ভর

ভর

সুবালার এত কম বয়স। তুমি ওর ওপর ভর করছ কেন?

সুবালাই বলে উঠল, সুবালা আমার বউ। তাকে তুমি বিয়ে করলে কেন? তােমার তাে দেশে বউ আছে। আমার বউ আমারই থাকবে।

সুবালা অ্যাতাে কম বয়সে বিধবা হল। সামনে সারা জীবন পড়ে আছে। ওকে কে দেখবে?

এবারও সুবালা ফোঁস করে উঠল। আমার বউ সুবালা। আমিই সারা জীবন দেখতাম। তােমার অ্যাতাে দরদ কীসের বাসুদেব!

বাসুদেব নামের লােকটি বেশ গাট্টাগােট্টা। মাথাটি কঁচাপাকা। গায়ে চেক চেক হাফশার্ট। তার সামনে একটি ছাব্বিশ-সাতাশের মেয়ে বসে। মাথার চুল এলাে হয়ে পিঠে পড়েছে। মুখ নামানাে। ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ। মাথার ওপর সিলিং থেকে একটি একশাে পাওয়ারের ডুম ঝুলছে। শেড থাকায় ইলেকট্রিক আলাে যে জায়গাটায় গােল হয়ে পড়েছে সেখানে বাসুদেবের মুখােমুখি বসা মেয়েটিই যে সুবালা তা বলার দরকার পড়ে না। কেননা, এই ঘরে আর কোনও মেয়ে নেই।

বাসুদেব বলল, দ্যাখাে বিশ্বনাথ। দেড় বছর হল তুমি মারা গ্যাছাে। এখন আর সুবালা তােমার বউ নয়।

সুবালাই বলে উঠল, বেশ তাে সুবালা আর আমার বউ নয়। কিন্তু আমারই বিধবা তাে।

বাসুদেব হাে হাে করে হেসে উঠল। মরে গিয়েও দাবি ছাড়ছ না! বিধবা কারও সম্পত্তি নয়। সুবালার সঙ্গে কালীঘাটে আমার মালাবদল করে বিয়ে হয়েছে।

জানি। জানি। টকোর মায়ের কারসাজিতে—

এইবার কয়েকটি কথা বলা দরকার। কে এই বাসুদেব? সুবালা কে? বিশ্বনাথই বা মরে গিয়ে ফিরে এল কেন ? পৃথিবীর কোথায় বাসুদেব সুবালাকে—

সামনে বসিয়ে বিশ্বনাথের সঙ্গে কথা বলছে? টকোর মা-ই বা কে? কী কারসাজি করেছে সে?

বাসুদেব আসলে বাঙালি নয়। কিন্তু তিরিশ বছর এদেশে থেকে সে বাঙালি বনে গেছে। তার পুরাে নাম বাসুদেব যাদব। বাড়ি অযােধ্যার ফুলওয়ারি গাঁয়ে। বয়স এখন বাহান্ন। সে বিয়েশাদি করা লােক। তার বউ সেই ফুলওয়ারি গাঁয়েই আছে। দুই মেয়ে নিয়ে। বড়াে মেয়ে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি। ছােটোমেয়ের গাওনা হয়ে গেছে। কিছুটা ডাগর হলেই শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তা ওদের মাযার নাম ধনিয়া বাঈ—সে তার স্বামীর চেয়ে চার বছরের বড়াে। তার আর ছেলেপেলে হওয়ার বয়স নেই। ধনিয়া এখন ফুলওয়ারিতে বাসুদেবের চাষবাস দেখে। অনেকটা যেন বাসুদেবের বড়াে দিদি।

কোনও কারসাজি নয় বিশ্বনাথ। আমার তাে ছেলে নেই। কলকাতায় এই মেটেবুরুজে সুতােকলে কাজ করি। এই একসময়ের কোয়ার্টারে সুবালাকে বিয়ে করে দুই ছেলে নিয়ে থাকি।

সুবালার মুখ দিয়ে বিশ্বনাথ বলে উঠল, জানি। জানি। সব জানি।

সব জানাে না। মরে গিয়ে তােমার মাথাটা একদম গেছে। আমার নেই ছেলে। আর এদেশে কে আমাকে এই বয়সে মেয়ে দেবে? সুবালাদের বস্তিতে ফুলওয়ারির মেয়ে টকোর মা থাকে। সে দেখল বিধবা সুবালার থাকা-খাওয়ার একটা হিল্লে হয়ে যায়—আবার চাই কি আমারও ছেলের বাপ হওয়া হয়—যদি আমাদের দুজনের বিয়ে হয়। তাই সে সুবালাকে বের করে এনে কালীঘাটে আমাদের বিয়ে দেয়। ওভাবে সুবালাকে বের করে না আনলে কি সুবালার মা আমার হাতে মেয়ে দিত? টকোর মায়ের দিমাগ আছে।

অনেক টাকা পিটেছে টকোর মা। কী বল?

তা পিটেছে। ছেলের বাপ হতে গেলে তাে টাকা ঢালতেই হবে। ঢেলেও আবার মেয়ে হতে পারত বিশ্বনাথ। কিন্তু লস হয়নি। সুবালা মুখ রেখেছে। তুমি মারা না গেলে তাে সুবালার ফের বিয়ে হত না।

আমি কী করব। আমি তাে আর ইচ্ছে করে মরিনি।

শুনেছি সব সুবালার মুখে। তােমাদের ভালােবাসাবাসি করে বিয়ে। ওদের রাস্তার মােড়ে মিষ্টির দোকানে জিলিপি ভাজতে তুমি। সুবালাকে একখানা দুখানা এমনিতে খেতে দিতে। সেই থেকে ভাব। শেষে বিয়ে। তারপর নাকে একটা গােটা হল। খুঁটে ফেললে। তা থেকে মৃত্যু।

তখন আমার জীবন আমার হাতে ছিল না বাসুদেব।

শুনেছি সব বিশ্বনাথ। তােমার কঁচা বয়স। চেহারা সুন্দর। সুবালাও খুব মজেছিল। নাও-এবার সুবালাকে ছেড়ে বিদেয় হও তাে।

ইস। এত সােজা। আমার মেয়ের মা না সুবালা?

সে মেয়ে তাে আমারও মেয়ে বিশ্বনাথ। তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছােটো। সাত মাসের মেয়ে রেখে তুমি মারা যাও | এখন সে মেয়ে ইস্কুলে যায়।

বড় দরদ দেখছি আমার মেয়ের জন্যে?

আহা ! ওভাবে বল কেন ? তাকে আমিও ভালােবাসি। কিন্তু বড্ড তঁাদড় মেয়ে। এখানে এনে রেখেছিলাম। কিন্তু কেঁদে কেটে একশা। সে তার দিদিমার কাছে চলে গেল। দিদিমাকেই মা ডাকে।

অন্যের পরিবারের ওপর অ্যাতাে ছোঁক ছোঁক ভালাে না। বলি কী বাসুদেব—তােমার তাে বয়স হল। এবার রিটায়ার করে অযােধ্যায় নিজের বউয়ের কাছে ফিরে যাও। যাওয়ার সময় সুবালাকে ফেরত দাও।

বাসুদেব ভালাে করে তার মালাবদল করে পাওয়া বউ সুবালার মুখে তাকাল। চোখ পাকানাে। ঠোটে ফেনা। পারলে সে যেন বাসুদেবকে চিবিয়ে খায়।

ধনিয়া বাঈয়ের কাছে অযােধ্যা ফিরে যাবাে ? বল কী! আর ছেলে দুটো? সঙ্গে নিয়ে যাও। ধনিয়াই দেখাশােনা করবে।

তা করবে। ধনিয়া মানুষ খুব ভালাে। সুবালাকে এসে দেখে গেছে। সতিন বলে ঝগড়াঝাটি করেনি। বরং বলে গেছে—বাসু। এখন তাের বয়স হয়েছে। এমন একটা কচি মেয়েরই তাের দরকার ছিল। নয়তাে তােকে দেখবে কে বিদেশে?

তাই তাে বলছি। ছেলের বাপ হওয়ার সাধ তাে মিটেছে। এবার ভালাে মানুষ ধনিয়ার কাছেই ফিরে যাও ছেলে দুটো নিয়ে। আমিও আমার বউ ফিরে পাই।

বিশ্বনাথ মান্না একসময় জিলিপির কারিগর ছিল। বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স হত তিরিশ-একত্রিশ। বাসুদেব যাদব তিরিশ বছর সুতােকলে ববিন ঘােরায়। পাল্টায়। এই ঘরখানি সুতােকলই তাকে দিয়েছে। সুবালাকে বিয়ে করে এনে বাসুদেব গ্যাস এনেছে। মাথার ওপর পাখা ঘােরে। ছেলেদের ন-মাস বয়স হলে অযােধ্যা থেকে ধনিয়াকে এনে ঘটা করে ওদের অন্নপ্রাশন দিয়েছে বাসুদেব। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় ধনিয়া বাঈ দুই ছেলেকে দুটো রুপাের

আংটি দিয়ে গেছে।

বাসুদেব একজন পুরােদস্তুর স্বামী এখন। একটা ভূত এসে কি না ভর হয়ে বলে সুবালাকে ফেরত দাও। তা হয় নাকি! বন্ধ ঘরের বাইরে সারা মেটেবুরুজ রােদে জ্বলে যাচ্ছে। বৃষ্টির দেখা নেই। ঘরের ভেতরে সে এখন তার ভর হওয়া বউ সুবালার মুখােমুখি একটি টুলে বসে। বড়াে ছেলে শ্লেট-পেনসিল নিয়ে স্কুলে। ছােটো ছেলে রয়েছে বাসুদেবেরই এক দেশােয়ালি বন্ধুর বাড়িতে—ক-খানা ঘর বাদেই। ছেলেরাও আজ দুদিন তাদের মায়ের এই ভর হওয়া দশা দেখে ভয় পেয়ে গেছে।

সুবালা আলাের দিকে তাকায় না। সব সময় মাথা নামিয়ে আছে। এলাে চুল। মুখ তুললে চোখের কানাচ দিয়ে কটমট করে তাকায়। ঠোটের কষে ফেকো বেরিয়ে এসেছে। এমনিতে সুবালা মিষ্টি করে কথা বলে। কিন্তু এখন কথা বলছে—গলার স্বরে যেন লােহার গুঁড়াে ছড়ানাে। আজ দুদিন বউকে কিছু খাওয়াতে পারেনি বাসুদেব।

আমি ফেরত দিলেও সুবালা তােমার কাছে আর ফিরে যাবে না।

সুবালা ঘচ করে মুখ তুলে তাকাল। সে মুখে ঘেন্না, রাগ—দুইই একসঙ্গে। দুদিনের ওপর কিছু মুখে না তুলে—একুটও না ঘুমিয়ে চোখ গর্তে। চেহারা শরীর আমসি।

ঠিক এই সময় বাসুদেব একটা কাজ করল। ঘরের দোর বন্ধ করার আগে সে রাস্তায় পড়ে থাকা কয়েকটি মাটির ঢেলা হাতে করে নিয়ে এসেছিল। সেগুলাে এখন তার হাতের ঘামে—হাতের চাপে গুঁড়িয়ে গিয়ে স্রেফ মাটি। ঢেলা আর নেই।

তাই চোখের সামনে তুলে বাসুদেব বিড় বিড় করে বলতে লাগল— ক্যায়সে বুলবুল উড়ান যাওগি ক্যায়সে পঙ্খ মেলােগি— কর কী? কর কী বাসুদেব?—বলতে বলতে এগিয়ে এল সুবালা।

এবার বাসুদেব যাদব মহানন্দে যা বলতে গেল তা হিন্দিতে বেরিয়ে এল—বিশ্বনাথ উহ্ কুছ নেহি! কুছ নেহি!! সিরিফ এক দোহা

কীসের দোহা ? ফুলওয়ারির মেলায় ওঝারা এই গান গেয়ে গেয়ে ভূত, জিন তাড়াতে তাড়াতে—এই অব্দি বলে বাসুদেব হাতের মাটিটুকু সুবালার সারা মাথায় মাখিয়ে দিল।

আর অমনি একটু আগে তেড়িয়া হয়ে এগিয়ে আসা সুবালা কেমন ঝিমিয়ে গিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল।

তখন বাসুদেব যাদব সারা ঘরে হরি-সংকীর্তনের পালা গাইয়েদের মতাে নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে গাইতে লাগল

ক্যায়সে মেলােগি পঙ্খ বুলবুল ক্যায়সে বুলবুল উড়ােগি— গান গায় বাসুদেব আর দুহাত তুলে হরিসংকীর্তনের ধাঁচে তালি দেয়। সে কী তালি। তালির চোটে ঘরের বন্ধ দরজা-জানলার কপাট কেঁপে কেঁপে ওঠে।

গানটা গেয়ে নিজের বুকে খানিকটা সাহস ফিরে পায় বাসুদেব। নয়তাে ভর হওয়া সুবালা অ্যাতক্ষণ একটুও ভাঙছিল না। একটুও মচকাচ্ছিল না। এ গানটা গেয়ে ওঝাদের নকলে সে সুবালার মাথায় মাটি মাখিয়ে দিতেই সুবালার ভেতরে ভর হওয়া বিশ্বনাথ এইমাত্র নেতিয়ে পড়েছে।

বাসুদেব ওঝাদের ওঝাগিরির কিছুই জানে না। যা দেখেছে—যা শুনেছে— ছেলেবেলায় ফুলওয়ারিতে মেলায় দেখা যেটুকু তার মনে আছে আবছা আবছা—শুধু সেইটুকুই সে এইমাত্র করেছে। নেতানাে বিশ্বনাথ এবার সুবালার ভেতর থেকে কিছু নরম গলায় বলল, ভালােয় ভালােয় বাসুদেব খুড়াে এবার তুমি সুবালাকে ফেরত দাও। তােমার তাে বয়স হয়েছে।

আমার না হয় বয়স হয়েছে। কিন্তু আমি তাে বেঁচে আছি। তুমি বিশ্বনাথ কিন্তু আর বেঁচে নেই। সেটা ভুলে যেয়াে না। মরে গিয়ে সুবালাকে তােমার কোন কাজে লাগবে ? সুবালাই বা তােমাকে নিয়ে কী করবে?

মরি বাঁচি সুবালা আমার। সব ওই টকোর মায়ের কারসাজি। নইলে তুমি সুবালার খোঁজ পাও না। মালা বদল করে সুবালাকে পাওয়াও হয় না তােমার।

কী একবার ভাবল বাসুদেব। তারপর শান্ত গলায় বলল, কারসাজি আমার জন্যে করেনি টকোর মা।

মানে?—বলে তাকিয়ে পড়ল সুবালা। বাসুদেব দেখল, এবার সুবালার চোখে সেই তিরিক্ষি ভাবটা আর নেই।

কারসাজি করেছে নিজের জন্যে। টকোর মা যা-কিছু করেছিল নিজেরই জন্যে। আর টাকা পিটেছে আমার ওপর দিয়ে।

কীরকম?

শুনলে তােমার মন খারাপ হয়ে যাবে। ওসব শুনে তােমার কাজ নেই বিশ্বনাথ।

বল না। শুনি তাও—

শুনবে? তবে সত্যি কথা শােনাে। তােমার সঙ্গে ভাব হওয়ার আগে সুবালার খুব ভাব ছিল টকোর সঙ্গে। একই বস্তিতে পাশাপাশি ঘর। খুব ভাব দুজনে। তােমার চেহারাটা সুন্দর বিশ্বনাথ। বিনিপয়সায় গরম জিলিপি খাইয়ে ভাব-ভালােবাসা করলে। বিয়ে করলে সুবালাকে। টকো হয়ে গেল দিওয়ানা। তাতে কোনও দুঃখু ছিল না টকোর মায়ের। আমার সঙ্গে বিয়ের পর সুবালা সব বলেছে আমাকে। বিধবা হয়ে সুবালা ফিরে এলে টকো আর তার পিছু ছাড়ে না। ফের আঠার মতাে লেগে থাকে।

তুমি যেন জানাে সব।

হ্যা। আমি জানি বিশ্বনাথ। পরে জেনেছি। বিয়ের পর সুবালাই বলেছে। নিজের ছেলে পাছে তােমার বিধবাকে বিয়ে করে বসে তাই

এবার সুবালা যেন নিজেই ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলে উঠল, আমি বিধবা। কোনও বিধবা ছেলের বউ হয়ে আসুক তা চায়নি টকোর মা। তাই আমার মাকে কিছু না জানিয়ে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে আমাকে সিধে কালীঘাটে নিয়ে গিয়ে হাজির—

বাসুদেব চোখের সামনে দেখতে পেল, হঠাৎ সুবালা খাটের ওপর কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছে। সে ছুটে গিয়ে তার বউকে ধরল। অমনি বন্ধ জানলার পাল্লা আপনা আপনি খুলে গেল।

 বিশ্বনাথকে আগে কোনওদিন দেখেনি বাসুদেব। এবারও দেখতে পেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *