ভয়
কতরকমের ভয় আছে এই দুনিয়ায়! ছেলেবেলায় ছুটির দিনে, মা বলতেন, ‘খুব সাবধান, আজ বাড়িতে বাবা আছেন। বেশি বাঁদরামো করে মোরো না।’ বাবার ভয়ে আমরা সিঁটিয়ে থাকতুম! খোকা, বলে ভারী গলায় একবার ডাকলেই হল। বাড়ির কাজের লোক মণিদা অমনি বলতেন, ‘যাও, এইবার দাওয়াইটা নিয়ে এসো। তখন থেকে বলছি কাঁসার বাটিতে পেনসিল দিয়ে জলতরঙ্গ বাজিও না।’ আমি হয়তো মুড়ি খাবার পর খালি বাটিতে পেনসিল দিয়ে টুংটাং বাজনা বাজাচ্ছিলুম।
স্কুলে বেনচে বসে আছি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে। পণ্ডিতমশাইয়ের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছি না। চোখাচোখি হলেই বিপদ। ‘ওঠো। বলো, ‘লতা’ শব্দের ষষ্ঠীর বহুবচনে কী হয়?’ পা কাঁপছে। পেট গুড়গুড়। ‘নাও, উঠে পড়ো। বেংচির ওপর ওঠো মানিক। দামড়া আমার । কনক চাঁপা। দু-কান ধরে জিভ বের করে দাঁড়াও। সবাই দেখুক। অ্যাঁ, চুলে আবার টেরি ফেরানো হয়েছে।’ স্কুলজীবনটা কেটে গেল, পড়া দেওয়ার ভয়ে। পরীক্ষার ভয় তো ছিলই। সবচেয়ে বড় ভয় ছিল রেজাল্ট বেরোবার। আজ রেজাল্ট বেরোবে। যেন বলির পাঁঠা চলেছে স্কুলের দিকে। যারা পাশ করেছে, তাদের নাম ডাকা হচ্ছে এক-এক করে। সে এক মুহূর্ত। অনেকটা রেললাইনে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকার মতো। পাশফেলের রেলগাড়ি আসছে। এই বুঝি কাটা পড়ল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় গেজেটে রোলনম্বর খোঁজা। একজন খুঁজছে, পাঁচজন গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রোল ক্যাল। রোল ক্যাল। এই হয়ে চলেছে। পরীক্ষা দেওয়া নয় তো যেন খুন করে সেসানস কোর্টে আসা! জজসাহেব রায় পড়ছেন। বলবেন, ‘যাও মুক্তি। এ জীবনের মতো এই ল্যাঠা চুকল।’ না হয় বলবেন, ‘বৎস’ আরও এক বছর ঘানি ঘোরাও।’
পরীক্ষার পর চাকরির ইন্টারভিউ। হল কী হল না। লিস্টে নাম আছে, না নেই। শেষে দেখা গেল নাম আছে প্যানেলে। সেটা কী? মানুষের মতো প্যানেলেরও বাঁচা মরা আছে। কোথাও প্যানেলের পরমায়ু ছ’মাস, কোথাও একবছর। মাস যাচ্ছে আর ভয় বাড়ছে। নিজের মৃত্যুভয় নয়, প্যানেলের পরমায়ু কমে আসছে। এই বুঝি কফিনে পুরে প্যানেলে ‘নেল’ মেরে দিলে।
যেকোনও লিস্ট বা তালিকাই ভয়ের। সবচেয়ে মারাত্মক হল ‘ওয়েটিং লিস্ট’। ট্রেনের রিজার্ভসানে নাম আছে ওয়েটিং লিস্টে মুখটি চুন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো। এই ‘ওয়েট আর সেই ‘ওয়েট’-এ বিশেষ তফাত নেই। প্রিয়জন শুয়ে আছে ‘ইন্টেনসিভ কেয়ারে’, বাহাত্তর ঘণ্টা না গেলে কিছু বলা যাবে না।
ছাত্রজীবনের পর কর্ম-জীবন, সংসার-জীবন, সে তো হল গিয়ে ভয়ের আখড়া। কিছু চাকরি আছে—যেমন, রেলের চাকরি, পুলিশের চাকরি। কোথায় কখন বদলি করে দেয়। সব সময় ভয়ে-ভয়ে থাকা। আজ এখানে, কাল ওখানে। বদলির ভয় ছাড়াও চাকরির আর-এক ভয় পচে মরার। একই পোস্টে পড়ে থাকো তদবিরের অভাবে। পাশ দিয়ে সব বেরিয়ে যাচ্ছে প্রাোমোশানের মেল-ট্রেনে। তুমি ব্যাটা পড়েই রইলে ল্যাম্পপোস্ট-মার্কা হয়ে। আবার যাঁরা হুহু করে উঠলেন, তাঁদের ভয়, ম্যানেজমেন্ট এই বুঝি ফেলে দিলে। একটা কথা আছে—শান্টিং। লাইন থেকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলে পাশের ইয়ার্ডে। নাও, এইবার ওইখানে বসে ন্যাজ নাড়ো। কাজ নেই, মাইনে আছে! পরিবার-পরিজন কেউ জানল না। বাবু রোজ দুর্গা বলে বেরোন। অফিসে এসে বসে থাকেন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে। আবার দেড়টার সময় টিফিন বাকস খুলে টিফিনও খান। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে বলেন, ‘টু টায়ার্ড!’ কিছু সরকারি পদ আছে, যেখানে আজীবন লড়াই করে থাকতে হয়, পাহাড়ে পাথরের খাঁজ ধরে ঝুলে থাকার মতো। একজনকে প্রমোশান দেওয়া হল, আর একজন গিয়ে কোর্টে একটা কেস ঠুকে দিয়ে এলেন। ইনি যতদিন বাঁচলেন মামলা চালালেন আর উনি যতদিন চাকরি করলেন, ভয়েই রইলেন। পরের সোনা দিও না কানে। কান যাবে তোমার হ্যাঁচকা টানে। দীর্ঘস্থায়ী ভয়কে বলে টেনশান। ভূতের ভয়-বাঘের ভয় রোজ আসে না। নিত্য যা আসে, যার মুখোমুখি হতে হয়, তা হল টেনশান।
কিন্তু ভয় একান্তই ব্যক্তিগত; যেমন দূরে কোথাও যাওয়ার নাম হলেই অনেকে ঘনঘন বাথরুমে ছোটেন। যদি পথে কোথাও পেট শমন জারি করে দেয়, সেই ভয়েই অস্থির। কারুর আছে জলাতঙ্ক। বাইরের জল খেলেই জন্ডিস, অ্যামিবায়োসিস, জিয়ার্ডিয়াসিস। সকলকেই তাঁদের উপদেশ, খবরদার! জল ছোঁবে না, স্রেফ চা খেয়ে যাও। আমার এক পরিচিতা মহিলার সঙ্গে একটা কাজে ভুবনেশ্বরে যেতে হয়েছিল। হাওড়ায় আমরা ট্রেনে উঠলুম। আমাদের পেছন-পেছন উঠল একটা প্যাকিং কেস। প্যাকিং কেসে পরপর সাজানো সোডার বোতল। ট্রেনের জল খাওয়া চলবে না। তেষ্টা পেলেই সোডা খাও, সঙ্গে অ্যান্টি অ্যামিবিক ট্যাবলেট। সকালে যখন ভুবনেশ্বরে নামলুম, তখন মনে হচ্ছিল আমার হেপাটাইটিস হয়ে গেছে।
কিছু ভয় আছে, ব্যক্তিগত নয়। সকলের, যেমন বাজেটাতঙ্ক। বাজেট এলেই ভয় হয়, কোন-কোন মাল বাজার থেকে উধাও হয়ে দশগুণ দাম নিয়ে ফিরে আসবে। ইলেকট্রিক বিল আর এক ভয়। এমাসে এক অঙ্ক, ওমাসে আর এক অঙ্ক। বিল নয় তো ব্যাং। কখন কতটা লাফ মারবে, কেউ জানে না। ইনকাম ট্যাকস আর এক ভয়। ইনকাম ট্যাকসের চিঠি এসেছে শুনলেই অনেক বড়মানুষের কণ্ঠতালু শুকিয়ে যায়। পালস-রেট কমে আসে।
প্রায় ছ’টা মাস কলকাতার মানুষ মেঘাতঙ্কে ভোগেন। প্রতিদিনই তিনটে নাগাদ আকাশে মেঘ জমে। ক্রমশই কালো হচ্ছে। আরও কালো। দফতরে দফতরে কর্মীরা অধীর হচ্ছেন। এই বুঝি নামল। নামলেই সব অচল। বাড়ি-ফেরা যেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরা।
বউকে ভয় পান না, এমন মানুষ খুব কমই আছেন। সেই গল্প। সমবেত প্রজাদের রাজা বললেন, ‘তোমরা যারা বউকে ভয় পাও, তারা একধারে হয়ে যাও। আর যারা পাও না, তারা একধারে। তা দেখা গেল, বউকে ভয় না পাওয়ার দিকে একজন মাত্র দাঁড়িয়ে। রাজা অবাক, পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে, যে বউকে ভয় পায় না। ডাকে লোকটিকে। গলায় বরমাল্য দেওয়া হবে। লোকটি কাঁদো-কাঁদো মুখে কবুল করলে, ‘মহারাজ, বউকে ভীষণ ভয় পাই বলেই একা দাঁড়িয়ে আছি। আমার বউ বলেছিল, যেদিকে বেশি লোক, সেদিকে খবরদার যাবে না।’
আরশোলার ভয়ে পালাতে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়া। চুরির ভয়ে সারা রাত জেগে থাকা। শেষ পযর্ন্ত ট্রেন ধরতে পারব কিনা, এই ভয়ে স্ট্রোক হয়ে যাওয়া, শীত চলে গেল, চিকেন পকস হবে কিনা, গলায় ব্যথা হলে ক্যানসার হল কিনা—এই সব ভাবতে-ভাবতে, ভয় পেতে-পেতে মহাভয়, রিটায়ারমেন্ট। সামনের মাসে বসে যাব ভাই, তারপর কী হবে।
সব ভয়ের শ্রেষ্ঠ ভয়—বল হরি। কে, কে গেল? নগেন? আমার চেয়ে চার বছরের ছোট ছিল যে। বল হরি! কে যায়? শৈলেন। আমার সহপাঠী ছিল যে! এক-এক জন পরিচিত যায় আর বুকের ভেতর একটা করে ঘণ্টা বাজে—ডং। মনে পড়ে যায়, ছেলেবেলার স্কুলের ছুটির ঘণ্টা। ঢংঢং, হোহো করে বেরিয়ে আসছে একদল ছেলে। সেই ঘণ্টা ছিল দিনের ছুটির আনন্দের ঘণ্টা। আর এ ঘণ্টা হল জীবনের খাতা বন্ধ করার ঘণ্টা। খাতার ওপর একটি মোটা লেনসের চশমা। একটি বহু ব্যবহৃত কলম। দোয়াতে তলানি একটু কালি।