ভস্মশেষ
প্রেমেন্দ্র মিত্র
বারান্দার এদিকটা সরু। নীচে নামবার সিঁড়িরও খানিকটা ভেঙে পড়েছে। তবু সন্ধ্যের আগে এই দিকেই চেয়ারগুলো ও টেবিল পাতা হয়—এদিক থেকে দূরে পাহাড় আর নদীর খানিকটা দেখা যায় বলে।
কৈফিয়ৎটা নিরর্থক। পাহাড় আর নদী কেউ দেখে না আজকাল একদিন হয়ত সত্যিই সেই দেখাটা ছিল বড় কথা, এখন আর তার কোনো অর্থ নেই। যা ছিল আনন্দ তা আজ অর্থহীন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বারান্দায় এই চেয়ার পাতাটুকু থেকে এ বাড়ির অনেক কিছুর, আরো গভীর কিছুর পরিচয় হয়ত পাওয়া যেতে পারে। এই কাহিনী সেইজন্যেই লেখা।
সবার আগে জগদীশবাবু এসে বসেন। নীচু ইজি-চেয়ারটি তাঁর জন্যেই নির্দিষ্টা চেয়ারের দু’ধারের হাতলে সুপুষ্ট হাতদু’টি ও সামনের টুলে পা দু’টি রেখে নিশ্চিন্তে আরামে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকা তাঁর পরম বিলাস স্বেচ্ছায় পারতপক্ষে কথা তিনি বড় বলেন না। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সুরমা একটু পরে আসেনা শাড়িতে প্রসাধনে আলুথালু ভাবা আলুথালু ভাব বুঝি প্রকৃতিতেও। এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন—’এর মধ্যেই ঘুমোলে নাকি?’
ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবু একটু নড়ে-চড়ে জানান তিনি ঘুমোন নি।
সে প্রশ্নের জবাবের জন্যে সুরমার অবশ্য কোনো আগ্রহ নেই। অভ্যাস মতই প্রশ্নটা করেন, তারপর বেতের মোড়াটিতে বসতে গিয়ে উঠে পড়ে হয়ত বলেন—’ওই যা, দোক্তার কৌটোটা ভুলে এলাম।’
জগদীশবাবু চক্ষুমুদ্রিত অবস্থাতেই বলেন—’ডাক না চাকরটাকো’
সুরমা আবার বসে পড়ে বলেন—’তাকে যে আবার বাজারে পাঠালামা যাও না গো তুমি একটু।’
ইজি-চেয়ারে জগদীশবাবুর নড়া-চড়ার কোনো লক্ষণ না দেখে মনে হয় তিনি বোধ হয় শুনতে পান নি অন্তত ওঠবার আগ্রহ তাঁর নেই।
কিন্তু সত্যি জগদীশবাবু খানিক বাদে বিশেষ পরিশ্রমে ইজি-চেয়ার ছেড়ে উঠেছেন দেখা যায়। জগদীশবাবুর আরামপ্রিয়তা ও আলস্য যত বেশিই হোক স্ত্রীর স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্ন ও দৃষ্টি তার চেয়ে প্রখরা।
জগদীশবাবুকে কিন্তু কষ্ট করে আর যেতে হয় না। বারান্দার সিঁড়িতে ডাক্তারবাবুকে দেখতে পাওয়া যায়।
সুরমা বলেন—’থাক, তোমায় আর যেতে হবে না ডাক্তার, আমার দোক্তার কৌটোটা নিয়ে। এসে একেবারে ব’সো। বিছানার ওপরই বোধ হয় ফেলে এলাম আর ঘরের আলোটা বোধ হয় নিবিয়ে আসি নি। সেটা নিবিয়ে দিয়ে এসা’
আদেশ নয়, অনুরোধেরই মিষ্টতা আছে কণ্ঠস্বরে, কিন্তু সে মিষ্টতা খানিকটা যেন যান্ত্রিক।
মিষ্টতা সুরমার সব কিছুতেই এখনো বুঝি অনেকটা আছে—চেহারায়, কণ্ঠস্বরে, প্রকৃতিতে। বয়সের সঙ্গে শরীরের সে তীক্ষ্ণ রেখাগুলি দুর্বল হয়ে এলেও তাদের আভাস আলুথালু বেশ ও প্রসাধনের মধ্য দিয়েও পাওয়া যায়। সুরমার সৌন্দর্য এখনো একেবারে ইতিহাস হয়ে ওঠে নি। অবশ্য ইতিহাস তার আর একদিক দিয়ে আছে—কিন্তু সে কথা এখন নয়।
ডাক্তারবাবু ঘরের আলো নিবিয়ে, দোক্তার কৌটো নিয়ে এসে, টেবিলের ওধারে সুরমার সামনা-সামনি বসেন নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরে। নদী ও পাহাড়ের দিকে কোনদিনই তাঁর চাইবার আগ্রহ ছিল না। বরাবর তিনি এই আসনটিতে এইভাবেই বসে আসছেন।
সন্ধ্যার অস্পষ্টতাতেও ডাক্তারবাবুকে কেমন অপরিচ্ছন্ন মনে হয়, শুধু পোশাকে ও চেহারায় নয়, তাঁর মনেও যেন একটা ক্লান্ত ঔদাসীন্য আছে সব ব্যাপারে। পোশাকের ত্রুটিটাই অবশ্য সকলের আগে চোখে পড়ে ঢিলে রঙচটা পেন্টুলেনের ওপর গলাবন্ধ একটা কোট পরা। গলাটা কিন্তু বন্ধ হয়নি বোতামের অভাবে এই কোট পরেই সম্ভবত তিনি সারাদিন রুগী দেখে ফিরবেন। একধারের পকেট স্টেথিস্কোপের ভারেই বোধ হয় একটু ছিঁড়ে গেছে। গোটাকতক আলগা কাগজপত্র সেখান দিয়ে উঁকি দিয়ে আছে। মাথায় চুলের কিছু পারিপাট্যের চেষ্টা বোধ হয় সম্প্রতি হয়েছিল, কিন্তু সে নেহাৎ অবহেলারা
ডাক্তারবাবুর মুখের ক্লান্ত ঔদাসীন্যের রেখাগুলি শুধু তাঁর চোখের উজ্জ্বলতার দরুনই বুঝি খুব বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে নি সমস্ত ঘুমন্ত নিষ্প্রাণ মানুষটির মধ্যে এই চোখ দুটিই যেন এখানে জেগে আছে পাহারায়। কে জানে কি তাদের আছে পাহারা দেবার
অনেকক্ষণ কোনো কথাই শোনা যায় না। সুরমার পানের বাটা সঙ্গে আছে এবং থাকে। তিনি সযত্নে পান সাজায় ব্যস্ত। জগদীশবাবু ইজি-চেয়ারে নিশ্চল ভাবে পড়ে আছেন। ডাক্তারবাবু নিজের হাতের নখগুলো বিশেষ মনোেযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে সুরমার পান-সাজা শেষ হবার জন্যেই বোধ হয় অপেক্ষা করেন।
সুরমার পান-সাজা শেষ হয়। সেটি মুখে দিয়েও তিনি কিন্তু খানিকক্ষণ নীরবে সামনের দিকে চেয়ে বসে থাকেন। তারপরে হঠাৎ এক সময়ে জিজ্ঞেস করেন—’তোমার সে ফুলের চারা এল ডাক্তার?’
জগদীশবাবু চোখ বুজে বলেন—’সে চারা আর এসেছে! তার চেয়ে আকাশ-কুসুম চাইলে সহজে পেতে’
সুরমা হেসে ওঠেন। বলেন—’তুমি ডাক্তারকে অমন অকেজো মনে কর কেন বল দিকি! সেবার আমাদের জলের পাম্পটা ডাক্তার না ব্যবস্থা করলে হ’ত?’।
ইজি-চেয়ারের ভেতর থেকে ঘুমন্ত স্বরে শোনা যায়—’তা হত না বটে। অন্য কেউ ব্যবস্থা। করলে হয়ত পাম্পে সত্যিই জল উঠত।’
তিনজনেই এ রসিকতায় হাসেন এ বাড়ির এটি একটি পুরাতন পরিহাস। সুরমা বলেন—’সত্যি, তুমি কি করে ডাক্তারি কর তাই ভাবি! লোকে বিশ্বাস করে তোমার ওষুধ খায়?’
‘খাবে না কেন, একবার খেলে আর অবিশ্বাসের সময় পায় না ত।‘
সুরমা হাসতে হাসতে পানের বাটা খুলে জিভে একটু চুন লাগিয়ে বলেন—’তোমার বাপু। ডাক্তারের ওপর একটু গায়ের জ্বালা আছে। তুমি ওর কিছু ভালো দেখতে পাও না।’
‘সেটা ওঁর চোখের দোষ, অনেক ভালো জিনিসই উনি দেখতে পান না।’—ডাক্তারের মুখে এতক্ষণে কথা শোনা যায়।
সুরমা হেসে বলেন—’তা সত্যি চোখ বুজে থাকলে আর দেখবে কি করে।’
‘চোখ বুজে থাকি কি সাধে! চোখ খুলে থাকলে কবে একটা কুরুক্ষেত্র বেধে যেত!’
সুরমা ও জগদীশবাবুর উচ্চ হাসির মাঝে ডাক্তারবাবুর নিস্তব্ধতাটা যেন একটু বিসদৃশ ঠেকে। সুরমার মুখের দিকে চেয়ে ডাক্তারের চোখে একটু বেদনার ছায়া এখনো দেখা যায় কি?
সুরমা হাসি থামিয়ে বলেন—’ওই যা, ভুলেই যাচ্ছিলাম, তোমায় এখন কিন্তু একবার উঠতে হবে ডাক্তার।’
‘এখনি? কেন?’
‘এখনি না উঠলে হবে না। দাদা কি-সব পার্সেল করেছেনা স্টেশনে কাল থেকে পড়ে আছে, —উনি একবার তবু সারাদিনে সময় করে যেতে পারলেন না। তোমায় এখন গিয়ে ছাড়িয়ে আনতেই হয়!’
ডাক্তারবাবু একটু ইতস্তত করে বলেন—’কাল সকালে গেলে হয় না?’
‘হয় না আবার! একমাস পরে গেলেও হয়! জিনিসগুলো খোয়া যাবার পর গেলে আরো ভালো। হয়। ‘সুরমার কণ্ঠে মিষ্টতার চেয়ে এবার ঝাঁঝটাই বেশ স্পষ্ট।
‘এক রাত্তিরেই খোয়া যাবে কেন?’—ডাক্তারবাবু একটু সঙ্কুচিতভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেন।
সুরমা বেশ একটু উচ্চস্বরেই বলেন—’তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারি না বাপু! সোজাসুজি বলই না তার চেয়ে যে, পারবে না! তোমায় বলা-ই ঝকমারি হয়েছে আমার।’
ডাক্তারবাবু এবার অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে উঠে পড়েন,—’আমি কি যাব না বলেছি? ভাবছিলুম একটা রাত্তির বই ত না।’
‘রাতটা কাটিয়ে গেলেই বা তোমার কি এমন সুবিধে! এমন কিছু কাজ ত আর হাতে নেই, চুপ করে বসেই ত থাকতে।’
সে কথা মিথ্যে নয়। ডাক্তার শুধু চুপ করে বসে থাকতেই এখানে আসেনা চুপ করে বসে আছেন আজ বহু বৎসর ধরে।
ডাক্তার টুপিটা তুলে নিয়ে একবার তবু বলেন,—’আসুন না জগদীশবাবু আপনিও! গাড়িটা ত রয়েছে, একটু ঘুরে আসা হবে।’
জগদীশবাবুর আগে সুরমাই আপত্তি করেন—’বেশ কথা! আমি একলা বসে থাকি এখানে তাহলে!’
ডাক্তার একটু হেসে বলেন—’আরে! তুমিও এস না!’
‘তার চেয়ে বাড়ি-সুদ্ধ পাড়া-সুদ্ধ সবাই একটা পার্সেল আনতে গেলেই হয়! সত্যি তুমি দিন দিন যেন কি হচ্ছ!’
ডাক্তার আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যান।
‘দিন দিন কি যেন হয়ে যাচ্ছ!’ মোটরে চড়ে স্টেশনের দিকে যেতে যেতে ডাক্তার সে কথা ভাবেন কি? না বোধ হয়। ভাবনা ও আবেগের উদ্বেল সাগর বহুদিন শান্ত নিথর হয়ে গেছে। সে সব দিন এখন আর বোধহয় মনেও পড়ে না। স্মৃতির সে সমস্ত পাতাও বুঝি অনেক তলায় চাপা পড়ে আছে। জীবনের একটি বাঁধা ছকে তিনি খাপ খেয়ে গেছেন সম্পূর্ণভাবে আগুন কবে। ভস্মশেষ রেখে একেবারে নিবে গেছে তা তিনি জানতেই পারেন নি।
আগুন একদিন সত্যিই জ্বলে উঠেছিল বইকি! কিন্তু সে যেন আর এক জনের কাহিনী, সে অমরেশকে তিনি শুধু দূর থেকে অস্পষ্টভাবে এখন চিনতে পারেন। তার সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ তাঁর নেই।
একদিন একটি ছেলে সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে পরম দুঃসাহসভরে দাঁড়াতে দ্বিধা করে নি। মেয়েটি ভীতস্বরে বুঝি একবার বলেছিল, সুযোগ পেয়ে—’তুমি এখানে চলে এলে!’
‘আরে অনেক দূরে যেতে পারতাম!’
‘কিন্তু?–’
‘কিন্তু এঁরা কি ভাববেন মনে করছ? তার চেয়ে তুমি কি ভাবছ সেইটেই আমার কাছে বড় কথা।’
‘আমি ত…’, মেয়েটি নীরবে মাথা নীচু করেছিল।
অমরেশ তার মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বলেছিল—’তোমার ভাববার সাহস পর্যন্ত নেই সুরমা!’
সুরমা মুখ তুলে মৃদুস্বরে বলেছিল—’না।’
‘সেই সাহস সৃষ্টি করতেই আমি এসেছি সুরমা। সেই সাহসের জন্যে আমি অপেক্ষা করব।’
সুরমা চুপ করে ছিল। অমরেশ আবার বলেছিল—’ভাবছ, কতদিন—এমন কতদিন অপেক্ষা করতে পারব? দরকার হলে চিরকালা কিন্তু তা বোধ হয় হবে না।’
জগদীশবাবু বুঝি সেই সময়ে ঘরে ঢুকেছিলেন। তাঁর চেহারায় এখনকার সঙ্গে তখনো বুঝি বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল না। বেঁটে গোলগাল মানুষটি। শান্ত নিরীহ চেহারা। একেবারে নীচের ধাপ থেকে সংগ্রাম করে তিনি যে সাংসারিক সিদ্ধি বলতে লোকে যা বোঝে তাই লাভ করেছেন, তাঁর চেহারায় তার কোনো আভাস নেই। দেখলে মনে হয় ভাগ্য তাঁকে চিরদিন বুঝি অযাচিত অনুগ্রহ করেই এসেছে। সুরমা-সম্পর্কে সে কথা হয়ত মিথ্যাও নয়।
তিনি ঘরে ঢুকে বলেছিলেন—’এখনও ট্রেনের জামা-কাপড় ছাড়েন নি? না না, এখন ছেড়ে দাও সুরমা। সারারাত ট্রেনের ধকল গেছে। স্নান করে খেয়ে-দেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন আগে।’
অমরেশ হেসে বলেছিল,—’ছেড়ে না দেওয়ার অপরাধটা আমার—ওঁর নয়।’
জগদীশবাবু উচ্চস্বরে হেসেছিলেন। হাসলে তাঁকে এত কুৎসিত দেখায় অমরেশও ভাবতে পারে নি সুরমার পেছনে তাঁর এই হাস্য-বিকৃত মুখটা সে উপভোগ করেছিল বেদনাময় আনন্দে–
তারপরে উঠে পড়ে বলেছিল—’আচ্ছা এখন ওঠাই যাক।’
জগদীশবাবু সঙ্গে যেতে যেতে বলেছিলেন—’বড় অসময়ে এলেন অমরেশবাবু। এই দারুণ গ্রীষ্মে এখানে কিছু দেখতে পাবেন না। বাইরে বেরুনই দায়।’
‘সেটা দুর্ভাগ্য নাও হতে পারে!’ জগদীশবাবুর বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে আবার বলেছিল—’তা ছাড়া গ্রীষ্ম ত একদিন শেষ হবে।’
‘তখন আপনাকে পাচ্ছি কোথায়!’ জগদীশবাবুর স্বরে বুঝি একটু সন্দেহের রেশ ছিল।
‘পাবেন বইকি। হয়ত বড় বেশি পাবেনা’
অমরেশ ডাক্তার মিথ্যে বলেনি। সত্যই একদিন এই ধূলিমলিন দরিদ্র শহরের একটি রাস্তার ধারে অমরেশ ডাক্তারের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেল।
জগদীশবাবু বলেছিলেন—’বিলিতি ডিগ্রির খরচ উঠবে না যে ডাক্তার! এ জঙ্গলের দেশে আমাদের মত কাঠুরের পোষায় বলে কি তোমার পোষাবে?’
অমরেশ ডাক্তার হেসে বলেছিল—’কাঠের কারবার আর ডাক্তারি ছাড়া আর কি পোষাবার কিছুই নেই?’
অমরেশ ডাক্তারকে রোগীর ঘরে দেখতে পাওয়া যাক বা না যাক, জগদীশবাবুর বাড়ির সরু বারান্দাটিতে প্রতিদিন তারপর দেখা গেছে।
‘চেয়ারটা ঘুরিয়ে বোস ডাক্তার।’—জগদীশবাবু বলেছেন।
‘কেন? আপনার ওই নদী আর পাহাড় দেখবার জন্যে? আপনার ট্রেডমার্ক পড়ে ওর সব দাম নষ্ট হয়ে গেছে।’
‘মড়া কেটে কেটে মনটাও তোমার মরে গেছে ডাক্তার!’
জগদীশবাবু তারপরেই আবার জিজ্ঞেস করেছেন অবাক হয়ে—’উঠলে কেন সুরমা?’
‘আসছি।’—বলে সুরমা মুখ নীচু করে ভেতরে চলে গেছে।
অমরেশ ডাক্তার অদ্ভুতভাবে হেসে বলেছে—’মেয়েরা কাটা-কাটির কথা সইতে পারে না, না জগদীশবাবু?’
জগদীশবাবু কোনো উত্তর দেন নি। গম্ভীর মুখে কি যেন তিনি ভাবছেন মনে হয়েছে।
অমরেশ ডাক্তার আবার বলেছে—’ওইটুকু ওদের করুণা!’
জগদীশবাবু গম্ভীরভাবে বলেছেন—’সেটুকু পাবারও সবাই যোগ্য নয়।’
ডাক্তারের আসা-যাওয়া গোড়ায় হয়ত এ বাড়ির উৎসাহ পায় নি। কিন্তু ক্রমে তা সয়ে গিয়েছে —সহজ হয়ে এসেছে জগদীশবাবুর কাছেও বুঝি।
‘কদিন আমায় জঙ্গলেই থাকতে হবে ডাক্তার। গুনতির সময়ে না থাকলে চলে না। দেখাশুনো কোরো। তোমায় অবশ্য বলতে হবে না।’
ডাক্তার হেসে বলেছে—’না, তা হবে না। আসতে বারণ করেও দেখতে পারেন!’
জগদীশবাবু হেসেছেন। সুরমাও হেসেছে, হাসলেই হয়ত তার মুখ লাল হয়ে ওঠো লাল হবার আর কোনো কারণ নেই বোধ হয়।
কিন্তু সুরমাই একদিন তীব্র স্বরে বলেছে—’আমি কিন্তু আর সইতে পারছি না!’
‘পারবে না-ই ত আশা করি।’
‘না না, তুমি এখান থেকে যাওা এমন করে নিজেকে ও আমাকে মেরে কি লাভ?’
‘বাঁচবার পথ ত খোলা আছে এখনো!’
‘সে পথ যখন আগে নেওয়া হয় নি…’
‘সে অপরাধ ত আমার নয় সুরমা তুমি তোমার নিজের মন জানতে না, আমি জানতাম না। সুযোগের মূল্যা ভাগ্যের নিষ্ঠুর রসিকতাকে তাই বলে মেনে নিতে হবে কেন!’
‘তুমি কি বলছ জান না! তা হয় না! তা হয় না!’ সুরমার কণ্ঠ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আবেগে।
‘অপরাধের কথা ভাবছ? অপরাধ করার চরম দামও যার জন্যে দেওয়া যায় এমন বড় জিনিস কি নেই?’
‘আমি বুঝতে পারি না। আমার ভয় হয়!’
‘বুঝতে পারবে, সেই প্রতীক্ষাতেই ত আছি।’
প্রতীক্ষা একদিন বুঝি সার্থক হল বলে মনে হয়েছে। জগদীশবাবুর কাঠের কারবারের জন্যে। জমা নেওয়া বিস্তীর্ণ জঙ্গল সেদিন তারা দেখতে গেছল। অরণ্যের রহস্যঘন আবেষ্টনে সারাদিন রাজসূয় চড়িভাতি’র উত্তেজনাতেই কেটেছে। বিকেলের দিকে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছিল।
অমরেশ ও সুরমা পথহীন অরণ্যে সকলের থেকে কেমন করে আলাদা হয়ে গেছে। আলাদা হওয়াটা হয়ত সম্পূর্ণ দৈবাৎ নয়, অমরেশেরও তাতে হয়ত হাত ছিল।
সুরমা খানিকক্ষণ বাদে বলেছে—’এ জঙ্গলে কিন্তু পথ হারাতে পারে!’
‘পথ জঙ্গলে ছাড়াও হারানো যায়!’
সুরমা একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলেছে—সব সময়ে তোমার এ ধরনের কথা ভালো লাগে না।’
‘কোথাও তোমার ব্যথা আছে বলেই ভালো লাগে না। নিজের কাছে তুমি ধরা দিতে চাও না বলেই এসব কথা তোমার অসহ্য।’
সুরমা নীরবে খানিক দূর এগিয়ে গেছে। অরণ্যের পশ্চাৎ-পটে তার দীর্ঘ সুঠাম দেহের গতিভঙ্গিতে বুঝি বনদেবীরই মহিমা ও মাধুর্য। সেটুকু উপভোগ করবার জন্যেই বুঝি খানিকক্ষণ নিঃশব্দে অমরেশ দাঁড়িয়ে থেকেছে। তারপর কাছে গিয়ে বলেছে—’এ জঙ্গলে হারাবার বদলে পথ আমরা পেতেও পারি।’
সুরমা তবু নীরব।
হঠাৎ তার একটা হাত ধরে ফেলে অমরেশ বলেছে—’চুপ করে থেকো না সুরমা। বলল, আজ তোমার অটলতার গৌরব আর নেই—আছে শুধু দুর্বলতার লজ্জা। এ সম্বল নিয়ে চিরদিন বাঁচা যায় না, বাঁচা উচিত নয় সুরমা।’
সুরমা প্রায়-অস্পষ্ট স্বরে বলেছে,—’আমি কি করতে পারি বলো!’
একটা কাটা গাছের গুঁড়ির ওপর পা দিয়ে অমরেশ বলেছে—’এই কাটা গাছটা দেখছ সুরমা! কাঠের কারবারে এর একটা দাম মিলেছে কিন্তু তার চেয়ে বড়, তার চেয়ে আসল দাম এর ছিল! তুমিও কারবারের কাঠ নও সুরমা, তুমি অরণ্যের।’
সুরমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অমরেশ আবার বলেছে,—’সহজ করে কথা আজ বলতে পারছি না বলে ক্ষমা কোরো সুরমা। মনের ভেতরেই আজ আমার সব জড়িয়ে গেছে।’
সুরমা অমরেশের আরো কাছে সরে এসেছে, বুকের ওপর মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে ধরা গলায় বলেছে—’তুমি আমায় সাহস দাও।’
কিন্তু চলে যাওয়া তাদের তখন হয়ে ওঠেনি। বাধা এসেছে অপ্রত্যাশিত দিক থেকে। জগদীশবাবু হঠাৎ অসুখে পড়েছেন—গুরুতর অসুখ সুরমা ও অমরেশ দিনরাত্রি বিনিদ্র হয়ে রোগ-শয্যার পাশে জেগেছে আর শান্তভাবে প্রতীক্ষা করেছে মুক্তিক্ষণের। আর বেশিদিন নয়। এই তাদের শেষ পরীক্ষা, নূতন জীবনের এই প্রথম মূল্যদানা।
জগদীশবাবু ভালো হয়ে উঠেছেন, তবু অপেক্ষা করতে হয়েছে, আর কিছুদিন, আর কয়েকটা দিন! ছোটখাট বাধা, ঘাটের নোঙর একেবারে তুলে ফেলতে সুরমার সামান্য একটু বিহ্বলতা এটুকু সময় তাকে দেওয়া যেতে পারে, নিজের ভেতর থেকে বল পাওয়ার সময়। অমরেশ কোথাও এতটুকু জোর খাটাতে চায় না, সব শিকড় আপনা থেকে আলগা হয়ে আসুক, সব বন্ধন। খুলে যাক। অসীম তার ধৈর্য
অমরেশ ডাক্তার অপেক্ষা করেছে কিছু দিন—অনেক দিন অপেক্ষা করেছে। বড় বেশিদিন অপেক্ষা করেছে।
ধীরে ধীরে কখন আগুন গিয়েছে নিবো কখন আর-বছরের পাপড়ির মত সে স্নান শুকনো বিবর্ণ হয়ে গেছে, তারা সবাই বিবর্ণ হয়ে গেছে। বিবর্ণ আর সুলভ আর সাধারণ অভ্যাসের ছাঁচে তারা বদ্ধ হয়ে গেছে, জীর্ণ মলিন হয়ে গেছে সংসারের ধূলায়। সবচেয়ে মলিন বুঝি ডাক্তার, সবচেয়ে মলিন আর ক্লান্ত। আগুন তার মধ্যে অমন লেলিহান হয়ে জ্বলেছিল বলেই সবার আগে তার সব পুড়ে ছাই হয়েছে। ডাক্তার তার নির্দিষ্ট চেয়ারে এসে এখানে রোজ বসে, নদী ও পাহাড়ের দিকে পিছন ফিরো কিন্তু সে শুধু অভ্যাস ডাক্তার স্টেশনে পার্সেল খালাস করতে ছোটে, সে শুধু দুর্বল আজ্ঞাবাহিত।
kindly premendro mitro er choto golpo gulo keu upload korun…