত দিয়ে মুখ ঢাকল এবং শিহরিত কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি তোমার কথা শুনতে পেয়েছি—আমি শুনতে পেয়েছি একটা কণ্ঠস্বর রাত্রির বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এবং একটি উচ্চ কলরব উন্মত্ত হয়ে উঠছে দিনের হৃদয়ের ভেতরে।’
ভুলে যাচ্ছি আমি আমার অতীত, আমার অস্তিত্ব—সবকিছু, কিন্তু সেলমা—আমি তাকে বললাম, ‘আমিও তোমার কথা শুনেছি সেলমা। আমি শুনেছি উল্লসিত সংগীত বাতাসের ভেতরে প্রকম্পিত হচ্ছে এবং শিহরিত করে তুলছে পুরো পৃথিবীকে।
এসব কথা শুনে সে তার চোখ বন্ধ করল এবং আমি দেখতে পেলাম তার ঠোঁটের ওপর বেদনামিশ্রিত আনন্দের হাসি। সে কোমলস্বরে ফিসফিস করল, ‘এখন আমি জানি সেখানে কিছু একটা আছে যা স্বর্গের চেয়ে উচ্চতর, সমুদ্রের চেয়ে গভীরতর এবং জীবন, মৃত্যু ও সময়ের চেয়ে বিস্ময়কর। আমি এখন সেইসব জানি যা আগে জানতাম না।’
সেই মুহূর্তে সেলমা পরিণত হল বন্ধুর চেয়ে অধিকতর প্রিয়, বোনের চেয়ে অধিকতর অন্তরঙ্গ এবং প্রিয়তমার চেয়ে অধিকতর পছন্দের মানুষে। সে পরিণত হল একটা পরাক্রমশীল চিন্তায়, একটা চমৎকার স্বপ্নে যা একটা পরাভূত আবেগ আমার আত্মার ভেতরে জীবন্ত।
এটা চিন্তা করা ঠিক নয় যে ভালোবাসা তৈরি হয় দীর্ঘদিন মেলামেশার পর এবং সংরক্ষিত হয় বিয়েপূর্ব প্রেমে। ভালোবাসা হচ্ছে আধ্যাত্মিক ঐক্যের সন্তানসন্ততি এবং যদি সেই ঐক্য একমুহূর্তের ভেতরে তৈরি না হয় তাহলে তা সারাবছরেও তৈরি হবে না, এমনকি প্রজন্মের পর প্রজন্ম পেরিয়ে গেলেও নয়।
তারপর সেলমা মাথা তুলে দিগন্তের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল, যেখানে মাউন্ট সেন্নাই আকাশের সঙ্গে মিলিত হয়েছে এবং বলল, ‘গতকাল তুমি ছিলে আমার ভাইয়ের মতো, যার সঙ্গে আমি শান্তভাবে বসেছিলাম আমার পিতার পরিচর্যার ছায়ায়। কিন্তু এখন, আমি বিস্ময়কর কিছু একটার উপস্থিতি লক্ষ্য করছি যা ভাইয়ের ভালোবাসায় চেয়েও অধিকতর মধুর, একটা অনভ্যস্ত ভালোবাসা এবং ভয় যা আমার হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তুলছে আনন্দ ও বেদনায়।’
আমি জবাব দিলাম, ‘এই আবেগ যাকে আমরা ভয় পাই এবং যা আমাদেরকে নাড়া দেয় যখন তা আমাদের হৃদয়কে অতিক্রম করে যায় এবং এটা হচ্ছে প্রকৃতির আইন, যা চন্দ্রকে পরিচালনা করে পৃথিবীর চারপাশে এবং সূর্যকে ঈশ্বরের চারপাশে।’
সেলমা আমার মাথার ওপর হাত রাখল এবং আমার চুলের ভেতরে আঙুল চালাতে লাগল। তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবং তা থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রু পদ্মফুলের পাতার ওপর শিশিরের মতো এবং সে বলল, ‘কে আমাদের কাহিনী বিশ্বাস করবে? কে বিশ্বাস করবে এখন আমরা অতিক্রম করছি সন্দেহের বাধাগুলি? কে বিশ্বাস করবে যে নিশান মাস আমাদেরকে প্রথমবারের মতো একত্রে বহন করে এনেছে এবং এই কি সেই মাস যা আমাদেরকে থামিয়েছে জীবনের পুণ্যস্থানে?’
তখনও সেলমার হাত আমার মাথার ওপর। সে কথা বলে যেতে থাকে, ‘আমি রাজকীয় মুকুট পছন্দ করি না অথবা গৌরবের কোনো আচ্ছাদান সেই কোমল হাতের কাছে যা আমার চুলকে বয়ন করছিল।’ তারপর আমি বললাম, ‘মানুষ আমাদের কথা বিশ্বাস করবে না, কারণ তারা সেই ভালোবাসা সম্পর্কে জানে না যা শুধুই একটা ফুল এবং যা বেড়ে ওঠে এবং প্রস্ফুটিত হয় ঋতুর সাহায্য ছাড়াই। কিন্তু এটা ছিল নিশান মাস যা আমাদেরকে প্রথম বারের মতো একত্রে বহন করে এনেছিল এবং এটা কী সেই সময় যা আমাদেরকে গ্রেফতার করেছিল জীবনের পুণ্যস্থানে? এটা ঈশ্বরের হাত নয়, যা জন্মের আগে আমাদের আত্মাকে একত্রে কাছাকাছি এনেছিল এবং আমাদেরকে পরস্পরের বন্দিতে পরিণত করেছিল সমস্ত দিন এবং সমস্ত রাত্রির জন্য? মানুষের জীবন আরম্ভ হয় না গর্ভে এবং কবরেও এর সমাপ্তিও ঘটে না কখনও। এই মহাশূন্য চন্দ্রালোক ও নক্ষত্রে পরিপূর্ণ এবং এটা পরিত্যক্ত হয় না প্রেমময় আত্মার দ্বারা যা সহজজ্ঞানে সবকিছু উপলব্ধি করে।’
সেলমা আমার মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিল। আমি আমার চুলের শিকড়ে ভোরের মৃদুমন্দ বাতাসমিশ্রিত একটা বৈদ্যুতিক কম্পন অনুভব করলাম। একটা অনুরক্ত প্রার্থনার মতো, তীর্থস্থানের বেদি চুম্বন করে যে আশীর্বাদ গ্রহণ করে। আমি সেলমার হাত আমার হাতে তুলে নিলাম। তার ওপর নামিয়ে আনলাম আমার উত্তপ্ত ঠোঁট এবং একটা দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন দান করলাম। সেই স্মৃতি আমার মনকে দয়ার্দ্র করে তুলল এবং জাগিয়ে তুলল আমার আত্মাকে যাবতীয় সদ্গুণের মধুরতায়
এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, যার প্রতিটি মিনিটকে মনে হচ্ছিল ভালোবাসার এক একটি বছর। রাত্রির নীরবতা, চন্দ্রালোক, পুষ্পগুচ্ছ এবং গাছপালা আমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিল সমস্ত বাস্তবতা একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া এবং তখন হঠাৎ করেই আমরা দ্রুতগামী ঘোড়ার খুর ও গাড়ির চাকার খসখস আওয়াজ শুনতে পেলাম। চমৎকার মূর্ছা থেকে আমরা জেগে উঠলাম এবং স্বপ্নের পৃথিবী থেকে ঝাঁপ দিলাম দ্বিধা ও দুর্গতির পৃথিবীতে। আমরা দেখলাম বৃদ্ধলোকটি ফিরে এসেছে। আমরা কুঞ্জবনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম।
গাড়িটা বাগানের প্রবেশপথে পৌঁছানোর পর ফারিজ ইফান্দি গাড়ি থেকে নামল। ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল আমাদের দিকে। তার শরীরটা সামনের দিকে সামান্য বাঁকানো, দেখে মনে হয় সে কোনো ভারী বোঝা বহন করছে। সে সেলমার কাছে এসে তার কাঁধে হাত রাখল এবং তার চোখের দিকে তাকাল। তার ভাঁজ পড়া কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল এবং বেদনার্ত হাসিতে শিহরিত হচ্ছিল তার ঠোঁট। শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলল, ‘হে আমার প্রিয় কন্যা সেলমা, খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে তোমার পিতার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হবে অন্য লোকের বাহুর ভেতরে। খুব তাড়াতাড়ি ভাগ্য তোমাকে পিতার এই নির্জন বাড়ি থেকে পৃথিবীর প্রশস্ত ভূমিতে নিয়ে যাবে এবং এই বাগান তোমার পদক্ষেপ অনুভব করতে পারবে না এবং তোমার পিতা তোমার কাছে একজন আগন্তুকে পরিণত হবে। সবকিছুই ঠিক হয়ে গেছে। ঈশ্বর তোমাকে আশীর্বাদ করুন।
এসব কথা শুনে সেলমার মুখে মেঘ জমল, চোখ স্থির হয়ে গেল যেন সে মৃত্যুর পূর্বাবস্থাকে অনুভব করছিল। সে চিৎকার করে উঠল সেই পাখির মতো যাকে গুলি করা হয়েছে। সে যন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘কী বলছ তুমি পিতা? একথা বলে তুমি কী বোঝাতে চাও? কোথায় তুমি আমাকে পাঠাচ্ছ পিতা?’
তারপর সে তার পিতার দিকে তাকিয়ে তন্ন তন্ন করে তার গোপনীয়তা আবিষ্কারের চেষ্টা করল। সেই মুহূর্তে সে বলল, ‘হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি। সবকিছু বুঝতে পেরেছি। বিশপ তোমার কাছে আমাকে দাবি করেছে এবং একটা খাঁচা তৈরি করছে সেই পাখির জন্য যার ডানাগুলি ভাঙা। এটা কি তোমার ইচ্ছা পিতা?’
তার উত্তর ছিল একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস। শান্তভাবে সে সেলমাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম বাগানের ভেতরে। দ্বিধার ঢেউ শরতের পাতার ওপর প্রচণ্ড ঝড়ের মতো আঘাত করতে লাগল আমাকে। তারপর আমি তাদেরকে অনুসরণ করে বসার ঘরে এলাম এবং অস্বস্তি এড়াতে বৃদ্ধের হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে তাকালাম সেলমার দিকে—আমার উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং তারপর আমি বাড়ি পরিত্যাগ করলাম।
বাগানের প্রান্তে পৌঁছে শুনলাম বৃদ্ধ আমাকে ডাকছে এবং আমি ফিরলাম। সে আমার হাত ধরে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো পুত্র। চোখের জল ফেলে আমি তোমাদের সন্ধ্যাটাকে নষ্ট করে দিয়েছি। কিন্তু দয়া করে আমাকে দেখতে আসবে যখন আমার এই বাড়ি জনমানবশূন্য, আমি একাকী এবং বেপরোয়া। প্রিয় পুত্র, আমার যৌবন জরাগ্রস্ততার সঙ্গে মিলিত হতে পারে না, যেমন সকালের সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ হয় না সন্ধ্যার, কিন্তু তুমি আমার কাছে আসবে এবং আমার স্মৃতিতে জাগিয়ে তুলবে সেইসব দিনগুলি, যা আমি কাটিয়েছি তোমার পিতার সঙ্গে এবং তুমি আমাকে বলবে জীবনের সংবাদগুলি, যা তার পুত্রদের ভেতরে আমাকে কোনোভাবেই গণনা করে না। তুমি কি আমাকে দেখতে আসবে না যখন সেলমা চলে যাবে এবং আমি যখন খুব একা হয়ে যাব?’
যখন সে এইসব কষ্টের কথাগুলো বলছিল তখন আমি নীরবে তার হাত ধরেছিলাম। অনুভব করলাম তার চোখের জল ঝরে পড়ছে আমার হাতের ওপর। আরও অনুভব করলাম আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে। যখন আমি মাথা তুলে তাকালাম তখন সে আমার চোখে অশ্রু দেখতে পেল। সে আমার দিকে ঝুঁকল এবং আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল, এবং বলল, ‘বিদায় পুত্র, বিদায়।’
একজন বৃদ্ধ মানুষের অশ্রু একজন যুবকের চেয়ে অধিক জোরালো। একজন যুবকের অশ্রু হল গোলাপ পাঁপড়ির ওপর শিশিরবিন্দুর মতো, পাশাপাশি একজন বৃদ্ধের অশ্রু হল হলুদ পাতার মতো যা ঝরে পড়ে শীত শুরুর আগের বাতাসে।
ফারিস ইফান্দি কারামির বাড়ি ছেড়ে চলে এলাম। তখনও সেলমার কণ্ঠ আমার কানে বাজছিল। তার সৌন্দর্য মৃত মানুষের ছায়ামূর্তির মতো অনুসরণ করছিল আমাকে এবং তার পিতার চোখের জল ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাচ্ছিল আমার হাতের ওপর।
আমার প্রস্থান ছিল স্বর্গ থেকে আদমের পতনের মতোই, কিন্তু আমার হৃদয়ের ঈভ আমার সঙ্গে ছিল না পুরো পৃথিবীটাকে স্বর্গের উদ্যানে পরিণত করতে। সেই রাত্রে আমার আবার জন্ম হয়েছিল, আমি অনুভব করছিলাম যে প্রথমবারের মতো আমি মৃত্যুর মুখ দেখেছি।
এভাবে সূর্য তার উত্তাপ দিয়ে যেমন প্রানবন্ত করে তোলে তেমনি হত্যা করে শস্যক্ষেতগুলি।
৬. আগুনের জলাভূমি
একজন মানুষ রাত্রির অন্ধকারে যা কিছু করে তার সবই পুরোপুরি প্রকাশিত হয় দিনের আলোয়। গোপনে যে কথা উচ্চারিত হয় তা পরিণত হয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সাধারণ কথাবার্তায়। আমাদের বাসস্থানের বাঁকগুলিতে আমরা আজ যে কথা গোপন করছি, আগামীকাল তা চিৎকার করে বলা হবে প্রতিটি রাস্তায়।
অন্ধকারের প্রেতাত্মারা বিশপ বুলোজ গালিব-এর উদ্দেশ্য প্রকাশ করে দেয় ফারিস ইফান্দির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এবং তার কথাবার্তা পুনরাবৃত্তি হয়েছিল সমস্ত প্রতিবেশীর কাছে যতক্ষণ তা আমার কাছে না পৌঁছায়
বিশপ বুলোজ গালিব ও ফারিস ইফান্দির ভেতরে সে রাতে যে আলোচনা হয়েছিল তা গরিব, বিধবা কিংবা এতিমদের সমস্যা নিয়ে নয়। তাকে এখানে নিয়ে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেলমার সঙ্গে তার ভ্রাতুষ্পুত্র মনসুর বেই গালিব এর বিয়েপূর্ব বাগদান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সেলমা ছিল সম্পদশালী ফারিস ইফান্দির একমাত্র কন্যা এবং বিশপ তাকে পছন্দ করেছে তার সৌন্দর্য ও আত্মার সততার জন্য নয়, তার লক্ষ্য হল তার পিতার অর্থ যা মুনসুরের চমৎকার সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাকে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ মানুষে পরিণত করবে।
পূবের ধর্মীয় প্রধানেরা তাদের অপরিমিত মানসিকতার কারণে মোটেও তৃপ্ত ছিল না, কিন্তু তারা চাইত তাদের সংগ্রাম করা উচিত পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে দমনকারী ও উৎকৃষ্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। একজন রাজকুমারের গৌরব উত্তরাধিকারে সূত্রে পায় তার জ্যেষ্ঠপুত্র, কিন্তু ধর্মীয় প্রধানের পরমানন্দ ছিল তার ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রদের ভেতরে সংক্রামক রোগের মতো। একজন খ্রিস্টান বিশপ, একজন মুসলিম ইমাম ও একজন ব্রাহ্মাণ অথবা যাজক সামুদ্রিক সরীসৃপে পরিণত হয় যারা শিকারকে আঁকড়ে ধরে চার হাত-পা দিয়ে এবং তারপর যেভাবে সম্ভব তার রক্ত চুষে নেয়।
যখন বিশপ তার ভ্রাতুষ্পুত্রের জন্য সেলমাকে চাইল তখন সে ইফান্দির কাছ থেকে একটা উত্তরই পেয়েছিল, তা হল গভীর নীরবতা এবং অশ্রুপতন। কারণ সে তার একমাত্র সন্তানকে কোনভাবেই হারাতে চাইত না। যেকোনো মানুষের হৃদয়ই শিহরিত হয় যখন তার একমাত্র কন্যা তার থেকে আলাদা হয়ে যায় যাকে সে এত বছর লালন পালন করেছে। পিতামাতার কাছে কন্যাকে বিয়ে দেওয়ার বেদনা পুত্রকে বিয়ে দেওয়ার সুখের সমতুল্য, কারণ পুত্র পরিবারে একজন নতুন সদস্যকে নিয়ে আসে, পাশাপাশি কন্যা তার বিয়েতে তার পিতামাতাকে হারায়।
বিশপের অনুরোধ ইফান্দি মেনে নিলেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও, কারণ বিশপের ভ্রাতুষ্পুত্রকে তিনি ভালোভাবেই চিনতেন এবং জানতেন, যে খুবই ভয়ংকর, ঘৃণার যোগ্য, মন্দ লোক এবং দুর্নীতিপরায়ণ।
লেবাননে কোনো খ্রিস্টান কোনো বিশপকে অবহেলা করে ভালো অবস্থায় থাকতে পারত না। কেউই পারত না ধর্মীয় প্রধান হিসেবে তার খ্যাতিকে অমান্য করতে। চোখ একটা বর্শাকে কখনও প্রতিরোধ করতে পারে না নিজে বিদ্ধ হওয়া ছাড়া এবং একটা হাত কখনও আঁকড়ে ধরতে পারে না একটা তরবারি নিজে রক্তাক্ত না হয়ে।
ধরে নেওয়া যাক ফারিস ইফান্দি প্রতিরোধ করল বিশপকে এবং অস্বীকার করল তার ইচ্ছা, তারপর দেখা যাবে সেলমার মানসম্মান ধ্বংস করে সে তার নামে অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে। উঁচু গাছের যে আঙুরগুচ্ছের কাছে শেয়াল পৌঁছাতে পারেনা সে আঙুর সম্পর্কে তার মতামত হল, তা টক এবং এটা একটা নির্জলা মিথ্যা।
সুতরাং নিয়তি সেলমাকে নেতৃত্ব দিয়েছিল অপমানিত দাসের মতো প্রাচ্যদেশীয় দুর্গত নারীদের মিছিলের সঙ্গে হাঁটতে এবং এভাবেই তার সৎ আত্মা ফাঁদে আটকা পড়েছিল ফুলের সৌরভে সুরভিত জোছনালোকিত আকাশে ভালোবাসার সাদা পাখায় ভর করে মুক্তভাবে উড়ে বেড়ানোর পর।
কোনো কোনো দেশে পিতামাতার সম্পদকে সন্তানের দুর্গতির কারণ হতে দেখা যায়। প্রশান্ত শক্তিশালী একটি বাক্স, যা পিতামাতা সম্পদের নিরাপত্তা দিতে তাদের উত্তরাধিকারের আত্মার অন্ধকার ও সংকীর্ণ কারাগারে বন্দি করে রাখে। একটি পরাক্রমশীল দিনার মানুষ যার প্রার্থনা করে দানবে পরিণত হওয়ার জন্য যা আত্মাকে শাস্তি দেয় এবং নিস্প্রভ করে দেয় হৃদয়কে। সেলমা কারামি ছিল তাদের ভেতরে একজন, যে তার পিতার সম্পদ ও হবু স্বামীর ধন-সম্পত্তির লোভের শিকার।
এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। সেলমার ভালোবাসা ছিল আমার একমাত্র বিনোদন। এই ভালোবাসা আমার জন্য সুখের গান গাইছে রাতে এবং ভোরবেলায় জাগিয়ে দিচ্ছে জীবনের অর্থ ও প্রকৃতির গোপনীয়তা প্রকাশ করতে। এটা একটা স্বর্গীয় ভালোবাসা যার ভেতরে কোনো ঈর্ষা নেই, এটা সমৃদ্ধ এবং আত্মার জন্য কখনও ক্ষতিকর নয়। এটা একটা গভীর ঐক্য যা পরিতৃপ্তির ভেতরে আত্মাকে স্নান করায়। এটা একটা গভীর ক্ষুধা ভালোবাসার জন্য যখন তা পরিতৃপ্ত। এই ভালোবাসা আত্মাকে অকৃপণ দানে পূর্ণ করে দেয়। এই ভালোবাসা হচ্ছে একটা কোমলতা, যা আত্মাকে আলোড়িত করা ছাড়াই আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে। এই ভালোবাসা পৃথিবীকে পরিবর্তন করছে স্বর্গে এবং জীবনকে মধুর ও চমৎকার স্বপ্নে। ভোরবেলা যখন আমি শস্যক্ষেতে হেঁটে বেড়াই তখন প্রকৃতির জাগরণের ভেতরে দেখতে পাই অনন্তকালের চিহ্ন এবং যখন আমি সমুদ্রের তীরভূমিতে বসি আমি শুনতে পাই ঢেউগুলি গাইছে অনন্তকালের সংগীত এবং যখন আমি রাস্তায় হাঁটি তখন জীবনের সৌন্দর্য এবং মানবতার দীপ্তি দেখতে পাই পথিকদের চোখে মুখে এবং শ্রমিকদের গতিশীলতার ভেতরে।
সেইসব দিনগুলি চলে গেছে প্রেতাত্মার মতো এবং অদৃশ্য হয়ে গেছে মেঘের মতো এবং আমার জন্য কিছুই নেই বেদনার্ত স্মৃতিগুলি ছাড়া। যে চোখ দিয়ে আমি বসন্তের সৌন্দর্য ও প্রকৃতির জাগরণ দেখতে অভ্যস্ত সেই চোখে আমি আর কিছুই দেখি না ঝড়ের হিংস্রতা ও শীতের দুর্গতি ছাড়া। যে কান দিয়ে আমি আগে ঢেউয়ের উম্মত্ত সংগীত শুনতাম সেই কানে আমি শুধুই শুনতে পাই বাতাসের আর্তনাদ এবং সমুদ্রের তীব্র ক্রোধ। যে আত্মা সুখের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছিল মানবজাতির ক্লান্তিহীন বলিষ্ঠতা ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গৌরব, সে-ই হতাশা ও ব্যর্থতার জ্ঞানের মাধ্যমে নির্যাতিত হয়েছিল। ভালোবাসার সেইসব দিনগুলির চেয়ে অধিক সুন্দর কিছুই ছিল না এবং কিছুই অধিক তিক্ত নয় দুঃখের সেই সব কুৎসিত রাত্রির চেয়ে।
নিজের তাড়নাকে প্রতিরোধ করতে না পেরে সপ্তাহ শেষে আমি আবার সেলমার বাড়িতে গেলাম— সেই তীর্থস্থান, যেখানে সৌন্দর্য সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং যাকে আশীর্বাদ করেছিল ভালোবাসা, যার ভেতরে আত্মা প্রার্থনা করতে এবং হৃদয় নতজানু হতে পারে। যখন আমি বাগানে প্রবেশ করলাম মনে হল একটা ক্ষমতা পৃথিবী থেকে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং স্থাপন করছে একটা গোলকের ভেতরে অলৌকিকভাবে যা সংগ্রাম ও কঠোরতা থেকে মুক্ত। একজন মরমি সাধকের মতো যে স্বর্গের গুপ্ত তথ্য জানতে পারে, আমি নিজেকে দেখলাম গাছ ও ফুলের মাঝখানে এবং আমি যখন বাড়ির প্রবেশ পথের কাছাকাছি গেলাম, লক্ষ্য করলাম সেলমা একটা বেঞ্চির ওপর বসে আছে জুঁইফুল গাছের ছায়ায়, যেখানে আমরা এক সপ্তাহ আগে বসেছিলাম, সেই রাতে কোনো দূরদর্শিতা নির্দেশ করেছিল আমার সুখ ও দুঃখের প্রারম্ভকে।
আমি কাছে যাওয়ার পরও সে নড়ল না কিংবা কোনো কথা বলল না। আমি তার পাশে বসলে সে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে আকাশ দেখতে লাগল এবং একমুহূর্ত মন্ত্রমুগ্ধ নীরবতার পর সে আমার দিকে ফিরল। তার শিহরিত হাতের ভেতরে আমার হাত এবং সে মূর্ছিতস্বরে বলল, ‘হে আমার বন্ধু আমার দিকে তাকাও। ভালো করে পর্যবেক্ষণ কর আমার মুখমণ্ডল এবং সেখানে পাঠ করো যা তুমি জানতে চাও এবং যা আমি বলতে পারি না। আমার দিকে তাকাও, হে আমার প্রিয় মানুষ… আমার ভাই, আমার দিকে তাকাও।’
আমি একাগ্রচিত্তে তার দিকে তাকালাম এবং দেখতে পেলাম সেই চোখদুটি যা কয়েকদিন আগে ঠোঁটের মতোই হাসত এবং গতিশীল ছিল। নাইটিংগেলের পাখার মতো তা এখন দুঃখ ও বেদনার সমুদ্রে ডুবে আছে। তার মুখের সঙ্গে সাদৃশ্য ছিল সেই পদ্মফুলের যার ভাঁজ এখনও খোলেনি এবং সূর্য যাকে চুম্বন করেছে। এখন তা বিবর্ণ হয়ে আছে। তার ঠোঁটগুলি দেখাচ্ছিল শুকিয়ে যাওয়া দুটি গোলাপফুলের মতো, শরৎ যাকে বোঁটার সঙ্গে ফেলে রেখে গেছে। তার গ্রীবা ছিল হাতির দাঁতের তৈরি স্তম্ভের মতো এবং তা সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল যেন তার মর্মবেদনার বোঝা তার মস্তিষ্ক তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।
সেলমার চোখে মুখে আমি এসব দেখতে পেলাম কিন্তু আমার কাছে তারা ছিল চলমান মেঘের মতো যারা ঢেকে ফেলেছে চাঁদের মুখ এবং তাকে করে তুলেছে অধিক সুন্দর। একটি দৃষ্টি যা অন্তরাত্মাকে প্রকাশ করে এবং মুখমণ্ডলে যোগ করে অধিক সৌন্দর্য, কতটুকু করুণা ও বেদনা আছে তাতে কিছু যায় বা আসে না কিন্তু যে মুখ নীরবতার ভেতরে আছে, যে লুকিয়ে থাকা রহস্য ঘোষণা করে না সে সুন্দর নয়। স্বচ্ছ কাঁচের পাত্রের ভেতর দিয়ে মদের রঙ না-দেখা পর্যন্ত আমাদের ওষ্ঠ তা পান করার জন্য প্ররোচিত হয় না।
সেই সন্ধ্যায় সেলমা ছিল স্বর্গীয় মদে পরিপূর্ণ একটা কাপের মতো, যা তৈরি হয়েছে জীবনের তিক্ততা ও মধুরতা থেকে। অসচেতনভাবে সে প্রতিকায়িত করে তুলছিল সেই প্রাচ্যদেশীয় নারীকে, যে কখনও তার পিতামাতার গৃহ পরিত্যাগ করেনি যতক্ষণ তার স্বামীর ভারী জোয়াল তার কাঁধের ওপর স্থাপন করা না হয়, সে কখনও পরিত্যাগ করেনি তার স্নেহময়ী মায়ের বাহু যতক্ষণ সে তার স্বামীর দাসীতে পরিণত না হয় এবং স্থায়ী না হয় তার শ্বাশুড়ির নিষ্ঠুরতা।
আমি সেলমার দিকে তাকিয়ে থাকলাম এবং শুনতে লাগলাম তার সঙ্গে তার অত্যাচারিত আত্মার কান্না এবং দুর্ভোগ যতক্ষণ আমি অনুভব না করলাম এখন তার থামা উচিত এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বিবর্ণ হয়ে পড়ছিল। আমি শুধুমাত্র তার বড়বড় চোখদুটো দেখতে পাচ্ছিলাম যা আমার ওপর স্থির হয়ে ছিল এবং অনুভব করতে পারছিলাম তার শিহরিত হাত আমাকে আঁকড়ে ধরছে।
সেলমার কণ্ঠস্বর শুনে আমি মূর্ছা থেকে জেগে উঠলাম, ‘এসো আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। চলো আমরা আলোচনা করি বীভৎস ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তা আসার আগেই। আমার পিতা এইমাত্র বাইরে গিয়েছে সেই লোকটির সঙ্গে দেখা করতে যে মৃত্যু পর্যন্ত আমার সঙ্গী হবে। আমার পিতা, যাকে আমার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ঈশ্বর পছন্দ করেছিলেন, সে এখন সেই লোকটির সঙ্গে দেখা করবে পৃথিবী যাকে আমার বাকি জীবনের জন্য প্রভু হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এই শহরে আমার পিতা আমাকে আমার যৌবন পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দিয়েছে, সে এখন সেই লোকটির সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে যে আগামী বছরগুলিতে আমার সঙ্গী হবে। আজ রাতে দুই পরিবার বিয়ের তারিখ ঠিক করবে। কী বিস্ময়কর ও চিত্তাকর্ষক এই মুহূর্ত। গত সপ্তাহে এ সময় জুঁইফুল গাছের নিচে ভালোবাসা প্রথমবার আমাদের আত্মাকে আলিঙ্গন করেছিল, যখন নিয়তি আমার জীবনকাহিনীর প্রথম শব্দ লিখছিল বিশপের অট্টালিকায়। এখন আমার পিতা ও আমার বিবাহপ্রার্থী যখন বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করছে তখন আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার শিহরিত আত্মা আমার চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে তৃষ্ণার্ত পাখির মতো সেই জলপ্রবাহের ওপরে যা পাহারা দিয়ে রেখেছে একটা ক্ষুধার্ত সাপ। আহ্, কী মহৎ এই রাত এবং কী গভীর এর রহস্য।’
এসব কথা শুনে আমার মনে হল যে সম্পূর্ণ হতাশার অন্ধকার ভূতগুলি আমাদের ভালোবাসাকে দখল করে নিয়েছিল এর শুরুতেই একে গলা টিপে হত্যা করতে। আমি বললাম, ‘ঐ পাখিটা সেই জলপ্রবাহের ওপর উড়তেই থাকবে যতক্ষণ তার তৃষ্ণা না মেটে অথবা পতিত হবে সেই সাপের আয়ত্তের মধ্যে এবং পরিণত হবে তার শিকারে।’
সেলমা উত্তরে বলল, ‘না প্রিয়তম, এই নাইটিংগেল-এর উচিত বেঁচে থাকা এবং গান গাওয়া যতক্ষণ অন্ধকার না হয়, বসন্ত তাকে অতিক্রম করে না যায়, পৃথিবীর সমাপ্তি না ঘটে এবং চিরকাল গান গাওয়া অব্যাহত রাখে। তার কণ্ঠ নীরব হওয়া উচিত নয়, কারণ সে আমার আত্মায় জীবন বহন করে আনে, তার ডানাগুলি ভেঙে যাওয়া উচিত নয়, কারণ তার গতিশীলতা আমার হৃদয় থেকে মেঘগুলি সরিয়ে দেয়।’
তারপর আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘আমার অত্যন্ত প্রিয় সেলমা, তৃষ্ণা আমাকে নিঃশেষ করে ফেলবে এবং আত্মা আমাকে হত্যা করবে।’ কাঁপতে থাকা ঠোঁটে সে দ্রুত উত্তর দিল, ‘আত্মার তৃষ্ণা বিয়ের মদের চেয়ে অধিক মধুর এবং আত্মার ভীতি শরীরের নিরাপত্তার চেয়ে অধিক সাহসী। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শোনো আমার অত্যন্ত পছন্দের মানুষ, আমি আজ একটা নতুন জীবনের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, যা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। আমি একজন অন্ধ মানুষের মতো যে শুধুই তার পথ অনুভব করতে পারে। সুতরাং সে পতিত হবে না। আমার পিতার সম্পদ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল দাসের বাজারে এবং এই লোক আমাকে কিনেছে। আমি তাকে চিনি না এবং ভালোওবাসি না, কিন্তু আমি তাকে ভালোবাসতে শিখব এবং তাকে মান্য করব, সেবা করব এবং সুখী করে তুলব তাকে। আমি তাকে সেইসব দেব যা একজন দুর্বল নারী একজন শক্তিশালী পুরুষকে দিয়ে থাকে।’
কিন্তু তুমি আমার প্রিয়তম, তুমি এখনও জীবনের উৎকৃষ্টতার অংশ। তুমি স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারো ফুলের গালিচা পাতা জীবনের প্রশস্ত পথে। পৃথিবী অতিক্রম করে যাওয়ার ক্ষেত্রে তুমি স্বাধীন, তোমার পথ আলোকিত করতে তুমি হৃদয়কে পরিণত করেছ মশালে। তুমি স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে, কথা বলতে এবং যে-কোনো কাজ করতে পারো। তুমি তোমার নাম লিখতে পার জীবনের মুখের ওপর, কারণ তুমি একজন মানুষ তুমি বাঁচতে পার প্রভুর মতো, কারণ তোমার পিতা তোমাকে দাসের বাজারে নিয়ে যাবেনা বিক্রি করতে, তুমি তোমার পছন্দমতো নারীকে বিয়ে করতে পারো এবং সে তোমার গৃহে বসবাস করার আগেই তুমি তাকে তোমার হৃদয়ে বসবাস করতে দিতে পারো এবং বিনিময় করতে পারো কোনো বাধা ছাড়াই গোপন কথা একটি মুহূর্ত নীরবে কেটে গেল। সেলমা আবার বলতে থাকল, ‘কিন্তু জীবন, যা আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করবে, সুতরাং তুমি অর্জন করতে পারো একজন পুরুষের গৌরব এবং আমি একজন নারীর দায়িত্ব? এটা কি সেই উপত্যকা যার গভীরতা গিলে ফেলবে নাইটিংগিলের গান এবং বাতাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবে গোলাপের পাপড়িগুলো? সেই সব রাত্রিগুলো কোথায় যা আমরা জুঁইগাছের তলায় কাটিয়েছিলাম চন্দ্রালোক? কোথায় আমাদের আত্মা মিলিত হয়েছিল, ব্যর্থতার ভেতরে? আমরা কি দ্রুতবেগে নক্ষত্রের দিকে উড়েছিলাম আমাদের পাখা ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত এবং এখন কি আমরা নরকের ওপর অবতরণ করছি? অথবা ভালোবাসা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল যখন সে আমাদের কাছে আসে এবং যখন সে জেগে ওঠে তখন কি ক্রুদ্ধ হয়েছিল এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমাদেরকে শাস্তি দেবার অথবা আমাদের আত্মা রাত্রের মৃদুমন্দ হাওয়াকে প্রবল বাতাসে পরিণত করেছিল যা আমাদেরকে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে এবং উড়িয়ে নিয়েছে আমাদেরকে ধুলোর মতো উপত্যকার গভীরে? আমরা অমান্য করিনি কোনো আদেশ, স্বাদ গ্রহণ করিনি কোনো নিষিদ্ধ ফলের, তাহলে আমাদেরকে কি স্বর্গ ত্যাগ করতে প্ররোচিত করেছিল? আমরা কোনো বিদ্রোহ কিংবা ষড়যন্ত্রের অনুশীলন করিনি কখনও, তাহলে কেন আমরা নরকে অবতরণ করছি? না, না, যে মুহূর্ত আমাদেরকে একত্রিত করেছিল তা শতাব্দীর বৃহত্তর এবং যে আলো আমাদের আত্মাকে আলোকিত করেছিল তা অন্ধকারের চেয়েও অধিকতর শক্তিশালী এবং যদি প্রচণ্ড ঝড় আমাদেরকে আলাদা করে উন্মত্ত সমুদ্রের ভেতরে তাহলে ঢেউগুলি আমাদেরকে একত্রিত করবে শান্ত তীরভূমিতে এবং এই জীবন যদি আমাদেরকে হত্যা করে তাহলে মৃত্যু আমাদেরকে আবার একত্রিত করবে। একজন নারীর হৃদয় সময় ও ঋতুর সঙ্গে পরিবর্তিত হবে না, এমনকি যদি তা চিরদিনের জন্য মরে যায় তাহলেও তা কখনও লোপ পাবে না। নারীর হৃদয় হচ্ছে শস্যক্ষেতের মতো যা যুদ্ধক্ষেত্রে রূপান্তরিত হয় গাছগুলি উপড়ে নেয়ার, ঘাসগুলি পুড়ে যাবার, পাথরগুলি রক্তে রঞ্জিত হওয়ার এবং মাটিতে হাড় ও খুলি রোপণ করার পর। এটা শান্ত ও নীরব থাকে যেন কোথাও কিছু ঘটেনি, কারণ শরৎ ও বসন্ত তাদের বিরতির পরই আসে এবং পুনরায় শুরু করে তাদের কাজ।
‘এবং এখন আমরা কী করব? কীভাবে আমরা আলাদা হব এবং কখন মিলিত হব আমরা? ভালোবাসাকে কি আমরা বিস্ময়কর পরিদর্শক হিসেবে বিবেচনা করব, যে সন্ধ্যায় আসে এবং সকালে আমাদেরকে ফেলে চলে যায়? অথবা এই ভালোবাসা একটি স্বপ্ন যা আমাদের স্বপ্নে এসেছিল এবং তা বিচ্ছিন্ন হয়েছে যখন আমরা জেগে উঠেছিলাম?
‘এই সপ্তাহকে কি আমরা আচ্ছন্নতার সময় হিসেবে বিবেচনা করব নম্রতার মাধ্যমে তাকে পুনঃস্থাপন করতে? তোমার মাথা তোলো এবং তোমার দিকে তাকাতে দাও। উন্মুক্ত করো তোমার ঠোঁট এবং শুনতে দাও তোমার কণ্ঠস্বর। কথা বলো আমার সঙ্গে। প্রচণ্ড ঝড় আমাদের ভালোবাসার জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার পরও কি তুমি আমাকে স্মরণ করবে? তুমি কি শুনতে পাবে আমার পাখার ফিসফিসানি রাত্রির নীরবতার ভেতরে? তুমি কি শুনতে পাবে তোমার ওপর আমার আত্মার পাথা ঝাপটানো? আমার দীর্ঘশ্বাস কি তুমি শুনতে পাবে? তুমি অন্ধকারের ছায়ার পাশাপাশি আমার ছায়াকে দেখতে পাবে এবং তা অদৃশ্য হয়ে যাবে ভোরের আলোর প্রস্রবণে? আমাকে বলো হে আমার প্রিয়তম, আমার চোখে যখন প্রবেশ করবে জাদুকরি রশ্মি, কানে প্রবেশ করবে মধুর সংগীত এবং আমার আত্মায় যুক্ত হবে দুটি পাখা, তখন তুমি কিসে পরিণত হবে?’
এসব কথা শুনে আমার হৃদয় গলে যেতে লাগল এবং আমি উত্তরে তাকে বললাম, ‘তুমি যা চাও আমি তাতেই পরিণত হব।’
তারপর সে বলল, ‘আমি চাই তুমি ভালোবাসবে আমাকে কবির মতো, যেভাবে একজন কবি তার বেদনার্ত চিন্তাকে ভালোবাসে। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসবে একজন পর্যটকের মতো যেভাবে সে স্মরণ করে একটি শান্ত জলাধারকে যার ভেতরে তার প্রতিকৃতি প্রতিফলিত হয় যখন সে তার পানি পান করে। আমি চাই তুমি আমাকে ভালোবাসবে সেই মায়ের মতো যে তার সেই শিশুকে স্মরণ করে যে আলো দেখার আগেই মারা গেছে এবং আমি চাই তুমি আমাকে স্মরণ করবে সেই দয়ার্দ্র রাজার মতো যে তার সেই বন্দিকে স্মরণ করে, বিচার পাওয়ার আগেই যে মারা গেছে। আমি চাই তুমি আমার সঙ্গী হবে এবং আমি চাই তুমি প্রায়ই আমার পিতাকে দেখতে আসবে, তাকে সান্ত্বনা দেবে তার একাকিত্বে, কারণ খুব তাড়াতাড়িই আমি তাকে পরিত্যাগ করব এবং তার কাছে পরিণত হবে একজন আগন্তুকে।’
আমি তাকে বললাম, ‘তুমি যা বললে তার সবকিছুই আমি করব এবং আমার আত্মাকে তৈরি করব একটা এনভেলপে তোমার আত্মার জন্য এবং আমার হৃদয়কে তোমার সৌন্দর্যের বাসস্থান এবং আমার বক্ষ হবে তোমার বেদনার জন্য একটা সমাধি। আমি তোমাকে ভালোবাসব সেলমা, যেভাবে তৃণভূমি ভালোবাসে বসন্ত এবং আমি বেঁচে থাকব তোমার ভেতরে- সূর্যরশ্মির নিচে একটা ফুলের জীবন। আমি গাইব তোমার নাম যেভাবে উপত্যকায় প্রতিধ্বনিত হয় গ্রামের চার্চের ঘণ্টাধ্বনি। আমি শুনব তোমার আত্মার ভাষা যেভাবে তীরভূমি শোনে ঢেউয়ের গল্প। আমি তোমাকে স্মরণ করব যেভাবে একজন আগন্তুক স্মরণ করে তার অত্যন্ত প্রিয়দেশকে এবং একজন ক্ষুধার্ত মানুষের মতো ভালোবাসব যেভাবে সে স্মরণ করে একটা ভোজসভার কথা এবং তোমাকে স্মরণ করব সিংহাসনচ্যুত একজন রাজা যেভাবে স্মরণ করে তার মহিমার দিনগুলি এবং একজন বন্দির মতো স্মরণ করব তোমাকে যেভাবে সে স্মরণ করে তার শাস্তি ও স্বাধীনতার দিনগুলিকে। আমি স্মরণ করব তোমাকে, যেভাবে একজন বীজ-বপনকারী মাড়াইখানায় দেওয়া গমের আঁটির কথা স্মরণ করে এবং তোমাকে স্মরণ করব একজন মেষপালকের মতো যে তার পশুর পালের জন্য সবুজ তৃণভূমি ও মিষ্টি ছোট্ট নদীর কথা স্মরণ করে।’
স্পন্দিত হৃদয় নিয়ে সেলমা আমার কথা শুনল এবং বলল, ‘আগামীকাল সত্য পরিণত হবে প্রেতাত্মায় এবং জাগরণ হবে স্বপ্নের মতো। প্রেতাত্মাকে আলিঙ্গন করে কি একজন প্রেমিক পরিতৃপ্ত হবে অথবা একজন তৃষ্ণার্ত মানুষ কি তার তৃষ্ণা মেটাবে স্বপ্নের বসন্ত থেকে?’
আমি উত্তর দিলাম, ‘আগামীকাল ভাগ্য তোমাকে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবারের ভেতরে স্থাপন করবে কিন্তু আমাকে পাঠিয়ে দেবে যুদ্ধ ও সংগ্রামের পৃথিবীতে। তুমি থাকবে এমন এক লোকের বাড়িতে তোমার সৌন্দর্য ও সদ্গুণের মাধ্যমে যেখানে নিজেকে সবচেয়ে ভাগ্যবান হিসেবে গড়ে নেবার সুযোগ রয়েছে। আর আমি বসবাস করব জীবনের আতঙ্ক ও দুর্ভোগের ভেতরে। তুমি প্রবেশ করবে জীবনের দরজায়, আমি প্রবেশ করব মৃত্যুর দরজায়। তুমি গ্রহণ করবে আতিথেয়তা, আর আমি টিকে থাকব নির্জনতার ভেতরে, কিন্তু আমি খাড়া করে তুলব ভালোবাসার একটা ভাস্কর্য এবং প্রার্থনা করব তার মৃত্যুর উপত্যকায় বসে। ভালোবাসা হবে আমার একমাত্র আয়েশ এবং আমি ভালোবাসাকে পান করব মদের মতো এবং পরিধান করব পোশাকের মতো। ভোরবেলায় ভালোবাসা আমাকে জাগিয়ে তুলবে সুখনিদ্রা থেকে এবং আমাকে নিয়ে যাবে দূরবর্তী শস্যক্ষেতে এবং দুপুরে আমাকে নিয়ে যাবে গাছের ছায়ায় যেখানে সূর্যের উত্তাপ থেকে আমি আশ্রয় খুঁজে নেব পাখিদের সাথে। সন্ধ্যায়, সূর্যাস্তের কিছু আগে কিছুক্ষণ বিরতির ভেতরে শুনব সূর্যালোকের বিদায়সংগীতে এবং দেখব ভূতের মতো পাল তুলেছে মেঘগুলি সন্ধ্যার আকাশে। রাতে ভালোবাসা আমাকে আলিঙ্গন করবে এবং আমি ঘুমিয়ে পড়ব স্বর্গীয় পৃথিবীতে স্বপ্ন দেখতে দেখতে যেখানে প্রেমিকের আত্মা এবং কবিরা একসঙ্গে বসবাস করে। বসন্তে আমি আর ভালোবাসা পাশাপাশি হাঁটব বাগানের ফুলগুলির ভেতর দিয়ে এবং পান করব পদ্মফুলের ওপর জমে থাকা ভোরের শিশির। গ্রীষ্মে আমরা খড়ের আঁটি দিয়ে তৈরি করব বালিশ এবং ঘাস হবে আমাদের বিছানা এবং নীলাকাশ ঢেকে দেবে আমাদেরকে যখন আমরা স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকব চন্দ্র ও নক্ষত্রের দিকে।
শরতে আমি আর ভালোবাসা একত্রে আঙুর বাগানে যাব, বসব আঙুর পেষণকারী যন্ত্রের কাছে এবং লক্ষ্য করব পত্রহীন আঙুরলতা এবং পরিযায়ী পাখির ঝাঁক পাখা ঝাপটাবে আমাদের ওপর। শীতে আমরা আগুনের পাশে বসে আবৃত্তি করব বহুকাল আগের গল্প এবং দূরবর্তী দেশের ঘটনাপঞ্জি। যৌবনের দিনগুলিতে ভালোবাসা হবে আমার শিক্ষক, মধ্য বয়সে আমার সাহায্যকারী এবং বৃদ্ধ বয়সে হবে আমার উল্লাস। সেলমা, আমার জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভালোবাসা আমার সঙ্গে থাকবে এবং মৃত্যুর পর ঈশ্বরের হাত আমাদেরকে আবার একত্রিত করবে।’
এসব কথা আমার হৃদয়ের ভেতর থেকে উঠে এল আগুনের শিখার মতো যা উন্মত্ত হয়ে উঠেছে পাশের অগ্নিকুণ্ডে এবং তারপর ছাইয়ের ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। সেলমা কাঁদছিল যেন তার চোখদুটি ঠোঁটে পরিণত হয়েছিল এবং আবার কথার জবাব দিচ্ছিল অশ্রুজলে।
যার ভালোবাসাকে পাখা দেওয়া হয়নি সে মুখমণ্ডলে জমে ওঠা মেঘের পেছনে উড়তে পারে না সেই মন্ত্রমুগ্ধ পৃথিবীকে দেখতে যেখানে সেলমা ও আমার আত্মা এ রাত্রে অবস্থান করে সেই বেদনার্ত কিন্তু সুখী সময়ের ভেতরে। যাদের ভালোবাসা অনুসরণকারী হিসেবে তাদেরকে পছন্দ করে না তারা শুনতে পায় না যখন ভালোবাসা আহ্বান জানায়। এই গল্প তাদের জন্য নয়। তবে তাদের উচিত এই পাতাগুলিও উপলব্ধি করা, তারা অবশ্য ছায়াচ্ছন্ন অর্থকে আঁকড়ে ধরতে সক্ষম নয় যা শব্দের পোশাক দিয়ে মোড়ানো হয়নি এবং তা বসবাস করে না কাগজের ওপর, কিন্তু কী ধরনের মানুষ সে যে কখনও ভালোবাসার কাপ থেকে চুমুক দিয়ে মদপান করে না এবং এটা কী ধরনের আত্মা যে মন্দিরে আলোকিত বেদির সামনে শ্রদ্ধাশীলভাবে কখনও দাঁড়ায় না, যে মন্দির চত্বর হচ্ছে নারী ও পুরুষের হৃদয় এবং যার ছাদ হচ্ছে স্বপ্নের গোপনীয় আচ্ছাদন। এটা কী ধরনের ফুল গাছ যার পাতার ওপর ভোরবেলা এক ফোঁটা শিশিরও ঝরায় না, কি ধরনের নদী এটা সমুদ্রে না গিয়েই যে তার গতি হারিয়ে ফেলে?
সেলমা আকাশের দিকে মুখ তুলল এবং স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল স্বর্গীয় নক্ষত্রের দিকে যা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল মহাশূন্যে। সে তার বাহু প্রসারিত করল, চোখগুলো বিস্তৃত হল এবং শিহরিত হতে থাকল তার ঠোঁট। তার বিবর্ণ আদলে দেখতে পেলাম বেদনা, নিপীড়ন, হতবিহ্বলতা এবং দুঃখ। তারপর সে কেঁদে ফেলল, ‘হে অধিপতি একজন নারী কী করেছে যাকে আপনি অপরাধ বলবেন? এ ধরনের শাস্তি পাবার জন্য কী ধরনের অপরাধ সে করেছে? কোন্ পাপের জন্য সে পুরস্কৃত হবে এই চিরস্থায়ী কঠোরতা দিয়ে? হে ঈশ্বর আপনার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা খুবই শক্তিশালী এবং আমি দুর্বল। কেন আপনি আমাকে এই কষ্ট দিচ্ছেন? আপনার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা বিশাল এবং সর্বময়, যেখানে আমি কিছুই নয় একটি ক্ষুদ্র প্রাণী ছাড়া, যে আপনার সিংহাসনের সামনে হামাগুড়ি দিচ্ছে। কেন এত দ্রুত আপনার পা দিয়ে আমাকে চূর্ণবিচূর্ণ করবেন? আপনার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা হচ্ছে প্রচণ্ড ঝড়ের মতো উন্মত্ত এবং আমি হলাম ধুলোর মতো, হে আমার ঈশ্বর, কেন আপনি আমাকে ঠাণ্ডা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলবেন? আপনার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা খুবই বিবেচক এবং আমি হলাম সতর্ক, কেন সে আমাকে ধ্বংস করছে? আপনি নারীকে তৈরি করেছেন ভালোবাসা দিয়ে এবং ভালোবাসা কেন তাকে ধ্বংস করে। আপনার ডান হাত তাকে উত্তোলন করে এবং বাম হাত তাকে নিক্ষেপ করে নরকে এবং সে জানে না কেন। তার মুখে জীবনের শ্বাসপ্রশ্বাস প্রবাহিত হয় এবং তার হৃদয়ে বপন করা হয়েছে মৃত্যুর বীজ। তাকে দেখান সুখের পথ কিন্তু তাকে আপনি নেতৃত্ব দেন দুর্গতির পথে যেতে। তার মুখে দেন আপনি সুখের সংগীত এবং তার ওষ্ঠ বন্ধ করে দেন দুঃখ দিয়ে এবং মর্মবেদনা দিয়ে জিভে পরিয়ে দেন শৃঙ্খল। আপনার রহস্যময় আঙুল দিয়ে আপনি পরিচর্যা করেন তার ক্ষতের এবং পাতলা হাত দিয়ে তুলে ধরেন তার আনন্দের চারপাশে বেদনার নিরানন্দ। আনন্দ ও বেদনাকে আপনি লুকিয়ে রাখেন তার শয্যায় কিন্তু তার পাশে আপনি সোজা করে তুলে ধরেন বাধা ও আতঙ্কগুলি। আপনার ইচ্ছায় তার ভালোবাসাকে আপনি উত্তেজিত করে তোলেন এবং তার ভালোবাসা থেকে প্রবাহিত হয়ে আসে লজ্জা। আপনার ইচ্ছায় তার হৃদয়ে বপন করা হয়েছে সৃষ্টির সৌন্দর্য, কিন্তু সৌন্দর্যের জন্য তার ভালোবাসা পরিণত হয়েছে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে। মৃত্যুর কাপে আপনি তাকে পান করিয়েছেন জীবন এবং জীবনের কাপে মৃত্যুকে। তাকে পরিশুদ্ধ করেছেন অশ্রুজলে এবং এই অশ্রুজলে ভেসে গেছে তার জীবন। হে ঈশ্বর, আপনি ভালোবাসা দিয়ে খুলে দিয়েছেন আমার চোখ এবং সেই ভালোবাসাতেই আমাকে অন্ধ করে দিয়েছেন। আপনার ওষ্ঠ দিয়ে চুম্বন করেছেন আপনি আমাকে এবং আবার আঘাত করেছেন আপনার শক্তিশালী হাত দিয়ে। আপনার হাত দিয়েই আপনি আমার হৃদয়ে রোপণ করেছেন একটি সাদা গোলাপ কিন্তু সেই গোলাপের চারপাশে সৃষ্টি করেছেন কাঁটার প্রতিবন্ধকতা। আমার বর্তমানকে আপনি বেঁধে ফেলেছেন একজন যুবকের আত্মার সঙ্গে যাকে আমি ভালোবাসি কিন্তু আমার জীবন একটা অপরিচিত মানুষের শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে। সুতরাং আমাকে সাহায্য করুন, হে আমার ঈশ্বর এই মরণোন্মুখ সংগ্রামে শক্তিশালী হতে এবং সাহায্য করুন সত্যবাদী ও সদ্গুণসম্পন্ন হতে মৃত্যু না আসা পর্যন্ত। আপনার ইচ্ছাই কার্যকার হবে হে আমার ঈশ্বর।’
চারদিক তখনও নীরব। সেলমা তাকিয়ে ছিল নিচের দিকে। বিবর্ণ ও দুর্বল দেখাচ্ছিল তাকে। তার হাতদুটো ঝুলে গিয়েছিল এবং মাথাও নোয়ানো। আমার মনে হল একটা ঠাণ্ডা ঝড় একটা শাখা ভেঙে দিয়ে গেছে এবং তা এখন শুকিয়ে যাবে এবং লোপ পাবে।
আমি তার ঠাণ্ডা হাত ধরলাম এবং তাতে চুমু খেলাম কিন্তু যখন আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলাম তখন আমারই সান্ত্বনার প্রয়োজন ছিল তার চেয়ে বেশি। আমি চুপচাপ থাকলাম; চিন্তা করতে লাগলাম আমাদের দুরবস্থা সম্পর্কে এবং মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম আমার হৃদস্পন্দন। আমরা কোনো কথাই বললাম না।
চূড়ান্ত নির্যাতন ছিল শব্দহীন সুতরাং আমরা নীরবে বসেছিলাম ভূমিকম্পের পর বালির নিচে সমাহিত মর্মর পাথরের স্তম্ভের মতো। কারোরই ইচ্ছা হচ্ছে না অন্যের সঙ্গে কথা বলার, কারণ আমাদের হৃদয়ের তন্তুগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে, এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসও তা ছিঁড়ে ফেলতে পারে।
এটা ছিল মধ্যরাত এবং আমরা মাউন্ট সেন্নাই-এর পেছনে ওঠা অর্ধেক চাঁদের দিকে তাকিয়েছিলাম। নক্ষত্রদের মাঝখানে এটা দেখাচ্ছিল একটা মৃত মানুষের মুখের মতো যেন কফিনকে ঘিরে রেখেছে অনুজ্জ্বল মোমের আলো এবং লেবাননকে দেখাচ্ছে একজন বৃদ্ধমানুষের মতো, যার পেছনটা বাঁকা হয়েছিল বয়সের ভারে এবং যার চোখ অনিদ্রার স্বর্গ, পর্যবেক্ষণ করছিল অন্ধকার এবং অপেক্ষা করছিল ভোরবেলার জন্য একজন রাজার মতো যে তার প্রসাদের ধ্বংসস্তূপের ভেতরে নিজের সিংহাসনের ছাইয়ের ওপরে বসে আছে।
পাহাড়শ্রেণী, বৃক্ষসমূহ ও নদীগুলি পরিবর্তিত হয় সময় ও ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে পরিবর্তন হয় মানুষের আবেগ বিচক্ষণতার সঙ্গে সঙ্গে। দিনের বেলা সুউচ্চ পপলার গাছ একটা পাখিকে নিজের পাতার ভেতরে লুকিয়ে ফেলে, সন্ধ্যায় তা দেখাবে একটা ধোঁয়ার স্তম্ভের মতো, অলঙ্ঘনীয় শিলার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে দুপুরবেলায় এবং রাতে আবির্ভূত হবে নিঃস্ব হিসেবে এবং সেই ছোট্ট নদী যা আমরা ভোরবেলায় দেখি জ্বলজ্বল করছে এবং শুনতে পাই সে গাইছে অনন্তকালের স্তোত্রগীতি। সন্ধ্যায় প্রবাহিত হবে অশ্রুর স্রোতোধারা, হাহাকার করবে সেই মায়ের মতো যার শিশু তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছে এবং লেবানন, যা এক সপ্তাহ আগেও মর্যাদাসম্পন্ন ছিল, চাঁদ ছিল পরিপূর্ণ এবং আমাদের আত্মা ছিল সুখী এবং তা সবই রাত্রিবেলায় বিষণ্ণতা ও বেদনায় পূর্ণ হয়ে থাকে।
আমরা উঠে দাঁড়ালাম এবং পরস্পরকে বিদায় জানালাম, কিন্তু ভালোবাসা ও নৈরাশ্য দাঁড়িয়েছিল দুটো প্রেতাত্মার মতো আমাদের মাঝখানে, এদের একজন পাখা বিস্তৃত করেছিল তার আঙুলসহ আমাদের কণ্ঠনালির ওপর এবং কাঁদছিল এবং অন্যজন লুকিয়ে হাসছিল।
আমি সেলমার হাত ধরে তাতে ওষ্ঠ ছোঁয়ালাম। সে আমার কাছে সরে এল এবং চুম্বন করল আমার কপালে, তারপর ধপ করে বসে পড়ল কাঠের বেঞ্চির ওপর। সে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, ‘আহ, হে আমার ঈশ্বর আমাকে দয়া করুন এবং আমার পাখাগুলি মেরামত করে দিন।’
আমি সেলমাকে বাগানে রেখে চলে গেলাম। মনে হল আমার বিচারবুদ্ধি একটা অবগুণ্ঠনে ঢাকা পড়েছে একটা জলাভূমির মতো যার উপরিভাগকে লুকিয়ে রেখেছে অসংখ্য ব্যাঙ।
গাছপালা, চন্দ্রালোক ও গভীর নীরবতার সৌন্দর্য আমার চোখে কুৎসিত ও বীভৎস মনে হল। প্রকৃত আলো, যা আমার সামনে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৌন্দর্য ও বিস্ময়কে তুলে ধরেছিল, তা পরিবর্তিত হয় বিশাল অগ্নিশিখায়, যা আমার হৃদয়কে দগ্ধ করে এবং অনন্তের যে সংগীত আমি শুনতে অভ্যস্ত তা পরিণত হয় উচ্চ কলরবে, যা সিংহের গর্জনের চেয়েও অধিক ভীতিপ্রদ।
শিকারির গুলিতে আহত পাখির মতো আমি ঘরে পৌঁছালাম। বিছানায় নিক্ষেপ করলাম নিজেকে এবং পুনরাবৃত্তি করলাম সেলমার কথাগুলি, ‘হে ঈশ্বর, আমাকে ক্ষমা করুন এবং মেরামত করে দিন আমার পাখাগুলি।’
৭. মৃত্যুর সিংহাসনের মুখোমুখি
আজকাল বিয়ে হচ্ছে একটা হাস্যকর বিষয় যদি তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব থাকে যুবক ও পিতামাতার হাতে। অধিকাংশ দেশে পিতামাতা মারা গেলে যুবকেরা লাভবান হয়। মেয়েদেরকে বিবেচনা করা হয় প্রয়োজনীয় সমাগ্রী হিসেবে- যাদেরকে কেনা ও সরবরাহ করা হয় এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে। এ সময়ে তার সৌন্দর্য ম্লান হয়ে আসে এবং সে বিবেচিত হতে থাকে পুরোনো আসবাবপত্র হিসেবে, যা বাড়ির অন্ধকার কোনায় পরিত্যক্ত হয়।
আধুনিক সভ্যতা নারীকে এ ব্যাপারে সামান্য সচেতন করলেও তার দুর্ভোগকে বাড়িয়ে দিয়েছে পুরুষের লোলুপতা। গতকালের নারী ছিল একজন সুখী স্ত্রী, কিন্তু বর্তমানের স্ত্রী হচ্ছে একজন দুর্গত মিসট্রেস। অতীতকালে সে আলোতে হাঁটত অন্ধভাবে, কিন্তু এখন সে অন্ধকারে খোলাচোখে হেঁটে বেড়ায়। সে ছিল তার অজ্ঞতার ভেতরে সুন্দর, সাধারণত্বের ভেতরে মর্যাদাসম্পন্ন এবং দুর্বলতার ভেতরে শক্তিশালী। বর্তমানে সে তার উদ্ভাবন কুশলতার ভেতরে কুৎসিতে পরিণত হয়েছে এবং আরও পরিণত হয়েছে জ্ঞানের ভেতরে হৃদয়হীন ও ভারসাম্যহীন। সেই দিন কি কখনও আসবে যখন সৌন্দর্য এবং জ্ঞান, উদ্ভাবনকুশলতা এবং সদ্গুণ এবং শরীরের দুর্বলতা ও আত্মার শক্তি ঐক্যবদ্ধ হবে একটা নারীর ভেতরে?
আমি সেইসব মানুষের একজন যারা বিশ্বাস করে আধ্যাত্মিক অগ্রগতি মানুষের জীবনের একটা আইন, কিন্তু উৎকৃষ্টতার প্রস্তাবটি ধীরগতিসম্পন্ন এবং বেদনাদায়ক। যদি কোনো নারী নিজেকে সম্মানের যোগ্য করে তুলতে পারে এবং প্রতিহত করে অন্যদেরকে তাহলে সেই এবড়োথেবড়ো পদচিহ্ন নেতৃত্ব দেয় পাহাড়ের শীর্ষে উঠে যেতে, যদিও সে পথ মুক্ত নয়, চোরদের হঠাৎ আক্রমণ ও নেকড়েদের গুহা থেকে।
এই বিস্ময়কর প্রজন্ম অবস্থান করে ঘুম এবং জাগরণের মাঝখানে। তার মুঠোবদ্ধ হাতে অতীতের মাটি এবং ভবিষ্যতের বীজ। যাহোক, আমরা প্রত্যেক শহরে খুঁজে ফিরি একজন নারীকে যে ভবিষ্যৎকে প্রতীকায়িত করে।
বৈরুত শহরে সেলমা কারামি ছিল প্রাচ্যদেশীয় ভবিষ্যৎ নারীর প্রতীক, কিন্তু অনেকের মতো যে বসবাস করত তাদের সময়ের সামনে। সে পরিণত হত বর্তমানের শিকারে এবং বোঁটা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া ফুলের মতো তাকে বহন করে নিয়ে যেত নদীর স্রোতোধারা, যে হেঁটে বেড়ায় পরাজিত মানুষের দুর্গতির মিছিলে।
.
মনসুর বেই গালিব এবং সেলমার বিয়ে হয়ে গেল এবং তারা একত্রে বসবাস করতে থাকল রাস-বৈরুতের একটা চমৎকার বাড়িতে, যেখানে সব উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের বাসস্থান। ফারিস ইফান্দি কারামি বাগান ও কুঞ্জবনের মাঝখানে অবস্থিত নির্জন বাড়িতে পরিত্যক্ত হলেন একপাল পশুর ভেতরে নিঃসঙ্গ মেষপালকের মতো।
বিয়ের উল্লসিত দিন ও রাত্রিগুলি পার হয়ে গেল। হানিমুনও চলে গেল, ফেলে রেখে গেল বেদনার তিক্ত স্মৃতি, যেভাবে যুদ্ধ পরিত্যাগ করে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে মৃতদের মাথার খুলি ও হাড়গুলি। প্রাচ্যদেশীয় বিয়ের মর্যাদা যুবক-যুবতীদের হৃদয়কে উদ্দীপ্ত করে, কিন্তু এর সমাপ্তি তাদেরকে ফেলে দিতে পারে সমুদ্রের তলদেশে। তাদের উল্লাস হল বালির ওপর পদচিহ্নের মতো যা সমুদ্রের ঢেউয়ে ধুয়ে না-যাওয়া পর্যন্ত টিকে থাকে।
বসন্ত চলে যায় এবং একইভাবে গ্রীষ্ম ও শরৎ, কিন্তু সেলমার জন্য আমার ভালোবাস বাড়তেই থাকে দিনে দিন একটা নীরব প্রার্থনায় পরিণত না হওয়া পর্যন্ত। এটা একটা অনুভূতি যা একজন এতিম অনুভব করে তার মায়ের প্রতি স্বর্গের ভেতরে। আমার আকুল আকাঙ্ক্ষা পরিবর্তিত হল অন্ধ বেদনাবোধে, যে নিজেকে ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পায় না এবং যে আবেগ আমার চোখ থেকে অশ্রু তুলে নেয় এবং পুনস্থাপন করে মানসিক দ্বিধার ভেতরে, যা আমার হৃদয় থেকে রক্ত চোষে এবং আমার ভালোবাসার দীর্ঘশ্বাস পরিণত হয় অপরিবর্তনীয় প্রার্থনায় সেলমা ও তার স্বামীর সুখের জন্য এবং তার পিতার শান্তির জন্য।
আমার আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনা ব্যর্থ হয়ে গেল কারণ সেলমার দুর্গতি ছিল একটা অভ্যন্তরীণ অসুস্থতা যা একমাত্র মৃত্যুই সারিয়ে তুলতে পারে।
মনসুর বেই ছিল সেই মানুষ জীবনের সমস্ত বিলাসিতা সহজেই যার কাছে ধরা দেয়। কিন্তু তারপরও সে ছিল অতৃপ্ত এবং লোভী। সেলমাকে বিয়ে করার পর সে তার পিতাকে অবহেলা করতে শুরু করে এবং প্রার্থনা করে যেন দ্রুত তার মৃত্যু হয় এবং বৃদ্ধের যাবতীয় সম্পদ সে নিজের দখলে নিয়ে আসতে পারে।
মনসুর বেই-এর চরিত্র ছিল তার চাচার মতোই। শুধু দুজনের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য ছিল বিশপ যা কিছু অর্জন করেছে সবই সে কামনা করেছে গোপনে, তার বক্ষের ওপর দোদুল্যমান ক্রুশ ও যাজকের পোশাকের নিরাপত্তার ছায়ায়, আর তার ভাতিজা সবকিছুই অর্জন করেছে জনগণের চোখের সামনে। বিশপ নিয়মানুযায়ী চার্চে যেত সকালবেলায় এবং বাকি সময় যে কাটাত বিধবা, এতিম এবং সাধারণ মানুষের সম্পদ চুরি করে। কিন্তু মনসুর বেই-এর দিন কাটত যৌনতৃপ্তির পেছনে ছোটাছুটি করে। রবিবারে বিশপ তার ধর্ম প্রচার করত, কিন্তু সপ্তাহের অন্য দিনগুলিতে সে কোনো অনুশীলনই করতনা। এলাকার রাজনৈতিক চক্রান্তে সে নিজেকে ব্যাস্ত রাখত। চাচার মর্যাদা ও প্রভাবের কারণে মনসুর সেইসব লোকদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিশ্চিত করত যারা তাকে ঘুষ দিত।
বিশপ ছিল একজন চোর যে নিজেকে লুকিয়ে রাখত রাত্রির অন্ধকারে, পাশাপাশি তার ভাতিজা ছিল জোচ্চোর যে প্রকাশ্য দিনের আলোতে অপকর্ম করে গর্বের সঙ্গে ঘুরে বেড়াত। যাহোক, প্রাচ্যদেশীয় জাতির মানুষেরা এদের ওপরও বিশ্বাস স্থাপন করত- নেকড়ে এবং কসাইদের লোলুপতার কারণে দেশটা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং তারা প্রতিবেশীদের দমন করত খুবই কঠোর হাতে।
কেন আমি একজন ভাঙা হৃদয়ের দুর্গত নারীর গল্পের পরিবর্তে এই পাতাগুলো দখল করেছি শব্দ দিয়ে গরিব জাতির প্রতারকদের সম্পর্কে কথা বলে? কেন আমি অশ্রু ঝরাই নিপীড়িত মানুষের জন্য, একজন দুর্বল নারীর স্মৃতির জন্য তা রক্ষা করার চেয়ে, যার জীবন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়েছে মৃত্যুর দংশনে।
কিন্তু আমার পাঠকেরা, আপনাদের কি মনে হয় না একটি জাতির মাতা একটি নারী, যে নিপীড়িত হয়েছিল যাজক ও শাসকদের দ্বারা। আপনারা কি সেই ব্যার্থ প্রেমকে বিশ্বাস করেন না যা একজন নারীকে নেতৃত্ব দিয়েছিল হতাশার মতো কবরের দিকে যেতে,যা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর মানুষের ভেতরে? একটি জাতির কাছে একটি নারী হল একটি আলো যেমন তেমনি। বাতির তেল কমে এলে কি বাতিটা অনুজ্জ্বল হয়ে পড়বে না।?
শরৎ চলে গেল এবং বাতাস হলুদ পাতাগুলি গাছ থেকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, তৈরি করল শীতের জন্য পথ এবং সেই পথে শীত এল কাঁদতে কাঁদতে এবং হাহাকার করতে করতে। আমি বৈরুত শহরেই ছিলাম সঙ্গীহীন শুধুমাত্র স্বপ্নগুলি ছাড়া, যা আমার আত্মাকে আকাশে তুলে নেবে এবং তারপর তা সমাহিত করবে মাটির বক্ষের গভীরতায়।
বেদনার্ত আত্মা নির্জনতার ভেতরে শিথিলতা সন্ধান করে। এই আত্মা মানুষকে ঘৃণা করে, আহত হরিণ হিসেবে পরিত্যাগ করে পশুপাল এবং মৃত্যু না-আসা পর্যন্ত বসবাস করে গুহায়।
একদিন শুনলাম ফারিস ইফান্দি অসুস্থ। আমি আমার নির্জন বাসস্থান পরিত্যাগ করে তার বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম একটা নতুন ও নির্জন রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দুপাশে অলিভ গাছ। গাড়ির চাকার ঘরঘর আওয়াজ এড়াতেই প্রধান সড়ক ছেড়ে এই রাস্তায় আসা।
ফারিস ইফান্দির বাড়িতে আসার পর তার ঘরে ঢুকে দেখি সে বিছানায় শুয়ে আছে—দুর্বল এবং বিবর্ণ। তার চোখদুটিকে মনে হচ্ছিল ডুবে যাওয়া দুটি গভীর অন্ধকার উপত্যকা, যাকে শিকার করেছে বেদনার প্রেতাত্মারা। সব সময়ই তার মুখে যে প্রাণবন্ত হাসি দেখা যেত তা বেদনা ও মর্মবেদনা শুষে নিয়েছে এবং তার হাতের হাড়গুলিকে দেখাচ্ছিল নগ্ন হাতের মতো যা প্রচণ্ড ঝড়ে কাঁপছে। আমি তার কাছাকাছি গিয়ে তার স্বাস্থ্যের খোঁজ-খবর করলাম। সে বিষণ্ণ মুখখানা আমার দিকে ঘোরাল এবং তার কাঁপতে থাকা ঠোঁটে আবির্ভূত হল একটা হাসি এবং সে খুব দুর্বল কণ্ঠে বলল, ‘হে আমার প্রিয় পুত্র। পাশের ঘরে যাও এবং সেলমাকে সান্ত্বনা দাও এবং তাকে আমার বিছানার পাশে এনে দাও।’
আমি পাশের ঘরে ঢুকে দেখি সেলমা একটা ডিভানের ওপর শুয়ে আছে। হাত দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। মুখখানা বালিশে সমাহিত যেন তার পিতা তার কান্না শুনতে না পায়। আমি আস্তে তার কাছে গেলাম এবং ফিসফিস করার চেয়ে একটু জোরে তার নাম ধরে ডাকলাম। সে আতঙ্কের সঙ্গে পাশ ফিরল যেন তার দেখতে থাকা বীভৎস স্বপ্নে কেউ বাধা দিয়েছে। জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে আমি ভূত না জীবন্ত মানুষ তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। একটা গভীর নীরবতা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল স্মৃতির সেই পাখাগুলির ওপর যখন আমরা ভালোবাসার মদ পান করে আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। সেলমা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘জীবনের গতিকে সময় কী পরিমাণ পরিবর্তন করেছে এবং আমাদেরকে ধ্বংস করে রেখে গেছে। এইখানে বসন্ত আমাদেরকে একত্রিত করেছিল ভালোবাসার বন্ধনে এবং এই জায়গায়ই আমাদেরকে একত্রিত করেছে কাঁটার সিংহাসনের সামনে। বসন্ত কী সুন্দর এবং কী ভয়াবহ এই শীত!’
এসব বলে সে তার মুখ ঢাকল হাত দিয়ে যেন তার সামনে দাঁড়ানো অতীতের প্রেতাত্মাদের কাছ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সে তার চোখে একটা বর্ম পরিধান করেছিল। আমি তার মাথায় হাত রাখলাম এবং বললাম, ‘এসো সেলমা, প্রবল ঝড়ের সামনে আমাদেরকে হতে হবে শক্তিশালী স্তম্ভের মতো। চলো আমরা সাহসী সৈনিকের মতো শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াই এবং মোকাবেলা করি তার অস্ত্রকে। আমরা মারা যাব ধর্মযুদ্ধে শহীদের মতো এবং যদি জয়লাভ করি তাহলে বেঁচে থাকব বীরের মতো। প্রশান্তিকে প্রত্যাহার করার চেয়ে সাহসের সঙ্গে বাধা ও কঠোর পরিশ্রমের মুখোমুখি হওয়া অধিক মহত্তর। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বাতির ওপর স্থির হয়ে ভেসে থাকে যে প্রজাপতি সে অধিক প্রশংসারযোগ্য অন্ধকার সুড়ঙ্গে বসবাসকারী ছুঁচোর চেয়ে। এসো সেলমা, চলো আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে এই এবড়োথেবড়ো পথে হাঁটি সূর্যের দিকে চোখ রেখে যেন আমরা পাথরখণ্ড ও সিংহাসনের ভেতরে মাথার খুলি ও সাপ দেখতে না পাই। যদি আতঙ্ক আমাদেরকে মধ্যপথে থামায় তাহলে আমরা শুধুই শুনব রাত্রির কণ্ঠস্বর থেকে ব্যঙ্গ- বিদ্রূপ, কিন্তু যদি আমরা সাহসের সঙ্গে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছাই তাহলে আমরা স্বর্গীয় আত্মাদের সঙ্গে মিলিত হব সাফল্য ও আনন্দের সংগীতের ভেতরে। উৎফুল্ল হও সেলমা, মুছে ফ্যালো তোমার চোখের জল এবং তোমার চেহারা থেকে বেদনা দূর হয়ে থাকে। ওঠো এবং চলো তোমার পিতার বিছানার কাছে গিয়ে বসি, কারণ তার জীবন নির্ভর করছে তোমার জীবনের ওপর এবং তোমার হাসিই পারে তাকে সারিয়ে তুলতে
সে স্নেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘তুমি আমাকে ধৈর্য ধরতে বলছ তাই না, যখন তোমারই তা বেশি প্রয়োজন। একজন ক্ষুধার্ত লোক কি তার রুটিটি অন্য ক্ষুধার্ত মানুষকে দেবে অথবা একজন অসুস্থ মানুষ কি তার ওষুধ অন্য লোককে দেবে যা তারই খুব বেশি প্রয়োজন?’
আমরা বৃদ্ধের ঘরে গিয়ে তার বিছানার পাশে বসলাম। সেলমা জোর করে হাসল এবং ভান করল ধৈর্য ধরতে এবং তার পিতা তাকে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করলেন যে, সে এখন ভালোবোধ করছে আমায় দেখে, কিন্তু পিতা ও কন্যা উভয়েই সচেতন ছিল পরস্পরের বেদনা সম্পর্কে এবং তারা শুনছিল পরস্পরের শব্দহীন দীর্ঘশ্বাস। তারা ছিল পরস্পর সমান শক্তির মতো এবং তারা পরস্পরকে ক্লান্ত করে তুলছিল নীরবতার ভেতরে। কন্যার নিরাশায় পিতার হৃদয় গলে যাচ্ছিল। তারা দুটি পরিশুদ্ধ আত্মা, একজন প্রস্থান করছিল, অন্যজন পীড়িত ছিল মর্মপীড়া ও মৃত্যুর আলিঙ্গনে এবং আমার সমস্যা জর্জরিত হৃদয় নিয়ে আমি ছিলাম দুজনের মাঝখানে। আমরা তিনজন মানুষ একত্রিত ও চূর্ণবিচূর্ণ হচ্ছিলাম নিয়তির হাতের মুঠোয়। একজন বৃদ্ধ বন্যায় ধ্বংস হয়েছে বসতির মতো, একজন যুবতী যার প্রতীক হল কাস্তে দিয়ে কেটে নেওয়া পদ্মফুল এবং একজন যুবক যে একটা দুর্বল চারাগাছ তুষারপাতের কারণে বাঁকা হয়ে গেছে এবং ভাগ্যের হাতের মুঠোয় আমরা হলাম খেলনার মতো।
ফারিস ইফান্দি ধীরে ধীরে নড়াচড়া করল এবং দুর্বল দুহাত বাড়িয়ে দিল সেলমার দিকে এবং অত্যন্ত কোমল ও স্নেহের স্বরে বলল, ‘হে আমার প্রিয় কন্যা। আমার হাত ধরো।’ সেলমা তার হাত ধরল এবং সে আবার বলল, ‘আমি যথেষ্ট সময় পৃথিবীতে থেকেছি এবং উপভোগ করেছি জীবনের বিভিন্ন ঋতুর ফলগুলি। প্রশান্তির সঙ্গে জীবনের সমস্ত পর্যায়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তোমার মাকে হারিয়েছি যখন তোমার বয়স তিন বছর এবং সে তোমাকে ছেড়ে গিয়েছিল আমার কোলে একটা মূল্যবান সম্পদ হিসেবে। আমি তোমার বেড়ে ওঠা লক্ষ্য করেছি, তোমার মুখে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে তোমার মায়ের ছায়া যেমন নক্ষত্র প্রতিফলিত হয় শান্ত জলাভূমির জলের ওপর। তোমার চরিত্র, মেধা ও সৌন্দর্য সবকিছুই তোমার মায়ের মতো, এমনকি তোমার কথাবলার ভঙ্গি ও ইশারা- ইঙ্গিত। তুমি হলে আমার এ জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা। কারণ প্রত্যেক কথা ও কাজে তুমি হলে তোমার মায়ের প্রতিমূর্তি। এখন আমি বৃদ্ধ হয়েছি এবং এখন আমার বিশ্রামের একমাত্র জায়গা হচ্ছে মৃত্যুর পাখার মাঝখানে। মা আমার, কষ্ট পেও না, আমি বহুদিন বেঁচেছি এবং দেখেছি তোমার বড় হওয়া। সুখী হতে চেষ্টা করো, কারণ আমি বেঁচে থাকব তোমার জীবনে আমার মৃত্যুর পরও। আজ আমার চলে যাওয়া কোনো পার্থক্য তৈরি করেবে না যদি আমি আগামীকাল চলে যাই কিংবা তার পরদিন, কারণ আমাদের দিনগুলি লোপ পাচ্ছে শরতের পাতার মতো। আমার মৃত্যুর সময়ও কাছে আসছে দ্রুত এবং আমার আত্মার আকাঙ্ক্ষা তোমার মায়ের সঙ্গে মিলিত হওয়া।’
এসব বলার সময় তার মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তারপর সে বালিশের তলায় হাত ঢোকাল এবং বের করে আনল সোনার ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি। তারপর সেই ছোট্ট ছবিটার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘কাছে এসো সেলমা। দ্যাখো তোমার মায়ের ছবি।’
সেলমা তার চোখ মুছল এবং কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর সে তাতে চুমু খেল বারবার এবং কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ওমা! মাগো।’ তারপর সে তার কাঁপতে থাকা ঠোঁট ছোঁয়াল আবার ছবির ওপর যেন সে ঐ ছবির ওপর সে তার হৃদয় ঢেলে দিতে চায়।
মানুষজাতির ঠোঁটে সবচেয়ে চমৎকার শব্দ হল ‘মা’ এবং সবচেয়ে মধুর আহ্বান হল ‘আমার মা’। এটা হল এমন একটা শব্দ যা ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষায় পরিপূর্ণ একটি মিষ্টি ও দয়ালু শব্দ এবং যা হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসে। মা হচ্ছে সবকিছু— সে হচ্ছে বেদনায় আমাদের সান্ত্বনা, দুর্গতিতে আমাদের প্রত্যাশা এবং দুর্বলতায় আমাদের শক্তি। সে হচ্ছে ভালোবাসা, সহানুভূতি, দয়া ও ক্ষমার উৎস; যে তার মাকে হারায় সে একটা শুদ্ধ আত্মাকে হারায় যে আত্মা তাকে সারাক্ষণ আশীর্বাদ করে এবং পাহারা দেয়।
প্রকৃতির সবকিছুতেই মায়ের কথা প্রতিধ্বনিত হয়। সূর্য হচ্ছে পৃথিবীর মাতা এবং উত্তাপ দিয়ে সে সবকিছুর পরিচর্যা করে। এটা কখনও পরিত্যাগ করে না বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে রাত্রিবেলায়, যতক্ষণ তা সমুদ্রের গান এবং পাখি ও নদীর স্তোত্রগীতির ভেতরে ঘুমিয়ে না যায় এবং এই পৃথিবী হচ্ছে বৃক্ষ ও ফুলের মাতা। সূর্যই তাদেরকে উৎপাদন, পরিচর্যা এবং একসময় তাদেরকে তাদের থেকে আলাদা করে ফেলে। বৃক্ষ এবং ফুলগুলি, ফল ও বীজের দয়ালু মাতায় পরিণত হয় এবং মাতা হচ্ছে অস্তিত্বের আদিরূপ এবং অনন্তকালের আত্মা যা সৌন্দর্য ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ।
সেলমা কারামি তার মাকে জানত না কারণ সে সেলমার শিশুবয়সেই মারা গেছে। কিন্তু সেলমা ছবি দেখে খুবই কাঁদল। মা শব্দটি আমাদের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে এবং বেদনা ও আনন্দের সময়ই তা আমাদের ঠোঁটের ওপর উঠে আসে, যেমন সৌরভ আসে গোলাপের হৃদয় থেকে এবং তা মিশে যায় পরিচ্ছন্ন বাতাসে। সেলমা স্থিরদৃষ্টিতে মায়ের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকল, চুম্বন করতে থাকল বার বার, যতক্ষণ সে ভেঙে না পড়ল।
বৃদ্ধ লোকটি তার মাথায় হাত রাখল এবং বলল, ‘সেলমা মা আমার, আমি তোমাকে একটা ছবি দেখিয়েছি মাত্র। এখন আমার কথা শোনো এবং আমাকে বলতে দাও তোমাকে তার কথাগুলি।’
সে তার মাথা তুলল একটা ছোট্ট পাখির মতো, যে কেবলই তার মায়ের পাখার ঝাপটানি শুনতে পারে এবং তাকিয়ে থাকতে পারে তার মায়ের দিকে।
ফারিস ইফান্দি বলল, ‘তুমি যখন খুবই ছোট তখন তোমার নানা মারা যান। তোমার মা তার মৃত্যুতে প্রচুর কেঁদেছিল। কিন্তু সে ছিল বিচক্ষণ ও ধৈর্যশীল। তোমার নানার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর তোমার মা এই ঘরে আমার পাশে বসে বলেছিল, ‘ফারিস, আমার পিতা এখন মৃত এবং তুমি হলে পৃথিবীতে আমার একমাত্র সান্ত্বনা। হৃদয়ের মায়া মমতা বৃক্ষের শাখার মতো বিভক্ত হয়ে যায়; যদি গাছটি তার শক্তিশালী একটা শাখা হারায় তাহলে সে মারা যায় না কিন্তু সে অবশ্যই দুর্ভোগ পোহাবে। এই গাছ তার সমস্ত প্রাণশক্তি ঢেলে দেবে অন্য একটি শাখায়। সুতরাং সে বেড়ে উঠবে এবং পূর্ণ করে দেবে শূন্যস্থান।’ যখন তোমার নানা মারা যায় তখন তোমার মা আমাকে একথা বলেছিল এবং তোমারও উচিত একই কথা বলা যখন মৃত্যু আমাকে নিয়ে যাবে সেই বিশ্রাম নেওয়ার জায়গায় এবং আমার আত্মা যাবে ঈশ্বরের নিরাপত্তায়।’
ভগ্নহৃদয়ে সেলমা কাঁদতে কাঁদতে জবাব দিল, ‘মা যখন নানাকে হরিয়েছিল তুমি তখন তার স্থান দখল করেছিলে কিন্তু তুমি চলে গেলে কে তোমার জায়গা দখল করবে? সে একজন বিশ্বাসী ও প্রেমিক স্বামীর তত্ত্বাবধানে পরিত্যাগ করেছিল এই পৃথিবী, সে সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল তার ছোট্ট মেয়ের ভেতরে, কিন্তু তুমি চলে যাবার পর কে হবে আমার সান্ত্বনা? তুমি ছিলে একইসঙ্গে আমার পিতা, মাতা ও যৌবনের সঙ্গী।’
এসব বলে সেলমা আমার দিকে তাকাল এবং আমার পোশাকের প্রান্ত চেপে ধরে বলল, ‘এই হল আমার একমাত্র বন্ধু তোমার চলে যাবার পর, কিন্তু সে কিভাবে আমাকে সান্ত্বনা দেবে যখন সেও কষ্ট পাচ্ছে? কীভাবে একটি ভাঙা হৃদয় একটা হতাশ আত্মার ভেতর সান্ত্বনা খুঁজে পাবে? একজন বেদনার্ত নারী তার প্রতিবেশীর দুঃখের ভেতরে সান্ত্বনা খুঁজে পায় না এবং একইভাবে ভাঙা ডানা নিয়ে একটা পাখি উড়তেও পারে না। সে আমার আত্মার বন্ধু কিন্তু ইতিমধ্যেই আমি দুঃখের একটা ভারী বোঝা তার ওপর চাপিয়ে দিয়েছি এবং আমার অশ্রু দিয়ে অনুজ্জ্বল করে তুলেছি তার চোখ, ফলে সে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না। সে একজন ভাই যাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি কিন্তু সে অন্যান্য ভাইদের মতোই যে আমার দুঃখ ভাগাভাগি করে এবং সাহায্য করে অশ্রু ঝরাতে, যা আমার তিক্ততা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং দগ্ধ করে আমার হৃদয়।’
সেলমার কথা আমার হৃদয়কে ছুরিকাঘাত করে এবং আমার মনে হয় আমি এর চেয়ে বেশি আর সহ্য করতে পারব না। বৃদ্ধ তার কথা শুনছিল পীড়িত হৃদয় নিয়ে এবং কাঁপছিল যেভাবে বাতাসের মুখোমুখি কাঁপতে থাকে একটা বাতির আলো। তারপর সে তার হাতদুটো প্রসারিত করল এবং বলল, ‘হে আমার প্রিয় কন্যা, আমাকে শান্তিতে যেতে দাও। আমি খাঁচার শিকগুলো ভেঙে ফেলেছি। এখন আমাকে উড়তে দাও এবং এখন আমাকে থামিও না, কারণ তোমার মা আমাকে ডাকছে। আকাশ পরিচ্ছন্ন, সমুদ্ৰ শান্ত এবং নৌকা পাল তোলার জন্য প্রস্তুত, সুতরাং আমার যাত্রায় যেন বিলম্ব না হয়। আমার শরীরকে সেইসব শরীরের সঙ্গে বিশ্রাম নিতে দাও যারা ইতিমধ্যেই বিশ্রাম নিতে শুরু করেছে, আমার স্বপ্নকে সমাপ্ত হতে দাও এবং আমার আত্মাকে জাগরিত হতে দাও ভোরের সঙ্গে। তোমার আত্মাকে আলিঙ্গন করতে দাও আমাকে এবং আমাকে দাও আকাঙ্ক্ষার চুম্বন এবং এক ফোঁটা বেদনা বা তিক্ততাকে ঝরে পড়তে দিও না আমার শরীরের ওপর, পাছে ফুল এবং ঘাসেরা তাদের পরিচর্যাকে অস্বীকার করে। আমার হাতের ওপর দুর্গতির অশ্রু ঝরিও না, কারণ তারা আমার কবরের ওপর তুলে ধরতে পারে সিংহাসন। আমার কপালের ওপর ফুটিয়ে তুলোনা মর্মবেদনার রেখাচিত্র, কারণ বাতাস তা অতিক্রম করে যেতে এবং পড়ে ফেলতে পারে তাদেরকে এবং অস্বীকার করতে পারে তৃণভূমিতে বহন করে নিয়ে যেতে আমার আত্মার ধুলো।… আমি তোমাকে ভালোবাসতাম যখন আমি বেঁচেছিলাম এবং যখন আমি মারা যাব তখনও তোমাকে ভালোবাসব এবং আমার আত্মা সবসময় তোমাকে পর্যবেক্ষণ করবে এবং রক্ষা করবে তোমাকে।
তারপর ফারিস ইফান্দি তার আধা-খোলা চোখে আমার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘হে আমার পুত্র, সেলমার প্রকৃত ভাইয়ে পরিণত হও, যেমন তোমার পিতা হয়েছিলেন আমার বন্ধু। তুমি হও তার সাহায্যকারী ও প্রয়োজনের বন্ধু এবং তাকে কখনও বিলাপ করতে দিও না, কারণ মৃতের জন্য বিলাপ করা একটা ভ্রান্তি। বারবার বলো তাকে সেইসব গল্পগুলি যা মনোমুগ্ধকর এবং গেয়ে শোনাও তাকে জীবনের গানগুলি, যেন সে তার দুঃখগুলি ভুলে যেতে পারে। তোমার পিতার স্মৃতির ভেতরে আমাকে স্মরণ করো, তার কাছে জানতে চাও আমাদের যৌবনের গল্পগুলি এবং তাকে বলো আমি তার ছেলের ভেতর দিয়ে তাকে ভালোবেসেছি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।’
নীরবতা সাফল্যের সাথে টিকেছিল এবং আমি বৃদ্ধ লোকটির চেহারায় মৃত্যুর বিবর্ণতা দেখতে পেলাম। তারপর সে চোখ ঘুরিয়ে আমাদের দুজনকে দেখল এবং ফিসফিস করে বলল, ‘চিকিৎসককে ডেকো না, কারণ তিনি হয়তো ওষুধের সাহায্যে মৃত্যুর কারাগারে আমার দণ্ডাদেশ দীর্ঘায়িত করতে পারেন। দাসত্বের দিনগুলি শেষ হয়েছে এবং আমার আত্মা আকাশের স্বাধীনতা অনুসন্ধান করে এবং যাজককেও ডেকো না আমার বিছানার পাশে, কারণ তার উচ্চারিত মন্ত্র আমাদের রক্ষা করতে পারবে না যদি আমি পাপী হই, অথবা আমাকে তীব্রবেগে ছোটাতে পারবে না স্বর্গের দিকে যদি আমি নিষ্পাপ হই। মানবতার ইচ্ছা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে পরিবর্তন করতে পারে না, যেমন একজন জ্যোতির্বিদ পারে না নক্ষত্রের গতি পরিবর্তন করতে। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর চিকিৎসককে তা-ই করতে দিও যা তাদের ইচ্ছা হয়, কারণ আমার জাহাজের পাল ততক্ষণ তোলা থাকবে যতক্ষণ তা গন্তব্যে না পৌঁছায়।’
মধ্যরাতে ফারিস ইফান্দি তার ক্লান্ত চোখদুটি খুলল শেষবারের মতো এবং সেই চোখের আলো ফেলল সেলমার ওপর, যে হাঁটু গেড়ে বসেছিল তার বিছানার পাশে। সে কথা কলতে চেষ্টা করল কিন্তু পারল না কারণ মৃত্যু ইতিমধ্যেই তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দিয়েছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত সে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘রাত্রি কেটে গেছে সেলমা…আহ সেলমা… আহ্….. সেলমা…।’ তারপর সে মাথাটা বাঁকা করল তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল এবং শেষবার শ্বাস গ্রহণের সময় আমি তার ঠোঁটে একটা হাসি দেখতে পেলাম।
সেলমা তার পিতার হাত ধরল এবং এটা ছিল ঠাণ্ডা। তারপর সে তার মুখের দিকে তাকাল। এটা ছিল মৃত্যুর অবগুণ্ঠনে ঢাকা। সে এতটাই কষ্ট পেল যে কাঁদতে ভুলে গেল। এমনকি সে কোনো দীর্ঘশ্বাসও ফেলল না। এমনকি নড়াচড়াও করল না। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার শরীর নুয়ে পড়ল যতক্ষণ কপাল মেঝে স্পর্শ না করে এবং সে বলল, ‘হে ঈশ্বর, আমাদেরকে ক্ষমা করুন এবং মেরামত করুন ভাঙা ডানাগুলি।’
ফারিস ইফান্দি কারামি মারা গেল। তার আত্মাকে আলিঙ্গন করল অনন্তকাল এবং তার শরীর মাটিতে ফিরে গেল। মনসুর বেই গালিব তার সম্পদের মালিক হল এবং সেলমা পরিণত হল জীবনের বন্দিতে— দুর্গতি ও মর্মবেদনার একটি জীবন।
আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম বেদনার ভেতরে এবং জেগে উঠেছিলাম স্বপ্নের ভেতরে। দিন ও রাত্রিগুলি আমাকে কুরেকুরে খাচ্ছিল যেমন ঈগল খেয়ে ফেলে তার শিকারকে বহু সময় আমি চেষ্ট করেছি অতীত প্রজন্মের গ্রন্থ ও ধর্মপুস্তকের ভেতরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখতে আমার দুর্ভাগ্যকে ভুলে যাবার জন্য, কিন্তু এটা ছিল তেল নিয়ে আগুন নেভানোর মতো, কারণ আমি অতীতের মিছিলের ভেতর কিছুই দেখতে পেতাম না বিয়োগান্তক ঘটনা ছাড়া এবং শুনতে পেতাম না কিছুই কান্না ও হাহাকার ছাড়া। স্তুতিগীতির চেয়ে বাইবেলের প্রাচীন নিয়ম ছিল আমার কাছে অধিক আকর্ষণীয় এবং আমি অধিক পছন্দ করি চিরবিরহের শোকগাথা থেকে শুরু করে সলোমনের গান পর্যন্ত। হ্যামলেট ছিল আমার হৃদয়ের কাছাকাছি পাশ্চাত্যের অন্যান্য নাটকের চেয়ে। কিন্তু হতাশা আমাদের দৃষ্টিশক্তি দুর্বল করে দিয়েছে এবং বন্ধ করে দিয়েছে আমাদের কান। আমরা কিছুই দেখতে পাই না মৃত্যুর অপচ্ছায়া ছাড়া এবং কেবলই শুনতে পাই আমাদের বিক্ষুব্ধ হৃদয়ের স্পন্দন।
৮. যিশু খ্রিস্ট এবং ইসতার-এর মাঝখানে
পাহাড় এবং বাগানের মাঝখানে অবিস্থত ছোট্ট মন্দিরটি বৈরুত শহরের সঙ্গে লেবাননের যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। মন্দিরটা ছিল খুবই প্রাচীন। এটা নির্মিত হয়েছিল মাটি খুঁড়ে বের করা সাদা পাথর দিয়ে এবং অলিভ, কাঠবাদাম ও উইলো গাছ ঘিরে রেখেছিল এই মন্দির। যদিও মন্দিরটা মূল সড়ক থেকে আধা মাইল দূরে অবস্থিত ছিল এবং আমার এই কাহিনীর সময় খুব কম সংখ্যক লোকই স্মৃতিচিহ্ন ও প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের প্রতি আগ্রহী ছিল। এটা ছিল লেবাননের অনেক লুকানো জায়গাগুলির মধ্যে একটি। নির্জনতার কারণে প্রার্থনাকারীদের কাছে এই মন্দির পরিণত হয়েছিল স্বর্গে এবং একাকিত্ব ভালোবাসে যারা তাদের জন্য এটা ছিল একটা তীর্থস্থান।
যে কেউ মন্দিরে প্রবেশ করলেই দেখতে পাবে পূর্বদিকের দেয়ালের ওপর একটা প্রাচীন ফিনিসীয় ভাস্কর্য খোদাই করা হয়েছে পাথরে এবং তাতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রেম ও সৌন্দর্যের ইসতারকে। ইসতার সিংহাসনে বসে আছে এবং তাকে ঘিরে আছে বিভিন্ন ভঙ্গিতে সাতজন নগ্ন কুমারী। প্রথমজন হাতে ধরে আছে একটা মশাল, দ্বিতীয় জনের হাতে গিটার, তৃতীয় জনের হাতে ধূপদানি, চতুর্থ জনের হাতে মদের পাত্র, পঞ্চম জনের হাতে একটা গোলাপ শাখা, ষষ্ঠ জনের গায়ে জড়ানো একটা জলপাই গাছ এবং সপ্তম জনের হাতে তীর-ধনুক এবং প্রত্যেকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে ইসতারের দিকে চেয়ে আছে।
দ্বিতীয় দেয়ালের ওপর অন্য একটা ছবি। প্রথমটার চেয়ে অনেক আধুনিক প্রতীকায়িত করছে ক্রুশবিদ্ধ যিশুকে এবং তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার বেদনার্ত মাতা ও মেরি ম্যাগডালিন এবং অন্য দুটি নারী- তারা কাঁদছে। এই বাইজানটাইন আমলের চিত্রটি সম্ভবত খোঁদাই করা হয়েছিল পনেরো অথবা ষোলো শতাব্দীতে।
মন্দিরের পশ্চিমদিকের দেয়ালে দুটি গোল আকৃতির নির্গমন পথ রয়েছে, যার ভেতর দিয়ে সূর্যরশ্মি মন্দিরে প্রবেশ করে, ছবিগুলিকে উত্তাপ দেয়, তখন মনে হয় সোনালি জলরঙে আঁকা মন্দিরের মাঝখানে একটা চারকোণা মর্মর পাথর রয়েছে এবং তার একপাশে রয়েছে কিছু পুরোনো ছবি, যার দু’একটার ভেতরে দেখা যায় শক্ত হয়ে যাওয়া রক্তের টুকরো এবং এটা থেকে বোঝা যায়, প্রাচীনকালে মানুষ এই পাথরের ওপর বলি দিত এবং ঢেলে দিত সুগন্ধি, মদ এবং তেল।
এই ছোট্ট মন্দিরে নীরবতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জীবন্তদের কাছে সারাক্ষণই এই মন্দির প্রকাশ করত ঈশ্বরীদের গোপনীয়তা এবং শব্দহীন ভাষায় বলে যেত অতীত প্রজন্ম এবং ধর্মের বিবর্তনের কথা। এই চমৎকার দৃশ্য কবিদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে এমন জগতে নিয়ে যেত যা বহু দূরবর্তী এবং সে যেখানে বসবাস করত এবং দার্শনিকেরা এমন মনোভাব পোষণ করত এখানে এসে যে, সে জন্ম থেকেই ধার্মিক। তারা একটা চাহিদা অনুভব করত যা তাদের কাছে দৃশ্যমান ছিল না এবং তাদের সামনে উত্তোলিত হত একটা প্রতীক, যার অর্থ ফাঁস করে দিত গোপন তথ্যগুলি এবং তাদের জীবন ও মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষাগুলিকে।
সেই অপরিচিত মন্দিরে প্রতিমাসে একবার আমি সেলমার সঙ্গে দেখা করতাম এবং সময় কাটাতাম তার সঙ্গে ঐসব বিস্ময়কর ছবি দেখে, ক্রুশবিদ্ধ যিশুর কথা চিন্তা করে এবং সেইসব ফিনিসীয় যুবক ও যুবতীদের কথা বিবেচনা করে, যারা বেঁচে থাকত, ভালোবাসত এবং প্রার্থনা করত ইসতারের সৌন্দর্যকে এবং তার মূর্তির সামনে তারা পোড়াত ধূপ এবং ঢেলে দিত সুগন্ধি।
সেইসব মুহূর্তের স্মৃতি শব্দ দিয়ে লেখা খুবই কঠিন, যখন আমি সেলমার সঙ্গে দেখা করতাম। সেই স্বর্গীয় সময় যা বেদনা, সুখ, দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা ও দুর্গতিতে পরিপূর্ণ।
আমরা সেই প্রাচীন মন্দিরে গোপনে মিলিত হতাম স্মরণ করতে পুরোনো দিনগুলি, আলোচনা করতে বর্তমান, ভয় পেতে ভবিষ্যৎকে এবং ক্রমে ক্রমে আমাদের হৃদয়ের গভীরতায় যে গোপনীয়তা লুকিয়ে আছে তাকে উন্মোচিত করতে এবং আমাদের দুর্গতি ও দুর্ভোগ সম্পর্কে পরস্পরকে অভিযোগ করতে এবং নিজেদেরকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করতে কাল্পনিক আকাঙ্ক্ষা ও বেদনার্ত স্বপ্ন দিয়ে। প্রায় সময়ই আমরা শান্ত হয়ে যেতাম এবং কাঁদতাম এবং তারপর হাসতে শুরু করতাম এবং ভুলে যেতাম ভালোবাসা ছাড়া সবকিছু। আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করতাম যতক্ষণ আমাদের হৃদয় গলতে শুরু না করত। তারপর সেলমা একটা চুম্বনের চিহ্ন এঁকে দিত আমার কপালে এবং আমার হৃদয় পরিপূর্ণ হয়ে উঠত পরমানন্দে। আমিও তার চুম্বন ফিরিয়ে দিতাম যখন সে তার গ্রীবা বাঁকাত এবং তার কপোল সামান্য লাল হয়ে উঠত যেভাবে পাহাড়ের কপাল সূর্যের প্রথম আলোয় ভোরবেলায় লাল হয়ে ওঠে। আমরা তাকিয়ে থাকতাম দিগন্তের দিকে যেখানে মেঘগুলি রঙিন হয়ে উঠত সূর্যাস্তের ছড়িয়ে পড়া কমলা রঙের রশ্মিতে।
আমাদের কথোপকথন শুধুমাত্র ভালোবাসার ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। আমরা সাম্প্রতিক বিষয়েও মতবিনিময় করতাম। কথোপকথনকালে সেলমা কথা বলত সমাজে নারীদের অবস্থান, অতীত প্রজন্ম যে ছাপ রেখে গেছে তার চরিত্রে, স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক এবং আধ্যাত্মিক অসুখ ও দূর্নীতি সম্পর্কে যা বিবাহিত জীবনকে হৃমকির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি মনে করতে পারি তার কথা : ‘কবি ও লেখকরা উপলব্ধি করতে চেষ্টা করছে নারীদের বাস্তবতা, কিন্তু বর্তমান সময়ে তারা উপলব্ধি করতে পারে, না তাদের হৃদয়ের লুকানো গোপনীয়তা, কারণ তারা যৌন অবগুণ্ঠনের পেছন থেকে তাদের দিকে তাকায় এবং কিছুই দেখতে পায় না শুধু বাহ্যিক আকার-আকৃতি ছাড়া, তারা নারীর দিকে তাকায় ঘৃণার ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাসের ভেতর দিয়ে এবং দুর্বলতা ও আত্মসমর্পণ ছাড়া তারা কিছুই দেখতে পায় না।
অন্য এক ঘটনায় সে মন্দিরের দেয়ালের ছবির দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘এইসব শিল্পীর হৃদয় দুটো প্রতীক চিত্রায়িত করছে, নারীর আকাঙ্ক্ষার সুগন্ধ এবং প্রকাশ করছে তার আত্মার লুকানো গোপনীয়তা, যা বেদনা ও ভালোবাসার ভেতরে চলাচল করছে— ভালোবাসা ও ত্যাগের মাঝখানে এবং সিংহাসনে বসে থাকা ইসতার ও ক্রুশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেরীর মাঝখানে। পুরুষ ক্রয় করে গৌরব ও খ্যাতি কিন্তু নারীরা শুধু মূল্যই দিয়ে থাকে।
মন্দিরে এই গোপন সাক্ষাৎ সম্পর্কে কেউই জানত না ঈশ্বর ও মন্দিরের ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখির ঝাঁক ছাড়া। সেলমা একটা বাহনে চড়ে আসত পার্ক পর্যন্ত। তারপর সে হেঁটে মন্দিরে আসত, যেখানে এসে সে দেখতে পেত আমি চিন্তিতভাবে তার জন্য অপেক্ষা করছি।
আমরা কোনো দর্শকের চোখকে ভয় পেতাম না, আমল দিতাম না কোনো নীতিচেতনাকে। যে আত্মা আগুনে শুদ্ধ হয়েছে এবং ধৌত হয়েছে চোখের জলে তা মানুষের কথিত লজ্জা ও অবমাননার চেয়ে অধিক উচ্চতর। এটা দাসত্বের আইন থেকে মুক্ত এবং মানুষের হৃদয়ের মমত্বের বিরুদ্ধে এটা একটা প্রাচীন প্রথা। সেই আত্মা গর্বের সঙ্গে কোনোরকম লজ্জা ছাড়াই দাঁড়াতে পারে ঈশ্বরের সিংহাসনের সামনে।
মনুষ্যসমাজ সত্তর শতাব্দী ধরে প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন হয়েছে আইনকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলার জন্য যতক্ষণ তা উৎকৃষ্টতা ও চিরন্তন আইনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে না। যে মানুষের চোখ মোমবাতির অনুজ্জ্বল আলোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সে সূর্যালোক দেখতে পারে না। আধ্যাত্মিক অসুখ এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম উত্তরাধিকার সূত্রে পায় যতক্ষণ পর্যন্ত তা মানুষের অংশে পরিণত না হয়। কে এদিকে তাকায় অসুখ হিসেবে নয় প্রাকৃতিক উপহার হিসেবে, যা ঝরে পড়েছিল ঈশ্বর কর্তৃক আদমের ওপর। সেইসব মানুষ যদি দেখতে পায় কাউকে যে এই জীবাণু থেকে মুক্ত, তাহলে সে লজ্জা ও অপমানের সঙ্গে তার সম্পর্কে চিন্তা করবে।
সেলমা সম্পর্কে কিছু কিছু লোক খারাপ চিন্তা করে, কারণ সে তার স্বামীর গৃহ পরিত্যাগ করেছে এবং আমার সঙ্গে গোপনে মন্দিরে সাক্ষাৎ করে। ফলে তাদের রোগাক্রান্ত দুর্বল মন বিদ্রোহী হতে সাহসী হত না। তারা হল সেই সব কীটপতঙ্গের মতো যারা অন্ধকারে হামাগুড়ি দেয় এই ভয়ে যে—কোন পথিক তাদেরকে পায়ের চাপে পিষে ফেলতে পারে।
নিপীড়িত একজন বন্দি তার কারাগারের শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারে কিন্তু তা যে করে না—সে একজন কাপুরুষ। সেলমা হচ্ছে নিষ্পাপ ও নিপীড়িত বন্দি, দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে সে অক্ষম। সে কি অভিযুক্ত হবে? কারণ সে কারাগারের জানালার ভেতর দিয়ে সবুজ শস্যক্ষেত ও প্রশস্ত আকাশ দেখে। লোকজন কি তাকে স্বামীর প্রতি অবিশ্বস্ত বলে গণ্য করবে, কারণ সে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে যিশু ও ইসতার-এর মাঝখানে বসার জন্য। লোকজনের যা ইচ্ছা তা-ই বলতে দাও, সেলমা যে জলাভূমি অতিক্রম করে যায়, যেখানে নিমজ্জিত অন্যান্য আত্মারা এবং তারা এমন একটা পৃথিবীতে অবতরণ করে যেখানে নেকড়ের হুঙ্কার এবং সাপের খসখসানি পৌঁছাতে পারবে না। জনগণ বলতে পারে তারা আমার সম্পর্কে কী জানতে চায়, কারণ যে আত্মা মৃত্যুর অপচ্ছায়া দেখেছে চোরের মুখমণ্ডল নিয়ে সে ঐশ্বরিক হতে পারে না, যে সৈনিক তার মাথার ওপর অস্ত্রের ঝলকানি দেখেছে এবং পায়ের তলায় দেখেছে রক্তের স্রোত, সে পরোয়া করে না তার দিকে রাস্তায় শিশুদের পাথর নিক্ষেপ করা।
৯. বিসর্জন
জুন মাসের শেষদিকে কোনো একদিন শহরের লোকেরা গ্রীষ্মের উত্তাপ এড়ানোর জন্য পাহাড়ের উদ্দেশ্যে শহর পরিত্যাগ করল। আমি যথারীতি মন্দিরে গিয়েছিলাম সেলমার সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে নিয়েছিলাম একটা আন্দালুসীয় কবিতার বই। মন্দিরে পৌঁছে আমি সেলমার জন্য বসে বসে অপেক্ষা করছিলাম। মাঝে মাঝে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম বইয়ের পাতায়, আবৃত্তি করছিলাম সেইসব কবিতা যা আমার হৃদয়কে পরিপূর্ণ করে তুলছিল এবং আমার আত্মায় বহন করে আনছিল রাজা, কবি ও নাইটদের স্মৃতি, যারা গ্রানাডাকে বিদায় জানিয়েছিল এবং চোখে অশ্রুজল ও হৃদয়ে বেদনা নিয়ে পরিত্যাগ করেছিল প্রাসাদ, প্রতিষ্ঠান এবং পেছনের আকাঙ্ক্ষাগুলিকে। এক ঘণ্টার ভেতরেই লক্ষ্য করলাম সেলমা বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে আসছে, মন্দিরের কাছাকাছি এসে সে তার ছাতাটা বন্ধ করল। তার মুখ দেখে মনে হল সে পৃথিবীর যাবতীয় দুশ্চিন্তা বহন করছে তার কাঁধে। সে মন্দিরে প্রবেশ করে আমার পাশে বসল। আমি তার চোখে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম এবং চিন্তিত হলাম এ ব্যাপার তাকে প্রশ্ন করা যাবে কিনা।
সেলমা অনুভব করল আমার ভেতরে কী চলাচল করছিল। সে আমার মাথায় হাত রাখল এবং বলল, ‘কাছে এসো, আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, এসো এবং আমার তৃষ্ণা মেটাতে দাও, কারণ পৃথক হওয়ার সময় এসে গেছে।’
আমি তাকে জিজ্ঞাস করলাম, ‘তোমার স্বামী কি আমাদের সাক্ষাতের ব্যাপারে জেনে গেছে?’ সে উত্তর দিল, ‘আমার স্বামী আমাকে পরোয়াই করে না। এমনকি সে জানেও না কীভাবে আমি আমার সময় কাটাই। কারণ সে সেইসব গরিব মেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত, দারিদ্র্য যাদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গেছে অশ্লীল খ্যাতির গৃহে, সেইসব মেয়ে যারা রুটির বিনিময়ে শরীর বিকিয়ে দেয়। রক্ত এবং অশ্রু দিয়ে হাতে বানানো রুটি।’
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী তোমাকে প্রতিরোধ করছে মন্দিরে আসতে এবং আমার পাশে বসতে শ্রদ্ধাশীলভাবে ঈশ্বরের সম্মুখে? তোমার আত্মা কি অনুরোধ করছে আমাদের পৃথক হওয়ার জন্য?’ সে অশ্রুসজল চোখে উত্তর দিল, ‘না, তুমি আমার অত্যন্ত পছন্দের মানুষ। আমার আত্মা পৃথকীকরণের কথা বলে নাই, কারণ তুমি হলে আমার অংশ। তোমার দিকে তাকিয়ে থেকে আমার চোখ কখনও ক্লান্ত হয় না, কারণ তুমিই হলে তাদের আলো, কিন্তু যদি নিয়তি তাকে শাসন করে তাহলে আমার উচিত জীবনের এবড়োথেবড়ো পথে চলা যা বেড়ি ও হাতকড়ায় বোঝাই হয়ে আছে। আমি কি তৃপ্ত হব যদি তোমার ভাগ্য আমার মতো হয়?’ তারপর সে আরও বলল, ‘আমি সবকিছু বলতে পারি না কারণ আমার জিভ ব্যথায় নিথর হয়ে আছে এবং তা কথা বলতে পারে না। ঠোঁটগুলিও দুর্গতির কারণে সিলমোহরকৃত এবং তা নড়াচড়া করতে পারে না— সবই আমি তোমাকে বলতে পারি, কিন্তু আমার ভয় তুমিও আমার মতো একই ফাঁদে পড়তে পারো।’
তারপর আমি বললাম, ‘তুমি কী বলছ সেলমা এবং কাকে তোমার ভয়?’ সে দুহাতে মুখ ঢাকল এবং বলল, ‘বিশপ ইতিমধ্যেই জেনে গেছে যে, মাসে একবার আমি সেই কবর পরিত্যাগ করছি যেখানে সে আমাকে সমাহিত করেছিল।’
আমি জানতে চাই, ‘বিশপ কি আমাদের সাক্ষাৎ সম্পর্কে জানতে পেরেছে?’ সে বলল, ‘তা যদি জানত তাহলে আমাকে তোমার কাছে বসা অবস্থায় দেখতে পেতে না, কিন্তু সে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছে এবং তার ভৃত্য ও প্রহরীদেরকে বলে দিয়েছে আমার ওপর খুব কাছে থেকে লক্ষ্য রাখতে। তাদের আঙুলগুলি নির্দেশ করছে আমাকে এবং তাদের কানে শুনছে আমার চিন্তার ফিসফিসানি।’
সে কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে থাকল এবং তারপর আবার বলতে শুরু করল, ‘বিশপের ব্যাপারে আমি ভীত নই, যার ডুবে মরার মতো অবস্থা সে কি ভিজে যেতে ভয় পায়? আমি ভীত তোমাকে নিয়ে, তুমি ফাঁদে পড়ে যেতে পারো এবং পরিণত হতে পারো শিকারে। তুমি এখনও যুবক এবং সূর্যালোকের মতোই স্বাধীন। আমি সেই ভাগ্য নিয়ে মোটেই ভীত নই যা তার সবগুলি তীর ছুড়েছে আত্মার বক্ষে, কিন্তু আমি ভীত যে সাপ তোমার পা কামড়াতে পারে। বিলম্ব ঘটাতে পারে পাহাড়চূড়ায় পৌঁছাতে যেখানে ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তোমার জন্য আনন্দ ও গৌরবকে সঙ্গে নিয়ে।’
আমি বললাম, ‘যাকে আলোর সাপ কখনও কামড়ায়নি এবং অন্ধকারের নেকড়ে যার শরীর ছিন্নভিন্ন করেনি সে দিন ও রাত্রির কাছে সবসময়ই প্রতারিত হবে। কিন্তু সেলমা মনোযোগ দিয়ে শোনো, পৃথকীকরণ কি মানুষের খারাপ কাজ ও মনের সংকীর্ণতা এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়? ভালোবাসা ও স্বাধীনতার সবগুলি পথ কি বন্ধ হয়ে গেছে এবং কিছুই পরিত্যক্ত হয়নি মৃত্যুর দাসদের ইচ্ছার কাছে পরাভূত হওয়া ছাড়া?
সে বলল, ‘কিছুই পরিত্যক্ত হয় না পৃথকীকরণ ছাড়া এবং পরস্পর পরস্পরকে বিদায়-সম্ভাষণ জানায়।’
বিদ্রোহী আত্মার মতো আমি তার হাত ধরলাম এবং উত্তেজিতভাবে বললাম, ‘দীর্ঘসময় ধরে আমরা মানুষের ইচ্ছাকে প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপাদন করেছি, যখন আমাদের দেখা হল সেই সময় থেকে এখন পর্যন্ত আমাদেরকে নেতৃত্ব দিয়েছে অন্ধরা এবং প্রার্থনা করেছে বেদির সামনে। যখন তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয় আমরা তখন ছিলাম বিশপের হাতের মুঠোয় দুটি বলের মতো, যা তিনি ইচ্ছামতো যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে ছুঁড়েছেন। আমরা কি তার ইচ্ছাকে জমা করতে যাচ্ছি মৃত্যু আমাদেরকে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত? ঈশ্বর কি আমাদের জীবনের শ্বাস-প্রশ্বাস দান করেন মৃত্যুর পাখার নিচে স্থাপন করতে? তিনি কি আমাদেরকে স্বাধীনতা দেন একে দাসত্বের ছায়ায় পরিণত করতে? যে তার আত্মার আগুনকে নিজ হাতে নেভায় সে স্বর্গের চোখে একজন নাস্তিক, কারণ স্বর্গ সেই আলো স্থাপন করেছে যে আমাদের আত্মার ভেতরে জ্বলে। যে নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি সে নিজেই অন্যায় করছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি সেলমা এবং তুমিও আমাকে ভালোবাসো এবং ভালোবাসা হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ, এটা হচ্ছে ঈশ্বরের উপহার সংবেদনশীল মানুষ ও বৃহত্তম আত্মার জন্য। আমরা কি এসব সম্পদ দূরে নিক্ষেপ করব এবং শূকরদেরকে দেব তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলতে এবং পায়ে মাড়াতে? এই পৃথিবী সৌন্দর্য ও বিস্ময়ে পরিপূর্ণ। কেন আমরা সেই সংকীর্ণ গুহায় বসবাস করছি যা বিশপ ও তার সহকারীরা আমাদের জন্য খনন করছে? জীবন হচ্ছে সুখ ও স্বাধীনতায় পরিপূর্ণ। কেন তুমি তোমার কাঁধ থেকে এই ভারী জোয়াল নামিয়ে ফেলছনা এবং ভেঙে ফেলছনা আমাদের পায়ের শৃঙ্খল এবং স্বাধীনভাবে হেঁটে যাচ্ছ না শান্তির দিকে? উঠে পড়ো এবং চলো এই ছোট মন্দির পরিত্যাগ করে আমরা ঈশ্বরের বিশাল মন্দিরের দিকে যাই। চলো আমরা এই দেশ, এর যাবতীয় দাসত্ব এবং অজ্ঞতাকে পরিত্যাগ করে অন্য কোনো দূরবর্তী দেশে যাই, চোরদের হাত যেখানে পৌঁছতে পারে না। চলো আমরা রাত্রির আচ্ছাদনের নিচে সমুদ্রতীরে যাই এবং একটা নৌকা জোগাড় করি যা আমাদেরকে সমুদ্র অতিক্রম করে নিয়ে যাবে সেইখানে, যেখানে আমরা একটা নতুন জীবন খুঁজে পাব যা সুখ ও উপলব্ধিতে পরিপূর্ণ। দ্বিধা কোরো না সেলমা, কারণ এই মুহূর্তগুলি আমাদের কাছে খুবই মূল্যবান রাজমুকুটের চেয়ে এবং অধিক উচ্চতম শ্রেণীর দেবদূতদের সিংহাসনের তুলনায়। চলো আমরা আলোর স্তম্ভ অনুসরণ করি যা আমাদেরকে শুকনো মরুভূমি থেকে সেই শস্যক্ষেতের দিকে নিয়ে যায় যেখানে জন্মায় ফুল এবং ঝাঁঝালো উদ্ভিদ।’
সেলমা মাথা ঝাঁকাল এবং মন্দিরের ছাদে কিছু একটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল যা দৃশ্যমান নয়, তার মুখমণ্ডলে আবির্ভূত হল বেদনা মেশানো হাসি, তারপর সে বলল, ‘না, না প্রিয়তম। স্বর্গ আমার হাতে একটা কাপ স্থাপন করেছে যা সিরকায় পরিপূর্ণ এবং তার স্বাদ খুবই তিক্ত। আমি জেনেশুনেই নিজেকে বাধ্য করেছি তা পান করতে যতক্ষণ তলানিতে কয়েক ফোঁটা ছাড়া আর কিছুই না থাকে, যা আমি পান করব ধৈর্যের সঙ্গে। ভালোবাসা ও শান্তির নতুন জীবন আমার প্রাপ্য নয়, জীবনের আনন্দ ও মধুরতা গ্রহণের জন্য আমি যথেষ্ট শক্তিশালীও নই, কারণ ভাঙা ডানা নিয়ে একটা পাখি প্রশস্ত আকাশে উড়তে পারে না। মোমবাতির অনুজ্জ্বল আলোয় যে চোখ অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সূর্যের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকানোর ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। আমার কাছে সুখের কথা বোলোনা; এর স্মৃতি আমাকে কষ্ট দেয়। শান্তির কথাও আমাকে বোলোনা, এর ছায়া আমাকে ভীত করে তোলে কিন্তু আমার দিকে তাকাও এবং আমি তোমাকে দেখাব সেই পবিত্র মশাল স্বৰ্গ যা জ্বালিয়েছে আমার আত্মার ছাইভষ্মের ওপর- তুমি জানো একজন মা যেভাবে তার শিশুকে ভালোবাসে আমি তোমাকে সেরকম ভালোবাসি এবং ভালোবাসাই শুধুমাত্র আমাকে শিখিয়েছে তোমাকে রক্ষা করতে, এমনকি আমার কাছ থেকেও। এটা হচ্ছে ভালোবাসা, আগুনে পরিশুদ্ধ এবং এই ভালোবাসাই আমাকে থামায় দূরবর্তী ভূমি পর্যন্ত তোমাকে অনুসরণ করতে। ভালোবাসা আমার আকাঙ্ক্ষাকে হত্যা করে যেন তুমি পূতপবিত্র ও স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারো। সীমাবদ্ধ ভালোবাসা প্রেমাস্পদের অধিকার সম্পর্কে জানতে পায়, কিন্তু সীমাহীন ভালোবাসা শুধুই নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। যৌবনের ছলাকলাহীনতা ও জাগরণের ভেতর থেকে ভালোবাসা আসে অধিকার দিয়ে একে তৃপ্ত করতে এবং আলিঙ্গনের ভেতরে তা বেড়ে ওঠে। কিন্তু ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে মহাশূন্যের কোলে এবং অবতরণ করেছে রাত্রির গোপনীয়তার সঙ্গে সঙ্গে এবং তা তৃপ্ত নয় অনন্তকাল ও অমরত্ব ছাড়া এবং ভালোবাসা শ্রদ্ধাশীলভাবে দাঁড়ায় না কোনোকিছুর সামনে একমাত্র ঈশ্বর ছাড়া।
‘যখন আমি জানতে পারলাম যে বিশপ চায় আমি যেন তার ভাতিজার বাড়ি ছেড়ে না যাই এবং সে আমার একমাত্র আনন্দকে ছিনিয়ে নিতে চায়, তখন আমি আমার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়ালাম এবং সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগলাম এর ওপরের বিশাল দেশ এবং প্রকৃত ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্পর্কে যা সেখানে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আমি অনুভব করলাম যদি আমি তোমার কাছাকাছি বসবাস করতাম, তোমার আত্মার ছায়া ঘিরে রাখত আমাকে এবং ডুবিয়ে দিত তোমার ভালোবাসার সমুদ্রে। কিন্তু এসব চিন্তাভাবনা যা একজন নারীর হৃদয়কে আলোয় উদ্ভাসিত করে তোলে, বিদ্রোহী করে তোলে প্রাচীন প্রথার বিরুদ্ধে, বেঁচে থাকে স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের ছায়ার ভেতর এবং তাকে বিশ্বাস করায় যে আমি দুর্বল এবং আমাদের ভালোবাসা সীমাবদ্ধ ও নিস্তেজ যা সূর্যের সম্মুখে দাঁড়াতে অক্ষম। আমি একজন রাজার মতো কাঁদলাম যার সমস্ত সাম্রাজ্য এবং ধনভাণ্ডার অন্যায়ভাবে দখল করা হয়েছে, কিন্তু আমি তাৎক্ষণিকভাবে আমার অশ্রুর ভেতর দিয়ে তোমার মুখের দিকে তাকালাম এবং তোমার চোখ আমার দিকে তাকিয়েছিল এবং আমি স্মরণ করলাম একসময় তুমি যা আমাকে বলেছিলে (এসো সেলমা, এসো আমরা প্রচণ্ড ঝড়ের মুখোমুখি শক্তিশালী হয়ে উঠি। এসো আমরা সাহসী সৈনিকের মতো দাঁড়াই শত্রুর মুখোমুখি এবং মোকাবেলা করি অস্ত্রকে। যদি আমরা মারা যাই, তাহলে মারা যাব শহীদ হিসেবে এবং যদি আমরা জয়লাভ করি তাহলে বেঁচে থাকব বীরের মতো। সাহস, বাধা এবং কঠোর পরিশ্রম, পিছু হটা ও প্রশান্তির চেয়ে অধিকতর মহৎ)। এসব কথা তুমি বলেছিলে যখন মৃত্যুর পাখা আমার পিতার ওপর স্থির হয়ে ভেসেছিল। গতকাল আমি কথাগুলো স্মরণ করেছিলাম যখন হতাশার পাখা আমার মাথার ওপর স্থির হয়ে ছিল। আমি নিজেকে শক্তিশালী করে তুলেছিলাম এবং অনুভব করেছিলাম যখন আমার কারাগারের অন্ধকারে কোনো এক ধরনের মূল্যবান স্বাধীনতা বিশ্রাম দিয়েছিল সমস্যাগুলিকে এবং দূর করেছিল দুঃখগুলো। আমি দেখেছিলাম যে আমাদের ভালোবাসা ছিল সমুদ্রের মতো গভীর এবং নক্ষত্রের মতো উচ্চতর এবং আকাশের মতো প্রশস্ত। আমি এখানে এসেছিলাম তোমাকে দেখতে এবং আমার দুর্বল আত্মার ভেতরে একটা নতুন শক্তি আছে, যা বৃহত্তর একজনকে অর্জনের উদ্দেশ্যে বিশাল কিছু উৎসর্গ করতে সক্ষম। এটা হচ্ছে আমার সুখের বিসর্জন, যেন তুমি পবিত্র ও মর্যাদাসম্পন্ন হতে পারো মানুষের চোখে এবং দূরবর্তী হতে পারো তাদের প্রতারণা ও যন্ত্রণা থেকে….
‘অতীতে আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন অনুভব করেছিলাম ভারী হাতকড়া আমাকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আজ আমি এখানে একটা নতুন সংকল্প নিয়ে এসেছি যা ঐ হাতকড়ার ওপর উচ্চহাসি হাসে এবং যাত্রাপথকে ছোট করে দেয়। আমি এই মন্দিরে অন্য সময় এসেছি একটা ঐশ্বরিক অপচ্ছায়ার মতো, কিন্তু আজ আমি এসেছি সেই সাহসী নারীর মতো যে বিসর্জনের অপরিহার্যতা অনুভব করে এবং জানে দুর্ভোগের মূল্য কতটুকু, একজন নারী যে একজনকে রক্ষা করতে চায় অজ্ঞ মানুষ ও নিজের আত্মার ক্ষুধা থেকে, যাকে সে ভালোবাসে। আমি তোমার পাশে কাঁপতে থাকা একটা ছায়ার মতো বসতে অভ্যস্ত, কিন্তু আজ আমি এখানে এসেছি তোমাকে দেখাতে আমার প্রকৃত আত্মা ইসতার ও যিশুখ্রিস্টের মাঝখানে।
‘আমি হলাম ছায়ার ভেতরে বেড়ে ওঠা একটা গাছ এবং আজ আমি আমার শাখাগুলি বিস্তৃত করি সূর্যালোকে কিছুক্ষণের জন্য শিহরিত হতে। আমি এখানে এসেছি তোমাকে বিদায় জানাতে, আমার অত্যন্ত পছন্দের মানুষ তুমি এবং আমার প্রত্যাশা আমাদের বিদায় সম্ভাষণ আমাদের ভালোবাসার মতোই বিশাল ও ভয়ংকর হবে। আমাদের বিদায় সম্ভাষণকে হতে দাও আগুনের মতো, যা সোনাকে বাঁকা করে ফেলবে এবং তাকে করে তুলবে অধিকতর উজ্জ্বল।’
সেলমা আমাকে কথা বলার অথবা প্রতিবাদ করার অনুমতি দিল না, কিন্তু সে আমার দিকে তাকাল, তার চোখ জ্বলজ্বল করছিল। তার মুখমণ্ডলে তখনও বজায় ছিল গাম্ভীর্য, দেবদূতের মতো সে নিজেকে নিক্ষেপ করল আমার ওপর যা সে আগে কখনও করেনি এবং তার মসৃণ বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরল আমাকে এবং একটা দীর্ঘ, গভীর ও উন্মত্ত চুম্বন এঁকে দিল আমার ঠোঁটের ওপর।
.
সূর্য ডুবে গেল। বাগান ও কুঞ্জবন থেকে অপসৃত হল শেষ আলোর রশ্মি। সেলমা মন্দিরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল এবং লক্ষ্য করতে লাগল মন্দিরের দেয়াল ও বাঁকগুলি, যেন সে তার চোখের আলো এইসব ছবি ও প্রতীকচিহ্নের ওপর ঢেলে দিতে চায়। তারপর সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল এবং যিশুর ছবির সামনে শ্রদ্ধশীলভাবে হাঁটু মুড়ে বসল এবং চুম্বন করল যিশুর পদযুগ এবং ফিসফিস করে বলল, ‘হে যিশু, আমি আপনার ক্রুশচিহ্ন পছন্দ করেছি এবং পছন্দ করেছি ইসতার এর সুখ ও আনন্দের পরিত্যক্ত পৃথিবীকে, পরিধান করেছি মাটির পোশাক এবং বাতিল করেছি জলপাই পাতার বেষ্টনী এবং নিজেকে ধৌত করেছি সুগন্ধির পরিবর্তে রক্ত ও অশ্রু দিয়ে। আমি পান করেছি তিক্ত স্বাদের সিরকা সেই কাপ থেকে যা মদ ও পুষ্পমধুর জন্য তৈরি। হে আমার ঈশ্বর, আপনার অনুসারীদের ভেতর থেকে আমাকে নেতৃত্ব দিন গালীল প্রদেশের দিকে যেতে, তাদের সঙ্গে, আপনি যাদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। তৃপ্ত হতে দিন তাদের দুর্ভোগের সঙ্গে এবং উল্লসিত হতে দিন তাদের বেদনার সঙ্গে।
তারপর সেলমা মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘এখন আমি অত্যন্ত সুখের সঙ্গে আমার অন্ধকার গুহায় ফিরে যাব যেখানে বীভৎস আত্মারা বসবাস করে। আমাকে সহানুভূতি দেখিও না এবং দুঃখ কোরো না আমার জন্য, কারণ যে আত্মা একবার ঈশ্বরের ছায়া দেখে সে কখনও ভীত হবে না দানবের প্রেতাত্মাকে দেখেও এবং যে আত্মা একবার স্বর্গের দিকে তাকায়, পৃথিবীর বেদনার মাধ্যমে সে কখনও কাছাকাছি আসবে না।’
এসব কথা বলার পর সেলমা প্রার্থনার স্থান পরিত্যাগ করল এবং আমি সেখানে থেকে গেলাম গভীর চিন্তার সমুদ্রের ভেতরে, শোষিত হলাম সেই পৃথিবীর দ্বারা যেখানে গুপ্ততথ্য প্রকাশিত হয় এবং যেখানে ঈশ্বর সিংহাসনে বসে থাকেন এবং দেবদূতরা লেখেন মানুষের কর্মকাণ্ড, আত্মারা আবৃত্তি করে জীবনের বিয়োগান্তক নাটক এবং স্বর্গের কনেরা গায় প্রেম, বেদনা ও অবিনশ্বরতার প্রশংসাসংগীত।
ইতিমধ্যে রাত্রি এল, যখন আমি মূর্ছা থেকে জেগে উঠলাম এবং নিজেকে দেখতে পেলাম বিভ্রান্ত অবস্থায় বাগানের মাঝখানে। পুনরাবৃত্তি করছি সেলমার উচ্চারিত শব্দাবলির প্রতিধ্বনি এবং স্মরণ করছি তার নীরবতা, কর্মকাণ্ড, গতিশীলতা, অভিব্যক্তি এবং তার হাতের স্পর্শ, যতক্ষণ আমি উপলব্ধি করতে না পারলাম তার বিদায় সম্ভাষণের অর্থ এবং বিষণ্নতার বেদনা। আমি ছিলাম অবদমিত এবং ভগ্নহৃদয়ের একজন মানুষ। প্রকৃতঅর্থে এটা ছিল আমার প্রথম আবিষ্কার সেই লোকগুলি সম্পর্কে, এমনকি যদি তারা স্বাধীনভাবে জন্মাত, কঠোর আইনের দ্বারা পরিণত হত দাসে পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের ফলে এবং সেই মহাশূন্যতা যা আমরা অপরিবর্তনীয় বলে কল্পনা করি তা আজ প্রাকৃতিক রীতিতে উৎপন্ন করছে আগামীকালের ইচ্ছা এবং গতকালের বশ্যতার কাছে আজকের ইচ্ছা— সেই রাত থেকে আমি চিন্তা করেছি আধ্যাত্মিক আইন সম্পর্কে যা সেলমাকে জীবনের চেয়ে মৃত্যুকে অধিক পছন্দ করতে সাহায্য করেছে এবং বহু সময় আমি উৎসর্গের সততা ও বিদ্রোহের সুখের ভেতরে তুলনা করেছি অনুসন্ধান করতে কোটি অধিকতর সৎ এবং অধিকতর সুন্দর, কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমি শুধুমাত্র একটি সত্যকে শোধন করে তুলতে পেরেছি সমস্ত বিষয়ের ভেতর থেকে এবং এই সত্য হচ্ছে আন্তরিকতা যা আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডকে সুন্দর ও মর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে।
এবং এই আন্তরিকতা ছিল সেলমা কারামির ভেতরে।
১০. উদ্ধার
পাঁচ বছর হল সেলমার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কোনো সন্তান হয়নি, আর এটা করা হয়েছে তার ও তার স্বামীর আধ্যাত্মিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করতে এবং দুটি অপছন্দনীয় আত্মাকে একসাথে বেঁধে ফেলতে।
সর্বত্রই বন্ধ্যা নারীর দিকে মানুষ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকায়, কারণ অধিকাংশ পুরুষেরই আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে বংশধরের মাধ্যমে সম্পর্ককে চিরস্থায়ী করা।
পৃথিবীতে এরকম মানুষও আছে যারা তার সন্তানহীন স্ত্রীকে শত্রু মনে করে। তাকে সে তীব্রভাবে ঘৃণা করে, কখনও কখনও পরিত্যাগ করে এবং অনেকে এরকম স্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে থাকে। মনসুর বেই গালিব ছিল সেই ধরনের মানুষ। বস্তুগতভাবে সে ছিল মাটির মতো, স্টিলের মতো ছিল কঠোর এবং লোভী ছিল কবরের মতো। সন্তানের আকাঙ্ক্ষা এবং সেই সন্তান তার নাম ও খ্যাতি বহন করবে একথা মনে হলে সে সেলমাকে ঘৃণা করত, তার সৌন্দর্য ও মধুরতা সত্ত্বেও।
গুহার ভেতরে যে গাছ বড় হয় সে গাছে কখনও ফল ধরে না এবং যে সেলমা জীবনের ছায়ায় বসবাস করত সে সন্তান ধারণ করতে পারে নাই…
নাইটিংগেল খাঁচার ভেতরে বাসা তৈরি করে না পাছে দাসত্বের বোঝা তার বাচ্চাদেরও বহন করতে হয়।… সেলমা ছিল দুর্গতির বন্দি এবং এটা ছিল স্বর্গের ইচ্ছা যে সে আরেকজন বন্দি তৈরি করবে না তার জীবনের ভাগীদার হতে। শস্যক্ষেতের ফুলেরা হল সূর্যের মমতা ও প্রকৃতির ভালোবাসার সন্তান এবং মানুষের সন্তান হল প্রেম ও মমতার পুষ্পগুলি।
ভালোবাসার সাহসিকতা এবং সমবেদনা কখনও রাস বৈরুতে অবস্থিত সেলমার চমৎকার বাড়ির ওপর কোনো কর্তৃত্ব করে নাই, তা সত্ত্বেও প্রতিরাতে সে হাঁটু গেড়ে বসে স্বর্গের সম্মুখে এবং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে একটা সন্তানের জন্য যার ভেতরে সে শান্তি ও সান্ত্বনা খুঁজে পাবে।… সে প্রার্থনা করত যতক্ষণ স্বর্গ তার প্রার্থনার জবাব না দিত।
শেষ পর্যন্ত গুহায় বিকশিত হওয়া বৃক্ষে ফল ধরল। খাঁচায় আবদ্ধ নাইটিংগেল তার পাখার পালক দিয়ে শুরু করল খাঁচার ভেতরে বাসা বাঁধতে।
সেলমা তার শৃঙ্খলিত বাহু বাড়িয়ে দিল স্বর্গের দিকে ঈশ্বরের মূল্যবান উপহার গ্রহন করতে এবং পৃথিবীতে আর কোনোকিছুই তাকে এর চেয়ে অধিকতর সুখী করতে পারত না একজন সম্ভাবনাময়ী মা হওয়ার পরিবর্তে…
সে চিন্তিতভাবে অপেক্ষা করতে থাকল। শুরু করল দিন গোনা এবং তাকিয়ে থাকল সেই সময়ের দিকে কখন স্বর্গের সবচেয়ে মিষ্টি গান, শিশুর কণ্ঠস্বর ঘণ্টা বাজাবে তার কানে…
সেলমার সন্তান প্রসবের সময় উপস্থিত হল। সে বিছানায় শুয়েছিল কষ্টকর বেদনার মাঝে, যেখানে জীবন ও মৃত্যু শুরু করেছিল মল্লযুদ্ধ। চিকিৎসক ও ধাত্রী প্রস্তুত ছিল একজন নতুন অতিথিকে পৃথিবীতে আনার ব্যাপারে সাহায্য করতে। শেষরাতের দিকে শুরু হল সেলমার সফল ক্রন্দন… একটা জীবন থেকে একটা জীবনকে আলাদা করার কান্না… কোনোকিছু না-থাকার শূন্যতার ভেতরে একটা ধারাবাহিক কান্না… একটা বিশাল শক্তির নীরবতার মুখোমুখি একটা দুর্বল শক্তির কান্না… এটা হল নিপীড়িত সেলমার কান্না যে জীবন ও মৃত্যুর পায়ের তলায় হতাশার ভেতরে শুয়ে আছে।
ভোরবেলায় সেলমা একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দিল। চোখ খুলে দেখল ঘরের সর্বত্রই হাসিমুখ। তারপর আবার তাকিয়ে দেখল তার বিছানায় জীবন ও মৃত্যুর তখনও মল্লযুদ্ধ চলছে। সে চোখ বন্ধ করে কেঁদে ফেলল, ‘আহ! আমার সন্তান।’ ধাত্রী কাপড় দিয়ে শিশুটাকে জড়িয়ে সেলমার কোলে দিল কিন্তু চিকিৎসক সেলমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল।
প্রতিবেশীদের ভেতরে উল্লাসধ্বনি গুঞ্জরিত হল। তারা ভিড় করে বাড়িতে এল। শিশুর পিতাকে অভিনন্দন জানাতে, উত্তরপুরুষের জন্মের কারণে, কিন্তু সেলমা ও তার শিশুর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়াতে থাকল…
ভৃত্যরা দ্রুত ছুটে গেল মনসুর বেই-কে খবরটা জানানোর জন্য। কিন্তু চিকিৎসকের দৃষ্টিতে ফুটে উঠল হতাশা।
সূর্য উপরে উঠে আসার পর সেলমা নবজাতককে তার বুকের ওপর তুলে নিল। নবজাতক চোখ খুলে প্রথম তার মাকে দেখল এবং তারপর চোখ বন্ধ করল শেষবারের মতো। চিকিৎসক সেলমার কাছ থেকে শিশুটিকে কেড়ে নিলেন, তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তারপর ফিসফিস করে নিজেকেই শোনালেন, ‘সে একজন প্রয়াত অতিথি।’
শিশুটি চলে গেল এবং অতিথিরা তখন বাড়ির বিশাল হলরুমে পিতার সঙ্গে নবজাতকের স্বাস্থ্য পান করতে ব্যস্ত ছিল এবং সেলমা চিকিৎসকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার শিশুটিকে আমায় আলিঙ্গন করতে দিন।’
শিশুটি মারা গিয়েছিল আর হলরুমে মদের পেয়ালার শব্দ কেবলই বাড়ছিল….
সে জন্ম নিয়েছিল ভোরবেলা এবং মারা গেল সূর্য ওঠার পর…
সে জন্ম নিয়েছিল একটা চিন্তার মতো এবং সে মারা গেল একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো এবং অদৃশ্য হয়ে গেল ছায়ার মতো।
মাকে শান্তি ও সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সে বেঁচে থাকল না।
তার জীবন শুরু হয়েছিল রাত্রিশেষে এবং শেষ হল দিনের শুরুতে, রাত্রির চোখ থেকে ঝরে পড়া একফোটা শিশিরের মতো এবং তা শুকিয়ে গেল আলোর স্পর্শে।
একটি মুক্তাকে তীরে বহন করে নিয়ে আসে স্রোতোধারা এবং তা ভাটার সঙ্গে প্রত্যাবর্তন করে সমুদ্রের গভীরতায়…
একট পদ্মফুল যা জীবনের মুকুল থেকে এইমাত্র ফুটেছিল এবং মৃত্যুর পায়ের তলায় তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে।
একজন প্রিয় অতিথি যার আবির্ভাবে সেলমার হৃদয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, তার প্রস্থান হত্যা করেছে তার আত্মাকে।
এই হচ্ছে মানুষের জীবন, জাতির জীবন, সূর্য, চন্দ্র ও নক্ষত্রের জীবন।
সেলমা চোখ খুলে চিকিৎসকের দিকে তাকাল এবং কেঁদে কেঁদে বলল, ‘আমার সন্তানটাকে দিন, আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে চাই। আমার সন্তানটা আমাকে দিন, আমি তার পরিচর্যা করতে চাই।’
চিকিৎসক তার দিকে তাকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আপনার শিশুটা মারা গেছে ম্যাডাম। ধৈর্য ধরুন।’
চিকিৎসকের এই কথা শুনে সেলমা বীভৎসভাবে চিৎকার করে উঠল। তারপর সে শান্ত হয়ে গেল এবং সুখী মানুষের মতো হাসল। তার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে সে কিছু একটা আবিষ্কার করেছে এবং সে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে আমার শিশুটা দিন। তাকে আমার কাছাকাছি নিয়ে আসুন এবং মৃত অবস্থায়ই তাকে দেখতে দিন।’
চিকিৎসক মৃত শিশুটিকে সেলমার হাতে তুলে দিলেন। সে তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে মৃত নবজাতকের উদ্দেশে বলল, ‘তুমি আমাকে নিয়ে যেতে এসেছ, তাইনা সোনামণি! তুমি আমাকে সেই পথ দেখাতে এসেছ যা তীরভূমির দিকে নিয়ে যায়। সোনামণি আমি এখানে। আমাকে নিয়ে চলো এবং এসো আমরা এই অন্ধকার গুহা পরিত্যাগ করি।’
এক মিনিটের ভেতরে সূর্যালোক জানালার পর্দা ভেদ করে পতিত হল বিছানায় পড়ে থাকা শান্ত দুটো শরীরের ওপর, যাকে পাহারা দিচ্ছে নীরবতার গভীর মর্যাদা এবং তাকে ঢেকে রেখেছে মৃত্যুর পাখাগুলি। চিকিৎসক অশ্রুসজল চোখে কক্ষ পরিত্যাগ করলেন এবং হলরুমে পৌঁছে দেখলেন উৎসব অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, কিন্তু মনসুর বেই কোনো কথা কলছে না অথবা কাঁদছেও না। ডান হাতে একটা মদের গ্লাস ধরে সে একটা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল।
… … … … …
দ্বিতীয় দিন সেলমাকে তার বিয়ের সাদা পোশাক পরিয়ে একটা কফিনে শোয়ানো হল। শিশুটিকে জড়ানো হল একটুকরো কাপড়ে। মায়ের বাহুই ছিল তার কফিন এবং তার কবর ছিল তার মায়ের প্রশাস্ত বক্ষদেশ। দুটো মৃতদেহ বহন করা হল একটা কফিনে এবং আমি শ্রদ্ধাশীলভাবে জনতার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। সেলমা ও তার নবজাতককে নিয়ে মিছিল চলেছে তাদের বিশ্রামের জায়গায়।
কবরস্থানে এসে বিশপ গালিব স্তবগান গাইতে শুরু করল। অন্য যাজকরা প্রার্থনা করছিল এবং তাদের মুখমণ্ডলে আবির্ভূত হল অজ্ঞতা ও শূন্যতার অবগুণ্ঠন।
কফিন কবরে নামানোর পর একজন ফিসফিস করে বলল, ‘জীবনে এই প্রথম দেখলাম এক কফিনে দুটো মৃতদেহ।’ অন্য একজন বলল, ‘আমার মনে হয় শিশুটা এসেছিল তার মাকে উদ্ধার করতে তার নির্দয় স্বামীর কাছ থেকে।
তৃতীয় একজন বলল, ‘মনসুর বেইকে দ্যাখো, সে স্থির দৃষ্টিতে আকাশ দেখছে, যেন তার চোখ কাঁচ দিয়ে তৈরি। তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে একই দিনে স্ত্রী ও সন্তানকে হারিয়েছে।’ চতুর্থ ব্যক্তি বলল, ‘তার চাচা, মানে বিশপ তাকে আগামীকালই আরও ধনী ও অধিক শক্তিশালী কোনো নারীর সঙ্গে তার বিয়ে দেবে।’
বিশপ ও অন্যান্য যাজকেরা ঈশ্বরের গুণকীর্তন করতে লাগল যতক্ষণ গোরখোদক কবরটাকে মাটি দিয়ে ভর্তি না করল। তারপর উপস্থিত সকলেই বিশপের কাছে এল এবং শেষ শ্রদ্ধা জানাল, কিন্তু আমি একা দাঁড়িয়ে থাকলাম সান্ত্বনা জানানোর মতো কোনো হৃদয় ছাড়াই।
প্রত্যেকেই চলে গেল একমাত্র গোরখোদক ছাড়া। সে বেলচা নিয়ে একটা নতুন কবরের কাছে দাঁড়িয়েছিল।
আমি তার কাছে গেলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমার কি মনে আছে ফারিস ইফান্দি কারামি-কে কোথায় সমাহিত করা হয়েছিল?’
সে এক মূহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকাল। তারপর সেলমার কবরের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘ঠিক ঐখানে। আমি তার কন্যাকেও একই জায়গায় রেখেছি। ঠিক তার ওপরে এবং তার কন্যার বুকের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে তার শিশুসন্তান। তারপর মাটি চাপা দিয়েছি।’
তারপর আমি বললাম, ‘এই গর্তের ভেতরে তুমি আমাকেও কবর দিয়েছ।’
গোরখোদক পপলার গাছের পেছনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর আমি আর নিজেকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। আমি সেলমার কবরের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম এবং কাঁদতে থাকলাম।