ভাগ্যপাঠ

ভাগ্যপাঠ

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নির্দেশ এসেছে, যেন সংস্কৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় এবং বৈদিক ফলিত জ্যোতিষ অবশ্যপাঠ্য করা হয়। প্রথমটি সম্বন্ধে কোনও দ্বিমত নেই, যদিও সেটি একটি মহাবিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরেই হওয়া উচিত, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে নয়। তথাপি এর একটা সর্বজনস্বীকৃত উপযোগিতা আছে।

কিন্তু বৈদিক ফলিত জ্যোতিষ? ফলিত জ্যোতিষ (astronomy অর্থে) বেদাঙ্গের অন্তর্ভুক্ত কিন্তু এ সম্বন্ধে মাত্র একটিই গ্রন্থ পাওয়া যায়, লগধের লেখা ‘জ্যোতিষ-বেদাঙ্গ’ অথবা ‘বেদাঙ্গজ্যোতিষ’। ছন্দে রচিত এ বইটি, ঋগ্বেদ সংস্করণে ৩৬টি শ্লোকে ও যজুর্বেদ সংস্করণে ৪৩টি শ্লোকে। এটি যজ্ঞের উপযুক্ত তিথির জন্যে সূর্য ও চন্দ্রের উত্তরায়ণ এবং পূর্ণিমা-অমাবস্যা নির্ণয়ের হিসাবের গ্রন্থ।

ইদানীং কিছু কিছু গ্রন্থ রচিত হচ্ছে বৈদিক ফলিত জ্যোতিষ সম্বন্ধে। এর মধ্যে Hindu Astrology for the Modern Astrologer James D Braha; David Frawley-

The Astrology of the Seer: A Comprehensive guide to Vedic Astrology; Haribhai Pandya, S Dutt Dikshit & R N M Kansu The Nakshatras: The Lunar Mansions of Vedic Astrology— এই বইগুলির উদ্দেশ্য, বেদে ফলিত জ্যোতিষ ছিল তা প্রমাণ করা; উৎসপাঠ থেকে টেনে টেনে নিজেদের মতের অনুকূলে ‘প্রমাণ’ গঠন করা, যে প্রমাণ সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং কষ্টকল্পিত।

কেন এই দুশ্চেষ্টা? বেদে কোথাও ফলিত জ্যোতিষ নেই। নেই এ কথা বলতে ক্ষতি কী ছিল?

বেশ কতকগুলি বিষয়কে লেখকরা ইচ্ছে করেই রহস্যাবৃত করে রাখেন; তাতে সুবিধে এই যে, সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেওয়া সহজ হয়, বোঝানো যায় যে, বিষয়গুলি এতই দুর্ব্বেয় যে সহজ সাধারণবোধ্য ভাষায় তা বোঝানো যায় না। এই বিষয়গুলির মধ্যে ফলিত জ্যোতিষ অন্যতম। গ্রহ-নক্ষত্র কী ভাবে ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত করে, বিভিন্ন মণিরত্ন কবচ তাগা মাদুলি ধারণে কী ভাবে মানুষ তার ভাগ্য ও ভবিষ্যৎকে অনুকূল করে তোলে এবং প্রয়োজনমতো দুর্ভাগ্যকে খণ্ডন ও প্রতিরোধ করতে পারে, তারই আলোচনা ফলিত জ্যোতিষের অন্তর্গত। আর আছে সামুদ্রিক জ্যোতিষ, যার আলোচ্য বস্তু হল, মানুষের অবয়বের বিভিন্ন লক্ষণ থেকে তার ভাগ্য নির্ণয় করা; তার শরীর-গঠন, হাত-পায়ের রেখা, চোখ, কান ইত্যাদি প্রত্যঙ্গগুলির বিচার করে মানুষের চরিত্রও ভাগ্য নিরূপণ করা।

মানুষ নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্রহ-নক্ষত্র বিচার, রত্নধারণ ও সামুদ্রিক লক্ষণ বিচার করে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। গত দেড়শো বছর ধরে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে নানা ক্ষেত্রেই মানুষের সংস্কারমুক্তি ঘটছে। ফলে বহু ব্যাপারকে সে এখন বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখছে, এবং যারা ফলিত জ্যোতিষীর নিরূপিত ব্যবস্থা গ্রহণ করেও অভীষ্ট ফল লাভ করছে না, তারাও ক্রমেই এ শাস্ত্রে বিশ্বাস হারাচ্ছে। এতে ফলিত জ্যোতিষ সম্পর্কে দীর্ঘকালব্যাপী যে কুসংস্কার সমাজে চালু ছিল, সেগুলিতে মানুষের বিশ্বাস ক্ষীণ হচ্ছে বা থাকছেই না। বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকে সব বিশ্বাস সব সংস্কারকে বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করে দেখছে এবং আগের মতো নির্বিচারে গ্রহণ করতে পারছে না। এই অবিশ্বাস বাড়ার অনুপাতেই কোথাও কোথাও জ্যোতিষীদের পসার কমেছে।

এরই পাশাপাশি গত শতকের শেষ দিকে দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশ্বায়নের আগ্রাসী প্রকোপে মানুষের জীবনে এত বড় ধাক্কা লাগল যে, তার অস্তিত্বে নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে উঠল। ফলে নতুন এক স্তরে অজ্ঞান ভাগ্যভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিল। যেন এক অজ্ঞাত দানবশক্তির দ্বারা আক্রমণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনও উপায় তার জানা নেই। ফলে সে শরণাপন্ন হয় তার পুরনো পরিত্রাতা জ্যোতিষীর। এতে যে তার বিপদ কাটে তা নয়; কিন্তু মনটা আশ্বস্ত হয়। জ্যোতিষীরা এত ছক কেটে হিসেবপত্তর করে সর্বজ্ঞের মতো বিধান দেয় কবচমাদুলির, শান্তি স্বস্ত্যয়নের ও নানা রকম প্রতিষেধক ক্রিয়াকর্মের, যে রকম ব্যাখ্যা দেয় মানুষের বিপদ ও দুর্দৈবের, যে সাধারণ মানুষ তখনকার মতো ক্ষণিক একটা আশ্বাস ও শান্তি পায়। নিজস্ব পৌরুষ বা সংহত মানবিক চেষ্টায় দুর্যোগ খণ্ডনের চেষ্টা করে না। এতে প্রশ্রয় পায় এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা, নিয়তিনির্ভরতা এবং বেশ কার্যকর ভাবে স্তিমিত হয়ে যায় আত্মশক্তিতে প্রত্যয়ী পুরুষকার-নির্ভর মানসিকতা।

ঠিক এইটেই প্রয়োজন সঙ্ঘ পরিবারের: মানুষ যেন আত্মশক্তিতে বিশ্বাস হারায়। সমবেত প্রতিবাদ-চেষ্টা থেকে বিরত হয়। বর্তমানের আগ্রাসী বিশ্বায়নের আক্রমণ যেন মানুষকে দিশেহারা ও বিহ্বল করে রাখে এবং আশেপাশে প্রতিকারের কোনও আশা দেখতে না পেয়ে সে যেন দৈববিশ্বাসী হয়ে দৈবজ্ঞদের শরণাপন্ন হয়। এই দৈবজ্ঞরা বরাবরই ছিল, কিন্তু গত কয়েক বছরে চক্রবৃদ্ধি হারে তাদের সংখ্যা বেড়েছে। এখন এক কলকাতা শহরেই নারীপুরুষ মিলে কয়েক হাজার জ্যোতিষী এবং তাদের রমরমা প্রতিষ্ঠা-সমৃদ্ধি অবিশ্বাস্য হারে। এদের খদ্দেররা কোটিপতি থেকে দিনমজুর পর্যন্ত, এদের অনুগত পোষ্য গোপনে সংবাদসংগ্রহকারীরা সংখ্যায় অনেক এবং এদের প্রচারও সুদূরব্যাপী।

এখন খুব কম লোকই জানেন যে, বৈদিক জ্যোতিষ ছিল খুব ছোট একটি গ্রন্থ, যাতে গ্রহ-নক্ষত্রদের অবস্থান নিয়েই আলোচনা, যজ্ঞের উপযুক্ত ঋতুনির্ণয় যার উদ্দেশ্য। এ ছাড়া ফলিত জ্যোতিষ সম্বন্ধে বেদে কোনও আলোচনাই নেই, কেবল সামুদ্রিক জ্যোতিষ; সুলক্ষণ কুমার ও সুলক্ষণা কন্যার লক্ষণ সম্বন্ধে সামান্য কিছু উল্লেখ আছে বিবাহের পাত্রপাত্রী নির্বাচনের প্রসঙ্গে। মানুষের জীবনের ওপরে জ্যোতিষ্কদের প্রভাব বিষয়ে কোনও কথা নেই, যেমন গ্রহরত্ন বা কবচমাদুলি ধারণ সম্বন্ধেও কোনও কথা নেই। তবু এত আগ্রহ কেন বৈদিক ফলিত জ্যোতিষ সম্বন্ধে? কারণ, তা হলে আজকের ফলিত জ্যোতিষচর্চা প্রাচীনতার আভিজাত্য পায়, এবং এটা যে প্রাচীনতা নয়, খাস বৈদিক প্রাচীনতা, ‘বেদে ছিল’ এ কথা বলায় এখনও এ দেশে একটা প্রায় অতিলৌকিকতার আবেশ সৃষ্টি করে। আর তার দ্বারাই যেন প্রমাণিত হয় রাশি বিচার, রত্ন মাদুলি কবচ ধারণ এ সব অর্বাচীন উদ্ভাবন নয়, বহু বহু প্রাচীনকাল, সেই বেদের কাল থেকেই আছে।

কোনও তত্ত্বের প্রামাণ্যতা নিরূপিত হতে পারে দুটি উপায়ে: প্রথমত যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিপরম্পরা দ্বারা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, সে সিদ্ধান্ত তখন অভ্রান্ত, অতএব সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। যেখানে যুক্তি দিয়ে কোনও তত্ত্বকে প্রমাণ করা যায় না অথচ তাকে সর্বজনের স্বীকৃতি পাওয়ানো চাই-ই, সেখানে এই অপকৌশলটি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। যুক্তি যখন জোটে না তখন সমাজপতিরা প্রমাণার্থীকে বলেন, ‘তোমরা বললেই হল, চিরকালটা লোকে এইটেই মেনে এসেছে, করে এসেছে…’ অর্থাৎ যুক্তির বিকল্প হল প্রাচীনতার দোহাই। এবং মানুষের আতঙ্ক হয়, সুদীর্ঘকালের আচরিত বিধি লঙ্ঘন করতে। অতএব চলতে থাকে অযৌক্তিক আচরণ। এই কারণে রাশিচক্রের দোষ খণ্ডন থেকে কবচ মাদুলি গ্রহরত্ন ধারণ, হস্তরেখা বিচার এবং সেখানে সংকেতিত দুর্যোগের খণ্ডনে ও অন্ধবিশ্বাসে বহুবিধ ব্যয়সাধ্য বিধান মেনে চলতে হবে।

এর তিনটি ফল: প্রথমত, মানুষের যুক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে তুলে রাখা। দ্বিতীয়ত, অযৌক্তিক সংস্কারের কাছে আত্মসমর্পণ করা। তৃতীয়ত, এই অযৌক্তিক আচরণকে প্রাচীনতার মহিমায় মণ্ডিত করে তাকে গৌরবান্বিত করা। ফলিত জ্যোতিষ বীজাকারেও বেদে ছিল না, তবু সেই কাল্পনিক তত্ত্বকে স্বীকার করতে হবে এবং ফলিত জ্যোতিষের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনধারণ করতে হবে। তার অর্থ, মানুষের বুদ্ধি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েই থাকবে, বুদ্ধিগ্রাহ্য সিদ্ধান্তের বদলে সে কুসংস্কার দিয়ে জীবন চালিত করবে। জ্যোতিষীরা তাদের অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত জনসাধারণ্যে প্রচার করেই চলবে। সাধারণ মানুষ এই বহুলপ্রচারিত ভ্রান্তির মধ্যেই নির্বাসিত হয়ে থাকবে। যথার্থ জ্ঞানান্বেষণে ও যুক্তিসিদ্ধ তত্ত্ব দিয়ে জীবন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।

‘বেদে উদ্ভূত’ এই মিথ্যাটির দ্বারা ফলিত জ্যোতিষ যে কৃত্রিম আভিজাত্য পায় তার দ্বারা সঙ্ঘপরিবারের কী লাভ হয়? সহজেই বোঝা যায় যে, আজকে যারা ফলিত জ্যোতিষ চর্চা করে, তাদের তা হলে অর্বাচীন, স্বকপোলকল্পিত তত্ত্বের চর্চা করছেন এমন কথা বলা যাবে না; ফলে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। এই গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তি বিজ্ঞানে নয়, কেবলমাত্র এ দেশের প্রাচীনতম গ্রন্থ বেদের সূত্র ধরে, যদিও বাস্তবে এ সূত্রটির কোনও অস্তিত্বই নেই।

বর্তমান ভারতবাসীর চিন্তাধারার সামনে দু’টি পথ খোলা আছে— (১) ইতিহাস- বিজ্ঞাননিষ্ঠ চিন্তা (২) প্রাচীন সংস্কারের উত্তরাধিকার অবৈজ্ঞানিক চিন্তা। প্রাচীন চিন্তাধারার মধ্যে অবশ্যই সুস্থ বিজ্ঞানী ধারা বহুদিন বর্তমান ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে, এই ধারা সুস্থ বিজ্ঞানের দিকে পিছন ফিরে, অর্থাৎ বিজ্ঞান যখন তার ওই সংস্কারকে অপ্রমাণ করেছে তখনও, সেই অবৈজ্ঞানিক চিন্তাকেই অবলম্বন করল তখন বিজ্ঞানের সঙ্গে বিরোধের কারণে এ বিশ্বাস ভ্রান্তিনিষ্ঠ, অতএব চিন্তাশীল মানুষের কাছে গ্রহণের অযোগ্য হয়ে উঠল। এখনও দেশে ওই দুই ধারাই বর্তমান। ফলিত জ্যোতিষের যে কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, এটা সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষিত মানুষই জানেন। যদিও বিপদে পড়ে অনেকেই বুদ্ধির বদলে চিরাভ্যস্ত ফলিত জ্যোতিষের আশ্রয় নেন, ফল হোক আর না হোক।

এর ফলে ফলিত জ্যোতিষের রমরমা সারা দেশজুড়ে। এই সে দিন ১৭ আগস্ট বিশ্ব ফলিত জ্যোতিষ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হল, দেশের, বিদেশের জ্যোতিষীরা সমবেত হয়েছিলেন; জ্যোতিষের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরস্কৃত হয় এবং এ-নিয়ে নানা আলোচনা চলে ক’দিন ধরে। ভারতবর্ষে প্রতি বছরেই ইতস্তত এমন সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং শুধু ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ চর্চা চলে। এর দ্বারা প্রমাণ হয়, দেশের একটা মহলে ফলিত জ্যোতিষের বেশ একটা ফলাও ব্যবসা দীর্ঘকাল ধরে চলে এসেছে এবং এখনও মহাসমারোহে চলছে।

এখন বরং এর দাপট বেড়েছে। একটা কারণ হল, খোদ সাহেবরাও এ-নিয়ে চর্চা করে, ফলে দীর্ঘকাল পরাধীন থাকা জাতের কাছে এর নতুন আভিজাত্য প্রতিপন্ন হয়েছে। এতদিন বহু তথাকথিত বিজ্ঞানশিক্ষিত আধুনিক মানুষ অন্ধের মতো ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাস করেছেন, তার ওপরে সাহেবরা এ শাস্ত্রের চর্চা করে এবং সর্বোপরি বেদে নাকি এ চর্চা ছিল। অতএব এর আভিজাত্য অনস্বীকার্য এবং এর গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণসিদ্ধ।

এখন, ঠিক এখন, ফলিত জ্যোতিষের চাহিদা হঠাৎ খুব বেড়েছে। তার কারণ, এখন মানুষের জীবন, ভাগ্য, ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তাও খুব বেড়েছে। গরিব দেশে এক শ্রেণির মানুষ বিশ্বায়নের কল্যাণে হঠাৎ ধনী হয়েছে; সেই ধন আকস্মিক ভাবে এসেছে, থাকবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা আছে, তাই কোনও একটা অতিলৌকিক শক্তিকে হাত ধরে ধনটা কায়েম করার বাসনায় রাশিচক্র বিচার, গ্রহরত্ন ধারণ, সামুদ্রিক লক্ষণের প্রতিকারে শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করার জন্যে জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হতে হচ্ছে। আবার গরিব চাষি-মজুরও নিজেদের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিত করবার জন্যে— অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা থেকে বাঁচতে, অথবা ছাঁটাই থেকে বাঁচতে, কোনও না কোনও সবজান্তা জ্যোতিষের আশ্রয় নিচ্ছেন। এ সবের খুব একটা সুবিধে আছে। সম্ভাব্যতার (probability) যে বৈজ্ঞানিক আইন চালু আছে, সে-অনুসারে সব সম্ভাব্যতারই ফাঁক থাকে, যার দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় এ গণনার বা নিদানের নিষ্ফলতা; অর্থাৎ কাকতালীয়বৎ কিছু মিলে যায় এবং অন্য অনেক কিছু মেলে না। না মিললে অনুষ্ঠানের ফাঁক ধরে দেয় জ্যোতিষী, ব্যাখ্যা হয়; ত্রুটির জন্যই বিফল হয়েছে অনুষ্ঠান। কিন্তু কিছু কিছু তো মেলে, সেইগুলিকেই আঁকড়ে ধরে থাকে বিপদ-সমুদ্রে ডুবন্ত মানুষ।

ভিত যার প্রকৃতপক্ষে এত নড়বড়ে, বিজ্ঞানের নিরিখে যা যথার্থ বিজ্ঞান বলে প্রতিপন্ন হতেই পারে না, সেই ফলিত জ্যোতিষকে কাল্পনিক আভিজাত্য দিয়ে ‘বৈদিক’ বলে সম্পূর্ণ অবিদ্যমান বৈদিক ফলিত জ্যোতিষকে এখন পাঠ্য করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এ জ্যোতিষে বর্তমানের ছাত্রছাত্রী নতুন কী পাবে, যার জন্যে একে বাজারে আমদানি করা হচ্ছে?

প্রথমত, ছাত্রছাত্রীরা জানবে যে, বেদের কাল থেকে একটি অবিচ্ছিন্ন ধারায় ফলিত জ্যোতিষের চর্চা চলছে, কাজেই তাদের ভক্তি ও বিশ্বাস বাড়বে। জীবনের সব সংকটের প্রতিকার তারা খুঁজবে গ্রহরত্ন, রাশিচক্র ও সামুদ্রিক জ্যোতিষের কাছে।

এরা জানবে না, কত বড় অবৈজ্ঞানিক ভ্রান্তি ও মিথ্যার ওপরে প্রতিষ্ঠিত এই ফলিত জ্যোতিষ। ফলে এরা বৈজ্ঞানিক সমাধান খুঁজবে না, জীবনের সংকটে এদের দৃষ্টিতে বিজ্ঞান-সত্য থেকে সরে এসে ভ্রান্ত ধারণা আরোপিত হবে। বিপদের সমাধান হবে না বুদ্ধি, যুক্তি, বিজ্ঞানের দ্বারা, হবে কুসংস্কার ও ধারাবাহিত অবৈজ্ঞানিক ফলিত জ্যোতিষের দ্বারা। সমস্ত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত হবে অনৈতিহাসিক অবৈজ্ঞানিক মনোভাবের দ্বারা। এক কথায়, দেশের মানসিক অবস্থান অন্তত কয়েকশো বছর পিছিয়ে মধ্যযুগীয় স্তরে পৌঁছে যাবে।

এতে কী লাভ? লাভ আছে বইকি। নানা কারণেই সঙ্ঘপরিবার চায় যে, মানুষ বিজ্ঞানের বদলে কুসংস্কারকে আশ্রয় করুক। আর চায়, দেশজুড়ে অন্নবস্ত্র শিক্ষা স্বাস্থ্য বাসস্থানের জন্যে হাহাকার, তার প্রকৃত সমাধানের পথ থেকে মানুষের দৃষ্টি সরে আসুক মিথ্যা কাল্পনিক জ্যোতিষী সমাধানের ওপরে। এর পরেও যখন সমাধান হবে না তখন নিজের ভাগ্যকে দোষ দিলেই চলবে।

বৈদিক জ্যোতিষ কেন? কারণ, বেদ অপৌরুষেয়, অতএব অভ্রান্ত। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের মেসোপটেমিয়ায় অসিরীয় রাজা অসুরবানিপালের রাজত্বে কিছু কিছু জ্যোতিষের চর্চার কথা শোনা যায়। তারও আগে মিশর ও চিনেও এ ধরনের চর্চার সন্ধান পাই। পরে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিসে যে ফলিত জ্যোতিষ প্রাধান্য পাচ্ছিল তারই পূর্ণ প্রভাব পড়ে ভারতবর্ষে। তখন এখানে গুপ্তযুগ, অভিপৌরাণিক থেকে পৌরাণিক চিন্তা ও আচরণ-অনুষ্ঠানের প্রাদুর্ভাব। এর আগেকার কোনও ফলিত জ্যোতিষ যেখানে নেই, সেখানে জাতে ওঠবার জন্য বৈদিক জ্যোতিষকে গৌরবান্বিত করে উপস্থাপিত করার আগ্রহ স্বাভাবিক। এর ফলে, যা প্রকৃতপক্ষে অর্বাচীন তাকে শুধু প্রাচীন নয় প্রাচীনতম গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হল। এতে সাধারণ মানুষ সভয়ে সসম্ভ্রমে একে গ্রহণ করল। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে তারা যা পেল তা একরাশি কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। বৈদিকতার নামে কাল্পনিক মর্যাদায় মণ্ডিত করে মানুষের বিজ্ঞানমুখী চিন্তা, বাস্তবনিষ্ঠতাকে খর্ব করে, যার যুক্তি নেই। বিজ্ঞানের ভিত্তি নেই তাকে শুধুমাত্র নামমাহাত্ম্যে মানুষের গ্রহণীয় বলা হল। এতে ফলিত জ্যোতিষ যথার্থ শাস্ত্রের মর্যাদা পেল, যে মর্যাদায় তার কোনও অধিকার নেই। বর্তমানের অসংখ্য জ্যোতিষী-জ্যোতিষিণী এই মর্যাদাকে অর্থকরী ভাষায় অনুবাদ করতে পারবেন।

ছাঁটাই হোক, বেকারি হোক, বিশ্বায়নের নখদন্ত প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে ক্রুর অমানবিক ব্যবস্থা দ্রুতগতিতে মানুষের অন্নবস্ত্র সুখশান্তি হরণ করছে, এমনকী তারও একটা ব্যাখ্যা মিলে যায় ফলিত জ্যোতিষে। এবং শুধু ব্যাখ্যা নয়, প্রতিকারও। গ্রহশান্তি, কবচমাদুলি, রাশিচক্র ইত্যাদির অধিকাংশ প্রবল অর্থকরী আকারে, জ্যোতিষীদের দোকানে দেখা দিচ্ছে। দুঃখী মানুষের যৎসামান্য পুঁজি উবে যাচ্ছে ওদের দেওয়া ব্যবস্থায়। আর হঠাৎ ধনীরা সহসালব্ধ ধনে সুরক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যে ওদের শরণাপন্ন হচ্ছেন। অতএব বজ্রনির্ঘোষে চলছে ফলিত জ্যোতিষের রথ। চলবে আরও ভাল। কারণ, এখন তার গায়ে চড়ানো হল বৈদিকতার তকমা। ব্যাপারটা খোলা চোখে না দেখলে, এর থেকে কোনও পরিত্রাণ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *