ভয়

ভয়

ছাপাখানাটি খুব ছোট হলেও সারাদিন সেখানে কাজ হত। ছুটি হতে হতে সেই সন্ধে হয়ে যেত। ছাপাখানার পাশে একটা চায়ের দোকান ছিল। কুড়ি পয়সা দিলে এক ভাঁড় গুড়ের চা আর ঝালঝাল আলু-চচ্চড়ি দিয়ে মোটা একটা হাতরুটি পাওয়া যেত। খেয়েই বন্ধু রওনা দিত। দুটো বাড়ি, তারপরেই বন। এসব জায়গায় কোথায় শহর শেষ হয়ে বন শুরু হল বলা মুশকিল। শহর বলতে অবিশ্যি খুবই ছোট শহর। গ্রামও বলা চলে। তবে ছাপাখানায় অনেক বাইরের লোক কাজ করত। তারা ওই গ্রামেই থাকত। গ্রাম বললে চটে যেত, বলত ছোট শহর।

বনের মধ্যে শালগাছই বেশি। মাঝে মাঝে পলাশ, মহুয়া, শিমুল বুনো তাল। দিনের বেলায় চমৎকার। সন্ধে হলেই মুশকিল। ছায়া ছায়া; অদ্ভুত সব শব্দ। গুরু শিষ্য প্যাঁচা ডাকে। বনের নাম ঘনার বাদা। এককালে এখানেই কুখ্যাত ঘনা ডাকাতের আস্তানা ছিল। সে প্রায় একশো বছর আগে। তখন কী দিনে কী রাতে, কেউ পারলে এ বনের ধারে কাছে আসত না।

রাতে এখনো আসে না। দিনে মধু আর আঠা নিতে এলেও, রাতে আসে না। ঘনা নাকি এখনো ডাকাতি ছাড়েনি। অনেকে নাকি দূর থেকে তাকে দেখে অমনি চোঁ চোঁ দৌড় দেয়।

বন্ধুর নাইট স্কুলটা বনের ওপারে। লেখাপড়া শিখতে হলে কষ্ট করতে হয়। বাবার ডান পা কাটা গেছে, পেনশন যা পায় তাতে ওদের চলে না। তাই বন্ধুকে ওদের হাইস্কুল ছেড়ে, এই নাইট স্কুলে পড়তে যেতে হয়। অন্য দিন সঙ্গে লখা থাকে। ওর বন্ধু লখাও ছাপাখানায় কাজ করে। দু’জনে থাকলে ভয় করে না। ঘনা একা, লোক খোঁজে।

তখনো আলো ছিল। হয়তো ছ’টা বেজেছিল। শাল গাছের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছিল। পাখি ডাকছিল। ঝোপেঝাড়ে খুস-খুস খর-খর। বঙ্কু আধ ঘণ্টার মধ্যে বন পার হয়ে, বন বিভাগের আপিসের গায়ে লাগা নাইট স্কুলে পৌঁছে গেল।

বঙ্কুর বয়স চোদ্দ। আর তিন বছরে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে, ছাপাখানার কাজ শেখার স্কুলে ভরতি হবে। পরীক্ষার জন্যেও তৈরি হবে, আবার রোজ পাঁচ ঘণ্টা কাজ করার জন্য মাইনেও পাবে। আরো তিন বছর পরে পাস করে বেরুলে সরকারি কাজ পেয়ে যাবে। মা-বাবা সেই আশাতেই আছেন। ছোট বোন নুটুও বলে, ‘দাদা আমাকে বড় পুতুল কিনে দেবে।’

তাই মন দিয়ে পড়ে বঙ্কু। পড়তে পড়তে ভাবে এরপর আবার বন পার হতে হবে। একা। এক সময়ে ছুটি হয়ে গেল। তখন রাত ন’টা। বঙ্কু আজ একা বনের পথ ধরল। সঙ্গে আলো ছিল না। আলো কোথায় পাবে, টর্চের বড্ড দাম। একটা বটগাছের কোটরে লখা কয়েকটা শুকনো বাঁশের আগা ছেঁচে শুকনো পাতা জড়িয়ে মশাল বানিয়ে, লুকিয়ে রেখেছিল। বঙ্কু সেই একটা বের করে শহরের শেষ পান-বিড়ির দোকান থেকে ধরিয়ে নিল।

জগাদা বলল, “একা যাচ্ছিস নাকি? আজ আবার অমাবস্যা। লখা কোথায়?”

“লখার জ্বর।”

“না হয় আমার এখানে চাট্টি খেয়ে শুয়ে রইলে। সকালে বাড়ি যাস্‌।”

“মা-বাবা ভাববে, জগাদা।”

মশাল ধরিয়ে বন্ধু রওনা হল।

মশালে যেমন আলোও হয়, তেমনি আবার মনে হয় চারদিকে গাছের ছায়াগুলো নড়ছে চড়ছে। বন্ধু পা চালিয়ে এগোতে লাগল। হঠাৎ শুনল ছোট ছেলের কান্না। বঙ্কুর গায়ের রক্ত হিম। ও নিশ্চয় সত্যিকারের ছোট ছেলের কান্না নয়, অন্য কিছুতে ওকে ভোলাবার জন্য ওই রকম শব্দ করছে।

কোনো দিকে না তাকিয়ে আরো খানিকটা এগিয়ে গেল বঙ্কু। ছোট ছেলেটার কান্না থামল না। মাঝে মাঝে চেঁচিয়ে ওঠে, আবার ফোঁপাতে থাকে। নুটু আগে ওই রকম করে কাঁদত।

বঙ্কু মশাল নিয়ে চারদিক খুঁজতে লাগল। জায়গাটা বড্ড ঘুপসি। তার মধ্যে বেদেরা খরগোশ ধরবার ফাঁদ পেতে রেখেছিল। কামড়ানো ফাঁদ। গোটা দুই খরগোশ পড়েছিল আর একটা ছোট ছেলে। কাঠুরেদের ছেলে কি না কে জানে। এ জায়গা ভালো না। এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।

কিন্তু ছেলেটার মুখে আলো পড়তেই, বঙ্কু দেখল তার চোখের কোণে জল জমেছে, ঠোঁট কাঁপছে। হয়তো বছর তিনেক বয়স। বঙ্কু তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। ফাঁদের কাটা কাটা দাঁতগুলো তার একটা পায়ে কামড়ে বসেছিল। সঙ্গে একটা সবুজ ডালেও কামড় পড়েছিল বলে পাটা কেটে পড়ে যায়নি।

হঠাৎ কানের কাছে ফোঁস শব্দ শুনে দেখে কুচকুচে কালো একটা লোক, কপালে কাটার দাগ, লাল লাল চোখ, উঁচু উঁচু দাঁত, বিকট চেহারা। কিন্তু লোকটা নরম গলায় বলল, “টেনে খুলো না, বাপু, পা কাটা যাবে। দাঁতের ফাঁকে ওই পাথরটা গোঁজ।” মশালটা পাথরে ঠেকা দিয়ে, ছোট একটা অসমান ঢিল নিয়ে আস্তে আস্তে ফাঁদের দাঁতের ফাঁকে গুঁজে দিতেই, ফাঁদের হাঁ বড় হল। বঙ্কু ছেলের ঠ্যাংটা টেনে বের করে আনল। ছেলেটা নেতিয়ে পড়ল। বঙ্কুর হাত পা ঠান্ডা।

কালো বিকট লোকটা বলল, “না, না, কিছু হয়নি। ব্যথার চোটে অচৈতন্য হল। ঐ যে তোমার ডান হাতে ছোট ছোট পাতা দেখছ, ঐ খানিকটা পাথরে ঘষে লাগিয়ে দাও। দেখতে দেখতে ঘা সেরে যাবে।”

তাই করল বঙ্কু। লতা দিয়ে জড়িয়ে বেঁধে দিল। তারপর ছেলেটাকে কোলে করে উঠতেই লোকটা বলল, “আমার পাটা কেউ বাঁচায়নি গো, আঙুলগুলো সব কাটা পড়েছিল।” ওর পায়ের দিকে চেয়ে শিউরে উঠল বঙ্কু। ডান পায়ে একটাও আঙুল নেই।

এমন সময় দূরে মশালের আলো দেখা গেল আর ডাক শোনা গেল। নাকু-উ-উ-উ। হারে নাকু-রে-এ-এ! সঙ্গে সঙ্গে বিকট চেহারার লোকটা কোথায় যে সরে পড়ল, তার ঠিক নেই। ছেলেটাকে খুঁজতে এসেছে গাঁয়ের লোকরা। সঙ্গে সঙ্গে এসেও পড়ল। পাগলের মতো চেহারা ওই বোধ হয় ছেলের মা। বন্ধুর কোল থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে, বারবার সে বলতে লাগল, “বাঁচি থাক, সুখী হ, ভগবান তোর ভালো করুক।”

কাঠুরেদের ছেলেটা নাকি ভারি দুরন্ত! কেমন করে দল-ছাড়া হয়ে গেছিল। তারপর হাসতে হাসতে সবাই দল বেঁধে গ্রামে ফিরল। ছেলের বাপ হঠাৎ বলল, “বড় বাঁচিয়েছিস, বাপ, খনার হাতে পড়লে উকে আর দেখতে পেতাম না। খনা বড় ভয়ঙ্কর।”

বন্ধু বলল, “কেমন দেখতে খনা?”

“কী জানি! কাছে গেলে তো নিঘ্যাত মিত্যৃ! শুনেছি কালো কুচকুচে, কপাল কাটা আর ডান পায়ে একটাও আঙুল নেই। বড় ভয়ঙ্কর সে।”

বঙ্কুর বুকটা টিপ টিপ করতে লাগল।

সে বলল, “না, না, খনা বড় ভালো, মোটেই ভয়ঙ্কর নয়।”

এরপর নাকি খনাকে আর কেউ কখনো দেখেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *