ভল্টুর ভোল বদল

ভল্টুর ভোল বদল

 ভল্টু খেলে মিড ফিল্ডে।

দুরন্ত প্লেয়ার ভল্টু। যেমন উঠে গোল করে, তেমন নেমে গোল আটকায়। মাঠে সর্বক্ষণ পাঁই পাঁই করে ছুটছে। ওর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া খুব কঠিন। কখন যে মাঠের কোনদিকে ঘাপটি মেরে থাকে বোঝা দায়। এই ডান দিকে তো এই বাঁয়ে, এই সামনে তো এই পিছনে। বিদ্যুতের মতো গতি ছেলেটার। সেই গতিতে অনবরত পজিশন বদলাচ্ছে। পায়ে বল পেলে ছুটছে গাঁক গাঁক করে। কখনও ছোট পাসে বল ছাড়ছে। কখনও আবার নিজের বল কেড়ে নিয়ে শট হাকাচ্ছে মাঝমাঠ থেকে। প্রতিপক্ষের গোলে বল ঢুকে জালে জড়ামড়ি খাচ্ছে। অপনেন্ট খেলোয়াড়রা ভল্টুর ওপর নজর রাখতে গিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়ে। কোথায় যে কখন সুবিধে মতো জায়গা বদলে নেবে ভল্টু বোঝা যায় না। কোনও সন্দেহ নেই মিডফিল্ডার হিসেবে আশপাশের কুড়িটা ক্লাবের মধ্যেই ভল্টুই সেরা।

তার পরেও আমরা ভল্টুকে পছন্দ করি না।

পছন্দ করি না বললে কম বলা হবে। খুবই অপছন্দ করি। শুধু আমরা কেন, কুড়িটা ক্লাবের সবাই তাকে অপছন্দ করে। কেন করে? তার ব্যবহার খারাপ? একেবারেই নয়। সে খুবই অমায়িক প্রকৃতির ছেলে। বিনয়ীও বটে। তবে কি মারকুটে? তাও নয়। ‘শান্ত, নম্র, সাতচড়ে রা কাটে না’ টাইপ। স্কুলের মাস্টারমশাইরা বলেন, ‘গুড বয়’। তবু আমরা বলি ‘ব্যাড বয়।’ তবে কি ভল্টু ‘মিচকে পটাশ’? সব স্কুলেই এক ধরনের ‘মিচকে পটাশ’ ছেলে থাকে। মুখটা সবসময় ভিজে বিড়ালের মতো করে রাখে। আমি তো কিছু জানি না। আমি তো কিছু করিনি। আসলে ভিতরে ভিতরে পাজি। হিংসুটি আর নালিশকুটি। সুযোগ পেলেই মাস্টারমশাইদের কাছে গিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করবে।

‘স্যার, সন্তু আমার পেন নিয়ে নিয়েছে।’

মাস্টারমশাই হয়তো বলবেন, ‘আহা, নিজেদের ঝগড়া নিজেরা সামলে নে। এসব ব্যাপারে নালিশ করা ঠিক নয়।’

মিচকে পটাশ মাথা নেড়ে ভালোমানুষের মতো তখন চলে যাবে বটে, কিন্তু পরদিন আবার হাজির হবে মাস্টারমশাইয়ের কাছে। এবার নতুন নালিশ।

‘স্যার, পার্থ আমার অঙ্ক বই নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না।’

মাস্টারমশাই এবার জোর ধমক দেবেন। বলবেন, ‘উফ। বলেছি না, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমার কাছে মোটে আসবি না। তোর এই নালিশ অভ্যেস ছাড় মিচকে। তোকে না বলেছি, নিজেদের ঝামেলা নিজেরা সামলাবি। ক্লাস এইটে পড়িস। বড় হয়েছিস।’

মিচকে তখন মাথা চুলকে বলবে, ‘স্যার, সে তো সন্তুরবেলায় বলেছেন। সন্তুর নামে তো নালিশ করতে আসেনি। আমার অঙ্ক বই নিয়েছে পার্থ। পার্থর বেলায় নালিশ করতে তো আপনি বারণ করেননি।’

মাস্টারমশাই এতে যাবেন বিরাট রেগে। জোর ধমকে মিচকেকে ক্লাসে পাঠিয়ে দেবেন। বলবেন, ‘সন্তু, পার্থ দুজনের কারও বেলাতেই নালিশ করতে আসবি না। যা এখন।’

মিচকে পটাশ হাল ছাড়বার পাত্র নয়। সে তিনদিন পর আবার মাস্টারমশাইয়ের কাছে যাবে।

মাস্টারমশাই চোখ পাকিয়ে বলবেন, ‘কী রে সন্তু, আবার কী করল? নাকি এবার পার্থ? কার নামে কমপ্লেইন?’

মিচকে বিনয়ের সঙ্গে বলবে, ‘না, স্যার, সন্তু পার্থ কেউ নয়। এবার গৌর।’

মাস্টারমহাই আকাশ থেকে পড়বেন। বলবেন, ‘গৌর! সে তো ভালো ছেলে। সে আবার কী করেছে?’

মিচকে ঠান্ডা গলায় বলবে, ‘স্যার, বেশি কিছু করেনি। শুধু আমার জামায় কালি ছিটিয়েছে।’

মাস্টারমশাই যাবেন খুব রেগে। সেটাই স্বাভাবিক। যে ছেলেকে এতদিন ভালো বলে জানতেন তার নামে এমন বিতিকিচ্ছিরি নালিশ পেলে রাগ তো হবেই। তিনি গৌরকে ডেকে জোর বকুনি দেবেন।

‘ছি:, গৌর, তোমাকে আমরা ভালো ছেলে বলে জানতাম। সবাই তোমাকে নিয়ে গর্ব করি। সেই তুমি কিনা তোমার বন্ধুর সাদা জামায় কালি ছিটিয়ে দিলে? তোমার কাছ থেকে তো এই আচরণ আশা করি না। ছি-ছি। নো নো নো। কাজটা তুমি মোটেই ভালো করোনি।’

গৌর মাথা নামিয়ে বকুনি শুনবে। তারপর কাঁদো কাঁদো গলায় বলবে, ‘আমি তো কিছু জানি না স্যার। আমি কি করেছি? আমাকে বকছেন কেন?’

মাস্টারমশাই মিচকে পটাসের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলবেন, ‘গৌর তো কখনও মিথ্যে কথা বলে না।’

মিচকে বলবে, ‘জানি তো বলে না। ক্লাসে সবাই ওকে সত্যবাদী গৌর বলে ডাকি। কিন্তু স্যার, আমার জামায় তো কালি লেগেছে। এটা তো সত্যি স্যার, মিথ্যে নয়।’

স্যার রাগি গলায় বলবেন, ‘কোথায় লেগেছে?’

মিচকে বলবে, ‘পিঠে।’

মাস্টারমশাই দাঁত কড়মড় করে বলবেন, ‘পিঠে হলে তুই জানলি কী করে, গৌরই কাজটা করেছে। তোর কি মাথার পিছনে চোখ আছে? গৌর তো এসব কিছুই জানে না। তুই কেন তার নামে নালিশ করলি?’

মিচকে কাচুমাচু হয়ে বলবে, ‘স্যার আমিও জানি না। সন্তু বলল, কে ছিটিয়েছে পার্থ জানে। আমি তখন পার্থকে জিগ্যেস করলাম। পার্থ বলল, নিশ্চয় গৌর। আমিও আপনাকে এসে বললাম। ভুলও হতে পারে। হতে পারে কেন? মনে হচ্ছে, ওরাই ভুল করেছে। নিজেরা কালি ছিটিয়ে গৌরের নাম বলেছে। কিন্তু আপনি তো স্যার ওদের নামে নালিশ করবে বারণ করেছেন।’

কথা শেষ করে মিচকে বাধ্য ছেলের মতো মাথা চুলকোতে থাকবে।

মিচকের কথা শুনে মাস্টারমশাইয়ের এবার সব রাগ গিয়ে পড়বে সন্তুর আর পার্থর ওপর। নিশ্চয় ওরা ভুল বুঝিয়েছে। ব্যস, দুজনকে ডেকে তুমুল বকুনি দেবেন। তখন আড়ালে দাঁড়িয়ে মিচকে পটাশ মিচকি মিচকি হাসতে থাকবে।

আমাদের ভল্টু কিন্তু এরকম মিচকে পটাশ নয়। তার নালিশ করবার স্বভাব নেই। তার দোষ অন্য। বিরাট দোষ।

ভল্টু মাঝে মঝেই দল পাল্টায়। আমরা বলি ভোল পালটায়। আজ ‘সবুজ সংঘ’-এর হয়ে মাঠে নামছে তো কাল ‘আমরা সবাই’ ক্লাবের টিমে। কাল ‘আমরা সবাই’ তো পরশু ‘বেস্ট ইলেভেন’। পরশু ‘বেস্ট ইলেভেন’ তো পরদিন ‘মিলন সংঘ’। ‘মিলন সংঘ’-এর পরেই হয়তো চলে গেল ‘সবুজ পাতা’য়। কবে যে ক্লাব বদলাচ্ছে কেউ বুঝতে পারবেও না। দু-বছর আগে কেলেঙ্কারি কাণ্ড হল। ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের লিগ চলছিল। ভল্টু খেলছিল ‘জিততে হবে’ ক্লাবের হয়ে। সেমিফাইনালে ‘জিতবে হবে’-র হয়ে তিন-তিনটে গোল দিল। ‘জিততে হবে’ ক্লাবের ছেলেদের সে কী আনন্দ! তারা ভল্টুকে কাঁধে চাপিয়ে গোটা মাঠ ঘোরাল। বিকেলে ক্লাবঘরে ফিস্ট এবং ভল্টু সংবর্ধনা হল। ফিস্টের মেনু ছিল ভাত, মাংস আর একটা করে রসগোল্লা। সেখানে ভল্টু গলায় গাদা ফুলের মালা পরে ভাষণ দিল। নিজে থেকে দিল না। সবাই জোর করে বলে দিল।

‘জিততে হবে ক্লাবের বন্ধুগন। আমি আজ বড় খুশি। আমি জিততে হবে ক্লাবের হয়ে খেলতে পেরেছি। তিনটে গোল দিয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছি। এই ক্লাবকে আমি প্রাণের থেকে বেশি ভালোবাসি। আমি যখন কোনও ম্যাচে জিততে হবে ক্লাবের হয়ে গোল দিই তখন মনে হয় শত্রুপক্ষকে তছনছ করে দিলাম। আমি জিততে হবে ক্লাবের জন্য গর্বিত। আজ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জিততে হবে ক্লাব আমাকে যা যা উপহার দিয়েছে তার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।’

ভল্টুর ভাষণ শুনে সবাই হাততালি দিয়ে উঠল।

ভল্টু হাত দেখিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলল। তারপর বলল, ‘আমি আজ কথা দিচ্ছি, জিততে হবে ক্লাবকে আমি ফাইনালে জিতিয়ে আনব। সেদিন বেস্ট ইলেভেন আমাদের বিরুদ্ধে খেলবে। তারা হাড়ে হাড়ের বদলে পায়ে পায়ে টের পাবে, ভল্টু কত বড় প্লেয়ার।’

এবার আরও জোর হাততালি পড়তে লাগল। ক্লাবের সব মেম্বার চিৎকার করে উঠল।

‘থ্রি চিয়ার্স ফর জিততে হবে, হুর হুর হুররে।’

‘থ্রি চিয়ার্স ফর ভল্টু, ‘হুর হুর হুররে।’

‘থ্রি চিয়ার্স ফর ফাইনাল ম্যাচ, হুর হুর হুররে।’

ফাইনালে ঘটনা ঘটল উলটো। ভল্টু প্রমাণ করল সত্যি সে বড় প্লেয়ার! চুপিচুপি ভোলবদল করল। খেলার সময় সবাই দেখল, ভল্টু বেস্ট ইলেভেনের হয়ে মাঠে নেমেছে। বেস্ট ইলেভেন দু-গোলে জিতল। দুটো গোলই দিল আমাদের ভল্টু। ‘জিততে হবে’কে ‘হারতে হবে’ বানিয়ে দিল। সন্ধেবেলা বেস্ট ইলেভেনের ক্লাব ঘরে বিরাট হইচই হল। ফিস্ট হল, ভল্টুকে সংবর্ধনা দেওয়া হল। ভল্টু সেখানে লজ্জা লজ্জা মুখ করে ভাষণ দিল।

‘বন্ধুগন। আমি বেস্ট ইলেভেনের হয়ে ফাইনাল ম্যাচ খেলতে পেরে আনন্দিত, গর্বিত। আমার বহুদিনের স্বপ্ন বেস্ট ইলেভেনের হয়ে খেলব। সেই স্বপ্ন আজ সত্যি হল। এতদিন আমি জিততে হবে ক্লাবের হয়ে খেলেছি। ওদের কাছ থেকে কী পেয়েছি? না পেয়েছি সম্মান না পেয়েছি যত্ন। অথচ আমি ছাড়া জিততে হবে কি কখনও জিততে পারত? আমি অভিমানে ক্লাব বদলেছি। ক্ষোভে দল বদলেছি। বুঝেছি, জিততে হবের সঙ্গে থাকা আমার ঠিক হয়নি। ভুল হয়েছে।’

‘বেস্ট ইলেভেন’ ক্লাব চিরকালই ‘জিততে হবে’ ক্লাবের শত্রু। তারা ভল্টুকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। তারা তার ভাষণ শুনে হাততালি দিয়ে উঠল।

পরদিন ‘জিততে হবে’ ক্লাবের ছেলেরা ভল্টুকে চেপে ধরেছে।

‘এটা কী হল ভল্টু?’

ভল্টু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘কোনটা কী হল?’

‘তুই দল বদলালি কেন?’

ভল্টু বলল, ‘দল বদলেছি তো কী হয়েছে, বল তো বদলায়নি। আগেও ফুটবল খেলতাম, এখনও খেলছি।’

‘তোর লজ্জা করল না?’

ভল্টু অবাক হয়ে বলল, ‘কেন লজ্জা করবে কেন? ফুটবল ম্যাচে লজ্জা কী? হারলে লজ্জা, জিতলে লজ্জা কীসের? আমরা তো জিতেছি।’

‘তুই আমাদের ক্লাবের হয়ে এতদিন খেলেছিস, সেই ক্লাবের প্রতি তোর কোনও টান নেই? কোনও ভালোবাসা নেই?’

ভল্টু হেসে বলল, ‘না নেই। ক্লাবের ওপর আমার কখনও টান থাকে না। মেডেলের ওপর টান থাকে। যখন তোদের ক্লাবের হয়ে খেলেছি, সেমিফাইনালে জিতে মেডেল পেলাম। এবার বেস্ট এগারোর হয়ে খেলে আমার মেডেল পেলাম।’

‘আমাদের সঙ্গে থাকলেও তো জিতে মেডেল পেতিস।’

ভল্টু হাই তুলে বলল, ‘তা হয়তো পেতাম, কিন্তু হয়েছে কী জানিস, ওদের সংবর্ধনার উপহারগুলো খুব ভালো। একটা বড় ঘড়ি দিয়েছে। ঘড়ি আগে না ক্লাব আগে।’

‘জিততে হবে’ ক্লাবের ছেলেরা এই কথা শুনে এত অবাক হল যে তারা আর ঝগড়াও করতে পারল না। দলের থেকে ঘড়ি বড়। ছি-ছি।

পরের বছর ভল্টু ‘বেস্ট ইলেভেন’ ছাড়ল। চলে গেল ‘নতুন পথে’। ‘নতুন পথে’ ক্লাব নাকি তাকে কথা দিয়েছিল, প্রতিটা ম্যাচের পর পেট পুরে বিরায়ানি খাওয়াবে। ভল্টু ‘নতুন পথ’ ছেড়ে ‘কিশোর বৃন্দ’-তে গেল টিমের ক্যাপ্টেন হবার লোভে। আবার এই ‘কিশোর বৃন্দ’ ছেড়ে ডিগবাজি দিল ‘কোরাস’ ক্লাবে। তারা টোপ দিয়েছে টিমের শুধু নয়, ক্লাবের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি করবে।

সবাই ভল্টুকে ডাকে ভল্টি। বলে, ওই ছেলের ফুটবল না খেলে পোল ভল্ট খেলা উচিত। যে ছেলের নিজের ক্লাবের প্রতি কোনও রকম ভালোবাসা, ভরসা, টান থাকে না সে আবার প্লেয়ার নাকি! ফুটবল খেলা কি শুধু পা দিয়ে হয়? মোটেও না। এই খেলায় আবেগ লাগে। ক্লাবকে জেতানো, তাকে অপনেন্টের হাত থেকে রক্ষা করা, তাকে বড় করবার জন্য খেলতে হয়। শুধু নিজের কথা ভাবলে চলে না। ভালো প্লেয়ার শুধু নিজের কথা ভাবে না। গোটা টিমের কথা ভাবে।

এই কারণেই আমরা ভল্টুকে মোটে পছন্দ করি না। খুব চাই, একবার ও ঝামেলায় পড়ুক। ঘন ঘন ভোল বদলের মজা টের পাক।

ভল্টু ঝামেলায় পড়ল। জমজমাট ঝামেলায়।

রবিবার খেলা ছিল। নক আউট ম্যাচ। স্কুলের মাঠে ভিড়ে ভিড়াকার। খেলবে ‘জীবন-মরণ’ আর ‘হা রে রে রে’ ক্লাব। দুই ক্লাবেরই শক্তিশালী টিম। এক টিম জীবন-মরণ দিয়ে লড়াই করবে আর এক দল ‘হা রে রে রে’ করে তাড়া করবে। ভল্টু খেলছে জীবন-মরণের হয়ে। দল পালটাতে পালটাতে সে এখন এই টিমে। খানিকক্ষণের মধ্যে খেলা জমে উঠল। এ বলে আমাকে দেখ, ও বলে আমাকে দেখ। ফার্স্ট হাফ শেষ হবার মুখে মুখে ভল্টু ব্যাক ভলি দিয়ে ‘হা রে রে রে’-র গোলে বল ঢুকিয়ে দিল। ‘জীবন-মরণ’-এর সাপোর্টাররা মাঠে নেমে ভল্টুকে জড়িয়ে ধরল। হাফ টাইম পর্যন্ত ‘হা রে রে রে’ কোণঠাসা। ভল্টু তাদের নাকানি চোবানি খাইয়ে ছাড়ল। দুটো গোল হতে হতে কোনওরকমে বেঁচে গেল।

হাফ টাইমে দু-দলের প্লেয়াররা বিশ্রাম নিতে চলে গেল ড্রেসিংরুমে।

শুরু হল সেকেন্ড হাফের খেলা। টানটান উত্তেজনা। ‘হা রে রে রে’—কি পারবে গোল করতে? নাকি ‘জীবন-মরণ আরও গোল দেবে?

সাত মিনিটের মাথায় ‘জীবন মরণ’-এর গোলে বল ঢুকল। কী হল! কী ব্যাপার! ব্যাপার সাংঘাতিক। সেমসাইড। সেমসাইড করেছে আর কেউ নয়, খোদ ভল্টু। নিজের ক্লাবের গোলে নিজেই বল ঢুকিয়েছে। জীবন-মরণের সাপোর্টাররা মাথায় হাত দিয়ে বসল। শেষ পর্যন্ত কিনা ভল্টু এভাবে ডোবাল! যাক, নিশ্চয় বাকি সময়ের মধ্যে পুষিয়ে দেবে সে। ভালো প্লেয়ারেরও তো মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়। হয় না? বুকভরা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সবাই অপেক্ষা করতে লাগল।

পুষিয়ে দিল ভল্টু।

খেলা শেষের মিনিট খানেক আগে আবার মেসসাইড করল জীবন-মরণ। নিজের টিমের গোলে বল ঢোকাল সেই ভল্টু। তবে এবার মাঠসুদ্ধ সবাই দেখতে পেল, কোনও ভুল হয়নি, ভল্টু ইচ্ছে করে নিজের গোলে শট মেরেছে। বল জড়িয়েছে নিজের নেটে।

এরপর কী ঘটল সবাই বুঝতে পারছে। জীবন-মরণের বাকি প্লেয়ার আর সাপোর্টারদের আর বুঝতে বাকি রইল না। সবাই ভল্টুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাকে উদ্ধার করে যখন ডাক্তারখানায় নিয়ে যাওয়া হল তখন তার অবস্থা কাহিল। জার্সি ছিঁড়ে গেছে। প্যান্টের অবস্থা ভয়ংকর। এক পায়ে জুতো নেই। দুটো দাঁত পড়েছে। একটা চোখের তলায় কালশিটে।

বিশ্বাসঘাতকার শাস্তি।

ভল্টু মিনমিন করে বলল, ‘বারে আমার কী দোষ? সেকেন্ডহাফ আমি তো হা রে রে রে ক্লাবের হয়ে খেলেছি। হাফ টাইমে ওরা যে বলল, আমাকে অনেক কিছু দেবে। মেডেল, ট্রফি। সেই কারণেই তো দল বদল করলাম। ওদের হয়ে গোল করলাম। আমাকে মারধোর করল কেন! টিম বদল করা কি বেআইনি?

যুক্তি ঠিক আছে। টিম বদল করা বেআইনি নয়। তা ছাড়া পৃথিবীর ফুটবল ম্যাচের ইতিহাসে এই ভাবে খেলার মাঝখানে টিম বদল করাবার কথা কারও জানা নেই। ফলে নিয়মটাও কারও কাছে স্পষ্ট নয়। সমস্যা হল, ভল্টু এতদিন ক্লাবের সাপোর্টারদের পাল্লায় পড়েনি। ক্লাবের প্রতি তাদের ভালোবাসা, টানের কথা জানত না। কোনও উপহারেই সেই ভালোবাসা কেড়ে নেওয়া যায় না সেখবরও তার কাছে ছিল না। সেই কারণে তার কপালে উত্তম মধ্যম জুটল।

ভল্টু আর কখনও ভোল বদল করেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *