ভল্লু সর্দার

ভল্লু সর্দার

গোড়াতেই স্বীকার করিয়া লইতে হইবে যে ভল্লুর বয়ঃক্রম ছয় বৎসর। তাহার কার্যকলাপ দেখিয়া এ বিষয়ে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে; কিন্তু সন্দেহ করিলে চলিবে না। আমরা তাহার ঠিকুজি কোষ্ঠীর সহিত পরিচিত।

ভল্লর জীবনযাত্রা বোধ করি আরো কয়েক বৎসর অল্পস্বল্প দুষ্টামি করিয়া অপেক্ষাকৃত বৈচিত্র্যহীনভাবেই কাটিয়া যাইত; কিন্তু হঠাৎ একদিন বায়স্কোপ দেখিতে গিয়া সব ওলট-পালট হইয়া গেল। সে অপূর্ব কয়েকটি আইডিয়া লইয়া বায়স্কোপ হইতে ফিরিয়া আসিল।

প্রধান আইডিয়া, সে নিজে একজন দুর্দান্ত ডাকাতের সর্দার। যেমন তেমন সর্দার নয়,—একদিকে যেমন দুর্ধর্ষ বীর, অন্যদিকে তেমনি ন্যায়পরায়ণ—দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন করাই তাহার ধর্ম। যদিচ, তাহার একজোড়া ভয়ঙ্কর গোঁফ নাই, এই এক অসুবিধা। কিন্তু ভাবিয়া দেখিতে গেলে, গোঁফ ডাকাতের সর্দারের একটা অপরিহার্য অঙ্গ নয়। কারণ, দরোয়ান ছেদী সিং-এর গোঁফ তো আছেই, উপরন্তু গালপাট্টা আছে কিন্তু তবু তাহাকে কোনও দিন দুষ্টের দমন কিম্বা শিষ্টের পালন করিতে দেখা যায় নাই। আসল কথা, আচরণ ডাকাত সর্দারের মতো হওয়া চাই, গোঁফ না থাকিলেও আসে যায় না।

কিন্তু সর্দার হইতে হইলে ডাকাতের দল চাই। বায়স্কোপে সর্দারের প্রকাণ্ড দল ছিল, তাহারা হুকুম পাইবামাত্র নানাবিধ অসমসাহসিক কাজ করিয়া ফেলিত, অত্যাচারী জমিদারের বাড়ি লুঠ করিয়া তাহাকে গাছের ডালে লটকাইয়া দিত। ভল্লুর সে রকম দল কোথায়? অনুগত অনুচরের মধ্যে তিন বছরের অনুজা লিলি, আর একটি নিংলে কুকুরছানা—গামা। অদূর ভবিষ্যতে এই কুকর শাবকটি মহা শক্তিশালী হইয়া উঠিবে এই আশায় তাহার উক্তরূপ নামকরণ হইয়াছিল।

ইহারা দু’জনেই ভল্লুর একান্ত অনুগত বটে কিন্তু আদেশ পাইবামাত্র কোনও অসমসাহসিক কাজ করিবে কিনা তাহাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। একবার একটা হুলো বিড়ালকে আক্রমণ করিবার জন্য ভল্লু গামাকে বহু প্রকারে উত্তেজিত করিয়াছিল কিন্তু গামা তাহাতে সম্মত হয় নাই, বরঞ্চ অত্যন্ত কাতরভাবে পুচ্ছ সঙ্কুচিত করিয়া বিপরীতমুখে প্রস্থান করিয়াছিল। আর লিলি—সে একে মেয়েমানুষ, তায় দৌড়িতে পারে না; দৌড়িতে গেলেই পড়িয়া যায়। তাহাকে দিয়া কোনও কাজ হইবে না।

কিন্তু এত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ভল্লু ভগ্নোৎসাহ হইল না। অনুচর না থাকে, না থাক—সে নিঃসঙ্গভাবেই সর্দার বনিবে। যদি তার ডাক শুনিয়া কেহ না আসে সে একলা চলিবে। বায়স্কোপেও তো ডাকাত সর্দার একাকী দুর্গ-প্রাকার লঙঘন করিয়া বন্দিনী তরুণীকে উদ্ধার করিয়াছিল।

সে যাহোক, কিন্তু সর্দার বনিয়া সে কোন্ কোন্ দুষ্টের দমন করিবে? কারণ, শিষ্টের পালন পরে করিলেও ক্ষতি নাই কিন্তু দুষ্টের দমন প্রথমেই করা দরকার। সর্বাগ্রে তাহার মাস্টার-মহাশয়ের কথা মনে পড়িল। দুষ্ট লোক বলিতে যাহা-কিছু বুঝায়, সব দোষই মাস্টার-মহাশয়ে বিদ্যমান। ভোর হইতে না হইতে তিনি আসিয়া হাজির হন। পাঠ্য পুস্তকের প্রতি ভল্লুর অনুরাগ কিছু কম, বিশেষত অঙ্কশাস্ত্রে সে একেবারেই কাঁচা। তাই, পরবর্তী দু’ঘন্টা ধরিয়া যে দারুণ অত্যাচার উৎপীড়ন চলিতে থাকে তাহা বলাই বাহুল্য। এত বড় অত্যাচারীকে শাসন করা ডাকাত সর্দারের প্রথম কর্তব্য।

কিন্তু ভাবিয়া চিন্তিয়া ভল্লু মাস্টার-মহাশয়কে পরিত্যাগ করিল। তাঁহার চেহারাখানা এতই নিরেট, দেহের দৈর্ঘ্য-প্রস্থও এত বিপুল যে টিনের তরবারি দিয়া তাঁহার মুণ্ড কাটিয়া লওয়া একেবারেই অসম্ভব। তাঁহাকে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া গাছের ডালে ফাঁসি দেওয়াও ভল্লুর সাধ্যাতীত। দুঃখিতভাবে ভল্লু তাঁহাকে অব্যাহতি দিল।

আর শাস্তিযোগ্য কে আছে? ছেদী সিং দরোয়ান? ভল্লু মনে মনে মাথা নাড়িল। ছেদী সিং-এর চেহারাটা দুশমনের মতো বটে; কিন্তু কেবলমাত্র চেহারা দেখিয়া তাহার বিচার করিলে অন্যায় হইবে। সে প্রায়ই পেয়ারা, কুল, কামরাঙা আহরণ করিয়া আনিয়া চুপি চুপি ভল্লুকে খাওয়ায়; মাঝে মাঝে কাঁধে চড়াইয়া বেড়াইতে লইয়া যায়। অধিকন্তু সন্ধ্যার সময় কোলের কাছে বসাইয়া অতি অদ্ভুত রোমাঞ্চকর কাহিনী-কেচ্ছা বলে—শুনিতে শুনিতে তন্ময় হইয়া যাইতে হয়। না—ছেদী সিং দরোয়ানকে পাপিষ্ঠ দুষ্কৃতকারীর পর্যায়ে ফেলা যায় না।

তবে—আর কে আছে? বাবা? ভল্লু অনেকক্ষণ গালে হাত দিয়া চিন্তা করিল। অভাবপক্ষে বাবাকে পাপিষ্ঠ বলিয়া ধরা যাইতে পারে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে বাবা লোকটি নেহাত মন্দ নয়। মারধর তিনি একেবারেই করেন না, নিজের লেখাপড়া লইয়াই সর্বদা ব্যাপৃত থাকেন, (যদিও, অত লেখাপড়া করা পাপিষ্ঠের লক্ষণ কিনা তাহাও বিবেচনার বিষয়)। উপরন্তু, ভল্লুর মাতার সহিত তাঁহার বিশেষ সদ্ভাব আছে বলিয়া মনে হয়। প্রায়ই তাঁহাদের মধ্যে হাস্য-পরিহাস ও অন্তরঙ্গের মতো কথাবার্তা হইয়া থাকে—ভল্লু তাহা লক্ষ্য করিয়াছে। আবার মাঝে মাঝে উভয়ের মধ্যে ঝগড়াও হয়,—তখন ভল্লুর মা চোখে আঁচল দিয়া অস্পষ্ট ভগ্নস্বরে কি বলিতে থাকেন অধিকাংশ বোঝাই যায় না এবং বাবা মুখ ভারী করিয়া ধীরে ধীরে এমন দু’ একটি বাক্যবাণ প্রয়োগ করেন যে, মায়ের কান্না আরও বাড়িয়া যায়। অতঃপর, ঝগড়া থামিয়া গেলে বাবা নিভৃতে মাকে অনেক আদর ও খোসামোদ করিতেছেন ইহাও ভল্লুর চোখ এড়ায় নাই।

এরূপ ক্ষেত্রে কি করা যায়? ভল্লু বড় দ্বিধায় পড়িল। বাবাকে অন্তরের সহিত বদ্-লোক বলা চলে না; অথচ তাঁহাকে বাদ দিলে আর শাস্তি দিবার লোক কোথায়? তবে কি কেবলমাত্র দুষ্ট-লোকের অভাবেই একজন ডাকাত সর্দারের জীবন ব্যর্থ হইয়া যাইবে? মুণ্ড কাটিয়া ফেলিবার মতো লোকই যদি পৃথিবীতে না থাকে, তবে ডাকাত হইয়া লাভ কি?

শীতের দ্বিপ্রহরে চিলের কোঠায় একাকী বসিয়া ভল্লু এইরূপ গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। এখন সে ধীরে ধীরে উঠিল। এই নৈষ্কর্মের অবস্থা তাহার ভাল লাগিল না। একটা কিছু করিতে হইবে। যদি একান্তই পাষণ্ড-লোক না পাওয়া যায়—

ভল্লু দ্বিতলে অবতরণ করিল। কেহ কোথাও নাই—বাড়ি নিস্তব্ধ। মা বোধ হয় লিলিকে ঘুম পাড়াইয়া নিজেও একটু শুইয়াছেন। ভল্লু মা’র ঘর অতিক্রম করিয়া চুপি চুপি কাকিমার ঘরে উঁকি মারিল। দেখিল, কাকিমা পালঙ্কের উপর বুকের তলায় বালিশ দিয়া শুইয়া করতলে চিবুক রাখিয়া উদাস-চক্ষে জানালার বাহিরে তাকাইয়া আছেন।

এই ঘরটি কাকিমার শয়নকক্ষ বটে, কিন্তু ব্যাপার গতিকে ভল্লুরও শয়নকক্ষ হইয়া পড়িয়াছিল। পূর্বে ভল্লু নিজের মা’র কাছে শয়ন করিত; এই ঘরটা ছিল কাকার। মাস দেড়েক পূর্বে কাকার বিবাহ হইল; তারপর কি একটা গণ্ডগোল হইয়া গেল,—ফলে কাকা নিজের ঘর ছাড়িয়া বাহিরের একটা ঘরে আশ্রয় লইলেন এবং নব-পরিণীতা কাকিমা তাঁহার ঘর দখল করিলেন। ভল্লু বোধ করি কাকিমার রক্ষক হিসাবেই তাঁহার শয্যায় শয়ন করিতে লাগিল।

সুতরাং কাকিমার শয়নকক্ষটিকে ভল্লুর শয়নকক্ষ বলা যাইতে পারে। এই ঘরেই তাহার যাবতীয় খেলার উপকরণ ও অস্ত্র-শস্ত্র লুক্কায়িত ছিল। ডাকাত সর্দারের প্রধান আয়ুধ—একটি টিনের তরবারি—তাহাও এই পালঙ্কের নীচে থাকিত। তরবারিটা বাড়িসুদ্ধ লোকের চক্ষুশূল; সকলেরই আশঙ্কা ভল্লু ঐ তরবারি দিয়া কখন কাহার চোখে খোঁচা দিবে। তাই, ভল্লু সেটাকে অতি সঙ্গোপনে পালঙ্কের নীচে কম্বল চাপা দিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছিল।

ভল্লু কিছুক্ষণ দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর নিঃশব্দে পা টিপিয়া প্রবেশ করিল। কাকিমার মাথার কাপড় খোলা, তাঁহার খোঁপায় সোনার শিকল বাঁধা কাঁটাগুলি ভল্লু দেখিতে পাইল। কিন্তু কাকিমার উদাস দৃষ্টি জানালার বাহিরে প্রসারিত; কি জানি কি ভাবিতেছেন। তিনি ভল্লুর আগমন জানিতে পারিলেন না।

সাবধানে ভল্লু পালঙ্কের তলায় প্রবেশ করিল; কিন্তু তরবারি কম্বলের ভিতর হইতে বাহির করিতে গিয়া ঠুং করিয়া একটু শব্দ হইয়া গেল। কাকিমা চমকিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ‘কে রে! ভল্লু বুঝি? খাটের তলায় কি করছিস্?’

ধরা পড়িয়া গিয়া ভল্লু বলিল, ‘কিচ্ছু না’—তারপর তরবারি হস্তে খাটের তলা হইতে হামাগুড়ি দিয়া বাহির হইয়া আসিল।

ডাকাত সর্দারকে কাকিমার সম্মুখে হামাগুড়ি দিতে হইল বলিয়া ভল্লু মনে মনে একটু ক্ষুব্ধ হইল, কিন্তু বাহিরে গর্বিত গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গিতে দাঁড়াইল।

তারপরই সে স্তম্ভিত হইয়া গেল। দেখিল, কাকিমার সুন্দর চোখ দুটিতে জল টল্ টল্ করিতেছে!

কাকিমা চট্ করিয়া আঁচলে চোখ মুছিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘কি করছিলি!’

‘কিচ্ছু না’ —কাকিমার মুখের উপর সুবর্তুল চোখের দৃষ্টি স্থাপন করিয়া বলিল, ‘তুমি কাঁদছ কেন?’

কাকিমা লজ্জিতভাবে মুখখানাকে আর একবার আঁচল দিয়া মুছিয়া বলিলেন, ‘কৈ কাঁদছি?—তুই সারা দুপুর রোদ্দুরে রোদ্দুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিস তো? আয়, আমার কাছে এসে শো।’

‘না’—ভল্লুর কৌতূহল তখনও দূর হয় নাই, সে পুনরায় প্রশ্ন করিল, ‘কাঁদছিলে কেন বল না। ক্ষিদে পেয়েছে বুঝি?’

স্ত্রীজাতি ক্ষুধার উদ্রেক হইলেই কাঁদে—ইহা সে লিলির উদাহরণ দেখিয়া অনুমান করিয়া লইয়াছিল।

‘দূর!’

‘তবে?’

‘কিচ্ছু না। —তুই তলোয়ার নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস? আয় আমার কাছে।’

‘না—আমি এখন যাচ্ছি একটা কাজ করতে।’—বলিয়া ভল্লু দ্বারের দিকে পা বাড়াইল।

কাকিমা তাহাকে ডাকিলেন, ‘ভল্লু, শুনে যা একটা কথা।’

ভল্লু অনিশ্চিতভাবে ফিরিয়া দাঁড়াইল—‘কি?’

‘কাছে আয়।’

ভল্লু সন্দিগ্ধভাবে কাকিমাকে নিরীক্ষণ করিল। তাহাকে ধরিয়া বিছানায় শোয়াইয়া রাখিবার অভিসন্ধি তাঁহার নাই তো?—নাঃ, কাকিমা ভাল লোক, তিনি এমন নির্দয় ব্যবহার কখনই করিবেন না।

ভল্লু কাছে আসিয়া অধীরভাবে বলিল, ‘কি?’

কাকিমার মুখ একটু লাল হইল; তিনি ভল্লুর হাত ধরিয়া তাহাকে খুব কাছে টানিয়া আনিলেন, তারপর প্রায় তাহার কানে কানে বলিলেন, ‘তোর কাকা কোথায় রে?’

ভল্লু তাচ্ছিল্যভরে বলিল, ‘জানি না। বোধ হয় নীচে আছেন।’

কাকিমা আরও নিম্নস্বরে বলিলেন, ‘দেখে এসে আমায় বল্‌তে পারবি? কাউকে কিছু বলিস্‌নি, শুধু দেখে আসবি।’

‘আচ্ছা’ বলিয়া ভল্লু প্রস্থান করিল। এই সামান্য বিষয়ে এত গোপনীয় কি আছে সে বুঝিতে পারিল না।

নীচে নামিয়া ভল্লু বাহিরের দিকে চলিল। বাহিরের একটা ঘরে তক্তপোষের উপর ফরাস পাতা; তাহার উপর চিৎ হইয়া শুইয়া কাকা বৈরাগ্যপূর্ণ চক্ষে কড়িকাঠের দিকে তাকাইয়া আছেন। ভল্লু দু’একবার ঘরের সম্মুখ দিয়া যাতায়াত করিল কিন্তু কাকার ধ্যানভঙ্গ হইল না; তখন ভল্লু কাকিমাকে খবরটা দিয়া আসিবে ভাবিতেছে, এমন সময় তাহার কুকুর গামা কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া লাফাইতে লাগিল এবং তরুণ অপরিণত কণ্ঠে ঘেউ ঘেউ করিয়া আনন্দ জ্ঞাপন করিতে লাগিল।

গামার বয়ঃক্রম তিন মাস, চেহারা অতিশয় কৃশ ও দুর্বল। সে যে কালক্রমে ভয়ঙ্কর তেজস্বী বিলাতি কুকুর হইয়া দাঁড়াইবে এ বিষয়ে কেবল ভল্লুর মনেই কোনও সংশয় ছিল না। গামার গলার একটি বগ্‌লস্ কিনিয়া দিবার জন্য সে বাড়ির সকলের কাছে জনে জনে মিনতি করিয়াছিল কিন্তু কেহই তাহার কথায় কর্ণপাত করে নাই।

চেঁচামেচিতে কাকা বিরক্তিপূর্ণ চোখ কড়িকাঠ হইতে নামাইয়া ভল্লুর দিকে চাহিলেন। ভল্লু তাড়াতাড়ি গামাকে লইয়া সরিয়া গেল।

গামা দীর্ঘকাল পরে প্রভুর সাক্ষাৎ পাইয়াছে—তাহার ক্ষীণ শরীরে যেন আর আনন্দ ধরে না। সে একবার বাগানের দিকে ছুটিয়া যায়, আবার ফিরিয়া আসিয়া ভল্লুর পায়ের উপর থাবা রাখিয়া সাগ্রহে তাহার মুখের পানে তাকায়, তাহার মনের ভাবটা—চল না, বাগানে যাই। এমন দুপুর বেলা ঘরের মধ্যে বন্ধ থাকতে তোমার ভাল লাগছে? চল চল, বাগানে কেমন ছুটোছুটি করব!

ভল্লু একটু ইতস্তত করিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত গামার আমন্ত্রণ অবহেলা করিতে পারিল না। কাকিমাকে কাকার সংবাদ পরে দিলেও চলিবে—এত তাড়াতাড়িই বা কি! বিশেষত কাকা তো কিছুই করিতেছেন না, কেবল চিৎ হইয়া শুইয়া আছেন। এ সংবাদ দু’ঘণ্টা পরে দিলেও কোনও ক্ষতি হইবে না। ভল্লু গামাকে লইয়া বাগানে চলিল।

বাড়ির সংলগ্ন বাগানটা বেশ বিস্তৃত। মাঝে মাঝে আম, লিচু, গোলাপজামের গাছ—বাকিটা ফুলের গাছে ভরা। বর্তমানে বিলাতি মরশুমি ফুলের শোভায় বাগান আলো হইয়া আছে। কোথাও একরাশ পপী উগ্র রূপের ছটায় মৌমাছিদের আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে। ওদিকে সুইট্-পীর ঝাড় পরস্পর জড়াজড়ি করিয়া সহস্র ফুলের প্রজাপতি ফুটাইয়া রাখিয়াছে। স্থানে স্থানে দু’একটা চন্দ্রমল্লিকা কোঁকড়া মাথা দুলাইয়া নিষ্কলঙ্ক শুভ্র হাসি হাসিতেছে।

কিন্তু উদ্যান-শোভার দিকে ভল্লুর দৃষ্টি নাই। তাহার হাতে তরবারি, পশ্চাতে ভক্ত অনুচর। সে খুঁজিতেছে অ্যাডভেঞ্চার। কিন্তু হায়, এই ফুলের মরুভূমিতে অ্যাডভেঞ্চার কোথায়? বিমর্ষভাবে ভল্লু কয়েকটি ডালিয়া ফুলের পাপড়ি ছিঁড়িয়া চারিদিকে ছড়াইয়া দিল।

কিন্তু ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকিলে জগতে কোনও জিনিসই দুষ্প্রাপ্য হয় না, শত্রুও অচিরাৎ আসিয়া দেখা দেয়। অবশ্য কল্পনার জোর থাকা চাই। ভল্লু শত্রুর অন্বেষণে ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ একটি চন্দ্রমল্লিকা গাছের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। গাঢ় লাল রঙের চন্দ্রমল্লিকা—একটি কঞ্চির ঠেক্‌নোতে ভর দিয়া সগর্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ভল্লু কল্পনার চক্ষে দেখিতে পাইল—এ চন্দ্রমল্লিকা নয়, মহাপাপিষ্ঠ জমিদার। ইহার অত্যাচারে বাগানের অন্য সমস্ত ফুল ভয়ে জড়সড় হইয়া আছে; উহার রক্তচক্ষুর সম্মুখে অদূরে ঐ ভূ-লুণ্ঠিতা পরটুলাক্কার ফুলটি বন্দিনী তরুণীর মতো ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িয়াছে।

উত্তেজনায় ভল্লুর চোখ জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতে লাগিল। সে পাঁয়তারা কষিয়া একবার শত্রুর চারিদিকে প্রদক্ষিণ করিল, তারপর তরবারি আস্ফালন করিয়া কঠোর স্বরে কহিল, ‘ওড়ে নড়াধম—’

উত্তেজিত হইলে ভল্লুর উচ্চারণ কিছু বিকৃত হইয়া পড়িত।

নরাধম কোনও জবাব দিল না, কেবল আরক্ত চক্ষে চাহিয়া রহিল। গামা উৎসাহিতভাবে বলিল, ‘ভুক্ ভুক্—’

ভল্লু পদদাপ করিয়া বলিল, ‘ওড়ে নড়াধম, তুই জানিস্ আমি কে? আমি ভল্লু সর্দার—তোর যম।’

এত বড় দুঃসংবাদেও নরাধম বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না। ভল্লু তখন গর্জন করিয়া বলিল, ‘পাজি-উল্লুক-গাধা, এই তোর মুণ্ডু কেটে ফেললুম!’ বলিয়া সবেগে তরবারি চালাইল।

দুর্বিনীত নরাধমের মুণ্ড কাটিয়া মাটিতে পড়িল।

‘ভল্লু!’—

হঠাৎ পিছন হইতে গুরু-গম্ভীর আহ্বান শুনিয়া ভল্লুর ক্ষাত্র-তেজের উত্তাপ এক মুহূর্তে নির্বাপিত হইল; সে সভয়ে ঘাড় বাঁকাইয়া দেখিল—কাকা! কাকার বৈরাগ্যপূর্ণ ললাটে বৈশাখী মেঘের মতো ভ্রূকুটি। তিনি ধীরে ধীরে অগ্রসর হইয়া আসিতেছেন।

গামা কাকার আগমনের সাড়া পাইয়া কাপুরুষের মতো আগেই সরিয়াছে। উপায় থাকিলে ভল্লুও সরিত কিন্তু কাকা এত কাছে আসিয়া পড়িয়াছেন যে পলায়নের চেষ্টা বৃথা। কাল-বৈশাখীর ঝড়টা তাহার মাথার উপর দিয়াই যাইবে।

কাকা আসিয়া উপস্থিত হইলেন; ভল্লুর শ্রবণেন্দ্রিয় ধারণ করিয়া বলিলেন, ‘এ কি করেছিস্?’

ভল্লু বাঙ্-নিষ্পত্তি করিল না। বাগানের ফুল ছেঁড়া বারণ একথা সে বরাবরই জানে এবং সাধ্যমতো এ নিষেধ মান্য করিয়া আসিয়াছে। তবে যে আজ কোন্ দুরন্ত কর্তব্যের তাড়নায় ঐ ফুলটাকে বৃন্তচ্যুত করিয়াছে তাহা কাকাকে কি করিয়া বুঝাইবে? ফুলটা যে ফুল নয়—একটা মহাপাপিষ্ঠ নরাধম, একথা কাকা বুঝিবেন কি? সকলের কল্পনাশক্তি সমান নয়; ভল্লু জানিত কাকা বুঝিবেন না। অরসিকেষু রসস্য মা নিবেদনং—তার চেয়ে নীরব থাকা শ্রেয়ঃ। ভল্লু নীরব রহিল।

কাকা ভল্লুর হাত হইতে তরবারি কাড়িয়া লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিয়া বলিলেন, ‘কেন ফুল ছিঁড়্‌লি?’

ভল্লু এবারও জবাব দিল না। কাকা তখন তাহার কান ছাড়িয়া চুলের মুঠি ধরিলেন, সজোরে নাড়া দিয়া বলিলেন, ‘পাজি-উল্লুক-গাধা, কতবার তোকে মানা করেছি বাগানের ফুলে হাত দিস্‌নি। কেন ছিঁড়্‌লি বল্!’

বারবার একই প্রশ্নে ভল্লু উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিল। তার উপর চুলের যন্ত্রণা! কাকার বজ্রমুষ্টি ক্রমে ক্রমে যেরূপ দৃঢ়তর হইতেছে, হয়তো শেষ পর্যন্ত চুলগুলি তাঁহার মুঠিতেই থাকিয়া যাইবে। অথচ ভাব-গতিক দেখিয়া মনে হইতেছে, একটা কোনও উত্তর না পাইলে কাকা শান্ত হইবেন না। যন্ত্রণা ও উগ্র প্রয়োজনের তাড়ায় ভল্লুর মাথায় এক বুদ্ধি গজাইল। সে সজল চক্ষে চিঁ চিঁ করিয়া বলিল, ‘কাকিমার জন্যে ফুল তুলেছি!’

ইন্দ্রজালের মতো কাজ হইল। সচকিতভাবে কাকা চুল ছাড়িয়া দিলেন, হতবুদ্ধির মতো বলিলেন, ‘কি বল্‌লি?’

এতটা ভল্লুও প্রত্যাশা করে নাই; কিন্তু যে পথে সুফল পাওয়া গিয়াছে সেই পথে চলাই ভাল। সে আবার বলিল, ‘কাকিমার জন্যে ফুল তুলেছি’—বলিয়া ভূপতিত ফুলটা সযত্নে তুলিয়া লইল; তারপর আবার আরম্ভ করিল, ‘কাকিমা বললেন—’

‘কি বললেন?’

খুল্লতাতের জেরায় পড়িবার ইচ্ছা ভল্লুর আদৌ ছিল না, বিশেষত মোকাবিলায় মিথ্যা ধরা পড়িবার সম্ভাবনা যখন সম্পূর্ণ বিদ্যমান। বয়ঃপ্রাপ্ত লোকেদের মহৎ দোষ, তাহারা প্রত্যেকটি কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য না পাইলে চটিয়া যায়; কল্পনা বলিয়া যে ঐশী শক্তি মাথার মধ্যে নিহিত আছে তাহার সদ্ব্যবহার করিতে চায় না। ভল্লু কাকার প্রশ্নটা এড়াইয়া গিয়া বলিল, ‘কাকিমা বড্ড ফুল ভালবাসেন; রোজ খোঁপায় তিন্‌টে পাঁচটা ফুল পরেন—’

খুল্লতাত অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। আর বিলম্ব করা অনুচিত বুঝিয়া ভল্লু প্রস্থানোদ্যত হইল।

কাকা ডাকিলেন, ‘ভল্লু-শোন্—’

ভল্লু খানিক দূর গিয়াছিল, সেখানে হইতে ঘাড় বাঁকাইয়া বলিল, ‘আর, কাকিমা তোমায় ডাকছিলেন—তুমি কোথায় আছ দেখতে বললেন’—বলিয়া ক্ষুদ্র পদযুগল সবেগে চালিত করিয়া দিল।

বাগানের নৈর্ঋত কোণে একটি বড় আম গাছের নিম্নতম শাখায় ভল্লুর স্থায়ী আড্ডা ছিল। স্থূল শাখাটি ভূমির সমান্তরালে কাণ্ড হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল; তাহার ডগার দিকে বসিয়া দোল দিলে শাখাটি মন্দ মন্দ দুলিত।

এই শাখার ঘনপল্লবিত ডগায় বসিয়া একটা বড় রকম দোল দিয়া বিক্ষুব্ধচিত্ত ভল্লু ভাবিতে আরম্ভ করিল। গামা এতক্ষণ নিরুদ্দেশ ছিল; এখন, যেন কিছুই হয় নাই এমনিভাবে ল্যাজ নাড়িতে নাড়িতে গাছের তলায় আসিয়া বসিল। ভল্লু একবার ভর্ৎ সনাপূর্ণ চক্ষে তাহার পানে তাকাইল। অনুচরের ভীরুতা তাহার মর্মে দারুণ আঘাত করিয়াছিল।

তারপর পুনরায় সে ভাবিতে আরম্ভ করিল।

প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। দুষ্টের দমনব্রত গ্রহণ করিয়া ভল্লু চারিদিকে দুষ্ট অন্বেষণ করিয়া বেড়াইতেছে—অথচ দুষ্ট, অত্যাচারী, দুর্বৃত্ত বলিতে যাহা কিছু বুঝায় তাহার মূর্তিমান বিগ্রই ভল্লুর সম্মুখেই হাজির রহিয়াছে। এতক্ষণ এটা সে দেখিতে পায় নাই কেন? তাহার মতো মহাপাপিষ্ঠ নরাধম পৃথিবী খুঁজিয়া আর কোথায় পাওয়া যাইবে?

শুধু আজিকার এই ঘটনার জন্য নয়, কাকা যে একজন অবিমিশ্র পাষণ্ড ইহা তাহার অনেকদিন আগেই জানা উচিত ছিল। প্রথমত তিনি ডাক্তার—ডাক্তারেরা যে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে বদ্-লোক একথা শিশু সমাজে কে না জানে? লিলি পর্যন্ত জানে। ভল্লুর সামান্য একটু পেটের অসুখ হইতে না হইতে কাকা তাহার সমস্ত প্রিয় খাদ্য বন্ধ করিয়া এমন সব কটু, তিক্ত, কষায় ঔষধ ও পথ্যের ব্যবস্থা করেন যে সে কথা স্মরণ করিলেই অন্নপ্রাশনের অন্ন ঊর্ধ্বগামী হয়। তাহার উপর তিনি একজন কঠোর ব্রহ্মচারী, মাথায় একটি ক্ষুদ্র টিকি আছে। ভোর পাঁচটা বাজিতে না বাজিতে তিনি শয্যাত্যাগ করিয়া স্নান করেন; তারপর ঠাকুরঘরে ঢুকিয়া এমন ঘোর রবে কাঁসর-ঘন্টা বাজাইতে আরম্ভ করেন যে পাড়ার ত্রিসীমানার মধ্যে আর কাহারও ঘুমাইবার উপায় থাকে না।

শুধু ইহাই নয়, নব-পরিণীতা কাকিমার সঙ্গে তাঁহার দুর্ব্যবহার স্মরণ করিলেও তাঁহার নৈতিক দুর্গতি সম্বন্ধে সন্দেহ থাকে না। বিবাহের পূর্বে বাড়িসুদ্ধ লোকের সহিত কাকার কথা কাটাকাটি বকাবকি চলিয়াছিল একথা ভল্লুর বেশ মনে আছে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত কাকা হাঁড়ির মতো মুখ করিয়া বিবাহ করিতে গেলেন। কিন্তু বিবাহ করিয়া আসিয়া তিনি অন্দর মহলের সংস্রব একেবারে ত্যাগ করিয়াছেন। এই লইয়া বাড়িতে অশান্তির শেষ নাই; ভল্লুর মা’র সহিত কাকার প্রায়ই বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। কাকা বায়স্কোপের দুষ্ট জমিদারের মতো তির্যক্ হাসি হাসিয়া বলেন, ‘আমি তো আগেই বলে দিয়েছিলুম!’

অথচ কাকিমা অতিশয় ভাল লোক; এতদিন তাঁহার সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়া ভল্লুর তাহা বুঝিতে বাকি নাই। লজঞ্চুস্ কিনিবার জন্য পয়সার প্রয়োজন হইলে তিনি চুপি চুপি তাহাকে পয়সা দেন; এমন কি, চোরাই মাল তাঁহার কাছে গচ্ছিত রাখিলে তিনি কাহাকেও বলিয়া দেন না। একবার কতকগুলি ডাঁশা কুল ও কাসুন্দি যথাসময়ে তাহাকে প্রত্যর্পণ করিয়াছিলেন, একটি কুল বা একবিন্দু কাসুন্দিও আত্মসাৎ করেন নাই। এরূপ গুণবতী নারী আজকালকার দিনে কোথায় পাওয়া যায়? অন্তত ভল্লুর মনে জানাশোনার মধ্যে এমন আর দ্বিতীয় নাই।

এহেন কাকিমাকে কাকা অবহেলা করেন। শুধু অবহেলা করিলে ক্ষতি ছিল না, পরন্তু তিনি কাকিমার উপর অন্যায় উৎপীড়ন করিয়া থাকেন তাহাও সহজে অনুমান করা যায়। পূর্বে দু’একবার কাকিমাকে বালিশে মুখ গুঁজিয়া ফুঁপাইতে শুনিয়া ভল্লুর ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছে; আজ সে কাকিমার চক্ষে জল দেখিয়াছে। এসব কি মিছামিছি? ভল্লুর দৃঢ় ধারণা জন্মিল, কাকা সুবিধা পাইলেই আসিয়া কাকিমার কান মলিয়া চুল ধরিয়া ঝাঁকানি দিয়া যান। নচেৎ কাকিমা অকারণ কাঁদিবেন কেন?

যে-দিক দিয়াই দেখা যাক, কাকার মতো দুর্নীতিপরায়ণ দমন-যোগ্য ব্যক্তি আর নাই।

কিন্তু দমন করিবার উপায় কি? দড়ি দিয়া বাঁধিয়া গাছে ঝুলাইয়া দেওয়া বা তরবারি দিয়া মুণ্ডচ্ছেদ সম্ভব নয়। সে-চেষ্টা করিতে গেলে ভল্লুর জীবনের সুখ-শান্তি চিরতরে নষ্ট হইয়া যাইবে। ক্রুদ্ধ কাকা হয়তো ভল্লুকে চিরজীবন ধরিয়া ভাত ডালের পরিবর্তে গাঁদালের ঝোল ও বোতলের সুতিক্ত ঔষধ খাওয়াইবার ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। সুতরাং তাহাতে কাজ নাই।

ভল্লু দীর্ঘকাল বদনমণ্ডল কুঞ্চিত করিয়া চিন্তা করিল কিন্তু কাকাকে জব্দ করিবার কোনও সহজ পন্থাই আবিষ্কৃত হইল না। তখন সে শাখা হইতে নামিয়া চিন্তাকুলচিত্তে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে চলিল। গামা এতক্ষণ বৃক্ষতলে লম্বমান হইয়া নিদ্রাসুখ উপভোগ করিতেছিল, এখন উঠিয়া ডন্ ফেলার ভঙ্গিতে আলস্য ভাঙ্গিয়া প্রভুর অনুগামী হইল।

চন্দ্রমল্লিকা ফুলটি এতক্ষণ ভল্লুর হাতেই ছিল, অন্যমনস্কভাবে সে তাহার গোটাকয়েক পাপড়ি ছিড়িয়া ফেলিয়াছিল; তবু ফুলের সৌষ্ঠব একেবারে নষ্ট হয় নাই। বাড়িতে পৌঁছিয়া ভল্লু কিছুক্ষণ বিরাগপূর্ণ নেত্রে তাহার দিকে তাকাইয়া রহিল, তারপর অনিচ্ছাভরে কাকিমার ঘরের উদ্দেশ্যে চলিল।

বাড়ি তখনো নিঃশব্দ—বিশ্রামকারীরা বিশ্রাম করিতেছে। কাকিমার দরজার নিকট পর্যন্ত পৌঁছিয়া ভল্লু থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। কাকার কণ্ঠস্বর! কাকা চাপা অথচ উদাস স্বরে কথা কহিতেছেন। ভল্লু দরজার বাহিরে দেয়ালের সঙ্গে একেবারে সাঁটিয়া গিয়া শুনিতে লাগিল। কাকা বলিতেছেন, ‘সংসারে আমার রুচি নেই। আমি একলা থাকতে চাই—ছেলেবেলা থেকেই আমার প্রতিজ্ঞা স্ত্রীলোকের সংসর্গে আসব না। কারণ, দেখেছি যারা স্ত্রীলোকের প্রলোভনে প’ড়ে সংসারে জড়িয়ে পড়েছে, তাদের দ্বারা আর কোনও বড় কাজ হয় না।’

কাকা নীরব হইলেন; কিছুক্ষণ পরে কাকিমার অশ্রুরুদ্ধ অস্পষ্ট কণ্ঠ শুনা গেল, ‘তবে বিয়ে করেছিলে কেন?’

‘দাদা আর বৌদি’র কথা এড়াতে পারলুম না, তাই বিয়ে করতে হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে এই শর্ত হয়েছিল যে, বিয়ে করেই আমি খালাস, তারপর আমার আর কোনও দায়িত্ব থাকবে না। কিন্তু এখন দেখছি, তাঁরা আমায় ঠকিয়েছেন, শর্তের কথা তাঁদের মনে নেই। কিন্তু সে যাক্। একটা কথা তোমায় বলে দিই, মনে রেখো—আমার কাছে তোমার কোনোদিন কিছুর প্রয়োজন হবে না, সুতরাং আমাকে ডাকাডাকি করে মিছে উত্ত্যক্ত কোরো না।’

‘আমি তো তোমাকে ডাকিনি—’

ভল্লু দেখিল তাহার স্থান-ত্যাগ করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে। সে ধীরে ধীরে অপসৃত হইয়া নীচে চলিল। তাহার সামান্য একটা কথার সূত্র ধরিয়া কাকা কাকিমাকে তিরস্কার করিতেছেন, এখনি হয়তো সাক্ষী দিবার জন্য তাহার তলব পড়িবে। কাকার মতো দুর্জনের নিকট হইতে দূরে থাকাই নিরাপদ।

সিঁড়ি দিয়া নামিতে নামিতে ভল্লু শুনিতে পাইল, তাহার মা নিজের ঘর হইতে বাহির হইয়া কাকাকে উদ্দেশ করিয়া বিস্ময়োৎফুল্ল স্বরে বলিতেছেন, ‘ওমা—একি! সন্নিসি ঠাকুর একেবারে বৌয়ের ঘরে ঢুকে পড়েছে যে—’

নীচে নামিয়া ভল্লু দেখিল বাড়ির ঝি বামা ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করিয়া দিয়াছে ও একগাছা ঝাঁটা লইয়া গামাকে চারিদিকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। তাহার কথা হইতে ভল্লু বুঝিল যে, বামা ভাঁড়ার-ঘরের দাওয়ায় রৌদ্রে শুইয়া হাঁ করিয়া ঘুমাইতেছিল, গামা গিয়া সস্নেহে তাহার মুখ-গহ্বরের অভ্যন্তরে জিহ্বা প্রবিষ্ট করাইয়া তাহার আলজিভ চাটিয়া লইয়াছে। বামা গামার উদ্দেশে যে-সব বিশেষণ নিক্ষেপ করিতেছে তাহা শুনিলে কুকুরেরও কর্ণেন্দ্রিয় লাল হইয়া উঠে।

ভল্লুও নিঃশব্দে গামাকে খুঁজিতে আরম্ভ করিল। বামার আল্‌জিভ চাটিয়া লওয়া যে গামার অন্যায় হইয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু তবু সব দোষ কি গামার? বামা হাঁ করিয়া ঘুমায় কেন? আর গামার গলায় একটা বগ্লস্ থাকিলে তো এমন ব্যাপার ঘটিতে পারিত না, গামাকে তখন স্বচ্ছন্দে বাঁধিয়া রাখা চলিত! দোষ গামার নয়,—দোষ বাড়ির লোকের। তাহারা একটা বগ্‌লস্ কিনিয়া দেয় নাই কেন?

খুঁজিতে খুঁজিতে বাহিরের ঘরে কাকার তক্তপোষের তলায় ভল্লু গামাকে আবিষ্কার করিল। গামা নিদ্রার ভান করিয়া এক চক্ষু ঈষৎ খুলিয়া মিটিমিটি চাহিতেছিল, ভল্লুকে দেখিয়া বাহির হইয়া আসিল।

ভল্লু গামার কান মলিয়া দিয়া চাপা তর্জনে বলিল, ‘পাজি কোথাকার! বামার মুখ এঁটো করে দিয়েছিস্ কেন?’

গামা বিনীতভাবে ল্যাজ নাড়িয়া অপরাধ স্বীকার করিল।

ভল্লু বলিল, ‘মজা দেখাচ্ছি দাঁড়াও, এবার থেকে তোমায় বেঁধে রাখব।’

গামা পুচ্ছ-স্পন্দনে কাতরতা জ্ঞাপন করিল।

ভল্লু কিন্তু শাসনে কঠোর। খানিকটা ছেড়া কাপড়ের পাড় সে অন্য প্রয়োজনে সংগ্রহ করিয়াছিল, এখন তাহা পকেট হইতে বাহির করিল। সেটা গামার গলায় বাঁধিতে যাইবে এমন সময় হঠাৎ কাকার শয্যার উপর বালিশের পাশে একটা জিনিস দেখিয়া তাহার চক্ষু পলকহীন হইয়া গেল। কাকার হাতঘড়িটা রহিয়াছে, ঘড়িতে চামড়ার বগ্‌লস্ সংলগ্ন। ব্যাণ্ডসুদ্ধ রিস্ট-ওয়াচ সে পূর্বে দেখে নাই এমন নয়, বহুবার, দেখিয়াছে; কিন্তু এখন তাহার মুগ্ধ নেত্র ঐ জিনিসটার উপর নিশ্চল হইয়া রহিল।

এক-পা এক-পা করিয়া অগ্রসর হইয়া সন্তর্পণে ভল্লু সোনার ঘড়িটি হাতে তুলিয়া লইল; তারপর ঘড়ি হইতে বগ্‌লস্ পৃথক করিবার চেষ্টা করিল। কিন্তু কৃতকার্য হইল না। তখন ভল্লু একবার দরজার দিকে তাকাইয়া ঘড়িসুদ্ধ বগ্‌লস্ গামার গলায় পরাইয়া দিল। দিব্য মানাইয়াছে। ঘড়িটি গামার লোমে ঢাকা পড়িয়া গিয়াছে—দেখা যায় না। ভল্লু আগ্রহ-কম্পিত হস্তে কাপড়ের পাড় বগ্লসে বাঁধিয়া অনিচ্ছুক গামাকে টানিতে টানিতে বাহির হইয়া পড়িল।

কাকা তখনও ফিরেন নাই, বোধ হয় মা’র সহিত তর্ক করিতেছেন। এই অবসরে ভল্লু বাগান অতিক্রম করিয়া রাস্তায় গিয়া পড়িল।

ভল্লু যখন বেড়াইয়া বাড়ি ফিরিল তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া গিয়াছে। ভ্রমণের ফলে বিলক্ষণ ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল; ভল্লু গামাকে একটি নিভৃত স্থানে বাঁধিয়া রাখিয়া বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করিল।

বাড়িতে ঢুকিতেই মাংস রান্নার সুগন্ধ তাহার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করিল। সে সটান রান্নাঘরে গিয়া বলিল, ‘মা, ক্ষিদে পেয়েছে।’ বলিয়া একটা পিঁড়ি পাতিয়া বসিয়া গেল। মা মাংস ও রুটি তাহার সম্মুখে ধরিয়া দিলেন।

নিবিষ্ট মনে আহার করিতে করিতে ভল্লু শুনিতে পাইল, বাড়িতে একটা কিছু গণ্ডগোল চলিতেছে। সে উৎকর্ণ হইয়া শুনিল। কাকা চাকরদের ধমকাইতেছেন: একবার ‘সোনার ঘড়ি’ কথাটা শুনা গেল। ভল্লুর বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল।

তারপরই বামা ঝি রান্নাঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া উপু হইয়া বসিল, ভারী গলায় বলিল, ‘এ ঐ দরোয়ন ড্যাক্‌রার কাজ, বলে দিলুম বড়মা, দেখে নিও। এ ছাড়া এত বুকের পাটা আর কারুর নয়। —কি অনাছিষ্টি কাণ্ড মা, ছোট দাদাবাবুর বিছানার ওপর থেকে সোনার ঘড়ি চুরি! আমি তো বার-বাড়ি মাড়াইনে সবাই জানে। রান্নাঘর মুক্ত করে, বাসন মেজে, কাপড় কেচে, উঠান ঝাঁট দিতেই বেলা কেটে যায়—তা বাইরে যাব কখন? আর, এই এগারো বছর এ বাড়িতে আছি, একটা কুটো হারিয়েছে কেউ বলতে পারে না। —এ ঐ ঝাঁটাখেগো দরোয়ানের কাজ; মিন্‌সের মরণ-পালক উঠেছে কিনা, তাই মালিকের সোনার ঘড়িতে হাত দিতে গেছে!’

দরোয়ানের সঙ্গে বামার চিরশত্রুতা!

মা রান্না করিতেছিলেন, বামার সাফাই শুনিতে পাইলেও উত্তর দিলেন না। ভল্লুরও মুখ দেখিয়া মনের অবস্থা বুঝা গেল না। কিন্তু তাহার গলায় মাংসের টুক্‌রা আটকাইয়া যাইতে লাগিল। সে অতিকষ্টে আরও কিছু খাদ্য গলাধঃকরণ করিয়া উঠিয়া পড়িল, পাতের ভুক্তাবশিষ্ট মাংস ও হাড় বাটিতে লইয়া ধীরে সুস্থে রান্নাঘর ত্যাগ করিল। প্রত্যহ দুইবেলা নিজের উচ্ছিষ্ট প্রসাদ সে স্বহস্তে গামাকে খাওয়াইত।

গামাকে খাওয়াইয়াতে খাওয়াইতে ভল্লু শুনিল কাকার কণ্ঠস্বর ও মেজাজ উত্তরোত্তর চড়িতেছে, তিনি পুলিসে খবর দিবেন বলিয়া চাকরদের ভয় দেখাইতেছেন। বাবাও সেই সঙ্গে যোগ দিয়াছেন। চাকরেরা ভয়ে আড়ষ্ট ও নির্বাক হইয়া আছে। ব্যাপার অতিশয় গুরুতর হইয়াছে।

ভল্লু কর্তব্য স্থির করিয়া ফেলিল। গামার আহার শেষ হইলে সে তাহাকে লইয়া গুটি গুটি কাকার ঘরের দিকে অগ্রসর হইল। ওদিকের বারান্দায় চেঁচামেচি চলিতেছে, এদিকে কেহ নাই। ভল্লু এপাশ ওপাশ চাহিয়া কাকার ঘরে ঢুকিয়া পড়িল। ঘরটি অন্ধকার; ভল্লু অন্ধকারে লুকাইয়া তাড়াতাড়ি গামার গলা হইতে ঘড়ি ও বগ্‌লস্ খুলিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু বগ্‌লস্ গামার গলায় আঁটিয়া গিয়াছে—বোধ করি গামা মাংস খাইয়া মোটা হইয়াছে। ভল্লু অনেক চেষ্টা করিয়াও বগ্‌লস্ খুলিতে পারিল না, যতই তাড়াতাড়ি খুলিবার চেষ্টা করে, ততই হাত জড়াইয়া যায়। এদিকে সময় অতিশয় সংক্ষিপ্ত—এখনি হয়তো কেহ ঘরে আসিয়া ঢুকিবে।

ত্রস্ত ভল্লু কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময় অতি সন্নিকটে কাকার গলা শুনিয়া সে চমকিয়া উঠিল। সর্বনাশ! মুহূর্ত মধ্যে সে গামাকে তুলিয়া কাকার বিছানায় লেপের তলায় চাপা দিল, তারপর ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার কোণে গিয়া দাঁড়াইল।

কিছুক্ষণ রুদ্ধশ্বাসে কাটিয়া গেল। কাকা কিন্তু ঘরে প্রবেশ করিলেন না, বকিতে বকিতে অন্যদিকে চলিয়া গেলেন।

এইবার ভল্লর সমস্ত সাহস হঠাৎ তাহাকে ত্যাগ করিল। তাহার যেন দম বন্ধ হইয়া আসিতে লাগিল। তস্করবৃত্তি আপাত-লোভনীয় বটে কিন্তু চিত্তের শান্তিবিধায়ক নয়। কাকার কণ্ঠস্বর দূরে চলিয়া গেলে ভল্লু ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। আর কোনোদিকে দৃকপাত না করিয়া একেবারে দ্বিতলে নিজের শয়নকক্ষে গিয়া উপস্থিত হইল। কাকিমা ঘরে ছিলেন, তাহাকে জুতা-মোজা ও গরম জামা খুলিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আজ পড়তে বস্‌লি না ভল্লু, এখনি শুতে চলে এলি যে?’

‘বড্ড ঘুম পাচ্ছে’ বলিয়া ভল্লু লেপের ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল।

ওদিকে গাও নরম বিছানায় লেপের মধ্যে শয়নের ব্যবস্থা দেখিয়া নিঃশব্দে পরম পরিতৃপ্তির সহিত কুণ্ডলী পাকাইয়া নিদ্রার আয়োজন করিল।

ভল্লু ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। প্রায় দুই তিন ঘন্টা ঘুমাইবার পর হঠাৎ একটা বিরাট গর্জন শুনিয়া তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল। কাকিমাও ইতিমধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ করিয়া তাহার পাশে আসিয়া শুইয়াছিলেন—তিনিও চমকিয়া উঠিলেন।

ঘরে আলো জ্বলিতেছিল; ভল্লু চোখ মেলিয়া দেখিল, কাকার রুদ্রমূর্তি ঠিক খাটের পাশেই দাঁড়াইয়া আছে—হাতে একটা মোটা লাঠি। ভল্লু প্রথমটা কিছু বুঝিতে পারিল না, তারপর তাহার সব কথা মনে পড়িয়া গেল।

কাকা দত্ত ঘর্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘ভুলো, বেরিয়ে আয় শিগ্‌গির লেপ থেকে—আজ তোকে—’

ভল্লুর মুণ্ড এতক্ষণ লেপের বাহিরে ছিল, এখন তাহা ভিতরে অদৃশ্য হইয়া গেল। সে কাকিমার বুকের কাছে ঘেঁষিয়া শুইল।

রাত্রি তখন মাত্র দশটা। ভল্লুর মা বাবা শয়ন করিতে গেলেও নিদ্রা যান নাই; তাঁহারা চেঁচামেচি শুনিয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া আসিলেন। মা ঘরে ঢুকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হয়েছে। ঠাকুরপো?’

‘হয়েছে আমার মাথা! ভুলো, বেরিয়ে আয় বলছি—’

মা শঙ্কিত হইয়া বলিলেন, ‘কি করেছে ভল্লু?’

কাকা ক্রোধে হস্তদ্বয় আস্ফালন করিয়া বলিলেন, ‘কি করেছে? ওর ঐ হতভাগা কুকুরটাকে আমার বিছানায় শুইয়ে রেখেছিল; শুতে গিয়ে দেখি লক্ষ্মীছাড়া পেটরোগা কুকুর লেপ বিছানার সর্বনাশ করে রেখেছে। বমি করে সব ভাসিয়ে দিয়েছে।’

শুনিয়া ভল্লুর মাথার চুল পর্যন্ত কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সে কাকিমার বুকের মধ্যে মাথা গুঁজিয়া একেবারে নিস্পন্দ হইয়া রহিল। কাকিমার শরীরটা এই সময় একবার সজোরে নড়িয়া উঠিল, যেন তিনি হাসি চাপিবার চেষ্টা করিতেছেন। কিন্তু এ রকম ভয়ঙ্কর ব্যাপারে হাসিবার কি আছে তাহা ভল্লু ভাবিয়া পাইল না। গুরুভোজনের ফলে গামা যে এমন বিদ্‌ঘুটে কাণ্ড করিয়া বসিবে তাহা ভল্লু দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করে নাই।

কাকা পূর্ববৎ বলিতে লাগিলেন, ‘শুধু কি তাই! কুকুরটাকে ঘাড় ধরে তুলতে গিয়ে দেখি, তিনি আমার রিস্ট-ওয়াচ গলায় পরে বসে আছেন।’

ঘরের বাহিরে বাবা হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন; মা’র কলকণ্ঠ সেই সঙ্গে যোগ দিল। লেপের মধ্যে কাকিমার সর্ব শরীর চাপা হাসির আবেগে ফুলিয়া ফুলিয়া দুলিয়া দুলিয়া উঠিতে লাগিল।

কাকা বলিলেন, ‘তোমাদের হাসি পাচ্ছে? ঐ ঘড়ির জন্যে চাকরগুলোকে শুধু মারতে বাকি রেখেছি। ভাগ্যে পুলিসে খবর দেওয়া হয়নি, নয় তো কেলেঙ্কারির একশেষ হত; পুলিস এসে দেখত কুকুরের গলায় ঘড়ি বাঁধা রয়েছে।—না, এ সব হাসির কথা নয়; ভুলোর বজ্জাতি বন্ধ করা দরকার।’

মা হাসিতে হাসিতে বলিলেন, ‘তা বেশ তো, কাল সকালে ওকে শাসন কোরো।’

কাকা বলিলেন, ‘না বৌদি, সে হবে না। তুমি ওকে এখনি লেপের ভেতর থেকে বার করে আনো।’

মা মুখে আঁচল দিলেন, তারপর বলিলেন, ‘কেন, তুমিই আনো না।’

‘না না,—তুমি ওকে বিছানা থেকে বার করে আনো—তারপর আমি—’

‘কেন বল তো? বিছানা ছুঁলে কি তোমার জাত যাবে?’

‘না না—মানে—। আচ্ছা বেশ, কাল সকালেই হবে—’ দ্বারের দিকে এক পা বাড়াইয়া কাকা দাঁড়াইলেন—‘কিন্তু আমার বিছানা! আমি আজ শোব কোথায়?’

মা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘বিছানা কি একেবারে গেছে?’

‘শুধু বিছানা! সে-ঘরে ঢোকে কার সাধ্য।’

মা হাসিভরা মুখ গম্ভীর করিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন, ‘তাই তো! বাড়িতে তো আর লেপও নেই। তাহলে তোমাকে এই ঘরেই শুতে হয়।’

কাকা বলিলেন, ‘এত রাত্রে ঠাট্টা ভাল লাগে না বৌদি। একটা লেপ বার করে দাও, বৈঠকখানায় ফরাসের ওপরেই শুয়ে থাকব।’

‘আর তো লেপ নেই।’

‘নেই।’

‘একখানা বাড়তি ছিল, সেটা তুমি গায়ে দিচ্ছিলে। আর কোথায় পাব?’

কাকা রাগিয়া বলিলেন, ‘এ তোমার দুষ্টুমি—আসল কথা দেবে না। উঃ—এই মেয়েমানুষ জাতটা—। বেশ, র‍্যাপার গায়ে দিয়েই শোব।’ বলিয়া তিনি প্রস্থানোদ্যত হইলেন।

মা তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া বলিলেন, ‘ছি ঠাকুরপো, ছেলেমানুষী কোরো না, আজ এই ঘরেই শোও। এই শীতে কেবল র‍্যাপার গায়ে দিয়ে শুলে অসুখে পড়বে যে।’

‘তা হোক—হাত ছাড়।’

‘লক্ষ্মী ভাই আমার, আজ রাতটা শোও—আমি ভল্লুকে আমার বিছানায় নিয়ে যাচ্ছি।’

‘না।’

‘তুমি সব বিষয়ে এত বুদ্ধিমান বিচক্ষণ, আর এই সামান্য বিষয়ে এত অবুঝ হচ্ছ! ধর্মে-কর্মে তোমার এত নিষ্ঠে, আর যাকে মন্ত্র পড়ে বিয়ে করেছ তাকে হেনস্থা করলে পাপ হয়, এটা বুঝতে পার না।’

‘সে দোষ আমার নয়—তোমাদের। আমি বিয়ে করতে চাইনি।’

‘বেশ, দোষ আমাদের, আমি ঘাট মানছি। কিন্তু বৌ তো কোনও দোষ করেনি।’

কাকা উত্তর দিলেন না, হাত ছাড়াইয়া দ্রুতপদে প্রস্থান করিলেন।

তিনি চলিয়া গেলে মা কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিলেন। তারপর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ‘মায়া, জেগে আছ নাকি?’

কাকিমাও একটা নিশ্বাস ফেলিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিলেন, ‘হ্যাঁ।’

মা কিছু বলিলেন না, আরও কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া আবার একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস মোচন করিয়া ধীরে ধীরে প্রস্থান করিলেন।

চারিদিক হইতে এই দীর্ঘনিশ্বাস ফেলাফেলি দেখিয়া ভল্লুর খুল্লতাত-ভীতি অনেকটা কাটিয়া গেল। সে লেপের ভিতর হইতে মুণ্ড বাহির করিল। দেখিল, কাকিমা আলোর দিকে তাকাইয়া আছেন, তাঁহার দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া যাইতেছে।

কাকার নিষ্ঠুরতাই এই অশ্রুজলের হেতু তাহাতে সংশয় নাই। ভল্লু বিছানায় উঠিয়া বসিল, আবেগপূর্ণ স্বরে বলিল, ‘কাকিমা!’

চোখ মুছিয়া কাকিমা বলিলেন, ‘কি?’

ভল্লু বলিল, ‘কাকা নড়াধম—না?’

কাকিমা উত্তর দিলেন না।

ভল্লু আবার বলিল, ‘কাকা কারুর কথা শোনে না। মা’র কথা শোনে না, বাবার কথা শোনে না, তোমার কথা শোনে না—খালি আমাকে বকে। কাকা নড়াধম।’

কাকিমা এবারও তাহার কথায় সায় দিলেন না, তাহাকে কোলের কাছে টানিয়া লইয়া ভাঙা ভাঙা গলায় বলিলেন, ‘ঘুমো ভল্লু, অনেক রাত হয়েছে।’

ভল্লু শুইল বটে কিন্তু তাহার ঘুম আসিল না। কাঁচা ঘুমের উপর কাকার উগ্র অভিযানে তাহার ঘুম চটিয়া গিয়াছিল; সে নীরবে শুইয়া ভাবিতে লাগিল।

ক্রমে এগারোটা বাজিয়া গেল; ঠং করিয়া সাড়ে এগারোটা বাজিল। তবু ভল্লুর চোখে ঘুম নাই। সে উত্তপ্ত মস্তিষ্কে চিন্তা করিতেছে। কাকিমা অনেকক্ষণ জাগিয়া থাকিয়া মাঝে মাঝে বুক-ভাঙা নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে শেষে বোধ করি ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন। ভল্ল একবার ঘাড় ফিরাইয়া দেখিল, তাঁহার চক্ষু মুদিত, তিনি শান্তভাবে নিশ্বাস ফেলিতেছেন।

কাকিমার মুখের দিকে চাহিয়া ভল্লুর কাকার উপর ক্রোধ ও বিদ্বেষ আরো বাড়িয়া গেল। ডাকাত সর্দারের আর কত সহ্য হয়! আজ দ্বিপ্রহর হইতে যে অমানুষিক অত্যাচার তাহার উপর হইয়াছে, তাহা না হয় সে সহ্য করিয়াছে; তাহার সাধের তরবারিটা ভাঙিয়া ব্যবহারের অযোগ্য হইয়া গিয়াছে তবু সে কিছু বলে নাই। কিন্তু কাকিমার প্রতি নিষ্ঠুরতা—নারী নির্যাতন—সে কি করিয়া বরদাস্ত করিবে? ভল্লুর ক্ষুদ্র প্রাণের সমস্ত শিভাল্‌রি সঙ্গীন উঁচাইয়া খাড়া হইয়া উঠিল। যায় প্রাণ যাক্ প্রাণ—ভল্লু কাকাকে শাসন করিবেই!

কিন্তু—

প্রতিহিংসার কল্পনায় রাত্রি জাগরণ করা যত সহজ, কল্পনাকে কার্যে পরিণত করা তত সহজ নয়। উপায় চিন্তা করিতে করিতে ভল্লুর ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ফাটিয়া যাইবার উপক্রম হইল।

অবশেষে দীর্ঘ জটিল চিন্তার পর ভল্লু সিদ্ধান্তে উপনীত হইল। তাহার অধরে একটু হাসি দেখা দিল।

কাকা কাকিমার উপর অত্যাচার করেন বটে—কিন্তু দুর হইতে। ইহার প্রকৃত কারণ, তিনি কাকিমাকে ভয় করেন। বাড়ির মধ্যে কাকা কেবল কাকিমাকেই ভয় করেন। প্রমাণ, কাকিমা এ বাড়িতে আসার পর হইতে কাকা নিজের ঘর ছাড়িয়া পলায়ন করিয়াছেন; এমন কি বিছানা স্পর্শ করিবার সাহস পর্যন্ত তাঁহার নাই। মুখে তিনি যতই বীরত্ব প্রকাশ করুন না কেন, কাকিমার ভয়ে তিনি সর্বদা সন্ত্রস্ত হইয়া আছেন। নচেৎ বাড়িসুদ্ধ লোকের এত সাধ্য-সাধনা সত্ত্বেও তিনি কাকিমার সংস্পর্শে আসিতে গররাজি কেন?

এরূপ ক্ষেত্রে কাকাকে জব্দ করিবার একমাত্র উপায়—

ভল্লুর মুখের হাসি আরও বিস্তার লাভ করিল। সে ধীরে ধীরে শয্যা হইতে নামিল—কাকিমা জাগিলেন না। ঘড়িতে বারোটা বাজিল।

বিছানা ও লেপের তপ্ত আয়েস ত্যাগ করিতে তাহার কষ্ট হইল; কিন্তু সঙ্কল্পিত কর্তব্য পালন করিতে ভল্লু কোনও সময়েই পরাঙ্মুখ নয়। সে নিঃশব্দ পদক্ষেপে ঘরের বাহির হইল।

বাড়ি অন্ধকার। কোন্ অদৃশ্য স্থান হইতে একটা মট্ মট্ শব্দ আসিতেছে—যেন কে অন্ধকারে বসিয়া আঙুল মট্‌কাইতেছে। ভল্লুর বুক দুর্ দুর্ করিয়া উঠিল; সে কিছুক্ষণ দুই মুঠি শক্ত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

শব্দটা অপ্রাকৃত নয়, একটা দরজার তক্তায় কীট গর্ত করিতেছে। ভল্লু ধীরে ধীরে রুদ্ধ নিশ্বাস মোচন করিল। কিন্তু ভয় বস্তুটা এমনি যে বাস্তব অবাস্তবের অপেক্ষা রাখে না,—অন্ধকারে নিজের পদশব্দও আতঙ্কের সৃষ্টি করে। ভল্লুর প্রবল ইচ্ছা হইল, ফিরিয়া গিয়া বিছানায় শুইয়া পড়ে—কাজ নাই আর কাকাকে শাসন করিয়া। কিন্তু সে দাঁতে দাঁত চাপিয়া মনে মনে বলিল, ‘আমি ভল্লু সর্দার! আমি কাউকে ভয় করি না—কিছু ভয় করি না—’

তথাপি, চক্ষু দুটি দৃঢ়ভাবে বদ্ধ করিয়াই ভল্লু সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া চলিল। নিতান্ত পরিচিত পথ, তাই কোনও দুর্ঘটনা ঘটিল না। অবশেষে শীতে কাঁপিতে কাঁপিতে সে বৈঠকখানার দ্বারে উপস্থিত হইল।

ঘরে মৃদু আলো জ্বলিতেছে। ভল্লু দেখিল, আপাদমস্তক র‍্যাপার মুড়ি দিয়া কাকা প্রায় গামার মতোই কুণ্ডলিত হইয়া শুইয়া আছেন।

ভল্লু কাকার গা ঠেলিয়া ডাকিল, ‘কাকা।’

কাকা চমকিয়া উঠিলেন, ‘অ্যাঁ—কে!’—ভল্লুকে দেখিয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিয়া বলিলেন, ‘কি হয়েছে রে!’

শীতের সহিত অন্যান্য মানসিক আবেগ মিশ্রিত হইয়া ভল্লুর দন্তবাদ্য আরম্ভ হইয়াছিল, সে বলিল, ‘কাকিমার অসুখ করেছে—ত্‌তুমি শিগ্‌গির চল—’

‘কি হয়েছে?’

ভল্লু বিপদে পড়িল। রোগের লক্ষণ সম্বন্ধে সে আগে চিন্তা করে নাই; অথচ কাকা ডাক্তার, তাঁহাকে বাজে কথা বলিয়া প্রতারিত করা চলিবে না। পূর্বে কয়েকবার কাল্পনিক রোগের উল্লেখ করিয়া ভল্লু ধরা পড়িয়া গিয়াছে।

হঠাৎ তাহার একটা রোগের কথা মনে পড়িয়া গেল। কয়েক মাস আগে লিলির ঐ রোগ হইয়াছিল, (স্যান্টোনিন প্রয়োগে আরাম হয়)। লিলির যে রোগ হইয়াছিল তাহা কাকিমার হইতে বাধা নাই—বিশেষত যখন উভয়েই মেয়েমানুষ। ভল্লু ঢোক গিলিয়া বলিল, ‘দাঁত কিড়্‌মিড়্ করছেন।’

দাঁত কিড়্‌মিড়্ করিতেছে! হিস্টিরিয়া নাকি? কাকা ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। এত রাত্রে—! বিচিত্র নয়। আজ রাত্রে ঐ সব বকাবকির পর হয়তো—

কাকা জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘আর কি করছে?’

‘আর কিছু না—শুয়ে আছেন।’

হুঁ—হিস্টিরিয়াই বটে! কাকা একটু দ্বিধা করিলেন। কিন্তু অনুতপ্ত মানুষের কাছে কঠোর ব্রহ্মচারীর পরাজয় হইল। তিনি আলমারি হইতে একটা বেঁটে সবুজ রংয়ের শিশি লইয়া সংক্ষেপে বলিলেন, ‘চল।’

ভল্লুর বুকের ভিতর ধড়াস-ধড়াস করিতে লাগিল। কঠিন ও বিপজ্জনক কার্য ফলনোন্মুখ হইলে ঐরূপ সকলেরই হয়। সে নিঃশব্দে কাকার অনুসরণ করিল।

কাকা উপরে উঠিয়া ঘরের দ্বারের সম্মুখে একবার দাঁড়াইলেন; তারপর ভিতরে প্রবেশ করিলেন।

খাটের পাশে দাঁড়াইয়া রোগিণীর অনাবৃত মুখের দিকে চাহিতেই একটা অজ্ঞাতপূর্ব মধুর অনুভূতি তাঁহার সর্বাঙ্গের উপর দিয়া বহিয়া গেল। কিন্তু তিনি তখনই মনকে যথোচিত কঠিন করিয়া হস্তস্থ শিশির মুখ খুলিয়া রোগিণীর নাকের সম্মুখে ধরিলেন।

কাকিমা শিহরিয়া জাগিয়া উঠিলেন। ঠিক এই সময় দ্বারের কাছে খুট্ করিয়া শব্দ হইল। কাকা ঘাড় ফিরাইয়া দেখিলেন—দ্বার বন্ধ; ভল্লু ঘরে নাই।

তিনি এক লাফে গিয়া দরজায় টান মারিলেন—দরজা খুলিল না। বাহির হইতে শিকল লাগানো।

কাকা চাপা গর্জনে বলিলেন, ‘ভল্লু! শিগ্‌গির দোর খোল্ পাজি—নইলে খুন করব।’

কিন্তু ভল্লু তখন পাশের ঘরে গিয়া বাবার লেপের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে।

পরদিন ভোর হইতে না হইতে ভল্লুর ঘুম ভাঙিল।

মা বাবা তখনো সুপ্ত; ভল্লু চুপি চুপি উঠিয়া বাহিরে আসিল।

কাকিমার দরজা তেমনি বাহির হইতে শিকল লাগানো, অর্থাৎ কাকা সারারাত্রি বাহির হইতে পারেন নাই। বিজয়গর্বে ভল্লু সর্দারের মুখ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল; সে নিজমনে একবার কিরাত নৃত্য নাচিয়া লইল। ভবিষ্যতে তাহার ভাগ্যে যাহা আছে তাহা তো আছেই, তাই বলিয়া বর্তমানের বিজয়োল্লাস তো আর দমন করিয়া রাখা যায় না।

কিন্তু কাকা কিরূপ নির্যাতন ভোগ করিতেছেন তাহা স্বচক্ষে দেখিবার লোভও সে সম্বরণ করিতে পারিল না। জানালায় একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র ছিল—ভল্লু তাহাতে চোখ লাগাইয়া উঁকি মারিল।

যাহা দেখিল, তাহাতে স্তম্ভিত বিস্ময়ে চক্ষু চক্রাকার করিয়া ভল্লু সরিয়া আসিল। তারপর দৌড়িতে দৌড়িতে মা’র ঘরে ফিরিয়া গেল। ঘুমন্ত মা’কে নাড়া দিয়া জাগাইতে জাগাইতে উত্তেজনা-সংহত কণ্ঠে বলিল, ‘মা। মা! কাকা কাকিমাকে তিন্‌টে-পাঁচটা চুমু খাচ্ছেন।’

১০ চৈত্র ১৩৪১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *