ভয় – আনন্দ বাগচী
ঠিক এমনই একটা আশ্রয় মনে-মনে আশা করেছিল মালতী—বাংলাদেশ থেকে ঠিক এতটা দূরে, সভ্য মানুষের বসতি থেকে ঠিক এতটাই বাইরে। তাই বলে অন্ধকারে নয়, আলো আসবে, প্রচুর আলো। বাতাস বইবে, অঢেল বাতাস। চার দিগন্তে বাঁধা একখানা মহাকাশ টাঙানো থাকবে মাথার ওপরে, সারাবেলা তার ওপর খড়্গধার রোদ্দুর ঝলসে গেলেও রাতের বেলা বাংলাদেশের মমতাময় তারাগুলো ফুটে উঠবে এক-এক করে। অর্থাৎ লোহার সিন্দুকের মতো নিরাপদ এবং নির্জন আশ্রয়, যেখানে তার বাবার চোখের আড়ালে সে আর রঘুনাথ অন্তত একটি মাস বেঁচে থাকতে পারবে। কোনও ভয় না পেয়েও।
এবং এই একমাসের মধ্যেই, পিসিমা আশ্বাস দিয়েছেন, খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন পড়বে : মিলু আর রঘু, তোমরা ফিরে এসো। ফিরে এলে তোমাদের কল্যাণই হবে। টাকার দরকার থাকলে লিখো। ইতি, তোমাদের দুই মা।
নিরুদ্দিষ্টের প্রতি বিজ্ঞাপনটা হয়তো হুবহু এই রকমেরই হবে এবং মায়ের নাম থাকলেও বাবার রাগ যে এতদিনে একদম জল হয়ে গিয়েছে, এ তো জানা কথাই। শুধু যে একমাত্র মেয়ে তাই নয়, ছোটবেলা থেকে এক হাতেই মানুষ। তাঁর অবর্তমানে বিরাট বিষয়-সম্পত্তি ভোগ করবার আর কেউ নেই। মালতী, এই একমাত্র মালতী, ছাড়া। আর তাই তো অত বড়লোকের মেয়ে হয়েও একজন সামান্য রিসার্চ স্কলারের সঙ্গে পালিয়ে আসতে সাহসী হল মালতী। অঙ্ক কষে যাঁরা মানুষের মন পর্যন্ত বিচার করেন, তাঁদের কাছে রঘুনাথের পরিচয় সামান্য বইকী। মালতী মনে-মনে হাসে। আসল মানুষটাকে সে ছাড়া আর কেই-বা চিনতে পেরেছে সত্যি করে।
রেজিস্ট্রারের বাড়ি থেকে বেরোবার পর একটানা দেড়টা দিন ট্রেন-জার্নিতে কেটেছে। এই দেড় দিনের মধ্যেই পায়ের নীচের ছুটন্ত মাটির রং বদলেছে, ধীরে-ধীরে ঢংও। এঁটেল দোআশের কৃষ্ণ ত্বক ধীরে-ধীরে আরক্ত হয়ে উঠেছে, মসৃণতা মিলিয়ে গিয়ে হয়েছে কাঁকরকুণ্ঠিত।
সাইকেল-রিকশা থেকে নেমে রঘুনাথ আঙুল বাড়িয়ে একটু দূরের একটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, ওইটেই দীননাথের ঠাকুরদার তৈরি ‘প্রবাস নিবাস’।
মালতীর মনে হল, পায়ের নীচে এতক্ষণে সে মাটি পেয়েছে, তা যে-রঙেরই হোক।
খবর পেয়ে মালি আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিল, রিকশার সাড়া পেয়ে ছুটে এল। সামান্যই যা মালপত্র ছিল রঘুনাথ মালির মাথায় তুলে দিয়ে পিছন-পিছন চলল।
চওড়া রাস্তা থেকে একটা সরু পায়ে-চলা ঢালু পথ সটান বাড়িটার বুকে গিয়ে বিঁধেছে। দূর থেকে দেখলে একটা আশ্চর্য অনুভূতি জাগে এবং সেই অনুভূতি পরপর ফুটে ওঠা কয়েকটা ছবির শিহরন মাত্র। বিশাল প্রান্তরের মধ্যে দুটিমাত্র দোতলা বাড়ি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানের ব্যবধান পঞ্চাশ গজের বেশি হবে না। চারপাশে কিছু সরলকাণ্ড গাছের সারি বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শাল আছে, ইউক্যালিপটাস আছে, বিবর্ণ বিরস তালও আছে। সহসা দেখলে মনে হয়, অতীত যুগের কোনও দুটি অতিকায় ম্যামথ যেন হাতিখেদার মধ্যে আটক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গায়ের রং কালের আলপনায় মেঘবর্ণ।
তারপরেই আবার ছবি বদলে যাবে। পিছনে দেখা যাবে বিপুল দীর্ঘ নীলকান্ত পাহাড়। গভীর বনের আচ্ছাদনকে দূর থেকে মনে হয়, নীল রঙের শ্যাওলার আস্তর, জায়গায়-জায়গায় রোঁয়া ওঠা। সেখানে ধূসর কিংবা সাদা রং।
জোর নজর চড়ালে একটা শীর্ণ নদীর ইতিচিহ্ন নজরে পড়বে, প্রায় পাদদেশে সাদা একগাছি পইতের মতো আড়াআড়ি বেষ্টন করে আছে। ধীরে-ধীরে এই বিরাট পটভূমির মধ্যে বাড়ি দুটির সত্তা লোপ পাবে। আগন্তুক তখন হয়তো খানিকটা এগিয়ে এসেছে। চারপাশে অস্পষ্ট কিছু নেই। পাহাড়ের দুটি প্রকাণ্ড গুহা যেন বৌদ্ধযুগের প্রশান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গম্ভীর, চাপা, অমসৃণ একটা দৃঢ় ভঙ্গি। মনে হয়, কক্ষগুলি পাহাড়ের গোপন বুকের মধ্যে দুরন্ত স্মৃতির মতো ঘিরে রয়েছে। আলো এবং বাতাস সেখানে হয়তো প্রচুর পৌঁছত না, কিন্তু চৈতন্য সেখানে প্রখর হয়ে আছে।
‘প্রবাস নিবাস’-এর মধ্যে ঢুকে মালতীর আকাঙ্ক্ষা অক্ষরে-অক্ষরে মিলে গেল। মনে হল, এই তো রৌদ্রপক্ব ফলের মতো নিটোল একটি বাড়ি, যেখানে আলো আসবে, প্রচুর আলো। বাতাস বইবে, অঢেল বাতাস। আর মালতী সারাদিন সারারাত বুক ভরে নিশ্বাস নেবে। গল্প করবে। গান গাইবে, আরও কত কী! রঘুনাথ মাঝে-মাঝে লজ্জা পেয়ে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে চাইবে, ভীত গলায় বলবে, এই, ও কী হচ্ছে!
মালতী তরল গলায় অজস্র হেসে বলবে, এখানে যে কেউ নেই!
কেউ নেই সেইটেই আসল কথা। মালতী তার প্রতিটি পরিপূর্ণ মুহূর্ত দিয়ে অনুভব করবে, কেউ নেই। এখানে তারা ছাড়া আর কেউ নেই। কলকাতা নেই। ইউনিভার্সিটি নেই, হিন্দুস্থান পার্ক নেই এবং তার বাবা নেই। আর নেই সেই শীতল পিচ্ছিল সাংঘাতিক সরীসৃপটা, যার নাম ভয়। আছে শুধু পাহাড়, পাথুরে প্রান্তর, প্রখর রোদ, প্রসন্ন জ্যোৎস্না, আর শান্তি, আর নির্জনতা, চোখ টিপে-ধরা দু ঘুম এবং একমাস সময়। তার কমও হতে পারে, কিন্তু বেশি নয়। রঘুনাথ। আর রঘুনাথও আছে, যাকে সম্পূর্ণ দেখা হয়েছে, কিন্তু সম্পূর্ণ জানা হয়নি।
‘প্রবাস নিবাস’-এর মধ্যে ঢুকতে-ঢুকতে মালতী খুশিমনে এই কথাগুলি ভাবল।
তারপর সেই সকালবেলাটা কী সুন্দরই না কাটল! রঘুনাথ খাবার আনতে চেয়েছিল। বলেছিল, আজকে আর রান্নার হাঙ্গামায় কাজ নেই।
মালতী একটা উচ্ছল তর্জনী তুলে তাকে থামিয়ে দিল। বলল, চুপ করে ইজিচেয়ারে বসে ডাগর-ডাগর চোখ মেলে দ্যাখো কী করি। বড়জোর কথা বলো, চেঁচামেচি করো—জানি তা পারবে না—কিন্তু তার বেশি না।
তরতর করে শুধু কথাগুলোই বলে গেল না মালতী, স্টেজ রিহার্সাল দেওয়ার মতো হাতে-কলমে কাজও শুরু করে দিল। নতুন কোনও একখানা ইংরেজি নভেল হাতে করে দোতলার চওড়া বারান্দাটায় রঘুনাথ শেষপর্যন্ত বসেই পড়ল। বেশ লাগছিল তার এই সকালবেলায়। রৌদ্র-প্রসন্ন প্রান্তর পার হয়ে চোখদুটো বারবার পাহাড়ের বুকে ছুটে যাচ্ছিল। আবার ফিরে আসছিল ইউক্যালিপটাসের ছায়ায়, তালবীথির মর্মরে।
ইঁদারার জলে স্নান করে ততক্ষণে মালতী স্টোভ ধরিয়েছে। আকাশি রংয়ের একটা পাতলা শাড়ি, কোঁকড়া-কোঁকড়া একরাশ ভিজে চুল, নিটোল দুটো হাতে দুটো জমাট রোদ্দুরের রেখার মতো বালা, একটা অনায়াস হালকা ভঙ্গি। রঘুনাথ শিল্পী নয়, তবু তার চোখে একটি সুন্দর ক্যানভাসের ওপর একটা আশ্চর্য ছবি ধরা পড়ে গেল। একটি কবিতার লাইন মনে পড়ে গেল যেন। একটি সুরের রেখা।
আবছা ঘুমের মতো দুপুর গড়িয়ে গেল। এলোমেলো কথা, হাসি, গল্প, খেতে বসা এবং তারপর বিশ্রাম। সমস্ত দুশ্চিন্তা একমুঠো ধুলোর মতো কোথায় উড়ে গেল, কেউ জানল না। বুকের ওপর থেকে সমস্ত গুরুভার নেমে গিয়ে তারা যে ফের এমনভাবে সহজ হতে পারবে, বেঁচে উঠতে পারবে—কে জানত!
রঘুনাথ যখন ঘুম থেকে জাগল, তখন প্রায় বিকেল। তাকিয়ে দেখল মালতী বিছানা থেকে কখন উঠে গেছে। কবজি-ঘড়িটার দিকে একপলক তাকিয়ে রঘুনাথ সবে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসতে যাচ্ছে, এমনসময় মালতী প্রায় অগোছালো মূর্তিতে ঘরে ঢুকে পড়ল। প্রথমটা রঘুনাথ দেখতে পায়নি স্পষ্ট করে, তাই বুঝতেও পারেনি। মালতী যে ভয় পেয়েছে, মুখ-চোখ অস্বাভাবিক করে ছুটে এসেছে, এ-কথাটা যখন টের পেল, তখন অনেকটা সামলে নিয়েছে। কিন্তু গা-হাত-পা থেকে-থেকে দুর্বলতায় কাঁপছে। ঠোঁট দুখানা তখনও আড়ষ্ট, গলার ভেতরটা শুকিয়ে গেছে, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ।
বিছানার একপাশে বসে পড়তেই রঘুনাথ ব্যগ্র কণ্ঠে শুধোল, কী হয়েছে?
মালতী স্পষ্ট করে কয়েক মুহূর্ত কথা কইতে পারল না।
রঘুনাথ আবার বলল, তুমি ভয় পেয়েছ মনে হচ্ছে। কিন্তু এ-বাড়িতে তো আমরা ছাড়া আর কেউ নেই! মালি অবশ্য আছে ওপাশের বাড়িটাতে, কিন্তু সে ছাড়া দ্বিতীয় কোনও পুরুষ এ-বাড়ি দুখানার ত্রিসীমানায় নেই—।
ঘুমের ঝোঁকটা রঘুনাথের কথার মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছিল। মালতী ভীত গলায় বলল, আছে।
কে?—রঘুনাথ সজাগ হয়ে বলল, কোথায়?
মালতী আচ্ছন্নের মতো বসে থেকে বলল, কে তা জানি না, তবে সে আছে, নিশ্চয়ই আছে। এই বাড়িতেই আছে।
শেষ দিকটায় মালতী প্রায় ফিসফিস করে কথা কইল।
রঘুনাথের মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল, তবু জোর করে বলল, কী যা-তা বলছ মালতী, শান্ত হও, একটু সুস্থির হয়ে বোসো—।
কথাগুলো মালতীর কানে গিয়ে পৌঁছল কি না বলা শক্ত।
এ আমাকে কোথায় নিয়ে এলে তুমি! আমি তো এখানে আসতে চাইনি। আমার ভুলে যাওয়া দুঃস্বপ্ন আবার একদিন এমনি করে—।
বাইরে একটা শব্দ হল দড়াম করে। সঙ্গে-সঙ্গে রঘুনাথ একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মালতী আর মুখ তুলল না। দুটি হাতের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে রইল।
বাইরে তখন পার্বত্য বিকেলের রহস্য নেমেছে। নানা দিক থেকে নানা-কোণ-করা ছায়া এসে ঘিরে ফেলেছে ‘প্রবাস নিবাস’কে, একটা জটিল ফাঁসের মতো। সূর্য চলে গেছে পাহাড়ের কাঁধের ওপারে, তালগাছের মাথাগুলো তখনও রাঙা।
কতটা সময় কেটেছে মালতীর হুঁশ নেই, রঘুনাথের ডাকে তার খেয়াল হল। হাতে একখানা মোটা বাঁশের লাঠি নিয়ে রঘুনাথ সহাস্যে ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।
ভুল! কোনও ছায়া-টায়া দেখে আচমকা ভয় পেয়েছিলে হয়তো, আসলে কেউ নেই! ওপরে, নীচে চারখানা ঘর, মায় ছাদ পর্যন্ত আমি খুঁটিয়ে দেখে এসেছি। মানুষ দূরে থাক, একটা বেড়াল পর্যন্ত নেই। খুব যা হোক!—কথা শেষ করে রঘুনাথ হাসল।
ভিজে ঠান্ডা চোখ তুলে মালতী আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, তাই হবে। কেউ না, কিছু না। সব ভুল।
নিশ্চয়ই! এখনও সন্দেহ আছে নাকি তোমার?—রঘুনাথ হা-হা করে হেসে উড়িয়ে দিল ব্যাপারটাকে।
মালতীর কেমন একটু খটকা লাগল। রঘুনাথ যেন খামোকা জোর করে হাসছে, একটু যেন অস্বাভাবিক গলায়।
রাত্রে যখন ‘প্রবাস নিবাস’-এর শোওয়ার ঘর থেকে শেষ আলোর বিন্দুটুকুও মুছে গেল, ঘড়ির ভাষায় রাত তখন বড়জোর সাড়ে আটটা। কিন্তু এই পাহাড়ি অঞ্চলে রাত্রির নিজের ভাষা তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর। বাইরে হাওয়া মাঝে-মাঝে তালের মাথায় থরথর শব্দ তুলছে। ইউক্যালিপটাসের একটা হালকা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরময়।
বালিশের ওপর মাথাটা একটু উঁচু করে ধরে রঘুনাথ বলল, দেখতে পাচ্ছ?
মালতী চুপ করে শুয়েছিল। চুড়িগুলো ঠুনঠুন করে বেজে উঠল। কাঁপা গলায় মালতী জেগে উঠল : কী?
রঘুনাথ একটু আহত হল। মালতীর মনটা এমন আনমনা হয়ে গিয়েছে সে কি সামান্য একটা ভয়ে, না অন্য কিছু আছে! এই অন্ধকার ঘরের মতোই সে চুপ করে শুয়ে আছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে হয়তো প্রতি মুহূর্তে কত কী ঘটে যাচ্ছে। পুরোনো কোনও স্মৃতি—সুখের হোক, দুঃখের হোক, তাকে হয়তো সহসাই অবশ করে ফেলেছে।
এই কথাগুলো রঘুনাথ যতক্ষণ ভাবছিল, মালতী ততক্ষণে অনেকখানি সরে এসেছে রঘুনাথের কাছে।
আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।—বিবর্ণ গলায় রঘুনাথকে সে প্রশ্ন করল, কই?
রঘুনাথ আলগোছে ওর একখানা হাত টেনে নিয়ে বলল, পাহাড়ে আগুন দিয়েছে, দেখতে পাচ্ছ না?
মালতী এইবার দেখল, আকাশের গায়ে কে যেন আগুনের মালা পরিয়ে দিয়েছে। ঘন অন্ধকারের মধ্যে পাহাড় স্পষ্ট-অস্পষ্ট কোনওভাবেই দেখা যাচ্ছে না। শুধু অনুমানে বোঝা যাচ্ছে তার এক কোটি থেকে অন্য কোটি পর্যন্ত একটা বিরাট আগুনের রেখা ঢেউ খেলে গেছে। কিন্তু তারপরেই—।
হঠাৎ মালতী আরও ঘন হয়ে এল রঘুনাথের বুকের মধ্যে। রঘুনাথ অবাক হল। এক মুহূর্তের জন্য মালতীকে একটা মরা পাখি বলে মনে হল নরম পালকের মতো শরীরে যেন কোনও স্পন্দন নেই, উত্তাপ নেই, কোনও শিহরন নেই। কিন্ত তারপরেই মনে হল, না, শীতল পিচ্ছিল নিরুত্তাপ পলায়ন নয়, আরও কিছু, মানে আরও অনেক কিছু যেন। অন্ধকারের যেমন সময়-সময় অসংখ্য মানে হয়। এক মুহূর্ত আগে অনেক কিছু দেখতে পায়নি, হঠাৎ যেন রহস্যের পরদাটা বাতাসে একটু সরে গেছে, আর—।
কিন্তু তারপরেই মালতীর মনে হল, আগুনের সেই বিরাট ঢেউ-খেলা রেখাটা মৃত্যুর রং হতে পারে, কিন্তু তা মৃত নয়। তার ধিকিধিকি স্পন্দনটা যেন স্পষ্ট চোখে পড়ল। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে মনে হল, শুকনো পাতায় কেউ আগুন লাগায়নি, একটা বিরাট পাইথন যেন তার আগুনের শরীরটা নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে পড়েছে এবং প্রতি মুহূর্তে একটু-একটু করে এগিয়ে চলেছে তার শিকারের দিকে, নির্মম মৃত্যুর মতো। মালতী মিত্তিরের অতীতটার ওপর দিয়েও যেন একটা হিংস্র সরীসৃপ অসহ্য আক্রোশে ছুটে আসছে। ভুলে যাওয়া একটি রাত্রিকে যেন মনে পড়িয়ে দিয়েই এবার আর থামবে না, তার সুন্দর স্বপ্নটাকেও চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ঝাড়বাতির মতো নিভিয়ে দেবে। দুটি কালো হাত অন্ধকারে সাঁড়াশির মতো মালতীর কণ্ঠরোধ করতে এগিয়ে আসছে। বাঁচা আর হল না। ছোট্ট হলেও মালতীর একটা অতীত ছিল, সেটাকে আর যে-ই ভুলুক, সে ভোলেনি।
আর, এক মুহূর্ত পরে রঘুনাথের মনে হল, একটা অস্পষ্ট কান্নার মতো মালতী তাকে জড়িয়ে আছে।
দিনের পর দিনের ইতিহাস অনেকটা এইরকম। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত একরকম কেটে যায়, কোনও কিছু নেই। মালি জল তুলে দিয়ে যায় ইঁদারা থেকে। রঘুনাথ টুকিটাকি কাজ সারে, কিংবা একটু বাইরে ঘুরে আসে। মালতী স্নান সেরে নিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। এই পর্যন্ত বেশ পরিষ্কার। ভয় নেই, ভাবনা নেই। তারপর যেই বিকেল হয়ে এল, পাহাড় থেকে ছায়া নামল, ‘প্রবাস নিবাস’-এর ঘরে-ঘরে ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার, নির্জন প্রান্তর জুড়ে নানারকম রহস্যময় শব্দ উঠতে থাকে, বাতাস আরও খেয়ালি হয়ে ওঠে, আর ঠিক তখনই মালতী ভয় পায়। ঠিক তখনই রঘুনাথের এই বাড়ি ছেড়ে, ঘর ছেড়ে, মালতীকে ছেড়ে কোথাও এক পা-ও যাওয়া চলবে না। মালতী স্পষ্ট করে কিছু না বললেও, তার মুখের হাসিগুলো ফিকে হতে-হতে মিলিয়ে আসবে, বুকের ওঠা-নামা বাড়বে। মনে হবে, সমস্ত চৈতন্য দিয়ে সে যেন কীসের প্রতীক্ষা করছে, কে যেন আসবে, কে যেন আসছে। সামান্য শব্দেও চমকে উঠবে তখন।
একটি শিক্ষিত মেয়ে এরকমভাবে ভয় পাবে রঘুনাথ কি আর আগে জানত! আর জানলে কি আর দীনুকে পীড়াপীড়ি করে তাদের দূর প্রান্তের বাড়িখানা জোগাড় করত! দীনুদের বাড়িখানা পড়েই ছিল, দীনু সেজন্য আপত্তি করেনি। করেছিল যেজন্য সেটা আজকে একটু যেন অনুমান করতে পারে রঘুনাথ। বিদায় নেওয়ার সময় মালতীর অলক্ষ্যে প্ল্যাটফর্মের কিনারে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ভাই, আমাকে ভুল বুঝিসনে কিন্তু—।
ভেবেচিন্তে অনেক দ্বিধার পর হয়তো দীননাথ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, এমনসময় গাড়ি স্টার্ট নিল। রঘুনাথের পক্ষে আর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হল না। এখন যেন মনে হয়, বাড়িটার সম্বন্ধেই তার কিছু বলবার ছিল, এবং সেইজন্যই সে প্রথমদিকে আপত্তি করেছিল তারপর মালির ব্যবহারটাও একটু আশ্চর্যের। দু-খানা বাড়িরই দেখাশোনার ভার তার ওপরে, তবু ‘প্রবাস নিবাস’-এ সে থাকে না। পাশের বাড়িটা এ-বাড়ির তুলনায় যেন অনেকটা বুড়িয়ে গেছে, রং এখন ঔজ্জ্বল্য হারিয়েছে, ইটের গাঁথনির জায়গায়-জায়গায় জরার চিহ্ন।
প্রথমটা রঘুনাথ ভেবেছিল বাড়িটার কোনও খারাপ ইতিহাস আছে, হয়তো কারও অপমৃত্যুর জন্য কিংবা অন্য কোনও কারণে। সারা দুপুর ধরে ক’দিন তন্নতন্ন করে দেখেছে বাড়িটার আনাচে-কানাচে, নির্জনতম কোণগুলোতে আচমকা গিয়ে দাঁড়িয়েছে যদি কিছুর দেখা পায়। কোনও ছায়া কিংবা কোনও অপমূর্তির—কিন্তু পায়নি। বাইরে দমকা বাতাস মাঝে-মাঝে অদ্ভুত শব্দ করেছে, জুতো পায়ে একটি মানুষের চলে বেড়ানোর মতো, দরজার কপাটে আস্তে-আস্তে ধাক্কা দেওয়ার মতো। সঙ্গে-সঙ্গে শিকারি বেড়ালের মতো লাফিয়ে বাইরে বেরিয়েছে রঘুনাথ, কিন্তু কোথায় কী! একটা-আধটা শুকনো শালপাতা হয়তো উড়ে এসেছে দূরের বাতাসে।
কাউকে দেখতে পায়নি সত্যি, তবু তার মনে হয়েছে মালতীর পক্ষে কিছু একটা দেখে ফেলা কি নিতান্তই শক্ত? তার নিজেরই মনে হয়েছে, আজকাল মনে হচ্ছে, কেউ হয়তো সত্যিই আছে। এই বাড়ির চারপাশে সে পাগলা হাওয়ার মতো পাক খেয়ে বেড়ায়। এবং সে রঘুনাথকে চোখে-চোখেই রাখে, কিন্তু রঘুনাথ তাকে দেখতে পায় না, একটা অস্বস্তি অনুভব করে। একটা কালো পিঁপড়ে যেন পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে অস্পষ্ট পায়ে হেঁটে বেড়ায়, এমনি একটা শিরশির ভাব। যেন দেওয়ালগুলো তার দিকে চেয়ে আছে, যেন ওই পঞ্চাশ গজ দূরের বোবা বাড়িটা তার দিকে বন্দুকের একটা নল উঁচিয়ে আছে। খামবন্ধ চিঠির মতো ওর দোতলার বন্ধ জানলাগুলোর পিছনে যেন একটা আশ্চর্য খবর অপেক্ষা করে আছে। সে-খবর ভয়ঙ্করও হতে পারে।
সত্যি, ঘরে বসে থেকে-থেকে রঘুনাথের মস্তিষ্কও অসুস্থ হয়ে উঠেছে ধীরে-ধীরে। নইলে নিজের ঘরের দেওয়াল আর জানলাগুলোকে তার সন্দেহ হয়! পাশের ওই নির্জন দোতলাটাকে অবিশ্বাস হয়! সত্যি, ভয় জিনিসটা এমনিই সংক্রামক, একজনের মন থেকে আর-একজনের মনে সে কত সহজে চলে আসে।
রঘুনাথ জোর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। স্টেশনে তাকে যেতেই হবে, কলকাতার সংবাদ জোগাড় করতে হবে, খবরের কাগজ চাই। সামান্য একটা ভয়ের আড়ালে আসল সমস্যাটাই চাপা পড়ে রয়েছে। ওদিকে কলকাতার মেজাজ এতদিনে কীরকম দাঁড়িয়েছে কে জানে। একটা ব্যক্তিগত কলমের বিজ্ঞাপন। ব্যস, তারা আবার ফিরে যাবে। এই বানপ্রস্থ আর ভালো লাগে না। কলেজ স্ট্রিটের সন্ধ্যাগুলো একটা বহুদিনের বহুমুখের বিচিত্র অ্যালবামের মতো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।
আবার শূন্য হৃদয়ে স্টেশন থেকে ফিরে এল রঘুনাথ। খবরের কাগজে কোনওই সিগন্যাল পড়েনি! আবার অনিশ্চিত প্রতীক্ষা, অনির্দিষ্ট কাল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকালয়ের বাইরে ধূসর রুক্ষ অর্থহীন মাঠের মধ্যে। হঠাৎ থমকে যাওয়া ট্রেনের বগির মতো বুকের ভেতরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। লাল গোলাপি রঙের আস্তর লাগা বিরাট সস কাগজের মতো স্তব্ধ আকাশটার নীচ দিয়ে যেতে-যেতে অসম্ভব শূন্য মনে হল নিজেকে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, সেই করুণ, বিষণ্ণ, ভয়ঙ্কর সন্ধ্যা। একটা বোবা আক্ষেপ অন্ধ কান্নায় মোচড় দিয়ে ওঠে মনের মধ্যে। সমস্ত আকাশ-বাতাস আর ধূ-ধূ প্রান্তরের বুকের মধ্যেও যেন আর-একটি বিশাল কান্নার জাগরণ, আর-একটি অসহ্য বিবর্ণ দগ্ধ অনুভূতি। কে যেন কাকে ছিনিয়ে নিল, মুমূর্ষু আলোকে যেমন করে অন্ধকার লুট করে নেয়।
বাড়ির ভেতর ঢুকেই রঘুনাথ চমকে উঠল ভূত দেখার মতো। কয়েকবার বুক ভরে ঘ্রাণ নিল সাবধানে। হ্যাঁ, আবার সেই গন্ধের রেশটা নাকে আসছে। একটা অদৃশ্য আঁকাবাঁকা রেখায় গন্ধের ক্ষীণ স্রোতটা যেন এই প্যাসেজ দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেছে, কিংবা ওপর থেকেই ধীরে-ধীরে নেমে এসেছে। কিছুদিন ধরেই এই গন্ধটা বারবার ‘প্রবাস নিবাস’-এর চারপাশে হানা দিয়েছে। রাত্রে যখন মালতী আর তার ছায়া জানলার কাচের ওপর একজোড়া কবিতার লাইনের মতো দ্ঘিল হয়ে এক জায়গায় গিয়ে মিলে গেছে, ঠিক সেই সময় বাইরের অন্ধকার থেকে এই আশ্চর্য তন্দ্রাতুর গন্ধটা ভেসে এসেছে, কিংবা তারও কিছু পরে, বিছানায় যখন রাত্রির যবনিকা কম্পমান হয়েছে।
প্রথম-প্রথম ইউক্যালিপটাসের গন্ধ বলে ভুল করত। ধীরে-ধীরে টের পেয়েছে, এই সুগন্ধ নির্যাসটা অনেকগুলি জিনিসের মিশ্রণ। ঠিক কীসের কে জানে! তবে ম্যাক্রোপোলোর গন্ধের মতো খানিকটা, খানিকটা আর-কিছুর। রঘুনাথ নিজে সিগারেট খায় না, কাছে-পিঠে কয়েক মাইলের মধ্যে ওই জাতীয় ধমপায়ীর অস্তিত্বও কল্পনা করা যায় না। তবে কি অশরীরী আত্মায় বিশ্বাস না করে উপায় নেই? কিংবা কোনও নাম-না-জানা, গল্প-না-শোনা বিষধরের নিশ্বাস বলে মেনে নিতে হবে? রঘুনাথ অবশ্য এতটা মাথা আগে কখনও ঘামায়নি। গন্ধটা সে খেয়ালও করত না মন দিয়ে, যদি না মালতী সেদিন ভয় পেত। তার কাগজের মতো ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে রঘুনাথ প্রশ্ন করেছিল, আবার কী হল? কোনও শব্দ-টব্দ শুনেছ নাকি?
মালতী বিছানার ওপর অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে বসে থেকে বলেছিল, কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছ না, মিষ্টি-মিষ্টি?
শব্দ করে হেসে উঠেছিল রঘুনাথ, তোমার মাথা খারাপ হল নাকি? মেয়েদের মনের কুসংস্কার জন্মে যায় না দেখছি।
প্রতিবাদ করল না মালতী, ক্লান্ত গলায় বলল, বলতে পারো।
রঘুনাথের মনে হল, সে যত সহজে ব্যাপারটিকে নিতে পারছে, মালতী পারছে না। কিন্তু তার এই সর্বক্ষণের ভয়ের কেন্দ্রটা ঠিক কোথায়, তা সে অনুমানও করতে পারবে না। প্রেতাত্মায় রঘুনাথের কোনওকালেই বিশ্বাস ছিল না, তবু কেমন একটা খটকা লাগল গন্ধটা মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করে। ইউক্যালিপটাসের নির্যাস তো এ নয়! এ-যেন খুব পরিচিত অথচ পরিচিত নয় এমন একটা কিছু, যেন দ্বিতীয় একজনের অতি নিকট উপস্থিতি ঘ্রাণের মধ্য দিয়ে অনুভবে পৌঁছচ্ছে। গায়ে কাঁটা দিল। ভয়ে নয়, বিস্ময়ে।
কী বলে তোমার সন্দেহ হয়, মালতী? এ-গন্ধ তোমার চেনা?—রঘুনাথ মালতীকে দু-হাতে আকৃষ্ট করে জানতে চাইল।
মালতীর সমস্ত শরীরটা একবার থরথর করে কেঁপে উঠল, কথা বলতে পারল না। শুধু মাথা নাড়ল।
কীসের ভয় তোমার! আমি আছি, আমাকে স্পষ্ট করে বলো।—রঘুনাথ মৃদু তীক্ষ্ন গলায় কথা বলল।
আমি আর-এক মুহূর্ত এখানে থাকতে পারছি না—দমবন্ধ গলায় মিনতি করল, আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চলো।
রঘুনাথের কপালের পাশটা দপদপ করে উঠল, মালতীকে ধীরে-ধীরে ছেড়ে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। তারপরে ব্যালকনিতে যেতে আর কতক্ষণই বা সময় লেগেছে! সেই অবয়বহীন বিশাল অন্ধকারের মধ্যে নীচে ঝুঁকে তাকিয়ে রঘুনাথের মনে হল, একটি লাল আগুনের স্ফুলিঙ্গ বারকয়েক লাফিয়ে তালবীথির মধ্যে মিলিয়ে গেল। মনে হল, পাহাড়ের যেখানে শুকনো পাতায় পাহাড়িরা আগুন লাগিয়েছে, সেখান থেকে ছিটকে আসা রক্তকণিকা আবার সেখানেই ফিরে গেল। আঃ, হাতে যদি একটা টর্চ থাকত এ-সময়!
শিকারি কালপুরুষ আকাশপ্রান্তে জ্বলজ্বল করছে। রঘুনাথ নিজের মাথার চুল মুঠো করে ধরে ঘরে ফিরে এল। মালতী আস্তে-আস্তে জিজ্ঞাসা করল, কিছু দেখলে?
রঘুনাথ ঝাপসাভাবে মাথা নেড়ে জানাল, না।
আর, আশ্চর্য, গন্ধটা তখন থেকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। মালতীর মুখের রংও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
আমি জানতুম।—মালতী ব্যাপারটার ওপরে যেন পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিল।
কিন্তু ব্যাপারটার ওপরে সত্যিই কি আর পূর্ণচ্ছেদ পড়ল!
কিন্তু আজ রঘুনাথ সত্যিই ভয় পেয়েছে। একটা অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা গুরগুর করে উঠল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যায়নি তো? মালতীর কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেন!
তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেই রঘুনাথ আর্তনাদ করে উঠল : মালতী! কী হয়েছে তোমার! মাটিতে শুয়ে আছ কেন!
কেউ উত্তর দিল না। ঘরের আবছা অন্ধকারের মধ্যে মালতীর অনড় দেহটা সেই একইরকম করুণভাবে পড়ে থাকল।
রঘুনাথ রক্তহীন শূন্যতা নিয়ে হাতড়ে-হাতড়ে দেশলাই খুঁজল। যে-দুঃসংবাদ তার জন্য অন্ধকারের মধ্যে নিঃশব্দে পড়ে রয়েছে, সত্যি বলতে কী, তাকে আবিষ্কার করতে না পারলেই সে বেঁচে যেত। মালতীকে ছাড়া সে কলকাতাকে যে ভাবতেই পারে না। আলো জ্বেলে অবশ্য বুঝতে পারল, ব্যাপারটা ততটা গুরুতর কিছু নয়। ভীষণরকম ভয় পেয়ে মালতী সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছে মাত্র।
কুঁজোর ঠান্ডা জলের দু-চার ঝাপটা মুখে-চোখে পড়তেই মালতী চোখ মেলে তাকাল। রঘুনাথকে দেখতে পেয়ে তার মুখে এক টুকরো রুগ্ন হাসি ফুটে উঠল ধীরে-ধীরে।
কী হয়েছিল, মালতী?—রঘুনাথ মালতীর মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল।
আবছা গলায় মালতীর উত্তর এল, ভয় পেয়েছিলুম।
আর কিছু না!—মুহূর্তের জন্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠল রঘুনাথের মনটা,—শুধু ভয়?
হ্যাঁ, শুধু-শুধু।—পাখির গলার ক্ষীণ উত্তর এল, ম্লান হাসির সঙ্গে।
রঘুনাথ গর্জে উঠল, কে?
ফিনকি দিয়ে কান্না বেরোল মালতীর গলা দিয়ে, জানি না।
আর সেইসঙ্গেই দরজার পাশের ছায়াটা ভাঙা-ভাঙা স্বরে উত্তর দিল, আমি, বাবুজি।
মালির ছায়া দেখেই রঘুনাথ অবশ্য চেঁচিয়ে উঠেছিল, এবার শান্ত গলায় বলল, কী ব্যাপার!
আপনার চিঠি আছে।
খামটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত আঙুলে ছিঁড়ে ফেলল রঘুনাথ।
দীননাথের চিঠি। মালতীর বাবা মত পরিবর্তন করেছেন, তারা যেন পত্রপাঠ ফিরে আসে।
মালি ফিরে যাচ্ছিল, রঘুনাথ ডাকল, বাঁশদেও! আমরা আজ রাত্রেই কলকাতা ফিরে যাব। একটা রিকশা ডাকতে পারো?
বাঁশদেও ফিরে দাঁড়িয়েছিল, তার মুখের ওপর একসঙ্গে বিস্ময় এবং আক্ষেপ ফুটে উঠল।
ইস, একটু আগে যদি জানতাম, বাবুজি, এই রিকশাটাকেই বলে দিতাম। এখন আবার এই অন্ধকারে তিন মাইল পথ—।
কোন রিকশাকে বলে দিতে, বাঁশদেও?—রঘুনাথ তার চামড়ার সুটকেসটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল।
কেন, পাগলাবাবু যে চলে গেলেন একটু আগেই।
পাগলাবাবু কে?—রঘুনাথ ফিরে তাকাল।
আপনি তাঁকে দেখেননি, বাবু?—বাঁশদেও কুণ্ঠিত হয়ে বলল, ও-বাড়িতে থাকতেন তিনি।—বলে সে পাশের বাড়ির দিকে ইঙ্গিত করল।
রঘুনাথ এইবার সত্যি করে চমকে গেল।
মাসিক রোমাঞ্চ
পুজো সংখ্যা, ১৯৮৭