ভগীরথ

ভগীরথ

তখন মাঠ গিলছিল রোদ্দুরের রং। পিচকুরির ঢালের বাতাস ছুটছে অজয় নদীর চরের দিকে। কড়াই দানা পুরুষ্ট হচ্ছে ডাঙা মাঠে। সদ্য প্রসবকরা মাঠে ধানকাটার অবশেষ পড়ে আছে। কোথাও মাঠের মাঝে পড়ে আছে স্তূপাকার ধান, গোরুর গাড়িতে ধান যাচ্ছে। উঠানে ধান্য গন্ধ। ধান ভানার টিপিক টিপিক শব্দ কোথাও। চিতের বেড়ায় এল লাল লাল ফুল, বাখরগুলি দিয়ে নতুন চালের পচাই তৈরি হচ্ছে বাগদি পাড়ায় বাউড়ি পাড়ায়, কানাই মুদি পলিথিনের প্যাকেটে আনিয়ে রেখেছে বোলপুরের ঝাল চানাচুর। চায়ের দোকানে সকাল সন্ধ্যা জিলিপি ভাজা হচ্ছে।

ধান পাকলে হইহই ঢ্যাঁড়া। মানুষ জনের মুখে শালুক ফুলের টাটকা হাসি। ঢোল বাজে, মাদল বাজে, ‘লবান’ হয়। নতুন ধানের উৎসব।

তখন ফাঁকা মাঠের গোপন আনাচ-কানাচ, ইঁদুরের গর্ত, আলের ফাটল থেকে পায়রা ঘুঘু আর চড়াইয়ের সাথে খুঁটে খুঁটে ধান খুঁজছে কোড়া পাড়ার ছিলা-পিলারা। মাঠবাবু এইসব দেখছিল। মাঝে মধ্যে তত্ত্বতালাশ নিচ্ছিল— হেই গদ্‌কা, পোয়াটাক পেলির‍্যা? হেই যমুনা, তুয়ার কত ক’টা হল? মাঠবাবু দাঁড়িয়ে আছে বঙ্গলক্ষ্মী রাইস মিলের পাঁচিলটার পাশে। পাঁচিলের ওপাশেই মাঠ। মাঠের মধ্যে কুচো ধান কুড়োবার উৎসব। কাঠ চাঁপা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাঠবাবু এইসব দেখছিল। পাঁচিলের এই ধারে বিরাট শানের চাতাল। ধু-ধু করছে। বয়লারে বসে আছে কাক। চিমনিটা একাকী দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে মুখ করে। গুদামের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছে শালিক আর ঘুঘু। একটাও ধান পাচ্ছে না ওরা।

অথচ এই সময়টা ধানের গন্ধ কুঁড়োর গন্ধে ম ম করত এই রাইস মিল। বয়লারের শব্দ, চিমনির ধোঁয়া, মাঝি, মেঝেন, হাঁকডাক।

এখন শুনশান। মাঠবাবুর সময় কাটে না। মাঠবাবু হলেন ধান শুকোদের সুপারভাইজার। ‘বিড়ায়ে দে’ বললেই গা চকচক সাঁওতালি মেঝেনরা বেলচা দিয়ে ধানগুলি শুকোবার জন্য বিছিয়ে দিত। ‘ছড়ায়ে দে’ বললে ছড়িয়ে দিত, ‘গড়ায়ে দে’ বললে উলটে দিত। এখন চাতাল জুড়ে ঘুরে বেড়ায় ভূখা বাতাস। শুখা পাতা ওড়ে।

এমন সময় রোগা, চিমসেমতো একজন গদিঘরের সামনে এসে হাত জোড় করে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ‘নমস্কার।’

মাঠবাবু দেখলেন। মাঠবাবুকে কম লোকই নমস্কার করে। ওই চিমসে লোকটার পিছনে একজন বেঁটেমতো লোক, খাংলা খাংলা চুল, গায়ে সাত তাপ্পির জামা, দাঁত ভাঙা। সে-ও বলল, নমস্কার। চিমসে লোকটা বলল, আমি ম্যাজিক করি স্যার। মাঠবাবু ‘স্যার’ শুনে বড় লজ্জা পেল। পদ্ম মেঝেনকে মাঠবাবু প্রথম যেদিন বলেছিল, পদ্ম, তুই বড় সুন্দর। পদ্ম বুক ঢেকেছিল আঁচলে। মাঠবাবু এখন দাঁতে ঠোঁট কামড়াল।

লোকটা বলল, আমি ম্যাজিক করি স্যার। আবার স্যার! লোকটা কি দেখতে পাচ্ছে না মাঠবাবুর খালি গা, ধুতি হাঁটুর কাছাকাছি উঠে আছে, পায়ের ফাঁকে ধুলো, গোড়ালি ফাটা?

আমার নাম ম্যাজিশিয়ান ডি রতন। রতন দত্ত, কেম ফ্রম রেসপেকটেবল কায়েত ফ্যামিলি, জানতে পারলাম আপনাদের গোডাউন ঘর ফাঁকা পড়ে আছে, যদি পারমিশন করেন তো ক’দিন ম্যাজিক শো করি। আপনাদের মালিকের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

মাঠবাবু ভাবল তবে তো ভালই। ক’দিন লোকজনে ভরে থাকবে এই ধানকলের চাতাল। মাঠবাবু চলল বাবুবাড়ি খবর দিতে।

মিলের বাবুবাড়ি দশ মিনিট হেঁটে যেতে। দোতলা বাড়ি, বাড়ির মাথায় অ্যান্টেনা। রং করা টিভি চলে। বাবুবাড়ির সামনে মোটা দরজা। দরজার উপর সিমেন্টের গণেশ। দরজার পাশে লেখা বাবু কমলাপতি রায়। কমলাপতিবাবু এখন কফে কাশে জব্দ। সাতেও নেই পাঁচেও নেই। যা করে ছেলেরা। বড়ছেলে ডাক্তার। বর্ধমান টাউনে নার্সিং হোম। মেজোটার পানাগড়ে কোল্ডইস্টোর। ছোটটাকে বলেছে কমলাপতিবাবু, ওই বন্ধ রাইস মিলটা তোকেই দিলুম। চালাতে হয় চালা, অন্য কিছু করলে অন্য কিছু কর। আর যদি মনে করিস ওটা বিককির করে দিয়ে বাস কিনবি, তাও করতে পারিস, কিছুই আপিত্য নাই।

মাঠবাবুকে কমলাপতি বললেন, আমি কী জানি, সন্টুকে বল। সন্টু হল ছোটছেলে।

সন্টুবাবু গুদোম ঘরটা কিছুদিন আগে সারিয়েছিল। ফুটো হওয়া চাল পালটে ছিল। দেয়ালে সাদা রঙের উপর লাল বর্ডার মারিয়ে ছিল। টিনের পাতে লেখানো হয়েছিল প্রস্রাব ঘর (পুং) আর (স্ত্রী)। ইচ্ছে ছিল গুদোম ঘরটাকে আপাতত ভিডিও হল বানাবে।

সন্টুবাবুর জুলফি কামানো। গায়ে গেঞ্জি। নীল প্যান্ট। হাঁটুর কাছটায় রং ওঠা ওঠা। সন্টুবাবু বঙ্গলক্ষ্মী মিলে এল।

ম্যাজিশিয়ান উঠে দাঁড়াল।

নমস্কার স্যার।

সন্টুবাবু বলল, কী ব্যাপার।

স্যার ক’দিন ম্যাজিক খেলা দেখাব। আমি ম্যাজিশিয়ান ডি রতন। কেম ফ্রম রেসপেকটেবল কায়েত ফ্যামিলি। শোয়িং ম্যাজিক সিনস টুয়েন্টি ইয়ারস। আই উইল পে রেন্ট, ডেলি টেন রুপিস। সন্টুবাবু বলল, দ্যাখো, আমি ভাবছিলাম সামনের হপ্তা থেকেই ভিডিও চালু করব। তোমায় এক হপ্তার জন্য দিতে পারি। লোকজন জানুক এটা আর ধানকলের গুদাম নয়। ডেলি কুড়ি টাকা দিয়ো।

চালু হল ম্যাজিক। সাত সকালে হাতে ডুগডুগি, পায়ে ঝুমুর, মুখে চোং লাগিয়ে খ্যাংলা চুলের ফোকলা দাঁতের লোকটা পাবলিসিটিতে বের হয়। গিলি গিলি গিলি হোকাস ফোকাস। আসুন, দেখুন, প্রফেছার ডি রতনের ম্যাজিক খেলা। শরবতকে জল করা, দেশলাইকে সিগারেট করা, হাওয়া থেকে সন্দেশ করা, ফুঁ থেকে ভাত রান্না করা, ট্যাকা নাচবে…।

লোকটার চুনকালি মাখা গাল, গায়ে শত তালি মারা জামা। ঘরের বউ-ঝিরা কাণ্ড দেখে এ ঢলে পড়ে ওর গায়ে।

আসুন দিদিরা, আসুন বউদিদিরা, ফুঁ মেরে ভাত রান্না হবে, হাওয়া থেকে সন্দেশ হবে, টাকা নাচবে হাতের তালুতে। গিলি গিলি গিলি হোকাস ফোকাস।

মিলের মাঠে পায়ের চিহ্ন। মিলের গেটে পাঁপর ভাজা, জিলিপি। খেলা আরম্ভ হবার আগে ফোকলা দাঁতের ছেলেটাই টিকিট চেকার। মাঠবাবু তত্ত্বতালাশ নিচ্ছে। ছেলেপেলেদের বলে, হাঁ করে দাইড়ে দাইড়ে দেখছিস কী, অ্যা!— ঢুকে যা, ঘেঁসাঘেঁসি করে বসে যা।

প্রথম রজনীর শো। স্টেশন মাস্টার, সন্টুবাবু, প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার, এদের জন্য ভাঁজ করা ওঠা কাঠের চেয়ার। ভি আই পি সিট।

যেখানে ম্যাজিক হবে, সেখানে একটা শাড়ি ঝুলছে। খ্যাংলা চুলের ফোকলা লোকটা একটা ডুগডুগি বাজিয়ে শাড়িটা খুলে দিল। মানে পর্দা উঠাল, ওই শাড়িটা দু’ভাঁজ করে টেবিলে পরিয়ে দিল, মানে টেবিলের ঢাকনি হল।

লোকটা হাত জোড় করে বলল লেডিস অ্যান্ড জেন্টিলম্যান, আই অ্যাম ভগীরথ। যে ভগীরথ গঙ্গা লিয়ে আসা করিছিল মা ধরিত্রীর বুকে, আমি তেমনি ম্যাজিশিয়ান ডি রতনের দি ওয়ান্ডার ম্যাজিককে লিশ্চয় লিয়ে আসা করি। হিন্দু ভাইদের নমস্কার, মুসলমান ভাইদের সেলাম আলিকুম। নাও স্টার্ট ম্যাজিক। ঝিং ঝিংচাক। মুখ দিয়েই আওয়াজ করল ভগীরথ।

টাইট পাজামা আর লাল ব্লাউজ পরা রোগা মেয়েটা হল ম্যাজিশিয়ানের বউ। সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট খ্যাংলা চুলের লোকটা এবার হল জোকার। ম্যাজিশিয়ানের গোলাপি আলখাল্লার রং উঠে গেছে। মিস্টার ভগীরথ, কাম হিয়ার বললেই– ভগীরথ ধপ ধপ পায়ে ম্যাজিশিয়ানের দিকে এগিয়ে যায়। ভগীরথের পিছন থেকে বার করা হয় ডিম, পেট থেকে জল। সদ্য অঘ্রাণের মানুষেরা হাওয়া দোলানো ধান গাছের মতোই আহ্লাদে লুটিয়ে হাসে।

ভগীরথের কত কাজ। সকালবেলা চোং নিয়ে পাবলিসিটিতে যাওয়া, দুপুরবেলা ম্যাজিকের জিনিস রেডি করা, টিকিট বেচা। সন্ধে হলে গালে লাগায় চুন, লাগায় কালি। ম্যাজিশিয়ানের বউটাও সন্ধে হলে লিপস্টিক ঘষে ঠোঁটে, দুপুরবেলা রান্না করে, বাচ্চা হাগায়, আর শানচাতালে মেলে দেয়া শাড়ির দিকে চেয়ে থাকে, কখন শুকোবে। আর ম্যাজিশিয়ান ডি রতন বসে বসে চুকচুক করে মাল খায়।

মাঠবাবু দুপুর থেকে উশখুশ করে। লোক সমাগম বড় ভাল লাগে ওর। শানচাতালে বহুদিন পর হাজার পায়ের চিহ্ন। ভগীরথের সঙ্গে গপ্পো করে মাঠবাবু।

বুঝলি ভগীরথ, এই ক্যাটালিচাঁপার গাছটা দেখছিস, সাজগোজ করে দাঁড়িয়ে আছে, ফুলে ভরতি, তখন কিন্তু গাছে একটা ফুলও থাকতনি, যখন মিলটা চালু ছিল। সব মেঝেন টেঝেন মেয়াছেলেগুলির এক একটা জ্যান্ত ফুল গাছ হয়ে থাকত। এই যে পুকুরটা দেখছিস ভগীরথ, ঝিম মেরে পড়ে রইচে, এমন ছিল না রে ভগীরথ, ধানের খুদ কুঁড়ো মেখ্যে মেয়াছেলেগুলির পুকুরে লেব্যে কী যে লুটোপুটি ঝুটোপুটি লাগাইত, হাজারে গুজর নাই, —কী বলব, যখন মিলটা চালু ছিল…। ওই যে বয়লারটা দেখতে পাচ্ছিস, ওটা থেকে ভুস ভুস করে ধোঁয়া উগলত। ধানের মধ্যে গরম ইস্টিম ঢোকাত ইস্টিমবাবু। তখন কী সুগন্ধা রে বাপ। তারপর ধান শুকাত ওই চাতালে। তারপর বুঝলি ভগীরথ, সন্ধের ভোঁ বাজত, মেয়েছেলে গুলিন লুটোপুটি করত পুকুরের জলে, জলের মধ্যে বুটবুটি ফেনা। আর ওরা চলে গেলে, জলের মধ্যে ভেসে থাকত খোঁপা থেকে খসে পড়া ক্যাটালিচাঁপার ফুল। বুঝলি যখন মিলটা জ্যান্ত ছিল…

ভগীরথও বলে ওর ম্যাজিকের দলের কথা। জানেন মাঠবাবু, ভেলভেটের ইসক্রিন ছিল। দড়ি দিয়ে টানলে ফিস করে খুলে যেত। আলোর ফোচাং বাতি ছিল। ভেলভেটের উপর যখন আলো পড়ত তখন কী দৃশ্য যে কী বলব। ভেলভেটের ইসক্রিন কী নরম। হাতে ঘসলে হাতের তেলোয় সুড়সুড়ি লাগত। তিন সেট জামা পাজামা ছিল আমার। জরি লাগানো বেল্ট ছিল। চারটে পাগড়ি ছিল ম্যাজিশিয়ানের, তিনসেট পোশাক ছিল। চারসেট টাইট জামা প্যান্ট ছিল বউদির। বুলু প্যান্ট আর লাল বেলাউজে যা লাগত না।… এখন কিছু নাই।

কেন! নাই কেন! মাঠবাবু জিজ্ঞাসা করল। অনেকটা বাতাস ফুসফুসে টেনে নিল ভগীরথ। তারপর বাতাসে মিশিয়ে দিল ফের। বলল, মাঠবাবু গো, সব কিছু ফুটোয় আর মদে ঢেলে দিল। একটু চুপ থেকে ভগীরথ বলল, তোমার কী হল মাঠবাবু? তোমার ধানকল ফাঁকা হয়ে গেল কেন? মাঠবাবু বলল, ছোটছেলে ইখানে সিনেমা হল বানাবে। সামনের বছরই সিনেমা হল হবে। লাভ বেশি, হাঙ্গামা কম।

পাড়ার ছেলেদের মুখে এক রা। গিলিগিলি গে হোকাস পোকাস। এ ওর পাছায় চাপড় মেরে বলে ডিম পাড়। এক-একজন দু’বার-তিনবার করে দেখছে। দু’দিন ধরে গুদাম হাউস ফুল। নদেরশোল, ভালুককাঠি, পিচকুড়ির চাল, নোয়দার ঢাল এমনকী আউশগ্রাম থেকেও ম্যাজিক দেখতে আসছে।

সন্টুবাবু সকালবেলায় লোকজন নিয়ে ফিতে দিয়ে চাতালটা মাপজোখ করাচ্ছিল। ডি রতন এল।

— স্যার। আর সেভেন ডে ম্যাজিক শো চালাতে চাই।

—খুব ভিড় হচ্ছে, না?

—আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। নতুন ধান ওঠা পয়সা। উড়ছে!

—সব পয়সা তুমিই মেরে দেবে নাকি! সাত দিনের আর একটা দিনও বেশি নয়। হলেই ছেড়ে দেবে। সন্টুবাবু সেইদিনই কাঠালিচাঁপার গাছে ঝুলিয়ে দিল বঙ্গলক্ষ্মী ভিডিও হল। গুদোমটা আর বঙ্গলক্ষ্মী রাইস মিলের গুদাম নয়। ভিডিও হল।

দুপুরে ম্যাজিকওলার ঘরে খুব হুটোপুটি। ঝগড়া, চিৎকার, রোজই একটু হয়, আজ অন্যদিনের চেয়ে বেশি। ম্যাজিশিয়ানের বউ কাঁদছে। বউ প্যাঁদাচ্ছে ম্যাজিশিয়ান। গদিঘর থেকে মাঠবাবু শুনতে পায় ম্যাজিশিয়ানের গলা। অ্যাঁ, একটু মাল খাব বলে আলু ভাজা চেয়েছিলাম, তাতেই এত বড় কথা। বাউড়ির বাচ্চা, বল তোকে পুষছি কেন? এক মাসের মধ্যে যদি অন্য একটা আলুভাজার মাগী না আনতে পারি, তবে আমি কায়েতের বাচ্চাই নই। শালা স্টেজের পোশাক পরে বিবি সেজে বসে থাকা?

এবার ভগীরথের গলা শোনা যায়। আর একবার বউদির গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখ শুয়োরের বাচ্চা, বহুত খারাপ হয়ে যাবে।

—দ্যাখ ভগীরথ, দিস ইজ মাই লাস্ট ওয়ার্নিং আগেও বলেছি, আমার ওয়াইফের জন্য দরদ দেখাতে গেলে তোকে লাথি মেরে ফেলে দেব।

—বেশ করব। আরও বলব। মাল খেয়ে মজা মারাচ্ছ, আলু ভাজা চাই, এদিকে বউদির সাজ নেই, গোটা শাড়িটাই ইস্টেজের পর্দা হচ্ছে, ছেঁড়াটা ভিজে। সে জন্য ইস্টেজের পোশাক পরেছে। সেটা বোঝ না?

—বা। ফাস্ট ক্লাস। আমার বউয়ের ক’টা শাড়ি, ক’টা ব্লাউজ, ক’টা ইড়িং পিড়িং সবই তো দেখি এ জানে। এক লাথি মারব তলপেটে…

—তোমার ম্যাজিকের পুঁটকি মারি… এই বলে হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল ভগীরথ। ধানকলের মরে যাওয়া বয়লারটার তলায় বসে বিড়ি খেল, তারপর চোং নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। আসুন, তালুতে ট্যাকা লাচায়, ফুঁ মেরে ভাত রান্না হবে, পেট থেকে জল বেরুবে… অদ্য শেষ রজনী…

দুপুরবেলা গদিঘরে একা একা শুয়েছিল মাঠবাবু। কুলুঙ্গিতে গণেশ। বিবর্ণ হাজিরা খাতা। ভগীরথ এল। টলছে। হাতে মদের বোতল। বলল, মালিককে শোরের বাচ্চা বলে এসেছিল মাঠবাবু। সেজন্য আজ এটু মাল খেলাম। মাল না খেয়ে মালিককে কী করে শোরের বাচ্চা বলি বলো দিকি? মাঠবাবু বলল, আমাকে এট্টু দিবি?

—লাও, লাও না।… ভগীরথ খুশি হয়। মাঠবাবু দু’ চুমুক খায়।

ভগীরথ বলল, মাঠবাবু গো, আমার বড় দুখ।

—কেনে?

—বউটারে তাড়াবে।

—কে?

—ম্যাজিশিয়ান।

—কেনে।

—ওর এই রোগ। নতুন জাগায় ম্যাজিক দেখাতে যায়, লতুন মেয়েমানুষ তুলে নেয়, আগেরটারে তাড়ায়।

—এখানে কাউকে তুলেছে নিকি?

—এখানে তুলেনি, তবে ও মন করলেই তুলে নেয়।

—তাতে তোর কী?

—এই বউদিদিটা বড় ভাল। ও ম্যাজিক বড় ভালবাসে। ম্যাজিক-অন্ত-পেরান। আর কুন বউদিদি এমন ছিল না। অনেক বউদিদি দেখলাম।

— ক’টা!

— এই এগারো বছরে চারটে।

— এগারো বছর তুই ওর সাথে আছিস?

— হ।

— এর আগে?

— চোর ছিলাম

— চোর।

— হ। গরিব ছিলাম। জন্মের পর বাপ দেখিনি চোখে। শুধু মা।

— তারপর!

— খুঁজে খাই, চেয়ে খাই। চুরি করে খাই।

— তারপর!

— একটু বড় হয়েছি। আসানসোলে ম্যাজিক হচ্ছিল, আমি জুতো চুরি করব বলে ঢুকেছিলাম। ম্যাজিক দেখতে দেখতে জুতোর কথা, রোজগারের কথা ভুলে গেলাম। সে কী ম্যাজিক গো মাঠবাবু, হাওয়া থেকে ট্যাকা ধরা, বলের নাচ, এটুকুন একটা বাস্ক থেকে পায়রা বেরুনো… খেলা শেষ হলে ওর কাছে যেয়ে বললাম, আমারে ভত্তি নাও। ম্যাজিশিয়ান বলল, কী কাজ পারবি তুই! আমি বললাম, সব। তুমাদের যাদুকাঠি গুইছে রাখব, ভেলভেট ইসকিরিন ভাজ করব, হুইসিল বাজার, বাঁধব, ছাদব…। ম্যাজিশিয়ান বলল, পা টিপতে পারবি? বললাম, হ আজ্ঞে আজ্ঞে। মাথা ম্যাসাজ! বললাম, হ আজ্ঞে। বলল, কর দেখি তো।

— তোর তখন বয়েস?

— ষোলো।

— সেই থেকেই ওর সঙ্গেই আছিস।

— হ। সেই থেকেই। সব ছিল গো সংসারে, সব কিছু। ভেলভেট ইসকিরিন, পিতলের জাদুকাঠি, চুমকি বসানো পাগড়ি…

— আহা! এখানেও ছিলরে ভগীরথ, মিলের ভো ছিল, বাতাসের সঙ্গে ধানকুঁড়োর ওড়াওড়ি, কী হাঁকডাক…

— সব ছিল গো মাঠবাবু, ঘোরানো চেয়ার, পিতলের কলসিতে ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার খেলা। আমি ছড়া কাটতাম। সব ক’টা দাঁত ছিল তকুন আমার। শুনবে একটা ছড়া!

ইচিং বিচিং চিচিং ফাঁক

শাকের রাজা পালং শাক

মাছের রাজা রুই

ম্যাজিশিয়ানদের রাজা হলাম

ভগীরথ দাস মুই।

‘ভগীরথ দাস মুই’ বলেই বুকে চাপড় মারতাম ঠাস করে, তারপর ব্যথায় কেতরে মাটিতে পড়তাম, পাবলিক হেস্যে গড়াত। তারপর আমি নিজে ম্যাজিকের খেলা দেখাতে গিয়ে সবকিছু গড়বড় করে দিতাম। …সে এক দিন ছিল গো…।

— তা তুই এমন দাঁতফোকলা হলি কী করে?

— প্যাঁদানি খেয়ে।

— কে মারলে, ওই ম্যাজিকশিয়ান?

— পাবলিক।

— কেনে?

— মেয়েছেলে কেস। ঘোষপাড়ার মেলায় ও একটু আলুবাজি করতে গেল। সবাই ম্যাজিকশিয়ানকে মারতে আসে তেড়ে। আমি বলি, মেরোনি গো, ও খেলাটা দেখায় ভাল, ওর কিছু হলে খেলাটা ভোম্বাট হয়ে যাবে। উলটে পাবলিক আমায় মারলে। … সে এক দিন ছিল গো…।

সন্টুবাবু হঠাৎই এল গদিঘরে। মাঠবাবু বোতল লুকোল। সন্টুবাবু বললে, ভগীরথ, এখানে তোমায় পেয়ে ভালই হয়েছে, তোমাকেই খুঁজছিলাম। তুমি আমার কাছে চাকরি করবে? ভগীরথ ভ্যাবাচাকা খেয়ে সন্টুবাবুর মুখের দিকে চায়। সন্টুবাবু বলল, এখন কত পাও তুমি? কত টাকা? ভগীরথ বলল, তা কিছু ঠিকানা নাই। যখন য্যামন, তখন ত্যামন।

— তাইলে আর কেন ওর কাছে আসিছ? আমি মাসে মাসে মাইনে দেব, থাকার জায়গা দেব।

— কী কার্য করতে হবে মোকে?

— পাবলিসিটি। টিকিট চেক। মাঠবাবু টিকিট বেচবে। ভিডিও হল হবে। সিনেমা। তুই সিনেমা দেখতে পাবি বিনিমাগনায়, যত খুশি।

— সে তো মিশিনের কাজ বাবু, যন্তরে সিনেমা হবে। আমরা তো কিছু লয়। আমি তো আর পাবলিককে হাসাতে পারব না।

— বিনি মাগনায় লোক হাসাচ্ছিস। কী লাভ তোর! তার চে আমার কাজে মজা বেশি। পাবলিসিটির মাইক দেব, মাইনে দেব মাসে মাসে। ভগীরথ রা কাড়ে না।

বাইরে হাঁকডাক। ম্যাজিশিয়ানটা চাঁচাচ্ছে— ভগীরথ, এই শালা ভগীরথ..

ভগীরথ ব্যস্ত হয়। উঠে যায়। তারপর ওধার থেকে তুমুল খিস্তির শব্দ আসে। সন্টুবাবু মাঠবাবুকে বলে, ওকে ম্যানেজ করো। ও ব্যাটা বেশ একস্পার্ট। কাজ দেবে!

রাত দুপুরে গদিঘরে কড়া নড়ে। ভগীরথ এসেছে। বলল, ও শালার কাজ আর করব না। আজকের দিনটা করে দিলাম, ব্যাস। কালকে ও শালা কাটোয়া যাবে। আমি আর যাচ্ছিনি। আমাকে তোমরা টুকুন নুইক্কে রাখো।

ওই রাত দুপুরেই টর্চে টাইগার ব্যাটারি পুরে সন্টুবাবুর বাড়ি যায় মাঠবাবু। ভগীরথ বাড়ির গোয়াল ঘরে বসে মশার কামড় খায়।

সকালবেলা ম্যাজিশিয়ান ডি রতন শানচাতালে পাইচারি করছিল, পাইচারিতে ছটফট ভাব। আঙুলের বিড়ি শেষ হয়ে গেল বড় জলদি। মাঠবাবুকে এসে জিজ্ঞাসা করল, ভগীরথকে দেখেছ? মাঠবাবু মুখে কোনও শব্দ না করে শুধু মাথা নাড়াল৷ এধার ওধার ঘুরাফিরি করে বেলা বারোটার বাসে বাসের ছাতে মাল উঠিয়ে কাটোয়ায় চলে গেল ডি রতন।

দুপুরে বাবুবাড়ির মুসুরির ডাল, ভাত আর কুমড়োর তরকারি দেয়া হল ভগীরথকে। ভগীরথ খেতেই পারেনি। মাঠবাবু গেল দুটোর সময়। বলল, ওরা বিদেয় হয়েছে। ভগীরথ বলল, মাঠবাবু গো, যাবার সময় বউদিদি কিছু বলে গেছে?

মাঠবাবু বলে, না।

বউদিদির চোখের দিকে টুকুন ভাল করে তাইকে ছিলে?

মাঠবাবু বলে, না।

ঠিক চোখ ছলছল করছিল, দেকলেই বুঝতে!

দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার। শুভ উদ্বোধন। ভিডিও হল। সতী সাবিত্রী। পরবর্তী আকর্ষণ প্রেমরোগ।

ভগীরথ চোং লাগিয়ে ব্যাটারি সিস্টেম মাইক লাগিয়ে পাবলিসিটি করল।

আসুন আসুন, সতী সাবিততিরির মহিমা দেখে যান। সাবিততিরের ভুমিকায় রয়েছেন গঙ্গা তেরি মাইলি খ্যাত মন্দাকিনী। ম-অ-ন-দা-কি-নী। আবার বলছি মন্দাকিনী।

প্রথম দিনে হাউস ফুল। চ্যাংড়া চোটার দল সতীসাবিত্রীর স্নান দেখে সিটি দিল। সাবিত্রী যখন যমের কাছে ভাতার ছিনাতে যাচ্ছে, তখন তুমুল বৃষ্টি। সাবিত্রী ভিজছে, আবার সিটি। শো ভাঙলে দু’জন বিধবা চোখের জল মুছতে মুছতে বেরুল। কয়েকজন কম বয়েসের ছোঁড়া আ যা রে মেরা পেয়ারা সত্যবান তু আ যা আর মৌত কেয়া হায় ইস্ককা পাস গান গাইতে গাইতে বেরুল! ভগীরথ ভাবল দুস, আমি কী করলাম। আমার তো কিচ্ছু কাজ নাই, সবই তো যন্তরের খেলা। আমি তো লোক মজাতে লারলাম!

সকালবেলা ভগীরথ নেই। কোথাও নেই। ওর হাওয়াই চটিটা শুধু গদিঘরের বাইরে পড়ে আছে।

এরপরেও বঙ্গলক্ষ্মী ভিডিও হলটা ঠিকঠাকই চলছিল। মাঠবাবু ঠিকঠাকই টিকিট ব্যাচে। ভগীরথ-এর বদলে ধনা বাগদি পাবলিসিটি করে। হল হাউস ফুল হয়।

উত্তরের হাওয়া বয়, চিতে ফুল ফোটে, প্রেমরোগের পর হান্টারওয়ালি, তারপর জয় সন্তোষী মা, কামাগ্নি, রোজা, দি বডি…

ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া নিতে মাঠবাবু এসেছিল বর্ধমান। এখন তো মাঠবাবুই আসে। কার্জন গেট-এর সামনে বাসস্ট্যান্ড। বাসে জানলার পাশের সিটে বসল মাঠবাবু। কচুরি ভাজার গন্ধ, মাইকের হল্লা, ভিড়…।

সামনে কীসের ভিড়?— মাঠবাবু জানালা দিয়ে দেখে। লোকজন গোল হয়ে ঘিরে আছে। ভিড়ের মাঝখানে ও কী?— ভগীরথ না? খেলা দেখাচ্ছে। ছেঁড়া জামা, মাথায় গামছার পাগড়ি। পাগড়িতে গোঁজা প্লাস্টিকের ময়ূর পেখম।

লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান এবার দেখুন দি ভগীরথ ম্যাজিক কোম্পানির পরবর্তী খেলা আশ্চর্য রুমাল। বাচ্চারা বাজাও তালি।

ইচিং বিচিং চিচিং ফাঁক
শাকের রাজা পালং শাক
মাছের রাজা রুই
ম্যাজিশিয়ানদের মধ্যে রাজা
ভগিরথ দাস মুই…

কাম অন ডার্লিং, মাই অ্যাসিস্ট্যান্ট, রুমালগুলো দাও। গিভ…

রাস্তার উপরে রাখা একটা কালো বাক্স থেকে একহাতে লাল রুমাল আর অন্য হাতে নীল রুমাল নিয়ে ভগীরথের দিকে নেচে নেচে এগিয়ে আসছে ওই মেয়েটা, রোগা মেয়েটা, প্যাংপ্যাঙে মেয়েটা, ম্যাজিশিয়ান ডি রতনের বউ… কী যেন নাম?

ওর নাম তবে গঙ্গা…।

বাস ছেড়ে দেয়।

কালিমাটি, ২০০১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *