ভাঁজ

ভাঁজ

চরণ প্রসাদের কাছে আমি এগিয়ে গেলাম। ওঁর দু-কাঁধে হাত রেখে আগুন চোখে তাকালাম। এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে প্রসাদের শরীরের ভিত পর্যন্ত নড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললাম, ‘বলুন, অমিতেশ কোথায়? কোথায় উধাও করলেন ওকে?’

চরণ প্রসাদ এতটুকু বিচলিত হলেন না। স্মিত হেসে আলতো করে আমার হাত দুটোকে ছাড়িয়ে নিলেন। তারপর স্বাভাবিক স্বরেই বললেন, ‘আপনার বন্ধু অমিতেশ সান্যাল হাইপারস্পেস-এ মিলিে গেছে।’

হাইপারস্পেস! অতি-দেশ! আমি মনে-মনে ভাবলাম। আমাদের এই ত্রিমাত্রিক জগতের বাইরে যে-দেশ তারই নাম হাইপারস্পেস। যা মানুষ চোখে দেখতে পায় না, স্পর্শ করতে পারে না, এমনকী কল্পনাও করতে পারে না—সেই রহস্যময় হাইপারস্পেস।

আমি চরণ প্রসাদের শীর্ণ শরীরটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওঁর ভেদী ধুরন্ধর চোখ দুটো যেন এক চাপা আনন্দে ঝকঝক করছে। আমার উদ্ভ্রান্ত অবস্থার দিকে এক পলক দেখে নিয়ে প্রসাদ বললেন, ‘ডক্টর বোস, এবার আমার কথা বিশ্বাস হয়েছে? শোনা এক কথা, আর চোখে দেখে বিশ্বাস করা এক কথা।’ চাপা হাসি হাসলেন তিনি।

হ্যাঁ, ভুলটা আমরাই করেছি। আমি আর অমিতেশ। আমরা দুজনেই ভারত সরকারের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করি। সাম্প্রতিক গ্রহান্তরে যাত্রার বিষয়ে প্রতিভাবান অমিতেশের বেশ কিছু মৌলিক গবেষণাও রয়েছে। আর ছেলেটা ভীষণ অনুসন্ধানী—বিশেষ করে বৈজ্ঞানিক গবেষণার বিষয়ে। ফলে এই অদ্ভুত চেহারার অপবিজ্ঞানী চরণ প্রসাদের হাতে আমাদের এই দুরবস্থা।

খবরটা প্রথম যোগাড় করেছিল অমিতেশ। একদিন ও আমাকে এসে বলল, ‘উৎপল, একটা দারুণ খবর পেয়েছি।

‘কী খবর?’ আমি সাগ্রহে জানতে চাইলাম।

‘চরণ প্রসাদ নামে একজন বিজ্ঞানীর সন্ধান পেয়েছি। লোকটার খুব উঁচু কোনও ডিগ্রি নেই, তবে হাতে-কলমে কাজ করে আর নিজে-নিজে পড়াশোনা করে বেশ কিছু গোপন আবিষ্কার করেছে। সরকার-বিরোধী গবেষণার জন্যে একবার ওর জেলও হয়। তারপর থেকেই লোকটা ভীষণ লুকিয়ে তলে-তলে সব উদ্ভট গবেষণা করে।’ একটু থেমে অমিতেশ খুব স্পষ্ট করে বলল, ‘উৎপল, সম্প্রতি লোকটা একটা অদ্ভুত যন্ত্র আবিষ্কার করেছে!’

‘কী যন্ত্র? পলকে নেপচুন-এ পৌঁছে দেওয়ার যন্ত্র?’ খানিকটা ব্যঙ্গের খোঁচা দিয়েই আমি বললাম।

কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে অমিতেশ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, অনেকটা তাই। ওঁর যন্ত্রটা অনেকটা টাইম মেশিনের মতো। তবে কিছুটা জটিল। চরণ প্রসাদ যন্ত্রটার নাম দিয়েছেন স্পেস অ্যান্ড টাইম ফোল্ডিং মেশিন—অর্থাৎ, দেশ ও কালে ভাঁজ সৃষ্টিকারী যন্ত্র। এই যে সময় ও শূন্য—তাতে এই যন্ত্র দিয়ে যে-কোনও মাপের ভাঁজ সৃষ্টি করা যেতে পারে। অনেকটা কাগজ দু-ভাঁজ করার মতো…।’

আরও অনেক কথা বলছিল অমিতেশ, তবে আমি সবটা পরিষ্কার বুঝিনি। এইচ. জি. ওয়েলস-এর টাইম মেশিন ও অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের কার্ভেচার অফ স্পেস অ্যান্ড টাইম—অর্থাৎ, দেশ ও কালের বক্রতা—ইত্যাদি থিয়োরিকে কাজে লাগিয়ে নানান কাণ্ড করে এই অপবিজ্ঞানী চরণ প্রসাদ তাঁর যন্ত্রটি তৈরি করেছেন—অমিতেশের কথায় মোটামুটি এটুকু বুঝতে পেরেছি।

তারপর ওরই পীড়াপীড়িতে রাতের অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে আমরা দুজনে রওনা হয়েছি চরণ প্রসাদের গবেষণাগার লক্ষ্য করে। পথে যেতে-যেতে অমিতে বলেছে, ‘এই যন্ত্রটা পেলে কত সুবিধে হবে জানো? বিভিন্ন গ্রহে আমরা পৌঁছে যাব চোখের নিমেষে।’

এই কথায় আমার হতবুদ্ধি ভাবটা অমিতেশের নজর এড়ায়নি। ও বলল, ‘উৎপল, একটা সাদা কাগজের দু-প্রান্তে তুমি দুটো কালির ফুটকি দাও। ফুটকি দুটোর দূরত্ব ধরো একফুট। এবারে যদি কাগজটা তুমি মাঝামাঝি ভাঁজ করে ফ্যালো,

তা হলে ফুটকি দুটো গায়ে-গায়ে পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ, এই ভাঁজের ফলে ওদের মধ্যেকার দূরত্ব একফুট থেকে সোজাসুজি শূন্য হয়ে যাবে।’

আমি ওর কথার তাৎপর্য এবারে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। বললাম, ‘অমিতেশ, তুমি কাগজ ভাঁজ করার মতো শূন্যকে ভাঁজ করতে চাও? অর্থাৎ, পৃথিবী ও নেপচুন হল কাগজের ওপরে দুটো কালির ফুটকি—ভাঁজ করলেই খুব কাছে এসে পড়বে। ফলে যে-কোনও গ্রহে আমরা নিমেষে পৌঁছে যাব?’

‘ঠিক তাই।’ অমিতেশ আমাকে সমর্থন জানাল। তারপর সাবধানে পা ফেলে পথ চলতে লাগল।

একটু আগেই ক’পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পথে কাদা-জল মাখামাখি। তার ওপর ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিঁঝির ডাক। অমিতেশ টর্চের আলো ফেলে পথ দেখিয়ে চলেছে। আমার কেমন যেন ভয়-ভয় করতে লাগল। ঠিক তক্ষুনি অন্ধকার জঙ্গলের বুক চিরে হলদে আলোর রেশ আমাদের চোখে পড়ল।

‘চরণ প্রসাদের গবেষণাগার!’ চাপা স্বরে উত্তেজিতভাবে বলল অমিতেশ। গবেষণাগারের দরজায় পৌঁছে সাংকেতিক নিয়মে নক্ করতেই এলোমেলো পোশাক পরা একটি লোক দরজা খুলে দিল। অমিতেশের কথা শুনে বুঝলাম ইনিই চরণ প্রসাদ। আপ্যায়িত হয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম। বিশাল গবেষণাগারে তিনি সম্পূর্ণ একলা মানুষ।

নিয়মমাফিক পরিচয় পর্ব ও আতিথেয়তার পাট শেষ হলে চরণ প্রসাদ উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘চলুন, যন্ত্রটা দেখবেন চলুন।’

আধো-আঁধারি অলিন্দ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। আমাদের সামনে বিচিত্র ভঙ্গিতে হেলেদুলে হেঁটে চলেছেন শীর্ণকায় অপবিজ্ঞানী চরণ প্রসাদ। আর ওঁর পিছনে আমরা দুজনে। চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছি অমিতেশের আগ্রহ আমার চেয়ে শতগুণ বেশি।

যেতে-যেতে অদ্ভুত খসখসে গলায় চরণ প্রসাদ বলে চললেন, ‘এই যন্ত্রের সমস্ত তত্ত্ব এইচ. জি. ওয়েল্স্ ও আইনস্টাইনের কাছ থেকে ধার করা। আমি শুধু যন্ত্রটা তৈরি করেছি মাত্র। ওয়েস্সাহেবের টাইম-ট্রাভেলার পৃথিবীর যেখানেসেখানে, অতীতে বা ভবিষ্যতে, যেতে পারত। আমি ভেবে দেখেছি, একমাত্র সময় ও শূন্যকে ভাঁজ করা ছাড়া এই ভ্রমণ সম্ভব নয়। ধরুন, আপনি ৫০০০ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকায় যেতে চান। তা হলে আপনাকে দুটো জিনিস ভাঁজ করতে হবে : এই ১৯৮২ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়ের যে দূরত্ব, সেটাকে; আর, এখান থেকে আকাশপথে আমেরিকার যে দূরত্ব, সেই শূন্যকে ভাঁজ করতে হবে; একমাত্র তখনই আপনার পক্ষে ৫০০০ সালের আমেরিকায় যাওয়া সম্ভব। যদি শুধু সময় ভাঁজ করেন, তাহলে ৫০০০ সালে পৌঁছোবেন ঠিক, তবে এই ভারতবর্ষেই আপনাকে বসে থাকতে হবে। আর যদি শুধু শূন্যকে ভাঁজ করেন, তাহলে আমেরিকায় অবশ্যই পৌঁছোবেন, কিন্তু সালটা হবে ১৯৮২—পাঁচ হাজার নয়।’

আমার মনে পড়ল অমিতেশের উদাহরণের কথা। কাগজের ওপরে কালির ফুটকি। এখানে সেইরকম দু-জোড়া ফুটকি। একজোড়া ফুটকি সময়ের, আরএকজোড়া দূরত্বের ফুটকি। সে কথা চরণ প্রসাদকে বললাম।

মিথ্যে বলব না, এই অপবিজ্ঞানীটির প্রতি আমার মনে কিছুটা শ্রদ্ধার ভাব জেগে উঠল।

একটু পরেই পৌঁছে গেলাম আসল ঘরে। ঘরের আকার বিশাল। ছাদটা প্রায় পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচু। আর ঘরের মেঝেটা যেন ফুটবল খেলার মাঠ। গোটা ঘরটা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এবং অজস্র উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। অবাক হয়ে ভাবলাম, এই বনে-বাদাড়ে চরণ প্রসাদ বিদ্যুৎ পেলেন কোথা থেকে? চরণ প্রসাদ হয়তো এই প্রশ্নটাই আশা করছিলেন, তাই প্রশ্ন না করতেই উত্তর দিলেন, ‘আমার নিজস্ব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। ওই যে।’ উনি আঙুল তুলে ঘরের একপ্রান্তের দিকে দেখালেন। বাইরে থেকে শুধু সীসেয় মোড়া একটা প্রকাণ্ড ঘর চোখে পড়ল। আর শোনা যাচ্ছে গম্ভীর গুঞ্জনের শব্দ।

এতসব দেখে আমি অমিতেশের কানে-কানে বললাম, “নিশ্চয়ই এর পিছনে শত্রু-রাষ্ট্রের টাকা আছে!’

অমিতেশ কিছু বলল না। শুধু হাসল। তারপর মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল ঘরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে বসানো কুড়ি ফুট উঁচু যন্ত্রটার দিকে। বুঝলাম, এটাই সেই স্পেস অ্যান্ড টাইম ফোল্ডিং মেশিন!

যন্ত্রটার সঠিক বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কয়েক হাজার যন্ত্রাংশ অত্যন্ত জটিলভাবে জুড়ে যদি অসংখ্য ইলেকট্রিকের তার যন্ত্রের সর্বাঙ্গে ঘিরে দেওয়া হয়, তা হলে হয়তো চরণ প্রসাদের যন্ত্রের কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। বিচিত্র তার আকৃতি। প্রকৃতি হয়তো আরও বিচিত্র।

চরণ প্রসাদ একটা সুইচ টিপে দিয়ে যন্ত্রটা চালু করলেন। বললেন, ‘অ্যাটমিক পাওয়ার।’ যন্ত্রের গায়ে হাজার-হাজার রঙিন আলো জ্বলতে-নিবতে লাগল। অমিতেশ নেশাগ্রস্তের মতো যন্ত্রটার কাছে এগিয়ে গেল। তক্ষুনি চরণ প্রসাদ চিৎকার করে উঠলেন, ‘সাবধান, ডক্টর সান্যাল। হাত দেবেন না। যদি ভুল করে সময়ে বা দূরত্বে ভাঁজ পড়ে যায় তাহলে আপনার হাত হাইপারস্পেস-এ মিলিয়ে যাবে!’

অমিতেশ চমকে হাত টেনে নিল। চরণ প্রসাদ এগিয়ে এসে যন্ত্রটার কার্যকলাপ ওকে বুঝিয়ে দিলেন। সবশেষে বললেন, ‘ডক্টর সান্যাল, কাগজ ভাঁজ করার উদাহরণটা দিয়ে আপনি ভালোই করেছেন। ব্যাপারটা বোঝার খুব সুবিধে। তবে তার একটা ছোট্ট তফাত রয়েছে এই যন্ত্রের কাজের সঙ্গে।’ একটু থেমে আমার দিকে এক পলক দেখে নিলেন চরণ প্রসাদ। তারপর বললেন, ‘কাগজটা আপনি ভাঁজ করছেন আমাদের খুব চেনা দুনিয়ায়—অর্থাৎ, থ্রি ডাইমেনশন্যাল স্পেস বা ত্রিমাত্রিক শূন্যে। কারণ দ্বিমাত্রিক তলে এই ভাঁজ সম্ভব নয়। তেমনি, আমার এই যন্ত্রও সময় এবং শূন্যকে ভাঁজ করে হাইপার স্পেস বা চতুর্মাত্রিক শূন্যে। কারণ, ভাঁজ করার জন্যে আমাদের অতিরিক্ত একটা জায়গা দরকার হয় — যা থ্রি ডাইমেনশন্যাল স্পেস-এ সম্ভব নয়…।’

অমিতেশ হঠাৎই বলে উঠল, ‘আমি আপনার যন্ত্রে চড়ে হাতেনাতে সব পরীক্ষা করে দেখতে চাই।’

ব্যস! চরণ প্রসাদ সঙ্গে-সঙ্গে রাজি। অমিতেশকে যন্ত্রে বসিয়ে উনি কীসব কলকবজা টিপলেন। কিছু শব্দ হল। কয়েক হাজার আলো জ্বলল, নিবল। তারপর যন্ত্রটা ছেড়ে অমিতেশ একা উধাও হয়ে গেল।

আমার ঠোঁট চিরে একটা আতঙ্কের চিৎকার বেরিয়ে এল। বুঝতে পারছি, অভিব্যক্তিও হয়ে উঠেছে বিকৃত। সেটা লক্ষ করে চরণ প্রসাদ বললেন, ‘ভয় পাবেন না, ডক্টর বোস, অমিতেশবাবুকে আমি দশ মিনিট আর একশো ফুট দূরত্বে পাঠিয়েছি। দশ মিনিট পরেই ওঁকে একশো ফুট দূরে ঘরের ওই কোণে দেখতে পাবেন।’

সুতরাং, উৎকণ্ঠায় থমথমে মুখ নিয়ে অপেক্ষায় রইলাম। ক্রমে দশ মিনিট থেকে বিশ মিনিট পার হয়ে গেল, কিন্তু অমিতেশের দেখা নেই। ভয় পেলাম। কী চায় এই অপবিজ্ঞানী? আমাদের ব্ল্যাকমেল করে মহাকাশ গবেষণার কোনও গোপন খবর আদায় করতে চায় না তো? অবশেষে যখন আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল, তখন আমি চরণ প্রসাদের কাছে এগিয়ে গেলাম। তার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে দু-কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিলাম, বললাম, ‘অমিতেশ কোথায়…??

ধীরে-ধীরে আবার বর্তমানে ফিরে এলাম। হ্যাঁ, চরণ প্রসাদের যন্ত্রের ক্ষমতা আমি চোখে দেখে বিশ্বাস করেছি। কিন্তু কী করব এখন? আমাদের আজকের এই গোপন অভিযানের কথা কেউই জানে না। অমিতেশ সবকিছু গোপন রেখেছে। এখন যদি আমি একা ফিরে যাই, তা হলে সবার কাছে কী জবাবদিহি করব? ভাবতে-ভাবতে মাথাটা আমার আগুন হয়ে উঠল। সময়ের ভাঁজে বা শূন্যের ভাঁজে এক ফুটকি থেকে আর-এক ফুটকিতে যাওয়ার সময় অমিতেশ কি অতি-শূন্যে হারিয়ে গেছে? কী করে এখন ফেরত পাব ওকে? ও কি দেখতে পাচ্ছে আমাদের? নিশ্চয়ই না।

হঠাৎই ভদ্রতা সভ্যতা ভুলে ক্রোধে অন্ধ হয়ে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম চরণ প্রসাদের ওপর। ওঁকে সহজেই ধরাশায়ী করে টুটি টিপে ধরলাম। গর্জন করে উঠলাম, ‘চরণ প্রসাদ, যে করে হোক অমিতেশকে ফিরিয়ে নিয়ে আসুন! নইলে আপনার নিস্তার নেই! আমি আপনাকে শেষ করে দেব!’ ওঁর গলার ওপর হাতের চাপ ক্রমশ বাড়াতে লাগলাম।

চরণ প্রসাদ এবার ভয় পেল। গভীর ভয়। কাঁপা গলায় বলল, ‘করছেন কী? ছাড়ুন। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি।’

ওঁকে ছেড়ে দিলাম। হাঁফাতে-হাঁফাতে উঠে জামা-কাপড় ঝেড়ে নিলেন চরণ প্রসাদ। আপনমনেই বিড়বিড় করে বললেন, ‘মাঝে-মাঝে মেশিনটার যে কী গণ্ডগোল হয়…!

এবার উনি নিজেই উঠে বসলেন যন্ত্রে। আবার নানারকম কলকবজা টিপলেন। তারপর চেঁচিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘ডক্টর বোস, আপনাকে আমার বিশ্বাস নেই। তা ছাড়া, অমিতেশবাবুকে ফেরত আনতে গেলে মেশিনটাকেও হাইপার স্পেস-এ নিয়ে যেতে হবে। মেশিনটা যে আপনার জিম্মায় ছেড়ে যেতে হচ্ছে না তাতে আমি বেশ ভরসা পাচ্ছি।’ চরণ প্রসাদ হাসলেন।

আমি উত্তরে গম্ভীরভাবে বললাম, ‘অমিতেশকে আমি এই মুহূর্তে ফিরে পেতে চাই! এক্ষুনি!’

চরণ প্রসাদ শেষ বোতামটা টিপলেন এবং ওই প্রকাণ্ড মেশ্বিন সমেত উধাও হয়ে গেলেন আমার চোখের সামনে থেকে।

এক মিনিট…দু-মিনিট…ওই তো অমিতেশ! ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে একটা নিওন লাইটের কাছে অমিতেশ আবির্ভূত হয়েছে। আচমকা ওর শরীরের আবির্ভাবের চাপে নিওন লাইটটা চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ল। আর এক মুহূর্ত শূন্যে ভেসে থেকে পরক্ষণেই মেঝেতে সশব্দে আছড়ে পড়ল অমিতেশ। আমি দৌড়ে গিয়ে ওকে তুলে ধরলাম। ও ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ, ওর ভ্রমণের খুঁটিনাটি, উধাও হওয়া, আবির্ভূত হওয়া, কিছুই ও টের পায়নি।

ও জিগ্যেস করল, ‘চরণ প্রসাদ কোথায়? ওঁর মেশিনটাই বা কোথায়?’

সংক্ষেপে অমিতেশকে সব খুলে বললাম। অবাক হয়ে দেখলাম, অমিতেশকে উদ্ধার করে কোনওরকমে ফেরত পাঠাতে পারলেও চরণ প্রসাদ নিজে এখনও হাইপার স্পেস-এর গোলকধাঁধায় ঘুরছেন। আর কোনও কথা না বলে অমিতেশকে হাত ধরে টান দিলাম। বললাম, ‘শিগগির! এক্ষুনি এখান থেকে পালাতে হবে!’ দুজনে ছুটতে শুরু করলাম দরজা লক্ষ করে। গবেষণাগারের বাইরে পা রাখার মুহূর্তে এক প্রকাণ্ড বিস্ফোরণ আমাদের ছিটকে ফেলে দিল। চারপাশের দেওয়াল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। চারিদিকে অসংখ্য আলোর ঝলসানি। কোনওরকমে উঠে আমরা প্রাণটুকু হাতে করে পৌঁছে গেলাম অন্ধকার জঙ্গলে। অমিতেশের টর্চ কোথায় হারিয়ে গেছে। ফলে জল-কাদা ঠেলে মরিয়া হয়ে ছুটে চললাম। পিছনে বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণ হয়ে চলেছে। রাতের আকাশটা যেন আতসবাজির আলোয় বারবার ধাঁধিয়ে উঠছে। বুঝলাম, চরণ প্রসাদের গবেষণাগার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।

অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর ক্লান্ত স্বরে অমিতেশকে প্রশ্ন করলাম, ‘এসব বিস্ফোরণ কী করে হল বলো তো?’

ও একটু ভেবে বলল, ‘চরণ প্রসাদ আমাকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন ঘরের মেঝের বদলে নিওন লাইটের ওপর—দেওয়ালের গায়ে। মানে ভুল জায়গায়। হয়তো মেশিনের কোনও গোলমালের ফলেই দূরত্বের ভাঁজটা ভুল জায়গায় হয়েছিল। আর উনি নিজে যখন মেশিন সমেত হাইপার স্পেস থেকে ফিরে আসেন, তখন হয়তো ভুল করে ওই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মধ্যে মেশিনসুদ্ধু গিয়ে হাজির হয়েছেন। ফলে এই বিধ্বংসী বিস্ফোরণ…’ একটু থেমে অমিতেশ দুঃখের স্বরে বলল, ‘একটা দরকারি যন্ত্রও একইসঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেল। কবে আবার মানুষ এই যন্ত্র তৈরি করতে পারবে কে জানে!’

আমি কোনও উত্তর দিলাম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *