ভাগ্য

ভাগ্য
Luck

[**এটা কোন কাল্পনিক চিত্র নয়। চল্লিশ বছর আগে উলউইচ-এ শিক্ষক ছিলেন এ রকম একজন পাদরির কাছে এটা আমি পেয়েছি, আর তিনি শপথ নিয়ে বলছেন যে এটা সত্য ঘটনা।]

এ যুগের দুজন বা তিনজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ইংরেজ সামরিক বিভাগীয় ব্যক্তির অন্যতম একজনের সম্মানে আয়োজিত লণ্ডনের একটি ভোজসভায় ব্যাপারটা ঘটে ছিল। কোন কারনে (কারণটা অচিরেই প্রকাশ পাবে) তার আসল নাম ও খেতাব উহ্য রেখে আমি তাকে বলল লেফটেন্যান্ট জেনারেল লর্ড আর্থার ঋের্স বি, ওয়াই সি., কে, বি., ইত্যাদি, ইত্যাদি, ইত্যাদি। একটি বিখ্যাত নামের কী আর্কষণ! রক্ত-মাংসের আসল মানুষটি বসে আছে। ত্রিশ বছর আগে ক্রিমিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ যেদিন তার নামটা একেবারে তুঙ্গে উঠে ছিল সেদিন থেকে হাজার হাজার বার তার নামটা আমি শুনেছি। সে নাম চিরদিনই বিখ্যাত হয়ে থাকবে ঐ অর্ধ-ঈশ্বরের দিকে অবিরাম তাকিয়ে থাকা যেন আমার ক্ষুধার অন্ন আর তৃষ্ণার জল; ভাল করে দেখা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, দেখা আর লিখে রাখা: ঐ প্রশান্তি, ঐ সংযম, মুখের ঐ মহৎ গাম্ভীর্য; যে সরল সাধুতা তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে আছে তা; স্বীয় মহত্ত্ব সম্পর্কে তার মধুর উদাসীনতা-তার উপর নিবদ্ধ শত শত ভক্তের দৃষ্টি সম্পর্কে উদাসীনতা, এ সব লোকের বুকের ভিতর থেকে স্বতঃ উৎসারিত ঐকান্তিক পূজার প্রবহমান স্রোত সম্পর্কে উদাসীনতা।

আমার বাঁ দিকে যে পাদরিটি বসে আছে সে আমার অনেক দিনের পরিচিত-এখন পাদরি বটে, কিন্তু জীবনের প্রথম অর্ধেকটা কাটিয়েছে শিবির ও যুদ্ধক্ষেত্রে এবং উলউইচ সামরিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে। এই মূহুর্তে আমি যখন কথা বলছি তখন তার চোখে একটা অদ্ভুত আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল; ভোজসভার নায়কের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে একটু ঝুঁকে পড়ে আমার কানে বলতে লাগল:

গোপনে বলছি-এই লোকটি একটি মহামূর্খ!

তার কথা শুনে অবাক হলাম। তার বক্তব্যের লক্ষ্য যদি নেপোলিয়ন, বা সক্রেটিস, বা সলোমন হত, তাহলেও আমি এর চাইতে বেশী অবাক হতাম না। দুটি বিষয় আমি খুবই সচেতন: মাননীয় ভদ্রলোকটি কঠোর সত্যবাদী, এবং মানুষ সম্পর্কে তার ধারনা আভ্রান্ত। আমি নিঃসন্দেহে বুঝতে পারলাম যে আজকের নায়ক সম্পর্কে মানুষের ধারনাটা ভুল: সে একটি বোকা লোক। কাজেই তখন। ভাবলাম, নিজে নিঃসঙ্গ, নির্জনে যাপন করলেও এই গোপন তথ্য সে কি করে সংগ্রহ করল, সুযোগ মত সে খবরটা পাদরি মশায়ের কাছে থেকে জেনে নিতে হবে।

কয়েকদিন পরেই সুযোগটা এল, আর পাদরি আমার এই কথাগুলি বলল:

প্রায় চল্লিশ বছর আগে আমি ছিলাম উলউইচ–এর সামরিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তরুণ স্কোর্সবি-র যখন প্রথামিক পরীক্ষা চলছিল তখন আমি একটা বিভাগে উপস্থিত ছিলাম। সেদিন সত্যি আমার করুণা হয়েছিল, কারণ ক্লাসের আর সমস্ত চটপট সুন্দর উত্তর দিল, কিন্তু সে-আরে, বলতে গেলে সে তো কিছুই জানতে না। ছেলেটি এমনিতে সৎ, মিষ্টি, মনের মত ও সরল; কাজেই সে যখন পাথরের মূর্তির মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল এবং এমন সব জবাব দিতে লাগল যেগুলি বোকামি ও অজ্ঞানতার চরম পরাকাষ্ঠা, তখন তাকে দেখে সত্যি কষ্ট হয়েছিল। তার জন্য অনুকম্পায় আমার মনটা গলে গিয়েছিল। মনে মনে ভাবলাম, আবার যখন তার পরীক্ষা শুরু হবে তখন তো সে চিৎপটাং হবেই; কাজেই তার সেই অবধারিত পতনকে যদি একটু মোলায়েম করে দিতে পারি তো তাতে কারও কোন ক্ষতি হবে না। তাকে একপাশে ডে কে নিয়ে দেখলাম যে সিজারের ইতিহাসটা তবু সে খানিকটা জানে, আর কিছুই জানে না। তাই সিরাজ সম্পর্কে যে ধরনের বাধা প্রশ্ন সাধারণতই পরীক্ষায় কার হয়ে থাকে আমি বিশেষ যত্ন নিয়ে সেগুলিই তাকে পাখি পড়ার মত করে শিখিয়ে দিলাম। আপনি কি বিশ্বাস করবেন, পরীক্ষার দিন সেই ছেলে কৃতিত্বের সঙ্গে বেরিয়ে গেল! স্রেফ পাখি-পড়া বিদ্যা নিয়ে সে পাশ করল, প্রশংসাও পেল, আর অন্য যারা তার চাইতে হাজার গুণ বেশী জানে তারা ফেল করে বসল। এমনই অদ্ভুত তার ভাগ্য-তেমন ভাগ্য এক শতাব্দীতে দুবার ঘটে না-যে তাকে শেখানো বুলির বাইরে একটা প্রশ্নও তাকে করা হল না।

ঘটনাটা হতবুদ্ধিকর। দেখুন, একটি পঙ্গু ছেলের প্রতি মায়ের মনে যে মমতা থাকে সেই মনোভাব নিয়ে পুরো পাঠ ক্রমটায় আমি তাকে সাহায্য করে গেলাম; সব ক্ষেত্রেই সে উদ্ধার পেয়ে গেল-স্রেফ অলৌকিক ভাগ্যের জোরে।

অবশ্য আমি জানতাম, শেষ পর্যন্ত গণিতের বেলায়ই তার সব বিদ্যা ধরা পড়ে যাবে, সে মারা পড়বে। স্থির করলাম, তার মৃত্যুটাকে যতটা সহজসাধ্য করা যায় চেষ্টা করে দেখব; কাজেই আমি তাকে নিয়ে শুরু করে দিলাম যে ধরনের প্রশ্ন পরীক্ষকরা সাধারণত করে থাকেন তাই নিয়ে অনুশীলন আর পাখি-পড়ানো, পাখি-পড়ানো আর অনুশীলন, আর তারপরে তাকে ছেড়ে দিলাম ভাগ্যের হাতে। ভাবুন তো স্যার, ফলটা কি হল: আমাকে হতবাক করে দিয়ে সে প্রথম পুরস্মরটি বাগিয়ে নিল! তাই তাই নিয়ে তাকে সম্বর্ধনা জানানোর সে কি হিড়িক!

ঘুম? একটা পুরো সপ্তাহ আমি ঘুমুতে পারলাম না। দিনরাত বিবেক আমাকে দংশন করতে লাগল। আমি যা করেছি করুণাপরবশ হয়েই করেছি, বেচারির পতনটাকে একটু সহনীয় করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। কিন্তু যা ঘটল সে রকম ভয়ংকর ফলাফলের কথা আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি। নিজেকে ফুাংকেনস্টিনের মতই দোষী ও শোচনীয় মনে হতে লাগল। একটা কাঠের মাথাকে আমি তো। উজ্জ্বল ভিবষ্যৎ ও গুরু দায়িত্বের পথে তুলে দিলাম। কিন্তু এর ফলে তো এও হতে পারে: প্রথম সুযোগেই সব দায়-দায়িত্ব নিয়ে সে একেবারে পপাত ধরণীতলে।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সবে বেঁধেছে। নিজের মনেই বললাম, যুদ্ধ তো বাঁধতেই হবে। শান্তি বজায় রেখে তো ধরা পড়বার আগে এই গাধাটাকে আমরা মরবার একটা সুযোগ দিতে পারতাম না। একটা ভূমিকম্পের জন্যই আমি অপেক্ষা করে ছিলাম। ভুমিকপ এল। কিন্তু যখন এল তখন আমারই মুণ্ডু ঘুরে গেল। একটি যুদ্ধযাত্রী সেনাবাহীনীতে তার ক্যাপ্টেন হবার খবর গেজেট–এ ছাপা হল। সেনাদলের অনেক ভাল লোককে ঐ পদে উঠতে বুড়ো হয়ে মাথার চুল পাকিয়ে ফেলতে হয়। অথচ এ রকম অপরিপক্ক ও অনুপযুক্ত কাঁধে যে এত বড় দায়িত্বের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হবে তা আগে কে জানত? তাকে যদি একজন পতাকাবাহী সেকি এরা হত তাও না হয় সইতে পারতাম; কিন্তু একেবারে ক্যাপ্টেন-ভাবুন তো! মনে হল আমার সব চুল সাদা হয়ে যাবে।

ভাবুন তো আমি কি করলাম-এই আমি যে বিশ্রাম করতে ও নিষ্কর্মা থাকতেই এত ভালবাসে। নিজেকে বললাম, এর জন্য দেশের কাছে। আমিই দায়ী, আর তাই তার সঙ্গে সঙ্গে থেকে যতটা পারি তার হাত থেকে দেশকে বাঁচাবার চেষ্টা আমাকে করতেই হবে। তাই অনেক বছর ধরে অনেক খাটুনি খেটে অনেক কষ্ট করে পয়সা বাঁচিয়ে যৎসামান্য যে অর্থ আমি সঞ্চয় করেছিলাম সেটা হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে গিয়ে তার সেনাবাহিনীতেই একজন পতকাবাহী সৈনিকের চাকরি প্রায় কিনে ফেললাম এবং দুজনে একসঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে পা বাড়ালাম।

আর সেখানে-আরে মশায়, সে কী ভয়ংকর অবস্থা। ভুল?-আরে, সে তো ভুল ছাড়া আর কিছুই করে নি। কিন্তু লোকটার গোপন কথা তো কেউ জানত না। সকলই ভুল করে তার উপরেই আলো ফেলত, আর প্রতিবারই তার কাজকর্মের ভুল ব্যাখ্যা করত। ফলে তার বোকা-বোকা ভুল গুলোকে তার প্রতিভার প্রকাশ বলে মনে করত। ভাল মানেই তারা তা করত! তার অতি ছোট খাট ভুল ও যে কোন লোককে কাদিয়ে তুলতে যথেষ্ট; সেগুলি সত্যি সত্যি আমাকে কাদিয়েই ছাড়ত-গোপনে তা নিয়ে আমি রেগে কাই হতাম। আর সে সব ভাবসাব দেখে ভয়ে আমার ঘাম ঝড়ত তা হল-যত সে নতুন নতুন ভুল করে চলল ততই তার সুনাম বাড়তে লাগল! নিজেকে বললাম, একদিন সে এত উঁচুতে উঠবে যে সব কথা যেদিন ফাস হয়ে যাবে সেদিন তার পতন হবে আকাশ থেকে সূর্যটারই ছিটকে পড়ার মত।

সে এগিয়েই চলল; উন্নতির ধাপের পর ধাপ পরিয়ে, তার ঊর্ধ্বতন অনেক অফিসারের মৃতদেহকে মাড়িয়ে। তারপর একদিন-যুদ্ধের চরম মুহূর্তে আমাদের কর্ণেলের পতন হল, আর আমার বুকটা কেঁপে উঠল, কারণ পদাধিকারের দিক থেকে তারপরেই স্মের্সাবির স্থান। বললাম, এবার সময় হয়েছে: দশ মিনিটের মধ্যেই আমরা শেওল-এ নামতে পারব।

ভীষণ লড়াই চলছে; মিত্রপক্ষ রণক্ষেত্রের সর্বত্রই ধীরে ধীরে হটে যাচ্ছে। আমাদের বাহিনীর অবস্থানটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; এখন একটা ভুলের অর্থই ধ্বংস। সেই সংকট মুহূর্তে সেই চিরকালের মূর্খ লোকটি করল কি-সেনাবাহিনীকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে নিকটবর্তী এমন একটা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হবার হুকুম দিল যেখানে একটি শত্রুসৈন্যও থাকবার কথা নয়! নিজেকে বললাম, এবার হয়ে গেল! শেষের দিনটি ঐ এল!

আমরা এগিয়ে চললাম। এই অভিযানের পাগলামিটা ধরা পড়বার আগেই আমরা পাহাড়ের উপরে উঠে গেলাম। সেখানে কি দেখলাম? অপ্রত্যাশিত একটা গোটা সংরক্ষিত রুশ সেনাদল! আর কি ঘটল? আমরা কচু–কাটা হলাম? প্রতি একশটার মধ্যে নিরানব্বইটা ক্ষেত্রে তাই অবশ্য ঘট বার কথা। কিন্তু না; একটি মাত্র সেনাদল সেই সময়ে সেখানে ফুর্তি করতে আসবে এ কথা রুশরা ভাবতেই পারে নি। নিশ্চয় গোটা ইংরেজ বাহিনীটাই উঠে এসেছে, এবং রুশদের চালাকি ধরা পড়ে গেছে, তাদের পথ আটকে দেওয়া হয়েছে কাজেই তারা লেজ গুটিয়ে যে যে ভাবে পারল সদলবলে পাহাড় থেকে নেমে মাঠ ধরে ছুটতে লাগল, আর আমরাও তাদের পিছন থেকে তাড়া করলাম। যুদ্ধক্ষেত্রে রুশদের শক্ত বাহটা তারাই ভেঙ্গে ফেলল; তার ভিতর দিয়ে তারাই প্রাণপণে ছুটে চলল। ফলে একটা অভূতপূর্ব বিশৃংখলার সৃষ্টি হল এবং তার ফলে মিত্রপক্ষের পরাজয় রূপান্তরিত হল একটি চূড়ান্ত চমৎকার জয়ে! মার্শাল ক্যান্ত্রবার্ট বিস্ময়ে, প্রশংসায়, আনন্দে অভিভূত হয়ে সব দেখল; তখনই ডেকে পাঠাল স্কোর্সবি-কে, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, আর সমবেত বাহিনীর সামনে সেই যুদ্ধক্ষেত্রেই তাকে নতুন সম্মানে ভূষিত করল!

আর তখন স্কোর্সবি কি ভুল করেছিল জানেন? শুধুমাত্র তার ডান হাতটাকে বাঁ হাত বলে ভুল করেছিল-বাস, ঐটু কুই। তার উপর হুকুম এসেছিল, পিছিয়ে গিয়ে আমাদের ডান দিকটাকে জোরদার করতে হবে; তার পরিবর্তে সে এগিয়ে গেল সামনে, পাহাড় ডিঙিয়ে গেল বাঁ দিকে। কিন্তু সেদিন এক আশ্চর্য সামরিক প্রতিভা হিসাবে যে সুনাম সে অর্জন করেছিল তাতে সারা জগৎ তার গৌরব-গাথায় ভরে উঠল, আর ইতিহাসের পুথিগুলি যতদিন থাকবে ততদিন সে গৌরব ম্লান হবে না।

একটা মানুষ যতদূর ভাল হতে পারে, মিষ্টি স্বভাব, প্রিয় ও সরল হতে পারে, সেও তাই, কিন্তু বৃষ্টি নামলে যে কি করতে হবে সেটাও সে জানে না। এটাই সম্পূর্ণ খাঁটি কথা। সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গর্ধভ; সে এবং আমি ছাড়া এ কথাটা আধ ঘণ্টা আগেও আর কেউ জানত না। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর একটা অসাধারণ বিস্ময়কর ভাগ্য তাকে তাড়া করে ফিরেছে। এক যুগ ধরে আমাদের সবগুলো যুদ্ধের সে এক সফল সৈনিক; তার সমস্ত সামরিক জীবনটাই ভুলে ভর্তি, অথচ এমন একটি ভুলও সে করে নি যার ফলে সে নাইট, বা ব্যারনেট, বা লর্ড উপাধিতে ভূষিত হয় নি। তার বুকের দিকে তাকিয়ে দেখুন; দেশী ও বিদেশী সম্মান-নিদর্শনে বুকটা ভর্তি হয়ে গেছে। কি জানেন স্যার, ওর প্রতিটি পদক কোন না কোন সোচ্চার নির্বুদ্ধিতার স্মারক; আর সবগুলি মিলিয়ে তারা এই কথাই প্রমাণ। করছে যে, এ জগতে মানুষের কপালে সব চাইতে বড় জিনিস যা জুটতে পারে সে হল ভাল ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করা। ভোজসভায় যা বলেছি, আবারও সেই কথাই বলছি, স্কেবি একটি মহামূর্খ।

[১৮৯১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *