ভয় পেয়ো না – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

ভয় পেয়ো না – দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

এই ভিড়ে ঠাসা স্টেশনে ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও সুমনের শিরদাঁড়া বরাবর একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। সে নিজের আগের মুহূর্তের দেখাটাকে মুছে ফেলতে চোখ বন্ধ করল। নিজেকে বোঝাল সে ভুল দেখেছে। তারপর চোখ খুলল।

শশব্যস্ত হাওড়া স্টেশন। সবাই হুটোপাটি করছে। পাশাপাশি তিনটে ট্রেন ঢুকেছে। শতশত লোক। তার মধ্যে একটা মেনলাইন বর্ধমান লোকাল অ্যানাউন্স হয়ে গেছে। দৌড়াদৌড়ির পরিবেশ। শুধু সুমন পত্রপত্রিকার হুইলার স্টল ঘেঁসে থমকে দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়ের মধ্যে ওই অদ্ভুতদর্শন লোকগুলো কারা? সংখ্যায় জনা-সাতেক। চেহারা সাধারণ মানুষের মতো হলেও চোখমুখ অবিশ্বাস্যরকম থমথমে। কারও চোখ যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। কারও বা এমন কোটরাগত, যে চোখ আছে কিনা বোঝার উপায় নেই। হালচাল দেখে মনে হচ্ছে কোথায় যাবে বুঝতে পারছে না। অথচ আশ্চর্য রকম নির্বিকারভাবে হাঁটছে।

এরা কারা? ওদের পাশে পাশে যারা চলেছে। তাদের কারো কি ব্যাপারটা চোখে পড়েনি? নাকি গন্তব্যে যাওয়ায় ব্যস্ততায় কেউ আমল দিচ্ছে না? তাহলে সুমনের এমন অস্বস্তি লাগছে কেন? সুমন একটু ভরসা পেতে পাশের একজনকে ছুঁয়ে দেখল। তাতে ভদ্রলোক একটু বিরক্তি প্রকাশ করায় সুমন চিন্তাটা মন থেকে তাড়াতে অন্য দিকে ঘাড় ঘোরাল। আরো ওদিকেও তো দুজন একইরকম লোক! এমন হচ্ছে কেন আজ তার সঙ্গে? সুমনের সব ধারণাগুলো কেমন ঘেঁটে যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটার ধকল এখনও কাটেনি সুমনের।

স্টাডি লিভের ভেতর স্যার হঠাৎ করে ডেকে পাঠানোয় তার ইউনিভার্সিটি আসা। আসার ইচ্ছা ছিল না। সুমনের দেখতে সমস্যা হচ্ছিল। আগেরদিন হাত থেকে পড়ে চশমাটার একদিকের কাচ ভেঙেছে। দোকানদারের দেওয়া একটু কম-পাওয়ারের টেমপোরারি চশমাটায় চারপাশ দেখে সন্তুষ্টি হচ্ছে না। এই অবস্থায় স্যারের অর্ডার—’চটপট চলে এসো। তোমার প্রোজেক্ট রিপোর্টটায় কিছু যোগবিয়োগ করতে হবে।’

অগত্যা আসতেই হল। আর এই গঞ্জের দোকানগুলোও হয়েছে বটে! আজকের দিনে এসেও আধুনিক হল না। লেন্সের কাজ সেই কলকাতা থেকেই করে আনবে। ফল, একদিনের অসুবিধা ভোগ করো!

সুমনের সারাটা দিন তেমন কিছু অস্বাভাবিক কাটেনি।

কাজ মিটিয়ে কলেজ স্ট্রিট ফেরত জ্যামে পড়েছিল। তাই বাস থেকে নেমে ছ-টা পঞ্চান্নর কর্ড লাইন লোকালটা ধরবার জন্য প্রায় দৌড় লাগাতে হয়েছিল। রাস্তা পেরিয়ে, যত জোরে পা চালানো সম্ভব চালিয়ে সে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে গিয়েছিল। ট্রেন ধরা ছাড়া অন্য কোনো কথা মাথায় রাখার সময় ছিল না তার। অবশ্য তাতেও একটু দেরি হয়ে যায়। চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা লাইন ধরে দূরে চলে যাচ্ছে দেখে সুমন বিষণ্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই তার মনে হল চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে তারা কেউ ‘পাবলিক’ নয়। যেন অনেকগুলো ছায়া তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আচমকা কোনো দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়ে গেলে যেমনটা হয়, সুমন সেভাবেই বিভ্রান্ত ভয়ার্ত হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখেছিল যে সবার পায়ের পাতা পিছনে গোড়ালি সামনে।

লোকে ভয়ের স্বপ্ন ভাঙতে চোখ খুলে চেনা চারপাশ দেখে নেয় আশ্বস্ত হতে। সুমন খোলা চোখে আতঙ্কের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছিল। তাই ভয় কাটাতে সে চোখ বন্ধ করেছিল। আর ভাবতে চেষ্টা করেছিল সে ভুল দেখেছে।

এরপর থেকে ওই অবাস্তব লোকগুলো সুমনের চোখের আড়াল হতেই চাইছে না। সুমনের ভয় বাড়ছিল। এত আলো, এত লোকজনের মধ্যে থেকেও মনে হচ্ছিল—সে অন্ধকারে একা।

সুমন এবার পত্রপত্রিকা বিক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল।

‘দাদা, ওই অদ্ভুত লোকগুলোকে দেখেছেন? কারা বলুন তো?’

সামনে সুমনকে অকারণে অস্থির দেখে দোকানদার কিছু বুঝতে পারল না। সে সুমনের আঙুলের ইশারা মতো প্ল্যাটফর্মে ডিসপ্লে বোর্ডটার নীচেটায় হালকা চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘কোন লোক দুটো? কোনো টিভি আর্টিস্ট?’

সুমন তাঁকে শুধরে দিয়ে আসল লোকদুটোকে দেখাতে চাইছিল। কিন্তু লোকদুটো তাদের ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দুটো পাকিয়ে এমনভাবে তাকিয়েছিল—যেন সুমনকে শাসন করছে। সুমনের গলা দিয়ে এরপর আর আওয়াজ বেরল না। লোক দুটো তার দিকেই এগিয়ে আসছে দেখে সে পালিয়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে চাইল। কিন্তু কোন ভিড়? কোথায় মিশে যাওয়া? ওই অবাস্তব লোকগুলোও তো ভিড়ের মধ্যেই মিশে রয়েছে। তারাই সুমনের পাশে চলে এসেছিল। তারপর থেকেই একটা ভয় সুমনকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।

‘সাতটা সতেরোর মশাগ্রাম লোকাল সাত নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে।’

অ্যানাউন্সমেন্টটা কানে আসতেই সুমন প্রায় অন্য কোনো দিকে না-তাকিয়ে সাত নম্বর প্ল্যাটফর্মে চলে এল। ঠাসাঠাসি লোকজন। কে আগে দৌড়ে উঠে বসার জায়গা নিতে পারে তার প্রতিযোগিতা। ট্রেন ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে ঢুকল। সুমন যে কামরাটা সামনে পেল ভিড়ের পিছন পিছন উঠে পড়ল। বসার সুযোগ না-পেলেও দাঁড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত জায়গা জুটিয়ে নিয়ে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে স্টেশনের দিকে ফিরে চাইল। না, তেমন কিছু নেই। শুধু জনঅরণ্য। প্রতিদিনের মতো। সে নিশ্চয়ই ভুল দেখছিল। ওসব কিছু নেই। কুসংস্কার, মনের ভুল।

বালীতে বেশ কিছু লোক নামার পর ডানকুনিতে এসে ট্রেন প্রায় খালি হয়ে গেল। সুমনকে সেই বারুইপাড়া পর্যন্ত যেতে হবে। সে জানলার ধারে সিট বাগিয়ে নিয়ে বাইরের হাওয়ায় নিজেকে মেলে ধরল। বেশ আরাম!

‘বাড়ি ফেরার সময় কোলেদার দোকান থেকে চশমাটা নিতে হবে। ভারি অসুবিধা হচ্ছে এই ভুলভাল চশমাটায়।’ সুমন নিজেকে বলে মনে মনে। আর কোলেদাটারও হয়েছে আজব স্বভাব। সারাদিন পাগলের মতো ঘসা কাচ নিয়ে কী সব গবেষণা করে চলেছে। ব্যবসায় মন নেই। আজকের কাজ কাল। কালকের কাজ পরশু করব ভাব। এইভাবে কাস্টমারকে ঠিকঠাক সার্ভিস দেওয়া যায়! এই যে সুমন ভুগছে—কম তো দেখছেই, প্লাস উলটোপালটা দেখছে—এর জন্য কী কোলেদার ঢিলেমি দায়ী নয়! দশ বছর হয়ে গেল ব্যবসার, নিজে নিজে লেন্স পালটানোর পরিকাঠামো তৈরি হল না। সুমনের সব রাগ ভরতকোলের ওপর গিয়ে পড়ে। আজ কী ভয়টাই না-পেয়েছিল সে! হয়তো চশমার পাওয়ারের গোলমালের জন্যই সে স্বাভাবিক মানুষজনকে বিকৃত অবস্থায় দেখেছে। সুমন অন্য সম্ভাবনাটা নাকচ করে আশ্বস্ত হতে চায়।

যাক গে! যা হয়েছে হয়েছে। ব্যাপারটা ভুলে যাওয়াই ভালো।

‘কী হয়েছে? এতো ঘামছ কেন?’

পাশের যাত্রীর এই কথায় সুমন নিজের জামাতে হাত রাখল। জামাটা জ্যাবজ্যাবে হয়ে ভিজে গেছে। সুমন মনে মনে বলল—আসলে ঘাম দিয়ে ভয় ছাড়ছে। মুখে বলল, ‘কই না তো। ওই যা ঠেলাঠেলি ভিড়।’

‘কোথায় ভিড়? আজ তো ট্রেন ফাঁকা!’

‘আসলে আমার একটুতেই ঘাম হয়। হাওড়ায় দৌড়াদৌড়ি হয়েছে তো।’

পাশের যাত্রী কিছুটা নিশ্চিন্ত মুখ করে বলল, ‘ও, আমি ভেবেছিলাম, বুঝি শরীর খারাপ লাগছে।’

সুমনের আর কথাবার্তা এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না।

সে ঘাড় ফিরিয়ে ট্রেনের ভিতরটায় চোখ বুলিয়ে নিল। গরমের দাপটে সবাই কম বেশি কাহিল। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছে। সুমনের পাশাপাশি উলটোদিকের সিটগুলো প্রায় ফাঁকা। একদম কোণের সিটের লোকটা তো পা তুলে উবু হয়ে বসে আছেন। যদিও মুখটা অন্যদিকে তবে দেখে মনে হচ্ছে কোনো মেঠো লোক হবে। পরনে ময়লা ফতুয়া, নোংরা ধুতি, পিছন থেকেই বোঝা যাচ্ছে উসকো-খুসকো চুল। সুমন এইটুকু দেখা সেরে নিয়ে আবার জানলার দিকে ফিরল। কামরার পিছন দিকে একজন হকারের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ট্রেন থামল। জনাই রোড এল বোধহয়।

স্টেশন পার হতেই বাইরের দৃশ্যরা অন্ধকারে হারাল। পিছনের হকারটাও বোধহয় বকবক করতে করতে থেমে গেল। সুমন যাবে বারুইপাড়া। এখনও দুটো স্টেশন।

অন্যদিনের চেয়ে আজকের যাত্রা যেন বড্ড তাড়াতাড়ি শুনশান হয়ে আসছে। যদিও তার পাশে বসে থাকা ভদ্রলোকের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। তিনি আবার কখন জিজ্ঞাসা করে বসবেন—শরীর খারাপ কিনা। সুমন নিজেকে একবার পরখ করে নিল। না, আর ঘাম হচ্ছে না।

এককীত্ব কাটাতে সে ভদ্রলোককে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কতদূর যাবেন?’

সুমনের প্রশ্নে ভদ্রলোক চট করে উঠে পড়ে উত্তর দিলেন, ‘এই তো নামার সময় হল। বেগমপুর।’

তিনি উঠে চলে যাচ্ছিলেন কিন্তু হঠাৎ কী দেখে আঁতকে উঠে সুমন তাঁকে হাত টেনে বসিয়ে দিতে চাইল। ভদ্রলোক হতচকিত হয়ে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল।

‘আপনি কি পাগল নাকি? না-কিছু ছিনতাইয়ের মতলব।’ লোকটি সুমনের ওপর চড়াও হয়।

সুমনের গলা থেকে আওয়াজ সেটুকু বেরল তাতে সে কাতর হয়ে বলল, ‘ওই সিটের লোকটাকে দেখুন। আমার প্রথমেই বোঝা উচিত ছিল!’

‘কোন সিটের? কোথায় লোক? ইয়ার্কি পেয়েছেন?’

‘ওই যে! পা তুলে উবু হয়ে বসে থাকা লোকটা! ওর পায়ের দিকটা লক্ষ করুন।’

আমি তখনই বলতে চাইছিলাম, ‘তোমার শরীর খারাপ। এখন বুঝতে পারছ।’

সুমন কিছু বুঝতে পারছিল না। ইনি কি লোকটাকে দেখতে পাচ্ছেন না? হে ভগবান! সে চিৎকার করে ওঠে, ‘হবহু এইরকম লোক আমি হাওড়া স্টেশনেও দেখেছি। ওই যে ওইখানে বসে আছে…….।’

‘একজন ভূত তাইতো? ‘লোকটা হাঃ হাঃ করে কয়েক মুহূর্ত হেসে নিল। তারপর সুমনকে ধমকে বলল, ‘দেখে তো কলেজ টপকেছ মনে হচ্ছে। তবু এমন ছেলেমানুষি? আর অতই যখন ভয়, তখন একা একা বেরিয়েছ কেন।’

লোকটার হাসিটা আস্তে আস্তে কেমন দুর্বোধ্য কুটিল হয়ে গেল। সুমনকে একা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই একটা থমথমে ভাব ছেয়ে ফেলল পরিবেশে। লোকটা প্ল্যাটফর্মে নেমে গেল, না-মিলিয়ে গেল? ভাবনাটা আসতেই সুমনের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। স্টেশন থেকে একজন মানুষও কি উঠছে? সুমন রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করে।

না, কেউ নেই। এবার শুধু সে আর ওই উবু হয়ে বসে থাকা লোকটা। এতক্ষণ সে এককোণে বসে ঝিমোচ্ছিল। এখন চিৎকার চেঁচামেচিতে জেগে বসেছে। ঠিক হাওড়ায় দেখা অবাস্তব লোকগুলোর মতো থমথমে মুখ। ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখদুটো দিয়ে দেখছে। যেন সুমনের দেহ থেকে সব কিছু শুষে নিতে চায়। এমন ভয়ানক দৃষ্টি। সুমন এখন ঘামছে না। তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে দিলে হয়তো বেঁচে যাবে। ঝিকঝিক ঝিকঝিক আওয়াজ করে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। কিন্তু পরের স্টেশনটা কি কোনো দিন সুমনের জন্য আসবে? লোকটা নড়েচড়ে বসল। এবার কি উঠে এগিয়ে আসবে? কামরায় আর কেউ নেই। ভর সন্ধেবেলা এই কর্ড লাইন লোকাল জনশূন্য হয়ে যাওয়াও ওই লোকটার উপস্থিতির মতো অবাস্তব ঘটনা। সুমন জানে এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। বিশ্বাস করেওনি।

লোকটা উঠছে! এগিয়ে আসছে। কঙ্কালসার হাতে লম্বা লম্বা নখযুক্ত আঙুল। হয়তো তেড়ে এসে সুমনের গলাটা ওই হাত দিয়েই চেপে ধরবে। সুমন দরজার কাছে দৌড়ে যায়। এরপর পালাতে হলে একটা লাফ দিতে হবে। কিন্তু তারপর?

সুমন পিছন হাঁটছিল লোকটার গতিবিধির দিকে নজর রাখতে রাখতে। ট্রেনটা ব্রেক কষল। হঠাৎ সুমন শূন্যে ঝুলে গেল কয়েক পলকের জন্য। সে পড়েই যাচ্ছিল, কে তার হাত টেনে ধরেছে।

‘কোলেদা!’

‘কী-রে? কী ব্যাপার? ফাঁকা ট্রেনে এমন করে ঝুলছিলি কেন?’

‘কোলেদা ও কে?’ সুমন কাঁপা কাঁপা আঙুল নেড়ে অদ্ভুত লোকটাকে দেখায়। লোকটা এখন সুমনের ছেড়ে আসা জায়গাটায় বসে আছে। জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে।

‘ওই লোকটা…আমাকে মেরে ফেলবে…!’

সুমন কাঁদোকাঁদো স্বরে বলে চলেছিল।

‘ও কিছু নয়। আমার আনমনে বড়ো ভুল হয়ে গিয়েছিল রে। এখন তোর নিজের চশমটা নে তো। দ্যাখ, একদম নতুন বানিয়ে দিয়েছি।’

কোলেদা সুমনকে শান্ত করতে করতে নিজের ব্যাগের ভিতর হাত ঢোকাল। সেখান থেকে একটা ছোটো পলিথিনের প্যাকেট তুলে নিল। এরপর সেটা সুমনের হাতে দিল। সুমন চোখে পরে থাকা চশমাটা খুলে নিয়ে আসল চশমাটা চড়িয়ে নিল। ট্রেনের গতি আস্তে আস্তে আরও কমে আসছিল। সুমনের কাঁপুনি তখনও কমেনি। কোলেদা হাস্যমুখে সুমনের নাকের ওপর চশমাটা আরেকটু ঠিকঠাক করে দিয়ে বলল, ‘দেখে নে। সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিস কিনা।’

কোনও দিকে না-তাকিয়ে নিজের ছেড়ে আসা জায়গাটার দিকে দেখে সুমন। তার হৃৎস্পন্দনের ধকধক শব্দটা বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে। ‘কোলেদা, ওই লোকটা!’

কোথায় গেল লোকটা! সুমনের ছেড়ে আসা জায়গাটা তো ফাঁকা। সুমন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

‘আরে বোকা। অত ভয় পাওয়ার কী আছে। এই যে হাওড়া, শিয়ালদায় এত লোকে লোকারণ্য প্রতিদিন। ওদের সবাই কি আর মানুষ?’ পিছন থেকে কোলেদা ফিসফিস করে বলল।

‘তাহলে কি?’ ঘুরে তাকাতে গিয়ে ট্রেন থামার ঝাঁকুনিতে সুমন উলটে যাচ্ছিল। বারুইপাড়া এসে গেছে।

সে ঘোর কাটিয়ে তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্মে পা রাখল। ‘কোলেদা কী বলছিলে?’ সুমন বেশ জোরালো আওয়াজে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল।

কোনো উত্তর ফিরে এল না। ‘কোলেদা?’ ট্রেন থেকে নামার মতো ওই কামরায় আর কাউকে দেখতে পায় না সুমন।

প্ল্যাটফর্মে দুজন অফিস ফেরত মধ্যবয়সি ভদ্রলোক সুমনের কাছে চলে এসেছিল।

তাঁরা সুমনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো তো। বেগমপুর থেকে আমাদের এক বন্ধু মোবাইলে ফোন করে বলল—এই কামরায় তুমি নাকি একা পড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছ। তাই দেখতে এলাম।’

সুমনের শরীর তখনও আতঙ্কে শক্ত হয়ে আছে। সে বলতে চাইছিল, ‘এই কামরায় হাত-পা বাঁকা একজন লোক…।’

কিন্তু তার কথা তাঁরা শেষ করতে দিল না। বলল, ‘ও কিছু নয়। আসলে প্রতিবন্ধীদের একটা সম্মেলন ছিল তো। সব ওই কামরাটায় উঠেছিল। বেশির ভাগ ডানকুনিতে নেমে যাওয়ায় একদম খালি হয়ে গেছে। তুমি কামরা চেঞ্জ করে নিতে পারতে তো। একা একা অসুবিধায় পড়তে হত না।’

সুমন চেঁচিয়ে ওঠে, ‘প্রতিবন্ধী নয়। হতে পারে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি। বিশ্বাস করুন!’

লোকদুটো অবিকল ট্রেনের ভদ্রলোকের মতো হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল। তারপর কুটিল ভ্রূ ভঙ্গি করে বলল, ‘তবে কি ভূতের সঙ্গে সফর করছিলে তুমি?’

সুমনের মনে হল এবার এরাও অদৃশ্য হয়ে যাবে।

সে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে দৌড় লাগাল। সিঁড়ি ভেঙে বাজারে নেমে মনাদার সাইকেল স্ট্যান্ডে গিয়ে হাঁপাতে লাগল। সুমনকে সাইকেল ধরিয়ে দু-টাকার খুচরোটা নিতে নিতে মনাদা বলে, ‘কলকাতা থেকে এলি? চশমা দোকানের কোলের খবরটা শুনেছিস? আজ কীভাবে কে জানে বেগমপুরে ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে…..।’

খবরটা শুনে সুমনের থমকে থাকার সময় ছিল না। তাকে পালাতে হবে। সে যা দেখেছে সেটা বললে মনাদা কি বিশ্বাস করবে? নাকি ‘হাঃ হাঃ’ করে হাসতে হাসতে হাওয়া হয়ে যাবে? সে সাইকেল নিয়ে চটপট এগিয়ে গেল।

‘দুর্ঘটনা কখন কীভাবে আসে। মানুষ এই আছে এই নেই!’

সুমন এসব কথায় কর্ণপাত করে না। কোলেদা তাকে চশমা দিয়ে গেল। অথচ মনাদা বলছে—কোলেদা নেই। কিন্তু মনাদা জলজ্যান্ত না-অবাস্তব? সুমন এবার সেই ধোঁয়াশায় হারিয়ে যেতে চলেছে। সে পিছন ফিরে না-তাকিয়ে তাড়াতাড়ি সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয়।

ওপরের আকাশে কৃষ্ণপক্ষের একফালি চাঁদ। ঝোড়ো বাতাস গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। সুমন পিচ রাস্তা ধরে প্রাণপণ বাড়ির দিকে।

আচ্ছা, কোলেদা কি ভুল করে ফেলেছিল? ঘসাকাচ নিয়ে এলোমেলো গবেষণা করতে করতে নতুন কিছু বানিয়ে ফেলেছিল? যা দিয়ে আরেকটু বেশি কিছু দেখা যায়? তার জন্যই কি আজ?

সুমন সাইকেলে গতি বাড়াল। একটু আগে মনাদা বলল, মানুষ এই আছে, এই নেই। কয়েক ঘন্টায় এ ব্যাপারে অনেক কিছুই অনুভব করেছে সে। সুমন তার নিজের চশমার ভিতর দিয়ে হালকা আলোয় পারিপার্শ্ব দেখতে থাকল। কিছুটা দমকা হাওয়া ঘাড়ে ঝাপটা মেরে চলে গেল। ওই তো রাস্তার একপাশে একটা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকাচ্ছে। সামনের মোড়ের বকুলগাছের ডালটা হঠাৎ অস্বাভাবিক কেঁপে উঠল। ইচ্ছা না-থাকলেও সে-সব দিকে সুমনের চোখ চলে যাচ্ছিল। সতর্কভাবে। সে কিছু দেখতে পেল না। তবু কেউ যেন কানের কাছে ফিসফিস করে বলল—আছে। চারপাশে এত উপস্থিতি, এত স্পন্দন তার সবটুকুই কি মানুষের?

হঠাৎ সুমনের মনে হল জামার বুক পকেটটা ভারী ভারী লাগছে কেন? চশমা পালটানের সময় খুলে ফেলা চশমাটা সে ট্রেনে রেখে এল? না……পকেটে রাখল? নাকি কোলেদা নিজের ভুল নিজেই নিয়ে গেল? সুমন আস্তে আস্তে কাঁপাকাঁপা ডান হাতটা পকেটের ওপর রাখতে যায়। এবার দমকা হাওয়াটা আরও জোরদার হল। দূরে কটকট করে পোকা ডেকে থেমে গেল। হাওয়ার বিপক্ষে একহাতে চালাতে গিয়ে টলে গেল সাইকেলটা, আর কেমন যেন গা ছমছম করে ওঠল সুমনের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *