ভয়

ভয়

বাবুলাল দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। তিনতলায় ওঠবার সময় স্যার বলে দিয়েছিলেন, কোনও অবস্থাতেই তাঁকে যেন বিরক্ত না করা হয়। কিন্তু উপায় নেই। একটু আগে যে অবস্থা ঘটেছে তাতে বিরক্ত করা ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।

ভারী পরদা সরিয়ে বাবুলাল নিচু গলায় বলল, ‘স্যার, ছেলেটা পেচ্ছাপ করেছে।’

তিনতলার এই ঘরটা কোণের দিকে। বাড়িতে থাকলে সুবিমল এখানেই অফিসের কাজকর্ম করে। এখনও করছে। তার সামনে ফাইল খোলা। প্রতিটা লাইন খুঁটিয়ে দেখছে। কোথায় যেন একটা যোগে ভুল আছে মনে হচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছে না। ছোট ভুল, চট করে চোখে পড়ছে না।

বাবুলাল আবার বলল, ‘স্যার, ছেলেটা পেচ্ছাপ করেছে।’

সুবিমল মুখ তুলল! অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী করেছে?’

‘পেচ্ছাপ স্যার। একেবারে কার্পেটের ওপর করেছে। কার্পেট তো গেছেই, মনে হচ্ছে, ড্রইংরুমের চেয়ার বিলগুলোও নষ্ট হয়েছে।’

সুবিমল ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি কী করল বাবুলাল? তুমি কি বলছ আমি নীচে গিয়ে কার্পেট পরিষ্কার করব’?

মনিবের কথায় বাবুলালের স্বর তার ও গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘ছেলেটা বড় জ্বালাচ্ছে স্যার। একটু আগে ফুলদানিটা ভেঙেছে। এখন ঘরের মধ্যে পেচ্ছাপ করল। ধমক দিলে বোঝে না, হাসে, খুবই জ্বালাতনের ব্যাপার স্যার।’

সুবিমলের ইচ্ছে করল বাবুলালকে জোর একটি ধমক লাগায়। এত জোৱ যে গোটা বাড়ির সকলে সেই ধমক শুনাতে পারে। কিন্তু সে তা করবে না। আজ তাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। কাল ভোরের ফ্লাইট সে মুম্বই যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা পৌঁছে যাবে হোটেলে। সেখানে মিটিং। সেই মিটিংয়ে ঠিক হবে অর্ডারটা সে পাচ্ছে কি না। খুব বড় অর্ডার। অনেক টাকার কাজ। এত টাকার কাজ সে আগে কখনও পায়নি। মনের মধ্যে চাপা একটা ভয় কখনও মনে হচ্ছে কাজটা পাবে, কখনও মনে হচ্ছে পাবে না। যে-কোম্পানি অর্ডার দেবে, তাদের লোক সিঙ্গাপুরের হেড অফিস থেকে সকালেই মুম্বইতে পৌঁছে গেছে। শেষরাতে ফুলের বোকে হাতে তালুকদার এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে মুম্বইতে পাঠানো হয়েছে, দুদিন আগে। ম্যানেজার হিসেবে তালকুদার খুবই দক্ষ। এখন পর্যন্ত কোনও ভুল নেই। ঘন্টায় ঘন্টায় টেলিফোনে সব জানাচ্ছে। তাকে সে রকমই বলা আছে। ভাল -মন্দ, কোনও খবরই সে যেন বাদ না দেয়।

তালুকদার শেষ ফোনটা করে সন্ধেবেলা। সুবিমল তখন অফিস থেকে বেরোচ্ছে।

‘গুড ইভনিং। এভরিথিং ওকে স্যার।’

‘ওরা কী করছে?’

‘দু’জনে জুহু বিচে ঘুরছে স্যার। আমি পেছনে পেছনে আছি। ফুচকা দেখে খেতে চাইছে। খাওয়ানো ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। শরীরটরির যদি খারাপ হয়।

‘দু’জন কেন তালুরদার? আর একজনের কী হল? কোনও সমস্যা?

‘তেমন কিছু নয়, মনে হল অল্প সদি লেগেছে, লোকটা ফোত ফোত করছে। আমি হোটেলে বলে রেখেছি, দরকার হলে ভাক্তার দেখিয়ে দেব।’

‘দরকার হওয়ার আগেই দেখিয়ে নেবে। সর্দি-কাশি ভাল জিনিস নয়। মেজাজ বিগড়ে যায়। মনে রেখো তালুকদার, কালকের আগে কোনও অবস্থাতেই ওদের মেজাজ বিগড়ানো চলবে না। রাতের অ্যারেঞ্জমেন্টের কী অবস্থা?

তালুকদার গলা নামিয়ে বলল, ‘ভাল অবস্থা। স্যার। একেবারে অলরাইট। পেমেন্ট করা আছে। ইন ফ্যাক্ট একটু পর থেকেই মেয়েগুলো হোটেলের রিসেপশনে ওয়েট করবে স্যার। বে। স্যার, আমি চার জনের ব্যবস্থা করেছি। একজন একস্ট্রা থাকা ভাল। আমি সিগন্যাল দিলেই ওরা লোকগুলোর ঘরে চলে যাবে। রুম নম্বরও এদের দেওয়া হয়ে গেছে। কথাটা ঠারেঠোরে লোকগুলোকে জানালাম। মনে হল ইনটারেস্টেড।’

‘কেন মনে হল?’

তালুকদার লজ্জা লজ্জা গলায় বলল, ‘একজন জিজ্ঞেস করল, ইন্ডিয়ান তো। আমি বললাম, ইয়েস, ভেরি মাচ ইন্ডিন।

‘গুড। তালুকদার, মুখ দেখে কী মনে হচ্ছে? ওরা খুশি?’

‘এটাই মুশকিল! মুখ দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। থ্যাবড়া চোখ মুখ তো, মনে হহে, সবসময়ই হাসছে। কনফিউশিং।

‘কনফিউশনের কোনও জায়গা রেখো না। খুশি রাখতেই হবে। শোনো, আমি এখন বাড়ি ফিরছি। অফিসে থাকলেই হাজার ঝামেলা। বাড়িতে বসে ঠান্ডা মাথায় কাগজগুলোতে চোক বুলিয়ে নেব। দরকারমতো ফোন করবে। চিন্তায় থাকব। মনে করে সর্দির অবস্থাটা জানাবে।’

বাড়ি ফিরে ঘটনা শুনল সুবিমল।

তন্দ্রা নেই। রোজকার মতো আজও বিকেলে সে পার্টিতে বেরিয়ে গেছে। থাকলে অবশ্য কোনও লাভ হত না। গত এক বছর দু’জনের মধ্যে কথাবার্তা প্রায় নেই বললেই চলে। যে যার নিজের মতো থাকে। কাজের লোক, দারোয়ান, রাঁধুনি তাকে ছেঁড়া ছেঁড়া ভাবে ঘটনাটা বলেছে। এরা যথেষ্ট ঘাবড়ে গেছে। ঘাবড়ে যাওয়ার মতোই বিষয়। কিন্তু এই মুহূর্তে কালকের মিটিং ছাড়া অন্য কিছুতে সুবিমল মন দিতে চায় না। তাতে ক্ষতিটা অনেক বড় হবে। সে বাবুলালের দিকে তাকাল। যতটা সম্ভব গলা স্বাভাবিক করে বলল, ’ছেলেটাকে তোমরা ঘাড় ধরে বের করে দিতে পারছ না? বাড়িতে এতগুলো লোক! চার-পাঁচ বছরের একটা অচেনা অজানা বাচ্চা ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে আর কতজনকে চাই। মিলিটারি ডাকব? থ্রো হিম আউট। যাও, রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে এসো।’

বাবুলাল চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে সুবিমল চেয়ারে হেলান দিল। না, সমস্যাটা পাকছে। চোখ বুজে গোটা ঘটনাটা দেখবার চেষ্টা করল সে। যার কাছ থেকে যতটা শুনেছে, সবটা জুড়ে যদি একটা পুরো চেহারা পাওয়া যায়।

তখন দুপুর সবে শেষ হব হব করছে। গেটের পাশে টুলে বসে বৈদ্যনাথ ঝিমোচ্ছিল। একটা ট্যাক্সি এসে নিঃশব্দে দাঁড়াল। ট্যাক্সি থেকে একটা মেয়ে নেমে এল। বছর বাইশ-তেইশ বয়স। আর একটু বেশিও হতে পারে। একেবারেই সাদামাটা দেখতে৷ মনে রাখার মতো কিছু নয়। গায়ের রং সামান্য কালোর দিকে। নীল রঙের শাড়ি। বিনুনি করা। তবে সিঁথিতে বেশি করে সিঁদুর দেওয়া। মেয়েটার সঙ্গে একটা ছোট ছেলেও নামল। বয়স বড়জোর চার-পাঁচ। বাচ্চাটা হাসছে। মেয়েটা বৈদ্যনাথের কাছে এগিয়ে এল। জানতে চাইল, সুবিমল বোস বাড়িতে আছে কিনা। বৈদ্যনাথ জানাল, সাহেব বাড়িতে নেই, ম্যাডাম আছেন। তবে তিনি ঘুমোচ্ছেন। দেখা করতে চাইলে অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটা হতাশ ভঙ্গিতে বলে, সে অপেক্ষা করতে পারবে না। আজই কলকাতার বাইরে চলে যাচ্ছে। একটু পরেই ট্রেন। ট্যাক্সিতে তার স্বামী বসে আছে। বৈদ্যনাথ মুখ ঘুরিয়ে দেখে, সত্যি, ট্যাক্সিটা একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়েছে। পেছনের সিটে বসে একটা লোক সিগারেট খাচ্ছে। এরপর মেয়েটা তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা ছোট সাইজের মিষ্টির বাক্স বের করে। মলিন হেসে বৈদ্যনাথকে অনুরোধ করে, সে যেন বাক্সটা ভেতরে দিয়ে দেয়। দিয়ে যেন বলে, বারাসতের শর্মিলা এসেছিল। ব্যস, তা হলেই হবে। ওরা চিনতে পারবে। পরে কোনওদিন কলকাতায় এলে নিশ্চয় সে দেখা করে যাবে। বৈদ্যনাথ গত দশ বছর ধরে এ বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করছে। সে যথেষ্ট কঠিন মনের মানুষ। বাইরের কাউকে সে চট করে ভেতরে ঢুকতে দেয় না। কিন্তু আজ তার কী যেন হল। সে একটু দুর্বল হয়ে পড়ে। মেয়েটাকে বলে, ‘আপনি সোজা ভেতরে যান। বাগান পেরোলেই সদর দরজা। বাঁ দিকে কলিং বেল। টিপলে দরজা খুলবে চিমসে মার্কা একজন। লোকটার নাম বাবুলাল। তার হাতে বাক্সটা দিয়ে আসুন।’ মেয়েটা ইতস্তত করে। এতে বৈদ্যনাথ আরও দুর্বল হয় এবং জোর করে। এবার মেয়েটা ঘাড় ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। ট্যাক্সির দিকে একবার তাকায়। তারপর শক্ত করে ছেলের হাত ধরে গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ছেলেটা তখনও হাসছে।

বৈদ্যনাথ সুবিমলকে জানিয়েছে, খুব বেশি হলে পাঁচ মিনিট। তার পরেই। বারাসতের শর্মিলা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসে। বৈদ্যনাথের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘চললাম ভাই। ট্রেন বোধহয় আজ মিস হবে।’ প্রায় ছুটে সে দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিতে ওঠে। ট্যাক্সি স্টার্ট দেয়। বৈদ্যনাথ এখন আর ঠিক মনে করতে পারছে না, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় মেয়েটার সঙ্গে বাচ্চা ছেলেটা ছিল কিনা। কখনও মনে হচ্ছে ছিল। কখনও মনে হচ্ছে ছিল না। এরও প্রায় আধঘন্টা পরে কাজের লোক শ্যামা কাপড় তুলতে বাগানে আসে। তখন সে দ্যাখে, চাঁপা গাছের নীচে, ঘাসের ওপর একটা বাচ্চা ছেলে বসে আছে। ঘাস এবং ধুলো নিয়ে খেলছে। তার কালো প্যান্ট আর বেগুনি রঙের জামা ধুলোয় মাখামাখি হয়ে আছে। ছেলেটার পাশে একটা মিষ্টির বাক্স রাখা। শ্যামা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘অ্যাই তুই কে রে? কী নাম তোর?’ ছেলেটা উত্তর দেয় না। শুধু হাসতে থাকে। শ্যামা ছুটে গিয়ে গেট থেকে বৈদ্যনাথকে ডেকে আনে। হইচই শুনে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিসে আসে বাবুলাল। তিনতলার বারান্দা থেকে ম্যাডাম জানতে চান, কী হল, এত গোলমাল কীসের?’।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা যায়, এই ছেলে কথা বলতে পারে না। কোনও কথা বুঝতে পারে না। শুধু হাসতে পারে।

সুবিমল চমকে উঠল। গোটাটা একটা চক্রান্ত নয় তো? হয়তো কালকের মিটিংটার আগে কেউ গোলমাল পাকিয়ে দিতে চাইছে। চেষ্টা করছে যাতে সে কলকাতা ছেড়ে বেরোতে পারে। অর্ডারটা হাতছাড়া হয়ে যাক। বারাসতের শর্মিলা, বারাসতের শর্মিলা…। সুবিমল নিজের মনে তোলপাড় করে খুঁজতে লাগল। কই এরকম নামের কাউকে তো মনে পড়ছে না! কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তন্দ্রাকে একবার মোবাইলে ধরলে কেমন হয়? তন্দ্রা কি ফোন ধরবে? মনে হয় না ধরাবে। সুবিমলের ফোন বেজে উঠল।

তালুকদারের গলায় উদ্বেগ— ‘স্যার একটা সমস্যা হয়েছে।’

‘সমস্যা! এত রাতে আবার কী সমস্যা পাকালে? সর্দি বেড়েছে?’

তালুকদার বলল, ‘না সার সে সব নয়। মনে হচ্ছে, ওদের পছন্দ হয়নি।’ সুবিমল অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘পছন্দ হয়নি! কী পছন্দ হয়নি?’ তালুকদার চিন্তিত গলায় বলল, ‘স্যার, ওই মেয়েগুলোকে মনে হয় ওদের পছন্দ হয়নি। খানিক আগে ওরা ওপারে যায়। কিন্তু লোকগুলো ঘরে ঢুকতে দেয়নি।’ সুবিমল চেঁচিয়ে উঠল, ‘রাবিশ। পছন্দ হয়নি মানে? তুমি কী করছ?’ তালুকদার অবাক হল। সারাদিন যে মানুষটা শান্তভাবে কথা বলেছে তার হঠাৎ কী হল! সে গলা নামিয়ে বলল, ‘না মানে, স্যার। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। মেয়েগুলোও খুব আপসেট।’সুবিমল আরও গলা তুলল। বলল, ‘বুঝতে পারোনি তো আমি কী করব? এখান থেকে সুটকেসে করে মুম্বইতে মেয়ে নিয়ে যাব?’ তালুকদার শান্ত গলায়, ‘সরি স্যার। ভেরি সরি।’ সুবিমল নিজেকে সামলাল। সত্যি তো, মেয়ে পছন্দ না হলে তালুকদার কী করবে? এটা সে কী করছে? কেন চেঁচাচ্ছে? গল নামিয়ে বলল, ‘সরি তালুকদার। তুমি কিছু মনে কোরো না। আসলে বাড়িতে একটা ঝামেলা হয়েছে। বাজে ঝামেলা। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, তুমি শর্মিলা নামে কাউকে চেনো? বারাসতে বাড়ি।’ তালুকদার চুপ। করে রইল। বসের কথা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আমতা আমতা করে বলল, ‘শর্মিলা! কই না তো, এই নামে কাউকে তো মনে করতে পারছি না। বারাসতে আমার এক পিসিমা থাকতেন। অনেকদিন হল, তিনি মারা গেছেন।’

‘ঠিক আছে, মনে করতে পারলে জানিয়ো।’

সুবিমল ফোন রেখে দিয়ে উঠে পড়ল। ঘর থেকে বেরিয়ে বাথরুমে গেল। মাথার ভেতরটা গরম লাগছে। প্রেশার কি বেড়ে গেল? ছিঃ, ছিঃ। এটা সে কী করছে! বিষয়টা নিয়ে এত কেন ভাবছে? আসলে কালকের অর্ডারটার জন্য চাপা টেনশন তোর হয়েছে। নিশ্চয় সেই টেনশন থেকেই এইসব উলটোপালটা ভাবনা। বাড়ির কাজের লোকেরা হয়তো বাচ্চাটার ব্যাপার এতক্ষণে সামলে নিয়েছে। কিন্তু ওরাই বা মেয়েটাকে ঘরে ঢুকতে দিল কেন? সত্যি কি কোনও সমস্যা? যদি তাই হয় তা হলে সেটা কী? সবিমলের ভাল লাগছে না। সে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে লাগল।

বাথরুমের সামনে বাবুলাল দাঁড়িয়ে। সুবিমল তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আবার কী হল বাবুলাল?’ বাবুলাল মাথা চুলকে বলল, ‘স্যার, একটা কথা ছিল।’ সুবিমল বিরক্ত মুখে বলল, ‘আবার কীসের কথা? ছেলেটাকে বের করে দিয়েছ।’ বাবুলাল মাথা নামিয়ে বলল, ‘না স্যার, এখনও করিনি।’ সুবিমল অবাক হয়ে বলল, ‘সেকী, করোনি কেন? দ্যাখো বাবুলাল, তোমাদের ভুলে আজ এ-বাড়িতে। একটা খুব বাজে ঘটনা ঘটেছে। বাড়ি-ভরতি লোককে বোকা বানিয়ে একজন মহিলা তার বোবা, বোধ-বুদ্ধিহীন বাচ্চাকে বাড়ির ভেতর ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। তোমরা। সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে। আমাকে বলো তো তোমাদের এই দ্যাখাটা আর কতক্ষণ চলবে? তোমরা ওই বাচ্চাটাকে কতক্ষণ দেখতে চাও?’ মনিবের ঠান্ডা গলায় বাবুলাল ভয় পেয়ে গেল। মাথা নামিয়ে বলল, ‘এক মিনিটও দেখতে চাই না স্যার। তবে ছেলেটাকে কীভাবে বের করব বুঝতে পারছি না স্যার। টানাটানি করলে যদি আঁচড়ে কামড়ে দেয়। হাত-পা বেঁধে নেব? সেটা কি ঠিক হবে? একটা ছোট ছেলেকে হাত-পা বেঁধে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছি, বাইরের কেউ যদি দেখে ফেলে? এ তো ধেড়ে মানুষ নয় যে ঘাড় ধাক্কা দিলাম আর সুড়সুড় করে চলে গেল।’

সুবিমল থমকে দাঁড়াল৷ সত্যি তো, বাবুলাল ভুল বলেনি। কীভাবে ছেলেটাকে বের করা হবে? একটা অচেনা, অজানা, কথা বলতে না-পারা বাচ্চা ছেলেকে কীভাবে বের করতে হয়? শরীরের ভেতর শিরশির করে উটল সুবিমলের। তার কি ভয় করছে? নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল সুবিমল। না, তাড়াহুড়ো করা যাবে না। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। কিন্তু সময় বেশি দেওয়া যাবে না। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা আরও জটিল হবে। বাইরে এবং ভেতরে দু’দিকেই জটিল হবে। সে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বাবুলালকে বলল, ‘কিছু করতে হবে না তোমাকে। আমার জন্য এক কাপ কফি নিয়ে এসো। আর শোনো, ছেলেটা কী করছে?’

তকে কিছু করতে হবে না শুনে বাবুলাল খুবই খুশি হয়েছে, সে হাসিমুখে বলল, ‘বসে আছে স্যার। চেয়ারে কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে আছে।’

‘কান্নাকাটি করছ?’

‘ওইটা তো মুশকিল। কথাবার্তা, কান্নাকাটি কিছুই নেই। শুধু হাসে।’

‘কিছু খেতে দিয়েছ?’

‘হ্যাঁ স্যার। শ্যামা দিয়েছিল।’

‘কী দিয়েছিল?’

‘দুধ দিয়েছিল।’

‘খেয়েছে?’

‘না স্যার, শ্যামা তখন দুধে চকোলেট মিশিয়ে দিল।’

‘খেল?’

‘না তখনও খেল না। মুখে ঠেকিয়ে গেলাস সরিয়ে রাখল।’

‘ঠিক আছে তুমি যাও। আমি দেখছি।’

সুবিমল বসল। তার ক্লান্ত লাগছে। ইচ্ছে করছে, দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ে। সেটা সম্ভব নয়। যার সামনে প্রায় কোটি টাকার অর্ডার ঝুলছে, আর পেছনে একটা বোধবুদ্ধিহীন শিশু হাসছে, তার পক্ষে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া সম্ভব নয়। সে ফোন তুলে তন্দ্রার মোবাইলের নম্বর টিপল। মনে হয় না তন্দ্রা ধরবে। নম্বর দেখে কেটে দেবে। দীর্ঘদিন ধরে সে এটাই করছে।

তন্দ্রা ফোন ধরল। একবার বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ধরল। পেছনে গানবাজনা,। হইহট্টগোলের শব্দ। সুবিমল চিৎকার করে বলল, ‘হ্যালো তন্দ্রা? তন্দ্রা বলছ?’ তন্দ্রা বিরক্তি-ভরা গলায় বলল, ‘চিৎকার করছ কেন?’ সুবিমল বলল, ‘তুমি কি জানো, বাড়িতে আজ একটা বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটেছে।’ তন্দ্রা গলায় বিরক্তির মাত্রা বাড়িয়ে। বলল, ‘বেরোনোর ‘সময় শুনলাম, একটা ছেলে না মেয়েকে কে যেন বাড়িতে ফেলে গেছে। আমি কী করব? ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ঘুরব বলছ নাকি?’সুবিমলের ইচ্ছে হল নোংরা একটা গালাগালি দেয়। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। গলা আরও নরম করল। বলল, ‘এরকম অনেক সময় হয়। গরিব বাবা-মা ছেলেকে খাওয়াতে পারছে না—কী করবে, মেরে তো ফেলবে না। সে যাই হোক, তন্দ্রা, তুমি কি শর্মিলা নামে। কাউকে চেনো? বারাসতে বাড়ি।’ তন্দ্রা হিসহিস করে উঠল, ‘ইটস টু মাচ সুবিমল। তোমার সবক’জন মেয়েছেলের খবর আমি রাখব তুমি ভাবলে কোন আক্কেলে? বাইরের কেলেঙ্কারি ঘর পর্যন্ত নিয়ে এসেছ। ভেরি গুড। আর দেরি কেন? রাত হয়ে গেছে, এবার বেডরুমে নিয়ে যাও। আজ রাতে আমি ফিরছি না। নাউ ইড ক্যান এনজয় উইথ দ্যাট লেডি। কী যেন নাম বললে, ‘শর্মিলা না উর্মিলা।’ কথা শেষ করে তন্দ্রা ফোন কেটে দিল।

সুবিমল থম মেরে বসে আছে। তন্দ্রার এ-আচরণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু সে একটা নতুন দিক দেখিয়ে দিল। এখন নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে, এটা একটা চক্রান্তই। শুধু একটা বাচ্চা ছেলেকে ফেলে যাওয়া নয়, ঘটনার সঙ্গে ইচ্ছে করে একটা মেয়েকে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে জিনিসটা একটা কেলেঙ্কারির চেহারা পায়। এখন কী করবে সে? কী করা উচিত? ছেলেটাকে নিয়ে থানায় যাবে? থানায় গেলে হাজার প্রশ্ন— এতক্ষণ আসেননি কেন? মহিলা বাচ্চা ফেলে যাওয়ার জন্য আপনার বাড়ি বেছে নিল কেন? আপনার নাম জানলে কী করে? দারোয়ানকে ডাকুন। কাজের। লোকদের পাঠিয়ে দিন। সব থেকে বড় প্রশ্ন, বারাসতের শর্মিলা কে? না, থানায় যাওয়া যাবে না। তা হলে? রাতের মধ্যে কোনও অনাথ আশ্রম টাশ্রমের খোঁজ পাওয়া যাবে? পেলেই বা কী এসে যাবে? মাঝরাতে সেখানে গিয়ে তাদের কী বলবে? বলতে হবে— দাদা, এই ছেলেটা আমার ড্রইংরুমে বসে ছিল। নিয়ে। এসেছি। একে আপনাদের আশ্রমে রাখুন। এ কথা শুনে তারা হেসে গড়িয়ে পড়বে। বলবে দুঃখিত, ড্রইংরুমের অনাথ শিশুদের জন্য আমাদের কোনও ব্যবস্থা নেই।

বাবুলাল ঘরে ঢুকল। তার হাতে কফির মগ। মগ টেবিলে নামিয়ে রেখে সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘স্যার, ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়েছে। চেয়ারের ওপরই গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।’ সুমিবল ভান করল, কথাটা যেন শুনতে পায়নি। বলল, ‘বাবুলাল, ম্যাডাম রাতে ফিরবে না। তোমরা খেয়ে নিয়ো। কাল ভোরে চা দিয়ে আমায় ডাকবে। আমি প্লেন ধরব।’

বাবুলাল খানিকটা ইতস্তত করে বলল, ‘স্যার, ছেলেটা কি ওখানেই থাকবে?’

সুবিমল চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, ‘থাকুক। তুমি যাওয়ার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ো। আর কফিটা নিয়ে যাও বাবুলাল, আমি খাব না।’

তিনবার বেজে যাওয়ার পর সুবিমল মোবাইলটা ধরল। ক্লান্ত গলায় বলল। ‘বলো।’ তালুকদার বলল, ‘আপনার শরীর ঠিক আছে তো স্যার?’

‘হ্যাঁ, ঠিক আছে।’

‘সার, একটা গোলমাল হয়েছে। খানিক আগে মুখার্জি অ্যান্ড আগরওয়াল কোম্পানির কাঞ্চন মুখার্জিকে হোটেলের লবিতে দেখলাম মনে হল। ঘুরঘুর করছে। ইফ আই অ্যাম নট রং স্যার তা হলে লোকটা কাঞ্চন মুখার্জিই হবে। ব্যাটা কখন কলকাতা থেকে এখানে এল? কেন এল? এই হোটলেই বা উঠেছে কেন— কিছুই বুঝতে পারছি না। স্যার, রাগ না করলে একটা কথা বলতাম।’

‘এত ভণিতা ভাল লাগছে না তালুকদার, তাড়াতাড়ি বলো।’

‘আমাদের কোম্পানির পাশাপাশি ওরা মুখার্জি অ্যান্ড আগরওয়াল কোম্পানির সঙ্গেও কথা চালাচ্ছে না তো? কাঞ্চন মুখার্জিই হয়তো ভুচং ভাচুং দিয়ে আমাদের মেয়েগুলোকে তাড়িয়েছে। এবার সেই হয়তো লোকগুলোর জন্য সারারাত ফুর্তির ব্যবস্থা করবে।’ এতটা বলে তালুকদার একটু চুপ করল। তারপর কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘আমার ভয় করছে স্যার। এত বড় একটা অর্ডার হাতছাড়া হয়ে গেলে…।’

সুবিমলের কেমন অবশ অবশ লাগছে। মনে হচ্ছে, মোবাইলটা হাত থেকে পড়ে যাবে। সে চাপা গলায় বলল, ‘স্টুপিডের মতো কথা বোলো না। ইউ আর গেটিং নার্ভাস তালুকদার। শুধু নার্ভাস হওনি, ভয় পেয়েছ। মুখার্জি অ্যান্ড আগরওয়াল আমাদের এই ডিলের খবর পাবে কী করে? নিশ্চয় তুমি ভুল করছ। কাঞ্চন মুখার্জির মতো দেখতে অন্য কাউকে দেখেছ। নার্ভ ঠিক রাখো তালুকদার। বি স্টেডি।’ তালুকদার ফিসফিস করে বলল, ‘সেটাই যেন হয় স্যার। যেন ভুল হয়।’

সুবিমল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ‘তালুকদার, তুমি বারাসতের শর্মিলাকে চিনতে পারলে?’ এরকম একটা গভীর সংকটের সময় বসের এই প্রশ্ন তালুকদার একেবারেই আশা করেনি। সে অবাক হয়ে বলে, ‘না স্যার, চিনতে পারলাম না। কিছু মনে করবেন না, এনিথিং রং স্যার? কোনও কিছু নিয়ে কি আপনি চিন্তিত?’ সুবিমল নিজের মনেই বলতে লাগল, ‘না, ঠিক চিন্তিত নই। আবার চিন্তিতও বলতে পারো। বছর চার-পাঁচের একটা ছেলে সন্ধে থেকে বড় বিরক্ত করছে। আমি অবশ্য ছেলেটাকে এখনও দেখিনি। শুনেছি, সে নিজে কথা বলতে পারে না, অন্যের কথা বুঝতেও পারে না। সম্ভবত মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে হাসতে পারে। দিস ইজ মোর ডিসটার্বিং।’ তালুকদার বলল, ‘স্যার, আমি কি কিছু করতে পারি?’ কথার উত্তর না দিয়ে সুবিমল বলে যেতে লাগল, ‘একটু আগে শুনলাম, ছেলেটা নাকি ড্রইংরুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। চেয়ারের ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছে।’ তালুকদার বলল, ‘স্যার, ছেলেটা আপনার কে হয়?’ সুবিমল শুকনো হাসল। বলল, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না তালুকদার। সম্ভবত কেউ হয় না। আর সেই কারণেই কেমন ভয় করছে। যাক, এসব ছাড়ো। হোটেলের বেয়ারাদের টাকাপয়সা দিয়ে জানতে চেষ্টা করো, সত্যিই কাঞ্চন মুখার্জি নামে কেউ ওখানে উঠেছে কিনা। খবরটা নিয়ে যত রাতই হোক আমাকে জানিয়ে। আমি এদিকটা দেখছি।’

ফোন ছেড়ে ঘড়ি দেখল সুবিমল। রাত বারোটা। সে ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবি বের করে উঠে দাঁড়াল।

যশোর রোডের যে-পাশে সুবিমল ছেলেটাকে গাড়ি থেকে নামিয়েছে সেখানে কোনও আলো নেই। উলটো দিকে এয়ারপোর্টের পাঁচিল চলে গেছে একটানা। পাঁচিলের ও দিকে ঝোপ জঙ্গল মাঠ। কিছুটা দূরে রানওয়ে। সেখানে সারি সারি ভুতুড়ে আলো মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পথে অসুবিধে হয়নি কোনও। পুরো সময়টাই পেছনের সিটে ছেলেটা ঘুমিয়েছে। হাঁটুদুটো মাথার কাছে তুলে কুঁকড়ে মুকড়ে। বোধহয় ঠান্ডা লাগছিল। গাড়ি থেকে নামানোর সময় ঘুম ভেঙে ফ্যালফ্যাল করা তাকায়। সুবিমল প্রথমে ভেবেছিল, রাস্তা পেরোবে হাত ধরে। ঝুঁকি নেয়নি। তাতে বেশি সময় লাগত। সে ছেলেটাকে কোলে তুলে নেয়। কোলে উঠে ছেলেটা প্রথমে হাসে। তারপর অবাক হয়ে তাকায় দূরে, রানওয়ের দিকে। তখনই রানওয়ে ছেড়ে গভীর রাতের কোনও বিমান সবে আকাশে উড়েছে। ছেলেটা সেদিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের দিকে।

ছেলেটাকে নামিয়ে দিয়ে, ধীরে সুস্থে রাস্তা পেরিয়ে সুবিমল একা ফিরে আসে। গাড়ির কাছে। গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে নিতে হেডলাইটের আলোয় দেখতে পায়, ছেলেটা তখনও চেয়ে আছে আকাশের দিকে। হাসছে কি?

বাইপাসে গাড়ি উঠতে মোবাইল বেজে উঠল। ‘বলো তালুকদার। খবর বলো।’

তালুকদারের গলায় খুশি উপচে পড়ছে। বলল, ‘স্যার, প্রবলেম ইজ ওভার। আপনিই ঠিক বলেছিলেন স্যার কাঞ্চন মুখার্জি নয়, আমি অন্য লোককে দেখে ভুল করেছিলাম। টেনশনে মাথাটা মনে হয় খারাপ হয়ে গিয়েছিল। হোক খারাপ, যত খুশি হোক। সমস্যা আর নেই এটাই বড় কথা। আর ফুর্তিটুর্তির কোনও ব্যাপার নেই, লোকগুলো স্যার যে-যার ঘরে টেনে দুম মারছে। আমি এইমাত্র দরজায় কান দিয়ে। শুনে এলাম, নাক ডাকছে। হা হা। স্যার, আপনি মনে হচ্ছে রাস্তায়। গাড়ির আওয়াজ পাচ্ছি। ছেলেটা কেমন আছে?’

সুমিবল অবসন্ন গলায় বলল, ‘মনে হয় ভালই আছে। খানিক আগে দেখলাম, যশোর রোডের পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। খারাপ থাকলে হাসবে কেন? গুড নাইট তালুকদার। ভেরি গুড নাইট।

গাড়ি চালাতে চালাতে সুবিমলের মনে হল জ্বর আসছে। গা ম্যাজম্যাজ করছে। মাথাটা কেমন একটা ভারী লাগছে। তবে আজ রাতে সে আর ঘুমোবে না। প্রায় দুটো বাজতে চলল। আর তো মাত্র কয়েক ঘন্টা। বাড়ি ফিরে ফাইলের বাকিটা নিয়ে বসতে হবে। তন্দ্রা কোথায়? কে জানে আজ কার বিছানায় গিয়ে উঠেছে। একটা ফোন করলে কেমন হয়? বলতে হবে, ‘ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত তন্দ্রা। খুবই দুঃখিত। তবে তোমার কথাই শেষপর্যন্ত ঠিক হল। বারাসতের শর্মিলাকে হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমার। এইমাত্র ছেলেটাকে তার কাছে দিয়েও এলাম।’

কথাটা ভেবে নিজের মনেই খুব হাসতে লাগল সুবিমল। ভাগ্যিস সঙ্গে কেউ নেই। থাকলে সুবিমলের এই হাসি তার ভাল লাগত না। কারণ, এই হাসি ঠিক স্বাভাবিক হাসি নয়। অন্যরকম হাসি।

দরজা খুলল বাবুলাল। তার চোখদুটো টকটকে লাল। ঘুম থেকে উঠে এসেছে। সুবিমল হাসিমুখে নিচু গলায় বলল, ‘আর চিন্তা নেই বাবুলাল, ছেলেটাকে রেখে এলাম। এক কাপ কফি বানাতে পারো?’

‘স্যার, এখনই বানিয়ে দিচ্ছি।’

‘চিনি কম দেবে। তোমরা আজকাল কফিতে বড্ড চিনি দাও। আর শোনো, ড্রইংরুম পরিষ্কার হয়েছে?’

‘হয়েছে। কার্পেট বদলানো হয়েছে। দোতলা থেকে নতুন একটা ফুলদানি এনে। রেখেছি স্যার।’

‘ঠিক আছে, আমি দেখে নিচ্ছি।’

‘কাঁচা ঘুম ভাঙলেও বাবুলাল খুশি। সব মিটে গেছে এটাই বড় কথা। সে রান্নাঘরে। এল। গ্যাস জ্বালিয়ে কফির জল চাপাল। একটু বেশি করেই চাপাল। নিজেও খাবে। কাজের লোকদের কফি খাওয়া ঠিক নয়, কিন্তু আজ একটা অন্যরকম দিন। বড় ঝামেলা থেকে বাড়িটা রক্ষা পেয়েছে। এরকম দিনে অত ঠিক-বেঠিক না মানলেও চলে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই কফির মগ হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল বাবুলাল। বেরিয়ে এসে বড় অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখল সে।

ড্রইংরুমে আলো জ্বলছে। বাইরে আলো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে সুবিমল। অল্প অল্প কঁপছে। মুখে চাপা গোঙানির মতো আওয়াজ। মানুষটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঘরের ভেতর। বিড়বিড় করে বলছে, ‘ওখানে কে? কে ওখানে?’

বাবুলাল প্রায় ছুটে মনিবের পাশে এসে দাঁড়াল। শূন্য ঘরের ভেতরে অবাক হয়ে তাকাল। তারপর বলল, ‘কই স্যার, কেউ নেই তো!’

‘ওই যে চেয়ারের ওপর, ওই তো গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *