ভরত দাশের গন্ডার

ভরত দাশের গন্ডার

মেদিনীপুরের মঙ্গলহাটা গ্রামের শ্রীযুক্ত ভরতকুমার দাশ দু-টি গন্ডার পুষেছেন বাড়িতে। এই খবর সমস্ত খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে। সেই খবরের চারদিকে কালো রুল দিয়ে বক্স আইটেম।

খবরটা পড়তেই শিশুপাল টেবিল চাপড়ে বলল, ‘দেখ এবার মেদিনীপুর সব ব্যাপারে টেক্কা দিয়েছে! আর কিছু বলতে পারবি? এখন থেকে মেদিনীপুরের পা-ধোওয়া জল খাবি, বুঝলি?’

কালনেমি লম্বা খাতায় হিসেব মেলাচ্ছিল, ‘উঁহু, উঁহু, এখন বিরক্ত করিস না। ভুল হয়ে যাবে!’

কিন্তু শিশুপাল তা শুনবে কেন? এত বড়ো একটা অস্ত্র পাওয়া গেছে কালনেমিকে ঘায়েল করার, এ কখনো ছাড়া যায়? এসব খবর ঠাণ্ডা হতে দিতে নেই!

সে খবরের কাগজটা কালনেমির খাতার ওপর মেলে ধরে বলল, ‘ওসব হিসেব পরে হবে, আগে এটা পড়ে দেখ।’

কালনেমি হতাশভাবে দু-হাত ছড়িয়ে বলল, ‘এখনও টিফিনের সময় আসেনি, এর মধ্যেই তুই কাগজ পড়তে শুরু করে দিলি? মালিক দেখতে পেলে…’

শিশুপাল বলল, ‘এত বড়ো খবর বেরিয়েছে। আজ অফিস ছুটি দেওয়া উচিত! মেদিনীপুর হুররে। থ্রি চিয়ার্স ফর মেদিনীপুর, হিপ হিপ…’

আশেপাশের অন্য টেবিল থেকেও অনেকে মুখ তুলে তাকাল। বটুকবাবু বলল, ‘আবার দুজনে লেগেছে। তোমরা নিজেরা কাজ করবে না, আমাদেরও কাজ করতে দেবে না!’

একটা ছোটো বেসরকারি অফিস। দু-টি মাত্র ঘরে মোট চোদ্দো জন কর্মচারী বসে। জায়গার এত টানাটানি যে, দুজনকে এক টেবিলে বসতে হয়। কালনেমি আর শিশুপাল মুখোমুখি।

দু-জনেরই তিরিশের কাছাকাছি বয়েস, দুজনেই গ্র্যাজুয়েট। কিন্তু দুজনেরই কোনো ব্যাপারেই মতের মিল হয় না। শিশুপাল বসুর বাড়ি মেদিনীপুর জেলায়, আর কালনেমি মিত্রর বাড়ি চব্বিশ পরগনার ডায়মণ্ড হারবারের কাছে। প্রথম দিন আলাপেই কালনেমি অবজ্ঞার সুরে শিশুপালকে বলেছিল, ‘ও, মেদিনীপুরিয়া?’ এর উত্তরে শিশুপাল বলেছিল, ‘ডায়মণ্ডহারবার মানে দোখনো? ওখানকার লোকেরা খুব মামলাবাজ হয়!’

সেই থেকেই তর্কের শুরু!

কালনেমি একবার ট্রেনে করে যাওয়ার সময় খড়্গপুর স্টেশনে জল খেতে নেমেছিল। কলের সামনে লম্বা লাইন, কালনেমি সবেমাত্র জলের তলায় হাত পেতেছে, এমন সময় ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল। জল খাওয়াও হল না আর ছুটতে গিয়ে তার একপাটি চটি ছিঁড়ে গেল। সেই থেকে মেদিনীপুরের ওপর কালনেমির খুব রাগ।

আর শিশুপালের এক মাসির বিয়ে হয়েছে কাকদ্বীপে। মাসি প্রায়ই বলেন, ‘ওই গুষ্টির কথা বলিস না। হাড়-মাস একবোরে ভাজা ভাজা করে খেল। তোদের যে একটু ডাকব একদিন, মাছ-দুধ খাওয়াব, তার উপায় নেই। সবসময়ই তো লাঠালাঠি আর মামলা চলছে! সেইজন্য শিশুপাল চব্বিশ পরগনার লোকদের বড়ো হেয় মনে করে।

কাজের মাঝখানে যদি কোনোক্রমে একবার চব্বিশ পরগনা কিংবা মেদিনীপুরের কোনো জায়গার নাম ওঠে, অমনি কাজ বন্ধ করে তর্ক শুরু করে দেয় দুজনে।

মজা দেখবার জন্য সহকর্মীরাও কেউ কেউ হঠাৎ বলে ওঠে, ‘যাই বলো, মেদিনীপুরের মতন জায়গা হয় না। এই তো দিঘায় বেড়াতে গেলাম, কী ভালো কাটল, সস্তায় কত মাছ খেলাম!’

কালনেমি অমনি ফোঁস করে উঠে বলল, ‘দিঘার মাছ? আরে ছ্যা ছ্যা! ওই মাছের কোনো স্বাদ আছে নাকি? ইলিশ মাছ খেতে হলে যেতে হবে ডায়মণ্ডহারবার। চিংড়ির জন্য বসিরহাট। পারশে খেতে হলে কাকদ্বীপ। সব মাছের ভেড়িই তো চব্বিশ পরগনায়!’

শিশুপাল অবজ্ঞার সঙ্গে বলে, ‘মেদিনীপুরের মাছের জন্য ভেড়ি লাগে না। যে-কোনো গ্রামের রাস্তা দিয়ে কই মাছ হেঁটে বেড়ায়। আর মুরগি? দশ টাকায় এক জোড়া মুরগি আর কোথাও পাওয়া যায়?’

এইরকম প্রায় রোজই চলে।

গত সপ্তাহে খবরের কাগজে একটা ছোটো খবর বেরিয়েছিল। টিফিনের সময় সেই খবরটা পড়তে পড়তে ওদের সহকর্মী রমেশবাবু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কাঁকড়াঝোড় জায়গাটা কোথায়?’

শিশুপাল অমনি বলে উঠেছিল, ‘মেদিনীপুরে। ওখানে দুর্দান্ত সুন্দর একটা জঙ্গল আছে।’

রমেশ বলেছিল, ‘আমি তো আগে নাম শুনিনি সেই জঙ্গলের। সেখানে আবার বাঘও আছে। এই দেখুন কাগজে বেরিয়েছে। দুটো বাঘ আদিবাসীদের গ্রামে এসে ছাগল ধরে নিয়ে গেছে!’

সেই শুনে কালনেমি অট্টহাসি করে বলেছিল, ‘কাঁকড়াঝোড় আবার একটা জঙ্গল, সেখানে আবার বাঘ! দেখো গিয়ে, বাঘ নয় বনবিড়াল! কার সামনে জঙ্গলের কথা বলছে! আমার বাড়ির পাশে সুন্দরবন, সেখানকার রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা ছাগল-টাগল ছুঁয়েও দেখে না, মানুষ ধরে ধরে ডিনার করে!’

সব সহকর্মীই অবশ্য কাঁকড়াঝোড়ের তুলনায় সুন্দরবনকে সমর্থন করে। শিশুপাল মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল, ‘ওই কাঁকড়াঝোড়ে মাঝে মাঝে হাতিও দেখা যায়। সুন্দরবনে তো হাতি নেই।’

কিন্তু কাঁকড়াঝোড়ে সত্যিই হাতি আছে কী না সে-কথা কাগজে ছাপা হয়নি, সুতরাং কোনো প্রমাণ নেই। সেইজন্য শিশুপালের দাবি অন্যরা মেনে নিতে রাজি হয় না।

শিশুপাল সেইজন্য একটু মনমরা হয়েছিল, আজ আবার সে খবর পেয়ে গেছে! মারি তো গন্ডার, লুটি তো ভান্ডার! এই সেই গন্ডার!

শিশুপালের চেঁচামেচি শুনে বটুকবাবু-রমেশবাবুরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ল কাগজটার ওপর। সত্যিই তো জবর খবর। মেদিনীপুরে গন্ডার! একটা নয়, দুটো। তাও আবার পোষা। কে এই ভরতকুমার দাশ।

কালনেমি মিনমিন করে বলল, ‘ভুল লিখেছে। খবরের কাগজে অনেক ভুল খবর বেরোয়!’

শিশুপাল বলল, ‘আরে তোদের ওই সুন্দরবনের অসভ্য বাঘগুলোর খবরও তো কাগজেই ছাপা হয়। নইলে, সেসব বাঘ কী কেউ চোখে দেখেছে? আমাদের মেদিনীপুরের মানুষ গন্ডারকেও পোষ মানাতে পারে। যে কেউ ইচ্ছে করলে দেখে আসতে পারে!’

কালনেমি বলল, ‘হুঁ! গন্ডার আবার কখনো পোষ মানে? তাহলে গিনেস বুক অফ রেকর্ডে ছাপা হয়ে যেত! তোদের ওই বাংলা কাগজের খবর আমি বিশ্বাস করি না। আমরা বাড়িতে ইংলিশ নিউজপেপার পড়ি। বাড়িতে গিয়ে মিলিয়ে দেখব।’

বটুকবাবু সঙ্গে সঙ্গে অফিসের বয়কে ডেকে বলল, ‘ওরে বংশী, পাশের অফিস থেকে ইংরেজি কাগজখানা একটু ধার চেয়ে আন তো!’

সেই কাগজ আনা হল। হ্যাঁ, ইংরেজি কাগজে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে! দু-খানা রাইনোসেরাস, পাশে আবার ব্র্যাকেট দিয়ে লেখা ডমেস্টিকেটেড।

শিশুপাল টেবিল চাপড়ে বলল, ‘এবার! চব্বিশ পরগনার থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে গেল তো!’

রমেশবাবু একটু সন্দেহ সৃষ্টির জন্য বলল, ‘অবশ্য ছাপার ভুল হতে পারে। মঙ্গলহাটা গ্রামটা যদি জলপাইগুড়িতে হয়, তাহলে আর অবিশ্বাসের কিছু নেই। ওখানে তো গন্ডার আছেই!’

শিশুপাল চোখ গরম করে বলল, ‘দু-দুটো কাগজে ভুল ছাপা হবে? তা ছাড়া, জলপাইগুড়িতে কেউ কোনোদিন গন্ডার পুষেছে? ওরকম হিম্মত মেদিনীপুরের লোক ছাড়া আর কারুর হয় না।’

বটুকবাবু বলল, ‘যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই বাচ্চা গন্ডার!’

শিশুপাল বলল, ‘চলুন, এই শনিবার আমার সঙ্গে চলুন মেদিনীপুর, আমি খরচা দেব, নিজের চোখে দেখে আসবেন, বাচ্চা না বড়ো!’

টিফিনের সময় কালনেমিকে দেখা গেল খবরের কাগজের অফিসে টেলিফোন করতে। ইংরেজি কাগজের লোকদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে হবে বলে সে ফোন করল বাংলা কাগজের অফিসে।

কিন্তু প্রথম কথাতেই তাকে ধাক্কা খেতে হল। যে প্রথম টেলিফোন ধরল সে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ, বলুন, কী চাই?’

কালনেমি বলল, ‘দেখুন, আজকের একটা খবর সম্পর্কে একটু জিজ্ঞেস করতে চাই…’

ওপাশের লোকটি বলল, ‘কী খবর? কার খবর? কোথাকার খবর? লোকাল না ফরেন? রিপোর্টিং না এজেন্সি ম্যাটার? বলুন, বলুন!’

ঘাবড়ে গিয়ে কালনেমি ফোন রেখে দিল।

শিশুপাল বলল, ‘আরে আরে, এ দেখছি ফোনও করতে পারে না। দেখ আমি করছি।’

সে ডায়াল ঘুরিয়ে কানেকশন পাওয়ার পর নিজেই প্রথম জিজ্ঞেস করল, ‘ও মশাই, গন্ডারের ব্যাপারটার একটা কথা জিজ্ঞেস করছিলুম…’

অন্য দিক থেকে বলল, ‘গন্ডার! এটা কী চিড়িয়াখানা ভেবেছেন নাকি? আজকাল যা হয়েছে টেলিফোনের ব্যাপার, সবসময় রং নাম্বার!’

সেই লোকটি লাইন কেটে দিল।

বটুকবাবু বলল, ‘দাও দাও, আমার কাকার এক শালা ওই কাগজে কাজ করে। তার কাছ থেকে একেবারে ভেতরের খবর জেনে দিচ্ছি!’

অপারটরকে অনেক বুঝিয়ে বটুকবাবুর কাকার শালার সন্ধান পাওয়া গেল। সব শুনে তিনি বললেন, ‘গন্ডার? সেরকম কোনো খবর পেয়েছিলে বুঝি? কে বলল?’

বটুক বলল, ‘আপনাদের আজকের কাগজেই তো প্রথম পাতায় বেরিয়েছিল, দেখেননি?’

কাকার শালা বলল, ‘ওসব তো নিউজের ব্যাপার। আমরা তো কিছু জানি না! তবে দাঁড়াও, তোমাকে আর একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি। তুমি ধরে থাকো।’

বটুকবাবুকে অনেকক্ষণ ধরে থাকতে হল। টিফিনের সময় ফুরোতে আর দেরি নেই। নিউজ-পেপারের লোক নিউজের খবর রাখে না, শুনে সবাই অবাক। কাগজের লোক নিজেদের কাগজ পড়ে না।

একটু বাদে আর একজন লোক ধরে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ, বলুন, গন্ডার সম্পর্কে কোনো খবর দেবেন? কলকাতার রাস্তায় গন্ডার বেরিয়েছে?’

বটুকবাবু বলল, ‘আজ্ঞে, না না, আমি সেকথা বলিনি। বলছিলুম কী, আজকের কাগজে মেদিনীপুরে গন্ডারের যা খবর বেরিয়েছে, সেটা কি সত্যি?’

লোকটি চটে গিয়ে বলল, ‘সত্যি না কি আমরা মিথ্যে খবর ছাপব? আপনি কে মশাই, শুধু সময় নষ্ট করছেন?’

‘না, না, সেকথা বলছি না। আমরা যদি ওই গন্ডার দেখতে যাই, দেখতে পাব তো?’

‘আপনারা গন্ডার দেখতে পাবেন কী পাবেন না, তা আমরা কী জানি, লোককে গন্ডার দেখানো কী আমাদের দায়িত্ব। গন্ডার যদি দেখার অত গরজ থাকে, তাহলে অতদূরে মেদিনীপুরে যেতে হবে কেন, আলিপুরে চলে যান!’

‘ওই গন্ডারের খবর যিনি লিখেছেন, তিনি নিজের চোখে দেখেননি?’

‘আরে মশাই, সব কিছু নিজের চোখে দেখে লিখতে গেলে তো আমাদের এক হাজারটা চোখ থাকা দরকার। তবে ওই খবরটা আমরা অনেক চেক করে তারপর ছেপেছি। দু-তিন জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে, সব জায়গাতেই মিলেছে। লাইভ স্টক সেনসাস হচ্ছে তো, লাইভ স্টক সেনসাস কাকে বলে জানেন আশা করি, গৃহপালিত পশু, যেমন গোরু-মোষ-ছাগল-ভেড়া এইসব গোনাগুনতি হচ্ছে, তার মধ্যে ওই দু-টি পোষা গন্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে! আশ্চর্য ব্যাপার, এদেশে কিন্তু কেউ জলহস্তী পোষে না।’

টেলিফোন রেখে দিয়ে বটুকবাবু যেই বলল খবরের কাগজের লোক নিজের চোখে দেখে লেখেনি, অমনি কালনেমি লাফিয়ে উঠল, ‘গাঁজাখুরি! গাঁজাখুরি! ওদের নামে মামলা আনা যায়!’

শিশুপাল আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখলেন দোখনোর কান্ডটা। এই যে লিখেছে, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্ট, মহকুমা হাকিম বলেন—এসব কখনো মিথ্যে হতে পারে? ঠিক আছে, এই শনিবার কে কে যাবে মেদিনীপুর? আমি খরচা দেব! নিজের চোখে দেখিয়ে দেব!’

এরকম সুযোগ ক-জন ছাড়ে। রমেশবাবু আর বটুকবাবু দুজনেই রাজি হয়ে গেল ওদের সঙ্গে যেতে। বাজি ধরা হল গন্ডার নিয়ে, যে পক্ষই জিতুক, একশো টাকা খাওয়াবে।

হাওড়া স্টেশনে এসে কালনেমি একসময় আপত্তি জানাল, সে খড়্গপুর হয়ে যাবে না। কিন্তু তার আপত্তি টিকল না। খড়্গপুরকে বাদ দিয়ে কি মেদিনীপুর যাওয়া যায়? শিশুপাল চেঁচিয়ে বলল, ‘ভীতু! ভীতু!’

মঙ্গলহাটা গ্রামে পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে গেল। ভরতকুমার দাশের নাম জিজ্ঞেস করতেই সবাই চিনতে পারল এক বাক্যে। কয়েকজন এগিয়ে এসে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলে যান, এই রাস্তার একেবারে শেষ বাড়িটা। মস্ত বড়ো বাগান আর পুকুর আছে দেখবেন।’

তাদের ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি।

বটুকবাবু ফিসফিস করে শিশুপালকে জিজ্ঞেস করল, ‘এদের কাছে জানতে চাইব নাকি?’

শিশুপাল বলল, ‘কিছু দরকার নেই। এতদূর এসে পড়েছি, একটু পরেই তো চক্ষু-কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাবে।’

রমেশবাবু বলল, ‘তা ঠিক। কিন্তু কথা হচ্ছে, ওই ভরত দাশ লোকটা কি পোষা গন্ডারদের ছেড়ে রাখে না খাঁচায় রাখে? আমার বড্ড কুকুরের ভয়।’

শিশুপাল প্রায় তেড়ে উঠে বলল, ‘আপনি তো মশাই আচ্ছা লোক। গন্ডারের সঙ্গে কুকুরের তুলনা করছেন? গন্ডার কি কুকুরের মতন ঘেউ ঘেউ করে?’

রমেশবাবু বলল, ‘গন্ডার কীভাবে ডাকে তা আমি জানিই না। তবে আমি আপনাদের পেছনে থাকব!’

ভরত দাশের বাড়িটি বেশ বড়ো। সামনে অনেকখানি বাগান, তাতে আবার গেট। ভেতরে চৌকো চত্বরের চারদিকে চারখানা ঘর। তার মধ্যে দু-খানা পাকা, দু-খানা খড়ের চালার। বাড়ির পেছন দিকেও অনেক গাছপালা। বেশ অবস্থাপন্ন লোক। এইরকম লোকেরই গন্ডার পোষা মানায়।

চৌকো চত্বরটায় মোড়ায় বসে একজন মাঝবয়েসি খালি গায়ের মানুষ হুঁকো টানছে। এই দলটি ভেতরে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘ভরতকুমার দাশ আছেন নাকি?’

হুঁকো টানা থামিয়ে লোকটি জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’

বটুকবাবু বলল, ‘কলকাতা থেকে।’

শুনেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বিগলিতভাবে বলল, ‘ও কলকাতা থেকে? আসুন, আসুন। এই কে আছিস রে, চেয়ারটা নিয়ে আয়। চায়ের জল বসা। লক্ষ্মীকে দেখতে এসেছে! লক্ষ্মীকে সাজাতে বল।’

বটুকবাবুরা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। বাড়ির ভেতর থেকে একজন লোক ওদের জন্য চেয়ার বয়ে আনল। দু-তিনজন মহিলাও উঁকি মারলেন।

হুঁকো হাতে লোকটি বলল, ‘বসুন, বসুন, আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো? আমি ভেবেছিলুম, আগামীকাল আসবেন। খবর দিলে আমি স্টেশনে লোক পাঠাতুম।’

শিশুপাল বলল, ‘আজ্ঞে আমাদের পরিচয় দিয়ে নিই। আমি শিশুপাল বসু, ইনি বটুকেশ্বর দত্ত, উনি রমেশচন্দ্র নাগ আর ওই একজন হচ্ছে কালনেমি মিত্তির। আমরা এসেছি ভরতকুমার দাশের সঙ্গে দেখা করতে।’

লোকটি বলল, ‘আমিই সেই অধম। আমার মেয়ের নামই লক্ষ্মী। একটু বসুন। লক্ষ্মীকে সাজিয়েগুজিয়ে নিয়ে আসছি।’

বটুকবাবু বলল, ‘লক্ষ্মী… মানে…. আমরা তো আপনার মেয়েকে দেখতে আসিনি!’

‘আমার মেয়েকে দেখতে আসেননি! তাহলে আপনারা…’

‘আমরা…মানে….আপনার বাড়ির গন্ডার দুটো দেখতে এসেছি, মানে দূর থেকে এক ঝলক দেখলেই চলবে, একটা বাজি হয়েছে কিনা।’

ভরতকুমার প্রথমে চোখ গোল করে বলল, ‘আপনারা বরদা সাঁতরার কাছ থেকে আসেননি? আমার মেয়েকে দেখতে আসেননি? আপনারা গন্ডার দেখতে… ওঃ হো-হো-হো-হো…’

…প্যাঁক প্যাঁক ডাকতে ডাকতে দুটো বেশ বড়ো রাজহাঁস চলে এল উঠোনে!

ভরতকুমার এমন হাসি শুরু করল যে সারাপাড়া যেন কেঁপে গেল একেবারে। হাসির চোটে হাত থেকে পড়ে গেল হুঁকো। প্রথমে সে বসে পড়ে মাথা ঝাঁকাতে লাগল। তারপর হাসতে হাসতে একেবারে মাটিতে গড়াগড়ি!

এরা চার জন একেবারে হতভম্ব। ভরতকুমার দাশের হাসি আর থামছেই না। লোকের যেমন কাশির রোগ থাকে, এর বোধ হয় তেমন হাসির রোগ। বটুকবাবু বলল, ‘চলো কেটে পড়ি। রমেশবাবু বলল, বাজির কিছু ফয়সালা হল না যে।’ শিশুপাল বলল, ‘ওই কালনেমি ব্যাটাই হেরেছে।’

কালনেমি মাটিতে বসে পড়ে ভরতকুমারের হাত ধরে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগল, ‘ও দাদা, ও দাদা, শুনুন। আমিও রামায়ণের ক্যারেকটার, আপনিও রামায়ণের ক্যারেকটার। আমরা দু-জনে এক দলের। ওই শিশুপালটা মহাভারত আরও বড়ো বইয়ের ক্যারেকটার বলে গর্ব করে। কিন্তু ওর যে মুন্ডু উড়ে গিয়েছিল, সেটা মনে রাখে না। আপনি শুধু একবার বলে দিন তো, আপনার বাড়িতে গন্ডার নেই। ওর মুন্ডটা আবার হেঁট হয়ে যাক।’

শিশুপালও অন্যদিকে বসে পড়ে বলল, ও ভরতদাদা, ও ভরতদাদা, আপনিও মেদিনীপুর, আমিও মেদিনীপুর। আমরা হলুম গে আত্মীয়, কী বলুন? একবার চট করে গন্ডার দুটো দেখিয়ে দিন তো। একটা দেখালেও চলবে।’

ভরতকুমার এবারে হাসি থামিয়ে উঠে বসল। মুখ মুছল গামছা দিয়ে। তারপর বলল, ‘দেখবেন, দেখবেন, দেখুন তাহলে।’

সুর করে সে ডাকল, ‘আয় তো রে আমার কার্তিক। আয় তো রে আমার গণেশ। আয় আয় আয়।’

অমনি গোয়াল ঘরের পাশ দিয়ে প্যাঁক প্যাঁক ডাকতে ডাকতে দুটো বেশ বড়ো রাজহাঁস চলে এল উঠোনে!

ভরতকুমার বললেন, ‘আমি মিছে কথা বলি না। এখনকার ছেলেছোকরারা ইংরেজি জানে না, আমি কী করব, বলুন? থানা থেকে লোক এল আমার বাড়ির গোরু-ছাগল গুনতে। আমি সব শেষে বললুম, আই হ্যাভ ডু গ্যাণ্ডারস। আমি কি কিছু ভুল বলেছি? তারা যদি মানে না-বুঝে গন্ডার লিখে নেয়…’

কালনেমি লাফাতে লাফাতে বলল, ‘নেই, নেই, গন্ডার নেই, নেই!’

শিশুপাল তার ঘাড় চেপে ধরে বলল, ‘ওরে ভালো করে চেয়ে দেখ। গন্ডার না হল তো কী হয়েছে? এমন রাজহাঁস জন্মে দেখেছিস? তোদের সুন্দরবনে তো সব পাতিহাঁস!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *