ভয়ের খুব কাছে
ব্রিজেশ ঢেউ গুনছিলেন, আর মনে-মনে বেশ মজা পাচ্ছিলেন। বিনিমাইনের এই চাকরিটা শখের খেলা হিসেবে মন্দ না।
পুরীর সমুদ্র বরাবরই ব্রিজেশের খুব প্রিয়। কারণ, সমুদ্রের সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর মধ্যে কোথায় যেন একটা একগুঁয়ে ফোর্স লুকিয়ে রয়েছে। বিউটির সঙ্গে ফোর্স মিশে গেলে তার আকর্ষণই আলাদা!
একটু আগেই সমুদ্রের ভেতর থেকে সূর্য উঠেছে। এখন তার লাল-কমলা আলো জলের ওপরে চকচক করছে। বহুদূরে দুটো নৌকো দেখা যাচ্ছে। একটু পরেই ওগুলো কালো ফুটকি হয়ে শেষে মিলিয়ে যাবে।
সমুদ্রের খুব কাছাকাছি ব্রিজেশ বসেছিলেন। লোকাল একজন মহিলা দশটাকার বিনিময়ে প্লাস্টিকের চেয়ার ভাড়া দেয়–এক ঘণ্টার জন্য। তার কাছ থেকে দুটি চেয়ার ভাড়া নিয়েছেন– ছাই রঙের হাতলওয়ালা চেয়ার। একটায় ব্রিজেশ বসেছেন আর তার পাশের চেয়ারে সানিয়া। ভাবতে অবাক লাগে, কতদিন পর ওঁরা স্বামী-স্ত্রী এমনভাবে পাশাপাশি বসেছেন, অলসভাবে সময় কাটাচ্ছেন।
সমুদ্রের হাওয়া চোখে-মুখে ঝাপটা মারছিল। সামনে সমুদ্রের অনন্ত বিস্তার, আর সঙ্গে ঢেউয়ের পরে ঢেউ। ব্রিজেশ চাইছিলেন, সময় এখন থেমে যাক, সমুদ্রের অদ্ভুত গন্ধটা চিরস্থায়ী পারফিউমের মতো শরীরে লেগে থাক।
গুনগুন গান কানে আসায় সনিয়ার দিকে মুখ ফেরালেন।
কপালের দু-পাশে চুল সাদা হয়ে গেছে, ত্বক আর আগের মতো মসৃণ নেই, কিন্তু গানের গলাটা একইরকম রয়ে গেছে। এই মেয়েটার সঙ্গে দু-দুটো যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন ব্রিজেশ। ওঁর হাই প্রোফাইল করপোরেট লাইফে সানিয়া সবসময় সলাস আর স্টেবিলিটি জুগিয়েছেন–শান্তি আর স্থিতি। তাই এই কম কথা বলা মেয়েটাকে ব্রিজেশ এখনও পছন্দ করেন। কিন্তু মাঝে-মাঝে মনে হয়, অফিসে যেমন সাবর্ডিনেটরা ওপরওয়ালার মরজিমাফিক চলার চেষ্টা করে সানিয়া সেরকম কিছু করছে না তো!
অফিসের কথা মনে পড়ল ব্রিজেশের। ওঁর আন্ডারে এমপ্লয়ির সংখ্যা একশো বারো। নট আ ম্যাটার অফ জোক। ওই একশো বারোজন এমপ্লয়ি ব্রিজেশ দত্ত চৌধুরীর কথায় ওঠ-বোস করে।
কিন্তু এখন অফিস ভুলে থাকার সময়। তাই পুরী রওনা হওয়ার সময় থেকেই অফিশিয়াল মোবাইল ফোন বন্ধ। প্রাইভেট ফোনের নম্বরটা ব্রিজেশ শুধু কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সুনন্দন শর্মাকে দিয়ে এসেছেন। বলেছেন, এক্সট্রিম ইমার্জেন্সি ছাড়া ওঁকে যেন ফোন না করা হয়। কারণ, পুরীর এই তিনটে দিন তিনি পুরোপুরি অলসভাবে কাটাতে চান, জীবনের স্রোতে নিজেকে স্রেফ ভাসিয়ে দিতে চান।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ব্রিজেশ। চারপাশে তাকালেন। সি-বিচে মোটামুটি ভিড়। কাছে দূরে কয়েকটা চায়ের দোকান। দোকানদার খদ্দেরদের জন্য কয়েকটা করে কাঠের বেঞ্চি পেতে রেখেছে। সেখানে টুরিস্টরা বসে চা খাচ্ছে, সমুদ্র উপভোগ করছে।
লোকাল হকাররা ঘুরে-ঘুরে শাঁখ, জগন্নাথের ফ্রেমে বাঁধানো ফটো, মুক্তোর মালা বিক্রি করছে। ভোরবেলা থেকে এই একঘণ্টার মধ্যেই ওরা ব্রিজেশদের অন্তত বারচারেক বিরক্ত করে গেছে। হকারগুলো মহা নাছোড়। মুখের সামনে এসে এমন করতে থাকে যে, ব্রিজেশের মাঝে মাঝে মনে হয়, ঠাস করে এক চড় কষিয়ে দেন। অফিস হলে ব্যাপারটা এতক্ষণে ঘটে যেত। কিন্তু এটা তো আর অফিস নয়!
সানিয়া গুনগুন গান থামিয়ে জিগ্যেস করলেন, কোথায় চললে?
কোথাও না। সাগরের জলে একটু পা ভিজিয়ে আসি।
আজ সানরাইজ খুব ভালো দেখা গেছে, তাই না?
ব্রিজেশ ছোট্ট করে জবাব দিলেন, হু। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, হকারদের কাছ থেকে ফালতু জিনিস কিছু কিনে বোসো না যেন!
সানিয়া বললেন, না, কিনব না।
স্বামী লোকটাকে দেখছিলেন সানিয়া।
বয়েস পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হলেও কম দেখায়। এই বয়েসেও হালকা শরীরচর্চা ওঁর নেশা। চওড়া গোঁফ, কদমছাট চুল। অল্পস্বল্প নেশা যে করেন সেটা চোখের কোল দেখলে বোঝা যায়। মুখে কেমন যেন একটা যান্ত্রিক শক্ত ভাব আছে। কিন্তু ওঁর হাসি এত সুন্দর-সরল যে, হাসলে ওঁর সাত খুন মাফ করে দেওয়া যায়। দু-যুগ আগে সানিয়া ওঁর এই হাসি দেখেই প্রেমে পড়েছিলেন।
ব্রিজেশের গায়ে লাল লেগো আঁকা একটা সাদা টি-শার্ট আর ছাই রঙা বারমুডা। বালির ওপরে পা ফেলে সমুদ্রের জলের দিকে এগোচ্ছিলেন। জল আসছে, যাচ্ছে তার সঙ্গে ভেসে আসছে রঙিন জেলিফিশ। গতকাল ভোরবেলা একটা বড় মাপের কচ্ছপও ভেসে এসেছিল। লোকাল। জেলেগুলো বলেছিল, কচ্ছপটা ভালোরকম চোট পেয়েছে, ওটা আর বাঁচবে না।
কী করে চোট পেল সে-কথা জিগ্যেস করাতে ওরা বলেছে, হয়তো ওটা কোনও জাহাজের প্রপেলারে ধাক্কা খেয়েছে।
কাল ভোরে কচ্ছপটাকে ঘিরে রীতিমতো ভিড় জমে গিয়েছিল। কেউ-কেউ মোবাইলে ওটার ছবিও তুলছিল।
ব্রিজেশ জলের কিনারায় নেমে এলেন। পা ভেজালেন নোনা জলে। একপলকের জন্য মনে। হল সমুদ্র ওঁর পা ধুয়ে দিচ্ছে। অফিসের ওই একশো বারোজনও কম-বেশি এই কাজটা করে থাকে। আর আশ্চর্য, ব্রিজেশ সেটা এনজয় করেন। যেমন এখন সমুদ্রের পা ধোয়ানোটা বেশ এনজয় করছেন।
সানিয়া স্বামীকে কিছুক্ষণ লক্ষ করছিলেন। কিন্তু ব্যাগের ভেতরে রাখা মোবাইল ফোন বেজে ওঠায় মনোযোগ সরে গেল। ছোট হাতব্যাগের মুখ খুলে ভেতরে উঁকি মারলেন। না, ব্রিজেশের ফোন নয়, সানিয়ার ফোনটাই বাজছে।
ফোন ধরলেন। অপরূপার ফোন। লস এঞ্জেলিস থেকে।
ব্রিজেশ আর সানিয়ার একমাত্র মেয়ে। দু-বছর আগে বিয়ে হয়েছে। তারপর থেকেই স্টেটসে। যোগাযোগ বলতে দিনে দু-তিনটে ফোন। ব্যস।
একটা লম্বা শ্বাস ফেলে হ্যালো বললেন সানিয়া। চোখের কোণ দিয়ে ব্রিজেশকে একবার দেখলেন। জলের ওপরে আয়েশি পা ফেলছেন। তারপর অপরূপার সঙ্গে কথায় ডুবে গেলেন।
সমুদ্রের হাওয়া ব্রিজেশের ভালো লাগছিল। দেখছিলেন, হাওয়ার দাপটে দুটো পায়রা অনিচ্ছাসত্ত্বেও তিরবেগে বাতাসে ভেসে চলেছে। ব্রিজেশও এখন ওদের মতো অলসভাবে প্রকৃতির হাত ধরে ভেসে চলেছেন। করপোরেট জীবনের কোনও বাঁধন নেই, শাসন নেই। ওই সূর্যের মতো তিনি স্বাধীন। কিংবা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।
ঠিক তখনই একটা জিনিস ব্রিজেশের চোখে পড়ল।
একটা প্রকাণ্ড মাপের জিনিস–একটা বস্তা কিংবা সেই জাতীয় কিছু সমুদ্রের জলে ভেসে আসছে।
ব্রিজেশের কাছ থেকে পনেরো-বিশ ফুট দূরে ভাসছে–অথবা, সাঁতার কেটে আসছে– জিনিসটা।
আবার একটা উন্ডেড কচ্ছপ নাকি?
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জিনিসটা ব্রিজেশের খুব কাছে এসে গেল। সমুদ্রের জল ওটাকে প্রায় ব্রিজেশের পায়ের কাছে জমা দিয়ে চলে গেল। আর বস্তুটা হামাগুড়ি দিয়ে বালির ওপরে অনেকটা উঠে এল।
অন্য কেউ হলে অবশ্যই চিৎকার-চেঁচামেচি করে একলাফে ছিটকে সরে যেত, কিন্তু ব্রিজেশ অন্য ধাতুতে গড়া। এক পলকেই প্রাণীটাকে তিনি যা দেখার দেখে নিয়েছেন।
না, প্রাণীটা কচ্ছপ নয়। এমন অদ্ভুত প্রাণী বোধহয় কেউ কখনও দেখেনি।
প্রাণীটার চেহারা কচ্ছপ আর শঙ্কর মাছের মাঝামাঝি। মাপে নেমন্তন্ন-বাড়ির নৌকোর মতো। মেটে রঙের শরীরে পায়রা-চঁদা মাছের মতো কালো চাকা-চাকা দাগ। শরীরটা মসৃণ নয়– এবড়োখেবড়ো। যেন খাবলা-খাবলা মাটি চাপিয়ে তৈরি। আর গায়ের চামড়াটা ব্যাঙের মতো খসখসে–তার ওপরে ডুমো-ডুমো আঁচিল।
প্রাণীটার পিছনদিকে অক্টোপাসের শুড়ের মতো গোটা চারেক লেজপাখনার মতো ছড়িয়ে আছে। চারটে শক্তপোক্ত পা। পায়ের আঙুলগুলো হাঁসের পায়ের পাতার মতো চামড়া দিয়ে জোড়া। আঙুলের ডগায় মোটা বাঁকানো নখ।
সবচেয়ে বীভৎস হল প্রাণীটার চোখ। অন্তত ব্রিজেশের তাই মনে হল।
চোখ তো নয়, যেন নীল রঙের দুটো টেনিস বল–তাও আবার শরীরের বাইরে উঁচু হয়ে আছে! এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে–যেন কাউকে খুঁজছে।
প্রাণীটা নখ দিয়ে ভিজে বালির ওপরে খুব ধীরে-ধীরে আঁচড় কাটছিল। বোধহয় অচেনা পরিবেশে আচমকা হাজির হয়ে ঠিক কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না।
ব্রিজেশ আর দেরি করলেন না। উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকালেন। কাছেই একজন বৃদ্ধ লাঠি হাতে বালির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। চোখের পলকে ব্রিজেশ ছুটে গেলেন তার কাছে।
এক্সকিউজ মি বলে এক ঝটকায় লাঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন। তারপর ছুটে আবার প্রাণীটার কাছে চলে এলেন। কালী পুজোয় খাঁড়া উঁচিয়ে যেমন করে পাঁঠাবলি দেয় ঠিক সেইভাবে লাঠিটা শক্ত দু-হাতে তুলে ধরলেন মাথার ওপরে। এবং ভয়ংকর শক্তিতে প্রাণীটার মাথা তাক করে সেটা নামিয়ে আনলেন।
বেলুন ফাটার মতো শব্দ হল। একটি চি-চিঁ শব্দও বেরিয়ে এল প্রাণীটার মুখ থেকে। কিন্তু ব্রিজেশ বুঝলেন, লাঠির ঘায়ে প্রাণীটাকে সেরকম কাবু করা যায়নি।
চায়ের দোকানদারদের পেতে রাখা বেঞ্চিগুলোর দিকে চোখ গেল ব্রিজেশের। ওগুলো বেশ ভারী কাঠ দিয়ে তৈরি। সুতরাং লাঠিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে একটা খালি বেঞ্চির দিকে ছুটে গেলেন।
প্রাণীটা ঘিরে ততক্ষণে ভিড় জমতে শুরু করেছে। কিন্তু সব দর্শকই ভয়ংকর প্রাণীটার কাছ থেকে অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছে।
বেঞ্চি কাঁধে নিয়ে ব্রিজেশ চিৎকার করে ছুটে এলেন। ওঁর মারমুখী চেহারা দেখে সবাই চটপট সরে গিয়ে ওঁকে পথ করে দিল।
প্রাণীটা তখন ওর লম্বা লাল জিভ বের করে ভিজে বালির ওপরে বোলাচ্ছে। ওর চারটে লেজ ছটফট লাফাচ্ছে। নীল চোখ এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে।
দর্শকদের গুঞ্জন জোরালো হল। আর ব্রিজেশ কাঠের বেঞ্চিটাকে গদার মতো ব্যবহার করলেন। সমস্ত শক্তি দিয়ে ওটা বসিয়ে দিলেন প্রাণীটার দেহে।
ওটার পিঠের চামড়া ফেটে গেল। কালচে তরল ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এল। প্রাণীটা ওর শরীর মোচড়াতে লাগল। চোখ উলটে পা ছুঁড়তে লাগল। চি-চিঁ শব্দটা আরও জোরালো হল।
ব্রিজেশ কিন্তু থামেননি। বেঞ্চিটাকে বারবার কাঁধে তুলে প্রাণীটাকে একের পর এক আঘাত করতে লাগলেন।
দর্শকদের একটা অংশ চেঁচিয়ে ব্রিজেশকে উৎসাহ জোগাতে লাগল। কেউ-কেউ ইশ! আহা! করতে লাগল।
হইচই আর ভিড় দেখে সানিয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছিলেন। অনেক মুখের ভিড়ে স্বামীর মুখটা খুঁজছিলেন, কিন্তু দেখতে পাচ্ছিলেন না।
কাঠের বেঞ্চিটা ওঠা-নামা করাতে করাতে ব্রিজেশ হাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যখন থামলেন তখন প্রাণীটা একেবারে থেঁতলে গেছে। নেহাত ওটার রক্ত লাল নয়–নইলে দৃশ্যটা অনেক বীভৎস দেখাত। প্রাণীটার গোটা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও চোখ দুটো অক্ষত ছিল। প্রাণীটার নীল চোখ দুটো কেমন শান্ত মায়াময় দেখাচ্ছিল।
মৃত প্রাণীটাকে ঘিরে জটলা বাড়ছিল। প্রাণীটার নাম কী, কোন জাতের, এইসব বিষয় নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছিল। ব্রিজেশ বেঞ্চিটা একপাশে নামিয়ে রেখে হাঁপাচ্ছিলেন। অনেকেই ব্রিজেশের শক্তি আর সাহসের তারিফ করছিলেন। বলছিলেন, ব্রিজেশ প্রাণীটাকে খতম না করলে সি-বিচে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে যেতে পারত। কেউ-কেউ গতকাল ভেসে ওঠা কচ্ছপটার কথা বলছিলেন।
সানিয়া ততক্ষণে ব্রিজেশকে দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু সমুদ্রের কিনারায় জটলাটা ঠিক কীসের সেটা বুঝতে পারছিলেন না। তাই উবিগ্ন হয়ে ব্রিজেশের নাম ধরে ডাকতে শুরু করলেন।
ব্রিজেশ সানিয়ার দিকে তাকালেন। সানিয়া বেশ খানিকটা দূরে, অনেকটা উঁচুতে, বালির ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। ব্রিজেশ হাত তুলে ওঁকে আশ্বাস দিলেন। বোঝাতে চাইলেন যে, চিন্তার কিছু নেই, এখুনি তিনি স্ত্রীর কাছে ফিরে যাবেন।
কিন্তু ব্রিজেশের প্ল্যান ভেস্তে গেল একটা উটকো লোকের জন্য।
লোকটা ভিড় ঠেলে সরিয়ে, বলতে গেলে আচমকাই, ব্রিজেশের সামনে এসে উদয় হল।
লোকটার গায়ের রং বেশ কালো। লম্বাটে মুখ। ঢ্যাঙা চেহারা। গায়ে পুলিশের খাকি উর্দি। মাথায় ক্রিকেটারদের কালো ক্যাপ। হাতে তামাটে রঙের ব্যাটন।
হয়তো ওর পুলিশের পোশাক আর হাতের লাঠি দেখেই জটলা পাকানো জনতার ভিড় বেশ কিছুটা পাতলা হয়ে গেল।
লোকটা পান চিবাচ্ছিল। প্রাণীটার ডেডবডির খুব কাছে এসে ও মুখ ছুঁচলো করে পুচ করে ভিজে বালিতে পানের পিক ফেলল। তারপর লাঠিটা আলতো করে বাঁ-হাতের তালুতে ঠুকতে ঠুকতে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুখগুলোর ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল।
লাঠিটা মরা প্রাণীটার দিকে তাক করে পুলিশটি বাতাসে রুক্ষ প্রশ্ন ভাসিয়ে দিলঃ এটাকে কে মারল রে?
জনতার গুঞ্জন শুরু হল। দু-একজন একটু ইতস্তত করে ব্রিজেশের দিকে আঙুল তুলে দেখালেন।
ব্রিজেশও প্রায় একইসঙ্গে নিজের বুকে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, আমি–আমি মেরেছি…।
লোকটা ব্রিজেশের দিকে দু-পা এগিয়ে এল। লাঠি উঁচিয়ে বেশ উদ্ধতভাবে জানতে চাইল, কেন? মারলেন কেন?
এ-এমনি…।
এমনি মানে? ব্যঙ্গের হাসি হাসল পুলিশ ও সমুদ্রের মাছ-মছলি-বকচ্ছপ কি আপনার বাপের সম্পত্তি যে, এমনি-এমনি মেরে ফেললেই হল?
ব্রিজেশ একটা ধাক্কা খেলেন। লোকটা কী অভদ্রের মতো কথা বলছে! একটা পেটি কনস্টেবলের এত সাহস আর আস্পর্ধা! ব্রিজেশ দত্ত চৌধুরীর সঙ্গে এভাবে কথা বলছে! এখুনি দুটো ফোন লাগাবেন নাকি? কী করে এইসব চাকরবাকর মার্কা পুলিশের প্যান্ট খুলে নিতে হয় সেটা ব্রিজেশ ভালোই জানেন।
কী হল? কেন মারলেন, বলুন? লোকটা পান চিবোতে চিবোতে জিগ্যেস করল।
না, মানে…অ্যানিম্যালটা খুব ডেঞ্জারাস ছিল…।
কী করে বুঝলেন ডেঞ্জারাস?
এইরকম একরোখা প্রশ্নের তোড়ের মুখে পড়ে ব্রিজেশ কেমন যেন থতোমতো খেয়ে গিয়েছিলেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, মানে…ওটার চোখ দুটো কী বড়-বড়…।
হ্যাঁঃ, বড়-বড়! তাচ্ছিল্যের শব্দ করে মুখ বেঁকাল লোকটা : আপনার চোখগুলোও তো খুব বড়-বড়। তো তাই বলে আপনাকে আমি কি লাঠিপেটা করে মেরে ফেলব? বড়-বড় চোখ দেখলে কি আপনার অ্যালার্জি হয়, না পেটখারাপ হয়?
ব্রিজেশের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। এই পুলিশ কনস্টেটাকে এবার থামানো দরকার। পাবলিকের সামনে এভাবে ব্রিজেশকে হেনস্থা করছে!
ব্রিজেশ সানিয়ার দিকে তাকালেন। সানিয়া এখন উদবিগ্ন মুখে ব্রিজেশের দিকে তাকিয়ে আছেন। ব্রিজেশ ইশারায় ওঁকে কাছে ডাকলেন। ওঁর ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোনটা নেওয়া দরকার। প্রথম ফোনটা ব্রিজেশ করবেন লালবাজারে, ডেপুটি কমিশনারকে। তারপর দ্বিতীয় ফোনটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পমন্ত্রীকে। গত একবছর ধরে কোম্পানির মেগা-এক্সপ্যানশনের ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে অনেকবার আলোচনায় বসেছেন ব্রিজেশ। ভদ্রলোক বেশ সেনসি আর পজিটিভ৷
ব্রিজেশ হঠাৎই খেয়াল করলেন, ওঁদের ঘিরে থাকা ভিড়টা বেশ হালকা হয়ে গেছে। আর এখন যারা মরা প্রাণীটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা নেহাতই বালক-বালিকা গোছের।
পুলিশটার শেষ মন্তব্যের কোনও জবাব দেননি ব্রিজেশ। কী-ই বা জবাব দেবেন। তিনি সানিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মোবাইল ফোনটা ক্রমশ ওঁর হাতের নাগালে আসছিল।
পুলিশ লোকটা বাতাসে লাঠি নেড়ে ভিড় ফাঁকা করতে লাগল। তারপর ব্রিজেশের নামিয়ে রাখা কাঠের বেঞ্চির আশপাশ থেকে পাবলিক হটাতে লাগল। বেঞ্চিটা দেখিয়ে ব্রিজেশকে লক্ষ্য করে বলল, এটা মাডার ওয়েপন। এভিডেন্স ডিসটার্ব করা ঠিক না।
মার্ডার ওয়েপন! একটা সামুদ্রিক প্রাণীকে মেরেছেন বলে সেটাকে এই অসভ্য লোকটা মার্ডার বানিয়ে ফেলল।
অসভ্য লোকটা ততক্ষণে পকেট থেকে নোটবই আর পেন বের করে ফেলেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে পানের পিক ফেলে ব্রিজেশকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন শুরু করল।
নিন, এবার আপনার নাম-ঠিকানা বলুন।
ব্রিজেশ দু-এক লহমা ইতস্তত করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর শান্ত গলায় নিজের নাম-ঠিকানা বললেন।
লাঠিটা বগলে চেপে ধরে লোকটা মনোযোগ দিয়ে সেটা নোট করে নিল।
পুরীতে নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছেন? লিখতে লিখতেই পরের প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল।
হ্যাঁ–।
সঙ্গে আর কে-কে আছে?
শুধু আমার ওয়াইফ আর কেউ না।
সানিয়া ব্রিজেশের কাছে এসে পড়েছিলেন। তাই উত্তরটা দেওয়ার সময় ব্রিজেশ হাতের ইশারায় সানিয়াকে দেখালেন।
চোখ সরু করে সানিয়াকে দেখল পুলিশটা। তারপর বাঁকা সুরে বলল, সত্যিকারের ওয়াইফ, নাকি বানানো-প্যাচানো?
তা-তার মানে! ব্রিজেশ উত্তেজনায় তোতলা হয়ে গেলেন : আ-আমাদের বয়েসটা দেখেছেন। এই বয়েসে কেউ।
হাত তুলে ব্রিজেশকে মাঝপথে থামিয়ে দিল লোকটা। বালিতে পানের পিক ছুঁড়ে দিয়ে বলল, সেক্সের কেসে বয়েসটা ফ্যাক্টর নয়। পুলিশের লাইনে আমরা এরকম সুজ্ঞা-সুড্ডির কেস ঢের দেখেছি। যাকগে, ওয়াইফের নাম বলুন…।
ব্রিজেশ বললেন। ওঁর মুখে রক্তের আভা। কানের ডগা লালচে। সানিয়ার অবস্থাও একইরকম। ওঃ, এই ছোটলোকটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না!
সানিয়ার কাছ থেকে নিজের মোবাইলটা চেয়ে নিলেন ব্রিজেশ। তারপর সবে ওটার বোতাম টিপতে শুরু করেছেন, কবজির ওপরে লাঠির আলতো টোকা পড়ল : কাকে ফোন করছেন? এখন ফোন-টোন করা যাবে না–সব বন্ধ।
তার মানে? রুক্ষ গলায় প্রতিক্রিয়া দেখালেন ব্রিজেশ, ফোন করা যাবে না মানে!
হাসল উদ্ধত ছোটলোক পুলিশ। পেনটা পকেটে রাখল। তারপর হাতের এক ছোবলে ব্রিজেশের মোবাইলটা কেড়ে নিল। অনায়াসে ছুঁড়ে দিল সমুদ্রে, অনেক দূরে।
ব্রিজেশ প্রথমটা হতবাক হয়ে গেলেও তারপর ফুঁসে উঠলেন। আঙুল তুলে শাসানোর ভঙ্গিতে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই লোকটা লাঠি উঁচিয়ে খেঁকিয়ে উঠল, একদম গরম দেখাবেন না। মার্ডার করে আবার গরমবাজি! আবার বেচাল দেখলেই ডান্ডা মারতে মারতে থানায় নিয়ে যাব।
লোকটার রাগি মারমুখী ভাব ব্রিজেশকে থামিয়ে দিল। সানিয়া ভয়েভয়ে বললেন, প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন…।
লোকটা সানিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসল। দাঁতে পানের লাল ছোপ।
ম্যাডাম, আপনার হাজব্যান্ড একটু আগে সমুদ্রের এই প্রাণীটাকে মার্ডার করে ফেলেছেন– মরা প্রাণীটার দিকে লাঠির ইশারা করল লোকটা? তাই নিয়ে আপনার হাজব্যান্ডকে গোটকয়েক কোশ্চেন করতে চাইছিলাম কিন্তু তিনি তো গরম খেয়ে বসে আছেন। যার জন্যে আমার ইনভেস্টিগেশানের কাজটাই ঠেকে গেছে।
সানিয়া স্বামীর বাহুতে হাত রেখে নীচু গলায় কীসব বললেন।
ব্রিজেশ চুপচাপ কয়েকবার মাথা নাড়লেন। মনে হল সানিয়ার কথায় সায় দিলেন। তারপর পুলিশের লোকটাকে লক্ষ্য করে শান্ত গলায় বললেন, বলুন, কী জানতে চান।
লোকটা চারপাশে ভিড় জমানো মানুষজনকে আচমকা খেঁকিয়ে উঠল : কী চাই আপনাদের? যান, যান, নিজের নিজের কাজে যান। এখান থেকে ফুটুন। কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে লোকটা শূন্যে লাঠি নাচিয়েছিল।
ওর ধমকে ভালোই কাজ হল। তা সত্ত্বেও একটু ফাঁকা জায়গায় সরে দাঁড়াল লোকটা ব্রিজেশদেরও ইশারায় ডেকে নিল।
এবার ব্রিজেশের দিকে তাকাল পুলিশ ও একদম শুরু থেকে বলুন। অ্যানিম্যালটাকে প্রথম কখন দেখলেন? তখন ওটা কী করছিল?
ব্রিজেশ এতক্ষণ চুপচাপ থেকে নিজেকে ধাতস্থ করছিলেন। সানিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে প্রাণীটার সঙ্গে ওঁর দেখা হওয়ার ব্যাপারটা খুলে বললেন।
লোকটা চুপচাপ শুনতে লাগল। লাঠি বগলে রেখে ব্রিজেশের স্টেটমেন্ট টুকে নিল। তারপর নোটবই-পেন পকেটে রেখে হাতে হাত ঘষল।
অ্যানিম্যালটা কি আপনাকে অ্যাটাক করতে এসেছিল?
ব্রিজেশ ইতস্তত করে বললেন, না মনে হয়…না।
হুঁ– তা হলে ওটাকে আপনি মারতে গেলেন কেন?
ওটা ওরকম বড় বড় চোখে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে দেখে আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মানে, না-নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। তাই…।
তাই অ্যাটাক করলেন?
ব্রিজেশ কেমন বিভ্রান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ। মানে, ওরকমই বলতে পারেন।
চুপচাপ পান চিবাতে লাগল পুলিশ। তারপর শব্দ করে পানের পিক ফেলে বলল, আচ্ছা, দেখুন–এমনও তো হতে পারে, আপনাকে দেখে ওই অ্যানিম্যালটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ওটা…।
বাধা দিয়ে ব্রিজেশ বললেন, ওটা দেখতে খুব বীভৎস…।
প্রাণীটার ডেডবডি লক্ষ্য করে তাকালেন ব্রিজেশ। ওটা ঘিরে এখনও লোকজনের ভিড়। সক্কালবেলা এরকম রোমাঞ্চকর দৃশ্য কে ছাড়ে! না, মানুষের পাঁচিল ভেদ করে প্রাণীটাকে দেখা যাচ্ছে না।
পুলিশটা মুচকি হেসে ব্রিজেশকে বলল, আমি যদি বলি, প্রাণীটা আপনার বীভৎস চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
ব্রিজেশ থতোমতো খেয়ে গেলেন। এ আবার কেমন কথা! ব্রিজেশকে দেখতে বীভৎস? আশ্চর্য!
আমাকে বীভৎস দেখতে?
হ্যাঁ হাসল পুলিশঃ ওই প্রাণীটার চোখে। আহা-হা, রাগ করবেন না–এরকম হতেও তো পারে! ফলে জানবেন, আপনার দেখার অ্যাঙ্গেলটাই সব নয়। অন্যদের আঙ্গেলটারও একটা দাম আছে।
সানিয়া ব্রিজেশের কাছ ঘেঁষে এসে স্বামীকে কানে-কানে কী যেন বললেন। ব্রিজেশ হাতের ইশারায় ওঁকে বোঝাতে চাইলেন, ঠিক আছে, দেখছি।
দু-একবার ঢোক গিলে ব্রিজেশ পুলিশটাকে বললেন, দেখুন, যা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এখন ব্যাপারটা কীভাবে মেটানো যায় বলুন।
ভুরু কপালে তুলল পুলিশ ও তার মানে? আমাকে কি আপনি ঘুষ খাওয়ানোর কথা ভাবছেন?
না, না–সে-কথা বলিনি…।
একটা হাত কোমরে রাখল, অন্য হাতে লাঠিটা নাচাল।
কী বলছেন আমি ভালোই বুঝেছি। চমৎকার! একে তো একটা নিরীহ প্রাণীকে বলা নেই কওয়া নেই অ্যাটাক করে খুন করলেন। তার ওপরে একজন সৎ পুলিশকর্মীকে অসৎ করার চেষ্টা করছেন?
সানিয়া কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলেন, প্লিজ, অফিসার। ওকে মাফ করে দিন। ও ভুল করে ফেলেছে। প্লিজ!
ব্রিজেশ স্ত্রী-কে প্রায় খিঁচিয়ে উঠলেন, হ্যাভ য়ু গন ক্রেজি, সানি? হোয়াই আর য়ু বেগিং টু আ পেটি কনস্টেবল?
শাট আপ! লোকটা এমনভাবে চিৎকার করে ধমকে উঠল যে, ব্রিজেশের পিলে চমকে গেল। সানিয়ার দিকে তাকিয়ে লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল, ম্যাডাম, আপনার ইংলিশ মিডিয়াম স্বামীকে সামলে রাখুন। নইলে, এখানেই ফেলে পেটাতে শুরু করব। পাছায় দু-ডান্ডা দিলে সিধে হয়ে যাবে। কথা বলতে-বলতে লাঠিটা মারাত্মক ভঙ্গিতে উঁচিয়ে ধরল লোকটা। ওর চোখ লাল। মনে হচ্ছে যেন চোখ দিয়ে পান চিবিয়েছে।
ব্রিজেশ সঙ্গে-সঙ্গে আত্মরক্ষার ঢঙে দু-হাত তুলে সরি! সরি! বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজের রাগ সামলে নিল পুলিশ। সানিয়াকে দেখে মায়া হল ওর। ব্রিজেশের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, আসলে কী জানেন, আপনাদের মতো প্রাণীদের প্রবলেম হল, যে-জিনিস আপনারা কখনও দেখেননি সেটা আপনাদের শত্রু। আপনাদের চোখে সেটা বীভৎস, ডেঞ্জারাস। তাই তাকে দেখামাত্রই খতম করতে হবে। তক্ষুনি। আরও সহজ করে বলতে হলে, আপনাদের অপছন্দের জিনিসকে আপনারা সহ্য করতে পারেন না।
থু-থু করে পানের পিক ফেলল পুলিশটা। মাথার টুপিটা খুলে নিল। মাথায় হাত বোলাল। তারপর টুপিটা আবার মাথায় বসিয়ে বলল, আমাদের স্বাধীনতার লড়াই লালমুখো ব্রিটিশদের পছন্দ ছিল না। তাই শালারা সেটা ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহ কিংবা সিপাহি-বিদ্রোহের বেলায়ও তাই। ভিয়েতনামের স্বাধীনতা চাওয়ার লড়াই মার্কিন সরকার বা ফরাসি সরকারের পছন্দ ছিল না। তাই কত প্রাণ বেমালুম খরচ হয়ে গেল!
তেমনই আপনি। ওই যে–মরে পড়ে আছে–ওই প্রাণীটা আঙুল তুলে ডেডবডি ঘিরে থাকা জটলার দিকে দেখাল পুলিশ ও ওটা আপনার অপছন্দের ছিল, তাই আপনি ওটাকে সরাসরি খুন করলেন। কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনাকে অনেকেই অপছন্দ করে? যেমন, ওই প্রাণীটা। আপনার অফিস কি ব্যবসায় জড়িয়ে থাকা অনেক লোক। সানিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারা করে হাসল, বলল, এমনকী আপনার ওয়াইফও হয়তো আপনাকে অপছন্দ করেন।
ব্রিজেশ প্রতিবাদ করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ওঁকে হাত তুলে থামিয়ে দিল পুলিশ। খেঁকিয়ে উঠে বলল, একদম চুপ। আপনার কথা ঢের শুনেছি–এখন আপনি শুনুন। আপনাকে যারা-যারা অপছন্দ করে তারা কিন্তু এখনও আপনাকে খতম করেনি। ওই প্রাণীটাও হয়তো আপনাকে অ্যাটাক করে ছিন্নভিন্ন করতে পারত, কিন্তু করেনি। এখন করেনি–কিন্তু পরে যে করবে তার গ্যারান্টি কিন্তু কেউ দিতে পারবে না। আমিও না। তাই এখন থেকে সাবধান থাকবেন– সিরিয়াসলি বলছি…।
সানিয়া স্বামীর হাত চেপে ধরলেন। ব্রিজেশ টের পেলেন সানিয়ার হাত কঁপছে। সেইসঙ্গে ওঁর নিজেরও।
পুলিশটা ইউনিফর্মে হাত ঘষল। তারপর চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াল।
ব্রিজেশ চাননি, কিন্তু ওঁর মুখ দিয়ে হঠাৎই বেরিয়ে এল, থ্যাংক্স…। সেইসঙ্গে বেরিয়ে এল একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস। এতক্ষণ ওঁর বুকটা কেমন ধড়ফড় করছিল, বুকের ভেতরে টেনশান জমা হচ্ছিল।
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল পুলিশ। ব্রিজেশের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আজ সমুদ্রে খুব ভালো করে স্নান করবেন। সমুদ্র অনেক বড়। অনেক ময়লা ধুয়ে দেয়। আপনাকে ধুয়ে-টুয়ে সাফ করে দেবে।
এই কথা বলে লোকটা চলে গেল।
ব্রিজেশ তাকিয়ে-তাকিয়ে লোকটার চলে যাওয়া দেখতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ পর চোখ সরিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালেন। ওঁর মনে হল, সত্যি, বড় দেরি হয়ে গেছে। আজ সমুদ্রে খুব ভালো করে স্নান করবেন ব্রিজেশ।