ভবঘুরে
ছন্নছাড়া, গৃহহারা, বাউণ্ডুলে, ভবঘুরে, যাযাবর–কত হরেকরকম রঙবেরঙের শব্দই না আছে বাঙলাতে ভ্যাগাবন্ড বোঝাবার জন্য। কিন্তু তবু সত্যকার বাউণ্ডুলিপনা করতে হলে সবচেয়ে উত্তম ব্যবস্থা– গেরুয়াধারণ। ইরান-তুরান-আরবিস্থানে দরবেশ সাজা। ইয়োরোপে এই ঐতিহ্যমূলক পরিপাটি ব্যবস্থা না থাকলেও অন্যান্য মুষ্টিযোগ আছে যার কৃপায় মোটামুটি কাজ চলে যায়। সেগুলোর কথা পরে হবে।
তবে এই সন্ন্যাসী বেশ ধারণ করার আগে একটুখানি ভেবে-চিন্তে নেওয়া দরকার। একটি ছোট উদাহরণ দিই।
আমি তখন বরদায়! বহু বৎসর আগেকার কথা। হঠাৎ সেখানে এক বঙ্গসন্তানের উদয়। ছোকরা এম এ পাস করে কী করে সেখানে একা চাকরি জুটিয়ে বসেছে–মাইনে সামান্যই, কষ্টে-সৃষ্টে দিন কেটে যায়।
ছোকরা আমাদের সঙ্গে মেলেমেশে বটে কিন্তু শনির সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল পর্যন্ত তার পাত্তা পাওয়া যায় না অথচ ওই সময়টাতেই তো চাকুরেদের দহরম-মহরম গাল-গল্প করা, বিশেষ করে যখন বিনয়তোষের বাড়িতে রবির দুপুরে ভূরিভোজনের জন্য তাবৎ বাঙালির ঢালাও নেমন্তন্ন। অনুসন্ধান না করেই জানা গেল বাঁড়ুয্যে ছোকরার দু পায়ে দু খানা অ্যাব্বড়া বড়া বড়া চক্কর। শনির দুপুরে আপিস ছুটি হতে না হতেই সে ছুট দেয় ইস্টিশান পানে। সেখানে কোনও একটা গাড়ি পেলেই হল। টিকিট মিন্-টিকিটে চলল সে ইঞ্জিনের একচোখা দৃষ্টিতে সে যেদিকে ধায়।
পূর্বেই বলেছি, এহেন সৃষ্টিছাড়া কর্মের জন্য সন্ন্যাসী বেশ প্রশস্ততম। হিন্দু-মুসলমান টিকিট-চেকারের কথা বাদ দিন, সে যুগের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্টুদে চেকার পর্যন্ত মিন টিকিটের গেরুয়াকে ট্রেন থেকে নামাত না–বিড়বিড় করতে আমিই একাধিকবার শুনেছি, গড ড্যাম হোলি ম্যান নাথিং ডুইং। অর্থাৎ ওটা খোদার খাসি, কিচ্ছুটি করার যো নেই।
আমাদের বাঁড়ুয্যে ছোকরাটি অতিশয় চৌকশ তালেবর। দুটি উইক-এন্ডের বাউণ্ডুলিপনা করতে না করতেই আবিষ্কার করে ফেললে এই হৃদয়-রঞ্জন তথ্যটি– সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের চক্কর দুটি টাইমপিসের ছেঁড়া স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে তার পা দুটিকেও ছাড়িয়ে গেল। বিশেষ করে যেদিন খবর পেল, সৌরাষ্ট্রের বীরমগাম ওয়াচওয়ান থেকে আরম্ভ করে ভাওনগর দ্বারকাতীর্থ অবধি বহু ট্রেনে একটি ইম্পিশেল কামরা থাকে যার নাম মেন্ডিকেট কম্পার্টমেন্ট, গেরুয়া পরা থাকলেই সে কামরায় মিন-টিকিটে উঠতে দেয়। সেখানে নাকি সাধু-সন্ন্যাসীরা আপসে নির্বিঘ্নে আত্মচিন্তা ধর্মচিন্তা পরব্রহ্মে মনোনিবেশ করতে পারেন। তবে নেহাত বেলেল্লা নাস্তিকদের মুখে শুনেছি সেখানে নাকি বিশেষ এক ধোয়ার গন্ধ এমনই প্রচণ্ড যে কাগে বগে সেখান থেকে বাপ-বাপ করে পালায়– দুষ্টেরা আরও বাঁকা হাসি হেসে বলে আসলে নিরীহ প্যাসেঞ্জারদের ওই কৈবল্য ধূম্রের উৎপাত থেকে বাঁচানোর জন্য ওই খয়রাতি মেডিকেন্ট কম্পার্টমেন্টের উৎপত্তি। কিন্তু আমাদের বাঁড়ুয্যে তার থোড়াই পরোয়া করে– আসলে সে খাস দর্জি-পাড়ার ছেলে, বাবা-ছোকরা বয়েস থেকে বিস্তর ইটালিয়ান (অর্থাৎ হঁটের উপরে বসে) ছিলিম-ফাটানো দেখেছে, দু-চার কাচ্চা যে নাকে ঢোকেনি সে-কথাও কসম খেয়ে অস্বীকার করতে সে নারাজ। দু আ ভূ আ না করে বাঁড়ুয্যে তদ্দশ্যেই ধুতিখানি গেরুয়া রঙে ছুপিয়ে মাদ্রাজি প্যাটার্নে লুঙ্গিপানা করে পরল, বাসন্তী রঙ করাতে গিয়ে গেরুয়াতে জাতান্তরিত তার একখানি উড়ুনি আগের থেকেই ছিল। ব্যোম ভোলানাথ বলতে বলতে বাঁড়ুয্যে চাপল মেডিকেন্ট কম্পার্টমেন্টে। বাবাজি চলেছেন সোমনাথ দর্শনে।
আমাদের বাঁড়ুয্যে কিপটে নয়, মিন-টিকিটে চড়ার পরও তার ট্র্যাকে ছুঁচোর নেত্য। তাই আহারাদিতেও তাকে হাত টেনে হাত বাড়াতে হত পয়সা দিতে। তাই ওই ব্যাপারে রিট্রেঞ্চমেন্ট করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল আরেকটি তথ্য– পুরি তরকারি, দহি-বড়া শিঙাড়ার চেয়ে শিককাবাব ঢের সস্তা, পোস্টাইও বটে। এক পেট পরোটা-শিককাবাব খেয়ে নিলে শুবো-শাম ত্রিযামা-যামিনী নিশ্চিন্তি।
গোস্ত-রোটি কাবাব-রোটি যেই না ফেরিওয়ালা দিয়েছে হক অমনি বাঁড়ুয্যে তিন লক্ষে দরজার কাছে এসে তাকে দিল ডাক। লোকটা প্রথমে কেমন যেন হকচকিয়ে গেল।– আসতে চাইল না। বাঁড়ুয্যে ঘন ঘন ডাকে, আরে দেখতে নাহি পারতা হায়, হাম তুমকো ডাকতে ডাকতে গলা ফাটাতা হায়– সে-হিন্দিকে রাষ্ট্রভাষা না বলে লোষ্ট্রভাষা বলাই উচিত। এক-একটি লজো যেন হঁটের থান।
ফেরিওলা কাছে এসে কাঁচুমাচু হয়ে হিন্দি গুজরাতিতে বুঝিয়ে বললে, সাধুজি এ তোমার খাওয়ার জিনিস নয়। বাঁড়ুয্যে গেল চটে। সে কি এতই অগা যে জানে না, শিক-কাবাব কোন অখাদ্য চতুষ্পদ থেকে তৈরি হয়। তেড়ে বললে, হাম ক্যা খাতা হায়, নাহি খাতা হায়, তোমার ক্যা ভেটকি-লোচন? ফেরিওলা তর্ক না করে স্পষ্ট বোঝা গেল অনিচ্ছায় কাবাব-রুটি দিয়ে পয়সাগুলো শুনেই ধামাতে ফেলে চলে গেল।
ট্রেন ছেড়েছে। বাঁড়ুয্যে কাবাব-রুটি মুখে দিতে গিয়েছে– লক্ষ করেনি, কামরার থমথমে ভাবটা। এমন সময় দশা হেঁড়ে গলায় একসঙ্গে হুঙ্কার উঠল, এই শালা, ক্যা খাতা হৈঃ।
প্রথমটায় বাঁড়ুয্যে বুঝতে পারেনি। আস্তে আস্তে তার চৈতন্যোদয় হতে লাগল সন্ন্যাসীদের প্রাণঘাতী চিল্কারের ফলে। শালা পাষণ্ড, নাস্তিক। অখ্যাদ খায়, ওদিকে ধরেছে গেরুয়া। চোর ডাকাত কিংবা খুনিও হতে পারে। ফেরার হয়ে ধরেছে ভেক। এই করেই তো সাধু-সন্ন্যাসীদের বদনাম হয়েছে, যে তাদের কেউ কেউ আসলে ফেরারি আসামি।
বাঁড়ুয্যে কী করে বলে সে জানত না, ওটা অখাদ্য। একে মাংস, তায়—ওদিকে ওরা ফেরিওলাতে-বাঁড়ুয্যেতে যে কথা কাটাকাটি হয়েছে সেটা যে ভালো করেই শুনেছে, তা-ও ওদের কথা থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল।
ওদিকে সন্ন্যাসীরা এক বাক্যে স্থির করে ফেলেছে, এই নরপশুকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে এর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করানো হোক। দু-একটা ষণ্ডা তার দিকে তখন এগিয়ে আসছে।
বাঁড়ুয্যের মনের অবস্থা কল্পনা করুন। চেন টানার ব্যবস্থা থাকলেও সেদিকেও দুশমনদের ভিড়। সে বিকল অবশ। এরকম অবশ্য-মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে কটা লোক?
একজন তার দু বাহুতে হাত দিয়ে ধরতেই কম্পার্টমেন্টের এককোণ থেকে হুঙ্কার এল, ঠরো। সবাই সেদিকে তাকালে। এক অতি বৃদ্ধ সন্ন্যাসী উপরের দিকে হাত তুলেছেন। ইনি এতক্ষণ এদের আলোচনায় যোগ দেননি।
বললেন, সাধুরা সব শোনো৷ এঁর গায়ে হাত তুলো না। ইনি কী ধরনের সন্ন্যাসী তোমরা জান না। উনি যে দেশ থেকে এসেছেন সেদেশের এক জাতের সন্ন্যাসীকে সব কিছু খেতে হয়, লজ্জা ঘৃণা ভয় ওঁদের ত্যাগ করতে হয়। শুধু ত্যাগ নয়, সানন্দে গ্রহণ করতে হয়। ইনি সেই শ্রেণির সন্ন্যাসী। তোমরা তো জানো না, সন্ন্যাসের গুরু বুদ্ধদেব শুয়োরের মাংস খেয়ে নির্বাণ লাভ করেছিলেন। একে একদিন ওই পর্যায়ে উঠতে হবে। মৃত্যু ভয় এর নেই। দেখলে না উনি এখন পর্যন্ত একটি শব্দ মাত্র করেননি। ঘৃণা এবং ভয় থেকে উনি মুক্ত হয়েছেন। বোধহয় একমাত্র লজ্জাজয়টি এখনও তার হয়নি। তাই এখনও পরনে লজ্জাবরণ। সে-ও তিনি একদিন জয় করবেন।
তোমরা ওঁর গায়ে হাত দিও না।
কতখানি বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর যুক্তিবাদের ফলে, কতখানি তার সৌম্য দর্শন শান্ত বচনের ফলে মারমুখো সন্ন্যাসীরা ঠাণ্ডা হল বলা কঠিন।
বাঁড়ুয্যে সে যাত্রায় বেঁচে গেল।
দু-তিন স্টেশন পরই সন্ন্যাসীরা নেমে গেল ওই বৃদ্ধ ছাড়া।
তখন তিনি বাড়জ্যেকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, বাবুজি এ যাত্রায় ভগবানের দয়ায় বেঁচে গেছ, ভবিষ্যতে সাবধান হয়ো।
***
সেই থেকে ওই বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর সন্ধান আমি প্রতি তীর্থেই করি। উনি যদি একবার আমার গৃহিণীকে বুঝিয়ে দেন, আমিও একটা অবধূত-টবধূত তা হলে ওর খাই-বায়নাক্কা-নথ ঝামটা থেকে নিষ্কৃতি পাই। দশটা মারমুখো সন্ন্যাসীকে ঠাণ্ডা করতে পারলেন আর ওকে পারবেন না? কী জানি!
***
ভবঘুরে সব দেশেই আছে কিন্তু শীত এলেই ইয়োরোপের ভবঘুরেদের সর্বনাশ। ওই জমাট বরফের শীতে বাইরে শোওয়া অসম্ভব। যদি-বা কেউ পার্কের বেঞ্চের উপরে খবর কাগজ পেতে (এই খবরের কাগজ সত্যি শরীরটাকে খুব গরম রাখে; হিমালয়ের চটিতে যদি দু খানা কম্বলেও শীত না ভাঙে তবে কম্বলের উপর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কয়েকখানা খবরের কাগজের শিট সন্তর্পণে বিছিয়ে নেবেন। আমি কোনও কোনও খানদানি ট্রাম্পকে বুকে-পিঠে খবরের কাগজ জড়িয়ে তার উপর ভেঁড়া শার্ট পরতে দেখেছি) শোবার চেষ্টা করে তবে বেদরদ পুলিশ এসে লাগায় হুনো। প্যারিসে তখন কেউ কেউ আশ্রয় নেয় নদীর কোনও একটা ব্রিজের তলায় শুকনো ডাঙায়। সেখানেও সকালবেলা পুলিশ আবিষ্কার করে শীতে জমে গিয়ে মরা ট্রাম্প। পাশে দু-একটা মরা চড়ই। গরমের আশায় মানুষের শরীরের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। গর্কি না কার যেন লেখাতে পড়েছি, এক ট্রাম্প ছোকরাকে সমস্ত রাত জড়িয়ে ধরে একটি ট্রাম্প মেয়ে সমস্ত রাত কাটিয়ে যে যার পথে কিংবা বিপথেও বলতে পারেন– চলে গেল। (এদেশে বর্ষাকালে তাই বুদ্ধদেবও সন্ন্যাসীর সঙ্গে আশ্রয় নিতে আদেশ দিয়ে গেছেন)।
এই বিপথে কথাটার ওপর আমি জোর দিতে চাই। গ্লোব-ট্রটার জীবটি আদপেই ভবঘুরে নয়– যদিও একটা শব্দ যেন আরেকটা শব্দের অনুবাদ। গ্লোবট্রটার সমুখ পানে এগিয়ে চলে, তার নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থল আছে। ভবঘুরে যেখানে খুশি দু-চারদিন এমনকি দু-চার মাসও স্বচ্ছন্দে কাটায়। এমনকি কোনও দয়াশীলের আশ্রয়ে সুখেও কাটায়। কিন্তু হঠাৎ একদিন বলা-নেই-কওয়া-নেই, হুট করে নেবে যায় রাস্তায়। কেন? কেউ জানে না। ওরা নিজেরাই জানে না। শুধু এইটুকু বলা যায়, সুখের নীড় তাদের বেশিদিন সয় না–নামে দুঃখের পথে; আবার দুঃখের পথে চলতে চলতে সন্ধান করে একটু সুখের আশ্রয়। দুটোই তার চাই, আর কোনওটাই তার চাইনে। এ বড় সৃষ্টিছাড়া দ্বন্দ্ব সৃষ্টিছাড়াদের।
যাদের ভিতরে গোপনে চুরি করার রোগ ঘাপটি মেরে বসে আছে ওটাকে সত্যই দৈহিক রোগের মতো মানসিক রোগ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে বলে এটার নাম ক্লেপ্টোমেনিয়া– তাদের জন্য আমাদের শাস্ত্রকাররা বৎসরে একদিন চুরি করার– তা-ও ফলমূল মাত্র– অনুমতি দিয়েছেন। ওটা যেন একজস্ট পাইপ। ঠিক তেমনি হোলির দিন একটুখানি বেএক্তেয়ার হওয়ার অনুমতি কর্তারা আমাদের দিয়েছে। এটাও অন্য আরেক ধরনের এক্সস্ট পাইপ।
জর্মন জাতটা একটু চিন্তাশীল। তারা স্থির করলে এই বাউণ্ডুলেপনা যাদের রক্তে ঘাপটি মেরে বসে আছে এদের নাম ভান্ডার-ফ্যোগোল অর্থাৎ ওয়ান্ডারিং বার্ডস অর্থাৎ উড়ন্ধু পাখি– তাদের জন্য জায়গায় জায়গায় অতিশয় সস্তায় রেস্ট হাউস করে দাও, সেখানে তারা নিজে বেঁধে খেতে পারবে, যদি অতি সস্তায় তৈয়ারি খানা খায় তবে বাসন বর্তন মেজে দিতে হবে, যদি ফ্রি বালিশের ওয়াড় বিছানার চাদর চায় তবে সেগুলো কিংবা আগের রাত্রে অন্য কারওর ব্যবহার করা বাসি ওয়াড়-চাদর কেচে দিতে হবে যাতে করে, ইচ্ছে করলে, সে অতি ভোরেই ফের রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে পারে। ওদের রান্নাঘরে নিজের আলমালু সেদ্ধ করে খেলে আর চাদর ওয়াড় না চাইলে রাত্রি-বাস একদম ফ্রি।
উড়ুক্কু পাখিরা অনেক সময় দল বেঁধে বেরোয়; সঙ্গে রান্নাবান্নার জিনিস এবং বিশেষ করে বাজনার যন্ত্র–ৎসি হারমনিকা (হাত অর্গিন) ব্যাঞ্জো, মান্ডলিন। ওই সব রেস্ট হাউসের কমন রুমে তারা গাওয়া-বাজনা নাচানাচি করে সমস্ত রাত কাটাত। অনেকেই শনির দুপুরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোমের সকালে বাড়ি ফিরত। কেউ কেউ পুরো গরমের ছুটি, কেউ কেউ দীর্ঘতর অনির্দিষ্টকাল।
এ-সব আমার শোনা কথা। নিজের অভিজ্ঞতা পরে বলব।
রাস্তায় ট্রাম্পকে অনেকেই লিফ্ট দেয়। জোড়া পাখি যদি হয় তবে লিফট পাওয়া আরও সোজা, একটু কৌশল করলেই। ছেলেটা দাঁড়ায় গাছের আড়ালে। মেয়েটা ফ্রক হাঁটু পর্যন্ত তুলে গার্টার ফিট করার ভান করে সুডৌল পা-টি দেখায়। রসিক নটবর গাড়ি থামিয়ে মধুর হেসে দরজা খোলেন। ছোকরা তখন আড়াল থেকে আস্তে আস্তে এসে পিছনে দাঁড়ায়, নটবর তখন ব্যাক-আউট করেন কী করে? করলেও দৈবাৎ। যে উড়ন্ধু পক্ষিণী আমাকে গল্পটি বলেছিল তার পা-টি ছিল সত্যই সুন্দর। তা সে যাকগে।
অনেকেই আবার লিফট দিতে ডরায়। তাদের বিরুদ্ধে নিম্নের গল্পটি প্রচলিত :
কুখ্যাত ডার্টমুর জেলের সামনে সদ্য খালাসপ্রাপ্ত দু জন কয়েদি লিফটের জন্য হাত তুলছে। যে ভদ্রলোক মোটর দাঁড় করালেন তিনি কাছে এসে যখন বুঝতে পারলেন এরা কয়েদি তখন গড়িমসি করতে লাগলেন। তারা অনেক কাকুতি-মিনতি করে বোঝালে তারা সামান্য চোর– খুনিটুনি নয়। সামনে টাউনে পৌঁছে দিলেই বাস ধরে রাতারাতি বাড়ি পৌঁছতে পারবে। ভদ্রলোক অনেকটা অনিচ্ছায়ই রাজি হলেন। পরের টাউনে ভদ্রলোকেরও বাড়ি। পরের টাউনে পৌঁছতেই লাইটিং টাইম হয়ে গিয়েছে। ওদিকে ওঁর হেডলাইট ছিল খারাপ। পড়লেন ধরা। পুলিশ ফুটবোর্ডে পা রেখে নম্বর টুকে হিপ পকেটে নোটবুকখানা রেখে দিয়ে চলে গেল। ভদ্রলোক আপসোস করে বললেন, তোমাদের সঙ্গে কথা কইতে যে তিন মিনিট বাজে খরচা হল সেটা না করলে এতক্ষণ আমি বাড়ি পৌঁছে যেতুম। এখন পুলিশ কোর্টে আমার জেরবার হয়ে যাবে। লোকে কি আর সাধে বলে কারও উপকার করতে নেই। দুই খালাস পাওয়া কয়েদি হাসতে হাসতে গাড়ি থেকে নামার সময় বললে, আপনার কিছু ভয় নেই, হুজুর, আপনার নামে কোনও সমন আসবে না। এই নিন সেই পুলিশের নোটবুক যাতে আপনার গাড়ির নম্বর টোকা ছিল। আমরা পুলিশের পকেট তখনই পিক করেছি। আসলে পকেট মেরেই ধরা পড়াতে আমাদের জেল হয়েছিল। আপনি আমাদের উপকার করতে গিয়ে বিপদে পড়বেন, এটা আমরা দাঁড়িয়ে দেখি কী প্রকারে বলুন।
আমি নিজে কখনও খানদানি বাউণ্ডুলে বনে বাড়ি থেকে বেরোইনি। তবে হেঁটে, সাইক্রে, আঁধা-বোটে অর্থাৎ কোনও প্রকারের রাহা খরচা না করে হাই কিং করেছি বিস্তর।
আমি তখন রাইন নদীর পারে বন্ শহরে বাস করি। রাইনের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখবার জন্য পৃথিবীর লোক সেখানে প্লেজার স্টিমারে করে উজান-ভাটা করে। আমিও একবার করার পর আমার মনে বাসনা জাগল ওই অঞ্চলেই হাই করে রাইন তো দেখব দেখবই, সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকার গিরি-পর্বত, উপত্যকার ক্ষেত-খামার, গ্রামাঞ্চলের বাড়ি-ঘরদোর, নিরিবিলি গ্রাম্যজীবন সব-কিছুই দেখে নেব। আর যদি রাইন অঞ্চল ভালো না লাগে তবে চলে যাব যেদিকে খুশি।
আমার ল্যান্ডলেডিই আমাকে রাস্তা-দুরস্ত করে দিলে। মাথায় প্রকাণ্ড ঘেরের ছাতা-হ্যাট। পশমের পুরু শার্টের উপর চামড়ার কোট। চামড়ার শার্ট। সাইক্লোমোজা। ভারী বুটজুতো।
শব্দার্থে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা একটি হেভার-স্যাক। তার ভিতরে রান্নার সরঞ্জাম, অর্থাৎ অতি, অতি হাল্কা এবং পাতলা কিন্তু বেশ শক্ত এলুমিনিয়ামের সসপেন জাতীয় বস্তু, প্লেট, চামচে ছুরি-কাটা নিইনি– স্পিরিট স্টোভ এবং অত্যন্ত ছোট সাইজের বলে দু বার মাত্র হাঁড়ি চড়ানো যায় কয়েক গোলা চর্বি, কিঞ্চিৎ মাখন, নুন-লঙ্কা আর একটি রবারের বালিশ ফুঁ দিয়ে ফোলানো যায়।
আর বিশেষ কিছু ছিল বলে মনে পড়ছে না। এসবে আমার খরচা হয়েছিল অতি সামান্যই, বাড়ির একাধিক লোক এসব বস্তু একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। এস্তেক কোট পাতলুনে একাধিক চামড়ার তালি! ল্যান্ড-লেডি বুঝিয়ে বললে, উকিলের গাউনের মতো এসব বস্তু যত পুরনো হয় ততই সে খানদানি ট্রাম্প!
পকেটে হাইনের বুখ ড্যার লিডার–কবিতার বই। কবি হাইনে বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবস্থায় এ বইয়ের কবিতাগুলো লিখেছিলেন। এতে রাইন নদী বার বার আত্মপ্রকাশ করেছে।
রবির অতি ভোরে গির্জার প্রথম ম্যাসে হাজিরা দিয়ে রাস্তায় নামলুম।
.
০৩.
একটা কোঁৎকা ছাড়া হাইকিঙে বেরোতে নেই। অবশ্য সর্বক্ষণ সদর রাস্তার উপর দিয়ে চলতে তার বড় প্রয়োজন হয় না, কিন্তু সদর রাস্তার দুপাশে আলুক্ষেত, আপেল বাগান থাকে না, লোকজন যারা থাকে তারাও ট্রাম্প ভিখিরি পছন্দ করে না। পিঠের ব্যাগটা খালি হয়ে গেলে সেটা বিন্-খরচায় ভরে নিতে হলে অজ পাড়াগাঁই প্রশস্ততম।
কিন্তু যত প্রচণ্ড শিক্ষিত দেশই হোক না কেন, পাড়াগাঁয়ে দু-একটা বদ-মেজাজি কুকুর থাকবে এবং তারা পয়লা নম্বরের মব। ছিমছাম ফিটফাট সুট পরে গটগট করে চলে যান কিছুটি বলবে না। কিন্তু আপনি বেরিয়েছেন হাইকিঙে যতই ফিটফাট হয়ে বাড়ি থেকে বেরোন না কেন, লজঝড় কাক বক তাড়ানোর স্কেয়ারক্রো বনে যেতে আপনার দু দিনও লাগবে না। দু দিন কেন, গাছতলায় একরাত কাটানোর পর সকালবেলাই সুটমুটের যে চেহারা হয় তার মিল অনেকটা ভ্যাগাবন্ড চার্লিরই মতো, এবং ওই সব কুকুরগুলো তখন ভাবে, আপনাকে ভগবান নির্মাণ করেছেন নিছক তাদের ডিনার-লাঞ্চের মাংস যোগাবার জন্য সিঙিকে যেমন হরিণ দিয়েছেন, বাঘকে যেরকম শুয়ার দিয়েছেন। পেছনে থেকে হঠাৎ কামড় মেরে আপনার পায়ের ডিম কী করে সরানো যায় সেই তাদের একমাত্র উচ্চাভিলাষ। ওটাতে আপনারও যে কোনও প্রয়োজন থাকতে পারে সে বিষয়ে ওরা সম্পূর্ণ উদাসীন।
আমার ল্যান্ড-লেডি হাতে লাঠি তুলে দিতে দিতে বললে, এক জর্মন গিয়েছে ঘোর শীতে স্পেনে। স্পেনের গ্রামাঞ্চল যে বিশ্বসারমেয়ের ইউনাইটেড নেশন সেটা ভদ্রলোক জানতেন না। তারই গণ্ডা তিনেক তাঁকে দিয়েছে হুড়ো। ভদ্রলোক আর কিছু না পেয়ে রাস্তা থেকে পাথর কুড়োতে গিয়ে দেখেন সেগুলো জমিতে জোর সেঁটে রয়েছে– আসলে হয়েছে কী, শীতে জল জমে বরফের ভিতর সেগুলো মোক্ষম আটকে গেছে। ভদ্রলোক খাঁটি গ্লোব-ট্রটারের মতো আত্মচিন্তা করলেন, অদ্ভুত দেশ! কুকুরগুলোকে এরা রাস্তায় ছেড়ে দেয়, আর পাথরগুলোকে চেন দিয়ে বেঁধে রাখে।
ল্যান্ড-লেডিকে বলতে হল না– আমি বিলক্ষণ জানতুম, তদুপরি আমার শ্যাম-মনোহর বর্ণটি অষ্টাচক্র স্কন্ধ-কটি দ্রাভদ্র যে-কোনও সারমেয় সন্তানই এই ভিনদেশি চিজটিকে তাড়া লাগানো একাধারে কর্তব্যকর্ম সম্পাদন এবং আয়বর্ধন রূপে ধরে নেবে– লক্ষ করেননি চীনেম্যান আমাদের গাঁয়ে ঢুকলে কী হয়?
কোঁৎকাটা ঠুকতে ঠুকতে শহর ছেড়ে মেঠো পথে নামলুম।
খৃস্টান দেশে রোববারে ক্ষেতখামারের কাজও ক্ষান্ত থাকে। পথের দু ধারের ফসল ক্ষেতে জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। রাস্তায়ও মাত্র দু-একটি লোকের সঙ্গে অনেকক্ষণ চলার পর দেখা হল। তারাও গ্রামের লোক বলে হ্যাট তুলে গুটেনটা বা গুটেন মর্গেন (শুভদিন বা শুভ দিবস) বলে আমাকে অভিবাদন জানায়। বিহার মধ্যপ্রদেশের গ্রামাঞ্চলেও ঠিক এইরকম অপরিচিত জনকেও রাম রাম বলে অভিবাদন করার পদ্ধতি আছে। কাবুলে তারও বাড়া। একবার আমি শহরের বাইরের উপত্যকায় বেড়াতে গিয়েছিলুম। রাস্তা প্রায় জনমানবহীন। বিরাট শিলওয়ার এবং বিরাটতর পাগড়ি-পরা মাত্র একটি কাবুলি ধীরে মন্থরে চলেছে–গ্রামের লোক শহুরেদের তুলনায় হাঁটে অতি মন্থরগমনে এবং তার চেয়ে মন্দ গতিতে চলে যারা একদম পাহাড়ের উপর থাকে। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তাকে ধরে ফেললুম। ঘাড় ফিরিয়ে অলস কৌতূহলে আমার দিকে তাকিয়ে, ভালো তো? কুশল তো? শুধিয়েই আমার দিকে একগুচ্ছ স্যালাড পাতা এগিয়ে দিলে। এস্থলে এটিকেট কী বলে জানিনে আমি একটি পাতা তুলে নিলুম। তখন এগিয়ে দিলে বাঁ হাতের পাতার ঠোঙাটি। সেটাতে দেখি হলদে-লালচে রঙের ঘন কী পদার্থ। আমি বোকার মতো তাকিয়ে আছি দেখে সে নিজে একখানা স্যালাড পাতা নিয়ে ওই তরল পদার্থে শুত্তা মেরে মুখে পুরে চিবোতে লাগল। আমিও করলুম। দেখি, জিনিসটা মধু এবং অত্যুত্তম মধু। ওই প্রথম শিখলুম, কাবুলিরা তেল-নুন-সিরকা দিয়ে স্যালাড পাতা খায় না, খায় মধু দিয়ে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়, মোদ্দা কথা দেহাতি কাবুলি যদি কিছু খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে চলে তবে পরিচিত অপরিচিত সবাইকে তার হিস্যা এগিয়ে দেবেই দেবে। এবং স্ট্রিক্টলি ব্রাদারলি ডিভিজ– অর্থাৎ আমার একখানা পাতা চিবানো শেষ হতে না হতেই আরেকখানা পাতা এবং মধুভাণ্ড এগিয়ে দেয়। পরে গ্রামে ঢোকা মাত্রই সে আমাকে এক চায়ের দোকানে টেনে নিয়ে যায় এবং দাম দেবার জন্য আখেরে বিস্তর ধস্তাধস্তি করে। কিন্তু থাক সেকথা– এটা আছে কাবুলে ভবঘুরেমি অনুচ্ছেদে।
এস্থলে স্থির করলুম, অপরিচিতকেও নমস্কার জানানো যখন এ-দেশে রেওয়াজ তবে এবার থেকে আমিই করব।
আধঘন্টাটাক পরে দেখি এগিয়ে আসছে একজন। বয়সে আমার চেয়ে বড়ও বটে। ও মোকা পাবার পূর্বেই আমি বেশ চেঁচিয়ে বললুম, ঞ্যসৃগট।
এ স্থলে নব জর্মন শিক্ষার্থীদের বলে রাখি, জর্মনভাষী জর্মন এবং সুইস সচরাচর গুটেন টাখ গুডে, শুভদিবস ইত্যাদি বলে থাকে, কারণ এরা বড় সেকুলারাইজড (ধর্মনিরপেক্ষ) হয়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে অস্ট্রিয়াবাসী জর্মনভাষীগণের অনেকেই এখনও সগট ভগবানের আশীর্বাদ বলে থাকে। এদেশের মুসলমানরা আল্লাকে স্মরণ করেই সালাম বলেন, হিন্দুরা রাম রাম এবং বিদায় নেবার বেলা গুজরাতে জয় জয়! জয় শিব, জয় শঙ্কর।
স্পষ্ট বোঝা গেল লোকটা গ্রুসগটের জন্য আদপেই তৈরি ছিল না। গুটেনটাখ, গুটেনটাখ বলে শেষটায় বার কয়েক গ্রুগ বলে সামনে দাঁড়াল। শুধালে, কোথায় যাচ্ছ?
ইংলন্ডে গ্রামাঞ্চলের এটিকেট জানিনে। সেখানেও বোধহয় শহুরেদের কড়াকড়ি নেই।
বললুম, বিশেষ কোথাও যাচ্ছিনে। ওই সামনের গ্রামটায় দুপুরবেলা একটু জিরোব। রাতটা কাটাব, তার পরে কোনও একটা গ্রামে, কিংবা গাছতলায়।
বললে, আমি যাচ্ছি শহরে! তার পর বললে, চল না, ওই গাছতলায় একটু জিরোন যাক। আমি বললুম, বিলক্ষণ। ভবঘুরেমির ওই একটা ডাঙর সুবিধে। না হয় কেটেই গেল ওই গাছতলাটায় ঘণ্টা কয়েক– যদিও ওটা তেঁতুলগাছ নয় এবং নজন সুজন তো এখনও দেখতে পাচ্ছিনে।
চতুর্দিক নির্জন নিস্তব্ধ। ইয়োরোপেও মধ্যদিন আসন্ন হলে পাখি গান বন্ধ করে। শুধু দূর অতি দূর থেকে গির্জার ঘণ্টা অনেকক্ষণ ধরে বেজে যাচ্ছে। রবির দুপুরের ওই শেষ আরতি– হাই ম্যাস– তাই অনেকক্ষণ ধরে ঘণ্টা বেজেই চলেছে। ওই ভেসে আসা শব্দের সঙ্গে আমার মনও ভেসে চলেছে দূর-দূরান্তে– ওই বহুদূরে যেখানে দেখা যাচ্ছে ভিনাস পাহাড়ের চুড়োর উপর গাছের ডগাগুলো।
বললে, আসলে পাইপটা অনেকক্ষণ টানিনি; তাই এই জিরোনো। তার পর শুধালে, তোমার দেশ কোথায়? আমি বললুম, আমি ইন্ডার (ভারতীয়)। এমনি চমক খেল যে তার হ্যাটটা তিন ইঞ্চি কাত হয়ে গেল। তোতলালে ইন্ডিয়ানার?
ইন্ডার অর্থাৎ ইন্ডিয়ান আর ইন্ডিয়ানার অর্থ রেড ইন্ডিয়ান। দেহাতীদের কথা বাদ দিন, শহরে অর্ধ-শিক্ষিতেরাও এ দুটোতে আকছারই ঘুলিয়ে ফেলে। অনেকরকম করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলুম, আমি কোন দেশের লোক। শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পেরেছিল কি না জানিনে তবে তার বিস্ময় চরমে পৌঁছেছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
আর বার বার শুধু মাথা নাড়ে আর বলে, বিপদে ফেললে, বড় বিপদে ফেললে।
আমি শুধালুম, কিসের বিপদ?
কত ভবঘুরে, বাউণ্ডুলে কত দেশ-দেশান্তরে যাচ্ছে আমার তাতে কী। কিন্তু তুমি অত দূর দেশের লোক, আমার গায়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছ, আমার সঙ্গে আলাপ হল আর তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতে পারলুম না– এতে দুঃখ হয় না আমার?
তার পর মরিয়া হয়ে বললে, আসলে কী জানো, আমার স্ত্রী একটি আঁকিল। দুনিয়ার লোকের হাড় গুঁড়িয়ে দেওয়াই ওঁর স্বভাব। না হলে তোমাকে বলতুম, আমার বাড়িতে বিকেল অবধি জিরিয়ে নিতে আমিও ফিরে আসতুম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, কত লোক ইয়ার-দোস্তকে দাওয়াত করে খাওয়ায়, গাল-গল্প করে, আমার কপালে সেটি নেই।
আমি তাকে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে বললুম তার সহৃদয়তাই আমাকে যথেষ্ট মুগ্ধ করেছে, যদি সম্ভব হয় তবে ফেরার মুখে তার খবর নেব।
পুনরায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, কিছু মনে কর না, কিন্তু ভবঘুরেদের কি আর কথা রাখবার উপায় আছে? আমার নামটা কিন্তু মনে রেখ– টেরমের!
আমি বললুম, সে কী! আমি তো ফের বন শহরে ফিরে যাব। এই নাও আমার ঠিকানা। সেখানে আমার খবর নিও। দু জনাতে ফুর্তি করা যাবে।
খুশি হয়ে উঠল। বললে, বড্ডই জরুরি কাজ তাই উকিল বসে আছে, এই রোববারেও, আমার জন্যে, টাকাটা না দিলে সোমবার দিন কিস্তি খেলাপ হবে।
আমি বললুম, ভগবান তোমার সঙ্গে থাকুন। বললে, যতদিন না আবার দেখা হয়।
দশ পা এগিয়েছি কি না, এমন সময় শুনি পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলছে, ওই সামনের মোড় নিতেই দেখতে পাবে ডানদিকে এক-পাল ভেড়া চরছে। ওখানে কিন্তু দাড়িও না। ভেড়াগুলোকে সামলায় এক দজ্জাল আলসেশিয়ান কুকুর। ওর মনে যদি সন্দেহ হয়, তোমার কোনও কুমতলব আছে তবে বড় বিপদ হবে।
কথাটা আমার জানা ছিল, কিন্তু স্মরণ ছিল না। বললুম, অনেক ধন্যবাদ।
.
০৪.
ইউরোপ তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এর বর্ণনা সে মহাদেশের কবি, চিত্রকার, বস্তুত চিন্তাশীল তথা দরদি ব্যক্তি মাত্রেরই দেওয়া সত্ত্বেও বলতে হয়, না দেখলে তার আংশিক জ্ঞানও হয় না। তুলনা দিয়ে এদেশের ভাষায় বলা যেতে পারে, বন্যা ও ভূমিকম্পের মার যারা দেখেছেন তারাই জানেন এর জের দেশকে কতদিন ধরে টানতে হয়।
মোড় নিতেই দেখি, বাঁ দিকের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে নাসপাতিভর্তি ঠেলাগাড়ি ঠেলতে ঠেলতে রাজ-আল ধরে আসছে একটি বয়স্ক লোক। সর্বপ্রথমই চোখে পড়ল, তার ডান হাতখানা কনুই অবধি নেই। হাতের আস্তিন ভাঁজ করে ঘাড়ের সঙ্গে পিন করা। বড় রাস্তায় সে উঠল ঠিক আমি যেখানে পৌঁছেছি সেখানেই। আমি প্রথমটায় ঞ্যসগট বলে তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই গাড়িটায় এক হাত দিয়ে ঠেলতে লাগলুম। এ অভিবাদনে লোকটি প্রথম চাষার মতো মোটেই হকচকালো না, এবং প্রত্যুত্তর গ্রুগট বলে আর পাঁচজনেরই মতো গুটেন টাখ–সুদিবস জানালে। তার পর বললে, ও গাড়ি আমি একাই ঠেলতে পারি। নাসপাতিগুলোর প্রতি তোমার যদি লোভ হয়ে থাকে তবে অত হ্যাঁঙ্গামা পোহাতে হবে না–যত ইচ্ছে তুলে নাও। আমি এই অন্যায় অপবাদে চটিনি– পেলুম গভীর লজ্জা। কী যে বলব ঠিক করার পূর্বেই সে বললে, হাত না দিলেও দিতুম।আমি তখন মোকা পেয়ে বললুম, নাসপাতি খেতে আমি ভালোবাসি নিশ্চয়ই, এবং তোমারগুলো যে অসাধারণ সরেস সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই কিন্তু ঠেলা দেবার সময় আমার মনে কোনও মতলব ছিল না, এবং তুমিও যে স্বচ্ছন্দে ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তার উঁচুতে গাড়িটাকে ঠেলে তুললে সেও আমি লক্ষ করেছি। আমি হাত দিয়েছিলুম এমনি। পাশাপাশি যাচ্ছি কথা বলতে বলতে যাব, তখন দু জনাই যে একই কাজ করতে করতে যাব সেই তো স্বাভাবিক– এতে সাহায্য লোভ কোনও কিছুরই কথা ওঠে না। চাষা হেসে বললে, তোমার রসবোধ নেই। আর তুমি জানো না, এবারে নাসপাতি এত অজস্র একইসঙ্গে পেকেছে যে এখন বাজারে এর দর অতি অল্পই। এই সামনের গ্রামগুলোর ভিতর দিয়ে যখন যাবে তখন দেখতে পাবে গাছতলায় নাসপাতি পড়ে আছে– কুড়িয়ে নিয়ে যাবার লোক নেই। যত ইচ্ছে খাও, কেউ কিছু বলবে না। আমি বললুম, আমাদের দেশেও এই রেওয়াজ। কোথায়, কোন দেশ, ইন্ডিয়ান আর রেড-ইন্ডিয়ানে পুনরায় সেই গুবলেট, তার পর আশ-কথা পাশ-কথা সেরে সর্বশেষে নিজেই বললে, তার হাতখানা গেছে গত যুদ্ধে। হেসে বললে, লোকে বলে, তারা করুণার পাত্র হতে চায় না; আমার কিন্তু তাতে কোনও আপত্তি নেই। হাত গিয়ে কত সুবিধে হয়েছে বলব। গেরস্তালির কোনও কিছু করতে গেলে বউ বেটি হা হা করে ঠেকায়, যদিও আমি এক হাত দিয়েই দুনিয়ার চোদ্দ আনা কাজ করতে পারি। চাষ-বাস, ফলের ব্যবসা, বাড়ি মেরামতি সবই তো করে যাচ্ছি– যদিও মেয়ে-জামাই ঠ্যাকাবার চেষ্টা করেছিল এবং শেষটায় করতে দিলে, হয়তো এই ভেবে যে কিছু না করতে পেরে আমি হন্যে হয়ে যাব।
আমি বললুম, তোমরা তো খৃস্টান; তোমাদের না রোববারে কাজ করা মানা।
লোকটা উত্তর না দিয়ে হকচকিয়ে শুধোলে, তুমি খৃস্টান নও?
না।
তবে কী?
হিদেন।
আমি জানতুম, পৃথিবীর খৃস্টানদের নিরানব্বই নয়া পয়সা বিশ্বাস করে, অখৃস্টান মাত্রই। হিদেন। তা সে মুসলমান হোক আর বই হোক। নিতান্ত ইহুদিদের বেলা হয়তো কিঞ্চিৎ ব্যত্যয়, অবশ্য সেটা পুষিয়ে নেয় তাদের বেধড়ক ঠেঙিয়ে। তাই ইচ্ছে করেই বললুম, হিদেন।
লোকটা অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করে বললে, আমি গত যুদ্ধে ঈশ্বরকে হারিয়েছি। তবে কি আমিও হিদেন? নিজের মনে যেন নিজেকেই শুধোলে।
আমি বললুম, আমি তো পরমেশ্বরে বিশ্বাস করি।
এবারে সে স্তম্ভিত। এবং শব্দার্থে। কারণ গাড়ি ঠেলা বন্ধ করে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালে। শেষটায় বললে, এটা কিন্তু আমাকে সোজা করে নিতে হবে। আমাদের পাদ্রি তো বলে, তোমরা নাকি গাছ, জল এইসব পুজো করো। পাথরের সামনে মানুষ বলি দাও।
আমি বললুম, কোনও কোনও হিদেন দেয়, আমরা দিইনে। আমি বিশ্বাস করি, ঈশ্বরকে ভক্তি দিলেই যথেষ্ট।
বোকার মতো তাকিয়ে বললে, তবে তো তুমি খৃস্টান! আমাকে সব-কিছু বুঝিয়ে বল।
আমি বললুম, থাক। ফেরার সময় দেখা হলে হবে।
তাড়াতাড়ি বললে, সরি, সরি। তুমি বোধহয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। ওই তো সামনে গ্রাম। আমার বাড়িতে একটু জিরিয়ে যাবে?
আমি টেরমেরের স্মরণে শুধালুম, তোমার বউ বুঝি টেরমেরের বউয়ের মতো খাণ্ডার নয়?
সে তো অবাক। শুধোলে ওকে তুমি চিনলে কী করে? সবকিছু খুলে বললুম। ভারি ফুর্তি অনুভব করে বললে, টেরমের একটু দিলদরিয়া গোছ লোক আর তার বউ একটু হিসেবি– এই যা। আর এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করলেই চিন্তা বাড়ে। যুদ্ধের সময়, আমার এক জর্মনের সঙ্গে আলাপ হয়– সে বুলগেরিয়াতে, বিয়ে করে বসবাস করছিল। তিন বছর সুখে কাটাবার পর একদিন তার স্ত্রীর এক বান্ধবী তাকে নির্জনে পেয়ে শুধোলে, তুমি তোমার বউকে ভালোবাসো না কেন– অমনি লক্ষ্মী মেয়ে। সে তো অবাক, শুধোলে, কে বললে? কী করে জানলে? বান্ধবী বললে, তোমার বউ বলেছে, তুমি তাকে তিন বছরের ভিতর একদিনও ঠ্যাঙাওনি! শোনো কথা!
আমি অবাক হয়ে শুধালুম, আমিও তো বুঝতে পারছিনে।
সে বললে, আমিও বুঝতে পারিনি, প্রথমটায় ওই জর্মন স্বামীও বুঝতে পারেনি। পরে জানা গেল, মেয়েটা বলতে চায়, এই তিন বছর নিশ্চয়ই সে কোনও না কোনও পরপুরুষের সঙ্গে দু-একটি হাসিঠাট্টা করেছে, স্বামী দেখেছে, কিন্তু পরে ঠ্যাঙায়নি। তার অর্থ, স্বামী তাকে কোনও মূল্যই দেয় না। সে যদি কাল কোনও পর-পুরুষের সঙ্গে পালিয়ে যায়, তবে স্বামী কোনও শোক করবে না, নিশ্চিন্ত মনে আরেকটা নয়া শাদি করবে। ভালোবাসলে ওকে হারাবার ভয়ে নিশ্চয়ই ওকে ঠেঙিয়ে সোজা রাখত।
আমি বললুম, এ তো বড় অদ্ভুত যুক্তি!
আমিও তাই বলি। কিন্তু ওই করে বুলগেরিয়া চলছে। আর এদেশে বউকে কড়া কথা বলেছ কী সে চলল ডিভোর্সের জন্য। তাই তো তোমায় বললুম, ওসব নিয়ে বড় বেশি ভাবতে নেই। লড়াইয়ে বহু দেশের জাত-বেজাতের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। অনেক দেখেছি। অনেক শিখেছি।
আমার মনে পড়ল ওই দেশবাসী রেমার্কের পশ্চিম রণাঙ্গন নিপ বইখানার কথা। সেখানে তো সব কটা সেপাই বাড়ি ফিরেছিল– অর্থাৎ যে কটা আদপেই ফিরেছিল– সর্বসত্তা তিক্ততায় নিমজ্জিত করে। আদর্শবাদ গেছে, ন্যায়-অন্যায়-বোধ গেছে; যেটুকু আছে সে শুধু যাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অহরহ মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছে তাদের জন্য। দেশের জন্য আত্মদান, জাতির উন্নতির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ, ফ্রান্সকে পরাজিত করার জন্য জীবন-দান –এসব বললে মারমুখো হয়ে বেআইনি পিস্তল নিয়ে তাড়া লাগায়।
নাসপাতিওলাকে শুধোতে সে বললে সে বইটই পড়ে না। খবরের কাগজ পড়ে বাজার দর জানবার জন্য, আর নিতান্তই যদি কোনও রগরগে খুন কিংবা কেলেঙ্কারি কেচ্ছার বয়ান থাকে। তবে হ্যাঁ, ওর মনে পড়েছে ফিল্মটা নাকি জর্মনিতে বারণ করে দেওয়া হয়েছিল ওর মেয়ের মুখে শোনা। আমি শুধালুম, ছবিটা দেখে ছেলেছোকরাদের লড়াইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা হবে বলে? বললে, না, ওতে নাকি জর্মনদের বড় বর্বররূপে দেখানো হয়েছে বলে। তখন আমার মনে পড়ল, ফ্রান্সেও দেখাবার সময় যে অংশে ফরাসি নারীরা ক্ষুধার তাড়নায় জর্মন সেপাইদের কাছে রুটির জন্য দেহ বিক্রয় করার ইঙ্গিত আছে সেটা কেটে দেওয়া হয়।
অনেকক্ষণ দু জনাই চুপচাপ। নাসপাতিওলা ভাবছে। হঠাৎ বললে, পিছন পানে তাকিয়ে আর লাভ কী। যারা মরেছে তারা গেছে। যারা পাগল হয়ে গিয়েছে, যাদের মুখ এমনই বিকৃত হয়েছে দেখলে মানুষ ভয় পায়, যাদের হাত-পা গিয়ে অচল হয়ে আছে নিছক মাংসপিণ্ডবৎ, তাদের বড় বড় হাসপাতালে লুকিয়ে রাখা হয়েছে; আর আত্মীয়স্বজনদের বলা হয়েছে তারা মারা গিয়েছে এরাও নাকি ফিরে যেতে চায় না। আর আমার হাল তো দেখছই।
আমাদের গ্রামের সবকিছুই থিতিয়ে যাওয়ার পর একটা ট্র্যাজেডির দিকে সক্কলেরই নজর গেল। একটা ছেলে গ্রামে ফিরে এসে শোনে, তার অবর্তমানে তার বাগদত্তা মেয়েটি পর-পুরুষের সঙ্গে প্রণয় করেছিল। এতে আর নতুন কী? লড়াইয়ের সময় সব দেশেই হয়েছে। এবং হবে। মেয়েটা তবু পদে আছে– জারজ সন্তান জন্মায়নি। আর সেই দু দিনের প্রেমিক কবে কোথায় চলে গেছে কে জানে।
এ অবস্থায় আর পাঁচটা ছেলে অন্য মেয়ে নেয়, কিংবা ক্ষমাঘেন্না করে আগেরটাকেই বিয়ে করে। এ হয়ে গেল মনমরা। সমস্ত দিন ছন্নের মতো ঘুরে বেড়ায়, কারও সঙ্গে কথাবার্তা কয় না, আমাদের পীড়াপিড়িতেও বিয়ার খেতে আসে না। মেয়েটা নাকি একাধিকবার তার পায়ে ধরে কেঁদেছে। সে কিছু বলে না।
ছোট গাঁ, বোঝ অবস্থাটা। গিঞ্জেয়, রাস্তায়, মুদির দোকানে প্রতিদিন আমাদের একে অন্যের সঙ্গে যে কতবার দেখা হয় ঠিক-ঠিকানা নেই। মেয়েটা করুণ নয়নে তাকায়, ছেলেটা ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। আমরা যারা তখন সামনে পড়ি, বোঝ আমাদের অবস্থাটা। ছেলেটা সামনে পড়লে আমাদের মুখ গম্ভীর, মেয়েটা সামনে পড়লে অন্যদিকে তাকাই, আর দু জনা সামনে পড়লে তো চরম। ছেলেটা যখন মুরুব্বি, পুরনো দিনের ইয়ার-বক্সি ইস্তেক পাদ্রি সায়েব কারও কথায় কান দিলে না, তখন মেয়েটাকে বলা হল সে যেন অন্য একটা বেছে নেয়। যদিও বরের অভাব তবু সুন্দর এবং পয়সাওয়ালার মেয়ে বলে পেয়েও যেতে পারে। দেখা গেল, সে-ও নারাজ।
নাসপাতিওলা রাস্তায় থেমে বললে, এই যে বাড়ি পৌঁছে গিয়েছি। চল ভিতরে।
আমি বললুম, না ভাই, মাফ কর।
তবে ফেরার সময় খবর নিও। বাড়ি চেনা রইল।
আমি বললুম, নিশ্চয়। কিন্তু ওদের কী হল?
কাদের? হ্যাঁ, ওই দুটোর। একদিন ওই হোথাকার (আঙুল তুলে দেখালে) ডোবায় পাওয়া গেল লাশ।
আমি শুধালুম, ছেলেটার?
না, মেয়েটার।
আর ছেলেটা?
এখনও ছন্নের মতো ঘুরে বেড়ায়। এক্ষুনি আসবে। থাকো না– আলাপ করিয়ে দেব। আমি পা চালিয়ে মনে মনে বললুম, এ গ্রাম বিষবৎ পরিত্যাজ্য।
.
০৫.
সিনেমার কল্যাণে আজকাল বহু নৈসর্গিক দৃশ্য, শহর-বাড়ি, পশুপক্ষী বিনা মেহন্নতে দেখা যায়। এমনকি বাস্তবের চেয়েও অনেক সময় সিনেমা ভালো। বাস্তবে বেলকনি থেকে রানিকে আর কতখানি দেখতে পেলুম?–সিনেমায় তার আংটি, জুতোবকলস, হ্যাঁটের সিল্কটি পর্যন্ত বাদ গেল না। আলীপুরে গিয়ে বাঘ-সিঙি না দেখে সিনেমাতে দেখাই ভালো– ক্যামেরাম্যান যতখানি প্রাণ হাতে করে ক্লোজ-আপ নেয় অতখানি ঝুঁকি নিতে আপনি-আমি নারাজ।
বিলিতি ছবির মারফতে তাই ওদের শহর, বার, রেস্টুরেন্ট, নাচ, রাস্তা-বাড়ি, দালানকোঠা আমাদের বিস্তর দেখা হয়ে গিয়েছে কিন্তু গ্রামের ছবি এরা দেখায় অল্পই। গ্রামের বৈচিত্র্যই-বা কী, সেখানে রোমান্সই-বা কোথায়? অন্তত সিনেমাওলাদের চোখে সেটা ধরা পড়ে না ধরা পড়ে এখনও আর্টিস্টদের কাছে। ইউরোপীয় গ্রাম্যজীবনের ছবি এখনও তারা একে যাচ্ছেন আর পুরনো দিনের মিইয়ে, ভান গখের তো কথাই নেই।
আমাদের গ্রামে সাধারণত সদর রাস্তা থাকে না। প্রত্যেক চাষা আপন খড়ের ঘরের চতুর্দিকে ঘিরে রেখেছে আম-কাঁঠাল সুপরি-জাম গাছ দিয়ে কিছুটা অবশ্য ঝড় থেকে কুঁড়েগুলোকে বাঁচাবার জন্য। এখানে সে ভাবনা নেই বলে গ্রামে সদর রাস্তা থাকে, তার দু দিকে চাষাভুষো, মুদি, দর্জি, কসাই, জুতোওলা সবাই বাড়ি বেঁধেছে। আর আছে ইস্কুল, গির্জে আর পাবৃ– জর্মনে লোকাল (অর্থাৎ স্থানীয় মিলন ভূমি)। এইটেকেই গ্রামের কেন্দ্র বললে ভুল হয় না।
রাস্তাটা যে খুব বাহারে তা বলা যায় না। শীতকালে অনেক সময় এত বরফ জমে ওঠে যে চলাফেরাও কয়েকদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যেতে পারে–আমাদের দেশে বর্ষাকালে যেরকম হয়। শুধু বাচ্চাদেরই দেখতে পাওয়া যায় তারই উপর লাফালাফি করছে, পেঁজা বরফের গুড়ো দিয়ে বল বানিয়ে একে অন্যকে ছুঁড়ে মারছে।
শুনেছি কট্টর প্রোটেস্টান্ট দেশে– স্কটল্যান্ড না কোথায় যেন রোববার দিন কাচ্চাবাচ্চাদেরও খেলতে দেওয়া হয় না। এখানে দেখি, ছেলে এবং মেয়েরাও রাস্তার উপর একটা নিম-চুবসে-যাওয়া ফুটবলে ধপাধপ কি লাগাচ্ছে। এদের একটা মস্ত সুবিধে যে জাতিভেদ এদের মধ্যে নেই। দর্জির ছেলে মুচির মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, ইস্কুলমাস্টারের মেয়ে শুড়ির ছেলেকেও পারে। পাদ্রির ছেলেকেও পারত কিন্তু ক্যাথলিক পাদ্রির বিয়ে বারণ। আফগানিস্তানে যেরকম মেয়েদের মোল্লা হওয়া বারণ– দাড়ি নেই বলে।
একে ট্র্যাম্পে তায় বিদেশি, খেলা বন্ধ করে আমার দিকে যে প্যাট প্যাট করে তাকাবে তাতে আর আশ্চর্য কী। এমনকি ওদের মা-বাপরাও। এদের অনেকেই রবির সকালটা কাটায় জানালার উপর কুশন্ রেখে তাতে দুই কনুইয়ে ভর দিয়ে, বাইরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে। প্রথম প্রথম আমার অস্বস্তি বোধ হত, শেষটায় অভ্যাস হয়ে গেল। সেটা অবশ্য পরের কথা।
ছবিতে দেখেছিলুম ছোঁড়াদের একজন চার্লির পিছন থেকে এসে একটানে তার ছেঁড়া শার্ট ফরফর করে একদম দু টুকরো করে দিলে সেটা অবশ্য শহরে। এবং আমার শার্টটা শক্ত চামড়ার তৈরি, ওটা ছেঁড়া ছোঁড়াদের কর্ম নয়! কিন্তু তবু দেখি গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ে এক-জায়গায় জটলা পাকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে আর ফন্দি-ফিকির আঁটছে। একটি দশ-বারো বছরের মেয়েই দেখলুম ওদের হন্টরওয়ালি, ফিয়ারলেস নাদিয়া, মিস্ ফ্রন্টিয়ার মেল, ডাকুকি দিবা, জম্বুকি বেটি যা খুশি বলতে পারেন। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই সে দল ছেড়ে গটগট করে এসে প্রায় আমার রাস্তা বন্ধ করে মধুর হাসি হেসে বললে, সুপ্রভাত। সঙ্গে সঙ্গে একটি মোলায়েম কার্টসিও করলে– অর্থাৎ বাঁ পা-টি সোজা সটান পেছিয়ে দিয়ে, ডান হাঁটু, ইঞ্চি তিনেক নিচু করে দু হাতে দু পাশের স্কার্ট আলতোভাবে একটু উপরের দিকে তুলে নিয়ে বাও করলে। এই কার্টসি করাটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শহরে লোপ পেয়েছে, গ্রামাঞ্চলে তখনও ছিল, এখনও বোধকরি আছে।
এরা গ্র্যুসগট হয়তো জীবনে কখনও শোনেইনি। এদের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। তাই গুটেন্ মার্গেন বলার পূর্বে প্রথম ছাড়লুম একখানা মৃদু হাস্য– একান ওকান ছোঁয়া। আমার মুখখানাও বোম্বাই সাইজের। কলাটা আড়াআড়ি খেতে পারি। স্যান্ডউইচ খাবার সময় রুটির মাখন আকছারই দু কানের ড্যালায় লেগে যায়।
ইতোমধ্যে মেয়েটি অতিশয় বিশুদ্ধ ব্যাকরণে আমাকে যা শুধাল তার যদি শব্দে শব্দে অনুবাদ করা হয় তবে সেটা বাইবেলের ভাষার মতোই শোনাবে। আপনি ইচ্ছে করলে বললে হয়তো বলতেও পারেন এখন কটা বেজেছে। পশ্চিম ইউরোপীয় ভাষাগুলোকে সবজনক্টিভ মুড তথা কন্ডিশনাল প্রচুরতম মেকদারে লাগালে প্রভূততম ভদ্রতা দেখানো হয়। বাঙলায় আমরা অতীতকাল লাগিয়ে ভদ্রতা দেখাই। শ্বশুরমশাই যখন শুধোন বাবাজি তা হলে আবার কবে আসছ? আমরা বলি, আজ্ঞে আমি তো ভেবেছিলুম অর্থাৎ আমি যা ভেবেছিলুম কথাটা আপনার সম্মতি পাবে না বলে প্রায় নাকচ করে বসে আছি। তবু আপনি নিতান্ত জিগ্যেস করলেন বলে বললুম।
তা সে যাকগে। মেয়েটি তো দুনিয়ার কুল্লে সৰ্বজনক্টিভ একেবারে কপিবুক স্টাইলে, ক্লাস-টিচারকে খুশি করার মতো ডবল হেলপিং দিয়ে প্রশ্নটি শুধোলে। আমিও কটা সজক্টিভ লাগাব মনে মনে যখন চিন্তা করছি এমন সময় গির্জার ঘড়িতে ঢং করে বাজল একটা। আমার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলল। কোনও কথা না বলে ডান হাত কানের পেছনে রেখে যেদিক থেকে শব্দ আসছিল সেইদিকে কান পাতলুম।
ইতোমধ্যে দু চারটে ছোঁড়া রাস্তা ক্রস করে মেয়েটার চতুর্দিকে দাঁড়িয়েছে। সে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে ওদের বললে, বোধহয় জর্মন বোঝেন, কিন্তু বলতে পারেন না।
আমি বললুম, বোধহয় তুমি জর্মন বলতে পার, কিন্তু শুনতে পাও না।
অবাক হয়ে শুধোলে, কীরকম?
আমি বললুম, গির্জার ঘড়িতে ঢং করে বাজল একটা–বদ্ধ কালাও শুনতে পায়। আবার তুমি আমায় শুধোলে কটা বেজেছে। গির্জার ঘণ্টা যে শুনতে পায় না, সে আমার গলা শুনতে পাবে কী করে? তাই তো উত্তর দিইনি। তার পর ছোঁড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে বললুম, কী বলো, ভাইরা সব! ও নিশ্চয়ই লড়াইয়ে গিয়েছিল। সেখানে শেলশকে কালা হয়ে গিয়েছে– আহা বেচারি।
সবাই তো হেসে লুটোপুটি। ইস্তেক মেয়েটি নিজে। একাধিক কণ্ঠস্বর শোনা গেল; মেয়েছেলে আবার লড়াইয়ে যায় নাকি। তা-ও এইটুকু মেয়ে! আমি গোবেচারির মতো মুখ করে বললুম, তা কী করে জানব ভাই। আমি তো বিদেশি। কোন দেশে কী কায়দা, কী করে জানব, বল। এই তো তোমরা যখন ঠাহর করতে চাইলে, আমি জর্মন জানি কি না, তখন পাঠালে মেয়েটাকে। আমাদের দেশ হলে, মেয়েটা বুদ্ধি যোগাত, কোনও একটা ছেলে ঠেলা সামলাবার জন্য এগোত।
একসঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্ন, আপনার দেশ কোথায় যাবেন কোথায়? ইত্যাদি।
আমার মাথায় তখন কলি ঢুকেছে। সংস্কৃতে বললুম, অহং বৈদেশিকঃ। মম কোহপি নিবাসো নাস্তি। সর্বদা পরিভ্রমণের করোমি।
কী উল্লাস! কী আনন্দ তাদের!
আমি ইন্ডিয়ান, আমি রেড ইন্ডিয়ান, আমি চীনেম্যান এমনকি আমি নিগ্রো ইস্তেক। যে-যার মতো বলে গেল একইসঙ্গে চিৎকার করে।
আমি আশ্চর্য হলুম, কেউ একবারের তরেও শুধোলে না, আমি কোন ভাষায় কী বললুম সেটা অনুবাদ করে দিতে। তখন মনে পড়ল, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাঁর বাল্য বয়সে শিশুসাহিত্য নামক কোনও জিনিস প্রায় ছিল না বলে তিনি বয়স্কদের জন্য লেখা বই পড়ে যেতেন এবং বলেছেন, তাতে সবকিছু যে বুঝতে পারতেন তা নয়। কিন্তু নিতান্ত আবছায়া গোছের কী একটা মনের মধ্যে তৈরি করে সেই আপন মনের নানা রঙের ছিন্ন সূত্রে গ্রন্থি বেঁধে তাতে ছবিগুলো গেথেছিলেন–বইখানাতে অনেকগুলো ছবি ছিল বলে তিনি নিজেই না বোঝার অভাবটা পুষিয়ে নিয়েছিলেন। কথাটা খুব খাঁটি। বাচ্চারা যে কতখানি কল্পনাশক্তি দিয়ে না-বোঝর ফাঁকা অংশগুলো ভরে নিতে জানে, তা যারা বাচ্চাদের পড়িয়েছেন তাঁদের কাছেই সুস্পষ্ট। অনেক স্থলেই হয়তো ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছয় কিন্তু তাতে কী এসে যায়। আমি চীনেম্যান না নিগ্রো তাতে কার ক্ষতি-বৃদ্ধি। তারা বিদেশি, অজানা নতুন কিছু একটা পেয়েই খুশি। আর আমি খুশি যে বিনা মেহন্নত বিনাকসরত আমি এতগুলো বাচ্চাকে খুশি করতে পেরেছি– কারণ আমি বিলক্ষণ জানি, আমি সোনার মোহরটি নই যে দেখামাত্রই সবাই উদ্ধাহু হয়ে উল্লাসে উল্লম্ফন দেবে।
তা সে যাই হোক, শেষ পর্যন্ত স্থির হল আমি রেড ইন্ডিয়ান। তার কারণটা একটু পরেই আমার কাছে পরিষ্কার হল। এরা কয়েকদিন পর ইস্কুলের শো-তে একটা রেড ইন্ডিয়ান নাচ, তীর ছোঁড়া এবং শান্তির পাইপ খাবার অভিনয় করবে– আমি যখন স্বয়ং রেড় ইন্ডিয়ান উপস্থিত, তখন আমি রিহার্সেলটি তদারক করে দিলে পাশের গ্রামের ছেলেমেয়েরা একেবারে থ মেরে যাবে। ওঃ! তাদের কী সৌভাগ্য।
আমি নৃতত্ত্বের কিছুই জানিনে। রেড-ইন্ডিয়ানদের সম্বন্ধে আমার জ্ঞান নির্জলা নিল। তাদের শান্তির পাইপ কী, সে সম্বন্ধে আমার কণামাত্র জ্ঞান নেই। বুশ-মেনের বেশ-পোশাক আর রেড-ইন্ডিয়ানের এই বস্তুতে কী তফাত তা-ও বলতে পারব না।
অথচ ওদের নিরাশ করি কী প্রকারে?
যাক। দেখেই নি ওরা কতদূর এগিয়েছে।
তখন দেখি, ইয়াল্লা, এরা জানে আমার চেয়েও কম। ছোট্ট ইস্কুলবাড়ির একটা ঘর থেকে বেঞ্চি ডেস্ক সরিয়ে সেখানে রিহার্সেল আরম্ভ হল। রেড-ইন্ডিয়ান মাথায় পালক দিয়েছে বটে কিন্তু বাদবাকি তার সাকুল্য পোশাক কাও বয়দের মতো। আরও যে কত অনাছিষ্টি সে বলে শেষ করা যায় না।
তখন আবার বুঝলুম রবীন্দ্রনাথের সেই কথাই আপ্তবাক্য। অল্প-বয়স্করা কল্পনা দিয়েই সবকিছু পুষিয়ে নেয়। তদুপরি এদের প্রাণশক্তি অফুরন্ত। এরা পেট ভরে খেতে পায়। জামা-কাপড়ে এদের মধ্যেও কিছু দামি সস্তা ছিল বটে কিন্তু ছেঁড়া জামা-জুতো কারওই নয়। আট বছর হতে না হতে ওরা ক্ষেত-খামারের কাজে ঢোকে না। কোথায় এদের গ্রামের কাচ্চা-বাচ্চারা আর কোথায় আমার গ্রামের কাচ্চা-বাচ্চারা! এই বাচ্চাদের হাসিখুশি দেখে এদের যে-কোনও একটির মাথায় হাত রেখে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা যায় :
তুমি একটি ফুলের মতো মণি
এমনই মিষ্টি এমনই সুন্দর
মুখের পানে তাকাই যখনি
ব্যথায় যেন কাদায় অন্তর!
শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি
পড়ি এই আশিস মন্তর,
বিধি তোরে রাখুন চিরকাল
এমনই মিষ্টি এমনই সুন্দর!
ডু বিস্ট ভি আইনে ব্লুমে
জো হোল্ট, উট শ্যোন উট রাইন;
ইষ শাও ডিষ আন, উন্ট ভেমুট।
শ্লাই মির ইস্ হের্তস্ হিনাইন।
মির ইস্ট আলস্ অপ ইষ ডি হ্যানডে
আউফস হাউণ্ট ডির লেগেন জলট,
বেটেন্ড, ডাস্ গট এরহাল্টে
জো রাইন উনট শ্যোন উ্নট হোল্ট।
এই গ্রামের পাশের বন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাইনরিষ হাইনে যার ছোট্ট কবিতার বইটি, বুক ড্যার লিডার পকেটে নিয়ে বন্ থেকে বেরিয়েছি। এই কবিতাটি তার থেকে নেওয়া।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে পরম বিস্ময় বোধহয় এই কথা স্মরণ করে যে তিনিই প্রথম বাঙলাতে অনুবাদ করেন এবং খুব সম্ভব ভারতের সব ভাষা নিলে বাঙলাতেই প্রথম– হাইনের কবিতা। এবং তা-ও হাইনের মৃত্যুর পর চল্লিশ বছর যেতে যেতেই এবং মূল জর্মন থেকে–ইংরিজি অনুবাদ মারফতে নয়। পরবর্তী কবিদের অধিকাংশই অনুবাদ করেছেন ইংরেজি থেকে। মাত্র সত্যেন দত্ত ও যতীন্দ্র বাগচীরই অনুবাদ রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের কিছুটা কাছে আসতে পারে। রবীন্দ্রনাথই প্রথম হাইনের বাঙলা অনুবাদ করেছিলেন সেদিকে হালে শ্ৰীযুক্ত অরুণ সরকার আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধন্যবাদভাজন হয়েছেন, কারণ বরীন্দ্রনাথের চলিত-অচলিত কোনও রচনাবলিতেই এ অনুবাদের উল্লেখ পর্যন্ত নেই।
হাইনের সঙ্গে চণ্ডীদাসের তুলনা করা যায়। দু জনাই হৃদয়-বেদনা নিবেদন করেছেন অতি সরল ভাষায়। দরদি বাঙালি তাই সহজেই এর সঙ্গে একান্ত অনুভব করে।
গ্যোটে যে সংস্কৃতের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার অন্যতম কারণ সংস্কৃত এবং গ্যোটের দেশ ও জাতের ভাষা দুটোই আর্য ভাষা। কিন্তু হাইনে জাতে ইহুদি। আর্য-সভ্যতা এবং ইহুদিদের সেমিতি সভ্যতা আলাদা। তিনি আকৃষ্ট হয়েছিলেন নিছক ভারতবর্ষের নৈসর্গিক দৃশ্যের বর্ণনা পড়ে এবং শুনে।
তার যে শুরু ফন শ্লেগেল তাঁর মাথায় সর্বপ্রথম কবির মুকুট পরিয়ে দেন তিনি ছিলেন বন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক।
.
০৬.
গোল বাঁধল শান্তির পাইপ খাওয়া নিয়ে। এটা বোধহয় ড্রেস রিহার্সেল। তাই এই প্রথম সত্যকার পাইপে করে সত্যকার তামাক খাওয়া হবে। যে-ছেলেটি রেড ইন্ডিয়ানদের দলপতি সে বোধহয় একটু অতিরিক্ত মাত্রায় গোবেচারি নিতান্ত দিক-ধেড়েঙ্গে ঢ্যাঙা বলে তাকে দলপতি বানানো হয়েছে এবং জীবনে কখনও রান্নাঘরের পিছনে, ওদের ভাষায় চিলেকোঠায় (অ্যাটিকে) কিংবা খড়-রাখার ঘরে গোপনে আধ-পোড়া সিগরেটও টেনে দেখেনি। না হলে আগে-ভাগেই জানা থাকত ভসভ করে পাইপ ফোকা চাট্টিখানি কথা নয়।
দিয়েছে আবার ব্রহ্ম-টান। মাটির ছিলিম হলে ফাটার কথা।
ভিরমি যায় যায়। হৈহৈ রৈরৈ কাণ্ড। একটা ছোট ছেলে তো ভ্যাক করে কেঁদেই ফেললে। ওদিকে আমিই ওদের মধ্যে মুরুব্বি। আমাকে কিছু একটা করতে হয়। একজনকে ছুটে গিয়ে মিনরেল-ওয়াটার আনতে বললুম ও জিনিস এ অঞ্চলে পাওয়া যায় সহজেই–টাই-কলার খুলে দিয়ে শিরদাঁড়া ঘষতে লাগলুম। এসব মুষ্টিযোগে কিছু হয় কি না জানিনে– শুনেছি মৃত্যুর দু-একদিন পূর্বে রবীন্দ্রনাথের হিক্কা থামাবার জন্য ময়ূরের পালক-পোড়া না কী যেন খাওয়ানো হয়েছিল– তবে সাইকলজিক্যাল কিছু-একটা হবে নিশ্চয়ই। আমি যখন রেড-ইন্ডিয়ান তখন ওদের পাইপের পাপ কী করে ঠেকাতে হয় আমারই জানার কথা।
ফাঁড়া কেটে যাওয়ার পর দুর্ভাবনা জাগল, শোর দিনে পাইপ টানা হবে কী প্রকারে? হায়, হায়, এতসব বখেড়া পোওয়াবার পর, এমনকি জলজ্যান্ত রেড-ইন্ডিয়ান পাওয়ার পর তীরে এসে ভরাডুবি?
আমি বললুম, কুচ পরোয়া নেই। সব ঠিক হো জায়েগা। কয়েক ফোঁটা ইউকেলিপটাস তেল নিয়ে এস–অজ পাড়াগাঁ হলে কী হয়, এ যে জর্মনি।
তারই কয়েক ফোঁটা তামাকে ফেলে আগুন ধরাতেই প্রথমটায় ধপ করে জ্বলে উঠল। সেটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে ফের ধরালুম। তার পর ভভস্ করে কয়েক টান দিয়ে বললুম, এইবারে তোমরা খাও। কাশি, নাকের জল, বমি কিছুই হবে না। কেউ সাহস করে না। শেষটায় ওই মারিয়ানা, ফিয়ারলেস্ নাদিয়াই দিলে দম! সঙ্গে সঙ্গে খুশিতে মুখচোখ ভরে নিয়ে বললে, খাসা! মনে হচ্ছে ইউকেলিপটাসের ধুয়োয় নাক-গলা ভর্তি হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কেমন যেন শুকনো শুকনো।
আমি বললুম, মাদাম কুরিকে হার মানালি। ধরেছিস ঠিকই। শুকনো শুকনো ভাব বলে খুবই ভিজে সর্দি হলে ডাক্তাররা এই প্রক্রিয়ায় ইউকেলিপটাস ব্যবহার করতে বলে।
শুধালে, আর তামাকের কী হল? তার স্বাদ তো আদপেই পাচ্ছিনে।
সাক্ষাৎ মা দুগগা! দশ হাতে একসঙ্গে পাঁচ ছিলিম গাঁজা সেজে–কুলোকে বলে নিতান্ত ওই গাঁজার স্টেডি সাপ্লয়ের জন্যই শিব দশভুজাকে বিয়ে করেছিলেন–বাবার হাতে তুলে দেবার পূর্বে মা নিশ্চয়ই তার বখরার পূর্ব-প্রসাদ নিয়ে নিতেন! এ মেয়ে শিব পাবার পূর্বেই নেশাটা মকসো করে রেখেছে– বেঁচে থাকলে শিবতুল্য বর হবে।
আমি বললুম, তামাক কর্পূর- মায় নিকোটিন। সময় সময় স্পষ্ট শোনা গেল গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করে বাজল দুটো। সঙ্গে সঙ্গে এদের সকলের মুখ গেল শুকিয়ে। কী ব্যাপার? দুটোর সময় সব্বায়ের বাড়ি ফেরার হুকুম! মধ্যাহ্নভোজন।
জর্মনি কড়া আইন, ডিসিপ্লিনের দেশ। বাচ্চাদের ডিসিপ্লিন আরম্ভ হয়, জন্মের প্রথম দিন থেকেই সে-কথা আরেকদিন হবে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, বিপদে পড়েছে আমাকে নিয়ে। ছেলেমানুষ হোক আর যাই হোক, একটা লোককে হুট করে বিদায় দেয় কী করে? ওদিকে আমিও যে এগোতে পারলে বাঁচি সেটা বোঝাতে গেলে ওরা যদি কষ্ট পায়।
গোবেচারি মনে হয়েছিল বটে, কিন্তু এখন দেখলুম, যার দলপতি সাজবার কথা সে ছেলেটা অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে। শুধালে, তুমি লাঞ্চ খেয়েছ? আমার সত্য ধর্ম ছিল মিথ্যা বলার, অর্থাৎ হা, কিন্তু আমার ভিতরকার শয়তান আমাকে বিপদে ফেলার জন্য হামেহাল তৈরি। সে-ই সত্যভাষণ করে বললে, না, কিন্তু–।
কয়েকজন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে চেঁচিয়ে বললে, আমার বাড়ি চল।
মেলা হট্টগোল। আমি বললুম, অনেক ধন্যবাদ, বাছারা, কিন্তু তোমাদের বাপ-মা একটা ট্রাম্পকে
মারিয়ানা মেয়েটা একদিন জর্মনির রানি হবে যদি না কৈলাস থেকে হুলিয়া বেরোয়। বলা-নেই-কওয়া-নেই খপ করে তার ছোট্ট হাত দিয়ে আমার হাতখানা ধরে বললে, চলো আমার বাড়ি। আমাতে ঠাকুমাতে থাকি। কেউ কিছু বলবে না। ঠাকুমা আমায় বড় ভালোবাসে। তার পর ফিসফিস্ করে কানে কানে বললে– যদিও আমার বিশ্বাস সবাই শুনতে পেলে– ঠাকুরমা চোখে দেখতে পায় না।
ইস্কুল থেকে বেরিয়ে বিস্তর হ্যান্ডশেক, বিস্তর চকলেট বদলাবদলি হল। মারিয়ানা বললে, চল। আমাদের বাড়ি গ্রামের সর্বশেষে। তুমি যেদিকে চলছিলে সেই দিকেই। খামোকা উল্টো পথে যেতে হবে না।
আজ স্বীকার করছি, তখনও আমি উজবুক ছিলুম। কাকে কী জিগ্যেস করতে হয়, না হয়, জানতুম না। কিংবা হয়তো, কিছুদিন পূর্বেই কাবুলে ছিলুম বলে সেখানকার রেওয়াজের জের টানছিলুম– সেখানে অনেকক্ষণ ধরে ইনিয়ে-বিনিয়ে হরেকরকমের ব্যক্তিগত প্রশ্ন শোধানো হল ভদ্রতার প্রথম চিহ্ন। জিগ্যেস করে বসেছি, তোমার বাপ-মা?
অত্যন্ত সহজ কণ্ঠে উত্তর দিলে, বাবা? তাকে আমি কখনও দেখিনি। আমার জন্মের পূর্বেই লড়াইয়ে মারা যায়। আর মা? তাকেও দেখিনি। দেখেছি নিশ্চয়, কিন্তু কোনও স্মরণ নেই। সে গেল, আমার যখন বয়েস একমাস।
ইচ্ছে করে এরকম প্রশ্ন শুধিয়ে বিপদে পড়া আহাম্মকিই। লড়াই, লড়াই, লড়াই! হে ভগবান! তুমি সব পার, শুধু এইটে বন্ধ করতে পার না?
ভাবলুম, কোন ব্যামোতে মা মারা গেল সেইটে শুধালে হয়তো আলাপটা অন্য মোড় নেবে। শুধালাম, মা গেল কিসে?
বারো, জোর তেরো বছরের মেয়ে। কিন্তু যা উত্তর দিল তাতে আমি বুঝলুম, আহাম্মকের মতো এক প্রশ্ন শুধিয়ে বিপদ এড়াবার জন্য অন্য প্রশ্ন শুধোতে নেই। বললে, আমাদের গায়ে ডাক্তার নেই। বন্ শহরের ডাক্তার বলে, মা গেছে হার্টে। ঠাকুরমা বলে অন্য হার্টে। মা নাকি বাবাকে বড় ভালোবাসত। সবে নাকি তাদের বিয়ে হয়েছিল।
***
নির্জন পথ চিত্রিতবৎ সাড়া নেই সারা দেশে
রাজার দুয়ারে দুইটি প্রহরী ঢুলিছে নিদ্রাবেশে ॥
তার বদলে একটি সিঁড়ির উপর পাশাপাশি বসে দুটি বুড়ি তুলছে।
আর খোলা জানালা দিয়ে আসছে ক্যানারি পাখির গিটকিরিওলা হুইসেলের মিষ্টি মধুর সঙ্গীত। মারিয়ানা বললে, দুই দুই বুড়ির ওই এক সঙ্গী– পাখিটি।
.
০৭.
গ্রামের ওই একটিমাত্র সদর-রাস্তা পেরিয়ে যাওয়ার পর দু দিকের বাড়িগুলো রাস্তা থেকে বেশ একটুখানি দূরে অর্থাৎ গেট খুলে বাগান পেরিয়ে গিয়ে ঘরে উঠতে হয়।
বাগান বললুম বটে, কিন্তু সেটাকে ঠিক কী নাম দিলে পাঠকের চোখের সামনে ছবিটি ফুটে উঠবে, ভেবে পাচ্ছিনে।
ঢুকতেই কম্পাউন্ডের বাঁ দিকে একটা ডোবাতে অনেকগুলি রাজহাঁস প্যাক প্যাক করছে। টলটল স্বচ্ছ সরোবর তরতর করে রাজহাঁস মরাল-সন্তরণে ভেসে যাওয়ার শৌখিন ছবি নয়– এ নিছক ডোবা, এদিকে-ওদিকে ভাঙা, ধসে-যাওয়া পাড়, জল ঘোলা এবং কিছু কিছু শুকনো পাতা এদিক-ওদিক ভাসছে। সোজা বাঙলায়, এখানে রাজহাঁসের চাষ হচ্ছে, বাগানের নয়নাভিরাম দৃশ্য হিসেবে এটাকে তৈরি করা হয়নি।
মারিয়ানার গন্ধ পেয়েই রাজহাঁসগুলো একজোটে ডোবা ছেড়ে তার চতুর্দিকে জড়ো হল। আমি লাফ দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালুম। রাজহাঁস, ময়ূর, এরা মোটেই নিরীহ প্রাণী নয়– যে যাই বলুন। মারিয়ানাও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে শুধু বললে, বাপরে বাপ, জানোয়ারগুলোর কী খাই! এই সকালবেলা উঠেই গাদাগুচ্ছের খাইয়ে গিয়েছি, ডোবাতেও এতক্ষণ এটা-সেটা খেয়েছে, আবার দেখো, কীরকম লেগেছে। এদের পুষে যে কী লাভ, ভগবান জানেন।
ইতোমধ্যে দেখি আরেক দল মোর্গা-মুর্গি এসে জুটেছে।
ঘরে ঢোকার আগে দেখি বাড়ির পিছনে এককোণে জালের বেড়ার ভিতর গোটাতিনেক শুয়োর।
আমি অবাক হয়ে মারিয়ানাকে শুধালুম, এই সবকিছুর দেখ-ভাল, তুমিই কর? তোমার ঠাকুরমা না?
ঠোঁট বেঁকিয়ে বললে, আমি করি কোথায় করে তো কার্ল?
আমি শুধালাম, সে আবার কে? তুমি না বললে, তোমরা মাত্র দু জনা?
ইতোমধ্যে কার্ল এসে জুটেছে। মাঝারি সাইজের এলসেশিয়ান হলেও এলসেশিয়ান তো বটে– জর্মনরা বলে শেপার্ড ডগ, অর্থাৎ রাখাল-কুকুর–কাজেই একদিকে রাজহাঁস, অন্যদিকে কুকুর, এ নিয়ে বিব্রত হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু দেখলুম, কার্ল স্যানা ছেলে, আমাকে একবার শুঁকেই মনস্থির করে ফেলেছে, আমি মিত্রপক্ষ।
মারিয়ানা বললে, আমি ওদের খাওয়াই-টাওয়াই। কালই দেখা-শোনা করে। তোমার মতো ট্রাম্প কিংবা জিপসি সুযোগ পেলেই খপ করে একটা মুরগি ইস্তেক হসের গলা মটকে পকেটে পুরে হাওয়া হয়ে যাবে।
আমি বললুম, মনে রইল, এবারে সুযোগ পেলে ছাড়ব না।
ভয় পেয়ে বললে, এমন কম্মটি করতে যেয়ো না, লক্ষ্মীটি। অনেকেরই কার্লের চেয়েও বিরাট দুআঁসলা শেপার্ড ডগ রয়েছে। সেগুলো বড় বদমেজাজি হয়।
আমি অবাক হয়ে ভাবছি, এই বারো বছরের মেয়ে দু-আঁসলা, এক-আঁসলা, ক্রস ব্রিডের কী বোঝে?
মারিয়ানাই বুঝিয়ে বললে, খাঁটি আলসেশিয়ান কার্লের চেয়ে বড় সাইজের হয় না। আলসেশিয়ানকে আরও তাগড়াই করার জন্য কোনও কোনও আহাম্মুক আরও বড় কুকুরের সঙ্গে ক্রস করায়। সেগুলো সত্যিকার দু-আঁসলা, বদমেজাজি আর খায়ও কয়লার ইঞ্জিনের মতো।
এর অনেক পরে এক ডাক্তার আমায় বুঝিয়ে বলেছিলেন, গরু-ভেড়া-ছাগল-মুরগি নিয়ে গ্রামের সকলেরই কারবার বলে কাচ্চা-বাচ্চারা অল্প বয়সেই ব্রিডিং বুল, বিচির মোরগ কী বুঝে যায়। তাই শহুরেদের তুলনায় এ-বিষয়ে ওদের সুস্থ স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গি জন্মায়, এবং পরিণত বয়সে যৌন-জীবনে শহুরেদের তুলনায় এদের আচরণ অনেক বেশি স্বাভাবিক ও বেহাঙ্গামা হয়।
থাক্ সেকথা। তবে এইবেলা এ কথাটি বলে রাখি, এই গ্রামাঞ্চলে ঘোরাঘুরির ফলে মানুষের জীবনধারা সম্বন্ধে যে জ্ঞান সঞ্চয় করেছি, শহরের বহু ড্রয়িংরুম, বার-রেস্তোরাঁর পাকা জউরি হয়েও তার সিকির সিকিও হয়নি।
***
ঠাকুরমা, আমি অতিথি নিয়ে এসেছি।
আমি বললুম, গ্র্যুসগট ঠাকুরমা। আমি বিদেশি।
ঠাকুরমা সেই প্রাচীন যুগের লোক। ফ্ল্যসগট বলাটাই হয়তো এখনও তার অভ্যাস। তাই বলে বসলেন, বসো। মারিয়ানাকে বললেন, এত দেরি করলি যে। খেতে বস্! আর সানডে সেট বের কর। আর শোন, চিজ, চেরি-ব্রান্ডি ভুলিসনি।
হ্যাঁ, ঠাকুরমা, নিশ্চয়ই ঠাকুরমা–বলতে বলতে আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি চোখ টিপে হাসলে। বিশেষ করে দেরাজের উপরের থাকের চেরি-ব্র্যান্ডির বোতল দেখিয়ে। অর্থাৎ অতিথি সৎকার হচ্ছে। সচরাচর এগুলো তোলাই থাকে।
এবং এটা বোঝা গেল, নিতান্ত ঠাকুরমা, নাতনি ছাড়া আর কেউ নেই বলে রবিবার দিনও সানডে সেটের কাপ-প্লেট বের করা হয় না।
মারিয়ানা টেবিল সাজাচ্ছে। আমি ঠাকুরমাকে শুধালুম, আপনার স্বাস্থ্য কীরকম যাচ্ছে?
ঠাকুরমা উত্তর না দিয়ে বললেন, তুমি তো আমার মতো কথা বল, আমার নাতনির মতো বল না।
আমি শুধালুম, একটু বুঝিয়ে বলুন।
ঠাকুরমা বললেন, আমি হানোফারের মেয়ে। সেই ভাষাতেই কথা বলি। সে-ভাষা বড় মিষ্টি। আমি ছাড়ব কেন? আমার নাতনির বাপ-ঠাকুর্দা রাইন-ল্যান্ডের লোক। এরা সবাই রাইনিশ বলে। তুমি তো হানোফারের কথা বলছ।
মারিয়ানা বলে উঠল, ওঃ, কত না মিষ্টি। শিপৎসে, শটাইন বলতে পারে না; বলে স্পিৎসে, স্টাইন।
(অর্থাৎ শ, স-এ তফাত করতে পারে না; আমরা যেরকম সাম-বাজারের সসিবাবুর সসা খেতে খেতে সগারোন নিয়ে ঠাট্টা করি।)
ঠাকুরমা কণামাত্র বিচলিত না হয়ে বললেন, আবার তোরা তো কিশে, কির্ষেতে তফাত করতে পারিসনে।
(এ দুটো উচ্চারণের পার্থক্য বাঙলা হরফ দিয়ে বোঝানো অসম্ভব। তবে এক উচ্চারণ করলে ফলে দাঁড়ায় আমি গির্জেটা (কির্ষে) খেলুম (!) এবং তার পর চেরি ফলে (কিশে) ঢুকলুম(!) যেখানে উচ্চারণে ঠিক ঠিক পার্থক্য করলে সত্যকার বক্তব্য প্রকাশ হবে, আমি চেরিফল খেয়ে গির্জেয় ঢুকলুম।)।
আমি বাঙাল-ঘটি যে-রকম উচ্চারণ নিয়ে তর্ক করে, সে ধরনের কাজিয়ার বাড়াবাড়ি থামাবার জন্য বললুম, আমার গুরু ছিলেন হানোফারের লোক।
.
০৮.
ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী। তুমি প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করেছ। রমণীজাতির মধ্যে তুমিই ধন্য, আর ধন্য তোমার দেহজাত সন্তান যিশু। মহিমাময়ী মা মেরি, এই পাপীতাপীদের তুমি দয়া কর, আর দয়া কর যেদিন মরণের ছায়া আমাদের চতুর্দিকে ঘনিয়ে আসবে।
এই আভে মারিয়া বা মেরি-আবাহন-মন্ত্র উচ্চারণ না করে সাধারণত ক্যাথলিকরা খেতে বসে না– আর গ্রামাঞ্চলে তো কথাই নেই। অনেকটা হিন্দুদের গপুষের মতো। আর প্রটেস্টান্টরা সাধারণত হে আমাদের লোকের পিতা (পাতের নস্তের) মন্ত্র পাঠ করে। কোনও কোনও পরিবারে উপাসনাটা অতি ক্ষুদ্র :
এস হে যিশু!
আমাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করো।
আমাদের যা দিয়েছ তার উপর
তোমার আশীর্বাদ রাখো।
কমে য়েজু, জাই উনজের গাস্ট।
উন্টু জোনে ভাস ডু!
উন্ট বেশেরট হাস্ট।*
[* ১. বিলাতের কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোজনগৃহে এই মন্ত্রপাঠ করার সময় জনৈক ভারতীয় ভোজনালয় ত্যাগ করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি সেটি ফলাও করে তার ভ্রমণ কাহিনীতে বর্ণনা দেন। নাস্তিকের এই সৎসাহসের কর্মটি তিনি যদি ইনকুইজিশন যুগে করতেন তবু না হয় তার অর্থ বোঝা যেত। কিন্তু তার এই আচরণ থেকে ধরে নিতে হবে, হয় ভারতীয়রা পরধর্ম সম্বন্ধে অসহিষ্ণু, অথবা ওই লেখক ভারতীয় নন। জানি, একজন ভারতীয়ের আচরণ থেকে তাবৎ ভারতীয় সম্বন্ধে কোনও অভিমত নির্মাণ করা অযৌক্তিক কিন্তু দেশ-বিদেশে সর্বত্রই তাই করা হয়। পক্ষান্তরে খাঁটি নাস্তিক আনাতোল ফ্ৰাস যখন একবার শুনতে পান, ফরাসি সরকার যে-পুস্তকে ভগবানের নাম উল্লেখ থাকে সে-পুস্তক স্কুল-লাইব্রেরির জন্য কিনতে দেয় না, তখন তিনি ক্রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিলেন, তা হলে ফরাসি বিদ্রোহ এত রক্তপাত করে পেলুম আমরা কী সে স্বাধীনতা–যে স্বাধীনতা আস্তিককে তার ধর্মবিশ্বাস প্রচার করতে দেয় না?]
মুসলমানদের উপাসনাটিও ক্ষুদ্র : আমি সেই খুদার নামে আরম্ভ করি যিনি দয়াময়, করুণাময়।
এদের এই মন্ত্রপাঠে একটি আচার আমার বড় ভালো লাগে; পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ যে সবে আধো আধো মন্ত্রোচ্চারণ করতে শিখেছে তাকেই সর্বজ্যেষ্ঠ আদেশ দেন, উপাসনা আরম্ভ করতে।
ঠাকুরমা আদেশ করলেন, মারিয়ানা, ফ্যাঙেমাল আন– আরম্ভ কর।
প্রাগৌক্ত শুদ্ধ-বৃদ্ধ-বিবেকমণ্ডিত নাস্তিক ভ্রমণকাহিনী লেখক আমি নই। (ভ্রমণকাহিনী যদিও লিখেছি তবু তাঁর মতো খ্যাতিলাভ করতে পারিনি। তাই আমি হস্তী দ্বারা তাড্যমানের ন্যায় খৃস্টানের গৃহ ত্যাগ করলুম না।
মারিয়ানার কিন্তু তখনও খাবার সাজানো হয়নি রোববারের বাসন-কোসন বের করতে একটু সময় লেগেছে বইকি, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। সুপ স্যালাড আনতে আনতেই, সেই সদা-প্রসন্ন তরুণ মুখটিতে কণামাত্র গাম্ভীর্য না এনে সহজ সরল কণ্ঠে বলে উঠল,
ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা
করুণাময়।–
বাচ্চাদের উপাসনা আমার সবসময়েই বড় ভালো লাগে। বড়দের কথায় বিশ্বাস করে তারা সরল চিত্তে ধরে নিয়েছে ভগবান সামনেই রয়েছে। ফলে তাদের মন্ত্রোচ্চারণের সময় মনে হয় তারা যেন তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে কথা কইছে যেন ঠাকুরমার সঙ্গে কথা না বলে ভগবানের সঙ্গে কথা বলছে। আর আমরা, বয়স্করা কখনও উপরের দিকে, কখনও মাথা নিচু করে উপাসনা করি– তাঁর সঙ্গে কথা বলিনে।
গ্রামের লোক হাতি-ঘোড়া খায় না। শহুরেদের মতো আটপদী নিরতিশয় ব্যালানসড ফুড ফলে স্বভাবতই আন-ব্যালান্সড়!– খায় না বলেই শুনেছি তাদের নাকি থ্রম্বোসিস কম হয়।
সুপ।
আপনারা সায়েবি রেস্তোরাঁয় যে আড়াই ফোঁটা পোশাকি সুপ খেয়ে ন্যাপকিন দিয়ে তার দেড় ফোঁটা ঠোঁট থেকে ব্লট করেন এ সে বস্তু নয়। তার থাকে তনু, এর আছে বপু।
হেন বস্তু নেই যা এ সুপে পাবেন না।
মাংস, মজ্জাসুদ্ধ হাড়, চর্বি সেদ্ধ করা আরম্ভ হয়েছে কাল সন্ধ্যা থেকে, না আজ সকাল থেকে বলতে পারব না। তার পর তাতে এসেছে, বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রাসেল স্পাউটস্, দু-এক টুকরো আলু, এবং প্রচুর পরিমাণে মটরশুটি। মাংসের টুকরো তো আছেই- তার কিছুটা গলে গিয়ে ক্কাথ হয়ে গিয়েছে, বাকিটা অর্ধ-বিগলিতালিঙ্গনে তরকারির টুকরোগুলো জড়িয়ে ধরেছে। এবং সর্বোপরি হেথা-হোথা হাবুডুবু খাচ্ছে অতিশয় মোলায়েম চাক্তি চাক্তি ফ্রাঙ্কফুর্টার সসিজ। চর্বিঘন-মাংসবহুল-তরকারি সংবলিত= মজ্জামণ্ডিত এই সুপের পৌরুষ দার্টের সঙ্গে ফেনসি রেস্তোরাঁর নমনীয় কমনীয় কচিসংসদ ভোজ্য সুপ নামে পরিচিত তরল পদার্থের কোনও তুলনাই হয় না।
এর সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে এদেশের ভাষায় বলতে গেলে বলব, মা-মাসীদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কোনও গতিকে পিকনিকে নিয়ে যেতে পারলে তারা সাড়ে বত্রিশ উপকরণ দিয়ে যে খিচুড়ি রাধেন, ধর্মে-গোত্রে এ যেন তাই। খেয়েই যাচ্ছি, খেয়েই যাচ্ছি, শুধুমাত্র খিচুড়িই খেয়ে যাচ্ছি– শেষটায় দেখি, ওমা, বেগুন ভাজা মমলেটে হাত পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
জর্মনির জনপদবাসী ঠিক সেইরকম সচরাচর ওই একটি মাত্র সুপই খায়। তার সঙ্গে কেউ কেউ রুটি পর্যন্ত খায় না।
আজ রোববার, তাই ভিন্ন ব্যবস্থা। অতএব আছে, দ্বিতীয়ত, স্যালাড।
আবার বলছি, আপনাদের সেই ফিনসি রেস্তোরাঁর উন্নাসিক সালাদ রুস, সালাদ আলা মায়োনেজ, সালাদ ভারিয়ে-ও-পোয়াসে ও-সব মাল বেবাক ভুলে যান।
সুপে যেমন ছিল দুনিয়ার সাকুল্যে সর্বকিছু, সালাডে ঠিক তার উল্টোটি। আছে মাত্র তিনটি বস্তু : লেটিসের পাতা, টমাটোর টুকরো, প্যাজের চাক্তি ব্যস!
এগুলো মেশানো হয়েছে আরও তিনটি বস্তু দিয়ে। ভিনিগার, অলিভ ওয়েল এবং জলে-মিশিয়ে-নেওয়া শর্ষেবাটা। অবশ্য নুন আছে এবং গোলমরিচের গুড়ো থাকলে থাকতেও পারে। কিন্তু ওই যে সিরকা, তেল, শর্ষে সেই তিন বস্তুর কতটা কতখানি দিতে হবে, কতক্ষণ মাখতে হবে বেশি মাখলে স্যালাড জবুথবু হয়ে নেতিয়ে যাবে, কম মাখলে সর্বাঙ্গে সর্ব জিনিসের পরশন শিহরণ জাগবে না–সেই হল গিয়ে স্যালাডের তমসাবৃত, সৃষ্টির নিগূঢ় রহস্য।
দম্ভভরে বলছি, আমি শঙ্কর কপিল পড়েছি, কান্ট হেগেল আমার কাছে অজানা নন। অলঙ্কার নব্যন্যায় খুঁচিয়ে দেখেছি, ভয় পাইনি। উপনিষদ, সুফিতত্ত্বও আমার কাছে বিভীষিকা নয়। আমার পরীক্ষা নিয়ে সত্যেন বোসের এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, তিন বছরে তিনি আমার রিলেটিভিটি কলকাতার দুগ্ধবত্তরল করে দিতে পারবেন। পুনরপি দম্ভভরে বলছি, জ্ঞানবিজ্ঞানের হেন বস্তু নেই যার সামনে দাঁড়িয়ে হকচকিয়ে বলেছি, এ জিনিস? না এ জিনিস আমাদ্বারা কখনও হবে না। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও হবে না।
কিন্তু ভগ্নদূতের মতো নতমস্তকে বার বার স্বীকার করছি ওই স্যালাড মেশানোর বিদ্যেটা আমি আজও রপ্ত করে উঠতে পারিনি। অথচ বন্ধু মহলে– বোম্বায়ের শচীন চৌধুরী থেকে আরম্ভ করে কলকাতার ডাক্তার ঘোষ পর্যন্ত স্যালাড মেশানো ব্যাপারে আমার রীতিমতো খ্যাতি আছে। তারা যখন আমার তৈরি স্যালাড খেয়ে আ মরি আ মরি করেন, আমি তখন ঠাকুরমার সেই স্যালাডের স্মরণে জানালা দিয়ে হঠাৎ কখনও-বা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিরীক্ষণ করতে থাকি, কখনও-বা মাথা নিচু করে বসে থাকি।
বাঙলা কথায় তুলনা দিয়ে বলতে হলে শুধাই, তেলমুড়ি আপনি মাখাতে পারেন, আমো পারি, কিন্তু পারেন ঠাকুরমার মতো? ধনে পাতার চাটনিতে কীই-বা এমন কেরানি! কিন্তু পারেন পদি পিসি পারা পিষতে?
***
গুটন আপেটিট– গুড এপিটাইট।
এর ঠিক বাঙলা নেই। উপাসনার পর একে অন্যের দিকে তাকিয়ে সবাই বলে, আশা করি তোমার যেন বেশ ক্ষুধার উদ্রেক হয়, আর তুমি তৃপ্তির সঙ্গে খেতে পারো। ইংরেজির মতো জমনেও হাঙার (হুঙার) ও এপিটাইট (আপেটিট) দুটো শব্দ আছে। এপিটাইটের ঠিক বাঙলা প্রতিশব্দ নেই। খাওয়ার রুচি, বাসনা অনেক কিছু দিয়ে মোটামুটি বোঝানো চলে কিন্তু ঠিক অর্ধটি বেরোয় না। যেমন ইংরেজিতে বলা চলে আই এম হাঙরি বাট হ্যাভ নো এপিটাইট–আমার ক্ষুধা আছে কিন্তু খাবার প্রবৃত্তি নেই, কিংবা মুখে রুচছে না। আবার পেটুক ছেলে যখন খাই খাই করে তখন অনেকেই বলে, দি বয় হ্যাঁজ এপিটাইট বাট হি ইজ নট হাঙরি এট অল। এস্থলে এপিটাইট তা হলে দাঁড়ায় চোখের ক্ষিধে। আমার অবশ্য, দুই-ই ছিল।
আইনানুযায়ী আমার মাঝখানে বসার কথা, কিন্তু আমি একরকম জোর করে মারিয়ানাকে মাঝখানে বসিয়ে দিলুম। ঠাকুরমার কখন কী দরকার হয় আমি তো জানিনে। মারিয়ানা কাছে থাকলে ওঁকে সাহায্য করতে পারবে।
বিরাট গোল এক চামচ দিয়ে সুপের বড় বোল থেকে আমার গভীর সুপ-প্লেটে মারিয়ানা চালান করতে লাগল লিটার লিটার সুপ। আমি যতই বাধা দিই, কোনও কথা শোনে না। শুধু মাঝে মাঝে পাকা গিন্নির মতো বলে, মান্ জল অর্ডন লিস্ এসে ভালো করে খেতে হয়, ভালো করে খেতে হয়।
ঠাকুরমা দেখি তখনও কী যেন বিড়বিড় করছেন। হয়তো নিত্য মন্ত্রের ওপর তার কোনও ইস্টমন্ত্র আছে, সেইটেই জপ করছেন।
আমার মা বলত, আমাকে দেখলে যতটা বোকা বলে মনে হয়, আমি ততটা বোকা নই; আর বড়দা বলত, আমাকে দেখলে যতটা বুদ্ধিমান বলে মনে হয়, আমি ততটা বুদ্ধিমান নই। কোনটা ঠিক জানিনে, তবে আমার স্মৃতিশক্তিটি ভালো সে-কথাটা উভয়েই স্বীকার করতেন। আমার মনে পড়ে গেল, আমার শহুরে বন্ধু পাউল একবার আমাকে উপাসনার অত্যাচারের কথা শুনিয়েছিল। সমস্ত দিন খেটে খিদেয় হন্যে হয়ে চাষারা তাকিয়ে আছে সুপপ্লেটের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে তার উপর আর পাদ্রিসায়েব, তিনি সমস্ত দিন প্রভুকে স্মরণ করছেন বলে তাঁর হাঙার এপিটাইট কিছুই নেই– পাদ্রিসায়েবের উপাসনার আর অন্ত নেই।
আমি অনুমান করলুম, আমি বিদেশি বলে হয়তো মারিয়ানা মন্ত্রোচ্চারণে কিছু কিছু কাট-ছাঁট করেছে। ফিসফিস করে সে-কথা শোধাতে তার সর্বমুখ শুধু নয়, যেন ব্লন্ড চুলের গোড়াগুলো পর্যন্ত লাল হয়ে গেল। অপরাধ স্বীকার করে বললে, খাওয়ার পরের উপাসনা পুরোপুরি করে দেবে।
ঠাকুরমার প্লেটে মারিয়ানা সুপ ঢেলেছিল অল্পই। তিনি প্রথম চামচ মুখে দেওয়ার পর আমরাও খেতে আরম্ভ করলুম। সঙ্গে সঙ্গে মারিয়ানা আমার দিকে তাকিয়ে শুধোলে, শে এস? অর্থাৎ খেতে ভালো লাগছে তো? এটা হল এদেশের দু-নম্বরের টেবিল এটিকেট। আমি বললুম, ধন্যবাদ! অপূর্ব! রাজসিক! জর্মনে কথাটা হারলিষ–তার বাঙলা রাজকীয় রাজসিক।
আমি বললুম, ঠাকুরমা, আপনাদের এই রবিবারের সেটটি ভারি চমঙ্কার।
ঠাকুমা বললেন, এ বাড়িতে কিন্তু মোটেই খাপ খায় না। তা কী করব বল। আমার মামা কাজ করতেন এক পর্সেলিন কারখানায়। তিনি আমাকে এটা দেন। সে কতকালের কথা– এস ইস সো লাঙে হের।
মারিয়ানা বললে, চেপে যেও না, ঠাকুমা! তোমার বিয়ের সময় উপহার পেয়েছিলে সেটা বললে কোনও অপরাধ হবে না। ফের এস্ ইস সো লাঙে হের বলে আরম্ভ কর না।
আমি শুধালম, এস ইসট সো লাঙে হের– সে আবার কী?
উৎসাহের সঙ্গে মারিয়ানা বললে, বুঝিয়ে বলছি, শোনো। ঠাকুমা যখনই আমাকে ধমক দিতে চায়, তখন হঠাৎ তার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর হয়ে ওঠে। তোর বাপ এ-পরবের সময় এরকম ধারা করত না, তুই কেন করছিস? তোর মা তার সাংবৎসরিক পরবের দিনে (নামেন্টাখ) ভোরবেলা চার্চে গিয়েছিল, আর তুই নটা অবধি ভভস্ করে নাক ডাকালি। কে কবে হেসেছিল, কে কবে কেশেছিল টায়-টায় মনে গাঁথা আছে। আবার দেখো শীতকালে যখন দিনভর রাতভর দিনের পর দিন বরফ পড়ে, বাড়ি থেকে বেরুনো যায় না, তখন যদি সময় কাটাবার জন্য ঠাকুরমাকে জিগ্যেস করি, হ্যাঁ, ঠাকুমা, বল তো ভাই, লক্ষ্মীটি, ঠাকুরদা কীভাবে তোমার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পেড়েছিল। এক হাঁটু গেড়ে আরেক হাঁটু মুড়ে, ফুলের তোড়া বাঁ হাতে নিয়ে এগিয়ে দিয়ে, ডান হাত বুকের উপর চেপে নিয়ে–
আমি বাধা দিয়ে বললুম, অবাক করলি! তুই এসব শিখলি কোথায়? তোর কাছে কেউ বিয়ের প্রস্তাব পেড়েছিল নাকি?
এইবারে ঠাকুমার ঠোঁট খুললেন। বললেন, বেশ হয়েছে।
মারিয়ানা মুখ আবার লাল করে বললে, দ্যৎ! সিনেমাতে দেখেছি। উইলহেলম বুশের আঁকা ছবিতে দেখেছি।*[*জর্মনদের সুকুমার রায়। ওরই মতো নিজের কবিতার ছবি নিজেই আঁকতেন। তবে সুকুমারের মতো প্যোর ননসেন্স লেখেননি। ওঁর বেশিরভাগই ইলাসট্রেটেড গল্প।] তা সে যাকগে, আমার কথা শোনো। ওইসব বিয়ের প্রস্তাব, বিয়ের পর পয়লা ঝগড়া, ঠাকুরদা যখন লড়াইয়ে চলে গেল তখনকার কথা, এসব কথা জিগ্যেস করলে হঠাৎ ঠাকুরমার স্মৃতিশক্তি একদম লোপ পায়। আমাদের ওই কার্ল কুকুরটা যেরকম পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে ডুকরে ডুকরে আতাঁরব ছাড়ে ঠিক সেই গলায় ককিয়ে ককিয়ে বলে– সেই এক কথা–এস ইস্ট সো লাঙে হের, সে কত প্রাচীন দিনের কথা, সেসব কি আর আমার মনে আছে। ধমকের বেলা সব মনে থাকে তখন আর লাঙে হের, লাঙে হের নয়।
আমি বললুম, আলবাৎ, আলবাৎ।
তার থেকে অবশ্য বোঝা গেল না আমি কোন পক্ষ নিলুম। পরে বিপদে পড়লে যেদিকে খুশি ঘুরিয়ে নেব। অবশ্য আমি কালো, কৃষ্ণপক্ষ অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের পক্ষেই থাকার চেষ্টা করি।
ইতোমধ্যে আমি মারিয়ানার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছি।
ঘরের উত্তর-পূর্ব কোণে দুই দেয়ালের সঙ্গে মিলে সিক– জর্মনে বলে শপ্যুলস্টাইন।
দেয়ালে গাঁথা ওয়াশস্টেন্ডের মতো, ছোট্ট চৌবাচ্চা-পানা দেয়ালে গাঁথা বলে যেন হাওয়ায় দুলছে– মাটি পর্যন্ত নেবে আসেনি। সেখানে ট্যাপে বাসন-কোসন মাজা হয়, মাছ-মাংস ধোয়া হয়। তাই রান্নাঘরে, কিংবা দাওয়ায় (অবশ্য এই শীতের দেশে দাওয়া জিনিসটাই নেই) ঘড়া ঘড়া জল রাখতে হয় না। খাওয়া-দাওয়ার পর তাবৎ বাসন-বর্তন, হাঁড়ি-কুড়ি ওইটেতে রেখে সেটাকে জলভর্তি করা হয়। তারই উপরে বাঁ দিকের দেয়ালে কয়েকটা হুকে ঝুলছে কুঁদুলের জালের পরিবর্তে ওয়েস্ট কটন, অতি সূক্ষ্ম তারের জালের স্পঞ্জ, খান দুই ঋড়ন। আর তার নিচে দেয়ালে গাঁথা শেলফের উপর ভিমজাতীয় (ওদের বোধ হয় পের্জিল) খুঁড়োর চোঙা, সাবান, আর দু-একটা টুকিটাকি যেগুলো আমি চিনিনে। আমি তো আর জর্মন রান্নাঘরে ছেলেবেলা কাটাইনি। ডান দিকের দেয়ালে গাঁথা, কিংবা ঝোলানো একটা বেশ বড় খোলা শেলফ। সিকে হয়তো দু-চার কালি গরম জলও ঢেলে দেওয়া হয়েছে– রান্না শেষ হওয়ার পর যেটুকু আগুন বেঁচে থাকে, সেটা যাতে করে খামকা নষ্ট না হয়, তাই তখন তার উপর কালি চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই গরম জলে বাসন কোসনের চর্বি গলাবার জন্যে সিকে ঢেলে দেওয়া হয়, আর ইতোমধ্যে কেউ কফি বা চা খেতে চাইলে তো কথাই নেই। সিনকের সামনে দেয়ালমুখো হয়ে দাঁড়িয়ে উপর থেকে ভিন্, স্পঞ্জ পেড়ে নিয়ে এক-একটা করে হাঁড়ি মাজবে, ঝাড়ন দিয়ে সেটা শুকোবে, তার পর ডান দিকের শেলফে রাখবে। ভালো হয় যদি একজন মাজে আর অন্য জন ঝাড়ন দিয়ে পৌঁছে।
সিকের ডান দিকে পুবের দেয়ালের সঙ্গে গা-ঘেঁষে একটি প্রমাণ সাইজের মোক্ষম টেবিল। উপরের তক্তাখানা অন্তত দু-ইঞ্চি পুরু হবে। এর উপরেই মাছমাংস-তরকারি কাটাকুটি হয়। তাই তার সর্ব-পৃষ্ঠে ক্রি-ক্রসূ ছোট-বড় সবরকম কাটার দাগ। পোয়া ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা বেরুবে না যেখানে কোনও দাগ নেই। টেবিলের একপাশে মাংস কোতা করার জন্য একটা কল লাগানো আছে। টেবিলের সামনে একটি টুল কিন্তু জর্মন মেয়েরা দাঁড়িয়েই রান্নার কাজ করতে ভালোবাসে।
সিনকের বাঁ দিকে উত্তরের দেয়ালের সঙ্গে গা ঘেঁষে হার্থ, উনুন, যা খুশি বলতে পারেন। প্রায় টেবিল সাইজের একটা লোহার বাক্স। উপরে চারটে উনুনের মুখ। নিচের দরজা খুলে কয়লা পোরা হয়। ভাঙা টুকরো টুকরো পাথুরে কয়লা ছাড়া এরা ব্যবহার করে ব্রিকেট। কয়লা গুঁড়ো করে ইটের (ব্রি) সাইজে বানানো হয় বলে এগুলোর নাম ব্রিকেট। হাত ময়লা না করে সাঁড়াশি দিয়ে তোলা যায়, আগুনও ধরে খুব তাড়াতাড়ি আর ধুয়োও দেয় অত্যল্প। উনুনের পাশে একটা বালতিতে কয়লা, অন্য বালতিতে চিমটেসুদ্ধ একগাদা ব্রিকেট। উনুন থেকে ধুয়ে নিকাশের চোঙা বেরিয়ে যেখানে দেয়ালে গিয়ে ঢুকেছে তারই ডান পাশের দেয়ালে গাঁথা আরেকটা শেলফ। তাতে বড় বড় জার। কোনওটাতে লেখা মেল– ময়দা, কোনওটাতে ৎসুকার–চিঠি, কোনওটাতে জাৎস্নু ন। তামচিনির (স্টোন-ওয়েয়ার) জারগুলো পোড়াবার আগেই কথাগুলো লেখা হয়েছিল বলে কখনও মুছে যাবে না। তার পর বোতল বোতল তেল, সিরকা ইত্যাদি তরল পদার্থ। সর্বশেষে মার্শরিন, মাখন আরও কী সব।
ঘরের মাঝখানে খাবার টেবিল।
ঘরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে– অর্থাৎ সিকের তির্যক কোণে একখানা পুরনো নিচু আর্ম-চেয়ার। দক্ষিণ থেকে ঘরে ঢুকতেই বাঁ-দিকে পড়ে। এ-চেয়ারে ঠাকুরমা বসে বসে ঢেলেন। সামনের ছোট ফুটল বা পাদপীঠের উপর পা রেখে।
এদের ড্রইং-রুম-ক-ডাইনিং রুম আছে। কিন্তু তার ব্যবহার বড় একটা হয় না। সেটা যেন বড় পোশাকি। বসে সুখ পাওয়া যায় না, কথাবার্তা কেমন যেন জমে না। বন্ধ ঘরের কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ।
আর এ-ঘরে কেমন যেন একটা হৃদ্যতা, খোলাখুলি ভাব। কেউ যেন কারও পর নয়।
.
০৯.
কুকু-কুকু, কুকু-কুকু, কুকু-কুকু!
এ কী?
এত যে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রান্নাঘরের বর্ণনা দিলুম, ঘড়িটা গিয়েছি বিলকুল ভুলে। লক্ষই করিনি। পর্যবেক্ষণ শক্তি আমার বিলক্ষণ অক্ষম বলে ছেলেবেলায়ই আমার গুরুমশাই আমাকে রান্ধ, দিবান্ধ ইত্যাদি উত্তম উত্তম খেতাবে বিভূষিত করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, আমাদ্বারা আর যা হোক সাহিত্যিক হওয়া হবে না। আমার দোষের মধ্যে লাটসায়েবের কুকুরের যে একটা ঠ্যাঙ নেই, সেটা আমি লক্ষ করিনি! এবার সেটা পুনরায় সপ্রমাণ হল। অবশ্য আমার একমাত্র সান্ত্বনা, মারিয়ানা আমার চেয়ে একমাথা খাটো বলে দেয়াল ঘড়িটা ঠিক আই-লেভেলে ঝোলানো হয়নি।
এসব ঘড়ি সস্তা হলেও এ দেশে বড় একটা আসে না। ছোট্ট একটি বাক্সের উপর ডায়েল লাগানো কিন্তু কাঁচের আবরণ নেই। বাক্সের উপর ছোট্ট একটি কুটিরের মডেল– ব্ল্যাক ফরেস্ট (ওয়ার্স ভাল্ট-কালো বন) অঞ্চল যেরকম সচরাচর হয়ে থাকে, এবং কুটিরটি দেখা যাচ্ছে যেন তার পাশ থেকে, কারণ কোনও দরজা সেখানে নেই, আছে একটি হলদে রঙের জানালা-কুটিরটি সবুজ রঙের। প্রতি ঘন্টায় ফটাস করে জানালার দুটি পাট খুলে যায় আর ভিতর থেকে লাফ দিয়ে তার চৌকাঠে বসে একটি ছোট্ট পাখি মাথা দোলাতে দোলাতে কু-কু করে জানিয়ে দেয় কটা বেজেছে। তার পর সে ভিতরে ডুব মারে আর সঙ্গে সঙ্গে জানালার দুটি পাট কটা করে বন্ধ হয়ে যায়।
ব্ল্যাক ফরেস্টের কুটিরশিল্প। এ দেশে রপ্তানি হতে শুনিনি। হলেও বেকার হবে। এতটুকু কাঁচের আবরণ যে ঘড়ির কোথাও নেই সে ঘড়ি এই ধুলো-বালির দেশে দু দিনেই ধূলিশয্যা গ্রহণ করবে।
আমি চমকে উঠে বললুম, সর্বনাশ! তিনটে বেজে গেছে। আমাকে যে এগুতে হবে।
আমাদের তখন সবেমাত্র সুপ পর্ব সমাধান হয়েছে। ঠাকুরমা সুপ শেষ করে চুপচাপ বসে আছেন।
মারিয়ানা বললে, এগুতে হবে মানে? খাবার শেষ করে তো যাবে! আজ যে রোববারের লাঞ্চ–তার ওপর রয়েছে রে রাও।
রাগু কথাটা ফরাসি। অর্থাৎ কোফতা-কাটা মাংস। আর রে মানে হরিণ।
তার সঙ্গে টুকরো টুকরো করে কাটা থাকে ব্যাঙের ছাতা (এদেশে মেদিনীপুর বাঁকুড়ার লোক এর তত্ত্ব কিছু কিছু জানে, কাশ্মিরিরা ভালো করেই জানে এবং টিনে করে রপ্তানি আরম্ভ হয়ে গিয়েছে), প্যাজ আর ট্রাফল অবশ্য যদি এই শেষোক্ত বস্তুটি পাওয়া যায়। রীতিমতো রাজভোগ!
আমি শুধালুম, হরিণের মাংস পেলে কোথায়?
বললে, দাঁড়াও, রাগুটা নিয়ে আসি।
আমার আর মারিয়ানার সুপ প্লেটের নিচে আগের থেকেই মারিয়ানা প্রধান খাদ্যের প্লেট সাজিয়ে রেখেছিল। এখন শুধু সুপ প্লেটই উপর থেকে সরাতে হল। শুনেছি রাতে চার পদের লাঞ্চ ডিনার হলে এরকম ধারা চারখানা প্লেট একটার উপর আরেকটা সাজানো হয়। যেমন এক এক পদ খাওয়া শেষ হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে সেই প্লেট সরানো হয় প্রতিবারে নতুন করে পরের পদের জন্যে প্লেট সাজাতে হয় না–একথা আমি শুনেছি, কারণ একাধিক রাশানের বাড়িতে আমি খেয়েছি বলশি এবং জারিস্ট দুই সম্প্রদায়েরই, কিন্তু এ-ব্যবস্থা দেখিনি। একখানা প্লেটের উপর সুপ প্লেট রাখলে উচ্চতার বিশেষ কিছু হেরফের হয় না, কিন্তু চারখানা প্লেটের উপর সুপ প্লেট রাখলে সে তো নাকের ডগায় পৌঁছে যাবে।
আভন খুলে মারিয়ানা রে রাণ্ড নিয়ে এল।
আমি ঠাকুরমার দিকে তাকিয়ে মারিয়ানাকে চোখের ইশারা করলুম।
মারিয়ানা বললে, ঠাকুরমা এক সুপ ভিন্ন অন্য কিছু খায় না। আমিও না। কিন্তু ওই জিগ্যেস করলে হরিণের মাংস কোথায় পেলুম? আমাদের গ্রাম থেকে বেরুলে দূরে দক্ষিণে দেখতে পাবে আরেকটা গ্রাম– তার নাম মুফেন-ড। তার পর পুরো একটা ক্ষেত পেরিয়ে রুঙ-ড। তার শেষে নামকরা হোটেল ড্রেজেন রাইনের পাড়ে। সেখানে কিন্তু ওপারে যাবার খেয়া নেই। তাই কিছুটা দক্ষিণে গিয়ে মেলে খেয়াঘাট। ওপারে ক্যোনিগ্সভিন্টার। সেটা সিবেন-গেবির্গের (সপ্তকুলাচলের) অংশ। তার আরও অনেক দক্ষিণে গিয়ে লরেলাই। ওই যে তোমার পকেটে রয়েছে হাইনের কবিতার বই তাতে আছে লরেলাই সম্বন্ধে কবিতা।*[* অধুনা প্রকাশিত হাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা (দীপায়ন প্রকাশনা। দেশ ১৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৬৮ সংখ্যা, পৃ. ৪১৮ দ্র.) পুস্তিকার ৮৬ ও ৮৭ পৃ. পশ্য।]
মারিয়ানা ইস্কুলমাস্টারের মতো আমাকে বেশকিছু ভূগোল জ্ঞান দান করে বললে, হা, হরিণের মাংসের কথা হচ্ছিল। ওই যে মুফেন ডর্ফ (ড= গ্রাম) সেটা এমনি অজ যে আমরা ওটাকে ডাকি মুফ্রিকা আফ্রিকার মতো সভ্যতা থেকে অনেক দূরে আছে বলে আফ্রিকার ফ্রিকাটি জুড়ে নিয়ে। আর আফ্রিকাবাসীকে যেমন জর্ষনে বলা হয় আফ্রিকানার ঠিক তেমনি ওদের আমরা ডাকি মুফ্রিকানার।
আমি হেসে বললুম, তোমাদের রসবোধ আছে।
মারিয়ানা বললে, ওই মুফ্রিকার কাকা হাস্ বাবার বন্ধু। আসলে অবশ্য বাবার বন্ধু বলেই ওঁকে ডাকি অঙ্কল হান্স। দু জনাতে প্রতি শনিবারে শিকারে যেত ৷ যতদিন বাবা বেঁচে ছিল। এখন একা যায়। যেদিন ভালো শিকার জোটে সেদিন মাংসের খানিকটে আমায় দিয়ে যায়। ব্যাঙের ছাতা আমি নিজে বন থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসি আর পঁাজ তো ঘরে আছেই।
আমি বললুম, মারিয়ানা, লক্ষ্মী মেয়ে, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ঠাকুরমার সুপপ্লেট সরানোর পর তিনি হাত দুটি একজোড় করে অতি শান্তভাবে আমাদের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে অল্প মৃদু হাস্য করলে গাল দুটি টুকটুকে লাল হয়ে যাচ্ছিল। যেন সর্ব শরীরের রক্ত ছুটে লাল গাল দুটিতে আশ্রয় নিচ্ছিল–হ্যায়, বুড়িদের গায়ে কফোঁটা রক্তই থাকে!
এবার তিনি মুখ খুলে বললেন, মারিয়ানা না বলল তুমি পায়ে হেঁটে হাইকিঙে বেরিয়েছ, তবে তোমার তাড়া কিসের? এ গ্রাম যা, সামনের গ্রামও তা। গ্রামে গ্রামে তফাত কোথায়? শহরে শহরে থাকে। কারণ ভগবান বানিয়েছে গ্রাম, আর মানুষ বানিয়েছে শহর।
এক লম্ফে চেয়ার ছেড়ে মারিয়ানা ঠাকুরমার কাছে গিয়ে দু হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে গালে ঝপাঝপ গণ্ডা তিনেক চুমো খেলে। আর সঙ্গে সঙ্গে ও! তুমি কী লক্ষ্মীটি ঠাকুরমা। তোমার মতো মেয়ে হয় না ঠাকুরমা। আমার কথা শুনতে যাবে কেন ওই ভবঘুরেটা। দেখা হয়েছে অবধি শুধু পালাই পালাই করছে।
ঠাকুরমা ব্যতিব্যস্ত না হয়ে বললেন, হয়েছে, হয়েছে। তুই খাওয়া শেষ কর।
রে রাগুর সঙ্গে নোনা জলে সেদ্ধ আলু আর জাওয়ার ক্রাউট।
ঠাকুরমা ব্যতিব্যস্ত না হয়ে বললেন, ক্রাউট খেতে ভালোবাসো? আমি তো শুনেছি, বিদেশিরা ও জিনিসটা বড় একটা পছন্দ করে না।
আমি বললুম, জিনিসটা যে বাঁধাকপির টক আচার। সত্যি বলতে কী, প্রথম দিন আমার ভালো লাগেনি। এখন সপ্তাহে নিদেন তিন দিন আমার চাই-ই চাই। জানেন, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী পিয়েল লাভাল যখন একবার বার্লিনে আসেন তখন তাঁর দেশবাসী কে যেন তাঁকে বলেছিল জর্মনদের মতো জাওয়ার ক্রাউট কেউ বানাতে পারে না। সেকথা তাঁর মনে পড়ল যেদিন ভোরে তিনি চলে যাবেন তার আগের রাত্রে আড়াইটার সময়। রেস্তোরাঁ তখন বন্ধ; হলে কী হয় ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী, তিনি খাবেন জাওয়ার ক্রাউট– যোগাড় করতেই হয়।
সেই রাত সাড়ে চৌদ্দটার সময় ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী সোল্লাসে খেলেন জাওয়ার ক্রাউট।
আমি যে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা পছন্দ করি না তার প্রধান কারণ ওই খাদ্যটি সম্বন্ধে তিনি অচেতন।
***
জাওয়ার ক্রাউট নিয়ে বড্ড বেশি বাগাড়ম্বর করার বাসনা নেই। আমাদের কাসুন্দোর মতো ওতে বড় বায়নাক্কার খুটিনাটি। তার কারণ সমস্যা দুজনারই এক। তেল, নুন, সিরকা, চিনি এসব কোনও সংরক্ষণকারী বস্তু অর্থাৎ প্রিজারভেটিভ ব্যবহার না করে কিংবা যতদূর সম্ভব অল্প ব্যবহার করে কী প্রকারে খাদ্যবস্তু বহুকাল ধরে আহারোপযোগী করে রাখা যায়, কান্দো ও জাওয়ার ক্রাউটের এই নিয়ে একই শিরঃপীড়া। সেই কারণেই বোধহয় কাসুন্দো বানাবার আস্য পুব বাঙালার বেশি পরিবারে নেই। মুসলমানরা আদপেই কাসুন্দা বানাতে পারে না বলে কাসুন্দো বানাবার সময় অক্ষয় তৃতীয়ায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি বড় বেড়ে যায়। বানাবার আস্য না থাকলেও সহাস্য বদনে খাবার আস সকলেরই আছে।
পশ্চিমের ওপর খুদাতালার মেহেরবানিও অত্যধিক। ওদের তরি-তরকারি ফলমূল বেবাক তৈরি হয়ে ওঠে গ্রীষ্মের শেষে। তার পরেই শীত এসে খাদ্যবস্তু সংরক্ষণে সাহায্য করে। আমাদের উত্তম উত্তম তরি-তরকারি তৈরি হয় শীতের শেষে তার পরই আসে গ্রীষ্মকাল–সংরক্ষণকর্মে প্রকৃতির কোনওই সহায়তা পাইনে। ফল পাকে গ্রীষ্মকালে তার পরই এসে যায় ভ্যাপসা বর্ষা–মসনে-ছাতি পড়ে সব-কুছ বরবাদ। পচা বর্ষার শেষের দিকে দুই নয়া পয়সার রোদ্দুর ওঠা মাত্রই গিন্নিমারা আচারের বোয়াম নিয়ে টাটু ঘোড়ার বেগে বেরোন ঘর থেকে। ফের পইন্ট জিরো ইলিশ গুঁড়ি নাবামাত্র তারা ঐয গেল গেল, ধর ধর বলে বেরোন রকেট-পারা। আর বাইবেলি ভাষায় ধন্য যাহারা সরল হৃদয়–অর্থাৎ ভোলা-মন, তাদের তো সর্বনাশ।
জানি, তেলে টইটম্বুর করে রাখলে মনে পড়ে না, কিন্তু বড় বেশি তেল চিটচিটে আচার খেয়ে সুখ নেই। তদুপরি ভেজাল তেলের ঠেলায় এ গ্রীষ্মে মোক্ষম মার খেয়ে আমি আচারের মাথায় ঘোল ঢেলে দিয়ে বিদায় দিয়েছি। এখন রইলেন শুধু জারক নেবু, আর বাজারের ওঁচা আচার!
আমি বললুম, মারিয়ানা, ঠাকুমার সেই লাঙে হের পুরনো দিনের গল্প বল না।
অপরাহ্নের ট্যারচা সোনালি রোদ এসে পড়েছে ঠাকুরমার নীল সাদা সেটের উপর আর মারিয়ানার ব্লড চুলের উপর। চেরি ব্র্যান্ডির বেগুনি রঙের সঙ্গে সে আলো মিশে গিয়ে ধরেছে এক অদ্ভুত নতুন রঙ। ডাবরের সুপের ফোঁটা ফোঁটা চর্বির উপর আলো যেন স্থান না পেয়ে ঠিকরে পড়ছে। সে রোদে ঠাকুরমার বরফের মতো সাদা চুল যেন সোনালি হয়ে উঠল। তার পিঠের কালো জামার উপর সে আলো যেন আদর করে হাত বুলোচ্ছে। জানালার পরদা যেমন যেমন হাওয়ায় দুলছে সঙ্গে সঙ্গে আলোর নাচ আরম্ভ হয় ঝকঝকে বাসন-কোসনের উপর, গেলাসের তরল দ্রব্যের উপর আর ঠাকুরমা-নাতনির চুলের উপর।
অনেককাল পর গ্রামাঞ্চলে এসেছি বলে খেতে খেতে শুনছি, রকম-বেরকম পাখির মধুর কূজন। এদের সময় ঘনিয়ে এসেছে। এরা আর বেশিদিন এখানে থাকবে না। শীত এলে দক্ষিণের দিকে পাড়ি দেবে। তখন গ্রাম-শহরের তফাত ঘুচে যাবে।
আসবার সময় এক সারি পপলার গাছের নিচু দিয়ে ছায়ায় ছায়ায় বাড়ি পৌঁছেছিলুম। রবিবারের অপরাহু বলে এখনও সমস্ত গ্রাম সুষুপ্ত– শুধু ওই চিনারের মগডালের ভিতর দিয়ে বাতাস চলার সামান্য গুঞ্জরণ ধ্বনি কানে আসছে, কিংবা কি এদেরই ডোবার পাড়ে যে নুয়ে পড়া উইপিং উইলো দেখেছি তারই ভেতর দিয়ে বাতাস ঘুরেফিরে বেরুবার পথ পাচ্ছে না? এ গাছের জলের উপর লুটিয়ে পড়া, মাথার সমস্ত চুল এলোমেলা করে দিয়ে সদ্য-বিধবার মতো গুমরে গুমরে যেন কান্নার ক্ষীণ রব ছাড়া– এগুলো আমার মনকে বড় বেদনায় ভরে দেয়। দেশের শিউলি ফুলের কথা মনে পড়ে। তার নামও কেউ কেউ ইংরেজিতে দিয়েছে সরো ফ্লাওয়ার বিষাদ-কুসুম।
ঠাকুরমা ঢুলতে ঢুলতে হঠাৎ জেগে উঠলেন। জানিনে, বোধহয় লাঙে হেরের ফাড়াকাটাবার জন্য মারিয়াকে শুধোলেন, কাল হের হানসের সঙ্গে কী কথাবার্তা হল?
মারিয়ানা আমার দিকে তাকিয়ে দুষ্ট হাসি হেসে বললে, দেখলে? তা সে যাক্। কিন্তু জানো, হাস্ কাকা বড় মজার লোক। যতসব অদ্ভুত অদ্ভুত গল্প বলে– কোনটা যে সত্যি, কোনটা যে তার বানানো কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই। কাল বলছিল, একবার হান্স কাকা আর বাবা নাকি লড়াইয়ের ছুটি পেয়ে দু জনা শিকারে গেছে তখন লড়াইয়ের সময় বলে বন্দুকের লাইসেন্স নিয়ে বড় কড়াকড়ি। হঠাৎ একটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়েছে। পুলিশ, দেখতে চেয়েছে লাইসেন্স। পুলিশকে যেই না দেখা অমনি হাস্ কাকা বাবাকে ফেলে দিয়ে চো চো ছুট। পুলিশও ধরবে বলে ছুটেছে পিছনে। ওদিকে হা কাকা মোটা-সোটা গালা-গোলা মানুষ। আধ মাইল যেতে না যেতেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলেছে। কাকা বললে, পুলিশ নাকি হুঙ্কার দিয়ে লাইসেন্স চাইলে। কাকাও নাকি ভালো মানুষের মতো গোবেচারি মুখ করে পকেট থেকে লাইসেন্স বের করে দেখালে।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, লাইসেন্স ছিল তবে ওরকম পাগলের মতো ছুটল কেন? মারিয়ানা বললে, আহ্ শোননই না। তোমার কিছুতেই সবুর সয় না। পুলিশও তোমার মতো বেকুব বনে ওই প্রশ্নই শুধালে। তখন হাস্ কাকা নাকি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়ে বললে, আমার লাইসেন্স আছে, কিন্তু আমার বন্ধুর নেই। সে এতক্ষণে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। পুলিশ নাকি প্রায় তাকে মারতে তাড়া করেছিল।
আমি হাসতে হাসতে বললুম, খাসা গল্প। পুলিশের তখনকার মুখের ভাবটা দেখবার আমার বড় ইচ্ছে হচ্ছে। জানো আমাকেও একবার পুলিশ তাড়া করেছিল। ওরে বাপ রে বাপ! সে কী ছুট, কী ছুট, কিন্তু ধরতে পারেনি।
মারিয়ানার কচি মুখ ভয়ে শুকিয়ে গিয়েছে। হোঁচট খেতে খেতে শুধোলে, কেন, কী হয়েছিল?
আমি বললুম, কী আর হবে, যা আকছারই হয়ে থাকে। পুলিশে স্টুডেন্টে পাল্লা।
মারিয়ানা নির্বাক ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি শুধালাম, কী হল? আমার মাথার পিছনে ভূত এসে দাঁড়িয়েছে নাকি?
তোতলাতে তোতলাতে শুধোলে, তুমি য়ুনিভার্সিটির স্টুডেন্ট!
আমার তখনও জানা ছিল না, এ দেশের গ্রামাঞ্চলের লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় একটা যায় না, কাজেই এখানে তাদের বড় সম্মান, রীতিমতো সমীহ করে চলা হয়। তাই আমি আমার সফরের শেষের দিকে কথাটা বেবাক চেপে যেতুম। আমি ট্রাম্প, ট্রাম্পই সই। কী হবে ভদ্রলোক সেজে।
মারিয়ানা বললে, তাই বল। আমি ভাবছি, ট্রাম্পই যদি হবে তবে নখের ভিতর দু ইঞ্চি ময়লা নেই কেন? ট্রাম্পই যদি হবে তবে গোগ্রাসে গিলছে না কেন? খেতে খেতে অন্তত বার তিনেক ছুরিটা মুখে পুরলে না কেন?
আমি অপরাধ স্বীকার করে নিয়ে বললুম, ভুলগুলো মেরামত করে নেব।
ধ্যৎ! ওগুলো নোংরামি। শিখতে হয় নাকি?
আমি বললুম, কোথায় স্টুডেন্ট বলে পরিচয় দিলে লাভ, আর কোথায় ট্রাম্প সাজলে লাভ এখনও ঠিক ঠাহর করে উঠতে পারিনি। যখন যেটা কাজে লাগে সেইটে করতে হবে তো। এই তো যেমন তুমি। মনে হচ্ছে ট্রাম্পের কদরই তোমার কাছে বেশি।
এইটুকু মেয়ে। কী-বা জানে, কীই-বা বোঝে। তবু তার মুখে বেদনার ছায়া পড়ল। বড় বড় দুই চোখ মেলে নিঃসঙ্কোচে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, তোমাকে আমার ভালো লাগে, তা তুমি ট্রাম্পই হও, আর স্টুডেন্টই হও।
পঞ্চদশীর স্মরণে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, অকারণ বেদনার ছায়া ঘনায় মনের দিগন্তে, ছল ছল জল এনে দেয় নয়নপাতে। এ মেয়ে একদিন বড় হবে। ভালোবাসতে শিখবে। সেইদিনের আগমনী আজকের দিনের এই কুচিৎ জাগরিত বিহঙ্গ-কাকলিতে।
.
১০
এবারে কিন্তু মারিয়ানা সেয়ানা। আহারান্তে উপাসনা আরম্ভ করলে, তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাই, হে প্রভু সর্বশক্তিমান দিয়ে এবং শেষ করল পরলোকগত খৃস্টাত্মাদের স্মরণে।
এসব প্রার্থনার সুন্দর অনুবাদ করা প্রায় অসম্ভব। সর্ব ভাষায় সর্ব প্রার্থনার বেলায়ই তাই। প্রণব কিংবা রুদ্র যত্তে দক্ষিণ মুখ তেন মাহপাহি নিত্যম-এর বাঙলা অনুবাদ হয় না। আমি বহু বৎসর ধরে মুসলমানের প্রধান উপাসনা, ফাতিহা অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি। আজ পর্যন্ত কোনও অনুবাদই মনকে প্রসন্ন করতে পারেনি। আভে মারিয়া মন্ত্রটি অতি ক্ষুদ্র। ট্রামে-বাসে ঘরে-বাইরে বার বার মনে মনে একটি অনুবাদ করেছি– আঠারো বছর ধরে, এবং এখনও করছি কোনওটাই মনঃপূত হয় না। দেশের ট্রেনে আমার পরিচিত এক ক্যাথলিক পাদ্রিসাহেবের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ ধরে ওই আভে মারিয়ার দুটি শব্দ নিয়ে আলোচনা হয়। ওই মন্ত্রে মা-মেরির বিশেষণে লাতিনে আছে, গ্রাসিয়া প্লেন, ইংরেজিতে ফুল অব গ্রেস, জর্মানে ফল ডের গ্লাডে! আমি বাঙলা করেছিলুম করুণাময়ী। পাদ্রিসায়েবের সেটা জানা ছিল। শব্দটা আমার মনঃপূত হয়নি, কিন্তু দু জনাতে বহু চেষ্টা করেও পছন্দসই শব্দ বের করতে পারলুম না।
কাজেই মারিয়ানার প্রার্থনাগুলোর বাঙলা অনুবাদ উপস্থিত মুলতুবি থাক।
মারিয়ানা বাসন-কোসন হাঁড়ি-বর্তন সিনকে ফেলেছে।
আমি উঠে গিয়ে সিনকের সামনে দাঁড়িয়ে বললুম, আমি মাজি : তুমি পোঁছো।
জুতো দিয়ে কাঠের মেঝেতে ঠোক্কর মেরে মারিয়ানা বললে, একদম অসম্ভব! তার চেয়ে তুমি ওই টুলটার উপরে বসে আমাকে ইন্ডিয়ার গল্প বল।
এ স্থলে আমার পাঠকদের বলে রাখা ভালো যে, এ-কাহিনীতে অনেক কিছু কাট-ছাঁট বাদ-সাদ দিয়েই আমি লিখছি। কারণ ভারতবর্ষ কত বড় দেশ, পাহাড়-নদী আছে কি না, লোকে কী খায়, মেয়েদের বিয়ে কবছর বয়সে হয়, এসব জানবার কৌতূহল বাঙালি পাঠকের হওয়ার কথা নয়, আর হলেও জর্মনির গ্রামাঞ্চলে হাইকিঙের বর্ণনায় সেগুলো নিশ্চয়ই অবান্তর ঠেকবে। অথচ জর্মনরা ওইসব প্রশ্নই বার বার জিগ্যেস করে বলে কথাবার্তার বারো আনা পরিমাণই ভারতবর্ষ নিয়ে। তাই পাঠক ভাববেন না, জর্মন জনপদবাসী আমার সামনে আপন দেশ নিয়েই বড়ফাটাই করেছে, আর-কিছু শুনতে চায়নি।
আমি বললুম, দেখো মারিয়ানা, তুমি যে বললে, আমাকে তোমার ভালো লাগে, সেটা নিছক মুখের কথা। আমাকে খাইয়েছ বলে আমাকে দিয়ে বাসন মাজিয়ে নিতে চাও না– কারণ তা হলে খাওয়ানোটা মজুরি হয়ে দাঁড়ায়। এসব হিসাব লোকে করে, যে-জন আপন নয়, তার সঙ্গে। আপনজনকে মানুষ সব কর্ম-অকর্মের অংশীদার করে। এইটুকু বলে, রাস্তায় নাসপাতিওলা যে আমাকে শেষ পর্যন্ত তার গাড়ি ঠেলতে দিয়েছিল সে-কথাও বললুম।
এ-কথাটা বলা হয়তো আমার উচিত হয়নি। টম-বয় হোক, আর হল্টারওয়ালিই হোক, মেয়েছেলে তো মেয়েছেলে। দেখি, মারিয়ানার চোখ টলমল করছে। আমাদের দেশে মানুষের নীল চোখ হয় না, আকাশের হয়। তাই রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন জল ভরেছে ঐ গগনের নীল-নয়নের কোণে। দেশে যে জিনিস আকাশে দেখেছি, এখানে সেটা মানুষের চোখে দেখলুম। অবশ্য এদেশের আকাশ কিন্তু আমাদের আকাশের মতো ঘন নীল, ফিরোজা নীল হয় না।
আমি তাড়াতাড়ি এই সজল সংকট কাটাবার জন্যে ঝাড়ন নিয়ে মারিয়ানার পাশে দাঁড়ালুম। সে কিছু না বলে একখানা প্লেট আমার দিকে এগিয়ে দিলে।
আমি সংকটের সম্পূর্ণ অবসান করার জন্য মাজার গুঁড়ো একটা হাঁড়ির উপর ছড়াতে ছড়াতে শুধালুম, ঠাকুরমা দুপুরবেলা ঘুমোয় না?
ওই চেয়ারেই। দিন-রাতের আঠারো ঘণ্টা ওরই উপর কাটায়, রাত্রেও অনেক বলে-কয়ে তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যাই। মাঝে মাঝে কার্ল অবশ্য ওঁকে বেড়াতে নিয়ে যায়।
আমি শুধালুম, কার্ল? কুকুরটা? তুমি নিয়ে যাও না?
ঠাকুরমা কার্লের সঙ্গে যেতেই পছন্দ করে। লিশে ঢিল পড়লেই ঠাকুরমা থেমে যায়, টান পড়তেই আস্তে আস্তে এগোয়। ঠাকুরমা বলে, ওতেই নাকি তার সুবিধে বেশি। জানো, লোকে আমার কথা বিশ্বাস করে না, যখন বলি, কার্ল ঠিক বুঝতে পারে কখন বৃষ্টি নামবে। তার সম্ভাবনা দেখতে পেলেই সে ঠাকুরমাকে বাড়ি ফেরত নিয়ে আসে।
হঠাৎ কার্লের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে, ঠাকুরমাকে বেড়াতে নিয়ে যাবিনে?
সঙ্গে সঙ্গে কার্ল পাশের ঘরে গিয়ে তার কলার লিশ মুখে করে নিয়ে এসে ঠাকুরমার কোলে রাখল। তিনি চমকে উঠে বললেন– হয়তো-বা ইতোমধ্যে তার তন্দ্রা এসে গিয়েছিল– আমি এখন বেড়াতে যাব কী করে?
মারিয়ানা হেসে বললে, না ঠাকুরমা, আমি শুধু ওকে দেখাচ্ছিলুম কার্ল কীরকম চালাক। তার পর কার্লকে বললে, যাও কার্ল! আজ ঠাকুরমা বেরুবে না। স্পষ্ট বোঝা গেল, কার্ল সাতিশয় ক্ষুণ্ণ মনে লিশ কলার মুখে তুলে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। এবং খুব সম্ভব, অভিমান করে ফিরে এল না।
আমি শুধালুম, ঠাকুরমা কারও বাড়িতে যায়?
মারিয়ানা বললে, রোববার দিন গিঞ্জেয়। অন্যদিন হলে পাদ্রিসায়েবের বাড়ি। আর মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে গোরস্তানে যায়। আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে না। বাবা তো সেখানে নেই, শুধু মা আছে। তাকেও চিনিনে।
ওর বলার ধরনটা এমনই সরল আর স্বাভাবিক যে আমার চোখে জল এসে গেছে। পাছে সে সেটা দেখে ফেলে তাই শেলফটার কাছে গিয়ে শুকনো বাসনগুলো একপাশে সরাতে লাগলুম। তাতেও দেখলুম, কোনও কাজ হয় না। তখন বুঝলুম, এ বোঝা নামিয়ে ফেলাই ভালো।
ফের মারিয়ানার কাছে এসে বললুম, আমাদের দেশের কবির একটি কবিতা শুনবে?
উৎসাহের সঙ্গে বললে, নিশ্চয়ই।
আমি বললুম, অনুবাদে কিন্তু অনেকখানি রস মারা যায়। তবু শোন :
মনে পড়া মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে
হঠাৎ অকারণে
একটা কী সুর গুনগুনিয়ে
কানে আমার বাজে,
মায়ের কথা মিলায় যেন
আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত, আমার
দোলনা ঠেলে ঠেলে;
মা গিয়েছে যেতে যেতে
গানটি গেছে ফেলে।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে।
শোবার ঘরের কোণে,
জানলা থেকে তাকাই দূরে।
নীল আকাশের দিকে
মনে হয়, মা আমার পানে
চাইছে অনিমিখে।
কোলের পরে ধরে কবে
দেখতো আমায় চেয়ে
সেই চাউনি যে গেছে।
সারা আকাশ ছেয়ে!!
এ কবিতার অনুবাদ যত কাঁচা জৰ্মনে যে কেউ করুক-না কেন, মা-হারা কচি হৃদয়কে নাড়া দেবেই দেবে। হয়তো এ কবিতাটি মারিয়ানাকে শোনানো আমার উচিত হয়নি, কিন্তু ইয়োরোপীয় সাহিত্যে মাকে নিয়ে কবিতা এত কম, এবং আমার দেশের কবির এত সুন্দর একটি কবিতা- এ প্রলোভন আমি সংবরণ করতে পারিনি বললে ভুল বলা হবে– আমি কেমন যেন আপন অজানাতেই কবিতাটি আবৃত্তি করে ফেলেছি।
রবীন্দ্রনাথ পলাতকা লেখার পর প্রায় চার বছর কোনও কবিতাই লেখেননি কিংবা অতি অল্পই লিখেছিলেন। তার পর কয়েক দিনের ভিতর অনেকগুলি কবিতা লিখে আমাদের ডেকে পাঠিয়ে সেগুলো পড়ে শোনালেন। মাকে আমার পড়ে না মনে তারই একটি। এ কবিতাটি শুনে আমরা সবাই যেন অবশ হয়ে গিয়েছিলুম। শেষটায় কে একজন যেন গুরুদেবকে শুধালে, ঠিক এই ধরনের কবিতা তিনি আরও রচনা করেন না কেন? তিনি বললেন, মা-হারা শিশু তার কাছে এমনই ট্র্যাজেডি বলে মনে হয় যে, ওই নিয়ে কবিতা লিখতে তার মন যায় না।
আমার দৃঢ়বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথ যদি সেদিন মারিয়ানার মুখচ্ছবি দেখতেন তবে তিনি এ-কবিতাটি তার কাব্য থেকে সরিয়ে ফেলতেন, এবং আমাদের ওপর হুকুম করতেন, আমরা যেন কখনও আর এটি আবৃত্তি না করি।
ভেজা চোখে মারিয়ানা শুধাল, তোমার নিশ্চয়ই মা আছে, আর তুমি তাকে খুব ভালোবাস?
আমি আশ্চর্য হয়ে শুধালুম, তুমি কী করে জানলে?
বললে এ কবিতাটি তারই হৃদয় খুব স্পর্শ করার যার মা নেই, আর যে মাকে খুব ভালোবাসে। আর আমার মনে হচ্ছিল, তোমার মা না থাকলে তুমি এ কবিতাটি আমাকে শোনাতে না।
আমি বিস্ময়ে হতবাক। এইটুকু মেয়ে কী করে এতখানি বুঝল। এতখানি হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারল। তখন আবার নতুন করে আমি সচেতন হলুম, ছোটদের আমরা যতখানি ছোট মনে করি ওরা অতখানি ছোট নয়। বিশেষ করে অনুভূতির ক্ষেত্রে। এবং সেখানেও যদি বাচ্চাটি মা-হারা হয় তবে তার বেদনা-কাতরতা এতই বৃদ্ধি পায় যে তার সঙ্গে কথা কইতে হয় বেশ ভেবে-চিন্তে।
এবারে শুধাল শেষ মোক্ষম প্রশ্ন : তুমি যে এতদূর বিদেশে চলে এসেছ তাই নিয়ে তোমার মা কিছু বললে না? এই যে ঠাকুরমা সমস্ত দিনরাত ওই দোরের পাশে চেয়ারটায় বসে থাকতে চায় কেন জানো? বাবা ঠিক সেটারই পাশের দরজা দিয়ে সবসময় বাড়ি ঢুকত–সদর দরজা দিয়ে নয়–অবশ্য আমার শোনা কথা। বাবা যেন সর্বপ্রথম ঠাকুরমাকে দেখতে পায়, ঠাকুরমাই যেন বাবাকে দেখতে পায়। লড়াইয়ের সময়ই সেটা আরম্ভ হল। বাবা যে কখন ছুটি পাবে, কখন বাড়ি পৌঁছবে তার ঠিক-ঠিকানা ছিল না বলে ঠাকুরমা দিবারাত্তির ওই চেয়ারটার উপর কাটাত। এখনও সে অভ্যাস ছাড়তে পারে না।
আমি মিনতি করে বললুম, আর থাক, মারিয়ানা।
কান্না-হাসি হেসে বললে, আচ্ছা, তবে এ দিকটা থাক। এখন আমার কথার উত্তর দাও? তোমার মা কী বলে?
আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললুম, মাকে ফেলে দূরে চলে আসাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাপ। কিন্তু কী করব বল। ইংরেজদের সঙ্গে ঝগড়া করেছি, তার ইস্কুল-কলেজে পড়ব না– অবশ্য গাঁধীর আদেশে। বিদেশে না গিয়ে উপায় কী? কিন্তু মা কি সেটা বোঝে?
এবারে মারিয়ানা হেসে উঠল। বললে, তুমি ভারি বোকা। মা-রা সব বোঝে, সব মাফ করে দেয়।
এর কথাই ঠিক। এ তো একদিন মা হবে।
আবার বললে, তোমার কিচ্ছুটি ভাববার নেই। দাঁড়াও, তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই হল শেষ প্লেট। এটা পুঁছে নিয়ে বেশ করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নাও। এই যে বোতলে তরল সাবান আছে তাতে নেবুর খুশবাই মাখানো আছে। তোমাকে একটা কবিতা পড়ে শোনাব– তুমি তোমারটা শোনালে না?
আমি হাত ধুয়ে ঠাকুরমার মুখোমুখি দেয়ালের চেয়ারে এসে বসলুম।
রবারের এপ্রন্ খুলতে খুলতে মারিয়ানা বললে, কই, দাও তোমার বইখানা। ওই যাতে হাইনের কবিতা আছে। আশ্চর্য এই যোগাযোগ। মাত্র কয়েক দিন আগে আমার ক্লাসে কবিতাটি পড়েছি।
এক ঝটকায় কবিতাটি বের করে বেশ সুন্দর গলায়, সুস্পষ্ট উচ্চারণে পড়তে আরম্ভ করল,
আন্ মাইনে মুটার- মাতার উদ্দেশে
ইষ বিনস্ গেভোন্ট—
সমস্ত কবিতাটি পড়ে শেষের কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করলে একাধিকবার :
আজ ফিরিয়াছে মন ভবনে আপন,
যেথা মা গো, তুমি মোরে ডাকিছ সদাই।
আজ দেখিলাম যাহা দৃষ্টিতে তোমার,
সেই তো মমতা, চির আরাধ্য আমার।*
[*১. সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অনুবাদ। পূর্বোল্লিখিত হাইনের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃ. ১৬ দ্রষ্টব্য। জর্মন ভাষায় নবীন সাধকদের এস্থলে একটু সাবধান করে দি। ১৭ পৃষ্ঠায় মূল জর্মনে পঞ্চম ছত্র হবে চতুর্থ ছত্র, চতুর্থ ছত্র হবে পঞ্চম ছত্র।]
আমি অস্বীকার করব না, কবিতাটি আমার মনে অপূর্ব শান্তি এনে দিল। অন্য পরিবেশে হয়তো কবিতাটি আমার হৃদয়ের এতটা গভীরে প্রবেশ করত না। বিশেষ করে ছাপাতে পড়া এক জিনিস আর একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে অবশ্য তার কবিতা পাঠ, তার রসবোধ দেখে তার হৃদয়-মনের বয়েস ষোল-সতেরো বছর বলতে কোনও আপত্তি নেই– তার মায়ের উদ্দেশে কবিতা সুন্দর উচ্চারণে দরদ দিয়ে পড়ে শোনাচ্ছে, সে একেবারে ভিন্ন জিনিস।
ঠাকুরমার গলা শোনা গেল। ক্ষীণ কণ্ঠে আমার উদ্দেশে বলছেন, তুমি কোনও চিন্তা করো না। তুমি তো কোনও অন্যায় করনি। আর অন্যায় করলেও মা সবসময়েই মাফ করে দেয়। ছেলের অন্যায় করার শক্তি যতখানি, মায়ের মাফ করার শক্তি তার চেয়ে অনেক বেশি। আর তুমি তোমার মাকে ভালোবাস সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা। কাছ থেকে না-ভালোবাসার চেয়ে কি দূরে থেকে ভালোবাসা বেশি কাম্য নয়? এই যে মারিয়ানার বাপ আমার আগে চলে গেল। আমার একটিমাত্র ছেলে। কিন্তু আমি জানি, সে মা-মেরির চরণতলে আশ্রয় পেয়েও এই মায়ের জন্য প্রতীক্ষা করছে। আমিও অনেক আগেই চলে যেতুম, কিন্তু এই তো রয়েছে আমার মারিয়ানা। আমি কি তার ঠাকুরমা? আমি তার মা। এ প্রথম মা হোক, তার পর আমি হেসে হেসে চলে যাব। তুমি কোনও চিন্তা কোরো না। আপন কর্তব্য করে যাও। ঠাকুরমা কথাগুলো বললেন অতিশয় ক্ষীণ কণ্ঠে কিন্তু তার বাক্যে বিশ্বাসের কী কঠিন দার্ট।
আমি উঠে গিয়ে ঠাকুরমার হাত দুটিতে চুমো খেলুম। ফিরে এসে মারিয়ানার মস্তকাঘ্রাণ করলুম।
বিদায় নেওয়াটা খুব সহজ হয়নি। অল্পক্ষণের পরিচয়ের বন্ধু আর বহুকালের পরিচিত বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নেবার ভিতর পার্থক্য আছে সত্য, কিন্তু অনেক সময় অল্প পরিচয়ের লোকও সেই স্বল্প-সময়ের মধ্যেই এতখানি মোহাচ্ছন্ন করে দেয় যে, তার কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় মনে ক্ষোভ থেকে যায় যে, এর সঙ্গে দীর্ঘতর পরিচয় হলে কত না নতুন নতুন বাঁকে বাঁকে নতুন নতুন ভুবন দেখতে পেতুম।
দু বছরের বাচ্চা মারা গেলে মার যে শোক হয় সে কি পঞ্চাশ বছরের ছেলে মরে যাওয়ার চেয়ে কম? আমার একটি ভাই দুই বছর বয়সে চলে যায়, কিন্তু থাক সে কথা—
***
এ-দেশে গ্রীষ্মের দিন যে কত দীর্ঘ হতে পারে সে-সম্বন্ধে আমাদের মনে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থাকলেও তার অভিজ্ঞতা না হওয়া পর্যন্ত সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা হয় না। তুলনা দিয়ে বলতে পারি, পূর্ণচন্দ্র-অমাবস্যায় কী পার্থক্য সেটা গ্রামের লোক যতখানি জানে চৌরঙ্গির লোক কি ততখানি বোঝে? আমিও এ-দেশের শহুরে; গ্রামে এসে এই প্রথম নিদাঘের দীর্ঘদিন কী সেটা প্রত্যক্ষ হৃদয়ঙ্গম হল!
সূর্য তখন অস্ত যায়নি। হঠাৎ বেখেয়ালে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি রাত আটটা। কিন্তু রাত আটটা কি ঠিক বলা হল? আটটার সময় যদি দিবালোক থাকে তবে তো সেটা এ-দেশে সকালের আটটা, দিনের আটটা? তা সে যাক। শেকসপিয়ার ঠিকই বলেছেন, নামেতে কী করে? সূর্যেরে যে নামে ডাকো আলোক বিতরে!
মধুময় সে আলো। অনেকটা আমাদের কনে দেখার আলোর মতো। কোনও কোনও গাছ, ক্ষেতে ইতোমধ্যেই পাক ধরেছে। তাদের পাতা দেখে মনে হয়, সমস্ত দিনের সোনালি রোদ খেয়ে খেয়ে সোনালি হয়ে গিয়ে এখন তারাও যেন সোনালি আলো বিকিরণ করছে। কিটস না কার যেন কবিতায় পড়েছিলুম, পাকা আঙুরগুলো সূর্যরশির স্বর্ণসুধা পান করে টইটম্বুর হয়েই যাচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, আর তাদের মনে হচ্ছে এই নিদাঘ রৌদ্রের যেন আর অবসান নেই। আমিও এগোচ্ছি আর ভাবছি, এ-দিনের বুঝি আর শেষ নেই। এতক্ষণে বুঝতে পারলুম মারিয়ানা যখন আমাকে তাদের বাড়িতে রাতটা কাটাবার জন্য অনুরোধ করছিল তখন নানা আপত্তি দেখানো সত্ত্বেও এটা কেন বলেনি, রাতের অন্ধকারে আমি যাব কী করে? আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলেও যেমন অতিথিকে ঠেকাবার জন্য শরৎ-পূর্ণিমা-সন্ধ্যায় এ অজুহাত ভোলা চলে না, রাতের অন্ধকারে পথ দেখবেন কী করে?
গ্রামের শেষ বাড়িটার চেহারা দেখে আমার কেমন যেন মনে হল এ-বাড়িটার বর্ণনা কে যেন আমায় দিয়েছিল। হা হা, এটা আমার যাত্রারম্ভের সেই প্রথম পরিচয়ের–কী যেন নাম, হুঁ, টেরমের, হ্যাঁ, এটা সেই টেরমের, যার বউ নাকি খাণ্ডার, এটা তারই বাড়ি বটে নিশ্চয়।
সাদা রঙের বুক অবধি উঁচু ফালি ফালি কাঠের গেটের উপর দুই কনুই রেখে আবার একটি রমণী। কই, খাণ্ডারের মতো চেহারা তো ঠিক নয়। আর এই অসময়ে এখানে দাঁড়িয়েই-বা কেন? তবে কি টেরমের এখনও বাড়ি ফেরেনি?
আমার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলল। দেখিই না পরখ করে। সত্যি ভাণ্ডার, না, পথে যে সেই লড়াই-ফেরতা বলেছিল, একটু হিসেবি এই যা। খাণ্ডার হোক আর যাই হোক, আমাকে তো আর চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে পারবে না। আর খেলেও হজম করতে হবে না। এ-দেশে ভেজাল নেই। আমি নির্ভেজাল ভেজাল। ফুড-পইজনিঙে যা কাতরাতে কাতরাতে মরবে সে আর দেখতে হবে না। সখা টেরমেরও নয়া শাদি করে সুখী হবেন, কিংবা কিংবা আকছারই যা হয়, জাদু টেরটি পাবেন, পয়লা বউটি কত না লক্ষ্মী মেয়ে ছিল– খাণ্ডার তো নয়, ছিল যেন গ্রীষ্মের তৃষ্ণার কচি শসাটি। অবশ্য ইতোমধ্যে যদি আমার ভ্রাতা ইল এখানে এসে ডাক ছাড়ে, হে বাতাপে! তুমি নিষ্ক্রান্ত হও। তা হলে তো কথাই নেই, আমিও মহাভারতের ভাষাতেই বলি– খারিনীর পার্শ্বদেশ বিদীর্ণ করে সহাস্য-আস্যে নিষ্ক্রান্ত হব।
ইতোমধ্যে আমি আমার লাইন অব্ অ্যাশ অর্থাৎ বৃহ নির্মাণ করে ফেলেছি।
কাছে এসে আমার সেই ছাতা হ্যাট হাতে নিয়ে প্রায় মাটি ছুঁইয়ে, বাঁ হাত বুকের উপর রেখে, কোমরে দু ভাঁজ হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে অর্থাৎ গভীরতম বাও করে মধ্যযুগীয় কায়দায় বিশুদ্ধতম উচ্চারণে বললুম, গুন আবেন্ড, গ্লেডিগে ফ্রাউ অর্থাৎ আপনার সন্ধ্যা শুভ হোক, সম্মানিতা মহিলা।
এই সম্মানিতা মহিলা বলাটা কবে উঠে গিয়েছে ভগবান জানেন। আজ যদি আমি কলকাতায় শহরে কোনও মহিলাকে ভদ্রে বলে সম্বোধন করি, কিংবা গৃহিণীকে মুগ্ধে বলে কোনও কথা বোঝাতে যাই তা হলে যেরকম শোনাবে অনেকটা সেইরকমই শোনাল।
তার গলা থেকে কী একটা শব্দ বেরুতে না বেরুতেই আমি শুধালাম, আপনি কি দয়া করে বলতে পারেন মেলেম গ্রামটি কোথায়?
অবাক হয়ে বললে, সে তো অন্তত ছ মাইল!
আমি বললুম, তাই তো! তবে আমি নিশ্চয়ই পথ ভুল করে বসে আছি। তা সে যাকগে। আমি ম্যাপটা বের করে একটুখানি দেখে নিই। এই হাইকিঙের কর্মে আজ সকালে মাত্র হাতেখড়ি কি না।
আমি ইচ্ছে করেই বাঁচালের মতো হেসে হেসে কথাই কয়ে যেতে লাগলুম, থাকি বন্ শহরে। গরমে কলেজের ছুটিতে যে যার গেছে আপন বাড়ি। আমি কী করে যাই সেই দূর-দরাজের ইন্ডিয়ায়? এই তো ম্যাপটা পেয়েছি। ঐয টর্চটা আনিনি। বললুম তো হাতেখড়ি। তা সে—
এতক্ষণে রমণী অবাক হয়ে সেই পুরনো– এই নিয়ে চারবারের বার–ইন্ডার-ইন্ডিয়ানার গুবলেট পাকালে। সেটার আর পুনরাবৃত্তি করে কোনও লাভ নেই।
আমি বললুম, তা হলে আসি, মাদাম (যেন আমার পালাবার কতই না তাড়া)! আপনি শুধু মোটামুটি দিকটা বাতলে দিন।
কিন্তু ইতোমধ্যে দাওয়াই ধরেছে। মৃদু কণ্ঠে বললেন, চলুন। ঘরের আলোতে ম্যাপটা ভালো করে দেখে নেবেন।
আমি আমতা আমতা করে বললুম, হ্যাঁ, মাদাম, তা মাদাম, কিন্তু মাদাম—
অথচ ওদিক দিব্য খোলা গেট দিয়ে তার পিছন পিছন মারিয়ানার কার্লের মতো নির্ভয়ে এগিয়ে চললুম। মনে মনে এক গাল হেসে বললুম, ট্রয়ের ঘোড়া ঢুকেছে, হুঁশিয়ার।
তবু বলতে হবে সাবধানী মেয়ে। রান্নাঘরে না নিয়ে গিয়ে, গেল ড্রয়িংরুমে।
পাঠক আমাকে বোকা ঠাউরে বলবেন, এতেই তো আমাকে সম্মান দেখানো হল বেশি; কিন্তু আমি তা পূর্বেই নিবেদন করেছি, এ দেশের গ্রামাঞ্চলে হৃদ্যতা দেখাতে হলে কিচেন, লৌকিকতা করতে হলে ড্রয়িংরুম।
আমাদের পূর্ব বাঙলায় যেরকম আত্তি করতে হলে রাত্রিবেলা লুচি, আপনজন হলে ভাত।
.
১২.
হিটলারের পিতা যখন তার মাতাকে বিয়ে করতে চান, তখন বিশেষ কোনও কারণে চার্চের অনুমতির প্রয়োজন হয়েছিল। দরখাস্তে বিবাহের পক্ষে নানা সদযুক্তি দেখানোর পর সর্বশেষে বলা হয় তদুপরি বধূ অর্থসামর্থহীন; অতএব সে যে এরকম উত্তম বিবাহের সুযোগ পুনরায় এ-জীবনে পাবে সে আশা করা যায় না।
পণপ্রথা তোলার চেষ্টা করুন আর না-ই করুন, এ জিনিসটা সমাজের বিশেষ বিশেষ শ্রেণিতে পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই দেখেছি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ে।
চাষার বাড়ির ড্রয়িংরুম প্রায় একই প্যাটার্নের। এ বাড়িতে কিন্তু দেখি, শেলফে বইয়ের সংখ্যা সচরাচর হয় তার চেয়ে বেশি, অপ্রত্যাশিত রকমের বেশি। তদুপরি দেখি, দেয়ালে বেশকিছু অত্যুত্তম ছবির ভালো ভালো প্রিন্ট, সুন্দর সুন্দর ফ্রেমে বাঁধা। আমার মুখে বোধহয় বিস্ময়ের চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। মাদামই বললেন, বিয়ের পূর্বে আমি কিছুদিন বন্ শহরে এক প্রকাশকের ওখানে কাজ করেছিলুম।
অ। সেই কথা। অর্থাৎ এ-দেশে যা আকছারই হয়ে থাকে। কনের বিত্তসামর্থ্য না থাকলে সে চাকরি করে পয়সা কামিয়ে যৌতুক কনে। যৌতুক কথাটা ঠিক হল না। স্ত্রী-ধন কথার সঙ্গে তাল রেখে ওটাকে বর-ধন বলা যেতে পারে।
এ-দেশের নিয়ম কনেকে রান্নাঘরের বাসন-বৰ্তন, হাঁড়িকুড়ি, মায় সিক–রান্নাঘরের তাবৎ সাজ-সরঞ্জাম, যার বর্ণনা পূর্বেই এক অনুচ্ছেদে দিয়েছি শোবার ঘরের খাট-গদি-বালিশ চাদর-ওয়াড়-আলমারি, বসবার ঘরের সোফা-চেয়ার ইত্যাদি সবকিছু সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়। শহরাঞ্চলে বর শুধু একখানি ফ্ল্যাট ভাড়া করেই খালাস। বিয়ের কয়েকদিন আগে তিনি শুধু ফ্ল্যাটের চাবিটি কনের হাতে গুঁজে দেন। কনে বেচারি সতেরো-আঠারো বছর থেকে গা-গতর খাঁটিয়ে যে পয়সা কামিয়েছে তাই দিয়ে এ-মাসে কিনেছে এটা, ও-মাসে কিনেছে সেটা বছরখানেক ধরে, দাও বুঝে–এখন কয়েকদিন ধরে আস্তে আস্তে সেগুলো সরানো হবে, বরের ফ্ল্যাটে। বিয়ের পর বর-কনে কখনও-বা সোজা চলে যায় হানিমুনে, আর কখনও-বা ফ্ল্যাটে দু চার দিন কাটিয়ে। কিন্তু একটা কথা খাঁটি; এর পর আর মেয়েকে ঘরকন্না চালাবার জন্য অন্যকিছু দিতে হয় না– জামাইষষ্ঠীর তত্ত্ব এ-দেশে নেই।
আর ট্র্যুসোর কথা পাঠিকারা নিশ্চয়ই এঁচে নিয়েছেন। সেও আরম্ভ হয়ে যায় ওই ষোল-সতেরো বছর বয়স থেকে। জামা-কাপড় ফ্রক গাউনের এমব্রয়ডারি আরম্ভ হয়ে যায় ওই সময়ের থেকেই মায়ের সাহায্যে এবং পরে কোনও পরিবারে চাকরি নিলে সে বাড়ির গিন্নিমা অবসর সময়ে কখনও-বা এমব্রয়ডারির কাজ দেখিয়ে দেন, কখনও-বা নিজেই খানিকটা করে দেন। শুনেছি, বাড়ন্ত মেয়েরা টাইট-ফিটের জামা গাউনগুলোর সবকিছু তৈরি করে রাখে– বিয়ের কয়েকদিন আগে দরজির দোকানে গিয়ে কিংবা মা-মাসি সাহসিনী হলে তাদের সাহায্যে নিজেই কেটে সেলাই করে নেয়।
ব্যাপারটা দীর্ঘদিন ধরে চলে বলে এতে একটা আনন্দও আছে। আমার এক বন্ধু পরীক্ষা পাস করে চলে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল তার ফিয়াসেকে যেন মাঝে মাঝে একটুখানি বেড়াতে নিয়ে যাই। বেচারি নিতান্ত একা পড়ে যাবে বলে, এবং আমার কোনও ফিয়াসে এমনকি বান্ধবী পর্যন্ত নেই বলে।
রাস্তায় নেমে আমি হয়তো বললুম, বাসন-কোসনের আলমারি হয়েছে, উনুন হয়েছে, এইবারে সিনক না?
বললে, হ্যাঁ, গোটা তিনেক এদিক-ওদিকে দেখেছি। আমার কিন্তু এটা ভারি পছন্দ হয়েছে। শহরের ওই প্রান্তে।
আমি বললুম, আহা, চলই না, দেখে আসা যাক কীরকম।
তুমি না বলেছিলে, রাইনের ওপারে যাবে?
কী জ্বালা! রাইন তো পালিয়ে যাচ্ছে না।
ছোট্ট শহর বন্। ডাইনে মুনস্টার গির্জে রেখে, রেমিগিউস স্ট্রিট ধরে ফের ডাইনেই য়ুনিভার্সিটি পেরিয়ে ঢুকলুম মার্কেট প্লেসে। বাঁ দিকে কাফে মনোপোল, ডান দিকে মনিসিপ্যাল আপিস। মার্গারেট বললে, দাঁড়াও। এদিকেই যদি এলে তবে চল ওই গলিটার ভিতর। রিডিং ল্যাম্পের সেল হচ্ছে– সস্তায় পাওয়া যাবে আমার যদিও পছন্দ হয়নি।
দেখেই আমি বললুম, ছ্যাঃ!
মার্গারেট হেসে বললে, আমিও তাই বলছিলুম।
করে করে, অনেকক্ষণ এটা-সেটা দেখে দেখে সবাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, দোকানে ঢাকা নদারদ, এখনও পাকাপাকি কেনার কোনও কথাই ওঠে না, মার্গারেটের মা দেখবে, পিসি দেখবে, তবে তো পৌঁছলুম সেই সিন্কের সামনে। আমি পাকা জউরির মতো অনেকক্ষণ ধরে ডাইনে ঘাড় নাড়ালুম, বায়ে ঘাড় নাড়ালুম, তার পর বাঁ হাতের কড়ে আঙুল দিয়ে ডান কানের উপরটা চুলকোতে চুলকোতে বললুম, হ্যাঁ, উত্তমই বটে। শেপটি চমৎকার, সাইজটিও বঢ়িয়া–দুজন লোকের বাসন-কোসনই-বা কখানা, তবে হ্যাঁ, পরিবার বাড়লে– মার্গারেট কী একটা বলেছিল; আমি কান না দিয়ে বললুম, তবে কি না বড় ধবধবে সাদা। এটিকে পরিষ্কার রাখতে জান বেরিয়ে যাবে। একটুখানি নীল ঘেঁষা হলে কিংবা ক্রেজি চাইনার মতো হলে– মার্গারেট বললে, সেই ঘষে ঘষে সাফ যদি করতেই হয় তবে ধবধবে সাদাই ভালো। মেহনত করব, উনি নীলচেই থেকে যাবেন, লোকে ভাববে হাড়-আলসে বলে নীল রঙের কিনেছি– কী দরকার?
আহা, সেসব শ্লো টেম্পোর টিমে তেতালার দিনগুলো সব গেল কোথায়? এখন সকালে বিয়ে ঠিক, সন্ধের ভিতরই ডেকরেটররা এসে সবকিছু ছিমছাম ফিটফাট করে দিলে। তবে হ্যাঁ, তখন বাড়ি পাওয়া যেত সহজেই; এখন আর সে সুখটি নেই। কিছুদিন পূর্বেই ইয়োরোপের কোন এক দেশে নাকি কাগজে বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল :
পাত্রী চাই! পাত্রী চাই!! পাত্রী চাই!!! আপন নিজস্ব সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত বাড়ি যার আছে। এমন পাত্রী চাই। বাড়ির ফোটোগ্রাফ পাঠান।
***
কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম। ট্রাম্পকে নিয়ে এই তো বিপদ। সে যেরকম সোজা রাস্তায় নাক-বরাবর চলতে জানে না, তার কাহিনীও ঠিক তেমনই পারলেই সদর রাস্তা ছেড়ে এর খিড়কির দরজা দিয়ে তাকায়। ঝোঁপের আড়াল থেকে ওর পিছনের পুকুরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
আমি আমার ম্যাপ খুলে অনেকক্ষণ ধরে সেটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ভান করলুম। তার পর দাঁড়িয়ে উঠে বললুম, অনেক ধন্যবাদ, মাদাম? আপনাকে অযথা বিরক্ত করলুম।
এইবারে মাদামের অগ্নিপরীক্ষা।…মাদাম পাস! টেরমের ফে।
অবশ্য কিছুটা কিন্তু কিন্তু করেই বলেছিল–কিছু বলেছিল তো ঠিকই এখন তো রাত নটা। ভিন গায়ে পৌঁছতে–
আমি বাধা দিয়ে এক গাল হেসে বললুম, আদপেই না, মাদাম! আপনাকে সবকিছু খুলে কই।
বসুন না। মাদাম শুধু পাস না; একেবারে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।
আমি শুনেছি, আপনাদের দেশে গরমের সময়ে দিনগুলো এত লম্বা হয় যে একটা দিনের আলো নাকি পরের দিনের ভোরকে গুড় মর্নিং বলার সুযোগ পায়। ঠিকমতো অন্ধকার নাকি আদপেই হয় না। এখানে আমি থাকি শহরে। ছটা সাতটা বাজতে না বাজতেই সব কড়া কড়া বিজলি বাতি দেয় জ্বালিয়ে। কিচ্ছুটি বোঝবার উপায় নেই, আলো, না অন্ধকার। ফিকে অন্ধকার, তরল অন্ধকার, ঘোরঘুট্টি অন্ধকার শুনেছি মিমারে নাকি গ্রামাঞ্চলে এর সব কটাই দেখা যায়। আমি হাঁটতে হাঁটতে দিব্য এগুতে থাকব আর অন্ধকারের গোড়াপত্তন থেকে তার নিকুচি পর্যন্ত রসিয়ে রসিয়ে চেখে চেখে যাব। এবং–
কিন্তু আপনার আহারাদি?
কে বলে এ রমণী খাণ্ডার।
মারিয়ানার ঠাকুরমাই তাকে বলেছিল, দেখ, দিকিনি, ও যে হাইকিঙে বেরিয়েছে, সঙ্গে স্যান্ডউইচ আছে কি না। আমার কোনও আপত্তি না শুনে মারিয়ানা আমার আধা-বাসি সাদামাটা স্যান্ডউইচগুলো তুলে নিয়ে আমার ব্যাগটা ভরতি করে দিয়েছিল গাদাগাদা রকম-বেরকমের স্যান্ডউইচে। সঙ্গে আবার টুথপেস্ট টুবের মতো একটা টুবও দিয়েছিল। ওর ভিতরে নাকি মাস্টার্ড আছে। বলেছিল স্যান্ডউইচে মাষ্টার্ড মাখিয়ে দিলে ওগুলো খুব তাড়াতাড়ি মিইয়ে যায়। যখন খাবে, তখন রাইটা মাখিয়ে নিও। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিল, তোমারগুলো কাল সকালে আমি খাব।
তাই আমার ব্যাগটাকে আদর করতে করতে তাড়াতাড়ি বললুম, কী আর বলব, মাদাম, আমার সঙ্গে যা স্যান্ডউইচ আছে, তার জোরে আমি আপনাকে পর্যন্ত রুপালি বোর্ডারওয়ালা সোনালি চিঠি ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ করতে পারি। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আমি খাই অনেক দেরিতে। রাত এগারোটার সময়।
বললে, সে তো ঠাণ্ডা। গরম সুপ আছে।
আমি অনেক-কিছু এক ঝটকায় বুঝে গেলুম। সখা টেরমের প্রতি রাত্রে না হোক রোববার রাত্রে ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে পাবে (মদের দোকান, ক্লাব এবং আড্ডার সমন্বয়) গুলতানি করে বাড়ি ফেরেন অনেক রাত্রিতে। পৃথিবীর কোনও জায়গাতেই গিন্নি-মা-রা এ অভ্যাসটি নেকনজরে দেখেন না। তাই সৃষ্টির আদিম যুগ থেকে একটা ভীষণ লড়াই চলেছে খরবেগে, একদিকে পাবওয়ালা, অন্যদি গৃহিণীর দল। গ্রামের কোনও কোনও পাবে তাই দেখেছি, পাব-ওয়ালা বেশ পয়সা খরচ করে বড় বড় হরফে দেয়ালে নিম্নেক্ত কবিতাটি পেন্ট করে নিয়েছে–
ফ্রাগে নিষট ডি উর ভি স্পেট এস সাই
ডাইনে ফ্রাই শিমফট উম সেন
গেনাও ভি উম ড্রাই।
ঘড়িটাকে শুধিয়ো না, কটা বেজেছে।
তোমার বউ তোমাকে দশটার সময় সেই বকাই বকবে, যেটা তিনটের সময় বকে!
মানুষ করেই-বা কী? জর্মনরা কারও বাড়িতে বসে আড্ডা জমানোটা আদপেই পছন্দ করে না। ডিনার-লাঞ্চে নিমন্ত্রণ করলে অবশ্য অন্য কথা। কিন্তু সে তো সম্পূর্ণ ভিন্ন বস্তু। এ-দেশেও এরকম লোক আছে, যাদের পেতে হলে চায়ের দোকানে যেতে হয়। পরের বাড়িতে যায় না, নিজের বাড়িতেও থাকে না।
এ অবস্থায় মেয়েরা কী করে?
কাচ্চা-বাচ্চা সামলায়। খামখা তিনবার বাচ্চাটার ফ্রক বদলিয়ে দেয়, চারবার পাউডার মাখায়, হাতের কাজ ক্ষান্ত দিয়ে ঘড়ি ঘড়ি টু মেরে যায় বাচ্চা ঠিকমতো ঘুমুচ্ছে কি না।
সেইখানে, যেখানে থাকবার কথা, ভরা গাঙ্গের তরতর স্রোত, যার উপর দিয়ে কলরব করে ধেয়ে চলবে ভরা পাল তুলে টেমের গিন্নির যৌবনতরী– হায়, সেখানে বালুচড়া। নৌকাটি যে মোক্ষম আটকা আটকেছে, তার থেকে তার নিষ্কৃতি নেই– কী করে জানিনে কথায় কথায় বেরিয়ে গিয়েছে, বেচারি সন্তানহীনা।
সমস্ত পৃথিবীটা নিষ্ফল সাহারায় পরিণত হোক, কিন্তু একটি রমণীও যেন সন্তানহীনা না হয়, মা হওয়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়।
তাই কি এ রমণীর হৃদয় থেকে সর্বরস বাষ্প হয়ে নক্ষত্রলোকে চলে গিয়েছে?– কেউ বলে খাণ্ডার, কেউ বলে হিসেবি? কিন্তু কই, ঠিক জায়গায় সামান্যতম খোঁচা লাগামাত্রই তো তার নৌকা চলুক আর না চলুক, পালে তো হাওয়া লাগল– স্বামীর জন্য তৈরি সুপ বাউণ্ডুলের সামনে তুলে ধরতে চায়।
আমি এসেছিলুম মজা করতে, বাজিয়ে দেখতে খাণ্ডার কি না, এখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ।
ঘরের আসবাবপত্র, ছবি, বই– এসব টেমের-বউ যোগাড় করেছিল যৌতুকের টাকা জমাবার সময় কেমন যেন আমার কাছে হঠাৎ অত্যন্ত নিরানন্দ, নিঃসঙ্গ, নীরস বলে মনে হতে লাগল। এরই ভিতর একা একা দিন কাটায় এ রমণী। টেরমের লোক নিশ্চয় খারাপ নয়– যে দু-চারটে কথা বলেছিলুম, তার থেকে আমার মনে অতি দৃঢ় ওই প্রত্যয় হয়েছিল– এবং এখন আমার মনে হল, দু জনার ভিতরে ভালোবাসাও আছে যথেষ্ট, কিন্তু একজনকে ভালোবাসা দেওয়া এক জিনিস, আর সঙ্গ দেওয়া অন্য জিনিস। এ-মেয়ে শান্ত গম্ভীর। খুব সম্ভব, স্বামী বাচ্চা নিয়ে নির্জনে থাকতে চায়, আর ওদিকে টেরমের ইয়ার-দোস্তের সঙ্গে বসে পাঁচজনের পাঁচ রকমের সুখ-দুঃখের কথা না শুনলে, না বললে, তার মনে হয় তার জীবনটা যেন সর্বক্ষণ অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।
এসব কথা বৃথা, টেরমের গিন্নি কি অন্য কিছু দিয়ে জীবন ভরে তুলতে পারে না? কেউ কেউ পারে, কিন্তু অনেকেই পারে না। এ মেয়ে যেন গ্রামোফোন রেকর্ডের কাটা লাইনের ভিতরে পড়ে গিয়েছে সাউন্ড বক্সটা– আছে ঠায় দাঁড়িয়ে, রেকর্ড ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে, সে কিন্তু আর এগুতে পারছে না। আমার অনেক সময় মনে হয়, এই একঘেয়ে নীরস জীবনের চেয়ে অনটনের জীবন, সঙ্কটের জীবন কাম্যতম। সেখানে অন্তত সেই অনটন, সেই সঙ্কটের দিকে সর্বক্ষণ মনঃসংযোগ করতে হয় বলে মনটা কিছু-না কিছু একটা নিয়ে থাকে। বেদনার শেষ আছে কিন্তু শূন্যতার তো নেই।
আমার বড় লজ্জা বোধ হল। ঠাট্টাছলে, মস্করা করতে এখানে এসেছিলুম বলে। স্থির করলুম, সব কথা খুলে বলব, নিদেন এটা বলব যে, তার স্বামীকে আমি চিনি, সে আমাকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল।
আমি ভয়ে ভয়ে আরম্ভ করলুম, আপনার স্বামী—
আমার কথা আর শেষ করতে হল না। এই শান্ত– এমনকি, গুরুগম্ভীরও বলা যেতে পারে– মেয়ে হঠাৎ হোহো করে অট্টহাস্য হেসে উঠল। কিন্তু ভারি মধুর। বিশেষ করে ঝকঝকে সাদা দু পাটি দাঁত আর চোখ দুটি যা জ্বলজ্বল করে উঠল, সে যেন অন্ধকার রাত্রে আকাশের কোণে বিদ্যুল্লেখা। কতদিন পরে এ-রমণী এভাবে প্রাণ খুলে হাসলে, কে জানে। কত তপ্ত নিদাঘ দিনের পর নামল এ-বারিধারা। তাই হঠাৎ যেন চতুর্দিকের শুষ্কভূমি হয়ে গেল সবুজ। দেয়ালের ছবিগুলোর গুমড়ো কাঁচের মুখের উপর দিয়ে যেন খেলে গেল এক পশলা আলোর ঝলমলানি।
আমার স্বামী– বার বার হাসে আর বলে আমার স্বামী-। শেষটায় কোনও গতিকে হাসি চেপে বললে, আমার স্বামী আপনাকে পেলে হাল্লেলুইয়া রব ছেড়ে আপনাকে ধরে নাচতে আরম্ভ করত। এ-গ্রামের যে-কোনও একজনকে পেলেই তার ক্রিসমাস। আপনি কত দূর দেশের লোক। আপনাকে পেলেই এখুনি নিয়ে যেত পাবে। আবার হাসতে হাসতে বললে, আপনি বুঝি ভয় পেয়েছেন, ও যদি হঠাৎ বাড়ি ফিরে দেখে আমি একটা ট্রাম্পকে অবশ্য আপনি ট্রাম্প নন–যত্ন করে সুপ খাওয়াচ্ছি তা হলে সে চটে গিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করবে! হোলি মেরি! যান না আপনি একবার পাবে। ও গিয়েছিল শহরে। এতক্ষণে ফিরেছে নিশ্চয়ই, এবং বাড়ি না এসে গেছে সোজা পাবে। শহরে কী কী দেখে এল তার গরমাগরম একটা রগরগে বর্ণনা তো দেওয়া চাই। যান না একবার সেখানে। নরক গুলজার। তার পর আবার হাসি। শেষটায় বললে, আমি যদি ওকে বলি যে, সে যখন শহরে কিংবা পাবে, তখন এক বিদেশি তা-ও সেই সুদূর ইন্ডিয়া থেকে, ফ্রান্স কিংবা পর্তুগাল থেকে নয়– আমাদের বাড়িতে এসেছিল তা হলে সে দুঃখে ক্ষোভে বোধহয় দেয়ালে মাথা ঠুকবে। তাই বলছি যান একবার পাবে। খরচার কথা ভাবছেন? আমার স্বামী যতক্ষণ ওখানে রয়েছে।
আমি ইচ্ছে করেই বেশ শান্ত কণ্ঠে বললুম, আমি তো শুনেছি, আপনি চান না, আপনার স্বামী বেশি লোকের সঙ্গে মেলামেশা করুক।
হঠাৎ তার মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। আমার মনে দুঃখ হল। কিন্তু যখন মনস্থির করেছি, সবকথা বলবই তখন আর উপায় কী? গোড়ার থেকে সবকিছু বলে গেলুম, অবশ্য তাঁর স্বামীর ভাষাটাকে একটু মোলায়েম করে, এবং লড়াই-ফেরতা চাষা কী বলেছিল তার অভিমতও।
নাঃ! বিধাতা আমার প্রতি সুপ্রসন্ন। টেরমেরিনীর মুখে ফের মৃদু হাস্য দেখা দিল। তা হলে বোধহয়, একবার গাম্ভীর্যের বাঁধন ভাঙলে সেটাকে আর চট করে মেরামত করা যায় না। হাসিমুখেই বললে, সে এক দীর্ঘ কাহিনী। আপনি বরঞ্চ পাবে যান। আমি বললুম, আপনি যদি সঙ্গে চলেন, তবে যেতে রাজি আছি। স্তম্ভিত হয়ে বললে, আমি? আমি যাব পাবে? আমি বললুম, দোষটা কী? আপনার স্বামী যখন সেখানে রয়েছেন। তাড়াতাড়ি বললে, না, না। সে হয় না। তার পর আমাকে যেন খুশি করার জন্য বললে, আরেক দিন যাব।
আমি বললুম, সেই ভালো, মাদাম। ফেরার মুখে যখন এ গা দিয়ে যাব তখন তিনজনাতে একসঙ্গে যাব।
রাস্তায় নেমে শেষ কথা বললুম, ওই কথাই রইল।
.
১৩.
বিচক্ষণ লোক ঠিক জানে, এই শেষবার, এর পর দোকানি আর ধার দেবে না। হুঁশিয়ার লোক দোকানির সামান্যতম চোখের পাতার কাঁপন কিংবা তার নিশ্বাসের গতিবেগ থেকে এই তত্ত্বটি জেনে যায়, এবং তার পর আর ওপাড়া মাড়ায় না। নৈসর্গিক পরিবর্তন সম্বন্ধেও সে কিছু কম ওয়াকিফহাল নয়। মাঠ দিয়ে যেতে যেতে দিব্য আপনার সঙ্গে নিবিষ্ট মনে কথা বলে যাচ্ছে, যেন অন্য কোনও দিকে তার কোনও খেয়াল নেই, অথচ আকাশের কোন কোণে কখন সামান্য এক রত্তি মেঘ জমেছে, কখন একটুখানি হাওয়া কোন দিক থেকে এসে তার টাকের উপর মোলায়েমসে হাত বুলিয়ে গিয়েছে সেটা লক্ষ করেছে ঠিকই, এবং হঠাৎ কথা বন্ধ করে বলবে, চল দাদা, একটু পা চালিয়ে। ওই মুদির দোকানে একটুখানি মুড়ি খাব। দোকানে ঢোকামাত্রই কক্কড় করে বাজ আর টিনের ছাতের উপর চচ্চড় করে গামলা-ঢালা বৃষ্টি। তখন আপনার কানেও জল গেল, আপনার হুঁশিয়ার ইয়ার কোন মুড়ির সন্ধানে মুদির দোকানে ঢুকেছিলেন।
ট্রাম্প মাত্রেরই এ-দুটি কিছু কিছু দরকার। তালেবর ট্রাম্পরা তো কান্টের ভাষায় বলি– মানুষের হৃদয় থেকে আরম্ভ করে আকাশের তারার গতিবিধি নখাগ-দর্পণে ধরে। তারই একজনের সঙ্গে আমার একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল; অনুকূল লগ্নে সেসব কথা হবে।
ওয়াকিফহাল তো নই-ই, দু ব্যাপারেই আমি বে-খেয়াল। কাজেই কখন যে শান্তাকাশের আস্যদেশে কুটির কটা ফেটে উঠেছে সেটা মোটেই লক্ষ করিনি। হঠাৎ ঘোরঘুট্টি অন্ধকার হয়ে গেল– আশ্চর্য। এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না এবং সঙ্গে সঙ্গে–
কণ্ঠের বরণ যাঁর
শ্যাম-জলধরোপম,
গৌরী-ভুজলতা যাহে
রাজে বিদ্যুল্লতা সম
নীলকণ্ঠ প্রভু সেই
করুন সবে রক্ষণ–
আমাকে রক্ষণ না করে রুদ্রের অট্টহাস্য হেসে বৃষ্টি নামলেন আমার মস্তকে মুষল ধারে। এরকম হঠাৎ, আচমকা, ঘনধারা বৃষ্টি আমি আমার আপন দেশেও কখনও দেখিনি।
তবে এটা ঠিক কালো মেঘের উপর সাদা বিদ্যুৎ খেললে কেন সেটা নীলকণ্ঠের নীল-গলার উপর গৌরীর গোরা হাতের জড়িয়ে ধরার মতো দেখায় সেটা সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম হল। বিস্তর বিদ্যুৎ চমকাল বটে।
আর সে কী অসম্ভব বিদ্যুৎ কনকনে সুচিভেদ্য ঠাণ্ডা।
এতদিনে বুঝতে পারলুম, ইউরোপীয় লেখকরা ভারত, মালয়, বর্ষার মৌসুমি বৃষ্টিতে ভিজে কেন লিখেছেন, ওয়ার্ম ট্রপিকাল রেস্। জ্যৈষ্ঠের খরদাহের পর আষাঢ়ের নবধারা নামলে আমরা শীতল হই, সে-বৃষ্টি হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয় না। তাই ইংরেজের কাছে এ বৃষ্টি ওয়োর্ম এবং আনন্দদায়ক। কারণ একে অন্যকে স্বাগত অভ্যর্থনা জানালে সায়েব বলে, আমি তার কাছ থেকে ওয়োর্ম রিসেপশন পেলুম। আর আমরা যদি বলি, আমাকে দেখেই উনি গরম হয়ে উঠলেন তবে অন্য মানে হয়।
যাক এসব আত্মচিন্তা। বাঙলা দেশে মানুষ বহুকাল ধরে তর্ক করেছে, মিষ্টি কথা দিয়ে কোনও জিনিস ভেজানো যায় কি না? কিন্তু উল্টোটা কখনও ভাবেনি–অর্থাৎ মিষ্টি কথা, এ-স্থলে আত্মচিন্তা দিয়ে সেলিকাজেলের মতো ভিজে জিনিস শুকনো করা যায় কি না? আবার এ-বৃষ্টি আসছে চতুর্দিক থেকে, নাগাড়ে এবং ধরণী অবলুপ্ত।
অবশ্য দশ মিনিট যেতে না যেতেই আমার ভিজে যাওয়া ভাবনা লোপ পেল। অল্প ভেজা থেকে মানুষ আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করে কিন্তু ভিজে ঢোল হয়ে যাওয়ার পর তার সেই উদ্বেগ কেটে যায়। মড়ার উপর এক মণও মাটি, একশো মণও মাটি। কিংবা সেই পুরনো দোহা,
অল্প শোকে কাতর।
অধিক শোকে পাথর—
হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলেছি। একটা গাড়ি কিংবা মানুষের সঙ্গেও দেখা হল না। গৌরী ও নীলকণ্ঠেও বোধহয় দু-লোকের পিকনিক সমাপন করে কৈলাসে ফিরে গিয়েছেন। বিদ্যুৎ আর চমকাচ্ছে না। ঘোরঘুট্টি অন্ধকার।
অনেকক্ষণ পরে আমার বাঁ দিকে দিক বলতে পারব না– অতি দূরের আকাশে একটা আলোর আভা পেলুম। প্রায় হাতড়ে হাতড়ে সামনে বাঁয়ে মোড় নিলুম। আভাটা কখনও দেখতে পাচ্ছি, কখনও না। যখন আলোটা বেশকিছু পরিষ্কার হয়েছে তখন সামনের কয়েকটা গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এল একটা জোরদার বাড়ির আলো! বাঁচলুম।
কই বাঁচলুম? বাড়ির সামনের সাইনবোর্ডে আলোতে আলোতে লেখা তিন সিংহ! বলে কী? ঘরে ঢুকে তিনটে সিঙির মুখোমুখি হতে হবে নাকি?
নাঃ। অতখানি জর্মন ভাষা আমি জানি। এরা এদের বার হোটেল পাব-এর বিদঘুঁটে বিদঘুঁটে নাম দেয়। তিন সিংহ, সোনালি হাঁস– আরও কত কী।
দরজা খুলেই দেখি, আমি একটা খাঁচা কিংবা লিফটের মতো বাক্সে দাঁড়িয়ে আছি। আমি আমার ভেজা জামাকাপড় নিয়ে কী করে ঢুকব সে সম্বন্ধে সচেতন ছিলুম বলে লক্ষ করলুম, পায়ের তলায় জাফরির ফুটোওলা পুরো রবারের শিট। ভয়ে ভয়ে সামনের দরজা খুলে দেখি বিরাট এক নাচের ঘর পাস বার-পাব। অথচ একটিমাত্র খদ্দের নেই। এক প্রান্তে বার। পিছনে একটি তরুণী। সাদামাটা কাপড়েই অতি সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি মুখ ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখে বেশ একটু চেঁচিয়ে বললে, ভিতরে আসুন না? আমি আমার জামাকাপড় দেখিয়ে বললুম, আমি যে জলভরা বালটির মতো। বললে, তা হোক। তার পর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে, একটা জাফরির রবারের পর্দা চলে গিয়েছে ঘরের অন্য প্রান্তের বাথরুম অবধি। আমি ওইটে ধরে ধরে বেবাক ঘর না ভিজিয়ে যখন প্রায় বাথরুমের কাছে পৌঁছেছি তখন মেয়েটি কাউন্টার ঘুরে পার হয়ে আমার কাছে এসে বললে, আপনি ভিতরে ঢুকুন। আমি আপনাকে তোয়ালে আর শুকনো কাপড় এনে দিচ্ছি।
গ্রামাঞ্চলে এরা এসব আকছারই করে থাকে, না আমি বিদেশি বলে? কী জানি? শহরে এরকম ঢোল আপন বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও ঢুকতে কখনও দেখিনি।
শার্ট সুয়েটার, প্যান্ট আর মোজা দিয়ে গেল। অবশ্য বাহারে নয়। বাহার! :! আমি তখন গজাসুর বা ব্যাঘ্রচর্ম পরে কৃত্তিবাস হতে রাজি আছি!
চার সাইজের বড় রবারের জুতা টানতে টানতে বার-এর নিকটতম সোফায় এসে হেলান দিয়ে এলিয়ে পড়লুম। মেয়েটি শুধালে, আপনি কী খাবেন? আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললুম, যাচ্ছেতাই।
এবার যেন কিঞ্চিৎ দরদ-ভরা সুরে বললে, গরম ব্র্যান্ডি খান। আপনি যা ভিজেছেন তাতে অসুখ-বিসুখ করা বিচিত্র নয়। আমার কথা শুনুন। আমি সবাইকে ড্রিঙ্ক দি। জানি, কখন কী খেতে হয়।
আমি তখন ট্র্যাম্পিঙের অন্নপ্রাশনের দিনেই নিমতলাগমন ঠেকাতে ব্যস্ত। পূর্বোল্লিখিত গজাসুরের গজ-বসাও খেতে প্রস্তুত। বললুম, তাই দিন।
গরম ব্র্যান্ডি টেবিলের উপর রেখে বললে, ‘ৎসুম ভোল জাইন’। এটা এরা সবসময়ই বলে থাকে। অর্থ বোধহয় অনেকটা এটা দ্বারা আপনার মঙ্গল হোক।
আমি বললুম, ধন্যবাদ। আপনি কিছু একটা নিন। বললে, আমার রয়েছে।
আমি এক চুমুক খাওযার বেশ কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি বার-এর পিছন থেকে শুধোল, আপনি যদি নিতান্ত একা বসে না থাকতে চান তবে আমি সঙ্গ দিতে পারি। আমি খাড়া হয়ে উঠে বসে বললুম, নিশ্চয় নিশ্চয়। আস্তেজ্ঞা থোক, বোস্তেজ্ঞা হোক। মেয়েটি এসে একটি চেয়ার একটুখানি দূরে টেনে নিয়ে এক জানুর উপর আরেক জানু তুলে বসল।
কী সুন্দর সুডৌল পা দুটি!
.
১৪.
হিটলার যখন মস্কোর চৌকাঠে তখন তিনি তার খ্যাতির মধ্যগগনে। ওই সময় লাঞ্চ-ডিনার খাওয়ার পর তিনি যেসব বিশ্রম্ভালাপ করতেন সেগুলো তার সেক্রেটারি বরমানের আদেশে লিখে রাখা হয়। তারই একাধিক জায়গায় হিটলার রমণীদের সম্বন্ধে নিজের অভিজ্ঞতা ও মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, আমরা শহরের রঙচঙা সুন্দরীদের দেখে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে, গ্রামের সুন্দরীরা আর আমাদের চোখে পড়ে না। অথচ তার মতে,সিনেমাওয়ালাদের সুন্দরীর সন্ধানে বেরোতে হলে যাওয়া উচিত গ্রামাঞ্চলে– সৌন্দর্যের খনি সেখানে।
লেখাটি পড়েছি আমি অনেক পরে, কিন্তু সেই অঝোরে ঝরার রাত্রে কেটে কির্ষনারকে দেখে আমার মনে এই তত্ত্বটির আবছা আবছা উদয় হয়েছিল। তার দেহটি তো স্বাস্থ্যে পরিপূর্ণ ছিলই, তদুপরি চোখে ছিল একটি অবর্ণনীয় শান্ত মধুর ভাব। চুল ছিল চেনাট ব্লন্ড এবং এমনি অদ্ভুত ঝিলিক মারত যে মনে হত যেন তেল ঝরে পড়ছে, যদিও জানি ইয়োরোপের মেয়েরা চুলে তেল মাখে না।
আমার টেবিলে আসার সময় সে তার অর্ধসমাপ্ত বিয়ারের গেলাস সঙ্গে এনেছিল। ঢাউস হাফ-লিটারের পুরু কাঁচের মগ। ক্যেটের চোখ দুটি ঈষৎ রক্তাভ। সেটা বিয়ার খেয়ে হয়েছে, না, চোখের জল ফেলে হয়েছে বুঝতে পারলুম না। আবার এটাও তো হতে পারে যে কেঁদে কেঁদে যখন সান্তনা পায়নি তখন শোক ভোলার জন্য বিয়ার খেয়েছে। কিন্তু আমিই-বা এত সেন্টিমেন্টাল কেন? পৃথিবীটা কি শুধু কান্নাতেই ভরা?
ইতোমধ্যে প্রাথমিক আলাপচারী হয়ে গিয়েছে।
আমি বার দুই বিয়ার-মগের দিকে তাকিয়ে বললুম, আমাদের দেশে প্রবাদ আছে ময়রা সন্দেশ খায় না।
কেটে হেসে বললে, এ-দেশেও মোটামুটি তাই। তবে আমি খাচ্ছি অন্য কারণে। তা-ও সমস্ত দিন, এবং জালা জালা।
এদেশে বিয়ার খাওয়াটা নিন্দনীয় নয় বরঞ্চ সেইটেই স্বাভাবিক কিন্তু পিপে পিপে খাওয়াটা নিন্দনীয়, আর মাতলামোটা তো রীতিমতো অভদ্র, অন্যায় আচরণ বলে স্বীকৃত হয়েছে। আমাদের দেশে যেরকম একটু-আধটু তাস খেলা লোকে মেনে নেয় কিন্তু জুয়ো খেলে সর্বস্ব উড়িয়ে দেওয়া পাপ বলে ধরা হয়।
কেটে কেন জালা জালা খায় সেটা যখন নিজের থেকে বললে না, তখন আমিও আর খোঁচাখুঁচি করলুম না। শুধালুম, আমি এখানে আসার সময় আকাশে একটা আলোর আভা দেখতে পেয়েছিলুম। সেটা কিসের?
ও, সে তো রাইন নদীর ঘাট আর জাহাজগুলো।
আমি অবাক হয়ে বললুম, আমি কি রাইনের পারে এসে পৌঁছে গিয়েছি।
হেসে বললে, যা বৃষ্টি হচ্ছে তাতে আপনি যে আপন অজানাতে পায়ে হেঁটেই রাইন পেরিয়ে ওপারে চলে যাননি সে-ই তো আশ্চর্য! আমাদের পাবৃ থেকে রাইন তো অতি কাছে। আসলে আমাদের খদ্দেরও অধিকাংশ রাইনের মাঝি-মাল্লারা। সন্ধ্যার সময় নোঙর ফেলে এখানে এসে বিয়ার খায়, নাচানাচি করে এবং মাঝে মাঝে মাতলামোও! সেলার কি না! আজ জোর বৃষ্টি নেমেছে বলে পাব একেবারে ফাঁকা। আমার আজ বড্ড ক্ষতি হল।
আপনার ক্ষতি? আমি তো ভেবেছিলুম, আপনি এখানে কাজ করেন।
ক্ষণতরে শ্রীমতীর মুখ একটু গম্ভীর হল। মুনিবকে চাকর বললে তাঁর যে ভাব পরিবর্তন হওয়ায় কথা। তার পর ফের একটু হাসলে। বোধহয় ভাবল, বিদেশি আর বুঝবেই-বা কী? বললে, না। এটা আমার পাব। অর্থাৎ মায়ের পাব। আমরা দুই বোন। ছোট বোন ইস্কুলে যায় আর পাব চালাবার মতো গায়ের জোর মার নেই। তাই আমি এই জোয়ালে বাঁধা। অবশ্য আমি কাজ করতে ভালোবাসি। কিন্তু সকাল আটটা-ন টা থেকে রাত একটা অবধি কাজ করা চাট্টিখানি কথা নয়। ছোট বোনটা ইস্কুল থেকে ফিরে এসে মাঝে মাঝে আমাকে জোর করে ঘরে নিয়ে শুইয়ে দেয়। অবশ্য একটা ঠিকে আছে। কিন্তু সে বেচারির আবার শিগগির বাচ্চা হবে।
কেটে যেভাবে সব কথা নিঃসঙ্কোচে খোলাখুলি বলে যাচ্ছিল তাতে আমি ভরসা পেয়ে হেসে বললুম, তা আপনি একটা বিয়ে করলেই পারেন, এত বড় ব্যবসা তায় আপনি সুন্দরী।
চুপ করো– হঠাৎ কেটে আপনি থেকে তুমিতে চলে এল। বললে, চুপ কর। আমি গায়ে থাকি বলে কী গাইয়া? আমি কী জানিনে ইন্ডিয়ান নর্তকীরা কী অদ্ভুত সুন্দরী হয়? বর্ণটি সুন্দর শ্যাম, মিশমিশে কুচকুচে কালো চুল, লম্বা লম্বা জোড়া চোখ, চমৎকার বাস্ট আর হিপ।
আমি গলা খাকারি দিয়ে বললুম, তুমি অত শত জানলে কোত্থেকে?
বললে, এইসব মাঝি-মাল্লারা এখানে বিয়ার খেতে আসে তাদের অনেকেই ভাটি রাইনে হল্যান্ড অবধি যায়। সেখানে সমুদ্রের জাহাজে কাজ নিয়ে কেউ কেউ তামাম দুনিয়া ঘুরে বেড়ায়। তাদেরই দু-একজন মাঝে মাঝে আমাকে ভিন্ন ভিন্ন দেশের ছবির পোস্টকার্ড পাঠায়। বিশেষ করে যারা আমার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে খানিকটে হতাশ হয়েছে তারা ইন্ডিয়া, ঈজিপ্ট থেকে খুবসুরত মেয়েদের ছবি পাঠিয়ে জানাতে চায়, তুমি তো আমাকে পাত্তা দিলে না; এখন দেখ, আমি কী পেয়েছি।
আমি রক্তের গন্ধ পেয়ে বললুম, সুন্দরী ক্যেটে, তুমি যে বললে, যারা তোমার সঙ্গে প্রেম করতে গিয়ে খানিকটে হতাশ হয়েছে– এ কথাটার প্রকৃত অর্থ আমাকে প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝিয়ে বলবে কি?
ক্যেটে বললে, সুন্দরী! বেশ বলেছ চাঁদ! কিন্তু সেকথা থাক। রাত একটা বেজেছে! পোলিৎসাই স্টুন্ডে পুলিশ-আওয়ার্স– অর্থাৎ পাব বন্ধ করতে হবে। এই ঝড়-বৃষ্টিতে এখন তুমি যাবে কোথায়? উপরে চল
আমি বাঙলা দেশের ছেলে। অন্য কারণে যা হোক তা হোক, কিন্তু বৃষ্টির ভয়ে আমি কারও বাড়িতে করুণার অতিথি হব–সেটা আমার জাত্যাভিমানে জব্বর লাগে। অবশ্য এই পোড়ার দেশে বারান্দা, রক, ভিলিকিনি (ব্যালকনি) নেই বলে শুকনো নদীর পোলের তলা ছাড়া অন্য কোথাও বৃষ্টির সময় গা বাঁচানো যায় না। বললুম, দেখো ফ্রলাইন কেটে
ক্যেটের অল্প নেশা হয়েছে কি না জানিনে শুনেছি, অল্প নেশাতে নাকি মানুষের সাহস বেড়ে যায় কিংবা সে টেরমের-গিন্নীর মতো তথাকথিত খাণ্ডারিনী কিংবা সত্যই প্রেমদায়িনী জানিনে। আমার দিকে কটকট করে তাকিয়ে বললে, চুপ!
তার পর উঠে গিয়ে সব কটা জানালার কাঠের রেলিঙে পর্দা নামালে এতক্ষণ শুধু শার্সিগুলো বন্ধ ছিল মেন দরজা আর সেই লিফটপানা খাঁচার ডবল তালার ডবল চাবি ঘোরালে, বারের পিছনে গিয়ে দু মিনিটে ক্যাশ মেলালে, সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে পটপট করে সে ঘরের চোদ্দটা আলো নেভালে, উপরে যাবার আলো জ্বালিয়ে দিয়ে আমাকে বললে, চল।
উপরে গিয়ে একটা কামরার দরজা খুলে আলো জ্বালালে। সত্যি সুন্দর ঘর। চমৎকার আসবাবপত্র। এক কোণে বাহারে কটেজ পিয়ানো। দেয়ালে নানা দেশের তীর-ধনুক ঝোলানো। একপ্রান্ত অতি সূক্ষ্ম ডাচ লেসের কাজওলা বেড-কভার দিয়ে ঢাকা বিরাট রাজসিক কালো আবলুশ কাঠের পালঙ্ক।
বললে, বস। আমি এখন দুটো গিলব। এই ঘরেই নিয়ে আসছি। রোজ রাত্রে আমাকে একা খেতে হয়, বড় কষ্ট লাগে। তোমার খাওয়া হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। তবে দাঁড়াও, এই সিগারেটটা খাও। বলে সেন্টার টেবিলের উপর থেকে একটি সিগারেট নিয়ে ধরালে। আমার হাতে দিয়ে বললে, খাও। এ রমণী সম্পূর্ণ লৌকিকতা-বর্জিতা।
দশ মিনিট পরে এল বিরাট এক ট্রে হাতে করে। তাতে দু প্লেট সুপ, দু প্লেট সার্ডিন সসিজ-অলিভ, গুচ্ছের রুটি-মাখন। টেবিলে সাজিয়ে, দু খানা চেয়ার মুখোমুখি বসিয়ে বললে, আরম্ভ করো। আমি মারিয়ানার ঠাকুরমার মতো আদেশ করলুম, কেটে, ফাঙে মাল আন– আরম্ভ কর অর্থাৎ প্রার্থনা কর। ক্যেটের হাত থেকে ঠং করে চামচ-কাটা পড়ে গেল। ফ্যাল ফ্যাল করে আমার দিকে তাকালে।
শ্ৰীমতী ক্যেটেকে লজ্জা দেবার জন্য যে আমি উপাসনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলুম তা নয়, আসলে আমি এ বাবদে চার্লস ল্যামের শিষ্য। তিনি বলেছেন, খাবার পূর্বের এই প্রার্থনা কেমন যেন বেখাপ্পা। বরঞ্চ ভোর-বেলায় শান্ত মধুর পরিবেশে বেড়াতে বেরোবার পূর্বে, কিংবা চাঁদনী রাতে হেথা-হোথা চলতে চলতে আপন-ভোলা হয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে, কিংবা বন্ধু-সমাগমের পূর্বমুহূর্তের প্রতীক্ষাকালে ভিন্ন ভিন্ন উপাসনার প্রয়োজন। শুধু তাই? মিলটন পঠন আরম্ভ করার সময় বিশেষ প্রার্থনা করা উচিত, শেক্সপিয়ারের জন্যে অন্য উপাসনা এবং ফেয়ারি কুইন পড়ার পূর্বে অন্য এক বিশেষ উপাসনার প্রয়োজন। ভোজনকর্মের চেয়ে এসব জিনিসের মূল্য আমাদের জীবনে অনেক বেশি। প্রার্থনা যদি করতে হয় তবে এগুলোর জন্য আলাদা আলাদা প্রার্থনা তৈরি করে রাখার প্রয়োজন।
ল্যামকে আমি শ্রদ্ধা করি অন্য কারণে। এই কার্যারম্ভের উপাসনা সম্বন্ধে বিবৃতি দেবার সময় তিনি এক জায়গায় বলেছেন, হায়! শাক-শবজির জগৎ থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি– ওসব আর খেতে ভালো লাগে না, কিন্তু এখনও যখন এসপেরেগাস সামনে আসে তখন আমার মন মধুর আত্মচিন্তায় নিমগ্ন হয়। আপ্তবাক্য, আপ্তবাক্য, এ একটা আপ্তবাক্য!
আমার অনুরাগী পাঠকদের বলি, আমার লেখা যে আগের চেয়েও ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে তার প্রধান কারণ বহুকাল ধরে এসপেরেগাসের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই। তাজাটার কথা হচ্ছে না, তিনি মাথায় থাকুন, টিনেরটার কথাই বলছি। সরকার আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। সেঁকো বিষ না কি এখনও আসে।
খুব অল্প লোকই মুখের লাবণ্য জখম না করে চিবোনো কর্মটি করতে পারে। আমি একটি অপরূপ সুন্দর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মহিলাকে চিনতুম। চিবোবার সময় তাঁর দুই চোয়ালের উপরকার ছোট ছোট মাংসপেশিগুলো এমনই ছোট ছোট দড়ির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠত যে বোধ করি তিনি সেটা জানতেন, তাই যতদূর সম্ভব মাথা নিচু করে একদম প্লেটের কাছে ঝুঁকে পড়ে মাংস চিবোতেন। কোটের বেলা দেখলুম উল্টোটা। খাবার সময় তার মুখের হাসি হাসি ভাবটা যেন আরও বেড়ে গেল। অবশ্য সে খেল অল্পই। বিয়ার পান করল প্রচুর। উপরে আসবার সময় ঢাউস এক জাগ বিয়ার সঙ্গে এনেছিল।
আমি বললুম, অত বিয়ার খাও কেন? দিনের শেষে না হয় এক আধ-গেলাস খেলে। ওই বিয়ার খেয়ে খেয়ে খিদেটি তো একেবারে গেছে। আমার দেশে অনেকেই চা খেয়ে খেয়ে এরকম পিত্তি চটায়।
আশ্চর্য হয়ে শুধাল, চা খেয়ে খেয়ে! একজন মানুষ দিনে ককাপ চা খেতে পারে?
আমি বললুম, আমার দেশের লোকও ঠিক এইরকম অবাক মেনে শুধোবে, একজন মানুষ দিনে কগেলাস বিয়ার খেতে পারে।
বিরক্তির সুরে বললে, থাক, ওসব কথা। তুমি আর পাঁচজনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওই একই জিগির তুলো না। সমস্ত দিনে ভূতের মতো খাঁটি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! ওই বিয়ারই আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। না হলে হুমড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতুম।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললুম, কিন্তু এর তো একটা সরল সমাধানও আছে। তোমাদের পাবে বিস্তর আমদানি, তুমি দেখতে ভালো, বিয়ে করে একটা ভালো লোক এনে তাকে কাজে ঢুকিয়ে দাও না? তোমাদের দেশে তো শুনেছি, এ ব্যবস্থাটা অনেকেরই মনঃপূত।
ক্যেটের ওই চড়ুইপাখির খাওয়া ততক্ষণে শেষ হয়ে গিয়েছে। চেয়ারটা টেবিলের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে, আরেকখানা চেয়ারের উপরে দু পা লম্বা করে দিয়ে ভস্ভস করে। সিগারেট টানছিল। হেসে বললে, সে এক্সপেরিমেন্ট হয়ে গিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে শুধালাম, এই অল্প বয়সে তোমার আবার বিয়ে হল কী করে?
দূর, পাগলা। আমি না। মা করেছিল এক্সপেরিমেন্টটা। সে তার বাপের একমাত্র মেয়ে। তাই বাবাকে বিয়ে করে এনে সঁপে দিয়েছিল পাবটা তার হাতে।
আমি শুধালাম, তার পর?
চিন্তা করে বললে, সমস্তটা বলা একটু শক্ত। শুনেছি, বাবা কাজ-কারবার ভালোই করত। এ ঘরের মতো আর সব ঘরেও যেসব ভালো আসবাবপত্র আছে সেগুলো ওই সময়েই। কেনা– বাবা লোকটি শৌখিন। তার পর আমার আর আমার ছোট বোনের জন্ম হল। তার পর বাবার বয়েস যখন চল্লিশ– বাবা-মার একই বয়েস তখন সে মজে গেল এক চিংড়ি মেয়ের প্রেমে, বয়েস এই উনিশ, বিশ। তার পর কী হয়েছিল জানিনে, আমি কিছু কিছু দেখেছি, তবে তখনও বোঝবার মতো জ্ঞান-গম্যি হয়নি। শেষটায় একদিন নাকি হঠাৎ মা নিচে এসে বারের পিছনে দাঁড়াল, পাবের হিসেব-পত্র নিজেই দেখতে আরম্ভ করল। তখন বাবা নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।
আমি শুধালাম, ডিভোর্স হয়েছিল?
বললে, না। মা চায়নি, বাবাও চায়নি। কেন চায়নি, জানিনে।
আমি শুধালুম, তার পর কী হল?
ক্যেটে বললে, ঠিক ঠিক জানিনে। তবে শুনেছি, বাবাতে আর ওই মেয়েতে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কার নেশা আগে কেটেছিল বলতে পারব না। তার পর হয়তো বাবা-মাতে ফের বনিবনা হতে পারত, কিন্তু হয়নি। বোধহয় মা-ই চায়নি, অবশ্য আমি সঠিক বলতে পারব না, কারণ মা আমার নিদারুণ আত্মাভিমানিনী– এসব যা বললুম, এর কিছুটা আমার চোখে দেখা, আর কিছুটা পাঁচজনের কাছ থেকে শোনা– মা একদিনের তরে একটি কথাও বলেনি।
আমি শুধালুম, তোমার বাবা
বললে, বুঝেছি। মাইল তিনেক দূরে ওই বস্ ডর্ষে থাকে। অবস্থা ভালো নয়, মন্দও নয়। আমার সঙ্গে মাসে ছ মাসে রাস্তায় দেখা হলে, হ্যাট তুলে আগের থেকেই নমস্কার করে– যেন আমি তার পরিচিতা কতই না সম্মানিতা মহিলা– কাছে এসে কুশলাদিও শুধোয়। বাবার আদব-কায়দা টিপট। মায়ের সঙ্গে দেখা হলেও তাই। একবার আমি মায়ের সঙ্গে ছিলুম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দু জনাতে কথাবার্তাও হল, তার পর যে যার পথ ধরল। এক মগ পুরো বিয়ার শূন্য করে বললে, তোমার বোধহয় ঘুম পেয়েছে?
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললুম, না না, মোটেই না।
আসলে আমার তখন জ্বর-জ্বর ভাব আরম্ভ হয়ে গিয়েছে আর সে সময় সব রক্ত মাথায় উঠে গিয়ে ঘুম দেয় চটিয়ে।
ক্যেটে উঠে বললে, জল ধরেছে। এবারে জানালাটা খুলে দি। দেখবে বৃষ্টিশেষের কী অদ্ভুত সুন্দর ভেজা পাইন-বনের গন্ধ আসছে।
আমি বললুম, এই বিয়ার আর সিগারেটের গন্ধে তোমার তো নাক-মুখ ভরতি, এর ভিতরও সেই অতি সামান্য পাইনের খুশবাই পাও? কেটে জানালা খুলে দিয়ে, দুই কনুই কাঠের উপর রেখে নিঃশব্দে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলুম, যেন আমাদের দেশের কোনও সুন্দরী নারীমূর্তি পিছন থেকে দেখছি। আমাদের দেশের নারীমূর্তি ইচ্ছে করেই বললুম, কারণ ইয়োরোপীয় ভাস্কররা তাদের নারীমূর্তির পিছনের দিকটা বড় অযত্নে খোদাই করে। নিতম্বিনীর ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই।
ফিরে এসে বললে, কিছু মনে করো না, তোমাকে জাগিয়ে রাখছি বলে। তা আমি কী করব, বল। কাজ শেষ করে খেতে খেতে দেড়টা বেজে যায় তখন আমি কার সঙ্গে সোসাইটি করতে যাব? আমার সঙ্গে রসালাপ করার জন্য কেই-বা তখন জেগে বসে?
আমি বললুম, সেরকম প্রাণের সখা থাকলে সমস্ত রাত জানালার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রহর গোনে। পড়োনি বাইবেল, তরুণী শোক করছে, তার দয়িত সমস্ত রাত হিমে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ভিজিয়ে ফেলেছে বলে। অতখানি না থোক; একটা সাদামাটা ইয়াংম্যানই যোগাড় কর না কেন?
বুকের কালো জামায় সিগারেটের ছাই পড়েছিল। সেইটে ঠোকা দিয়ে সরাতে সরাতে বললে, আমার আছে। না, না, দাঁড়াও, ছিল। কী জানি, ছিল না আছে, কী করে বলব।
আমি অবাক হয়ে শুধালুম, সে কী? এ আবার কীরকম কথা?
বললে, প্রথম যেদিন তাকে ভালোবেসেছিলুম সেদিনকার কথার স্মরণে আজও আমার মনপ্রাণ গভীর শান্তিতে ভরে যায়। আজও যদি তাই থাকত তবে এতক্ষণে ছুটে যেতুম না তার বাড়িতে তাকে ধরে নিয়ে এসে তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে? এই রাত তিনটেয়ও।
.
১৫.
ছেলেবেলায় শরচ্চাটুজ্যের আত্মজীবনীমূলক প্রমণ-কাহিনীতে পড়েছিলুম, একদা গভীর রাতে হৃদয়-তাপের ভাপে ভরা একখানা চিঠি লিখে সেই গভীর রাতেই সেখানা পোস্ট করতে যান, কারণ মনে মনে বিলক্ষণ জানতেন, ভোরে আলো ফুটে ওঠার পর সাদা চোখে তিনিও চিঠি ডাকে ফেলতে পারবেন না। শরচ্চাটুজ্যে কোনও প্রকারের নেশা না করে শুধু নিশীথের ভূতে পেয়েই বে-এক্তেয়ার হয়েছিলেন, আর এস্থলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এতক্ষণে বিয়ার এ-মেয়ের মাথায় বেশ কিছুটা চেপেছে– কাজের জিম্মাদারিতে মগ্ন সচেতন মন ওটাকে ক্যাশ না মেলানো অবধি আমল দেয়নি এবং জ্বরের তাড়সানিতে আমিও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নই; এবং মেয়েটি কী বলতে যে কী বলে ফেলবে আর পরে নিজের কাছে নিজেই লজ্জিত হবে সেই ভেবে আমি একটু শঙ্কিত হলুম।
হঠাৎ চেয়ারটা কাছে টেনে এনে আমার দিকে ঝুঁকে বললে, তুমি ভাবছ, আমি আমার হৃদয়টাকে জামার আস্তিনে বয়ে বয়ে বেড়াই না? আর যে কেউ একজনকে পেলেই তার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার কোটের পিছন দিকটা ভিজিয়ে দিই– না?
আমি অনিচ্ছায় বললুম, আর বললেই-বা কী? আমরা প্রায় একয়েসী, তায় আমি বিদেশি, কাল চলে যাব আপন পথে–
কী বললে? কাল চলে যাবে? কী করে যাবে শুনি? আমি কি লক্ষ করিনি যে তোমার জ্বর চড়ছে? এখন তোমাকে শুতে দেওয়াই আমার উচিত। কিন্তু তাতে কোনও লাভ নেই। জ্বর তার চরমে না ওঠা পর্যন্ত এখন তুমি শুধু এপাশ-ওপাশ করবে, আর মাথা বনবন করে ঘুরবে। তাই কথাবার্তাই বলি। জ্বরের পর অবসাদ যখন আসবে তখন উঠব।
আমি এতক্ষণ একটা সুযোগ খুঁজছিলুম আমার এখানে থাকা-খাওয়ার দক্ষিণার কথাটা তুলতে। মোকা পেয়ে বললুম, দেখো লাইন কেটে
ফ্রলাইন বলতে হবে না।
আমি বললুম, সুন্দরী কেটে, কাটেরিয়া, অর্থাৎ ক্যারিন, আমি বেরিয়েছি হাইকিঙে। তুমি আমার কাছ থেকে যত কমই নাও না কেন ইন, হোটেল ক্লাইপেতে থাকবার মতো রেস্ত আমার পকেটে নেই। কালই আমাকে যেতে হবে।
ক্যেটে আপন মনে একটু হাসলে। তার পর বললে, তুমি বিদেশি, তদুপরি গ্রামাঞ্চলে কখনও বেরোওনি। না হলে বুঝতে এটা হোটেল নয়, এখানে রাত্রিবাসের কোনও ব্যবস্থা নেই। এ ঘরটা আমাদের আপন আত্মীয়-স্বজনের জন্য গেস্টরুম, এরকম আরও দু তিনটে আছে। প্রায় সংবৎসরই ফাঁকা পড়ে থাকে। কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। আসল কথা হচ্ছে, তুমি ভাবছ আমরা পাব চালাই বলে আমাদের আর কোনও লৌকিকতা, সামাজিকতা নেই– দয়া-মায়া, দোস্তি-মহব্বতের কথা না হয় বাদই দিলুম। ভালোই হল। এবার থেকে যখন আমার গড়-ফাদার ও ঘরটায় শোবে, সকালবেলা ব্রেকফাস্টের সঙ্গে তাকে একটা বিল দেব?
আমি আর ঘাঁটালুম না। আমি অপরিচিত, অনাত্মীয় এসব কথা রাত তিনটের সময় সুন্দরী তরুণীর সামনে তা-ও নির্জন ঘরে তুলে কোনও লাভ নেই। আমার শুধু আবছা-আবছা মনে পড়ল, আফ্রিকা না কোথায়, মার্কো পোলো গাছতলায় বসে ভিজছেন আর একটি নিগ্রো তরুণী গম না ভুট্টা কী যেন পিষতে পিষতে মাকে গান গেয়ে গেয়ে বলছে, মা, ওই বিদেশিকে বাড়ি ডেকে এনে আশ্রয় দি। সত্যেন দত্ত গানটির অনুবাদ করেছেন। এবং এ-কথাটাও এ-প্রসঙ্গে মনে রাখা উচিত, খাস নিগ্রোরা সাদা চামড়ার লোককে বড় তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখে আমাদের মতো সাদা-পাগলা নয়।
নিগ্রো তরুণীর মায়ের কথায় আমাদের কথা মোড় ঘোরাবার সুযোগ পেলুম। বললুম, হোটেল যদি না হয়, তবে এরকম অপরিচিতকে ঘরে আনাতে তোমার মা কী ভাববে?
পাছে বাড়ির লোক ডিস্টার্বড় হয় তাই রুমাল দিয়ে মুখ চেপে কেটে তার খলখলানি হাসি থামাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু হাসি আর থামতেই চায় না। আমি বেকুবের মতো তাকিয়ে রইলুম।
অনেকক্ষণ পরে গুমরানো হাসি চেপে-ছেড়ে বললে, তোমার মতো সরল লোক আমি সত্যই কখনও দেখিনি। তোমার কল্পনাশক্তিও একেবারেই নেই। আচ্ছা ভাবো তো, রাত বারোটার সময় তিনটে আধা-মাতাল মাল্লা যদি আমার পাবে ঢুকে বিয়ার চায়, তখন কি
আমি তাদের তাড়িয়ে দিই? সেলার মানে বাপের সুপুতুর নয়। আমি দেখতে মন্দ না। পাবও নির্জন। ওরা বারে দাঁড়িয়ে গাল-গল্প এমনকি ফষ্টি-নষ্টির কথা বলবেই বলবে। তখন কি মা এসে আমার চরিত্র রক্ষা করে?
আমি আমতা আমতা করে বললুম, তা বটে, তা বটেই তো। কিন্তু বল তো, ওরা যদি বিয়ার খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে যেতে চায় তখন তুমি কী করো?
হেসে বললে, দেখবে? তার পর উঠে গিয়ে ঘরের দরজা একটুখানি ফাঁক করে আস্তে আস্তে মাত্র একবার শিস দিলে। অমনি কাঠের সিঁড়িতে কিসের যেন শব্দ শুনতে পেলুম। আর সঙ্গে সঙ্গে দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকল ভীষণদর্শন বিকটের চেয়েও বিকট ইয়া বিশাল এক আলসেশিয়ান। আমার দিকে যেভাবে তাকালে তাতে আমি লাফ দিয়ে জুতোসুদ্ধ উঠে দাঁড়াই খাটের উপর। ভয়ে আমার মুখ দিয়ে কথা ফুটছে না যে বলব, ওকে দয়া করে বের কর। ক্যেটের তবু দয়া হল। কুকুরটাকে আদর করতে করতে বললে, না, ব্রুনো, ইনি আমাদের আত্মীয়। বুঝলি? এবার আরও বিপদ। ব্রুনো ন্যাজ নাড়তে নাড়তে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন আমার প্যারে নেবার জন্য। আমি হাত জোড় করে বললুম, রক্ষে কর, নিষ্কৃতি দাও।
ক্যেটে বললে, কিচ্ছু না। শুধু ব্রুনোকে বলতে হয়, ওই তিনটে লোককে ঠেকা তো। ব্যস! সে তখন দরজায় দাঁড়িয়ে তিনটে বেহেড সেলারকে ঠেকাতে পারে। অবশ্য এরকম ঘটনা অতিশয় কালে-কম্মিনে ঘটে। বাপের সুপুতুররা তখন সুড়সুড় করে পয়সা দিয়ে পালাবার পথ পায় না। অবশ্য রাইন নদীর প্রায় সব সেলারই পুরুষানুক্রমে এ পাব চেনে। নিতান্ত ডাচম্যান কিংবা ওই ধরনের বিদেশি হলে পরে আলাদা কথা– তা-ও তখন ‘পাবে’ অন্য খদ্দের থাকলে কেউ ওসব করতে যায় না।
তার পর বললে, তুমি এখন একটু ঘুমাবার চেষ্টা কর। আমি তোমাকে একটা নাইট-শার্ট দিচ্ছি। ঘরের আলমারিতেই ছিল। বললে, আমি এখনি আসছি। আমি আর লৌকিকতা না করে কোট-পাতলুন ছেড়ে সেই শেমিজ-পারা নাইট শার্ট পরে লেপের ভিতর গা-ঢাকা দিলুম।
হে মা মেরি! এ কী? কেটে আরেক জাগ বিয়ার নিয়ে এসেছে!
আমি করুণ কণ্ঠে বললুম, আর কত খাবে?
বিরক্তির সুরে বললে, তুমিও ওর সঙ্গে ভিড়লে নাকি?
আমি বললুম, না, বাপু, আমি আর কিছু বলব না। একদিন, না হয় দু দিনের চিড়িয়া, আমার কোথায়-বা সুযোগ, কীই-বা শক্তি। কিন্তু এবারে তুমি ওর সঙ্গে ভিড়লে নাকি? বললে। সেই ও-টি কে?
অটো। যাকে ভালোবাসি, না বাসিনে বুঝতে পারছিনে, তাই বলেছিলুম, সে আছে কি নেই জানিনে।
আমি বললুম, তুমি বড় হেঁয়ালিতে হেঁয়ালিতে কথা বল।
আদপেই না। আসলে তুমি বিদেশি বলে আমাদের আচার-ব্যবহার সামাজিকতা লৌকিকতা জানো না। তাই তোমার অনেক জিনিস বুঝতে অসুবিধে হয়, যেগুলো আমাদের দশ বছরের বাচ্চার কাছেও জলের মতো তরল। যেমন তুমি হয়তো মনে করছ আমি বার-এর পিছনে দাঁড়িয়ে বিয়ার বিক্রি করি বলে আমি বার-মেড়। এবং বারমেডরা যে সচরাচর খদ্দেরকে একাধিক প্রকারে তুষ্ট করতে চায়– প্রধানত অর্থের বিনিময়ে সেটাও কিছু গোপন কথা নয়। বিশেষত শহরে। গ্রামে ঠিক ততখানি নয়। আমি যদি এখানে কাজের সাহায্যের জন্য ঠিকে নি, তবে সে আমাদের চেনা-শোনারই ভিতরে বলে ততখানি বে-এক্তেয়ার হতে সাহস পাবে না। আর আমি, আমার মা-বোন, দাদামশাই আমরা পাব-এর মালিক। আমরা যদি মুদি, দরজি বা গারাজের মালিক হতুম তা হলে আমাদের সমাজ আমার কাছ থেকে যতখানি সংযম আশা করত এখনও তাই করে। অবশ্য বাড়িতে ব্যাটাছেলে থাকলে সে-ই বার-এর কাজ করত, ভিড়ের সময় মা-বোনেরা একটু-আধটু সাহায্য করত। মুদি কিংবা কসাইকে যেমন তার বউ-বেটি সাহায্য করে থাকে। তার পর হঠাৎ এক ঝলক হেসে নিয়ে বললে, তুমি ভাবছ, আমি মব, না? জাতের দেমাক করছি। আমি বার-মেডের মতো ফ্যালনা নই –রীতিমতো খানদানি মনিষ্যি, না?
.
১৬.
আমি চুপ। যে-মেয়ে মাতাল সেলারদের সামলায় আমি তার সঙ্গে পারব কেন?
ক্যেটে বললে, তবে শোন–
আচ্ছা বল তো, তোমার কখনও এমনধারা হয়েছে, যে-জিনিস দেখে দেখে সম্পূর্ণ অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলে সে হঠাৎ একদিন দেখা দিল অপরূপ নবরূপ নিয়ে? এই যে দিক্ধেড়েঙ্গে অটো-টা, চুল ছাঁটা যেমন পিনকুশনের মাথাটা, হাত দু খানা যেমন বেঢপ বেঁটে থাকগে, বর্ণনা দিয়ে কী হবে– একে দেখে আসছি যবে থেকে জ্ঞান হয়েছে, ইস্কুল গিয়েছি ফিরেছি একসঙ্গে, কখনও মনে হয়নি পাড়ার আর পাঁচটা বাঁদর আর এ বাঁদরে কোনও তফাত আছে, অথচ হঠাৎ একদিন তার দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল, এ কাকে দেখছি? সে সুন্দর কি না, কুশ্রী কি না, কিছুই মনে হল না, শুধু মনটা যেন মধুতে ভরে উঠল আর মনে হল, এ আমার অটো, একে আরও আমার করতে হবে।
তুমি বিশ্বাস করবে না, ঠিক সেই মুহূর্তেই সে-ও আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে আমি নিঃসন্দেহে বুঝতে পারলুম, সে-ও ঠিক ওই কথাটিই ভেবেছে।
আর এমন এক নতুনভাবে তাকাল যে আমার লজ্জা পেল। আমার মনে হল, পুলওভারটার উপর কোটটা থাকলে ভালো হত।
আচ্ছা, বল তো, এ কি একটা রহস্য নয়! যেমন মনে কর, তুমি আমার একখানা বই দেখে মুগ্ধ হয়ে বললে, চমৎকার বই! আমি কি তখন তোমাকে সেটি এগিয়ে দেব না, যাতে করে তুমি আরও ভালো করে দেখতে পার?
চুপ করে উত্তরের প্রতীক্ষা করছে বলে বললুম, আমি কী করে বলব? আমি তো ব্যাটাছেলে।
বললে, অন্য দিন ইস্কুল থেকে ফিরে বাড়ির কাজে লেগে যাই, আজ বার বার মনে হতে লাগল, যাই একবার অটোকে দেখে আসি। যাওয়া অত্যন্ত সোজা। কোনও অছিলারও প্রয়োজন নেই। তার দু দিন আগেই তো এক বিকেলের ভিতর মা আমায় অটোদের বাড়ি পাঠিয়েছে তিন-তিনবার– এটা আনতে, সেটা দিতে। তাছাড়া ইস্কুলের লেখাপড়া নিয়ে যাওয়া-আসা তো আছেই। কিন্তু তবু কেন, জানো, যেতে পারলুম না। প্রতিবারে বাড়িয়েই লজ্জা পেল। খুব ভালো করেই জানি, মা কিছু জিগ্যেস করবে না, তবু মনে হল, মা বুঝি শুধোবে, এই! কোথা যাচ্ছিস? আর জিগ্যেস করলেই-বা কী? কতবার বেরুবার সময় নিজের থেকেই তো বলেছি, মা, আমি ঝপ করে এই অটোদের বাড়ি একটুখানি হয়ে আসছি। মা হয়তো শুনতেই পেত না।
তবু যেতে পারলুম না। আর সর্বক্ষণ মনে হল, মা যেন কেমন এক অদ্ভুত নতুন ধরনে আমার দিকে তাকাচ্ছে।
অন্য দিন বালিশে মাথা দিতে না দিতে আমার ঘুম ঘোর। আজ প্রহরের পর প্রহর গির্জে-ঘড়ির ঘণ্টা শুনে যেতে লাগলুম রাত বারোটা পর্যন্ত। আর মনে হল সুস্থ মানুষ বিদ্রিদের কথা চিন্তা করে ঘড়ির ঘণ্টা বানায়নি! সন্ধ্যাটা ছটা ঘণ্টা দিয়ে শুরু না করে যদি একটা ঘণ্টা দিয়ে শুরু করত তবে রাত বারোটায় তাকে শুনতে হত মাত্র ছটা ঘণ্টা। এখন পৃথিবীতে যা ব্যবস্থা তাতে যাদের চোখে ঘুম নেই তাদের সেই ঠ্যাং-ঠ্যাং করে বারোটার ঘন্টা না শোনা অবধি নিষ্কৃতি নেই।
তার পর আরম্ভ হল জোর ঝড়-বৃষ্টি। ঝড়ের শো-শোঁ আওয়াজ আর খড়খড়ি জানালার ঝড়ঝড়ানি আমার শুয়ে শুয়ে শুনতে বড় ভালো লাগে, কিন্তু আজ হল ভয়, কাল যদি এরকম ঝড় থাকে তবে মা তো আমাকে ইস্কুল যেতে দেবে না। অটোকে দেখতে পাব না। পরখ করে নিতে পারব না, সে আবার তার পুরনো চেহারায় ফিরে গিয়েছে, না আজ যে-রকম দেখতে পেলুম সেইরকমই আছে।
সব মনে আছে, সব মনে আছে, প্রত্যেকটি কথা আমার মনে আছে।
ক্যেটে বোধহয় আমার মুখে কোনও অবিশ্বাসের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিল তাই এ-কথা বলল। আমি ভাবছিলুম, বেশি বিয়ার খেলে মানুষের স্মৃতিশক্তি তো দুর্বল হয়ে যায়, এর বেলা উল্টোটা হল কী করে? হবেও-বা! পায়ে কাঁটা ফুটলে বড় লাগে, কিন্তু পাকা ফোঁড়াতে সেই কাঁটা ফুটিয়ে দিয়েই তো মানুষ আরাম পায়। বললুম, তুমি বলে যাও। প্রেম বড় অদ্ভুত জিনিস।
ক্যেটে অনেকক্ষণ ধরে বিয়ারে চুমুক দেয়নি, সিগারেটও ধরায়নি। প্রেমে তো নেশা আছে বটেই, প্রেমের স্মরণেও নেশা– অন্য নেশার প্রয়োজন হয় না।
ক্যেটে বললে, আশ্চর্য এবং তুমিও বিশ্বাস করবে না, আমি তখনও বুঝতে পারিনি, কবিরা একেই নাম দিয়েছেন প্রেম। প্রেমের যা বর্ণনা কবিরা দিয়েছেন তাতে আছে, মানুষের সর্বসত্তা নাকি তখন বিরাটতম চৈতন্যলোকে নিমজ্জিত হয় এবং পরমুহূর্তেই সে নাকি নভোমণ্ডলে উড্ডীয়মান হতে হতে দ্যুলোক সুরলোক হয়ে হয়ে ব্রহ্মাণ্ডাতীত লোকে লীন হয়ে যায়; আর আমি ভাবছি, কাল যদি ঝড় হয় তবে আমি ইস্কুলে যাব কী করে! দুটো যে একই জিনিস জানব কী করে?
পরদিন দেখি, আকাশ বাতাস সুপ্রসন্ন! আসন্ন বর্ষণেরও কোনও আভাস নেই।
অন্য দিন মায়ের তাড়া খেতে খেতে হন্তদন্ত হয়ে শেষ মুহূর্তে বাড়ি থেকে বেরুতুম, ইস্কুল যাবার জন্যে ছোট বোন বিরক্ত হয়ে আগেই বেরিয়ে যেত; আজ আমি একঘণ্টা আগে থেকেই তৈরি। অন্যদিন জুতোতে কালি বুরুশ লাগাবার ফুরসত কোথায়? আজ ফিটফাট। আমি জামা-কাপড় সম্বন্ধে চিরকালই একটু উদাসীন– অন্য মেয়েদের মতো নই আজ ওয়ার্ডরোবের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল এ যেন সার্কাসের সঙের ওয়ার্ডরোব খুলেছি।
আমি বললুম, তোমাকে সাদা-মাটা কাপড়েই এত সুন্দর দেখায় যে বাহারে জামা কাপড় পরলে যে আরও শ্রীবৃদ্ধি হবে তা আমার মনে হয় না। এক লিটার বিয়ারের মগে এক লিটারই ধরে। সস্তা বিয়ার দিয়ে না ভরে দামি শ্যাম্পেন দিয়ে ভরলেও তাই।
ক্যেটে বললে, থ্যাঙ্কস্। সুন্দরী বলাতে ইতোমধ্যে দু বার তাড়া খেয়েছি। এবারে দেখি, সে মোলায়েম হয়ে গিয়েছে।
বললে, অটোও এখন বলে আমাকে সাদা-মাটাতেই ভালো দেখায়। একটু করুণ হাসি হাসলে।
ক্যেটে যে এখন কথাটাতে বেশ জোর দিয়েছে সেটা আমায় এড়িয়ে যায়নি। তাই শুধালুম, অটো এখন বলে, কিন্তু আগে কি অন্য কথা বলত?
সেই তখন আর এখনের কথাই তো হচ্ছে। সেটাই প্রায় শেষ কথা। একটু সবুর কর। না, তাড়াতাড়ি শেষ করে দেব?
আমি বললুম, দোহাই তোমার, সেটি কোরো না। পরের দিন সকালবেলা কী হল, তাই বল।
এক ঘণ্টা আগে থেকে তৈরি অথচ বেরুবার সময় যতই এগিয়ে আসতে লাগল, আমার পা যেন আর নড়তে চায় না। এদিকে বোন খুশি হয়েছিল, আজ আমার সঙ্গ পাবে বলে। সে বার বার বলে, চল, চল আর আমি তখন বুঝতে পেরেছি, কী ভুলটাই না করেছি। বোন সঙ্গে থাকবে– ওদিকে অটোকে একা পেলেই ভালো হত না? অত সাত তাড়াতাড়ি তৈরি না হলে বোন বেরিয়ে গেলে অটোতে-আমাতে, শুধু আমরা দু জনাতে একসঙ্গে যেতে পারতুম। অবশ্য এমনটাও আগে হয়েছে যে আমার দেরি দেখে বোন বেরিয়ে গিয়েছে, এবং তার পর আরও দেরি হওয়াতে অটোও আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। কিন্তু তখন তো আমি অটোর জন্য হোড়াই পরোয়া করতুম!
শেষটায় বোনের সঙ্গেই বেরুতে হল। ঘরে বসে থাকবার তো আর কোনও অছিলা নেই। ওদিকে আবার ভয়, বেশি দেরি দেখে অটো যদি একা চলে যায়।
দূর থেকে দেখি, অটো রাস্তায় দাঁড়িয়ে।
এবং আশ্চর্য! পরেছে রবিবারে গির্জে যাবার তার বু সার্জের পোশাকি স্যুট! এতই অস্বাভাবিক যে, বোন পর্যন্ত উঁচিয়ে শুধোল, এ কী অটো, রোববারের স্যুট কেন?
অটোর রোববারের স্যুট পরা নিয়ে সেদিন কী হাসাহাসি। অটোটাও আকাট। কাউকে বলে ইস্কুল ছুটির সঙ্গে সঙ্গে সোজা মামাবাড়ি যাবে, কাউকে বলে পাদ্রিসায়েবের কাছে যাবে। আরে বাপু, যা বলবি একবার ভেবে-চিন্তে বলে নে না।
আমি কিন্তু হাসিনি। অটো রাজবেশে সেজেছিল, তার রাজরানির সঙ্গে দেখা করার জন্যে আর আমি রাজরানি সেজেছিলুম, আমার রাজার সঙ্গে দেখা হবে বলে।
আমি বললুম, কেটে, এটা ভারি সুন্দর বলেছ।
ক্যেটে বললে, শীতকালে যখন দিনের পর দিন অনবরত বরফ পড়ে, রাইনেও জাহাজ আঁধা-বোটের চলাচল কমে যায়, খদ্দের প্রায় থাকেই না, তখন ঘণ্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন কাটে পাবের কাউন্টারের পিছনে বসে বসে। তখন মন যে কত আকাশ-পাতাল হাতড়ায়, কত অসম্ভব অসম্ভব স্বপ্ন দেখে, অটোকে বলার জন্য সুন্দর সুন্দর নতুন নতুন তুলনা ছলনা খোঁজে, সেটা বলতে গেলে দশ মিনিটের ভিতরই শেষ হয়ে যাবে, অথচ আমি ভেবেছি, দুই-আড়াই-তিন বছর ধরে।
আমি বললুম,
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা
আকাশ কুসুম চয়নে
সব পথে এসে মিলে গেল শেষে
তোমার দু খানি নয়নে –
ক্যেটে পড়াশোনায় বোধহয় এককালে ভালোই ছিল, অন্তত লিরিকে যে তার স্পর্শকাতরতা আছে সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর এ জিনিসটা তো লেখাপড়া শেখার ওপর খুব একটা নির্ভর করে না। রাগ-রাগিণী-বোধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সাড়া দেওয়া এসব তো ইস্কুল শিখিয়ে দিতে পারে না, যার গোড়ার থেকে কিছু আছে তারই খানিকটে মেজেঘষে দিতে পারে মাত্র।
সবচেয়ে তার ভালো লাগল ওই আকাশ-কুসুম-চয়ন ব্যাপারটা।
আমি বললুম, জানো ওই সমাসটা আমার মাতৃভাষায় এমনই চালু যে ওটা দিয়ে নতুন করে রসসৃষ্টি করা যায়। এরকম আকাশ-কুসুম-চয়ন মহৎ কবিই করতে পারেন এই যেরকম সকলের কাছে সাদামাটা অটো হঠাৎ একদিন তোমার কাছে নবরূপে এসে ধরা দিল।
তার পর?
ইস্কুল ছাড়ি আমরা দু জনাতে একসঙ্গেই। আমি পাবে ঢুকলুম। অটো রেমাগেনে এপ্রেন্টিসিতে।
সময় পেলেই ‘পাবে’ ঢু মেরে আমাকে দেখে যেত। আর শনির সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল অবধি ছিল আমাদের ছুটি- মা তখন পাবের কাজ সম্পূর্ণ ছেড়ে দেয়নি। সে সময় পায়ে হেঁটে, বাইসিক্লে, ট্রেনে বাসে আমরা এদেশটা ইঞ্চি ইঞ্চি করে চষেছি। শেষটায় অটো কিনল একটা ক্যাম্বিসের পোর্টেবল, কলাপসিবল নৌকো। তাতে চড়ে উজানে লিৎস থেকে ভাটিতে কলোন পর্যন্ত কতবারই না আসা-যাওয়া করেছি। শুধু আমরা দু জনা, আর কেউ না। গরমের দুপুরে ননেবের্ট দ্বীপে ওই তো রাইন দিয়ে একটু ভাটার দিকে গাছতলায় শুয়ে শুয়ে, পোকার উৎপাতে মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে, জ্যোত্সারাতে নৌকো স্রোতের হাতে ছেড়ে দিয়ে, বরফের ঝড়ে আটকা পড়ে গ্রামের ঘরোয়া পাব বা ইনে কাটিয়েছি রাত। দু জনাতে নিয়েছি দুটি ছোট কামরা। শেষরাতে ঘুম ভাঙলে মাঝখানের দেয়ালে টোকা দিয়ে অটোকে জাগিয়েছি, কিংবা সে আমাকে জাগিয়েছে। জেলের কয়েদিরা যেরকম দেয়ালে টোকা দিয়ে সাঙ্কেতিক কথা কয়, আমরাও সেইরকম একটা কোড় আবিষ্কার করেছিলুম। আর সমস্তক্ষণ মনে মনে হাসতুম, সে অনায়াসে আমার ঘরে আসতে পারে, আমি তার ঘরে যেতে পারি তবু বড় ভালো লাগত এই লুকোচুরি।
ইস্কুলে থাকতে অটো কালে-কম্বিনে একটু-আধটু বিয়ার খেত– সে কিছু ধর্তব্যের মধ্যে নয়। চাকরি পেয়ে সে আস্তে আস্তে মাত্রা বাড়াল। আমিও সঙ্গে সঙ্গে খেতে লাগলুম। তার পর একদিন তার মাত্রা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছল যার তুলনায় আমার আজকের বিয়ার খাওয়া নিতান্ত জলযোগই বলা যেতে পারে। অর্থাৎ শনির সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল অবধি সর্বদাই ঢুলুঢুলু নয়ন।
আমি মন্তব্য করিনি, বাধাও দিইনি। যতখানি পারি তাকে সঙ্গ দিতুম।
তার পর একদিন হল এক অদ্ভুত কাণ্ড। পড়ল কোন এক টেম্পারেন্স না কিসের যেন পাদ্রির পাল্লায়। তাদের নাকি সবরকম মাদকদ্রব্য বর্জন করা ধর্মেরই অঙ্গ! আমরা ক্যাথলিক। মদ খাই–বাড়াবাড়ি না করলেই হল। ফ্রান্সসকানর, বেনেডিটিনার এসব ভালো ভালো লিকোর তো আবিষ্কার করেছে পাদ্রিসায়েবরাই। আমাদের গায়ে পাদ্রি সায়েবের সেলারে যে মাল আছে তা আমার পাবের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।
অটো দুম করে মদ ছেড়ে দিল। আমি খেলে আমার দিকে আড় নয়নে তাকায়। এ আবার কী?
মদ সিগরেট কোনও-কিছু একটা হঠাৎ ছেড়ে দিলে মানুষ খিটখিটে হয়ে যায়। অটো আমাকে ভালোবাসত বলে সেটা যতদূর সম্ভব চাপবার চেষ্টা করত। আমি টের পেতুম।
জানিনে, পুরনো অভ্যাসবশত, না কর্তব্যজ্ঞানে সে তখনও আমার সঙ্গে শনি রবি বাইরে যায়, কিন্তু কেমন যেন তার জমতে চায় না। একদিন তো বলেই ফেললে, আমার মুখে বিয়ারের গন্ধ!
শোন কথা! দু দিন আগেও দু দণ্ড চলত না তোমার যে বিয়ার না খেয়ে, সেই বিয়ারে তুমি পাও এখন গন্ধ!
তখন– এখন না– তখন ইচ্ছে করলে আমি বোধহয় বিয়ার ছাড়তে পারতুম, কিন্তু আমার মনে হল, এ তো বড় এক অদ্ভুত ন্যাকরা। আমাকে তুমিই খেতে শেখালে বিয়ার আর এখন তুমি হঠাৎ বনে গেলে বাপের সুপত্নর। এখন বিয়ারের গন্ধে তোমার বাইবেল অশুদ্ধ হয়!
আমি বললুম,
জাতে ছিল কুমোরের ঝি,
সরা দেখে বলে এটা কী?
ক্যেটেকে প্রবাদটা বোঝাতে বেশিক্ষণ লাগেনি।
ক্যেটে বললে, ভুল করলুম না ঠিক করলুম জানিনে আমি ভাবলুম, এরকম ন্যাকামোকে আমি যদি এখন লাই দিই, তবে ভবিষ্যতে কতকিছুই না হতে পারে। একদিন সে ন্যুডিস্ট কলোনিতে মেম্বার হতে চেয়েছিল, আমি বাধা দিয়েছিলুম– কেমন যেন ও জিনিসটা আমার বাড়াবাড়ি বলে মনে হয় পরে সে বলেছিল, আমি বাধা দিয়ে ভালোই করেছিলুম। এখন যে তাই হবে না কে জানে।
ইতোমধ্যে এল আরেক গেরো।
বলা-নেই, কওয়া-নেই হঠাৎ একদিন এসে বলে, সে পাদ্রি হবে, সে নাকি ভগবানের ডাক শুনতে পেয়েছে। আমি তো গলাভর্তি বিয়ারে হাসির চোটে বিষম খেয়ে উঠেছিলাম। শেষটায় ঠাট্টা করে শুধিয়েছিলুম, পৃথিবীতে কত শত অটো আছে। তুমি কী করে জানলে, আকাশ বাণী তোমার জন্যই হয়েছে।
রাগে গরগর করতে করতে অটো চলে গেল।
অর্থাৎ তা হলে আমাদের আর বিয়ে হতে পারে না।
সেই থেকে, এই তিন মাস ধরে চলেছে টানাপড়েন। পরপর দুই শনি যখন এটা ওটা অছিলা করে আমার সঙ্গে এস্কাশনে বেরোল না, তখন আমিও আর চাপ দিলুম না। এখন মাঝে মাঝে রাত দশটা-এগারোটায় পাবে এসে এক কোণে বসে, আর বিশ্বাস করবে না, লেমনেড হ্যাঁ হ্যাঁ, লেমনেড খায়! আমি বিয়ার হাতে তার পাশে গিয়ে বসি।
ধর্ম আমি মানি। খৃস্টে আমার বিশ্বাস আছে। কিন্তু ধর্মের এ কী উৎপাত আমার ওপর আমি পাব-ওয়ালির মেয়ে। আমার ধর্ম বিয়ারে ফাঁকি না দেওয়া, যে বানচাল হবার উপক্রম করছে তাকে আর মদ না বেচে বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা, মা-বোনের দেখভাল করা– আমি না হতে যাব কোন দুঃখে।
তবু জানো, এখনও তার পদধ্বনির প্রতীক্ষা করি।
ক্যেটের গলায় কীরকম কী যেন একটা জমে গেছে। তুমি ঘুমুও বলে আলো নিভিয়ে দিয়ে হুট করে চলে গেল।
.
১৭.
পড়ল পড়ল বড় ভয়
পড়ে গেলেই সব সয়।
ভোরের দিকে ভয় হয়েছিল, বৃষ্টিতে ভেজার ফলে যদি আরও জ্বর চড়ে। চড়লও। তখন সর্ব দুর্ভাবনা কেটে গেল। এবার যা হবার হবে। আমার কিছু করবার নেই।
সকালে ঘুম ভাঙতেই কিন্তু সর্বপ্রথম লক্ষ করেছিলুম, খাটের পাশে চেয়ারে আমার সব জামা-কাপড় পরিপাটি ইস্ত্রি করে সাজানো, ড্রাইক্লিনিঙেরও পরশ আছে বোঝা গেল। ধন্যি মেয়ে? কখনই-বা শুতে গেল, আর কখনই-বা সময় পেল এসব করবার।
কিন্তু আমার টেম্পারেচার দেখে সে যায় ভিরমি। আমি অতি কষ্টে তাকে বোঝালুম, এ-টেম্পারেচার জৰ্মনিতে অজানা, কারণ এটা খুব সম্ভব আমার বাল্য-সখা ম্যালেরিয়ার পুনরাগমন।
এবারে ক্যেটে সত্যই একদম ফ্যাকাশে হয়ে গেল। ম্যা–লে–রিয়া–? ওতে শুনি পুবের দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক মরে!
আমি ক্যেটের হাত আমার বুকের উপর রেখে বললুম, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো, আমি মরব না। তদুপরি, আমাদের এতে কিছুই করবার নেই। বন, কলোন কোথাও কুইনিন পাওয়া যায় না। বন্-এ আমার এক ভারতীয় বন্ধুর ম্যালেরিয়া হয়েছিল; তখন হল্যান্ড থেকে কুইনিন আনাতে হয়েছিল, কারণ ডাচদের কাজ-কারবার আছে জ্বরে-ভর্তি ইভোনেশিয়ার সঙ্গে।
ক্যেটে সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, তা হলে হল্যান্ডে লোক পাঠাই।
আমার দেখি নিষ্কৃতি নেই। বললুম, শোন, কেটে, আমার ডার্লিং, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আজ না হোক, কাল সকালেই আমার জ্বর নেবে যাবে। তখন তুমি যাবে সত্যসত্যই ভিরমি। কারণ টেম্পারেচার অতখানি নামেও না এদেশে কখনও ৩৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। যদি না নামে তবে কথা দিচ্ছি, তুমি হল্যান্ডে লোক পাঠাতে পার।
তা হলে ওঠ, ব্রেকফাস্ট খাও।
এই জর্মনদের নিয়ে মহা বিপদ। প্রথম, এদের অসুখ-বিসুখ হয় কম। পেটের অসুখ তো প্রায় সম্পূর্ণ অজানা– যেটা কি না প্রত্যেক বাঙালির বার্থ-রাইট–। আর যদি-বা অসুখ করল, তখন তারা খায় আরও গোগ্রাসে। ডায়েটিং বলে কোনও প্রক্রিয়া ওদেশে নেই, উপোস করার কল্পনা ওদের স্বপ্নেও আসে না। ওদের দৃঢ়তম বিশ্বাস, অসুখের সময় আরও ঠেসে খেতে হয় যাতে করে রোগা গায়ে গত্তি লাগে।
একেই কোনও মেয়ে ছলছল নয়নে তাকালে আমি অস্বস্তি বোধ করি, তদুপরি এ মেয়ে অপরিচিতা, বিদেশিনী। এবং সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল, যে মেয়ে রায়বাঘিনীর মতো মাতাল সেলারদের ভেড়ার বাচ্চার মতো গণনা করে, তার এই এত সুকোমল দিকটা এল কোত্থেকে? তখন মনে পড়ল, কে যেন বলেছিল, ফাঁসুড়ের ছেলের পায়ে কাঁটা ফুটলে সে কি বিচলিত হয় না?
ক্যেটেকে বললুম, তুমি দয়া করে তোমার পা সামলাওগে। আর শোনো, যাবার পূর্বে আমাকে একটি চুমো খাও তো।
এবারে ক্যেটের মুখে হাসি ফুটল। আমার দুই গালে বম্-শেল ফাটাবার মতো শব্দ করে দুটি চুমো খেয়ে যেন নাচতে নাচতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
রুচিবাগীশ পাঠকদের বলে রাখা ভালো, এদের গালে চুমো খাওয়া স্নেহ, হৃদ্যতার প্রতীক। ঠোঁটের ব্যাপার প্রেম-ট্রেম নিয়ে। যস্মিন দেশাচার। কেটে নিশ্চিত হয়ে কাজে গেল– আমি বিদেশি নই, আমি ওদেরই একজন। এই যেরকম কোনও সায়েব যদি আমাদের বাড়িতে খেতে খেতে হঠাৎ বলে ওঠে, দুটো কাঁচা লঙ্কা দাও তো, ঠাকুর–তা হলে আমরা যেরকম নিশ্চিন্ত হই।
***
জ্বর কমেছে। পাবে এসে বসেছি। জামাকাপড় ইস্ত্রি করা ছিল বলে ভদ্রলোকের মতোই দেখাচ্ছিল। কেটে পা-কিপারের মতো কেতাদুরস্ত কায়দায় আমাকে শুধোলে, আপনার আনন্দ কিসে? সঙ্গে আবার মৃদু হাস্য আপন-প্রিয় বান্ধবীর মতো।
আমি বললুম, বুইয়োঁ–বুইয়োঁ, ঘনচর্বির শুরুয়া। ওতে আর কিছু থাকে না। কেটে আরও পুরো পাক্কা নিশ্চিত হল- আমি আঁটি জর্মন হয়ে গিয়েছি। আশ্চর্য, সর্বত্রই মানুষের এই ইচ্ছা– বিদেশিকে ভালো লাগে, কিন্তু তার আচার-ব্যবহার যেন দিশির মতো হয়।
বুইয়োঁ দিতে দিতে বললে, অটোকে খবর দিয়েছি।
খানিকক্ষণ পরেই অটো এল।
স্বীকার করছি, প্রথম দর্শনেই ওকে আমার ভালো লাগেনি। জৰ্মনে যাকে বলে উন-আপেটিটলিষ–অর্থাৎ আন-এপিটাইজিং। পাঠক চট করে বলবেন, তা তো বটেই! এখন তুমি কেটেতে মজেছ। সপত্নকে আন-এপিটাইজিং মনে হবে বইকি। আমি সাফাই গাইব না, কিন্তু তবু বলি ওইটুকু ছোকরার মুখে ধর্ম ধর্ম ভাব আমার বেখাপ্পা বেমানান, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে সির্ফ ভণ্ডামি বলে মনে হয়। অটো ফ্রন্টাল এটাক করলে। পাদ্রিরা যা আকছারই করে থাকে। খুব সম্ভব, আমিই তার পয়লা শিকার। অন্য জর্মন যেখানে ব্যক্তিগত প্রশ্ন শুধোয় না, সেখানে পাদ্রিদের চক্ষুলজ্জা অল্পই। পরে অবশ্য অনেকেই পোড় খেয়ে শেখে। শুধালে, আপনি খৃস্টান নন।
বললুম, আমি খৃস্টান নই, কিন্তু খৃস্টে বিশ্বাস করি।
সাত হাত পানিমেঁ। শুধালে, সে কী করে হয়?
আমি বললুম, কেন হবে না? খৃস্টান বিশ্বাস করে, প্রভু যিশুই একমাত্র ত্রাণকর্তা। সেই একমাত্র ত্রাণকর্তাকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ না করলে মানুষ অনন্তকাল নরকের আগুনে জ্বলবে। আমি বিশ্বাস করি, প্রভু বুদ্ধ, হজরত মুহাম্মদে বিশ্বাস করেও ত্রাণ পাওয়া যায়। এমনি কাউকে বিশ্বাস না করে আপন চেষ্টাতেও ত্রাণ পাওয়া যায়।
গিলতে তার সময় লাগল। বললে, প্রভু যিশুই একমাত্র ত্রাণকর্তা।
আমি চুপ করে রইলুম। এটা একটা বিশ্বাসের কথা। আমার আপত্তি করার কী আছে।
কিন্তু এর পর যা আরম্ভ করল সেটা পীড়াদায়ক। সর্ব ধর্মের মিশনারিই একটুখানি অসহিষ্ণু হয়। তাদের লেখা বইয়ে পরধর্মের প্রচুর নিন্দা থাকে। মিস মেয়োর বইয়ের মতো। অতি সামান্য অংশ সত্য, বেশিরভাগ বিকৃত সত্য, কেরিকেচার। গোড়ার দিকে আমি এসব জানতুম না। আমি বন্-এর যে পাড়াতে থাকি তারই গির্জাতে প্রতি রোববারে যেতুম বলে গির্জার পাদ্রি আমাকে একখানা ধর্মগ্রন্থ দেন। তাতে পরধর্ম নিন্দা এতই বেশি যে মনে হয় মিস মেয়ো এ বইখানাও লিখেছেন। অবশ্য এ কথাও সত্য মানুষের দ্ৰতাজ্ঞান যত বাড়ছে এ-সব লেখা ততই কমে আছে। একটা দৃষ্টান্ত দিতে পারি; ষাট সত্তর বছর আগে আমাদের দেশের খবরের কাগজে, মাসিকে তর্কাতর্কির সময় যে সৌজন্য দেখানো হত আজ আমরা তার চেয়ে অনেক বেশি দেখাই। এবং একথাও বলে রাখা ভালো যে এ-সংসারে হাজার হাজার মিশনারি আসছে, যারা কখনও পরনিন্দা করেন না। শত শত মিশনারি পরধর্মের উত্তম উত্তম গ্রন্থ আপন মাতৃভাষায় অনুবাদ করে আপন ভাষার শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছেন, দুই ধর্মকে একে অন্যের কাছে টেনে এনেছেন।
কিন্তু এই গ্রামের ছেলে অটো এসব জানবে কোথা থেকে? সে কখনও নিগ্রোদের নিন্দা করে, কখনও পলিনেশিয়াবাসীর, কখনও-বা হিন্দু-মুসলমানের। এ সবই তার কাছে বরাবর।
আমি এক জায়গায় বাধা দিয়ে বললুম, হ্যের অটো। অন্যের পিতার নিন্দা না করে কি আপন পিতার সুখ্যাতি পাওয়া যায়?
বেশ গরম সুরে বললে, আমি অসত্যের নিন্দা করছি।
আমি বিনীত কণ্ঠে বললুম, প্রভু যিশু বলেছেন, ভালোবাসা দিয়ে পাপীতাপীর চিত্ত জয় করবে।
ক্যেটে লম্বা এক ঢোক বিয়ার গিলে, গেলাসটা ঠক করে টেবিলে রেখে বললে, হককথা।
.
১৮.
স্বার্থে স্বার্থে বেধেছে সংঘাত, লোভে লোভে ঘটেছে সংগ্রাম- কিন্তু যখন সংগ্রামটা স্বার্থে স্বার্থে না হয়ে আদর্শে আদর্শে হয় তখন সেটা হয় আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রাণঘাতী। কারণ খাঁটি মানুষ অনায়াসে স্বার্থ ত্যাগ করতে রাজি হয় কিন্তু আদর্শ বর্জন করতে রাজি হয় না।
অটোকে যদিও প্রথম দর্শনে আমার ভালো লাগেনি, তবু তর্ক করতে করতে স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, সে খাঁটি। সে স্থির করেছে, সর্বস্ব ত্যাগ করে ধর্মপ্রচার করবে। সেটা যে ক্যেটের স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতে এসেছে তা নয়– কেটেও খাঁটি মেয়ে, স্বার্থত্যাগ করতে প্রস্তুত ক্যেটে দেখছে, তার মার বয়েস হয়েছে, তার ছোট বোনকে ভালো যৌতুক দিয়ে বিয়ে দিতে হবে, পরিবারের মঙ্গল কামনা তার আদর্শ। দুই আদর্শ-সংঘাত! এ সংগ্রামে সন্ধি নেই, কম্প্রমাইস হতেই পারে না।
অটোকে বোঝানো অসম্ভব, খৃস্টধর্মের প্রতি তার যেরকম অবিচল নিষ্ঠা, দৃঢ় বিশ্বাস ঠিক তেমনি বৌদ্ধ শ্রমণ রয়েছেন, মুসলমান মিশনারি আছেন– আপন আপন ধর্মের প্রতি এঁদের বিশ্বাস কিছুমাত্র কম নয়। আর কেমন যেন একটা আবছা আবছা বিশ্বাস, এরা সব কেমন যেন একটা মোহাচ্ছন্ন অবস্থায়, একটা মায়ার ঘোরে আছে– খৃস্টের বাণী তাদের সামনে একবার ভালো করে তুলে ধরতে পারলেই ওরা তৎক্ষণাৎ সত্য ধর্মে আশ্রয় নেবে।
ততক্ষণে আমি বিলক্ষণ বুঝে গিয়েছি, অটোর সঙ্গে তর্কাতর্কি বা আলোচনা করা নিষ্ফল। সে তার পথ ভালো করেই ঠিক করে নিয়েছে। এবং সেটা যখন খৃস্টের পথ, তবে চলুক না সে সেই পথে।
আমি বললুম, হ্যের অটো। আমার একটি নিবেদন শুনুন। আমি ছেলেবেলায় গিয়েছি পাদ্রি ইস্কুলে, আমার প্রতিবেশীরা ছিল সব হিন্দু। ভিন্ন ধর্মের খুব কাছে আপনি কখনও আসেননি– কাজেই আমার মনের ভাব আপনি বুঝতে পারবেন না, আপনারটাও আমি বুঝতে পারব না। আমার শুধু একটি অনুরোধ– যেখানেই ধর্মপ্রচার করতে যান না কেন, প্রথম বেশ কিছুদিন সে দেশবাসীর শাস্ত্র, আচার-ব্যবহার, সামাজিক প্যাটার্ন ভালো করে দেখে নেবেন, শিখে নেবেন, তার পর যা করবার হয় করবেন।
অটোর চোখ-মুখের ভাব থেকে অনুমান করতে পারলুম না, আমার পরামর্শটা তার মনে গেঁথেছে কি না। এতক্ষণ আমি তক্কে তক্কে ছিলুম, কী করে এ আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যাওয়া যায়। তাই শুধালুম, আপনি কোন দেশে ধর্ম প্রচার করতে যাবেন?
অটো বললে, এখনও ঠিক করিনি।
আমি তৎক্ষণাৎ আলোচনার মোড় নেবার সুযোগ পেয়ে গেলুম বললুম, ভারতবর্ষ, ইরান, আরব এসবের কোনও একটা দেশে যাবেন। অর্থাৎ যেখানকার লোকের রঙ আমার মতো বাদামি। এরাই ভগবানের সর্বোত্তম সৃষ্টি।
অটো বুঝতে না পেরে বললে, কেন? ক্যেটে বললে, আমরা জর্মনরা চামড়ার বাদামি রঙ পছন্দ করি বলে? অটো কেমন যেন একটু ঈর্ষার নয়নে আমার দিকে তাকালে। বাঁচালে। ক্যেটের প্রতি তার সর্ব দুর্বলতা তা হলে এখনও যায়নি।
আমি বললুম, বুঝিয়ে বলি। সৃষ্টিকর্তা যখন মানুষ গড়তে প্রথম বসলেন, তখন এ বাবদে তাঁর বিলকুল কোনও অভিজ্ঞতাই ছিল না। প্রথম সেট বানানোর পর সেটা বেক করবার জন্য ঢোকালেন বেকিং বক্সে। যতখানি সময় বে করার প্রয়োজন তার আগেই বাক্স খোলার ফলে সেগুলো বেরল আন্ডার-বেট, সাদা সাদা। অর্থাৎ তোমরা, ইয়োরোপের লোক। পরের বার করলেন ফের ভুল। এবারে রাখলেন অনেক বেশি সময়। ফলে বেরোল পুড়ে-যাওয়া কালো কালো। এরা নিগ্রো। ততক্ষণে তিনি টাইমিংটি ঠিক বুঝে গেছেন। এবার বেরুল উত্তম বে-করা সুন্দর ব্রাউন-ব্রেড। অর্থাৎ আমরা, ইরানি, আরব জাত।
ক্যেটে হাসতে হাসতে তখন পুনরায় আরম্ভ করল ভারতীয় নর্তকী-সৌন্দর্য-কীর্তন। এবারে অটোর হিংসা করার কিছু নেই– কারণ প্রশংসাটা হচ্ছে মেয়েদের। কিন্তু মানবসৃষ্টি রহস্যের গল্পটা শুনে সে প্রাণভরে হাসলে না। নিছক ভদ্রতা রক্ষা করার জন্য কেমন যেন শুকনো শুকনো।
আমি বললুম, আর প্রভু খৃস্টও তো ছিলেন বাদামি। তার আমলের কিছু কিছু ইহুদি এখনও প্যালেস্টাইনে আছে। তাদের বর্ণসঙ্কর দোষ নেই। এখনও ঠিক সেই সুন্দর বাদামি রঙ, মিশমিশে কালো নীল চুল। ইন্ডিয়া যাবার পথে প্যালেস্টাইন দেখে নেবেন।
ক্যেটে অভিমানভরা সুরে বললে, তুমি দেখি অটোকে দেশছাড়া করার জন্য সাত-তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে লেগেছ!
আমি সপ্রতিভ কণ্ঠে উত্তর দিলুম, কেন, তুমি ওর সঙ্গে যাচ্ছ না?
অটো বললে, ওর অভাব কী? সৌন্দর্যদানে তো ভগবান ওর প্রতি কার্পণ্য করেননি।
ক্যেটে রোষ-কষায়িত লোচনে অটোর দিকে তাকাল। মন্তব্যটা আমারও মনে বিরক্তির সঞ্চার করল। এতক্ষণ ধর্ম নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল বলে ওকে কোনও প্রকারে আঘাত না দেবার জন্য টাপেটোপে কথা বলছিলুম, এখন আর সে পরোয়া নেই। বাঁকা হাসিটাকে প্রায় চক্রাকারে পরিবর্তিত করে বললুম, আপনি বুঝি ধরে নিয়েছেন, প্রত্যেক পরিবর্তনই প্রগতি, এবং পরিবর্তনটা করা হবে ঝটপট! আজ আছ মুসলমান, কাল হয়ে যাও খৃস্টান; আজ ভালোবাসো অটোকে, কাল ভালোবেসে ফেল ডাভিড় কিংবা ফ্রিডরিষকে! যেমন এখন খাচ্ছ বিয়ার, পরের গেলাস ভরে নাও লেমনেড দিয়ে! না?
অটোর আঁতে খানিকটে লেগেছে। তাই শুষ্ক কণ্ঠে বললে, মিথ্যা প্রতিমা (ফলস আইডলস্) যতদূর সম্ভব শীঘ্ন বর্জন করে সত্যধর্মে আশ্রয় নেওয়া উচিত।
আমি রীতিমতো রাগত কণ্ঠে বললুম, মিথ্যা প্রতিমা! নরনারীর প্রেম মিথ্যা, আর কোথায় কোন আফ্রিকার জঙ্গলে পড়ে আছে নিগ্রো তারা মাম্বো জাম্বো নিয়ে হয়তো সুখেই আছে, শান্তিতেই আছে– তাকে তার অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পাপ সম্বন্ধে সচেতন করাই সবচেয়ে বড় সত্য!
শুনুন হ্যের অটো। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, যে লোক ঐশীবাণীর স্পন্দন তার হৃৎপিণ্ডে অনুভব করেছে তার কিছু বাকি থাকে না–আমাদের দেশের গ্রাম্য সাধক পর্যন্ত গেয়েছে, যে জন ডুবল সখী তার কী আছে বাকি গো?
কিন্তু ধর্মের দোহাই, নরনারীর প্রেম অবহেলার জিনিস নয়, আপনি রাগ করবেন না, আমি জিগ্যেস করি, আজ যে আপনি প্রভু যিশুকে ভালোবাসতে শিখেছেন, তার গোড়াপত্তন কি ক্যেটের প্রতি আপনার প্রথম প্রেমের ওপর নয়?
টায় টায় মিলবে না, তবু একটি উদাহরণ দি। আমার একজন আত্মীয় উনিশ-বিশ বৎসর অবধি তার মাকে বড্ড অবহেলা এমনকি তাচ্ছিল্য করত। তার পর তার বিয়ে হল, বাচ্চা হল। তখন সে জীবনে প্রথম বুঝতে পারল বাচ্চার প্রতি মার ভালোবাসা কী বস্তু। তখন সে ভালোবাসতে শিখল আপন মাকে।
বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে আপনাদের ধর্মের অনেকখানি মিল আছে। সংসারাশ্রম ত্যাগ করে, সন্ন্যাসী হয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করা সে ধর্মের অনুশাসন। অথচ জানেন, সে ধর্মেও মায়ের আসন অতি উচ্চ। বুদ্ধদেব যখন তাঁর প্রধান প্রধান শিষ্যদের নিয়ে ধর্মালোচনা করতেন তখন তাঁর একমাত্র কিশোর পুত্র রাহুল অত্যন্ত বিমর্ষ বদনে এককোণে বসে থাকত– সে তো শ্ৰমণ নয়, তার তো কোনও আসন নেই সেখানে। আপন পিতা বুদ্ধদেব পর্যন্ত শিষ্য মহামৌদগল্যায়ন, সারিপুত্তের সঙ্গে যেরকম সানন্দে কথা বললেন, তার সঙ্গে সেরকম ব্যবহার করেন না। তখন রাহুল স্থির করলেন, সন্ন্যাস নেবেন বলে। সেকথা শুনতে পেয়ে রাহুল-জননী যশোধারা নিরাশকণ্ঠে বলেছিলেন, আর্যপুত্র আমাকে বর্জন করেছেন, আমি তাঁকে পেলুম না। তিনি সিংহাসন গ্রহণ করলেন না, আমিও পট্ট-মহিষী হওয়ার গৌরব থেকে বঞ্চিত হলুম। এখন বুঝি তিনি আমার শেষ আশ্রয়ের স্থল যুবরাজ রাহুলকেও আমার কোল থেকে কেড়ে নিতে চান? একথা শুনতে পেয়ে বুদ্ধদেব অনুশাসন করেন, মাতার অনুমতি ভিন্ন কেউ শ্রমণ হতে পারবে না। আড়াই হাজার বছর হয়ে গেছে– এখনও সে অনুশাসন বলবৎ। আমার আশ্চর্য বোধ হয়, হ্যের অটো! মাতা হয়তো নিরক্ষরা, কুসংস্কারাচ্ছন্না। কিন্তু তারই ওপর নির্ভর করছে পুত্রের আদর্শবাদ, সদ্ধর্ম গ্রহণ, সবকিছু। সেই মূর্খা মাতা অনুমতি না দিলে সে সবচেয়ে মহৎ কর্ম প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারবে না– আজ আপনি যেরকম করতে পারছেন। আর এ তো আবার প্রেম।
ভগবান কোথায়?–নাস্তিক জিগ্যেস করেছিল সাধুকে, আমার যতদূর মনে পড়ছে, খৃস্টান সাধুকেই। কৃ-সাধনাসক্ত, দীর্ঘ তপস্যারত, চিরকুমার সাধু বলেছিলেন, তরুণ-তরুণীর চুম্বনের মাঝখানে থাকেন ভগবান।
.
১৯.
আমি বললুম, শ্রীমতী কেটে, কাল ভোরে আমি বেরুব।
ইতোমধ্যে তিনটি দিন কেটে গিয়েছে। ফিল্মস্টারের আদরে কদরে। শরীর একটু সুস্থ বোধ হলেই নিচের পাবে এসে বসেছি, ক্যেটের কাউন্টারের নিকটতম সোফায়। তার বোধহয় মনে রঙ ধরেছে। কিংবা তার কপাল ভালো– কী করে যেন বারের একটা ঠিকে জুটে গিয়েছে বলে অধিকাংশ সময় তার বিয়ারের মগসহ আমার সামনে বসে। আর যখন মৌজে ওঠে তখন সোফায় এসে আমার গা ঘেঁষে। অটোও প্রতি রাত্রে এসেছে। আমাদের ভিতর যতখানি ভাব জমেছে কেটে সেটা অটোর কাছ থেকে লুকোবার চেষ্টা করেনি। অটোর হাব-ভাব দেখে অনুমান করলুম, সে পড়েছে দ্বন্দ্বে। অস্কার ওয়াইল্ড় বলেছেন, আমাদের প্রত্যেকের কাছে এমন একাধিক জিনিস আছে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে পথের ধুলোয় ছুঁড়ে ফেলে দিতুম, যদি না জানতুম, অন্যলোকে সেগুলো তৎক্ষণাৎ কুড়িয়ে নেবে। অটো ভাবছে সে ক্যেটেকে কবুল জবাব দেওয়ামাত্রই আমি তাকে লুফে নিয়ে বটন-হোলে বসরাই গোলাপের মতো খুঁজে নেব।
একবার শুধু অটোকে বলেছিলুম, আপনাদের কবি গ্যোটে অতুলনীয়। সুদূর ভারতের আমরা যে হিদেন, আমরাও তাকে সম্মান করি। তিনি বলেছেন–
দূরে দূরে তুমি কেন খুঁজে মরো
হেরো প্রেম সে তো হাতের কাছে
শিখে নাও শুধু তারে ধরিবারে।
সে তো নিশিদিন হেথায় আছে।
Willst du immer weiter schweifen?
Sieh, das Gute liegt so nah.
Lerne nur das Glueck ergreifen.
Denn das Glueck ist immer da.
অটো এর উত্তরে কিছু না বলে শুধু অন্য কথা পেড়ে আমাকে বলেছিল, আপনি এখানে আরও কিছুদিন থাকুন। আস্তে আস্তে সব কথাই বুঝতে পারবেন।
এ আরেক প্রহেলিকা।
ক্যেটে চালাক মেয়ে। আমার উড়ন্টু ভাব বুঝতে পেরে আমাকে কিছুতেই বিদায় নেবার প্রস্তাব পাড়তে দেয় না। কী করে যে বুঝে যায়, কথার গতি ওই দিকে মোড় নিচ্ছে আর অমনি দুম করে ভারতবর্ষের ফকিরদের কাহিনী শুনতে চায়, আমার মা বছরে কবার তার বাপের বাড়ি যায়– অতিশয় ধূর্ত মেয়ে, কী করে যে বুঝে গেছে আমি আমার মায়ের গল্প বলতে সবসময়ই ভালোবাসি, আমিও একবার মূখের মতো বলেছিলুম, মায়ের গল্প সব গল্পের মামা চলে গেলে বাড়ি চালায় কে, আরও কত কী।
আর আমিও তো অতটা নিমকহারাম নই যে এতখানি স্নেহভালোবাসা পাওয়ার পর হঠাৎ বলে বসব, আমি চললুম। যেন পচা ডিমের ভাঙা খোটা জানালা দিয়ে ফেলে দেবার মতো ওদের বাড়ি বর্জন করি!
শেষটায় মরিয়া হয়েই প্রস্তাবটা পাড়লুম।
ক্যেটে বললে, কেন? এখানে আরও কয়েকটা দিন থাকতে আপত্তি কি? তুমি যে ঘরটায় আছ সেটা সাড়ে এগারো মাস ফাঁকা থাকে, খদ্দেরদের জন্য এখানে প্রতিদিন রান্না হয় অন্তত তিরিশটা লাঞ্চ-ডিনার। একটা লোকে বেশি খেল কি কম খেল তাতে কী যায় আসে?
আমি বললুম, আমি আর তিন দিন থাকলেই তোমার প্রেমে পড়ে যাব।
আমি ভেবেছিলুম, কেটে বলবে, তাতে ক্ষতিটা কী? সে কিন্তু বললে অন্য কথা। এবং অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে। বললে, কোনও ভয় নেই তোমার। তোমার স্বভাব প্রেমের লক্ষণে দীন (যেন, হুবহু রবীন্দ্রনাথের ভাষা)। মানুষ হঠাৎ একদিন প্রেমিক হয় না। যে প্রেমিক, সে প্রেমিক হয়েই জন্মায়। কিংবা যেমন কেউ বাকা নাক নিয়ে। যাদের কপালে প্রেমের দুর্ভোগ আছে তাদের জন্ম থেকেই আছে। তোমার সে ভয় নেই।
আমি চুপ করে রইলুম।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, অটো যত দূরে চলে যাচ্ছে আমার জীবনটা ততই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এই যে তোমার প্রিয় কবি হাইনরিষ হাইনে তারই একটি কবিতা আছে–
গোলাপ, কমল, কপোত, প্রভাত রবি
ভালোবাসিতাম কত যে এসব আগে,
সেসব গিয়েছে, এখন কেবল তুমি,
তোমারি মূর্তি পুরাণে কেবল জাগে!
নিখিল প্রেমের নিঝর তুমি, সে সবি–
তুমিই গোলাপ, কমল, কপোত, রবি।*
[* যতীন্দ্রমোহন বাগচীর অনুবাদ।]
কবি একদিন তাঁর প্রিয়াতেই গোলাপ, কমল, কপোত সবই পেয়ে গেলেন। কিন্তু তার পর আরেকদিন যখন তার প্রিয়া তাকে ছেড়ে চলে গেল তখন কি তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবার গোলাপ-কমলকে ভালোবেসে সে অভাব পূর্ণ করতে পারলেন? আমার হয়েছে তাই। এ তো আর চটিজুতো নয় যে, যখন খুশি পরলে, যখন খুশি ছুঁড়ে ফেলে দিলে। এ যেন নির্জন দ্বীপে পৌঁছে নৌকোটাকে পুড়িয়ে দেওয়া।
তার পর একদিন যখন ভূমিকম্পে দ্বীপটি সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেল তখন তুমি যাবে কোথা?
এর উত্তর আমার ঘটে নেই। তার অন্য পন্থা ধরে বললুম, তোমার বয়েস আর কতটুকু? এত শিগগির নিরাশ হয়ে গেলে চলবে কেন?
ইতোমধ্যে অটো এসে পড়াতে আমাদের এ আলোচনা বন্ধ হল। অটোকে অশেষ ধন্যবাদ। তাকে বললুমও, অটো, আপনি অনেক লোকের বহু উপকার করবেন।
অটো বুঝতে না পেরে বললে, কীরকম?
আমি বললুম, পরে বলব, আমি কাল চললুম।
অটো কিছু বলার পূর্বেই কেটে আমাকে বললে, কিন্তু তুমি তো এখনও আমার গান শোনোনি।
অটো বললে, ও সত্যি খুব ভালো গাইতে পারে।
আমি বললুম, কেটে, ডার্লিং, একটি গাও না।
পাবে’র এক প্রান্তে গ্র্যান্ড পিয়ানো। প্রায়ই দেখেছি, সেলারদের একজন কিংবা কেটে স্বয়ং সেটা বাজায়, আর বাকিরা নাচে। কেটে স্টুলে বসে মুহূর্তমাত্র চিন্তা না করে বাজাতে আরম্ভ করে। তার পরেই গান,
তুমি তো আমার
আমি তো তোমার
এই কথা জেনো,
দ্বিধা নাহি আর।
হিয়ার ভিতরে
তালা চাবি দিয়ে
রাখিনু তোমারে
থাকো মোরে নিয়ে
হারায়ে গিয়েছে
চাবিটি তালার
নিষ্কৃতি তব
নাই নাই আর।*
[*Du bist min, ich bin din:
des solt du gewis sin.
du bist beslozzen
in minem herzen:
verlorn its daz sluezelin :
du most immer drinne slin.]
গান শেষ হলে কেটে দৃপ্তপদে ফিরে এসে অটোর মুখোমুখি হয়ে তাকে শুধালে, অটো, এ গানটি তুমিই আমাকে শিখিয়েছিলে না?
.
২০.
বলা বাহুল্য যে কতখানি বলা বাহুল্য এই প্রথম টের পেলুম। ক্যেটের কাছ থেকে বিদায় নেওয়াটা উভয়ের পক্ষেই বেদনাদায়ক হয়েছিল সেটা বলা বাহুল্য, না বলাও বাহুল্য।
ধোপার কালি দিয়ে সে আমার শার্টটার ঘাড়ের ভিতরের দিকে তাদের বাড়ির ফোন নম্বর ভালো করে লিখে দিয়ে বললে, দরকার হলে আমাকে ফোন কর।
আমি শুধালুম, আর দরকার না হলে? এটা ইডিয়টের প্রশ্ন। কিন্তু আমি তখন আর কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিলুম না। কেটে কোনও উত্তর দিলে না। ইতোমধ্যে ক্যেটের মা-বোন এসে পড়াতে আমি যেন বেঁচে গেলুম।
ক্যেটের মা আমার গলায় একটি ক্রুশবিদ্ধ যিশুর ক্ষুদ্র মূর্তি ঝুলিয়ে দিলেন। চমৎকার সূক্ষ্ম, সুন্দর কাজ করা। এখনও আছে।
***
প্রথমটায় রাইনের পাড়ে পাড়ে সদর রাস্তা দিয়েই এগিয়ে চললুম।
এদেশের লোক বিদেশির প্রতি সত্যই অত্যধিক সদয়। পিছন থেকে যেসব গাড়ি আসছে তাদের ড্রাইভার সোওয়ার আমার ক্ষুদ্রাকৃতি, চামড়ার রঙ আর বিশেষ করে চলার ধরন দেখে বুঝে যায় আমি বিদেশি আর অনেকেই কেউ হাত নেড়ে, কেউ গাড়ি থামিয়ে জিগ্যেস করে লিফট চাই কি না। আমি মৃদু হাসির ধন্যবাদ জানিয়ে হাত নেড়ে ওদের এগোতে বলি।
মনে মনে বলি, এ-ও তো উৎপাত। আচ্ছা, এবারে তা হলে গাঁয়ের রাস্তা পাওয়া মাত্রই মোড় নেব। এমন সময় একখানা ঝা চকচকে মোটর আমার পাশে এসে দাঁড়াল। ওনার ড্রাইভার। দরজা খুলে দিয়ে আমার দিকে তাকালে। আমি যতই আপত্তি জানাই সে ততই একগুঁয়েমির ভাব দেখান। শেষটায় ভাবলুম, ভালোই, ক্যেটের থেকে যত তাড়াতাড়ি দূরে চলে যাওয়া যায় ততই ভালো। গাড়িতে বসে বললুম, ধন্যবাদ। ভদ্রলোক বললেন, মোটেই না। এই হল বুদ্ধিমানের কাজ। তার পর শুধোলে, ইডার?
এই প্রথম একটা বিচক্ষণ লোক পেলুম যে প্রথম দর্শনেই ধরে ফেলেছে, আমি কোন দেশের লোক। এস্কিমো বা মঙ্গলগ্রহবাসী কি না, শুধাল না। বললে, কোথা যাবে? ভদ্রতার খুব বেশি ধার ধারে না।
ইন্ডিয়া।
আদপেই বিচলিত না হয়ে বললে, তা হলে তো অনেকখানি পেট্রল নিতে হবে। ঠিক আছে। সামনের স্টেশনেই নিয়ে নেব। তা আপনি বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন না।
শার্লক হোমসের জর্মন মামা ছিল নাকি? পরিষ্কার ভাষায় সেটা শুধালুমও।
হেসে বললে, না। শুনুন। আচ্ছা, আপনি লেফারকুজেন ফার্বেন ইনডুষ্ট্রির নাম শুনেছেন?
দুনিয়ার সবচেয়ে বড় না হোক– দুসরা কিংবা তেসরা, রঙ আর ওষুধ বানায়?
আমি অজ্ঞতা স্বীকার করলুম।
বললে, আমি সেখানে কাজ করি। এখন হয়েছে কী, আমরা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই বহুত কিছু বেচি। ইন্ডিয়াও আমাদের বড় মার্কেট। একটা ওষুধের বিজ্ঞাপন ছাপাতে গিয়ে দেখি তাতে ইন্ডিয়ার যা খরচা পড়বে তার চেয়ে অনেক কম খরচায় হবে এখানে। ইন্ডিয়া থেকে ছবি ক্যাপশন আনিয়ে এখানে জোড়াতালি লাগিয়ে ছাপতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, এ জোড়াতালি লাগানোতে যদি উল্টো-পাল্টা হয়ে গিয়ে থাকে তবেই তো সর্বনাশ! ছাপা হবে তিন লক্ষখানা– তদুপরি মেলা রঙ-বেরঙের ছবি। খরচাটা কিছু কম হবে না– যদিও ওই যা বললুম, ইন্ডিয়ার চেয়ে অনেক কম। তাই ভাবলুম, ওটা কোনও ইন্ডিয়ানকে দেখিয়ে চেকআপ করে নি। আমাদের লেফারকুজেন শহরে কোনও ভারতীয় নেই। কাজেই কলোন বিশ্ববিদ্যালয়। গেলুম সেখানে। তারা তাদের নথিপত্র ঘেঁটে বললে, ভারতীয় ছাত্র তাদের নেই, তবে পাশে বন্ শহরে থাকলে থাকতেও পারে– সেখানে নাকি বিদেশিদের ঝামেলা। কী আর করি, গেলুম সেখানে। সেখানেও গরমের ছুটির বাজার। সবাই নাকে কানে ফ্লোরোফর্ম–আমাদের কোম্পানিরই হবে– ঢেলে ঘুমুচ্ছে। অনেক কষ্ট করে একজন ইন্ডারের নাম বাড়ির ঠিকানা বের করা গেল। তার বাড়ি গিয়ে খবর নিতে জানা গেল সে মহাত্মাও বেরিয়েছেন হাইকিঙে! লাও! বোঝ ঠ্যালা। এসেছিল তো বাবা তিন হাজার না পাঁচ হাজার মাইল দূরের থেকে! তাতেও মন ভরল না। আবার বেরিয়েছেন পায়ে হেঁটে আরও এগিয়ে যেতে। আমার আরও কাজ ছিল মানহাইমে। ভাবলুম, রাস্তায় যেতে যেতে নজর রাখব ইন্ডারপানা কেউ চোখে পড়ে কি না। তার পর এই আপনি।
আমি বললুম, আমি ইন্ডার নিশ্চয়ই, কিন্তু তাতে আপনার সমস্যার সমাধান হবে কি না বলা কঠিন। ইন্ডিয়াতে খানা তেরো চোদ্দ ভাষা! তার সব কটা তো আর আমি জানিন!
বললে, সর্বনাশ! তা হলে উপায়? সেই জোড়াতালির মাল ইন্ডিয়া পাঠাব, সেটা ফিরে আসবে, তবে ছাপা হবে, এতে করে যে মেলা দেরি হয়ে যাবে।
আমি শুধালাম, ইন্ডিয়ার কোন জায়গাতে সেটা তৈরি করা হয়েছে মনে পড়ছে কি?
বললে, বিলক্ষণ! কালকুট্টা।
আমি বললুম, তা হলে বোধহয় আপনার মুশকিল আসান হয়ে যাবে। অবশ্য জোর করে কিছু বলা যায় না। কারণ কলকাতার শহরেও সাড়ে বত্রিশরকম ভাষায় কাগজপত্র ছাপা হয়।
বেশ সপ্রতিভ কণ্ঠেই বললে, আর শুনুন। আমরা কোনও কাজই ফ্রি করাইনে। আপনি বললেও না।
আমি বললাম, আপনি কিছুমাত্র দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনাদের মহাকবি হাইনরিষ হাইনের আমি অন্ধভক্ত। তাঁর সর্বক্ষণই লেগে থাকত তার অভাব। পেলেই খরচা করতেন দেদার এবং বে-এক্তেয়ার। তিনি বলছেন, কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে? যখনই ফুরিয়ে গিয়েছে, তখনই বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছি। আমার বেলাও তাই। আপনি নির্ভয়ে আপনার মাল বের করুন।
জর্মন বললে, ওই তো ডবল সর্বনাশ। আমি সেটা সঙ্গে আনিনি। মোটরে তেলমেলের ব্যাপার, জিনিসটা জখম হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে। তার জন্য কোনও চিন্তা নেই। সামনের কোলেস্ শহরে সবচেয়ে দামি হোটেলের ম্যানেজার আমার বন্ধু, অতিশয় পণ্ডিত এবং সজ্জন। আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তার সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ করে সত্যই আপনি আনন্দ পাবেন। আপনার হোটেল খরচা অতি অবশ্য আমাদের কোম্পানিই দেবে। আমিও প্রতিবার মানহাইম যাবার সময় সেখানে দু রাত্তির কাটিয়ে যাই। আপনাকে তার কাছে বসিয়ে আমি লেফারকুজেন যাব আর আসব।
মোটর থামল।
বাপস! রাজসিক হোটেল। ম্যানেজারটির চেহারাও যেন রাজপুতুর। আরামসে বসেছি। হোটেল খরচা দিতে হবে না। পকেটে একশো মার্ক।
ম্যানেজারের সঙ্গে গালগল্প করলুম। রাত এগারোটায় সেই জর্মন ফিরে এল। কাজকর্ম ইল। আরও একশো টাকা পেলুম।
কিন্তু বাধ সাধল পাশের ওই টেলিফোনটা। বার বার লোভ হচ্ছিল ক্যেটেকে একটা ফোন করি।