ভরত ডাক্তারের ঘোড়া
কাছাকাছি আট-দশখানা গ্রামের মধ্যে একজনই ডাক্তার। ভরত ডাক্তার। তাঁর ওপর সবারই খুব বিশ্বাস। কয়েকজন কবিরাজ আছেন ঠিকই। কিন্তু কবিরাজ তো আর ডাক্তার নন। সিরাজসাহেব হেকিমি চিকিৎসা করেন, কিন্তু সে-ও তো হেকিমি, ডাক্তারি নয়। লোকের ধারণা, ভরত ডাক্তার বিলিতি ওষুধ দেন, তাতেই সব রোগ সারে। তা ছাড়া, তিনি সুই দেন মাঝে মাঝে। অর্থাৎ ইঞ্জেকশন। তা তো কবিরাজ কিংবা হেকিম দিতে পারেন না।
ভরত ডাক্তার বেশ ভালো ডাক্তার এবং ভালো মানুষ। দূর-দূর গ্রামের লোক তাঁকে ডাকলেই তিনি চলে যান। গোলগাল ফরসা চেহারা, একটু বেঁটে, মাথায় সুন্দর চকচকে টাক।
তখনকার দিনে গ্রামে রাস্তাঘাট প্রায় কিছুই ছিল না। বর্ষার সময় লোকে যাতায়াত করত নৌকোয়, আর গ্রীষ্মকালে জল শুকিয়ে গেলে হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। সরু আলপথ কিংবা এবড়োখেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে সাইকেল চালানোও খুব কষ্টকর।
কিন্তু একজন ডাক্তার কী করে হেঁটে-হেঁটে রুগি দেখতে যাবেন? তাহলে তো দু-তিন জায়গার বেশি যাওয়াই যায় না। অথচ শীত শেষ হতে না-হতেই মানুষের খুব রোগভোগ শুরু হয়।
তাই ভরত ডাক্তার রুগি দেখতে যান ঘোড়ায় চেপে। ভরা বর্ষার সময় নৌকো। অন্য সময় ঘোড়া। ডাক্তার ছোটোখাটো মানুষ বলে তার ঘোড়াটিও তেমন বড়ো নয়। কখনো খুব জোরে ছোটে না।
ঘোড়ার একটা সুবিধে, সকাল-দুপুর-রাত যেকোনো সময়েই নিয়ে যাওয়া যায়। ঘোড়ারা সহজে ক্লান্ত হয় না, তাদের ঘুমও কম। পেটব্যথা থেকে মাথাব্যথা, সবরকম চিকিৎসাই করতে হয় ভরত ডাক্তারকে। তাই এক-একদিন রাতবিরেতেও তার ডাক পড়ে। রুগির এখন-তখন অবস্থা ভরত ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিলেই সে বেঁচে উঠবে। অনেকে মাঝরাতেও শুনতে পায় ঘোড়ার পায়ের কপ কপ শব্দ, তাতে বুঝে যায় ভরত ডাক্তার কোথাও কোনো মুমূর্ষুকে বাঁচাতে যাচ্ছেন।
ভরত ডাক্তারের ফি মাত্র দু-টাকা। কেউ কেউ তাও দিতে পারে না। কেউ কেউ কাঁচুমাচু মুখ করে মাথা চুলকে বলে, ‘ডাক্তারবাবু, হাতে তো এখন পয়সাকড়ি নেই, পরে শোধ করে দেব। যদি দয়া করেন।’
ভরত ডাক্তার জানেন, পরে আর কেউ শোধ করে না। তবু রাগারাগি করেন না তিনি। উদারভাবে বলেন, ‘ঠিক আছে। তোকে পয়সা দিতে হবে না। আমার ঘোড়াটার জন্য এক বস্তা ঘাস পাঠিয়ে দিস। কিংবা, তোদের ঘরের মাচায় তো দেখলাম, দুটো বেশ পুরুষ্টু লাউ ঝুলছে, তার একটা দে, অনেক দিন লাউয়ের শুক্তো খাইনি।’
ডাক্তারের এই উদারতার সুযোগ নিয়ে কারো-কারো কাছে টাকা থাকলেও তা না-দিয়ে কিছু জিনিস দিতে চায়। একটা লাউয়ের দাম মোটে চার আনা, আর এক বস্তা ঘাস বড়োজোর আট আনা।
সব রুগিই তো আর শেষপর্যন্ত বাঁচে না। দুনিয়ার কোনো ডাক্তারই বাঁচাতে পারেন না সব মানুষকে। কোনো বাড়িতে রুগির মৃত্যু হলে ভরত ডাক্তার ফি তো নেনই না, বরং পকেট থেকে দু-পাঁচ টাকা বের করে দেন শ্মশান খরচের জন্য।
ডাক্তারের বাড়ির লোক অবশ্য এমন উদার নন। এত নামকরা ডাক্তার কিন্তু টাকাপয়সা এত কম উপার্জন করেন বলে বকাবকি করেন তাঁর বউ। দুটো ছেলে আছে, মহাবিচ্ছু। রাত্তিরে বাবা বাড়ি ফিরলেই তারা তাঁর পকেট হাতড়ে দেখে, তারপর ঠোঁট উলটে বলে, ‘মোটে এই!’
ডাক্তারের ঘোড়াটির নাম ছোট্টু। তার দেখাশুনো করে বদন ভুঁইমালি। সে ছোট্টুকে ঘাস খাওয়ায়, ছোলা খাওয়ায়, দলাইমলাই করে। আর সপ্তাহে একদিন গায়ে জল ঢেলে স্নানও করিয়ে দেয়। অন্য কেউ ছোট্টুর গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে এলে ছোট্টু তা মোটেই পছন্দ করে না, জোরে-জোরে মাথা নাড়ে আর চিঁ-হি-হি করে ডেকে ওঠে।
ঘোড়ার দেখাশুনো ছাড়াও এবাড়ির আরও অনেক কাজ করতে হয় বদনকে।
বদনের কাছে ডাক্তারবাবু যে স্বয়ং এক দেবতা। কোনোদিন তিনি বদনকে বকাবকি করেন না। মাস-মাইনে ছাড়াও তিনি বদনকে এক টাকা-দু-টাকা বকশিশ দেন। বদনের বাবা সাধুচরণকে সাপে কামড়ে ছিল, তাকে পর্যন্ত সারিয়ে তুলেছিলেন ভরত ডাক্তার। তাঁর ওষুধের এমন গুণ।
এক ঝড়জলের রাতে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় বাড়ি ফিরলেন ভরত ডাক্তার। তাঁর গায়ের জামা ছেঁড়া, মুখে ফালা ফালা দাগ, সেখান থেকে রক্ত পড়ছে, ফুলে গিয়েছে একটা চোখ। সোনালি ফ্রেমের চশমাটাও নেই।
কী হয়েছে? কী হয়েছে?
ডাক্তারবাবু একেবারে চুপ।
বউ, ছেলে-মেয়ে কারুর প্রশ্নেরই তিনি জবাব দেন না। পোশাক বদল করে তিনি শুয়ে পড়লেন। কিছু খাবারও খেলেন না।
এরপর দু-দিন ডাক্তারবাবু ওই একইরকম রইলেন, কোনো কথাও বললেন না, রুগি দেখতেও বেরোলেন না। অবশ্য ঝড়বৃষ্টি চলছেই।
পাড়াপ্রতিবেশীরা দেখা করতে এল অনেকেই। ডাক্তারবাবু কথা বলছেন না বলে কেউ কিছু জানতেও পারল না। তখন কেউ কেউ বলতে লাগল, ‘ডাক্তারবাবুকে ডাকাত ধরেছিল নিশ্চয়ই।’
তাতে কয়েকজন বলল, ‘যা:, তা হতেই পারে না। এ তল্লাটের সবাই ডাক্তারবাবুকে ভালোবাসে। ডাকাতরাও তাঁকে দেখলে প্রণাম করে। কত দিন তিনি কত রাতে বাড়ি ফিরেছেন। কখনো কিছু হয়নি।’
আর ক-জন বলল, ‘‘তাহলে নিশ্চয়ই ভূতে ধরেছিল। ডাক্তারবাবু চিকিৎসা করলেও তো কেউ কেউ ভূত হয়, সেরকম কোনো ভূত যদি রেগে থাকে!’
তা শুনে একজন বলল, ‘আরে কী যে বল! কেউ মরলেও মরতে-মরতে ভাবে, ডাক্তারবাবু যথাসাধ্য করেছেন, নেহাত আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছে, তাই মরতে হল। ডাক্তারবাবুর ওপর রাগ করবে কেন? তা ছাড়া তিন-চার দিনের মধ্যে তো এই তল্লাটের কেউ মরেনি।’
এইসব তর্কাতর্কিতে আসল ব্যাপারটা আর বোঝা গেল না।
তৃতীয় দিনে ডাক্তারবাবু বিছানা ছেড়ে বারান্দায় বসে রইলেন কিছুক্ষণ। উঠোনের একপাশে একটা গোয়ালঘর, তার পাশে একটা আস্তাবল। সেখানে বদন দলাইমলাই করছে ঘোড়াটাকে।
একসময় ডাক্তারবাবু হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, ‘এই বদন, শোন। এদিকে আয়।’
বদন কাছে এসে প্রণাম করে উবু হয়ে বসল।
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বদন রে, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আমার মৃত্যুদিন ঘনিয়ে এসেছে।’
তা শুনে বদন দারুণ চমকে উঠে বলল, ‘এ কী কথা বলেন কর্তা? আপনি কত মানুষকে চিকিৎসা করে বাঁচাচ্ছেন। আপনি নিজের দু-ফোঁটা ওষুধ খেলেই তো সেরে উঠবেন। আপনি মরবেন কেন?’
ডাক্তারবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওরে, ডাক্তাররা নিজের চিকিৎসা করতে পারে না। ডাক্তারদেরও মরতে হয়। আমি বুঝে গিয়েছি, আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে।’
তা শুনেই বদন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে শুরু করে দিল।
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আমার কয়েকটা কথা মন দিয়ে শোন। আমি মরে গেলে তোকে বোধ-হয় আর এ বাড়িতে কাজে রাখবে না। আমার ছেলেরা তোকে পছন্দ করে না। তা তুই অন্য বাড়িতে কাজ পেয়ে যাবি। কিন্তু আমার ঘোড়াটার কী হবে বল তো?’
বদন চোখ মুছে বোকার মতো বলল, ‘আপনার ঘোড়া? ছোট্টু? তার কী হবে?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ রে, আমার ছেলেরা ছোট্টুকেও পছন্দ করে না। ওকেও রাখবে না। বিক্রি করে দেবে! তারপর?’
বদন বলল, ‘বিক্রি করে দেবে? তারপর?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘বিক্রি করে দিলে কে কিনবে জানি না। যদি কোনো গাড়িওয়ালাকে দেয়, সে গাড়ির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে রোজ চাবুক মারবে। তাহলে আমি মরে গিয়েও শান্তি পাব না। ছোট্টু আমায় কত সার্ভিস দিয়েছে। বদন, ছোট্টুকে আমি তোর হাতে দিয়ে যাব। তুই আগের মতোই ওর দেখাশুনো করবি। প্রতিজ্ঞা কর। তুই ওকে কোনোদিন বিক্রি করে দিবি না?’
বদন প্রথমে আনন্দে ডগমগ হয়ে বলল, ‘কর্তা, ছোট্টু আমার কাছে থাকবে? আহা-হা, কী ভালো। কী ভালো! কোনোদিন ওকে বিক্রি করব না। তাহলে আমার পাপ হবে! তিন সত্যি করছি, কোনোদিন ওকে বেচব না।’
তারপরই সে মুখ শুকনো করে বলল, ‘কিন্তু কর্তা, আমি গরিব মানুষ। আমি একটা ঘোড়া পালব কী করে? অন্য বাড়িতে চাকরি করলে কী করে ওর দেখাশোনা করব? ছোলা আর বিচালি কেনার পয়সাই বা পাব কোথায়?’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তাও তো কথা বটে। গচ্চা তো আছেই। ঠিক আছে, আমি একটা কিছু ব্যবস্থা করে যাব, যাতে তুই মাসে-মাসে কিছু টাকা পাবি!’
পরদিনই মারা গেলেন ডাক্তারবাবু। একেবারে জলজ্যান্ত অবস্থায়। রাত্তিরে ঘুমিয়ে ছিলেন, সকালবেলা আর জাগলেন না।
বদনের জন্য ডাক্তারবাবু কী ব্যবস্থা করে গেলেন তা জানা গেল না। বোধহয় তিনি সময় পাননি।
শ্রাদ্ধশান্তি চুকে যাওয়ার পর ডাক্তারবাবুর স্ত্রী বদনকে বললেন, ‘কাল থেকে আর তোকে আসতে হবে না। আমরা কম টাকায় অন্য লোক রাখব। তুই বুড়ো হয়ে গিয়েছিস, তোকে দিয়ে আর চলবে না।’
বদন গিন্নিমাকে প্রণাম করে ছোট্টুকে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। পরদিন সকালেই ডাক্তারবাবুর ছেলে সুধীর বদনের বাড়িতে এসে খুব চ্যাঁচামেচি লাগিয়ে দিল।
সে বলল, ‘তুই কোন সাহসে আমাদের ঘোড়া নিয়ে চলে এলি? তুই একটা চোর। তোকে পুলিশে দেওয়াই উচিত। নেহাত পুরোনো লোক বলে দিচ্ছি না।’
বদন যতই বলে, ডাক্তারবাবু ঘোড়াটা তাকেই নিতে বলেছেন, তা সুধীর শুনতেই চায় না। সে জোর করে ছোট্টুকে নিয়ে চলে গেল, বদন কোনো বাধাই দিল না।
সন্ধ্যেবেলাই ফিরে এল ছোট্টু। বদনের বাড়ির কাছে এসে চিঁ-হি-হি করে ডাকল।
দু-দিন পরে সুধীর এসে আবার অনেক গালাগালি করে ফিরিয়ে নিয়ে গেল ছোট্টুকে। এবার সে ছোট্টুকে বিক্রি করে দিল কলিমুদ্দিন মিঞার কাছে। কলিমুদ্দিনের দু-খানা ঘোড়ার গাড়ি আছে। তাদের মধ্যে একটা ঘোড়ার মার খেতে-খেতে খুব কাহিল অবস্থা।
সেখান থেকেও পালিয়ে এল ছোট্টু। সে যেন ঠিক জানে ডাক্তারবাবুর মনের কথা।
কলিমুদ্দিন মিঞা যখন জানতে পারল যে ঘোড়াটা ফিরে গিয়েছে বদনের কাছে, তখন সে কিন্তু রাগারাগি করল সুধীরের ওপরেই। বদনের দোষ কী? সে তো ঘোড়া চুরি করে আনেনি। ঘোড়া নিজে থেকে তার বাড়ি চলে এলে সে কী করবে?
চারদিকে রটে গেল, ডাক্তারবাবুর ঘোড়া বদন ছাড়া আর কারুর বাড়িতেই থাকবে না। তাহলে আর এ ঘোড়া কে কিনবে?
তারপর থেকে ছোট্টু রয়ে গেল বদনের কাছে। কিন্তু সে গরিব মানুষ, ঘোড়া দিয়ে কী করবে? অন্য একটা বাড়িতে সে কাজ পেয়েছে, সেখানে সারাদিন খাটতে হয়। ঘোড়ায় চড়ার সময়ই বা সে পাবে কখন, আর ঘোড়ায় চড়ে সে যাবেই বা কোথায়?
এক-একদিন ভোরবেলায় ঘোড়াটা নিয়ে বেরোলে মাঠের লোকেরা তাকে দেখে হাসে, ঠাট্টা করে। কেউ কেউ চেঁচিয়ে বলে, ‘কীরে বদন, ঘোড়ায় চেপে যুদ্ধ করতে যাচ্ছিস নাকি? ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, নিধিরাম সদ্দার।’
কেউ বলে, ‘এই রে, গরিবের ঘোড়া-রোগ হয়েছে!’
দিনের বেলা আর সে ঘোড়া নিয়ে বেরোয় না। কোনো কাজেই লাগে না। তাও তো ঘোড়াকে খাওয়াতে হয়। ঘাস কাটার সময় পায় না সে। ছোলাটোলা কিনতেও তো পয়সা লাগে। কিন্তু সে ডাক্তারবাবুর সামনে প্রতিজ্ঞা করেছে, ঘোড়াটার কখনো অযত্ন করবে না। মহামুশকিল!
বদনের ছেলে নেই, আছে দু-টি মেয়ে আর বউ। তারা তো জানেই না কী করে ঘোড়ার যত্ন নিতে হয়। বদনই রাত্তিরে ফিরে এসে ছোট্টুকে দলাইমলাই করে। নিজেরা আধপেট খেয়েও ছোট্টুকে খেতে দেয়। ঘাস-বিচালির বদলে ছোট্টুকে ভাত কিংবা রুটি দিলেও দিব্যি খেয়ে নেয় সে। তাকে বেঁধে রাখা হয় না, সারাদিন সে বাড়ির আশপাশেই ঘোরাফেরা করে, দূরে কোথাও যায় না।
মাঝে মাঝে বদন ছোট্টুর সঙ্গে কথাও বলে। ছোট্টুও যেন বুঝতে পারে সব কিছু। বদন তার ঘাড়ে চাপ্পড় মেরে বলে, ‘ওরে ছোট্টু রে, আমি তোকে ঠিকমতো যত্ন করতে পারি না। আমরা যে বড়ো গরিব।’
ছোট্টু মুখ দিয়ে ফ-র-র-র শব্দ করে। যেন এইটুকু আদর পেয়েই সে খুব খুশি।
একদিন বদন ভাবল, বেশি রাত্তিরে ছোট্টুকে নিয়ে কোথাও ঘুরে এলেই তো হয়। রাত্তিরে তো কেউ দেখতে পাবে না, কেউ ঠাট্টাও করবে না। তা ছাড়া ঘোড়ার মতো একটা প্রাণীকে তো মাঝে মাঝে ছোটানোও দরকার। দৌড়োদৌড়ি না-করলে ঘোড়ার পায়ে বাত হয়।
ছোট্টুর পিঠে জিন পরিয়ে বদন চেপে বসল। সঙ্গেসঙ্গে ছোটা শুরু করল ছোট্টু মনের আনন্দে। প্রথমে আস্তে, তারপর বেশ জোরে।
আকাশ পরিষ্কার, ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, তার মধ্যে ঘোড়া ছোটাতে ভারি আরাম। বদনের মনে হল, সে যেন বদন ভুঁইমালির মতো একজন সাধারণ এলেবেলে মানুষ নয়, সে একজন সেনাপতি। হাতে তলোয়ার নেই, এই যা!
বদন ভেবেছিল সে শুধু গ্রামের চারপাশটা ঘুরে আসবে। কিন্তু খানিক বাদে সে ফিরতে চাইলেও ছোট্টু ফিরবে না। সে ছুটতে লাগল আপন খেয়ালে। বেশ জোরে। বদন তাকে থামাতেই পারছে না।
দু-খানা গ্রাম ছাড়িয়ে ছোট্টু এসে থামল একটা বড়ো বাড়ির সামনে। দু-পা তুলে চিঁ-হি-হি করে ডাকল। সেই ডাক শুনে বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলে দু-জন লোক। একজন লোক অবাক হয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবুর ঘোড়া। ওমা ডাক্তারবাবু এসেছেন! ডাক্তারবাবু, আসুন—আসুন। আমাদের রতনের খুব জ্বর। আপনি কী করে জানলেন?’
সেদিনের আকাশ মেঘলা। বাইরেটা বেশ অন্ধকার। ঘোড়ার পিঠে কে বসে আছে তা বোঝা যায় না। অন্য লোকটি বলল, ‘যা:, ডাক্তারবাবু তো স্বর্গে গিয়েছেন, তিনি কী করে আসবেন? এ অন্য কেউ।’
বদন তখন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘বাবুরা, আমায় মাপ করবেন। আমি বদন ভুঁইমালি। ডাক্তারবাবুর ঘোড়াটা আমার কাছে এখন থাকে।’
একজন বলল, ‘অ, তাই বল। তা তুমি এখানে এলে কীজন্যে? কিছু দরকার আছে?’
বদন বলল, ‘আজ্ঞে না। এধার দিয়ে যাচ্ছিলাম। ঘোড়াটা এখানেই একবার থামল।’
অন্যজন জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের রতনের ধুম জ্বর। এত রাতে ডাক্তার-বদ্যি কোথায় পাব! তুমি কি চিকিৎসার কিছু জান? তুমি তো ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ছিলে।’
বদন জিভ কেটে বলল, ‘বাবু, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। ওষুধ-বিসুধের কিছুই জানি না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনাদের বাড়ির ছেলে তাড়াতাড়ি সেরে উঠুক।’
ছোট্টু এবার ছটফটিয়ে উঠল। উলটো দিকে মুখ ফিরিয়ে শুরু করল দৌড়। সোজা বদনের বাড়ি।
ছোট্টুর পিঠে জিন পরিয়ে বদন চেপে বসল…
এর দু-দিন পর আবারও ঠিক ওইরকম ব্যাপার হল। বেশি রাত্তিরে বদন ছোট্টুর পিঠে চাপতেই সে ছুটতে লাগল আপন খেয়ালে।
এবারে গিয়ে থামল অন্য দিকের আর-একটা গ্রামের একটা বাড়ির সামনে। এ বাড়ির ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে কান্নার আওয়াজ। কেউ বুঝি মারা গিয়েছে। ভয় পেয়ে বদন কাঁপা গলায় বলল, ‘এ কোথায় এলি রে ছোট্টু? চল—চল ফিরে চল।’’
ছোট্টু মুখ দিয়ে ফ-র-র-র শব্দ করল।
এ বাড়ি থেকেও একজন লোক বেরিয়ে এসে খুব অবাক হল। ভরত ডাক্তারের ঘোড়াকে অনেকেই চেনে। ডাক্তারবাবুকে নিয়ে এবাড়িতেই আগে এসেছে কয়েকবার। আজ সেই ঘোড়ার পিঠে কে?
বদন হাতজোড় করে বলল, ‘আমায় মাপ করবেন বাবু। আমি অতিসামান্য লোক। এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম।’
লোকটি বলল, ‘আমার মেয়ে মায়ারানির ভেদবমি শুরু হয়েছে সন্ধ্যে থেকে। এখন-তখন অবস্থা। ডাক্তারবাবুর ঘোড়ায় চাপ, তুমি কি চিকিৎসার কিছু জান?’
এখানেও লজ্জা পেয়ে সে বলল, ‘আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ। ওসব কিছুই জানি না। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আপনার মেয়ে সেরে উঠবে।’
তৃতীয়বার মাঝরাত্তিরে ছোট্টু বদনকে নিয়ে এল আর-একটা বাড়ির সামনে। এটা বেশ বড়ো বাড়ি, কোনো জমিদার-টমিদারের হবে বোধহয়। বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন লোক। তারাও বদন ডাক্তারের ঘোড়াটাকে চেনে। যে এখন ঘোড়াটা চালাচ্ছে, তাকে চেনে না। একজন লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কে হে? তুমি বুঝি এই ঘোড়াটা কিনেছ?’
বদন বলল, ‘আজ্ঞে না। ঘোড়া কিনব সে সামর্থ্য আমার কোথায়? আমি অতিগরিব লোক, ডাক্তারবাবু এ ঘোড়াটা আমায় দিয়ে গিয়েছেন।’
লোকটি কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ‘আহা, ডাক্তারবাবু ছিলেন অতিমহৎ মানুষ। শেষবার তো এ বাড়িতেই ছোটো কত্তার চিকিৎসে করতে এসেছিলেন। সে রাতেই তিনি ফেরার সময় ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলেন। লোকে বলে, শ্মশানতলায় একটা বটগাছের ডাল নেমে এসে ওঁকে খুব মেরেছিল। লোকে তো কত কথাই বলে। অমন একজন মানুষকে একটা গাছ মারবে কেন? হয়তো ঝড়ে গাছের একটা ডাল ভেঙে পড়েছিল মাথায়। যাই হোক, তুমি যে আজ এই সময় এলে? তুমি কি কোনো খবর পেয়েছ?’
বদন হাতজোড় করে বলল, ‘আজ্ঞে না। কীসের খবর?’
লোকটি বলল, ‘আমার মাতৃদেবী আজ চলে যাচ্ছেন। এখন-তখন অবস্থা। কবিরাজ-বদ্যিরা সব জবাব দিয়ে গিয়েছেন। সারাদিন ধরে অজ্ঞান, শুধু শ্বাস আছে একটু-একটু। তোমাকে দেখে ভাবলাম, তুমি বুঝি কোনো ওষুধ এনেছ। এখন তো আর কোনো আশা নেই, যে যা বলছে তাই শুনছি।’
বদন অন্য দিনের মতো কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘আজ্ঞে, আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, ওষুধের কথা কিছুই জানি না।’
বাড়ির সামনের উঠোনে একটা খাটের উপর শুইয়ে রাখা রয়েছে বৃদ্ধাকে। একজন তাঁর মুখে গঙ্গাজল দিচ্ছে। বদন ঘোড়া থেকে নেমে সেই খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। তার মনে পড়ল নিজের মায়ের কথা। চোখে জল এসে গেল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘হে ভগবান, ভালো করে দাও, ভালো করে দাও!’ ফেরার পথে সে রাতে বদন বকুনি দিতে লাগল ছোট্টুকে। ছোটো চাপড় মেরে সে বলল, ‘তুই এটা কী করিস ছোট্টু? শুধু-শুধু আমাকে এক-একজন রুগির বাড়িতে নিয়ে আসিস! মানুষের রোগভোগের কষ্ট দেখতে কী ভালো লাগে? আমারও কষ্ট হয়। আর আমি রাত্তিরে তোকে নিয়ে বেরোব না।’
দু-দিন বাদে একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। ঘোড়া ছুটিয়ে একজন এল বদনের বাড়িতে। তিনি পুলিশের দারোগা। এ তল্লাটে জমিদার, ম্যাজিস্ট্রেট দারোগারাই তো ঘোড়া হাঁকান। বদনের মতো গরিব লোকের তো ঘোড়া থাকার কথা নয়।
দারোগাসাহেব বদনকে ডেকে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু তাঁর এই ঘোড়াটা তোমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন?’
বদন বলল, ‘আজ্ঞে, সে কথাটা শুধু ভগবান জানেন। ডাক্তারবাবু তো আর কাউকে কিছু বলে যাননি। কেউ যদি অবিশ্বাস করতে চায়, আমি নিরুপায়।’
দারোগা বললেন, ‘তুমি ঘোড়া নিয়ে কী করবে? বিক্রি করে দাও না কেন?’
বদন বলল, ‘আমি বিক্রি করতে পারব না। ডাক্তারবাবুর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি। তবে কেউ যদি জোর করে নিয়ে যেতে চায়, আমি আর কী করে বাধা দেব? এ ঘোড়া কিন্তু অন্য কারুর কাছে থাকতে চায় না।’
দারোগা বললেন, ‘হুঁ:, বাধা নেই তো দেখছি। শোনো বদন, তুমি যে সে-রাতে জমিদার মুরারি চৌধুরির বাড়িতে গিয়েছিলে, কেউ তোমাকে খবর দিয়েছিল?’
বদন বলল, ‘আমি সামান্য মানুষ, আমায় কে খবর দেবে? কেনই-বা খবর দেবে?’
দারোগা বললেন, ‘ভরত ডাক্তারকে যে-ই কল দিত, রাতবিরেত হলেও তিনি ঠিক যেতেন। তুমি গিয়েছিলে কেন?’
বদন বলল, ‘তাও জানি না হুজুর। ঘোড়াটাই আমাকে ওখানে নিয়ে গেল।’
দারোগা ঘোড়াটার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললেন, ‘এর মধ্যে এক তাজ্জব ব্যাপার ঘটেছে। ও-বাড়ির বুড়ি মায়ের তো সেদিন মরণ একেবারে ঘনিয়ে এসেছিল। কবিরাজি চিকিৎসায় কোনো কাজ হয়নি। দু-একজন বলেছিল, ভরত ডাক্তার বেঁচে থাকলে হয়তো কিছু একটা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো আর নেই। এর কিছু পরেই ভরত ডাক্তারের ঘোড়া নিয়ে তুমি উপস্থিত হলে সেখানে। তারপর দু-ঘণ্টা যেতে না-যেতে বুড়ি চোখ মেললেন। আজ তো তিনি স্নান করতে গেলেন পুকুরঘাটে। একেবারে সুস্থ। তোমাদের দেখেই নাকি এমনটা হয়েছে। নইলে তো কোনো ক্রমেই বাঁচার কথা নয়। সেইজন্য জমিদারবাবু তোমাকে আর ওই ঘোড়াকে পঞ্চাশটা টাকা উপহার পাঠিয়েছেন।’
বদন চক্ষু চড়কগাছে তুলে বলল, ‘পঞ্চাশ টাকা? সে তো আমি কখনো একসঙ্গে দেখিনি।’
শুধু তাই নয়, এরপর জানা গেল, আর যে দুটো বাড়িতে ছোট্টু নিয়ে গিয়েছিল বদনকে, সে দু-বাড়ির রতন আর মায়ারানিও সেরে উঠেছে একেবারে। তারাও কিছু টাকা পাঠাল।
চারিদিকে রটে গেল ভরত ডাক্তার বেঁচে না-থাকলেও এখনও তিনি চিকিৎসা চালাচ্ছেন। অনেক বাড়ি থেকে এখন বদন আর ছোট্টুর ডাক পড়ে। ইচ্ছে থাক বা না-থাক, বদনকে যেতেই হয়। সে ওষুধ দেয় না, শুধু প্রার্থনা করে। তাতেই অনেক রুগি সেরে ওঠে। যে কয়েকজন সারছে না, তাদের বাড়ির লোক ধরে নেয়, তাদের আয়ু একেবারে ফুরিয়ে গিয়েছে। আয়ু না-থাকলে ডাক্তার কী করবে!
ওইসব বাড়ি থেকেই বদন এখন এক টাকা দু-টাকা কিংবা লাউ-কুমড়ো, কিংবা ছোট্টুর জন্য ঘাসের বস্তা পায়।
ভরত ডাক্তার বদনকে যে কথা দিয়েছিলেন, সে-কথা রেখেছেন।