ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) – বিখ্যাত ফরাসি চিন্তাবিদ
মহাজ্ঞানী ভলতেয়ার (Voltaire) ছিলেন এমনই এক বিতর্কিত মহাপ্রাণ ব্যক্তি, যাঁর লেখার অজস্র ভক্ত ছিল সারা বিশ্বে। অথচ ১৭৭৪ সালের ৩০ মে তারিখে যেদিন তিনি মারা যান সেদিন তাঁর মৃত আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রথা অনুসারে প্যারিসের কোনো গির্জায় ঘণ্টাধ্বনি করা হয়নি, এমনকি কোনো প্রার্থনা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি। নীরবে আর অবহেলায় শুধু তাঁর একান্ত ভক্তরা এই দার্শনিকের মরদেহ বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন শহরের এক নির্জন প্রান্তে। তারপর সেখানেই তাঁকে অযত্নে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
অথচ এর মাত্র এক যুগ পরেই ১৭৯০ সালে ফরাসি বিপ্লবের সূচনা লগ্নে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় আকাশচুম্বী। যে ভলতেয়ারের মৃতদেহ একদা অবহেলায় শহরতলির নির্জন পরিবেশে সমাধিস্থ করা হয়েছিল, সেই দেহাবশেষই তাঁর লাখো ভক্ত মিলে বিশাল শোভাযাত্রা করে তুলে নিয়ে আসে শহরের কেন্দ্রস্থলে। সেদিন তাঁর দেহাবশেষ বহনকারী কফেলাটিকে বিপুল জনতা পথের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থেকে জানিয়েছিল প্রাণঢালা শ্রদ্ধা। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গার্ড অব অনার দান করেছিল ছয় লক্ষ সৈন্য। তাঁর শববাহী শকটের ওপর লেখা ছিল “এই মহামানব দিয়ে গেছেন মহান প্রেরণা, করেছেন আমাদের মহামুক্তির পথ উন্মোচন।”
মহাজ্ঞানী ভলতেয়ারের জন্ম ১৬৯৪ সালের ২১ নভেবম্বর। পিতার নাম ছিল ফ্রাঁসোয়া এবং মায়ের নাম ছিল মারি আরোয়েত। কিন্তু মজার ঘটনা হল—ফ্রাঁসোয়া- ম্যারি দম্পতি এক অজ্ঞাত কারণে তাঁদের সন্তান হওয়ার খবর চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। সন্তানজন্মের কথা গোপন রাখার একটি বিশেষ কারণ ছির বলেও অনেকে মনে করেন।
এ সম্পর্কে পরবর্তী সময়ে ভলতেয়ার তাঁর স্মৃতিকথায় নিজেই বলেছেন, আমার প্রকৃত পিতার (জন্মদাতার) নাম ছিল রোচেব্রুয়েঁ। তিনি ছিলেন একজন গীতিকার। তিনি আরও বলেছেন, আমার সামাজিক আইনসঙ্গত পিতা ফ্রাঁসোয়ার প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধাবোধ ছিল না। আর সে কারণেই আমি পিতার কাছে বেশিদিন থাকিনি। তিনি অবশ্য তাঁর মা সম্পর্কে কিছু বলেননি। তাঁর যখন মাত্র সাত বছর বয়স, তখনই তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়।
মায়ের মৃত্যুর পরপরই তিনি নিজেও বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে আসেন অ্যাবে ডি চ্যাটেয়াওনিয়ফ নামে এক পাদরির কাছে। পাদরি সাহেব তাঁর লালনপালনের দায়িত্ব অর্পণ করেন ৮৪ বছর বয়স্কা লিনোঁ ডে লেক্লোস নামের এক ধাত্রীমাতার কাছে।
অবশ্য পাদরি সাহেবও তাঁকে নিয়মিত দেখাশোনা করতেন এবং তাঁর কাছে থেকেই ভলতেয়ার মুক্তচিন্তা ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন।
গির্জার প্রাথমিক পড়া শেষ করে তিনি ভর্তি হন প্যারিসের লুইস-লি-গ্রাদে অবস্থিত জেসুইট কলেজে। এখানেই তিনি রোম্যান্টিক কাব্য, নাটক এবং সমাজবিজ্ঞানের ওপর পড়াশোনা করেন।
কলেজ থেকে পাস করে বের হয়ে আসার পর তাঁর পিতা ফ্রাঁসোয়া চাইছিলেন, ছেলে আইন পড়ুক। এতে সে ভাল আয়-উন্নতি করতে পারবে। কিন্তু ভলতেয়ার আইন পড়তে রাজি হলেন না। বিশেষ করে পিতার মতের সাথে সায় দিতে তাঁর মন চাইত না। পিতা যা বলতেন, তিনি ইচ্ছে করেই তার উলটোটা করতেন। তাই পিতার ইচ্ছা অনুসারে আইন না পড়ে তিনি ঢুকলেন চাকরিতে। ফরাসি দূতাবাসের সেক্রেটারির পদে চাকরি নিয়ে তিনি চলে যান হল্যান্ডে।
কিন্তু সেখানে গিয়েও ঘটালেন আরেক কেলেঙ্কারী। জনৈক ধনী ব্যক্তির মেয়ের প্রেমে পড়ে গেলেন ভলতেয়ার। ফরাসি রাষ্ট্রদূত এই খবর গোপনে জানতে পেরে কোনো অঘটন ঘটার আগেই ভলতেয়ারকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন দেশে।
চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরার পর তাঁর পিতা চাইছিলেন, ছেলে এবার ব্যবসা করুক। কিন্তু ভলতেয়ার আবারও বাবার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বসলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন সাহিত্য সাধনা করে জীবিকানির্বাহের
রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সময় দেশ জুড়ে ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামির প্রাবল্য। ধর্ম পালন নিয়ে ছিল বাড়াবাড়ি। কিন্তু চতুর্দশ লুইয়ের মৃতুর পর দেশে ধর্মীয় গোঁড়ামি অনেকখানি কমে আসে। ভলতেয়ার ছিলেন মুক্তচিন্তার অধিকারী। তাঁর রচিত সাহিত্যও ছিল সমাজসংস্কারের পক্ষে ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার। তাই রাজা চতুর্দশ লুইয়ের মৃত্যুর পর সারা দেশে ভলতেয়ারের সাহিত্যখ্যাতি বেড়ে যায়। তাঁর জনপ্রিয়তাও বাড়তে থাকে দ্রুত।
১৭১৮ সালে তিনি মহাকবি ভার্জিলের ঈনিদ-এর মতো করে ৪র্থ হেনরির জীবনী অবলম্বনে রচনা করেন ‘লা হেনরিয়েড’ নামে একটি মহাকাব্য।
উল্লেখ্য, এই সময় থেকেই তিনি তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম গ্রহণ করেন ভলতেয়ার। তাঁর আসল নাম ফ্রাঁসোয়া-মারি আরুয়ে।
এই মহাকাব্য রচনার পর থেকেই তিনি রাজানুগ্রহ লাভ করেন এবং দেশের তরুণী রানি মারির প্রিয়পাত্রে পরিণত হন। পরে রানির আশীর্বাদ লাভ করেই তিনি একটি মাসিক বৃত্তি এবং রাজসভায় কবির পদে মনোনয়ন লাভ করেন।
রাজসম্মান লাভ করার পরপরই ভলতেয়ারের জীবনেরও মোড় ঘুরে যায়, তিনি সমাজ ও সাহিত্য-শিল্পমহলের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে মেলামেশা করার সুযোগ লাভ করেন। তিনি মুক্তচিন্তার অধিকারী হিসেবে দেশের অন্যতম খ্যাতনামা দার্শনিক বলেও বিবেচিত হতে থাকেন।
তিনি এবার ইংরেজি ভাষাতেও সাহিত্যরচনা শুরু করেন। ফ্রান্সে তখন মুক্তচিন্তার পরিবেশ ছিল। ফলে ভলতেয়ার তৎকালীন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত টোরি নেতা ভিসকাউন্ট বোলিংব্রোক-এর সাথেও সাক্ষাৎ করার সুযোগ পান। উল্লেখ্য, নেতা বোলিংব্রোক তখন রাজনৈতিক কারণে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবনযাপন করছিলেন।
ভলতেয়ার বোলিংব্রোককে প্রশংসা করে প্রাচীন রাজনৈতিক দার্শনিক সিসেরোর সাথে তুলনা করে একটি কবিতা রচনা করেন। এতে করে তিনি খুবই খুশি হন। পরে ব্রোলিংব্রোকের উৎসাহেই ভলতেয়ার ইংরেজি সাহিত্য পড়তে শুরু করেন।
কিন্তু নিজ দেশের ভাষা ও সাহিত্য ফেলে ইংরেজি ভাষা শেখা ও ইংরেজি সাহিত্য পড়তে গিয়ে দেশের কিছু কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির বিরাগভাজন হন তিনি। তাঁর ইংরেজি ভাষা শেখা ও সাহিত্যিক ছদ্মনাম গ্রহণ করা নিয়ে ফ্রান্সের তৎকালীন প্রভাবশালী ব্যক্তি চেভালিয়ের ডি রোহাঁ ঠাট্টামশকরা শুরু করে দেন। এতে ভলতেয়ার খুব রেগে যান। কিন্তু তাতে করে পরিস্থিতি আরও হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। রোহাঁ ছিলেন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী লোক। তিনি ভলটেয়ারকে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে মারধোর করেন এবং বাস্তিল দুর্গে আটকে রাখেন।
এতে ভলতেয়ার আরও খেপে যান এবং খুবই অপমানিত বোধ করেন। এর ফলেই তিনি ১৭২৬ সালের ৫ মে ফ্রান্স থেকে পালিয়ে লন্ডনে চলে যান। এখানে অবস্থান করার সময় তিনি ইংরেজি সাহিত্য আরও ভালোভাবে পড়তে এবং লিখতে শেখেন। এ ছাড়া ইংরেজি সাহিত্যের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অনেক লেখকের সাথে পরিচিত হওয়ারও সুযোগ লাভ করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্ডার পোপ ও স্যামুয়েল ক্লার্ক প্রমুখ লেখক।
তাঁর লন্ডনে আসা এবং এখানে থাকা-খাওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতা বোলিংব্রোকের ওপর। উল্লেখ্য, তিনিও ততদিনে তাঁর নির্বাসিত জীবন শেষ করে দেশে ফিরে এসেছিলেন। ভলতেয়ার ছিলেন তাঁরই আশ্রয়ে।
বোলিংব্রোকের পরামর্শেই ভলতেয়ার তাঁর লেখা মহাকাব্য ‘লা হেনরিয়েড’ রানি ক্যারোলিনকে উৎসর্গ করলেন। এতে ইংল্যান্ডের রাজদরবারের সাথেও তাঁর একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৭২৮ সালের শেষের দিকে কিংবা ১৭২৯ সালের প্রথম দিকে তিনি আবার স্বদেশ ফ্রান্সে ফিরে আসেন। এসেই ইংরেজি সাহিত্য ও ব্রিটিশ সমাজকে নতুন করে নতুন ভঙ্গিতে স্বদেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে লাগলেন।
তিনি শেপিয়ারের নাটকের ‘জুলিয়াস সিজার’ অবলম্বনে রচনা করলেন একটি করুণ রসাত্মক নাটক। নাম ‘ব্রুটাস’ (Brutus)। উল্লেখ্য, ‘ব্রুটাস’ নাটকটি তিনি লন্ডনে থাকতেই লিখতে শুরু করেছিলেন শেষ করেন ফ্রান্সে এসে।
এরপর ১৭৩০ সালে রচনা করেন তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বোলিংব্রোকের জীবন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর একটি বই—’ডিসকোর্স এ মিলর্ড বোলিংব্রোক’ (Discoures a Milord Bolingbroke)। শেপিয়ারের হ্যামলেট (Hamlet) নাটকের কাহিনী অবলম্বনেও লেখেন ১৭৩২ সালে ‘ইরিফাইল’ (Eriphyle) নামে একটি নাটক। ১৭৩৫ সালে রচনা করেন জুলিয়াস সিজারের ওপর ভিত্তি করে আরও একটি নাটক—’লা মোর্ট ডে সিজার’ (La Mort de Cesar)। তবে তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাটক হল ‘জয়ের’ (Zoire)। এটি রচিত হয়েছিল ১৭৩২ সালে।
কিন্তু তিনি শুধু নাটকই নয়, রচনা করেছেন অনেকগুলো ঐতিহাসিক গ্রন্থও। লন্ডনে অবস্থানকালেই তাঁর সাথে পারিচয় ঘটে সুইডেনের রাজা দ্বাদশ চার্লসের। ভলতেয়ার এই রাজা ও মহান সৈনিকের চারিত্রিক গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে যান।
তারপর দ্বাদশ চার্লসের গৌরবময় জীবনের ওপর রচনা করেন ঐতিহাসিক গ্রন্থ Histoire de Charles XII। তিনি বইটি এমন চমৎকার ভঙ্গিতে ও সাহিত্যরসমণ্ডিত করে রচনা করেন যে, এটি কেবল একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ হিসেবে নয়, অবিকল গল্পের ভঙ্গিতে রচিত একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের মর্যাদাও লাভ করে।
১৭৩৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দর্শনের ওপর গ্রন্থ ‘লেটারস ফিলোসোফিস্’ (Lettres Philosophiques)। এটি ছিল পত্রের আকারে লেখা। এই গ্রন্থ প্রকাশের পরপরই সমগ্র ইউরোপে সৃষ্টি হয় চরম উত্তেজনা। তিনি তৎকালীন সমাজের ধর্মগুরু এবং পুঁজিবাদী ধনিকগোষ্ঠীর শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ করেন তাঁর মুক্ত ও স্বাধীন মতবাদ।
ফলে স্বাভাবিক কারণেই ধর্মগুরুদের শ্যেনদৃষ্টি নিপতিত হয় তাঁর ওপর। তখন বাধ্য হয়েই ভলতেয়ার আত্মরক্ষার জন্য প্যারিস ত্যাগ করে চলে আসেন ফ্রান্সের দক্ষিণ- পশ্চিম প্রদেশ লোরেনে।
এখানেই মাদাম দ্যু স্যাৎলে নামের এক বিদুষী মহিলার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ে ঘটে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ না হয়েও তিনি সালের সাথে সুখী দম্পতির মতো বসবাস করতে থাকেন।
পরবর্তী সময়ে মাদাম সালেও তাঁর ওপর প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁর জীবনসঙ্গিনীরূপে প্রায় চোদ্দ বছর তাঁকে সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন এই মহিলা। সালের অনুপ্রেরণাতেই তিনি রচনা করেন ‘অ্যাডেলেইড দু গুয়েসক্লিন’ (Adelaide du Guesclin) নামে একটি বিয়োগান্ত নাটক। এর দুবছর পর ১৭৩৬ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর সর্বাধিক মঞ্চসফল নাটক ‘অ্যালজায়ার’ (Alzire)।
এই সময় তাঁর জীবনসঙ্গিনী মাদাম সালেও বিজ্ঞানী নিউটনের লেখা অনুবাদ করার জন্য ইংরেজি শিখছিলেন। তাঁরই অনুরোধ ও অনুপ্রেরণাতেই ভলতেয়ার নিউটনের বৈজ্ঞানিক দর্শনের ওপরও ১৭৩৮ সালে রচনা করেন একটি গ্রন্থ ‘ইলিমেন্টস ডে লা ফিলোসোফি ডে নিউটন (Elements de la Philosophie de Neueton )।
একই সাথে তিনি তাঁর ঐতিহাসিক গ্রন্থ প্রণয়নের কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৭৫১ সালে রচনা করেন Le Siecle de Loui’s XIV। ১৭৫৬ সালে রচনা করেন রাজনৈতিক দর্শনের ওপর অপর একটি মূল্যবান গ্রন্থ Essai Sur les Moeurs |
একই সময়ে ভলতেয়ারের জীবনসঙ্গিনী সালে রচনা করেন বাইবেলের ওল্ড টোস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্টের ওপর গবেষণাগ্রন্থ একজামেন (Examen)।
এর আগে ১৭৩৯ সালে ভলতেয়ার তাঁর প্রেমিকা সাৎলেকে নিয়ে বের হয়েছিলেন দেশভ্রমণে। তিনি প্রথমে আসেন ব্রাসেলসে। সেখান থেকে যান বেলজিয়াম, সাইরে (Cirey) এবং প্যারিসে।
এই সময় তাঁর সাথে পরিচয় ঘটে প্রুশিয়ার যুবরাজের, যিনি পরে দ্বিতীয় ফ্রেডেরিক নামে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। তিনি প্রুশিয়ার ‘পিটার দি গ্রেট’ হিসেবে অভিহিত হয়েছিলেন।
তিনি পিটার দি গ্রেটের আমন্ত্রণক্রমে প্রুশিয়ায় গমন করে সেখানকার ক্লেভেলে অবস্থান করতে থাকেন। তারপর ১৭৪২-৪৩ সালে যখন অস্ট্রিয়ার সাথে প্রুশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তাঁকে নিরাপদ স্থান বার্লিনে পাঠানো হয়। এই সময় তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীর পক্ষেও গোপনে কাজ করেন। ফলে লাভ করেন ফ্রান্সের রাজার অনুগ্রহ।
এই সময় তিনি ফ্রান্সের রানি মাডাম দ্য পম্পিডুর প্রিয়পাত্র জোসেফ প্যারিস ডুভারনের ভাইঝি মাদাম ডেনিস-এর প্রেমে পড়েন।
এই নতুন প্রেমের কথা তাঁর জীবনসঙ্গিনী সালেও জানতেন। কিন্তু রানির অনুগ্রহ পেলেও ফ্রান্সের রাজা পঞ্চদশ লুই কিন্তু তাঁকে খুব পছন্দ করতেন না। এ ছাড়া রোমান ক্যাথলিক গির্জার পাদরিরা তাঁর ওপর আগে থেকেই চটে ছিলেন। তাঁর ধর্মবিরোধী ও মুক্তচিন্তার কথাগুলো পাদরিদের কাছে আগে থেকেই ভয়ানক বিষবৎ হয়ে উঠেছিল।
তবু এর মধ্যেই তিনি আবার প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন ১৭৪৭ সালে। এই সময়েই অর্থাৎ ১৭৪৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর বিখ্যাত আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জাদিগ’ (Zadig)। ১৭৪৮ সালে প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘ভিসন দ্য ব্যাবোক’ (Vision de Babouc)। ১৭৪৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘মেমো’ (Memmon)। ১৭৫২ সালে প্রকাশিত হয় ‘মাইক্রোমেগাস’ (Micromegas) নামের উপন্যাস।
১৭৪৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তাঁর জীবনে নেমে আসে সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। তাঁর দীর্ঘ চোদ্দ বছরের জীবনসঙ্গিনী ও সাহিত্যকর্মে অনুপ্রেরণাদাত্রী মাদাম দু সালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হন। তিনি অসহায়ের মতো প্রেমিকার পাশে দাঁড়িয়ে এই মর্মান্তিক মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেন।
এই মৃত্যুতে খুব ভেঙে পড়েন ভলতেয়ার। তিনি ফিরে আসেন তাঁর প্যারিসের শূন্য ঘরে, যে ঘরে একদা সালে এসে তাঁর সাথে ঘর বেঁধেছিলেন। প্রিয়তমা সালের মৃত্যুতে তিনি এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে, প্রায় রাতেই তিনি ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে আসতেন এবং সালের নাম ধরে উন্মাদগ্রস্তের মতো করে ডাকতেন।
এই মর্মপীড়ার সময়েই তিনি প্রুশিয়ায় সম্রাট পিটার দি গ্রেটের কাছ থেকে আমন্ত্ৰণ লাভ করেন। রাজার আমন্ত্রণেই তিনি আবার বার্লিনে আসেন ১৭৫০ সালের ২৮ জুন তারিখে।
প্যারিসে তাঁর অনুপস্থিতির সময়েই তাঁর মতাদর্শের বিপরীত আদর্শে বিশ্বাসী একদল তরুণ লেখকের আবির্ভাব ঘটে। আর এমনি করে তিনি ধীরে ধীরে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। এদিকে বার্লিনেও তাঁর দিনকাল ভালো যাচ্ছিল না। তাঁর বন্ধুমহল ও বুদ্ধিজীবীমহলের অনেকের সাথে তাঁর মতপার্থক্য শুরু হয়ে যায়। বিশেষ করে বার্লিনে ফ্রেডরিক’স অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের সভাপতি ম্যাপারটুইসের সাথে তাঁর শুরু হয়ে যায় ঘোর বিবাদ-বিসস্বাদ।
ভলতেয়ার রেগে গিয়ে রাজা ফ্রেডরিক এবং তাঁর অ্যাকাডেমিকে আক্রমণ করে ১৭৫২ সালে একটি বুকলেট ‘ডিয়াট্রাইব দু ডকটিউর অ্যাকাকিয়া’ (Diatribe du doc- teur Akakia) প্রকাশ করে বসেন। এতে করে তাঁর অবস্থা আরো সঙ্গীন হয়ে ওঠে | রাজা যে তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন, এটা টের পেয়ে ভলতেয়ার গোপনে বার্লিন ত্যাগ করে প্যারিসে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছনো তাঁর পক্ষে সম্ভব হলো না। প্যারিসে আসার পথেই ১৭৫৩ সালের ২৬ মার্চ তারিখে তাঁকে গ্রেফতার করে কোলমার নামক স্থানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এখানে তিনি এক বছর গৃহবন্দি ছিলেন।
তারপর আবার তাঁকে নির্বাসনে পাঠানো হয় সুইজারল্যান্ডে। জেনেভায় গিয়ে তিনি একটি বাড়ি কিনে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন।
এখানে আসার পর তাঁর কিছুদিন ভালো কাটলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি ভয়ানক প্রতিকুল হয়ে ওঠে। যে ধর্মান্ধতা ও গির্জার পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব তাঁকে তথা গোটা সমাজকে জর্জরিত করে তুলেছিল, খোলাখুলি তাকে কটাক্ষ করে এই সময় তিনি আবার রচনা করতে থাকেন অসংখ্য পুস্তিকা, প্রবন্ধ, সেই সাথে নাটক রচনা ও সেসবের মঞ্চায়ন। পাশাপাশি প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর বিদ্রূপাত্মক উপন্যাসসমূহও। এর মধ্যে জোয়ান অব আর্কের জীবনী অবলম্বনে রচিত উপন্যাস ‘লা পুসেলে ডি অর্লিন্স’ (La Pucelle d’ Orleans) অন্যতম। এই গ্রন্থের জন্যই আবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। গির্জার পাদরিরা তাঁর ওপর আবার খেপে যায়।
তাঁকে আরও বিতর্কিত করে তোলে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কাঁদিদ’ (Candide)। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৫৮ সালে। তবে সমালোচকরা বলেছেন, কাঁদিদই ভলতেয়ারের সমগ্র রচনার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।
গল্পগ্রন্থ বা উপন্যাস ছাড়া তিনি জেনেভার অ্যানেসির বিশপের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনেও প্রচার-পুস্তিকা রচনা করেন। ফলে একদিকে যেমন তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তার শত্রুর সংখ্যাও।
ভলতেয়ার ১৭৬৪ সালে রচনা করেন উপন্যাস ‘জীনোঁ এট কলি’ (Jeannot et Colin) এবং ১৭৬৮ সালে রচনা করেন ‘লা প্রিন্সেসে দ্য ব্যাবিলোন’ (La Princesse de Babylone) এবং ১৭৭৪ সালে রচনা করেন ‘লে তোরো ব্লাক’ (Le Taureau Blac ) উপন্যাস।
১৭৭৪ সালে তিনি আবার ফিরে আসেন প্যারিসে। এখানে কিন্তু তাঁর অনেক ভক্ত ছিল। সুদীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর পর যেদিন তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন, সেই দিনই তাঁকে দেখতে এসেছিলেন প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক। তারপর এই প্যরিসেই তিনি ১৭৭৪ সালের ৩০ মে মৃত্যুবরণ করেন।