ভাগের মা – মানব চক্রবর্তী
এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে একটু আগে, বাতাসে জলের গন্ধ, একদিক ঢালু পিচরাস্তায় জল গড়াচ্ছিল মৃদু শরশর শব্দে, তারই মাঝে দাঁড়িয়ে রিকশাওলা—লোকটার মাথামুখ ঢাকা একটা সবুজ পলিথিন প্যাকেটে, গেঞ্জিলুঙ্গি জলে ভেজা। সে মাথামুখ আচ্ছাদিত পলিথিন প্যাকেটটা খুলব কি খুলব না ভাবছিল, মাঝে মাঝে অন্ধকার আকাশ দেখছিল আর সম্মুখস্থ বাড়িতে উজ্জ্বল আলোর নীচে কিছু সবুজ-সবুজ মানুষ—জলছোপালি সবুজ পলিথিনের ভেতর থেকে তার চোখে সবই সবজে ঠাহর দিচ্ছিল; যদিও খানিক আগে বৃষ্টিতে ভেজাকালীন সে ছিল রেগে টং। সওয়ারি যাবে বলে ডেকে এনে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখলে রাগ হওয়ারই কথা—তারপর বৃষ্টি।
রাত্রি এগারোটা দশ। আশেপাশের বাড়ি থেকে দু’চারটি ক্ষীণ ছায়া সবুজে অন্ধকারে কিম্ভূত, বৃষ্টির কারণে যারা এতক্ষণ আসতে পারেনি, তারা গুটিগুটি এগিয়ে এল। ওদের চলা, শব্দহীন, দৃষ্টি নির্বাক, শেষ জেনে গেলে শূন্যতায় মথিত নিঃশ্বাস যেমন ভারী ঠেকে, তেমনই, ভারবাহী চলন, প্রশ্নহীন চাহনি—কেবলমাত্র যেন সামাজিক দায় থেকে উদ্ভূত এই বিদায়কালীন উপস্থিতি—এতকালের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের।
ট্রেনের সময় আরও দেরিতে। বারোটা বিয়াল্লিশ, অধিকন্তু এক ঘণ্টা লেট; অর্থাৎ একটা বিয়াল্লিশের আগে আসার সম্ভাবনা নেই, তবু এই আড়াইঘণ্টা আগে এমন যাওয়ার পিছনে সরসীবালার মাথায় যে চিন্তাটি তখনও ক্রিয়াশীল তা-পরদিন সকালে ছোট বউমার মর্নিং শিফ্ট ডিউটি ও দুটি নাতিনাতনির প্রভাতকালীন স্কুল। এদিকে শুতে রাত হলে ওদিকে উঠতে ওদের যদি দেরি হয় এমত দুশ্চিন্তা তাঁর নিজের শরীরের কাহিল অবস্থার চেয়েও বেশি গুরুত্বের বোধ হওয়ায় রাত্রি এগারোটা দশেই রিকশায় চাপলেন সরসীবালা, যদিও প্রতিমা, ছোট বউমা, খানিক আগে, বলেছিল ‘একটু ঘুমিয়ে নিন মা আমি একটা নাগাদ ডেকে দেব।’
‘ঘুম…উঃ, আর কত…এবারে আমার মহাঘুম…’ বলেই প্রতিমার এককালের মুখরা শাশুড়ি স্তব্ধ হয়েছিলেন আচমকা, ছোট ছেলে সর্বেশ্বরের হাত চেপে ‘উঃ…আঃ…ওরে…কী যন্ত্রণা…বিষব্যথা…’ ইত্যাদি অর্ধস্ফুট শব্দঘ্যাঙ্গানি-যোগে, খাট থেকে প্রায় গড়ানে ভঙ্গিতে নেমেছিলেন—বৃষ্টির তখনও ধাক্ ছিল খুব তাই এগোননি।
এখন বৃষ্টি নেই। রিকশায় সরসীবালা। পাশের বাড়ির হেমচন্দ্রের মা, অতি বৃদ্ধা, আঁচলের গেরো খুলে মায়ের প্রসাদী কালোকালচে জবা ফুল এগিয়ে ধরলেন, কিন্তু সরসীবালার মাথার নাগাল না পাওয়ায় তা চিবুকের প্রায় হাতখানেক দূরত্বে পঞ্চপ্রদীপ নাচানোর মতো হাতের মৃদু আন্দোলনে বিড়বিড় করলেন বিপত্তারিণী মন্ত্র, অবিনাশ মজুমদারের স্ত্রী নিবিড় উচ্চারণে ‘আহা…চিন্তা করেন ক্যান…পোলারা সঙ্গে যাইতাছে, আপনে ভাইগ্যবান, সব ঠিক হইয়া যাইব’ বলতে অন্য প্রতিবেশী ধনঞ্জয় দাস যোগ করলেন,‘কলকাতায় কত বড় বড় ডাক্তার, কত সিরিয়াস পেশেন্ট সুস্থ হয়ে যাচ্ছে, আপনি ঠিক ভাল হয়ে যাবেন মাসিমা…’
রিকশায় সরসীবালা—স্থির, এসব শুনছিলেন অথবা শুনছিলেন না, চেয়েছিলেন আকাশের দিকে— বৃষ্টিশেষের চাঁদ, ফটকিরি আলোয় তাথাইয়া, মাঝে মাঝে মেঘেদের লুকিছুপি।
সরসীবালার পাশে একজন বসা দরকার, অসুস্থ ও দুর্বল তিনি যেন অকস্মাৎ ঝাঁকুনিতে পড়ে না যান। অথচ বসে কে—এই নিয়ে দুই পুত্র রামেশ্বর ও সর্বেশ্বরের মধ্যে শালীনতার তবকবন্দি কিঞ্চিৎ বাদানুবাদ চাগাড় দিচ্ছিল মাঝে মাঝে।‘তুই মা’র পাশে বোস সর্ব—রামেশ্বর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাসুলভ গাম্ভীর্যে এমন বলতে, সর্বেশ্বর জবাব দেয়—‘আহা…তুমিই বসোনা…আমি স্কুটার নিয়ে পাশে পাশে আসছি।’
‘কেন…স্কুটার কি আমি চালাতে জানি না নাকি! ওটা আমি চাই, তুই বরং মাকে ধরে বোস…’
ভাশুরের এহেন জাঁকমিশ্রিত কথায় সর্বেশ্বরের চাকুরিকরা বউ প্রতিমার স্বরে ছোট্ট ঢেউ ভাঙে চিকন ও ক্ষণস্থায়ী হাসিতে—‘ওটা বেতো ঘোড়া, দশবার কিক্ দিলে তবে চালু হয়, আপনি পারবেন না দাদা খামোখা পায়ে চোট…’
প্রতিমার বাক্য শেষ হওয়ার আগেই রামেশ্বর ফের কথার ঘুঁটি গড়ান দেয় সজোর উচ্চারে ‘হু…আঠারো বছর বয়স থেকে স্কুটার মোটরবাইক চালাচ্ছি, সেই তিরিশ বছর আগের থেকে…
এমন অনর্থক কথা ও পাল্টা কথার বুনুনিতে সময়ক্ষেপ হচ্ছিল, সরসীবালার মুখচোখে যন্ত্রণার দাগ, তবু সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিল না গুরুতর অসুস্থ মায়ের পাশে বসে কে; ফলে একসময় সরসীবালা নিজেই ম্লান মুখে, ছেঁড়াফাটা স্বরে বলে ওঠেন, ‘থাক…একা…একাই যেতে পারব…তোরা দু’জনেই স্কুটারে চেপে আয়…’
‘তুমি পারবে মা?’ প্রায় একসঙ্গে দুই ছেলে একই প্রশ্ন করে কিছুটা নিশ্চিন্তত্ততা কিছুটা দুর্ভাবনায় যখন ‘কী করি কী করি’ ভাব, তখনই দলমা ও দোলনা, নয় ও ছয়, সর্বেশ্বরের পুত্রকন্যা ঘুমজড়ানো চোখে ‘টা টা’ দেয় আম্মাকে, ‘সাবধানে যেও, বাপির হাত ধরে থাকবে…তুমি ঠিক ভাল হয়ে যাবে আম্মা।’
সরসীবালার চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে, তিনি শীর্ণ হাতে চশমা নামান, আঁচলের খুঁটে খুব মনোযোগ সহকারে কাঁচ মোছেন, পরে, একটু ধাতস্থ গলায় ‘ভাল থেকো…ভাল থেকো…দুষ্টুমি কোরো না ভাইবোন’—ইত্যাদি রোজকার বলা কথাগুলিই গম্ভীর স্বরে, ছিন্ন বিষন্ন, থেমে থেমে বলেই মুখ ফেরান রিকশাওলার দিকে, হাতের মৃদু আন্দোলনে ইঙ্গিত করেন—আগে বাঢ়ো…
ততোমধ্যে রিকশাওলার মাথার পলিথিনের প্যাকেটটি হাতে। সে আর সবুজ দেখছিল না মানুষ। স্ট্রিট লাইটের ম্রিয়মাণ আলোয় বৃদ্ধার ভাঙাচোরা মুখের ছবি স্পষ্টতর, দুই পুত্রের উদগ্রীব চাহনি, ব্যস্ততা, পড়োশিদের সান্ত্বনা, টুকরো কথা—ইত্যাদি সবকিছুই এমনভাবে ফুটে উঠেছিল যাতে করে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার কারণে সঞ্চিত রাগ ফিকে হয়ে আসছিল।
যতটা সাবধানে সম্ভব, রিকশা চলতে থাকে পিচপথে। ক্রমশ অন্ধকারে ঢাকা পড়েন সরসীবালা, আর সর্বেশ্বর বেতো ঘোড়াকে চাগানের জন্য কিকের পর কিক মারতে থাকে। একসময়, যখন সে সগর্জনে জাগে, ঘর্ঘর ও থরোথরো শব্দের আড়ালে বড় ভাই রামেশ্বর বলে ওঠে “মা-র স্ট্যামিনা দেখেছিস! বায়াপসি রিপোর্ট পজিটিভ জেনেও কেমন স্টেডি!’
‘ঠিক বলেছ…আজকালকার দিনে এমন বিশেষ দেখা যায় না। ক্যান্সার শুনেই মানুষ যেখানে ভিরমি খায়—’ বলার মাঝে গিয়ার চেঞ্জ করে সর্বেশ্বর এবং পিছু ফিরে প্রতিমার উদ্দেশে ‘কলকাতার হাসপাতালে অ্যাডমিট করেই আমি চলে আসব…ওদের ইস্কুল যেন কামাই না হয়’ বলতে বলতে ক্রমশ এগিয়ে যায়।
ফাঁকা রাস্তায়, অন্ধকারে, স্কুটারে আলোয় অল্প পরেই দেখা যায় রিকশাটিকে, যা ধীর লয়ে চলছিল, এবং সরসীবালা বসেছিলেন ঘাড় কাত করে। স্কুটার যেই মুহূর্তে রিকশার পাশাপাশি, আলো সম্মুখে প্রসারিত, সরসীবালার মুখ দেখা যায় না—পাশে পাশে ডিগডিগ শব্দের মধ্যে চলতে থাকা দুই পুত্রের একজন, রামেশ্বর, দায়িত্বমিশ্রিত স্বরে ‘অসুবিধে হচ্ছে না তো মা’ বলতেই সর্বেশ্বর যোগ করে ‘হলে বলবে কিন্তু…আমি তোমার পাশে বসব।’
এমন কথায় রিকশার ঘেরবন্দি অন্ধকার থেকে সরসীবালার স্বর ঝাঁঝে কাঁপন দেয়—‘কী তখন থেকে এক কথা…তোরা যা, স্টেশনে গিয়ে দাঁড়া..আমি ভালই আসছি…’
ফলে সর্বেশ্বর মৃদু মোচড় দেয় অ্যাক্সিলেটারে আর ক্ষণপূর্বে অগ্রজর বলা মায়ের স্ট্যামিনা সংক্রান্ত বক্তব্যের সাক্ষাৎ প্রমাণ পেয়ে ‘রিয়েলি, এমন অ্যাডভ্যান্স স্টেজে এইরকম মনের জোর কিন্তু দেখাই যায় না’ বলে দ্রুত অতিক্রম করতে থাকে মধ্যরাতের ঘুমন্ত ঝিল, চৌরাস্তার খর্বুটে আইল্যান্ড, আকাশমণি আর রাধাচূড়ার ছাউনি দেওয়া ঘনান্ধকার সরণি—ক্রমে একসময় স্টেশনের আউটার কেবিনের লালনীল সিগন্যাল বাতি দৃশ্যমান হয়।
এর মধ্যে রামেশ্বর, মায়ের জন্য উদ্বিগ্ন, মাঝে মাঝেই ঘাড় ফিরিয়ে ফেলে আসা পথ দেখছিল, যদিও অন্ধকারের মধ্যে টোপ্পাই কুলসদৃশ দু’চারটি নিঃসঙ্গ বিজলিবাতি ও হঠাৎ হঠাৎ ছুটে আসা গাড়ির ‘শির-চক্ষু’ বিনা অন্য কিছু নজরে পড়ছিল না।
সর্বেশ্বর তার স্কুটারখানি যতক্ষণে অদূরস্থিত সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে আসে, ততক্ষণে স্টেশন রোড সংলগ্ন রাত্রিভোর চালু মধুসূদনের চা দোকানে ভাড়ে চা পান করছিল রামেশ্বর। সম্ভবত রাতের ট্রেনে মাকে, কলকাতা নিয়ে যাওয়ার হ্যাপা সংক্রান্ত উত্তেজনা কাটান দিতে ওই ঈষদুষ্ণ পানীয়ে নিমগ্ন ছিল সে। এমন সময় রকমারি শব্দ তুলে পশ্চিমাগত রাতের বাস দ্রুত ছুটে আসে এবং দাঁড়ায়। ভাগলপুর-রাঁচি রুটের বাসখানি তখনও ফোঁসাচ্ছিল, তার ইস্পাতের চাদরমণ্ডিত দেহ কাঁপছিল থরোথরো। ভেতরের নীল-অন্ধকারে সিটে ঘুমন্ত সারি সারি মানুষ। তাদের বাক্সপ্যাঁটরা, উড়ুক্কু কনডাকটারের কাঁধঝোলা পয়সার ব্যাগসহ ঝপ্ করে নামা, গম্ভীর ড্রাইভারের দুলকি পদক্ষেপে চায়ের জন্য ইশারা—এইসব দেখতে দেখতে রামেশ্বর সাময়িক বিস্মৃত হয় পিছনে পড়ে থাকা সরসীবালার কথা। তার চোখ সামনের কাচে ‘রাঁচি’ শব্দটির ওপর নিবদ্ধ। আগামী পূজোয় রাঁচি ও নেতারহাট ভ্রমণের একটা মৃদু ইচ্ছা ক্রমশ স্ফীত হয়ে উঠেছিল মনে, হুড্রু ফলস্ জোনার ফলস্-এ এর কল্লোলিনী শব্দ প্রবলতর ভাবে বাজছিল, নেতারহাটের সূর্যোদয় মনোহর চমৎকারিত্বে হামা দিচ্ছিল বুকের গহনে।
ফলে সর্বেশ্বর যখন রামেশ্বরের কাছে এসে ঈষৎ উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, ‘এখনও তো রিকশা দেখা যায় না’—জবাবে রামেশ্বর মোহগ্রস্তের মতো বিড়বিড় আউড়ে দেয়,‘রাঁচি পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগে রে সর্ব?’
সর্বেশ্বরের বিস্ময় বাঁধ মানে না। সে একটু জোরের ওপর বলে ওঠে ‘রাঁচি! হঠাৎ রাঁচির কথা যে! হিহি…ওখানেই তো পাগলাগারদ…’
‘দেখবার জায়গাও বটে!’
‘হ্যাঁ, তা বটে। পাগলাগারদও দর্শনীয়। আমি পাগল দেখেছি, কিন্তু একসঙ্গে অ-নে-ক—’
‘ধুস…রাঁচি দারুণ স্বাস্থ্যকর জায়গা…খুব ঠাণ্ডা…ওখান থেকে নেতারহাট, হাজারিবাগের ন্যাশনাল ফরেস্ট…কত কী দেখার জায়গা…ভাবছি আসছে পুজোয় তোর বউদিকে নিয়ে একবার—’
এমনসময় পিছনের অন্ধকারে দূরাগত গরুর গলায় ঘন্টাধ্বনির মতো টুংটাং টুংটাং শব্দ বেজে উঠতে রামেশ্বর তার কথা অসমাপ্ত রেখে দু’কদম পেছিয়ে যায়, তার সঙ্গে সর্বেশ্বরও, দুই ভাইয়ের নজরে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দর্শায় না, অথচ ওই ঘণ্টাধ্বনি ক্রমশ জোরালো হতে থাকে। ফলে একসময় অন্ধকার ফুঁড়ে জোয়ালটানা ষাঁড়ের ভঙ্গিতে, মাথা-কাঁধ ঝুঁকিয়ে হ্যান্ডেলে হাত রেখে, পয়দল, চড়াই-ঠেলা বিহারী রিকশাওলার ছবি স্পষ্ট হয়। কাছে আসতে দেখা যায় শতচ্ছিন্ন গেঞ্জি ঘামে সপসপে। সরসীবালা বসেছিলেন স্থির। তাঁর নজর সোজা। অথচ সোজা ছিল অনেক কিছুই। প্রাণাধিক পুত্রেরা, আলোকিত স্টেশন, রাঁচি-ভাগলপুরের বাস, ক্লান্ত-ঘর্মাক্ত রিকশাওলাটি, ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো রাতের যাত্রীরা, এমন কি পরিপার্শ্বে উনুনে ভুট্টা পোড়াতে ব্যস্ত এক গ্রাম্য রমণীকে ঘিরে কিছু পশ্চিমাপুরুষ। সরসীবালার নজর ঠিক কোনখানে তা সর্বেশ্বর ও রামেশ্বরের মাথায় ঢোকে না, অথচ মায়ের এই অসুখে তাদের কাতরতা ও চিন্তা যেহেতু মাত্রাতিরিক্ত তাই বিমূঢ় রামেশ্বর একসময় মায়ের ওই নির্বাক, হিমথম দৃষ্টি দেখে ফিসফিসিয়ে ছোটভাইকে বলে ওঠে, ‘লক্ষ করেছিস, সর্ব, মার চোখদুটো…কেমন ভ্যাকেন্ট লুক…’
‘হ্যাঁ দাদা, তুমি ঠিক বলেছ, মনে হয় শেষের সীমা দেখতে পেলে মানুষের তখন অমনই—
তখনই রিকশাওলা পয়সার জন্য হাত বাড়ালে সর্বাগ্রে পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করে রামেশ্বর, যদিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দীর্ঘশ্বাসমর্থিত শূন্যস্বর বিকুলি কাটে সশব্দে ‘ইসস্…যাঃ…’। সর্বেশ্বর চকিতে মুখ ফেরালে সে ফের বলে ‘আমার কাছে যে খুচরো নেই, সব একশ টাকার নোট…ঠিক আছে তুই দিয়ে দে সর্ব…’
সর্বেশ্বর বিরক্তি গোপন রাখে চিলতে হাসির উজালায়, পরে রিকশাভাড়া মিটিয়ে সরসীবালাকে নামানোর জন্য হাত বাড়াতেই তিনি ‘থাক্…আমি নিজেই নামতে পারব’ বলায় কিঞ্চিৎ গুটিয়ে যায়। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে মায়ের ভাবগতিক কেমন যেন পাল্টে গেছে। হাত গুটিয়ে নিলেও সর্বেশ্বর, ছোটছেলে, যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে, এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে যাতে বোঝা যায় সামান্য বেতাল বুঝলেই সে পতন রোধ করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু না, সরসীবালা পড়েন না।
রিকশা থেকে নেমে গজ বিশেক পাকা রাস্তা পার হয়ে তবে স্টেশন চত্বর, খান বিশেক সিঁড়ি দিয়ে যার শুরু। সর্বেশ্বর ও রামেশ্বর সরসীবালার দুইপাশে, অতন্দ্র প্রহরী যেন, সতর্ক নজর; মৃদুমন্দ তালে, গুটিগুটি, এমনভাবে হাঁটতে থাকে যা দেখে স্টেশনে অপেক্ষারত মানুষজন সহজেই বুঝতে পারছিল ভদ্রমহিলা দারুণ অসুস্থ; আরও যা বুঝছিল তা দুই পুত্রের অকৃত্রিম মাতৃভক্তির এহেন বহিঃপ্রকাশ।
সরসীবালা খানপাঁচেক সিঁড়ি ভেঙে দাঁড়িয়ে পড়তে রামেশ্বর উদ্বিগ্ন স্বরে বলে ওঠে, ‘কষ্ট হচ্ছে মা? তবে একটু দাঁড়াও, স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে কথা বলে দেখি একটা স্ট্রেচার পাওয়া যায় কিনা—’
‘স্ট্রেচার পাওয়া যাবে না দাদা, হুইল চেয়ার পেলেও পেতে পার’ এমন বলে সর্বেশ্বর দাদার উদ্বিগ্নতায় থাবা বসায়।
কিন্তু স্ট্রেচার বা হুইল চেয়ার কিছুই আনার প্রয়োজন হয় না কারণ ততক্ষণে সরসীবালা আরও পাঁচটি সিঁড়ি অতিক্রম করে ফের দাঁড়িয়ে পড়েছেন, হাঁফ ছাড়ছিলেন, তাই দেখে রামেশ্বর তার একহাত ধরে উৎসাহ টগবগ স্বরে, দীর্ঘমেয়াদী দৌড়ের শেষ পাকে পরিশ্রান্ত দৌড়বীরকে যে ভাষায় চাঙ্গা রাখে তার ব্যক্তিগত ট্রেনার, সেভাবেই বলে ওঠে ‘কিপ ইট্ আপ…আর মাত্র কটা…সাবাস্—’
সরসীবালা কী বোঝেন কে জানে! তবে বড় ছেলের এমন উৎসাহব্যঞ্জক কথায় তাঁর চোখের নিভু আলো উজ্জ্বল হয় না, যন্ত্রণাদগ্ধ মুখের ভাঁজ কাটে না, শুধু ঠোঁট দুটি মৃদু নড়তে থাকে—যা অনেক কিছু বলার পূর্বাভাষ বা কিছুই না বলার উপসংহার, যা কিছু একটা হতে পারে। তিনি আলগোছে রামেশ্বরকে দেখেন, এবং অবলীলায় হাতের ওপর রাখা হাতখানি সরিয়ে আরও তিনটি সিঁড়ি ভেঙে ঝপ করে বসে পড়েন ওই ধূলিমলিন কালচেটে সিঁড়িতে।
‘কী হল! কী হল!’ দুই পুত্র ঝুঁকে পড়ে আর্তনাদে, উদ্বিগ্নতায়।
সরসীবালার চোখ ফেলে আসা পথের পানে। তিনি অপলক চোখে দেখছিলেন দূরের অন্ধকার এবং অন্ধকারের গা-লাগোয়া কেবল অন্ধকারে ছাওয়া বার্ধক্যের বারাণসী।
হুইল চেয়ার বা স্ট্রেচার ছাড়াই বাকি সিঁড়িগুলি অতিক্রম করে সরসীবালা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে এসেছেন, অতি ধীরে। একটা ফাঁকামতন বেঞ্চ দেখতে পেয়েই সর্বেশ্বর ছুটে যায় দ্রুত, কাছে আসতে দেখে ফাঁকা নয়—একটা টেনিয়া-চেহারার ছেলে, চালচুলোহীন, অকাতরে ঘুমোচ্ছিল।
সে আর দেরি করে না, একটা হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে কর্কশ গলায় বলে ওঠে, ‘অ্যাই ওঠ— এটা কি শোবার জায়গা!’ ঘুম ভেঙে ছেলেটি বিস্ময়ে থ। সে রা কাড়ে না। বরং সর্বেশ্বরের মারমুখী ভাবসাব দেখে গুটিগুটি উঠে দাঁড়ায় বগলে কুণ্ডলীকৃত ছেঁড়া চাদরখানি চেপে, এবং ওই নাতিদীর্ঘ জীবনে অসংখ্যবার উদ্বাস্তু হওয়ার মতো আরও একবার শ্রাবণের মধ্যরাতে নতুন জায়গার সন্ধানে হাঁটা দেয়। স্বীয় সাফল্যে উৎসাহিত সর্বেশ্বর তখনও বকবক করছিল ‘যতসব চোর-ছ্যাঁচোড়…হঁ, পা ছড়িয়ে ঘুম…স্টেশন তো নয় যেন মামার বাড়ি…’
এরই মধ্যে সে খবরের কাগজ দিয়ে ঝেড়ে তা বেঞ্চে পেতে ফেলে এবং রামেশ্বরের উদ্দেশে হাঁক ছাড়ে, ‘এদিকে নিয়ে এসো দাদা…এখানেই শুইয়ে দাও মা-কে…’
সরসীবালা বিনা বাক্যব্যয়ে শুয়ে পড়েন, ঘাড় মাথা একপাশে কাত, চকচকে, সমান্তরাল, গিট্টির স্তুপে চাগানো অনির্দেশে ছুটে চলা রেললাইনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কিছু পরেই ঝমঝম শব্দ তুলে ফাইভ আপ হাওড়া-অমৃতসর মেল থামতে ঘুমন্ত স্টেশন আড়মোড়া ভেঙে জেগে ওঠে। মাঝরাতে কান্নার মতো চা-ওলার হাঁক ভেসে বেড়ায়। সরসীবালা চোখ খোলেন এবং সেভাবেই, ঘাড়মাথা কাত করে আলোআঁধারি কামরাগুলির দিকে চেয়ে থাকেন, তখন তার পায়ের কাছে সর্বেশ্বর মাথার কাছে রামেশ্বর।
চুপচাপ বসে থাকা সর্বেশ্বর দারুণ একটা মানসিক অস্বস্তিতে ছিন্ন হচ্ছিল। ক্ষণপূর্বে রিকশাভাড়া বারো টাকা সে দিয়েছে, তা বড় কথা নয়, আরও বড় যা, এখনও ট্রেনের টিকিট কাটা হয়নি। এই মফঃস্বল শহর থেকে হাওড়া স্টেশনের টিকিটের মূল্য আটান্ন টাকা। সর্বেশ্বরের চিন্তা যত বাড়ছিল তত ভাবছিল মায়ের টিকিট কাটার ব্যাপারটা নিয়ে। কেন যেন তার বারে বারেই মনে হচ্ছিল মায়ের টিকিটের টাকা রামেশ্বরেরই দেওয়া উচিত। এমন যুক্তিপূর্ণ চিন্তার পেছনে যে প্রধান কারণগুলি কাজ করছিল তা, একে তো রামেশ্বর বড় ছেলে, তায়, মায়ের অসুস্থতার শুরু থেকে আজ অবধি ডাক্তার দেখানো, রক্ত পরীক্ষা, হিস্টো-প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের খরচা, ওষুধ এবং পথ্য, সবই সর্বেশ্বর করেছে—যেহেতু সরসীবালা তার কাছে থাকে।
সুতরাং মালদহ থেকে মায়ের অসুস্থতার বাড়াবাড়ির দিনে এসে পৌঁছানো রামেশ্বরের যে সামান্য এই ভাড়ার টাকাটা দেওয়া উচিত এ ব্যাপারে আর কোনও সংশয় ছিল না বলেই ভাবনার তালে তালে সর্বেশ্বরের অস্বস্তি বাড়ছিল। সর্বেশ্বর মুখ ফিরিয়ে রামেশ্বরের মনের ভাব পড়তে চেষ্টা করছিল যতই, ততই আটান্ন টাকার আশংকা কাঁটালো ফণীমনসার ঝোপ হয়ে সেঁদিয়ে যাচ্ছিল বুকে।
এমন সময় রামেশ্বরের চা-তেষ্টা পায়। সামান্য দূর দিয়ে হেঁটে চলা এক চা-ওলাকে ডাকে, সে কাছে এসে প্রথম ভাঁড়টি তুলে দেয় রামেশ্বরের হাতে, দ্বিতীয় ভাঁড় এগিয়ে দেয় সর্বেশ্বরের দিকে। সর্বেশ্বর তা না ধরে প্রথমেই পকেট থেকে খুচরো দু’ টাকা বার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কারণ, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা—টিকিট কাটার সময় সে অবশ্যই হাত গুটিয়ে রাখবে, বিশেষত সরসীবালার, এবং এজন্যই ছোটখাট খরচাগুলি এখন দরাজ হাতে করতে চায়। প্রথমে রিকশাভাড়া পরে চা—এসবের পর টিকিট কাটার সময় রামেশ্বর অন্তত, চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও বাধ্য হবে মায়ের টিকিট কাটতে।
দুই ভাই চা পান করছিল নিঃশব্দে, আর মাঝেমধ্যে মুখ ফিরিয়ে দেখছিল চোখ বুঁজে শুয়ে থাকা সরসীবালাকে। এর মধ্যে রামেশ্বর, চা শেষ হতে ভাড়খানি রেললাইনে ছুড়ে বলে ওঠে ‘তোর চিঠি পাওয়ামাত্র মালদা থেকে চলে এলাম, একে মেয়েদের পরীক্ষা, তায় মাসের শেষ…’
এমন কথায় সর্বেশ্বরের শংকা বাড়ে, ফলে সেও প্রতিমার নিজের চাকরি, বাচ্চাদের স্কুল, উপরন্তু মায়ের সেবা, এই তিনের সংমিশ্রণে নিরন্তর খাটুনি ও কর্তব্যের বাখান দেওয়া আবশ্যক মনে করে, এবং দেয়ও; সবশেষে অনুচ্চারিত ক্ষোভ ও বিরক্তিতে, দার্শনিকসুলভ স্বরে, গুরুত্বপূর্ণ টীকার মতো জুড়ে দেয়—‘যুদ্ধটা যে দেশের মাটিতে হয়, সেই বোঝে আসল ক্ষয়ক্ষতি।’ এমন কথায় প্রকারান্তরে, সরসীবালার ছোট ছেলের বাড়িতে থাকা নিয়ে বড় ভাইয়ের উদ্দেশে যে তোপ দাগে সর্বেশ্বর, তা যথেষ্ট নিরীহ স্বরে বলা বলেও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া বড় কম নয়। এভাবেই সময় কাটছিল। এর মাঝে আবার দুটি বড় ঘণ্টা বাজে—খানকয় ছোট ও লাগোয়া আপ ট্রেনের ঘণ্টা ঘোষিত হয়। তিন নম্বর প্ল্যাটফর্মে সাউথ বিহার এক্সপ্রেস আসার কথা।
চায়ের পর অনিবার্যভাবে ধূমপানের ইচ্ছা জাগে রামেশ্বরের। সে সর্বেশ্বরের উদ্দেশে বলে ‘চল, একটু হাঁটাহাঁটি করি…।’ অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরায় সে এবং অন্য একটা এগিয়ে দেয় সর্বেশ্বরের দিকে, ‘নে খা, মা ঘুমোচ্ছেন…।’
সর্বেশ্বরের সিগারেট ধরানো হলে রামেশ্বর উৎসুক মুখে প্রশ্ন করে ‘তা হ্যাঁরে সর্ব, বড়মামাকে খবর দিয়েছিলি?’
‘হ্যাঁ, ফোন করেছিলাম।’
‘কী বললেন?’
‘বললেন ভাল করে চিকিৎসা করাতে, আরও বললেন, সুউপায়ী দুই ছেলে কত কষ্টে তোমাদের মানুষ করেছে সরসী—এখন তো তোমাদের করার সময়। প্রাণ ঢেলে সেবা করো…’
রামেশ্বর ঘন ঘন টান দিচ্ছিল সিগারেটে, ফলে তার মুখ ও নাসাপথে গলগলে ধোয়া, এভাবে সিগারেটের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ শেষ হতে তা দূরে ছুড়ে দেয় এবং কুঞ্চিত মুখে বলে ওঠে ‘হ…জ্ঞান দেওয়ার স্বভাবটা এখনও গেল না, যাদের অনেক থাকে তারা সবাই অমনিই…’।
সর্বেশ্বর আরও একবার শ্লাঘাবোধের সুযোগ পেয়ে যায়, অধিকতর গাম্ভীর্যে মুখচোখ কুঁচকে রেললাইন ধরে দৃষ্টিকে চালান দেয় অনির্দেশে, এবং একটি নির্ভুল তীর ছোড়ে যা বসিরহাটবাসী বড়মামাসহ রামেশ্বরকেও দারুণ বিদ্ধ করে—‘বললাম না…ওই যে…যুদ্ধটা যে দেশের মাটিতে হয়…’
রামেশ্বর তখন আউটার সিগন্যালের লালবাতি দেখছিল। অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকার পর সে দুঃখ দুঃখ মুখে জানায়—‘জানিস সর্ব, মা’র খবর পেয়েই তিন হাজার টাকা লোন নিয়েছিলাম। যেদিন আসব তার আগের দিন হঠাৎ শ্বশুরমশাইয়ের চিঠি। চোখ অপারেশনের জন্য টাকার দরকার। মল্লিকার সে কী কান্নাকাটি। এদিকে মায়ের এই অবস্থা। শেষে অনেক ভেবে দেখলাম—আমার মায়ের তবু দুই ছেলে, পাশে দাঁড়ানোর লোক আছে, কিন্তু মল্লিকার বাবার কে আছে বল। এখনও ঘরে দুটো আইবুড়ো মেয়ে, রিটায়ার্ড মানুষ…ভাড়া বাড়িতে বাস, সব কিছু চিন্তা করে শেষে…’
সিগারেটের শেষটা পায়ে মাড়ায় সর্বেশ্বর, নিরুৎসাহে। মিছেই দু’কদম এগোয়। আপ ও ডাউন লাইন দেখে। থুতু ফেলে। কিছুক্ষণ থম্ ধরে থাকে, পরে অনতিদূরে কাঠের বেঞ্চে শয়ান সরসীবালার দিকে চেয়ে অস্ফুটে বলে ‘দুই ছেলে চাকরি করে, মা আমাদের ভাগ্যবান…’।
রামেশ্বরের আহত মুখভঙ্গি স্টেশনের অনুজ্জ্বল আলোয় বেশ বোঝা যায়, সে তড়িঘড়ি মুখ ফেরায় অদূরস্থিত মায়ের দিকে এবং ‘হুউশ্’ শব্দে ছুটে যায় কারণ একটা বেওয়ারিশ কুকুর তখন সরসীবালার ঝুড়িব্যাগের ঘ্রাণ নিচ্ছিল লোভার্ত দৃষ্টিতে—যদিও ওতে এক বোতল ফোটানো জল, দুটি সায়া, শাড়ি, ব্লাউজ, প্রেসক্রিপশান, বায়াপসি রিপোর্ট, এক্স-রে ছবি, ব্লাড রিপোর্ট ইত্যাদি ভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ছিল না মোটে।
কিছুক্ষণ স্টেশন চত্বরে এলেবেলে পায়চারি শেষে ঘড়িতে যখন বারোটা পঞ্চাশ, সর্বেশ্বর সরসীবালার সামনে এসে দাঁড়ায়, এবং মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রামেশ্বরের উদ্দেশে একটু যেন বাড়তি জোর দিয়ে বলে, ‘চলো…এবারে তা হলে টিকিট কাটতে হয়…একটা বাজতে চলল…’
‘হ্যাঁ…ঠিক বলেছিস,…টিকিট…জানিস, সিক্সটি ফাইভে একবার রেলের অ্যাপ্রেনটিসে কল পেয়েছিলাম, আসিনি…এখন আপশোষ হয় খুব…’এমন ছেঁড়া ছেঁড়া, অর্থহীন, দু’চারটি কথা শেষ করে রামেশ্বর উঠে দাঁড়ায় এবং ধীর পায়ে চলতে শুরু করে। সে দিক ভুল করেছিল, যেদিকে টিকিট কাউন্টার নয়—ওভারব্রিজ, সেই দিকে, সম্ভবত অনিচ্ছাকৃত, সে মালদহবাসী, হয়তো বা সে কারণে— কিন্তু সর্বেশ্বর, এমন উল্টো হাঁটার অন্য তাৎপর্য চিন্তা করে, প্রথমটা শংকিত ও পরে বিদ্রুপে ভরভরাট স্বরে ‘ওদিকে কোথায় যাচ্ছ…ইউরিন্যাল..এদিকে টিকিট কাউন্টার’ বলতে রামেশ্বর ঈষৎ লাজুক মুখে ফেরান দেয়—কিন্তু গতি তার ধীর, অধিকন্তু রাত্রিজাগরণের অনভ্যাসে ঝিমকালা।
সর্বেশ্বর থেমে ছিল। থেমেই থাকে যতক্ষণ না রামেশ্বর আসে, যতক্ষণ না দুই ভাই পাশাপাশি সমান্তরাল রেখাসদৃশ হয়। এর পর দুজন চলতে থাকে এবং সে চলা ধীরে চলো প্রতিযোগিতার অচেনা দুই প্রতিযোগীর মতো। ওরা যত না চলছিল, ততোধিক থামছিল। একসময় হঠাৎ রামেশ্বর দাঁড়িয়ে পড়ে, তার ‘কুয়োভ্যাদিস্’ জুতোর একটা খুলে আসা স্ট্র্যাপ নিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করতে থাকে যা দেখে সর্বেশ্বর অনিচ্ছাসত্ত্বেও পান দোকানে দাঁড়ায়। অনভ্যাসের পান মুখে ফেলে চুনের জন্য কড়ে আঙুল বাড়িয়ে দিতে, ততোমধ্যে রামেশ্বর পাশাপাশি হয়, সমানে সমানে এবং শম্বুকগতিতে টিকিট কাউন্টারের সামনে উপনীত হয়।
‘দুজনে দাঁড়ানোর কী দরকার, একজন দাঁড়ালেই তো তিনটে টিকিট কাটা যায়’—রামেশ্বরের এমন কথায় সর্বেশ্বরের বুকে আশংকার গুপগুপি তীব্রতর হয়, সে ঝটিতি জবাব দেয়, ‘তাহলে তুমিই দাঁড়াও দাদা…’
এতে রামেশ্বর তীব্র বিতৃষ্ণায় ফের নিজের জুতোর দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে এবং পরক্ষণেই উবু হয়ে ছেঁড়া স্ট্র্যাপ নাড়াচাড়া করতে করতে আক্ষেপে বলে ওঠে ‘ফাঁকিবাজ…জুতোর কোম্পানিগুলো আজকাল বেজায় ফাঁকি দিচ্ছে…এত দামের জুতো…’
লাইনে ভিড় বাড়ছিল। ওদের প্রায় শরীর ঘেঁষে লাইন, তবু কেউ লাইনে নয় ওরা। এমত অবস্থায় ট্রেন চলে আসলে বিপদ…এই দুশ্চিন্তায় তিতিবিরক্ত সর্বেশ্বর আর রাখঢাকের পরোয়া করে না, কিঞ্চিৎ চড়া স্বরে হাঁকে, ‘দাও দাদা, দুটো ভাড়া দাও…আমিই লাইনে দাঁড়াচ্ছি…’
রামেশ্বর জুতোর মাথায় বেরিয়ে থাকা আঙুল নাচায় অল্পসময়, পরে বুকপকেটে আলাদা করে রাখা একটি পঞ্চাশ টাকার সঙ্গে আরও চারটি দশ টাকার—সাকুল্যে নব্বই টাকা, বার করে জোরের সঙ্গে বলে ‘নব্বই আছে—’
লাইনে দাঁড়ানো সর্বেশ্বর নব্বইয়ের রহস্য বুঝতে কিঞ্চিৎ সময় নেয়। পরে মনে মনে, একজনের ভাড়া আটান্ন বলে অন্যজনের অর্ধেক-উনত্রিশ, মোট সাতাশি—এই সরল সমীকরণটি বুঝে খুশি না হলেও অখুশি হতে পারে না এই জন্য যে, তবু সরসীবালার অর্ধেক ভাড়া রামেশ্বরের দেওয়া—
আরও বড় কথা, ব্যবস্থাটি যখন রামেশ্বর নিজেই চালু করেছে, চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এমন সহজ সরল ভাগবণ্টন ব্যবস্থা চালু থাকবে নিশ্চয়—এমত আশায়, অবশেষে সর্বেশ্বর কিছুটা হালকা বোধ করে। লাইন ধীরে ধীরে কাউন্টারের দিকে এগোচ্ছিল। টিকিট কাটার শেষে সর্বেশ্বর, তিন টাকা সযত্নে হাতে নিয়ে রামেশ্বরকে বলে ‘এই নাও দাদা…’
‘এ আবার কেন?’
‘আহা…মায়ের আধাআধি হল না। এ তোমার প্রাপ্য…’
‘মায়ের আধাআধি’ শব্দের প্রচণ্ডতা এই সময় অদূরবর্তী এক গুডস ট্রেনের গুমগাজানি শব্দে ভেঙে চূর্ণ হয়, রামেশ্বর ও সর্বেশ্বর উভয়েই উৎকর্ণ, ক্ষণপরে ধাবমান মালগাড়ির চলে যাওয়া শেষ হলে দুজনেই তৃষ্ণা বোধ করে এবং প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠে ‘তবে একটু চা হোক।’
চা পান শেষ হতে রামেশ্বর ও সর্বেশ্বর সরসীবালার দুইপাশে এসে বসে। রামেশ্বর দেখতে পায় ছোটভাই অসুস্থ মায়ের শীর্ণ দুটি পায়ের পাতা কোলে নিয়ে অসীম মমতায় আঙুল টেনে দিচ্ছিল, সঙ্গে সঙ্গে সেও সরসীবালার মাথাখানি পরমযত্নে নিজের কোলে টেনে নেয় এবং চুলে বিলি কাটতে থাকে।
নির্জন স্টেশন চত্বরের লম্বা পিলারের হিমথম ছায়া ফালি কাটছিল সরসীবালাকে ঠিক মাঝামাঝি, এমন সময় ডাউন ট্রেনের ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং, ঘোষণা হয় হাওড়াগামী ট্রেনের আগমনী।
সরসীবালার মুখ যন্ত্রণায় নীল, ক্ষীণস্বরে তিনি ‘জল…জল’ বলতেই দুই পুত্র দুদিক থেকে ঝুঁকে পড়ে, সর্বেশ্বর দ্রুত বোতল থেকে দু ঢোক জল খাইয়ে ছিপি বন্ধ করতেই রামেশ্বর শুধায় ‘আর খাবে মা?’
সরসীবালার মাথা যেভাবে অতি ধীরে নড়ে ওঠে তাতে হ্যাঁ বা না কিছুই বোঝা যায় না, তবু রামেশ্বর, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, সামান্য জল মুখে ঢালে। কিছুটা হয়তো যায়, কিছু চিবুক বেয়ে গড়ায়।
ট্রেন আসে, থামে, এবং চলে যায়।
শিয়রে রামেশ্বর, পায়ের কাছে সর্বেশ্বর—এমন আত্মজ দুই ঈশ্বরের মধ্যে ভাগের মা ভাগ্যবতী— ঘুম ভাঙে না।
২১ এপ্রিল ১৯৯৬