ভয়ঙ্কর ভাড়াটে ও পরাশর বর্মা – প্রেমেন্দ্র মিত্র
বাড়ি খুঁজে বের করে ভেতরে গিয়ে বসতে না বসতেই প্রথম কবিতার খাতার চাপে প্রায় দমবন্ধ হবার জোগাড়। একটি-দুটি নয়, পাঁচ-পাঁচটি মোটা বাঁধান খাতা, আর প্রত্যেকটি খাতা আগাগোড়া কবিতায় ঠাসা।
প্রথম খাতা খুলে প্রথম কবিতা পড়েই চক্ষুস্থির।
কবিতাটির নমুনা :
যদি বল, মাঝরাতে ঘুম যেই ভেঙে যায়
ছটফট কর শুধু বিছানায়
আমি বলি ভাবনা কি?
ঘুম যদি নাহি আসে—
ছাদে গিয়ে দাঁড়াও না খাড়া পায়।
দেখবে শহর ঘুমে মগ্ন।
দূরে কোথা গাড়ি চলে যাচ্ছে।
ঠিক যেন মাঝে মাঝে
চিৎ হয়ে শুতে গিয়ে ঘড়ঘড় নাক তার ডাকছে।
বিছানায় নিঃসাড়ে ছারপোকা মশারা
যেভাবে কামড় দিতে ব্যস্ত ;
চোর, বাটপাড় আর বদমাস যেথা যত—
কোথা নেই কেউ অলস ত।
আহা কিবা মনোহর
তারাদের ঝিকমিক
মনে হয় আকাশেতে কারা করে পিকনিক।
আমি তাই বলি মিছে।
যেও নাকো ঘাবড়িয়া
মাঝে মাঝে মন্দ কি
হলে ইনসোমনিয়া।
কবিতাটি শেষ ক’রে খাতা থেকে মুখ তোলার আগেই লেখকের সলজ্জ মন্তব্য শোনা গেল, ‘আমি একটু আধুনিক ধরণেরই লিখি, তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন।’
যাঁরা এ-লেখা পড়ছেন, তাঁরাও এতক্ষণে বোধ হয় বুঝেছেন যে এ কবিতার লেখক পরাশর বর্মা ছাড়া আর কেউ নয়। নিজের গরজে তাঁরই বাড়ি খুঁজে আজ সকালে এসে পৌঁছবামাত্র তিনি আনন্দে এমন গদগদ হয়ে উঠেছেন যে আসল কথাটা বলবার এখনও সময়ই পাইনি।
খিদিরপুরের একটি গলির ভেতর বাড়ি। দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তেই হঠাৎ একেবারে কানের কাছে ভারী গলায় ‘কাকে চান?’ শুনে চমকে উঠেছি।
কাছে-পিঠে তো কেউ নেই!
এ অশরীরী গলা তাহলে কোথা থেকে এল?
বিস্ময়ের ধাক্কাতেই মুখ থেকে আপনা হতে বেরিয়ে গেছে, ‘আজ্ঞে, পরাশর বর্মাকে।’
‘নাম বলুন আপনার!’ আবার সেই ভূতুড়ে আওয়াজ।
নামটা বলার পরই দরজাটা যেন মন্ত্রবলে খুলে গেছে। কিন্তু দরজার ওধারেও তো কেউ নেই!
সত্যিই ঢুকব, না এইখান থেকেই সরে পড়ব ভাবছি, এমন সময় ভেতরের ঘর থেকে স্বয়ং পরাশর বৰ্মাই বেরিয়ে এসেছেন।
‘আরে আসুন, আসুন। আমার কি সৌভাগ্য!’ পরাশর বর্মার কণ্ঠে সাদর অভ্যর্থনা।
ভূতুড়ে আওয়াজের অস্বস্তিটা তখনও কাটাতে পারিনি! সন্দিগ্ধ ভাবে পেছনে একবার তাকিয়ে তাঁর পিছু পিছু ভেতরের ঘরে গিয়ে ঢোকবার পথে জিজ্ঞাসা করেছি, ‘ব্যাপারটা কি বলুন তো! এসব ভূতুড়ে কাণ্ড-কারখানার মানে কি?’
‘ভূতুড়ে!’ প্রথমে একটু অবাক হয়ে পরাশর বর্মা হেসে উঠেছেন। আরে না, ভূতুড়ে হবে কেন? চাকর-বাকর পাওয়া আজকাল কিরকম শক্ত জানেন তো, তাই একটু বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থার পরিচয় তাঁর বাড়িতে তারপর আরও অনেক পেয়েছি। কিন্তু সে প্রসঙ্গ আজ থাক।
যেখানে তারপর ঢুকেছি, সাদাসিধে ভাবে সাজান সেটি সাধারণ বসবার ঘর। শুধু চেয়ার টেবিলের বদলে দেশী ধরণের নিচু গদি দেওয়া বসবার আসন।
একটিতে তার বসতে না বসতেই কবিতার আক্রমণ শুরু হয়েছে। পরাশর বর্মা এই ঘরে বসেই বোধ হয় কাব্যচর্চা করছিলেন। ঘরটার চারদিকে আমার চোখ বোলান শেষ হতে না হতেই দেখি সামনে বাঁধান খাতাগুলি উপস্থিত।
পরাশর প্রথম খাতাটি তুলে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলেছেন, ‘আপনি নিজে থেকে আমার খোঁজ করতে আসবেন ভাবতেই পারিনি। কিন্তু এসেছেন যখন তখন আপনাকে সব না পড়িয়ে ছাড়ছি না। কি খাবেন বলুন, চা না কফি?’
বিমূঢ়ভাবে খাতাগুলির দিকে চেয়ে চা, না কফি, কিসে সায় দিয়েছি মনে নেই।
ভদ্রতার খাতিরে প্রথম খাতাটা হাতেও তুলে নিতে হয়েছে।
তারপর নামাবার অবসর আর পাইনি।
একেবারে কবিতার শিলাবৃষ্টি সমানে চলেছে।
প্রথমটির নমুনা আগেই দিয়েছি। আরও একটি না তুলে দিয়ে পারছি না। পরাশর বর্মার এটি অত্যন্ত নাকি প্রিয় কবিতা। কবিতার নাম ‘পকৌড়ি’ । পকৌড়ি নিয়ে আধ্যাত্মিক কবিতা অন্তত কেউ লিখেছেন বলে কোন সাহিত্যে আমার জানা নেই।
পকৌড়ি তুমি অতি তুচ্ছ
আশা তব নয় মোটে উচ্চ
কি তেলে যে ভাজা হও নাই তব পরোয়া
তবু তব স্বাদ কভু পায় নাকো ঘরোয়া
তেলেভাজা বেসন কি ডালবাটা যাই হোক।
তুমিই সুলভতম রসনার সম্ভোগ।
রহস্য ও স্বাদের কিসে কোন মশলায়
জানলে এ দুনিয়ার সব গোল মিটে যায়।
রাস্তার ধুলো সে কি, সকলের মাড়ানো?
ভেজাল তেলের গুণ, বার বার পোড়ানো?
শুধু তাই নয় আরও আছে বিশেষত্ব
জনগণ মন দিয়ে খুঁজে সেই তত্ত্ব।
কবিতার স্রোতে যখন হাবুডুবু খাচ্ছি, এমন সময় কফি এল। এবার আর ভৌতিক কায়দায় নয়, রক্তমাংসের চাকরের হাতে কাঠের ট্রের ওপরে।
কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে একটু ফাঁক পেয়ে আসল কথাটা পাড়লাম, ‘আপনার কাছে একটা বিশেষ দরকারে এসেছিলাম পরাশরবাবু।’
‘ঠিক আছে। তার জন্যে কিছু ভাববেন না। যে ক’টা কবিতা আপনার পছন্দ হয়, সব আপনি নিয়ে যেতে পারেন!’ —বলে পরাশর বর্মা আবার কবিতা পড়বার উপক্রম করলেন।
সন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, ‘আজ্ঞে কবিতা, তা তো নেবই, কিন্তু তার আগে আমার কথাটা যদি একটু শোনেন! একটা রহস্যের কিনারা করতে আপনার সাহায্য চাই।’
‘বেশ তো! বেশ তো! কি রহস্যটা বলেই ফেলুন না!’—বলে পরাশর বর্মা ভরসা দিলেন।
কিন্তু ওই ভরসা পর্যন্তই। তাঁর আর একটি কবিতা পড়া তখন শুরু হয়ে গেছে।
উপায় নেই। তাই ওই কবিতার-ফাঁকে ফাঁকেই কোনরকমে ঘটনাগুলো তাঁকে জানালাম। তাঁর কানে কথাগুলো গেল কিনা তাই সন্দেহ।
ফল যে কিছু হবে সে আশা তখন আর নেই। মনে মনে এই কাব্য-পাগলা মানুষটার কাছে রহস্যের মীমাংসা করাতে আসাটাই আহাম্মকী হয়েছে বলে নিজেকে তখন দোষ দিচ্ছি। কবে কি সামান্য একটা রহস্যের কিনারা করেছিল বলে তার বুদ্ধি-শুদ্ধি সম্বন্ধে অত উঁচু ধারণা করাই অন্যায় হয়েছে মনে হচ্ছিল।
রহস্যের মীমাংসায় আর দরকার নেই। এ লোকের হাত থেকে ছাড়া পেলেই এখন বাঁচি।
নিজের বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ভদ্রতার খাতিরে আরও ঘণ্টাখানেক কবিতা শুনে মাথা যখন ঝিমঝিম করছে, তখন একটু ফাঁক পেয়ে বললাম, ‘আজ আমার একটু কাজ আছে পরাশরবাবু, তাই এখন না উঠলে নয়।’
বেশ একটু হতাশ হয়ে পরাশর বর্মা বললেন, ‘এখুনি উঠবেন! কিন্তু সবে তো একটি খাতাই মোটে শেষ হয়েছে।’
সভয়ে অন্য খাতাগুলোর দিকে চেয়ে বললাম, ‘একটা খাতাতেই যা পেলাম তাই আগে সামলাই দাঁড়ান। এত ভাল জিনিস সব একসঙ্গে হজম করতে পারব না যে!’
কথাটার মধ্যে বিদ্রূপের সুরটা খুব প্রচ্ছন্ন ছিল না। কিন্তু পরাশর বর্মা খুশি হয়েই বললেন, ‘তা ঠিক বলেছেন, আবার একদিন শোনানো যাবে, কি বলেন?’
আমার উৎসাহের অভাবটা লক্ষ্য না করেই পরাশর বর্মা আবার বললেন, ‘কিন্তু আপনার রহস্যের কিনারাটা তো করে ফেলতে হয়।’
এবার অসন্তোষটা গোপন না করেই বললাম, ‘না থাক, তার আর দরকার নেই।’
পরাশর বর্মা এবারও উল্টো বুঝলেন। যেন প্রসন্ন হয়েই বললেন, ‘ও, নিজেই এর মধ্যে মীমাংসা করে ফেলেছেন বুঝি! করে ফেলাই অবশ্য উচিত। রহস্যটা এমন কিছু নয়।’
‘এমন কিছু নয়!’ রাগব না অবাক হব বুঝতে না পেরে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গেই বললাম, ‘রহস্যটা কি না জেনেই বলছেন,—এমন কিছু সেটা নয়!’
‘বাঃ—’পরাশরই এবার যেন অবাক। ‘রহস্যটা না জেনে কি রকম! আপনি এতক্ষণ ধরে বললেন কি তাহলে?’
‘আমি তো বলেছি। কিন্তু আপনি তো নিজের কবিতা পড়াতেই মত্ত। শুনেছেন আমার কথা কিছু?’
‘শুনিনি মানে!’ এবার পরাশর হাসলেন, ‘আচ্ছা, আমিই তাহলে ব্যাপারটা বলি, আপনি মিলিয়ে নিন ঠিক হচ্ছে কি না! ব্যাপারটা সংক্ষেপে হল এই : আপনাদের পাড়ায় একটি বাড়ি আছে। পুরোন ভাঙা বাড়ি, কিন্তু বছর দু’এক আগে এক অবাঙালী ভদ্রলোক সেটা কিনে মেরামত করিয়ে প্রায় নতুন করে তোলেন। ভদ্রলোকের নাম এস কাউল। তাঁর কোন কুলে কেউ আছে বলে আপনারা জানতে পারেননি। ভদ্রলোক একাই বাড়িতে থাকতেন। সঙ্গী শুধু একটা কুকুর। কাউল সাহেব খুব মিশুক লোক নয়। পাড়ায় কারুর সঙ্গে বিশেষ আলাপ পরিচয় তাই তিনি করতেন না। তবে মাঝে মাঝে বাড়িতে খুব জাঁকজমক করে উৎসব খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপার হত। হোমরাচোমরা বড়লোক, ব্যবসাদার, কারখানার মালিকরাই সাধারণত আসতেন! বড় বড় গাড়িতে রাস্তা ভর্তি হয়ে যেত। নাচ-গানের ব্যবস্থাও থাকত। আপনারাও কেউ কেউ এইসব উৎসবের দু’একটিতে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন। অত লোকের ভিড়ের মধ্যে কাউল সাহেবের সঙ্গে বিশেষ আলাপের সুযোগ হয়নি। কিন্তু তাঁর নিজের সাজগোজ থেকে তাঁর বাড়ির সবকিছু ব্যবস্থার মধ্যে তাঁর রুচির পরিচয়, তাঁর অমায়িক ব্যবহার, আর বিশেষ করে রেশমি পাকা চুল দাড়ির ভেতর দিয়ে তাঁর মুখের সৌম্য প্রসন্নতা আপনাদের ভাল লেগেছে। কথা তাঁর মুখে খুব কমই শুনেছেন, শুধু বাংলা বলতে পারতেন না বলে নয়, ভদ্রলোক কথাই বলতেন কম।
বাড়িটা তখনই আপনাদের অদ্ভুত লাগত।
উৎসব হয়ে যাবার পরদিন সকালেই আবার সব নিঝুম। মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক ছাড়া বহুকাল আর তারপর সেখানে কোন সাড়াশব্দই পাওয়া যেত না। মনে হত উৎসবটাই যেন স্বপ্ন। ওই ভূতুড়ে গোছের নির্জন বাড়ি যে একরাত্রে আলোয় ঝলমল মানুষ-জনে গমগম করে উঠেছে, কখনো বিশ্বাসই হতে চাইত না।
মাঝে মাঝে কাউল সাহেবকে বাড়ি থেকে বেরুতে কি বাড়িতে ঢুকতে অবশ্য দেখা যেত। বাড়ির দরজার সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে দরজায় তালা দিয়ে তিনি শুধু একটি ছড়ি হাতে ট্যাক্সিতে উঠে কোথায় যে যেতেন আপনারা জানেন না।’
পরাশর বর্মা একটু থামতেই সবিস্ময়ে বললাম, ‘আশ্চর্য!’
পরাশর একটু হেসে বললেন, ‘আশ্চর্যটা কি! সব কথাই আপনার শুনেছি, এই তো! দাঁড়ান, আগে সবটা মেলে কি না দেখুন!’
পরাশর বলতে শুরু করলেন আমায় থ বানিয়ে, ‘শেয়ার-মার্কেট বা ওই রকম কোনও জায়গায় যে তিনি যেতেন, এইটে আপনারা অনুমান করতেন মাত্র! এ নিয়ে বিশেষ মাথা কেউ ঘামায়নি। দরকারও হয়নি। একদিন শুধু পাড়ার ছেলেরা ওই বাইরের দরজাতেই সরস্বতী পুজোর চাঁদার জন্যে তাঁকে ধরেছিল। তিনি কড়কড়ে একটি একশ’ টাকার নোট এতটুকু দ্বিধা না করে চাঁদা হিসেবে দিয়ে যথারীতি দরজায় তালা দিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে চলে গিয়েছিলেন।
কিন্তু একদিন হঠাৎ সেই যে দরজায় তালা দিয়ে বেরিয়ে গেছেন আর ফেরেননি। তাঁকে বাড়ি থেকে বেরুতে অবশ্য কেউ দেখেনি, কিন্তু পরপর কয়েকদিন দরজায় সমানে বন্ধ তালা ঝুলতে দেখে আপনাদের কেমন আশ্চর্য লেগেছে।
কাউল সাহেব গেলেন কোথায়?
দিনের বেলায় যে যার নিজের ধান্দায় থাকেন, অত খেয়াল থাকে না, কিন্তু রাত্রে সেই বাড়ির ভেতর থেকে কুকুরের ডাক শুনে হঠাৎ মনটা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। কাউল সাহেবের হল কি?
দিন কয়েক এমনি কাটবার পর পাড়ার অনেকেই একটু ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু করবার তো কিছু নেই। তালা ভেঙে পরের বাড়িতে তো ঢোকা যায় না। যা রাগী কুকুর, সেটা নিরাপদও হবে না। আর পুলিশে খবর দেবার মত কিছু হয়েছে কি না তাও তখনও বুঝতে পারছেন না।
একটা কিছু কিন্তু করা দরকার আপনাদের মনে হল। আপনাদের ছাড়া আরও অনেকের যে তা মনে হয়েছে পরের দিন বুঝতে পারলেন। ছুটির দিন পরের পর বড় বড় মোটর আসে আর দরজায় তালা দেখে হতাশ হয়ে চলে যায়। কেউ কেউ আপনাদের কাছে খোঁজ-খবরও নিলে। আপনারা কি আর জানেন যে বলবেন, আপনারাই বরং শুনে অবাক হলেন যে যারা এসেছে তাদের অধিকাংশই পাওনাদার। শুনলেন যে অনেকেই নাকি কাউল সাহেবের কাছে অনেক পায়। ফট্কা-বাজারে কাউল সাহেব নাকি বড় দাঁও মারতে গিয়েই কাৎ হয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন। পাওনাদাররা নাকি একজোট হয়ে তাঁর বাড়িটা নিলামে তোলবার ব্যবস্থা করছেন। এও ক’দিন বাদে শুনলেন।
কিন্তু বাড়ি নিলামে আর উঠল না। কাউল সাহেব উধাও হবার হপ্তাখানেক বাদেই একদিন দেখেন বাড়ির বাইরের দরজার তালা খোলা। ভেতরে মিস্ত্রী লেগেছে আবার বাড়ি মেরামত আর চূণকাম করতে।
ব্যাপার কি? কে এলেন আবার এ বাড়িতে?
আপনাদের কৌতূহলী হয়ে বেশিক্ষণ থাকতে হল না। বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে না যেতে বাড়ির নতুন মালিক নিজেই গায়ে-পড়া হয়ে এসে আলাপ করলেন আপনাদের সঙ্গে। মনে হল বেশ মিশুক। খালি গায়ে ধবধবে পইতের সঙ্গে কাঁধে গামছা ফেলা। পরনে আটহাতি খাটো ধুতি, পায়ে খড়ম। বেলের মত চাঁছা ছোলা মাথা ভরতি টাক, কামানো গোল মুখের সঙ্গে যেন মানানসই করে তৈরি। কথায় একটু রাঢ় দেশের টান। ভদ্রলোক নিজে থেকেই আলাপ পরিচয় করেছেন ও সারাক্ষণ নিজের কথাই বলেছেন। এসেছিলেন কিছু জানা যায় কি না চেষ্টা করে দেখতে। ভদ্রলোকের অনর্গল কথার তোড়ে দিশেহারা হয়ে মনে হয়েছে ছাড়া পেলে বাঁচেন।
ভদ্রলোকের নাম বিশ্বম্ভর রায়। তাঁর সব কথাই শুনেছেন। কাউল সাহেবের আর সব পাওনাদারের মত তিনিও কেমন করে ফাঁকি পড়তে বসেছিলেন, শুধু নেহাৎ বরাত জোরে কি করে কাউল সাহেবের অন্তর্ধানের আগে তার কাছ থেকে বাড়িটা নিজের নামে কিনে নিতে পেরেছেন, বাড়িটা পেয়েও এখনও কি গণ্ডগোল তাঁকে পোহাতে হচ্ছে, অন্য পাওনাদাররা সারাদিন কি ভাবে এসে জ্বালাতন করছে, কেউ কেউ বাড়ি বিক্রি নাকচ করবার চেষ্টাও নাকি করছে—এই সব কাহিনীই তিনি বলে গেছেন!
কাউল সাহেবের উধাও হওয়া যত অদ্ভুতই হোক, দু’চারদিন বাদে আপনারাও ব্যাপারটা প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। এমন সময় আপনাদের পাড়ারই যে মিউনিসিপ্যাল পুকুরটায় ছেলেরা সাঁতার শেখে, তার তলা থেকে একটা ছড়ি একটি ছেলে ডুব দিতে গিয়ে তুলে এনেছে। সে ছড়িটা এমন কিছু আশ্চর্য জিনিস নয়, তবু আপনাদের দু’একজনের মনে হয়েছে ঠিক এই রকম ছড়িই যেন কাউল সাহেবের হাতে আপনারা দেখেছেন। ব্যাপারটা এত সামান্য যে এ নিয়ে পুলিশে যাওয়া যায় না, অথচ মনের সন্দেহ দূর হয় না।
ক’জনে মিলে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে রহস্যটা যেন গভীর হয়ে উঠেছে। আপনাদের মনে পড়েছে যে বিশ্বম্ভরবাবু কখন কবে যে তালা খুলে ও-বাড়িতে ঢুকেছেন আপনারা কেউই দেখেননি! সেটাও না হয় অগ্রাহ্য করা গেল, কিন্তু বিশ্বম্ভরবাবুর চাল-চলনও কেমন অদ্ভুত মনে হয়েছে এবার। সেই প্রথম ক’দিন সকলের সঙ্গে মেলামেশার পর তিনি যেন ডুব মেরেছেন একেবারে। মিস্ত্রী-মজুর বাড়িতে আর খাটছে না। তালা দেওয়া না হলেও দরজা বন্ধই থাকে বেশির ভাগ। রাত্রে মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক ছাড়া বাড়ি আগেকার মতই যেন নিস্তব্ধ।
এর মধ্যে পাড়ার একটি রাস্তায় এক রাত্রে কাউল সাহেবের সেই কুকুরটাকে একটি ছেলে ন’টার শেষ বায়স্কোপ ভাঙবার পর বাড়ি ফেরবার পথে দেখতে পায়। বিশ্বম্ভরবাবুকেও নাকি গভীর রাত্রে কেউ কেউ ব্যস্তসমস্ত হয়ে নির্জন রাস্তায় হাঁটতে দেখেছে। তাঁকে অনুসরণ করতে গিয়ে কিন্তু ফল হয়নি কিছু। তিনি যেন বুঝতে পেরে এদিক-ওদিক ঘুরে বাড়িতেই ফিরে এসেছেন।
সমস্ত ব্যাপার জড়িয়ে আপনাদের মনে একটা দারুণ সন্দেহ জট পাকিয়ে উঠেছে। কাউল সাহেব সত্যিই দেনার দায়ে পালিয়েছেন না তাঁর অন্তর্ধান হওয়ার ব্যাপারে অন্য কোন রহস্য আছে! কাউল সাহেবের সঙ্গে বিশ্বম্ভরবাবুর সম্পর্কটা কি ও কতটা তা নিয়েও আপনাদের মনে সন্দেহ জেগেছে। শুধু নিজেদের মনের এই সন্দেহ নিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়া এখুনি সঙ্গত হবে কিনা ঠিক করতে না পেরে আমার কাছে এসেছেন, কেমন?’
উত্তর দেবার আগে বেশ কিছুক্ষণ অবাক হয়ে পরাশর বর্মার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন। সমস্ত ব্যাপারটা মোটেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।’
‘সাংঘাতিক কিছুও এর ভেতর থাকতে পারে মনে হচ্ছে, তাই না?’
বাধ্য হয়ে স্বীকার করলাম যে আমাদের আশঙ্কা সেই রকম।
পরাশর গম্ভীর হয়ে খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘যেমন, কাউল সাহেব পালিয়ে যাননি, তাঁকেই কেউ হয়তো সরিয়ে ফেলেছে, পুকুরের ভেতর থেকে ছড়িটা পেয়ে এই রকম অনুমানই হয়।’
উৎসাহিত হয়ে উঠে বললাম, ‘আমরাও ঠিক তাই ভেবেছি। শুধু ছড়িটা পাওয়া গেলেও লাশটা কেন পাওয়া যায়নি তাই বুঝতে পারছি না।’
‘লাশটা তো বাড়ির ভেতরেই থাকতে পারে?’ পরাশরের গলা অত্যন্ত গম্ভীর।
অবাক হয়ে বললাম, ‘বাড়ির ভেতরে? তাহলে?’
‘তাহলে লাশ আর খুনে দুই যাতে ধরা পড়ে তার ব্যবস্থা এখুনি করা দরকার।’ বলে পরাশর পাশের ফোনটা তুলে নিলেন।
‘ও কি, ফোন করছেন কোথায়?’ সবিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম।
ততক্ষণে ফোনের নম্বর ঘোরান হয়ে গেছে।
‘হ্যালো!’ বলে পরাশর যার নাম করলেন, তিনি যে পুলিশের গোয়েন্দা-বিভাগের মস্তবড় কর্মচারী তা জানি বলে আমি আরও অবাক।
বিমূঢ় ভাবে পরাশরের ফোনের আলাপ শুনতে লাগলাম।
‘হ্যাঁ, আমি পরাশর। না, না গদাধর নয়, পরাশর—হ্যাঁ, পরাশর বর্মা, কবি পরাশর বর্মা। না, না কবিতা শোনাতে ডাকছি না, ডাকছি তোমাদেরই একটু উপকার করতে। নিতাই মুস্তোফি স্ট্রীটের এস কাউল সম্বন্ধে কোনও কৌতুহল আছে কী? আছে। বেশ! তার অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা করতে চাও? কাউল সাহেবকে কেউ সরিয়েছে সন্দেহ করছ? ভাল ভাল! আমাদের কৃত্তিবাসবাবুরও তাই মত। কৃত্তিবাসবাবু কে? চিনবে না ঠিক। সাহিত্যের খবর তো রাখ না, তিনি মস্তবড় এক কাগজের সম্পাদক। কবিতা শুনতে এসেছেন আমার বাড়িতে। যাক্, এখন ওসব কথার সময় নেই। কাউল সাহেবের লাশ পাচ্ছ না! পাবে। লাশ আর খুনী একসঙ্গেই। এখুনি চলে যাও মুস্তোফি স্ট্রীটে। বিশ্বম্ভরবাবুকে এখনও পেতে পার। ওয়ারেন্ট নিয়ে যাও সঙ্গে। একেবারে দেখামাত্র গ্রেফতার। হ্যাঁ, হ্যাঁ, গ্রেফতার। প্রমাণ? প্রমাণ তিনি নিজেই। তাঁর অনেক কীর্তি ঘাটলে বেরুবে। হ্যাঁ, তিনিই লাশ আর তিনিই খুনী!’
ওধারে গোয়েন্দা-বিভাগের উচ্চ কর্মচারী আর এধারে আমাকে সমান ভাবে বিমূঢ় করে পরাশর বর্মা ফোনটা তৎক্ষণাৎ নামিয়ে রেখে দিলেন।
বিস্ময়ের ধাক্কাটা একটু সামলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি হঠাৎ ক্ষেপে গেলেন নাকি! না, আপনাদের মধ্যে এরকম ঠাট্টা ইয়ার্কি চলে!’
‘ঠাট্টা ইয়ার্কি!’ পরাশর হাসলেন। ‘পুলিশের লোকের সঙ্গে এমনি যত বন্ধুত্বই থাক, আসল ব্যাপারে ঠাট্টা ইয়ার্কি চলে না।’
‘তার মানে? বিশ্বম্ভরবাবুই কাউলের লাশ আর খুনে—একথার মানে কী?’
‘মানে যা বলেছি তাই। কাউল বলে কেউ নেই। বিশ্বম্ভর রায়ই কাউল সেজে দুনিয়া শুদ্ধ সকলকে ঠকিয়েছেন, এখন বিশ্বম্ভর হয়ে জাল গুটিয়ে আবার অন্য মৃগয়ায় যাবার তালে আছেন। তখন বাংলা বলতেন না, সাদা দাড়ি গোঁফ দিয়ে সৌম্য বিদেশী সেজে থাকতেন, এখন আবার বাংলা চেহারাটা বের করেছেন। সকলকে ফাঁকি দেবেন বলেই যেখানে যা পেরেছেন হাতিয়ে নিয়ে বাড়িটি নিজেকেই অন্য নামে বিক্রি করে গেছেন।’
‘কিন্তু চোখে কিছু না দেখে শুধু আমার কাছে গল্প শুনে আপনি এ রহস্য বুঝলেন কি করে?’
‘বুঝলাম কুকুরের ডাকে!’
‘কুকুরের ডাকে?’
‘হ্যাঁ, কুকুরের ডাকে! যুধিষ্ঠিরের বেলায় যম কুকুর সেজেছিলেন, আর বিশ্বম্ভরবাবুর বেলায় কুকুরই যম হল। কাউল সাহেব উধাও হবার পরও আপনারা বাড়িতে কুকুরের ডাক শুনেছেন। আপনিই বলেছেন, কুকুরটা হিংস্র। হিংস্র কুকুর হলে মনিব ছাড়া আর কারুর সঙ্গে এক বাড়িতে কিছুতেই থাকত না। সে যে বন্ধ থাকে কোনও ঘরে তাও নয়, কারণ একদিন তাকে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে একজন দেখেছে। সেদিন কোন রকমে দরজা খোলা পেয়ে কুকুরটা বেরিয়েছিল, আর বিশ্বম্ভরবাবুও তাকে খুঁজতে নির্জন রাস্তায় রাত্রে বেরিয়েছিলেন। বিশ্বম্ভরবাবু সব ভোল পাল্টে ছিলেন, শুধু কুকুরটার প্রতি মায়ায় তাকে কোথাও পাঠিয়ে দিতে কি মেরে ফেলতে পারেননি। আশা করি এতক্ষণ পুলিশের গাড়ি রওনা হয়ে পড়েছে তাঁকে ধরতে।’
মুখ থেকে আপনা হতে বেরিয়ে গেল, ‘সত্যি, কি বলে আপনার প্রশংসা করব ভেবে পাচ্ছি না।’
পরাশর বর্মা সলজ্জ একটু হেসে বললেন, ‘তাহলে কোন্ কবিতাগুলো নেবেন?’