ভয়

ভয়

ছাদে কি নূপুর পায়ে কেউ হাঁটছে? নাকি অন্য কোনও শব্দ? আনোয়ার নিশ্চিত হতে পারছে না। এই শীতে বিছানা থেকে উঠতেও ইচ্ছা করছে না। যদিও ছাদে উঁকি দেয়া তার জন্য সহজ। কারণ সে ছাদের চিলেকোঠায় থাকে। এই বিশাল চারতলা বাড়িটা আনোয়ারদের। কিন্তু একা-একা শান্তিতে থাকার জন্য ও ছাদের চিলেকোঠাকেই বেছে নিয়েছে। ছাদেই যেন একটা সুন্দর সংসার আছে ওর। খুব প্রয়োজন না হলে আনোয়ার ছাদ ছেড়ে বাসায়ও তেমন একটা যায় না। তাই কেউ ওর সঙ্গে দেখা করতে এলে সরাসরি ছাদেই চলে আসে।

শব্দটা বেশ মিষ্টি লাগছে। এত রাতে ছাদে কে হতে পারে? ভাড়াটিয়াদের কেউ? কেয়া বা খেয়া নয় তো? দোতলার সোবহান সাহেবের দুই মেয়ে কেয়া আর খেয়া। কেয়া ইণ্টারমিডিয়েট পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করছে। আর খেয়া ক্লাস নাইনে পড়ে। দুই বোনই অসম্ভব রকমের সুন্দর। এরা প্রায়ই ছাদে আসে। সোবহান সাহেবের এ ব্যাপারটা একদম পছন্দ নয়। তাই তিনি ওদের ছাদে আসার বিষয়ে ১৪৪ ধারা জারি করেছেন। তবুও দুই বোনকে প্রায়ই ছাদে দেখা যায় এবং আনোয়ারের সাথে গল্প করাই যে তাদের মূল উদ্দেশ্য এটাও বোঝা যায়। আনোয়ারও ওদের খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে কেয়াকে। পছন্দটা কোন্ পর্যায়ের এ ব্যাপারে আনোয়ার নিশ্চিত নয়। কেয়ার সাথে কথা বলতে ওর খুব ভাল লাগে এটুকুই ও জানে।

রাত ১টা ৫৫। এত রাতে কেয়া-খেয়ার যে-কারও ছাদে আসার সম্ভাবনা শূন্য। আর নূপুর পরে হাঁটার কথা তো চিন্তাই করা যায় না। আনোয়ার দরজা খুলে ছাদে এল। নূপুরের শব্দটা ক্ষীণ হয়ে আসে। তবে চমৎকার একটা ঘ্রাণ পায় আনোয়ার। আর মৃদু বাতাসে যেন শরীর জুড়িয়ে আসে। এমন কি হতে পারে ছাদে অশরীরী কিছু আছে? এমন হলে মন্দ হয় না। আনোয়ার এসব জিনিস দেখার জন্য অনেক অ্যাডভেঞ্চার করেছে। কত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার যে মুখোমুখি হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

আনোয়ারদের ছাদটা বেশ বড়। অনেক সুন্দর করে সাজানো। আনোয়ার ছাদে হাঁটতে শুরু করে। নূপুরের শব্দ আরও স্পষ্ট শোনা যায়। মনে হচ্ছে একটু দূরে কেউ যেন হাঁটছে। আনোয়ার দ্বিধাহীনভাবে ওদিকে হেঁটে যায়। হ্যাঁ, ওদিকে আসলেই কেউ আছে।

‘কে, কে ওখানে?’ আনোয়ার বলে ওঠে।

ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির হাঁটাহাঁটি বন্ধ হয়ে যায়। আনোয়ার মানুষটির আরও কাছে চলে আসে।

একটি মেয়ে। আপাদমস্তক বোরকায় ঢাকা। মুখে নেকাব।

‘কে আপনি?’ আনোয়ার প্রশ্ন করে বসে।

মেয়েটি আস্তে-আস্তে বলল, ‘আমি পরী।’

‘আপনার নাম পরী?’

‘না, আমি পরী। কোকাকে থাকি।’

‘মজা করছেন? আপনি চোর নাকি? এত রাতে এখানে? আপনার মতলব কী?’

‘এমনি ঘুরতে এলাম। আপনার সাথে গল্প করতে ইচ্ছা করছিল।’

ছাদের মৃদু আলোতে মেয়েটার হাতের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। নখগুলোতে নীল রঙের নেলপালিশ দেখতে পায় আনোয়ার।

মেয়েটা হাঁটতে-হাঁটতে ছাদের কিনারে চলে যায়। ওদিকে রেলিং নেই।

আনোয়ার শঙ্কিত মুখে বলল, ‘এই, কী করছেন? পড়ে যাবেন!’

মেয়েটার হাসির শব্দ শোনা গেল। আনোয়ারের মনে হলো কেয়া-খেয়া নয় তো! কিন্তু ও নিশ্চিত হতে পারছে না। মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছে।

আনোয়ার বলল, ‘এই, আপনি কে বলুন তো?’

‘আমার নাম সুলেখা মিত্র।’

‘মিত্র? মানে আপনি তো হিন্দু! বোরকা পরেছেন কেন?’

‘কেন, কোনও হিন্দু কি বোরকা পরতে পারে না?’

উত্তর শুনে আনোয়ার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

মেয়েটি আবার বলল, ‘আসলে আমার সারা গায়ে রক্তের ছাপ, মাথার সামনের দিকটা থেঁতলে গেছে, মুখটাওঁ বেঁকে গেছে। এই জন্য নিজের চেহারা দেখাতে চাইছি না।’

‘মানে? কী বলছেন এসব? মজা করছেন?’

‘আপনার সাথে আর কথা বলব না। এখন আমাকে যেতে হবে। আপনি চোখ বন্ধ করুন।’

‘চোখ বন্ধ করব মানে?’

‘আমাকে যেতে হবে। সময় বেশি নেই। ওই যে দেখুন আকাশে কিছু একটা আসছে। সময় বেশি নেই।’

আনোয়ার আকাশের দিকে তাকায়। কিছু দেখতে পায় না। কয়েক মুহূর্ত পর পিছনে তাকিয়ে আনোয়ার দেখে মেয়েটা নেই।

সকালে ঘুম ভাঙার পর আনোয়ার ছাদে পায়চারী করতে থাকে। পাশের বাসা থেকে বেশ হইচই শোনা যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে ওই বাড়ির কোনও এক মেয়ে মারা গেছে। আনোয়ারের সঙ্গে আশপাশের মানুষের খুব বেশি পরিচয় নেই। তাই সে ঠিক জানে না কে মারা গেছে। কেয়া-খেয়ার সঙ্গে কথা বললে অবশ্য জানা যেত।

সকাল ১১টার দিকে কেয়া ছাদে আসে। ওর হাতে আচারের বয়াম। আচারগুলো রোদে দিল কেয়া। আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। ‘আনোয়ার ভাই, কেমন আছেন?’

‘এই তো, কেয়া, ভালই আছি।’

‘আপনার ঘোরাঘুরি কেমন চলছে?’

‘এই তো ভালই।’

‘এই যে আপনি ভূত-প্রেত খুঁজে বেড়ান, দেশের নানা জায়গায় যান, আপনার ভয় লাগে না?’

আনোয়ার হাসল। এরপর বলল, ‘মজা লাগে। অনেক মজা।’

‘আমাকে একবার আপনার সাথে নেবেন?’

‘অবশ্যই।’

‘আমার মাঝে-মাঝে কী ইচ্ছা করে জানেন? দূরে কোনও দ্বীপে চলে যেতে। যেখানে প্রকৃতির মাঝে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারব।’

আনোয়ার হেসে বলল, ‘আশা করি তোমার ইচ্ছা একদিন পূরণ হবে।’

‘আপনি এমন করে হাসলেন কেন?’

‘সত্যি কথাটা কি জানো, আমাদের সবারই দূরে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু ইচ্ছাপূরণ হওয়ার পর দেখবে, বেশিদিন একা-একা ভাল লাগছে না।’

কেয়া জোর দিয়ে বলল, ‘আমার লাগবে।’

‘আচ্ছা মেনে নিলাম।’

তাদের কথোপকথনের এই পর্যায়ে পুলিসের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। আনোয়ার ছাদ থেকে নীচের রাস্তায় তাকাল। ওদের পাশের বাড়িতে পুলিস এসেছে।

আনোয়ার বলল, ‘কী ব্যাপার, হঠাৎ পুলিস কেন?’

‘আপনি কোন্ দুনিয়ায় থাকেন? কিছু জানেন না?’

‘না তো। কী হয়েছে?’

‘পাশের বাসার এক বৌদি দু’দিন আগে আত্মহত্যা করেছে।’

‘কীভাবে আত্মহত্যা করেছেন?’

‘ছাদ থেকে লাফ দিয়েছিল। মাথা থেঁতলে গেছে। খুব বিশ্রীভাবে মারা গেছে। পুলিস তার স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।’

‘যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম কী?’

‘সুলেখা বৌদি।’

আনোয়ার ভিতরে-ভিতরে বেশ চমকে উঠল। হঠাৎ বলল, ‘কাল রাতে কি তুমি বা খেয়া কেউ ছাদে এসেছিলে?’

‘রাতে! কী বলছেন এসব? রাত তো অনেক দূরের কথা, বাবা দিনের বেলাই ছাদে আসতে দিতে চান না। তো আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন করছেন কেন?’

‘না, এমনি।’

‘সুলেখা বৌদির স্বামী অনেক ক্ষমতাবান মানুষ। সুনীল কুমার বিশ্বাস। চেনেন তো তাকে? পুলিস, আণ্ডারওয়ার্ল্ডের মানুষ সবার সাথে তার ভাল সম্পর্ক। তাই এই আত্মহত্যায় তার কোনও ভূমিকা থাকলেও দেখবেন শেষ পর্যন্ত কিছুই হবে না।’

‘এটা আত্মহত্যা না হত্যা?’

‘আমি কী করে বলব বলেন। তবে আত্মহত্যাই মনে হয়। আত্মহত্যা হোক আর যা-ই হোক সুনীলের অত্যাচারেই নিশ্চয় এটা ঘটেছে।’

‘হুম।’

কেয়া চলে গেল। আনোয়ারের মনটা হঠাৎ খুব খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন বাসায় কাটাল সে। আর রাতের খাবার শেষ করে ছাদের এক কোনায় বসে রইল। কিছু একটা নিয়ে বড্ড চিন্তিত সে বোঝা যাচ্ছে। রাত ১১টা ৪০ মিনিট। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ পেল আনোয়ার। পিছনে ফিরে দেখল বোরকা পরা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। আনোয়ার দ্রুত উঠে দাঁড়াল।

‘ভাল আছেন?’ মেয়েটির সরল জিজ্ঞাসা।

‘কে, কে আপনি?’ আনোয়ারের কণ্ঠে কিছুটা উত্তাপ।

‘আগের দিন তো বলেছি আমি সুলেখা।’

‘আমি বিশ্বাস করি না। আপনার মুখ দেখান।’

‘আপনি ভয় পাবেন।’

‘না, আমি ভয় পাব না।’

‘আপনি এখনই ভয় পাচ্ছেন। আপনার শরীর কাঁপছে।’

আনোয়ার আসলেই খুব ভয় পাচ্ছে। সে তো এত ভীতু নয়। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে?

‘আপনি আমার কাছে কী চান?’

‘কিছু না। আপনার সাথে গল্প করতে চাই।’

‘আপনি চলে যান।’

‘বেশি কথা বলবেন না। চুপ করে বসুন। বেশি কথা আমার ভাল লাগে না।’ হঠাৎ হিংস্র গলায় বলল সুলেখা।

আনোয়ার বসে পড়ল।

‘আমি আপনাকে নিয়ে যেতে চাই,’ সুলেখা বলল। ‘মানে?’

‘আমার বড্ড একা লাগে। আপনাকে আমার চাই।’

আনোয়ারের মুখ আরও শুকনো হয়ে যায়। হেসে ওঠে সুলেখা। আনোয়ারের মনে হয় পরিচিত হাসি। কিন্তু সুলেখার হাসি তো ও আগে শোনেনি। সুলেখার হাতের দিকে চোখ যায় ওর। শক্ত করে কিছু ধরে রেখেছে সুলেখা। আনোয়ার বুঝতে পারে ওটা একটা ছুরি। ছাদে জ্বলতে থাকা বাল্বের মৃদু আলোতে হাতের লাল রঙের নেলপালিশও দৃশ্যমান হয়। আনোয়ারের শরীর কেমন যেন অসাড় হয়ে যায়। সুলেখাকে খুব ভয় পাচ্ছে ও।

‘আপনাকে আজ নেব না। চিন্তা নেই, তবে একদিন ঠিকই নিয়ে যাব। যান, এখন বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’

আনোয়ার বাধ্য ছেলের মত চিলেকোঠার ঘরে যায়। লাইট জ্বেলে বিছানায় বসে পড়ে। ১০ মিনিট পর বাইরে বেরিয়ে দেখে ছাদে কেউ নেই। তবে সেই মিষ্টি গন্ধটা আছে। যে গন্ধটার জন্য বারবার ওর চিন্তাশক্তি লোপ পাচ্ছিল।

সকাল ১০টায় ঘুম ভাঙল আনোয়ারের। রাতে বেশ ভাল একটা ঘুম হয়েছে। দ্রুত ফ্রেশ হলো আনোয়ার। বাসা থেকে কাজের ছেলে খালেদ ছাদে নাস্তা দিয়ে গেল। আনোয়ার নাস্তা শেষে কেয়াকে ফোন করল।

‘কেয়া, তুমি আর খেয়া কিছুক্ষণের জন্য ছাদে আসতে পারবে?’

‘কেন, আনোয়ার ভাই? হঠাৎ?’

‘একটু দরকার ছিল। খুব সমস্যা থাকলে আসার দরকার নেই। ‘

‘না, কোনও সমস্যা নেই। বাবাও বাড়িতে নেই। আমরা দশ মিনিটের মধ্যে আসছি।’

আনোয়ার আয়েশ করে সিগারেট ধরাল। আজ ওর মনটা বেশ ভাল। একটা রহস্যের সমাধান ও করতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।

কেয়া-খেয়া কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাদে চলে এল। এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেশ পরিপাটি হয়ে এসেছে দুই বোন। আনোয়ারের ঘরে চেয়ারে বসল ওরা। কেয়া বলল, ‘কী, আনোয়ার ভাই। হঠাৎ জরুরি তলব?’

‘ভাল আছ তোমরা?’

‘হ্যাঁ, ভাল। আপনি তো কখনও ফোন করেন না। আজ হঠাৎ ফোন করে ছাদে আসতে বললেন?’

‘আমি ভণিতা পছন্দ করি না। তাই সরাসরি কিছু কথা বলতে চাই।’

আনোয়ারের কথা বলার ভঙ্গি দেখে ওরা দু’জনে চুপ হয়ে যায়। কিছু একটা আন্দাজ করে।

‘এটা কেন করলে তোমরা?’

‘কী করেছি?’ কেয়া মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল।

‘সুলেখা সেজে আমার সাথে কেন এমন করলে?’ দু’জনের মাথা নিচু হয়ে যায়।

‘উত্তর দিচ্ছ না কেন?’

‘আমরা আসলে আপনাকে একটু ভয় দেখাতে চেয়েছি।’

‘কেন?’

‘আপনি নিজেকে অনেক সাহসী ভাবেন। আসলেই সাহসী কি না সেটা দেখার জন্যই এমন করেছি।’

‘আমি প্রথম রাতে বুঝতে না পারলেও গতকাল রাতে হিসাব মেলাতে পেরেছি। প্রথম দিন কেয়া এসেছিল, আর দ্বিতীয় দিন খেয়া। ঠিক?’

‘কী করে বুঝলেন?’ পাল্টা প্রশ্ন কেয়ার।

‘কেয়া, তোমার হাতে নীল রঙের নেলপালিশ। আর খেয়ার হাতে লাল রঙের নেলপালিশ। আমি তোমাদের হাতের দিকে লক্ষ্য করেছিলাম।’

কথাগুলো শুনে কেয়া-খেয়া নিজেদের হাত ঢেকে ফেলল।

আনোয়ার আবার বলল, ‘তোমরা গায়ে এমন কোনও সুগন্ধি লাগিয়েছিলে, যেটা আমার চেতনার জগৎ ওলট-পালট করে দিয়েছিল। আমি সহজভাবে কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না। এজন্য ভয়টাও বেশ জেঁকে ধরেছিল। এই সুগন্ধি তোমরা পেলে কোথায়? আমার তো মনে হয় এটি নিষিদ্ধ কোনও সুগন্ধি। আর এটা শুধু ছেলেদের উপরই কাজ করে। আমি কি ঠিক বলেছি?’

‘হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। অনলাইনে একটা ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপন দেখে আমরা অর্ডার দিয়েছিলাম। তারা গোপনে আমাদের বাসায় দিয়ে গেছে। ওটা ছেলেদের আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা হয়।’

‘ওই সুগন্ধি এতটাই প্রখর ছিল যে আমি ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিলাম না। আমি গলার স্বর শুনেও তাই তোমাদের চিনতে পারিনি। আচ্ছা, আমাকে ভয় দেখানো কি এতটাই জরুরি?’

কেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আর খেয়ার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়।

কেয়া কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘আমরা শুধু মজা করতে চেয়েছিলাম। প্লিজ, আমাদের মাফ করে দিন।’

কেয়ার জন্য মায়া হয় আনোয়ারের। ইচ্ছা করে মাথায় একটু হাত রাখতে। ইচ্ছাটাকে দমন করে আনোয়ার হাসল। এরপর বলল, ‘আমি রাগ করিনি। কান্না থামাও। বিষয়টা চিন্তা করে এখন বেশ মজাই লাগছে। তবে ঘটনার এখানেই ইতি ঘটাও। আর এসব কোরো না।’

দুই বোন মাথা নাড়ে। খেয়া নীচে চলে গেল। কেয়া বিছানায় বসেই থাকল। এখনও চোখে পানি ওর।

আনোয়ার আবার বিব্রত হলো। হঠাৎ বলল, ‘কেয়া, আমি একটু অন্যরকম। সৌন্দর্য বিষয়টা ভাল বুঝি না। কিন্তু তোমার কান্না দেখে মনে হচ্ছে স্বর্গের কোনও দেবী কাঁদছে। আমার ইচ্ছা করছে…’

কেয়ার কান্না পুরোপুরি থেমে গেল। চোখ বড়-বড় করে তাকাল আনোয়ারের দিকে। তারপর বলল, ‘কী ইচ্ছা করছে?’

‘নাহ। কিছু না।’

‘বলুন। বলতে হবে।’

‘তোমার চোখের পানি মুছে দিতে ইচ্ছা করছে।’

কেয়া দ্রুত এগিয়ে গেল। ‘দিন, চোখের পানি মুছে দিন।’

‘চোখে তো এখন পানি নেই!’

‘তা হলে কি আমাকে আবার কাঁদতে হবে?’

এ সময় খেয়া দৌড়তে দৌড়তে ছাদে এল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘আপা, বাবা বাসায় এসেছে। তাড়াতাড়ি চলো।’

কেয়া-খেয়া দু’জনেই দৌড় দিল।

.

আজ সারাদিন বাইরে ঘুরে কাটিয়েছে আনোয়ার। নীলখেত থেকে কিছু বই কিনল। এক বন্ধুর সাথে পুরান ঢাকার রহস্যময় একটা বাড়ি নিয়ে আলাপ হলো, আনোয়ার সেখানে যেতে চায়। ওর বন্ধুও খুব আগ্রহ দেখাল। টিএসসি-তে গিয়ে কিছুক্ষণ একা-একা বসে রইল আনোয়ার। কয়েক বছর আগেও সে ঢাবির ছাত্র ছিল। এখন এখানের কাউকেই সে চেনে না।

রাত ৮টার দিকে বাসায় ফিরল আনোয়ার। প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। বাসায় ঢুকেই পেট ভরে খেয়ে নিল ও। এরপর সোজা ছাদে। আকাশটা আজ বেশ পরিষ্কার। বাইরে বেশ বাতাস বইছে। আনোয়ার চিলেকোঠার ঘরে বসে একটা রগরগে ভূতের বই পড়ছে।

রাত ১২টা পার হয়ে গেছে। আশপাশের শব্দ কমে গেছে একদম। হঠাৎ ছাদে কারও পায়ের শব্দ শুনতে পেল আনোয়ার। পা টেনে-টেনে হাঁটার খস খস শব্দ। রুম থেকে বেরিয়ে আনোয়ার দেখতে পেল বোরকা পরা কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। কেয়া-খেয়া আবার ওকে ভয় দেখাতে এসেছে? মেজাজটা চরম খারাপ হলো ওর। এগিয়ে গেল ওদিকে।

আনোয়ার জোরে বলল, ‘তোমরা পেয়েছ কী? আবার ভয় দেখাতে এসেছ?’

বোরকা পরা মেয়েটি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। আনোয়ারের কথায় তার কোনও ভ্রুক্ষেপ হলো না। আনোয়ার দ্রুত এগিয়ে গেল ওদিকে। টেনে মেয়েটাকে চোখের সামনে নিয়ে এল। এরপর টান দিয়ে নেকাব খুলে ফেলল। আজ একটা হেস্তনেস্ত ও করবেই।

নেকাব সরিয়ে আনোয়ার যেন পাথরের মত জমে গেল। সুলেখা মিত্র দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা একদিকে বেঁকে আছে, মাথার সামনে থেঁতলানো। ফোঁটা-ফোঁটা রক্ত পড়ছে সেখান থেকে। মুখটা অল্প খোলা। লালা ঝরছে সেখান থেকে।

আনোয়ার কয়েক পা পিছনে সরে গেল। ‘আ-আপনি?’

কোনও উত্তর নেই। সুলেখা মিত্র শুধু একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি কোনও জীবিত মানুষের হতে পারে না।

‘কী চান আপনি?’

এবারও কোনও উত্তর নেই। আনোয়ার দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ল। দরজা বন্ধ করে দিল। সম্ভবত সে ভুল দেখছে। তার মস্তিষ্ক কোনও ধরনের খেলা খেলছে। আবার সেই পুরানো ভয়টা ফিরে এল আনোয়ারের। মনের ভিতর কাজ করছে তীব্র অপরাধবোধ। এক নিঃশ্বাসে দুই গ্লাস পানি খেল আনোয়ার। আবার ধীরে- ধীরে ছাদের দিকে উঁকি দিল। না, কেউ নেই সেখানে। কিন্তু আনোয়ার জানে সুলেখা আবার আসবে।

সে রাতে আর ঘুম হলো না ওর। সারারাত এপাশ-ওপাশ করল। কয়েকবার মনে হলো কে যেন দরজায় মৃদু শব্দ করছে। ছাদে দ্রুত গতিতে কেউ যেন হাঁটছে। কয়েকবার বাইরে বেরিয়েও আনোয়ার কাউকে দেখতে পেল না। দূরে কোথায় যেন একটা পাখি ডেকে উঠল।

.

সেই রাতের পর থেকে আনোয়ারের জীবনে হঠাৎ যেন দুর্যোগ নেমে এল। প্রতি রাতে সুলেখা ওর কাছে আসতে থাকে। কোনও-কোনও রাতে আনোয়ার ঘুম ভেঙে সুলেখাকে ওর বিছানায় দেখতে পায়। মাঝে-মাঝে চিৎকার করে ওঠে আনোয়ার। কখনও প্রচণ্ড ছটফট করতে থাকে। তখন সুলেখা চলে যায়।

সুলেখা আনোয়ারের সঙ্গে কোনও কথা বলে না। শুধু বিকৃত মুখমণ্ডল নিয়ে আনোয়ারের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই তাকিয়ে থাকার মধ্যেই অনেক কথা লুকিয়ে থাকে। তার কিছুটা আনোয়ার ঠিকই বুঝতে পারে।

সেদিন রাতে সাহসে ভর করে আনোয়ার বলল, ‘কী চান আপনি?’

সুলেখা বিড়বিড় করে কিছু বলল। বোঝা যাচ্ছে ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

আনোয়ার কাছে গিয়ে শোনার চেষ্টা করল। সুলেখা আবার বলল, ‘ক-কষ্ট অ-অ-অনেক ক-কষ্ট।’ রক্তের স্রোত যেন তুমুলবেগে নেমে এল সুলেখার মাথা আর মুখ দিয়ে। পানির একটা ধারাও গড়িয়ে পড়ল চোখ দিয়ে। আনোয়ার বুঝতে পারল সুলেখার কাছ থেকে মুক্তি পেতে হলে ওকে কী করতে হবে।

.

পর-পর তিন রাত না ঘুমিয়ে আনোয়ার কেমন যেন অন্য মানুষ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে মাথার উপর রয়েছে অসহ্য চাপ। নিজেকে খুব অসহায় লাগতে থাকে ওর। সেই সাথে চলতে থাকে বিবেকের দংশন। আনোয়ার একটা সত্য সবার কাছ থেকে গোপন করেছে। সুলেখা আত্মহত্যা করেনি, ওর স্বামী সুনীল ওকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। আনোয়ার সেদিন রাতে পাশের ছাদ থেকে পুরো দৃশ্যটা দেখতে পেয়েছিল। সুনীল সুলেখাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই দৌড়ে নীচে চলে গিয়েছিল। পাশের ছাদ থেকে যে আনোয়ার ওদের দেখেছে এটা সুনীল জানে না। আর সেদিন আনোয়ারদের ছাদের বাতি ছিল নেভানো। তাই সুনীল ধারণা করেছে খুব সুচারুভাবে ও খুনটা করেছে। আসলে তা নয়। সুনীল জানে ওর যেটুকু ক্ষমতা তাতে বিষয়টা সহজেই আত্মহত্যা বলে প্রমাণ করা যাবে। আর কোনও প্রত্যক্ষদর্শী থাকার তো প্রশ্নই নেই। তাই ওর কোনও শাস্তি হবে না। আর সুলেখা যে মানসিক রোগী ছিল এ সংক্রান্ত ভুয়া কাগজপত্রও সুনীল জোগাড় করেছে। পুলিসও তদন্তে খুশি। সত্যি বলতে, সুনীল তাদের খুশি করে দিয়েছে। আর কিছুদিনের মধ্যেই পুলিস রিপোর্ট দেবে, সুলেখা মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল। তাই সে আত্মহত্যা করেছে।

আনোয়ার পুরো বিষয়টা জেনেও চুপ ছিল। অনেক নির্ভার থাকার চেষ্টা করেছে। কারণ ও সুনীলের ক্ষমতা সম্পর্কে জানে। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে গেলে ওর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে যাবে। আর তার সাক্ষ্যতে আদৌ কিছু হবে কি না, এ ব্যাপারেও সে সন্দিহান। তবুও নিজের কাপুরুষতা বারবার আনোয়ারের বিবেককে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সুলেখা সুবিচার চাইতেই হয়তো বারবার ওর কাছে আসে। আনোয়ার এসব থেকে মুক্তি চায়। কাপুরুষ হিসাবে ও বাঁচতে চায় না। আনোয়ার ঠিক করল পুলিসের কাছে সে সব কিছু বলবে।

.

ছাদে দাঁড়িয়ে কেয়াকে সব খুলে বলল আনোয়ার। তার মত শক্ত চরিত্রের মানুষ কথা বলতে-বলতে হঠাৎ কেঁদে উঠল। বড্ড মায়া হলো কেয়ার। শক্ত করে জড়িয়ে রাখল আনোয়ারকে। কেয়া বলল, ‘আপনি, প্লিজ, শান্ত হোন। আমি আপনার পাশে আছি।’

আনোয়ার বলে, ‘আমি একজন মানুষের উপর অবিচার করেছি। একজন খুনির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারিনি।’

‘শুধু আপনি নন, অন্য যে-কোনও মানুষই এমন করত। আর সময় তো এখনও চলে যায়নি। আমি খেয়াকে বলেছি থানায় ফোন করতে। পুলিস কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। আর এই যুদ্ধে আমি সবসময় আপনার পাশে আছি।’

কেয়া আবার বলল, ‘আপনার তো অনেক জ্বর। ইস্! চলুন, মাথায় পানি ঢালতে হবে।’

আনোয়ার বাধ্য ছেলের মত গেল। বিছানায় শুয়েই চোখ বন্ধ করল সে।

কত সময় পার হয়েছে জানে না আনোয়ার। হঠাৎ চোখ মেলে দেখল কেয়া ওর মাথায় পানি ঢালছে। একটু দূরে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে আনোয়ারের বাবা। আনোয়ার একটা ঘোরের মধ্যে আছে। সে সুলেখাকেও দেখতে পেল। লাল একটা শাড়ি পরেছে সুলেখা। কী সুন্দর করে সেজেছে ও! বিকৃত শরীরেও এখন তাকে সুন্দর লাগছে।

পুলিসের গাড়ির সাইরেন শুনতে পেল আনোয়ার। আবার ওর চোখ বন্ধ হয়ে এল।

বারবার চোখ মেলে কেয়ার উদ্বিগ্ন মুখ দেখে আশ্বস্ত হলো আনোয়ার। ও জানে এমন একটা মায়াবী মুখ ওকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ভয়
1 of 2

ভয়

ভয়

বন্দুক হাতে সেনারা ঘুরছে, চারদিকে,
মাঝখানে নিরস্ত্র আমি।
সেনারা কেউ আমাকে চেনে না, নিরস্ত্র নারীর দিকে
মাঝে মাঝে অদ্ভুত চোখে তাকায়।
কেউ জানে না এখানে হঠাৎ কী কারণে আমি!
ময়লা শরীর, মলিন কাপড়চোপড়, মনমরা উড়ুককু চুল,
গায়ে পায়ে শেকল নেই আমার, কিন্তু কোথাও না কোথাও আছে,
টের পায় ওরা, চাইলেও দু পা এগোতে পারবো না টের পায়।
ওদের চোখের তারায় বীভৎস এক টের পাওয়া দেখি।

বন্দুকগুলো, জানে ওরা, ভয় দেখাতে,
বেয়নেটগুলো, বুটজুতোগুলো ভয় দেখাতে।
ভয় না পেলে ওরা আঘাত পাবে খুব,
কাউকে আঘাত দেওয়ার অধিকার আমার আইনত নেই।
ওরা যদি ওপরতলায় খবর পাঠিয়ে বলে, এর তো দেখি ডর ভয় নেই।
শেকল ভাঙতে চাইছে প্রাণপণে!

ওপরতলা আমাকে নির্ঘাত ফাঁসি দেবে। ফাঁসির দিনক্ষণ ঠিক হলে,
খেতে দেবে মাছের ঝোল, ইলিশচিংড়ি ইত্যাদি।
যদি বলি, খাবো না!
ফাঁসির মঞ্চে উঠে যদি একটাও দীর্ঘশ্বাসনা ফেলি?
গলায় দড়ি পরাবার পরও যদি ভয় না পাওয়ার দুঃসাহস আমার হয়?

০৪.০১.০৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *