ভরাডুবি (আন্ ফ্রাঙ্ক)
আজকালের মধ্যেই তো ৬ জুন। শুধু ইয়োরাপের না, বিশ্বের ইতিহাসেও এটি একটি অবিস্মরণীয় দিন। আজ থেকে পঁচিশ বৎসর পূর্বে ওইদিন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ সৈন্যে জাহাজ ভর্তি করে ফ্রান্সের নরমাদি উপকূলে মার্কিন-ইংরেজ অবতরণ করে। এরকম বিরাট নৌবহর নিয়ে এ আকারের একটা অভিযান পৃথিবীর ইতিহাসে ইতোপূর্বে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সারা বিশ্বে এটা ডি ডে নামে পরিচিত এবং সুদ্ধমাত্র কূলে অবতরণের ওই একটি দিবস নিয়েই এত কেতাব লেখা হয়েছে যে, একটা মানুষ দশ বছরেও সেগুলো পড়ে শেষ করতে পারবে না। এবং নতুন নতুন বই লেখা হচ্ছে। এর বুঝি শেষ নেই। তাই বোধহয় এটাকে দীর্ঘতম দিবসও বলা হয়, যদ্যপি জ্যোতিষ অনুযায়ী এটি দীর্ঘতম দিবস নয়।
ফিল্মও হয়েছে। তারই বদৌলত যাদের যুদ্ধ বাবদে কৌতূহল সীমাবদ্ধ তাঁরাও অনেকখানি ওয়াকিফহাল হয়ে গিয়েছেন। যদ্যপি ফিল্মটি বড়ই একপেশে ও অসম্পূর্ণ। কিন্তু সুশীল পাঠক তোমাকে অভয় দিচ্ছি, আমি এ কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করব না যেসব মহারথীরা এ বিষয়ে বিরাট বিরাট ভুলুম ভুলুম কেতাব লিখেছেন পার্কার শিফার ম ব্লা ফাউনটেন পেন দিয়ে তার সঙ্গে পাল্লা দেবে আমার ভোতা কঞ্চির কলম।
আমার বর্তমান উদ্দেশ্য ভিন্ন।
ওই ১৯৪৪ সালের মার্কিনিংরেজ অভিযানের প্রায় দেড়-দুই বৎসর পূর্বের থেকেই সারা ইয়োরোপময়–এমনকি প্রাচ্যে– জল্পনা-কল্পনা হচ্ছিল ওরা জনিকে হুড়ো দেবার জন্য ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করে জর্মন নির্মিত আটলানটিক উয়োলে হানা দেবে কবে, কোন জায়গায় এই জল্পনা-কল্পনা সর্বাপেক্ষা উল্কণ্ঠ আকণ্ঠ আগ্রহে, আশা-নিরাশার দোদুল্যমান ইয়োরোপের সর্বত্র লুক্কায়িত কিংবা কনসানট্রেশন ক্যাম্পে বন্দি ইহুদিরাই ছিল প্রধানতম।
আন ফ্রাঙ্ক তার ডাইরিতে মার্চ মাসে অর্থাৎ ডি ডের তিন মাস পূর্বে লিখছে :সেটা ছিল রবিবার, রাত্রি নটা। উইনস্টন চার্চিল সেদিন বেতার বক্তৃতা দিয়েছিলেন সে বক্তৃতার মধ্যে সত্যিকারের আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। তার মধ্যে মিথ্যা বাগাড়ম্বর ছিল না–ছিল হিটলার-নিপীড়িত অগণিত নরনারীর প্রতি অশ্বাসের বাণী। সেই সময়টা মনে হয়েছিল যে আমাদের এই গোপন-আবাসে আমরা অসহায় ও নিঃসঙ্গ নই। এক বিশাল দুনিয়া জুড়ে আমাদের উদ্ধার করার জন্য তোড়জোড় চলছে।
কিন্তু আন্ সরলা হলেও এ বাবদে রীতিমতো বুদ্ধিমতী। ওই গোপন আবাসে যে আটটি প্রাণী প্রতিদিন জল্পনা-কল্পনা করছে তার নীর সরিয়ে ক্ষীরটুকু সযত্নে সংগ্রহ করে তার ডাইরিতে লিখে রাখছে, এদের ভিতর বয়সে যে সবচেয়ে ছোট, সেই আন্। আর খাসা রসিয়ে রসিয়ে
একজন হয়তো বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হবে। ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে আক্রমণ করা কি এতই সোজা! আবার একজন বলল, একবার ফ্রান্সে নামতে পারলে, এক মাসের মধ্যে বার্লিন পৌঁছে যাবে। আর একজন রণবিশারদ বলে উঠলেন, এক বৎসরের কম কিছুতেই বার্লিন পৌঁছতে পারবে না। আন্ এর অভিমত দিয়ে এ অনুচ্ছেদ শেষ করেছে। এবং এর কথা আখেরে ফলেছিল। ডি ডে হয় ৬ জুন; তার এগারো মাস পরে ৮ মে জমনি বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করে। যাহা বাহান্ন, তাহা তিপ্পান্ন, ইংরেজিতে নাকি সিসেস্ অ্যান্ড সেনে, ফারসিতে শশ (ষষ্ঠ) ও পন্জ (পঞ্চ) বলে– অবশ্য অল্প ভিন্নার্থে। মোদ্দা : এগারো মাস যা, বারো মাস তা।
কিন্তু এইমাত্র বলেছি, আন্ সুচতুরা বালা।
কারণ যদ্যপি সে বলেছে, এক বিশাল দুনিয়া জুড়ে আমাদের উদ্ধার করবার জন্য তোড়জোড় চলেছে, তথাপি যে অন্তরে অন্তরে জানে মার্কিনিংরেজ বাবুরা নিছক খয়রাতি কর্ম করার জন্য, দুহাতে চ্যারিটেবল হসপিটাল ছড়াতে ছড়াতে ডি ডেতে ফ্রান্সে নামবেন না। তাই এই দিবসের এক মাস পূর্বে লিখছে, আমাদের এখানে সকলেই এখন আশা করছে যে, মিত্রপক্ষের (অর্থাৎ মার্কিনিংরেজ) অভিযান খুব তাড়াতাড়ি আরম্ভ হবে; কারণ রাশিয়া সমস্ত ইউরোপ দখল করে নেবে, এ তারা কিছুতেই হতে দেবে না।
অতিশয় হক কথা। আন্ এই বয়সেই বাবুদের সচ্চরিত্রের কিছুটা চিনে গিয়েছে, নিছক ঈশ্বরপ্রসাদাৎ! আমরা ইংরেজকে বিলক্ষণ চিনি, চোখের জলে নাকের জলে হাড়ে হাড়ে।
কিন্তু মুক্তি পাবার আশা উষ্ঠা উত্তেজনার মাঝখানেও দেখুন, এই কুমারীটি কীরকম শান্তভাবে উভয় পক্ষের দায়িত্ব ওজন করে দেখছে। ডি ডের ঠিক এক পক্ষ পূর্বে সে লিখছে : ..আশা এবং উষ্ঠা চরমে পৌঁছে গেছে। কেন এখনও আক্রমণ হচ্ছে না, ইংরেজরা কেন এত দেরি করছে, তারা কি কেবল তাদের নিজের দেশের জন্য লড়ছে, হল্যান্ডের প্রতি কি তাদের কোনও দায়িত্ব নেই। কিন্তু ইংরেজদের আমাদের প্রতি কীই-বা দায়িত্ব আছে। আমরা আমাদের নিজেদের মুক্তির জন্য কতটুকু চেষ্টা করেছি। জর্মন অধিকৃত দেশগুলোর মধ্যে কবার কটা বিদ্রোহ হয়েছে। নিজের মুক্তি নিজেরই অর্জন করতে হয়– অন্য দেশের কী মাথাব্যথা পড়েছে যে, কেবলমাত্র আমাদের উদ্ধার করার জন্যে সৈন্যসামন্ত পাঠাবে আক্রমণ একদিন হবেই, কিন্তু তা আমরা চাইছি বলে নয়, ইংরেজ এবং আমেরিকার নিজেদের স্বার্থে।
এই চরম দ্বন্দ্বের মাঝখানে মেয়েটির ভগবানে বিশ্বাস, অন্তিমে সত্যের সর্বজয় সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ প্রত্যয় এবং সর্বোপরি তমসাচ্ছন্ন পাশ্চাত্যে নবীন উষার উদয়, নবীন জীবনের অত্যুদয় সম্বন্ধে এ বালাটির পরিপূর্ণ আশাবাদ– তার পরিচয় আমার এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে কিছুতেই প্রকাশ পাবে না।
তবু মাঝে মাঝে মেয়েটি কিন্তু ভেঙে পড়ত।
একদিন লিখছে, প্রিয় কিটি, এক নিদারুণ হতাশা এবং অবসাদ আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এখন মনে হচ্ছে যে এ যুদ্ধ বুঝি আর কখনও শেষ হবে না। যুদ্ধ মিটে যাওয়া যেন বহু দূরের রূপকথার রাজ্যের ব্যাপার বলে এখন মনে হচ্ছে। তার দেড় মাস পরে বলছে, আবার আমার অবস্থা ভেঙে পড়বার মতো হয়েছে। এই গোপন আবাসে এখন সবই বিষাদময়।… হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু–দুটোর যে কোনও একটা তাড়াতাড়ি ঘটুক। ভগবান এই আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা থেকে আমাদের রেহাই দাও।
—তোমারই আন
কিন্তু এর মাত্র এগার দিন পরেই–
কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ,
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ
তাতা থৈথৈ তাতা তৈথৈ তাতা থৈথৈ।
মঙ্গলবার, ৬ জুন, ১৯৪৪ (অর্থাৎ ডি ডে–লেখক)
প্রিয় কিটি,
আজ একটি অবিস্মরণীয় দিন। অবশেষে দ্বিতীয় রণাঙ্গন খোলা হল। ফরাসি উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় মিত্রপক্ষের সৈন্যদল অবতরণ করছে।…
জর্মনির খবরেও স্বীকার করা হয়েছে যে, ফরাসি উপকূলে ব্রিটিশ প্যারাশুট বাহিনী অবতরণ করেছে।…
আমাদের গোপন আবাস চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সেই বহু প্রতীক্ষিত মুক্তি যা এতদিন আমাদের কাছে ছিল সুদূর স্বপ্নরাজ্যের কাহিনীর মতো, তা কি সত্যিই আমাদের কাছে এল? সত্যিই কি ১৯৪৪ সালের মধ্যে বিজয়লাভ করব?
হতাশার অন্ধকার ছিন্ন করে আবার আশার আলোক জেগেছে।
কিন্তু পাঠক, এর পর দিনের পর দিন, মিত্রশক্তি যেমন যেমন ফ্রান্স জয় করে এগিয়ে আসতে লাগল, আর আন্ সোল্লাসে তার ডাইরিতে সেগুলো লিপিবদ্ধ করল তার উদ্ধৃতি আমি দেব না। আপনারা ডাইরিখানা পড়ে দেখবেন। সে প্রতিদিন আশা করছে মিত্রশক্তি হল্যান্ড জয় করে তাদের মুক্তিদান করবে। এবং এইটুকু বলব, এ যুদ্ধের শেষাঙ্ক সম্বন্ধে যেসব বই লেখা হয়েছে তার মধ্যে আন্ ফ্রাঙ্কের ডাইরি সর্বপ্রথম সর্বপ্রধান পর্যায়ে পড়ে।
কিন্তু হায়! হায়! শেষরক্ষা হল না।
২১ জুলাই আন বেতারে শুনল, হিটলারকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল, আর হিটলার হন্যে হয়ে দোষী-নির্দোষী হাজার হাজার জনকে ফাঁসি দিচ্ছেন। আন্ লিখছে, এইরকম করে হতভাগারা যদি নিজেরা মারামারি করে মরে, তা হলে ইংরেজ-আমেরিকা আর রুশদের কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়। আমাকে কি বড় খুশি মনে হচ্ছে সত্যি, আমি যে আনন্দ চেপে রাখতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে এই অক্টোবর মাসেই আবার আমার পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে।
একে তুমি আকাশ-কুসুম কল্পনা বলছ? বার্লিনের দিকে ধাবমান সৈন্যদের পদধ্বনি বলছে, না এ আকাশ-কুসুম নয়। এ সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
কিন্তু হায়, পাড়ে এসে ভরাডুবি হল। এর কয়েকদিন পরেই জর্মন পুলিশ আন্দের গুপ্তাবাস আবিষ্কার করে সবাইকে গ্রেফতার করে কনসানট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাল। তার পর কী হয়েছিল সেটা, কঠোর পাঠক, দয়া করে আমাকে পুনরাবৃত্তি করার হুকুম দিও না।
আন্ ফ্রাঙ্ক সম্বন্ধে আমার হয়তো আরও অধিক কিছু লেখাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। কারণ ইতোমধ্যেই হাতে-কলমে সপ্রমাণ হয়ে গিয়েছে যে, একাধিক দরদী পাঠক-পাঠিকার দৃষ্টি আন্-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ বাবদে আমার মতো নগণ্য লেখক একজন প্রখ্যাত বাঙালি লেখকের সহৃদয় একখানি চিঠি পেয়েছে। তিনি লিখেছেন :
সম্প্রতি এর্নাকুলাম থেকে একটি মহিলা (ইনি আমার –এর মালায়ালাম অনুবাদ প্রকাশ করেছেন) জানতে চেয়েছেন–আন্ ফ্রাঙ্কের লেখা The Diary of a Young Girl বইখানার বাংলা অনুবাদ কে করেছেন, তার ঠিকানা কী এবং প্রকাশক কারা। এখানে বসে কী করে খবরটা সগ্রহ করা যায় যখন ভাবছি, দেশ পত্রিকার বর্তমান সংখ্যায় আপনার পঞ্চতন্ত্রে এ বিষয়ে অনুবাদকের নাম পেয়ে গেলাম। এদের ঠিকানা কি আপনি জানেন? ইত্যাদি।
আন্ সম্বন্ধে যখন সেই সুদূর কেরালায়ও এতখানি কৌতূহল রয়েছে তখন আমার পক্ষে হয়তো এ নিয়ে আর অত্যধিক বাগৃবিন্যাস করা উচিত হবে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কোনও কোনও কাঁচা লেখক একটি বিষয়েই এমনি মজে যান যে, সে দ থেকে আর সহজে বেরুতে পারেন না। আমার হয়েছে তাই। কিংবা বলতে পারেন, একে তো ছিল নাচপাগলী বুড়ি, তার ওপর পেল মৃদঙ্গের তাল। কিংবা তারও বাড়া :
কী কল পাতাইছ তুমি
বিনা বাইদ্দে (বাদ্যে) মাছি আমি!!
অতএব বন্দাশীল পাঠকের সামনে আন্-এর আরও একটু সামান্য পরিচয় নিবেদন করি।
আন্-এর রসিকতাবোধ ছিল অসাধারণ। তার তেরো বৎসর বয়সে ক্লাস টিচার আদেশ দিয়েছেন বাঁচালতা সম্বন্ধে রচনা লিখতে। আন-এর বাঁচালতার শাস্তিস্বরূপ।
ফাউন্টেন পেনের ডগা কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে লাগলাম–কী লেখা যায়। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, বরাদ্দ তিন পাতা লিখে ফেলে আমি নিশ্চিন্ত বোধ করলুম। আমার যুক্তি হল, বক বক করা নারীজাতির বৈশিষ্ট্য। যদিও বাঁচালতাকে সংযত করার চেষ্টা করা উচিত, তবুও এই দোষ থেকে আমার একেবারে মুক্ত হওয়া উচিত হবে না, কারণ আমার মা, আমারই মতো এবং সময় সময় আমার চেয়েও বেশি কথা বলেন। সুতরাং উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত স্বভাবধর্ম কী করে ত্যাগ করতে পারি আমার যুক্তি শুনে মি. কেল্টরকে (শিক্ষককে) হাসতে হল।
আমরাও হাসছি। কিন্তু আন্-এর শেষ দুর্গতির কথা স্মরণে আছে বলে চোখের জলের ফাঁকে ফাঁকে। সেই প্রাচীন দিনের এক হতভাগ্যের গান,
I am dancing with tears in my eyes.
সবেমাত্র চৌদ্দ বছর পূর্ণ হওয়ার সময় আন্ তাদেরই সঙ্গে লুক্কায়িত একটি ইহুদি ছোকরার প্রেমে পড়ে। তখন লিখছে– আমি কেটে-হেঁটে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করছি।
রবিবার, ১৬ এপ্রিল ১৯৪৪
প্রিয় কিটি,
কালকের দিনটা আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। প্রথম চুম্বন। প্রত্যেক মেয়ের জীবনেই এক স্মরণীয় ঘটনা এবং সেই জন্যেই কালকের দিনটা আমার চিরকাল মনে থাকবে। কাল সন্ধ্যাবেলা পিটারের ঘরে আমরা দুজনা চৌকির উপর বসে ছিলাম। খানিকক্ষণ পরে ও আমার কাঁধের উপর হাত রাখল। আমিও ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম। ও তখন আমাকে আরও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। এর আগেও আমরা অনেকবার এইরকম পরস্পরকে জড়িয়ে বসেছি, কিন্তু এবার আমার সান্নিধ্য অনেক নিবিড় ও উষ্ণ। আমার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ করছিল।… ওই সময় আমার যে কী আনন্দ হচ্ছিল, তা লিখে বোঝাতে পারব না… তার পরের মুহূর্তগুলো আমার ঠিক মনে নেই। নিচের দিকে যাবার জন্য যখন পা বাড়িয়েছি, ও তখন হঠাৎ আমায় চেপে ধরে আমার কপাল, গালে, গলায় এবং বুকে বার বার চুমু খেতে লাগল। আমি কোনওরকমে ওর হাত ছাড়িয়ে ছুটে নিচে পালিয়ে এলাম।
আজকে আবার ওই মুহূর্তগুলোর জন্য প্রতীক্ষা করছি।
–তোমারই আন।
ছেলেটির বয়স তখন মাত্র সাড়ে সতেরো। মনে হচ্ছে, এটি নিষ্পাপ কিশোর-কিশোরীর প্রথম প্রণয়।
এর পূর্বে আন অতিশয় সরলতার সঙ্গে বর্ণনা করেছে তার দেহের বহির্ভাগে বিস্ময়কর যা ঘটেছে, কিন্তু বলছে; দেহের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে তা আরও রহস্যঘন বিস্ময়। ইতোমধ্যে আমি তিনবার ঋতুমতী হয়েছি।…এখন আমার মনের মধ্যে অদ্ভুত সব কামনা জাগছে। কোনও কোনও দিন রাত্তিরে বিছানায় শুয়ে নিজের স্তনদুটোকে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমার ভীষণ ইচ্ছে হয়। এ বক্ষের ছন্দোময় স্পন্দন শোনবার জন্য আমি কান পেতে থাকি।…।
এস্থলে উদ্ধৃতিটি অসম্পূর্ণ রেখে বলি, ধন্য ধন্য কবীন্দ্র রবীন্দ্র। তিনি কী করে জানলেন বালিকা যখন কিশোরী হয় তখন তার দেহানুভূতি হৃদয়ানুভূতি!
ওগো তুমি পঞ্চদশী,
পৌঁছিলে পূর্ণিমাতে।
মৃদুশ্রিত স্বপ্নের আভাস তব বিহ্বল রাতে।
ক্বচিৎ জাগরিত বিহঙ্গকাকলী
তব নবযৌবনে উঠিছে আকুলি ক্ষণে ক্ষণে।
প্রথম আষাঢ়ের কেতকীসৌরত তব নিদ্রাতে।
যেন অরণ্যমর্মর
গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর।
অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে,
ছলো ছলো জল এনে দেয় তব নয়নপাতে।
এই যে যেন অরণ্যমর্মর গুঞ্জরি উঠে তব বক্ষে থরথর ঠিক সেই অনুভূতিই তো আন্ প্রকাশ করছে যখন সে বলছে এ বক্ষের ছন্দোময় স্পন্দন শোনবার জন্য আমি কান পেতে থাকি।
ততোধিক আশ্চর্য, ঠিক ওই সময়েই প্রেমবোধের সঙ্গে সঙ্গে তার ধর্মবোধও জাগ্রত হয়েছে। তার দয়িত পিটারের কথা ভাবতে ভাবতে বলছে,
এর ওপর আরও বিপদ, ও ধর্ম ও ভগবান মানে। ধর্ম মানুষের এক বিরাট অবলম্বন স্বর্গীয় বিধানের ওপর কজন লোক পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখতে পারে
(রবীন্দ্রনাথের আমার গুরুর আসন কাছে/ সুবোধ ছেলে কজন আছে?–লেখক) কিন্তু যারা পারে, তারা সত্যিই সুখী। আর নিজের বিবেক যখন ধর্মের বিধানের সঙ্গে যোগ খেয়ে যায় তখন যে শক্তি ও আনন্দ পাওয়া যায়, তার তুলনা নেই।
এ অধম যুক্তিত। ধর্মের বিধানের সঙ্গে যে প্রায়ই বিবেকের দ্বন্দ্ব লাগে সেটা সে ওই অতি অল্প বয়সে হৃদয়ঙ্গম করল কী করে!
.
বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে ইয়োরোপীয় ইহুদিদের অন্যতম কেন্দ্রভূমি ছিল রাইন নদীর পারের ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর। এরই এক পরিবারে আন্ ফ্রাঙ্কের জন্ম ১২ জুন, ১৯২৯-এ(১)। ১৯৩৩-এ হিটলার গদিনশীন হলে পর আ-এর পিতা সপরিবার হল্যান্ডের আমসটের্ডাম চলে যান। (আইনস্টাইনও ওই বছরে আমেরিকা যান)।
স্বয়ং আন লিখছেন (তখন তার বয়স তেরো : আমাদের অন্যান্য আত্মীয় স্বজন, যারা জর্মনিতে রয়ে গেছেন তারা নাসিদের হাতে নানাভাবে লাঞ্ছিত হতে লাগলেন। তখন আমার দু-মামা আমেরিকায় পালিয়ে গেলেন। তাদের জন্য আমরা সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকতাম। ১৯৩৮ সালৈ যখন ইহুদিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানো রু হল, তখন আমার বুড়ি দিদিমা আমাদের কাছে চলে এলেন। তাঁর বয়স ৭৩।
১৯৪০-এর মে মাস থেকে আরম্ভ হল হল্যান্ডবাসী তাবৎ ইহুদিদের বিপর্যয়। হিটলার হল্যান্ড দখল করে এমন সব আইন পাস করলেন যাতে করে ইহুদিদের জীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠল।
হিটলার হল্যান্ড বিজয়ের দুই বত্সর পরও আন্ লিখছেন :
হাজাররকম বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবন কাটতে লাগল। আমাদের স্বাধীনতা বলতে কিছুই রইল না। তবুও তখন অবস্থাটা একেবারে অসহ্য হয়নি।
বেচারি আন্- আন্ কেন, কজন ওই ১৯৪২-এ জানত যে হিটলার ১৯৩৯ সালেই মনস্থির করে গোপনে হুকুম দিয়েছেন, নির্যাতন উৎপীড়ন দিয়ে আরম্ভ করে শেষটায় ইহুদিদের সবংশে ও সমূলে নিধন করতে হবে। বিশেষ করে হল্যান্ড দেশটিতে যেন একটি ইহুদিও জীবন্ত না থাকে।
কিন্তু আন্-এর পিতা বুঝতে পেরেছিলেন যে দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। ৫ জুলাই ১৯৪২ সালে আন্ লিখেছেন,
একদিন বাবার সঙ্গে পার্কে বেড়াচ্ছিলাম, বাবা হঠাৎ আমাকে বললেন, শোন অন্, এখন যত পারো আনন্দ করে নাও, কেননা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের এখান থেকে চলে গিয়ে কোনও নতুন জায়গায় লুকোতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন বাবা, এখান থেকে কোথায় যাব? লুকোতেই-বা হবে কেন? তিনি বললেন, জর্মনরা এসে আমাদের ধরবার আগেই আমরা লুকিয়ে পড়ব। ব্যাপারটা এখনও ভালো করে বুঝতে পারলাম না, কিন্তু একটা অস্পষ্ট বিষাদে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
এর পাঁচ-সাত দিন পরই ফ্রাঙ্ক পরিবারকে তাদের বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে শহরের অন্যপ্রান্তে চারতলার পিছনের দিকে গুটিকয়েক কুইরিতে গোপন আশ্রয় নিতে হল। এদের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ইহুদি পরিবারও আশ্রয় নেয়। সবসুদ্ধ আটটি প্রাণী। প্রায় দুই বৎসর এখানে লুকিয়ে থাকার পর এদের সকলেই ধরা পড়ে। এর পরের কাহিনী অত্যন্ত মর্মন্তুদ।
এই দুই বত্সর ধরে আন তাঁর ডাইরিটি লিখে যান। যখন ডাইরিটিতে লিখতে আরম্ভ করেন তখন তার বয়স তেরো, যখন ধরা পড়েন তখন তার বয়স পনেরো বত্সর। ষোল পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আন্ জর্মন কনসানট্রেশন ক্যাম্পে টাইফাস জ্বরে অসহ্য যন্ত্রণা ভুগে মারা যান। তার আঠারো বছরের দিদি মারগট (মারগারেট)-এরও টাইফাস হয়েছিল এবং ক্যাম্পের একই কামরায় রোগ-যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে উপরের বাঙ্ক থেকে পড়ে গিয়ে মারা যান। ওই একই সময়ে এদের মা-ও ক্যাম্পে মারা যান। তখন তার বয়স পঁয়তাল্লিশের মতো। পরিবারের মাত্র একজন, পিতা অটো দৈববলে অবলীলাক্রমে বেঁচে যান।
এই ডাইরিখানার বৈশিষ্ট্য কী?
যুদ্ধশেষে মোটামুটি ১৯৪৯ সালে ডাইরিখানা ডাচ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে বইখানি জমনে অনূদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ইয়োরোপ-আমেরিকাতে প্রচুরতম খ্যাতিলাত করে। কয়েক বছরের ভিতরই বইখানা নূনাধিক ত্রিশ-চল্লিশটি ভাষায় অনূদিত হয়। অনবদ্য বাংলা অনুবাদ করেছেন শ্রীঅরুণ সরকার ও শ্রীঅংকুমার চট্টোপাধ্যায়।
ইতোমধ্যে ডাইরিটি অবলম্বন করে যে নাটকটি রচিত হয়– সেই জর্মন বিশ্বকোষের ভাষায় বিশ্বের সর্বমঞ্চে অভিনীত হয়েছে (য়্যবার ডি বুনেন ড্যার ভেলট)। ফিলজগতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কম, তবে শুনেছি এর ফিল্ম নাকি এদেশেও এসেছিল।
ভাবতে আশ্চর্য বোধহয়, চোদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ের লেখা একটি রোজনামচা কী করে এতখানি খ্যাতি অর্জন করল। এ যেন সেই বালকবীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, এ কী গো বিস্ময়!
বইখানা যতবার পড়ি ততবার মনে হয় এর পাতার পর পাতা তুলে দিয়ে কত না অশ্রুজল পর্যায়ের সমাপ্তি টানি। কিন্তু স্পষ্টত দেখা যাচ্ছে সেটা সম্ভবপর নয়। তবে আন্-এর কিছুটা ব্যক্তিগত পরিচয় দেবার জন্য অত্যল্প তুলে দিচ্ছি। কিন্তু তার পূর্বে তুলে দিই আন্ কীভাবে রোজনামচা লেখা রু করেন।
শনিবার, ২০ জুন ১৯৪২ (জর্মনি কর্তৃক হল্যান্ড দখলের দুই বৎসর পরে– লেখক)
আমার ডায়েরি লেখার খেয়াল একটু অদ্ভুত। আমার বয়সী কোনও মেয়ে ডাইরি লেখে বলে তো আমি শুনিনি। আর তেরো বছরের মেয়ের মনের কথা জানবার কারই-বা মাথাব্যথা পড়েছে। কিন্তু তবুও আমি লিখছি। আমার মনের গহনে যেসব ভাব রয়েছে, সেগুলোকে আমি প্রকাশ করতে চাই।
একটি প্রবাদ আছে : মানুষের থেকে কাগজ অনেক বেশি সহিষ্ণু। একদিন নিরানন্দ অলিস্যের মধ্যে গালে হাত দিয়ে যখন ভাবছিলাম, কী করে সময় কাটানো যায়, সেই সময় এই কথাটা আমার মনে এল।
এখন আমার সত্যিকারের বন্ধু কেউ নেই।
এর পর আন্ বলছেন তাঁর বাপ, মা, বোন এবং প্রায় ত্রিশজন বন্ধু আছেন। এবং আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ইহুদিরা আসলে প্রাচ্যদেশীয় বলে আমাদেরই মতো শুষ্টিসুখ অনুভব করতে খুবই ভালোবাসে।
তবু আন্ বলেছেন, কিন্তু তবু আমি নিঃসঙ্গ। সুতরাং এই নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে আমি এই ডাইরি লিখছি; কিন্তু এই ডাইরি আমি চিঠির আকারে লিখব। আমি এক কাল্পনিক বন্ধু ঠিক করেছি তার নাম কিটি (ইংরেজিতেও কিটি, ক্যারিন –লেখক), আমার এই ডায়েরি কিটিকে লেখা চিঠির আকারে লিপিবদ্ধ হবে।
পাঠকের মনে এস্থলে প্রশ্ন উঠতে পারে, আন্ কি জানতেন তাঁর এ রোজনামচা একদিন প্রকাশিত হবে?
আনকেই বলতে দিন :
বুধবার, ২৯ মার্চ ১৯৪৪
প্রিয় কিটি,
বলকেস্টাইন নামে একজন মন্ত্রী লন্ডন থেকে একদিন বেতার-বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তার বক্তৃতার বিষয় ছিল হল্যান্ডের যুদ্ধের পরিকল্পনা। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বললেন– জর্মন অধিকৃত অঞ্চলের লোকেদের ডায়েরি জোগাড় করতে হবে; তা যদি হয় তা হলে আমার এই ডায়েরির খুব কদর হবে। ভাবতে কী মজাই না লাগছে! বাস্তবিক দশ বছর পরে আমার এই ডাইরি যদি লোক পড়ে (প্রকৃত প্রস্তাবে দশ নয় পাঁচ বছর পরেই বিশ্বজন এই বইখানিকে হৃদয়ে টেনে নিয়ে তার প্রভূততম কদর দিয়েছে লেখক) তা হলে আমরা এখানে কী অবস্থায় কাটিয়েছি, তা জেনে তারা অবাক হবে।
এর দেড় মাস পর আন আবার কিটিকে জানাচ্ছেন :
কিন্তু জীবনের চরম লক্ষ্য সাংবাদিক ও বড় লেখিকা হওয়া– সেকথা মুহূর্তের জন্যেও ভুলি না। আমার এই অলীক আশা কোনওদিন সফল হবে কি না, তা ভবিষ্যই জানে। কিন্তু আমার ডাইরি যুদ্ধ শেষ হলে আমি ছাপিয়ে বার করব- এ সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত।
–তোমারই আন
বস্তুত লেখিকা হতে হলে যে কটি গুণের প্রয়োজন আন্-এর সবকটিই ছিল, কিন্তু বিধাতা তার জন্য রেখেছিলেন অকালমৃত্যু।
জানি না, আমার দরদী পাঠক এর থেকে কোনও সান্ত্বনা পাবেন কি না। যে আন্-এর মৃত্যুর জন্য হিটলার-হিমলার দায়ী, তাদের দুজনকেই আত্মহত্যা করতে হয় আন্-এর মৃত্যুর দু মাসের মধ্যে।
যে নাৎসি নেতা সাইস-ইনভারট ফ্রাঙ্ক পরিবার গ্রেফতার হওয়ার সময় হল্যান্ডের শাসনকর্তা ছিলেন তিনি প্রধানত হল্যান্ডে কৃত তার কুকীর্তির জন্য নরবের্গ মোকদ্দমার বিচারের পর আন্-এর মৃত্যুর দেড় বৎসর পর ঝোলেন ফাঁসি কাঠে। গেস্তাপো নেতা কাটলেন নারও ওইদিন একই পন্থায় ওপারে যান এবং তার সহকর্মী আইকমানকে ফাঁসি দেয় ইহুদিরা কয়েক বৎসর পরে–জরায়েলে।
———-
১. আন তিন-তিনবার তাঁর ডাইরিতে লিখেছেন তার জন্মদিন ১২ জুন। অথচ প্রামাণিক জর্মন বিশ্বকোষ ড্যারগ্রসে ব্ৰহহাউস (১৯৫৮, অ্যারাসুংসবাট, পৃ. ১৫৭) লিখছেন ১৪ জুন। জর্মন-প্রবাসী কোনও বঙ্গসন্তান যদি অনুসন্ধান করে পাকা খবর জানান তবে উপকৃত হই। তবে কি ইহুদি ক্যালেন্ডারের সঙ্গে চালু ক্যালেন্ডারের কোনও ফেরফার আছে।