ভগ অর্যমা
ক্রমশই তাদের কুটিরগুলি শক্ত, আরও শক্ত হচ্ছে। চারপাশ গাছ দিয়ে ঘেরা, যাতে অতিরিক্ত বৃষ্টি, হাওয়া, গরম, ঠান্ডা আড়াল করতে পারে। মাটি, মাটিকে অবলম্বন করে তৈরি হচ্ছে মানুষের থাকার ঘর। ওপরে আচ্ছাদন, শুকনো ধানগাছ আঁটি বেঁধে বেঁধে তৈরি করা হচ্ছে। নতুন কত কিছু উদ্ভাবন করছে এ ও সে। যখনই দেখো, মাটি চাপড়ে চাপড়ে, তার ওপর আরও মাটি চাপিয়ে ঘর আর তার দেয়াল রোদ পোহাচ্ছে। ঢালু চাল বেয়ে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির কণা। পরম সন্তোষে জলকণাগুলি হাত পেতে ধারণ করে ছন্দ। সে মোটামুটি বীরপুরুষ, মধুরার দলেও সে বীরপুরুষের প্রাপ্যই পায়। কিন্তু বিজিত বলে তার মর্যাদা কিছু কম ছিল। নিমেষও অব্যর্থ লক্ষ্যভেদ করতে পারে, সে-ও পারে। কিন্তু নিমেষের স্থান অনেক উঁচুতে। যেই ধানগাছের আঁটি খড়ের দড়ি দিয়ে বেঁধে বেঁধে সে ঘরের দুদিকে ঢালু ছাতের পরিকল্পনা করল অমনি হঠাৎ তার দাম খুব বেড়ে গেছে। শিশুগুলি মুখে আঙুল পুরে হাঁ করে ঘরের চালের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিচু দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে হাতে হাত ঘষে খুশি জানায় মধুরা। না একটুও বৃষ্টি পড়ছে না। ভেতরটি বেশ সুরক্ষিত।
বড় একটি ঘর পেয়েছে ভগ ও অর্যমা। ওরা নিজেরাই বেছে নিয়েছে, কেননা ওদের কাজকারবার অন্যরকম। ভগর তো রাশি রাশি গাছগাছড়া, বড় বড় ভাঁড়ে রাখে সে তৈরি ওষুধ। আর অর্যমা নির্নিমেষ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভবিষ্যদ্বাণী করে—দেখে রাখো ভগ, কাল চাঁদ পূর্ণ হবে, ধন্যা ফুলে উঠবে। চাঁদ পূর্ণ কিংবা অদৃশ্য হলেই ধন্যার মধ্যে এরকম পরিবর্তন আসে।
দুজনের প্রতীক্ষা শুরু হয়। আর কাউকে বলে না তারা। সত্যি! একদম ঠিক। একটি শিশু যেদিন জল ফুলবে বুঝতে না পেরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলা করছিল এবং জলের তোড়ে ভেসে গেল, সেই দিনই অর্যমা তার আবিষ্কার জানাল।—‘চাঁদ গোল হলে কিংবা অদর্শন হলে, ধন্যা ফুলবে। সাবধান!’ সবাই সেই থেকে সাবধান হয়ে গেল। সবাই অবাক। পূর্ণ চাঁদের দিন ধন্যার তীরে সব সারসার দাঁড়িয়ে আছে, দেখবে।
মধুরা বলল— জাদু! জাদু! অর্যমা জাদু করতে পারে, চাঁদকে ও-ই বশ করেছে।
ভগ বিরক্ত হয়ে বলল—বাজে বোকো না। জাদু যদি কেউ করে থাকে সে স্বয়ং চাঁদ। চাঁদের সঙ্গে নদীর খেলা। অর্যমা সেটি লক্ষ করেছে মাত্র। অর্যমার লক্ষ করা, আরও অনেক ঘটনার কথা ক্রমে জানতে পারে সবাই। সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে— এই মানুষটি বিশেষ, শিকারে যায়—পশুপাখির সম্পর্কে নানা তথ্য জেনে আসে, ক্ষেত্রে কাজ করতে যায়, ধান্যর প্রকৃতি সম্পর্কে নানা কথা জেনে আসে। ক্রমে অর্যমা অন্য গাছও তৈরি করে, ঘাসপাতার রকমসকম লক্ষ করে করে। যেগুলো ওষধির জন্য দরকার, ভগকে অনেক কষ্টে সংগ্রহ করতে হয়, সেগুলিও কিছু কিছু একটি ক্ষেত্রে উৎপাদন করে সে।
সেদিন এইরকম পূর্ণচন্দ্র। আকাশ, বন আলোয় ভেসে যাচ্ছে। নদীর দিক থেকে খলখল আওয়াজ আসছে। তীরে বসে আছে ভগ। হঠাৎ সামনে আলো আড়াল হয়ে গেল। তারপরই আলো সর্বাঙ্গে মেখে হেসে উঠল রঙ্কা।
—ভগ তুমি একা? তোমার বন্ধু কোথায় গেল? পাগলটা?
ভগ হাসল—তা তো জানি না রঙ্কা, তবে কাল সারারাত কী যেন গণনা করেছে, কাঠি দিয়ে আঁক কাটছিল। আজ দুপুরেও ভাবিত ছিল, এখন বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। রঙ্কা বলল—ভগ, এসো আমরা মিলিত হই।—সে বিনা বাক্যব্যয়ে ভগর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার সাদা বুকের ওপর মুখ ঘষতে ঘষতে বলল—আমার তোমাকেই সবচেয়ে মনোহর লাগে। ভগ, তোমার মতো এরকম উচ্চ পুরুষ আমি দেখিনি। তোমাদের ওপর আমার খুব রাগ ছিল। কিন্তু তুমি আশ্চর্য। চাঁদের দেবতা স্বয়ং তোমাকে গড়েছেন। তুষারের মতো। চাঁদের বুকের মতো সাদা তুমি। তুমি আমার ঘরে থাকবে চলো ভগ।
রঙ্কার বলিষ্ঠ আলিঙ্গনে ভগর এক অপরিচিত অনুভূতি হচ্ছিল। আজ পর্যন্ত কোনও নারী তাকে চায়নি। সে অস্বাভাবিক, যখন জন্মেছিল তখন তার মা বর্ণা তাকে জলে ভাসিয়ে দিতে গিয়েছিল, অন্যরা বর্ণাকে বারণ করে। সে একা একা বেড়ে উঠেছে। একা একা খেলা করত, অন্য শিশুগুলি নিমেষ, শব্দ, নন্দ, এরা তাকে দেখলে সরে যেত। বলত— ভগ তুমি দূরে যাও। তোমার চোখের পলক সাদা, চোখের মণি লালচে, তোমার সারা দেহে কোথাও কালো নেই। শিশু অথচ সাদা চুল তুমি এক অদ্ভুত। তুমি বৃদ্ধ কি শিশু আমরা জানি না। তুমি দূরে যাও।
ভগ বনভূমিতে নিজের মনে বিচরণ করত। একদিন দেখল একটি আহত হরিণ দৌড়ে এসে এক ধরনের ঝোপঝাড়ের মধ্যে গড়াগড়ি খেতে লাগল, …আরেক দিন একটি নকুলকে আরেক ধরনের ঘাসে একই ভাবে গড়াগড়ি খেতে দেখল। হরিণটা আহত ছিল, সে তার একটি পায়ে শক্ত করে লতার বাঁধন দিয়ে চিহ্ন করে রেখে দিয়েছিল। নকুল খুব অস্থির জীব, তাকে পারেনি। কিন্তু ঘাসগুলি আলাদা করে রাখে। চিহ্নিত হরিণটির ক্ষত ক’দিনেই শুকিয়ে মিলিয়ে গেল। এই ভাবে শুরু হল ভগর কাজ-কারবার। ক্রমে গোষ্ঠীতে সে একজন সম্মানিত মানুষ বলে গণ্য হতে লাগল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনও নারী তার কাছে কখনও আসেনি।
সে সামান্য জোর করে রঙ্কার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে আলাদা করল। হাত দুটি দিয়ে রঙ্কার কাঁধ ধরে সামান্য পিছিয়ে দিল তাকে। নিরীক্ষণ করল অনেকক্ষণ ধরে, তারপর বলল—রঙ্কা, ভাল করে ভেবে দেখেছ? নিশ্চয় জানো আমার মতো অদ্ভুত চেহারা আর কারও নেই। চিরকাল আমি একা একা থেকেছি, কোনও নারী আমাকে ডাকেনি। মধুরা যে মধুরা, দলে হেন পুরুষ নেই যে তার কৃপা না পেয়েছে সে পর্যন্ত আমাকে কোনও দিন মিলনদৃষ্টি দেয়নি। কেন? আমি অস্বাভাবিক… আমার স্পর্শে কারও কিছু ক্ষতি হতে পারে… সবাই তাই-ই ভাবে। কিংবা ঘৃণা জন্মায়, ঘৃণা করে…
রঙ্কা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে বলল—তুমি অস্বাভাবিক নও, অসাধারণ। বললাম না! স্বয়ং চাঁদ তোমায় গড়েছেন! যে দেবতা সে কী করে আর পাঁচজনের মতো শুধু মানুষ হবে? আর ক্ষতির কথা যদি বলো, ভগ, তোমার মতো মহৎ উপকার তো আর কেউ এ গোষ্ঠীতে করতে পারেনি! তুমি তাদের রোগ সারাও, ক্ষত সারাও, তারপরও যদি তাদের ঘৃণা হয়, তো হোক। সে তারা বুঝবে। মধুরা না চাক, অন্য কোনও নারী না চাক, আমি রঙ্কা, মাতঙ্গীর মেয়ে আমি তোমাকে মিলনদৃষ্টি দিচ্ছি।
ধন্যার তীরে কোথাও কোনও আড়াল নেই। চাঁদ গলে গলে পড়ছে যুগলের ওপর। ভগ যেন শ্বেত হরিণ, আর রঙ্কা যেন বিদ্যুৎ। ধন্যার তীরের ভিজে মাটি মেখে মেখে, ধন্যার ছলচ্ছলের সঙ্গে তীব্র শীৎকার মিলিয়ে প্রায় সারারাত ধরে দুজনের খেলা চলে। এবং অনেক দূরে গাছের আড়াল থেকে ধনুর্বাণধারী একটি মানুষ তাদের লক্ষ করে। সে ব্যাপারটি পছন্দ করছে না। এই মুহূর্তে রঙ্কা ভগকে পছন্দ করেছে, তার কিছু বলবার নেই। নালিশ করা হাস্যকর হবে। মধুরাকে বলা আরও বিপজ্জনক, মধুরা যদিও সবাইকেই মিলনদৃষ্টি দেয়, তবু তার প্রতি একটু বেশি বেশি। সে যদি জানতে পারে রঙ্কাকে অন্যের সঙ্গে মিলিত দেখলে তার রাগ হয়, তখন ঈর্ষায় সে রঙ্কাকে মেরে ফেলতেও পারে। আবার গোষ্ঠীর নারীর সঙ্গী নির্বাচনের মধ্যে নাক গলাচ্ছে বলে তাকে বিতাড়িত করতে পারে। সে একা থাকতে পারে না। বনে-জঙ্গলে একা একা ঘোরা তার পোষাবে না। কত কষ্ট করে তার এই গোষ্ঠীর বিশ্বাস ও ভরসা সে অর্জন করেছে, আবার কোথায় যাবে! এই ধান্য ছেড়ে? এই নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে! নিমেষ ভাবতে থাকে, ভাবতে থাকে।
রঙ্কা কুটিরে থাকত একা। সবাই তাকে ভয় পায়। খরচোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে মধুরাদের দেখে, যেন অভিশাপ দিচ্ছে। সে কোনও পুরুষকে চায় না। শম, ছন্দ, অলম্বুষ— এরা সব তার চোখে ব্রাত্য হয়ে গেছে। আপন মনে থাকে রঙ্কা। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর করে সব। এবং সে এমন একটা কাজ করে যেটা গোষ্ঠীর সবাইকার প্রশংসা কুড়িয়েছে। ধান্য ছাড়াও আজকাল তারা বন্যফল নানারকম ফলাচ্ছে। বনের ভেতর থেকে মাটি খুঁড়ে ও গাছ ঝাঁকিয়ে সংগ্রহও করে অনেক। রঙ্কা সেগুলি থেকে চমৎকার খাদ্য প্রস্তুত করে। ধান্যের ভেতরের তণ্ডুল, বড় বড় কন্দ সিদ্ধ করে, খণ্ড খণ্ড করে তাতে ঝলসানো হরিণ বা বরাহ মাংস মিশিয়ে দেয়, লোনা মাটি মেশায় এবং অপূর্ব স্বাদের খাদ্য তৈরি হয়। অন্ধকার হলে যখন গ্রাম ঘিরে আগুন জ্বালানো হয়, অনেকেই শিকার করে আনা পশু ঝলসায় তাতে। রঙ্কা এক ধারে বসে নীরবে। আপন মনে তার কাজ করে যায়।
—কী করছ রঙ্কা! —শব্দ হয়তো জিজ্ঞেস করল।
—পরিপক্ব করছি।
—কী করছ রঙ্কা?
অর্যমা হয়তো জিজ্ঞেস করল।
—রন্ধন করছি। আগুনের ওপর সোজা ফেলে দিলে তা পোড়ানো হয়। জল দিয়ে বস্তু আগুনে রেখে নরম করার নাম সিদ্ধ করা। উভয় মিললে রন্ধন। আমি রন্ধন করছি। রঙ্কার উদ্ভাবিত এই নতুন খাদ্য মধুরার ভাল লাগে। নিমেষ মুগ্ধ হয়ে যায়। এবং পুরো গোষ্ঠী রঙ্কাকে অসাধারণ বলে স্বীকার করে। তাই যখন সে ভগকে তার ওষধি ও রসের ভাঁড়সুদ্ধু নিজের কুটিরে নিয়ে এল, সকলেই অবাক হল। এত দিন জেদ করে ছোট কুটিরটি সে তার একার অধিকারে রেখেছিল। এরকম নিয়ম নেই। একমাত্র মধুরা কয়েকটি শিশু নিয়ে একটি বড় কুটিরে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক কেউ সেখানে থাকে না। আর প্রত্যেকটি কুটিরে তিনজন, চারজন করে মানুষ থাকে। বস্তুত ঘরের তেমন দরকারই বা কী! সারাদিন হয় ধান্যক্ষেত্রে, নয়তো বনের গভীরে ঘুরতে ঘুরতে কেটে যায়, একমাত্র রাত্রে ঘুমের সময়ে ঘর। মাথার ওপর আচ্ছাদন থাকলে শীত ও বৃষ্টির হাত থেকেও বাঁচা যায়। কিন্তু রঙ্কা যখন নিজের হাতে একটি ছোট কুটির তৈরি করে সেটি দখল করে সোজা তীব্রভাবে দাঁড়িয়ে রইল, মধুরা সবাইকে নিষেধ করে— ওকে কেউ বিরক্ত কোরো না। ও যা চায় তাই করুক। মধুরার চোখ নেত্রীর চোখ, সে রঙ্কার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা দেখে। রঙ্কা একা একাই ধান আছড়ায়। একা একাই শিকার করে আনে, তার ছাল ছাড়িয়ে পরিষ্কার করে। সবই একা একা। অসহযোগিতা করে না, কিন্তু সে বুঝিয়ে দেয় সে নিজেকে নিয়ে থাকতেই পছন্দ করছে। নিমেষ তাকে বাগ মানাতে অনেক চেষ্টা করেছে। বনে গুঁড়ি মেরে মেরে নিঃশব্দে রঙ্কা এগোচ্ছে একটি বড় খরগোশকে ধরবে বলে, হঠাৎ পাতায় সড়সড় শব্দ হয়। শশক ছুটে পালায়, রঙ্কা মুখ তুলে দেখে নিমেষ।
রাগে অধীর হয়ে সে চিৎকার করে— আমার শিকারটি নষ্ট করলে কেন? উত্তরে হাসে নিমেষ, চট করে ঘুরে কোথায় চলে যায়, অল্প পরেই তিন-চারটি খরগোশ হাতে ঝুলিয়ে এনে রঙ্কার পায়ের কাছে রেখে দেয়। রঙ্কা অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তার দিকে চায়। তারপর সে জায়গা ছেড়ে চলে যায়।
রঙ্কা সাঁতার কাটছে। জলের মধ্যে মাছ ধরছে। তীরের কাছে এসে মাছটি আছড়ে মেরে ফেলে আবার যাচ্ছে। এভাবে কয়েকটি বড় বড় মাছ ধরার পর সে শুধুই সাঁতার কাটে। ডুব দিয়ে চলে যায় গভীরে, তারপর ভুস করে ভেসে ওঠে এবং দেখে ওদিক থেকে সাঁতরে আসছে নিমেষ।
—রঙ্কা, রঙ্কা মনে আছে আমি তোমার সাঁতার-বন্ধু, জলের বন্ধু? মনে আছে?
রঙ্কা উত্তর দেয় না। সে মুখের জল কুলকুচি করে ঊর্ধ্বমুখে ফোয়ারার মতো ছড়িয়ে দেয়। তারপর আবার ডুব গালে। পিছলে পিছলে চলে যায় দূরে আরও দূরে। আসলে সে নিমেষকে ঘৃণা করে। এই লোকটি মিথ্যা বলেছিল, এ তার পেছন পেছন এসে তাদের ধান্য দেখে গিয়ে তাদের আক্রমণ করেছে। মেরেছে। মাতঙ্গীকে, সিংহকে সে হারিয়েছে এই কূট মানুষটির জন্য। সে কখনওই নিমেষকে বরদাস্ত করবে না।
অর্যমা করুণ চোখে তাকিয়ে বলল— আমার বন্ধু ভগকে নিয়ে যাবে রঙ্কা?
রঙ্কা বলে— অর্যমা, তুমিও ইচ্ছে করলে আসতে পারো। আমি দশার সময়ে তোমাকেও আলিঙ্গন দিতে পারি, কিন্তু একটি শর্ত। অন্য কারও আহ্বানে সাড়া দিতে পারবে না। রাজি?
—এ আর শক্ত কী! আমাকে কে ডাকতে যাচ্ছে? আমি তো তেমন বীর নই। আর আমার তেমন দশা হয়ও না। কিন্তু আমাকে ইচ্ছেমতো বিচরণ করতে দিতে হবে— তা বলে দিলাম। অনেক সময়ে রাতে আমি বাইরেই থাকি।
রঙ্কা, ভগ ও অর্যমার একসঙ্গে থাকার এই ইতিহাস। এরকম তো কতই হয়। কে লক্ষ করছে? একটি কুটির একজন পাবে এত কুটির তো এখনও হয়নি। তাই দু’তিনজন ভাগাভাগি করেই থাকে। সেই দলে অদল-বদলও হয়। কিন্তু ভগ খুব আত্মমগ্ন থাকলেও বুঝতে পারে যখন-তখন কে যেন তাকে অনুসরণ করছে। পশু নয়, মানুষ। সে কান খাড়া করে শোনে, শব্দটা সরে যায়, তারপর আবার সে কাজের মধ্যে ডুবে যায়। কাজ বলতে নতুন লতাপাতার সন্ধান, নোনা মাটির সন্ধান। লতাপাতা ছেঁচে রস বার করা— এই সব। সম্প্রতি নদীর ভেতরে থেকে সে একরকম জলজ উদ্ভিদ পেয়েছে। ছেঁচে খেয়ে দেখতে চেয়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুম এসে যায়। দিন-দুপুরে যখন পুরো গ্রাম ঘর ছেড়ে শিকারে, শস্যক্ষেত্রে গেছে, বালকগুলি পালিত জন্তুগুলিকে ঘাসপাতা খাইয়ে আনছে, তখন ভগ নদীর ধারে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
দুটি পা এসে তার সামনে থামল। কিছুক্ষণ দাঁড়াল, তারপর দুটি অমিতবল হাত তাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। ভগ পড়ে যাচ্ছিল, একটি শক্ত কাঁধ তাকে ঠেকাল।
—ভগ, ভগ, জাগো, জেগে ওঠো— গম্ভীর স্বরে কেউ বলল। ভগর ঘোর কেটে গেল, সামনেটা ছায়া-ছায়া, সে ঢুলু-ঢুলু চোখে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে নিমেষ।
—কী হয়েছে? ভগ জড়ানো স্বরে বলল— আমি আরও একটি নতুন শক্তিশালী ওষধি খুঁজে পেয়েছি। কাজে লাগবে…। নিমেষ তোমার কিছু হয়েছে?
কড়া গলায় নিমেষ বলল— তুমি আর অর্যমা রঙ্কার কুটির ছেড়ে চলে যাবে।
—কেন? —ভগ অবাক হয়ে বলল— রঙ্কাই তো ডেকে আনল, সে বললেই চলে যাব।
নিমেষ দাঁত কিড়মিড় করে বলল— আমি বলছি চলে যাও। —আমি কথাটার ওপর জোর দিল সে।
ভগ জীবনে কখনও এত অবাক হয়নি। রঙ্কার কুটির থেকে তাকে চলে যেতে বলবার নিমেষ কে? বলতে পারে রঙ্কা নিজে কিংবা মধুরা, দলের নেত্রী। ভগ নিজেও চলে যেতে পারে, তার যদি খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু নিমেষ কেন? নিমেষ তো বলবার কেউ নয়! নিমেষ বলল— চলে যাবে আজই, নইলে বিপদ হবে— আজই যাবে… এই বেলা রঙ্কা শস্য-মাঠে গেছে, যাও নিজের গাছ-গাছড়া সব নিয়ে চলে যাও।
ভগ শান্ত চোখে চেয়ে রইল তার দিকে, তারপর আস্তে আস্তে তার সদ্য সংগৃহীত উদ্ভিদগুলি নিয়ে চলে গেল। তার এখনও খুব মিঠে একটা ঘুমঘোর রয়েছে। সে এখন কুটিরে গিয়ে আরও একটু ঘুমোবে। ওষধির ঘোরটি কাটিয়ে নেওয়া উচিত। কারও গায়ে বর্শা বা তির কিছু লাগলে, উপড়ে তোলার সময়ে এই ওষধিটি কাজে দেবে। বিশেষত বালক-বালিকাদের ক্ষেত্রে। কুটিরে আসতে আসতে কিন্তু ভগর ঘোরটি একেবারে কেটে গেল।
কেন? নিমেষ এরকম কথা বলল কেন? অনেকক্ষণ ধরে ভেবে ভেবেও সে কূল পেল না। এদিকে না রঙ্কা, না অর্যমা কারও দেখা নেই যে জিজ্ঞেস করবে।
—নিমেষ, তুমি কি এখনও রঙ্কাকে শত্রুপক্ষীয় বলে অবিশ্বাস করো? সে নিজেকেই শুধোয়। এ কথা সত্যি রঙ্কা মধুরার দলের কারও সঙ্গে মেশে না, নিজেদের দলের পুরনো মানুষদের প্রতিও কেমন একটা অবজ্ঞা দেখায়। রঙ্কা কি ভেতরে ভেতরে কোনও গণ্ডগোল পাকাচ্ছে বলে ভাবে নিমেষ? ওকে ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে, রঙ্কা অভিমানে উগ্র হয়ে আছে, তার দলনেত্রী মাতঙ্গীর পরাজয় ও মৃত্যু সে মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু আর কোনও মতলব তো তার নেই! সে ওষধির ব্যবহার রঙ্কাকে অনেক শিখিয়ে দিয়েছে, অর্যমাও তার পর্যবেক্ষণের ফলাফল ও সিদ্ধান্ত নিয়ে রঙ্কার সঙ্গে আলোচনা করে। রঙ্কা চট করে সব বুঝে নেয়। …ব্যাপারখানা কী? নিমেষ কি রঙ্কাকে চায়? তো চাক না, কে বারণ করেছে। রঙ্কার কাছে নিজেকে নিবেদন করুক না, ভগ তো নিষেধ করেনি! এই প্রশ্নের উত্তর শীঘ্রই একদিন ভগ পায়।
শস্য তোলা হয়ে গেছে। রোদে শুকোচ্ছে তারা গোছায় গোছায়। মাটির ওপর শস্য ঘিরে গোল হয়ে বসে রয়েছে সবাই। হাসিখুশি। খেলাচ্ছলে এ ওকে খোলামকুচি ছুড়ে দিচ্ছে, লোফালুফি চলছে। গাছে একরকম বাদাম পেয়েছে তারা। অজস্র। সেগুলি খাচ্ছে অনেকেই। হঠাৎ রঙ্কার কুটিরের দিক থেকে একটা আওয়াজ উঠল। ক্রুদ্ধ বনবিড়ালের ঝগড়ার মতো। কিছুক্ষণ পরেই অবাক হয়ে সবাই দেখল, নিমেষ রঙ্কার চুল ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসছে। রঙ্কা প্রাণপণে দু হাতে নিমেষকে প্রহার করবার চেষ্টা করছে কিন্তু নিমেষ তার নাগালের একটু বাইরে। এইভাবে টানতে টানতে সে রঙ্কাকে সবার মাঝখানে ছুড়ে ফেলে দিল, কঠিন গলায় বলল— প্রথম থেকেই বলেছি এ আমার নারী। আমার একার। নিজের রক্ত দিয়ে এর কপাল দেগে দিয়েছি আমি। তা সত্ত্বেও ভগ, অর্যমা, রঙ্কা কেউ আমার কথা শোনেনি। আজ তোমাদের সবার সামনে বলে দিলাম, রঙ্কার কুটিরে আর কেউ থাকবে না, থাকবে খালি নিমেষ। খালি নিমেষ। রঙ্কার কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে, সে উঠে দাঁড়িয়েছে। সমস্ত শরীর থেঁতলে ছড়ে গেছে, কালো লাল নীল দাগ ফুটে উঠেছে যেখানে সেখানে, সে চিৎকার করে বলল—তোমরা সবাই শুনে রাখো, নিমেষ থুঃ থুঃ থুঃ। জোর করে সে আমাকে দখল করতে চায়। আজ অবধি এমন অঘটন মাতঙ্গীর গোষ্ঠীতে হয়নি। মধুরা, মধুরা— যদি সত্য সত্য নেত্রী হও, তো আজ মাতঙ্গীর মেয়ে রঙ্কা তোমার কাছে বিচার চাইছে-এ-এ-এ।
সোজা একটি তির এসে কোথা থেকে বিঁধে গেল নিমেষের ডান হাতে, সে যন্ত্রণায় একটু হেলে গেলে আরেকটি তির এসে বিঁধল তার বাঁ হাতে। নিমেষের দুই হাত খালি। সে মাটিতে পড়ে গেছে। ভগ ছুটে গেল কুটির থেকে তার ওষধি আনতে। অর্যমা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, ক্রুদ্ধ গোঙানি নিমেষের মুখে, এক অশ্বারোহিণী এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল—আমার দলের নারীর ওপর হামলা করার দণ্ড দিলাম।
ভগ ততক্ষণে তার ওষধি নিয়ে এসে গেছে। জোর করে সে নিমেষকে কিছু খাইয়ে দিল, তারপরেই মধুরার বল্লম তার ভাঁড়গুলিকে ঠেলে সরিয়ে দিল। বলল—তোমরা সকলে মিলে একে বনের গভীরে রেখে এসো। নিমেষকে নিয়ম ভাঙার জন্য দল থেকে তাড়িয়ে দিলাম। কেউ তাকে সাহায্য করবে না।
নিমেষ বিতাড়িত, নিমেষ বিতাড়িত—একটা বিস্ময়, ভয়, আক্ষেপের চিৎকার উঠল চারদিকে।—আক্রান্ত হলে কার শর আমাদের রক্ষা করবে?
—কেন মধুরা নেই?
—মধুরা একা, মধুরা একা…
—কেন? তোরা নেই! তোদের বাহুবল নেই? লড়তে পারিস না? —ঘৃণায় কুটিল হয়ে উঠেছে মধুরার মুখ।
…নিমেষ আমাদের চেয়েও বীর ছিল!
—চুপ। একদম চুপ। নিমেষের জায়গায় রঙ্কা তোদের রক্ষা করবে, ছন্দ করবে, শব্দ করবে। ভগ তুমি রঙ্কার ক্ষত ভাল করে দাও।
নিমেষ ততক্ষণে বেহুঁশ। মধুরার কথামতো কয়েকজন তাকে চ্যাং-দোলা করে বনের গহনে দূরে আরও দূরে নিয়ে যেতে থাকল।