ভাগ্যিস এমন হয় না

ভাগ্যিস এমন হয় না

বদ্যিনাথ সান্যাল ঘুম থেকে ওঠবার পর সকালটা হাসি মুখে থাকেন। হাসি মুখে দাঁত মাজেন, হাসি মুখে এক্সারসাইজ করেন, হাসি মুখে চা খান, হাসি মুখে খবরের কাগজ পড়েন, হাসি মুখে টেলিফোনে জরুরি কথা বলেন এবং সর্বোপরি হাসি মুখে স্ত্রীর সঙ্গে সংসার বিষয়ে কাজের কথা সারেন। স্ত্রীর সঙ্গে সংসার বিষয়ে কথা বলবার সময় মুখ হাসি হাসি রাখা যে-কোনও পুরুষমানুষের জন্য একটা বিরাট শাস্তি। বদ্যিনাথবাবু তাও মেনে নিয়েছেন। এরপর স্নান সেরে, হেভি ব্রেকফাস্ট করেন। স্নানের সময় জল গরম না থাকলেও মুখ থেকে হাসি মোছেন না। ব্রেকফাস্টে টোস্টের একপিঠ পুড়ে গেলেও হাসি মুখে কামড় দেন। ড্রাইভার লেট করলে হাসি মুখে তাকে মোবাইলে ধরে বলেন, ‘জ্যামে আটকালে নাকি? এই মুখ হাসি যন্ত্রণা থেকে তিনি মুক্তি পান বাড়ি থেকে বেরোলে। বদ্যিনাথ সান্যাল হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

তিনমাস হল বদ্যিনাথবাবুর এই হাসি পিরিয়ড চলছে। প্রথম প্রথম বাড়ির লোক অবাক হয়েছিল। পরে বিরক্ত এবং চিন্তিত। স্ত্রী শর্মিষ্ঠা ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ‘কী হয়েছে তোমার? মুখটা অমন করে বোকার মতো করে আছ কেন? হাসির কথা তো তোমায় কিছু বলিনি। বলেছি, ছেলে বড় হয়েছে। এবার তার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করো। ছেলের বিয়ে কি হাসির কথা?’ বদ্যিনাথ কোনও উত্তর দেননি। ছেলে অর্চিষ্মান বলেছিল, ‘বাবা, মনে হয় সকালের দিকটায় তোমার মুখের মাসলে কোনও সমস্যা হচ্ছে। তুমি ডক্টর কনসালট করো।’ বদ্যিনাথ কোনও উত্তর দেননি। মেয়ে অনুষ্কা শ্বশুরবাড়ি থেকে একদিন বাবাকে ফোন করল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘বাবা, তুমি নাকি সকালে বাড়ির সবাইকে মুখ ভেংচাও?’ বদ্যিনাথবাবু কোনও উত্তর দেননি। রান্নার মাসি রতনের মা, ড্রাইভার রামনিধি, মালি নিত্য, দারোয়ান সাউজিও ছিল চিন্তিত। বাড়ির দুই হোলটাইমার কাজের লোক বিয়াল্লিশ বছরের ধনঞ্জয় এবং তেরো বছরের বুটি ছিল অতিরিক্ত চিন্তিত। ধনঞ্জয় বাড়ির ভারী কাজ সামলায়। বুটি ফাইফরমাস খাটে। বুটি সর্বদা টিপটপ সেজেগুজে থাকে আর বিরাট ফাঁকি দেয়। ফাঁকি ধরা পড়লে জিব বের করে ক্রমাগত ‘ছি-ছি’ বলতে থাকে। অতবার ‘ছি-ছি’ শুনলে মাথায় রক্ত ওঠে। তখন আর তার ফাঁকির কথা মনে থাকে না। বলতে হয়, ‘তুই সামনে থেকে যা।’ বুটিও তার ছোট্ট বিনুনি দুলিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময়ও মাথা নাড়িয়ে ‘ছি-ছি’ বলা বাদ দেয় না।

আসলে একটা সময় পর্যন্ত বদ্যিনাথ সান্যালের হাসিমুখের কারণ কেউ জানত না। পরে জেনেছে।

টেনশন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এ হল ডাক্তার পালের ট্রিটমেন্ট। ‘হাসি মুখ ট্রিটমেন্ট’। একদিন প্রেশার-টেসার পরীক্ষা করে ডাক্তার পাল বললেন, ‘বদ্যিনাথবাবু আপনি হাসিখুশি থাকুন। আপনি যে ধরনের কাজ করেন তাতে হাসিখুশি থাকা খুব প্রয়োজন।’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘কীভাবে থাকব। ওষুধ দিন।’

‘হাসির আবার ওষুধ কী!’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘তাহলে হাসব কী করে?’

‘এই যে এইভাবে।’ ডাক্তারবাবু দাঁত বের করে হেসে দেখালেন।

বদ্যিনাথ অবাক হয়ে বললেন, ‘এ তো অভিনয়, ভান!’

ডাক্তার পাল এবার সত্যি সত্যি হাসলেন। বললেন, ‘ওরিজিনাল গোমড়া মুখের থেকে হাসিখুশির ভানও ভালো। দেখবেন, ভান করতে করতে একসময় সত্যি হেসে ফেলবেন। হাসতে না পারুন, টেনশন তো বন্ধ হবে। আচ্ছা, দিনের কোন সময়টা আপনার টেনশন বেশি? সকালে, দুপুরে না রাতে? নাকি শুধু কাজের সময়?’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘মূলত সকালে। বাড়িতে যতক্ষণ থাকি চিন্তা হয়। সারাদিনের কাজ ঠিকমতো হবে তো? গড়বড় কিছু হয়ে যাবে না তো? তারপর বেরিয়ে কাজ শুরু করলে আর সমস্যা হয় না। কাজে ডুবে যাই।’

‘খুব ভালো। তাহলে ওই সকালটুকুই জোর করে হাসিখুশি থাকবেন। যতক্ষণ বাড়িতে থাকবেন মুখে একটা হাসি হাসি ভাব থাকে যেন। হাজার চিন্তা হলেও সেই হাসি ভাব ছাড়বেন না। দেখবেন ওটাই মনের ওপর এফেক্ট করবে। মনটাও হাসি হাসি হয়ে যাবে।’

সেই থেকে তিনমাস বদ্যিনাথবাবু হাসি মুখ ট্রিটমেন্টের মধ্যে রয়েছেন। বাড়ির সকলে চিকিৎসার কথা জেনেও গেছে। জেনে হাঁফ ছেড়েছে। যাক বাবা, এই হাসি মুখ অন্তত ভেংচানি বা পাগলামি নয়। আজ ঘটনা কিন্তু অন্যরকম।

বদ্যিনাথবাবুর মুখে হাসি নেই। মুখ থমথমে। ড্রইংরুমের সোফায় পিঠ সোজা করে বসে আছেন। সোফায় পিঠ সোজা করে বসে থাকা মানে ঘটনা অতি গুরুতর। হাতে চায়ের কাপ। সেই কাপ তিনি মুখে তুলছেন না। হাতে নিয়ে বসে আছেন। কারণ কী?

কারণ টেলিভিশনের সিরিয়াল। বদ্যিনাথবাবু একজন সিরিয়াল পরিচালক। সিরিয়াল বাজারে মানুষটার খুব নামডাক। যদিও তা নিয়ে মানুষটার কোনও অহংকার নেই। মুখ ফুটে নিজের সাফল্য জাহির করেও বেড়ান না। চুপচাপ নিজের কাজ করেন। গত বারো বছরে কমপক্ষে আটটা হিট মেগা সিরিয়াল তার ঝুলি থেকে বেরিয়েছে। কোনওটা এগারোশো, কোনওটা একুশশো, কোনওটা একতিরিশশো এপিসোড পর্যন্ত চলেছে। তার ‘জীবন যখন ফুরিয়ে যায়’ নামের সিরিয়াল নিয়ে বিরাট ঝামেলা হয়েছিল। জীবন ফুরিয়ে গেল কিন্তু সিরিয়াল ফুরোতে চায় না। এই মুহূর্তে বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন সময়ে বদ্যিনাথবাবুর চারটে কাজ চলেছে। চারটে চার রকম। আধুনিক সময়ের গল্প নিয়ে হচ্ছে, ‘বেশ করেছি, আবার করব’, দু:খের গল্প নিয়ে হচ্ছে, ‘কেন এমন হল’, ঐতিহাসিক কাহিনি নিয়ে হচ্ছে, ‘প্রণমি তোমায়’ আর হাসির গল্প নিয়ে চলছে, ‘পটলা যখন চিৎপটাং’। চারটেরই রমরমা অবস্থা। পুরোদমে কাজ চলছে। কাজের ব্যাপারে বদ্যিনাথবাবুর নিখুঁত সিস্টেম। আলাদা আলদা টিম। কোথাও শুটিং হচ্ছে, কোথাও গল্প লেখা চলে, কোথাও স্ক্রিপ্ট কাটাছেঁড়া হয়, কোথাও মিউজিক রেকর্ডিং চলছে। বদ্যিনাথবাবু সকালবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিকেল পর্যন্ত বিভিন্ন টিমের কাজ দেখে বেড়ান। সন্ধের পর হয় জোড়াতালি। গল্পের সঙ্গে স্ক্রিপ্ট, স্ক্রিপ্লেটর সঙ্গে শুটিং, শুটিঙের সঙ্গে মিউজিক। টিভিতে দেখালে দর্শকদের চোখে কখনও জল, কখনও মুখে হাসি।

আজ এই হাসিকান্না নিয়েই গোলমাল হয়েছে। হাসিকান্না নিয়ে গোলমাল নয়, গোলমাল হয়েছে জোড়াতালিতে। বদ্যিনাথবাবুর সহকারী পরিচালক প্রবীর ভোরবেলা টেলিফোন করেছিল। ‘দাদা কেলেঙ্কারি হয়েছে।’

বদ্যিনাথ বলেন, ‘কেলেঙ্কারি! কী কেলেঙ্কারি? শুটিং ক্যানসেল? নায়িকার ডেঙ্গু? ক্যামেরায় গন্ডগোল? স্টুডিয়োতে আগুন লাগেনি তো?’

প্রবীর উত্তেজিত গলায় বলল, ‘না, না, সেসব নয়। গতকাল যে এপিসোড দেখানো হয়েছে সেখানে একটা বিগ মিসটেক হয়ে গেছে।’

বদ্যিনাথবাবু হাসি মুখ মেনটেন করেই দাঁত কিড়মিড় করলেন।

‘মিসটেক! ভণিতা না করে কী মিসটেক সেটা বলে ফেলো প্রবীর।’

প্রবীর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘কেন এমন হল’ সিরিয়ালের মিউজিক ভুল করে ‘পটলা যখন চিৎপটাং’ সিরিয়ালে জুড়ে গেছে। সাউন্ডের নির্মাল্য এই কাণ্ড করেছে। চারদিক থেকে রিপোর্ট আসছে।’

হাসি মুখ ভুলে বদ্যিনাথবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘সে কী!’

আর্তনাদ করবারই কথা। টিভি সিরিয়ালে রাগ, দু:খ, হাসি, ভালোবাসার কথা অনেকটাই বাজনা দিয়ে বোঝানো হয়। এতে রিস্ক কম। দর্শকরা গল্প, ডায়লগ বা ছবিতে বুঝতে না পারলে বাজনায় বুঝতে পারে। সেই মতো রাগে, হাসে, কাঁদে। দু:খের গল্প হলে বাজে করুণ বাজনা। এটাই নিয়ম। কাল হয়েছে গোলমাল। জোড়াতালির সময় ভুল করে চোখে জল আসা বাজনা বেজে গেছে হাসির সিরিয়াল ‘পটলা যখন চিৎপটাং’-এ। আজ সকাল থেকে রিপোর্ট আসতে শুরু করেছে। এই ঘটনায় দর্শকরা ঘাবড়ে গেছে। কেউ কেউ নাকি পেট ফাটা হাসির সিকোয়েন্সে করুণ বাজনা শুনে চোখের জল ফেলেছে। তাদের কী দোষ? কোনও দোষ নেই। বাজনা যখন কাঁদতে বলছে, কাঁদতে তো হবে। এই হল কেলেঙ্কারি।

বদ্যিনাথবাবু সহকারীর ফোন কেটে থম মেরে বসে গেছেন। তার চোখেও জল আসার জোগাড়। স্বাভাবিক। হাসির ঘটনা দেখে কেউ যদি চোখের জল মোছে পরিচালক কাঁদবে না তো কী করবে? একটু পরেই বদ্যিনাথ সান্যাল চ্যানেল কর্তাদের কাছ থেকে ফোন পেলেন। সেই ফোন আরও মারাত্মক।

শর্মিষ্ঠা ঘরে ঢুকে থমকে গেলেন। কী হল? স্বামীর মুখ থমথমে কেন? এই সময় তো হাসি ট্রিটমেন্ট চলবার কথা। আজ কি ট্রিটমেন্ট থেকে ছুটি? নাকি ডাক্তার ওষুধ পালটে দিলেন? হাসির বদলে মুখ থমথমে? যাই হোক, সিরিয়াল স্বামীর সঙ্গে তার আজ খুব জরুরি কথা আছে। এমনি স্বামী নয়, সিরিয়াল পরিচালক স্বামীর সঙ্গে কথা আছে। কথা জরুরি এবং কঠিন। কথার বিষয় সংসার নয়, কথার বিষয় সিরিয়াল। সিরিয়ালের নাম, ‘বেশ করেছি, আবার করব’। স্বামীর সিরিয়াল নিয়ে শর্মিষ্ঠার কোনও মাথাব্যথা ছিল না। তিনি দেখেনও না, ঘরের লোক করে বলেই হয়তো দেখেন না। ঘরের লোকের কদর কেই বা বোঝে? কিন্তু আর না বুঝে পারা যাচ্ছে না। কারণ তিনি শুধু বদ্যিনাথ সান্যালের স্ত্রী, দুই সন্তানের মা এবং একজন সুগৃহিণী নন, বছরখানেক হল যুক্ত হয়েছেন ‘নারীকে জাগতে হবে সমিতি’র সঙ্গে। নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং অধিকার রক্ষায় এই সংগঠন মূলত আলোচনা সভা করে। স্বামী ব্যস্ত। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে চাকরি করছে। তাই হাতে অনেক সময়। সেই সময় কাটাতেই সমিতিতে নিজেকে জড়িয়েছেন শর্মিষ্ঠা। সেখানেই হয়েছে গোলমাল। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি ‘সমিতি’র সদস্যদের মুখে গুজগুজ ফুসফুস শুনছিলেন। আমল দেননি। কাল সমিতির সেক্রেটারি শেফালি নাগ ডেকে কড়া গলায় বললেন। ‘বললেন’ না ‘হুমকি’ দিলেন বলা ভালো।

‘তুমি তোমার হাজবেন্ডকে বলো শর্মিষ্ঠা। হোয়াট ইজ দিস?’

শর্মিষ্ঠা বলল, ‘কী বলব?’

শেফালিদি মাথা নেড়ে বললেন, ‘সিরিয়ালের নামে উনি এসব কী দেখাচ্ছেন? এসব বন্ধ করতে বলো।’

শমিষ্ঠা অবাক হয়ে বললেন, ‘সিরিয়াল! কোন সিরিয়াল?’

শেফালিদি রাগ রাগ গলায় বললেন, ‘ওই যে কী সব ছাইপাঁশ হয় না? ”বেশ করেছি, আবার করব” না কী যেন নাম?’ শেফালি নাগ ডাকসাইটে মহিলা। এই কারণেই সম্প্রতি তাকে, ‘নারীকে জাগতে হবে’ সমিতির সেক্রেটারির পদে বসানো হয়েছে। তিনি ক্ষমতায় এসে সমিতিতে ঝাঁঝ আমদানি করছেন। আগে শুধু সেমিনার, দুপুরে খাওয়াদাওয়া, বিকেলে গান হত। সেই গান নিয়ে মেম্বারদের মধ্যে পলিটিকস হত। কার মেয়ে, কার বোন, কার ননদ চান্স পাবে তাই নিয়ে পলিটিকস। শেফালি নাগ এসব কমিয়ে দিয়েছেন। তিনি চান শুধু ইনডোর নয়, সমিতিকে আউটডোর অ্যাকটিভিটিসও করতে হবে। নির্যাতন, অবহেলার অভিযোগ এলে ঘটনাস্থলে যেতে হবে। চাই বিক্ষোভ। অ্যাজিটেশন। হাতজোড় করে কাকুতিমিনতির দিন শেষ। নারীকে সম্মান ছিনিয়ে আনতে হবে। তা ছাড়া বড় ধরনের গোলমাল করতে না পারলে প্রচার পাওয়া যাবে না।

শর্মিষ্ঠা সেক্রেটারির রাগ সামলাতে চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘কী দেখাচ্ছে ওখানে? অশ্লীল কিছু? মেয়েদের ছোট করছে নাকি! নেশা ভাং নয় তো?’

‘না, না, তার থেকেও ভয়ংকর। শুনেছি ও জিনিস দেখে ছেলেমেয়েরা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। পরিবারে অশান্তি ছড়াচ্ছে, আরও ছড়াবে। আমাদের শুধু নারী নারী করলে তো চলবে না, যাতে পরিবারে শান্তি থাকে সেটাও দেখতে হবে। সমাজে একটা নিয়ম আছে। সেই নিয়মের এদিক-ওদিক হলে আগুন জ্বলবে। সেই আগুনে নারী-পুরুষ সবাই পুড়বে।’

সেক্রেটারি হওয়ার পর থেকে শেফালি নাগের এই একটা অভ্যেস হয়েছে। দুটো কথার পরই ভাষণে চলে যান।

শর্মিষ্ঠা ভয় পেয়ে বললেন, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না শেফালিদি।’

শেফালি নাগ এই কথার উত্তর না দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘একটা কথা বলে দিচ্ছি শর্মিষ্ঠা, বদ্যিনাথবাবু যদি এই কাজ বন্ধ না করেন আমাদের সমিতি হাত গুটিয়ে বসে থাকবে না। আধুনিকতার নামে ছেলেমেয়েকে উচ্ছন্নে যেতে শেখালে আমরাও প্রতিবাদ করব, অ্যাজিটেশন করব।’

শর্মিষ্ঠা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘অ্যাজিটেশন!’

শেফালি নাগ চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই অ্যাজিটেশন। আমাদের পাড়ার একজন টিভি সিরিয়ালের নামে ছেলেমেয়েদের গোল্লায় যেতে বলবেন, আর আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকব? শুনেছি ওই সিরিয়াল নাকি অনেকে দেখে। তার মানে ঘরে ঘরে বারুদ ছড়াচ্ছে। যে-কোনও সময় আগুন লাগবে। অনেক মা-ই আমার কাছে কমপ্লেন করে গেছে। তারা ভয় পাচ্ছে। মনে রেখো, মা-ও একজন নারী। এ জিনিস মেনে নেওয়া যায় না। বলতে খুব খারাপ লাগছে শর্মিষ্ঠা, তোমার বাড়ির সামনে সমিতির পক্ষ থেকে বিক্ষোভ দেখানোর কথা ভাবা হয়েছে। সভা হবে। তোমাকেও সেখানে থাকতে হবে। সেরকম হলে বদ্যিনাথবাবুর কুশপুতুল পোড়ানো হবে। এফিজি। এফিজি কী জানো? খড়ের হাত-পা, মাটির হাড়ির মাথা। অ্যাজিটেশনের সময় আগুন লাগিয়ে সেই মাথায় বাঁশ পেটা করা হয়। এতে কাগজে ফটো পাওয়া যাবে। শুধু বিক্ষোভ করলেই তো হবে না। পাবলিসিটিটাও তো দেখতে হবে। এটাই হবে সমিতির প্রথম আউটডোর অ্যাকটিভিটি।’

শর্মিষ্ঠা ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘আমাকে একটা দিন সময় দিন প্লিজ।’

শর্মিষ্ঠা ঠিক করেছিলেন, সকালে স্বামীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন। সত্যি যদি ভয়ংকর কিছু হয় তাহলে হাসি মুখে ঘুরঘুর করা বের করে দিতে হবে। বদ্যিনাথ সান্যাল যেন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন, তার স্ত্রী শুধু স্ত্রী নয়, সমিতির একজন সদস্যও বটে।

‘তোমার সঙ্গে জরুরি কথা ছিল।’

বদ্যিনাথবাবু থমথমে গলায় বললেন, ‘আজ বাদ দিলে হয় না শর্মিষ্ঠা?’

শর্মিষ্ঠা সোফায় গ্যাঁট হয়ে বসে বললেন, ‘না হয় না। আজই বলতে হবে। তার আগে বলো, আজ তোমার হাসি ট্রিটমেন্টের কী হল? ট্রিটমেন্ট কি শেষ? তা ছাড়া তুমি অমন পিঠ সোজা করে বসেই বা আছ কেন? ধ্যান করছ নাকি?’

বদ্যিনাথবাবু বিড়বিড় করে আপন মনে বললেন, ‘মিউজিক… মিউজিক…।’

শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বললেন, ‘কীসের মিউজিক?’

বদ্যিনাথবাবু বিরক্তির হাত নেড়ে বলেন, সিরিয়ালের মিউজিক। বাদ দাও।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘এবার নিজের বাড়ির সামনে মিউজিক বাজবে। মিটিং, মিছিল, স্লোগান শুরু হবে। তখন বুঝতে পারবে মিউজিক কাকে বলে।’

‘তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না।’

শর্মিষ্ঠা কঠিন গলায় বললেন, ‘আমিও পারছি না। তোমার সিরিয়ালে কী হয়েছে?’

বদ্যিনাথবাবু ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন। তাহলে ঠিকই ভেবেছেন। বাজনা নিয়ে গোলমালের খবর চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। জনপ্রিয় সিরিয়াল। বদ্যিনাথবাবু মুখ নামিয়ে বললেন, ‘গোলমাল হয়েছে। ”পটলা যখন চিৎপটাং” সিরিয়ালের দুশো সাতান্ন নম্বর এপিসোডে মিউজিক স্কোরিং-এ গোলমাল হয়েছে। তবলা, ঢোল, মৃদঙ্গের বদলে ”কেন এমন হল” সিরিয়ালের করুণ সুরের বেহালা ঢুকে গেছে। হাসির বদলে কান্নার মিউজিক। সমস্যা হল চ্যানেলের লোকজন একটু আগে ফোন করেছিলেন। বলছেন, এই ভুল বাজনার রিপোর্ট নাকি দুর্দান্ত। দর্শকরা চাইছে, ”পটলা যখন চিৎপটাং” সিরিয়ালকে আর হাসির মধ্যে বেঁধে রাখা যাবে না। গল্প বদলে তাকে দু:খের করে দিতে হবে। রাতারাতি একটা হাসির জিনিসকে কীভাবে দু:খের করব আমি বুঝতে পারছি না শর্মিষ্ঠা। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।’

শর্মিষ্ঠা ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘এবার মাথায় বাঁশ পড়বে।’

‘বাঁশ। কেন, বাঁশ পড়বে কেন?’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘সে যখন অ্যাজিটেশন হবে তখন বুঝতে পারবে। কুশপুতুলের মাথায় বাঁশ পেটানো হয়। যাক, আসল কথায় আসি। মিউজিক-টিউজিক নয়, তোমার ”ওই যে বেশ করেছি” না কী একটা সিরিয়াল চলছে, তাতে নাকি ছেলেমেয়েদের উচ্ছন্নে যাওয়ার উপায় বলা আছে। মায়েরা এসে আমাদের ”নারীকে জাগতে হবে” সমিতিতে কমপ্লেন ঠুকেছে। ঘটনাটা কী?’

এত চাপের মধ্যে থেকেও বদ্যিনাথবাবু স্বস্তি পেলেন। যাক বাবা, হাসি-কান্নার গোলমালটা অন্তত নয়। একটু হেসে বললেন, ‘তোমার উত্তেজনা দেখে হাসছি। তুমি তো কখনও আমার সিরিয়াল-টিরিয়াল নিয়ে মাথা ঘামাও না। হল কী? ওই সিরিয়ালের গল্পটা খুব জমে গেছে। অল্প বয়েসের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গল্প। কিন্তু উচ্ছন্নে যাওয়ার মতো তো কিছু নেই!’

স্বামীর হাসি শর্মিষ্ঠার পছন্দ হল না। বললেন, ‘কিছু নেই তো হইচই এমনি হচ্ছে?’

বদ্যিনাথবাবু একটু ভেবে নিয়ে বললেন, ‘গল্পের নায়ক বৃষ্টির রাতে একটা মেয়েকে বাড়িতে এনে তুলেছে। জানা গেছে, মেয়েটি প্রস্টিটিউট। খদ্দের পাওয়ার আশায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছিল। ছেলেটি না বুঝে তাকে গাড়িতে তুলে ফেলেছে। বাড়িতে এসে আসল পরিচয় জানতে পারে। এদিকে মেয়েটি অসুস্থ। প্রবল জ্বর। নায়কের মা বলল, মেয়েটিকে এখনই বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে। একজন প্রস্টিটিউটকে বাড়িতে এনে তুমি খুব খারাপ কাজ করেছ। ছেলেটি তার মাকে বলল, অসুস্থ মেয়েটিকে কিছুতেই সে বাড়ি থেকে বের করে দেবে না।’

বদ্যিনাথবাবু থামলে শর্মিষ্ঠা বিড়বিড় করে বললেন, ‘কী আস্পর্ধা!’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘আস্পর্ধার কী দেখলে! ঠিক কথাই তো বলছে। একজন সাহসী, আধুনিক, লেখাপড়া জানা তরুণের মুখে তো এরকম কথাই মানায়। প্রস্টিটিউট হলেই বা কী? অসহায়, অসুস্থ এক তরুণীকে সে বাড়ি থেকে বের করে দেবে? স্ক্রিপ্ট রাইটার কার্তিককে আমি নায়কের মুখে আরও কড়া ডায়লগ লাগাতে বলেছি।’

শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বললেন, ‘ডায়লগ! তুমি ওর মুখে ডায়লগ দিতে বলেছ? ওই ছেলের গালে তো চড় লাগানো উচিত।’

বদ্যিনাথ মুচকি হেসে বললেন, ‘ক’টা এপিসোড পরেই আমার নায়ক তার মাকে বলবে, তোমার যদি না পোষায় মা, ক’টাদিন মামা বা মাসির বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতে পারো। মেয়েটি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত এই বাড়িতেই থাকবে। ডায়লগটা কীরকম হবে শর্মিষ্ঠা?’

শর্মিষ্ঠা প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, ‘সেকী! ওই বখে যাওয়া ছোকরার মুখে এই কথা বসিয়েছ! ছি-ছি, শেফালিদি তো ঠিকই বলেছেন। এ জিনিস দেখলে ছেলেপিলেরা উচ্ছন্নে যাবে না তো কী হবে? মাকে ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া শেখাচ্ছ। এখনই তুমি এসব বন্ধ করো।’

বদ্যিনাথবাবু অবাক গলায় বললেন, ‘ঘাড় ধরে বের করে দেওয়ার কথা তো বলিনি। কয়েকদিনের জন্য চলে যাওয়ার কথা বলেছি। তোমার শেফালিদি কী বলছেন, মেয়েটিকে অসুস্থ অবস্থায় বের করে দিতে হবে?’

শর্মিষ্ঠা থমকালেন। ঢোঁক গিলে বললেন, ‘তাই করা উচিত। ওই সব মেয়ের ওপর আবার দরদ কী? ছি-ছি। নইলে…নইলে হাসপাতালে দিক, নার্সিংহোমে যাক…যে-কোনও চুলোয় যাক…না, না, তুমি এই সিরিয়ালের গল্প আজই বদলে দাও। নইলে সমিতি থেকে বাড়ির সামনে বিক্ষোভ হয়ে যাবে।’

বদ্যিনাথবাবু এবার নড়েচড়ে বসলেন। নিজের কাজ নিয়ে ঢাক পিটিয়ে বেড়ান না তিনি, কিন্তু খোঁচা খেলে ছেড়ে কথা বলেন না। কঠিন গলায় বললেন, ‘বিক্ষোভ হলে ভালো। কাগজ, পত্রিকায় লেখালিখি হবে। আমার সিরিয়ালের আরও প্রচার হবে। আমিও গল্পটাকে আরও কড়া করব। ছেলেমেয়েরা ভালো কাজ করলে বাবা-মায়ের সমর্থন করা উচিত। একটা অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্যে খারাপ কিছু নেই। আমাদের এই সিরিয়ালে সেই মেসেজ ছড়িয়ে দেব। যত খুশি তোমরা বিক্ষোভ করো আমার কিছু যায় আসে না।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘তুমি গোয়ার্তুমি কোরো না। গল্পটা একটু এদিক-ওদিক করে দাও। শেফালিদিরাও শান্ত হবেন।’

বদ্যিনাথ সান্যাল উঠে পড়লেন। বললেন, ‘তোমার শেফালিদিকে বলবে ওরা যেন অবশ্যই আমার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করে। চিন্তার কিছু নেই, খরচপাতি যা লাগবে আমি দেব। প্রচারের দায়িত্বও আমার। আমার টিভি চ্যানেল, খবরের কাগজ, পত্রপত্রিকার সঙ্গে চেনাজানা আছে।’

বদ্যিনাথবাবু চলে গেলে গুম মেরে বসে রইলেন শর্মিষ্ঠা। সেদিন দুপুরের ঘুমে স্বপ্ন দেখলেন। বাড়ির সামনে বিক্ষোভ হচ্ছে। চিৎকার, হইচই, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, স্লোগান। বিক্ষোভে তিনিও আছেন। তাঁর হাতে লম্বা একটা বদখত পুতুল। খড়ের হাত-পা, মাটির হাড়ির মাথা। বড় বড় চোখ। পুতুলের গলায় প্ল্যাকার্ড ঝুলছে। তাতে লেখা—’বদ্যিনাথ নিপাত যাক।’ বাড়ির গেটের সামনে কোথা থেকে বুটি এসে উপস্থিত হল। সে লম্বা জিব বের করে মাথা নেড়ে বলল, ‘ছি-ছি মামিমা, নিজের বরের নামে গাল দিচ্ছ! ছি-ছি।’

শর্মিষ্ঠা স্বপ্ন দেখলেও বদ্যিনাথ সান্যালের বাড়িতে বিক্ষোভ হল না।

‘নারীকে জাগতে হবে সমিতি’র মিটিং ডেকে শেফালি নাগ বললেন, ‘এখন ওসব সিরিয়াল-টিরিয়ালের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। আমাদের কাছে নতুন কেস এসেছে। সেটা সিনেমা, সিরিয়ালের মতো বানানো নয়, বাস্তব ঘটনা। সেটাই এখন আমাদের লিস্টে এক নম্বর।

শর্মিষ্ঠা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক, বাড়ির সামনে কিছু হচ্ছে না। ক’দিন খুব ভয়ে ভয়ে ছিলেন। অর্চি, অনুর বাবা যেভাবে তেতে আছে তাতে ঘটনা আরও বড় দিকে গড়াতে পারত। এই ক’দিন হাসি ট্রিটমেন্ট নেই। জিগ্যেস করলে বলছে, ‘রাখো তোমার ট্রিটমেন্ট। আমার পাগলের মতো অবস্থা। দুশো সাতান্ন এপিসোড ধরে দর্শকদের হাসানোর পর কান্নাকাটির মধ্যে ফেলা সহজ কাজ নয়। সকাল থেকে স্ক্রিপ্ট রাইটারের সঙ্গে বসছি। সে বেচারি কাজ ছেড়ে দেবে বলছে। এই লাইনে আর থাকবেই না। দেশের বাড়িতে চলে যাবে। ওখানে জমি আছে, চাষবাস করবে, গরু-ছাগল পুষবে। সেটা অনেক সহজ হবে। আমারও তাই ইচ্ছে। আমার দেশের বাড়ি থাকলে আমিও তাই করতাম। এই সময় মুখ হাসি করে ঘুরে বেড়ানোর সময় নেই। আর শোনো, তোমার সমিতি কবে অ্যাজিটেশন করবে আগে থেকে জানিয়ো। মিডিয়ায় খবর দেব।’

শর্মিষ্ঠা আর ঘাঁটাননি। দম বন্ধ করে থেকেছেন। ঘটনাটা কাউকে বলতেও পারেননি আবার গিলতেও পারেননি। রবিবার অনুষ্কা এসে বলল, ‘মা, তোমার মুখ শুকনো কেন?

শর্মিষ্ঠা তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন, ‘মুখ শুকনো! কই, না তো?

অনুষ্কা খাটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে বলল, ‘না হলে ভালো। কিন্তু তোমাকে দেখে কেমন যেন চিন্তিত মনে হচ্ছে। তোমার ওই নারী ঘুমন্ত সমিতির কী খবর?’

শর্মিষ্ঠা জোর করে হেসে বললেন, ‘ঘুমন্ত নয়, জাগন্ত। ওসব ঠাট্টা-ইয়ার্কি বাদ দাও। এবার দাদাকে নিয়ে ভাবো দেখি। অর্চির তো বিয়ে দিতে হবে।’

অনুষ্কা ধড়ফড় করে উঠে বসল, ‘ঠিক বলেছ মা। আমাদের এখনই নেমে পড়া উচিত। দাদার মতো ভালো ছেলের জন্য কমপক্ষে এক হাজার একটা পাত্রী দেখতে হবে। সময় লাগবে।’

শর্মিষ্ঠা ছদ্মরাগ দেখিয়ে বললেন, ‘তোমাদের মধ্যে তো তার কোনও লক্ষণ দেখছি না। তুমি হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে আছ আর তোমার বাবা হাবিজাবি সব টিভি সিরিয়াল নিয়ে পড়ে আছে।’

অনুষ্কা চোখ বড় করে বলল, ‘হাবিজাবি কী বলছ মা! বাবার সব তো সুপারহিট। আমার শ্বশুরবাড়িতে দেখে। একটা দেখে তো শাশুড়িমা ঘন ঘন চোখের জল মোছেন।’

শর্মিষ্ঠা একটু থেমে বিছানার চাদর খুঁটতে খুঁটতে বললে, ‘হ্যাঁ রে অনু, তোর বাবার ‘বেশ করেছি,’ না কী নামে যেন একটা সিরিয়াল আছে না? তুই দেখেছিস?’

অনুষ্কা আবার ঝপাং করে খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। মায়ের কাছে এলেই তার কেন যেন মনে হয় একটু ঘুমিয়ে নিই। হাই তুলে বলল, ‘খেপেছ? আমার টিভি দেখতে একেবারে ভালো লাগে না। বাবার হলে তো আরও নয়। ওসব বাদ দাও মা। তুমি বরং দাদার বিয়ের কথা বলো। জানো মা, আমার ছোট ননদের এক বান্ধবী আছে। ইশা না নিশা কী যেন নাম…কী সুইট দেখতে গো…যদি বলো কথা বলি…।’

সমিতির মিটিং-এ ঠিক হল, নতুন জায়গার বিক্ষোভে হই-হট্টগোল, ভাষণ-টাষণ সবই হবে। সেরকম হলে বাড়ি ঘেরাও করা হবে। যতক্ষণ না দাবি মানা হচ্ছে, ততক্ষণ ঘেরাও তোলা হবে না। এই কর্মসূচিতে সমিতির সদস্যরা খুব উত্তেজিত। এই না হলে জেগে ওঠা? শুধু শর্মিষ্ঠা ‘কিন্তু কিন্তু’ করলেন। এই বুড়ো বয়সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিৎকার-টিৎকার কি মানাবে? তা ছাড়া ক’দিন পর থেকে ছেলের বিয়ের কথাবার্তা শুরু করবেন। এই সময় কোনও ভাবী পাত্রীর মা যদি দেখে রাখে, পরে কি আর এবাড়িতে মেয়ে দেবে? তবে শর্মিষ্ঠা কথা বাড়ালেন না। গোলমাল নিজের বাড়ি থেকে সরেছে এটাই বড় কথা। এবার ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকলেই হবে। কেউ দেখতে পাবে না।

দেখতে পেলেন, বদ্যিনাথ সান্যাল। সেদিন বিকেলে ‘কেন এমন হল’ সিরিয়ালের শুটিং শেষ করে ‘প্রণমি তোমায়’ সিরিয়ালের মিউজিক রিহার্সাল শুনতে যাচ্ছিলেন। আজকাল আর তিনি এসব কারও হাতে ছাড়েন না। কে জানে ছাড়লে আবার কী কেলেঙ্কারি ঘটে। তার গাড়ি গলির মোড়ে ঢুকতে গিয়ে আটকে গেল। ড্রাইভার বলল, ‘সামনে গোলমাল হচ্ছে স্যর।’

কাচ নামিয়ে উঁকি মারলেন বদ্যিনাথবাবু। মহিলাদের ভিড়। গোলমাল কিছু নয়, বিক্ষোভ-টিক্ষোভ হচ্ছে। দু-একজন পুলিশও আছে। বিরক্ত হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সময় বদ্যিনাথবাবু স্ত্রীকে দেখতে পেলেন। শর্মিষ্ঠা। হাতে প্ল্যাকার্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জানলা দিয়ে আরও খানিকটা মুখ বাড়ালেন বদ্যিনাথ। এবার প্ল্যাকার্ডটা পড়তেও পারলেন। সেখানে লেখা—’তিতাসকে ফিরিয়ে নাও।’

ডিনারের পর বদ্যিনাথবাবু ডায়েরি খুলে বসেন। পরের দিনের কাজ ঝালিয়ে নেন। আজও বসেছেন। শর্মিষ্ঠা ঘরে ঢুকলে মুখ না ফিরিয়েই বললেন, ‘তিতাস কে শর্মিষ্ঠা?’

থমকে দাঁড়ালেন শর্মিষ্ঠা। এক মুহূর্ত ভেবে ঠোঁট কামড়ে বললেন, ‘তুমি কী করে জানলে?’

বদ্যিনাথবাবু কোনওরকম ভণিতা না করে বললেন, ‘বিকেলে মিউজিক রিহার্সালে যাচ্ছিলাম। গলিতে ঢুকতে গিয়ে দেখি রাস্তা বন্ধ। জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। দেখি বড় গেটওয়ালা বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছ। তোমার হাতে একটা প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা ছিল।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘ও, আমাদের সমিতির অ্যাজিটেশন ছিল। এই প্রথম বাইরে বেরিয়ে বিক্ষোভ হল।’

বদ্যিনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, ‘সেকী, আমার বাড়িতে না করে অন্য জায়গায়!’ শর্মিষ্ঠা খাটের একপাশে বসে রিল্যাক্সড গলায় বললেন, ‘ওসব সিরিয়াল-টিরিয়াল আর আমাদের মাথায় নেই। তিতাসের কেসটা নিয়ে আমরা এখন ব্যস্ত। মেয়েটাকে নিয়ে কী ভয়ংকর ঘটনা যে হয়েছে।’

বদ্যিনাথ সান্যাল ডায়েরির পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন, ‘ইস, পাবলিসিটির একটা বড় চান্স হারালাম। তিতাস মেয়েটার ওপর আমার হিংসে হচ্ছে।’

বালিশে হেলান দিয়ে শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘ঠাট্টা কোরো না। মেয়েটা যে কী সমস্যায় পড়েছে ভাবতে পারবে না।’

বদ্যিনাথবাবু খানিকটা অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘তাই নাকি?’ কথার ভঙ্গি বলে দিল, বিষয়টায় তার কোনও আগ্রহ নেই।

শর্মিষ্ঠা তবু ছাড়লেন না। উৎসাহ নিয়ে বলতে শুরু করলেন। ‘ঘটনা একেবারে যে নতুন এমন নয়। আগেও ঘটেছে। তবে এখানে বাড়াবাড়ি হয়েছে। বাড়ির ছেলে কাউকে না বলে কয়ে দুম করে বিয়ে করে বসেছে। মেয়েটার নাম তিতাস। তিতাসকে এনে ঘরে তুলেছে। বাবা-মা, কাকারা তাতে বেঁকে বসেছে। ছেলের ওপর দিয়েছে চাপ। ছেলে নিজে আলাদা করে কিছু করে না। ফ্যামিলি বিজনেস দেখে। বউকে নিয়ে যে আলাদা হয়ে যাবে তার উপায় নেই। বাবা-কাকার চাপে গেছে ঘাবড়ে।

তিতাসকে রেখে এসেছে বাপের বাড়ি। এর মধ্যে বাড়ির লোকেরা আচ্ছা করে তার মাথা মুড়িয়েছে। ভয়, লোভ সব দেখিয়েছে। তিনমাস হয়ে গেছে এখন আর মেয়েকে ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এমনকী মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগও করে না।’

বদ্যিনাথবাবু হালকা গলায় বললেন, ‘এরকম তো আকছার হচ্ছে। পুলিশের কাছে গেলেই তো পারে।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘যায়নি ভেবেছ? গেছে বইকি। ছেলের বাড়ি থেকে গোপনে টাকা দিয়ে চেপে রেখেছে। মেয়ে জোর করে বিয়ে করেছে বলে কমপ্লেন হয়েছে। ছি-ছি। বলছে ডিভোর্স চাই। শেফালিদি খবর পেয়েই বললেন, আমরা কেসটা ছাড়ব না। ছেলের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখাব, থানায় ডেপুটেশন দেব। তিতাসকে আইনি লড়াইয়ের জন্য সাহায্য করব। সমিতির সবাই ওর সঙ্গে একমত। ছেলের বাপ-মাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে।’

বদ্যিনাথবাবু ডায়েরির পাতা থেকে চোখ তুলে বললেন, ‘সে তোমরা যা-ই করো, ছেলের বাবা-মা কিন্তু অন্যায় কিছু করছে না।’

শর্মিষ্ঠা আহত গলায় বললেন, ‘মানে! ছেলের বিয়ে করা বউকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না সেটা অন্যায় নয়! কী বলছ তুমি!’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘কেন অন্যায়? ছেলে আর ওই মেয়েটি যদি কৌশল করে বিয়ে করে ফেলতে পারে, ছেলের বাবা-মা’ও গোপনে কৌশল করে তাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ছেলের কৌশল করবার অধিকার থাকলে, তার বাবা-মায়েরও আছে। তাছাড়া তারা তো আর মেয়েটিকে মারধোর করে তাড়ায়নি। মেয়েটির স্বামীই তাকে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছে।’

শর্মিষ্ঠা চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী বলছ তুমি! বধূ নির্যাতনকে সমর্থন করছ?’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘না! বাবা-মা নির্যাতনের বিরোধিতা করছি।’

শর্মিষ্ঠা অবাক হয়ে বললেন, ‘বাবা-মা নির্যাতন হল কোথায়! ছেলে তার পছন্দমতো একজনকে বিয়ে করেছে এটা বাবা-মাকে নির্যাতন করা? এসব মান্ধাতা আমলের ধারণা কবে থেকে তোমার মাথায় এল? বাড়ির লোক যেমন বলবে ছেলেমেয়েকে তেমন বিয়ে করতে হবে নাকি? তুমি নিজে করেছিলে? তুমি তো আমাকে…থাক ওকথা। যত বয়স বাড়ছে তত দেখছি প্রাচীনপন্থী হয়ে যাচ্ছ। আসলে সিরিয়ালের হাবিজাবি গল্প মাথার মধ্যে সারাক্ষণ গিজ গিজ করে তো মাথাটাই গেছে। কে জানে হয়তো এই ঘটনাটা নিয়েও একটা গল্প ফেঁদে বসবে।’

বদ্যিনাথবাবু হেসে ফেললেন। বললেন, ‘না শর্মিষ্ঠা। নতুন কাজে এখন আর হাত দিতে পারব না। হাসির গল্পে কান্না আনতে গিয়ে আমার পাগল পাগল অবস্থা হয়েছে। তবে সমিতি করে তুমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছ। বিয়ের ব্যাপারে ছেলেমেয়ে যা খুশি করবে তাতেই হাততালি দিতে হবে, নইলে গায়ে প্রাচীনপন্থী স্ট্যাম্প পড়বে এটা মানতে পারছি না। পরে ঝামেলা কিছু হলে তখন তো বাড়ির সবার ওপরই এফেক্ট পড়ে। এই যেমন ছেলেটার জন্য হয়েছে। থানা, পুলিশ, মামলা সব হচ্ছে। বাড়ির সামনে গিয়ে তোমরা নাচানাচি পর্যন্ত করে এলে। বাড়ির সকলেই তো ঝামেলায় পড়ল। এর জন্য দায়ী কে?’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘দায়ী ওর বাবা-মা। তারা যদি তিতাসকে তাড়িয়ে না দিত আমরা ওখানে যেতাম? না থানা পুলিশ হত?’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘আর ছেলেটা যদি বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়েটা করত তাহলে কী সমস্যা হত? হয়তো বাড়িতে রাজিও হয়ে যেত। এই ভাবে দুম করে বাড়িতে নিয়ে আসার ড্রামা করে লাভ কী হল? লাভ হল শুধু তোমাদের।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘মোটেই না। শেফালিদি ঠিকই করেছেন। আমি ভেবেছিলাম সমিতির এতটা বাড়াবাড়ি ঠিক নয়। একেবারে রাস্তায় নেমে…এখন বুঝতে পারছি ঠিক হয়েছে। মেয়েদের পাশে মেয়েরা না দাঁড়ালে কে দাঁড়াবে?’

বদ্যিনাথবাবু ডায়েরি বন্ধ করে হাই তুললেন। ঘুমের ওষুধ কাজ শুরু করেছে। বললেন, ‘খুব ভালো। তোমাদের শুভেচ্ছা। কিন্তু এবার আমি ঘুমাব।’

শর্মিষ্ঠা নরম গলায় বললেন, ‘অ্যাই একটা কাজের কথা আছে।’

‘কী?’

শর্মিষ্ঠা নরম গলায় বললেন, ‘অর্চির বিয়ের কথা!’

বদ্যিনাথবাবু আবার হাই তুললেন। বললেন, ‘কাল সকালে শুনব। ঘুম পাচ্ছে। সারাদিন বড্ড চাপ গেছে। ক’দিন এরকমই চলবে।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘ঠিক আছে ঘুমোও। কিন্তু তোমার ওই হাসি মুখের সামনে বসে কাজের কথা বলতে অসহ্য লাগে।’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘হাসি ট্রিটমেন্ট আপাতত মুলতুবি আছে। গম্ভীর হয়েই ছেলের বিয়ের কথা শুনব। তুমি এখন শোবে না?’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘না, অর্চি এখনও ফেরেনি। কোন্নগর না কাঁচড়াপাড়ায় কার বিয়েতে গেছে। খানিক আগে ফোন করে বলল, রাত হবে। আমি জেগে থাকি।’

বদ্যিনাথবাবু পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন, ‘ধনঞ্জয়কে বলে রেখেছ? ঘুমিয়ে না পড়ে। দরজা খুলতে হবে তো!’

শর্মিষ্ঠা উত্তর দিলেন না। আপন মনে হাসলেন ছেলে বড় হয়ে গেছে, নিজে গাড়ি চালিয়ে গেছে, তাও তাকে নিয়ে চিন্তা।

বাড়ি থমথম করছে। কাল রাতে এবাড়িতে যে ঘটনা ঘটেছে তাতে বাড়ি থমথমে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

সিকিউরিটি, মালি, ড্রাইভার সবার মুখ শুকনো। তারা ঘটনার খবর পেয়েছে, কিন্তু পুরোটা পায়নি। আধা খেঁচড়া শুনেছে। সেই আধখেঁচড়ার মধ্যেও জল মেশানো আছে। জল মিশিয়েছে ধনঞ্জয় এবং বুটি। বাড়ির ভিতরের খবর একমাত্র তারাই জানে। যেটুকু যা খবর বাইরে আসছে তাদের মাধ্যমেই আসছে। অবশ্য তারাও যে সবটা ভালো মতো জানে এমন নয়। ধনঞ্জয় একরকম জানে, বুটি জানে আর-এক রকম। ধনঞ্জয় নিত্যকে যা বলেছে, বুটি ড্রাইভার রামনিধিকে সেকথা বলেনি। ফলে নিত্য এবং রামনিধি যখন আলোচনা করছে খবরের মধ্যে বড় রকমের ফারাক থেকে যাচ্ছে। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে চাপা গলায় ঝগড়াও হয়ে গেছে।

‘তুমি বেশি জানো?’

‘জানি বইকি। বুটি বলেছে।’

‘দূর, ওইটুকু মেয়ে কী জানবে? আমাকে বলেছে ধনঞ্জয়।’

‘ধনঞ্জয় জানবে কী করে? সে তো তিনতলাতেই উঠতে পারে না। তার যত ওস্তাদি একতলায়, আমাদের সঙ্গে।’

‘তিনতলায় উঠতে পারে না তো কী হয়েছে? কাল রাতে দাদাবাবুকে দরজা খুলে দিয়েছে কে? ধনঞ্জয় খুলেছে। খুলেই দেখে গাড়ি থেকে নামছে…।’

বদ্যিনাথ আজ বেরোবেন কি না ঠিক নেই। রামনিধি খুশি। বাড়িতে থাকলে আরও ‘কেচ্ছা’ জানা যাবে।

বুটি রোজকার মতো সাজগোজ করেছে। কিন্তু মাঝেমধ্যেই ফ্রকের কোণ দিয়ে চোখ মুছছে এবং নাক টানছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাঁদছে। আসলে কাঁদছে না, যদি কাঁদতে হয় এই ভেবে প্রস্ততি নিচ্ছে। ঘটনা কোনদিকে গড়াচ্ছে খুব একটা আঁচ করতে পারছে না। তবে ভালো দিকে যে গড়াবে না সেটা বুঝতে পারছে। রতনের মা এল আটটা নাগাদ। বাড়িতে ঢোকার মুখে দারোয়ানের কাছে খবর পেয়ে তার চোখ কপালে। এ-মা! ভদ্রলোকের ঘরে এ কী কাণ্ড! লেখাপড়া জানা ছেলে।

দোতলার সিঁড়ির একপাশে বুটিকে ডেকে চাপা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ রে, যা খবর পেলাম তা সত্যি?’

বুটি ছলছল চোখে ঘাড় কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যি?’

‘তুই দেখেছিস?’

বুটি দেখেনি। তবু বলল, ‘দেখেছি। কাল রাতেই দেখেছি।’

‘কেমন দেখতে রে?’ ঠোঁটের কোনায় হেসে রতনের মা জিগ্যেস করল।

বুটি বলল, ‘খুব সুন্দর। অনেকটা মনীষার মতো। বড় বড় চোখ। এক ঢাল চুল।’

রতনের মা ভুরু কোঁচকাল। এই মেয়ের কথা সে বিশ্বাস করে না। বড্ড মিথ্যে বলে। তবে শুনতে ভালো লাগছে। বলল, ‘মনীষা কে?’

বুটি উজ্জ্বল মুখে বলল, ‘মামাবাবুর সিরিয়ালের নায়িকা। আমার মনে হচ্ছে এই মেয়ে মনীষাই হবে।’

আঁশটে হেসে রতনের মা বলল, ‘সে তো বিরাট কেলেঙ্কারি রে! বাবার নায়িকা ছেলের ঘরে! তা সেই নায়িকা এখন কোথায়? দাদাবাবুর ঘরে নাকি?’

বুটি লজ্জা পাওয়া মুখে বলল, ‘দূর, কী বলো না মাসি। বিয়ে হয়েছে নাকি যে এক ঘরে থাকবে? দাদাবাবু নিজের ঘরে। আর উনি ঘুমোচ্ছেন দোতলার গেস্টরুমে। মামি কাল রাতে নিজে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।’

‘আর কর্তা-গিন্নি? তারা কোথায় এখন?’

বুটি কথা বলল না। আঙুল দিয়ে ওপরে দেখাল। সে এখন তিনতলায় যাবে না। দোতলায় ঘুরঘুর করবে, ‘নায়িকা’-কে না দেখা পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগছে। এখন পর্যন্ত যেটুকু জেনেছে সেটাও তার জানবার কথা নয়। প্রথমে খবর ফাঁস করেছে ধনঞ্জয়দা। দাদাবাবু এলে সে-ই রাতে দরজা খুলেছে। তারপর বলেছে, মামিমা। ভোরবেলা থমথমে মুখে বলেছে, গেস্টরুমে দাদাবাবুর এক বন্ধু আছে। অনেক রাতে এসেছে। ঘুম ভাঙলে ওঁকে চা করে দিবি।’ সে এখন দোতলা থেকে কোথাও নড়বে না।

খাটের ওপর চুপ করে বসে আছেন শর্মিষ্ঠা। বদ্যিনাথ সান্যাল পায়চারি করছেন। তার তিনটে মোবাইলই বন্ধ। সকাল থেকে কোনও ফোন ধরেননি। শুধু প্রবীরকে ফোন করে বলে দিয়েছেন, ‘আজ কোথাও যাব না। তোমরা নিজেরা যা পারো করে নাও। আমাকে টেলিফোন করে বিরক্ত করবে না।’ প্রবীর তার মধ্যেই জানায়, ‘কেন এমন হল’ সিরিয়ালের থার্ড নায়িকা আজ ভোরে ফোন করে জানিয়েছে, সে আর কাজ করবে না। তাকে নাকি ঠিকমতো কাজে লাগানো হচ্ছে না।

বদ্যিনাথ ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘কার অ্যাক্সিডেন্টে মেরে দাও। থার্ড নায়িকা মারা গেলে গল্পের কোনও ক্ষতি হবে না।’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘শর্মিষ্ঠা, কালই আমাকে বললে না কেন?’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘তুমি ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছ তাই ডাকিনি।’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘তুমি জিগ্যেস করেছ মেয়েটি কে?’

‘করেছিলাম। অর্চি ভাসা ভাসা উত্তর দিল। কী সব ট্রেনের গোলমাল বলছিল। মেয়েটা বাড়ি ফিরতে পারেনি।…অর্চি বলল, মা কাল সকালে সব জানাব। আজ খুব টায়ার্ড, এখন ঘুমাব।’

বদ্যিনাথবাবু মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘আর মেয়েটি? সে কী বলল?’

শর্মিষ্ঠা ভেঙে পড়া গলায় বলল, ‘সে আবার কী বলবে? তাকে তো আর জিগ্যেস করতে পারি না তুমি কে?’

বদ্যিনাথবাবু দাঁতে দাঁত ঘষে বললেন, ‘কেন পারো না। যে মেয়ে বলা নেই, কওয়া নেই একটা ছেলের বাড়িতে রাত কাটাতে চলে আসে, তাকে সব জিগ্যেস করা যায়। তার লজ্জা না থাকলে আমাদের লজ্জার কী আছে?’

শর্মিষ্ঠা বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আহ, আস্তে বলো। কাজের লোকেরা শুনতে পাবে।’

বদ্যিনাথ চেয়ারে এসে বসলেন। রাগ এবং হতাশা মেশানো গলায় বললেন, ‘শুনতে আর বাকি কী রয়েছে শর্মিষ্ঠা? বাড়িতে একটা জলজ্যান্ত মানুষ এসে রয়েছে, মালি, ড্রাইভার, কাজের লোকেরা জানে না ভেবেছ? ধনঞ্জয় নিজেই তো রাতে দরজা খুলেছে। এতক্ষণে যা ছড়াবার ছড়িয়ে পড়েছে। দ্যাখো, কাল কোনও পত্রিকায় না বেরিয়ে যায়, বিখ্যাত সিরিয়াল পরিচালক বদ্যিনাথ সান্যালের বাড়িতে রাত কাটাল।…ছি-ছি! ইনডাস্ট্রিতে আমার কত সুনাম, সবাই সম্মান করে…।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘ওকথা বলছ কেন? তুমি তো কোনও মেয়েকে বাড়িতে এনে তোলোনি।’

বদ্যিনাথবাবু চাপা ধমক দিয়ে বললেন, ‘চুপ করো। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বোলো না। স্ক্যান্ডাল যুক্তি সাজিয়ে হয় না। আমাদের মতো মানুষের ছেলেমেয়েরা কিছু করলেও সেটা আমাদের ঘাড়ে চাপে। ছেয়েমেয়ে কেন? কাল যদি ধনঞ্জয় বা বুটি কোনও কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে বসে সেটাও মুখরোচক গল্প হয়ে বেরোবে। তোমরা কমন মানুষ, এসব বুঝবে না।’

শর্মিষ্ঠা চিরকালই স্বামীর ওপরে কথা বলেছেন। আজ গুটিয়ে গেছেন। তার কান্না পাচ্ছে। কাল অত রাতে অর্চিষ্মান যখন মেয়েটিকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল তিনি হতভম্ব হয়ে যান। অর্চিষ্মান বেশি কথা বলেনি, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ঝলমলে শাড়ি পড়া মেয়েটিকে দেখিয়ে এক গাল হেসে বলল, ‘মা, এ হল পায়েল, ট্রেনে গোলমাল, বাড়ি ফিরতে পারেনি। তুমি ওর জন্য গেস্টরুমটা অ্যারেঞ্জ করে দাও। বাকিটা কাল জেনো। আমি তোমাকে মোবাইলে ট্রাই করলাম, ঢুকতে পারলাম না। মনে হয় টাওয়ারে প্রবলেম। যাক, খুব টায়ার্ড লাগছে।’ এরপর পায়েল নামের অচেনা মেয়েটি এগিয়ে এসে শর্মিষ্ঠাকে প্রণাম করতে যায়। ‘থাক থাক’ বলে দু-পা সরে গিয়েছিলেন শর্মিষ্ঠা।

শর্মিষ্ঠা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘আমার ওপর রাগারাগি করছ কেন? আমি কী করেছি?’

বদ্যিনাথবাবু লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, ‘না কিছু করোনি। শুধু ছেলেকে মানুষ করতে পারোনি। হুট বলতে একটা মেয়েকে যে বাড়িতে এনে তুলতে নেই সেটা শেখাওনি।’

শর্মিষ্ঠা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে বললেন, ‘সত্যি হয়তো মেয়েটা বিপদে পড়েছিল।’

বদ্যিনাথবাবু মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন, ‘হলে ভালো। খারাপ মেয়েরা বিপদের ভান করে ঘাড়ে চাপে।’

শর্মিষ্ঠা আঁতকে উঠলেন। খারাপ মেয়ে! অসম্ভব। অর্চি খুব ভালো ছেলে। সে কখনও খারাপ মেয়ে…অবশ্য যদি বুঝতে না পারে…বাইরে থেকে দেখে কতটুকুই বা বোঝা যায়? শর্মিষ্ঠা ঢোঁক গিলে বললেন, ‘তুমি বেশি ভাবছ। অর্চি তো বলল, ট্রেনে গোলমাল বলে মেয়েটা বাড়ি ফিরতে পারেনি।’

বদ্যিনাথবাবু আবার চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। ফের পায়চারি শুরু করলেন, ‘ওসব গল্পকথা বাদ দাও। ঘাড়ে পড়বার জন্য এরা সব বানাতে পারে। তুমি কথা বললে না কেন? খানিকটা ধরতে পারতে। সাজপোশাক কেমন? ভদ্রসভ্য?’

শর্মিষ্ঠা মেয়েটির পোশাক মনে করবার চেষ্টা করলেন। পুরোটা মনে পড়ল না। পড়বার কথাও নয়। তিনি এতটাই অবাক হয়ে পড়েছিলেন যে খুঁটিয়ে সাজ দেখার সুযোগ ছিল না। তাছাড়া মেয়েটি ক্লান্ত ছিল। দ্রুত ঘরে ঢুকে যায়। শর্মিষ্ঠা বিড়বিড় করে বললেন, ‘ভালোই তো মনে হল। একটা শাড়ি পড়েছিল। চেহারা দেখে ভদ্রঘরের মেয়েই তো মনে হল।’

বদ্যিনাথবাবু হতাশ গলায় বললেন, ‘আমি কিছু ভাবতে পারছি না।’

শর্মিষ্ঠা উঠে এসে স্বামীর গায়ে হাত রেখে বললেন, ‘এত ছটফট কোরো না, প্রেশার বেড়ে যাবে। ঘটনা হয়তো স্বাভাবিক। আমরা অকারণ ভয় পাচ্ছি। তোমার ছেলে কোনও খারাপ কাজ করবে না।’

বদ্যিনাথবাবু স্ত্রীর হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খারাপ কাজ তোমার ছেলে করবে না, সে হয়তো জানেও না মেয়েটা কেমন। আজ জানতে পারবে। যাই হোক, আমি ডিসিশন চেঞ্জ করেছি শর্মিষ্ঠা। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি। এই অবস্থার মধ্যে বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকতে চাই না। ওই মেয়ে বাড়ি থেকে বিদায় হলে আমাকে জানাবে।’

শর্মিষ্ঠা উঠে পড়ে বললেন, ‘সেটাই ভালো। তুমি চলে যাও। আমাদের নর্ম্যাল থাকা উচিত। নইলে সবাই সন্দেহ করবে। যদি কানাঘুষোয় আমার সমিতির কারও কাছে খবর চলে যায় খুব খারাপ হবে। ওখানে আবার পরনিন্দা পরচর্চা খুব। আমি রান্নঘরে যাচ্ছি।’

বদ্যিনাথবাবু বাথরুমে ঢোকার পরই অনুষ্কা ফোন করল। ভোরেই সে মায়ের টেলিফোন পেয়েছে। দু-চার লাইনে ঘটনা শুনেছে। তারপর থেকেই ছটফটানি শুরু হয়েছে তার। আবার সাবধানেও থাকতে হচ্ছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন যদি কিছু আঁচ করে তাহলে সর্বনাশ। পুত্রবধূর অবিবাহিত দাদা গভীর রাতে একটা বাইরের মেয়ের হাত ধরে বাড়িতে ঢুকেছে শুনলে হার্টফেল করবেন। অনুষ্কার খুব ইচ্ছে করছে ছুটে মায়ের কাছে চলে যেতে। ওই মেয়েকে নিজের চোখে দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত অশান্তি লাগছে। অনুষ্কা ফোনে মুখ চেপে বলল, ‘মা, ও উঠেছে?’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘কে?’

‘ওই মেয়ে।’

শর্মিষ্ঠা রাগি গলায় বললেন, ‘আমি কী করে বলব? আমি কি ওর পাশে শুয়ে আছি?’

অনুষ্কা মায়ের রাগ পাত্তা দিল না। বলল, ‘মা, আমি একটু পরেই যাচ্ছি।’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘কেন? তুই কেন আসবি?’

‘বা:, বাড়িতে এমন একটা ঘটনা ঘটল আর আমি যাব না? আমি কি ওবাড়ির মেয়ে নই?’

শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘অনু, একদম আসবি না। দারোয়ান ড্রাইভার, মালি, রান্নার মাসি, বুটি এমনিতেই ভাবছে বিরাট কোনও কাণ্ড হয়েছে। তুই এলে আরও ভাববে।’

অনুষ্কা এই কথারও গুরুত্ব দিল না। ফিসফিস করে বলল, ‘মা, কেমন দেখতে?’

শর্মিষ্ঠা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, ‘জানি না। তুই ফোন ছাড়।’

‘আমার কী মনে হল জানো মা? আমার মনে হয়, দাদা বিয়ে করে বসেছে। বিয়ে করে সটান বউ নিয়ে চলে এসেছে। তাই কাল তোমাদের বলতে সাহস পায়নি। আমি গেলে আমায় বলবে। আমার খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে মা। খুব এক্সাইটেড ফিল করছি। পুরো সিনেমার মতো। ফোন ছাড়ছি মা। একটু পরেই ওখানে পৌঁছে যাচ্ছি। লোকে যা খুশি ভাবুক।’ ফোন কেটে দিল অনুষ্কা।

বিয়ে! শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল শর্মিষ্ঠার। অর্চি তাকে না জানিয়ে এ কাজ করবে! কিছু না বলে সরাসরি বউ বাড়িতে এনে তুলবে! না, না, এ কাজ ও করতে পারে না। কখনোই পারে না। অর্চি জানে তার বাবা-মা তাকে কত ভালোবাসে। ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করল শর্মিষ্ঠার! ছেলের পছন্দ-অপছন্দের ওপর তারা কোনওদিন হস্তক্ষেপ করেনি। তার শিক্ষা, রুচিতে বিশ্বাস, ভরসা করেছে। এই তার রির্টান! যদি কোনও মেয়েকে তার পছন্দ হয় তারা বাধা দিত? বারণ করত? ছি-ছি। রান্নাঘরে যেতে যেতে শর্মিষ্ঠা মনকে শক্ত করলেন। তার এবার রাগ হচ্ছে। সত্যি যদি এমন ঘটে তাহলে অর্চির কপালে দু:খ আছে। ওই মেয়েকে তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। মেয়েকে নিয়ে ছেলেকে বাইরে চলে যেতে হবে। যে ছেলে বাবা-মাকে বিশ্বাস করেনি তার কোনও কাজে সমর্থন নয়। শর্মিষ্ঠা কোনওরকমে কান্না সামলালেন। একটু পরে বুটি হাঁফাতে হাঁফাতে রান্নাঘরে এসে হাজির হল। বলল, ‘মামিমা, উনি উঠেছেন…উনি উঠেছেন…উনি…।’

‘নারীকে জাগতে হবে সমিতির সদস্যা শর্মিষ্ঠা অতীতে যে কাজ কখনও করেনি, আজ তাই করলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে বুটির গালে একটা চড় মারলেন। হুংকার দিয়ে বললেন, ‘উনি উঠেছেন তো কী হয়েছে? দু-হাত তুলে নাচব?’

আধঘণ্টা পরের ঘটনা।

পায়েল শর্মিষ্ঠার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সুন্দর করে হাসল। বলল, ‘মাসিমা, আজ তাহলে চলি? হুট করে এসে আপনাদের খুব জ্বালিয়ে গেলাম।’

শর্মিষ্ঠা পায়েলের চিবুকে হাত দিয়ে হেসে বললেন, ‘দূর, ঝামেলা আবার কী?’

পায়েল বলল, ‘আসলে কাল রাতে নেমন্তন্ন বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্টেশনে গিয়ে শুনি ট্রেনে খুব গোলমাল। নার্ভাস হয়ে বাবাকে ফোন করলাম। গাড়ি নিয়ে যাইনি বলে বাবা একচোট খুব রাগারাগি করলেন। তারপর বললেন, ‘ওখানে পরিচিত কেউ আছে?’ আমি বললাম, ‘নেমন্তন্ন বাড়িতে বহুদিন পর দাদার বন্ধু অর্চিদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। জানি না এতক্ষণে বেরিয়ে গেছে কি না। তবে অর্চিদার মোবাইল নম্বর নিয়েছি।’ বাবা বললেন, ‘অর্চির সঙ্গে দেখা হল? তাহলে তো কোনও চিন্তাই নেই। তুই এখনই ওকে ফোনে ধর, সেরকম বুঝলে ওর সঙ্গে ওর বাড়িতে চলে যা। কাল ফিরবি।’

আমি অর্চিদাকে ফোনে ধরলাম। অর্চিদা বলল, ‘উফ, কী যে জ্বালাতন করিস। চুপ করে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাক। আমি দশ মিনিটে গাড়ি ঘুরিয়ে আসছি।’

বদ্যিনাথবাবু মাথা নামিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আরে, তুমি রাজুর বোন! রাজু এখন কোথায়?’

‘ফিলাডেলফিয়ায় মেসোমশাই। চাকরি করছে। অর্চিদা বলল ফেসবুকে কথা হয় রেগুলার।’

বদ্যিনাথবাবু বললেন, ‘গুড। দেখা হলে ভালো লাগত। কত ছোট দেখেছি ওকে। অর্চির সঙ্গে খেলতে আসত।’

পায়েল সলজ্জ হেসে বলল, ‘দাদার সঙ্গে অবশ্যই দেখা হবে আপনার। জানুয়ারিতে আসছে। আমার বিয়ের সময়। আপনাদের কিন্তু সবাইকে যেতে হবে। নইলে খুব দু:খ পাব।’

বদ্যিনাথবাবু মুখ তুলে হেসে বললেন, ‘অবশ্যই যাব। ভাগ্যিস কাল ট্রেনে গোলমাল হল আর অর্চিকে ধরে তুমি এখানে চলে এলে। নইলে বিয়ের খাওয়াটা বাদ হয়ে যেত।’

পায়েল বেরিয়ে যাওয়ার পর শর্মিষ্ঠা আর বদ্যিনাথবাবু দুজনে চুপ করে বসে রইলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *