ভবিষ্যৎ
পৃথিবীর যা অবস্থা দেখছেন ধানুরাম তাতে তার ব্যবসা চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে। ধানুরাম কবিরাজ। এই তেত্রিশশো বাহান্ন সালে আয়ুর্বেদের তেমন কদর হওয়ার কথা ছিল না। বাপ-পিতেমোর পেশা ছেড়েই দিতে চেয়েছিলেন, আর কবরেজি করবেনই বা কি ভাবে?
সারা পৃথিবী জুড়ে কেবল শহর আর বসত। গাছ গাছালির পাঠ উঠে গিয়েছিল। ধানুরাম তখন কবরেজি ছেড়ে নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গেই একটা রাসায়নিক গবেষণাগারে কাজ করতে লাগলেন। তখন তার বয়স চব্বিশ পঁচিশ হবে।
একদিন সহকর্মী বনমালী বলল, ধানু গোপনে তোমাকে একটা খবর দিই। আমি একটা জিনিস বানিয়েছি, বড় আজব জিনিস।
কী বল তো!
মাধ্যাকর্ষণকে ফাঁকি দেওয়ার একটা কায়দা করা গেছে। একদিন ল্যাবরেটরিতে বসে নানারকম জিনিস মিশিয়ে যাচ্ছিলাম খেয়ালখুশিতে, হঠাৎ দ্রব্যটা লাফিয়ে শূন্যে উঠে ভাসতে লাগল।
বলো কী হে?
তবে আর বলছি কী?
বনমালীর সেই আবিষ্কার থেকে দেখ-না-দেখ দুনিয়ার ডোল পাল্টে গেল। তার কারণ ওই নতুন যন্ত্র আবিষ্কারের পর মানুষজন তাই শূন্যপথে যাতায়াত করতে শুরু করল। মাটির ওপর দিয়ে যাতায়াত কমে যেতে লাগল। তার ফলে রাস্তাঘাট ফাঁকা পড়ে থেকে থেকে গাছপালা গজাতে লাগল। তারও ওপর বনমালীর ওই জিনিস আরও উন্নত করে মহাশূন্যে যাতায়াত হয়ে গেল আরও সহজ এবং দ্রুত। ফলে সূর্যের অন্য সব গ্রহে যাতায়াতে ঝামেলা ঝাট আর রইল না। আবিষ্কারের দশ বছরের মধ্যে অন্যান্য গ্রহে এবং চাদে বিরাট বিরাট কলোনী তো হলোই, আকাশে বেলুন বাড়ি তৈরি হলো মেলা। পৃথিবীর দু চার মাইল ওপরে শূন্যে বাড়িগুলো ভেসে থাকে। ফলে পৃথিবীতে বাস না করে অধিকাংশ মানুষই ভাল আবহাওয়ার জন্য আর নির্জনতার খোঁজে নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে শহর ফাঁকা হয়ে যেতে লাগল এবং সেখানে গাছপালা গজাতে লাগল ।
এখন সেই আবিষ্কারের পঞ্চাশ বছর পর পৃথিবী গাছপালায় ছেয়ে তো গেছেই, জঙ্গল এত নিবিড় হয়েছে যে পা রাখার জায়গা নেই। সাপ, বাঘ, সিংহ, ভালুক, গরিলা, ব্যাঙ, বিছে একেবারে গিজগিজ করছে। দিনে দুপুরে ঝিঁঝির ডাক শোনা যায়।
মুশকিলটা এখানেই। জঙ্গলের জন্য পৃথিবীতে গাছগাছড়ার খোঁজ করাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সকালে ধানুরাম তার ভাসমান নৌকার মতো বাতাসী যানে নাতি সহ কন্টিকারি, পাথরকুঁচি, বিশল্যকরণী ইত্যাদি গাছগাছড়ার সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন। কিন্তু কোথাও নামতে সাহস হচ্ছে না। এক জায়গায় ঘন জঙ্গল দেখে নামতে গিয়ে দেখলেন তলায় সাত আটটা বাঘ মুখ তুলে তাদের দেখছে।
নাতি বলল, বাঃ, কী সুন্দর!
ধানুরাম ভ্রূ কুঁচকে বলল, বড় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। আগে পৃথিবীতে একটাও বাঘ ছিল না। কোথা থেকে যে গজাল কে জানে!
নাতি অবশ্য মজাই পাচ্ছে। কারণ সে থাকে তার বাবার কাছে, পৃথিবীর দু মাইল ওপরে এক আকাশবাড়িতে। বাঘ দূরের কথা গাছপালাও চোখে দেখেনি। সে বলল নামো না দাদু।
বাপ রে! নামলেই ঘ্যাঁক।
তার মানে?
সে বুঝবি না। ও হলো, বাঘ।
বাঘ তো কী?
ও বড় ভয়ংকর জিনিস।
আবার আর এক জায়গায় নামতে গিয়ে ধানুরাম দেখলেন একটা গরিলা মস্ত একটা গাছের গায়ে গা ঘষে পিঠ চুলকোচ্ছে।
দাদু, আমি ওই লোকটার সঙ্গে ভাব করব।
ভাব করার লোক নয় দাদু, কাছে গেলেই ঘাড় মটকাবে।
নাতি ঝুঁকে জঙ্গলের মধ্যে গরিলাটাকে দেখছিল। দুষ্টু ছেলে, হঠাৎ নৌকোর কানা টপকে নীচে লাফিয়ে পড়ল। ধানুরাম তাকে সাবধান করার সময়টাও পেলেন না। অসহায়ভাবে চেঁচাতে লাগলেন, ও দাদু! ও দাদু! এ কী সব্বনেশে কাণ্ড করলি!
নীচে লাফ দিলেও হাত পা অবশ্য ভাঙবে না। কারণ নাতির জুতোয় বনমালীর সেই আবিষ্কার লাগানো আছে। নাতি ধীর গতিতেই পড়ল এবং গভীর জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ধানুরাম ভয়ে উদ্বেগে ঘামতে লাগলেন। ধীরে ধীরে অগত্যা নিজের যানটিকে নীচে নামিয়ে আনলেন। নামাতে খুবই ক্লেশ পেতে হলো। নিচ্ছিদ্র গাছপালা, লতাগুল্মে তলাটা দুর্ভেদ্য হয়ে আছে। যানটা ভূমিস্পর্শ করতে পারল না। লতাপাতায় আটকে ঝুলে রইল। ধানুরাম লাফ দিয়ে নীচে নেমে নাতির নাম ধরে ডাকাডাকি করে খুঁজতে লাগলেন। চারিদিকে নানারকম জীবজন্তুর পায়ের শব্দ হচ্ছে। একটা হাতি ডেকে উঠল কাছেপিঠে। হায়না হাসল। ধানুরামের বুক কাঁপতে লাগল ভয়ে। মাত্র পাঁচ বছর বয়সী নাতি। এ জঙ্গলে তার নিরাপত্তা কোথায়?
খুঁজতে খুঁজতেই ধানুরাম বুঝতে পারলেন আশা নেই। গাছপালায় চারদিক এত অন্ধকার যে এই দিন দুপুরেও কিছু দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তবু প্রাণপণে ডাকতে লাগলেন। যদি সাড়া দেয়। তারপরেই ঘটল অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ধানুরাম নাতিকে খুঁজতে খুঁজতে বেশ খানিকটা এগোতেই হঠাৎ দেখতে পেলেন সেই গরিলাটা তার নাতির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ফাঁকা জায়গায়। আর সাতটা বাঘ তার নাতিকে ঘিরে পা আর গা চেটে আদর করছে।
ধানুরাম একটা শ্বাস ছাড়লেন। না, জীবজন্তুরা আর আগের মতো নেই। নব্য প্রজন্মের এরা বেশ সভ্য ভব্যই বলতে হবে।