ভয়
তোমাকে তো আমি বললাম, আমার খুব দরকারি একটা কাজ ছিল! আর থাকতে পারব না। সেইজন্যই হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে চলে এলাম। আসলে কিন্তু আমার কোনো কাজই ছিল না। দ্যাখো না, তোমার কাছ থেকে ফিরে এসেই বাড়িতে এখন তোমাকে এই চিঠি লিখতে বসেছি।
কেন যে চলে এলাম! আসল কারণটা বলব? রাগ করবে না? আসলে আমার ভয় করছিল।
এই পর্যন্ত পড়েই শান্তনু এমন রেগে গেল যে চিঠিটা দলা পাকিয়ে ছুড়ে ফেলল মাটিতে।
সব সময় খালি ভয় আর ভয়। এই ভয়ের জ্বালায় আর পারা যাবে না। ওরা কি চুরি ডাকাতি কিংবা মানুষ খুন করেছে যে সব সময় ভয় পেতে হবে?
যেদিনকার কথা লিখেছে স্নিগ্ধা, সেদিন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। সকাল এগারোটার সময়। সেই সময় চেনাশুনো অন্য কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার কোনোই সম্ভাবনা ছিল না। অফিস পালিয়ে আসতে হয়েছিল শান্তনুকে। অফিসেরই কাজ নিয়ে ডালহৌসিতে যাবার বদলে চলে এসেছিল আলিপুরে।
কলকাতা শহরের যে-কোনো জায়গায় দেখা করতেই ভয় পায় স্নিগ্ধা। সারা কলকাতাতেই নাকি ওর আত্মীয়স্বজন ছড়ানো। সেইসব আত্মীয়রা ধারালো চোখ নিয়ে সব সময় পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্নিগ্ধাকে দেখে ফেলার জন্য।
স্নিগ্ধার বাড়িতে ফোন করার উপায় নেই, চিঠি লেখার উপায় নেই। বাইরে দেখা করতে গেলে তো প্রায় একটা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করতে হয়।
স্নিগ্ধা চিঠি লেখে। প্রত্যেক চিঠিতেই সে আকুতি জানায়, কখন শান্তনুকে দেখবে। শান্তনুকে সে প্রত্যেকদিন দেখতে চায়, অথচ দেখা করতেও ভয়। এ তো মহা মুশকিল।
একসঙ্গে সিনেমায় যাওয়ার উপায় নেই। কোনো প্রকাশ্য জায়গায় পাশাপাশি বেড়াবার তো প্রশ্নই ওঠে না। একটা মাত্র জায়গা আছে, মিউজিয়াম, যেখানে কলকাতার বাঙালিরা সাধারণত যায় না। কিন্তু সেখানেও যাওয়া চলে না বারবার, স্নিগ্ধার ধারণা, দারোয়ান, চাপরাশিরা তাকে চিনে ফেলেছে। চিনে ফেললেই যে কী বিপদ, তা বোঝে না শান্তনু। চিনুক না। তারা তো মিউজিয়ামে কিছু চুরি করতে যাচ্ছে না।
আর একটা জায়গা হচ্ছে, ন্যাশনাল লাইব্রেরি। এখানে স্নিগ্ধাকে মাঝে মাঝে বই নিতে আসতে হয়। বাড়ির অনুমতি আছে। তাও স্নিগ্ধা আসবে সকালের দিকে। বিকেলে বা সন্ধেবেলা এখানে অনেক ভিড় হয়ে যায়, তাদের মধ্যে চেনাশুনো কেউ কেউ তো থাকতেই পারে। অফিসের দিনে সকাল সকাল আসতে গেলে শান্তনুকে যে কী অসুবিধেয় পড়তে হয়, তা সে শুধু নিজেই জানে, স্নিগ্ধাকে বলেনি কখনও।
শান্তনু এটাই শুধু বুঝতে পারে না, কেউ দেখে ফেললেই বা ভয়ের কী আছে? সে স্নিগ্ধাকে ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করার জন্য বদ্ধপরিকর। স্নিগ্ধাও অন্য কারুকে বিয়ে করবে না, বাড়ির যদি খুব অমত থাকে, স্নিগ্ধা বাড়ি থেকে চলে আসতেও রাজি।
অবশ্য স্নিগ্ধার বাড়ি থেকে আপত্তি করার বিশেষ কোনো কারণও নেই। শান্তনু পড়াশুনোয় ভালো ছিল, এখন মোটামুটি ভালোই চাকরি করে। পরিচ্ছন্ন সচ্ছল পরিবারের ছেলে। স্নিগ্ধাদের বাড়িতে জাত-বিচারের বাড়াবাড়ি নেই, স্নিগ্ধার জ্যাঠতুতো দাদা অসবর্ণ বিয়ে করলেও বাড়ির লোক তাদের ভালোভাবেই মেনে নিয়েছে।
মুশকিল বাধিয়েছেন স্নিগ্ধার বাবা। ভদ্রলোক বেশ ভালোমানুষ, অর্থনীতির অধ্যাপক, বেশ সুরসিক। কিন্তু তিনি হঠাৎ ইরানে ভিজিটিং প্রফেসারের চাকরি নিয়ে চলে গেছেন এক বছরের জন্য। ওঃ, সেই এক বছরটা কী অসম্ভব লম্বা স্নিগ্ধার বাবাকে এখনও কথাটা জানানোই হয়নি।
স্নিগ্ধা চিঠি লিখে বাবাকে জানাতে চায় না। বাবা ভাববেন, তিনি নেই বলে মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। শান্তনুকে চোখে না দেখে বাবা বুঝবেন কী করে যে কোন রকম ছেলে সে। বাবা ফিরে এলে সে বাবাকে নিজের মুখে বলবে। এই জন্য মাকেও কিছু জানতে দিচ্ছে না। কারণ মা তাহলেই বাবাকে চিঠি লিখবেন। অতদূর ইরান থেকে তো শুধু শুধু হঠাৎ চলে আসা যায় না। বাবা যদি চিঠি পেয়ে চলে আসেন, সেটা খুবই লজ্জার ব্যাপার হবে।
শান্তনু অবশ্য এক বছর অপেক্ষা করতে রাজি আছে। কী আসে যায় এক বছরে। কিন্তু তা বলে কি এই এক বছর মুখ দেখাদেখিও বন্ধ থাকবে? স্নিগ্ধার যুক্তি হচ্ছে, যদি কোনো রকমে কোনো আত্মীয়স্বজন একবারও স্নিগ্ধাকে শান্তনুর সঙ্গে ঘুরতে দেখে, তাহলেই তারা কথাটা মায়ের কানে তুলবে। মা অমনি বাবাকে চিঠি লিখবেন। বাবা অতদূরে বসে দুঃখ পাবেন। বাবাকে যে দারুণ ভালোবাসে স্নিগ্ধা।
শান্তনু ঠাট্টা করে, তোমার আত্মীয়স্বজনদের কি আর খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই যে তোমার পাশে কোনো ছেলেকে হাঁটতে দেখলেই অমনি তোমার মায়ের কাছে নালিশ করতে যাবেন?
স্নিগ্ধা বলে, নালিশ নয়, এমনি যদি কথায় কথায় বলে দেয় কেউ—
বলুক না। তোমার মাকে তুমি বুঝিয়ে বলবে।
আমার লজ্জা করে।
লজ্জা আর ভয়। এই দুটো জিনিসই যেন ভালোবাসার প্রধান শত্রু। সব সময় দুজনে তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে একটু দেখা করার জন্য, কাছাকাছি বসে একটু কথা বলার জন্য— আর কেউ এতে বাধা দিচ্ছেও না। যত বাধা এই লজ্জা আর ভয়।
সেদিন অত কষ্ট করে শান্তনু গেল ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে। ভেতরে কথা বলার সুযোগ নেই, তাই ওরা এসে দাঁড়িয়েছিল বাইরে একটা গাছের নীচে। পাতলা রোদ সবুজ ঘাসে মোলায়েম হয়ে ছড়িয়ে আছে।
স্নিগ্ধার হাতে দুটি বই। একটা শান্তনুকে দিয়ে বলল, এটা তোমার হাতে রাখো।
কেন?
তাহলে সবাই ভাববে, তুমিও বই নিতে এসেছ লাইব্রেরিতে।
শান্তনু হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, এখানে সবাইটা কোথায়? কেউ তো নেই। আমাদের শুধু দেখছে ওই বড়ো বড়ো গাছগুলো।
স্নিগ্ধা বলল, আস্তে আস্তে তো লোকজন আসবে।
শান্তনু বলল, চলো, ঘাসের ওপর গিয়ে বসি।
স্নিগ্ধা একটুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, না।
কেন, এতে আবার কী অসুবিধে?
এখানে দাঁড়িয়ে থাকতেই তো ভালো লাগছে।
স্নিগ্ধা কারণটা না বললেও শান্তনু বুঝল। ঘাসের ওপর বসলে দৃশ্যটা অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। এমনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনে কথা বললে, কেউ দেখে ফেললেও মনে করবে, দুজন ছাত্রছাত্রী বুঝি পড়াশুনোর বিষয় নিয়ে আলোচনা করছে।
একটা উজ্জ্বল লাল রঙের সোয়েটার পরে ছিল স্নিগ্ধা। মাথার চুল এক বেণী করে বাঁধা। নামের সঙ্গে তার মুখটার খুব মিল আছে। চোখ দুটোর দিকে তাকালেই কী রকম যেন ঠান্ডা লাগে। মুখে সব সময় একটা লজ্জা ভাব।
একটু বাদেই স্নিগ্ধা বলল, তুমি এবার যাবে না?
শান্তনু অবাক হয়ে বলল, চলে যাব? এক্ষুনি? কেন?
বাঃ, তোমার অফিস নেই?
সে আমি ঠিক ম্যানেজ করব।
না, না, অফিসে যদি তোমার নামে কেউ কিছু বলে, তাহলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
কে কী বলবে? আমি তো একটা কাজেই বেরিয়েছি, কাজটা ঠিকই সেরে ফিরব।
কাজটার জন্য এক ঘন্টার বেশি দেরিও তো হতে পারে।
স্নিগ্ধা ঠিক যেন মানলো না। তার চোখ দুটি চঞ্চল হয়ে রইল। ঘাসে বসা হল না বলে শান্তনু প্রস্তাব করল একটু হেঁটে বেড়াতে। স্নিগ্ধা তাতেও রাজি হতে চায় না। অনেক পেড়াপীড়িতে সে এক পাক মাত্র ঘুরতে রাজি হল।
একবার স্নিগ্ধার কাঁধে হাত রাখার জন্য শান্তনুর বুকের মধ্যে আকুলিবিকুলি করে। কিন্তু তার উপায় নেই। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে স্নিগ্ধার শরীরের সুন্দর গন্ধটা উপভোগ করে শান্তনু। সবচেয়ে কি স্বাভাবিক ছিল না, স্নিগ্ধাকে এখন একবার জড়িয়ে ধরা? এখানে, প্রকাশ্যে, আকাশের নীচে তাকে একবার চুমু খাওয়া? কিন্তু সে তো কল্পনাই করা যায় না।
শান্তনু খপ করে স্নিগ্ধার একটা হাত চেপে ধরল।
স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে ছাড়িয়ে নিল হাতটা। চোরা চোখে তাকে একবার বকুনি দিল। তারপর যেখান থেকে হাঁটতে শুরু করেছিল, সেইখানে এসেই স্নিগ্ধা বলল, এবার তুমি যাও।
এ কী, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছ?
বাঃ, তোমার অফিসের কত দেরি হচ্ছে।
হোক।
না। না, আমার ভয় করে।
আবার ভয়! স্নিগ্ধাও হেসে ফেলল এবার। তারপর বলল, আমার মতন একটা বাজে বিচ্ছিরি মেয়েকে নিয়ে তুমি খুব বিপদে পড়েছ, তাই না?
শান্তনু বলল, খুব। দারুণ বিপদ ওই দ্যাখো। ওই একজন আত্মীয় আসছে তোমার।
কোথাও একজনও মানুষ দেখা যায় না। শুধু বড়োবড়ো গাছপালা ওদের দর্শক।
শান্তনু জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, শোনো, আমরা যদি ওইখানে সরে গিয়ে ওই রাধাচূড়া গাছটার কাছে গিয়ে দাঁড়াই, তাতে তোমার আপত্তি আছে?
কেন, ওখানে কী আছে?
কিছুই না। ওখানে দাঁড়ালে আমাদের সহজে দেখা যাবে না।
ওখান দিয়ে লোকজন হাঁটে না বুঝি?
ঠিক আছে। আমি কথা দিচ্ছি, যদি একটি লোককেও ওখানে আসতে দেখি, এক্ষুনি আমরা চলে আসবো। লোক না-আসা পর্যন্ত আমরা ওখানে দাঁড়াবো। রাজি?
স্নিগ্ধাকে রাজি হতেই হল। জায়গাটা সত্যি নির্জন। তবু এই নির্জনতার মধ্যেও শান্তনু স্নিগ্ধার কাঁধে হাত রাখলো না। চুমু খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু একটু বেশি ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য, এক একবার কাঁধে কাঁধ ছুঁয়ে যায়, শান্তনু সিগারেট মুখে দিলে স্নিগ্ধা দেশলাই জ্বেলে দেয়। এইটুকুতেই অনেকখানি পাওয়া।
স্নিগ্ধা এক সময় বলল, বাঃ, লোক না এলেও বুঝি আমরা এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকবো?
আমি এখানে সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। তুমি পারো না?
শুধু শুধু দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে?
আমার তো শুধু তোমাকে দেখতেই ভালো লাগে।
আমার ভয় করে।
আবার ভয়? এখানেও ভয়?
স্নিগ্ধার চোখ দুটি আরও বেশি চঞ্চল। সে সুস্থির হতে পারলে না কিছুতেই। এবার অনুনয় করে বলল, শোনো লক্ষ্মীটি, আমার একটা দারুণ কাজ আছে, আমাকে বারোটার মধ্যে ফিরতেই হবে।
বারোটার মধ্যে? তাহলে তো এক্ষুনি যেতে হয়।
হ্যাঁ, বই দুটো বদলেই—
মোটে এইটুকু সময়ের জন্য আমি এলাম?
লক্ষ্মীটি রাগ করো না, আর একদিন…
কী কাজ তোমার?
বিশ্বাস করছো না? মাকে বলে এসেছি, আমাকে এক জায়গায় যেতে হবে…
স্নিগ্ধাকে আর আটকানো যায়নি কিছুতেই। শান্তনু খানিকটা ক্ষুণ্ণ মনেই ফিরে এসেছিল। অন্য কেউ হলে হয়তো সন্দেহ করত, স্নিগ্ধা বুঝি শান্তনুকে তেমন ভালোবাসে না। সে বুঝি শান্তনুর কাছে মিথ্যে কথা বলে অন্য কারুর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। কিন্তু স্নিগ্ধা সম্পর্কে সেরকম সন্দেহ কিছুতেই করা যায় না। কারুকে ঠকাবার কোনো ক্ষমতাই নেই স্নিগ্ধার।
মেঝে থেকে শান্তনু স্নিগ্ধার দলা পাকানো চিঠিটা আবার তুলে নিল। পড়তে লাগল পরের অংশটুকু।
রাগ করবে না? আসলে আমার ভয় করছিল। কীসের ভয় জানো? কারুর দেখে ফেলার ভয় নয়। ভয় করছিল নিজেকেই। আমার মনে হচ্ছিল, বেশিক্ষণ থাকলে, আমাকে যদি তোমার আর দেখতে ভালো না লাগে? আমি তো সুন্দরী নই। তুমি কত সুন্দর। তোমার সামনে আমাকে কেমন যেন…আমি বেশি সাজতেও পারি না, আমার ভয় হয়, যদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তুমি হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে নাও। আমার চিবুকটা বিচ্ছিরি, তাই না?
শান্তনু আবার অবাক হল। এ আবার কী রকম ভয়? স্নিগ্ধাকে তার দেখতে খারাপ লাগবে? যাকে দেখার জন্য সে সব সময় ছটফট করে, হঠাৎ কোথাও আচমকা দেখা হয়ে গেলে সে নোবেল পুরস্কার পেয়ে যায়, সেই স্নিগ্ধাকে দেখতে তার খারাপ লাগবে? স্নিগ্ধার মতন সুন্দরী আর কে আছে? ওর চিবুকে একটা ছোট্ট কাটা দাগ, সেই জন্যই মুখটা আরও মিষ্টি দেখায়, ইচ্ছে করে ওই কাটা জায়গাটায় চুপুস করে একটা চুমু খেতে। এই জন্য স্নিগ্ধা এত তাড়াতাড়ি চলে গেল! কোনো মানে হয়।
পরে কোথায় আবার দেখা হবে, সে সম্পর্কে স্নিগ্ধা কিছু লেখেনি। তার মানে এখন দু-তিন দিন আর স্নিগ্ধা বাড়ি থেকে বেরুবে না। স্নিগ্ধার অন্য ভাইবোনরা ছোটো ছোটো। বাবা এখানে নেই বলে স্নিগ্ধাই যেন এখন বাড়ির অভিভাবক। ওর মতন নরম মেয়েকে কি ভাইবোনরা মানে একটুও? বাবা এখন এখানে নেই বলেই, সেই সুযোগে স্নিগ্ধা এখন প্রেম করে বেড়াচ্ছে—এই অপবাদটাকেই স্নিগ্ধার বেশি ভয়।
এদিকে অফিসের কাজে তিনদিন পর আবার শান্তনুকে পাটনা যেতে হবে। তার মানে এর মধ্যে আর স্নিগ্ধার সঙ্গে দেখা হবে না? পাটনা থেকে ফিরতে ফিরতেও তো তিন-চার দিন লাগবে। পাটনা যাওয়ার কথাটা স্নিগ্ধাকে জানাবেই-বা কী করে?
স্নিগ্ধা চিঠি লেখে কিন্তু শান্তনুর চিঠি লেখার উপায় নেই। টেলিফোন করাও চলবে না। স্নিগ্ধাই কখনো-সখনো বাড়ি একেবারে ফাঁকা থাকলে শান্তনুকে টেলিফোন করে, বাড়িতে কিংবা অফিসে। যদি স্নিগ্ধা সেরকম ফোন করে…
পাটনা থেকে ফিরতে ফিরতে শান্তনুর পাঁচদিন লেগে গেল। ফেরার পথে আর এক ঝামেলা। ট্রেন কলকাতায় এসে পৌঁছোবার কথা ভোরে, কিন্তু ইঞ্জিনে গণ্ডগোল হওয়ায় গাড়ি মাঝ রাস্তায় থেমে রইল ঘন্টার পর ঘন্টা। আগের জংশনে খবর দিয়ে নতুন এঞ্জিন আনতে পাঁচ ঘন্টা কেটে গেল। অতক্ষণ থেমে থাকা ট্রেনে অপেক্ষা করা এক বিরক্তিকর ব্যাপার। তাও মাঠের মধ্যে। কিছুই করার নেই। নেমে পায়চারি করতে গেলেও চড়া রোদ গায়ে বেঁধে। হঠাৎ শীত চলে গিয়ে গরম পড়ে গেছে। প্রথম গ্রীষ্ম দারুণ চিটচিটে হয়। ট্রেনের মধ্যে বসে থাকলেও গরম, বাইরে রোদ্দুরে ঘোরাও অসম্ভব। ঘামে জামা-টামা চিটচিটে হয়ে গেল। মুখে বিরক্তির ভাঁজ।
হাওড়া স্টেশনে পৌঁছেও আর এক ঝামেলা। ট্যাক্সি নেই। অনেক দৌড়োদৌড়ি করেও কোনো ফল হল না। শেষ পর্যন্ত, এক ভদ্রলোকের প্রাইভেট গাড়ি ওকে হাজরা মোড় পর্যন্ত নামিয়ে দিতে রাজি হল।
হাজরায় পৌঁছে, হাতের ছোটো ব্যাগটা নিয়ে শান্তনু গাড়ির ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিয়ে যেই মুখ তুলল, অমনি দেখল এক অপরূপ দৃশ্য।
রাস্তার ওপারে, বাস গুমটির পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। সঙ্গে আত্মীয়স্বজন কেউ নেই। অন্য একটি মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। সেই মেয়েটিও বোধহয় এক্ষুনি চলে যাবে, কেননা, একবার একটুখানি চলে গিয়ে আবার ফিরে এসে কী যেন বলল। স্নিগ্ধার সঙ্গে দেখা করার এমন আকস্মিক সুযোগ পাওয়া যায় না। বুকের মধ্যে থেকে একটা খুশি লাফিয়ে উঠল।
কিন্তু শান্তনু তার চিবুকে হাত বুলোল। দাড়ি কামানো হয়নি, বেশ খোঁচা খোঁচা দাড়ি টের পাওয়া যাচ্ছে। মুখে চটচটে ঘাম। জামাটাও ঘামে জবজবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, ট্রেনে পাজামা পরে ছিল, তার ওপরেই শার্ট পরে নিয়েছে। এই চেহারায় সে স্নিগ্ধার সামনে দাঁড়াবে?
শান্তনু আর দ্বিতীয়বার চিন্তা না করে সামনের চলন্ত মিনিবাসে লাফিয়ে উঠে পড়ল।
বাড়িতে এসেই কিন্তু মন খারাপ হয়ে গেল আবার। এমন দুর্লভ সুযোগ পেয়েও সে স্নিগ্ধার কাছে যেতে পারল না? আজ যা দেরি হয়ে গেছে, অফিসে যাবার কোনো প্রশ্ন নেই—স্নিগ্ধার সঙ্গে দুটো-চারটে কথাও বলতে পারত অন্তত, তবু কেন গেল না? তার লজ্জা করছিল? কিংবা ভয়?
পরদিনই স্নিগ্ধার চিঠি এল।
জানো, কাল তোমাকে দেখলাম। নিজের চোখকে আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। হঠাৎ মনে হল যেন স্বর্গ থেকে দেবতারা আমার জন্য একটা পুরস্কার পাঠালেন। তুমি একটা কালো রঙের গাড়ি থেকে হাজরা মোড়ে নামলে। আমি হাত তুলে তোমাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তোমার বোধ হয় খুব তাড়া ছিল, তুমি একটা মিনিবাসে উঠে পড়লে। তুমি আমায় দেখতে পাওনি, আমি কিন্তু তোমায় দেখে নিয়েছি। আমার ভাগ্যটা কত ভালো বলো তো!
দাড়ি কামাওনি, মুখে নীল নীল দাড়ি, পাজামার ওপরে একটা লাল চেক চেক শার্ট পরেছিলে। তোমাকে কী ইয়াং আর কী সুন্দর দেখাচ্ছিল।