ভাগলপুরের পাঞ্জাবি
রেলগাড়ির কামরার জানলা দিয়ে অনেক দামদর করে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের হকারের কাছ থেকে একটা চাদর কিনেছিলাম। মধ্য রাত, বোধহয় ভাগলপুর স্টেশন ছিল সেটা, বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা।
ফিকে হলুদ রঙের। বেশ শক্ত বুনোট, লম্বায় চওড়ায় বেশ প্রমাণ সাইজের চাদর সেটা। বেশ একটা মুগা মুগা ভাব আছে, লোকাল জিনিস, দামও তেমন বেশি ছিল না।
অল্প শীতে বাড়ির মধ্যে বা পাড়ার মধ্যে গায়ে দেওয়ার জন্যে চমৎকার চাদর। এবং তাই ভেবেই কিনেছিলাম।
কিন্তু কলকাতায় এসে যে কী দুর্মতি হল অবশ্য কারণও একটা ছিল, তখন সবে মোটা হতে শুরু করেছি, পুরনো জামা-প্যান্ট, পাঞ্জাবিগুলো কেমন টাইট হচ্ছে, ফিট করছে না, সেই ভাগলপুরি চাদরটা দরজির দোকানে নিয়ে সেটা কেটে একটা পাঞ্জাবি বানাতে বললাম।
ক্রমশ মোটা হয়ে যাচ্ছি এই চিন্তা মাথায় রেখে কিন্তু কথায় গোপন করে দরজিমশায়কে বললাম, একটু বড়সড় ঢিলেঢালা করে বানাবেন, কাপড়টা ড্রিঙ্ক করতে পারে।
দরজিভদ্রলোক অবশ্য ওজাতীয় নির্দেশের পক্ষপাতী নন, জামাকাপড় একটু চাপা, একটু বেশি ফিট করার দিকে তাঁর ঝোঁক। তিনি আমার অনুরোধ রাখেননি। পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে দেখলাম ঢিলেঢালা মোটেই করেননি, বরং একটু টাইটের দিকে।
যা হোক পাঞ্জাবিটা গায়ে দিতে লাগলাম। এদিকে ঠিক সেই সময়ে আমার দেহে মেদের জোয়ার শুরু হয়েছে। বন্ধুবান্ধব আমার বুদ্ধির প্রশংসা করা আরম্ভ করেছে, বলছে, এতদিনে তোর বুদ্ধি খুলছে, তোর মাথার ফ্যাট, ঘিলুর চর্বি গলে শরীরে নামছে।
বন্ধুবান্ধবের ঠাট্টা, অপমান, কোনওদিনই আমি সেসব কিছু গায়ে মাখিনি, তা হলে আমার বিদ্যাবুদ্ধি জ্ঞানগম্যি নিয়ে আমি করে খেতে পারতাম না।
বন্ধুদের এই কটুকথার মধ্যে অবশ্য একটা সত্যি ব্যাপার ছিল, দেহের ওজন বাড়লে স্বাভাবিক কারণেই লাফালাফি, দৌড়ঝাঁপ কমে যায়, জীবনে স্থিরতা আসে, ঠান্ডা মাথায় বসে চিন্তা করে কাজ করা যায়, বোকামি কমে।
তখন আমার বোকামি দ্রুত, অতি দ্রুত কমছে। সপ্তাহে সপ্তাহে ওজন বাড়ছে, ওজনের সঙ্গে তাল রেখে আয়তন মানে প্রস্থ। প্রস্থ এত বাড়ছে যে মনে হচ্ছে, দৈর্ঘ্য কমে যাচ্ছে, আগে লোকেরা আমাকে লম্বা না হলেও বেঁটে ভাবত না। আমাকে বেঁটে ভাবা তখন থেকেই আরম্ভ।
অফিস-কাছারি করি। সেখানে শার্ট-প্যান্ট পরেই যেতে হয়, সেটাই প্রচলিত বিধি। আবার অবসরে রবিবার বা ছুটির দিনে কখনও পাঞ্জাবি গায়ে দেওয়ার সুযোগ জোটে।
এই ভাবে প্রথম মাস দুয়েকে দু-তিন ঘণ্টা করে পাঁচ সাতবার পাঞ্জাবিটা পরিধান করার সুযোগ মিলল।
অবশ্য ওটাকে সুযোগ না বলে দুর্যোগই বলা উচিত। কারণ তখন আমি প্রতিনিয়ত ফুলে ফেঁপে উঠছি। জগু বাজারের মতো অকুস্থলে বাঙালি দোকানদারেরা পর্যন্ত আমাকে বাজারে দেখলে, আইয়ে শেঠজি বলে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে।
তখন আমার দমবন্ধ অবস্থা। পেটমোটা ওয়াটারকুলার বোতলের ছিপি হোমিওপ্যাথিক ওষুধের শিশির কর্ক যেমন খাপে খাপে ফিট করে যায়, যেমন নিচ্ছিদ্র, না বাতাস–সেই ভাগলপুরি চাঁদরের পাঞ্জাবিটা সেই ভাবে আমার শরীরে চেপে বসে। দম আটকিয়ে আসে মনে হয় আমি ভীম ভবানী, বুকের ওপর হাতি নিয়েছি। জামার বোতাম আটকাই না, শুধু হাঁসফাস করি। অথচ নতুন পাঞ্জাবি, ফেলেও দিতে পারি না।
.
ভাগ্য ভাল, এই দু মাসের ব্যবহারে পাঞ্জাবিটা বেশ মলিন হয়েছিল, সুতরাং এটি একদিন আমার সুলক্ষণা স্ত্রীর নজরে পড়ল তিনি সেটা ধোপাবাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
সপ্তাহ খানেক বাদে ধোপাবাড়ি থেকে পাঞ্জাবিটা ফেরত এল। ফিকে হলুদ ফিকেতর হলুদ হয়েছে তবে সর্বত্র নয়। একটু চিতাবাঘ চিতাবাঘ ভাব সেই সঙ্গে বুনোনটা আর তত জমজমাট নয় কেমন ঝ্যালঝেলে মনে হল। ভয় হল হয়তো আরও ছোট হয়ে গেছে।
পরের রবিবার দিন সকালবেলায় বাসায় এক সম্পাদিকার আসার কথা ছিল, তার সৌজন্যে ভয়ে ভয়ে ভঁজ ভেঙে পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে দেখলাম, কতটা ছোট হয়েছে, গায়ে দেওয়া যাচ্ছে কি না। কিন্তু কী আশ্চর্য, পাঞ্জাবিটা মাথায় গলিয়ে গায়ে চাপিয়ে, আবিষ্কার করলাম মোটেই টাইট নয়। চমৎকার ঢিলেঢালা, হৃদয় থেকে নাভির মধ্যে চমৎকার বাতাস খেলছে।
সঙ্গে সঙ্গে উল্লসিত হয়ে উঠলাম, ধরে নিলাম আমার মেদ ঝরছে, ওজন কমছে, আয়তন কমছে। গলির মোড়ের ওষুধের দোকানে একটা ওজনের মেশিন বসিয়েছে, সেখানে ছুটে গিয়ে গর্তে একটা আধুলি ঠেলে ওজন নিলাম। কিন্তু এ কী? আমার ওজন আরও দু কেজি বেড়েছে। তা হলে?
তা হলে? ব্যাপারটা বুঝলাম আর দেড়মাস পরে। ততদিনে ওই পাঞ্জাবি আমার শরীরে আবার প্রায় প্রকৃতিদত্ত চামড়ার মতো টাইট হয়ে বসে গেছে। অর্থাৎ আমি আরও প্রসারিত হয়েছি।
এদিকে পাঞ্জাবিটা আবার ময়লা হয়েছে, দেড় মাসের মাথায় ধোপাবাড়ি থেকে আরেকবার কেচে আসতে গায়ে দিয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখলাম আমার শরীরে সুন্দর গলে যাচ্ছে, বেশ ঢিলেঢালা যেমন আমার পছন্দ। আমার মেদাধিক্য এবং ভুড়ি দুইই বেশ ঢাকা পড়েছে। কাঁচতে দেওয়ার আগের সেই টাইট অবস্থাটা আর নেই তবে একটা অসুবিধে হয়েছে জামার স্কুল এবং সেই সঙ্গে হাতা দুটো খুব বেড়ে গেছে। আজকাল লম্বা ঝুল পাঞ্জাবি চলছে, সে যাহোক, কিন্তু হাতা দুটো প্রায় ছয় ইঞ্চি বেড়ে গেছে, একসঙ্গে হাতা ও দস্তানার কাজ করছে, তার মধ্য থেকে হাত দুটো বের করে আনা বেশ কঠিন। কঁচি দিয়ে কেটে ফেলে গৃহিণী সে সমস্যা দূর করলেন।
ইতিমধ্যে আমার মনে বৈজ্ঞানিক জিজ্ঞাসা দেখা দিয়েছে। পরের বারে পাঞ্জাবিটা ধোপার বাড়িতে না পাঠিয়ে এক ছুটির দিনের সকালে আমি নিজেই কাঁচলাম। কেচে একটা হ্যাঁঙ্গারে করে তারে ঝুলিয়ে দিলাম।
এর পর কেউ বিশ্বাস করবে না জানি। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পেলাম পাঞ্জাবি বেড়ে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে ঝুল এগোচ্ছে, হাত লম্বা হচ্ছে। বিকালে শুকোনোর পর গায়ে দিয়ে দেখি আমার মোটা হওয়ার সঙ্গে তাল রেখে পাঞ্জাবিটা বেড়েছে, একটু বেশিই বেড়েছে, একটু ঢিলেই হয়েছে, যেটা আমার পক্ষে বেশ ভাল।
ইতিমধ্যে গত কিছুকাল ধরে আমি প্রবল স্ফীত থেকে স্ফীততর হয়েছি। কত দামি দামি শৌখিন জামাকাপড় ছোট হয়ে গেছে, বরবাদ হয়ে গেছে।
কিন্তু পাঞ্জাবিটা আছে। ঝুল এখন সেমিজের মতো প্রায় গোড়ালি পর্যন্তই আলখাল্লাই বলা চলে তবে হাত দুটো প্রত্যেকবার কাঁচার পরে তিন ইঞ্চি করে হেঁটে নিই, না হলে একটু অসুবিধা হয়।