ভয় ও ভূত – সুকুমার সেন
সত্য ঘটনা৷ নিজেদের অভিজ্ঞতা৷ সুতরাং নামধাম ঢাকবার কোনো প্রয়োজন নেই৷ আমি আর বিমলেন্দু ইস্কুলের ফিফথ ক্লাসে—এখনকার ক্লাস সিক্সথে তিন-চার দিন আগে-পিছে ভর্তি হয়েছিলুম৷ ও এসেছিল পাড়া-গাঁ থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে শহরের ইস্কুলে পড়তে৷ আমি তো বর্ধমান শহরেই থাকতুম৷
দু-চার মাসের মধ্যেই বিমলেন্দুর সঙ্গে আমার প্রগাঢ় ভাব হয়ে গেল৷ এ ভাব বরাবর অটুট ছিল৷ বর্ধমানে দুজনে একই ইস্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করি, একই কলেজ থেকে আই.এ. পাস করি৷ তার পর কলকাতায় এসে আমাদের কলেজ ভিন্ন হয়৷ কিন্তু ছাড়াছাড়ি হয় না৷
আমি এম. এ. পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে থাকি৷ বিমলেন্দু এম.এ. পাস করে ভারত গভর্নমেন্টের হায়ার সার্ভিসের পরীক্ষা দেয় ও আয়কর বিভাগে কাজ পায়৷ প্রথমে কয়েক বছর ও কলকাতাতেই ছিল৷ যদিও ওর চাকরি বদলির৷ বিমলেন্দু চাকরি নিলে, আমি পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলুম উপযুক্ত কোনো চাকরির সন্ধান না পেয়ে৷ আমাদের দুজনের মেলামেশা আগেকার মতোই অক্ষুণ্ণ চলতে লাগল৷
যেদিনের কথা বলতে যাচ্ছি তখন বিমলেন্দুর বিয়ে হয়েছে, তবে তখন ওর স্ত্রী বাপের বাড়িতে ছিল৷ কলকাতায় তখন তার বাসা ছিল বাগবাজার অঞ্চলে৷ সংসারে তখন বিমলেন্দু ও তার মা ছাড়া আর কেউ নেই৷ আমি থাকি গোয়াবাগানে মামার বাড়িতে৷
একদিন কথা হল শনিবার সন্ধ্যায় কর্নওয়ালিস থিয়েটারে সিনেমা দেখবার৷ আমি বিকেলে বিমলেন্দুর বাড়ি যাব৷ সেখান থেকে ছটার শোয়ে ছবি দেখে বাসায় ফিরব৷ সেদিন বিকেলের আগেই বিমলেন্দু আমার কাছে এসে হাজির আপিস-ফেরতা৷ বললে, ‘‘সন্ধ্যার শোয়ের টিকিট পাইনি তাই রাত্রির শোয়ের টিকিট কিনেছি৷ সেই কথা তোকে জানাতে এলুম৷’’
আমি বললুম, ‘‘এখানে সাপারের যে বন্দোবস্ত তাতে রাত্রির শোতে যেতে অসুবিধা হবে৷’’
বিমলেন্দু বললে, ‘‘তার ভাবনা কী? তুই আমার কাছে খাবি৷ তারপর ছবি দেখে বাড়ি ফিরবি৷ যা, ভিতরে গিয়ে বলে আয়৷’’
আমি মামিমাকে বলে এলুম রাত্রিতে বিমলেন্দুর বাড়িতে খাব৷ তারপর বিমলেন্দুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম৷
ওর বাড়ির গলিতে ঢুকে মনে হল শনিবারের বিকেলের পক্ষে বড় নির্জন বোধ হচ্ছে৷ বিমলেন্দুকে জিজ্ঞাসা করলুম৷ ও বললে, ‘‘আমার বাসার সামনাসামনি যে ভদ্রলোক থাকতেন তিনি রাত্রিতে মারা গেছেন৷ তিনি পাড়ার একজন চাঁই ছিলেন৷’
তারপর রাত্রি সাড়ে-আটটার সময় খাওয়াদাওয়া করে নটার শো দেখতে গেলুম কর্নওয়ালিস থিয়েটারে৷ শো ভাঙতে পৌনে বারোটা বেজে গেল৷
রাস্তায় নেমে বিমলেন্দু বললে, ‘‘রাস্তা তো খুব ফাঁকা দেখছি৷ দুজনের তো একলা একলা যেতে হবে দুদিকে৷ তার চেয়ে চল আমার সঙ্গে৷ ওখানে রাত কাটিয়ে সকাল বেলায় গোয়াবাগানে ফিরবি৷ ওঁরা তো জানেন যে আমার কাছে এসেছিস৷ তাই ভাবনাচিন্তা করবেন না৷’’
আমি সায় দিলুম৷ একটা রিকশ করে দুজনে বাগবাজারে ফিরে এলুম৷
বিমলেন্দুর বাসায় ওপরে তিনটি ঘর ও ফালি বারান্ডা৷ একটি ঘর মায়ের, একটি ঘর বিমলেন্দুর বসবার, আর একটি ঘর তার শোবার৷
বিমলেন্দু এসেই বললে, ‘‘একটু চা খাওয়া যাক৷’’ চা দুধ চিনি জল স্টোভ কেটলি কাপ ডিশ ছাঁকনি, সবই ছিল তার শোবার ঘরে এক পাশে৷ প্রাইমাস স্টোভ জ্বালিয়ে সে চায়ের জল চড়িয়ে দিলে৷ চা হল, আমি আধ কাপ খেলুম৷ তারপর দুজনে শুয়ে পড়লুম৷ আমাকে ও শোয়ালে খাটের ওপর, আর নিজে সে শুল মেজেতে একটা মাদুর পেতে আর বালিশ, পাশ-বালিশ নিয়ে৷ এমনি করেই ও শুতে ভালোবাসত৷
শুয়ে শুয়ে কিছু কথাবার্তা হতে হতে বিমলেন্দু পড়ল ঘুমিয়ে, আর আমার চোখে ঘুম আসে না৷ এটা একটু অস্বাভাবিক ব্যাপার৷ আমিই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ি, বিমলেন্দু নয়৷ ভাবলুম নতুন জায়গা ‘ঠাঁই নাড়া’ হয়েছে বলে ঘুম আসছে না৷ যাই হোক, অনেকক্ষণ পরে ছেঁড়া-ছেঁড়া রকম ঘুম এল৷ কিন্তু হঠাৎ কিছুর শব্দ শুনে তড়াক করে ছেঁড়া ঘুমের স্বপ্নতন্তু ছিঁড়ে গেল৷ আমি মুহূর্তমধ্যে সজাগ হলুম আর মনে পড়ল সামনের বাড়ির মৃত্যুর কথা৷ অমনি ভয়ের প্রস্রবণ আমাকে আচ্ছন্ন করলে৷ আমি অনড় হয়ে কান পেতে আছি সে অস্ফুট শব্দের জন্য৷ শব্দ শুনলুম, একটুক্ষণ করে বাদ দিয়ে কয়েক বারই শুনলুম৷ মনে হল শব্দটা মেটালিক, কিন্তু বাসন মাজার শব্দ নয়, টিন কাটার শব্দ নয়, শান দেবার শব্দ নয়৷ কিসের শব্দ?
ভয়ে অভিভূত হয়ে মনে হল বিমলেন্দুকে জাগিয়ে দিই৷ কিন্তু প্রচণ্ড ভয় পেলেও আমার সুবিবেচনা একেবারে লোপ পায়নি৷ একে ওর ঘুম কম, তাতে যদি কাঁচা ঘুমে উঠিয়ে দিই তবে আর তার ঘুম হবে না৷ তাছাড়া ও যদি আমাকে ভয়কাতুরে বলে উপহাস করে, তা আমি সইতে পারব না৷
তখন মনের রাশ জোর করে ধরে ভাবতে লাগলুম, শব্দটা আসছে গলির দিক থেকে নয়, আসছে ভিতরের বারান্ডার দিক থেকে৷ এই সিদ্ধান্তে ভূতের ভয় এক ডিগরি কমে গেল৷ বারান্ডার কথা ভাবতে ভাবতে মনে হল, এই ঘরেরই কাছে বারান্ডার শেষে করোগেটের পার্টিশন আছে এবং সেই পার্টিশনের গায়ে জলের কল লাগানো আছে৷ এইটুকু মনে পড়তেই চড়াং করে ভয়ের সমাধান হয়ে গেল৷ দিনের বেলায় তাপে সিসের নল একটু বেড়ে ওঠে, শেষরাত্রিতে ঠাণ্ডা পড়ায় সে বাড়টুকু কমে যায় এবং সিসের নল সঙ্কুচিত হওয়ার দরুণ করোগেট টিনে একটু ঘষড়ানি হয়৷ সেই শব্দই আমি শুনেছি৷ ঠিক হোক চাই নাই হোক, এই ব্যাখ্যা আমার মনে ওঠায় ভয় জল হয়ে গেল৷ আমি দু-এক মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লুম৷ সকালের আগে আর ঘুম ভাঙেনি৷
আমার এই অভিজ্ঞতার সারমর্ম হল, ভয় ঠেকালে ভুত ঠেকানো যায়৷
তারপর বিমলেন্দুর যে অভিজ্ঞতার কথা বলছি তা ঘটেছিল বছর সাত-আট পরে৷ বিমলেন্দু তখন বর্ধমানে আয়কর অফিসার৷ তার উপর বীরভূম ও বাঁকড়ো জেলার ভারও আছে৷ এসব জেলায় কাজের জন্যে তাকে মাঝে মাঝে ট্যুর করতে হয়৷ এইরকম এক ট্যুরেই ব্যাপারটা ঘটেছিল৷
বিমলেন্দু বর্ধমানে আছে, আমি সপ্তাহান্তিকে বর্ধমানে যাই৷ শনি রবি সোম তিন দিন সেখানে থাকি, বিমলেন্দুর সঙ্গ পাই৷ দিন বেশ ভালোই কাটে৷
এক সপ্তাহে বর্ধমানে গিয়ে শুনলুম, বিমলেন্দু ট্যুরে গেছে৷ সেবারে দেখা হল না৷ পরের সপ্তাহে দেখা হল৷ তার কাছে শুনলুম সেই ট্যুরের এক আশ্চর্য কাহিনী৷ সে কথা আমি বিমলেন্দুর জবানিতেই লিখছি৷
‘‘গিয়েছিলুম বাঁকড়ো জেলার গহনে এক গণ্ডগ্রামে৷ সে গ্রামে কিছু আড়তদার ব্যবসাদার আছে৷ ডাকবাংলো আছে৷ সুতরাং ওখানে গিয়ে তদন্ত করতে অফিসারদের কোনো অসুবিধা হয় না৷ এই সব বুঝে আমি গেলুম সেখানে এনকোয়ারিতে কাগজপত্র ও সেরেস্তাদারকে সঙ্গে নিয়ে৷
‘‘বেলা তিনটে নাগাদ ডাকবাংলোয় পৌঁছলুম৷ অভ্যর্থনা করতে স্থানীয় ভদ্রলোকেরা এসেছিলেন৷ বাংলোটি মন্দ নয়৷ বেশ নির্জন, একটু যেন বেশি নির্জন বলে মনে হল৷ গ্রাম সেখান থেকে অন্তত আধমাইল দূরে৷ গাঁ আর বাংলোর মধ্যিখানে কোনো বসতি নেই, জঙ্গল আর মাঠ৷
‘‘হাতমুখ ধুয়ে ডাকবাংলোর সর্দারকে চা করে আনতে বললুম৷ সে চা করে এনে দিল৷ চা খেতে খেতে তাকে নির্দেশ দিলুম রাত্তিরের খাবারের৷ সর্দার বিনীতভাবে বললে, ‘হুজুর, আপনার রাত্তিরের খাবার গাঁয়ে গিয়ে খাবেন৷ এখানে কেউ রাত্তিরে খাবার খায় না৷ আমরা সবাই সন্ধের পর এখান থেকে গাঁয়ে চলে যাই৷ হুজুরও যাবেন৷’
‘‘আমি অবাক হয়ে বললুম, ‘সে কী ব্যাপার, কী পাগলামি বকছ তুমি?’
‘‘ও বললে, হুজুর সন্ধের পর এখানে ভূতের উপদ্রব হয়, কেউ তিষ্ঠুতে পারে না৷’’
সর্দারের সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে আমি সেরেস্তাদারকে ডাকলুম৷ তাঁকে সর্দারের কথা বললুম৷ সেরেস্তাদের ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বললেন, ‘‘স্যার, সব কথা সত্যি৷ এখানকার ভদ্রলোকেরা এসেছেন আপনাকে রাত্রিবেলায় গাঁয়ে থাকবার ও খাবার জন্যে বলতে৷’
এই বলে সেরেস্তাদারবাবু জন তিনচার ভদ্রলোককে নিয়ে এলেন৷ তাঁরাও সকলে নির্বন্ধ করতে লাগলেন সন্ধের পর ডাকবাংলোতে না থাকবার জন্য৷ আমার রাগ হল৷ সে রাগ দমন করে আমি বললুম, ‘এখান ছেড়ে রাত্রিতে আমি কোথাও যাব না৷’ সেরেস্তাদারবাবুকে বললুম, ‘আপনি সর্দারকে বলুন আমার রাত্তিরের খাবার সন্ধের আগেই যেন তৈরি করে রেখে দিয়ে যায়৷ যখন ইচ্ছে হবে তখন খাব৷ আপনিও চলে যেতে পারেন৷ তবে সকালে যথাসময়ে আসবেন৷ ঠিক নটার সময় আপিসের কাজ করতে হবে৷’
‘‘খানিকক্ষণ গাঁইগুঁই করে আমাকে নাছোড়বান্দা দেখে সকলে চলে গেলেন৷ সন্ধের সময় সর্দার আমার খাবার তৈরি করে ঢাকা দিয়ে রেখে চলে গেল৷ তারপর কেউ কোথাও নেই দেখে আমি বাংলোর দরজায় খিল দিয়ে বই পড়তে বসলুম৷ সর্দার সব ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল৷ যথাসম্ভব নিরুদ্বেগে রাত কাটল৷ সূর্য ওঠার আগে বাংলোর বাইরে এসে খোলা হাওয়ায় পায়চারি করছি এমন সময় সর্দার এসে হাজির৷ আমাকে সুস্থশরীর দেখে তার যে আনন্দ হয়েছে তা তার মুখ দেখে বুঝতে পারলুম৷ কোনো কথা না বাড়িয়ে ফতুয়ার পকেট থেকে পার্স বার করে তার থেকে একটা টাকা দিয়ে বললুম, ‘দৌড়ে যাও, চায়ের দুধ আনোগে৷’
‘‘গাঁয়ের লোক সর্দারের মুখে আমার কিছু হয়নি জেনে খুশি হয়েছিল কিনা বলতে পারি না৷ তবে বিকেলেও আমাকে গাঁয়ে যাবার জন্যে পীড়াপীড়ি করেছিল৷
‘‘তিন দিন পুরোদমে সরকারি কাজ চালিয়ে শেষ করলুম৷ সন্ধেবেলায় সেরেস্তাদারকে বলে দিলুম কাগজপত্র সব ভালো করে গুছিয়ে নিতে৷ আমরা কাল সকালে নটার আগেই রওনা হব৷
‘‘সকালে আটটা নাগাদ গ্রামের লোক আমাকে বিদায় দিতে এসেছেন৷ কারো মুখে রা নেই৷ বুঝলুম আমার ওপর এদের একটু বিশেষ শ্রদ্ধা জন্মেছে ভূতের রোজা মনে করে৷
‘‘আমি কাউকে কোনো কথা না বলে যখন আমার ঘর থেকে বারান্ডায় বেরিয়ে আসছিলুম, তখন চৌকাট ডিঙোতে ডিঙোতে সামনে গাঁয়ের একজন চাঁইকে দেখে বললুম, ‘এই তো চার রাত এখানে একলা কাটিয়ে গেলুম, কই আপনাদের ভূতের টিকিটিও তো দেখা গেল না!’
‘‘এই কথা বলতে বলতে দেখি চৌকাঠের ওপর থেকে ঝুরঝুর করে বালি পড়ছে৷ আমি একবার ওপরপানে চেয়ে নিয়ে তারপর পা চালিয়ে বারান্ডা পেরিয়ে সটান গাড়িতে গিয়ে উঠলুম৷ ও-বিষয়ে এই তোর কাছে প্রথম মুখ খুলছি৷ তুই কি বলিস?’’
আমি বললুম, ‘‘কেস দু’তরফেই সমানভাবে লড়া যায়৷ ঝুরঝুর বালি-পড়া স্বাভাবিকভাবে ঘটতে পারে, ভূতের কাজও হতে পারে৷ তবে বেনিফিট অব ডাউটের খাতিরে ভূতের পক্ষেই রায় দিই৷’’
আমার অভিজ্ঞতায়—ভয় তাড়িয়ে ভূত ঠেকানো যায়৷ আমার বন্ধুর অভিজ্ঞতায়— ভয় ঠেকালেও ভূত ঠেকানো যায় না৷
সত্য হয়তো দুই অভিজ্ঞতার মাঝামাঝি কিছু৷ কে জানে!