ভগলু
একটু আগে একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। চৈত্রের শেষ। বৃষ্টিতে ঝরা পাতা, ঝরা ফুল জঙ্গলময় ছড়ানো। মাটি থেকে একটা সোঁদা গন্ধ উঠছে। গুহার সামনে একটা উপত্যকা। তার মধ্য দিয়ে বোষ্টমনালা নামে একটি পাহাড়ি নদী বয়ে গেছে। নানা পাখি ডাকছে বৃষ্টির পরে। নানা পোকামাকড় উড়ছে। আর সেই পোকামাকড় ধরে খাবার জন্যে নানারকম ফ্ল্যাই-ক্ল্যাচার পাখি ঘুরে ঘুরে উড়ছে আর পোকা ধরে খাচ্ছে।
বাঘটার সঙ্গে আমার শেষবার দেখা হয়েছিল মাস ছয়েক আগে। বাঘেদের আয়ু হিসেবে সে প্রায় বুড়ো হয়ে এসেছে। এখন তার বয়েস বারো কি তেরো বছর। বাঘটাকে এই অঞ্চলের জঙ্গলের মানুষেরা ‘ভগলু’ বলে ডাকে। সে পুরুষ বাঘ। যৌবন আসার পরে সে বার চারেক বাঘিনির সঙ্গে সহবাস করেছে। বাঘ আর বাঘিনি তো একসঙ্গে থাকে না! মানুষদের মতো মশারি টাঙানো, পাখা চালানো এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে বাঘ-বাঘিনির মধ্যে কখনো মতভেদ হয় না। এই জানোয়ারের মতো জানোয়ার পৃথিবীতে আর নেই। সারাজীবনের আটানব্বই ভাগ সময় বাঘ ও বাঘিনি একা থাকে। তারা একেবারেই পরনির্ভর নয়। সংগমেচ্ছা তীব্র হলে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর জন্যে বন-পাহাড় কাঁপিয়ে ডাকাডাকি করে এবং বাঘের ডাক যারা জঙ্গলে শুনেছে তারা জানে সে ডাকের কী মহিমা। দু-তিন মাইল দূর থেকে সে ডাক শোনা যায়। সমস্ত পাহাড়, জঙ্গল, গাছগাছালি সে ডাকে শিহরিত হয়ে ওঠে। সঙ্গী বা সঙ্গিনী কাছে এলে তারা একসঙ্গে দিন দশ-পনেরো থাকে এবং আশ্চর্যের কথা এরকম পরাক্রমশালী জানোয়ার পৌনঃপুনিকভাবে সংগম করে এবং এক এক বারের সংগমে হয়তো একবিন্দু রেতস্খলন হয়। বাঘেদের প্রেমে কামড়া কামড়ি, মারামারি এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, জঙ্গলের সব পশুপাখি সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। সংগমের সময় বিরক্ত হলে তারা মেজাজ হারিয়ে ফেলে এবং সঙ্গী বা সঙ্গিনীটিকে দেখাবার জন্যে অপ্রয়োজনেও অনেক গৃহপালিত পশুকে মেরে দেয়।
আমি বেরিয়েছিলাম মুরগি মারার জন্য। রাতে খাবার কিছু ছিল না। আমার খিদমদগার শিব্ব তাই বলেছিল, পারলে কিছু মুরগি মেরে আনুন। ভালো করে বানিয়ে দেব। আমড়ার আচার আছে। কাঁচা পেঁয়াজ কেটে দেব। কাঁচালঙ্কাও আছে যথেষ্ট।
বৃষ্টির পরে একটা কুড়ি বোরের টলির বন্দুক আর দুটি চার নম্বর ছররা নিয়ে বেরিয়েছিলাম মুরগির খোঁজে। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। কিন্তু ভগলুর সঙ্গে যে দেখা হয়ে যাবে তা জানা ছিল না। বৃষ্টি থামার পর ভগলু গুহা থেকে বেরিয়ে, গুহার সামনে মস্ত বড়ো কালো পাথরের চাটানে বসেছিল দূরের জঙ্গলের দিকে চেয়ে। আমার পায়ে রাবার সোলের জুতো ছিল। এবং বহুদিনের অভ্যেসে জঙ্গলের মধ্যে নি:শব্দে চলাফেরাতে আমি অভ্যস্থ ছিলাম। তা ছাড়া চোখের দৃষ্টিও ছিল এক-শো আশি ডিগ্রি। চোখের মণি সোজা তাকিয়ে থাকলেও দু-পাশের কিছুর সামান্য নড়াচড়াও চোখের দৃষ্টি এড়াত না। এর আগে যখন ভগলুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন সে হাতিগির্জা পাহাড়ের ওপরে একটা গুহাতে থাকত। বোষ্টমনালার পাশে প্রায় সমতলে অবস্থিত এই গুহাতে যে সে আস্তানা গেড়েছে তা আমার জানা ছিল না। আমরা দুজনেই দুজনকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। ভগলু তার শরীরটিকে ছোটো করে নিয়ে আমার দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়েছিল। তার দু-চোখের দৃষ্টি স্থির ছিল। আমিও তাকে দেখে স্থাণুর মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম। আমি বাঘ শিকারে যাইনি। সঙ্গে শুধু পাখি মারা ছররা গুলি। ভগলুও আমাকে সেখানে প্রত্যাশা করেনি। অনেকদিন পর দুই বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে যেমন করে আমরা হ্যালো বলি, তেমনি না বলা সম্ভাষণে আমরা দুজনে দুজনকে সম্ভাষিত করলাম। আমাকে দেখে ভগলু তার গুহার ভেতরে ঢুকে গেল। এবং আমিও যে সুঁড়িপথ দিয়ে হেঁটে এসেছিলাম সেই পথ দিয়েই জঙ্গলের নীচে যে উপত্যকা তাতে নেমে গেলাম মুরগির খোঁজে।
একটা কোটরা হরিণ আমাকে এবং হয়তো ভগলুকেও দেখে তীব্র আর্তস্বরে বাক, বাক, বাক করে ডাকতে ডাকতে জঙ্গলের গভীরে দৌড়ে গেল। তার লাল-রঙা শরীরের ঝিলিক উঠল চৈত্রশেষের হলুদ এবং সবুজ জঙ্গলে।
২
সেদিন বিকেলে কপাল মন্দ ছিল তাই কোনো শিকারই জুটল না খাবার জন্যে। ফুটুদাদের কাঠকাটা মুহুরি নারান বাসে করে টিকরপাড়ায় গেছিল কোনো কাজে। সেখান থেকে ফেরার সময় সে মহানদীর নাকে নোলক পরা লাল মহাশোল মাছ এনেছিল আমার জন্যে। যদিও ক্যাম্পে ফ্রিজ ছিল না, কিন্তু তখনও জঙ্গলে বেশ ঠাণ্ডা ছিল এবং বৃষ্টি হওয়াতে সে ঠাণ্ডা বেড়েছিল। তাই দু-তিন দিন সে মাছ অক্ষত রাখার কোনো অসুবিধে ছিল না। ক্যাম্পে ফিরতেই আমার খিদমদগার শিব্ব মাছের বড়ো বড়ো চাকা ভেজে দিল, কফির সঙ্গে খাওয়ার জন্যে। নারানও হাত-মুখ ধুয়ে ক্যাম্পে লণ্ঠনটা জ্বালিয়ে আমার সামনে এসে বসল। ওকেও শিব্ব কফি দিল। কফি খেতে খেতে আমরা দুজনে গল্পে মাতলাম। নারান এখানকার জঙ্গলের সব খবরই রাখে। কোথায় কোন হাতি গুণ্ডা হয়ে গেছে, কোথায় কোন চিতা গোরু-বাছুর ধরছে আর কোথায় কোন বাঘ হঠাৎ মানুষ মেরেছে সে সমস্ত খবর ওর নখদর্পণে। নারানকে ভগলুর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বলতে, সে সখেদে আমাকে বলল, কিছুদিন আগেই এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হওয়াতে হাতিগির্জা পাহাড় থেকে নেমে আসা একটা অতিকায় বাঘ ওকে সাংঘাতিকভাবে আহত করেছে। ওর ডান পা-টা প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। ভালো করে চলাফেরাও করতে পারে না। আপনি ভগলুকে ভালো করে দেখলে দেখতে পেতেন সে আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছে। বন্যপ্রাণী শিকার করতে ওর ভারি অসুবিধে হয়। সাম্প্রতিক অতীত থেকে সে বাঁদর, ময়ূর, এমনকী খরগোশ অথবা গুরাণ্ডি হরিণ (মাউস ডিয়ার) ধরে খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছে। আরও একটা বড়ো বিপদ হয়েছে যে, ও গতকাল পুরুনাকোট গ্রাম থেকে চরতে আসা গোরু-বাছুরদের মধ্যে একটি ছোটো গোরুকে ধরে কিছুটা খেয়েছিল এবং কাঠের ঠিকাদার বিশু মহাপাত্রর বড়োছেলে পিসু ভগলুকে মারার জন্যে একটা মিটকুনিয়া গাছের ওপরে মাচা বেঁধে তার নীচে গোরুর অবশিষ্টাংশকে শক্ত দড়ি দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছে। এবং সেই মাচার ওপরে সে আজ শেষবিকেলে বসবে। ভগলু যদি গোরুর মড়িতে আসে তবে সে রাতে তাকে মারবার চেষ্টা করবে।
খবরটা শুনে আমার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। ঠিক করলাম, নারানকে সঙ্গে নিয়ে এবং জিপ নিয়ে সেই মিটকুনিয়া গাছের কাছে পৌঁছোব এবং যাতে পিসু মহাপাত্র ভগলুকে গুলি করতে না পারে তা দেখব। বন্দুক কিনলেই কেউ শিকারি হয়ে যায় না। বিশেষত বাঘশিকারি। বাঘ মারার ইচ্ছা থাকে অনেকেরই। কিন্তু বাঘ দেখলে অনভিজ্ঞ মানুষের যে অবস্থা হয়, তাতে বাঘের দিকে বন্দুক তোলার ক্ষমতাও তাদের অধিকাংশেরই থাকে না। বাঘ এমনই এক জানোয়ার যে সে কারো চোখে চাইলে, যার চোখে চাইল তার মনে হয় বাঘ তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল পর্যন্ত সব দেখে ফেলল। সে প্রথম কখন কাকে প্রেম নিবেদন করেছিল অথবা শেষ পরীক্ষায় সে কেমন ফল করেছিল তা বাঘ বুঝে ফেলে। বাঘের দৃষ্টির মতো অন্তর্ভেদী দৃষ্টি খুব কম জানোয়ারেরই আছে। তাই পিসু মহাপাত্র বন্দুক নিয়ে মাচায় বসলেই ভগলুকে মারতে পারবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। যদি যথেষ্ট সাহস দেখিয়ে সে ভগলুর দিকে গুলি ছুড়তেও পারে তাতেও বিপদের আশঙ্কা বেশি। কারণ সে গুলি যে ভগলুর শরীরের কোথায় লাগবে সে সম্বন্ধে কোনো স্থিরতা নেই। বাঘকে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় তুলতুলে চামড়ামোড়া একটি জানোয়ার যাকে দেখলে তার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যদি কেউ বাঘ মারার পর তার চামড়া ছাড়ানো চেহারাটা দেখে থাকে তবে সে-ই জানে বাঘ কী অসীম শক্তিশালী জানোয়ার। পেট ছাড়া তার শরীর দড়ির মতো মাংসপেশিতে মোড়া এবং মেদ বলতে প্রায় কোথাও কিছু থাকে না। যে কারণে বাঘ তার চেয়ে অনেক বড়ো প্রাণী যেমন বড়ো গোরু কি মোষ অথবা সম্বর মেরে, তার টুঁটি ধরে অথবা তাকে পিঠে নিয়ে বহুদূর জঙ্গলে, পাহাড়ে চলে যায় এবং নিরিবিলি জায়গা দেখে সেখানে তাকে খায়। খাবার সময়ে কোনোরকম উপদ্রব বাঘের আদৌ পছন্দ নয়। এবং যে ছোটো গোরুটি ভগলু মেরেছিল এবং সেটিকে যে সেখানেই বসে খেয়েছিল তার কারণ এখন বুঝতে পারছি যে, তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল না।
নারান বলল, পিসু মহাপাত্র নতুন বন্দুক কিনেছে কটকের দোকান থেকে। এবং বন্দুক কিনেই তার শখ হয়েছে বাঘ মারার। যোগাযোগও একটা ঘটে গেছে কারণ সে আসার পরই ভগলু এই গোরুটিকে মারে। অতএব আজ সন্ধ্যায় কী ঘটন বা অঘটন ঘটবে তা কেউ জানে না।
কফি খাওয়ার পরে শিব্বকে মুগের ডালের খিচুড়ি চাপাতে বলে আমি আর নারান জিপ নিয়ে, নারানের নির্দেশমতো পথ ছেড়ে জঙ্গলের ভেতরে বেশ কিছুটা চলে গেলাম। সঙ্গে আমার প্রিয় রাইফেলটি নিয়েছিলাম। ৩৬৬ ম্যানলিকার শুনার। অস্ট্রিয়ান রাইফেল। বাবা অস্ট্রিয়া থেকে ইম্পোর্ট করিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন আমার জন্মদিনের উপহার হিসেবে। এই রাইফেলে আমি একটি গুলিও কোনোদিন ফসকাইনি। জিপ নিয়ে যতদূর যাওয়া যায় আমরা গেলাম। তার পর জিপ থেকে নেমে নারানের নির্দেশমতো আমরা হেঁটে শ-খানেক গজ যেতেই নারানের পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলোতে মাচাটিকে দেখতে পেলাম এবং মাচার ওপরে পিসু মহাপাত্র এবং তার দুজন অনুচর বসে আছে তাও দেখতে পেলাম। আমাদের দেখে পিসু হকচকিয়ে গেল এবং নারানের ওপর চোটপাট করে বলল, ‘তমে এটি কাঁই আসিল্বা’।
পিসু অন্ধকারে আমাকে দেখতে পায়নি। অথবা পেলেও চিনতে পারেনি। আমাকে দেখেই সে একটু ঘাবড়ে গেল। নারানকে সে তম্বি করে বলল, বাঘ আসার আগেই তুমি এখানে চলে এলে! আর কি বাঘ এখানে আসবে!
নারান বলল, ভগলু এমনিতেই চোট পেয়েছে। প্রায় চলচ্ছক্তিহীন। এই বাঘকে বেজায়গায় গুলি করে তুমি নিজে নিজের সাংঘাতিক বিপদ ডেকে এনো না। সবে দু-মাস হল তোমার বিয়ে হয়েছে। বউকে বিধবা করার ইচ্ছা যদি না থাকে তাহলে মাচা থেকে নেমে এসো। আমাদের সঙ্গে জিপ আছে। চলো তোমাকে তোমাদের ডেরায় নিরাপদে পৌঁছে দিচ্ছি।
এই কথাতে পিসু খুব অপমানিত বোধ করল এবং বলল, আমাদের চিন্তা তোমাদের করতে হবে না। তুমি বাবুকে নিয়ে ফিরে যাও।
ভগলু যদি কাছাকাছিও এসে থাকে তাহলেও যাতে মাচার কাছে না আসে সেজন্যে আমি কাঁধ থেকে রাইফেলটি নামিয়ে শূন্যে একটি গুলি করলাম। শুধু আওয়াজ করার জন্যেই। সেই গুলির আওয়াজ শুনেই ভগলু ফিরে যাবে এই আশায়। সঙ্গে আমি থাকাতে নারানকে তখনকার মতো আর কিছু বলল না সে। তবে বুঝলাম, এই অপরাধের জন্য সে নারানকে ক্ষমা করবে না। কিন্তু আমার যা করার করা হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি আর সেখানে না থেকে নারানকে বললাম, চলো ফিরে যাই।
আমরা যখন জিপের দিকে যাচ্ছি, তখন আমাদের বাঁ-পাশে কতগুলি আর্গুন ঝোপের মধ্যে আমরা ভগলুর চোখ চমকাতে দেখলাম নারানের টর্চের আলোয়। চোখে আলো পড়তেই সে শরীরটাকে ছোটো করে নিয়ে আর্গুন ঝোপের আড়ালে শরীরটাকে লুকিয়ে ফেলল। বাঘ যদিও মস্ত বড়ো জানোয়ার কিন্তু এত অল্প আড়ালে সে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে পারে যে যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তাদের পক্ষে ধারণা করা মুশকিল। আমি রাইফেলটি কাঁধ থেকে নামিয়ে রেডি পজিশনে ধরে, ভগলু যেদিকে লুকিয়ে ছিল সেই জায়গাটি পেরিয়ে জিপের দিকে এগিয়ে গেলাম। যেতে যেতে ভাবলাম সাংঘাতিকভাবে আহত ভগলুকে যদি সত্যি পিসু মহাপাত্র গুলি করে তবে হয়তো সে বেচারির পক্ষে বাঁচাই মুশকিল হবে। কিন্তু রঙ্গমঞ্চে ভগলুর উপস্থিতি ঘটলে যে কী ঘটবে তা এখনই বলা মুশকিল।
আমরা যখন জিপে উঠে জিপ ঘুরিয়ে আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগোলাম তখন মনের মধ্যে একরাশ দুশ্চিন্তা জমে উঠল। ক্যাম্পে পৌঁছে জামাকাপড় ছেড়ে, রাইফেল রেখে, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যখন ক্যাম্পের বারান্দায় ইজিচেয়ারে এসে বসলাম, তখন খুব বেশি হলে রাত আটটা হবে। নারান ফিরে গেল রান্নার তদারকি করতে। এমন সময় বন্দুকের পর পর দুটি গুলির আওয়াজ ভেসে এল। বন্দুকের গুলি যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তাহলে জঙ্গলে তার আওয়াজ অন্যরকম হয়। আওয়াজ শুনে মনে হল গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়নি। তখন তো কল্পনা করা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তাই কিছুক্ষণ পরে আমরা খেতে বসলাম। খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে তখন ক্যাম্পের বাইরে ‘নারানদা, নারানদা’ বলে কেউ উত্তেজিত কন্ঠে ডাকল এবং নারান এঁটোহাতেই উঠে গেল। সামান্যক্ষণ অন্যান্যদের সঙ্গে কথা বলে সে আবার ফিরে এল।
ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হল?
নারান বলল, ভগলু মাচার কাছে গেছিল। মনে হয় খুব ক্ষুধার্ত ছিল ও এবং খাওয়া শুরু করার আগেই পিসু এক অনুচরের টর্চের আলোতে ওর বন্দুকের দু-ব্যারেলের দুটি গুলি ভগলুর দিকে তাক করে চালিয়ে দিয়েছিল। গুলি করার পরে ভগলু পড়ে গেছিল। কিন্তু পড়ে গিয়েই খোঁড়াতে খোঁড়াতে জায়গা ছেড়ে ফিরে গেছিল। কোনো আওয়াজ করেনি। তাই পিসু বুঝতে পারেনি দুটি গুলির একটিও লাগল কি না। কিছুক্ষণ মাচায় অপেক্ষা করে ওরা মাচা থেকে নেমে সোজা আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছেছিল।
বড়ো বাঘকে গুলি করার পর বাঘ যদি আহত হয় তবে মাচা থেকে নামাটা আত্মহত্যা করার শামিল। বিখ্যাত শিকারি এবং ব্যারিস্টার কুমুদ চৌধুরি তাঁর বইতে একথা লিখে গেছেন। অথচ সেই তিনি ওড়িশার কালাহাণ্ডির জঙ্গলে দিনের বেলায় হাঁকোয়া শিকারে বাঘকে মাচা থেকে গুলি করে আহত করার পর মাচা থেকে নেমে সেই বাঘের হাতে প্রাণ খুইয়েছিলেন। পিসু মহাপাত্রের উৎসাহ যতখানি ছিল অভিজ্ঞতা ততখানি ছিল না। সেইজন্য এই সাংঘাতিক বিপজ্জনক কাজটি সে করেছিল।
নারান বলল, এবারে কী হবে?
আমি বললাম, কাল সকালে ভোরে উঠে, মানে সকালের আলো ফুটলেই চলো আমরা যে গুহাতে ভগলুকে দেখেছিলাম সেখানে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করি। তার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
৩
ভোরের প্রথম আলো ফোটার আগেই র্যাকেট টেইলড ড্রঙ্গোর ডাকাডাকিতে আমরা বিছানা ছেড়ে উঠে তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। তখনও বন-মুরগিরা ডাকাডাকি শুরু করেনি। আমার রাইফেলটি সঙ্গে নিলাম। যখন সেই গুহার কাছে গিয়ে পৌঁছোলাম, দেখলাম ভগলু একটি কালো পাথরের চাটানের ওপরে শুয়ে আছে রক্তে মাখামাখি হয়ে। একটু পরেই শকুন পড়ে যাবে ওর ওপরে এবং এই মহান প্রাণীটিকে তারা ঠোঁটে, নখে ছিঁড়ে খাবে। তার সুন্দর চামড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। আশ্চর্যের কথা এই যে, পিসু মহাপাত্রের দুটি গুলিই লেগেছিল ভগলুর গায়ে। যেখানে গুলি লেগেছিল সেখানে মাংস কালচে হয়েছিল এবং চোখ বন্ধ করে ভগলু শুয়েছিল। ভোরের প্রথম আলো এবং সেই চৈত্র সকালের হাজারও পাখির ডাকাডাকির মধ্যে পরমস্বস্তিতে ভগলু ঘুমিয়েছিল। শেষ ঘুম।
কী আশ্চর্য মৃত্যু! কোনো ডাক্তার ডাকতে হয়নি, অক্সিজেন সিলিণ্ডার ছিল না, অ্যান্টি টিটেনাস ইঞ্জেকশন দিতে হয়নি, ই সি জি করতে হয়নি, এম আর আই করতে হয়নি, আই সি ইউ-তে ভরতি করতে হয়নি, ভেন্টিলেটরে থাকতে হয়নি তাকে। একজন আধুনিক মানুষকে মৃত্যুর আগে বিভিন্ন ডাক্তার এবং নার্সিংহোম বা হাসপাতালে যে পরমযন্ত্রণা ও হেনস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তার কিছুই ভগলুকে করতে হয়নি। একদিন এই জঙ্গলের মাটিতে সে যেমন স্বাভাবিকভাবে জন্মেছিল আজকেও সেরকমই জঙ্গলের মধ্যেই প্রস্তরাসনে তার শেষনিশ্বাস পড়ল। দুঃখের কথা এই যে, তার জীবন শেষ হল পিসু মহাপাত্র নামক একজন অর্বাচীন ও আনাড়ি শিকারির হাতে। যে তাকে অশেষ যন্ত্রণা দিয়ে পরলোকে পাঠাল।
তখনও সূর্যটা ওঠেনি। ভগলু যদি বেঁচে থাকত তাহলে তার ডান হাতের থাবা দিয়ে থাবড়া মেরে লাল বলের মতো সূর্যটাকে কাছে নামিয়ে আনার চেষ্টা করত। কিন্তু সে সুযোগও সে পেল না।
একটি উর্দু কবিতার কথা আমার মনে পড়ে গেল ভগলুকে দেখে—
অব তো শোনে দো চ্যয়ন সেপঢ়োঁ না তলকিঁ লহদ সে যাও।