ভাগ্যবানের বোঝা ভগবান বয়
আশি বছর? তার বেশিই হবে।
অ্যালি মোরানের বয়সের কথা বলছি। বিরাশি, চুরাশি বা অষ্টাশি অনায়াসে হতে পারে। তবে গাঁয়ের কারও গরজ পড়ে যায়নি অ্যালি বুড়ির বয়স নিয়ে মাথা ঘামানোর। কে ভাবছে ওর কথা? ওর পয়সা নেই যে কেউ ঘনিয়ে আসবে খাতির জমাবার জন্য। ও আছে নিজের মনে নিজের কুঁড়েতে পড়ে, হাড্ডিসার একটা কুত্তা আর তেঠ্যাঙ্গা একটা বেড়াল নিয়ে। বেশ আছে, খাসা আছে, ধার ধারে না কারও।
কুকুরটা আর বেড়ালটা— এরা ছাড়াও তৃতীয় একটি পুষ্যি আছে অবশ্য অ্যালির। না, এটি হাড্ডিসারও নয়, ঠ্যাংও যা হিসেবমতো তার হিস্যায় পড়ে, তার চেয়ে কম নেই গুনতিতে। সে হচ্ছে তার নাতি পিটার— বছর একুশের পুরুষ্টু ছোকরা, দিলদরিয়া আমুদে হুজুগে খোশখেয়ালি আড্ডাবাজ ইয়ার, নাচতে গাইতে কুস্তি লড়তে জুড়ি যার খুব বেশি নেই এ-তল্লাটে।
ঠাকুরমা অ্যালি তো পিটার বলতে অজ্ঞান। ‘আহা-হা, বেঁচে থাক বাছা আমার, অমন ছেলে তিন-ভুবনে আর হয় না বাবা! ও একটা মানুষের মতো মানুষ হবে, তা তোমরা দেখে নিও!’
‘কী করে হবে মিসেস মোরান?’— কোনো মুখফোড় হয়তো বলেই বসে মুখের উপর, ‘কী করে হবে শুনি? মানুষ হতে হলে চাই মেহনত। নেচে-কুঁদে বেড়াক, সে কিছু খারাপ নয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কাজের কাজ কিছু তো করা দরকার! রোজগার করতে না-পারলে সে আবার পুরুষ মানুষ কীসের? বলতে পারো, একটা ফুটো পয়সা তোমার হাতে ও এনে দিয়েছে কোনোদিন?’
অ্যালি মোরান তখন তেড়ে আসে তাকে, ‘ফুটো পয়সা? ফুটো পয়সার ভিখিরি পিটারের ঠাকুরমাও নয়, পিটার নিজেও নয়। কাজ? কী কাজ আবার করবে ও? কাজ করবার জন্যই কি সব লোক জন্মায়? পিটার কি পাথর কাটবে গাঁইতি মেরে? ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঠ চিরবে করাত কলে? সে তোরা কর গিয়ে যা। পিটার ওসব করবেনি। করবেনি!’
‘তবে খাবে কী?’— প্রতিপক্ষ যদি নাছোড়বান্দা হয়, তো তর্ক তোলে, ‘তুমি কি আজন্মকাল বেঁচে থেকে ওর খোরাক জোগাবে ভেবেছ? তুমি কবরে গেলে যে ওর দশা ওই তেঠ্যাঙ্গা বেড়ালটার চেয়েও খারাপ হবে, তা বুঝতে পারছ না? কে ওকে খাওয়াবে শুনি?’
‘খাওয়াবে ওর বউ।’— হুংকার করে ওঠে ছিয়াশি বছরের বুড়ি, ‘ভাবছ ওর ভাগ্যে বউ নেই? তোমরা হিংসেয় ফেটে যাচ্ছ, তোমরা তো ভাববেই তা। কিন্তু আমি এই বলে রাখছি, জমিদারের মেয়ে আমার এই কুঁড়েতে আসবে পিটারের বউ হয়ে। গোরুর গাড়ি বোঝাই করে নিয়ে আসবে সোনাদানা। ও যখন মায়ের পেটে, তখনই আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে আমার নাতবউ আসবে রাজা-বাদশার ঘর থেকে। আমার নাতির খাবার ভাবনা?’
এর পরে প্রতিপক্ষকে রণে ভঙ্গ দিতেই হয়।
জ্ঞান হয়ে অবধি পিটার শুনে আসছে ঠাকুরমার এই ভবিষ্যদবাণী। বউ আসবে পয়সাওয়ালি, পিটারকে সংসারের ঝামেলা পোয়াতে হবে না কোনোদিন।
শুনে আসছে, কিন্তু খুশি হতে পারেনি শুনে। সংসারের ঝামেলা থেকে রেহাই দেবে বউ। কিন্তু বউয়ের ঝামেলা থেকে কে বাঁচাবে পিটারকে? সে অন্ধ নয়, যেদিকে চোখ ফেরাচ্ছে, ঘরে ঘরে দেখতে পাচ্ছে, এক-একটা বউ নিয়ে কী-পরিমাণ ঝামেলায় রয়েছে তার পড়শিরা।
ওই জনসন রয়েছে, রাতে ফিরতে যদি দশটা বাজল কোনোদিন, বউ দরজাই খুলবে না বাড়ির। রয়েছে ওই স্টোনওয়াল, হপ্তার শেষে পুরো মাইনেটি এনে বউয়ের হাতে গুনে দেয়, তারপর একটা পয়সার দরকার হলে তিনদিন তেল দেয় বউয়ের পায়ে। না, না, বাবা, ও-ঝামেলা থেকে পিটারকে রক্ষা করুন সেন্ট পিটার। বিয়ের ফাঁদে পা সে দিচ্ছে না। ওর চেয়ে করাতকলে গিয়ে ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে কাঠচেরাই ঢের ভালো।
কিন্তু সমস্যার সমাধান তো একটা চাই। যে-সমাধান ঠাকুরমা করে রেখেছিলেন, সেটা যদি বাতিল করেই দিতে হয়, তার চেয়ে ভালো একটা সমাধান তো তার নিজের তরফ থেকে করে রাখা দরকার! মানে, ওই দানাপানি সমস্যার সমাধান! ঠাকুরমার অবর্তমানে জঠরানলের জ্বালা নিবারণ কী করে হবে, তারই একটা উপায় উদ্ভাবন!
ভাগ্যবান পিটার! ভাবতে ভাবতে উপায় একটা সত্যিই পেয়ে গেল সে। রাজকন্যেকে ঘরে আনার চাইতে অনেক সোজা ব্যাপার। ঝামেলা নেই, ঝক্কি নেই, জবাবদিহি নেই কাকপক্ষীর কাছে। এই সোজা উপায়টা মাথায় আনতে এত দেরি হল কেন, এইটেই অবাক লাগছে তার।
উপায়টা জলবৎতরলং। স্রেফ কিছু গুপ্তধন আবিষ্কার করে ফেলা। বেশি হয় যদি, তাতে আপত্তি নেই অবশ্য, তবে যৎসামান্য মিলিয়ন খানিক পেয়ে গেলেই খুশি হবে পিটার, মানুষ ও লোভী নয়।
কর্তব্য যখন স্থির, এখন অপেক্ষা শুধু সুযোগের। উদ্যোগের কোনো প্রশ্ন নেই, যোগাযোগ যে-মুহূর্তে হবে, কাজে নেমে পড়তে হবে তখনই। কখন যে হবে সে-যোগাযোগ, তা জানে শুধু ভাগ্য। পিটারের তরফ থেকে করবার কিছু নেই। একমাত্র ধৈর্য ধরে বসে থাকা ছাড়া।
তা ধৈর্যধারণের অসুবিধা হয়নি কিছু এখনও। হবে না অসুবিধা, যতদিন বুড়ি ঠাকুরমা বেঁচে আছে। কোথা থেকে সে কী করে, কেউ জানে না, কিন্তু নিজের, পিটারের, তেঠ্যাঙ্গা বেড়ালের ও হাড্ডিসার কুকুরের তিনবেলা খোরাক সে এখনও সামনে যুগিয়ে যাচ্ছে।
ধৈর্য ধরে বসে আছে পিটার। প্রাতরাশ সেরে শহরটা ঘোরে একবার। লাঞ্চের আগে বাড়ি আসে এবং ডিনারের পরে আবার বেরোয়। এবার টহল দেয় শহর থেকে দূরে। আশেপাশে যত গ্রামে যত আড্ডাখানা আছে, পালা করে এক-এক সন্ধ্যায় এক একটাতে দর্শন দেয় সে। সমধর্মী অর্থাৎ বেকার ছোকরাদের সঙ্গে হইহুল্লোড় চলে সেখানে গভীর রাত অবধি। বাড়ি ফিরতে এক একদিন রাত প্রায় ভোর হয়ে যায়।
সেদিন পালা পামার্সটাউনের। নামের শেষে টাউন শব্দটা থাকলে কী হবে, আসলে টাউন ওটা এমন কিছু নয়, তার নিজের শহর চাপলিজড বরং ওর চেয়ে অনেক বড়ো জায়গা। যাহোক, আড্ডা জমে উঠল যথারীতি, তিন-চারটি ইয়ার দোস্ত মিলে তাস পেটানো, গল্পগুজব, যথাসম্ভব পানভোজন ইত্যাদি ইত্যাদি চালিয়ে গেল প্রায় রাত একটা পর্যন্ত। তারপর স্থানীয় সব ছোকরা গৃহমুখী হল দেখে দারুণ অনিচ্ছাতেও গা তুলতে হল পিটারকে, সিগার ফুঁকতে ফুঁকতে পা বাড়াল চাপলিজডের দিকে।
মাঝপথে পড়ে লিফি নদী। তার উপরে পাকা সেতু। দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে মাথা ঠান্ডা করার পক্ষে চমৎকার জায়গা। পিটারের মাথাটা ঠান্ডা করে নিতে পারলে ভালোই হয়। ওটা খুব স্বাভাবিক অবস্থায় নেই বলে পিটারের নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল সেতুর মাঝামাঝি এক জায়গায় রেলিংয়ের পাকা গাঁথনিতে ভর দিয়ে।
ঠান্ডা হাওয়াটা চমৎকার লাগছে মাথায়-মুখে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রসগ্রাহী সে কোনোদিন নয়। কিন্তু তার অজান্তেই আজকের রাতটা কেমন যেন আচ্ছন্ন করে ফেলছে ওকে। ওপারে ঘুমন্ত লোকালয়, একটা কোনোকিছু আওয়াজ কোথাও নেই, হালকা কুয়াশায় চাঁদের আলোটাকে দেখাচ্ছে ঘোলাটে। আকাশ পৃথিবী সবজুড়ে এক মোহময় পরিবেশ।
রেলিংয়ে ভর দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে পিটার। তাকিয়ে আছে চাপলিজডের দিকেই। নদীকুলের থেকে কিছু উপরে সারি সারি বাগান। সেইসব বাগানের ওপাশ দিয়ে চাপলিজডের রাস্তা। বাড়ি ঘরটর যা-কিছু, তা ওই রাস্তারও ওপারে।
হ্যাঁ, বাড়িঘর সব, সবই এখান থেকে অনেকটা দূরে। পিটার আজন্ম দেখে আসছে তাই। পুলের উপর দিয়ে নদী পেরুলে প্রথমে খানিকটা ফাঁকা জমি। তারপরে এক লাইন বাগান, তারও পরে রাস্তা এবং তারও ওপারে বাড়িঘর। চিরদিনই রয়েছে এইরকমটা।
কিন্তু আজ কী হল, এ কীরকম হল? পুলের উপর দাঁড়িয়ে পিটার যে এক-একটা বাড়ি দেখতে পাচ্ছে এক-একবার! বাগানগুলোর এ-কোলেই দেখতে পাচ্ছে যে! কোথা থেকে আসবে বাড়ি এখানে? আর এরকম ধরনের বাড়ি বিশেষত? ছোটো ছোটো টালি-ছাওয়া কুঁড়ে ঘর, মাটির দেওয়ালে চুনকাম করা? না, এরকম বাড়ি এই নদীর ধারে তো নয়ই চাপালিজড বা পামার্সটাউন বা হলোডেন বা সুইনডন— কোথাও নেই বাবা, কোথাও নেই। কোনোদিন ছিল না, থাকলে পিটার অবিশ্যি দেখতে পেত। সে রোজ দু-বেলা হাঁটছে এ-পথে, সে কানা নয়।
আর কী কাণ্ড দেখ, বাড়িগুলো এই দেখছে, এই নেই। এই দেখছে এখানে, পরের মুহূর্তেই দেখছে আর এক জায়গায়, হয়তো দু-শো গজ তফাতে। দেয়ালগুলো কাঁপছে, টালিগুলো উবে যাচ্ছে হাওয়ায়, সাদা দেয়াল মিলিয়ে যাচ্ছে গাছগাছালির সবুজ রঙে।
নিজের চোখকেই প্রথমে অবিশ্বাস করেছিল পিটার, তা ঠিক। কিন্তু একটু পরেই ভেবে দেখল, দোষ আর যারই হোক, তার চোখের কখনো নয়। সবই সে ঠিক দেখছে তো! নদীর উপর সাঁকো, কুয়াশার আড়ালে চাঁদ, গাছে গাছে হাওয়ার নাচন। কোনোকিছু সে ভুল দেখছে না, সে ওই ভুঁইফোঁড় বাড়িগুলোকেই ভুল দেখবে? বাড়ি যখন সে দেখতে পাচ্ছে চোখে, সে-বাড়ি আছেই। কেন আছে, সে হল অন্য প্রশ্ন। সে-প্রশ্নের সমাধান এখন আর হয় না, কারণ রাত এদিকে ফুরিয়ে আসছে। বাড়ি গিয়ে ঘুমোনো দরকার একটু, সময়মতো না-উঠলে চলবে না, বেলা নয়টাতেই ক্রিকেট ক্লাবের মিটিং আছে।
অতএব, থাকুক টালি-ছাওয়া কুঁড়ের সারি, শ্রীমান পিটার বাড়ি চলল, তাদের দিকে দৃকপাত না-করে। পুল থেকে নেমে ফাঁকা মাঠ, মাঠের পরে দুইদিকে দুটো বাগানের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। সেই রাস্তা গিয়ে বড়ো রাস্তায় মিলেছে চাপলিজডে। সেই বড়ো রাস্তার ওধারে—
ওই তো সারি সারি পাকা বাড়ি। কয়লার আড়ত, করাতকল, পাথরকুচির ডিপো— আরে এ আবার কী?
পুলিশ? উঁহু, এত পুলিশ চাপলিজডে আছে নাকি? আর পুলিশের হাতে বন্দুক, মাথায় লোহার টুপি থাকে নাকি? পোশাকও তো পুলিশের খাকিই হয়। এ লোকগুলোর কুর্তা-প্যান্ট সবই নীল রঙের। সৈন্য? তা, সত্যিই এ তো একটা সৈন্যদলের মতোই দেখাচ্ছে দেখি!
কিন্তু চাপলিজডে সৈন্য? কস্মিনকালেও তো ছিল না! গল্প শোনা যায়, মিলিশিয়া ছিল সেই গৃহযুদ্ধের সময়। ক্যাপ্টেন ডেভারোজ গড়ে তুলেছিল দক্ষিণীদের ঠ্যাঙাবার জন্য, তা সেই ডেভারোজই নানান কাণ্ডকারখানার ফলে—
কিন্তু থাকগে, সে তো অন্য কথা। এরা যদি সেই মিলিশিয়াই হবে, এত কাল এরা ছিল কোথায়? এই এক-শো বছর?
পিটারের কেবলই মনে হচ্ছে, সে বেবাক কিছু ভুল দেখে যাচ্ছে, পামার্সটাউন থেকে বেরুবার পর থেকে। প্রথমে নদীর ধারের সেই বাড়িগুলো, তারপর চাপলিজড রোডে এই সৈন্যদল, কিন্তু এমন কিছু তো কড়া মদও সে খায়নি আজ, এমন বেশি বেশি পরিমাণও খায়নি। খাবে কোত্থেকে? আজকের খরচা চালাবার ভার ছিল জয়েস হেভারসনের উপরে, সে আবার এমন হাড়কিপটে কঞ্জুস।
সৈন্যদল ঠিক আগে আগে যাচ্ছে পিটারের। সবাই পায়দলে মার্চ করছে, কেবল ক্যাপ্টেন যাচ্ছে ঘোড়ায়। ক্যাপ্টেনই লাইনের প্রথম, যেমন নাকি হওয়া উচিত। ওর পিঠটা এত পিছন থেকেও নজরে আসছে পিটারের। বাহুর লাল টকটকে বিল্লাও। ওই যে ক্যাপ্টেন, তাতে আর সন্দেহ নেই। ক্যাপ্টেন না-হলে বিল্লা লাগাবে কেন জামাতে?
রাস্তার আড়াআড়ি এখানে গেট আছে করাতকলের সাইডিং ওইদিকে। রেলগাড়ি গড়গড় করে আসে ছয় মাইল দূরের ইস্টেশন থেকে। আসে আর কাঠ বোঝাই নিয়ে গড়গড়িয়ে ফিরে যায় ইস্টেশনে। রাতেই চলে-ফেরে সেসব মালগাড়ি, তাই রাতে প্রায়ই এই গেট বন্ধ থাকে চাপলিজড রোডে। আজও আছে বন্ধ।
পিটার ভাবছে, সৈন্যদল এইবার থামতে বাধ্য হবে। ক্যাপ্টেন সমেত। গেট না-খুললে লাইন পেরুবে কেমন করে? ভালোই হয়েছে। এইবার পিটার পা চালিয়ে গেলেই ওদের ধরে ফেলতে পারে। মুখ দেখতে পারে ওদের। বিশেষ করে ওই ক্যাপ্টেনটির চেহারা সমুখ থেকে দেখার ভারি কৌতূহল হচ্ছে পিটারের। কে লোকটা? চাপলিজডের ভিতর কে এমন লোক আছে যে, রাত্তির বেলায় একটা গোটা পল্টনকে প্যারেড করিয়ে নিয়ে বেড়ায় পথে পথে? পিটার আর না-চেনে কাকে?
কিন্তু, এ কীরকম হল? থামল না তো ওরা? একে একে পেরিয়ে গেল যে লোহার বেড়া! কীরকম? লাফ দিয়ে নয়, ফাঁকের ভিতর দিয়ে গলে নয়, বেশ স্বাভাবিকভাবে পা ফেলে ফেলে এগিয়ে এল, যেন চার ফুট উঁচু লোহার রেলিং ডাইনে-বাঁয়ে নিয়ে মজবুত লোহার গেট একজোড়া জুড়ে বসে নেই চাপলিজড রোডে! কীরকম হল এটা, অ্যাঁ? পিটার এক ছুটে এসে পড়ল। তার সন্দেহ, আজই রাতে রেল কোম্পানি গেটসমেত রেলিং-টেলিং সব তুলে নিয়ে গিয়েছে এখান থেকে। তা ওরা পারে। দায়িত্বজ্ঞান ওদের তো ষোলো আনা কিনা! ওরা খেয়ালখুশি মতো গেট তো নিয়ে গেল তুলে, এখন মরে তো মরুক চাপলিজডের মানুষ মালগাড়ির চাকার তলায়, ওদের কী!
ছুটে এল পিটার, অনেকখানি রাগ মাথায় নিয়ে। এসে কিন্তু রাগ জল একেবারে। শুধু রাগ নয়, শিরার ভিতর রক্ত পর্যন্ত জল বোধ হয়। যেমন গেট, যেমন রেলিং তেমনি পড়ে আছে রাস্তাজুড়ে, নিরাপরাধ রেল কোম্পানিকে মিছেই গালমন্দ দেওয়া।
তবে? তবে? তবে?
নাঃ, এ সেই জয়েস হেভারসনটারই পেজোমি। মদ কম বলে তার ভিতর দাওয়াই কিছু গুলে দিয়েছে, যাতে কম খরচায় নেশা ধরিয়ে দেওয়া যায় স্যাঙাতদের। নেশা যে ধরেছে, তার ওই তো চাক্ষুষ প্রমাণ। সৈন্যদল পেরিয়ে গেল গেট, না-দিল লাফ, না-দিল হামা। অবশ্য হামা দিয়ে পেরুতে হলেও যেটুকু ফাঁক দরকার, তা নেই গেটে বা রেলিংয়ে।
যাক গে, মরুক গে, সবই যখন নেশাপ্রসূত, ও নিয়ে আর মাথা ঘামায় কে? পিটারের যা দরকার এই মুহর্তে, তা হল চটপট বাড়ি গিয়ে শয্যাগ্রহণ। একটা লম্বা ঘুম না-দিলে এ বিশ্রি নেশা কাটছে না। দাঁড়া না জয়েস হেভারসন, দাঁড়া না তুই, এর জের সহজে মিটবে না। বোঝাপড়া তোর সঙ্গে হবেই একহাত—
পিটারকে অবশ্য মামুলি পদ্ধতিতেই পেরুতে হল। বেয়ে উঠল গেটের মাথায়, বেয়ে নামল গেটের মাথা থেকে। লাইনের এপারে এক দফা, ওপারে আর এক দফা। এতক্ষণ সৈন্যদলটা, অবিশ্যি সত্যিকার সৈন্যদল সে যদি দেখেই থাকে, নেশায় খোয়াব যদি না-হয়ে থাকে অতগুলো দশাসই পুরুষ, হ্যাঁ, এতক্ষণ সৈন্যদলটা রাস্তার মোড় ঘুরে গিয়েছে হয়তো। তারা তো আয়েশ করে হাঁটে না পিটার মোরানের মতো, কারণ সবাইয়ের তো আর ললাটে লেখন থাকে না যে এ গুপ্তধন আবিষ্কার করবে।
গেট পেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল পিটার। যা ভাবা গিয়েছিল, তাই। লোপাট সেই এক বিগ্রেড সেপাই! টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না সেই বিল্লাধারী অশ্বারোহীর। যাঃ! ফাঁকা! ফক্কিকার! কোথাও কিছু নেই, স্রেফ এলোমেলো এন্তার হাওয়া চাপলিজড রোডে! বেশ! মজার অভিজ্ঞতা একটা হয়ে গেল বটে! গল্প করবার মতো ব্যাপার! গল্প সে করবেও, অবশ্য জয়েস হেভারসনের নাকটা থেঁতলে দেবার পর।
পা চালিয়ে দিয়েছে পিটার, গজগজ করতে করতে। আর সে তাকিয়েও দেখবে না কোনোদিকে। তাকাতে গেলেই চোখে পড়ছে সব আজগুবি জিনিস। যেখানে বাড়ি নেই, সেখানে বাড়ি। যেখানে জনমনিষ্যি নেই, সেখানে সেপাইয়ের দঙ্গল। না, আর ওসবের মধ্যে নেই পিটার। বাড়ি যাবে আর ঘুমিয়ে পড়বে! কারও খাতির রাখবে না আর পিটার মোরান।
এই যে বাড়ির মোড়। পাশের গলিতে ঢুকলেই পিটারের বাড়ি পাঁচ মিনিটের পথ। গলিতেই সে ঢুকতে যাচ্ছে, হঠাৎ সে চমকে উঠল। ও কে? গলির মুখটা ছাড়িয়েই বড়ো রাস্তায় ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে ওই যে লোকটা? ওর পিঠটা চোখে পড়ছে পিটারের, খুব চেনা পিঠ। চেনা ওই দুই হাতের লাল টকটকে বিল্লাও। এই লোকটাকেই না একটু আগে দেখা গেল, ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে দু-শো সেপাইকে মার্চ করাতে?
হয়েছে, প্যারেডের শেষে সেপাইরা যে-যার বাড়ি চলে গিয়েছে, ক্যাপ্টেনও এখন চলেছেন বাড়িতে। তা যান, কিন্তু ওঁর মুখখানি যে একবার দেখতেই হবে পিটারের! প্রথমত চাপলিজডে মিলিশিয়া যদি এখনও থেকেই থাকে, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল না-হওয়া পিটারের পক্ষে লজ্জার কথা। দ্বিতীয়ত, মিলিশিয়ার ক্যাপ্টেনি করার মতো লোক একটা যদি হাতের নাগালে এসেই থাকে, তাকে চিনে রাখতে লাভ ছাড়া লোকসান নেই, কখনো-না-কখনো সে পরিচয় কাজে আসতে পারেও বা।
সে ঝটিটি পাশ কাটিয়ে সমুখে চলে গেল ক্যাপ্টেনের, আবার তক্ষুনি ঘুরে দাঁড়িয়ে সবিনয়ে নিবেদন করল, ‘ইওর অনার, কিছু যদি মনে না করেন, আপনার যদি অনুগ্রহ হয়, মানে অধমের ধৃষ্টতা যদি ক্ষমা করেন—’
ক্যাপ্টেন মুখ নীচু করে হাঁটছিলেন, আস্তে আস্তে মুখ তুলে চাইলেন। পিটার অবাক। এ লোক তার একান্তই অচেনা। চাপলিজডে তার অচেনা লোকও আছে তা হলে? বৃথাই সে তাহলে এই একুশটা বছর চষে বেড়াল চাপলিজডের পথঘাট?
কিন্তু তার অবাক হওয়ার কারণ শুধু ওটাই নয়। দ্বিতীয় কারণ এবং প্রধান কারণ হল লোকটার সৌন্দর্য। পুরুষ মানুষ এমন সুন্দর হয়? পুরুষালি সৌন্দর্য কথাটা একেবারে কখনো শোনেনি পিটার, তা নয়। কিন্তু সেটাকে সে এতদিন সোনার পাথরঘাটির মতনই একটা অবাস্তব বস্তু বলে ধারণা করে এসেছে! সে ধারণা যে তার নিছক ভুল, তা পিটার বুঝল আজ। প্রশস্ত ললাট, সটান নাক, ভরাট চোয়াল— খুব ভালো করেই সে দেখছে লোকটিকে।
আরও ভালো করে দেখবার সময় কিন্তু পেল না পিটার। ক্যাপ্টেন বলল, ‘শুভদিন পিটার!’
‘শুভদিন?’ পিটারের নাম যে ক্যাপ্টেন জানে, তা লক্ষ করল পিটার, কিন্তু তাতে আশ্চর্য হবার মতো কিছু দেখল না, কারণ চাপলিজডে তাকে আর না-চেনে কে? সে বরং আশ্চর্য হল, ক্যাপ্টেন ‘শুভদিন’ বলে তাকে সম্ভাষণ করেছে বলে। শুভদিন? দিন এখন কোনখানটায়। ভোরের এখনও তিনঘণ্টা বাকি। সে সবিনয়েই বলল,
‘শুভদিন বলছেন ইওর অনার? শুভরাত্রি বললেই কি ঠিক হত না?’
‘তা হয়তো হত।’ বিষণ্ণভাবে জবাব দিলেন ক্যাপ্টেন, ‘তবে কী জানো, দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানিয়ে নেওয়া অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে আমার। তা সে কথা যাক, আমার একটা কাজ তুমি করে দেবে? বেশি কিছু নয়, এক জায়গা খুঁড়ে একটা জিনিস তুলে আনা। তোমার তাতে বিলক্ষণ মুনাফা হবে, আমি কথা দিচ্ছি তোমায়।’
চট করে পিটারের মনে পড়ে গেল, গুপ্তধন আবিষ্কারের জন্যই ভগবান তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। ওটা তাকে পেতেই হবে। পাওয়ার বোধ হয় এইটাই সুযোগ! সেই বহু প্রতীক্ষিত যোগাযোগ! জায়গা খুঁড়ে জিনিস আনা? তা থেকে মুনাফা? এ যদি গুপ্তধন না-হয়, তাহলে অভিধানে ‘গুপ্তধন’ কথাটার মানে পালটে লেখা উচিত।
এত যে মেহনতে বিমুখ পিটার মোরান, তিলমাত্র ওজর না-করে সে রাজি হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের সাহায্য করতে। মালটা তো বেরুক, তারপর মুনাফার বখরা কতটা সে টানতে পারে, তা বোঝা যাবে তখন।
ক্যাপ্টেন অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে তাকে নিয়ে এল সাবেককালের রোমান ক্যাথলিক গির্জার কাছে। একটা গলির মুখেই ভাঙা এক বাড়ি, পিটারের চেনা বাড়িই। জ্ঞান হয়ে অবধি সে-বাড়িতে মানুষের বাস সে দেখেনি! ঠিক তো! গুপ্তধন থাকতে হলে এইরকম জায়গাতেই তো থাকবে!
ক্যাপ্টেন তাকে নিয়ে গেল বাড়িটার দরজায়। দরজা এখানে আগে কখনো দেখেনি পিটার, যা দেখেছে তা মস্ত একটা ইটের গাদা। আজ লম্বা-চওড়া দরজা সেখানে, তার কড়া নাড়তেই ভিতর থেকে তা খুলেও দিল কেউ একজন। কে সে একজন, তা অবশ্য দেখতে পাওয়া গেল না, আর পাওয়া গেল না বলে বিস্মিতও হল না পিটার।
বাইরে জ্যোৎস্না ছিল ফুটফুটে, দেখা যাচ্ছিল সব। এখানে ঘরের ভিতর জ্যোৎস্না তো নেই, তবু এ আলো আসছে কোথা থেকে? উজ্জ্বল না-হোক, স্নিগ্ধ না-হোক, মরাংচে ঘোলাটে একটি আলোতে, স্পষ্টভাবে না-হোক, মোটামুটি সবই চোখে পড়ছে একরকম। কীসের আলো এটা তা খুঁজে দেখবার কথা মনেও হল না পিটারের।
ক্যাপ্টেন একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভিতরে গাঁইতি আছে, নিয়ে এসো পিটার।’ পিটার দরজা খুলে সত্যিই পেয়ে গেল গাঁইতি, কাঁধে করে ফিরে এল ক্যাপ্টেনের কাছে।
সিঁড়ি বেয়ে উপরতলায়। ঘরের পরে ঘর পেরিয়ে একেবারে শেষের কামরায় এসে দাঁড়াল দু-জনে। দরজা একটিমাত্র এ ঘরে, জানলা একটিও নেই। একটা দেয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে ক্যাপ্টেন বলল, ‘ঠিক ওর গা ঘেষে খোঁড়ো।’
খুঁড়ছে, খুঁড়ছে। এমন মেহনতের কিছু নয়, গাঁইতির ঘা পড়তেই সিমেন্টের নীচে ইট, ইটের নীচে খোয়া, সব উঠে এল আস্তে আস্তে। পিটারের মনে হচ্ছে এইবার বুঝি টালি বেরিয়ে পড়বে, আর তাতে ঘা মারলেই দেখা যাবে নীচের ঘরের মেজে। কিন্তু তা তো নয়!
খোয়ার নীচে আবারও ইট। আর সেই ইটের উপরে শোয়ানো একটা ছোটো কঙ্কাল।
গাঁইতির আঘাতে পাঁজরার একখানা হাড় ভেঙেও গেল বুঝি।
কঙ্কালের দিকে একনজর তাকিয়েই ছিটকে পিছিয়ে এল পিটার, তারপরই পাশের দিকে তাকাল, যেখানে ক্যাপ্টেনের থাকবার কথা। কোথায় কী? কেউ নেই সে-ঘরে। আলোটাও নিবে যাচ্ছে দেখতে দেখতে।
মাথার ভিতর কীরকম যেন করে উঠল পিটারের। সে দড়াম করে গিয়ে আছড়ে পড়ল দেয়ালের উপরে। কতকালের পুরোনো দেয়াল, আপনিই হয়তো ভেঙে পড়তো দু-দিন বাদে। আজ, একে তার গোড়াটা হয়েছে খোঁড়া, তার উপরে আবার আচমকা ধাক্কা খেল দুই-মণি একটা মনুষ্যদেহের, সে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল পিটারকে নিয়ে।
পরের দিন সকালে আধমরা পিটারকে ধরাধরি করে রাস্তায় লোকেই নিয়ে এল তার ঠাকুরমার বাড়ি। ‘নাও, কাজকর্মের ত্রিসীমায় যাবে না, নেশাভাঙ করে বেড়াবে দিন রাত। হল তো এখন?’ বলে বিদায় নিল তারা।
বুড়ি ডাক্তার ডাকল। না, এমন কিছু হয়নি, হাড়গোড় এক আধখানা ভেঙেছে বটে, তবে এ-বয়সে সেটা মারাত্মক নয়, যাবে সেরে।’— ভরসা দিলেন ডাক্তার।
গেল সেরে, অবিশ্বাস্যরকম তাড়াতাড়িই সেরে গেল। আর ভালো করে সেরে উঠবার আগেই সে গিয়ে হাজির হল টাউন হলে, পুলিশের বড়োকর্তার কাছে।
‘মিলিটারি প্যারেড? ক্যাপ্টেন? পাগল!’— রায় দিতে যাচ্ছেন কর্তা পাগল বলেই, এমন সময় ‘কঙ্কাল’ কথাটা কানে গেল তাঁর! ‘কঙ্কাল? বাড়িটা কোথায়? রোমান ক্যাথলিক গির্জার কাছে? ড্যাম। ওই বাড়িতেই না ডেভারোজ থাকত? ড্যাম!’
দেয়ালে সারি সারি ছবি টাঙানো আছে টাউন হলের। ‘খুঁজে দ্যাখো তো ছোকরা, ওইসব ছবির ভিতর সেই ক্যাপ্টেনকে দেখতে পাও নাকি?’
এক পলক দেখে নিয়েই একখানা ছবির দিকে আঙুল তুলে ধরল পিটার। ক্যাপ্টেনের সৌন্দর্যটি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করেছিল রাস্তায়, ভুল হবার জো কী?’
‘ড্যাম! ক্যাপ্টেন ডেভারোজ! মারা গিয়েছে ষাট বছর আগে। চলো দেখি।’— বলে কর্তা একদল পুলিশ নিয়ে চললেন গির্জার ধারের ভাঙা বাড়িতে। পিটার পথ দেখাচ্ছে।
সব মিলে যাচ্ছে পিটারের জবানবন্দির সাথে, গাঁইতি, কঙ্কাল— সব। গাঁইতিতে অবশ্য মাকড়সার জাল জড়িয়ে আছে। পিটার বলেনি সে-জালের কথা। সম্ভবত সে খেয়াল করেনি সেটা।
পুলিশের নথি থেকেই বেরুল, ডেভারোজের দাদার ছিল বিপুল বিষয়, সন্তান ছিল একটিমাত্র ছেলে! সে-ছেলে হারিয়ে যায়। ডেভারোজের উপর সন্দেহ করে পুলিশ, কিন্তু প্রমাণ পায় না।
আজ প্রমাণ মিলল। কঙ্কালটা বালকেরই বটে। ওই হল সেই হারানো ছেলে ডেভারোজের দাদার। পাওয়া গেল ডেভারোজের বাড়িতেই। দেখিয়ে দিয়ে গেল ডেভারোজেরই অনুতপ্ত আত্মা। আইনের কিছু করবার নেই আর। কঙ্কালটা নিয়ে কবর দেওয়া হল গির্জায়। হত এবং হন্তা, দু-জনেরই আত্মা শান্তি পাবে এবার।
কিন্তু পিটারের কী হল? পিটারের? সে এক মজার কথা।
নিহত বালকের বাপ উইলে লিখে যান, জীবিত বা মৃত তাঁর পুত্রের কোনো সন্ধান যদি কেউ দিতে পারে, তাঁর এস্টেট থেকে দশ হাজার ডলার পুরস্কার সে পাবে।
হল তো? ষাট বছর পরে উইলের সেই দশ হাজার ডলারের দাবিদার এল একজন।
পিটার এরকম আমরণ তাল ঠুকে বেড়িয়েছে চাপলিজডের রস্তায় রাস্তায়, ‘ভাগ্যে আছে গুপ্তধন, খণ্ডায় কে আমার?’
তার ঠাকুরমাও, যত দিন বেঁচেছিল, পড়শিদের ডেকে ডেকে বলছে, ‘আমি বলিনি যে আমার নাতিকে খেটে খেতে হবেনি? হবেনি? কাজকম্মো করতে তাকে হবেনি? হবেনি?