ভাগ্যবানের
কৌতুকের ছলে আমাদের ভাষায় একটি কথা প্রায়শ বলা হয়, কী ভাবে ফিরবে? ভাগ্যবান আবার একটি বিয়ে করবেন। সেকালের মানুষের দায়িত্বজ্ঞান খুব কম ছিল। কিন্তু বেপরোয়া। দশ-বারোটা বিয়েতেও পিছপা ছিল না। লাগিয়ে দাও, দেখা যাবে তারপরে।
আমার মত, প্রথম বিয়েই বিয়ে। তার যে উত্তেজনা, উন্মাদনা, রহস্য, রোমান্স, সে আর কোথায় পাওয়া যাবে? ইংরেজিতে বলে, ম্যারেজ ইজ হেভন বর্ণ। বিয়েটা স্বর্গেই হয়ে থাকে। ক্যাথলিক বিশ্বাস। আমাদের প্রাচীন বিশ্বাসও সেই রকম—জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ তিনটেই বলা যায় না। যার সঙ্গে যার বিয়ে হবে, ঈশ্বর ঠিক করেই রাখেন।
সে কথা থাক। একালের বিশ্বাস অন্যরকম। ধর্ম হল কুসংস্কার। প্রাচীন পদ্ধতির বিয়েই লোপাট হয়ে যেতে বসেছে। একালের কথা হল, একসঙ্গে কিছুকাল বসবাস করলেই হল। প্রাচীন পদ্ধতির বিবাহ এক এলাহি ব্যাপার। যজ্ঞীয় প্রথায় দুটো প্রাণকে গেঁথে দেওয়া। রজনীগন্ধার নৈশগন্ধ। চুরচুর আলোর মালা। সামান্য সানাইয়ের শব্দ। জীবনের প্রথম একান্ত সাথীকে নিভৃতে কাছে পাওয়া। তুলনাটা আকাট শোনালেও অনেকটা এইরকম—নিজের গাড়ি নিজে চালাবার লাইন্সেসের মতো।
তারপর দুজনেই দুজনের স্বভাব চিনব। অপরিচয়ের ব্যবধান অদৃশ্য হবে। আড়ষ্টতা ছেড়ে যাবে। মনরাখা কথা বলার প্রয়োজন ফুরোবে। হয়ে উঠব প্রেমিক ও সমলোচক। পরস্পরকে মেনে নেওয়ার অভ্যাস তৈরি হবে। নির্ভরতা আসবে। কাঁচা সম্পর্ক পাকা হবে। রোলানের আঠায় দুটো জীবন জড়িয়ে যাবে বজ্রের মতো। একজন আর একজনকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। সুখ-দু:খের দোলায় দুলবে দাম্পত্য তরণী। সেই অনেক কালের হিন্দি গান—দো হংসকা জোড়া।
স্ত্রী যদি সহসা চলে যান জীবনের পারে তখন অক্ষয়কুমার বড়ালের কবিতা :
কত যুগ-যুগ পরে—
এখনও কি মনে পড়ে
তোমার সে হাতেগড়া সোনার সংসার!
কবিত্ব-কল্পনা-ভরা
জীবন-মরণ-হরা
ত্রিভুবন-আলো-করা প্রীতি দুজনার!
কিন্তু এর মধ্যে একটা সাইকোলজিক্যাল পয়েন্ট আছে—পলিগ্যামি ইজ এ টেনডেনসি ইন ম্যান। জীবনের স্বাদ পালটাবার জন্যে আমরা অ্যাডভেঞ্চারাস হতে চাই। একজনকে তো সংসারের বালতিতে জিওল মাছ করেছি, আর একজনকে দেখি না। ব্যাপারটা পৌরুষের। একে বলে, ‘ডন জুয়ানিজম’। বিয়ে নয়, নিত্য নতুন মহিলার সঙ্গে মেলামেশা। মহিলাদেরও এই ভাব থাকতে পারে ‘নিমফোম্যানিয়া।’ বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘সবুরে মেওয়া ফলে।’ সেই সবুরের অভাবে সুখের মেওয়া ফলার আগেই আজকাল দাম্পত্য সৌধে চিড় ধরছে। ছুটছেন আদালতে। জোড় খোলার জন্যে সুখ আর শান্তির প্রয়াসের মধ্যে নাক গলাচ্ছে কুৎসিত আইন। আমার মনে হয়েছে, বারে বারে জুটি পালটালেও প্রথম কদমফুলের স্মৃতি সহজে মুছে ফেলা যায় না। একজনের দু:খের কারণ হয়ে সুখের অনুসন্ধান ব্যর্থ হয়। ম্যারেজ ইজ এন অ্যাডজাস্টমেন্ট। প্রথম পরীক্ষায় ফেল করলে দ্বিতীয় পরীক্ষায় সেই ব্যর্থতা ছায়া ফেলে। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর সেন্টিমেন্টাল।
তবে যদি এই রকম হয়, যেমন হত দূর অতীতে—বড়-বউ, মেজো বউ, ছোট বউ। একই মানুষের তিন বউ সুখে বসবাস করে। বড় বউয়ের আঁচলে সংসারের চাবির থোলো। মেজো খড়খড়ে ম্যানেজার, বেশ ঝাঁঝালো। ছোট আদুরি গোলাপি। কর্তার রোজগার আর তাকত তিনজনকেই টানতে পারে। তাহলে একবার চেষ্টা করে দেখা যেত।
ছেলেবেলার, যৌবনের সেই তলতলে রোমান্টিক মন ফিরিয়ে আনতুম। রুপোলি পর্দা থেকে নামিয়ে আনতুম সোফিয়া লোরেনকে। সেই ইতালির সুন্দরীকে। অলিভের মতো গায়ের রং। কখনও সফিস্টিকেটেড সুন্দরী, কখনও কোর্স গ্রাম্য মহিলা। তাঁকে বলতুম, সোফিয়া ডারলিং, তোমারও বয়েস হয়েছে, আমিও নেহাত ছোকরা নই। চলো, সব ছেড়ে ছুড়ে চলে যাই দূরে—বহু দূরে। ভারতীয় জীবনচর্যায় একটাই সুর—
‘ভেবে দেখো, শেষের সেদিন কী ভয়ঙ্কর।’
আমাদের সব ভাবনায় শেষের ভাবনা। ইওরোপের জীবনচর্যা দেখলে, এইবার ভারত দ্যাখো। দুজনেই আমরা ‘সেকসলেস জম্বি’। এই দ্যাখো কলকাতা। গাছপালাঘেরা ছোট বাড়ি, তোমার বিশাল ম্যানসান নয়। এস, সাইকেল রিকশায় উঠি। তোমার মার্সিডিস, কী রোলস, কী পিজো, কী সির্টো, কী ফিয়াট নয়। শাড়ির আঁচলটা সাবধান, চাকায় জড়িয়ে যেতে পারে। আমাকে ধরে থাকো। এদেশের ছেলেকে ছেলেবেলাতেই পড়ানো হয়—পথে বড় রিপুভয়। সেই রিপু হল গর্ত। একে বলে—বসে-বসে নেচে-নেচে যাই। জীবন-দোলায় শুধু দুলব। যত ব্যথা দুজনেই ভুলব। বাতের ব্যথা, একস-সুন্দরী।
এত অন্ধকারে কেন? একে বলে লোডশেডিং। আমাদের জীবনসাথী। আমারে এই আঁধারে চালায় কে গো। ভাগ্য-জননী! নাও, সাবধানে নামো। রিকশায় খোঁচা পেরেক থাকে। সাবধানে হাতড়ে-হাতড়ে সিঁড়ি ভাঙো। জল থাকতে পারে, রাস্তার কালো কুকুরটা থাকতে পারে, কয়েক জোড়া চটি থাকতে পারে, কেরোসিনের খালি বোতল থাকতে পারে। সিঁড়ি হল যাবতীয় অ্যানিমেট ইনঅ্যানিমেট অবজেক্টের গ্যালারি।
এই আমার ষোলো-বারো ঘর। এই সেই খাট সংসারের রঙ্গভূমি। সোফিয়া ডার্লিং বসো। একটা বাতি জ্বালি—কি রোমান্টিক, তাই না।
—কামড়াচ্ছে?
—ও হল মশার লাভ বাইট।
—ওগো দ্যাখো, কাকে এনেছি? সোফিয়া, মাই ড্রিম।
—ওমা! দিদি, তুমি? এই মালের খপ্পড়ে পড়লে কী করে!