ভাঙা ঘোড়া

ভলিউম ১২ – ভাঙা ঘোড়া – তিন গোয়েন্দা – রকিব হাসান – সেবা প্রকাশনী

এইই, কিশোর, ইস্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ডাক দিলো মুসা আমান, পিনটু আলভারেজ কথা বলতে চায় তোমার সঙ্গে। সবে ছুটি হয়েছে ইস্কুল, বাইরে তারই জন্যে অপেক্ষা করছে রবিন আর কিশোর।

ওই নামের কাউকে চেনো বলে জানতাম না তো, রবিন বললো কিশোরকে।

ঠিক চিনি বলতে পারবো না এখনও, জবাব দিলো গোয়েন্দাপ্রধান। ক্যালিফোর্নিয়া হিস্টরি ক্লাবে মাঝে মাঝে দেখা হয়। তবে কথা বিশেষ বলে না। নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। মুসা, কি চায় ও?

কাছে এসে দাঁড়িয়েহে মুসা। জানি না। আমাকে অনুরোধ করলে তোমাকে বলতে, ইস্কুল ছুটির পর যেন তার সাথে দেখা করো, অবশ্য যদি তোমার সময় হয়। জরুরী কথা বলবে বলেই মনে হলো।

তিন গোয়েন্দার সাহায্য চায় নাকি?

শ্রাগ করলে মুসা। চাইতেও পারে।

চল তো, কি বলে শুনি। কোথায় দেখা করতে বলেছে?

খেলার মাঠে।

আগে আগে চললো কিশোর। ইস্কুল বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে এসে পড়লো শান্ত, নীরব একটা রাস্তায়। দুই ধারে গাছের সারি। শেষ মাথায় একটা গেট, ওটা দিয়ে যেতে হয় খেলার মাঠে। গায়ের জ্যাকেট টেনেটুনে নিলো ওরা। নভেম্বরের বিকেল। রোদেলা দিন, কিন্তু তারপরেও ঠাণ্ডা, নকনে বাতাস বইছে।

কই, পিনটু কোথায়? এদিক ওদিক তাকালো রবিন।

সর্বনাশ হয়েছে। নিমের তেতো ঝরলো মুসার কষ্ঠে। দেখো, কে।

গেটের ঠিক বাইরে হোট একটা হুডতোলা পিকআপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। এগুলোর ডাকনাম রাঞ্চ ওয়াগন, র্যাধের কাজে ব্যবহার হয়। চওড়া কাধ, গাট্টাগোট্টা একজন মানুষকে দেখা গেল গাড়ির সামনের বাম্পারের ওপর বসে থাকতে। মাথায় কাউবয় হ্যাট, গায়ে ডেনিম জ্যাকেট, পরনে নীল জিনস, পায়ে ওয়েস্টার্ন বুট। ওর পাশে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিপছিপে, লম্বা এক তরুণ। ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো, লম্বা, পাতলা নাক। পিকআপটার দরজায় সোনালি অক্ষরে বড় বড় করে লেখা রয়েছেঃ ডয়েল র‍্যাঞ্চ।

শুঁটকি টেরি! নাকমুখ কুঁচকে ফেললো রবিন। ও এখানে…

রবিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই ওদেরকে দেখে ফেললো লম্বা ছেলেটা, বলে উঠলো, বাহ, শার্লক হোমস এসে গেছে দেখি। সঙ্গে দুই চেলাও আছে।

খিকখিক করে গা জ্বালানো হাসি হাসলো তিন গোয়েন্দার চিরশত্রু টেরিয়ার ডয়েল। ধনী ব্যবসায়ীর বখে যাওয়া ছেলে সে। সুযোগ পেলেই ওদের পেছনে লাগে, জ্বালিয়ে মারে। নিজেকে খুব চালাক ভাবে, কিন্তু প্রতিবারেই হেরে যায় তিন গোয়েন্দার কাছে।

শুঁটকির টিটকারির জবাব না দিয়ে পারা যায় না, গেটের কাছে থমকে দাঁড়ালো কিশোর। ভোতা গলায় বললো, রবিন, ঘেউ ঘেউ করে উঠলো যেন কেউ?

কই, কোনো মানুষকে তো দেখতে পাচ্ছি না, শুঁটকির দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো রবিন।

মানুষ দেখছি না, তবে একটা দুর্গন্ধ পাচ্ছি, নাক কোঁচকালো মুসা। বোধহয় শুঁটকির।

রসিকতাটা বুঝলো কাউবয়, হেসে উঠলো। লাল হয়ে গেল টেরির মুখ। ঘূসি পাকিয়ে হুমকির ভঙ্গিতে এগোলো তিন গোয়েন্দার দিকে। এই সময় ডেকে উঠলো আরেকটা নতুন কন্ঠ, কিশোর পাশা, দেরি করে ফেললাম, সরি। একটা উপকার চাইতে এসেছি তোমার কাছে।

সুন্দর স্বাস্থ্য, কালো চোখ, কালো চুলওয়ালা একটা ছেলে বেরিয়ে এলো গেট দিয়ে। পিঠ এতো খাড়া করে হাঁটে যে যতোটা না লম্বা তার চেয়ে বেশি লম্বা মনে হয়। পরনে আঁটো পুরানো জিনস, পায়ে খাটো রাইডিং বুট, গায়ে ঢাললে সাদা শার্ট, জোড়াগুলো রঙিন সুতো দিয়ে সেলাই করা। কথায় কোনো টান নেই, তবে পোশাকেই বোঝা যায় পুরানো স্প্যানিশ জমিদারের রক্ত রয়েছে শরীরে।

কি উপকার? জানতে চাইলো কিশোর।

হেসে উঠলো টেরি। হা-হা, শার্লক, শেষমেষ চেঁড়োদের সঙ্গে মিশলে? লাল কাপড় দেখিয়ে ষড় খেদানো ছাড়া ওরা আর কি বোঝে? একটা উপকার অবশ্য করতে পারো। ঘাড়টা ধরে মেকসিকোতে ফেরত পাঠাতে পারো। উপকারটা আমাদের সবারই হয় তাহলে।

চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালো পিনটু। এতোই দ্রুত, অবাক করে দিলো টেরিকে, মুখের হাসি মুছে দিলো তার কঠিন কণ্ঠে বললো, কথাটা ফিরিয়ে নাও! আর মাপ চাও আমার কাছে।

শুঁটকির চেয়ে খাটো ছেলেটা, ওজনও কম হবে, কিন্তু পরোয়াই করলো না। মাথা তুলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে টেরির মুখোমুখি, একেবারে স্প্যানিশ জমিদার। কিংবা ডন।

পাগল!কললো বটে, কিন্তু হাসলো না টেরি। আমি মেকসিকানদের কাছে মাপ চাই না।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ঠাস করে টেরির গালে চড় মারলো ছেলেটা।

শয়তানের বাচ্চা! ভীষণ রাগে গাল দিয়ে উঠে এক ধাক্কায় ছেলেটাকে মাটিতে ফেলে দিলো টেরি। কিন্তু চোখের পলকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল পিনটু। আবার তাকে ফেলে দিলো টেরি। আবার উঠলো পিনট, আবার পড়লো। আবার উঠলো। টেরির শার্টের বুক খামচে ধরলো। তাকে ঠেলে রাস্তার দিকে নিয়ে চললো টেরি, এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, যেন আশা করছে কেউ এসে এই অসম লড়াইটা থামায়। চেঁচিয়ে বললো, এই, এই আেঁকটাকে সরাও তো…।

জেঁকটাকে সরানোর জন্যে নয়, অন্য উদ্দেশ্যে শার্টের হাতা গুটিয়ে আগে বাড়লো মুসা। হেসে উঠলো মোটা কাউবয়। লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো বাম্পার থেকে। পিনটুকে বললো, এই ছেলে, থামো। পারবে না ওর সাথে। অহেতুক মার খাবে আরও।

নাআআ!

তীক্ষ্ণ, কঠিন আরেকটা কণ্ঠ যেন চাবুকের মতো আছড়ে পড়ে জমিয়ে দিলো সবাইকে। কোনদিক থেকে এসেছে সে, উত্তেজনার মাঝে খেয়াল করেনি কেউ। পিনটুর একটা বড় সংস্করণ মনে হচ্ছে লোকটাকে। চেহারার মিল তো রয়েছেই, পোশাক-আশাকও অবিকল একরকম, শুধু পিনটুর চেয়ে লম্বা আর বয়েস কিন্তু বেশি এই যা। আর মাথায় একটা কালো সমব্রেরো হ্যাট রয়েছে। পাথর কুঁদে তৈরি যেন মুখ, কালো শীতল চোখ। কেউ এগোবে না, গর্জে উঠলো আবার লোকটা। ওরা লেগেছে, ওদেরকেই মীমাংসা করতে দাও।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে আবার ফিরে এলো কাউবয়, হেলান দিয়ে দাঁড়ালো গাড়ির গায়ে। মুসাও দাঁড়িয়ে গেছে। চেয়ে রয়েছে রবিন আব কিশোর। জ্বলন্ত চোখে সবার ওপর একবার চোখ বুলিয়ে আবার পিনটুর দিকে তাকালে টেরি। রাস্তায় নেমে গেছে দুজনে। টেরির শার্ট ছেড়ে দিয়েছে পিনটু। ঘুসি তুলে এগিয়ে গেল তাকে মারার জন্যে।

বেশ, সেঁড়ো, দেখাচ্ছি মজা! বলে ঘেঁকিয়ে উঠলো টেরি।

র‍্যাঞ্চ ওয়াগনের একটু দূরে আরেকটা গাড়ি পার্ক করা। মাঝখানের খালি জায়গায় বাধলো লড়াই। হঠাৎ লাফিয়ে পিছিয়ে গেল টেরি, ভালোমতো সই করে একটা ঘুসি ঝাড়ার জন্যে।

সরো! সরো। একসাথে চেঁচিয়ে উঠলো রবিন আর মুসা।

পিছিয়ে একেবারে রাস্তার মাঝে চলে গেছে টেরি। খেয়ালই করেনি গাড়ি আসছে। চোখ পিনটুর দিকে। টায়ারের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ শোনা গেল। ব্রেক কষেছে ড্রাইভার, কিন্তু বাঁচাতে পারতো না টেরিকে, যদি সময়মতো ডাইভ দিয়ে না পড়তে পিনটু। করে এক প্রচণ্ড ধাক্কায় টেরিকে সরিয়ে দিলো গাড়ির সামনে থেকে। তাকে নিয়ে গিয়ে পড়লো মাটিতে।

ক্ষণিকের জন্যে নিশ্চল হয়ে পড়ে রইলো দুটো দেহ। চেঁচামেচি করে ছুটে গেল দর্শকরা।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো পিনটু, হাসিমুখে। টেরিও উঠলো। ক্ষতি হয়নি তারও।

পিনটুর পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলো মুসা। গাড়ি থেকে নেমে তাড়াহুড়ো করে ছুটে এলো ড্রাইভার। পিনটুকে বললো, দারুণ হেলে তো হে তুমি? তা কোথাও লাগেনি তো?

মাথা নাড়লো পিনটু। ওকে ধন্যবাদ দিয়ে টেরির দিকে এগোলো ড্রাইভার। তার খোঁজখ নিলো। যখন দেখলো কারোরই কোনো ক্ষতি হয়নি, আবার গিয়ে উঠলো গাড়িতে। চলে গেল। টেরি তখনও পা ছড়িয়ে বসে আছে। কাঁপছে মৃদু মৃদু। চেহারা ফ্যাকাসে।

এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে টান দিলো তার কাউবয় সঙ্গী। ওঠো! অল্পের জন্যে বেঁচেছে। ওঠো!

ও…ও আমাকে বাঁচালো। বিড়বিড় করলো টেরি।

কি মনে হয় তোমার? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা। ধন্যবাদ দাও ওকে।

থ্যা-থ্যাংকিউ, পিনটু,কাপা গলায় বললো টেরি। শু

ধু থ্যাংকিউ? কড়া গলায় বললো পিনটু। আর কিছু না?

দ্বিধায় পড়ে গেল টেরি। আর আবার কি?

আর? কেন ভুলে গেছো মাপ চাওয়ার কথা? জলদি মাপ চাও। নইলে এসো, দেখি, আবার হয়ে যাক এক হাত।

ছেলেটার দিকে দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবে চেয়ে রইলো টেরি।

কি হলো? ভুরু নাচালো পিনটু। কথা বলছো না কেন? কথা ফিরিয়ে নাও। আর মাপ চাও।

লাল হয়ে গেল টেরির গাল। বেশ, তাতে যদি খুশি হও-ফিরিয়ে নিলাম আমার কথা…

হাত তুললো পিনটু। ঠিক আছে, আর মাপ চাইতে হবে না। এমনিতেই মাপ করে দিলাম। বলে ঘুরে দাঁড়ালো সে।

এই, শোনো…,বলতে ঝলতেই টেরির চোখ পড়লো তিন গোয়েন্দার হাসিমুখের দিকে, তার দিকে তাকিয়েই হাসছে। রাগে লাল হয়ে গেল মুখ। ঝটকা দিয়ে ঘুরে গটমট করে এগোলো র‍্যাঞ্চ ওয়াগনের দিকে। ডরি! হেঁকে বললো কাউবয়কে, আদেশের সুর, চলো!

পিনটুর দিকে তাকালো এবার ডরি। তারপর তার পাশে দাঁড়ানো কঠিন চেহারার লোকটার দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, কাজটা ঠিক করোনি তোমরা। এজন্যে পস্তাতে হবে।

র‍্যাঞ্চ ওয়াগলে টেরির পাশে উঠে বসলো ডরি। গাড়ি স্টার্ট দিলো।

ডরির হুমকি তখনও যেন কানে বাজছে তিন গোয়েন্দার। দেখলো, চলন্ত ওয়াগনটার দিকে তাকিয়ে আছে পিনটু, চোখে বিতৃষ্ণা।

এই অহংকারই সর্বনাশ করলো আমাদের! দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তার অন্তর থেকে বেরিয়ে এলো ক্ষোভটা।

না, পিনটু, প্রতিবাদ করলো লম্বা লোকটা, এটা অহংকার নয়। আত্মসম্মানজ্ঞান। আলভারেজদের গর্ব।

তিন গোয়েন্দার সঙ্গে লোকটার পরিচয় করিয়ে দিলো পিনটু, আমার ভাই, রিগো। বর্তমানে আমাদের পরিবারের কর্তা। ভাইয়া, এরা হলো আমার বন্ধু, কিশোর পাশা, মুসা আমান, আর রবিন মিলফোর্ড।

ছেলেদের দিকে তাকিয়ে সামান্য একটু মাথা নোয়ালো রিগো। বয়েস পঁচিশের বেশি নয়, পরনের কাপড়-চোপড়ও পুরানো কিন্তু তবু আচার-আচরণই স্পষ্ট বলে দেয় এককালে বড় জমিদার ছিলো বাপ-দাদারা। বললো, তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

ডা নাদা! বলে স্প্যানিশ কায়দায় বাউ করলো কিশোর।

বাহ্! এই প্রথম হাসি ফুটলো রিগোর মূখে। তুমি স্প্যানিশ জানো?

একআধটু চৰ্চা করি ইস্কুলে, কিছুটা লজ্জিত কণ্ঠেই বললো কিশোর। তবে তেমন পারি না। আপনাদের মতো করে বলার তো প্রশ্নই ওঠে না।

স্প্যানিশ কলার দরকার নেই আমাদের সঙ্গে, ভদ্রতা করে কললো রিগো। আমরা নিজেরা যখন কথা বলি দেশী ভাষায়ই বলি। কিন্তু এখন আমরা আমেরিকারও নাগরিক, তোমাদেরই মতো, কাজেই ইংরেজিও আমাদের ভাষা কলা চলে।

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো কিশোর, তার আগেই অধৈর্য হয়ে হাত নাড়লো মুসা, বলে উঠলো, আচ্ছা, পস্তাবে বলে শাসিয়ে গেল কেন কাউবয়টা?

ওই এমনি বলেছে, বিশেষ পাত্তা দিলো না রিগো, কথার কথা। পিনটুর কণ্ঠে অস্বস্তি ফুটলো, কিন্তু ভাইয়া, মিস্টার ডয়েল…

থাক থাক বাধা দিয়ে বললো রিগো, আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যা ওটা। অন্যকে বিরক্ত করার দরকার নেই।

কোনো গোলমাল হয়েছে? জিজ্ঞেস করলো কিশোর। কিছু করেছে ডরি আর টেরিয়ার?

না, না, তেমন কিছু না।

ভাইয়া, প্রতিবাদ জানালো পিনটু, আমাদের র‍্যাঞ্চ চুরি করে নিয়ে যেতে চাইছে, আর একে তুমি কিছু না বলহো!

হাঁ হয়ে গেল রবিন আর মুসা। রবিন বললো, তোমাদের র‍্যাঞ্চ? মুসা বললো, করে কিভাবে?

কথা শুদ্ধ করে বলবে, পিনটু, বললো তার ভাই। চুরি শব্দটা ঠিক হয়নি।

কোন শব্দটা হলে ঠিক হতো? ফস করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

দ্বিধায় পড়ে গেল যেন রিগো। মুখ ফসকে বলে ফেলেছে, এখন বাকিটা বলবে কিনা ভাবছে যেন। শেষে বলেই ফেললো, কয়েক মাস আগে আমাদের পাশের র‍্যাঞ্চটা কিনেছেন মিস্টার ডয়েল। তারপর আশেপাশে যত বড় বড় র‍্যাঞ্চ আছে সব কিনে ফেলবেন ঠিক করেছেন। আমার বিশ্বাস জমির ওপর টাকা খাটাচ্ছেন। আমাদের র‍্যাঞ্চটাও চাইছেন। অনেক টাকা দাম দিতে চেয়েছেন। কিন্তু আমরা বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় ভীষণ রেগে গেছেন তিনি।

তোমার শব্দ-চয়নও ঠিক হয়নি, হেসে বললো পিনটু। বরং বলো পাগলা ঘোড়া হয়ে গেছেন।

ভাইয়ের কথায় কান না দিয়ে বলতে থাকলো রিগো, বুঝেছে, আসলে আমাদের জমির দরকার খুব একটা নেই তার কাছে। তিনি চাইছেন অন্য জিনিস। পুরানো একটা ড্যাম আর রিজারভোয়ার রয়েছে আমাদের এলাকায়, নাম সান্তা ইনেজ ক্রীক। মিস্টার ডয়েরে বিশাল র‍্যাঞ্চের জন্যে পানি দরকার, তাই বাধ আর ওই দীঘিটা চায়। প্রথমে এসে কেনার প্রস্তাব দিলো আমাদের কাছে, রাজি হলাম না। আরও বেশি দাম দিতে চাইলো। তারপরও যখন রাজি হলাম না, আমাদের পুরানো দলিল ঠিক না বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করলো। পারলো না। আমাদের জমি আমাদেরই রইলো।

তখন অন্য পথ ধরলো ডয়েল, মিস্টার ডয়েলকে সৌজন্য দেখানোর ধার দিয়েও গেল না পিনটু। ডরিকে দিয়ে শেরিফকে বলে পাঠালো, প্রায়ই আমাদের র‍্যাঞ্চে আগুন লাগে। সেই আগুন নাকি তার র‍্যাঞ্চেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। বলে আমাদের লোক কম। আরও লোক রাখা দরকার যাতে ওরকম দুর্ঘটনা আর না ঘটতে পারে। রাগ চাপা দিতে পারলো না সে।

এই ডরিটাকে? রবিন জানতে চাইলো।

মিস্টার ডয়েলের র‍্যাঞ্চ ম্যানেজার, জানালো রিগো। মিস্টার ডয়েল হলেন গিয়ে ব্যবসায়ী মানুষ। র‍্যাঞ্চ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। তাই লোক রেখে চালাতে চাইছেন আমার মনে হয়।

ডরির কথা নিশ্চয় বিশ্বাস করেননি শেরিফ, মুসা আশা করলো। নইলে এতোদিনে হাতছাড়া হয়ে যেতো আপনাদের র‍্যাঞ্চ, তাই না?

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললো রিগো। কাগজ-পত্র সব ঠিক আছে বলেই কিছু করতে পারছে না। কিন্তু আমাদের টাকা নেই, কতোদিন ঠেকাবো? ট্যাক্স জমে গেছে অনেক। সেটা জেনে ফেলেছেন মিস্টার ডয়েল। কাউন্টিকে ফুসলাচ্ছেন যাতে নীলামে তোলে আমাদের জমি, তাহলে তিনি কিনে নিতে পারবেন। এখন যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্যাক্স ক্লিয়ার করতে হবে আমাদের…

ব্যাংকের কাছে বাধা দিয়ে টাকা ধার নিতে পারেন, কিশোর বললো।

হ্যাঁ, কিশোরের কথা সমর্থন করতে পারলো না মুসা, তারপর ব্যাংক এসে জমিটা নিয়ে নিক। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় ঝাপ দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছো।

না, তা কেন হবে? কিশোরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে তার পক্ষ নিলো রবিন। নিশ্চয় অনেক টাকা ট্যাক্স জমেছে। সেটা ব্যাংক দিয়ে দেবে। সেই টাকার ওপর কিছু সুদ ধরে কিস্তিতে শোধ দিতে কলবে জমির মালিককে। একবারে দেয়ার চেয়ে অল্প অল্প করে দেয়া অনেক সহজ, আর দেয়ার সময়ও পাওয়া যাবে।

তা ঠিক, রাগ ফুটলো রিগোর কণ্ঠে। কিন্তু কথা হলো আমাদের মতো বাইরের লোকদের ধার দিতে চায় না ক্যালিফোর্নিয়ার ব্যাংক। খাঁটি আমেরিকান না হলে বিশ্বাস করে না। জমি বন্ধক রেখে ট্যাক্সের জন্যে ধার আমরা নিয়েছি, আমাদেরই এক পুরানো বন্ধু, প্রতিবেশী, আমাদের মতোই মেকসিকান-আমেরিকান রডরিক হেরিয়ানোর কাছ থেকে। কয়েক দিনের জন্যে। টাকাটা শীঘ্রি শোধ করতে হবে। সে-কারণেই তোমার কাছে এসেছি, কিশোর পাশা।

আমার কাছে?

যেহেতু র‍্যাঞ্চ ছাড়ছি না আমরা, জায়গা আর বিক্রি করতে পারছি না। বিক্রি করার মতো জমিই নেই। যা আছে সেগুলো দিয়ে আমাদেরকে চলতে হবে। অনেক পুরুষ ধরে অনেক জিনিসপত্র কিনেছে আলভারেজরা, অনেক কিছু জমিয়েছে। এই যেমন আসবাবপত্র, ছবি, ভাস্কর্য, বই, পোশাক, যন্ত্রপাতি, আরও নানারকম জিনিস। আলভারেজদের ইতিহাসই বলা চলে ওগুলোকে। কিন্তু জমির চেয়ে তো বড় না, তাই ওগুলো বিক্রি করে ধারশোধ করবো ঠিক করেছি। পিনটুর কাছে শুনেছি, তোমার চাচা নাকি সব ধরনের পুরানো জিনিস কেনেন।

নিশ্চয়ই কেনেন, কিশোরের আগেই চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। আর যতো বেশি পুরানো জিনিস হয় ততো বেশি খুশি হন।

হ্যাঁ, কিশোর কললো, পুরানো হলে খুশি হয়েই কিনবেন। আসুন।

সত্যিই খুশি হলেন রাশেদ পাশা। মুসা আর কিশোরের মুখে শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে বললেন, তাহলে আর বসে আছি কেন? উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ।

কয়েক মিনিট পরেই স্যালভিজ ইয়ার্ডের একটা ট্রাক উত্তরে রওনা হলো। প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূল থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, পার্বত্য এলাকার দিকে চলেছে, আলভারেজদের র‍্যাঞ্চের দিকে। গাড়ি চালাচ্ছে ইয়ার্ডের কর্মচারী, ব্যাভারিয়ান ভাইদের একজন, বোরিস। পাশে বসেছেন রাশেদ পাশা আর পিনটু। ট্রাকের পেছনে চড়ে চলেছে কিশোর, মুসা, রবিন আর রিগো। নভেম্বরের বিকেলের রোদ এখনও মুছে যায়নি, তবে পর্বতের মাথায় কালো মেঘ জমতে আরম্ভ করেছে।

সেদিকে তাকিয়ে রবিন বললো, বৃষ্টি তাহলে নামবে মনে হয়। গত মে-এর পর থেকে এক ফোঁটা বৃষ্টিও হয়নি। সময় হয়েছে এখন। যখন তখন শুরু হতে পারে শীতের বর্ষণ।

কাঁধ ঝাঁকালো রিগো। মনে হয়। না-ও হতে পারে। গত কিছু দিন ধরেই দেখছি, মেঘ জমে, কেটে যায়, জমে আবার কেটে যায়। বৃষ্টি হলে ভালোই হতো। পানি দরকার। আমাদের দীঘিটা আছে বলে বেঁচে গেছি। ওটার পানিতেই চলে সারা বছর। তবে এবছর খরা পড়েছে বেশি, পানি একেবারে নিচে নেমে গেছে। শীঘ্রি বৃষ্টি হলে বিপদ হবে।

পথের পাশে শুকনো বাদামী অঞ্চল। মাঝে মাঝে ওক গাহ, সবুজ পাতাগুলো লালচে হয়ে আছে ধূলিতে।

সেদিকে তাকিয়ে বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো রিগো, একসময় এসবই ছিলো আলভারেজদের জায়গা। এদিকের উপকূল থেকে শুরু করে ওদিকে ওই যে ওই পর্বতের একেবারে গোড়া পর্যন্ত। বিশ হাজার একরের বেশি।

দ্য আলভারেজ হাসিয়েনডা, মাথা ঝাঁকিয়ে বললো রবিন। পড়েছি। স্পেনের রাজার কাছ থেকে এই জমি ভোগদখলের অনুমতি পেয়েছিলো আলভারেজরা।

হ্যাঁ, রিগো বললো। অনেক দিন ধরে এখানে আছি আমরা। প্রথম যে ইউরোপিয়ান মানুষটি ক্যালিফোর্নিয়ায় পা রাখেন তাঁর নাম হুয়ান ক্যাবরিলো। পনেরো শো বিয়াল্লিশ সালে এটা স্পেনের সম্পত্তি বলে দাবি করেন। কিন্তু তারও আগে থেকেই আমেরিকায় ছিলেন নিরো আলভারেজ। হারনানদো করটেজের সেনাবাহিনীতে একজন সৈনিক ছিলেন তিনি। করটেজের নাম নিশ্চয় অনেহো, পনেরোশো একুশ সালে দক্ষিণ মেকসিকোতে আজটেকদেরকে পরাজিত করেছিলেন যে বীর সেনাপতি।

খাইছে! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। তারমানে প্লাইমাউথ রকে খ্রীষ্টান তীর্থযাত্রীদের ঢোকারও একশো বছর আগের ঘটনা সেটা।

তাহলে আলভারেজরা ক্যালিফোর্নিয়ায় এলো কবে? এই ইতিহাস শুনতে খুব ভালো লাগছে কিশোরের, আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো।

অনেক পরে, রিগো জানালো। ক্যাবরিলো ক্যালিফোর্নিয়ায় ঢোকার পর থেকেই ধীরে ধীরে স্প্যানিশ এই এলাকায় ঢুকতে আরম্ভ করলো। তবে ঠিকমতো বসতি জমাতে দুশো বছরেরও বেশি সময় লেগে গেল তাদের। এর কারণ, নিউ স্পেনের তৎকালীন রাজধানী মেকসিকো সিটি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অনেক দূরে। দুর্গম ছিলো তখন এই এলাকা, আর ভয়ংকর ছিলো এখানকার ইনডিয়ানরা। শুরুর দিকে তো স্থলপথে এখানে আসতেই পারতো না স্প্যানি, আসতো সমুদ্রপথে।

ক্যালিফোর্নিয়াকে তখন দ্বীপ মনে করতো স্প্যানিশরা, তাই না? কিশোর কলো।

মাথা ঝাঁকালো রিগো।। তারপর, সতেরোশো ঊনসত্তর সালে স্থলপথে এক অভিযান চালালেন ক্যাপ্টেন গ্যাসপার ডা পরটোলা। উত্তরে এগোতে এগোতে তিনি পৌঁছে গেলেন স্যান দিয়েগোতে। আমাদের পূর্বপুরুষ লেফটেন্যান্ট ডারিগো আলভারেজ ছিলেন তখন তাঁর সঙ্গে। সান ফ্রানসিসকো বে-এর অনেক জায়গা ঘুরে ঘুরে দেখলেন পরটোলা। তারপর সতেরোশো সওর সালে মনটেরোতে বসতি স্থাপন করলেন। ওই সময়ই রকি বীচকে চোখে লেগে গিয়েছিলো ডারিগোর। ঠিক করলেন, এখানেই বসতি করবেন। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রভিনশিয়াল গভার্নমেন্টের কাছে দরখাস্ত করলেন জায়গা চেয়ে। অনুমতি পেলেন সতেরোশো চুরাশি সালে।

আমার তো ধারণা ছিলো স্পেনের রাজা তাকে জমি দিয়েছেন, মুসা কললো।

মাথা ঝাঁকালো রিগো। একদিক থেকে তা-ই করা হয়েছে আসলে। নিউ স্পেনের সমস্ত জায়গাই অফিশিয়ালি তখন রাজার সম্পত্তি। তাঁর পক্ষেই অনুমতিপত্র সই করতেন তৎকালীন মেকসিকো আর ক্যালিফোর্নিয়ার গভার্নার। ডারিগো পেলেন ফাইভ স্কোয়ার লীগস, অর্থাৎ বিশ হাজার একরেরও বেশি। এতো জায়গা ছিলো, অথচ এখন আমাদের আছে মাত্র একশো একর।

বাকি জমি? জানতে চাইলো রবিন।

বাকি? বিষণ্ণ চোখে ট্রাকের পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া জমির দিকে তাকিয়ে রইলো রিগো এক মুহূর্ত। বোধহয় ঈশ্বরের বিচার! ইনডিয়ানদের কাছ থেকে তাদের জায়গা কেড়ে নিয়েছিলো স্প্যানিশরা; কাজেই ও-জমি তাদের দখলে থাকবে কেন? যাবেই। বছরের পর বছর আলভারেজদের সংখ্যা বেড়েছে, জমি ভাগাভগি হয়েছে। কিছু বিক্রি করেছে, কিছু কায়দা করে দখল করে নিয়েছে শরা, আর কিছু কেড়ে নিয়ে গেছে কলোনির উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা।

ধীরে ধীরে হোট থেকে ছোট হয়ে এলো আমাদের র‍্যাঞ্চ। কিন্তু জমিদারি মেজাজ আর অহংকার হাড়তে পারিনি আমরা। বড় বড় লোকদের সঙ্গে ছিলো আমাদের পূর্বপুরুষদের আত্মীয়তা। ক্যালিফোর্নিয়ার শেষ মেকসিকান গভার্নার পিও পিকো ছিলেন আমাদের আত্মীয়। বহু বহুর আগে করটেজের একটা মৃর্তি স্থাপিত হয়েছিলো আলভারেজদের জমিতে, এখনও সেটা আমাদের সীমানার মধ্যেই আছে।

মিষ্টার ডয়েল তাহলে আপনাদের এই শেষ সম্বলটুকু ছিনিয়ে নিতে চাইছেন, সহানুভূতি মিশিয়ে বললো মুসা।

এতো সহজে নিতে দেবো না, দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলো যেন রিগো। খুব একটা ভালো জায়গা নয় ওটা, ভালো তৃণভূমি নেই, ফসল ফলানো কঠিন। শুধু বাপ-দাদার জায়গা বলেই ভিটে আঁকড়ে পড়ে আছি। পড়ে থাকবো। ঘাস বেশি নেই বলে গরু তেমন পোষা যাচ্ছে না। তবে বিকল্প হিসেবে ঘোড়ার প্রজনন শুরু করেছি আমরা। অ্যাভোক্যাডো গাছ লাগিয়েছি। ছোটখাটো একটা তরকারীর খামারও করেছি। তারপরেও আমার বাবা আর চাচাকে গিয়ে শহরে নানারকম কাজ করতে হয়েছে র‍্যাঞ্চটা খাড়া রাখার জন্যে। এখন তারা নেই, মারা গেছে। র‍্যাঞ্চটা টিকিয়ে রাখতে হলে এখন আমাকে আর পিনটুকেও গিয়ে তাদের মতো কাজ করতে হবে।

কাউন্টি রোড ধরে চলেছে এখন ট্রাক। পাহাড়ী অঞ্চল। উত্তরে চলেছে ওরা। ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে পথ। হঠাৎ করেই যেন পাহাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ছড়ানো একটা সমতল জায়গায়। বাঁয়ে সামান্য মোড় নিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে গেছে এখন রাস্তাটা। মোড়ের কাছ থেকে আরেকটা কাছা রাস্তা বেরিয়ে গেছে ডানে।

সেই রাস্তাটা দেখিয়ে রিগো কললো, ডয়েল র‍্যাঞ্চে গেছে ওটা।

দূরে ডয়েল র‍্যাঞ্চ দেখতে পেলো গোয়েন্দারা, তবে বাড়িটার পাশে কোনো গাড়িটাড়ি চোখে পড়লো না। টেরি আর ডরি কি তাহলে ফেরেনি?

কাউন্টি রোডটা যেখানে মোড় নেয়া শেষ করেছে ওখানে একটা ছোট পাথরের ব্রিজ আছে। নিচে শুকনো খট খটে বুক চিতিয়ে রেখেছে যেন পাহাড়ী নালা, পানি নেই।

সান্তা ইনেজ ক্রীক, নালাটা দেখিয়ে বললো রিগো, আমাদের সীমানা এখান থেকে শুরু। বৃষ্টি না নামলে আর পানি আসবে না ওটাতে। ওটা ধরে মাইলখানেক উত্তরে বাঁধ। ওই ওদিকে।

কতগুলো শৈলশিরা দেখালো সে। বোঝালো বাধটা ওগুলোর ওপাশে। নালার অন্যপাশে রয়েছে একটা শিরা, কাউন্টি রোডের সঙ্গে তাল রেখে পাশাপাশি এগিয়ে গেছে। উত্তরের পর্বতের গায়ে গ্রিগুলো এমনভাবে বেরিয়ে রয়েছে, দেখে মনে হয় হাতের হুড়ানো আঙুল।

আঙুলগুলোর পাশ দিয়ে গেছে পথ। শেষ আঙুলের কাছে এসে হাত তুলে দেখালো রিগো। ওটার ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কালো বিশাল মূর্তি-ঘোড়ার পিঠে বসে আছে ঘোড়সওয়ার, একটা হাত এমন ভাবে তুলে রেখেছে, মনে হয় যেন পেছনের সেনাদলকে এগোনোর নির্দেশ দিচ্ছে।

মহাবীর কটেজ, গর্বের সঙ্গে বললো রিগো। আলভারেজদের প্রতীকই বলা চলে ওটাকে। আলভারেজ হীরো। দুশো বছর আগে বানিয়েছিলো ইনডিয়ানরা।

শেষ শিরাটা পেরোনোর পর আবার দেখা গেল সমভূমি। আরেকটা পাথরের বিজ পেরোতে হলো। নিচে গভীর খাদ, এটাও শুকনো।

আরেকটা নালা? জিজ্ঞেস করলো মুসা।

নালা হলে তো ভালোই হতো, রিগো বললো। এটার মেকসিকান নাম অ্যারোইও। জোর বৃষ্টি হলেই শুধু এসব অ্যারোইওতে পানি জমে। আর কোনো উৎস নেই।

আর উৎস মানে?

পর্বতের গা থেকে বেরোনো ঝর্নার কথা বলছি। সান্তা ইনেজ ক্রীকে যেমন আসে।

সান্তা ইনেজ ক্রীকেও না বললেন বৃষ্টি হলে পানি আসে?

হ্যাঁ, তাই তো। বৃষ্টি হলে পর্বতের ভেতরের ফাঁকফোকরে পানি ঢুকে যায়, ঝর্না হয়ে বেরিয়ে আসে আবার নিচের নালা বেয়ে। কিন্তু অ্যারোইওর মুখ বন্ধ থাকে বলে ঢুকতে পারে না।

ডানে মোড় নিয়ে একটা কাঁচা রাস্তায় নামলো ট্রাক। পথের দুপাশে এখানে অ্যাভোকাডো গাছ লাগানো। আরেকবার ডানে মোড় নিয়ে পথটা বেরিয়ে এলো একটা ছড়ানো, খোলা চত্বরের মতো জায়গায়।

সিয়েনডা অ্যালভারেজে স্বাগতম, নাটকীয় ভঙ্গিতে বললো রিগো। নিচের মাটিতে ধুলো জমে আছে। লাফ দিয়ে দিয়ে ট্রাক থেকে নামলো গোয়েন্দারা। লম্বা, নিচু হাতওলা একটা বাড়ি। দেয়ালে সাদা চুনকাম। কোটরে বসা চোখের মতো যেন ক্ষ দেয়ালের গভীরে বসে রয়েছে জানালাগুলো। লাল টালির ঢালু ছাত। কালচে বাদামী রঙের খুঁটি আর কড়িকাঠের ওপর ভর দিয়ে হাতটা এসে যেন ঝুলে রয়েছে বারান্দার ওপর। এই বাড়িটাই অ্যালভারেজদের হাসিয়েনডা। বাঁয়ে ঘোড়ার ঘর, এটারও হাত নিচু। অনেকটা গোলাঘরের মতো দেখতে। সামনে তারের বেড়া দিয়ে তৈরি করা হয়েছে কোরাল। মুরগীর খোয়াড়ের বাইরে যেমন দিনের বেলা চরে খাওয়ার জন্যে ঘেরা জায়গা থাকে, কোরালও অনেকটা এরকমই। কোরাল আর গোলাঘরের চারপাশে গজিয়ে উঠেছে বাকাচোরা ওকগাছ। নভেম্বরের এই মেঘলা বিকেলে সব কিছুই কেমন যেন মলিন, বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

হাসিয়েনডার পেছনে খানিক দূরেই দেখা গেল সেই অ্যারোইওটা, যেটা পেরিয়ে এসেছে ট্রাক। তার ওপাশে মাথা তুলে রেখেছে শৈলশিরাগুলো। হাত তুলে করটেজের মূর্তিটা চাচাকে দেখালো কিশোর।

ওটাও কি বিক্রি হবে? রিগোকে জিজ্ঞেস করে বসলেন রাশেদ পাশা কিছু না ভেবেই।

না না, রিগো মাথা নাড়লো। বিক্রির জিনিস রয়েছে গোলাঘরের ভেতরে।

কোরারে কাছে ট্রাক পিছিয়ে নিতে শুরু করলো বোরিস। অন্যেরা দ্রুত এগোলো ধুলো মাড়িয়ে গোলাঘরের দিকে। ভেতরে আলো খুব কম। একটা কাঠের হুকের মাথায় হ্যাটটা প্রায় ছুঁড়ে ফেললো রিগো, পারিবারিক রত্নগুলো ভালোমতো দেখার এবং দেখানোর জন্যে। হাঁ হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা।

লম্বা ঘরটার অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে ঘোড়া রাখার স্টল, আর কৃষিকাজের সাধারণ যন্ত্রপাতি। বাকি অর্ধেকটা গুদাম। মেঝে থেকে হাত পর্যন্ত জিনিসপত্রে বোঝাই। টেবিল, চেয়ার, ট্রাংক, আলমারি, লণ্ঠন, কাজের যন্ত্রপাতি, জমকালো পোশাক, তৈজসপত্র, গোসল করার ব্রিট গামলা আর আরও নানা জিনিস। দুই চাকার একটা রানো ঠেলাগাড়িও দেখা গেল। দেখে তিন গোয়েন্দার মতোই স্তব্ধ হয়ে গেছেন রাশেদ পাশাও।

অনেক ঘর ছিলো আলভারেজদের, জানালো রিগো। এখন অবশিষ্ট আছে মাত্র একটা হাসিয়েনডা। ওসব ঘরের প্রায় সমস্ত জিনিসপত্ৰই এনে রাখা হয়েছে এখানে।

সব কিনবো আমি! ঘোষণা করে দিলেন রাশেদ পাশা। এই দেখো দেখো! প্রায় চিৎকার করে বললো রবিন। পুরানো আরমার! একটা হেলমেট, একটা ব্রেস্ট-প্লেট …

…একটা তলোয়ার, একটা জিন! রবিনের কথাটা শেষ করলো মুসা। দেখো, জিনের গায়ে আবার রূপার কাজ!!

মালপত্রের মাঝে মাঝে সরু গলিমতো করে রাখা হয়েছে ভেতরে ঢোকার জন্যে। ঢুকে পড়লো তিন গোয়েন্দা। তালিকা তৈরি করার জন্যে সবে নোটবুক ব্বে করেছেন রাশেদ পাশা, এই সময় বাইরে শোনা গেল চিৎকার।

ভালো করে শোনার জন্যে কান পাতলে সবাই। আবার শোনা গেল চিৎকার। স্পষ্ট বোেঝা গেল এবার কি কলহেঃ আন্ন! আগুন!

আগুন লেগেছে! জিনিস দেখা বাদ দিয়ে দৌড় দিলো সবাই দরজার দিকে।

গোলাঘর থেকে ছুটে বেরোলো তিন গোয়েন্দা। হালকা ধোঁয়ার গন্ধ নাকে ঢুকলো। চত্বরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আর চিৎকার করছে দুজন লোক। রিগো! পিনটু! আগুন! ওই যে! বাঁধের কাছে।

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে রিগোর মুখ। কোরালে দাঁড়িয়েই দেখতে পেলো সবাই, উত্তরের শুকনো বাদামী পর্বতের ভেতর থেকে মেঘলা আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে ধোঁয়া। বিপদটা বুঝতে দেরি হলো না কারোই। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার ওসব পর্বতের ঢালে, খাড়িতে, গিরিপথের যেখানে সেখানে ঘন হয়ে জন্মায় মেসকিট আর চ্যাপাৱালের ঝোপ। প্রায় শুকিয়ে ঝনঝনে হয়ে আছে নিশ্চয় এখন। একটা ঝোপে আগুন লাগার মানেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা, এবং তার অর্থ দাবানল!

জলদি দমকল আর বনবিভাগকে খবর দাও! চেঁচিয়ে উঠলো দুজনের একজন। বেলচা! কুড়াল! জলদি!

দৌড়ে গিয়ে পারবো না! বললো আরেকজন। ঘোড়া লাগবে, ঘোড়া!

তারচে আমাদের ট্রাকে করে চলুনা পরামর্শ দিলো কিশোর। ঠিক! সায় জানালো রিগো। এই, বেলচা আর কুড়াল রয়েছে গোলাঘরে!

ট্রাক স্টার্ট দেয়ার জন্যে দৌড় দিলো বোরিস। অন্যেরা গোলাঘরের দিকে ছুটলো আগুন নেভানোর যন্ত্রপাতি আনতে। আগের মতোই বোরিসের পাশে উঠে বসলেন রাশেদ পাশা আর পিনটু। অন্যেরা টপাটপ লাফিয়ে উঠে পড়লো ট্রাকের পেছনে। ট্রাকের দুধার খামচে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো, যাতে উঁচু-নিচু জায়গায় চলার সময় আঁকুনিতে ছিটকে না পড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে দুজন লোকের পরিচয় করিয়ে দিলো রিগো, যারা চিৎকার করে আগুনের কথা জানিয়েছে।

আমাদের বন্ধু, পুয়ের্তে হুগো, আর ডা স্টেফানো, এক এক করে দুজনকে দেখালো রিগো। কয়েক পুরুষ ধরে হাসিয়েনডা আলভারেজে কাজ করছে। এই পথের ধারেই এখন বাড়ি করেছে দুজনে। শহরে কাজ করে। তবে অবসর সময়ে এখনও আমাদের র‍্যাঞ্চের কাজ করে দেয়।

দুজনেই বেঁটে। কালো চুল। খুব ভদ্রভাবে মাথা নুইয়ে সৌজন্য দেখালো তিন গোয়েন্দাকে। তবে চোখের উৎকণ্ঠা তাতে ঢাকা পড়লো না। ট্রাকের কেবিনের ওপর দিয়ে আবার ফিরে তাকালো ওরা আগুনের দিকে। রোদ-বাতাসে অল্প বয়েসেই ভাঁজ পড়েছে মুখের চামড়ায়, উদ্বেগে গভীর হলো সেগুলো। অস্বস্তিতে হাত ডললো পুরানো জিনসের প্যান্টের পেছনে।

সোজা উত্তরে ছুটেছে ট্রাক। ঘন হচ্ছে এখন ধোঁয়া। ঢেকে দিচ্ছে মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসা মলিন রোদকে। আগুনের দিকেই নজর, তবু, পথের পাশের সজী বাগানগুলো চোখ এড়ালো না ওদের। দক্ষিণের একটা মাঠের দিকে ছুট দিয়েছে একপাল ঘোড়া। শুরুতে অ্যারোইও আর শৈলশিরার পাশাপাশি চললো কাঁচা রাস্তাটা, তারপর পর্বতের কাছাকাছি এসে দুভাগ হয়ে গেল। আগুনটা ডান দিকে, তাই ডানের পথই ধরলো বোরিস। রুক্ষ এবড়োখেবড়ো পথে ঝাঁকুনি খেতে খেতে ছুটে চলেছে ট্রাক, ছড়িয়ে পড়া ধোঁয়া লক্ষ্য করে। বাঁক নিয়ে সোজা অ্যারোইওর দিকে এগিয়েছে পথ। হঠাৎ করেই যেন হোঁচট খেয়ে দাঁড়িয়েছে একটা পাথুরে শৈলশিরার গোড়ায়। খানিক দূরে শিরাটাও যেন আচমকাই শেষ হয়ে গেছে। এবং তার পরে ডানে একটা পুরানো পাথরের বধ, তার ওপ্র দিয়ে হুটলো টাক। বাধে নিচে সান্তা ইনেজ ক্রীকে শুকনো বুক দীর্ঘ বাঁক নিয়ে এগিয়ে গেছে দক্ষিণ-পুবে শৈলশিরার একেবারে দূরতম প্রান্তের কাছে। বাঁধের পেছনে রিজারভোয়ার অর্থাৎ রিগোর দীঘি, বড়জোর একটা পুকুর বলা চলে ওটাকে, পর্বতের পায়ের কাছে শুয়ে শুয়ে যেন ঝিমোচ্ছে ক্লান্তিতে। পুকুরের পাশ দিয়ে ঘুরে ছুটলো ট্রাক। সামনে লাফিয়ে ওঠা আগুনের শিখা চোখে পড়লো এতোক্ষণে।

থামো। থামো! কেবিরে জানালার পেছনে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো রিগো।

ঘ্যাচ করে ব্রেক কষলো বোরিস। এগিয়ে আসা আগুনের কাছ থেকে শখানেক গজ দূরে। লাফিয়ে নেমে পড়লো সবাই।

ছড়াও! ছড়িয়ে পড়ে! নির্দেশ দিলো রিগো। ঝোপের মাঝখানে কেটে দাও, আলাদা হয়ে যাক। বালি খুঁড়বে আগুনের ওপর। কোনোমতে ঠেলে পুকুরের দিকে নিয়ে যেতে পারলে বাঁচোয়া! জলদি ফ করো!

নালার দুই পাশেই আগুন জ্বলছে, অনেকটা অর্ধচন্দ্রাকারে। নিচে লাল আগুন, ওপরে কালো ধোঁয়ার একটা বিচিত্র দেয়াল যেন কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে আসছে, ছড়িয়ে পড়ছে দুপাশে। হড়াচ্ছে লাফ দিয়ে দিয়ে। এইমাত্র যেখানে দেখা যাচ্ছে সবুজ ঝোপ, পরমুহূর্তেই সেখানে লাল আগুন, দেখতে দেখতে পুড়িয়ে ছাই করে ফেলছে।

বাতাস কম, তাই রক্ষা! মুসা বললো।

নালার বাঁ দিকে ছুটে গেল তিন গোয়েন্দা। কুপিয়ে কেটে ফেললো ছোট ছোট গাহ, ঝোপ পরিষ্কার করে মাঝখানে একটা লম্বা গর্ত করে ফেললো, অনেকটা ট্রেঞ্চের মতো। মাটি নরম, কাটতে খুব একটা কে পেতে হলো না। খুঁড়ে তোলা মাটি ছিটিয়ে দিলো আগুনের ওপ্র।

আরি, দেখো! হাত তুলে দেখালো রবিন। শুঁটকি! আর ম্যানেজারটা!

লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটে আসছে টেরি আর ডরি। আরও লোক আসছে ওদের পেছনে। ডয়েলদের র‍্যাঞ্চ ওয়াগন আর আরও দুটো ট্রাকে করে এসেছে ওরা। হাতে কুড়াল, বেলচা। আগুনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলো ওরাও। কিশোর দেখলো এমনকি মিস্টার ডয়েলও চলে এসেছেন। হাত নেড়ে নেড়ে চেঁচিয়ে আদেশের পর আদেশ দিয়ে চলেছেন।

দুই র‍্যাঞ্চের দুটো দল, আগুন আর ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছে

ভালো করে, লড়ে চললো আগুনের সঙ্গে। মনে হলো কয়েক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। অথচ মেঘ আর ভাঙা ঘোড়া ধোঁয়ার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখা যাওয়া সূর্য দেখেই আন্দাজ করতে পারলো গোয়েন্দারা, সময় কেটেছে মাত্র আধ ঘণ্টা। ইতিমধ্যে পুরো কাউন্টিই যেন এসে হাজির হয়েহে আগুন নেভানোর জন্যে।

রাসায়নিক পদার্থ ভরা ট্যাংক আর বুলডোজার নিয়ে এসেছে বনবিভাগ। শেরিফের সহকারীরা হাত লাগিয়েহে আলভারেজ আর ডয়েলদের সঙ্গে। জোরালো এঞ্জিনের গর্জন তুলে আর ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে মাটি কাঁপিয়ে ছুটে এলো দমকলের গাড়ি। লাফিয়ে নামলো কর্মীরা। পাইপ খুলে নিয়ে দৌড় দিলো পুকুরের দিকে। পানি ছিটানো শুরু করলো আগুনের ওপর।

এলাকার আরও লোক ছুটে আসছে সাহায্য করতে। নালার দুই তীরেই অপেক্ষা করছে অনেকে, দুরে। ওদেরকে আনতে ছুটলো সিভিলিয়ানদের ট্রাকগুলো। বোরিস গেল একদিকে। ডয়েলদের ওয়াগন আর ট্রাকগুলো গেল দক্ষিণে কাউন্টি রোডের দিকে।

উড়ে এলো বনবিভাগের হেলিকপ্টার আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত বম্বার প্লেন। খুব নিচু দিয়ে উড়তে উড়তে আগুনের ওপর রাসায়নিক পদার্থ ছিটাতে লাগলো। পানিও ছিটাচ্ছে কোনো কোনোটা। কয়েকটা উড়ে গেল পর্বতের অন্যপাশে, আগুন ছড়িয়ে গেছে ওদিকেও। কয়েকটা উড়তে লাগলো দমকল-কর্মীদের ওপর, পানি ছিটিয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ভিজিয়ে চুপচুপে করে দিলো ওদের।

পরের একটা ঘন্টা ধরে চললো জোর লড়াই, মনে হচ্ছে সব বৃথা। আগুনকে পরাজিত করা যাবে না। ধোঁয়া আর আগুনের চাপে ক্রমেই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলো দমকল-কমীরা। তবে বাতাস কম থাকায় বেশিক্ষণ আর সুবিধে করতে পারলো না। আগুন। প্রতিপক্ষের চাপের মুখে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো একটু একটু করে। দাউ দাউ করে জ্বলতে জ্বলতে প্রথমে দ্বিধা করলো যেন কিছুক্ষণ, তারপর ঘন কালো ধোঁয়ায় আকাশ কালো করে দিয়ে কমতে আরম্ভ করলো। তবে খুব ধীরে।

থেমো না! চালিয়ে যাও! চেঁচিয়ে আদেশ দিলো দমকল বাহিনীর ক্যাপ্টেন। ঢিল পেলেই আবার লাফিয়ে উঠবে।

আরও দশ মিনিট পর বেলচায় ভর দিয়ে দাঁড়ালো কিশোর। হাত দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো। গালে এসে লাগলো কিছু। চেঁচিয়ে উঠলো সে, বৃষ্টি। বৃষ্টি! বৃষ্টি আসছে

একটা দুটো করে বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করলো। কাজ থামিয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালো কয়েকজন দমকলকর্মী। হঠাৎ করেই যেন ফাঁক হয়ে গেল আকাশের ট্যাংক, ঝমঝম করে নেমে এলো বারিধারা। ঘামে ভেজা, ধোঁয়ায় কালো মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আনন্দের হুল্লোড় বয়ে গেল নালার একমাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত। সেই চিৎকারকে ছাপিয়ে হিসহিস করে উঠলো আগুনের অন্তিম আর্তনাদ।

মাথার ওপর দুহাত তুলে দিয়েছে রবিন। মুখ আকাশের দিকে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, সে

য় নিচ্ছে হাত-মুখের কালি-ময়লা। ঝিলিক দিয়ে গেল বিদ্যুতের তীব্র নীল শিখা। বাজ পড়লো ভীষণ শব্দে। তারপর থেকে একটু পর পরই পড়তে লাগলো পর্বতের মাথায়।

পানিতে ধুয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়া, তবে এখনও কিছু কিছু ভাসছে এখানে ওখানে। মার খাওয়া কুকুরের মতো নেতিয়ে পড়ছে আগুন, শেষ ছোবল হানার চেষ্টা করছে পাথরের ফাঁকে ফাঁকে যেখানে বৃষ্টি সরাসরি পড়তে পারছে না সেসব জায়গায়। তবে ভঙ্গি দেখেই বোেঝা যায় সুবিধে করতে পারবে না আর।

বিপদ কেটেছে। সাহায্য করতে যারা এসেছিলো আস্তে আস্তে সরে পড়তে লাগলো তারা। বাকি কাজ শেষ করার দায়িত্ব রেখে গেল বনবিভাগ আর দমকল বাহিনীর ওপর।

সারা শরীরে কালি মাথা, ভিজে চুপচুপে হয়ে এসে পুকুরের পাড়ে দাঁড়ালো আলভারেজদের দল। ট্রাকে করে লোক নামিয়ে দিতে গেছে বোরিস, এখনও ফেরেনি।

কমে আসছে বৃষ্টি। শেষে গুঁড়ি গুঁড়িতে এসে স্থির হলো। কিছুটা পরিষ্কার হলো শেষ বিকেলের আকাশ।

চল, যাই, রিগো বললো। এক মাইলও হবে না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে হেঁটেই চলে যাই।

ক্লান্ত, ভেজা শরীর নিয়ে অন্যদের পেছন পেছন চলেছে তিন গোয়েন্দা। কিন্তু মনে সুখ, আগুনটা শেষ পর্যন্ত নেভাতে পেরেছে। বৃষ্টিতে ভিজে কাদায় প্যাঁচপ্যাঁচ করছে এখন কাঁচা রাস্তা, তার ওপর দিয়েই চলেছে মানুষ আর গাড়ির মিছিল, দক্ষিণে। সামনে মাথা তুলে রেখেছে উঁচু শৈলশিরা, যেটা শুকনো অ্যারোইও আর সান্তা ইনেজ ক্ৰীককে আলাদা করে রেখেছে।

ভিড় আর কাদার দিকে তাকালো রিগো, নিজের দলকে সরিয়ে নিয়ে এলো বায়ে। বললো, আরেকটা পথ আছে। এতে ভিড়ও নেই, কাদাও কম থাকবে, সহজেই চলে যেতে পারবো হাসিয়েনডায়।

বাঁধের কিনার দিয়ে হেঁটে উঁচু শৈলশিরার গোড়ায় একটা বড় ঢিবির কাছে চলে এলো ওরা। জংলা জায়গা, ঝোপঝাড় জন্মে রয়েছে। শৈলশিরার পশ্চিম অংশে অ্যারোইওর পথ রোধ করেছে এই টিবিটাই। প্রায় মুছে যাওয়া একটা পায়ে-চলা পথ চোখে পড়লো এখানে নেমে গেছে বাঁধের তিরিশ ফুট নিচে নালার বুকে। ওটাতে নামার আগে মুখ ফেরালো একবার সবাই, পেছনে দেখার জন্যে। বাঁধের দুধারে যতো দূর চোখ যায়, শুধু পোড়া ঝোপঝাড়। কিন্তু পুড়ে ছাই হয়ে মিশে গেছে মাটিতে, কিছু কালো ডাটা এখনও মাথা তুলে রেখেছে এখানে ওখানে।

গাছপালা নেই। পোড়া মাটি এখন পানি আটকাতে পারবে না, হুগো কললো গজর হয়ে। বৃষ্টি যদি বাড়ে, বন্যা হয়ে যাবে।

টিবির নিচের পথ ধরে নিচে নামতে আরম্ভ করলো দলটা। নালার বুকও এখন আর আগের মতো শুকনো নেই, কাদা হয়ে গেছে। অন্য পারে আরেকটা কাঁচা রাস্তা আছে, ওটা গেছে ডয়েল র‍্যাঞ্চের ভেতর দিয়ে। যানবাহন আর লোকের ভিড় ওটাতেও। কাউন্টি সড়কের দিকে ওই রাস্তা দিয়েই ফিরে চলেছে দমকল বাহিনী। ডয়েলদের র‍্যাঞ্চ ওয়াগনটাকে ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে যেতে দেখলো তিন গোয়েন্দা। কয়েকজন লোকের সঙ্গে পেহনে বসেছে টেরি। গোয়েন্দাদের দেখলো ঠিকই, কিন্তু সে-ও এতো পরিশ্রান্ত, টিটকারি মারারও বল পেলো না যেন। এমনকি তার গা জ্বালানো হাসিটা পর্যন্ত হাসলো না।

ওটা কি ডয়েলদের এলাকা? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

মাথা ঝাঁকালো রিগো। নালাটাই হলো সীমানা, এদিকটা আমাদের, ওদিকটা ওদের।

ডানে, উঁচু শৈলশিরা যেন হঠাৎ করে ডুব মেরেছে বালির তলায়। ওটার ওপাশে এখন কি আছে দেখা যায়। গোয়েন্দারা দেখলো, একসারি শৈলশিরা এগিয়ে গেছে দক্ষিণে। নালার বুক থেকে উঠে এসে মোড় নিলো রিগো। পায়েচলা পথটা এখানে ঘাসে ঢেকে গেছে। চলে গেছে কতগুলো ছোট পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, অনেকটা গিরিপথের মতো। এতে সরু, দুজন পাশাপাশি চলতে কষ্ট হয়। ফলে একসারিতে এগোলো দলটা। এখানে কিছু পোড়েনি, আগুন আসতেই পারেনি এ-পর্যন্ত। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে চললৈ তিন গোয়েন্দা। পাহাড়ের ঢালে জন্মে রয়েছে নানা জাতের ঝোপ। ফাঁকে ফাঁকে বেরিয়ে রয়েছে বাদামী পাথর। মাথার ওপরে এখনও ঝুলে রয়েছে যেন ছাড়া ছাড়া ধোঁয়া। বৃষ্টি থেমে গেছে পুরোপুরি। মেঘের ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেও থাকার সময় পানি আর সূর্য, প্রায় ডুবে গেছে।

আগে আগে হাঁটছে এখন মুসা। তার পাশে চলে এলো কিশোর। পায়েচলা পথ ধরে ওরা যখন শেষ শৈলশিরাটার ওপর উঠলো, দলের অন্যেরা তখন প্রায় বিশ গজ পেছনে পড়েছে।

খাইছে! কিশোওর! হঠাৎ করে ওপরে হাত তুলে দেখালো মুসা।

ওদের মাথার ওপরে ভেসে যাওয়া ধোঁয়ার ফাঁক থেকে বেরিয়ে আসছে একজন মানুষ। কালো একটা ঘোড়ার পিঠে বসা। গোধূলীর আলোয় হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে দুজনে। সামনের দুপা তুলে দিয়ে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে ঘোড়াটা সামনের খুর দিয়ে যেন লাথি মারতে চাইছে ধোঁয়াকে, মাথাটা…

আরে …আরে…, কথা আটকে যাচ্ছে কিশোরের, ও-ওটার মা-থা কই!

চূড়ার ওপর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক মুণ্ডুহীন ঘোড়া!

খাইছেরে! ভূউত! গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

দেখে মনে হচ্ছে ধোঁয়ার ভেতর থেকে এই বুঝি লাফিয়ে এসে ওদের ঘাড়ে পড়বে ঘোড়াটা।

তার জন্যে অপেক্ষা করলো না আর দুজনে, ঘুরেই দিলো দৌড়। চিৎকার শুনে ওদের দিকে ছুটে আসতে লাগলো রবিন আর পিনটু। পেছনে সরু পথে চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন রাশেদ পাশা, রিগো, হুগো আর স্টেফানো।

মাথা নেই! মাথা নেই! চেঁচালো আবার মুসা। ঘোড়া-ভূতটার মাথা নেই! এসো না! পালাও!

থমকে দাঁড়ালো রবিন। মুসার মাথার ওপর দিয়ে তাকালো ঘোড়াটার দিকে। ধোঁয়া পাতলা হয়ে এসেছে এখন। তাকিয়েই চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার।

কিশোর, ওটা, ওটা…, কথা শেষ করতে পারলো না রবিন।

হো হো করে হেসে উঠলো পিনটু। আরে কি শুরু করলে! ওটা তো মৃর্তি, করটেজের মূর্তি। ধোঁয়া ভাসছে, ফলে ধোঁয়ার ভেতরের মূর্তিটাকে মনে হচ্ছে নড়ছে।

অসম্ভব! কিছুতেই মানতে রাজি নয় মুসা। করটেজের মূর্তির ঘোড়ার মাথা ছিলো!

মাথা? তাজ্জব হয়ে গেল পিনটু। আরে, তাই তো! মাথা গেল কই! নিশ্চয় কেউ ভেঙে ফেলেছে! ভাইয়া, দেখে যাও!

অন্যদেরকে নিয়ে এসে হাজির হলো রিগো। ঘোড়টার দিকে তাকিয়ে বললো, আশ্চর্য। চল তো দেখি!

কাঠের মূর্তিটার কাছে এসে জড়ো হলো সবাই। এখনও হালকা ধোঁয়া উড়ছে ওটার ওপরে। বিশাল একটা গাছের কাণ্ড কুঁদে তৈরি হয়েছে ঘোড় আর মানুষের আস্ত ধড়টা, পুরোটাই একটা অংশ। হাত, পা, তলোয়ার আর জিন আলাদা তৈরি করে লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ওটার সঙ্গে। ঘোড়াটার শরীরের রঙ কালো, তাতে লাল আর হলুদের অলংকরণ করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ওখানটায় ঝুলে আছে উঁচু জিনের নিচের ঝালর। আরোহীর রঙও কালো। দাড়ি হলুদ, চোখ নীল, আর লাল রঙে আঁকা রয়েছে আরমার-প্লেট। মলিন হয়ে এসেছে সমস্ত রঙ।

আগে নিয়মিত রঙ করা হতো, পিনটু জানালো। কিন্তু অনেক দিন থেকেই আর তেমন যত্ন নেয়া হয় না। কাঠও নিশ্চয় পচে নরম হয়ে গেছে এতেদিনে।

মূর্তির পাশে ঘাসের ওপর পড়ে আছে ভাঙা মাথাটা। মুখের হাঁ-এর ফাঁকে লাল রঙ করা। কাছেই মাটিতে পড়ে আছে একটা ধাতব ভারি জিনিস।

ওটা পড়েই ভেঙেছে, বললো সে। আগুন নেভানোর কেমিক্যালের সিলিণ্ডার। নিশ্চয় প্লেন থেকে পড়েছে, মূর্তিটার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় ফেলা হয়েছে।

মাথাটা ভালোমতো দেখার জন্যে ওটার কাছে বসে পড়লো মুসা। ঘাড়ের অনেকখানি নিয়ে ভেঙেছে মাথা। ডেটা ফাপা। নিশ্চয় ওজন কমানোর জন্যেই ওরকম করে তৈরি করা হয়েছিলো। কি যেন একটা বেরিয়ে রয়েছে ভেতর থেকে। টেনে বের করলো সে। কি জিনিস?

দেখি তো? ওর হাত থেকে জিনিসটা নিলো কিশোর।

চামড়া আর ধাতুর তৈরি লম্বা, পাতলা একটা সিলিন্ডারের মতো জিনিস, ভেতরে ফাপা। হুঁ, ধীরে ধীরে বললো কিশোর, লাগছে তো তলোয়ারের খাপের মতো। ওই যে, কোমরে ঝুলিয়ে নিতো যেগুলো সৈন্যরা…

কিন্তু বেশি বড়, রবিন বললো। খাপে খাপে মিলবে না, ঢিলে হয়ে থাকবে তলোয়ার।

হা। আর বেল্টে ঝোলানোর জন্যে কোনো হুকটুকও নেই।

দেখি, হাত বাড়ালো রিগো। না, তলোয়ারের খাপ না এটা, ঢাকনা। খাপের খোলস। খুব দামী তলোয়ারকে আগে এভাবেই যত্ন করে রাখা হতো। যাতে খাপটারও ক্ষতি না হয়। বিশেষ করে যখন ব্যবহার হতো না। অনেক পুরানো মনে হচ্ছে।

পুরানো? দামী? উত্তেজিত হয়ে উঠলো পিনটু। কটেজ সোর্ড-এর খোলস না তো! মুসা, দেখো তো, মাথাটার ভেতরে ভালো করে দেখো…

ততোক্ষণে ভাঙা ঘাড়ের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে মুসা। ঘাড় দেখলো, মাথা দেখলো, তারপর পুরো মূর্তিটার ভেতরেই দেখলো। মাথা নেড়ে বললো, ঘাড়-মাথার ভেতরে কিছু নেই। ধড় আর পায়ের ভেতরে ফাঁপা নয়। সলিড।

বোকামি করছিস, পিনটু, রিগো বললো। অনেক আগেই হারিয়ে গেছে কটেজ সোর্ড।

দামী ছিলো? মুসার প্রশ্ন।

হয়তো ছিলো, তবে আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। হয়তো আর দশটা সাধারণ তলোয়ারের মতোই ছিলো ওটা, ঐতিহাসিক কারণে দামী হয়ে গেছে। অনেক দিন নাকি ছিলো আমাদের পরিবারে।

করটেজের ব্যক্তিগত জিনিস? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

পারিবারিক ইতিহাস তো তাই বলে। ডন নিরো আলভারেজ, নিউ ওয়ার্ল্ডে আমাদের প্রথম পূর্ব-পুরুষ, একবার গুপ্ত আক্রমণ থেকে বাঁচিয়েছিলেন করটেজের সেনাবাহিনীকে। খুশি হয়ে তখন তাঁকে নিজের তলোয়ারটা উপহার দিয়েছিলেন কটেজ। তলোয়ারটা সম্পর্কে কিংবদন্তী আছে, স্পেনের রাজা নাকি বিশেষ উপলক্ষে অনেক আয়োজন করে ওটা উপহার দেন কাটেজকে। খাঁটি সোনার তৈরি বাঁট, দামী পাথর বসানো। ফলা আর খাপটাতেও নাকি পাথর বসানো ছিলো। ওটা এই অঞ্চলে নিয়ে আসেন নিরো আলভারেজের বংশধর লেফটেন্যান্ট ডারিগো আলভারেজ।

তারপর কি হলো ওটার? আগ্রহী হয়ে উঠেছে কিশোর।

আঠারোশা ছেচল্লিশ সালে মেকসিকোর যুদ্ধের সময় আমেরিকানরা যখন রকি বীচে ঢুকতে আরম্ভ করে, তখন হারিয়ে যায় ওটা। একেবারে গায়েব।

আমেরিকান সৈন্যরা চুরি করেছিলো?

হয়তো। দামী জিনিস যা-ই পেতে তুলে নিয়ে যাওয়ার স্বভাব ছিলো ওদের। পরে সেনাবাহিনীর দপ্তরে খোঁজ নেয়া হয়েছে। দপ্তরের লোকেরা সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তলোয়ারটার কথাই শোনেনি ওরা। হয়তো সত্যিই বলেছে, কে জানে। আমার দাদার-বাবার-বাবা পিউটো আলভারেজ লড়াই করেছিলেন আমেরিকানদের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্যে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে সাগরে পড়ে যান। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। রকি বীচ গ্যারিসন কমাণ্ডারের ধারণা, তলোয়ারটা তখন পিউটোর হাতে ছিলো, ওটা নিয়েই সাগরে পড়েছেন। যা-ই হোক, তলোয়ারটা আর পাওয়া যায়নি।

কিন্তু, চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো কিশোর, একটা কথা ঠিক, কেউ ঠিক করে বলতে পারে না তলোয়ারটা আসলে কোথায় গেছে। এবং কেউ একজন নিশ্চয় ওই খাপের খোলসটা ঢুকিয়ে রেখেছিলো ঘোড়ার গলার মধ্যে…।

ভাইয়া! হাসিয়েনড়া! শৈলগ্রির কিনারে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু।

কি হয়েছে দেখার জন্যে ছুটে গেল সবাই। আঁতকে উঠলো হাসিয়েনডার দিকে তাকিয়ে।

আরি, ঘরেও আগুন! রাশেদ পাশা চিৎকার করে বললেন।

জলদি! চেঁচিয়ে উঠলো রিগো।

ঢাল বেয়ে দৌড়ে মাঠের ওপর দিয়ে হুটলো সবাই। লাফিয়ে উঠছে আগুনের শিখা। আকাশে এখনও ভাসমান দাবানলের ধোঁয়ার সঙ্গে মিশতে চলেছে নতুন আগুনের কালো ধোঁয়া। হাসিয়েনডার চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে একটা দমকলের গাড়ি, হোসপাইপ হাতে নিয়ে গোলাঘরের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন দমকলকর্মী। রিলোর দল ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে ক্ষতি যা করার করে ফেললো আগুন, ধড়াস করে ধসে পড়লো পোড়া ছাত। দুটো বাড়িই পুড়েছে ভালোমতো। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।

নাহ, হতাশ ভঙ্গিতে বললো দমকল বাহিনীর ক্যাপ্টেন, লাভ হলো না! দাবানলের আগুনই নিশ্চয় ছিটকে এসেছিলো।

তা কি করে হয়? প্রতিবাদ করলো মুসা। বাতাসই তো ছিলো না। কি করে আসবে?

নিচে ছিলো না,ক্যাপ্টেন বললো। তবে মাটির কাছে না থাকলেও অনেক সময় ওপরে জোর বাতাস থাকে। আর আগুন লাগলে তো বটেই। গরম বাতাস দ্রুত ওপরে উঠে যায়, সাথে করে নিয়ে যায় স্ফুলিঙ্গ, ওপরের বাতাস সেই স্ফুলিঙ্গকে বয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর। ওরকম ঘটতে দেখেছি। ঘরগুলোর কাঠ শুকিয়ে খটখটে হয়েছিলো। আগুন লাগতে দেরি হয়নি। পুরানো বাড়ির কড়িবর্গার কাঠ বেয়ে আগুন নিচে নেমেছে, টালির হাতের নিচে চলে আসার পর সেই আগুনকে আর ছুঁতে পারেনি বৃষ্টি। আরও আগে দেখলে হয়তো বাঁচাতে পারতাম। কিন্তু তখন এতো ধোঁয়া ছিলো, কোনটা যে কোনখান থেকে উড়ছে বোঝা যায়নি…।

পুরানো হাসিয়েনডার দুটো দেয়াল ধসে পড়ার শব্দে থমকে গেল ক্যাপ্টেন। দ্রুত কমে আসছে আগুন, পোড়ানোর মতো কিছু না পেয়ে। স্তব্ধ হয়ে গেছে দুই ভাই, পিনটু আর রিগো। রাশেদ পাশা চুপ, ছেলেরা নীরব। কি বলবে?

নীরবতা ভাঙলো মুসা। চেঁচিয়ে উঠলো, জিনিসগুলো!

ভাড়ারের দিকে ঝট করে ফিরলেন রাশেদ পাশা। কিশোর আর রবিনও তাকালো। তবে এগোনোর চেষ্টা করলো না কেউ। পোড়া ধ্বংসস্তূপ। কয়েকটা দেয়াল এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছে বটে, তবে ভেতরের জিনিস কিছুই নেই, পুড়ে ছাই। রাশেদ পাশার কেনার মতো কিছুই নেই ওখানে।

সব গেছে। কান্নার সুর বেরোলো রিগোর কষ্ঠ থেকে। সব! বীমাও করানো ছিলো না! সব গেল আরকি আমাদের!

যাবে কেন? ফুঁসে উঠলো পিনটু, কার বিরুদ্ধে রাগ কে জানে। আবার হাসিয়েনডা বানিয়ে নেবো আমরা।

তাহয় নিলাম। ধারের টাকা শোধ করবো কোত্থেকে, ট্যাক্স দেবো কি দিয়ে? জায়গাই তে রাখতে পারবো না, ঘর বানিয়ে কি হবে?

চাচা,রাশেদ পশির দিকে তাকিয়ে বললো কিশোর, জিনিসগুলো আমরা কিনে নিয়েছিলাম। টাকা দিইনি বটে, কথা তো দিয়েছি। তারমানে আমাদের জিনিস

পুড়লো। টাকাটা আমাদের দিয়ে দেয়া উচিত।

সামান্যতম দ্বিধা না করে হাসলেন রাশেদ পাশা কিশোরের দিকে চেয়ে, তারপর মাথা ঝাঁকালেন, ঠিক বলেছিস, কিশোর। পোড়ার আগে আমরা রাতে পারিনি, সেটা আমাদের দোষ…

জোরে জোরে মাথা নাড়লো রিগো। না, তা হয় না। ভিক্ষে আমরা নিতে পারবো না। বাপ-দাদার অপমান করতে পারবো না এভাবে। তারচে জায়গাই বিক্রি করে দিয়ে শহরে চলে যাবো। কিংবা ফিরে যাবো মেকৰিকোতে।

কিন্তু আপনারা এখন আমেরিকান, বোঝানোর চেষ্টা করলো রবিন। অনেক আমেরিকানের চেয়ে আলভারেজরা আগে এসেছিলো এই অঞ্চলে।

নিশ্চয়ই, রবিনের সঙ্গে সুর মেলালো কিশোর। কি যেন ভাবছে। প্রয়োজনীয় টাকা চেষ্টা করলে অন্যখানেও পেয়ে যেতে পারেন।

বিষণ হাসি হাসলো রিগো। আর কোনো উপায় নেই, কিশোর।

হয়তো আছে, ধীরে ধীরে বললো গোয়েন্দাপ্রধান। অনেক দূরের ব্যাপার যদিও সেটা…যা-ই হোক, আপনাদের টাকাটা কি এখনই শোধ করতে হবে? না কিছু দিন সময় পাবেন? ঘর তো পড়ে গেল, কদিন অন্য কারও বাড়িতে থাকতে পারবেন?

পারবো। সিনর হেরিয়ানোর বাড়িতে। পিনট জানালো।

হ্যাঁ, বললো তার ভাই। টাকাটাও কয়েক দিন পরে দিলে চলবে। কিন্তু কিশোর, পাবো কোথায়?

তলোয়ারটার কথা ভাবছি আমি, জবাব দিলো কিশোর, করটেজ সোর্ড। মেকসিকোর যুদ্ধের সময় ওটা চুরি যায়। একশো বছরেরও বেশি হয়ে গেছে, ইতিমধ্যে কোথাও না কোথাও ওটা বেরোনোর কথা। সৈন্যরা চরি করলে বিক্রি করে দিতো। আর যেহেতু বেরোয়নি, সেহেতু আমার সন্দেহ হচ্ছে, আদৌ চুরি হয়েছিলো কিনা ওটা। হয়তো এখনও কোথাও লুকানোই রয়েছে, ওই খোলসটার মতো!

ঠিক বলেছো! তুড়ি বাজালো পিনটু। ভাইয়া, ও ঠিকই…

আরে দূর! বাতাসে বাবা মারলো যেন রিগো। তা-ও কি হয় নাকি? তলোয়ারটা না বেরোনোর একশো একটা কারণ থাকতে পারে। হয়তো সাগরে পড়ে গিয়েছিলো সত্যিই, কিংবা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো অন্য কোনোভাবে। কিংবা সৈন্যরা নিয়ে গিয়ে এমন কারো কাছে বিক্রি করেছে, যারা আজ পর্যন্ত বের করেনি ওটা, লুকিয়ে রেখেছে। অ্যানটিক জিনিস অনেকে ওভাবে লুকিয়ে রাখে। কিংবা হয়তো বহুদূরে চলে গেছে ওটা, একেবারে চীন দেশে, যেখান থেকে এখানে খোঁজ আসার সম্ভবনা খুবই কম। খোলসটা দেখেই তুমি এতো আশা করছে। হতে পারে এটা অন্য কোনো তলোয়ারের। তুমি অসঙ্ঘকে সম্ভম্ব করার কথা ভাবছে, কিশোর পাশা। স্রেফ ছেলেমানুষী। ফ্যানটাসি দিয়ে আমাদের র‍্যাঞ্চকে রক্ষা করা যাবে না।

আপনার কথায় যুক্তি আছে, মোটেও দমলো না কিশোর। কিন্তু খোলসটা আপনাআপনি মূর্তির ভেতরে ঢুকে যায়নি, ঢোকানো হয়েছে। ভেবে দেখুন, শহরে তখন ছিলো শত্রুসেনা, ডন পিউটো আলভারেজ যদি তলোয়ারটা লুকিয়ে ফেলে থাকেন, অবাক হওয়ার কিছু আছে কি? ওরকম একটা দামী জিনিস! পান আর না পান, অন্তত খোঁজার চেষ্টা তো করে দেখতে পারেন। আমরা আপনাকে সাহায্য করতে রাজি আছি। আর মোটেই ছেলেমানুষী করছি না আমরা। এ-পর্যন্ত ওরকম অনেক জিনিস খুঁজে বের করেছি, যেগুলো কখনও পাওয়া যাবে না বলে হাল ছেড়ে দেয়া হয়েছিলো।

ও ঠিকই বলছে, ভাইয়া, উত্তেজনায় টগবগ করছে পিনটু। ওরা দুর্দান্ত গোয়েন্দা, আমি জানি! এই কিশোর, কার্ড দেখাও না তোমাদের। আর পুলিশের ক্যাপ্টেন ফ্লেচারের সার্টিফিকেটটা। আছে না সঙ্গে?

মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

দেখলো রিগো। বেশ, বুঝলাম তোমরা গোয়েন্দা। অভিজ্ঞতাও আছে। পুলিশের একজন ক্যাপ্টেন ফালতু কথা বলবেন না। কিন্তু একশো বছর আগে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একটা তলোয়ার কিভাবে খুঁজে ব্বে করবে?

একটা সুযোগ তো অন্তত দিয়ে দেখো? পিনটু বললো।

হ্যাঁ, ছেলেদের পক্ষ নিলেন রাশেদ পাশা, তাতে অসুবিধেটা কি? পেলে তো ভালোই।

পুরানো হাসিয়েনডার ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রিগো। বেশ, করো চেষ্টা। আমার সাধ্যমতো সাহায্য আমি করবো। কিন্তু তলোয়ার পাবে বলে আমার মনে হয় না। যাকগে, কোত্থেকে কাজ শুরু করতে চাও? কিভাবে? কি সূত্র নিয়ে?

সেটা ভেবে বের করে ফেলবো, কিশোর কললো। তবে গলার জোর কমে গেছে তার।

ট্রাক নিয়ে ফিরে এলো বোরিস। রিগো জানালো, হুগো আর স্টেফানোকে নিয়ে হেরিয়ানোর বাড়ি চলে যাবে।

বাড়ি ফিরে চললো তিন গোয়েন্দা। ট্রাকের পেছনে উঠেছে।

কিশোর, মুসা জিজ্ঞেস করলো, কোনখান থেকে শুরু করবো?

কেন? হেসে বললো গোয়েন্দাপ্রধান, গলার জোর আবার বেড়েছে। তোমার হাতেই তো রয়েছে জবাব।

আমার হাতে? অবাক হয়ে পুরানো তলোয়ারের খোলসটার দিকে তাকালো মুসা। সাথে করে নিয়ে এসেছে ওটা।

এখনও তেমন আশা করতে পারছি না, কিশোর বললো, তবে একটা জিনিস চোখে লেগেছে আমার। খোলসটার ধাতব অংশে খুদে লেখার মতো কিছু দেখেছি। সাংকেতিক চিহ্নও হতে পারে। মিস্টার ক্রিস্টোফারের সাহায্য নিতে পারি আমরা। তিনি আমাদেরকে এমন কারো খোঁজ দিতে পারেন, যে ওগুলোর মানে বুঝিয়ে দিতে পারবে।

চোখ চকচক করে উঠলো তার। মনে হয় পথ আমরা পেয়ে গেছি! করটেজ সোর্ড খুঁজে বের করার সূত্র বুঝি পায়ে হেঁটে এসে ধরা দিলো আমাদের হাতে!

ফ্যানটাসটিক! চিৎকার করে উঠলেন প্রফেসর ওয়ালটার সাইনাস, চকচক করছে চোখ। কোনো সন্দেহ নেই, ইয়াং ম্যান, কোনো সন্দেহ নেই! এগুলো ক্যাসটিলির রয়াল কোট অভ আরমরেই চিহ্ন!

শুক্রবার বিকেল। হলিউডে প্রফেসরের স্টাডিতে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। সেদিন সকালে ফোন করে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেডিস ক্রিস্টোফারকে সব বলেছিলো, কিশোর, তিনিই তাঁর বন্ধু সাইনাসের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছেন। স্প্যানিস আর মেকসিকান ইতিহাসের বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ওয়ালটার সাইনাস। সেদিন ইস্কুল ছুটি হলে স্যালভিজ ইয়ার্ডের ট্রাকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। চালক অবশ্যই বোরিস।

তলোয়ারের এই খোলসটা মোল শতকের গোড়ার দিকে তৈরি, বললেন প্রফে। জিনিসটা ছিলো স্পেনের রাজার, আমি শিওর। তোমরা কোথায় পেলে?

মূর্তিটার কথা জানালো কিশোর। জিনিসটা কি করটেজ সোর্ডের? অতো পুরানো?  করটেজ সোর্ড? ভুরু উঠে গেল প্রফেসরের। হ্যাঁ, তা হতে পারে। তবে তলোয়ারটা হারিয়ে গেছে। আঠারোশো ছেচল্লিশ সালে পিউটো আলভারেজের সঙ্গে সাগরে পড়ে হারিয়ে গেছে ওটা…কেন, একথা জিজ্ঞেস করছো কেন? ওটাও পেয়েছে নাকি?

না, স্যার, জবাব দিলো রবিন।

এখনও পাইনি, এমনভাবে হাসলো মুসা, যেন অদূর ভবিষ্যতে পাবে।

স্যার, কিশোর জিজ্ঞেস করলো, পিউটো আলভারেজের সত্যি সত্যি কি হয়েছিলো, একথা কোথায় গেলে জানতে পারবো?

রকি বীচ হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে গেলে পেতে পারো, প্রফেসর বললেন। আলভারেজরে তো বটেই, মেকসিকোর যুদ্ধের ইতিহাসও জানতে পারবে।

প্রফেসরকে ধন্যবাদ জানিয়ে উঠতে গেল ছেলেরী। হাত তুললেন তিনি, এক মিনিট। আচ্ছা, তলোয়ারটার কথা জিজ্ঞেস করলে কেন? যোজটোজ পেয়েছে নাকি ওটার?

পাইনি এখনও, কিশোর কললো। পাওয়ার আশা করছি আরকি।

তাই? আবার চকচকে হলো প্রফেসরের চোখ। পেলে জানিও আমাকে।

নিশ্চয়ই জানাবো, স্যার, বলে উঠে পড়লো কিশোর।

বাইরে গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। ওদেরকে নামিয়ে দিয়ে ট্রাক নিয়ে একটা কাজে গেছে বোরিস, এখনও ফেরেনি। একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ছেলেরা।

তলোয়ারটার কথা শুনে কেমন চমকে গেলেন প্রফেসর, দেখেছো? মুসা বললো।

হা, ভ্রূকুটি করলো কিশোর, অনেকেই ওরকম চমকাবে। করটেজ সোর্ডের নাম পারতপক্ষে আর কারও কাছে বলা উচিত হবে না। লোভে পড়ে কে এসে বাগড়া দিতে শুরু করবে কে জানে! একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেছি, খোলসটা করটেজ সোর্ডেরই, আর ওটা খুঁজে পাওয়ার চান্স আছে।

হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে যাবে? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

যাবো।

কি খুঁজবো ওখানে? মুসার প্রশ্ন।

জানি না এখনও, জবাব দিলো কিশোর। ভাবহি, ইতিহাস থেকে কোনো সূত্র পেয়েও যেতে পারি।

বোরিস আসতে আসতে বৃষ্টি বেড়ে গেল অনেক। ট্রাকের পেছনে ওঠার আর উপায় নেই, কেবিনেই গাদাগাদি করে বসতে হলো সবাইকে। রকি বীচে পৌঁছে ওদেরকে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে নামিয়ে দিয়ে আরেকটা কাজে চলে গেল বোরিস।

ঘরটা নীরব, নির্জন, শুধু নির্দিষ্ট জায়গায় বসে রয়েছেন অ্যাসিসটেন্ট হিসটোরিয়ান। তিন গোয়েন্দাকে চেনেন। হেসে বললেন, আরে, তিন গোয়েন্দা যে। তা কি মনে করে? নতুন কোনো কেস-টেস?

এই কর…, শুরু করেই আঁউউ করে উঠে থেমে গেল মুসা। তার পা মাড়িয়ে দিয়েছে কিশোর। হিসটোরিয়ানের দিকে চেয়ে হেসে বললো তাড়াতাড়ি, না, স্যার, কোনো কেস-টেস না। ইস্কুলের ম্যাগাজিনের জন্যে একটা গবেষণামূলক লেখা লিখতে চায় রবিন। তাকে সাহায্য করছি। রকি বীচ আলভারেজ ফ্যামিলির ওপর গবেষণা করছে সে।

ও। আলভারেজদের ফাইল তো আছে আমাদের কাছে। জায়গামতোই এসেছে।

ডন পিউটো আলভারেজের কথাও নিশ্চয় লেখা আছে?

মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে গেলেন হিসটোরিয়ান। দেয়াল ঘেঁষে সারি সারি তাকে বই ঠাসা। কতগুলো আলমারি আর শেলফও আছে। শেলফ থেকে দুটো ফাইল রে করে আনলেন তিনি। হেসে বাড়িয়ে দিলেন ছেলেদের দিকে।

ফাইলের আকার দেখেই দমে গেল মুসা। তবে কিশোর আর রবিনের মুখ দেখে কিছু বোঝা গেল না।

ফাইল দুটো কোণের একটা টেবিলের কাছে বয়ে নিয়ে এলো কিশোর। এটা তোমরা দেখো। যুদ্ধের ওপর লেখা ফাইলটা রবিন আর মুসার দিকে ঠেলে দিলো সে। নিজে নিলো আলভারেজদের ওপ্র লেখা ফাইল। এটা আমি দেখছি।

পরের দুটো ঘন্টা পাতার পর পাতা উল্টে গেল ওরা। ডন পিউটো আলভারেজ আর করটেজ সোর্ডটার কথা কিছু লেখা আছে কিনা খুঁজছে। হিসটোরিয়ান কাজে ব্যস্ত, ছেলেদেরকে বিরক্ত করলেন না। ইতিমধ্যে অন্য কেউ ঢুকলো না ওঘরে।

দুই ঘণ্টা পর দুটো ফাইলই ওল্টানো শেষ হলো। তার ফাইলে একটা জিনিসই শুধু দৃষ্টি আকর্ষণ করলো কিশোরের, একটা চিঠি পুরানো হতে হতে হলদে হয়ে এসেছে কাগজ। দুই সহকারীকে জানালো সে, ছেলের কাছে এই চিঠি লিখেছিলেন ডন পিউটো আলভারেজ। রকি বীচে একটা ঘরে তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে তখন। ওই সময় তাঁর ছেলে ছিলো মেকসিকো সিটিতে, মেকসিকান আর্মির একজন অফিসার।

কি লিখেছেন? জানতে চাইলো মুসা।

ভাষাটা স্প্যানিশ, তা-ও আবার পুরানো ঢঙে, নাক কুঁচকালো কিশোর, খুব কঠিন। ভালো বুঝলাম না। তবে এটুকু বুঝেছি, সাগরের কাছে একটা বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিলো ডন পিউটো আলভারেজকে। লোকজন বোধহয় দেখা করতে আসতো তার কাছে, ওরকম কিছু লিখেছে। বিজয়ের পরে ছেলের সঙ্গে দেখা করবেন তিনি, এরকম কথাও আছে। বোধহয় পালিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত এটা, তবে আমি শিওর না। চিঠিটার তারিখ তেরো সেপ্টেম্বর, উনিশশো ছেচল্লিশ। তলোয়ারটার কথা কিছু লেখা নেই।

বন্দি অবস্থায় লিখেছে, না? চিন্তিত ভঙ্গিতে গাল চুলকালো মুসা। আচ্ছা, কিশোর, সাংকেতিক কিছু লেখা নেই তো?

তা থাকতে পারে, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। রিগোকে দিয়ে পড়াতে হবে। মানে ঠিকমতো না বুঝলে কিছু বলা যাচ্ছে না…

পড়িয়ে লাভ হবে বলে মনে হয় না, রবিন বললো। এই যে আরেকটা চিঠি, আমেরিকান আর্মি লিখেছিলো ডন পিউটোর ছেলে স্যানটিনোকে। যুদ্ধের পর সে তখন বাড়ি ফিরেছে। চিঠিতে দুঃখপ্রকাশ করেছে আমেরিকান প্রকার, ডন পিউটোর মৃত্যুর জন্যে। আঠারোশো ছেচল্লিশের পনেরোই সেপ্টেম্বর পালাতে গিয়ে মারা পড়েন ডন। তাকে গুলি করা ছাড়া নাকি আর কোনো উপায় ছিলো না সৈন্যদের, কারণ তিনি সশস্ত্র ছিলেন, এবং আগে হামলা করেছিলেন। গুলি খেয়ে সাগরে পড়ে যান তিনি…

ওসব তো পুরানো খবর, বাধা দিয়ে বললো মুসা, জানি আমরা। নতুন কি লিখেছে?

ডনের এভাবে সাগরে পড়ে যাওয়ার কথা রিপোর্ট করেছে জনৈক সার্জেন্ট রবার্ট ডগলাস। তার পক্ষে সাক্ষি দিয়েছে দুজন করপোরাল, তিনজনেই তখন ওই বাড়িতে পাহারায় ছিলো। ডগলাসের লেখা রিপোর্টটাও আছে এই ফাইলে, বলে ফাইলে টোকা দিলো রবিন। একথাও বলা হয়েছে, ডনের হাতে তখন একটা তলোয়ার ছিলো।

ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। মুসার চোখে নিরাশা।

সার্জেন্টের ধারণা, বলে চললো রবিন, তলোয়ারটা লুকিয়ে ডনের কাছে নিয়ে এসেছিলো তার কোনো সহচর, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতো যারা, তাদেরই কেউ। মুখ তুললো রবিন। তারমানে, তলোয়ার হাতে নিয়েই সাগরে পড়েছিলেন ডন পিউটো।

বাইরে জোর বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো কিশোর। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলো, মুসা, তুমি কিছু পেয়েছো?

তেমন কিছু না, জবাব দিলো মুসা হতাশ কণ্ঠে। আমিও একটা চিঠি পেয়েছি। ২৩ সেপ্টেম্বর লস অ্যাঞ্জেলেস গ্যারিসনের ওপর মেকসিকান হামলার বিব্রণ চেয়ে কমাণ্ডিং অফিসারের কাছে চিঠিটা লিখেছেন একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা। কয়েকজন সৈন্যের নাম উল্লেখ করেছেন, যারা দুটি না নিয়েই নিরুদ্দেশ হয়েছে। ষোল সেপ্টেম্বরের পর থেকে তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানানো হয়েছে। সামরিক নিয়মে পলাতক ঘোষণা করা হয়েছে ওদেরকে। ডন পিউটো কিংবা তলোয়ারটার কথা কিছু লেখা নেই…

মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই কিশোর জানতে চাইলো, পলাতকদের নাম কি?

সার্জেন্ট রবার্ট ডগলাস, করপোরাল হ্যানসন, এবং করপোরাল…

ডি. ফাইবার! মুসার কথা শেষ হওয়ার আগেই চেঁচিয়ে উঠলো রবিন। এদের কথাই লেখা আছে আমার চিঠিটাতেও! ডন পিউটোকে পাহারা দিয়ে রেখেছিলো!

চিৎকার শুনে অবাক হয়ে যে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন হিসটোরিয়ান খেয়ালই করলো না ওরা।

ডগলাস, হ্যানসন এবং ফাইবার, খুশি খুশি মনে হলো কিশোরকে। আঠারোশো ছেচল্লিশের মোল সেপ্টেম্বর থেকে নিখোঁজ!

হ্যাঁ, কিন্তু… হঠাৎ চোখ বড় বড় হয়ে গেল মুসার। খাইছে! ওরাই ডনকে গুলি করেনি তো?

ওরা রিপোর্ট করেছে যে গুলি খেয়েছেন ডন, কিশোর বললো। কে করেছে, তা বলেনি।

ওরাই গুলি করেছে, তাই না কিশোর? জিজ্ঞাসু চোখে গোয়েন্দাপ্রধানের দিকে তাকালো রবিন।

তাই তো মনে হয়, গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর। ব্যাপারটা খুবই রহস্যজনক। যারা ডনকে আগের দিন গুলি করে মারলো, প্রদিন থেকেই নিখোঁজ হয়ে গেল তারা, পলাতক ঘোষিত হয়ে গেল। তারপর আর কোনো খবরই নেই তাদের।

তলোয়ারটা চুরি করে পালায়নি তো? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

পালাতেও পারে। কিন্তু তাহলে ওই খোলসটা মূর্তির ভেতরে লুকালো কে, এবং কেন? অবাক লাগছে আমার। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। রিগোর সঙ্গে কথা বলতে হবে। এহহে, অনেক দেরি হয়ে গেছে, ঘড়ির দিকে চোখ পড়তে বলে উঠলো মুসা। তাই তো বলি, পেটের মধ্যে এমন মোচড় দেয় কেন? খুব খিদে পেয়েছে, বুঝলে, আমি বাড়ি যাবো।

আমিও, রবিন কালো।

কিশোর বললো, তাহলে কাল সকালেই রিগার সঙ্গে দেখা করতে যাবো।

সোসাইটির ডুপ্লিকেটিং মেশিনে চিঠি আর দলিলের কপি করে নিলো ওরা। তারপর হিসটোরিয়ানকে তাঁর সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলো। তখনও বৃষ্টি পড়ছে। বোরিস আসেনি। দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলো না আর মুসা। তাছাড়া বাড়ি যাচ্ছে, ভিজে গেলেই বা কি। বাড়ি গিয়ে কাপড় পাল্টে নেবে।

ভিজে চপচপে হয়ে স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছলো তিনজনে। রবিন আর মুসা সাইকেল ফেলে গিয়েছিলো এখানে, নিয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। গেট দিয়ে বেরোতেই দেখা শুঁটকি টেরির সঙ্গে। টিটকারি দিয়ে বললো, আহারে, ইস্, একেবারে গোসল করে ফেলেছে! এসো, গাড়িতে ওঠো, পৌঁছে দি।

শুঁটকির গন্ধে বমি করার চেয়ে ভিজে যাওয়া অনেক ভালো, জবাব দিলো মুসা।

চকিতের জন্যে রাগ ঝিলিক দিয়ে উঠলো টেরিয়ারের চোখে। চিবিয়ে চিবিয়ে, বললো, দেখো, আলভারেজ র‍্যাঞ্চের ধারেকাছে যাবেনা আর। সাবধান!

টেরিয়ারের গাড়ি দেখে এগিয়ে এসেছে কিশোর। তার কথা কানে গেছে। জিজ্ঞেস করলো, ধমক দিচ্ছো?

ওদের র‍্যাঞ্চটার লোভ, না? কড়া গলায় বললো মুসা। ছুঁতেও দেয়া হবে না তোমার বাপকে, মনে রেখো!

দাঁত বের করে হাসলো টেরি। কি করে ঠেকাবে?

আমরা তলো…, প্রায় বলে দিয়েছিলো মুসা। তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে উঠলো কিশোর, দেখতেই পাবে, কি করে ঠেকাই।

যা করার তাড়াতাড়ি করো, খিকখিক করে হাসলো টেরি, সময় বেশি পাবে না। হপ্তাখানেকের মধ্যেই দখল করে নেবো ওটা। আলভারেজদের কপালে শনি আছে। ওদের সঙ্গে খাতির লাগিয়ে কিছু করতে গেলে তোমাদেরও ভালো হবে না।

তিন গোয়েন্দাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল টেরি। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে তিন গোয়েন্দা। ভাবছে, বড় বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলে গেল শুঁটকি!

শনিবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলো কিশোর। বৃষ্টি থামেনি, পড়েই চলেছে। তবে বৃষ্টি তাকে আলভারেজ র‍্যাঞ্চে যাওয়া ঠেকাতে পারতো না, যেতে পারলো না অন্য কারণে। ফোন করে রবিন আর মুসা জানালো, বাড়িতে জরুরী কাজ আছে, দুপুরের আগে আসতে পারবে না।

গেল মনটা খারাপ হয়ে। শেষে আর ঘরে বসে থাকতে না পেরে ভিজে ভিজেই গিয়ে ইয়ার্ডের কাজে সাহায্য করলো বোরিস আর রোভারকে।

দুপুরে খাবার পরে এলো রবিন আর মুসা। বৃষ্টি থামেনি, তবে হালকা হয়ে এসেছে। রেনকোট পরে এসেহে দুজনেই। কিশোরও পরে নিলো। সাইকেল নিয়ে আলভারেজ র‍্যাঞ্চে রওনা হলো তিনজনে। কাউন্টি রোড ধরে চললো। সাথে ম্যাপ নিয়ে নিয়েছে কিশোর, যাতে পাহাড়ের গলিঘুপচি দিয়ে যাওয়ার সময় পথ ভুল না হয়। আলভারেজ হাসিয়েনডার পোড়া ধ্বংসপ পেরিয়ে এসে সহজেই খুঁজে বার করলো প্রতিবেশী রডরিক হেরিয়ানোর বাড়িটা। অ্যাভোকাডোর ফার্ম করা হয়েছে ওখানে।

পুরানো ধাঁচের পুরানো বাড়ি। মস্ত গোলাঘর, তার পেছনে ছোট ছোট দুটো কটেজ। বৃষ্টির মধ্যেই কাঠ ফাড়ছে পিনটু, সেখানে হাজির হলো তিন গোয়েন্দা।

তোমার ভাই আছে ঘরে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

আছে, এসো, কুড়ালটা হাত থেকে ফেলে দিলো পিনটু।

একটা কটেজে ঢুকলো ওরা। মাত্র দুটো ঘর, আর ছোট্ট রান্নাঘর। ফায়ারপ্লেসে তখন আগুন জ্বালছে রিগো। তিন গোয়েন্দাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে হাসলো। এসো এসো।

প্রফেসর সাইনাসের কথা বললো পিনটু আর রিগোকে কিশোর। বললো, তিনি বলেছেন করটেজ সোর্ডেরই খোলস ওটা।

পালাতে গিয়েও মারা পড়েননি পিউটো আলভারেজ, যোগ করলো মুসা।

পড়েননি এটা জোর দিয়ে বলা যায় না, শুধরে দিয়ে বললো রবিন, তবে কথাটা ঠিক না-ও হতে পারে এই আরকি।

কপি করে আনা দলিলগুলো দুই ভাইকে দেখালো কিশোর।

এতে আর নতুন কি বোঝা গেল? হাত ওল্টালো রিগো।

কেন, কিছুই সন্দেহ হচ্ছে না আপনার? ডন পিউটো পালাতে গিয়ে মারা পড়েছে বলে যারা রিপোর্ট করেছে, তাদেরকেই পরদিন থেকে পলাতক ঘোষণা করেছে আর্মি,

এটা সন্দেহজনক নয়? তিন তিনজন লোক একই সাথে পালালো!

হুঁ, মাথা দোলালো রিগো, আমার সন্দেহই তাহলে ঠিক। এখন তোমাদের বলি, তলোয়ারটা সাগরে পড়ে হারিয়ে গেছে, কথাটা বিশ্বাস হয়নি আমার। বুঝতে পারছি, ওরা তলোয়ারটা কেড়ে নিয়ে ডনকে খুন করে সাগরে ফেলে দিয়েছে। রিপোর্ট করেছে, পালাতে গিয়ে মারা পড়েছেন ডন। তারপর তলোয়ার নিয়ে পালিয়েছে তিনজনে।

হয়তো, কিশোর বললো। কিন্তু খোলসটার ব্যাপারে কি বলবেন? মূর্তির ভেতরে কে লুকিয়েছে ওটা? একমাত্র ডনের কথাই মনে আসে আমার। আমেরিকানদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে একাজ করেছেন হয়তো তিনি। কোনো কারণে খোলসটা ওখানে লুকিয়ে তলোয়ার আর খাপটা আলাদা জায়গায় নিয়ে গেছেন।

তলোয়ারটা ডনের কাছে নিয়ে গেছে যে, সে-ও তো লুকাতে পারে, যুক্তি দেখালো রিগো।

এই আরেকটা রহস্য! দামী একটা তলোয়ার জেনেশুনে ওভাবে শক্রর গুহায় নিয়ে যাওয়া হলো কেন? ধরে নিলাম অস্ত্র দরকার ছিলো ডনের, একটা বন্দুক নিয়ে গিয়ে দিলেই তো আরও ভালো হতো। বন্দুকের বিরুদ্ধে তো বন্দুকই দরকার, তলোয়ার কেন? তা-ও আবার পাথর বসানো?

শ্রাগ করলো রিগো। পাথর ছিলোই তা কিন্তু শিওর না।

আমি কি ভাবছি, শুনুন। ডন পিউটোকে অ্যারেস্টই করেছিলো আমেরিকানরা কর্টেজ সোর্ডের জন্যে। হ্যাঁ, রবিন, প্রফেসর সাইনাস কি বলেছেন আমি জানি, রবিন মুখ খুলতে যাচ্ছিলো দেখে তাকে থামিয়ে দিলো কিশোর। ডন সেটা বুঝতে পেরে মূর্তির ভেতরে লুকিয়ে ফেলেন তলোয়ারটা, ধরা পড়ার আগেই। বন্দিশালা থেকে যখন পালালেন তিনি, তার পিছু নিলো সার্জেন্ট ডগলাস আর তার দুই করপোরাল। রিপোর্ট করে দিলো যে পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে তলোয়ারসহ সাগরে পড়ে গেছেন ডন। ডন বুঝতে পারলেন ওদের উদ্দেশ্য, পিছু যে নিয়েছে হয়তো টের পেয়ে গিয়েছিলেন। তলোয়ারটাকে নতুন আরেক জায়গায় লুকালেন তিনি। খোলসটা মূর্তির মধ্যেই রেখে দিলেন ওদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্যে।

তারপর ডনের কি হলো? প্রশ্ন করলো রিগো।

আমি জানি না।

কিছু না জেনেই একটা গল্প বানিয়ে বলে দিলে তুমি, কিশোর পাশা, ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগলো রিগো। ধরলাম তোমার কথা সত্যি, মানে ডনের পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা, আর তলোয়ারটাও তিনি লুকিয়েছেন। কোথায়? আর কিভাবে সেটা খুঁজে বের করবে?

ডনের চিঠিটা দেখাও তো কিশোর, রবিন বললো।

চিঠির কপি বের করে রিগোর হাতে দিলো কিশোর। এটার অনুবাদ করুন। রবিন, লিখে নাও।

চিঠিটা একবার দেখেই রিগো বললো, এই চিঠি আমি দেখেছি। আমার দাদা এটা বহুবার পড়েছে, হারানো তলোয়ারের সূত্র খুঁজেছে, কিছুই পায়নি। ঠিক আছে, আমি অনুবাদ করছি, লিখে নাও। কনডর ক্যাসল, তেরো সেপ্টেম্বর, আঠারোশো ছেচল্লিশ। মাই ডিয়ার স্যানটিনো, আশা করি কুশলেই আছো, আর তোমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে খাঁটি মেকসিকানের মতো। ইয়াংকিরা এসে ঢুকেছে আমাদের হতভাগ্য শহরে, আর আমি গ্রেপ্তার হয়েছি। কেন ধরা হয়েছে আমাকে, বলেনি ওরা তবে আন্দাজ করতে পারছি, বুঝলে? সাগরের কাছে ক্যাবরিলো হাউসে আমাকে বন্দী করে রাখা হয়েছে, কাউকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না আমার সঙ্গে। আমাদের পরিবারের সাই, এবং সবকিছু ভালো আছে, নিরাপদে আছে। জানি, শীঘ্রি, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।

নোটবুকে লিখে নিয়েছে রবিন। দ্রুত একবার পড়লো। বললো, কেন ধরা হয়েছে আন্দাজ করতে পেরেছেন তিনি। তলোয়ারটার জন্যেই কি?

এবং সব কিছু বলে উঠলো মুসী। তারমানে কি স্যানটিনোকে বোঝাতে চেয়েছেন তলোয়ারটা নিরাপদে আছে?

দেখি, নোটবুকের জন্যে হাত বাড়ালো কিশোর। বললো, হয়তো। তবে একটা ব্যাপারে শিওর হয়ে গেলাম এখন, মিথ্যে কথা বলেছে সার্জেন্ট ডগলাস।

কি করে শিওর হলে? রিগো জানতে চাইলো।

রিপোর্টে বলেছে ডগলাস, যে তলোয়ার সহ পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরেছেন ডন। তলোয়ারটা তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিলো একজন বন্ধু বা ওরকম কেউ। কিন্তু ডনের সঙ্গে কাউকে দেখাই করতে দেয়া হতো না, তাহলে কি করে দিলো তলোয়ার? তারমানে হাতে তলোয়ার পৌঁছেনি। বানিয়ে বলেছে ডগলাস, যাতে সবাই ভাবে তলোয়ারটা হারিয়ে গেছে। কেউ আর ওটার খোঁজ না করে। তাহলে নিশ্চিন্তে খুঁজতে পারবে সে।

চিঠির দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু…

থেমে গেল একটা শব্দে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝেই হলো আওয়াজটা, লাকড়ির ওপর লাকড়ি পড়ার। পরক্ষণেই শোনা গেল পায়ের শব্দ।

এই, দাঁড়াও। চেঁচিয়ে উঠলো একটা কণ্ঠ।

ঘর থেকে ছুটে বেরোলো তিন গোয়েন্দা, রিগো আর পিনটু। দেখলো গোলাঘরের ওপাশ দিয়ে একটা ঘোড়া দৌড়ে যাচ্ছে। সাদা চুল, ছোটখাটো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন চত্বরে।

জানালায় আড়ি পেতে নছিলো, রিগোকে জানালেন তিনি। তোমার সঙ্গে কথা বলতে আসছিলাম, এই সময় দেখি আমার সাড়া পেয়েই লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে পড়লো লাকড়ির ওপর। ঘোড়াটা রেখে দিয়েছিলো গোলার পেছনে।

লোকটা কে, চিনেছেন? পিনটু জিজ্ঞেস করলো।

মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। চোখে তো ভালো দেখতে পাই না, চিনতে পারিনি।

ভিজে যাচ্ছেন, ডন, বৃদ্ধকে খুব সম্মান দেখিয়ে বললো রিগো। ভেতরে চলে আসুন।

কটেজের ভেতরে এনে ফায়ারপ্লেসের কাছে বসালো সে। পরিচয় করিয়ে দিলো তিন গোয়েন্দার সঙ্গে। তাদের দিকে তাকিয়ে হেসে মাথাটা সামান্য নোয়ালেন ডন রডরিক হেরিয়ানো।

লোকটা কতোক্ষণ ছিলো, স্যার, বলতে পারবেন? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

কি জানি। আমি তো এইমাত্র এলাম।

কে হতে পারে? কিশোরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রবিন। আড়ি পেতে ছিলো কেন?

আমি কি করে বলি? কর্টেজ সোর্ডটার কথা শুনে ফেললো কিনা কে জানে!

শুনলে কি ক্ষতি হবে? মুসার প্রশ্ন।

সরাসরি জবাব দিলো না কিশোর। কললো, আমার মনে হয়, মিস্টার ডয়েল চান তলোয়ারটা আমরা খুঁজে বের করি। কাল শুঁটকি খুব আগ্রহ দেখাচ্ছিলো আমাদের সম্পর্কে। আমরা কি করছি বোঝার চেষ্টা করছে নিশ্চয়।

শুনলেও কিছু এসে যায় না, বিশেষ গুরুত্ব দিলো না রিগো। এমন কিছু শোনেনি। তলোয়ারটা কোথায় আছে সেকথা তো আর বলিনি আমরা।

আমি শিওর,আগের কথার খেই ধরে শুরু করলো আবার কিশোর, ডন পিউটো। জানতেন তিন সৈন্য তার পিছু নিয়েছে। তিনি সেটা লুকিয়ে ফেললেন। নিশ্চয়ই ছেলের জন্যে কোনো সূত্র রেখে গেছেন তিনি। চিঠিটাতে না থাকলে অন্য কোথাও। তবে চিঠিতেও কিছু না কিছু আছেই। বন্দি ছিলেন তিনি, বিপদের মধ্যে ছিলেন, সরাসরি কিছু লেখা সম্ভব ছিলো না। জানতেন, ওই চিঠিই ছেলেকে কিছু জানানোর শেষ সুযোগ।

আরেকবার করে চিঠিটা পড়লো ওরা। তিন গোয়েন্দা পড়লো অনুবাদ করা লেখাটা, আর দুই ভাই পড়লে কপিটা।

আমি কিছুই পেলাম না, হাল ছেড়ে দিলো মুসা। মাথা নাড়লো রিগো, আমিও না। এটা সাধারণ একটা চিঠি, কিশোর। সাংকেতিক কোনো কিছুই নেই।

এবং সব কিছু ভালো আছে, নিরাপদে আছে কথাটা ছাড়া, বললো পিনটু।

কিশোর? রবিন বললো হঠাৎ, তারিখের ওপরে হেডিং লেখা হয়েছে কনডর ক্যাসল, খেয়াল করেছো? রিগোকে জিজ্ঞেস করলো সে। আপনি জানেন এটা কি?

না, ধীরে ধীর বললো রিগো, হবে কোনো দুর্গ-টুর্গ। অনেকেই ওরকম লিখে থাকে। যেখানে থেকে লিখছে সেটার নাম।

কিন্তু, রবিন বললো, ডন চিঠিটা লিখেছিলেন ক্যাবরিলো হাউস থেকে।

আপনাদের সিয়েনডাটার নাম কখনও কি কনডর ক্যাসল ছিলো? কিশোর জিজ্ঞেস করল।

না, জবাব দিলো রিগো। এটার নাম সব সময়ই হাসিয়েনডা আলভারেজ।

তাহলে ওপরে ডর ক্যাসল লিখলেন কেন? ভুরু নাচালো মুসা। বিশেষ কোনো জায়গা না তো যেটা স্যানটিনো চিনতো?

সঙ্গে করে আনা ম্যাপটা খুললো কিশোর। বাই দেখার জন্যে ঝুঁকে এলো তার কাঁধের ওপর দিয়ে। কিছুক্ষণ দেখে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবার হেলান দিলো কিশোর। নো কনডর ক্যাসল! তারপর হঠাৎ কি মনে পড়াতে আবার তাকালো ম্যাপের দিকে। দাঁড়ান দাঁড়ান, এটা আধুনিক ম্যাপ! পুরানো হলে, মানে আঠারোশো ছেচল্লিশ সালের…

আমার কাছে একটা প্রানো মাপ আছে, বললেন ডন হেরিয়ানো।

ওটা আনার জন্যে বেরিয়ে গেলেন তিনি। অস্থির হয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো সবাই। হলদে হয়ে আসা পুরানো একটা ম্যাপ নিয়ে এলেন হেরিয়ানো। ১৮৪৪ সালে তৈরি করা হয়েছিলো, অর্ধেকটা স্প্যানিশে লেখা, অর্ধেকটা ইংরেজিতে। ভালোমতো ম্যাপটা দেখলো রিগো আর কিশোর।

কিছুই নেই, নিরাশই মনে হলো রিগোকে।

না, একমত হলো কিশোর।

পরাজিত হয়েই যেন রেগে গেল রিগো। বোকামি হচ্ছে! বুঝলে, পাগলামি! আমি আগেই বলেছি ফ্যান্টাসি দিয়ে আমাদের র‍্যাঞ্চ বাঁচানো যাবে না…

আস্তে করে বললেন হেরিয়ানো, এছাড়া আর কি-ই বা করার আছে তোমার, রিগো? একটা খারাপ খবর জানাতে এসেছি তোমাকে, আমি টাকাটা ধার করে নিয়ে দিয়েছিলাম তোমাকে। আমার টাকা নয়। বললে তুমি নিতে না, তাই দেয়ার সময় বলিনি। এখন আর না বলে পারছি না। ওই লোক টাকা ফেরত দেয়ার জন্যে চাপ দিচ্ছে আমাকে। টাকা দিতে না পারলে মিস্টার ডয়েলের কাছে জায়গা তোমাকে বিক্রি করতেই হবে।

হিঁসিয়ে উঠলো মুসা, শুঁটকিটার গলায় এজন্যেই এতো জোর ছিলো কাল!

অনেক করেছেন আমার জন্যে, ডন, বিষণ্ণ কণ্ঠে বললো রিগো। কি বলে যে ধন্যবাদ দেবো আপনাকে…

কি আর করতে পারলামশোনো, তুমি যেও না এখান থেকে। আমার কটেজেই থেকে যাও। খুব খুশি হবো।

আপাতত তো আছিই। জায়গা বিক্রি করে দিলে পরে কি করবো সে তখন দেখা যাবে।

উলেন হেরিয়ানো। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। চত্বরে কাদা হয়ে গেছে। বৃষ্টি থামেনি। মাথা নিচু করে হাঁটছেন বৃদ্ধ। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিগোও বেরিয়ে গেল। একটু পরেই লাকড়ি ফাড়ার শব্দ কানে এলো ছেলেদের।

সব গেল! দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পিনটুর বুক চিরে।

না, কিছুই যায়নি! দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করলো কিশোর। করটেজ সোর্ড আমরা খুঁজে রে করবোই।

হ্যাঁ, করবো। প্রতিধ্বনি করলো যেন রবিন।

নিশ্চয় করবো! সুর মেলালো মুসা। আমরা… আমরা খাইছে, কিশোর, কিভাবে কাজটা করবো আমরা?

কাল, কিশোর জবাব দিলো, যতো পুরানো ম্যাপ পাওয়া যাবে সবগুলো দেখবো আমরা। কনভর ক্যাসল একটা সূত্রই। কি বোঝাতে চেয়েছেন ডন, জানার চেষ্টা করবো। রকি বীচে পুরানো ম্যাপের অভাব নেই।

আমি তোমাদের সঙ্গে আছি! উত্তেজিত হয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু। মেলাও হাত!

হাসি ফুটলো চারজনের মুখেই।

রোববার সকালে ইলশে গুঁড়িতে পরিণত হলো বৃষ্টি। হেরিয়ানার কাছ থেকে একটা সাইকেল আর একটা রেনকোট চেয়ে নিয়ে শহরে রওনা হলো পিনটু। হিসটোরিক্যাল সোসাইটির সামনে কিশোরের সাথে দেখা করলো দুপুরের দিকে।

রবিন গেছে লাইব্রেরিতে খুঁজতে, কিশোর জানালো। কাউন্টি ল্যাণ্ড অফিসে গেছে মুসা।

কনডর ক্যাসল খুঁজে বের করবোই আমরা! দৃঢ় কণ্ঠে বললো পিনটু।

হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে ঢুকলো ওরা। অনেকে বসে পড়ছে। আজ বেশ ব্যস্ত অ্যাসিসট্যান্ট হিসটোরিয়ান। ম্যাপের কথা বললো কিশোর। ম্যাপ রাখার ঘর আলাদা। সেদিকে দুজনকে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি বললেন, আরেকজন এসে আলভারেজদের ব্যাপারে খোঁজ-খবর করেছে। লম্বা, পাতলা।

শুঁটকি! হিসটোরিয়ানের কাছ থেকে সরে এসে নিচু গলায় পিনটুকে বললো কিশোর। আমরা কি করছি জানার চেষ্টা করছে।

ওর নিশ্চয় ভয়, তলোয়ারটা খুঁজে বের করে ফেলবে তোমরা।

আমারও তাই মনে হয়।

ম্যাপ-ঘরে আর লোক নেই। ১৮৪৬ সালের পঞ্চাশটা সাপ পাওয়া গেল। কোনো কোনোটা সমস্ত কাউন্টির, আর কোনোটা শুধু রকি বীচ এলাকার। কনডর ক্যাসল খুঁজে পেলো না ওরা।

এই যে আরেকটা, কিশোর বললো। এটা শুধু আলভারেজ র‍্যাঞ্চের।

আরিব্বাবা! কত্তোবড় ছিলো তখন দেখো!

কিন্তু ওটাতেও কনভর ক্যাসল খুঁজে পাওয়া গেল না।

ডন পিউটোর সময়কার আর কোনো ম্যাপ নেই! হতাশ কণ্ঠে বললো পিনটু।

নেই, তাতে কি? হাল ছাড়লো না কিশোর। ওই সময়কার না হোক, রকি বীচের যতো ম্যাপ পাবো, সব দেখবো।

১৮৪০-এর কয়েকটা পাওয়া গেল। ওগুলোতেও নেই কনডর ক্যাসল। আরও কিছু আধুনিক ম্যাপেও যখন পাওয়া গেল না, হাল না ছেড়ে আর উপায় থাকলো না ওদের। ফিরে চললো স্যালভিজ ইয়ার্ডের হেডকোয়ার্টারে।

দেখি, রবিন আর মুসা কিছু পায় কিনা, আশা করলো কিশোর।

দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে ট্রেলারে ঢুকলো দুজনে। ভেতরটা দেখে অবাক হয়ে গেল পিনটু। বললো, দারুণ সাজিয়েছো তো!

জবাবে শুধু মৃদু হাসলো কিশোর।

রবিন আর মুসার অপেক্ষায় বসে রইলো ওরা। রবিন এলো প্রথমে।

নাহ, হলো না! ধপাস করে একটা চেয়ারে বসে পড়লো সে। কোথাও আর বাদ রাখিনি!

মুসা ঢুকলো কালো মুখটাকে আরও কালো করে। তার চেহারার দিকে একবার তাকিয়েই যা বোঝার বুঝে গেল সবাই। একটা টুলে বসতে বসতে বললো, কনডর ক্যাসলের যদি কোনো মানে সত্যিই থেকে থাকে, তাহলে সেটা জানে শুধু ডন পিউটো আর সানটিনো আলভারেজ!

তারমানে আর কিছুই করার নেই আমাদের, কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললো রবিন। প্রায় কেঁদে ফেলবে যেন পিনটু। না না, ওরকম করে বলো না!

হঠাৎ পিঠ সোজা করে ফেললো মুসা। ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করলো সবাইকে।

কান পাতলো সকলেই। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সব কিছু চুপচাপ। তারপর সবার কানেই এলো ক্ষীণ শব্দটা, বাইরে ধাতব কিছু নড়ছে। তারপর শব্দ শোনা গেল আরেক জায়গা থেকে। পরক্ষণেই হলো টোকা দেয়ার শব্দ।

ফিসফিসিয়ে রবিন বললো, কেউ কিছু খোঁজাখুঁজি করছে।

আচ্ছা, কিশোর বললো, তোমাদের পিছু নিয়ে আসেনি তো কেউ?

কি জানি, আমি অন্তত দেখিনি। মুসার দিকে তাকালো কিশোর।

আমি…ঠিক বলতে পারবো না, মুসা বললো চিন্তিত ভঙ্গিতে। তাড়াহুড়া করে এসেছি। পেছনে তাকানোর কথা মনেই হয়নি।

বাইরে জঞ্জালের মধ্যে কয়েক মিনিট ধরে চললে টোকা দেয়া আর খোঁচাখুচির শব্দ। তারপর নীরব হয়ে গেল।

দেখতো, রবিন, ফিসফিস করে বললো কিশোর।

আস্তে করে উঠে গিয়ে ট্রেলারের ছাতে লাগানো পেরিস্কোপ সর্ব-দর্শনে চোখ রাখলো রবিন। এই, ম্যানেজার, ডরি! বেরিয়ে যাচ্ছে!

লোকটা চলে যাওয়ার পর সর্ব-দর্শন থেকে চোখ ফিরিয়ে তাকালো রবিন। নিশ্চয় ফলো করেছিলো। কাকে করলো বুঝলাম না। ও-ই হয়তো কাল গিয়ে আড়ি পেতে ছিলো কটেজের জানালায়।

বোধহয়, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। আমাদের ওপর বড় বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে টেরি আর ডরি। র‍্যাঞ্চ দখলের জন্যেই, না কোনো মতলব আছে? আর এখানেই বা কেন এসেছিলো?

হয়তো কোনোভাবে জেনে ফেলেছে তলোয়ারটার কথা! পিনটু বললো উত্তেজিত কণ্ঠে।

তা হতে পারে।

আমাদের চেয়ে বেশি জানলেই মুশকিল, বললো মুসা।

গভীর হয়ে মাথা ঝাঁকালো কিশোর। হ্যাঁ। এখন যে-করেই হোক একটা ম্যাপ খুঁজে পেতে হবে আমাদের, যেটাতে কনডর ক্যাসল রয়েছে।

একটা ইনডিয়ান ম্যাপ দেখলে কেমন হয়? কিছুটা রসিকতা করেই বললো মুসা। আমরা তো পড়তে পারবো না, কোনো ইনডিয়ানই পড়ে দেবে।

দূর! বিরক্ত হয়ে হাত নাড়লো রবিন। এখন ওসক…

মুসাআ! চিৎকার করে উঠলো কিশোর। ঠিক বলেছো!

ঠিক বলেছি! নিশ্চয়! এটাই জবাব! আমি একটা গাধা!

জবাবটা কি? দ্বিধায় পড়ে গেছে মূসা।

একটা সত্যিকারের পুরানো ম্যাপ! ডন পিউটো জানতেন, সব ম্যাপেই পাওয়া যায় এমন নাম লিখলে আমেরিকানরা সেটা বের করে ফেলবে। তাই এমন কিছু কথা বলেছেন, যেটা শুধু স্যানটিনোই বুঝতে পারে। ওঠো, জলদি চলো! হিসটোরিয়ান সোসাইটিতে!

দুই সুড়ঙ্গের পাইপের ভেতর দিয়ে যতো দ্রুত সত্য বেরিয়ে এলো ওরা। দৌড় দিলো সাইকেলের দিকে।

পেছন থেকে ডাক দিলেন মেরিচাচী, কিশোওর!

থমকে দাঁড়ালো কিশোর। ফিরে তাকালো। অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন মেরিচাচী। বললেন, যাচ্ছিস কোথায়? আমার চাচার জন্মদিন আজ ভুলে গেছিস নাকি? জলদি রেডি হ। পনেরো মিনিটের মধ্যেই বেরোবো।

গুঙিয়ে উঠলো কিশোর। আ-আমি না গেলে হয় না, চাচী?

বলিস কি? তোকে এতো করে যেতে বললো, আর তুই যাবি না? না গেলে খুব দুঃখ পাবে তোর নানা। চল।

রবিন, মুসা আর পিনটুকে চলে যেতে বললো কিশোর। তারপর এগোলো ঘরের দিকে।

কি করবো এখন? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

আবার কি? হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে যাবো, নেতৃত্ব নিয়ে ফেললো রবিন। কোন্ ধরনের ম্যাপে খুঁজতে হবে বুঝে গেছি আমি। চল।

রবিন কি চায় শুনলেন অ্যাসিসট্যান্ট হিসটোরিয়ান। তারপর বললেন, ওরকম একটা ম্যাপ আছে, আমাদের রেয়ার কালেকশন। অনেক পুরানো, সতেরোশো নব্বই সালের। এতো নরম হয়ে গেছে বের করে আলোতে আনাই রিস্কি।

প্লীজ, স্যার, অনুরোধ করলো রবিন। একবার অন্তত দেখান।

দ্বিধা করলেন হিসটোরিয়ান। মাথা ঝাঁকালেন। পেছনের ঘরের একটা দরজার দিকে নিয়ে চললেন ওদেরকে। ঘরটায় কোনো জানালা নেই, আর এমনভাবে তৈরি যাতে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা সবসময় একরকম থাকে। কাচের বাক্সে কিংবা কাচের দরজা লাগানো শেলফের মধ্যে রয়েছে সমস্ত পুরানো দলিলপত্র। একটা ফাইল দেখলেন হিসটোরিয়ান, তারপর একটা ডয়ার খুলে বের করে আনলেন লম্বা একটা কাচের বাক্স। ভেতরে একটা ম্যাপ। মোটা, হলদে কাগজে বাদামী রঙে আঁকা।

বের করা যাবে না, হিসটোরিয়ান বললেন। কাঁচের ওপর দিয়েই দেখো।

ম্যাপটার ওপর ঝুকে দাঁড়ালো গোয়েন্দারা।

ওই তো! বিশ্বাস করতে পারছে না পিনটু। স্প্যানিশে লেখা, কনডর ক্যাসল!

এটা! কাচের বাক্সের ওপর পিনটুর আঙুলের পাশে আঙুল রাখলো রবিন।

হ্যাঁ! একেবারে আলভারেজ ব্যাঙ্কের মধ্যেই! আঁকাবাকা রেখাগুলো দিয়ে বোধহয় সান্তা ইনেজ কীককে বোঝানো হয়েছে।

হঠাৎ করে চুটকি বাজালো মুসা। তাহলে দাঁড়িয়ে আছি কেন এখনও?

বিস্মিত হিসটোরিয়ানকে ধন্যবাদ জানিয়েই দরজার দিকে দৌড় দিলো ছেলেরা।

বৃষ্টি থেমেছে। কিন্তু পর্বতের ওপরে এখনও ইতিউতি ঘুরছে কালো মেঘের ভেলা যে-কোনো সময় ঝরঝর করে নামার পাঁয়তাড়া কষছে যেন। কাঁচা রাস্তা ধরে সাইকেল চালিয়ে বাঁধের দিকে চলেহে দুই গোয়েন্দা আর পিনটু। শুকনো অ্যারোইওর কাছে একজায়গায় মোড় নিয়েছে পথটা, সেখানে এসে থামলো পিনটু।

আমি যতদূর বুঝলাম, সে বললো, এই পাহাড়ের শেষ মাথায় চূড়াটাকেই বলা হতো কনডর ক্যাসল। ওটার ওপাশেই সান্তা ইনেজ ক্রীক।

রাস্তার ধারের ঝোপের মধ্যে সাইকেলগুলো লুকিয়ে ফেললো ওরা। তারপর চ্যাপারালের ঘন ঝোপ ঠেলে এগোলো গভীর অ্যারাইওর কিনারার দিকে। বাঁয়ে রয়েছে বাধটা, এখান থেকে চোখে পড়ে না-ঝোপঝাড়ে ঢাকা ঢিবিটার জন্যে, যেটা অ্যারোইওর মুখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছে।

উঁচু চূড়াটার দিকে মুখ তুলে তাকালো ছেলেরা।

ওটাই! পিনটু বললো। ম্যাপ তা-ই বলে।

এখন কি নাম ওটার? মুসা জানতে চাইলো। ভিজে মাটি নরম হয়ে গেছে, প্রায় কাদা। সেটা ধরে সাবধানে নেমে চলেছে।

বলতে পারবো না।

অ্যারোইও থেকে উঠে পাহাড়ে চড়তে আরম্ভ করলো ছেলেরা। ঢাল কোথাও ঢালু, কোথাও খাড়া। ওপরে উঠতে উঠতে হাঁপ ধরে গেল ওদের।

এই তাহলে কনডর ক্যাসল! বিস্ময়ে গলা কেঁপে গেল রবিরে।

অতো ওপরে দাঁড়িয়ে আশপাশের পুরো এলাকাটা চোখে পড়ছে শুধু উত্তর দিক ছাড়া। সেদিকে অনেক ওপরে উঠে গেছে পর্বতের চূড়া যেন আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টায়। পর্বতের গোড়ায় বাধ আর ক্রীকের কাছে ছড়িয়ে রয়েছে পোড়া অঞ্চল।

পশ্চিমে দেখা যাচ্ছে রাস্তা আর গভীর অ্যারোইও, একেবারে হাসিয়েনডার ধ্বংস্তুপের কাছে এগিয়ে গেছে। অনেক দূরে চোখে পড়ছে সাগর, ধূসর এই মেঘলা দিনে কালচে হয়ে আছে। দক্ষিণ-পশ্চিমে বাঁকা হয়ে পড়ে আছে যেন সান্তা ইনেজ ক্রীক, কিছু পানি চকচক করছে এখন তাতে। তার পরে প্রায় মাইলখানেক দূরে দেখা যায় ডয়েল র‍্যাঞ্চের বাড়িঘর আর কোরাল। দক্ষিণ থেকে একটা রাস্তা ডয়েল র‍্যাঞ্চ হয়ে চলে গেছে উত্তরে পর্বতের দিকে।

জায়গাটাকে কনডর ক্যাসল বলে কেন? মুসার প্রশ্ন। না দেখছি কনডর, না দুর্গ।

কনডর মানে জানো তো? রবিন বললো। এক ধরনের শকুন।

আমার মনে হয় নামটা দেয়া হয়েছে বার্ডস-আই ভিউ থেকে, অনুমান করলো পিনটু। অর্থাৎ পাখির চোখ থেকে দেখা। অনেক ওপর থেকে দেখা আরকি।

জানি। হতে পারে। তবে নাম নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এসো তলোয়ার খুঁজি। কোথায় লুকানো হয়েছে বলো তো?

লুকানোর জায়গা আছে নিশ্চয়, মুসা বললো। গর্ত, ফাটল। গুহাটুহাও থাকতে পারে। এসো, খুঁজি।

ছড়িয়ে পড়ে খুঁজতে আরম্ভ করলো ওরা। কিন্তু কোনো ফাটল বা গর্ত চোখে পড়লো না, গুহা তো দূরের কথা। মার্বেলের মতো মসৃণ পিঠ এখানে পাহাড়ের। প্রতিটি ইঞ্চি পরীক্ষা করে দেখলো ওরা। খাড়া ঢালের কিনারে যতোদূর যাওয়া সম্ভব গিয়ে উঁকি দিয়ে নিচে তাকালো। একেবারে নিরেট পাথর।

নাহ্, এখানে কিছু লুকানো যাবে না, মাথা নাড়লো মুসা। চলো চূড়ার নিচে ঢালে খুঁজে দেখি।

চলো, রবিন বললো। তুমি খোজো কীকের দিকটায়, আমি আর পিনটু অ্যারোইওর দিকটায়।

দুই দিক মোটামুটি ঢালু, ততোটা খাড়া নয়। আবার খোঁজা শুরু হলো। মুসা যেদিকে নামলো সেদিকে কিছু বড় বড় পাথর দেখা গেল, কোনো খাঁজটাজ বা ফাটল নেই। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। রবিন আর পিনটু তখনও খুঁজছে। ওদের কাছে চলে এলো সে।

না, লুকানোর জায়গা এখানেও নেই, রবিন বললো। গাল চুলকালো পিনটু। মাটিতে পুঁতে রাখেনি তো?

খাইছে! তাহলে সর্বনাশ! আঁতকে উঠলো মুসা। সমস্ত পাহাড় খুঁড়তে হবে তাহলে! অস!

আমার মনে হয় না মাটিতে পোঁতা হয়েছে, ধীরে ধীরে বললো রবিন। তাড়াহুড়োর মধ্যে ছিলেন তখন ডন। পুঁততে সময় লাগে। এতো সময় নিশ্চয় পাননি। তাছাড়া যেখানে পুঁতবেন সেখানে চিহ্ন দিয়ে রাখতে হবে, নইলে কিভাবে খুঁজে বের করবে স্যানটিনো? আর চিহ্নতে ডগলাসের চোখেও পড়ে যাওয়ার কথা।

মাথা নাড়লো রবিন। না, পুঁতে রাখেননি তলোয়ারটা। তবে কনডর ক্যাসলের কাছেই কোথাও লুকানো হয়েছে, যেখানে খুঁজে পাওয়ার কথা স্যানটিনোর। এমন কোনো জায়গা, যেটা তৈরি করতে হয়নি তখন, আর যেটাতে চিহ্ন দেয়ার দরকার পড়েনি।

কিন্তু, চারপাশে চোখ বোলালো মুসা, কোথায়?

কনডর ক্যাসলে নেই, এটা বোঝা গেল, বললো রবিন। তাহলে টাকে একটা চিহ্ন হিসে চিহ্ন হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। কাছেই কোনো জায়গা আছে, মনে হয়, যেখানে ডন আর স্যানটিনো প্রায়ই যেতো। পিনটু, তেমন কোনো জায়গা…

বাঁধটা হতে পারে।

বাঁধ? হ্যাঁ, হতে পারে।

পথ দেখিয়ে বাঁধের কাছে দুই গোয়েন্দাকে নামিয়ে নিয়ে এলো পিনটু। সেন্টার গেট দিয়ে পানি গিয়ে পড়ছে তিরিশ ফুট নিচের নালায়। বারে যতোটা ওপরে ওঠা স উঠে দেখলো ওরা। হাজার হাজার ছোট পাথর একসাথে চুণ-সুরকি দিয়ে গেঁথে তৈরি হয়েছে ওটা।

একেবারে ইস্পাত হয়ে গেছে, মুসা বললো। কুড়াল দিয়ে কুপিয়েও কাটা যাবে না।

দুশো বছর আগে স্থানীয় ইনডিয়ানদের সাহায্যে এটা তৈরি করেছিলো আলভারেজরা, পিনটু জানালো।

এখানেও তো কোনো ফাঁকফোকর দেখছি না, রবিন বললো। ওইই নিচে দেখা যাচ্ছে অবশ্য কয়েকটা। কিন্তু ওখানে নামতে হলে দড়ির মই দরকার। ডন পিউটোর কাছে নিশ্চয় তখন ওরকম মই ছিলো না।

মুসাও একমত হলো তার সঙ্গে।

কোথায় যে রাখলো! নিরাশা ঢাকতে পারলো না রবিন। আরও সূত্র যদি পেতাম!।

সূত্রই বা আর কোথায় পাবো, বলো? ডন পিউটো চিঠি তো লিখেছিলেন মোটে একটা।

গণ্যমান্য লোক ছিলেন তিনি। নিশ্চয় অনেক বন্ধু ছিলো তার। হয়তো কারও কাছ থেকে সাহায্য পেয়েছেন। কেউ তাকে দেখে থাকতে পারে। এমন কিছু সূত্র খুঁজে রে করা দরকার, যাতে বোঝা যায় পালানোর দিনটিতে কি কি করেছিলেন তিনি।

কিভাবে? বিশেষ আশা করতে পারলো না পিনটু। সে-অনেক বছর আগের কথা।

হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে ওই সময়ে টেলিফোন ছিলো না। লোকে চিঠির মাধ্যমেই যোগাযোগ করতো। লোকে ডায়রি রাখতো এখনকার চেয়ে অনেক বেশি। হয়তো এই এলাকায় খবরের কাগজও ছিলো একআধটা। কিছু না কিছু পেয়ে যাবোই…

আবার সেই হিসটোরিক্যাল সোসাইটি! গুঙিয়ে উঠলো মুসা। পুরানো কাগজ ঘটতে আর ভাল্লাগে না!

হেসে উঠলো রবিন। তোমার অসুবিধে হবে না। ওসব দলিলের বেশির ভাগই স্প্যানিশে লেখা। পড়ার কষ্ট করতে হবে না তোমাকে। আজ যাচ্ছি না আর আমরা, কাল কিশোরকে নিয়ে যাবো। এ-হপ্তার হোমওয়ার্ক করেছো?

আবার গুঙিয়ে উঠলো মুসা। সর্বনাশ! তাই তো! মনেই ছিলো না! আমারও না। আজ সারতে হবে। সাইকেলগুলোর কাছে ফিরে চললো ওরা।

ডান দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো মুসা। সরে বাঁধের ওপর থেকে নেমেছে ওরা। পিনটু, বললো সে, তোমাদের র‍্যাঞ্চের কারো কুকুর আছে? চারটে, বড় বড় কালো কুত্তা?

কুকুর? না তো…

আমিও দেখেছি, রবিনের কণ্ঠে অস্বস্তি।

দীঘির ওপারে আলভারেজদের সীমানার মধ্যেই ঘোরাফেরা করছে চারটে বিরাট কুকুর। লাল টকটকে জিভ বের করা, জ্বলন্ত চোখ।

বিকট চেহারা… কথা শেষ করতে পারলো না রবিন। তার আগেই শোনা গেল তীক্ষ্ণ হুইসেল। পাই করে ঘুরলো মুসা। সংকেত! জলদি দৌড় দাও!।

দাঁত বের করে লাফিয়ে উঠে বাঁধের দিকে দৌড় দিলো কুকুরগুলো।

পড়িমড়ি করে আবার বাঁধের ওপর উঠে পড়লো ছেলেরা। প্রাণপণে ছুটলো সামনে পঞ্চাশ গজ দূরের কতগুলো ওক গাছের দিকে।

অনেক…দূর..! হাঁপাচ্ছে রবিন।

পারবো না…! পিনটুরও কথা আটকে গেল।

জলদি করো! আরো জোরে! তাগাদা দিলো মুসা।

মুসাআ! পেছনে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠলো পিনটু। দেখো, সাঁতরাচ্ছে!

দীঘির পাশ দিয়ে ঘুরে না এসে তাড়াতাড়ি আসার জন্যে পানিতেই লাফিয়ে পড়েছে কুকুরগুলো। দ্রুত সঁতরে আসছে। শিগগিরই উঠে আসবে এপাশে। ধরে ফেলবে ছেলেদের।

তবে ভুল করেছে কুকুরগুলো। পানিতে না নেমে যদি ঘুরে আসতো তাহলে আরও তাড়াতাড়ি করতে পারতো। কিছুটা সময় পেয়ে গেল ছেলেরা। এবং সেটা কাজে লাগালো।

পৌঁছে গেল গাছগুলোর কাছে। কোনোদিকে না তাকিয়ে গাছে উঠতে শুরু করলো। উঠে বসলো ওপরের ডালে, কুকুরের নাগালের বাইরে।

পৌঁছে গেল জানোয়ারগুলো। শিকার হাতছাড়া হয়েছে দেখে খেপে গেল ভীষণ। তুমুল ঘেউ ঘেউ করে লাফালাফি শুরু করলো। ধরতে পারলে ছিঁড়ে ফেলবে এমন ভাব।

গাছের ওপর আটকা পড়লো তিন কিশোর।

আবার বেজে উঠলো হুইসেল। শান্ত হয়ে গেল কুকুরগুলো, শুয়ে পড়লো গাছের গোড়ায়।

দেখো। হত তললো রবিন। ভটকি আর তার মানেজার!

লাফিয়ে লাফিয়ে বাঁধের ওপর দিয়ে দৌড়ে আসহে তালপাতার সেপাই ছেলেটা। পেছনে তার হোল্কা ম্যানেজার। গাহের ওপরে ছেলেদের দেখে দাঁত বের করে হাসলো টেরিয়ার। আমাদের এলাকায় ঢুকেছো কেন? হাসতে হাসতে বললো সে। চুরি করতে?

তোমার কুত্তাগুলো তাড়িয়ে এনেছে আমাদের! রাগ করে জবাব দিলো পিনটু।

আলভারেজদের এলাকায় তোমরা কি করছিলে? ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

হেসে উঠলো ডরি। ঢুকেছিলাম সেটা প্রমাণ করতে পারবে?

আমরাই রং প্রমাণ করে দিতে পারি চুরি করে আমাদের সীমানায় ঢুকেছে তোমরা, টেরি বললো।

শেরিফকে জানিয়েছি, এখানে চোরের উৎপাত হচ্ছে, হেসে ডরি বললো। ওই যে, এসে পড়েছে।

ডয়েলদের এলাকার ভেতর দিয়ে আসা কাঁচা রাস্তা ধরে একটা গাড়ি আসতে দেখা গেল।

গাড়িটা থামলো। নামলেন শেরিফ আর তার ডেপুটি। এগিয়ে এলেন গাছের কাছে। জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার?

কয়েকটা চোরকে আটক করেছি, শেরিফ, ডরি বললো। আলভারেজদের ছেলেটা, আর তার দুই দোস্ত। বলেছিলাম না, ছেলেগুলো প্রায়ই ঢোকে আমাদের এখানে। নিশ্চয়ই চুরি করার মতলব। আরও শয়তানী করে। ঘোড়া ঢুকিয়ে গাছপালা নষ্ট করে, বেড়া ভাঙে, বেআইনীভাবে ক্যাম্প করে আগুন জ্বালে। আমার তো মনে হয় সেদিন আগুনটা ওরাই লাগিয়েছিলো।

মুখ তুলে ছেলেদের দিকে তাকালেন শেরিফ। নেমে এসো। ডরি, কুকুরগুলো সরাও।

নেমে এলো তিন কিশোর। ওদের দিকে তাকিয়ে গরগর করে উঠলো কুকুরগুলো।

দুই গোয়েন্দার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন শেরিফ। মুসা আর রবিন না তোমাদের নাম? ইয়ান ফ্লেচারের সঙ্গে দেখেছিলাম। তোমরা গোয়েন্দা। অনুমতি না নিয়ে অন্যের এলাকায় ঢাকা যে বেআইনী এটা তো তোমাদের জানা উচিত।

জানি, শান্ত কণ্ঠে বললো রবিন। ইচ্ছে করে ঢুকিনি আমরা। ওরাই বরং না বলে আলভারেজদের এলাকায় ঢুকেছিলো। আমাদের দেখে কুত্তা লেলিয়ে দিয়েছে। উপায় না দেখে এসে এই গাছে উঠেছি।

মিথ্যে কথা বলছে ওরা, শেরিফ! গর্জে উঠলো টেরিয়ার।

মিথ্যে কথা তো তুমি বলছো! পাল্টা জবাব দিলো মুসা।

শেরিফ, রবিন প্রমাণ করার চেষ্টা করলো, আমরা যদি আগে থেকেই ওদের সীমানায় থাকতাম, তাহলে কুত্তাগুলো কি করে ভিজলো? এখন তো বিষ্টি-টিষ্টি কিছু নেই?

ভিজেছে? কুকুরগুলোর দিকে তাকালেন শেরিফ। তাই তো?

আমাদের তাড়া করতে দীঘি সাঁতরে এসেছে বলেই ভিজেছে। ওটা আলভারেজদের এলাকা।

লাল হয়ে গেল ডরির গাল। বললো, ওদের কথা শুনবেন না, শেরিফ। কুকুরগুলোর গা আগেই ভেজা ছিলো।

তোমার কথা কিন্তু আর বিশ্বাস করতে পারছি না, কড়া চোখে ডরির দিকে তাকালেন শেরিফ। কুকুরগুলো কি করে ভিজেছে?

সেটা পরে বলছি। আরেকটা জিনিস দেখবেন, আসুন।

শেরিফকে নিয়ে চলে গেল ডরি।

কি দেখাবে, উটকি? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

সেটা এখন বলতে যাবো কেন? দাঁত বের করে হাসলো টেরি। দেখতেই পাবে।

মিনিট পনেরো পরে ফিরে এলেন শেরিফ। হাতে বাদামী রঙের একটা ব্যাগ। দুই গোয়েন্দা আর পিনটুর দিকে চেয়ে গভীর ভঙ্গিতে মাথা আঁকালেন, যাও, ছেড়ে দিলাম। কে মিথ্যে বলেছে, বুঝলাম না। যা-ই হোক, ডরিকে সাবধান করে দিয়ে এসেছি যাতে অন্যের এলাকায় কুত্তা না ছাড়ে। আর তোমাদেরও হুঁশিয়ার করছি অন্যের এলাকায় ঢুকবে না।

প্রতিবাদ করার জন্যে মুখ খুলতে যাচ্ছিলো পিনট আর মুসা। তাদের থামিয়ে দিয়ে রবিন বললো, ঠিক আছে, মনে থাকবে আপনার কথা। তারপর যেন নিতান্ত কথার কথা বলছে, এমনুভাবে জিজ্ঞেস করলো, ব্যাগে কি, স্যার?

সেটা তোমাদের জানার দরকার নেই। গম্ভীর হয়ে বললেন শেরিফ। এখন ভাগো এখান থেকে।

বাঁধের ওপর দিয়ে আবার সাইকেলের দিকে রওনা হলো ওরা। আলভারেজদের এলাকার কাঁচা রাস্তা দিয়ে যখন পোড়া খসিয়েনার দিকে চললো, জোর বৃষ্টি শুরু হলো আবার।

ধ্বংসস্তুপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রিগোর সঙ্গে দেখা। পোড়া হাইয়ের মধ্যে কিছু খুঁজছে যেন। পুড়ে নষ্ট হয়নি এমন কিছু এখনও আছে কিনা দেখছে হয়তো। ওদেরকে দেখতে পেলো না।

কিছু পেলেন? ডেকে জিজ্ঞেস করলো মুসা।

চমকে মুখ তুললো রিগো। কাঁচুমাচু হয়ে গেল, লজ্জা পেয়েছে। ইয়ে, কটেজ সোর্ডটাই খুঁজছি। আমার মনে হলো, ডন পিউটো যদি কোথাও লুকিয়ে থাকেন সেটা, হাসিয়েনডার ভেতরেই লুকিয়েছেন। বাড়ি পুড়ে ছাই হয়েছে। ভাবলাম এখন বেরোতে পারে। পড়ে থাকা কয়েকটা টালিতে লাথি মারলো রাগ করে। পেলাম না। কোনো চিহ্নই নেই!

কনডর ক্যাসল খুঁজে পেয়েছি আমরা, ভাইয়া, পিনটু জানালো।

সংক্ষেপে সব জানালো ওরা।

কনডর ক্যাসল খুঁজে পেয়েছে শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলো রিগোর চোখ, ওখানেও কিছু পাওয়া যায়নি শুনে আবার নিষ্প্রভ হয়ে গেল ধীরে ধীরে। তাহলে আর পেয়েই কি লাভ হলো?

তলোয়ারটা পাইনি বটে, তবে একেবারেই লাভ হয়নি একথাও বলা যাবে না, রবিন কললো।

কি লাভ?

হেলের জন্যে তলোয়ারটা লুকিয়ে রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন ডন পিউটো। কনডর ক্যাসলের নির্দেশ রয়েছে অনেক পুরানো ম্যাপে। যেখানে বন্দি করা হয়েছিলো ডনকে, সেই জায়গা আর তার বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই জায়গাটার। অথচ সেটার কথা লেখা হয়েছে চিঠিতে। এটা সূত্র না হলে কিছুতেই লিখতেন না।

যুক্তিতে তাই বলে, রিগো কললো। কিন্তু লাভটা…।

এঞ্জিনের শব্দে থেমে গেল সে। দুটো গাড়ি এসে ঢুকলো হাসিয়েনডার চত্বরে। একটা ডয়েলদের ওয়াগন, আরেকটা শেরিফের গাড়ি। ওয়াগন থেকে লাফিয়ে নামলো টেরি আর ডরি।

ওই তো! চেঁচিয়ে উঠলো ডরি।

ছাড়বেন না! ছাড়বেন না। ম্যানেজারের চেয়ে জোরে চেঁচালো টেরি। গাড়ি থেকে নামলেন শেরিফ। চুপ করো। অতো চেঁচিও না! বলেছি না, যা করার আমি করবো। তাঁর হাতে তখনও বাদামী ব্যাগটা রয়েছে। রিগোর সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। রিগো, যেদিন আগুন লেগেছিলো সেদিন কোথায় ছিলে?

কোথায় ছিলাম? ভুরু কোঁচকালো রিগো। কেন, আর সবার সঙ্গে আগুন নেভাতে গিয়েছিলাম। আপনি জানেনই তো। তার আগে ছিলাম রকি বীচের সেন্ট্রাল ইস্কুলে, পিনটুর সঙ্গে।

হ্যাঁ, ছিলে। তখন বিকেল তিনটে। তার আগে কোথায় ছিলে?

আগে? আমাদের র‍্যাঞ্চে। ব্যাপারটা কি, শেরিফ?

আগুন কিভাবে লেগেছে জানা গেছে। ডয়েলদের এলাকায় কেউ একজন ক্যাম্পফায়ার জ্বেলেছিলো। তিনটের বেশ কিছুক্ষণ আগে। বছরের এই সময়ে এভাবে আগুন জ্বালানো বেআইনী। যা-ই হোক, আগুনটা ঠিকমতো নেভানো হয়নি। ডয়েলদের বেড়া ভেঙে…

ঘোড়ার পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে! শেরিফের কথা শেষ হওয়ার আগেই বলে উঠলো ডরি। তোমাদের ঘোড়া। ওগুলো ধরে আনতে গিয়েই আগুনটা জ্বেলেছিলে, টেরি বললো। তারমানে আগুনটা তুমিই লাগিয়েছে।

শীতল গলায় বললো রিগো, পাশাপাশি র‍্যাঞ্চ থাকলে গরু-ঘোড়ায় ওরকম বেড়া ভাঙেই। ওগুলো ধরে আনার জন্যে একে অন্যের এলাকায়ও ঢেকে র‍্যাঞ্চাররা। সেটা এমন কোনো ব্যাপার না। পড়শীদের মধ্যে একটা আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং থাকেই। তবে ঢুকলেও আগুন আমরা লাগাইনি।

ব্যাগ খুলে একটা কালো সমব্রেরো হ্যাট বের করলেন শেরিফ। এটা কার হ্যাট, রিগো?

আমার। আমি মনে করেছিলাম সেদিন আগুনে পুড়ে গেছে। পেয়েছেন ভালোই হয়েছে…

আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো মনে করেছিলে? কর্কশ গলায় বলে উঠলো ডরি।

হ্যাঁ। তাতে কি? কঠিন দৃষ্টিতে ম্যানেজারের দিকে তাকালো রিগো।

রিগো, ডরি আর কিছু বলার আগেই বললেন শেরিফ, হ্যাটটা কখন হারিয়েছিলে?

কখন? মনে করার চেষ্টা করলো রিগো। বোধহয় আগুন নেভানোর সময়-…

না। আগুন নেভানোর সময় তোমার মাথায় হ্যাট ছিলো না। আমার ঠিক মনে আছে। কয়েকজন লোকের সাক্ষিও নিয়ে এসেছি। তারাও আমার সঙ্গে একমত।

কি জানি, মাথা চুলকালো রিগো। কখন হারিয়েছি সত্যিই মনে নেই আমার।

রিগো, এই হ্যাটটা পাওয়া গেহে একটা ক্যাম্পফায়ারের পাশে। যেটা থেকে আগুন ছড়িয়েছিলো।

তাহলে এটা পুড়লো না কেন?

কারণ, আগুনটা ক্যাম্পফায়ার সেকে শুধু একটা দিকে সরেছে। হ্যাটটা পড়ে ছিলো আরেক পাশে।

চুপ হয়ে গেল রিগো।

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেললেন শেরিফ। রিগো, তোমাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি আমি।

চিৎকার করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো পিনটু, তাকে থামালো রিগো। শেরিফের দিকে ফিরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, আপনার ডিউটি আপনি করুন, শেরিফ। তারপর আবার ভাইয়ের দিকে ফিরে বললে, ডন হেরিয়ানোকে গিয়ে এখুনি খবর দাও।

টেরি আর তার ম্যানেজারের দিকে ফিরে শেরিফ বলেন, তোরাও এসে আমার সাথে। স্টেটমেন্ট দিতে হবে।

নিশ্চয়ই, ডরি বললো।

খুশি হয়েই দেবো, বলে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো টেরি। মুখে মুচকি হাসি।

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে দুটো গাড়িকে চলে যেতে দেখলো ছেলেরা। পিনটুর চোখে পানি টলমল করছে। দুই গোয়েন্দার দিকে ফিরলো সে। বিশ্বাস করো, আমার ভাই আগুন লাগায়নি!

জানি, রবিন বললো। নিশ্চয়ই কোথাও একটা ঘাপলা আছে। ওই হ্যাটটা আগেও একবার দেখেছি, কিন্তু কোথায়, কখন, মনে করতে পারছি না। ইস্, এখন কিশোর এখানে থাকলে কাজ হতো।

হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো মুসা, যেন বাতাসে থাবা মারলো। সমস্যা ছিলো একটা, এখন হয়েছে দুটো। তলোয়ারটাও খুঁজে বের করতে হবে, রিগোকেও ছাড়িয়ে আনতে হবে।

১০

হেরিয়ানোকে খবর দিতে চললো পিনটু। রকি বীচে ফিরে চললো মুসা আর রবিন। তাড়াতাড়ি সাইকেল চালালো ওরা। বাড়ি ফিরে বার বার কিশোরকে ফোন করলে দুজনে, কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না স্যালভিজ ইয়ার্ড থেকে। বার্থডে পার্টি থেকে ফেরেনি বোধহয় কিশোররা। শুতে যাওয়ার আগে আরও একবার ফোন করলো দুজনে, সাড়া মিললো না ইয়ার্ড থেকে।

পরদিন সকালে নাস্তার জন্যে নিচে নেমে দেখে রবিন তার বাবা কাগজ পড়ছেন। ছেলের সাড়া পেয়ে মুখ তুললেন মিস্টার মিলফোর্ড। এই, রবিন, রিগোকে দেখি অ্যারেস্ট করেছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। রিগোর মতো অভিজ্ঞ র‍্যাঞ্চার ওরকম একটা কাঁচা কাজ করতেই পারে না।

ও লাগায়নি, বাবা। হয় শেরিফ ভুল করেছে, নয়তো কেউ ইচ্ছে করে রিগোকে ফাসিয়েছে। শয়তানী। সেটা প্রমাণ করে ছাড়বো আমরা।

তাই করো।

তাড়াহুড়ো করে নাস্তা সারলো রবিন। তারপর কিশোরকে ফোন করলো। সব শুনে কিশোর বললো, রিগো তো লাগায়নি। ওই হাটটাকেই প্রমাণ হিসেবে ধরেছে না? ইচ্ছে করলে তুমিই ঠেকাতে পারতে শেরিফকে। মনে নেই? ওই হ্যাট ওর মাথায় দেখেছি আমরা।

কখন? তোমার মতো তো ফটোগ্রাফিক মেমোরি না আমার। কোথায় দেখলাম?

ইস্কুলে এসো। বলবো।

কিশোরের এইসব তথ্য চেপে রেখে টেনশনে রাখার ব্যাপারটা ভালো লাগে না রবিনের। এখন ফোনে বললে কি অসুবিধে হতো? বিরক্তি চাপতে না পেরে রিসিভারটা আছড়ে ক্রেডলে ফেললো সে। ইস্কুলে পড়াশোনা আর ক্লাস নিয়ে এতো ব্যস্ত রইলো কথা বলার সুযোগ পেলো ছুটির পর। তবে সেদিন ছুটি হলো সকাল সকাল।

আজ পিনটুকে দেখেছো তোমরা? জোর বৃষ্টির মধ্যে সাইকেল চালিয়ে ইয়ার্ডে ফেরার সময় জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

খুঁজেছি, মুসা জবাব দিলো। দেখিনি। ইস্কুলে আসেনি মনে হয় আজ।

আসলেই আসেনি পিনটু। হেরিয়ানোর সঙ্গে কাটিয়েছে। একজন উকিল ঠিক করার চেষ্টা করেছে, ভাইকে ছাড়িয়ে আনার জন্যে। ইয়ার্ডে ঢুকে দেখলো তিন গোয়েন্দা, ওদের জন্যেই অপেক্ষা করছে পিনটু। হেডকোয়ার্টারে ঢুকলো চারজনে।

প্রাইভেট উকিলের খরচ দেয়ার সামর্থ্য নেই আমাদের, পিনটু জানালো, তাই পাবলিক ডিফেন্ডারস অফিসের সাহায্য চেয়েছি। ওরাও আশা দিতে পারলো না। কেসটা নাকি খারাপ।

সে তো জানিই,মুখ গোমড়া করে বললো রবিন। যদিও কাজটা করেনি সে।

কি করে প্রমাণ করবো, করেনি? চোখের কোণে পানি দেখা দিলো পিনটুর। আমাদের র‍্যাঞ্চই বা বাঁচাবো কি করে? ভাইয়া জেলে, কোনো সাহায্য করতে পারবে না। হাড়িয়ে আনতে যে জামিনের টাকা লাগবে, তা-ও দিতে পারবো না। এক মুহূর্ত থেমে কললো। পাঁচ হাজার ডলার জমা দিতে হয়।

পাঁচ হাজার! চোখ বড় বড় করে ফেললো মুসা তারমানে র‍্যাঞ্চটা তোমাদের বেচতেই হবে।

ওটা বেচেও তো লাভ হবে না। হেরিয়ানোর ধার শোধ করে আর খুব একটা থাকে না। প্রথমেই পাঁচ হাজার দেয়ার দরকার নেই অবশ্য। জজ বলেছে, দশ ভাগের একভাগ আপাতত দিলেই চলবে, বাকিটা কিস্তিতে। সেটাই বা পাবো কোথায়? ধারে চেষ্টা করছি।

আমার মনে হয়, গম্ভীর হয়ে বললো কিশোর, বুঝেশুনেই শয়তানীটা করেছে কেউ। আগুন লাগাটা দুর্ঘটনা ছিলো না। হ্যাটটা চুরি করে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পফায়ারের কাছে ফেলে রেখেছে। সেটা প্রমাণ করতে পারলেই হতো।

কিন্তু কিভাবে? করুণ হয়ে উঠেছে পিনটুর মুখ।

হ্যাটটা শেষ কখন রিগোর মাথায় ছিলো, তাই তো জানি না আমরা, বললো রবিন।

জানি, কিশোর বললো। গত বিষ্ণুত্বারে বেলা তিনটায় তার মাথায় ছিলো ওটা। যেদিন আগুন লেগেছিলো। মনে নেই? ইস্কুলের বাইরে যখন আমাদের সাথে দেখা হলো, তখন ছিলো।

ঠিক বলেছো, ঠিক! চেঁচিয়ে উঠে টেবিলে বাবা মারলো রবিন।

তারমানে ক্যাম্পফায়ারের কাছে হ্যাট ফেলে আসেনি রিগো, শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর, তিনটের আগেও ছিলো মাথায়, পরেও। আমাদের সঙ্গে ছিলো তখন। তার পরে আগুন নেভাতে গিয়েছিলো। শেরিফ যদি তার মাথায় হ্যাট দেখে না থাকেন, তাহলে হ্যাটটা খোয়া গেছে ইস্কুল থেকে আমাদের রওনা হওয়া থেকে আগুন নেভাতে যাওয়ার সময়ের মাঝখানে, কোনো এক সময়।

কিশোর, রবিন বললো, আগুন নেভাতে যাওয়ার সময় ট্রাকের পেছনে ছিলো রিগো, আমাদের সঙ্গে। তখন বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেনি তো? ক্যাম্পফায়ারের কাছে গিয়ে পড়ে থাকতে পারে।

অসম্ভব, পিনটু মাথা নাড়লো। ড্র-কর্ড দিয়ে চিবুকের নিচে আটকানো থাকে ওই হ্যাট। কোনো কিছুতে চড়ার সময় ওটা খুব শক্ত করে আটকে নেয় ভাইয়া।

তাছাড়া সেদিন তেমন বাতাসও ছিলো না, যোগ করলো মুসা। সেজন্যেই তো বেশি ছড়াতে পারেনি আগুন।

যাই হোক, কিশোর কললো, আগুনটা শুরু হয়েছিলো আমরা র‍্যাঞ্চে পৌঁছার আগেই। কাজেই ট্রাক থেকে হ্যাটটা উড়ে গিয়ে থাকলেও বুঝতে হবে আগুন লাগার পরে ক্যাম্পফায়ারের কাছে গিয়ে পড়েছিলো ওটা।

প্রমাণ করতে পারছি না, নাক কুঁচকালো রবিন, সেটাই হলো মুশকিল।

আমরা সাক্ষি দিতে পারি অবশ্য। তাতে কতোটা কাজ হবে জানি না। তবে সত্যিকারের কোনো প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। সুতরাং প্রমাণ জোগাড় করতে হবে। জানতে হবে হ্যাটটা কিভাবে ক্যাম্পফায়ারে কাছে গিয়ে পড়েছিলো।

কি করে, কিশোর? মুসার প্রশ্ন।

প্রথমে রিগোর সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করবো, হ্যাটটা শেষ কখন মাথায় ছিলো, কিংবা কখন খুলেছিলো মনে করতে পারে কিনা। একই সঙ্গে করটেজ সোর্ড খোঁজাও চালিয়ে যাবো। আমরা যে খুঁজছি এটা জানে টেরি আর ডরি। তলোয়ার খুঁজছি কি না জানলেও এটা বুঝতে পেরেছে, দামী কিছু খুঁজছি আমরা, যেটা বিক্রি করে আলভারেজ র‍্যাঞ্চ বাঁচানো যাবে। সেজন্যেই হয়তো রিগোকে অ্যারেস্ট করিয়েহে আমাদের ঠেকানোর জন্যে।

আবার তাহলে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে যেতে হবে আমাদের, রবিন বললো, নতুন সূত্র খুঁজতে।

পাবো না, নিরাশ ভঙ্গিতে এপাশ ওপাশ মাথা দোলালো মুসা। সারা জিন্দেগী খুঁজেও বের করতে পারবো না।

কাজটা সহজ হলে তো অনেক আগেই বের করে ফেলতো কেউ, কিশোর বললো। তবে ঠিকমতো চেষ্টা করলে বের করা যাবেই। দুটো দিনের ওপর জোর দিতে হবে আমাদের। পনেরো আর মোল সেপ্টেম্বর, আঠারোশো ছেচল্লিশ সালের। পনেরো তারিখে পালিয়েছেন ডন পিউটো, তার আগে পর্যন্ত বন্দি ছিলেন, এবং তার পরে তার কি হয়েছে কেউ জানে না। দেখেওনি কেউ। তারপর, ঠিক পরের দিনই, ষোল তারিখে আর্মি থেকে পালিয়েছে তিনজন সৈনিক। তাদেরকেও আর দেখা যায়নি।

আচ্ছা, টেবিলে কনুই রেখে সামনে ঝুঁকলো রবিন, কনডর ক্যাসলকে নিজের ঠিকানা বোঝাতে চাননি তো ডন?

মাথা নাড়লো কিশোর। না, তার ঠিকানা ছিলো ক্যারিলো হাউস।

একটা গল্প বলি। ডন পিউটোর মতোই বিপদে পড়েছিলো একজন লোক, স্কটসম্যান, নাম ক্লানি ম্যাকফারসন। সতেরোশো পঁয়তাল্লিশ সালে ইংরেজরা স্কটিশ হাইল্যাণ্ড দখল করে বসলো, কালোডেনের যুদ্ধে স্কটদেরকে পরাজিত করে। ম্যাকফারসনকে খুঁজে বেড়াতে লাগলো তারা, খুন করার জন্যে। কারণ ম্যাকফারসন ছিলো হাইল্যাণ্ডের একজন চীফ। বেশি ভাগ চীফই তখন দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। কিন্তু ম্যাকফারসন পালায়নি।

কি করলো? কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো পিনটু।

ঠিক তার বাড়ির কাছেই গুহায় গিয়ে ঢুকলো। পুরো এগারোটা বছর বাস করেছিলো ওখানে। তার অনেক বন্ধু ছিলো, তারা তাকে সাহায্য করেছে। খাবার দিয়েছে, পানি দিয়েছে, কাপড় দিয়েছে। ইংরেজরা বুঝতেই পারেনি কিছু। বিপদ কেটে গেল একদিন, আবার বেরিয়ে এলো ম্যাকফারসন।

তারমানে, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে মুসা, তুমি বলতে চাইছে, কনডর ক্যাসলের কাছাকাছি কোনো গুহায় লুকিয়েছিলেন ডন পিউটো?।

মাথা ঝাঁকালো রবিন। অসত্ব কি? লুকিয়ে ছিলেন বলেই হয়তো কেউ তাঁকে আর দেখতে পায়নি।

কেউ দেখতে পায়নি, একথাটা তাহলে ঠিক না, শুধরে দিলো কিশোর। ম্যাকফারসনের মতোই তাঁর বন্ধুরা তাঁর সাথে দেখা করেছে, খাবার-কাপড়-পানি দিয়েছে। এদিকটা তুমি ভালোই ভেবেছে, রবিন, আমার খেয়াল হয়নি। তাহলে আমাদের খোঁজার সময়টা আরও বাড়িয়ে দিতে হবে। আঠারোশো হেচল্লিশের শুধু ষোল সেপ্টেম্বরে হবে না, পরের দিনগুলোরও খাবার নিতে হবে।

খাইছে! আতঙ্ক ফুটলো মুসার চোখে। কয়েকটা কমপিউটর লাগবে! নইলে অসম্ভব।

গোয়েন্দাগিরি অতো সহজ না, নির্বিকার ভঙ্গিতে বললো কিশোর। রহস্য জটিলতর হচ্ছে বলে মজাই পাচ্ছে সে। খোঁজার দরকার হলে খুঁজবে। তবে তোমার তেমন ভয় নেই। তুমি স্প্যানিশ জানো না। কাজটা করতে হবে আমাকে আর নিটুকেই।

আমি আর মুসা তাহলে কি করবো? রনি জানতে চাইলো।

জেলে যাবে।

জেলে! চমকে গেল মূস।

আরে না না, মুচকি হাসলো কিশোর, আসামী হয়ে যাবার কথা বলছি না। যাবে রিগোর সঙ্গে কথা বলতে।

১১

পুলিশ হেডকোয়ার্টারের ওপরের একটা তলায় রকি বীচ জেলখানা। তালাবদ্ধ গরাদের সামনে ডেস্কে বসে আছে একজন ডিউটিরত পুলিশ্যান। দ্বিধাজড়িত পায়ে তার দিকে এগিয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। রিগো আলভারেজের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি চাইলো।

সরি, বয়েজ, লোকটা বললো, লাঞ্চের পরে ভিজিটিং আওয়ার। তবে আসামীর উকিল যখন খুশি তার সঙ্গে দেখা করতে পারে। একটা বিমল হাসি উপহার দিলো পুলিশম্যান।

কেউকেটা গোছের মানুষ ওরা, এমন ভাব দেখিয়ে রবিন বললো, সে আমাদের মক্কেল।

অনেকটা উকিলের মতোই ধরতে পারেন আমাদেরকে, মুসা বললো।

দেখো, আমি বস্ত। অহেতুক বকবক করার সময়…

অহেতুক করছি না, তাড়াতাড়ি বললো রবিন। আমরা প্রাইভেট ডিটেকটিভ। রিগো আমাদের মক্কেল। এই কেসের ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতে চাই। খুব জরুরী। আমরা

হাসি হাসি ভাব দূর হয়ে গেছে লোকটার। পুরোপুরি গভীর এখন। ভ্রুকুটি করে বললো, যাও, বেরোও এখন! বেরোও।

ঢোক গিললো রবিন। মুসাকে নিয়ে বেরোতে যাবে, এই সময় পেছনে কথা বলে উঠলো একটা কণ্ঠ, ওকে তোমাদের কার্ডটা দেখাও না, তাহলেই তো হয়।

চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরলো রবিন আর মুসা। হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন রকি বীচের পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার।

কার্ড বের করে কর্তব্যরত পুলিশম্যানকে দেখালো রবিন। ইয়ান ফ্লেচারের দেয়া সার্টিফিকেটের একটা ফটোকপিও দেখালো।

কি জন্যে এসেহো, রবিন? চীফ জিজ্ঞেস করলেন।

জানালো রবিন।

সব শুনে মাথা ঝাঁকালেন চীফ। পুলিশম্যানের দিকে ফিরে বললেন, দেখা করতে দিতে পারো।

দিচ্ছি, স্যার, উঠে দাঁড়ালো লোকটা। আমি জানতাম না আপনি ওদেরকে সার্টিফাই করেছেন। আগে ওটা দেখালেই হতো।

ওরা যে কতোবার কতোভাবে পুলিশকে সাহায্য করেছে, জানো না তুমি। বয়েস কম হলে কি হবে, তুখোড় গোয়েন্দা, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন চীফ। ছেলে চেয়ে বললেন, আমি যাই, কাজ আছে। একবার হেসে চলে গেলেন তিনি।

একটি কলিংবেলের বোতাম টিপলো পুলিশম্যান। একটা করিডর দিয়ে বেরিয়ে এলো আরেকজন পুলিশ। গোয়েন্দাদেরকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললো তাকে প্রথম পুলিশম্যান।

আসামীর সঙ্গে দেখা করতে যাবারও নানা ঝক্কি। অনেক নিয়ম-কানুন। সেগুলো পালন করার পর গিয়ে আসামীর দেখা পেলো দুই গোয়েন্দা।

এসেছো, শান্তকণ্ঠে বললো রিগো। ভালো। তবে আমার কিছু দরকার নেই।

আমরা জানি আগুনটা আপনি লাগাননি, মুসা বললো।

হাসলো রিগো। জানি আমিও। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে?

আমরা সেটা প্রমাণ করে ছাড়বো, দৃঢ়কণ্ঠে বললো রবিন।

কিভাবে?

বেলা তিনটায় যে রিগোর মাথায় হ্যাট দেখেছে, সেকথা তাকে বললো রবিন।

তাহলে নিশ্চয়ই, উজ্জ্বল হলো রিগোর চোখ, আগুন লাগার পর কোনোভাবে ডয়েলদের জমিতে গিয়ে পড়েছিলো হ্যাটটা!

এমনও হতে পারে, অন্য কোথাও পড়ে ছিলো ওটা, কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে ডয়েলদের এলাকায়?

হ্যাঁ, পারে! আমাকে ফাঁসানোর জন্যে।

সেটা জানার চেষ্টা করছি আমরা। কে, কিভাবে ক্যাম্পফায়ারের কাছে নিয়ে গিয়ে হ্যাটটা ফেললো।

কাজেই আমাদের জানা দরকার, রবিনের কথার পিঠে বললো মুসা, কখন আপনার মাথা থেকে খুলেছেন ওটা। ট্রাকে করে যখন আগুন নেভাতে যাচ্ছিলাম, তখন কি ছিলো?

গাল চুলকালো রিগো। চোয়ালে হাত বোলালো। তারপর মাথা নাড়লো, নাই, মনে করতে পারছি না।

ভাবুন! জোর দিয়ে বললো মুসা।

হ্যাঁ, ভাবুন, গলা মেলালো রবিন।

কিন্তু অসহায় চোখে শুধু তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো বেচারা রিগো।

পুরানো খবরের কাগজের সমস্ত সংস্করণ মাইক্রোফিল্ম করে রাখা হয়েছে। মাইক্রোফি রীডারে সেগুলো পুরে পড়ছে পিনটু। তাকে রকি বীচ লাইব্রেরিতে রেখে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে চলে গেছে কিশোর। দুজনে দুই জায়গায় খোঁজার জন্যে।

কাগজের প্রতিটি সংখ্যার প্রতিটি পাতা খুঁটিয়ে দেখছে পিনটু। সেপ্টেম্বরের ষোল থেকে অক্টোবরের শেষ হপ্তায় চলে এলো। কিছুই পায়নি এতোক্ষণেও, শুধু একটা সংখ্যায় ডন পিউটোর মৃত্যুর সংক্ষিপ্ত খবর ছাড়া। সার্জেন্ট ডগলাসের রিপোর্টেরই পুনরাবৃত্তি, আর কিছু না।

জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাত মাথার ওপরে তুলে শরীর টানটান করলো সে। ঘরটা নীরব। বাইরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে।

পত্রিকা দেখতে ইচ্ছে হলো না আর তার। বুঝলো, ওগুলোতে কিছু পাওয়া যাবে। টেবিলে হাতের কাছেই একগাদা বই ফেলে রেখেছে। ওগুলো সব ছাপানো মেমোয়ার আর ডায়েরী, উনিশ শতকে লেখা স্থানীয় মানুষের। যতোগুলো জোগাড় করতে পেরেছে লাইব্রেরি, সব তুলে এনে একসাথে করে ছেপে নিয়েছে।

প্রথম মেমোয়ারটা টেনে নিলো পিনটু। লিস্ট দেখে পাতা খুললো : মিড-সেপ্টেম্বর,

১৮৪৬।

পঞ্চম জার্নালটা বন্ধ করে কান পাতলো কিশোর পাশা। বাইরে ঝমঝম ঝরছে অব্রিাম বৃষ্টি। স্প্যানিশ সেটেলারদের হাতে লেখা পুরানো ইতিহাস পড়তে দারুণ লাগে তার, তবে সেগুলোর ওপর থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে এনে শুধু খুঁজছে ডন পিউটোর খবর। কিন্তু এততক্ষণেও কোনো সূত্র চোখে পড়েনি।

কিছুটা হতাশ হয়েও হয় নম্বর জার্নালটা টেনে নিলো সে। এটা পড়তেততো কষ্ট হবে না, বুঝলো, কারণ এটা ইংরেজিতে লেখা।

মিনিট দশেক পরে হঠাৎ সামনে ঝুঁকে গেল সে, ঢিলেমি ভাবটা দূর হয়ে গেছে মুহূর্তে। চকচক করছে চোখ। বার বার করে পড়লো লেখাটা। আমেরিকান সেনাবাহিনীর একজন সেকেণ্ড লেফটেন্যান্টের কথা।

লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো সে। পৃষ্ঠাটার একটা ফটোকপি করে নিলো। জার্নালগুলো অ্যাসিসটেন্ট হিসটোরিয়ানকে বুঝিয়ে দিয়ে প্রায় ছুটে বেরোলো ঘর থেকে। বাইরের বৃষ্টির পরোয়াই করলো না।

আবার মাথা নাড়লো রিগো। নাহ্, কিছু মনে করতে পারছি না!

বেশ, রবিন বললো, জোর করে শান্ত রাখছে নিজেকে, আমরা আপনাকে সাহায্য করছি। ধাপে ধাপে আসা যাক। ইস্কুলে আপনার মাথায় হ্যাটটা ছিলো। কিশোরের সেটা মনে আছে, আমারও। এখন

টেরি আর ডরিরও নিশ্চয় মনে আছে, বাধা দিয়ে তিক্ত কণ্ঠে বললো মুসা। হাজার চাপ দিলেও ব্যাটারা স্বীকার করবে না সেটা।

না করুক, রবিন বললো। মুসা বলেছে, স্যালভিজ ইয়ার্ডে আপনার মাথায় ওটা দেখেছে, তাই না মুসা?

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো মুসা।

ট্রাকে আলভারেজদের ইতিহাস আমাদের শুনিয়েছেন আপনি। আমার পরিষ্কার মনে আছে, হাত তুলে তুলে জায়গা দেখাচ্ছিলেন আপনি, আপনার হাতে ছিলো না হ্যাট। ট্রাকে করে যাওয়ার সময় জোরালো বাতাস ছিলো, কনকনে ঠাণ্ডা, কাজেই মাথায় যাতে বাতাস না লাগে সেজন্যে হ্যাটটা তখন মাথায় পরে থাকাই স্বাভাবিক।

তারপর আমরা হাসিয়েনডায় পৌঁছলাম, রবিনের কথার খেই ধরলো মুসা। ট্রাক থেকে নামলাম। আপনি রাশেদ আংকেলের সঙ্গে করটেজের মূর্তিটা নিয়ে কথা বললেন। তারপর? হাসিয়েনডায় ঢুকেছিলেন? হ্যাটটা খুলেছিলেন?

ভালো রিগো। না, আমি ঘরে ঢুকিনি।…আমি…দাঁড়াও দাঁড়াও…হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে!

কী? চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। জলদি বলুন! তাগাদা দিলো রবিন।

জ্বলজ্বল করছে এখন রিগোর চোখ। সরাসরি গোলাঘরে ঢুকেছিলাম, মিস্টার পাশাকে মাল দেখানোর জন্যে। ভেতরে আলো কম ছিলো। হ্যাটের কানা ছায়া ফেলছিলো চোখের ওপর, তাই খুলে হাতে নিয়েছিলাম। তারপর, ছেলেদের দিকে তাকালো সে, ওটা দরজার কাছে একটা হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। ওটা ওখানেই থাকলো। হুগো আর ষ্টেফানো যখন আগুন আগুন বলে চিৎকার করে উঠলো হ্যাট না নিয়েই ছুটে বেরোলাম।

হুঁ। তাহলে ওটা ওখানেই থাকার কথা, রবিন কললো। ক্যাম্পফায়ারের কাছে নয়।

তারমানে কেউ একজন, বললো মুসা, ওটা বের করে নিয়ে গেছে ঘরে আগুন লাগার আগেই। নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছে ক্যাম্পফায়ারের কাছে।

কিন্তু, রিগো কললো, সেটা প্রমাণ করা যাচ্ছে না।

দেখি গোলাঘরে গিয়ে কিছু মেলে কিনা, আশা করলো রবিন। সব নিশ্চয় পুড়ে মাটিতে মিশে যায়নি। সূত্র পেলে পেতেও পারি। মুসা, চলো, কিশোরকে গিয়ে বলি।

রিগোকে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে এলো দুজনে।

বাইরে বৃষ্টি। তারমধ্যেই সাইকেল চালিয়ে হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে চললো ওরা। কিন্তু ওখানে পাওয়া গেল না কিশোরকে।

গেল কোথায়? রবিনের দিকে তাকালো মুসা।

কি জানি, ঠোঁট কামড়ালো রবিন। অন্ধকার হতে দেরি আছে, আরও ঘণ্টা দুয়েক। চলো, আমরাই গিয়ে খুঁজি।

চলো। কিশোররাও হয়তো ওখানেই গেছে।

আবার বাইরে বৃষ্টিতে বেরিয়ে এলো ওরা। রওনা হলো আলভারেজ র‍্যাঞ্চে।

১২

হাসিয়েনডার চত্বরে ঢুকলো রবিন আর মুসা। বৃষ্টি থেমেছে। পোড়া কালো ধ্বংসপটা নীরব, নির্জন। কিছু পোড়া খুঁটি আর দেয়াল দাঁড়িয়ে রয়েছে এখনও, যেন ঘরগুলোর কঙ্কাল। হাসিয়েনডার পেছনে পাহাড়ের মাথায় আগের মতোই দাঁড়িয়ে রয়েছে ভাঙা ঘোড়ার মূর্তি, নিচ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘের মধ্যে কেমন যেন ভূতুড়ে লাগছে ওটাকে। কিশোর আর পিনটুকে দেখা গেল না।

অপেক্ষা করবো? মুসার প্রশ্ন।

এসেছি যখন চুপ করে থেকে লাভ কি? এসো খুঁজি।

ভাঙা দেয়াল, আর পড়ে থাকা কড়িবর্গাগুলোর দিকে বিতৃষ্ণ নয়নে তাকালো মুসা। যা অবস্থা! কি করে খুঁজবো?

বাইরেই খুঁজি আগে। কোনো কিছু পড়ে থাকতে পারে। পায়ের ছাপ পাওয়া যেতে পারে।

কোরালাটা যেখানে ছিলো তার দুপাশে ছড়িয়ে পড়লো দুজনে। মাথা নিচু করে দেখতে দেখতে এগোলো গেটের দিকে। পুরো চত্বরে কাদা হয়ে গেছে বৃষ্টিতে। আঠালো কাদা জুতো কামড়ে ধরে টান দিয়ে তুলতে গেলে বিচিত্র শব্দ হয়ে যায় ফচাৎ করে।

গোলার দরজার কাছে চলে এলো ওরা। পোড়া কাঠামোটা কিম্ভুত ভঙ্গিতে বেঁকেচুরে রয়েছে।

একটা কাঠিও দেখছি না মাটিতে, মুসা বললো। এমন কাদার কাদা, সব ঢেকে

ফেলেছে।

পায়ের ছাপও পাওয়া যাবেনা। চলো, ভেতরে দেখি।

ভেতরের অবস্থা আরও খারাপ। কড়ির্গা, ধসে পড়া দেয়াল, হাত, ঘোড়ার স্টল, আর হাজারটা পোড়া জিনিস যেন জট পাকিয়ে রয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে সেসব জঞ্জাল থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছে, নাকে জ্বালা ধরায়। কোনো জিনিসই চেনার উপায় নেই। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো দুজনে।

এখানে পাবো? মাথা নাড়লো মুসা। মনে হয় না। কি খুঁজতে এসেছি সেটাই জানি না!

সূত্র। দেখলেই বুঝে যাবো যে ওটা খুঁজছি। কোনখান থেকে শুরু করবো?

দরজার কাছ থেকে। যেখানে ঝোলানো ছিলো হ্যাটটা। ওই দেখো, বাঁ দিকের দেয়ালে হুকটা এখনও আছে।

আছে। হুকের কঙ্কাল, বিড়বিড় করলো মুসা। পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে কাঠের হুক।

কালো হয়ে থাকা দেয়ালে এখনও গাথা রয়েছে তিনটে হুক, একসারিতে। ওগুলোর নিচের মাটিতে খোঁজা আরম্ভ করলো ওরা।

জঞ্জালের অভাব নেই। অনেক জিনিসই পাওয়া গেল, কিংবা বলা ভালো জিনিসের ধ্বংসাবশেষ, তবে সবই ওগুলো আলভারেজদের জিনিস, কোনো সূত্র-টুত্র না।

অবশেষে কিছু না পেয়ে ধপ করে একটা পোড়া বর্গার ওপর বসে পড়লো মুসা। হবে না। সূত্রটার গায়ে যদি সূত্র সীল মারা থাকে, তাহলেই শুধু চিনবো।

ঠিকই বলেছে, হাল ছেড়ে দিয়েছে রবিনও। এতো বেশি জঞ্জলি…

এই, কে যেন আসছে, লাফ দিয়ে উঠে দরজার দিকে এগোলে মুসা। বোধহয় কিশোর-..। কথা শেষ না করেই চকিতে সরে চলে এলো ভাঙা দেয়ালের আড়ালে। ফিসফিস করে বললো, তিনজন! চিনি না!

জঞ্জালের তূপের আড়ালে বসে পড়ে সাবধানে মাথা তুলে উঁকি দিলো রবিন।

এদিকেই আসছে! জলদি ওখানে ঢোকো। কড়িকৰ্গার ওপর পড়ে থাকা কতগুলো টালি দেখালো সে। ভেতরে ঢোকার জায়গা আছে।

শরীর মুচড়ে মুচড়ে নিঃশব্দে সেই ফাঁকে ঢুকে পড়লো দুজনে। উপুড় হয়ে পড়ে রইলো মাটিতে। নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে, পাছে ওনে ফেলে লোকগুলো।

গোলাঘরে এসে ঢুকলো তিন আগন্তুক।

জঘন্য চেহারা, ফিসফিসিয়ে না বলে পারলো না মুসা। তাকে চুপ করতে বললো রবিন।

ঠিক দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চোখ বোলাতে লাগলো লোকগুলো। একজন বিশালদেহী, কালো চুল, পুরু গোঁফ, মুখে তিন-চার দিনের না-কামানো দাড়ি। দ্বিতীয়জন ছোটখাটো, মুখটা লম্বাটে-মুসার মনে হলো, ইঁদুরের মুখের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে, কুতকুতে চোখে যেন রাজ্যের শয়তানী ভরা। তৃতীয়জন মোটা, টাকমাথা, টকটকে লাল মোটা নাক, সামনের কয়েকটা দাঁত ভাঙা। তিনজনেই নোংরা, পরনে মলিন জিনস, কাদামাখা কাউবয় বুট পায়ে, গায়ে ওঅর্ক শার্ট, মাথায় তেল চটচটে, ময়লা, দোমড়ানো হ্যাট। হাত-মুখের খসখসে চামড়া দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না, শেষ গোটা মাসখানেক আগে হয়তো করেছে।

পোড়া ধ্বংসস্তুপের দিকে তাকিয়ে একজনও খুশি হতে পারলো না।

এখানে কিছু পাবো না, বললো হাড্ডিসর্বস্ব ইঁদুরমুখো। কি করে বের করবো এখান থেকে, গুড়ু?

রে করতেই হবে, জবাব দিলো বিশালদেহী লোকটা।

সম্ভব না, গুডু, ইঁদুরের মতো কিচকিচ করে কথা বলে মোটা, টাকমাথা লোকটা। কোনো উপায় দেখছি না।

না খুঁজেই ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে দিলে? ধমকের সুরে বললো গুড়। এখানেই আছে।

বেশ, দেখছি, ইঁদুরের কণ্ঠ শোনালো আবার মোটো। লাথি মারতে আরম্ভ করলো জঞ্জালে। এমন একটা ভাব করছে, যেন যা খুঁজছে যে কোনো মুহূর্তে লাফ দিয়ে বেরিয়ে চলে আসবে চোখের সামনে।

এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি শুরু করলো ইঁদুরমুখো। খুঁজছে, তবে তেমন মন আছে বলে মনে হলো না। গুডু বলেছে, তাই খুঁজছে, এই আরকি।

রেগে গেল গুড। এটা কিরকম কাজ হচ্ছে নিকি! ভালোমতো খোজো।

গুডুর দিকে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরবে তাকিয়ে রইলো ইঁদুর, তারপর খোঁজায় আরেকটু মন লাগালো।

এই, হারনি, তুমিও ফাঁকি মারছে! টাকমাথাকে ধমক লাগালো বিশালদেহী।

সাথে সাথে মেঝেতে বসে পড়লো হারনি। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে জঞ্জালের তলায়, ফাঁকফোকরে উঁকি দিয়ে দেখতে লাগলো। তার দিকে তাকালো একবার নিকি আর গুডু, দুজনেই বিরক্ত, দরজার ফ্রেমের দুই পাশে খুঁজতে শুরু করলো ওরা।

এখানেই হারিয়েছে? নিকি জিজ্ঞেস করলো গুড়ুকে। তুমি শিওর?

না হলে কি এসেছি নাকি? তাড়াতাড়ি পালানোর জন্যে ইগনিশনের কি করেছিলাম মনে নেই? পরে আরেক সেট লাগাতে হয়েছে।

খুঁজতে খুঁজতে অন্তত বার দুই মুসা আর রবিনের কাছাকাছি চলে এলো ওরা। একবার তো গুডু এতো কাছে চলে এলো, হাত বাড়ালেই তার জুতো ছুঁতে পারতো মুসা। লোকটার বুটের বিশেষ খাপে ঢোকানো ধারালো কাউবয় হুরিটার দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো সে।

বুঝতে পারছি না কিছু কিছুক্ষণ পর আরও বিরক্ত হয়ে বললো নিকি। আর কোথাও হারায়নি তো?

গাধা নাকি! গর্জে উঠলো গুড়। এখানেই তো…

এতো ধমক মারছো কেন? সমান তেজে জবাব দিলো এবার নিকি। তারপর বললো, দেখি, বাইরে পড়লো কিনা।

আরেকবার খোঁজায় মন দিলো ইদরখো। তার দুরিটাও দেখতে পেলো মুসা।

হুঁ, অবশেষে বললো গুডু, বুঝতে পারছি, এভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আলো দরকার। চলো, আরেকবার গিয়ে খুঁজে দেখি, যেখানে সেদিন পার্ক করেছিলাম। কিছু না পেলে আলো নিয়ে এসে আবার খুঁজবো।

বেরিয়ে গেল তিনজন। চত্বরে ওদের কথা কাটাকাটি শোনা গেল কিছুক্ষণ। তারপর চুপ হয়ে গেল। বোধহয় চলে গেছে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো রবিন আর মুসা। নির্জন চত্বর।

ওরা কে জানি না, রবিন কললো। তবে একটা কথা বোঝা গেল, আগুন লাগার দিন ওরা এসেছিলো এখানে। রিগোর হাট চুরির সঙ্গে ওদের কোনো সম্পর্ক আছে।

আমার মনে হয় গাড়ির চাবিটাবি হারিয়েছে ওরা।

আমারও তাই মনে হলো। মিষ্টার ডয়েলের ওখানে কাজ করে বোধহয়।

চাবি হারিয়ে থাকলে ব্যাপারটা সত্যি ওদের জন্যে বিপজ্জনক। কিংবা আর কারও জন্যে। এসসা, খুঁজি।

খুঁজলাম তো। ওরাও খুঁজলো নেই।

ওরা ঠিকমতো খোজেনি। এখন আমরা জানি কি খুঁজতে হবে। দরজার আশপাশে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জঞ্জাল তুলে দেখবো। একটা পোড়া কাঠ-টাঠ তুলে আনো না।

একটা বেলচাই পাওয়া গেল। যুই আর জঞ্জাল খুঁচিয়েতুলতে আরম্ভ করলো মুসা। যেই ধাতব কিছুতেই লাগে কেলচা, শব্দ হয়, অমনি দুজনে মিলে বসে পড়ে বেলচায় উঠে আসা জঞ্জালে হাত দিয়ে দেখে। প্রতিটি জিনিস রীক্ষা করে। ওদেরকে সাহায্য করার জন্যেই যেন মেঘ অনেকখানি পাতলা হয়ে এসেছে, আলো বেড়েছে, দেখতে সুবিধে হচ্ছে তাতে। মেঘের ফাঁকে এখন নীল আকাশও বেরিয়ে এসেছে কোথাও কোথাও।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো রবিন, মুসাআ! আঙুল নির্দেশ করলো একটা চকচকে জিনিসের দিকে।

তুলে নিলো মুসা। দেখার জন্যে এমনভাবে ঝুঁকে এলো রবিন, মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে গেল দুজন্মে। থাবা মেরে প্রায় কেড়ে নিলো জিনিসটা মুসার হাত থেকে।

দুটো চাবি। রিঙে লাগানো। রিঙটায় একটা খাটো চেন, চেনের আরেক মাথায় রূপার একটা নকল ডলার।

কোনো চিহ্নটি আছে? মুসা জিজ্ঞেস করলো। নাম-টাম?

না। তবে গাড়ির চাবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটাই খুঁজতে এসেছিলো লোকগুলো?

না-ও হতে পারে, অতোটা আশা করতে পারলো না মুসা। রিগোর চাবিও হতে পারে এটা। কিংবা তার কোনো বন্ধুর।

এই, তোমরা এখানে কি করছো?

ঝট্‌ করে ফিরে তাকালো মুসা আর রবিন। হারনি দাঁড়িয়ে আছে পোড়া দরজার কাছে।

পেছনে। রবিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো মুসা। কুইক! পেছনে ঘুরে দৌড় মারলো দুজনে। লাফিয়ে পেরিয়ে এলো জঞ্জালের কয়েকটা প। গোলাঘরের পেছনে ওক গাছগুলো পোড়েনি, এখনও জীবন্ত। ঢুকে পড়লো ওগুলোর ভেতরে। গাছের আড়ালে থেকে ফিরে তাকালো চত্বরের দিকে।

এই! কে ছেলেগুলো! শুডুর গর্জন শোনা গেল। পোড়া হাসিয়েনডার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

ঠিক এই সময় কোরালের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নিকি, ডেকে বললো, গুডু, ছেলেগুলো নাকি কিছু পেয়েছে! হারনি বলেছে!

পাগলের মতো আশেপাশে লুকানোর জায়গা খুঁজলো রবিন আর মুসা। হাসিয়েনডার চত্বরে রয়েছে ওদের সাইকেল। ওগুলোর কাছে যেতে হলে লোকগুলোকে

পেরিয়ে যেতে হবে। এখানেও লুকানোর জায়গা নেই।

পাহাড়! ফিসফিসিয়ে বললো মুসা। আর কোথাও জায়গা নেই!

তর্ক করলো না রকিন। করার সময়ও নেই। মুসার পেছন পেছন দিলো দৌড় সেই শৈলশিরাটার দিকে, যেটাতে পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুণ্ডুহীন ঘোড়র মূর্তিটা।

১৩

লাইব্রেরিতে এসে পিনটুকে খুঁজে বের করলো কিশোর। মুখ কালো করে বসে আছে আলভারেজদের শেষ বংশধর। কললো, গিরিখাতে গোলাগুলির অনেক খবর আছে। কিন্তু ডনের কি হয়েছিলো, সে-সম্পর্কে কিছুই নেই।

দরকারও নেই। জিনিস পেয়ে গেছি আমি। রবিন আর মুসাও নিশ্চয় কাজ শেষ কবে ফেলেছে। চলো, যাই।

কোথায়? হেডকোয়ার্টারে। ওখানেই আসবে ওরা।

স্যালভিজ ইয়ার্ডে এসে দুটো সাইকেল পার্ক করে রেখে ট্রেলারে ঢুকলো দুজন। রবিন আর মুসা আসেনি।

এখনও হয়তো কথা বলছে রিগোর সাথে, কিশোর বললো। আসুক। আমরা বসি।

তুমি কি জিনিস পেলে? বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো পিনটু।

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো কিশোর। উত্তেজনায় আবার চকচক করে উঠলো চোখ। আমেরিকান সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার ছিলো ফ্রিমন্টস, যার দলে ছিলো সার্জেন্ট ডগলাস আর দুই করপোরাল। আরও একজন অফিসার ছিলো, সে সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট, জার্নাল রাখতো। আঠারোশো ছেচল্লিশের পনেরো সেপ্টেম্বর লিখেছে এই লেখাটা, বলে পড়তে লাগলো সে। মাথা ঘুরছে আমার! মেজাজও ভীষণ খারাপ। হবেই। যা অত্যাচার যাচ্ছে শরীরের ওপর দিয়ে। তারপরেও স্বস্তি নেই, রেহাই পেলাম

কাজ থেকে। আজ রাতে আমার ডিউটি পড়লো ডন পিউটো আলভারেজের হাসিয়েনডায়, লুকানো জিনিসের খোঁজ করার জন্যে। শোনা গেছে, চোরাই মাল নাকি আছে ওখানে। সন্ধ্যা হয় হয় এই সময় এমন একটা জিনিস চোখে পড়লো, বিশ্বাস করতে পারলাম না। হয়তো আমার চোখের ভুল, প্রচণ্ড ক্লান্তিতে অমন হয়েছে। দেখলাম, সান্তা ইনেজ ক্ৰীকের পাশের একটা শৈলশিরা ধরে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে ডন পিউটো আলভারেজ, হাতে একটা ব্রিট তলোয়ার। পিছু নেয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কাছাকাছি যাওয়ার আগেই অন্ধকার নেমে এলো। আর এগোতে সাহস করলাম না, কারণ আমার শরীরের অবস্থাও ভালো নয়। যদি সত্যিই ডন হয়ে থাকে, তার সাথে একলা লাগতে যাওয়া বোকামি হয়ে যাবে। ক্যাম্পে ফিরে রিপোর্ট করলাম। আমাকে, জানানো হলো, সেইদিন সকালেই পালাতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা পড়েছে ডন, কাজেই আমি যাকে দেখেছি সে ডন হতেই পারে না। তাহলে কাকে দেখলাম? চোখের ভুল? ভূত? বার বার জিজ্ঞেস করছি ক্লান্ত মনকে, কোনো জবাব পাচ্ছি না।

তারমানে গুলি খেয়ে মরেননি ডন প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু। লেফটেন্যান্ট সত্যিই দেখেছে। কিশোর, তার হাতে তলোয়ারটাও ছিলো

ছিলো, হাসলো কিশোর। এখন জোর দিয়ে বলা যায়, পনেরো সেপ্টেম্বর রাতে জীবিত ছিলেন ডন, সাথে ছিলো করটেজ সোর্ড। ভুল দেখেনি লেফটেন্যান্ট। মুসা আর রবিন এলেই দেখতে যাবো।

কিন্তু আরও আধঘণ্টা পরও যখন ওরা ফিরলো না, আশঙ্কা জাগলো পিনটুর মনে। কিছু হয়নি তো ওদের?

গোয়েন্দাগিরি করতে গেলে হওয়াটা স্বাভাবিক, গভীর হয়ে বললো কিশোর। আমার মনে হয়, রিগোর কাছ থেকে কোনো তথ্য জানতে পেরে খোঁজ নিয়ে দেখতে গেছে সেটা।

কোথায় গেল?

নিশ্চয় হাসিয়েনডায়। আর কোথায় যাবে? চলো, আমরাও যাই।

ট্রেলার থেকে বেরিয়ে আবার সাইকেলে চাপলো দুজনে। বৃষ্টি কমছে। ওরা হাসিয়েনডায় পৌঁছতে পৌঁছতে একেবারে কমে গেল। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ। কাউন্টি রোড ধরে সান্তা ইনেজ কীকের ব্রিজ পেরোনোর সময় দেখলো পানিতে কানায় কানায় ভরে গেছে নালাটা। অ্যারোইওর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মুখ তুলে করটেজের মূর্তিটার দিকে তাকালো পিনটু। চিৎকার করে উঠলো, কিশোর, দেখো দেখো, নড়ছে!

ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষলো দুজনেই।

না, মূর্তি নড়ছে না, কিশোর কললো। ওটার কাছে কেউ উঠেছে।

মূর্তির পেছনে লুকিয়েছে?

মনে হয়…দুজন…আরে দৌড়াচ্ছে!

আসছে তো এদিকেই!

মুসা আর রবিন!

চলো, চলো!

পথের পাশের ঝোপে ঠেলা দিয়ে সাইকেল দুটো ঢুকিয়ে রেখেই দৌড় দিলো দুজনে। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছে, পিছলে পড়ছে রকিন আর মুসা, কিন্তু পরোয়াই করছে না যেন ওসবের। কি করে রাস্তায় নেমে আসবে দ্রুত, কেবল সেই চেষ্টা। শৈলশিরাটা যেখানে শেষ হয়েছে, তার গোড়ায় একটা খাদ রয়েছে। ওখানে মিলিত হলো চার কিশোর।

কিশোর, প্রমাণ পেয়েছি! হাঁপাতে হাঁপাতে বললো মুসা।

লোক তিনটে দেখে ফেলেছে আমাদের! এতো জোরে দম ফেলছে রবিন, জড়িয়ে যাচ্ছে কথা।

তিনজন? কারা? পিনটু হাঁপাচ্ছে।

চিনি না। তাড়া করলো আমাদের।

জলদি চলো ব্রিজের দিকে, কিশোর বললো। ওটার নিচে লুকানোর জায়গা আছে।

কিন্তু ওখানেও খুঁজবে,রবিন বললো, জানা কথা।

রাস্তার ধারে একখানে একটা বড় ড্রেন-পাইপ আছে, পিনটু জানালো। ওটা দিয়ে একটা খাদে নেমে যাওয়া যায়। খাদের মধ্যে এতো জংলা, ঢুকলে আর দেখতে পাবে না। চলো চলো।

পাহাড় থেকে বেরিয়ে আসা বিশাল ড্রেনটার মুখের কাছে এসে পঁাড়ালো চারজনে। ভেতরে পানি বইছে, তবে খুব কম, সামান্যতম দ্বিধা না করে তাতে ঢুকে পড়লো পিনটু। অন্য তিনজনও ঢুকলো। গিয়ে নামলো খাদের মধ্যে। কাদা থিকথিক করছে ওটাতে, একেবারে তলায় পানিও জমেছে যেখানটায় সবচেয়ে বেশি গভীর। চারপাশে চ্যাপারালের ঘন ঝোপ। তার মধ্যে লুকিয়ে বসে রইলো ওরা।

কি প্রমাণ পেয়েছো? ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

চাবিটার কথা জানালো রবিন আর মুসা। ওটা হাতে নিয়ে ম্লান আলোয় দেখলো পিনটু। আমাদের না।

তাহলে ওই লোকগুলোরই কারো, কিশোর বললো। মনে হচ্ছে গোলাঘরে আগুন লাগার আগে ঢুকেছিলো ওখানে। চাবিটা হারিয়েছে। এবং কাউকে জানতে দিতে চায় না যে ওরা ঢুকেছিলো। হয়তো হ্যাটটা ওরাই চুরি করে নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পফায়ারের কাছে রেখে দিয়েছিলো।

কিন্তু ওরা কারা? খসখসে হয়ে গেছে মুসার গলা।

কি করে বলি? তবে ওই আগুন লাগা আর রিগোর অ্যারেস্টের পেছনে ওদের হাত আছে শশশশ!

রাস্তায় হুটন্ত পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। আস্তে ঝোপ ফাঁক করে তাকালো ছেলেরা। দুপদাপ করে দৌড়ে ওদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল তিন কাউবয়।

কখনও দেখিনি, ফিসফিসিয়ে জানালো পিনটু। মিস্টার ডয়েলের লোক হতে পারে। নতুন চাকরি নিয়েছে হয়তো।

এখানে কি করছে? মুসার প্রশ্ন।

সেটাই জানতে হবে, জবাব দিলো কিশোর।

আবার ফিরে না এলেই বাঁচি! রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো রবিন।

বসেই রইলো ছেলেরা। কান পেতে রয়েছে। আরও পনেরো মিনিট পর জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে কিশোর বললো, গিয়ে দেখা উচিত।

আমি যাচ্ছি, পিনটু উঠে দাঁড়ালো। মুসা আর রবিনের পিছে লেগেছে ওরা, আমার নয়। আমাকে সন্দেহ করবে না।

রাস্তায় উঠে বাঁয়ে মোড় নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল পিনটু। খাদের মধ্যে অপেক্ষা করতে লাগলো তিন গোয়েন্দা। শব্দটা প্রথম শুনতে পেলো রবিন। কে এসেছে দেখার জন্যে উঠতে গেল সে।

রাখো! বাধা দিলো মুসা। পিনটু না-ও হতে পারে।

খাদের কাছে এসে থামলো কেউ। ডেকে বললো, বেরিয়ে এসো।

পিনটু। খাদ থেকে উঠে এলো তিন গোয়েন্দা। ফিরে এলো সান্তা ইনেজ ক্রীকের ব্রিজের কাছে। হাত তুলে দেখালো পিনটু। সবাই দেখলো, উত্তরের কাঁচা রাস্তা ধরে ডয়েল র‍্যাঞ্চের দিকে চলে যাচ্ছে তিন কাউবয়।

গেছে, হেসে বললো পিনটু। এখান থেকেই আমাদের তদন্ত শুরু হবে, তাই না কিশোর?

কিসের তদন্ত? বুঝতে পারলো না মুসা।

লেফটেন্যান্টের জার্নালের কথা মুসা আর রবিনকে জানালো কিশোর। ফটোকপি করে আনা লেখাটাও দেখালো।

খাইছে বলে উঠলো মুসা। ডন পিউটো তাহলে সত্যি সত্যি পালিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলো করটেজ সোর্ড।

হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। তবে লেফটেন্যান্ট যেভাবে লিখেছে, তাতে জায়গা খুঁজে পাওয়ার ভরসা কম। জায়গাটার কোনো বর্ণনা দেয়নি।

কিন্তু কিশোর, বলেছে… প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল পিনটু।

ও তো বিশ্বাসই করেনি, বলবে কি? তবে যতদূর মনে হয় ওদিকটার কথা বলেছে। হাত তুললো কিশোর। বলেছে সান্তা ইনেজ ক্রীকের পাশের একটা শ্লৈাি ধরে গিয়েছেন। নিশ্চয় বেরিয়েছিলেন হাসিয়েনডা থেকে। তার মানে পশ্চিমে গেছে।

সেদিকে তাকালো সবাই।

কিছুই বোঝা গেল না, ওদিক দিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন ডন।

মাথা গরম ছিলো তখন লেফটেন্যান্টের নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর।

কি দেখতে কি দেখেছে। কিছু একটা ভুল করেছে, লিখতে গিয়ে। হয়তো যা দেখেছিলো ঠিকমতো লিখতে পারেনি।

আবার নিরাশা এসে ভর করলো ওদের মনে।

চলো ফিরে যাই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো গোয়েন্দাপ্রধান।

ধীরে ধীরে আবার ফিরে চললো ওরা। বাড়ি যাবে।

১৪

রাতে আবার জোর বৃষ্টি শুরু হলো। ঝরলো পরদিন সারাটা কেলা। ইস্কুলে যেতে হলো তিন গোয়েন্দাকে। ক্লাসে বসে তলোয়ারটার কথা আলোচনার সুযোগ পেলো না।

বিকেলে ভাইকে চাবিটা দেখাতে নিয়ে গেল রিগো। তিন কাউবয়ের কথা বললো। রিগোও চিনতে পারলো না ওদের। চাবিটাও না। পোড়া গোলাবাড়িতে কেন এসেছিলো ওরা, তা-ও বুঝতে না পেরে অনুমানে বললো, মিস্টার ডয়েল জোর করে আমাদের তাড়াতে চান আরকি। সেজন্যেই গুণ্ডাপাণ্ডা ভাড়া করেছেন।

ডিনারের পর আবার বেরোলো সেদিন তিন গোয়েন্দা। হিসটোরিক্যাল সোসাইটি আর লাইব্রেরিতে তথ্য খুঁজতে। আবার ঘাটতে লাগলো গাদা গাদা পুরনো খবরের কাগজ, জার্নাল, ডায়রি, মেমোয়ার, আর্মি রিপোর্ট। নতুন কিছুই পেলো না।

কোনোদিনই আর থামবে না বলে যেন জেদ ধরেছে বৃষ্টি। পড়েই চলেছে, পড়েই চলেছে, একটান। সেদিন রাতে পড়লে, পরদিন বুধবারেও কমতি নেই। বন্যা হতে পারেঃ জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিলো কাউন্টি। ইস্কুল ছুটির পর বাড়িতে কাজ সারতে গেল রবিন আর মুসা। ভাইকে দেখতে গেল পিনটু। হিসটোরিক্যাল সোসাইটিতে গেল আবার কিশোর।

কাজ শেষ করে হেডকোয়ার্টারে চলে এলো রবিন আর মুসা। কিশোরফেরেনি। পিনটুও আসেনি। ভেজা রেনকোট ছড়িয়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো ওদের জন্যে

রবিন, তলোয়ারটা পাবো তো? আর তেমন আশা করতে পারছে না মুসা।

জানি না,মুসার মতোই নিরাশায় ভুগছে রবিন।

আগে এলো পিনটু। দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে এসে ট্র্যাপডোর দিয়ে ঢুকলো ট্রেলারে। গত দুই দিন তার সঙ্গে দেখা হয়নি গোয়েন্দাদের। বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ছেলেটাকে।

কি ব্যাপার? শঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো রবিন। তোমার ভাইয়ের কিছু হয়েছে?

ভাইয়ার কিছু হয়নি, তবে আমরা শেষ! ভেজা জ্যাকেটটা খুলে ওদের পাশে বসে পড়লো পিনটু। আমাদের মর্টগেজের কাগজ ছিলো সিনর হেরিয়ানোর কাছে।

তিনি সেটা বিক্রি করে দিয়েছেন মিস্টার ডয়েলকে।

বলো কি কপাল কুঁচকে ফেললো মুসা।

কিন্তু তিনি তো বলেছিলেন…

বলেছিলেন আরও সময় দেবেন, রবিনের কথাটা শেষ করে দিলো পিনটু। কিন্তু আমাদের জন্যেই সেটা করতে পারলেন না। ভাইয়ার জামিনের টাকা দরকার। আর নিজের ইচ্ছেয় বিক্রি করেননি হেরিয়ানা, ভাইয়ার সঙ্গে আলোচনা করেই করেছেন। ভাইয়াই চাপাচাপি করেছে করতে।

হুঁহ! গেল তাহলে, বলে চুপ হয়ে গেল রবিন।

তলোয়ারটাও পাওয়ার আশা নেই, এদিকে জমিও…, কিশোরকে দেখে থেমে গেল মুসা।

ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে গোয়েন্দাপ্রধান। হাঁপাচ্ছে। জানালো, শুঁটকি ব্যাটা পিছু নিয়েছিলো। অনেক কষ্টে খসিয়ে এসে লাল-কুকুর-চার দিয়ে ঢুকলাম।

পিছু নিয়েছিলো কেন? পিনটু জিজ্ঞেস করলো।

জিজ্ঞেস তো আর করিনি,ভোতা গলায় জবাব দিলো কিশোর। আমার রয়েছে তাড়া, ওকে জিজ্ঞেস করার সময় কোথায়? যতো তাড়াতাড়ি পারলাম চলে এলাম। কি পেয়েছি, শোনো…

ধুড়ুম করে কি যেন পড়লো, ট্রেলারের বাইরের জঞ্জালের মাঝে। আরেকবার হলো শব্দ। বাইরের বৃষ্টির মধ্যে থেকে ভেসে এলো টেরিয়ারের কণ্ঠ, শার্লকের বাচ্চা! এখানেই কোথাও লুকিয়েছে, আমি জানি!

দড়াম করে আবার কিছু একটা বাড়ি লাগলো এসে ট্রেলারের গায়ে। গোয়েন্দারা কোথায় লুকিয়েছে জানে না, তবে আন্দাজ করতে পারছে জঞ্জালের ভেতরেই কোথাও রয়েছে। চেঁচিয়ে বললো, নিজেদের খুব চালাক ভাবো, না? বারোটা বাজিয়ে ছাড়বো এবার মেকসিকান ছাগলগুলোর। শনিবারে ওদের র‍্যাঞ্চ দখল করবো, দেখি কিভাবে ঠেকাও।

পরস্পরের দিকে তাকালো ছেলেরা। শুধু কিশোরকে অবাক মনে হলো। মর্টগেজটা যে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে এটা এখনও জানানো হয়নি তাকে।

শনিবার, বুঝলে শার্লকের বাচ্চারা? আবার চেঁচালো টেরিয়ার। এইবার হেরে গেলে আমার কাছে। পরক্ষণেই শোনা গেল গা জ্বালানো হাসি।

হাসতে হাসতে চলে গেল টেরিয়ার। তার হাসি মুছে যাওয়ার পরও কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো চার কিশোর। ইয়ার্ডে কোনো শব্দ নেই। শুধু মাথার ওপরে ট্রেলারের হাতে বৃষ্টির ঝমঝমানি ছাড়া।

অবশেষে কিশোর বললো, আমাদের ধোঁকা দিতে চেয়েছে…

না, পিনটু বললো। ঠিকই বলেছে ও।

মিস্টার ডয়েলের কাছে মর্টগেজ বিক্রি করা হয়েছে, একথা কিশোরকে জানালো

শনিবারে আমাদের পয়লা পেমেন্ট দেয়া হবে, একমুহূর্ত চুপ থেকে আবার বললো নিট।

জিতেই গেলেন মিস্টার ডয়েল, আনমনে বিড়বিড় করলো কিশোর।

হার মানবো! রবিন অবাক।

কিশোর পাশা হেরে যাবে, মুসাও বিশ্বাস করতে পারছে না। কিশোর, তুমি…তুমি একথা বলছো!

ক্ষণিকের জন্যে হাসি ঝিলিক দিলো কিশোরের চোখের তারায়। দুটো শব্দ বাদ দিয়েছি। বলতে চেয়েছি মনে হয় জিতে গেলেন। একটা সুবিধে হয়েছে এতে। আমাদের থামাতে আসবে না এখন আর কেউ। সময় যেটুকু পেলাম, তার পুরো সদ্ব্যবহার করতে হবে। তবে খুব বেশি সময় নেই আমাদের হাতে।

সময়ও নেই, সূত্রও নেই,নাক কুঁচকে বললো মুসা।

অনেক আছে, কিশোর বললো। ঠিকমতো এতোদিন কাজে লাগাতে পারিনি ওগুলো। আরও একটা জিনিস পেয়েছি। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলো সে। রবিনের আন্দাজ ঠিক। গুহায়ই লুকিয়েছিলেন ডন পিউটো।

লুকিয়েছিলেন? তাহলে পরে কি হলো তাঁর? বন্ধুরা দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলো?

হতে পারে। তবে আমার তা মনে হয় না। ওরকম হলে কোনো না কোনো দলিলে প্রমাণ পাওয়া যেতোই। পালাতে পারেননি তিনি। পর্বতের মধ্যেই কিছু একটা ঘটেছিলো তার। কেউই হয়তো জানে না, কি হয়েছিলো। এবং আমার বিশ্বাস, ওটা জানতে পারলেই রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারবো।

কেউই যদি না জানে, আমরা জানবো কি করে?

জেনে নেবো নিজেরাই। কারণ আমি জানি কোথায় লুকানোর পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। চিঠিতেই সেকথা স্পষ্ট বলে দিয়েছেনঃ কনডর ক্যাসল। ওই পাহাড়ের কাছেই রয়েছে রহস্যের জবাব। তোমরা খুঁজতে গিয়েছিলে বটে, তবে নিশ্চয় কিছু একটা মিস করেছিলে, বুঝতে পারোনি। কাল ইস্কুল ছুটির পর আবার যাবো আরা কনডর ক্যাসলে।

১৫

বৃহস্পতিবার ইস্কুল ছুটি হলো। বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। সূত্র খুঁজতে রওনা হলো গোয়েন্দারা।

বৃষ্টিতে ভিজে কাহিল হয়ে আছে রাস্তার অবস্থা। সাইকেল চালানোই মুশকিল। কাঁচা রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে হাউনি রয়েছে, হঠাৎ বৃষ্টি এলে বা অন্য কোনো অসুবিধেয় পড়লে পথচারীদের মাথা গোঁজার জন্যে। ওরকম একটা ছাউনিতে সাইকেল রেখে পায়ে হেঁটে এগোলো ওরা। সাথে করে ব্যাগ নিয়ে এসেছে রবিন। তাতে কিছু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আর টর্চ আছে। ব্যাগটা সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে খুলে বেল্টে ঝুলিয়ে নিলো। বাঁধের দিকে পথ ধরলো ওরা, ওদিক দিয়েই যাবে কনডর ক্যাসলে।

আরিব্বাবা, কতো পানি! চলতে চলতে বললো মুসা। আরও বৃষ্টি হলে আর হাঁটার দরকার নেই, সাঁতরেই ফিরতে পারবো।

কনডর ক্যাসলের কাছাকাছি পৌঁছে দেখলো পানিতে টইটম্বুর হয়ে আছে অ্যারোইও। ওটা ঘুরে এসে টিবিটার ওপর দিয়ে চড়তে হবে শৈলশিরায়।

টিবির নরম গা থেকে অনেক ঝোপঝাড় খসে পড়েছে বেশি খাড়া হলে চড়াই যেতো না, ঢালু বলে রক্ষা।

তারপরেও চড়তে অনেক অসুবিধে হলো। যাই হোক, কোনোমতে এসে উঠলো কনডর ক্যাসলের চুড়ায়। ওপর থেকে আজ অন্য দৃশ্য দেখতে পেলো রবিন আর মুসা, সেদিনকার সঙ্গে অনেক পার্থক্য। শুধু সেন্টার গেট দিয়েই বাঁধের পানি উপচে পড়ছে না আজ, পুরো বাঁধটাই যেন ভাসিয়ে নেয়ার মতলব করেছে, ওপর থেকে মনে হচ্ছে একটা বড়সড় জলপ্রপাত। বাঁধের নিচে পাক খেয়ে খেয়ে বয়ে যাচ্ছে পানি, প্রচুর ফেনা, কাউন্টি রোডের পাশের নালা আর খানাখন্দ ভরে দিয়ে বয়ে চলেছে সাগরের দিকে।

কিশোর এই দৃশ্য দেখতে আসেনি। সেদিকে তাকালো বটে, তবে তার মন অন্য চিন্তায় ব্যস্ত। বিড়বিড় করে বললো, কোথায় একজন মানুষ দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকতে পারে?

এখানে তো নিশ্চয়ই নয়, বললো মুসা। গুহা তো দূরের কথা, একটা ফাটলও নেই।

আশেপাশে কোথায় গুহা আছে, পিনটু? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

কি জানি, মাথা চুলকালো পিনটু। আমি বলতে পারবো না। পর্বতের ওদিকে অবশ্য আছে,

না, অতোদূরে নয়, মাথা নেড়ে বললো কিশোর। কাছাকাছি।

বাঁধের ভেতরটা হয়তো ফাঁপা, মুসা বললো।

আরে নাহ,মানতে পারলো না রবিন।

গোপন কোনো খাদ-টাদ থাকতে পারে, বললো কিশোর। যেখানে তাঁবু বা ঝুপড়ি তুলে থাকা যায়। বাইরে থেকে কারো চোখে পড়বে না।

ওরকম কিছুই নেই এখানে, কিশোর, পিনটু বললো। এদিকের সমস্ত পাহাড় আমি চিনি।

শ্রমিকদের বাড়িঘরের কি অবস্থা? রবিন জিজ্ঞেস করলো। নিশ্চয় অনেক কাজের মানুষ ছিলো ডন পিউটোর?

ছিলো। কিন্তু সব কাউন্টি রোডের ধারে, ভালো জায়গায়। একটাও এখন নেই।

পিনটু, জিজ্ঞাসু চোখে পিনটুর দিকে তাকালো মুসা, কাঁচা রাস্তাটা এক জায়গায় দুভাগ হয়ে গেছে দেখেছি। একটা তো এসেছে বাঁধের দিকে, আরেকটা কোথায় গেছে?

পর্বতের ভেতর দিয়ে ঢুকে আবার বেরিয়ে গিয়ে উঠেছে কাউন্টি রোডে, সিনর হেরিয়ানোর এলাকায়।

অ্যারোইওর ওপাশে দূরে একটা পথ দেখিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো মুসা, ওই পথটার সাথে কোনো যোগাযোগ আছে ওটার?

পথ? ভুরু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো কিশোর, মুসা যা দেখেছে দেখার জন্যে।

হ্যাঁ, হাত তুললো পিনটু, ওই ওটার কথা বলছো তো? আছে। কাঁচা রাস্তা থেকে বেরিয়ে পাহাড় ঘুরে গেছে।

সবাই দেখেছে পথটা এখন। খুব সরু একটা পায়েচলা পথ, চ্যাপারালের ঝোপের ভেতর দিয়ে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের গোড়ায় ওকে জঙ্গলে।

ছাউনি! হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো পিনটু। ভুলেই গিয়েছিলাম! পুরানো একটা ঝুপড়ি আছে। অনেক আগে এক বুড়ো বানিয়েছিলো, থাকতো ওখানে। তক্তা আর টিন দিয়ে। অনেক দিন যাই না।

ডন পিউটোর আমলে ছিলো ওটা? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

ছিলো। ভাইয়ার মুখে শুনেছি, আগে নাকি ওখানটায় একটা অ্যাডাব রুম ছিলো।

লুকানো, অব্যবহৃত, আর যাওয়ার পথটা শুধু কনডর ক্যাসল থেকেই দেখা যায়! উত্তেজিত হয়ে উঠেছে গোয়েন্দাপ্রধান। বোধহয় ওটাই জায়গা!

তাড়াহুড়ো করে আবার নামতে শুরু করলো ওরা। টিবির ঢালে পিছলে পড়া ঠেকাতে পারলো না একজনও, কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল জুতো, প্যান্টে লেগে গেল কাদা। বাঁধ পার হয়ে যেতে হবে। উপচে পড়া পানির দিকে শঙ্কিত চোখে তাকালো কিশোর। ভেঙে-টেঙে পড়বে না তো পানির চাপে?

সব সময়ই ওরকম পানি হয়, পিনটু জানালো। পড়ে তো না। টিকে আছে শত শত বছর ধরে।

তাহলে চলো,মুসাও ভয় পাচ্ছে এতো পানি দেখে।

নিরাপদেই এসে পায়েচলা সরু পথটায় উঠলো ওরা। পথের দুই পাশে চ্যাপারাল জন্মেছে ঘন হয়ে, মাঝে মাঝে খাটো ওক। এদিকটায় মানুষজন আসে না, কোনো কাজও হয় না, ফলে ইচ্ছেমতো বাড়তে পেরেছে ঝোপঝাড়। একটা পাথুরে পাহাড়ের কাঁধ পেরিয়ে পথটা গিয়ে ঢুকেছে দুটো মাঝারি আকারের পাহাড়ের মধ্যে, গিরিপথ হয়ে গেছে। মেঘলা এই ধূসর দিনে পথটা ছায়াঢাকা, প্রায় অন্ধকারই বলা চলে।

ওই যে, হাত তুলে দেখালো পিনটু।

অনেক গাছপালা আর উঁচু উঁচু ঝোপের মধ্যে, পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে থাকা একটা বড় পাথরের নিচে আড়াল হয়ে আছে ঝুপড়িটা। ওটা যে আছে একথা জানা না থাকলে সহজে কারো চোখে পড়বে না। একচালা টিনের ছাউনি। মরচে পড়ে লাল হয়ে গেছে চাল। কাঠের বেড়া, তক্তার মাঝে বড় বড় ফাঁক। দরজায় ঠেলা দিলো পিনটু। খুলে মাটিতে পড়ে ধুলো ওড়ালো কপাটটা। ওপরের চ্যাপ্টা পাথরটার জন্যে বৃষ্টি পড়ে চালার ওপর। ভেতরটা খটখটে শুকনো।

একটা মাত্র, কাঁচা মেঝে। গারে খুটি ভর রেখেছে চালার। বিদ্যুৎ নেই, জানালা নেই, কোনো আসবাব নেই, শুধু এককোণে পড়ে রয়েছে মরচে পড়া একটা স্টোভ, একসময় ঘর গরম করার কাজে ব্যবহার হতো।

দুতিনটে বছর লুকিয়ে থাকা যাবে এখানে সহজেই, মুসা মন্তব্য করলো। তবে আমি দুই দিন থাকতেও রাজি না।

খুন করার জন্যে যদি সৈন্যরা তেড়ে আসতো, সেকেণ্ড, কিশোর বললো, আর তোমার সাথে থাকতো একটা দামী তলোয়ার, তাহলে তুমিও থাকতে পারতে। তবে জায়গাটা বাজে।

একেবারেই বাজে, বললো রবিন। আর কোনো জায়গাই তো নেই তলোয়ার লুকানোর।

হ্যাঁ, একমত হয়ে মাথা দোলালো পিনটু। মেঝেতে? মাটির দিকে আঙুল তুললো মুসা। পুঁতে রাখেননি তো ডন?

মাথা নাড়লো কিশোর। না। পুঁতলে মাটি খোঁড়ার আলামত বোঝা যেতোই তখন, সৈন্যদের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভবনা ছিলো। ওই ঝুঁকি নিশ্চয় নেননি ডন… পুরানো স্টোভটার দিকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো সে। একটা চ্যাপ্টা পাথরের ওপর রয়েছে ওটার পায়াগুলো, পাইপটা চালা ভেদ করে উঠে গেছে। স্টোভটা সরানো যায় না?

চেষ্টা করে দেখা যাক,মুসা বললো।

জোরে ঠেলা দিয়ে দেখলো সে। ভারি জিনিস, তবে নড়লো। নিচের পাথরের সাথে লাগানো নয় পায়াগুলো।

পাইপটা খুলতে পারো নাকি দেখো তো, কিশোর বললো। চেষ্টা করে দেখলো মুসা। খাইছে! মরচে। নড়েও না।

নড়বে কি করে? আঠারোশো ছেচল্লিশ থেকেই আছে হয়তো ওই অবস্থায়। পারলে ভেঙে ফেলে।

রবিনের ব্যাগে যন্ত্রপাতি রয়েছে। ওগুলোর সাহায্যে গোড়া থেকে পাইপটা ভেঙে ফেললো মুসা। তারপর চারজনে মিলে পাথরের ওপর থেকে ভারি স্টোভটা সরিয়ে আনলো ওর। হাঁটু গেড়ে বসে পাথরটা সরানোর চেষ্টা করলো মুসা।

কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করে জোরে হাউফ করে উঠে বললো, বেজায় ভারি। একলা পারছি না।

দেয়াল থেকে একটা তক্তা খুলে নেয়া হলো। বেশ শক্ত কাঠ। পাথরের নিচে ছোট একটা গর্ত করলো মুসা। সেটাতে ঢুকিয়ে দিলো কাঠের এক মাথা। ওটাকে লিভার হিসেবে ব্যবহার করে, আর অন্য তিনজনের সহায়তায় অবশেষে নড়াতে পারলো জগদ্দল পাথরটাকে। বেরিয়ে পড়লো একটা গর্ত। গর্তের ভেতরে উঁকি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু, কি যেন দেখা যাচ্ছে!

ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে টেনে বের করে আনলো একটুকরো দড়ি, একটা কাগজ-বয়েসের ভারে হলুদ, আর গোল করে পাকানো একটুকরো ক্যানভাস-বাইরের দিকটায় আলকাতরা মাখানো।

কাগজটার দিকে তাকিয়ে পিনটু বললো, স্প্যানিশে লেখা। এই, আমেরিকান আর্মির একটা ঘোষণাপত্র এটা, তারিখ আঠারোশো ছেচল্লিশের নয় সেপ্টেম্বর। কিছু একটা আইন জারি করা হয়েছিলো।

ক্যানভাসটার ভেতর কি? হাত বাড়িয়ে ওটা নিলো কিশোর। সাইজ তো তলোয়ারের সমানই। ভেতরে আছে নাকি? মোড়কটা খুলে ফেললো সে।

দূর, কিছু তো নেই। বড়ই নিরাশ হলো মুসা।

পিনটু, গর্তে আর কিছু আছে?

রবিন এগিয়ে গেল টর্চ হাতে। গর্তের ভেতর ফেললো। পিনটু হাত ঢুকিয়ে হাতড়ে হাতড়ে দেখতে লাগলো। না, নেই…না না, আছে! ছোট পাথরের মতো…

পাথরটা বের করে আনলো সে। সাধারণ পাথরের মতোই দেখতে। তবে মাটি লেগেও ওরকম হয়ে থাকতে পারে ভেবে প্যান্টের কাপড়ে ঘষে পরিষ্কার করতে লাগলো। ঠিকই ভেবেছে। বেরিয়ে পড়লো ঘন সবুজ উজ্জ্বল রং।

এটা…,রবিন ওরু করলো, শেষ করলো কিশোর, পান্না! নিশ্চয়ই তলোয়ারটা লুকানো ছিলো এখানে প্রথমে এখানেই লুকিয়েছিলেন ডন। পালিয়ে আসার পর সরিয়ে ফেলেছিলেন অন্য জায়গায়। নিশ্চয় তার তখন মনে হয়েছিলো এটা নিরাপদ জায়গা নয়।

ঠিকই ভেবেছেন, রবিন বললো। সহজেই তো ব্বে করে ফেললাম আমরা।

তাহলে নিজেও এখানে লুকাননি, পিনটু বললো, এটাও ঠিক।

হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। পেছনে তাড়া করে আসছিলো ডগলাসেরা। সময় বিশেষ পাননি। তলোয়ারটা ব্বে করে নিয়ে গিয়েই তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলেছিলেন কোথাও, নিজেও লুকিয়ে পড়েছিলেন।

এই কিশোর,হঠাৎ বলে উঠলো মুসা, কিসের আওয়াজ?

কান পাতলো সবাই। বাইরে থেকে আসছে, বেশ জোরালো, ভূমিধস নামার সময় যেমন হয়, অনেকটা এরকম।

বৃষ্টি, রবিন বললো। সব জায়গায় পড়ছে, শুধু ঝুপড়িটার ওপর ছাড়া। বেশ মজা তো।

না, বৃষ্টি না, অন্য শব্দ, মুসা বললো আবার। শুনছো?

মাথা নাড়লো কিশোর। রবিনও শুনতে পায়নি। তবে পিনটু শুনলো। কথা! ফিসফিস করে বললো সে।

ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ঘন ঝোপে লুকিয়ে পড়লো ওরা। একটু পরেই দেখলো গিরিপথ ধরে আসছে সেই তিনজন কাউবয়। ভারি বৃষ্টির মধ্যেও হালকা ভাবে ভেসে আসছে ওদের কথা।

এদিকেই আসতে দেখেছি, শুডু। চারজনকেই। এগোও।

ঝুপড়িটার পাশ দিয়ে চলে গেল লোকগুলো, দেখতে পেলো না ওটা। অদৃশ্য হয়ে গেল পাহাড়ের আড়ালে।

উঠে দাঁড়ালো কিশোর। চলো ভাগি। এসে পড়ার আগেই। আবার কনডর ক্যাসলে যাবো।

লোকগুলো যে ঘাপটি মেরেছিলো, বুঝতে পারেনি ছেলেরা। ওরা বেরোতেই পেছনে চিৎকার করে উঠলো গুডু, ধরো! ধরো!

খিঁচে দৌড় মারার কথা বলে দিতে হলো না চারজনের একজনকেও।

১৬

কাদায় ভরা কাঁচা রাস্তায় পৌঁছার আগে থামলো না ছেলেরা। হাঁপাতে হাঁপাতে তাকালো ডানে-বাঁয়ে। বুঝতে পারছে না এখন কোনদিকে যাওয়া দরকার।

এটা দিয়ে গেলে, মুসা বললো, কাউন্টি রোডে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলবে।

পাহাড়ে উঠতে গেলেও দেখে ফেলবে, বললো রবিন।

বাঁধের ওপর দিয়েও আর যাওয়া যাবে না এখন, পিনটু বললো। পানির যা তোড়। ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।

প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছে ওরা। কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে।

বেরিয়ে এলো তিন কাউবয়। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটে এলো ছেলেদের ধরার জন্যে। সঙ্গীদেরকে চেঁচিয়ে নির্দেশ দিচ্ছে গুড়।

রাস্তার দিকে যাই। মুসা বললো।

জোরে মাথা নাড়লো কিশোর, না না, অ্যারোইও! শেষ মাথায় চলে যাবো, বাঁধের কাছাকাছি। আমরা ওদিকে গেহি এটা ভাববে না ওরা।

একটা মুহূর্ত সময় নষ্ট করলো না হেলেরা, হুড়মুড় করে এসে নামলো অ্যারোইওতে। নিচে নামতে পারলো না, ওখানে পানি, কিনার ধরে চললো। পিচ্ছিল হয়ে আছে ঢালের মাটি, তার ওপর ঝোপঝাড়, দৌড়াতে পারলো না। তবে ঝোপ থাকায় গাহ ধরে ধরে মোটামূটি দ্রুতই এগোতে পারলো।

ওপরে রাস্তার কাদায় ভারি বুটের ছপাৎ হুপাৎ শব্দ হচ্ছে। মাটির ওপর উপুড় হয়ে পড়লো ছেল্লো, পিছলে যাতে পানিতে না গিয়ে পড়ে সেজন্যে গাছ আঁকড়ে ধরে রেখেছে। দুরুদুরু করছে বুক। ঠিক মাথার ওপরেই শোনা গেল কর্কশ কণ্ঠ, গেল কোথায় বদমাশগুলো!

এক্কেবারে ইবলিসের বাচ্চা!

চাবিটা সত্যিই পেয়েছে?

পেয়েছে। নইলে আমাদের দেখলেই পালায় কেন?

বাঁধের দিকে যায়নি তো?

গাধা নাকি? মরতে যাবে?

পাহাড়েও চড়েনি। তারমানে রাস্তা দিয়েই গেছে। এসো।

কাউন্টি রোডের দিকে ছুটলো তিন কাউবয়। চুপ করে পড়ে রইলো ছেলেরা। চ্যাপারালের ঝোপ আড়াল করে রেখেছে তাদের শরীর।

ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। উঠে বসে মাথা ঝাড়া দিলো রবিন। গেছে। বাঁচা গেল।

এখানে লুকিয়ে থাকা যাবে না, পিনটু বললো। ওঠো।

যাবোটা কোথায়? মুসার প্রশ্ন। আপাতত বাঁচলাম। রাস্তায় না পেয়ে আবার ফিরে আসবে ওরা। তখন?

বাঁধের কাছে লুকানোর একটা জায়গা খুঁজে ব্বে করতে হবে, কিশোর বললো। আর তেমন জায়গা না পেলে ঢিবি পেরিয়ে চলে যাবো। কনডর ক্যাসলের ওধারে

লুকানোর জায়গা পাওয়া যাবেই।

মাথা নিচু করে, রাস্তা থেকে যাতে দেখা না যায় এমনভাবে আবার টিরি দিকে এগোলো ওরা। বাঁধের ওপর থেকে পানি পড়ার শব্দ কানে আসছে বৃষ্টির আওয়াজকে আপিয়ে।

দেখ, কিশোর বললো, ঝোলা পাথর-টাথর আছে কিনা। কিংবা কোনো গর্ত।

ঢালের গায়ে গাছ আঁকড়ে দাঁড়িয়ে চোখ বোলালো চারজনেই।

মুসা মাথা নাড়লো, নাহ্ একটা ইঁদুরের গর্তও নেই।

রাস্তার ওপারে পাথর আছে, ওগুলোর আড়ালে লুকানো যেতে পারে, বলে মাথা তুলে দেখতে গেল পিনট। পরক্ষণেই ঝট করে নামিয়ে ফেললো। ওরা আসছে!

আবার মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো ওরা।

দেখেনি তো তোমাকে? রবিনের কণ্ঠে শঙ্কা।

মনে হয় না।

কোনখানে আছে? কিশোর জিজ্ঞেস করলো।

আমরা যেখানে অ্যারোইওতে নেমেছি।

ঝুপড়িতে ফিরে যাচ্ছে বোধহয় আবার, আশা করলো মুসা।

না, অতোটা আশা করতে পারলো না কিশোর, ওরা এদিকেই আসবে। বাঁধ্বে কাছে খুঁজতে। এখানেই থাকতে হবে আমাদের। দেখে ফেললে,ফেলবে, আর কিছু করার নেই।

ঝোপ আর মাটির সঙ্গে যতোটা সম্ভঘ গা মিশিয়ে পড়ে রইলো ওরা। বুটের শব্দ কানে আসছে। অবশেষে শোনা গেল কথা, …বাঁধের কাছে না পেলে এখানে এসে ঝোপের মধ্যে খুঁজবো।

থাকা যাবে না এখানেও। ফিসফিসিয়ে বললো কিশোর। ওরা সরলেই ঢিবি বেয়ে উঠতে শুরু করবো, যতোটা ওপরে ওঠা যায়। যেই ওরা এদিকে সরে আসবে ওদিকে চলে যাবো আমরা।

কিন্তু চূড়ায় উঠলেই তো দেখে ফেলবে আমাদের, মুসা বললো।

ঝুঁকি নিতেই হবে। বেশিক্ষণ থাকছি না আমরা ভোলা জায়গায়, মাত্র কয়েক সেকেণ্ড।

কিশোরে পরামর্শটা পছন্দ হলো না মুসার, কিন্তু এর চেয়ে ভালো কিছু আর রে করতে পারলো না। ভাবনারও সময় নেই। ওদের মাথার ওপর দিয়ে কাউবয়দের চলে যাওয়ার শব্দ হলো। আস্তে করে মাথা তুলে দেখলো কিশোর। ঢিবির আড়ালে চলে যাচ্ছে তিনজন লোক। চলো, বললো সে।

চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে অ্যারোইওর বাকি পথটুকু পেরিয়ে এলো ওরা, টিবির ঢাল বেয়ে উঠতে আরম্ভ করলো। ঝোপের কমতি নেই, সেগুলোর গড়া কিং শেকড় ধরে ধরে বেয়ে উঠছে, খাড়া ঢালে পর্বতারোহীরা যেমন করে ওঠে। দাঁড়ানো তো দূরের কথা, ঠিকমতো মাথা তোলারই সাহস করতে পারছে না। যদি চোখে পড়ে যায়। প্রতি মুহূর্তে আশা করছে এই বুঝি চেঁচিয়ে উঠলো কেউ। কিন্তু না, শোনা গেল না।

যাক তাহলে উঠলাম! অবশেষে বললো মুসা।

সোজা শিরাটার দিকে! তাগাদা দিলো কিশোর। যত তাড়াতাড়ি পারো?

তাড়াতাড়ি কি আর হয়? সব পিচ্ছিল হয়ে আছে। মাথা নামিয়ে শরীরটাকে যথাসর কজো করে চলতে লাগলো ওরা। দুইবার কিশোর আর রবিন পা পিছলালো। আরেকবার পিনটু। পড়েই যাচ্ছিলো নিচে, অনেক কষ্টে সামলালো গাছের বেরিয়ে থাকা শেকড় চেপে ধরে। তারপর ধীরে ধীরে উঠে এলো আবার আগের জায়গায়। কেবল মুসা পড়লো না। অন্য তিনজনকে সাহায্য করলো বরং। সারা শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে ওদের। তবে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছতে পারলো শৈলশিরার প্রায় খাড়া পাথুরে ঢালের কাছে।

থামলো না। উঠতে শুরু করলো কনডর ক্যাসলের চূড়ায়। নাড়া লেগে ঝুরঝুর করে ঝড়ে পড়তে লাগলো আলগা ছোট পাথর।

জলপ্রপাতের গর্জনকে হাপিয়ে হঠাৎ শোনা গেল উত্তেজিত চিৎকার, ওই যে! ওখানে!

চূড়ার ওপরে!

ওরাই! ধরো, ধরো!

ঢালের ওপরে স্থির হয়ে গেল ছেলেরা। ফিরে তাকালো। রাস্তা থেকে সরে বাপ্পে ধরে চলে এসেছে তিন কাউবয়।

দেখেই ফেললো! কান্নার মতো স্বর বেরোলো পিনটুর।

এত্তো তাড়াতাড়ি! কোলাব্যাঙ ঢুকেছে যেন মুসার গলায়।

ঢিবির পাশ ঘুরে তততক্ষণে শৈলশিরার দিকে ছুটতে শুরু করেছে তিন কাউবয়।

কিশোর, এখন কি করা? কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো রবিন।

তোতলাতে লাগলো কিশোর, কি-ক্কি..

অঝোর বৃষ্টি আর প্রপাতের শব্দকে ছাপিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ যেন ভরে দিতে লাগলো বাতাসকে। ক্রমেই বাড়ছে, জোরালো হচ্ছে। বারে ওপরে কোনোখান থেকে আসছে। টিরি ওপরে অর্ধেকটা উঠে পড়ছিলো কাউবয়রা, শব্দটা শুনে থমকে গেছে ওরাও। কান পেতে শুনহে।

আরি, দেখো! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা।

বাঁধের ওপর দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানির উচ্চতা যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল দশ ফুট। তাতে ভাসছে কাঠ, ওপড়ানো ঝোপঝাড়। এমনকি আস্ত গাছও রয়েছে। প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো বাঁধের নিচে। জলপ্রপাতের গর্জন একলাফে যেন বেড়ে গেল একশো গুণ। ছেলেদের পায়ের নিচে থরথর করে কেঁপে উঠলো পাহাড়টা।

থেমে গিয়েছিলো, আবার টিবি বেয়ে ছেলেদের দিকে উঠে আসতে লাগলো তিন কাউবয়। ছেলেরাও থেমে রইলো না আর, চূড়ায় উঠতে শুরু করলো আবার। কি মনে করে একবার পেছনে ফিরে তাকিয়েই অস্ফুট শব্দ করে উঠলো পিনটু। অন্য তিনজনেও ফিরে তাকালো। দুভাগ হয়ে গেছে ঢিবিটা। একটা অংশ দাঁড়িয়ে আছে, খসে পড়ছে আরেকটা অংশ। চেঁচামেচি, হাত-পা ছোড়াছুঁড়ি শুরু করে দিলো তিন কাউবয়। কিন্তু কিছুই করতে পারলো না। ওদেরকে নিয়েই পানিতে ভেঙে পড়লো মাটির বিশাল চাঙড়। জলপ্রপাতের মধ্যে পড়ে খাবি খেতে লাগলো কাউবয়েরা, সঁতরে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। একজন একটা ভেসে যাওয়া গাছের গুড়ি চেপে ধরলো। পানি ওদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

গেল ব্যাটারা! হঠাৎ বড় বেশি ক্লান্তি লাগলো রবিনের। অবশ হয়ে গেছে যেন হাত-পা।

বেশিক্ষণের জন্যে না, রবিনের মানসিক শান্তি আবার নষ্ট করলো কিশোর। বাঁধের নিচে পড়েনি ওরা, পড়েছে অ্যারোইওর ভেতরে। ভেসে চলে যাবে শেষ মাথায়। স্রোতের জোর কম ওখানে। সাঁতরে পাড়ে উঠে আবার ধরতে আসবে আমাদের।

আগে আগে উঠছে এখন মুসা। কনডর ক্যাসলের চূড়ায় উঠে নিচে তাকালো সবাই। ঢাল থেকে খসে পড়ছে মাটি আর পাথর। বেরিয়ে পড়ছে নতুন নতুন পাথর, শেকড়। মাটি খসে গিয়ে যেন ক্ষত সৃষ্টি করছে পাহাড়ের গায়ে।

যেভাবে মাটি ভাঙছে, পাহাড়টাই না ধসে পড়ে। উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে নামার সময় কললো মুসা। এবারেও আগে আগে চলেছে সে।

বেরিয়ে থাকা কয়েকটা পাথরের ওপাশে চলে গেল মুসা।

অন্য তিনজনও এলো পেছনে পেছনে।

কিন্তু মুসা নেই। গেল কোথায়?

১৭

বাতাসে মিলিয়ে গেছে যেন মুসা।

কোথায় গেল? এদিক ওদিক তাকাচ্ছে পিনটু, চোখে অবিশ্বাস।

মুসাআ! চিৎকার করে ডাকলো রবিন।

মুসা, কোথায় তুমি? ডেকে জিজ্ঞেস করলো কিশোর।

ঢালে যতদূর চোখ যায়, চোখ বোলালো ওরা। মুসার চিহ্নও নেই। সাড়াও দিলো। কান পেতে রয়েছে তিনজনে। তারপরে শোনা গেল আওয়াজটা। কোথা থেকে আসছে বোঝা গেল না।

আমি এখানে! নিচে! আবার শোনা গেল কথা। পাহাড়ের গভীর থেকে যেন ভেসে এলো মুসার চাপা কণ্ঠ।

কোথায় তুমি? জিজ্ঞেস করলো পিনটু। বুঝতে পারছি না।

এই যে এখানে। কয়েকটা বড় বড় পাথর আছে না, যেগুলো পেরিয়ে এসেছি, ওগুলোর গোড়ায়!

আরেকটু পাশে সরলো তিনজনে। চোখে পড়লো গর্তটা। আগের বার যখন এখানে এসেছিলো, তখন ছিলো না।

মাটি খসে যাওয়ায় বেরিয়েছে। রবিন কললো।

গর্তের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো কিশোর, মুসা, বেরোতে পারছো না? সাহায্য লাগবে?

বেরোতে চাই না, জবাব এলো। এটা একটা গুহা। ভেতরে অনেক পাথর আছে। ইচ্ছে করলে গর্তের মুখ ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়া যাবে। কাউবয়েরা দেখতে পাবে না। জলদি নেমে এসো।

পরস্পরের দিকে তাকালো তিন কিশোর।

বেশ, আসছি, জবাব দিলো কিশোর।

তাড়াতাড়ি করো, নইলে ওরা চলে আসবে। অসুবিধে নেই, ভালো জায়গা। শুকনো, খোলামেলা।

একে একে ঢুকে পড়লো তিনজনে। টর্চ বের করলো রবিন।

জানতামই না এখানে গুহা আছে! পিনটুর কণ্ঠে বিস্ময়।

টর্চের আলোয় দেখা গেল, বেশি বড় না গুহাটা। গাড়ি রাখার গ্যারেজের সমান। নিচু হাত। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে অনেক পাথর। এখনও শুকনো রয়েছে ভেতরটা। তার মানে মুখটা যে খুলেহে বেশিক্ষণ হয়নি। নইলে যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে এতোটা শুকনো থাকার কথা নয়।

আলোটা আরও ঘোরাও তো, কিশোর ললো।

দশ বাই পনেরো ফুট হবে গুহাটা। একপাশে পাথর জমে উঁচু হয়ে গিয়ে হাতে ঠেকেছে। গুহামুখের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকালে কিশোর, বহুদিন বন্ধ হয়ে ছিলো মুখটা। হয়তো ভূমিকম্পে পাথর গড়িয়ে পড়ে…

যেভাবেই হয়েছে, হয়েছে, বাধা দিয়ে বললো মুসা, সেকথা পরেও ভাবা যাবে। এখন মুখটা বন্ধ করে দেয়া দরকার। নইলে কাউবয় ব্যাটারা এসে দেখে ফেলবে।

পাথরের অভাব নেই। চারজনে মিলে গড়িয়ে গড়িয়ে পাথর নিয়ে গিয়ে রাখতে লাগলো মুখের কাছে। দ্রুত বন্ধ করে দিলো গুহামুখ দিয়ে আসা বিকেলের ধূসর আলো। মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৃষ্টিও আর ভেতরে আসতে পারছে না। দেয়ালে আরাম করে হেলান দিয়ে বসলো ওরা, হাসি ফুটেছে মুখে।

কয়েক ঘণ্টা থাকতে হবে আমাদের। অনুমান করলো কিশোর, আমাদের খুঁজে পাবেনা লোকগুলো। চলে যাবে। তার পর বেরোবো।

কারা ওরা? রবিনের প্রশ্ন।

ডয়েলের লোক, আর কে হবে? বললো পিনটু। নইলে ভাইয়ার হ্যাটই বা চুরি করবে কেন, আর ক্যাম্পফায়ারের পাশেই বা ফেলে রাখবে কেন?

গাড়ির চাবি খুঁজছে ওরা, কিশোর কললো। ভাবছি, গাড়িটা কোথায়? ওদেরকে তো একবারও গাড়িতে দেখা যায়নি।

গাড়ি যেখানেই থাকুক, মুসা বললো, চাবিটা ওদের ভীষণ দরকার। হয়তো ওদেরকে ফাসিয়ে দিতে ওই চাবিই যথেষ্ট, সেজন্যেই ওরকম হন্যে হয়ে খুঁজছে।

হতে পারে…

কি-ক্কি-ক্কিশোর…!

রবিনের তোতলামিতে থেমে গেল কিশোর। তাকালো টর্চের আলোর দিকে। গুহার পেছন দিকে ধরে রেখেছে রবিন।

ওই… ওই পাথরটার…

চোখ! ঢোক গিললো পিনটু। দাঁতও আছে!

খাইছে! কেঁপে উঠলো মুসার কণ্ঠ। খুলি!

স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর। ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হলো মুখ। উঠে এগিয়ে গেল সেদিকে।

খুলিই। ওখান থেকে বললো সে। এই এসে, মাটি খুঁড়তে হবে।

হাড়গোড় আছে। অস্বস্তিতে ভরা মুসার কণ্ঠ। ভূমিকম্পে মাটি চাপা পড়ে মরেছিলো হয়তো!

এই, কাপড় আছে, রবিন বললো।

একটা বোতাম! তুলে নিলো পিনটু। তামার তৈরি বোতামটায় ময়লা জমে কালো হয়ে গেছে। ঘষে পরিষ্কার করলো সে। আরি, আমেরিকান আর্মির!

ভূমিকম্পে মরেনি, বুঝলে, খুলিটা দেখতে দেখতে বললো কিশোর। খুন করা হয়েছে একে। এই দেখো, গুলির ফুটো।

উত্তেজিত গলায় বলতে লাগলো গোয়েন্দাপ্রধান, মনে হচ্ছে ঈগলের বাসাটা খুঁজে পেলাম! এখানেই লুকানোর মতলব করেছিলেন ডন পিউটো, তলোয়ারটাও হয়তো এখানেই লুকিয়েছেন। কনডর ক্যাসলের ঠিক নিচে এই গুহা, সূত্রের সঙ্গে মিলে যায়। তাঁর ছেলে স্যানটিনো নিশ্চয় জানতে এই গুহার কথা।

কিশোর, পিনটু কললো, এই লোকটা কি সার্জেন্ট ডগলাসের দলের কেউ?

বোধহয়। আমার বিশ্বাস, আরও কঙ্কাল আছে এখানে।

কয়েকটা পাথর দেখিয়ে মুসা বললো, আলগা। ধসে পড়েছে। ওপাশে কিছু আছে নাকি?

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। থাকতে পারে।

দ্রুত পাথরগুলো প্রাতে লাগলো ছেলেরা। কিন্তু যতোই সরায়, কমে না আর। একটা রালে তিনটে এসে পড়ে। তবে ধৈর্য হারালো না ওরা। সরিয়ে চললো এক এক করে। ফাঁক বাড়তে লাগলো আস্তে আস্তে।

বেরিয়ে পড়লো একটা সরু সুড়ঙ্গ। আলো হাতে আগে আগে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকলো রবিন। সোজা এগিয়েছে সুড়ঙ্গটা। কয়েক মিনিট পরে আরেকটা গুহা আবিষ্কার করলো সে, প্রথমটার চেয়ে তিন গুণ বড়।

রবিনের পেছনে ঢুকলো পিনই। উঠে দাঁড়িয়ে বললো, অনেক বড়!

প্রথমটার চেয়ে এটা উঁচুও বেশি, প্রায় দ্বিগুণ।

একেবারে ক্যাসলের নিচে, রকিন বললো।

লুকানোর চমৎকার জায়গা, বললো মুসা। সহজেই ভেতর থেকে পাথর দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেয়া যায়। জানা না থাকলে বাইরে থেকে কেউ কিছু বুঝতেই পারবে না।

যতোদিন খুশি থাকা যাবে এখানে, মন্তব্য করলো পিনটু, যদি বাইরে থেকে নিয়মিত খবর দিয়ে যাওয়া হয়।

তবে, কিশোর বললো, আমার মনে হয় না সময়মতো মুখটা বন্ধ করতে পেরেছিলেন ডন। হাত তুলে বয়ে দেখালো সে।

আসেটা সামান্য সরালো রবিন, ভালোমতো দেখার জন্যে। আরেকটা কাল পড়ে আছে। কালচে হয়ে আসা তামার বোম পড়ে রয়েছে কয়েকটা, আর পাশেই পড়ে আছে একটা পুরানো মরচে ধরা রাইফেল।

পাথরের আড়ালে কভার নিয়েছিলো বোঝা যাচ্ছে, মুসা কললো। আরেকজন সৈন্য।

ওই, আরও একজন, কিশোর দেখালো।

উপুড় হয়ে ওহার প্রায় মাঝখানে পড়ে রয়েছে তৃতীয় কঙ্কালটা। এটার পাশেও তামার বোতাম আছে। আর আছে চামড়ার বুট, বেল্ট আর হোলস্টার। নষ্ট হয়ে এসেছে। কঙ্কালের এক হাতের আঙুলের কাছে পড়ে রয়েছে একটা মেকসিকান ওয়রস্টাইল রিভলভার।

নিশ্চয় সার্জেন্ট ডগলাস। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লো কিশোর, পালানোর পর ওদেরকে যে আর পাওয়া যায়নি, এটাই কারণ।

কিন্তু, চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে পিনটু, ডন কোথায়?

গুহার চারপাশে টর্চের আলো বোলালো রবিন। লুকানোর কোনো জায়গা চোখে পড়লো না, শুধু খাড়া, শূন্য দেয়াল।

এই তিনজনকে গুলি করে মেরেছে কেউ, মুসা বললো। কে মারলো? ডন পিউটো?

বোধহয়, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো একবার কিশোর। কিন্তু তাই যদি করবেন, তাহলে তো সহজেই ওদেরকে কবর দিয়ে এখানে থাকতে পারতেন। কেন থাকলেন না?

হয়তো তিনি মারেননি, মুসা বললো। মারাটা কঠিনও ছিলো অবশ্য। তিনজন ট্রেইনড সৈন্যের বিরুদ্ধে একা…।

ডনই মেরেছেন! বলে উঠলো রবিন। ওই দেখো!

কোণের দিকে অন্ধকার মতো একটা জায়গায় আলো ফেলেছে রবিন। ছোট একটা গর্ত রয়েছে ওখানে দেয়ালের গোড়ায়। ভালো করে না তাকালে চোখে পড়ে না ওটা। লুকিয়ে থাকার চমৎকার জায়গা। ওখানেই দেখা গেল চতুর্থ কঙ্কালটা। এগিয়ে গেল ছেলেরা। কঙ্কালের পোশাক সৈন্যদের চেয়ে আলাদা। পাশে পড়ে আছে একটা মেকসিকান হ্যাট, ইনডিয়ান ডিজাইন। আর আছে দুটো মরচে পড়া রাইফেল।

হ্যাটটা তুলে নিলো পিনটু। স্থানীয় ইনডিয়ানদের তৈরি। একে বলে কনচো। এজন্যেই…বুঝলে, এজন্যেই ডন পিউটোকে কোনোদিন কেউ দেখেনি… ধরে এলো তার গলা।

মাথা ঝাঁকালো কিশোর। পালিয়ে এসে কনডর ক্যাসলের এই গুহায় লুকানোর মতলব করেছিলেন ডন। পিছু নিয়েছিলো ডগলাস আর তার দুই করপোরাল। এখানে এসে ঢুকেছিলো। ওদেরকে গুলি করে মেরেছেন ডন। তবে তিনিও রেহাই পাননি ওদের গুলি থেকে। তার পর ভূমিকম্প হয়েছিলো, বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো গুহামুখ, ওদেরকে আর কেউ খুঁজে পায়নি। একেবারে গায়েব হয়ে গিয়েছিলো চার চারজন মানুষ।

কিন্তু কিশোর, রবিন প্রশ্ন তুললো, তার বন্ধুরা এখানে খুঁজতে এলো না কেন? ওরা নিশ্চয় জানতো ঈগল তার বাসা খুঁজে পেয়েছে।

এই প্রশ্নের জবাব আমরা কোনোদিনই জানতে পারবো না। হয়তো তাঁর বন্ধুরা জানতোই না যে তিনি এসেছেন, জানানোর সময়ই হয়তো পাননি। কিংবা ওরা আসার আগেই ভূমিকম্পে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো গুহামুখ। স্যানটিনো যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরে হয়তো এমন কাউকে পায়নি, যে তাকে জানাতে পারে ডগলাসের রিপোর্ট ঠিক নয়। তলোয়ারটা সাগরে পড়ে গেছে একথা নিশ্চয় বিশ্বাস করেনি সে, ভেবেছিলো, চুরি হয়ে গেছে।

কিশোওর! চেঁচিয়ে উঠলো মুসা। করটেজ সোর্ডটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা! এখানেই হয়তো আছে!

গুহাটায় তন্ন তন্ন করে খুঁজলো ওর।

কিন্তু পাওয়া গেল না তলোয়ার।

১৮

পেছনে লোক লেগে ছিলো, কিশোর বললো, এটা জানতেন ডন। এখানে আনেননি হয়তো সেজন্যেই।

তাহলে কোথায় লুকালেন? রবিনের প্রশ্ন।

পিনটু বললো, ডন চিঠিতে কনডর ক্যাসলের কথা লিখেছিলেন। যাতে তাঁর ছেলে এসে তলোয়ারটা খোজে এখানে। ঠিক?

ঠিক, বললো কিশোর। তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, ছেলে ফিরে আসা পর্যন্ত এখানেই লুকিয়ে থাকতে পারবেন।

কিন্তু পারলেন না। গুলি খেয়ে মরলেন। এমনও হতে পারে, গুলি খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মারা যাননি। তাহলে তলোয়ারটা এমন কোথাও রেখে যাবেন, যাতে স্যানটিনো খুঁজে পায়…।

এবং তাহলে একটা মেসেজ রেখে যাবেন ছেলের জন্যে! বাক্যটা শেষ করে দিলো কিশোর। ঠিক বলেছো। এতোদিন পর এখন মেসেজটা নষ্ট না হয়ে গেলেই হয়।

কিন্তু আছে কোথায় মেসেজটা? ইতিমধ্যেই খুঁজতে আরম্ভ করে দিয়েছে মুসা।

জখমী মানুষ, কিশোর বললো, বেশি দূর যেতে পারার কথা নয়। গর্তটাতেই আগে দেখা যাক।

গর্তের দেয়ালে কোনো লেখা দেখা গেল না।

কঙ্কালটার কাছে, পাথরের পেছন থেকে হোট একটা জিনিস কুড়িয়ে নিলো পিনটু। ইনডিয়ানদের তৈরি মাটির একটা জগ। উল্টেপাল্টে দেখে বললো, কি যেন আছে।

জগটা হাতে নিলো কিশোর। শুকনো রঙের মতো লাগছে।

কালো রঙ? দেখার জন্যে ঝুঁকে এলো রবিন।

হুঁ, করলো শুধু মুসা।

গুহার দেয়ালে আরেকবার খোঁজা দরকার, কিশোর বললো। ধুলো লেগে আছে। পুরু হয়ে। ঢেকে থাকতে পারে লেখাটা। পকেট থেকে রুমাল বের করে সাবধানে বাড়ি দিয়ে ধুলো ঝাড়তে শুরু করলো সে।

অন্যেরাও রুমাল রে করলো।

বেশ কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মুসা বলে উঠলো, রবিন, আলোটা ধরো তো এদিকে?

কঙ্কালের পাশে পাথরের দেয়ালে সত্যিই লেখা রয়েছে চারটে শব্দঃ হাই…ধুলো—বৃষ্টি…সাগর। কালচে রঙে লেখা।

চেয়ে রয়েছে চারজনেই। কিছু বুঝতে পারছে না।

পরের দুটো শব্দ বেশ কাছাকাছি, পিনটু বললো। লিখলেন কি দিয়ে? রক্ত?

ছাই আর ধুলোর কথা লিখেছেন কেন? মুসার প্রশ্ন। কোনো ফায়ারপ্লেসে লুকিয়েছেন?

নাকি সাগরের ধারে কোথাও? রবিন যোগ করলো।

কিন্তু এর সাথে বৃষ্টির সম্পর্ক কোথায়? ভুরু নাচালো পিনটু।

নাহ, অর্থহীন! মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যায় না, মাথা নাড়লো মুসা।

কিন্তু অর্থহীন কথা কেন লিখবেন একজন মানুষ, যিনি মরতে চলেছেন?

লেখেননি, পিনটুর সঙ্গে একমত হলো কিশোর। ঘন ঘন চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। অর্থ একটা নিশ্চয়ই আছে।

অন্য কেউ লিখে থাকতে পারে, রবিন বললো। ডন পিউটোর আগেই।

আমার মনে হয় না, কিশোর কললো। ডনই লিখেছেন, ছেরে জন্যে মেসেজ। তিনি মারা যাওয়ার পর অন্য কেউ এসে লিখেছে, তা-ও হতে পারে না। তাহলে বেরিয়ে গিয়ে চারটে লাশের কথা বলতেই সেই লোক।

এমনও হতে পারে, তখন মাথার ঠিক ছিলো না তাঁর, কি লিখতে কি লিখেছেন, রবিন বললো।

এটাও বিশ্বাস কতে ইচ্ছে করছে না…

কিশোর! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো পিনটু। ও কিসের শব্দ?

গুহার হাতের ওপরে হচ্ছে শব্দটা।

পায়ের শব্দ! রবিন বললো। বুট পরা। কনডর ক্যাসলের ওপরে উঠেছে কেউ।

কাউবয়গুলো হবে, পিনটু বললো।

কাদায় জুতোর ছাপ পড়েছে আমাদের! শঙ্কিত হয়ে উঠলো মুসা। গুহামুখের কাছেই যদি পড়ে থাকে তাহলে দেখে ফেলবে ওরা। তাহলে আর বাঁচতে পারবো না!

এসো! আদেশ দিলো গোয়েন্দাপ্রধান।

কোথায় যেতে বলছে, প্রশ্ন করলো না কেউ। কিশোরের সাথে চললো। সরু সড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এলো ছোট ওহাটায়। গুহামুখের দুপাশে ঘাপটি মেরে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। বাইরে থেকে আসছে কথা বলার মৃদু আওয়াজ।

আসবেই! মুসা বললো ফিসফিসিয়ে।

জোরালো হচ্ছে কণ্ঠস্বর। তারপর শোনা গেল গুহামুখের কাছে পায়ের আওয়াজ।

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে সেঁটে থাকো, নির্দেশ দিলো কিশোর। পাথরগুলো ঠেলে সরিয়ে নামতে হবে ওদেরকে। ঢুকেই প্রথমে আমাদের দেখতে পাবে না, অন্ধকারে পাথর-টাথরই ভাববে দেখলেও। আর না দেখলে সরে যাবে পেছন দিকে, এই সুযোগে বেরিয়ে দেবো দৌড়।

পাথরের গায়ে বুট দিয়ে লাথি মারার আওয়াজ হলো কয়েকবার। তর্ক শুরু করে দিলো তিনটে কণ্ঠ। তার পর পাথরের গায়ে পাথর বাড়ি লাগার শব্দ হলো।

কি বলছে? জিজ্ঞেস করলো রবিন। কিছুই তো বোঝা যায় না।

আমিও বুঝতে পারছি না, মুসা বললো।

কান খাড়া করে আছে চারজনেই।

পাথর দিয়ে গুহামুখ বন্ধ করে রাখার ফলে বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে ঠিকই, তবে ছাঁকুনিতে আঁকা হয়ে যেন, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কথা।

আসে না কেন এখনও? ফিসফিস করে বললো পিনটু।

গুহার অন্ধকারে বসে আছে চার কিশোর, টানটান উত্তেজনা।

সময় যেন স্থির হয়ে গেছে ওদের জন্যে।

প্রায় মিনিট পনেরো পর গুহার বাইরে বুটের শব্দ জোরালো হলো আবার। তার সরে যেতে লাগলো। মিলিয়ে গেল কণ্ঠস্বর। চলে যাচ্ছে বোধহয় লোকগুলো।

আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করলো ছেলেরা। গুহামুখটা দেখেনি, পিনটু বললো।

না, দেখেনি, প্রতিধ্বনি করলো যেন রবিন।

কিন্তু, মুসার প্রশ্ন, আমাদের পায়ের ছাপ তো না দেখার কথা নয়। গুহামুখটা কেন চোখে পড়লো না ওদের?

গুহামুখের দিকে তাকিয়ে ভাবহে কিশোর। বিড়বিড় করে বললো, আমাদের কাছ থেকে বেশি দূরে ছিলো না ওরা। কথা বুঝলাম না কেন? কেন পরিষ্কার হলো না?

চলো, বেরোই, মুসা কললো। পাথর সরাতে হবে। টর্চ জ্বেলে ধরে রাখলো রবিন। পাথর সরাতে লাগলো অন্য তিনজন। একটা সরালো…দুটো…তিনটে…কিন্তু বাইরে থেকে আলো কিংবা তাজা বাতাস আসার কোনো লক্ষণ নেই।

যেকটা পাথর দিয়ে মুখ বন্ধ করেছিলো, সরিয়ে ফেললো ওরা। তার পরেও না এলো আলো, না বাতাস, না বৃষ্টির ছাঁট।

ব্যাপারটা কি? বুঝতে পারছে না পিনটু।

হামাগুড়ি দিয়ে গুহামুল্মে কাছে এগোলে মুসা। খাইছে! চিৎকার শোনা গেল তার। পাথর!

কি বলছো! পেছন থেকে চেঁচিয়ে বললো রবিন, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে, বন্ধ করে দেয়নি তো!

ধীরে ধীরে ফিরে এলো মুসা। চোখে আতঙ্ক। না, ওরা বন্ধ করেনি। কাদার আরেকটা ধ্বস নেমেছিলো মনে হচ্ছে। বিরাট এক পাথর এসে পড়েছে গুহামুখে। সেজন্যেই ওর মুখটা দেখেনি, ওদের কথা স্পষ্ট কানে আসেনি আমাদের।

১৯

ঠিক দেখেছো তো মুসা? শান্তকণ্ঠে বললো কিশোর, হয়তো তেমন বড় নয়। চলো, দেখে আসি।

সুড়ঙ্গটা সরু, কিন্তু ঠাসাঠাসি করে জায়গা হয়ে গেল চারজনের। সবাই মিলে ঠেলা লাগালো পাথরটায়।

হাউফ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মুসা। বা

পরে বাপ! পা ফসকে গেল পিনটুর।

গায়ের জোরে ঠেলছে কিশোর আর রবিন।

কিন্তু এক চুল নড়লো না পাথর।

হবে না, হাল ছেড়ে দিলো রবিন। এভাবে কিছুই করতে পারবো না।

মুসাও একমত হলো তার সঙ্গে।

আবার গুহায় ফিরে এলো ওরা।

আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখলো কিশোর। আজ আমরা না ফিরলে কাল খোঁজাখুঁজি শুরু হবে। রিগো বলে দেবে তখন কনডর ক্যাসলের কথা। কথা বোঝা যায়নি বটে, তবে গলার স্বর তো শুনেছি। বাইরে কেউ এলে আমরা শুনতে পাবো, আমরা চেঁচামেচি করলে বাইরে থেকে শোনা যাবে।

গুঙিয়ে উঠলো মুসা। তার মানে আজ সারাটা রাত এখানে থাকতে হবে?

আর কি করার আছে? হাসলো কিশোর। শুহাটা খারাপ না। শুকনো। বাতাস আছে। গুহার মুখে এতো বড় পাথর থাকা সত্ত্বেও বাতাস যখন আসছে, আমার মনে হয় আরও কোনো পথ আছে। ফাটল তো থাকতেই পারে।

ঠিকই বলেছো, সায় জানালো পিনটু।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলতে লাগলো রবিন। অন্য তিনজন খুঁজে দেখলো কিন্তু একটা ফাটলও কোথাও চোখে পড়লো না যেটা দিয়ে বাতাস আসতে পারে।

বায়ের দেয়ালটা দেখো, কিশোর কললো, পাথরের চেয়ে মাটি বেশি। আর ভেজা ভেজা। বেশি পুরু মনে হচ্ছে না। খুঁড়ে বেরোনো হয়তো যায়।

খুড়বো কি দিয়ে? মুসা জিজ্ঞেস করলো।

তাহলে চলো, আবার বললো কিশোর, বড় গুহাটায় ফিরে যাই। দেখি আর কোন পথ আছে কিনা।

ওটাতে তো অনেক খুঁজলাম, রবিন মনে করিয়ে দিলো। পথ থাকলে কি চোখে পড়তো না?

আরেকবার চেষ্টা করতে দোষ কি? তাছাড়া সাংকেতিক লেখাটাও আবার দেখতে চাই।

সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আবার বড় গুহাটায় এসে ঢুকলো ওরা। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে যেন ব্যঙ্গ করছে খুলিগুলোর শূন্য কোটর। বিকট হাসিতে বেরিয়ে পড়েছে সঁত। টর্চের আলোয় আরেকবার দেয়ালগুলো পরীক্ষা করলো ওরা। তাজা বাতাস রয়েছে ভেতরে, ঢোকার পথ নিশ্চয় আছে, অথচ সেটা বের করা গেল না।

সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই, হতাশ ভঙ্গিতে হাত নাড়লো রবিন। কিংবা খালি হাতেই দেয়াল খোঁড়ার চেষ্টা করতে পারি।

কোনোটাই করার ইচ্ছে নেই আমার, সাফ মানা করে দিলো মুসা।

খোঁড়াটা কঠিনই, অসম্ভব শব্দটা বলতে চাইলো না কিশোর। বেরোতে না পারলে সারারাত বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। শুধু শুধু বসে থাকবে কেন? মেসেজটা নিয়েই মাথা ঘামাই।

তুমি ঘুমাওগে, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো মুসা। আমার মাথাও নেই, ঘামও নেই।

তার কথায় কান দিলো না কিশোর। আরেকবার দেখা যাক লেখাগুলো।

হোট গর্তের কিনারে এসে বসে পড়লো চারজনে। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা চারটে শব্দের দিকে তাকালো নীরবে।

বার কয়েক নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটলো কিশোর। পিনটু, ঠিকই বলেছে, চারটে শব্দের মাঝে ফাঁক একরকম নয়। তাই আর ধুলোর মাঝে ফাঁক বেশি, কিন্তু বৃষ্টি আর সাগরের মাঝে কম। প্রায় গায়ে গায়েই লেগে আছে। মাঝখানে একটা ড্যাশমতোও দেখা যাচ্ছে, হাইফেনও বলা যায়। দুটো শব্দকে এক করে বোঝাতে চেয়েছেন বোহয় ডন। তাহলে মেসেজটা পড়তে হবে এভাবেঃ হাই…ধুলো-বৃষ্টি-সাগর। মানেটা কি?

কিছু না, বলে দিলো মুসা।

সাগর আর বৃষ্টির মাঝে একটা মিল আছে, পিনটু বললো। পানি।

ঠিক, মাথা ঝাঁকালো কিশোর।

সম্পর্ক আরও আছে, রবিন বললো, যদি গোড়া থেকে ভৌগোলিক কারণ খুঁজতে যাও। সাগর থেকে বাষ্প উঠেই মেঘের সৃষ্টি হয়, সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়ে আবার সাগরে নেমে আসে পানি, আবার বাস্প হয়, চলতে থাকে এভাবেই।

বেশ, কিশোর বললো, সাগর থেকে বৃষ্টির উৎপত্তি, তারপর আবার সাগরেই ফিরে যায়। এর সাথে ধুলোবালি আর হাইয়ের কি সম্পর্ক?

হাইয়ের মধ্যে ধুলোবালি থাকতে পারে, পিনটু কালো। কিংবা ধুলো থেকে হাই আসে…।

উহুঁ, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলে মুসা, ধুলো থেকে হাই আসতেই পারে না।

না, পারে না, ধীরে ধীরে বললো কিশোর। ভাবো, ভাবতে থাকো। কোথাও কোনো যোগাযোগ আছেই। চারটে শব্দের মধ্যেই রয়েছে সূত্র। স্যানটিনোকে কি বোঝাতে চেয়েছিলেন ডন?

কেউ জবাব দিতে পারলো না।

আবার বললো কিশোর, মাথা খাটাও। চলো যাই ছোট গুহাটায়। দেখি খোঁড়াটোড়া যায় কিনা? আশা ছাড়তে রাজি নয় গোয়েন্দাপ্রধান।

এক কাজ করতে পারি! তুড়ি বাজালো মুসা। রাইফেলগুলোকে খোঁড়ার যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি!

বেল্টে ঝোলানো যন্ত্রপাতির ব্যাগে চাপড় দিলো রবিন। মাটি ঘোড়ার কিছু নেই এটাতে। তবে ভ্রু-ড্রাইভারটা কাজে লাগানো যায়।

হোট গুহায় ফিরে এসে বাঁয়ের দেয়ালটা পরীক্ষা করে দেখলে ওরা। ভেজা, নরম মাটি।

পুরো এক হপ্তা ধরে বৃষ্টি হচ্ছে, মুসা কললো, কাদা হয়ে গেছে মাটি। কতোটা পুরু আল্লাহুই জানে। হাসলো সে। দেখা যাক।

পুরানো রাইফেল, ক্রু-ড্রাইভার আর চ্যাপ্টা পাথর নিয়ে কাজে লেগে গেল ওরা। শুরুতে মাটি বেশ আঠালো, সাবানের মতো আটকে থাকতে চায়। সেই স্তরটা সরানোর পর আঠা কমে গেল, ভেজা বাড়লো। মাটিতে খোঁচা দিলেই এখন পুচপুচ করে কাদা বেরোয়। আরও ফুটখানেক খোঁড়ার পর পড়লো পাথর। বড় না, খুঁড়ে ঝে করে আনলো সেটা।

দরদর করে ঘামছে চারজনেই। মাটি-কাদায় মাখামাখি হয়ে গিয়েছে শরীর আগেই, তার সঙ্গে যুক্ত হলো আরও মাটি। ক্লান্ত হয়ে আসছে ওরা, পেট মোচড় দিচ্ছে খিদেয়। শেষে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না, সটান শুয়ে পড়লো মাটিতে। তার পরেই ঘুম। ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলো ভোর পর্যন্ত। ঘড়ি দেখে বুঝলো যে ভোর হয়েছে। ব্যাটারি ফুরিয়ে আসছে রবিনের টর্চের। আবার কাজে লাগলো ওরা। টর্চের আলো থাকতে থাকতেই যা করার করতে হবে।

সাড়ে সাতটার দিকে চেঁচিয়ে উঠলো মুসা, আলো! এই, আলো দেখা যায়

নতুন উদ্যমে সুড়ঙ্গ খোঁড়ায় ঝাঁপিয়ে পড়লো সকলে। আলো বাড়ছে…বাড়ছে, ব্যস, হয়ে গেল কাজ। সরু সুড়ঙ্গ পথে হামাগুড়ি দিয়ে একের পর এক বেরিয়ে এলো ওরা, ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে।

খাইছে! মুসা কললো। আওয়াজ শুনতে পাচ্ছো?

পানির গর্জন কাঁপিয়ে দিচ্ছে যেন পুরো এলাকাটাকে। নেমে এসেছে পাহাড়ী ঢল। হাত তুলে চিৎকার করে বললো পিনটু, দেখো দেখো, অর্ধেকটা বাঁধ শেষ…

টিবিটাও গায়েব। রবিন বললো।

দেখো! অ্যারোইওর দিকে হাত তুললো কিশোর।

ওদের নিচে যে অ্যারোইওটা চলে গিয়েছিলো হাসিয়েনডা পর্যন্ত, ঢিবি ধসে পড়ায় ওটা আর অ্যারোইও নেই, এমনকি নালা বা খালও বলা যাবে না এখন, নদীই হয়ে গেছে প্রায়। প্রচণ্ড বেগে বয়ে চলেছে ঘোলাটে পানির স্রোত। একটা ক্রীক নয়, দুটো ক্রীক দিয়ে এখন সাগরের দিকে চলেছে পানি।

সেদিকে তাকিয়ে চক চক করে উঠলো কিশোরের চোখ। জোরে তুড়ি বাজিয়ে বললো, পেয়েছি! জবাব পেয়েছি!

২০

কী, কিশোর? একসাথে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো মুসা আর রবিন।

কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল গোয়েন্দাপ্রধান। কাউন্টি রোডের দিকের শৈলশিরাটার দিকে হাত তুললো। মানুষ! কাউবয়গুলো না তো?

কপালের ওপর হাত তুলে এনে বৃষ্টি বাঁচিয়ে ভালোমতো তাকালো মুসা। চারজন লোক আসছে।

না না, কাউবয় না! খুশি হয়ে বললো মুসা। আমার আর রবিনের বাবা আসছে! সাথে শেরিফ আর ক্যাপ্টেন ফ্লেচার!

পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে যতো দ্রুত সম্বদৌড়ে নামতে আরম্ভ করলো চার কিশোর।

মুসাআ! দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন মিস্টার আমান, তোরা ভালো আছিস?

আছি, হাসিমুখে জবাব দিলো মুসা।

রাগ করে বললেন মিস্টার মিলফোর্ড, এখানে সারা রাত কি করলে তোমরা?

আটকে গিয়েছিলাম, কি করে গুহায় আটকা পড়েছিলো জানালো রবিন। ডন পিউটো আর তিন সৈনিকের কঙ্কাল আবিষ্কার করেছে যে সেকথাও জানালো।

আরেকটা রহস্যের সমাধান তহলে করে ফেললে, হাসতে হাসতে বললেন পুলিশ-চীফ।

মা-বাবাকে যা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে না, শেরিফ বললেন। রিগে বললো তলোয়ার খুঁজতে বেরিয়েছো তোমরা। অর্ধেকটা রাত এই পাহাড়ে খোঁজাখুঁজি করছি আমরা। কিশোর, বোরিস আর রোভারকে নিয়ে খুঁজছেন তোমার চাচা। মিস্টার ডয়েলও খুঁজছেন দলবল নিয়ে, নালার ওদিকটায়। গুহায় কি করে ঢুকলে এখন খুলে বলো তো শুনি?

শুরু করতে যাচ্ছিলো মুসা, তাকে থামিয়ে দিয়ে কিশোর বললো, চলুন, হাসিয়েনডার দিকে যেতে বলছি। চাচাকে আর দুশ্চিন্তায় রেখে লাভ নেই। রেডিওতে খবর দেয়া যাবে?

ওয়াকি-টকিতে কথা বললেন শেরিফ। সার্চ পার্টিকে এসে জমায়েত হতে বললেন হাসিয়েনডার কাছে।

হাঁটতে হাঁটতে জানালো ছেলেরা, কিভাবে কাউবয়েরা তাড়া করেছিলো ওদের। কাউন্টি রোডে উঠে ব্রিজ পেরোলো, এসে পৌঁছলো হাসিয়েনডার কাছে।

ইতিমধ্যেই ওখানে বোরিস আর রোভারকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন রাশেদ পাশা। তাঁদের পেছনে ডয়েলদের র‍্যাঞ্চ ওয়াগনটা, ওটার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন মিস্টার ডয়েল, টেরিয়ার, ম্যানেজার ডরি, আর দুজন লোক।

শেরিফের গাড়িটাও আছে। তাতে বসে আছেন ডেপুটি শেরিফ।

দৌড়ে এলেন রাশেদ পাশা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস কলেন, কিশোর, ভালো আছিস তোরা?

আছি, চাচা।

এগিয়ে এলেন মিস্টার ডয়েল, তার সাথে এগোলো টেরি আর ডরি।

দাঁত বের করে হেসে বললো টেরি, ইহুহি, চেহারার কি ছিরি হয়েছে। একেবারে ভূত…

এই, থাম্ তো! ধমক দিলেন তার বাবা। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভালোয় ভালোয় যে ফিরে এসেছো এটাই বেশি।

কাজের কথা শুরু করলেন শেরিফ, ওই তিনজন লোক কেন তাড়া করেছিলো তোমাদের?

কারণ, ওরা রিগোকে ফাঁসানোর জন্যে ফাঁদ পেতেছিলো, জবাব দিলো মুসা। আর সম্বত হাসিয়েনডাটাও ওরাই পুড়িয়েছে।

গজগজ করতে লাগলো ডরি, আগুন রিগো লাগিয়েছে। ওরকম একটা কাণ্ডজ্ঞান ছাড়া লোক র‍্যাঞ্চ চালাবে এখানে? অসম্ব!

র‍্যাঞ্চ থাকলে তো চালাবে, হেসে উঠলো টেরি।

এই, তোকে চুপ থাকতে বলেছি না! কড়া ধমক লাগালেন মিস্টার ডয়েল। ডরি, তুমিও কথা বলবে না। কিশোরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, রিগো যে লাগায়নি প্রমাণ করতে পারবে?

নিশ্চয় পারবো। আগুন যেদিন লেগেছিলো সেদিন বিকেল তিনটেয় তার মাথায় হ্যাট ছিলো। আমাদের সঙ্গে ছিলো তখন রকি বীচ সেন্ট্রাল ইস্কুলে। শেরিফ বলেছেন, আগুনটা লেগেছে তিনটের আগে। তাহলে ক্যাম্পফায়ারের কাছে তখন রিগোর হ্যাট পড়ে থাকে কি করে?

কিশোর থামতে রবিন যোগ করলো, শুঁট…ইয়ে, টেরিয়ার আর মিস্টার ডরিও ইস্কুলে রিগোর মাথায় হ্যাটটা দেখেছে। কারণ ওরাও তখন ওখানে ছিলো।

আমি মনে করতে পারছি না, গোমড়া মুখে বললো টেরি।

ছিলোই না মাথায়, ডরি বললো, মনে থাকবে কি?

ছিলো, জোর দিয়ে বললো কিশোর। বিকেলে যখন তার সাথে হাসিয়েনায় ফিরলাম, তখনও ছিলো মাথায়। গোলাঘরে ঢুকে একটা হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলো। এই সময় আগুন লাগার কথা শুনে দৌড়ে বেরোয় ঘর থেকে। গোলাঘর পুড়লো, তখন হ্যাটটা ভেতরে থাকলে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার কথা, অথচ পোড়েনি। এর কারণ, দাবানল নেভাতে যখন ব্যস্ত ছিলো সবাই, তখন এসে গোলাঘর থেকে হ্যাটটা তুলে নিয়ে যায় তিন কাউবয়। নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পফায়ারের কাছে ফেলে রাখে ওটা, রিগোকে ফাঁসানোর জন্যে।

সেটা প্রমাণ করতে পারবে না, কুকুরের মতো গরগর আওয়াজ বেরোলো ডরির গলা দিয়ে। কেন রিগোকে ফাঁসাতে চাইবে ওরা?

কারণ, ওই দাবানলটাও ওরাই লাগিয়েছিলো। গোলাঘর আর হাসিয়েনডা পোড়ানোর জন্যেও ওরাই দায়ী।

প্রমাণ করতে পারবে, কিশোর? ইয়ান ফ্লেচার জিজ্ঞেস করলেন।

আর ওই কাউবয়গুলোকে পাওয়া যাবে কোথায়? জানতে চাইলেন শেরিফ।

আমার বিশ্বস, ডয়েল র‍্যাঞ্চে পাবেন।

রেগে গেলেন মিস্টার ডয়েল, কি বলছো তুমি, ছেলে! আমি এসব করিয়েছি কলতে চাও?

না, স্যার, আপনি এসব্বে কিছুই জানেন না। তবে যারা জানে, তারা, এখানেই আছে। কাউবয়ের হ্যাটটা আনতে একা যায়নি, তাই না টেরি?

টেরি? ঝট করে ছেলের দিকে তাকালেন মিস্টার ডয়েল।

ও পাগল হয়ে গেছে, বাবা, ওর কথা বিশ্বাস করো না!

পকেট থেকে চাবির রিঙটা বের করলো কিশোর। গোলাঘরে পেয়েছি। এটা খুঁজতেই এসেছিলো কাউবয়েরা, আর এটার জন্যেই আমাদেরকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। রিগোর হ্যাটটা নেয়ার সময় চাবিটা পড়ে গিয়েছিলো। র‍্যাঞ্চ ওয়াগনের চাবি।

আমাদের ওয়াগনের? বিশ্বাস করতে পারছেন না মিস্টার ডয়েল।

আমার তো তাই বিশ্বাস। আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন।

টেরি! কঠিন দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন মিস্টার ডয়েল।

আ-আমি…আমি…, তোতলাতে শুরু করলো টেরি। তারপর ডরির দিকে তাকিয়ে জ্বলে উঠলো তার চোখ। এই ম্যানেজারের বাচ্চাকে দিয়েছিলাম এটা, বাবা! ও বললো, তার কাছে যেটা ছিলো, আগুন লাগার সময় সেটা হারিয়ে ফেলেছিলো। আমাকে বলেনি…

চুপ করো! গর্জে উঠলো ডরি। তুমি জানো না কিছু, না? হ্যাটটা আনার সময় যে চাবিটা হারিয়েছি একথা ভালো করেই জানো তুমি।

সবার চোখ এখন হোঁৎকা ম্যানেজারের দিকে।

ওই গাধা তিনটে আমার দোস্ত, সব বলে দিতে লাগলো ডরি, রাগটা টেরির ওপর। আমাকে একবার বিপদ থেকে বাঁচিয়েছিলো। এবার ওরা বিপদে পড়ে এলো আমার কাছে। মিস্টার ডয়েলের এলাকায় ওদের লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করলাম। আগুন জ্বালতে কতোবার মানা করেছি, তা-ও শুনলো না গাধাগুলো, জ্বাললোই। ওদের ক্যাম্পফায়ার থেকেই দাবানল লাগলো। বুঝলাম, এটা জানাজানি হয়ে গেলে আমারও বিপদ হবে, ঘাড় ধরে বের করে দেবেন আমাকে মিস্টার ডয়েল। টেরিয়ারকে বললাম সেকথা। সে-ই আমাকে বুদ্ধি দিলো রিগোকে ফাঁসিয়ে দেয়ার জন্যে। চলে গেলাম আলভারেজদের গোলাঘরে, রিগোর ব্যবহার করা একটা জিনিস খুঁজে আনার জন্যে। দেখলাম, দরজার পাশেই কে ঝোলানো রয়েছে ওর ব্যাটটা নিয়ে এলাম। পরে গিয়ে ফেলে রেখেছিলাম ক্যাম্পফায়ারের কাছে। হয়ে গিয়েছিলো কাজ, সব ভজঘট করে দিলো ওই হতচ্ছাড়া চাবিটা!

গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন শেরিফ, চাবিটা তখন তুলে নিলে না কেন?

তাড়াহুড়ার মধ্যে ছিলাম তখন, ডরি বললো। খোঁজার সময়ই ছিলো না। কে কোত্থেকে দেখে ফেলে এই ভয়ে…

সময় আর থাকবে কি করে? খোঁচা দিয়ে বললো মুসা। গোলাঘর তখন নিশ্চয় পুড়তে শুরু করেছে।

হ্যাঁ, গলা বসে গেল ডরির। কাশি দিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে বললো, আসলে এসব পোড়ানোর কোনো ইচ্ছে আমার ছিলো না। আমি শুধু শয়তান তিনটেকে জায়গা দিয়েছিলাম। ওরা শুনে ফেললো, আলভারেজদের র‍্যাঞ্চটা আমরা চাই। তাই ইচ্ছে করেই আমাদেরকে সাহায্য করতে এলো, দাবানল লাগালো, হাসিয়েনডা আর গোলাঘর পোড়ালো। আমি যখন জানলাম, তখন দেরি হয়ে গেছে। আগুন লাগিয়ে দিয়েহে গোলাঘরে। ছুটতে ছুটতে গিয়ে ঢুকলাম, হ্যাটটা পেয়ে আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে চলে এলাম। চাবি খোঁজার সময়ই পেলাম না।

আরেকটা কথা স্বীকার করছেন না কেন? ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো রবিন, তলোয়ার খোঁজায় আমাদের বাধা দিয়েছেন আপনারা। আপনি আর টেরি। পিছে লেগেছেন, জানালায় আড়ি পেতেছেন, আমাদের হুমকি দিয়েছেন।

দায়িত্ব পালন করেছি শুধু, প্রতিবাদ জানালো ডরি।

দায়িত্ব আর পালন করতে হবে না তোমাকে, মিস্টার ডয়েল বললেন। যাও, জিনিসপত্র যা আছে, নিয়ে বিদেয় হও। তারপর জ্বলন্ত চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। আর তোমার ব্যবস্থাও আমি করছি, পরে! যাও, গাড়িতে গিয়ে বসো।

আপনি যেতে বললেও আমরা ওদের যেতে দিতে পারি না, শেরিফ বললেন। ডেপুটিকে আদেশ দিলেন, অ্যারেস্ট করো।

উরি আর টেরিকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুললেন ডেপুটি।

দীর্ঘ একটা মুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে রইলেন মিস্টার ডয়েল। তারপর নীরবে গিয়ে নিজের গাড়িতে উঠলেন। শেরিফরা রওনা হওয়ার আগেই গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন, বোধহয় উকিলের সঙ্গে দেখা করার জন্যেই।

গাড়ির দিকে যাওয়ার আগে তিন গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে হাসলেন ইয়ান ফ্লেচার, একজন নির্দোষ মানুষকে মুক্ত করলে তোমরা। আমি এখুনি গিয়ে রিগোকে ছাড়ার ব্যবস্থা করছি।

শেরিফ, ক্যাপ্টেন ফ্লেচার, আর ডয়েলরা চলে গেল। ঘড়ি দেখলেন রাশেদ পাশা। ইয়ার্ডের ট্রাকটা আনতে বললেন বোরিস আর রোভারকে। ছেলেদেরকে বললেন, ভূত সেজে আছিস তো একেকজন। চল, আগে গোসল করতে হবে। তারপর খাওয়া।

কিন্তু আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে আমাদেরকে এখানে, কিশোর কললো। অন্তত পনেরো মিনিট। তাতেই হয়ে যাবে।

আরও থাকবি? অবাক হলেন রাশেদ পাশ। কেন?

তাতে কি হয়ে যাবে, কিশোর? রবিন জিজ্ঞেস করলো।

আলভারেজদের র‍্যাঞ্চটা বাঁচাতে হবে না? কিশোর বললো, করটেজ সোর্ডটা বের করবো।

হায় হায়, ভুলেই গিয়েছিলাম! প্রায় চিৎকার করে উঠলো পিনটু। তুমি বলছিলে জবাব পেয়ে গেছে!

হ্যাঁ, পেয়েছি তো। এসো আমার সঙ্গে।

কাউন্টি রোডের দিকে এগোলো সে। সাথে চললো রবিন, মুসা, পিনটু। কৌতূহল দমাতে না পেরে রাশেদ পাশাও চললেন পেছন পেছন। বৃষ্টি থেমেছে। মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসার তাল করছে সূর্য। অ্যারোইওর ওপরের ব্রিজটায় পৌঁছে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর। আমেরিকান লেফটেন্যান্টের জার্নালের কথা মনে আছে তোমাদের? লিখেছিলো, শৈলশিরার ওপরে তলোয়ার হাতে দেখেছে ডন পিউটোকে। ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন ডন।

আছে, মুসা বললো। তবে ভুল লিখেছিলো। হাসিয়েনডার দিক থেকে আসা কোনো নালাও নেই, আর পাশে কোনো শৈলশিরাও নেই, যেটাতে ঘোড়সওয়ার দেখা যাবে।

আছে এখন, খুশি খুশি গলায় বললো কিশোর। আর আঠারোশো ছেচল্লিশ সালেও ছিলো। ওই দেখো।

অ্যারোইওটাই ক্রীক বা নালা হয়ে গেছে এখন। ওটার ওপাশে লৈশিরার মাথায় সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেন মুণ্ডুহীন ঘোড়ার মূর্তিটা।

আঠারোশো ছেচল্লিশ, এবং তারও আগে, বুঝিয়ে বললো কিশোর, শান্তা ইনেজ ক্রীকের নিশ্চয় দুটো শাখা ছিলো। ম্যাপে দেখেছি, কিন্তু বুঝতে পারিনি আমরা। কারণ ম্যাপে আঁকা অ্যারোইও আর ক্রীক দেখতে একই রকম। আঠারোশো ছেচল্লিশ সালে লেফটেন্যান্ট যখন এখানে এসেছিলো, অ্যারোইওটা তখন ক্রীকই ছলো। তারপর ভূমিকম্পে কিংবা ভূমিধস নেমে এটার মুখ বন্ধ হয়ে যায়, নালা বন্ধ হয়ে গিয়ে সৃষ্টি হয় অ্যারোইও। সম্ভবত ওই একই ভূমিকম্পে বন্ধ হয়ে যায় কনডর ক্যাসলের নিচের গুহামুখটাও। দিন যেতে থাকলো। এই অ্যারোইওটা যে একসময় ক্রীক ছিলো, ধীরে ধীরে লোকে ভুলেই গেল সেকথা।

লেফটেন্যান্ট তাহলে ঠিকই দেখেছিলো, রবিন বললো। উন পিউটোকে দেখেছিলো সান্তা ইনেজ ক্রীকের পাশের শৈলশিরায়।

দেখেছিলো। চলতে দেখেছিলো, তারপর নিশ্চয় হারিয়ে ফেলে। লেফটেন্যান্টের মাথা গরম ছিলো তখন, তাছাড়া সন্ধ্যার অন্ধকার। মূর্তিটার কথা জানতো না। মূর্তিটাকে যখন দেখলো, ওটাকে ডন পিউটো বলেই ভুল করলো।

ব্রিজ থেকে নেমে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলো কিশোর। অন্যেরা সঙ্গী হলো তার। রবিন জিজ্ঞেস করলো, কিন্তু মূর্তিটাকে তো নড়তে দেখার কথা নয়।

নড়েওনি, কিশোর বললো। নড়েছেন পিউটো। ওটার কাছে দাঁড়িয়ে।

তলোয়ারের খোলসটা তখন ওটার ভেতরে লুকাচ্ছিলেন তিনি।

তাহলে কি আরও কোনো সূত্র আছে মূর্তির কাছে? মুসা জিজ্ঞেস করলো। যেটা আমাদের চোখ এড়িয়ে গেছে?

ছাই… ধলো…বৃষ্টি-সাগর, বিড়বিড় করলো গোয়েন্দাপ্রধান। ছেলের জন্যে মেসেজ রেখে গিয়েছিলেন ডন। সাগর থেকে বৃষ্টির উৎপত্তি, আবার সাগরেই ফিরে যায়। ছাই যায় কোথায়? ধূলো যায় কোথায়? স্প্যানিশ ক্যালিফোর্নিয়ানরা খুব ধার্মিক লোক ছিলো। তারা…

দ্বাই থেকে হাই! বলে উঠলো পিনটু।

আর ধুলো থেকে ধুলো! প্রতিধ্বনি করলো যেন রবিন। কবর দেয়ার সময় এই শ্লোক আওড়ায় পাদ্রীরা। এটা বোঝানোর জন্যে, যেখান থেকে আসে সেখানেই আবার ফিরে যায় সব কিছু। যেখান থেকে উৎপত্তি!

ঠিক, মাথা ঝাঁকালো কিশোর। আহত ডনের হাতে সময় ছিলো খুব কম। স্যানটিনো যেন বুঝতে পারে, এরকম একটা ম্যাসেজই তিনি লিখেছিলেন ওই অল্প সময়ে। বোঝাতে চেয়েছিলেন, তলোয়ারটা যেখান থেকে এসেছে, সেখানেই ফিরে গেছে। অর্থাৎ করটেজের কাছ থেকে এসেছে, আবার তার কাছেই গেছে।

পাহাড়ের চূড়ায় উঠে মূর্তিটার দিকে তাকালো সবাই। মুহীন ঘোড়ার পিঠে আসীন দাড়িওয়ালা গর্বিত আরোহী যেন তাকিয়ে রয়েছে আলভারেজদের জমিদারীর দিকে।

তাহলে কি মূর্তির মধ্যেই লুকানো রয়েছে তলোয়ারটা? প্রশ্ন করলেন রাশেদ পাশা।

তা কি করে হয়? মানতে চাইলো না পিনটু। খোঁজা তো আর বাদ রাখিনি আমরা। তলোয়ার লুকানোর জায়গাই নেই ভেতরে।

দোহাই তোমার, কিশোর, দুই হাত ওপরে তুলে ফেললো মুসা, মূর্তির তলায় খুঁড়তে বলো না আর! এমনিতেই যা খুঁড়েছি, আগামী একশো বছর আর ওকাজটি করার ইচ্ছে নেই।

তার কথায় হেসে ফেললো সবাই।

না, সেকেণ্ড, অভয় দিয়ে বললো কিশোর, মাটি খুঁড়তে কলবো না। দরকার নেই। মনে আছে, খোলস থেকে তলোয়ারটা বের করে ফেলায় অবাক হয়েছিলাম আমরা? খোলসটা তৈরিই হয়েছে জিনিসটা নিরাপদে রাখার জন্যে, অথচ বের করে ফেলা হয়েছে। নিশ্চয় জরুরী কারণে। কারণটা এখন আমি জানি।

জানো?

বলো।

কোথায় ওটা, কিশোর?

হাসলো গোয়েন্দাপ্রধান। সবাইকে টেনশনে রেখে আনন্দ পাচ্ছে সে। গুহার ভেতরে জগটার কথা মনে আছে, যেটাতে কালো রঙ ছিলো? মেসেজ লেখা ছাড়াও ওই শুরু দিয়ে আরও একটা কাজ করেছেন ডন। গুলি খাওয়ার আগেই। যেখান থেকে তলোয়ারটা এসেছিলো, সেখানেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। মৃর্তির ভেতরে নেই ওটা, আছে মূর্তির গায়ে।

কাঠের মূর্তির পাশে ঝুলছে কাঠের তলোয়ার। আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়। তলোয়ারটা ধরে টান দিলো কিশোর। খুলে এলে তার হাতে, একটা নখের সর্বনাশ করলো। হাত থেকে ছেড়ে দিলো ওটা। পাথরে লেগে ঠং করে উঠলো তলোয়ার। নখটা একবার দেখে পকেট থেকে ঝের কালো ছোট ছুরি। উত্তেজনায় ব্যথা ভুলে গেছে। তলোয়ারের কালো শরীর থেকে রঙ চেয়ে তুলতে লাগলো। মেঘের ফাঁক দিয়ে বেরোনো সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে উঠলো তলোয়ারের ধাতব শরীর।

বেরিয়ে পড়লো লম্বা একসারি দামী পাথর-লাল, নীল, সবুজ রঙের, হীরাও আছে কয়েকটা।

তলোয়ারটা সূর্যের দিকে তুলে ধরলো কিশোর। ঝিক করে উঠলো কয়েকটা পাথর। গতর গলায় ঘোষণা করলো সে, এটাই করটেজ সোর্ড!

২১

ছাই থেকে ছাই, ধুলো থেকে ধুলো! একঘেয়ে কণ্ঠে বললেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার, অনেকটা মন্ত্রপাঠের মতো করে। চমৎকার একটা মেসেজ রেখে গিয়েছিলেন ডন পিউটো আলভারেজ। অসাধারণ বুদ্ধিমান লোক। আমাদের কিশোর পাশার মতোই।

তলোয়ারটা খুঁজে পাওয়ার দিন কয়েক পরে পরিচালকের অফিসে রিপোর্ট করতে এসেছে তিন গোয়েন্দা। একজন প্রহরীকে নিয়ে এসেছে সাথে করে, কারণ, কটেজ সোর্ডটা মিস্টার ক্রিস্টোফারকে দেখাতে এনেছে ওরা। বিশাল টেবিলে পড়ে আছে এখন ওটা। ঘরের আলোয় দ্যুতি ছড়াবে পাথরগুলো, ঝিকমিক করছে সোনা আর রূপার অলংকরণ। একটা পান্না দেখালো কিশোর, ওটা এখন তলোয়ারের গায়ে জায়গামতো বসানো, ঝুপড়ির গর্তে খুঁজে পেয়েছিলো যেটা।

চমৎকার জিনিস। তলোয়ারটার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করলেন পরিচালক। তাহলে র‍্যাঞ্চটা বাচলো আলভারেজদের। কিশোরের দিকে মুখ তুললেন তিনি। কাউবয়গুলোকে ধরেছে পুলিশ?

ধরেছে, কিশোর জানালো। টেকসাসে ডাকাতির দায়ে ওদের খুঁজছিলো পুলিশ এমনিতেই। আগুন লাগিয়ে আরেকটা অপরাধ করেছে। ওদেরকে সাহায্য করার জন্যে ডরিকেও জেলে ভরে দিয়েছে পুলিশ।

আর টেরিয়ারকে?

টেরিয়ার ওদেরকে প্রাসরিভাবে সাহায্য করেনি, মুসা জানালো। তাই কিছুটা নমনীয় হয়েছেন বিচারক। কিশোর অপ্রাধীদের সংশোধন করার ইস্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হাসলো মুসা। বেরিয়ে এসে আর শয়তানী করতে হবে না আমাদের সঙ্গে। বোরোতেই দেবে না।

বেশি লাই দিয়ে আসলে মাথায় তুলে ফেলা হয়েছিলো তাকে। সন্তান খারাপ হওয়ার জন্যে বাবা-মায়েরাই বেশি দায়ী। যাকগে, সংশোধন ইস্কুলে যখন দেয়া হয়েছে, স্বভাব-চরিত্র ভালো না করে আর ছাড়বে না। তো, করটেজ সোর্ভটার কি হবে?

দেখেই কেনার অফার দিয়ে ফেলেছেন মিস্টার ডয়েল, কিশোর বললো।

তবে দাম আসলে যা হওয়া উচিত, তার চেয়ে কম, রবিন বললো। ঠকানোর লোভ এখানেও হাড়তে পারেননি।

টাকা ধার দিতে রাজি হয়ে গেল একটা লোক্যাল ব্যাংক, কিশোর জানালো, মিস্টার ডায়েলের কাছ থেকে হেরিয়ানো পয়লা পেমেন্ট নেয়ার আগেই। মর্টগেজটা ডন হেরিয়ানোর কাছ থেকে আপাতত ব্যাংকই নিয়ে নিয়েছে।

আহারে, কি দরুদ! তিক্ত কণ্ঠে বললেন পরিচালক। আগে কোথায় ছিলো ওরা? যেই দেখালো, অত্যন্ত দামী একটা জিনিস পেয়ে গেহে আলভারেজরা, ওটা হাতিয়ে নেয়ার জন্যে উঠে-পড়ে লাগলো। তলোয়ারটা কিনে নিয়ে গিয়ে আরেকটা ব্যবসা করার জন্যে। দামী অ্যানটিক দেখলে ওরকম অনেক ব্যাংকই এগিয়ে আসে। তবে মিস্টার ডয়েলের চেয়ে নিশ্চয় বেশি দেবে?

অনেক বেশি, মুসা জানালো। কিন্তু রিগো আর পিনটু ব্যাংককে সেটা দিতে রাজি নয়। ধার যা দিয়েছে ব্যাংক সেটা ওরা সুদসহ আদায় করে দেবে। তলোয়ারটা বিক্রি করতে চায় মেকসিকান গভার্নমেন্টের কাছে, ওখানকার ন্যাশনাল মিউজিয়ম অভ হিসটোরিকে। ব্যাংক যা দিতো দাম অবশ্য তার চেয়ে কমই পাবে। তবু ওখানেই বেচবে ওরা। রিগো কাছে, মেকসিকোর ইতিহাসের সঙ্গে তলোয়ারটা জড়িত, কাজেই যেখানকার জিনিস সেখানেই যাক।

আবার হাই থেকে দুইয়ে, মৃদু হাসলেন পরিচালক। ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

টাকা যা পাবে, কিশোর বললো, তাতে ব্যাংকে ঋণ শোধ করেও অনেক বাচবে। আবার নতুন করে সিয়েনড়া বানাতে পারবে আলভারেজরা, কৃষিযন্ত্রপাতি কিনতে পারবে। হাসি ছড়িয়ে পড়লো তার মুখে। তারপরেও আরও টাকা থাকবে। এবং সেটা দিয়ে কিনে নেবে মিস্টার ডয়েলের সমস্ত র‍্যাঞ্চ।

ভুরু সামান্য কুঁচকে গেল পরিচালকের, অবাক হয়েছেন, মিস্টার ডয়েল বিক্রি করে দেবেন?

দেবেন, হেসে উঠলো মুসা, র‍্যাঞ্চ করার শখ তার মিটিয়ে দিয়েছে টেরি আর ভরি মিলে। তিনি র‍্যাঞ্চার নন। বেতন দিয়ে লোক রেখে যে ওই কাজটি করানো যায় না বুঝেছেন এতোদিনে। আরও একটা কারণ আছে। ইচ্ছে করলেই তাঁর বিরুদ্ধে এখন মামলা ঠুকে দিতে পারে আলভারেজরা, কারণ তাঁর লোকই ওদের ক্ষতি করেছে। ঝিগোকে অনুরোধ করেছেন তিনি, মামলা যাতে না করে, তাহলে খুব কম দামে তাদের কাছে র‍্যাঞ্চ বিক্রি করে দেবেন তিনি।

নিশ্চয় রাজি হয়েছে রিগো?

হয়েছে।

এটা সবচেয়ে ভালো খবর, খুব খুশি হয়েছেন পরিচালক, তাঁর হাসির পরিমাণ দেখে সেটা অনুমান করা গেল। এক কাজ করো। সময় করে একদিন পিনটুকে নিয়ে এসে আমার এখনে। এই বিজয় সেলিব্রেট করবো আমরা। মূসা, মেন্যুটা তুমিই তৈরি করো।

ঝকঝকে সাদা দাঁত সব বেরিয়ে পড়লো মুসার। নিশ্চয় করবো, স্যার।

কিশোর হাসলো না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পরিচালকের দিকে, আলভারেজরা র‍্যাঞ্চ ফিরে পেয়েছে, নিশ্চয় সে-খুশিতে নয়, তাই না, স্যার?

নো, মাই বয়, হাসি মুহূলো না পরিচালকের মুখ থেকে। ঠিকই, ধরেছে। আমিও ব্যবসায়ী। সেলিব্রেটটা করবো গল্পের জন্যে, নতুন একটা ভালো গল্প উপহার দিয়েছে। ছবি করবো। ভাবহি, শুটিংও করবো আলভারেজদের জায়গায়ই। অবশ্যই ভাড়া দেবো। কেমন হবে, বলো তো?

খুব ভালো হবে, স্যার, খুব ভালো! সমস্বরে বলে উঠলো তিন গোয়েন্দা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *