প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – ভাই-ফোঁটা
‘ভাই-ফোঁটা’ সম্পর্কে বাঙালী সমাজের কাছে খুব বেশী কিছু বলবার দরকার হবে বলেতো আমার মনে হয় না। ‘ভাইফোঁটা’ হল ভাইয়ের জন্য বোনের মঙ্গল কামনা। সারা বছরই বোন সে ছোটই হউক, কি বড়ই হউক, দাদা বা ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু না কিছু পেয়ে আসছে, শুধু এই দিনটিতেই বোনের কাছে ভাইয়ের প্রাপ্য। এর সঙ্গে নেপালীদের “তিওহার” উৎসবের একটা বেশ মিল আছে। ভাই-বোনের যে মধুর সম্পর্ক—তাকে ভিত্তি করে ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও অন্য রকম উৎসব চালু আছে। আপাততঃ আমাদের বাংলার ‘ভাই-ফোঁটা’ উৎসবের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিকেই বলা হয় ভাতৃদ্বিতীয়া বা ভাই-দ্বিতীয়া। কেউ কেউ বলেন ‘যম-দ্বিতীয়া’। ফলশ্রুতি অনুসারে যমরাজের ভগ্নী যমুনা এই বিশেষ দিনে যমরাজকে ভাই-ফোঁটা দিয়েছিল। সেই থেকেই এই প্রথাটির প্রচলন। এর ছড়ার ভিতরও এর যেন একটু আভাস মেলে। এই দিন ভোর থেকেই প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে বোনেদের ভিতর সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কেউ কেউ এই দিনে ভাইকে কী কী খাওয়াবে সেই নিয়ে আগে থেকেই জল্পনা-কল্পনা শুরু করে, তার ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতও হয়। কেউ কেউ যতক্ষণ না ভাইয়ের কপালে, ফোঁটা দেওয়া হয় ততক্ষণ জলস্পর্শও করেনা। কোথাও সকালে কোথাও বা প্রদোষে (সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে) ভাই-ফোঁটা দেবার প্রথা আছে। অনেকের ভিতর আবার ভাই-ফোঁটায় বারদোষ দেকেহো সে বছর ভাই ফোঁটা বন্ধ থাকে। তাদের শনি-মঙ্গলবার ভাই-ফোঁটা পড়োলে তারা ফোঁটা দেয়না, শুধু ভাইয়ের হাতে খাবারের থাকা তুলে দেয়। অনেকেই খাবারের সঙ্গে ভাইকে নতুন জামা কাপড় দিয়ে থাকে। যার যেমন সাধ্য, সে সেই ভাবেই ভাইকে ফোঁটা দেয়। তাদের বিশ্বাস এই দিন এই ছড়া বলে ভাইকে চন্দন তিলক পরিয়ে দিলে ভাইয়ের পরমায়ু বৃদ্ধি হয়।
সকালে বা সন্ধ্যায় যখনই হোক না কেন, ভাইকে বসান হয় পিঁড়ি অথবা কোনো আসনের উপর। তার সামনে জ্বালিয়ে দেয় প্রদীপ, আর সুমুখে থাকে একখানা বাটা, তাতে থাকে ধান, দূর্বা প্রভৃতি। এরই পাশে থাকে এক থালা (যার যেমন সাধ্য) মিষ্টি সামগ্রী।
ভাই প্রথমে বোনের দেওয়া নতুন কাপড় পরে বসে এসে পিঁড়ি বা আসনের উপর। বোন পানের বোঁটায় করে কাজল পরিয়ে দেয় ভাইয়ের চোখে, তারপর বাঁ হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলীর সাহায্যে চন্দন নিয়ে ভাইয়ের কপালে পড়িয়ে দিতে দিতে মন্ত্র (?) বা ছড়া বলতে থাকে :—
প্রতিপদে দিয়ে ফোঁটা, দ্বিতীয়াতে নিতে,
আজ হতে ভাই আমার, যমের ঘরে
নিমের অধিক তিতে।
ঢাক বাজে, ঢোল বাজে, আরও বাজে কাড়া,
বোনের ফোঁটা না নিয়ে ভাই,
না যেও যম পাড়া।
না যেও যমের ঘর,
আজ হতে ভাই আমার রাজ রাজেশ্বর।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দেই আমার ভাইর কপালে ফোঁটা।
ভাইর কপালে দিলুম ফোঁটা,
যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা।।
তিনবার চন্দন সহ এই শ্লোক (ছড়া) বলে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয় বোন, আর প্রতিবার শ্লোক (ছড়া) বলা শেষ হলে ঐ কনিষ্ঠা অঙ্গুলী দ্বারা মাটিতে একটি করে কাটা X চিহ্ন এঁকে দেয়। তারপর বোন ছোট হলে ভাইকে কিংবা ভাই ছোট হলে বোনকে প্রণাম এবং মিষ্টির থালা তুলে দেয় ভাইয়ের হাতে, আর ভাই বড় হলে বোনকে, কিংবা বোন বড় হলে ভাইকে দূর্বা দিয়ে করে আশীর্বাদ।