ভয়ংকর প্রতিশোধ

ভয়ংকর প্রতিশোধ

কালো চশমা পরা লোকটি দাঁড়িয়েছিলেন হাজরা রোডের মোড়ে৷ অনেকেই রোদ্দুরের সময় নানা-রকম রঙের সানগ্লাস পরে তাই দীপু প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি৷ তারপর লোকটির হাতে একটা সাদা রঙের লম্বা লাঠি দেখে দীপু বুঝতে পারল যে লোকটি অন্ধ৷

দীপু বাবার কাছে শুনেছিল যে সারা পৃথিবীতেই অন্ধ লোকেরা রাস্তায় বেরুবার সময় হাতে ওই রকম ঠিক সাদা রঙের একটা লাঠি রাখে৷ তাতে অন্য লোকদের চিনবার সুবিধে হয়৷ অনেক সময় অন্য লোকেরা রাস্তা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে একজন অন্ধ লোককেই ধাক্কা দিয়ে বলে ওঠে, চোখ নেই নাকি? দেখে শুনে হাঁটতে পারো না?

বিকেল পাঁচটা, এই সময় হাজরা রোডে দারুণ ভিড়৷ অনবরত গাড়ি যাচ্ছে আসছে৷ দীপুর মনে হল অন্ধ লোকটি রাস্তা পার হতে পারছেন না বলেই দাঁড়িয়ে আছেন৷

সে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি রাস্তার ওপারে যাবেন? আমি আপনার হাত ধরে নিয়ে যেতে পারি৷

লোকটি খুব বুড়োও নয়, যুবকও নয়৷ মুখে দাড়ি আছে৷ সেই দাড়ি আর মাথার চুল সামান্য কাঁচা-পাকা৷ লোকটি বোধহয় অন্য কিছু ভাবছিলেন, দীপুর কথা শুনে চমকে উঠলেন৷

দীপু লোকটির হাত ধরে বলল, চলুন আমি আপনাকে ওপারে পৌঁছে দিচ্ছি৷

লোকটিকে নিয়ে দীপু রাস্তায় নেমে পড়ল৷ একটা হাত উঁচু করে রইল যাতে গাড়িগুলি তাদের দেখে থেমে যায়৷ সত্যিই অনেক গাড়ি হর্ন দিতে দিতে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষতে লাগল৷

রাস্তার ওপারে এসে দীপু বলল, এবার আপনি কোন দিকে যাবেন? ডান দিকে না বাঁ দিকে? আমি কি আর একটু এগিয়ে দেবো আপনাকে?

লোকটি এবার জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কোন দিকে থাকো ভাই? রাস্তার এপারে না ওপারে?

দীপু বলল, রাস্তার ওপারে৷ আমি বাড়ির জন্য একটা পাঁউরুটি কিনতে এসেছিলাম৷

লোকটি বললেন, তাহলে তুমি এপারে এলে—কেন ভাই?

দীপু বলল, বাঃ এইটুকু এলে কী হয়েছে! আপনি রাস্তা পার হতে পারছিলেন না, সেইজন্য!

লোকটি বললেন, তাহলে এসেছই যখন, তখন তোমাকে আর একটু আসতে হবে৷ তুমি আমার বাড়িতে পৌঁছে দাও৷

দীপু একটু কিন্তু কিন্তু করতে লাগল৷ মা তাকে বলেছিলেন মোড়ের দোকান থেকে পাঁউরুটি কিনে আনতে৷ বেশিক্ষণ তো লাগবার কথা নয়৷ দীপুর ফিরতে দেরি হলে মা চিন্তা করবেন৷

কিন্তু একজন লোক যদি বলে বাড়িতে পৌঁছে দিতে, তাহলে না বলা উচিত না৷ তাছাড়া দীপুর এখন তেরো বছর বয়েস হয়ে গেছে, সে তো আর রাস্তা হারিয়ে ফেলবে না৷ সে এদিককার সব রাস্তাই চেনে!

অন্ধ লোকটি বললেন, এই যে, কাছেই হাজরা পার্ক, এটা তুমি কোনাকুনি পার হয়ে চলো, তারপর দেখবে একটা গলি, সেই গলি দিয়ে খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে একটা হলদে রঙের তিনতলা বাড়ি, সেই বাড়িতে আমি থাকি৷ তুমি আমায় সেখানে নিয়ে যেতে পারবে?

দীপু বলল, চলুন৷

অন্ধ লোকটির হাত ধরে দীপু পার্কটা পার হতে লাগল৷ তারপর সেই গলির মধ্যে খানিকটা গিয়ে হলদে তিনতলা বাড়িটা পেয়ে গেল সহজেই৷

সে-বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দীপু বলল, এবার আমি যাই?

লোকটি বললেন, না না, এখন যাবে কি৷ আমাকে একদম ঘরে পৌঁছে দাও৷ ভেতরে ঢুকে দেখবে একটা উঠোন, তার ডান পাশে সিঁড়ি৷ আমরা কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠব না৷ তুমি আমাকে সিঁড়ির পেছন দিকটায় নিয়ে চলো৷

বাড়িটা তিনতলা হলেও মনে হয় যেন ফাঁকা৷ কোনো লোকজনের সাড়াশব্দ নেই৷ এতবড় বাড়িতে কি আর কোনো লোক থাকে না? দীপুর একটু অবাক লাগল৷

সিঁড়ির পেছনে বেশ খানিকটা পরিষ্কার জায়গায় বাড়ির যতসব ভাঙা জিনিসপত্র থাকে৷

অন্ধ লোকটি এবার দীপুর হাত ছেড়ে দিয়ে সেখানে বসে পড়লেন৷ তারপর জামার পকেট থেকে বার করলেন একটা চাবি৷ মাটির মধ্যে একটা ছোট্ট গর্ততে লোকটি সেই চাবি ঢুকিয়ে দিয়ে ঘোরাতেই কট শব্দ হল৷

দীপু আরও অবাক হয়ে গেল৷ কোনো তালা নেই, শুধু মাটির গর্ততে চাবি ঢোকাবার ব্যাপারটা বুঝল না৷ তা ছাড়া লোকটি অন্ধ হলেও চাবিটা একবারেই সেই গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন কী করে?

মিষ্টির দোকানের আলমারিগুলোর পাল্লা যেমন ঠেললেই একদিকে সরে যায়, লোকটি এবার মাটিতে চাপ দিতেই সেরকম একটা পাল্লা একদিকে সরে গেল৷ দীপু দেখল নীচের দিকে একটা অন্ধকার গর্ত৷

লোকটি নিজেই একবার দীপুর হাত ধরে বললেন, এসো৷

দীপু জিজ্ঞেস করল, আমি কোথায় যাবো?

লোকটি বললেন, এসোই না৷ তুমি ভয় পাচ্ছ নাকি?

ভয় পাওয়ার কথা শুনলেই দীপুর সাহস বেড়ে যায়৷

একজন অন্ধ লোকের সঙ্গে অন্ধকারে নামতে সে ভয় পাবে কেন?

ভেতরে পা দিয়ে দেখল, একটা কাঠের সিঁড়ি আছে৷ তবে সিঁড়িটা বেশ সরু৷ দুজনে পাশাপাশি নামা যায় না৷ অন্ধকারে কিছু দেখাও যায় না৷

লোকটি বললেন, ঠিক গুনে গুনে ছত্রিশটা সিঁড়ির ধাপ নেমেই থামবে৷ তখন সামনে একটা দরজা দেখতে পাবে৷

লোকটি আগে নিজে নিজেই বেশ টপাটপ নেমে যেতে লাগলেন; নামতে নামতে দীপুকে বললেন, দেখো, যেন হোঁচট খেয়ে পড়ে যেও না৷

দীপু ভাবল, বাঃ, বেশ মজা তো৷ অন্ধ লোকটি তরতরিয়ে নেমে যাচ্ছেন, আর সে হোঁচট খাবে! অবশ্য অন্ধ লোকটির নিশ্চয়ই বারবার ওঠানামা করতে করতে বেশ অভ্যেস হয়ে গেছে!

ছত্রিশটা ধাপ নামার পর দীপু থামল৷ একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার৷ কিছু দেখা যায় না৷

অন্ধ লোকটি সামনের দেওয়ালে হাত দিয়ে সুইচ টিপতেই ঝলমলে আলো জ্বলে উঠল!

দীপু দেখল, পাশাপাশি দুখানা তালা বন্ধ ঘর আর একটা ছোট্ট বারন্দা৷ কলকাতার কোনো বাড়িতে যে এরকম মাটির নীচে ঘর থাকে, দীপু জানত না৷ তার ধারণা ছিল যে আগেকার সব দুর্গতেই শুধু মাটি নীচে সুড়ঙ্গ থাকত৷

লোকটি আবার পকেট থেকে একটা চাবি বার করে একটা ঘরের তালা খুলে ফেললেন৷ এবারের তালায় চাবি পরাতে তাঁর একটুও দেরি হল না৷

ঘরটার মধ্যে একটা খাটে বিছানা পাতা, একটা চেয়ার-টেবিল, আর মেঝেতে বেশ কয়েকটা খাঁচা৷ সেই খাঁচাগুলোর মধ্যে একটা করে খরগোশ রয়েছে!

ঘরে ঢুকে লোকটি একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বালাতেই তার থেকে খুব গাঢ় নীল রঙের আলো জ্বলে উঠল৷

লোকটি দীপুকে বললেন, বসো৷

দীপু বলল, আপনি এখানে থাকেন? এই মাটির নীচে?

হ্যাঁ, ওপরের আলো আমার ঠিক সহ্য হয় না৷

আচ্ছা আপনি তো পৌঁছে গেছেন, এবার আমি বাড়ি যাই?

না, না, এক্ষুনি বাড়ি যাবে কি? তোমার নামটা এখনো জানা হল না৷

দীপু নিজের নাম জানাল৷ লোকটি বললেন, তাঁর নাম পিনাকপাণি৷ এরকম অদ্ভুত নাম দীপু আগে কখনো শোনেনি৷

হাতের সাদা লাঠিটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে রেখে লোকটি চোখ থেকে কালো চশমাটা খুলে ফেললেন৷

লোকটির দু’চোখে দুটি ময়দার ডেলা লাগানো, অথবা কাচ জোড়ার জন্য যে পুটিং লাগায় তাও হতে পারে৷

হাত দিয়ে সেই ডেলা দুটো টেনে খুলে ফেলে লোকটি দীপুর দিকে চেয়ে হাসলেন৷

লোকটি অন্ধ নয়৷

দীপু একটু শিউরে উঠল৷ অন্ধ নয়, তবু ইচ্ছে করে অন্ধ সেজে থাকে, তাহলে লোকটা কে? ডিটেকটিভরা অনেক সময় ছদ্মবেশ নেয়৷ লোকটা তাই? কিংবা চোর বা গুন্ডাও হতে পারে৷

লোকটি বললেন, ভাবছ তো আমি চোর, গুন্ডা কিংবা ডিটেকটিভ কিনা? আমি ওসব কিছুই নয়৷ আমি সাধারণত এ জায়গা ছেড়ে বাইরে যাই না৷ তবু মাঝে মাঝে দু-একবার যেতেই হয়৷ খোলা হাওয়া ও নিশ্বাস নেওয়াও তো দরকার৷ তখন অন্ধ সেজে না থাকলে আমার খুব অসুবিধে হয়৷

দীপু ভাবল, এ আবার কী কথা? চোখ থাকতে কেউ কি অন্ধ সেজে থাকে? অন্ধ হলেই তো বেশি অসুবিধে৷

লোকটি বললেন, এই নীল আলো ছাড়া অন্য কোনো আলো আমার সহ্য হয় না৷ তা ছাড়া আরও গন্ডগোল হয়৷ আমার চোখ নিয়ে মহা মুশকিল৷ তোমার হাতে ওটা কী? খরগোশ?

দীপুর হাতে একটা হাফ পাউন্ড পাঁউরুটি ছিল৷ অমনি সেটা জ্যান্ত হয়ে একটা খরগোশ হয়ে গেল৷

দীপু চমকে সেটা ছেড়ে দিতেই খরগোশটা মাটিতে পড়ে লাফাতে লাগল৷

দীপু খুব চমকে গেলেও সামলে নিল তাড়াতাড়ি৷ এ ব্যাপারটায় সে ভয় পায়নি৷ লোকটি তাহলে ম্যাজিশিয়ান৷ ম্যাজিশিয়ানরা ওরকম পারে৷ জাদুকর ম্যানড্রেকের ছবিতে দীপু এরকম দেখেছে৷

লোকটি গম্ভীর গলায় বললেন, আমি ম্যানড্রেকের মতন ম্যাজিক দেখাই না৷ আমি পিনাকপাণি!

দীপু এবার সত্যিই একটু ভয় পেয়ে গেল৷ লোকটি মনের কথা বুঝতে পারে৷ দীপু মনে মনে যা ভাবছে, লোকটি তক্ষুনি সেটা বলে দিচ্ছে৷

পিনাকপাণি বললেন, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আমার চোখে একটা অসুখ হয়৷ চোখে ভীষণ ব্যথা করত৷ অনেক ডাক্তারকে দেখিয়েছিলাম৷ ওষুধ লাগিয়েছি, কোনো ফল হয়নি৷ তখন আমার নাম ছিল বিজনকুমার বসু৷

তখন আপনার অন্য নাম ছিল?

হ্যাঁ৷ তখন আমি জামসেদপুরে থাকতাম, স্টিল প্ল্যান্টে কাজ করতাম৷ চোখে কোনো সময় আগুনের ঝাপটা লেগেছিল কিংবা অন্য কিছু হয়েছিল জানি না৷ সেই থেকে চোখে খুব ব্যথা৷ তারপর একদিন সকালবেলা ঘুম থেকে চোখ মেলবার পর দেখলাম, আমার একটুও ব্যথা নেই! আর আমার মাথার মধ্যে কে যেন বলল, তুমি বিজনকুমার বসু নও, তুমি পিনাকপাণি!

কে বলল একথা?

তা তো জানি না৷ আমার মাথার মধ্যে কেউ যেন ফিসফিস করে উঠল৷ আমি তো প্রথমে খুব অবাক৷ কিন্তু মাথার মধ্যে অনবরত ওই কথাটা শুনতে পেলাম৷ তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম কে পিনাকপাণি৷ তার কোনো উত্তর পেলাম না তখন৷

দীপু মাটির দিকে তাকিয়ে দেখল, তার হাতের পাঁউরুটিটা তখনও খরগোশ হয়ে লাফাচ্ছে৷ দীপুর কাছে আর পয়সা নেই৷ মা তাকে পাঁউরুটি কিনে আনতে বলেছিলেন৷ পাঁউরুটির বদলে খরগোশ নিয়ে গেলে কি মা খুশি হবেন?

পিনাকপাণি অমনি দীপুর মনের কথা বুঝে নিয়ে বললেন, তোমার কোনো চিন্তা নেই, তুমি পাঁউরুটি নিয়েই বাড়িতে ফিরবে৷

দীপু একটু কেঁপে উঠল৷ কেউ এমনভাবে মনের কথা বুঝে ফেললে দারুণ অস্বস্তি হয়৷

পিনাকপাণি আবার বললেন, তোমাকে এসব কথা বলছি কেন জানো? আমি তো এতদিন রাস্তা দিয়ে ঘুরি অন্ধ সেজে, কিন্তু এর আগে কেউ একজনও আমায় রাস্তা পার করে দিতে চায়নি৷ কলকাতা শহরের মানুষের মনে মায়া নেই৷ তুমিই প্রথম দিলে৷ অবশ্য আমার কোনো দরকার হয় না৷ আমি কিচ্ছু না দেখেও হাঁটতে পারি৷ একদিন একটা গাড়ি আমায় চাপা দিয়েছিল, কিন্তু আমি মরিনি৷

দীপু বলল, আমাকে এবার বাড়ি যেতেই হবে৷ নইলে মা ভীষণ চিন্তা করবেন৷

পিনাকপাণি বললেন, তুমি ভাবছ আমি ভূত, তাই না? গাড়ি চাপা পড়ার পর মরে ভূত হয়ে গেছি? সত্যি আমি মরিনি৷ তুমি আমার হাতে চিমটি কেটে দেখো!

পিনাকপাণি নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন দীপুর কোলের কাছে৷ সত্যিই মানুষের মতন হাত৷ তাছাড়া দীপু তো ওঁর হাত ধরেই রাস্তা দিয়ে এনেছে৷

পিনাকপাণি বললেন, আমি ইচ্ছে না করলে তো তুমি এ ঘর থেকে যেতে পারবে না৷ সেই জন্য চুপটি করে বসে আমার কথা শোনো! হ্যাঁ, সেই জামসেদপুরের কথা বলছিলাম৷ সেখানে আমার বউ ছেলে মেয়ে সব ছিল৷ আমার চোখ ভালো হয়ে যাবার পর আনন্দে সেই কথাটা সবাইকে বলতে গেলাম৷ কিন্তু আমার মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরুল না, শুধু গোঁ গোঁ শব্দ হতে লাগল৷ তখন সবাই ভাবল, আমি পাগল হয়ে গেছি৷

দীপু আবার চোখ গোলগোল করতেই পিনাকপাণি বললেন, আমি কিন্তু সত্যিই পাগল হইনি৷ সে ব্যাপারে তোমার ভয়ের কিছু নেই৷ তবে একথা ঠিক, আমি এক জীবনে দু’জন মানুষ হয়ে গেছি৷ আগে ছিলাম বিজনকুমার বসু, এখন পিনাকপাণি৷ জামসেদপুরে আমার বাড়ির লোক আমাকে জোর করে পাগলা গারদে দেবার চেষ্টা করতেই আমি বাড়ি থেকে পালালাম৷ স্টেশনে এসে সামনে যে ট্রেনটা দেখলাম, উঠে পড়লাম সেটাতেই৷ তখন আমার মাথার মধ্যে ফিসফিস করে কে যেন বলল, কলকাতায় চলে যাও, হাজরা পার্কের পেছনের দিকে একটা গলি, যেখানে হলদে রঙের তিনতলা বাড়ি…সেই বাড়ি তোমার৷

দীপু বলল, এই পুরো বাড়িটা আপনার? তাহলে আপনি ওপরে না থেকে এই মাটির নীচে থাকেন কেন?

বললাম না, ওপরের আলো আমার সহ্য হয় না৷ আমার চোখটা বদলে গেছে বলেই মানুষ হিসাবে আমি বদলে গেছি৷ কীরকম আমার চোখের অবস্থা হয়েছে শুনবে? হাওড়া স্টেশন থেকে সেদিন যখন আমি আসছি, বড়বাজারের কাছে একটা পুলিশ দাঁড়িয়েছিল৷ কী জানি কেন, সেই পুলিশটার ওপর রাগ হল৷ সে বোধহয় উলটোপালটা হাত দেখিয়েছিল৷ আমি মনে মনে বললাম, এই পুলিশটা একটি গাধা৷ আর সঙ্গে সঙ্গে কী হল জানো? পুলিশটা তক্ষুনি একটা গাধা হয়ে গেল৷ সত্যি সত্যি৷ আর কেউ বুঝতে পারল না৷ সবাই ভাবলে পুলিশটা কোথায় চলে গেছে, আর সেখানে একটা গাধা ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু আমি তো সেদিকেই তাকিয়েছিলাম৷ আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখ চেপে ধরলাম৷ ওঃ সেদিন কী যে ভয় পেয়েছিলাম!

কথা বলতে বলতে পিনাকপাণি নিজের চোখেও হাত চাপা দিয়ে ফেললেন, তারপর একটু বাদে হাত দুটো আবার সরিয়ে নিতেই দেখা গেল, তাঁর চোখ দিয়ে জল পড়ছে৷

জল মুছে নিয়ে তিনি বললেন, এটা একটা অভিশাপ৷ বুঝলে দীপু, এটা দারুণ অভিশাপ৷ রাস্তাঘাটে এই জন্যই আমি অন্ধ সেজে যাই! কোনো মানুষের উপর যদি আমার হঠাৎ রাগ হয়, তবে তার দিকে তাকিয়ে গরু, গাধা, ছাগল ভাবলেই সে সেইরকম হয়ে যায়৷

খরগোশটা দীপুর আঙুলে কুটুস করে কামড়ে দিল৷ দীপুর পায়ে চটি পরা, আঙুলগুলো বেরিয়ে আছে৷ আর সেই আঙুলগুলোকে বোধহয় কোনো খাবার ভেবে খরগোশটা কামড়াচ্ছে৷

দীপু খরগোশটাকে একটা লাথি কষাল৷

সত্যিই খুব আশ্চর্য ব্যাপার, যেটা একটু আগে ছিল একটা পাঁউরুটি, সেটা এখন খরগোশ হয়ে গিয়ে রীতিমতো কামড়াচ্ছে৷ তার মানে এটা ম্যাজিকের খরগোশ নয়৷

পিনাকপাণি খরগোশটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন৷ আর তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, এই একটা জায়গায় আমি হেরে যাই৷ আমি একটা পাঁউরুটিকে খরগোশ বানাতে পারি৷ কিন্তু সেই খরগোশটাকে আর পাঁউরুটি অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি না৷

বাইরের খরগোশটাকে ঘুরে বেড়াতে দেখে খাঁচার খরগোশগুলো লাফালাফি করছে৷

পিনাকপাণি বললেন, এর একটাও আসল খরগোশ নয়৷ আগে অন্য জিনিস ছিল৷ এগুলোকে রেখে দিয়েছি কেন জানো তো৷ রোজ চেষ্টা করে দেখি, ওদের আবার আগেকার অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় কিনা৷ কিন্তু আমি এক জিনিসকে দু’চার বার পালটাতে পারি না৷ এসো তোমাকে পাশের ঘরটা দেখাই৷

পিনাকপাণি বেরিয়ে গিয়ে পাশের ঘরের তালাটা খুললেন৷ সেই ঘরের মধ্যে একটা বোঁটকা গন্ধ৷ সেখানেও একটা নীল আলো জ্বালাবার পর দীপু দেখল, সেই ঘরেও কয়েকটা খাঁচা রয়েছে৷ মোট পাঁচটা খাঁচা, তার মধ্যে দুটোতে দুটো ছাগল, একটাতে একটা বাঁদর, একটাতে একটা বেড়াল আর একটাতে একটা হরিণের বাচ্চা৷

পিনাকপাণি বললেন, এরা আসলে সবাই মানুষ৷

দীপুর বুকের মধ্যে দপ করে উঠল৷ বলছে কী লোকটা! এরা সবাই মানুষ? নাকি লোকটা আগাগোড়াই গাঁজা দিচ্ছে!

কিন্তু দীপুর হাতের পাঁউরুটিটাকে খরগোশ হয়ে যেতে তো সে নিজের চোখেই দেখেছে৷

পিনাকপাণি বললেন, এরা আমার জন্যই বদলে গেছে৷ ওই হরিণছানাটা আর বেড়ালটা আসলে দুটো মেয়ে৷ আর ছাগল দুটো আর বাঁদরটা তিনটে ছেলে৷ ওদের এখানে রেখে দিয়েছি কেন? বাইরের কেউ ওদের মেরে ফেলতে পারে৷ আমি ওদের এখানে খুব যত্নে রেখেছি৷ আর রোজ চেষ্টা করি৷ ওদের যদি আবার মানুষ করে দিতে পারি৷ এখনো পারছি না৷

দীপু ভাবল, ওরে বাপ রে! লোকটা যদি তাকেও ছাগল কিংবা বাঁদর করে দেয়? তাহলে আর সে কোনোদিন মা-বাবার কাছে ফিরতে পারবে না৷

পিনাকপাণি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না, না, তোমাকে অন্য কিছু করে দেবো কেন? তোমার ওপর কি আমি রাগ করতে পারি? তুমি যে অন্ধ ভেবে আমায় রাস্তা পার করে দিয়েছ৷ আর কেউ কখনও দেয়নি৷

দীপু বলল, আমি তাহলে এবার বাড়ি যাই?

পিনাকপাণি কিছু উত্তর দেবার আগেই ওপর দিকে দুম দুম করে শব্দ হল৷ কেউ যেন ওপরের দরজায় ধাক্কা মারছে৷

পিনাকপাণি তরতর করে ওপরে উঠে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে৷ একটু বাদেই ফিরে এলেন হাতে দুটো টিফিন কেরিয়ার নিয়ে৷

তিনি বললেন, আমার আর এই ছেলেমেয়েদের খাবার৷ একজন চাকর রেখেছি৷ সে দু’বেলা খাবার দিয়ে যায়৷ তুমি কিছু খাবে?

দীপু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, না, না, না৷

বাড়ি ফেরার জন্য এত ব্যস্ত হয়েছ কেন? একদিন না হয়! একটু দেরি করেই ফিরলে৷ তোমাকে আমার আর একটু উপকার করতে হবে৷

আমি আপনার কি উপকার করব?

বলছি৷ তোমার সাহস আছে?

কী জানি, জানি না৷

খাঁচার বাঁদরটা কিচু-মিচু কিচু-মিচু করে ডেকে উঠল৷

পিনাকপাণি বললেন, এই ছেলেটার আগে নাম ছিল সুবোধ৷ ওর স্বভাব কিন্তু মোটেই সুবোধ ছিল না৷ হাজরা পার্কে গুন্ডামি করে বেড়াত আর খুব জ্বালাতন করত৷ লোকজনদের৷ একদিন কোনো কারণ নেই, আমি হাজরা পার্কের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, ওই ছেলেটা দৌড়ে এসে আমার পায়ে একটা ল্যাং মারল, আমি পড়ে গেলাম, আর ও হাসতে লাগল হো হো করে৷ ভেবে দ্যাখো, একজন লোককে শুধু শুধু ফেলে দিয়ে আনন্দ করা কি উচিত? আমি উঠে দাঁড়িয়ে রেগেমেগে বললাম, বাঁদর কোথাকার! তারপর থেকে ওর এই অবস্থা৷ কিন্তু ওইটুকু দোষ করার জন্য তো ওর সারা জীবন বাঁদর হয়ে থাকা উচিত নয়৷ তুমি ওর খাঁচার কাছে গিয়ে ওর নাম ধরে ডাকো তো?

দীপু বাঁদরের খাঁচাটার কাছে গিয়ে ডাকল, সুবোধ৷ সুবোধ!

বাঁদরটা দারুণ ছটফট করতে লাগল খাঁচার মধ্যে৷ মনে হয় ও ওর নাম শুনে চিনতে পেরেছে৷

ছাগল, বেড়াল, আর হরিণছানাটাও এমনভাবে দীপুর দিকে তাকিয়ে আছে যেন ওরাও মানুষের ভাষা বোঝে৷

দীপুর গা ছমছম করতে লাগল৷ এরকম অদ্ভুত অবস্থায় সে কোনোদিন পড়েনি৷

পিনাকপাণি বললেন, এইবার তোমায় আসল কথাটা বলি৷ তোমায় দেখেই বুঝেছি, তুমি খুব ভালো ছেলে৷ তুমি যদি আমার একটা উপকার করো, তোমায় আমি রাজা করে দেবো৷

কী উপকার করব আমি?

বলছি৷ তার আগে ঘরের কোণে ওই যে একটা কাঠের বাক্স দেখছ? ওর মধ্যে মোহর ভর্তি আছে, ওই সব মোহর তোমার হবে৷ সব আমি তোমাকে দিতে চাই৷

আমায় কী করতে হবে বলুন আগে৷

পিনাকপাণি শার্টের তলায় হাত দিয়ে কোমর থেকে একটা লম্বা ছোরা টেনে বললেন, এই ছোরাটা নিয়ে আমার বুকে বসিয়ে দিতে হবে৷

দীপু চোখ কপালে তুলে দারুণ একটা ভয়ের আওয়াজ করে বলল, অ্যাঁ?

পিনাকপাণি বললেন, তুমি ভাবছ, আমি ইচ্ছে করে মরতে চাইছি? না, না, তা নয়৷ এ ছাড়া আর আমার অন্য কোনো উপায় নেই৷ আমার মাথার মধ্যে মাঝে মাঝে কে যেন ফিসফিস করে কথা বলে৷ সেই কথার জন্য আমি জামসেদপুর ছেড়ে এখানে চলে এসেছি৷ সেই ফিসফিসে কথাই এই বাড়িটা খুঁজে দিয়েছে৷ মাটির তলায় যে এরকম ঘর আছে, তাও কি ছাই আমি জানতুম? সবই বলে দিয়েছে সে৷ সে যে কে তা আমি অনেকদিন জানতে পারিনি৷ এখন বোধহয় খানিকটা জানি৷ দ্যাখো, বাইরের আলো আমার সহ্য হয় না৷ যতদিন বাঁচব আমাকে এই রকম মাটির নীচে থাকতে হবে৷ এরকম ভাবে বেঁচে থেকে লাভ কী? আমার বুকে যদি তুমি এই ছুরিটা বসিয়ে দিতে পারো তাহলেই বোধহয় আমি বাঁচব৷

দীপু চিৎকার করে বলল, না৷ আমি কিছুতেই পারব না৷

এসো, তোমায় আর একটা জিনিস দেখাচ্ছি৷

পিনাকপাণি আবার চলে এলেন পাশের ঘরে৷ তাঁর শোবার খাটটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন দেওয়ালের এক দিকে৷

সেই খাটের তলায় একটা মস্ত কাঠের বাক্স৷

সেটা সাধারণ বাক্স নয়৷ ওপরে নানান রকম রুপোর কারুকার্য করা৷ বেশ পুরোনো আমলের বাক্স বলে মনে হয়৷ সেটা প্রায় ওই খাটেরই সমান৷

পিনাকপাণি বললেন, ওই বাক্সটা তুমি খুলে দেখো, দীপু৷

কী আছে ওর মধ্যে?

খুলেই দ্যাখো না৷

অতবড় বাক্স আমি খুলতে পারব না৷

পারবে৷ ডালাটা ধরে টানলেই উঠে আসবে৷

বাক্সটার কাছে গিয়েই ডালাটা ধরে ওঠাতেই দীপু ওরে বাবারে বলে চেঁচিয়ে উঠল৷ সঙ্গে সঙ্গে ডালাটা সে ছেড়ে দিল আবার৷ ধপ করে একটা শব্দ হল৷

বাক্সের মধ্যে লাল ভেলভেটের বিছানায় শুয়ে আছে একটা মেয়ে৷ দারুণ ফর্সা রং, কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, চোখ দুটো নীল কাচের মতন৷ দেখলেই বোঝা যায় মেয়েটির দেহে প্রাণ নেই৷ কিন্তু চামড়া একটুও কুঁচকোয়নি৷

দীপু ফ্যাকাশে মুখ করে জিজ্ঞেস করল, ও কে?

আমি জানি না দীপু৷

আপনি ওর ওপরে খাটে শুয়ে থাকেন?

হ্যাঁ, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস৷ মাঝে মাঝে ডালা খুলে দেখি, ওর চেহারা একই রকম আছে৷ পচে যায় না, গলে যায় না৷ এখন বুঝতে পারি ওই মেয়েটিই আমার মাথার মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে৷

আমি আর থাকতে পারছি না৷ আমাকে ছেড়ে দিন, আমি বাড়ি যাব৷

না দীপু যেও না৷ তোমাকে আমার এই উপকার করতেই হবে৷ ওই মেয়েটি আমার মাথার মধ্যে ফিসফিস করে বলে, আমার বুকে ছুরি বসিয়ে মরে যেতে৷ কিন্তু আমি পারি না৷ কিছুতেই পারি না! অনেকবার চেষ্টা করেছি৷ নিজের বুকে ছুরি বসানো সহজ নয়৷ তুমি আমাকে এই সাহায্যটুকু করো দীপু৷

না—আ—আ বলে এক চিৎকার দিয়ে দীপু দৌড়াল, ঘর থেকে বেরিয়ে ডাকতে লাগল সিঁড়ি দিয়ে! পিনাকপাণি তাকে ধরতে পারল না৷

খানিকটা উঠে দীপু পেছনে ফিরে দেখল পিনাকপাণি ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেও দু’হাতে নিজের চোখ চেপে রয়েছে৷

ওপরের দরজাটা ঠেলে দীপু বেরিয়ে এল বাইরে৷ তারপর দ্রুত ছুটে রাস্তায়৷ গাড়ি-টাড়ি কিচ্ছু গ্রাহ্য না করে দীপু একইভাবে ছুটতে ছুটতে চলে এল বাড়িতে৷

দীপুর মা সত্যিই চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন৷ ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে এত দেরি করলি কেন? পাঁউরুটি কোথায় গেল? আনলিনি?

দীপু হতভম্বের মতন খানিকক্ষণ চুপ করে রইল৷ কোনো উত্তরই দিতে পারল না৷

তারপর আমতা আমতা করে বলল, পাঁউরুটিটা হাত থেকে পড়ে গেল, আমি আর তুললাম না, গড়িয়ে গেল ময়লার মধ্যে৷

মা বললেন, বেশ করেছিস৷ ময়লা থেকে কে তোকে তুলতে বলেছে? কিন্তু দেরি হল কেন?

দীপু কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে মা ভাবলেন, পাঁউরুটিটা নষ্ট করে দীপু বুঝি লজ্জায় পড়ে গেছে৷ তাই আর কিছু বললেন না৷

দীপু নিজের ঘরে গিয়ে গুম হয়ে বসে রইল৷

বাইরে যখন যা দেখে সে বাড়িতে এসে মাকে বলে৷ কিন্তু আজকের ঘটনাটা বলা যায়? একটা কথাও কেউ বিশ্বাস করবে, সব কিছুই যেন দারুণ অদ্ভুত, অবিশ্বাস্য৷

রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে দীপু ভাবতে লাগল, সত্যিই কি আজ এইসব হয়েছে! সত্যিই কি সে রাস্তায় একটা অন্ধ লোককে দেখেছিল? সত্যিই মাটি নীচের অন্ধকার ঘরে কয়েকটা ছেলেমেয়ে বাঁদর, ছাগল, বেড়াল আর হরিণ হয়ে আছে?

নাকি সবই স্বপ্ন?

বিছানায় শুয়ে দীপু ছটফট করতে লাগল, আজ একটা বিকেলের ঘটনায় যেন তার জীবনটা বদলে দিয়েছে৷

সবচেয়ে ভয়ংকর সেই খাটের তলায় কাঠের বাক্সের মধ্যে শুয়ে থাকা মেয়েটি৷ লাল ভেলভেটের বিছানা, নীলরঙা শাড়ি পরা সেই মেয়েটিকে মনে হয় পুতুলের মতন৷ কিন্তু পুতুল নয়৷ উনিশ-কুড়ি বছর বয়েসের একটি মেয়ে, যেন কিছুক্ষণ আগেই জীবন ছিল, চোখ দুটো শুধু কাচের মতন৷

সারারাত দীপুর ঘুম হল না!

সকালবেলা মা জিজ্ঞেস করলেন, তোর মুখটা এত শুকনো দেখাচ্ছে কেন রে? শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?

দীপু বলল, না, কিছু হয়নি৷

একবার দীপুর ইচ্ছে হল, সব কথা মাকে, বাবাকে বলে দেয়৷ কিন্তু ওঁরা নিশ্চয়ই হাসবেন! দীপুকে পাগল ভাববেন৷

সব কিছু ভুলে থাকার জন্য দীপু বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে গেল৷ কিন্তু খেলাতেও মন বসে না৷ বন্ধুদেরও কিছু বলতে পারে না৷

দু-তিনদিন পর দীপুর মনে হল ব্যাপারটা বুঝি স্বপ্নই৷ ওরকম অসম্ভব গাঁজাখুরি ব্যাপার আবার হয় নাকি?

একটা বাঁদরের সামনে সে সুবোধ সুবোধ বলে ডাকছিল, অমনি বাঁদরটা সাড়া দিয়েছিল৷ বাঁদরটা নিশ্চয়ই পোষমানা৷ ওই ডাক ওকে শেখানো হয়েছে৷

আগেকার দিনে মুনিঋষিরা অভিশাপ দিয়ে লোকজনকে হঠাৎ ভেড়া কিংবা গরু কিংবা সাপ বানিয়ে দিতেন৷ আজকাল কী আর তা হয়৷ লোকটা পাগল নিশ্চয়ই৷

কিন্তু বাক্সের মধ্যে ওই মেয়েটা?

নাঃ দীপু আর ওইসব কথা ভাবতে চায় না৷

চারদিন পর বিকেলবেলা দীপু ইস্কুল থেকে ফিরেছে৷ বন্ধুদের সঙ্গে সে মনোহর পুকুরের মোড় পর্যন্ত আসে, বাকি রাস্তাটা একলা৷ আপন মনে সে হাঁটছে, হঠাৎ পেছনে খটখট আওয়াজ হতে সে চমকে পিছনে ফিরে তাকাল৷

সেই লোকটা৷

সেই পিনাকপাণি৷ সেই রকমই অন্ধ সেজে লাঠি ঠকঠকিয়ে আসছে৷ চোখে কালো চশমা৷

এখন সে অন্ধ সেজে আছে, এখন আর দীপুকে দেখতে পাবে না৷

দীপু দৌড়াতে লাগল৷

একটুক্ষণের মধ্যেই দীপু রাস্তার বাঁকে চলে গেল৷ তারপরে থমকে গিয়ে একটা বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল৷

পিনাকপাণিও সেই পথের বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ তারপর ফিসফিস করে ডাকল, দীপু দীপু৷

দীপু একেবারে কুঁকড়ে গেল ভয়ে! লোকটা কি অন্ধ অবস্থাতেও দেখতে পায়?

সে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে মারল টেনে দৌড়৷

বুদ্ধি করে দীপু নিজের বাড়িতে না গিয়ে কাছেই তার বন্ধু সুজিতের বাড়িতে ঢুকে পড়ল৷ ওই লোকটাকে সে নিজের বাড়ি চেনাতে চায় না৷

সুজিতদের বাড়ির দোতলায় উঠে জানলা দিয়ে দেখল, পিনাকপাণি খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সেখানে৷ তারপর যেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল পার্কের দিকে৷

পরদিন ইস্কুলে টিফিনের সময় বেরিয়ে আলুকাবলি খেতে গিয়ে দীপু দেখল রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে পিনাকপাণি৷

দীপু সুট করে ঢুকে এল ইস্কুলের মধ্যে৷ তার বুকের মধ্যে ধড়ফড় করছে৷ লোকটা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ লোকটা তাকে সহজে ছাড়বে না৷

এখন কি উচিত লোকটাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া?

পুলিশ ওর বাড়ি সার্চ করলেই সব কিছু পেয়ে যাবে৷

এই কথা ভাবতেই দীপুর শরীরে কাঁপুনি ধরে গেল৷ পিনাকপাণি মনের কথা বুঝতে পারেন৷ দীপু ওঁকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার কথা ভাবছে এই কথা জানতে পেরে পিনাকপাণি যদি তাকেই বাঁদর কিংবা ছাগল করে দেন?

না, না, দীপু একথা কিছুতেই মনে আনবে না৷ একবার সে বাঁদর কিংবা ছাগল হয়ে গেলে কেউ তো আর তাকে মানুষ করে দিতে পারবে না৷ এমনকি পিনাকপাণি নিজেও পারবেন না৷

স্কুল ছুটির পর দীপু দেখল পিনাকপাণি তখনো দাঁড়িয়ে আছেন উলটো দিকে৷

দীপু একদল বন্ধুর মধ্যে মিশে রইল৷ মনোহর পুকুরের মোড়ে এসেও তিন-চারজন বন্ধুকে বলল, চল আমাদের বাড়ি যাবি এখন একটু? আমার মা পায়েস বানিয়েছেন, তোদের খাওয়াব৷

পিনাকপাণি পেছন পেছন ঠকঠকিয়ে আসছেন ঠিক৷

দীপু বন্ধুদের সঙ্গে বাড়িতে ঢুকে গেল৷ পিনাকপাণি রাস্তার ওপর খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেলেন৷

সেদিন রাত্তিরবেলা খেতে বসে দীপু বাবাকে বলল, বাবা, আমি কয়েকদিনের জন্য চন্দননগরে যাব? ছোটমাসির বাড়িতে?

বাবা বললেন, হঠাৎ? এখন চন্দননগরে যাবি কেন?

তুমি যে আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিলে?

ছুটি পড়ুক৷ এখন ইস্কুল খোলা, এখন যাবি কী করে?

আজ তো শুক্রবার৷ কালকে যদি ছুটি নিই, তাহলে শনি আর রবি দু’দিন অন্তত চন্দননগরে কাটিয়ে আসতে পারি৷

দীপু মনে মনে ভেবে রেখেছে, একবার চন্দননগরে গিয়ে পড়লে সে আর দশ-বারোদিনের মধ্যে ফিরবে না৷ ছোটমাসিকে বলবে, যাতে তিনি জোর করে তাকে আটকে রেখে দেন৷ ছোটমাসির সঙ্গে তার খুব ভাব৷

বাবা বললেন, হঠাৎ এখন চন্দননগরে যাবার এত গরজ কেন? পড়াশুনা নষ্ট করে এখন যেতে হবে না৷ গরমের ছুটি পড়ুক, তখন নিয়ে যাব৷

দীপু নিরাশ হয়ে গেল৷

রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে সে ভাবল, কাল ইস্কুলে যাবার নাম করে সে একাই চন্দননগরে পালাবে৷ সেখানে যাওয়া তো খুব সোজা৷ হাওড়ায় গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লেই হল৷ চন্দননগর স্টেশনের খুব কাছেই ছোটমাসির বাড়ি৷ যাবার আগে সে বাড়িতে একটা চিঠি লিখে রেখে যাবে৷

কিন্তু পরদিন সকালে বাবা নিজেই বললেন, আচ্ছা চল, দীপু, তোর যখন এত শখ হয়েছে, তোকে চন্দননগরেই রেখে আসছি আজ৷ ওখানে গিয়ে পড়াশুনা করতে হবে কিন্তু৷ ফাঁকি দিলে চলবে না৷

বাবার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হল দীপু৷

সে যে-কোনো উপায়েই কিছুদিনের জন্য এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাইছিল৷ রাস্তায় বেরুলেই সেই অন্ধ লোকটিকে দেখতে হবে, একথা ভাবলেই তার বুক ধড়ফড় করে৷

চন্দননগরে ঠিক এগারো দিন থেকে এল দীপু৷ আর এই কটা দিন তার দারুণ আনন্দে কাটল৷ ছোটমাসির বাড়ির পেছনে রয়েছে একটা বাগান আর পুকুর৷ সেখানেই সারাদিন কেটে যায়৷ এই সুযোগে তার সাঁতারটা শেখা হয়ে গেল৷

পিনাকপাণির কথা মনে পড়লেই সে মন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে৷ না, ওই লোকটির কথা সে আর কিছুতেই ভাববে না৷

এগারো দিন পর বাবা এসে জোর করে নিয়ে গেলেন দীপুকে৷ এর আগে সে কক্ষনো একটানা এতদিন ইস্কুল ফাঁকি দেয়নি৷

পরদিন ইস্কুল যাবার সময় সে ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক চাইতে লাগল৷ না, পিনাকপাণিকে কোথাও দেখা গেল না৷ টিফিনের সময়ও নেই৷ ছুটির সময়েও না৷

যাক পিনাকপাণি নিশ্চয়ই তাহলে ভুলে গেছেন দীপুকে৷

পরপর চারদিন দীপু নিশ্চিন্তভাবে রাস্তা দিয়ে ঘোরা-ফেরা করল খুব নিশ্চিন্তভাবে৷ পিনাকপাণির কোনো চিহ্নই নেই কোথাও৷ তার মনে হল, আর কোনোদিন দেখা হবে না পিনাকপাণির সঙ্গে৷ বাবা, পৃথিবীতে এত অদ্ভুত মানুষও থাকে!

শুধু বারবার দীপুর মনে পড়ে সেই খাঁচায় বন্দি ছাগল, বাঁদর, বেড়াল আর হরিণ শিশুটির কথা৷ ওরা যদি মানুষ হয় সত্যিই, তাহলে সারা জীবন ওরা ওইরকম হয়েই থাকবে? ইশ, ওদের বাবা-মায়েরা নিশ্চয়ই কত চিন্তা করে৷

খবরের কাগজে যে প্রায়ই ছেলেমেয়েদের নিরুদ্দেশের খবর থাকে, হয়তো সেই সব ছেলেমেয়েদেরই কয়েকজন ওই সেই মাটির নীচের ঘরে জন্তু হয়ে গেছে৷

এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল শনিবার৷ সেখানে নেমন্তন্ন খেয়ে ফিরছে দীপু এমন সময় লোডশেডিং হয়ে গেল৷

সমস্ত রাস্তা ঘোরঘুট্টি, অন্ধকার৷

সাবধানে সে পা টিপে টিপে হাঁটছে এমন সময় হঠাৎ কে যেন তার কাঁধে হাত দিল৷

তারপর ফিসফিস করে ডাকল, দীপু দীপু৷

দীপুর শরীরের রক্ত যেন জল হয়ে গেল৷ গলার আওয়াজ শুনেই সে চিনতে পেরেছে৷

শরীরটা মুচড়ে কোনোরকমে কাঁধটা ছাড়িয়ে নিয়ে দীপু চেষ্টা করল দৌড়ে পালাবার৷ কিন্তু পিনাকপাণি তাকে ধরে আছেন লোহার মতো শক্ত ভাবে৷

দীপু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, আমায় ছেড়ে দিন৷

পিনাকপাণি বললেন, দীপু, আমার হাত ছাড়িয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করো না৷ আমি কিন্তু ইচ্ছে করলে তোমাকে একটা বেড়াল বা টিয়াপাখি করে দিতে পারি৷ কিন্তু তা তো করিনি, দীপু৷ আমি তোমাকে পছন্দ করি বলেই তোমার ক্ষতি করতে চাই না৷ তুমি আমার সঙ্গে চলো৷

দীপু বলল, আমাকে এক্ষুনি বাড়িতে ফিরতে হবে৷ আমার ভীষণ কাজ আছে৷

তুমি ভয় পাচ্ছো? বললাম যে, তোমার ভয় নেই৷

দীপু একবার ভাবল চেঁচিয়ে উঠবে৷ রাস্তায় অনেক লোক আছে৷ অন্ধকার হলেও লোকেরা এসে তাকে নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে দেবে৷

পিনাকপাণি বললেন, চেঁচিয়ে লাভ নেই, দীপু৷ আমার চোখ আজ খোলা৷ পকেটে টর্চ আছে৷ ইচ্ছে করলেই একবার তোমার ওপর ফেলে তোমাকে একটা বেড়াল বানিয়ে কোলে করে নিয়ে যেতে পারি৷ রাস্তার লোক কিছু বুঝতে পারবে না৷

দীপু বলল, আমার কাঁধে লাগছে!

পিনাকপাণি বললেন, আমায় রাগিয়ে দিও না, দীপু৷

রাগিয়ে দিও না৷ একবার কিছু হলে আর যে ফেরাতে পারবে না৷

দীপু সঙ্গে সঙ্গে বলল, না না, আমি যাচ্ছি চলুন৷

দীপুর কাঁধ ছেড়ে দিয়ে একটা হাত চেপে ধরে পিনাকপাণি সেই অন্ধকারের মধ্যেই গট গট করে হাঁটতে লাগলেন৷

আগের দিন দীপু ওঁর হাত ধরে বড় রাস্তা পার করে দিয়েছিল৷ আজ পিনাকপাণিই দীপুকে নিয়ে গেলেন রাস্তার ওপারে৷

অন্ধকারের মধ্যেই পিনাকপাণির হাঁটতে কোনো অসুবিধেই হয় না৷ জলের মাছ যেমন জলের মধ্যে স্বাভাবিক, সেই রকম পিনাকপাণিও যেন অন্ধকারেরই প্রাণী৷

হাজরা পার্ক হয়ে গলির মধ্যে এসে পিনাকপাণি সেই বাড়িটাতে ঢুকলেন৷ সিঁড়ির নীচে মেঝের সঙ্গে আটকানো দরজাটার এক পাল্লা খোলাই ছিল, সেখান দিয়ে তরতর করে নেমে ওরা চলে এল নীচে!

পিনাকপাণি ঘরের মধ্যে ঢুকে নীল আলোটা জ্বাললেন৷

বাইরে লোডশেডিং থাকলেও এখানে ঠিকই আলো জ্বলছিল৷ বোধহয় এখানে অন্য ব্যবস্থা আছে৷

পিনাকপাণি একটা চমৎকার ছোট কাঠের বাক্স দীপুর হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমাকে দেবো বলেই খুঁজছিলাম! তুমি এটা নাও৷

দীপু বাক্সটা হাতে করে দাঁড়িয়ে রইল৷

খুলে দেখো৷

দীপু বাক্সটা খুলল৷ মনে হল যেন ভেতরে অনেকগুলো পেতলের গোল গোল চাকতি রয়েছ৷

ওগুলো কী জানো?

না৷

ওগুলো সোনার মোহর৷ এক একটা মোহরের দাম অনেক; এই সব মোহর এখন তোমার৷ এই মোহরগুলি মাটির তলায় এই ঘরে ছিল, এগুলো কার আমি জানি না৷ আমার তো কোনো কাজে লাগবে না৷ আমি আর বাঁচব না৷

দীপুর গলা শুকিয়ে গেছে৷ এতগুলো মোহর পেয়ে সে কী করবে বুঝতে পারছে না৷ এগুলো নেওয়া কি তার উচিত?

পিনাকপাণি সঙ্গে সঙ্গে দীপুর মনের কথা বুঝতে পেরে বললেন, ওগুলো আমি তোমায় উপহার দিয়েছি, দীপু৷ তুমি একদিন আমায় রাস্তা পার করে দিয়েছিলে, আর কেউ কোনোদিন দেয়নি৷

কিন্তু আপনাকে তো আর পার করে দেবার দরকার ছিল না৷ আপনি নিজেই তো পার হতে পারেন?

তুমি তো সেকথা জানতে না! তুমি তো সত্যিকারের একজন অন্ধ লোক ভেবেই রাস্তা পার করে দিতে চেয়েছিলে৷ তাতেই বুঝছি তোমার মনটা খুব ভালো৷

দীপু বারবার খাটের তলাটার দিকে চাইছে বলে পিনাকপাণি বললেন, তুমি ভাবছ, এখনো সেই মেয়েটা ওখানে আছে কি না? হ্যাঁ, আছে৷ ওই মেয়েটাই তো আমায় পাগল করে দিচ্ছে৷ তুমি দেখবে?

দীপু বলল, না, না, আমি দেখতে চাই না৷

পিনাকপাণি শুনলেন না৷ খাটটা সরিয়ে ফেললেন৷ তারপর নিজেই বাক্সের ডালাটা খুলে চিৎকার করে বললেন, কেন, তুমি আমাকে মারতে চাও?

দীপু দেখল মেয়েটির ঠিক একই রকম চেহরা রয়েছে৷ খুব তাজা৷ চোখ দুটো কাচের মতন৷

পিনাকপাণি দেওয়ালে হেলান দিয়ে বললেন, আগে আমি পাগল ছিলাম না, দীপু৷ আগে আমি ছিলাম জামসেদপুরের বিজন বসু৷ চাকরি-বাকরি করতাম, বউ-ছেলেমেয়ে ছিল, হঠাৎ একদিন আমি পিনাকপাণি হয়ে গেলাম৷ আমার মাথার মধ্যে কেউ ফিসফিস করে কথা বলে৷ এই মেয়েটাই বলে৷ আমি বুঝতে পেরেছি৷ আগে ফিসফিস করে নানারকম কথা বলত৷ এখন শুধু একটাই কথা বলে৷ আমাকে মরতে বলে৷

দীপু বলল, আপনি এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন না?

কোথায় যাব?

অনেক দূরে৷ এই মোহরগুলো আপনি নিন৷

তা হয় না, দীপু৷ আমি জানি, কোথাও গিয়ে আমি বাঁচতে পারব না৷ আমার চোখটা বদলে গেছে৷ পৃথিবীর আলো আমি সহ্য করতে পারি না৷ মাঝে মাঝে অন্ধ সেজে চোখ বন্ধ করে যাই৷ আগে তবু একটু একটু চোখ খুলতে পারতাম, এখন আর দিনের আলোতে কিছুতেই চাইতে পারি না৷ চোখে ভীষণ জ্বালা করে৷

তা হলে অন্ধ সেজেই থাকবেন৷ কত লোক তো এমনিতেই অন্ধ, তবু, তো তারা ভালোভাবেই বেঁচে থাকে৷

আমি তা পারব না৷ মাথার মধ্যে সব সময় ফিসফিস আওয়াজ৷ যেখানে যাই, ওই আওয়াজ আমাকে ছাড়বে না, হয় আমাকে পাগল করে দেবে, কিংবা এখানে টেনে আনবে৷ তুমি চন্দননগরে গিয়েছিলে, সেখানেও আমি তোমার খোঁজে গেলুম—’

আমি চন্দননগরে গিয়েছিলাম, তাও আপনি জেনে ফেলেছিলেন?

হ্যাঁ, এই ক্ষমতাও আমার নতুন হয়েছে৷ আমি একবার যাকে দেখি, তার মনের সব কথা ছবির মতন দেখতে পাই৷ চন্দননগরে একটা হোটেল ভাড়া করেছিলাম৷ কিন্তু সেখানেও থাকতে পারলাম না রাত্তিরে৷ মাথার মধ্যের ফিসফিসে আওয়াজ বার বার বলতে লাগল, ফিরে এসো, ফিরে এসো৷ ঠিক যেন চুম্বকের টানে ফিরে এলাম৷

কোমর থেকে সেই বড় ছোরাটা বার করে পিনাকপাণি বললেন, এই আওয়াজটা রোজ আমাকে বলছে, এই ছোরাটা দিয়ে আত্মহত্যা করতে৷ আমি এই ছোরাটা হাজরা পার্কে মাটি খুঁড়ে পুঁতে এসেছিলাম৷ নিজের কাছে রাখতে চাইনি৷ কিন্তু মাঝরাত্তিরে নিজেই আবার সেটাকে তুলে নিয়ে এলাম৷ পারলাম না, বুঝলে দীপু৷ পারলাম না৷

দীপুর যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে৷ কাঠের বাক্সটার ডালাটা খোলা৷ সেই মেয়েটার দিকে যতবার চোখ যাচ্ছে, ততবারই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ভয়ে ভয়ে৷ একটা মরা মেয়ে কতদিন ধরে ওই বাক্সটার মধ্যে রয়েছে কে জানে৷ পচে না৷ গলে না৷

আর পিনাকপাণির হাতে ওই অতবড় ছোরা৷ ওঁর চোখ দুটো এখন সত্যিই যেন পাগলের মতন মনে হচ্ছে৷ দীপু যদি এখনো পালিয়ে যেতে পারত৷

পিনাকপাণি বললেন, ব্যাপারটা আমি অনেকটা আন্দাজ করতে পারছি৷ অনেকদিন আগে, মনে হয় কয়েক জন্ম আগে পিনাকপাণি নামে একটা লোক মেয়েটিকেই বোধহয় খুন করেছিল৷ তারপর পিনাকপাণিও অন্য কোথাও গিয়ে মারা যায়, ওদের দু’জনের আত্মাই মুক্তি পায়নি৷ এই পৃথিবীতে একজন আর একজনকে তাড়া করে ফিরছে৷ তারপর পিনাকপাণি বোধহয় আমার অর্থাৎ বিজন বসুর শরীরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে৷

দীপু বলল, আমি এবার যাব?

না দীপু, তোমার সাহায্য যে আমার খুব দরকার৷

আপনি আমাকে দয়া করুন, আমাকে ছেড়ে দিন৷ আমি কিছুতেই পারব না৷

আমি নিজেও যে পারছি না দীপু৷ মরতে আমাকে হবেই৷ কিন্তু নিজে কি নিজের বুকে ছুরি বসানো যায়? অনেকবার চেষ্টা করেও পারিনি৷

আমি পারব না৷ কিছুতেই পারব না৷

কেউ তো এখানে দেখবে না৷ কেউ এখানে আমাদের খুঁজে পাবে না৷ তুমি পালিয়ে যেও৷ ওপরের দরজাটা বন্ধ করে দিলে কেউ কোনো দিন আর আমাদের খুঁজে পাবে না৷

না, না, না!

তুমি এক কাজ করো দীপু, শুধু একটা কাজ—

না, না, আমার পাপ হবে৷

হবে না, তোমার পাপ হবে না৷ সব পাপ আমার৷

পিনাকপাণি দীপুকে জোর করে টেনে এনে একটা দেওয়ালের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন৷ তারপর ছোরাটা দীপুর হাতে তুলে দিয়ে বললেন, তোমাকে আর কিছু করতে হবে না, তুমি শুধু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকো—

দীপু কিছু বোঝবার আগেই পিনাকপাণি দীপুর হাতের ছোরাটার ওপর বুক দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন৷ ছোরাটা ওঁর বুকে সম্পূর্ণ গেঁথে গেল৷

পিনাকপাণি একটুও শব্দ করলেন না৷ সেই রকম ছোরা-বেঁধা অবস্থাতেই কোনোরকমে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, এইবার তোমার ছুটি—দীপু—তুমি যাও—এবার আমারও ছুটি৷

তারপর পেছন ফিরে টলতে টলতে এক পা এক পা করে সেই কাঠের বাক্সটার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, এইবার আমি এসেছি—আমি এসেছি৷

রক্তমাখা বুক নিয়ে পিনাকপাণি ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই মরা মেয়েটির ওপর৷

অমনি মেয়েটি উঠে বসে বিকট গলায় হি হি হি হি করে হেসে উঠল৷

দীপু আর সহ্য করতে পারল না৷ ঝুপ করে সেখানেই পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে৷

কতক্ষণ সেভাবে অজ্ঞান হয়ে ছিল, দীপু জানে না৷ পরে জ্ঞান ফিরল কয়েকটি ছেলেমেয়ের চিৎকারে৷ কোথায় যেন কারা খুব ভয় পেয়ে কাকে ডাকছে৷

দীপু চোখ মেলে দেখল পিনাকপাণির মৃতদেহটা পড়ে আছে, মাটিতে৷ কিন্তু কাঠের বাক্সের মধ্যে সেই মেয়েটি নেই, সে ঘরের মধ্যে কোথাও নেই৷

দীপু কোনোক্রমে উঠেই দৌড় লাগাতে গেল৷ তখন সে বুঝল, চ্যাঁচামেচি আসছে পাশের ঘর থেকে৷

সেই ঘরটাতে খাঁচাগুলোর মধ্যে ছাগল, বাঁদর, বেড়াল বা হরিণ আর নেই৷ বরং দুটি মেয়ে আর তিনটি ছেলে বন্দি৷—

দীপু এক হ্যাঁচকা টানে খাঁচার দরজাগুলো খুলে দিতেই ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে এল৷

ওরা একসঙ্গে জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায়! কে আমাদের এখানে আটকে রেখেছে?

দীপু বলল, ওসব কথা জিজ্ঞেস করবার এখন সময় নেই৷ শিগগির পালাও৷

দীপু মোহরের বাক্সটা তুলে নিয়ে নিজেই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে এল বাইরে৷ তারপর সে অন্ধকারের মধ্যে ছুটে মিলিয়ে গেল৷

মোহরের বাক্সটা দীপু খুব গোপনে লুকিয়ে রেখেছে৷ আজও কোনো কথা সে মাকে বলেনি৷ অন্তত চার-পাঁচ বছর কেটে না গেলে, সে কারুকে কিছু জানাতে চায় না৷

কাঠের বাক্সের সেই মেয়েটি যে কোথায় গেল, দীপু এখনো তা জানে না৷ এখনো সেই মেয়েটির হাসির কথা ভাবলে তার বুক গুড়গুড় করে৷

পিনাকপাণির জন্য তার মাঝে মাঝে কষ্ট হয়৷ পিনাকপাণিই হোক বা বিজনকুমার বসুই হোক, লোকটি খারাপ ছিল না৷ তবে পিনাকপাণি মরে গিয়েছিল বলেই যে ছাগল বাঁদর বেড়াল আর হরিণরা আবার মানুষ হয়ে গেল, একথা ভেবে দীপুর আবার মনে হয় লোকটা মরে গিয়ে ভালোই হয়েছে৷

খরগোশগুলোর কী অবস্থা হয়েছিল, তা আর দীপু দেখেনি৷ তবে ওরা মানুষ ছিল না নিশ্চয়ই৷ তাহলে পিনাকপাণি বলতেন৷ হয়তো অন্য কোনো জানোয়ার৷ তারা শেষ পর্যন্ত খাঁচাতেই বন্দি থেকে গেছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *