ভজগোবিন্দ ভোজনালয়
ভজগোবিন্দ ভোজনালয়ের আমি একজন বাঁধা খদ্দের। অবশ্য এতে আমার আপত্তি বা অসম্মানের কিছু নেই। এই ভোজনালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভজগোবিন্দ জীবিত থাকলে যে কোনও উৎসাহী তার কাছ থেকে এই হোটেলের প্রাক্তন গ্রাহকদের একটি বিস্তৃত তালিকা শুনতে পারতেন। যাঁদের মধ্যে অনেকেই রীতিমতো খ্যাতনামা এখন। একসঙ্গে রাজভবনের কোনও ভোজসভাতেই বোধহয় এতগুলি কৃতবিদ্যা ব্যক্তির দর্শন অসম্ভব। ভজগোবিন্দবাবুর তালিকায় পূর্ণ আস্থা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যেত অন্তত দুজন পদ্মশ্রী, একডজন এম-এল-এ, এমপি এবং ততোধিক সাহিত্যিক, অধ্যাপক এবং চিত্রতারকা জীবনের কোনও না কোনও সময়ে এখানে বসে কিছু না কিছু গলাধঃকরণ করেছেন। ভজগোবিন্দবাবু মধ্যে মধ্যে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে দেখাতেন, ওই চেয়ারটায় বসতেন ভূতোবাবু–আহা, চিংড়ি মাছ দিয়ে নটেচচ্চড়ি তিনি কী যে ভালবাসতেন!অনুসন্ধান করলেই জানা যেত ভূতোবাবু কোনও কেউকেটা নন, বর্তমানে যাঁর ছবি ঘরে ঘরে পর্দায় পর্দায়, সেই বিখ্যাত চিত্রতারকার পরিত্যক্ত নাম ওটা।
যা হোক, ভজগোবিন্দ ভোজনালয় আপনিও নিশ্চয়ই দেখেছেন। হাজরার মোড়ে সেই বিস্তৃত সাইনবোর্ড-হলুদ পটভূমিকায় নীল কালিতে লেখা গোটা গোটা বাংলা হরফে হোটেলের নাম। নামের দুপাশে দুটি ছবি–একদিকে ব্যাঘ্রচর্ম পরিহিত ত্রিশূল হাতে মহাদেব এবং অপরদিকে চেয়ারে আসীন খালিগায়ে হোটেলের মালিক ভজগোবিন্দবাবুর আনুমানিক প্রতিকৃতি। অবশ্য এসবই বছর পনেরো আগের কথা। যখন সাইনবোর্ডটি প্রথম আঁকা হয়েছিল সেই সময়কার। সাইনবোর্ডটির একটি ইতিহাস আছে, জনশ্রুতি কোনও এক সাইনবোর্ড লিখিয়েকে দিয়ে একমাস বিনামূল্যে খেতে দেওয়ার চুক্তিতে এই সাইনবোর্ডটি আঁকানো হয়। কিন্তু ভজগোবিন্দবাবু দিন পনেরো পরে অনুভব করেন যে, হিসেবের তৌলে তিনি কিছু ঠকেছেন এবং ফলত আর্টিস্টের ডালে ভাতের ফ্যান এবং ঝোলের মাছটি ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু ভজগোবিন্দবাবু হিসাবে ভুল করেছিলেন, কেননা তার দুর্ভাগ্যবশত সেই সময়ে শুধুমাত্র তার প্রতিকৃতিটি ব্যতীত আর সবই আঁকা প্রায় শেষ হয়েছিল। সুতরাং খাদ্যাভাবে শিল্পীর স্নায়বিক এবং শারীরিক দৌর্বল্যের প্রকোপ ভজগোবিন্দবাবুর প্রতিকৃতিতে প্রতিফলিত হয়েছিল। তদুপরি পরবর্তীকালে রৌদ্র-বৃষ্টি ইত্যাদি নৈসর্গিক কারণে সাইনবোর্ডের লাল রংটুকু সর্বাগ্রে মুছে যাওয়ায় (ভজগোবিন্দবাবুর চেয়ার লালরঙে আঁকা ছিল) একটি বিচিত্র দৈহিক ভঙ্গি উক্ত প্রতিকৃতিকে জনসাধারণের অবশ্যদ্রষ্টব্যে পরিণত করেছিল। এবং স্বীকার করতে দ্বিধা নেই একদা উক্ত প্রতিকৃতিই আমাকে ভজগোবিন্দ ভোজনালয়ে আকৃষ্ট করে এনেছিল। তদবধি এর বন্ধনে আমি বদ্ধ, বিপরীত ফুটপাথের নিউ গ্র্যান্ড হোটেলের তীব্র প্রতিযোগিতা সত্ত্বেও যে এটি চিরস্থায়ী গ্রাহক ভজগোবিন্দ ভোজনালয়ের আওতায় রয়েছে আমি তাদের অন্যতম।
ভজগোবিন্দ ভোজনালয়ের সেই সাইনবোর্ড আজ আর নেই। নয়া পয়সা হওয়ার পরে ভজগোবিন্দবাবু ভেবেছিলেন যে সাইনবোর্ডের নীচে যেখানে পাইস হোটেল লেখা আছে সেখান নয়া পয়সা হোটেল লিখে দেবেন, এই ভেবে সাইনবোর্ডটা নামিয়ে আনেন। কিন্তু শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে অবশেষে তিনি মত পরিবর্তন করেন এবং নয়া পয়সার মতো তুচ্ছ ব্যাপারে পাইস হোটেলের ঐতিহ্য নষ্ট না করাই স্থির করেন।
মধ্যে কয়েকদিন আমি কলকাতায় ছিলাম না। অনেক রাত্রিতে বাসায় ফিরে এসেছি। এমন সময় দরজায় ধাক্কাধাক্কি এবং কান্নার চিৎকারে ঘুম ভেঙে দরজা খুলে বেরোলাম। বাইরে দেখি ভজগোবিন্দবাবুর বড় ছেলে নবলাল দাঁড়িয়ে, সঙ্গে আর দু-একজন। আমি বেরোনোমাত্র নবলাল বললে, বাবু, সর্বনাশ হয়েছে। বাবা, আমার বাবা আজ তিনদিন…এই বলে ফোঁপাতে লাগল। আমি কিছুটা অনুমান করলাম!
ভজগোবিন্দবাবুর বয়স হয়েছিল! আমি সঙ্গের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল? লোকটি যা জানাল তার সারাংশ ভজগোবিন্দবাবু আজ তিনদিন হল মরে গেছেন। আমি বেশ অবাক হলাম। আমি ভজগোবিন্দবাবুর হোটেলের গ্রাহক, কিন্তু শুধুমাত্র সেই সূত্রেই ভজগোবিন্দবাবুর মৃত্যুর তিনদিন পরে তার ছেলে মধ্যরাত্রিতে আমার উপর হামলা করে শোকপ্রকাশ করবে, এটা বিশেষ সুবিধে মনে হল না। তবে ভদ্রতার খাতিরে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি, তা বাবার বয়স হয়েছিল, মানুষ কি চিরকাল বাঁচে? ইত্যাদি নানা ধরনের কথা বলতে লাগলাম।
নবলালবাবুর কান্না থামল না, কিন্তু বাবা তো আরও একমাস আগেও মরতে পারতেন, এখন আমরা একেবারে ডুবে গেলাম। আর, আর ওই শয়তান, ওই বলাই দাস…।
বলাই দাস–ভজগোবিন্দ ভোজনালয়ের সনাতন প্রতিদ্বন্দ্বী নিউ গ্র্যান্ডের মালিকের নাম। ভজগোবিন্দবাবু একমাস আগে মারা গেলেই বা কী সুবিধা আর বলাই দাসই বা এই শোকের মধ্যে আসে কেন, সমস্ত বিষয়টি বিশেষ জটিল হয়ে উঠল আমার কাছে। সারাদিন ক্লান্তির পর বর্ষণমুখর এক শ্রাবণের মধ্যরজনীতে হোটেল-মালিকের তিনদিন পূর্বে মৃত্যুর জন্যে যেটুকু দুঃখিত হওয়া। উচিত, যেটুকু শোকান্বিত হওয়া উচিত–তার চেয়ে অনেক বেশি শোক এবং দুঃখ পেতে হল। অনেক পরমাত্মীয়ের মৃত্যুতে নির্বিকার থেকেছি, এটাকে তার প্রায়শ্চিত্ত বলে ধরে নিলাম।
এইবার নবলাল আমাকে পায়ে জড়িয়ে ধরল, বাবু বাঁচান। আমি প্রায় পড়ে যেতে যেতে আচমকা এই ধাক্কা সামলে নিলাম। নবলাল তখন বলছে, আমাদের হোটেলে আপনাকে খেতে হবে। তা তো খাই, সে তো নবলাল না বললেও খাই, কিন্তু ব্যাপারটা কী? শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে এসেছে নাকি–তিনদিনে শ্রাদ্ধ, কী জানি আর এভাবে নিমন্ত্রণ আমার জ্ঞাতসারে কোথাও কখনও দেখিনি।
খটকাটা লেগেই রয়েছে। অবশেষে যা বোঝা গেল, এখন চারিদিকে ভীষণ কলেরা– কর্পোরেশন বলছে মহামারী, এর মধ্যে ভজগোবিন্দবাবু মারা গেছেন। বলাই দাস চারদিকে রটিয়ে দিয়েছে যে ভজগোবিন্দবাবুর কলেরায় মৃত্যু হয়েছে। হোটেলের মালিক যে সবচেয়ে ভাল খাদ্যদ্রব্যগুলি নিজে খায়, সেই যদি কলেরায় মরে, তাহলে অন্য লোক আসবে কোন ভরসায়। বাঁধা খদ্দের আজ দুদিন একজনও আসছে না, উটকো ছুটকো এক আধটা আসে, আর সব সময় হোটেল ফাঁকা।
নবলাল আবার আমার পা জড়িয়ে ধরল, বাবু, আপনার পা ছুঁয়ে বলছি, বাবা এমনি এমনি মরে গেছে, তার কিছু হয়নি, ফোঁপাতে লাগল, আপনি আমাদের হোটেলে খাবেন, এক পয়সা দিতে লাগবে না। যা খেতে চান তাই রান্না করব। শুধু দুবেলা রাস্তার ধারের ওই জানলার পাশের সিটটায় বসে খাবেন। এ পাড়ায় আমি পুরানো লোক। সুতরাং আমি যদি ভোজনালয়ে নিয়মিত খেতে থাকি, তাহলে আস্তে আস্তে অনেকেই আমার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে, নবলাল কেঁদে কেটে জানাল।
জানি না, ভজগোবিন্দ সত্যই কলেরায় মরেছেন কিনা, সেটা তো বলাই দাসের অপপ্রচার নাও হতে পারে, হয়তো সত্যিই তাই–কিছু আশ্চর্য নয়।
কিন্তু তাতে আমার কী? জীবনে এই প্রথমবার মরাল কারেজ, সৎসাহসের অভাব হল না আমার। কোনও ইতিহাসের কোনও অধ্যায়েই এই অভূতপূর্ব আত্মবিসর্জনের কাহিনির কোনও স্থান নেই, কোনও তুলনাও নেই–একথা জেনেও আমি নবলালকে কথা দিলাম। সেই কথা এখনও রেখেছি। আর সৎসাহস থাকলে যে কোনও কাজেই কোনও ক্ষতি হয় না তার প্রমাণ আমি এখনও জীবিত। ভজগোবিন্দ ভোজনালয়ের কোনও আসনই কোনও মুহূর্তে ফঁকা যাচ্ছে না। হাজরার মোড়ে নতুন সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে, তাতে কবজিতে ঘড়ি-আঁকা একটি হাতের তর্জনী নির্দেশ রয়েছে, আসুন, পাইস হোটেল ভিতরে।