ভগবানের হাত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

ভগবানের হাত – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত

নার্সিংহোমের ছোট্ট কেবিনে সন্ধেবেলা শুয়ে ছিল সুস্নাত। ভিজিটিং আওয়ার্স কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। সুস্নাতর কলিগরা তাকে দেখে ফিরে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার হাজরা রাউণ্ডে আসবেন। আগামীকাল সকালে সম্ভবত তার মুখের ব্যাণ্ডেজ খোলা হবে, একথা আজ সকালে নার্সের মুখে শোনার পর থেকে সারাদিন ধরে সুস্নাতর মনে চাপা একটা উত্তেজনা কাজ করছে। চোখ আর ঠোঁট বাদে, সুস্নাতর সারা মুখ ও মাথা সাদা কাপড়ের ব্যাণ্ডেজে মোড়া। প্রথমবার তো বেসিনের সামনে হাত ধুতে গিয়ে তার সামনের আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে সুস্নাত চমকে গিয়েছিল। মুখ তো নয়, ঠিক যেন মমির মাথা! তারপর থেকে আয়নার দিকে সেআর তাকাতে সাহস করে না। কিন্তু কালই তো তা হলে আসল ব্যাপারটা ঘটবে। নার্সের কথা ঠিক হলে, কাল তাকে তাকাতেই হবে আয়নার দিকে, তাও ব্যাণ্ডেজ খোলা অবস্থায়! সুস্নাতর মনে একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। ব্যাণ্ডেজ খোলার পর কী দেখবে সে? তার সেই চেনা মুখ, নাকি অন্য কিছু? নিজেকে চিনতে পারবে তো সে? তার কলিগরা অবশ্য তাকে আশ্বস্ত করে গিয়েছে, তেমন কিছু ঘটবে না বলে। ডাক্তার হাজরা কলকাতা শহরের অন্যতম বড়ো সার্জন। বিশেষত প্লাস্টিক সার্জারিতে তার সমকক্ষ এখানে আর কেউ নেই বললেই চলে। তিনি নিজে যখন অপারেট করেছেন, তখন নাকি চিন্তার কিছু নেই। বহু অ্যাক্সিডেন্ট কেসে তিনি মুখাবয়ব ফিরিয়ে দিয়েছেন নিখুঁতভাবে। লোকে বলে, তাঁর হাত দুটো নাকি ‘ভগবানের হাত’! কিন্তু কলিগরা যাই বলে থাক, উৎকন্ঠা কিছুতেই কাটছে না তার। ব্যাণ্ডেজ খুললে কী দেখবে সে? এই চিন্তা করতে করতে হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল সেই বীভৎস মুখটার কথা। ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠল এই ভেবে যে, তার মুখ ওইরকম হয়ে যাবে না তো! শিউরে উঠল সুস্নাত। প্রাণপণে ভোলার চেষ্টা করতে লাগল সেই মুখটাকে।

একটা মৃদু শব্দে সুস্নাতর চিন্তাজাল ছিন্ন হল। তার বেডের গায়ে প্লাইউডের পার্টিশন ওয়ালের ওপাশে কেউ যেন টোকা দিচ্ছে। ফুট সাতেক উঁচু এই পার্টিশন ওয়ালটাই একটা বড়ো ঘরকে দু-টো কেবিনে ভাগ করেছে। দু-টো কেবিনে ঢোকার দরজা অবশ্য আলাদা। সুস্নাতর কেবিনের দরজার সামনে যে লম্বা বারান্দার মতো প্যাসেজ আছে, তার ধারে সুস্নাতর দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে ঢুকতে হয়। দোতলার শেষ প্রান্তের কেবিন। ডাক্তার হাজরা ছাড়া ওই কেবিনে কোনওদিন কাউকে ঢুকতে দ্যাখেনি সুস্নাত।

ঠক-ঠক! আবারও সেই শব্দ! তারপর ওপাশ থেকে একটা চাপা কন্ঠস্বর শোনা গেল ‘দাদা, আপনি কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’ সুস্নাত সামান্য বিস্মিতভাবে বলল, ‘না, ঘুমইনি। আপনি কে?’ ওপাশের লোকটা বলল, ‘আমিও আপনার মতো বেডে শুয়ে আছি। আসলে, কথা বলার কোনও লোক নেই তো! তাই ভাবলাম যদি আপনার সঙ্গে একটু কথা বলা যায়। তা আপনি বিরক্ত হলেন না তো?’ সেজবাব দিল, ‘না, না, বিরক্ত হব কেন? ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হয়ে গেলে সন্ধেবেলা এই সময় আমারও বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সেই তো একঘেয়ে চুপচাপ থাকা! কথা বললে আমার ভালোই লাগবে।’ সুস্নাতর কথা শুনে লোকটা মনে হয় আশ্বস্ত হল। সেবলল, ‘যাক বাঁচলাম। একদম হাঁপিয়ে উঠেছি কথা না বলে। তা আপনার তো অ্যাক্সিডেন্ট কেস, তাই না?’

‘কী ভাবে জানলেন?’

লোকটা সামান্য চুপ করে থেকে বলল, ‘আড়ি না পাতলেও ওপাশের কথাবার্তা এপাশে শোনা যায়। তাই শুনে বুঝেছি। কী করে অ্যাক্সিডেন্ট হল?’

প্রশ্নটা শুনে সামান্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সুস্নাত। সেএকবার ভাবল ব্যাপারটা লোকটাকে বলবে। কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, লোকটা বিশ্বাস করবে না তার কথা। ঠিক যেমন তার কলিগরা করেনি। তার এক কলিগ তো বলেই ফেলেছিল, ‘তুমি কি আজকাল নেশাটেশা করছ? নাকি ‘হরর ফিল্ম’ দ্যাখো?’

কাজেই দুর্ঘটনার মূল কারণটা চেপে গিয়ে বলল, ‘আমি সেক্টর ফাইভে একটা কম্পিউটার ফার্মে চাকরি করি। যে দিন অ্যাক্সিডেন্টটা হল, সেদিন অফিস থেকে বেরতে বেশ রাত হয়েছিল। রাত এগারোটা হবে। বেরিয়ে বাইপাসে উঠতেই ঝোড়ো বাতাস আর মুষলধারে বৃষ্টি। দাঁড়ানোর কোনও জায়গা না দেখে তার মধ্যেই বাইক নিয়ে এগোচ্ছিলাম। কিছুটা পর এগোবার পরই, আমার বাইকের চাকাটা স্কিট করল। ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে ছিটকে পড়লাম রাস্তায়। আমার তারপর জ্ঞান ছিল না। পরে শুনলাম স্থানীয় লোকেরা আমাকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে, রাত একটা নাগাদ এই নার্সিংহোমে দিয়ে যায়। নার্সিংহোমের লোকেরা আমার মোবাইলের কললিস্ট দেখে আমার কলিগদের যোগাযোগ করে।’ এই পর্যন্ত শুনে লোকটা জানতে চাইল, ‘আপনার কোথায় লেগেছে।’

সেজবাব দিল, ‘মুখে। ডিভাইডারে ধাক্কা মারার সময় হেলমেটটা কোনওভাবে ভেঙে গিয়েছিল। যখন আমাকে এখানে আনা হয়, তখন নাকি নার্সিংহোমের লোকেরাও আমার মুখ দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল।’

এরপর একটু থেমে সেবলল, ‘তবে অন্য কোনও নার্সিংহোমে না গিয়ে, সেলোকগুলো যে ঘটনাচক্রে আমাকে এখানে এনেছিল, এ ব্যাপারে আমি ভাগ্যবান। ডাক্তার হাজরার মতো সার্জনকে আমি পেলাম। লোকে নাকি ওঁর হাতকে বলে, ‘ভগবানের হাত।’ অ্যাক্সিডেন্ট বা বার্নিংকেসে মুখমন্ডল ফেরাতে সকলে নাকি ওঁরই শরণাপন্ন হন। আমার ডান কানটাই শুনেছি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দু-দুবার অপারেট করতে হয়েছে। তা আপনার কী কেস? আমার মতো অ্যাক্সিডেন্ট?’

লোকটা জবাব দিতে যাচ্ছিল মনে হয়, কিন্তু তার আগেই করিডরে ডাক্তার হাজরার গলা শোনা গেল, ‘হ্যাঁ, কাল সকাল দশটায় আসবেন। গেটম্যানকে বলা আছে। ঢুকতে দেবে…’

তার গলার শব্দ পেয়েই পাশের কেবিনের লোকটা চুপ করে গেল। তারপরই সুস্নাতর কেবিনে ঢুকলেন ডাক্তার হাজরা। মধ্য পঞ্চাশের ডাক্তার হাজরা বেশ সুপুরুষ। ফরসা, লম্বা, মেদহীন দেহ। টিকোলো নাকে বসানো সোনার বাইফোকালের আড়ালে ঝকঝকে, সপ্রতিভ চোখ। নিখুঁতভাবে কামানো মুখ ও ঠোঁটের কোণে আবছা হাসির রেশ।

সুস্নাত তাঁকে দেখে বিছানায় উঠে বসতেই তিনি হেসে বললেন, ‘কাল সকালে কিন্তু আপনার ব্যাণ্ডেজ খুলব।’

সুস্নাত তার কথা শুনে একটু ভয়ে-ভয়ে বলল, ‘আমার মুখটা ঠিক আগের মতো থাকবে তো ডাক্তারবাবু?’

তার প্রশ্নের জবাবে ডাক্তার হাজরা তাঁর দু-হাতের পাতা সুস্নাতর সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘আমার এই হাতের উপর আপনি বিশ্বাস রাখতে পারেন। ডাক্তারি লাইনে সতীর্থরা অনেকে আমাকে ‘হ্যারল্ড গিলিস’ বলে ডাকেন।’

‘তিনি কে?’ জানতে চাইল সুস্নাত।

ডাক্তারবাবু হেসে বললেন, ‘তাঁকে বলা যেতে পারে ‘ফেশিয়াল প্লাস্টিক সার্জারির জনক।’ তিনিই প্রথম ১৯৯৭ সালে ‘ওয়াল্টার ইও’ নামে এক ব্রিটিশ সৈনিকের মুখমন্ডলে প্লাস্টিক সার্জারি করেন। ‘ইও’র ক্ষতবিক্ষত কপালে তিনি ‘টিউবড ফ্ল্যাপ’ বা ‘নলাকৃতি চামড়ার পট্টি’ বসিয়ে তার পূর্বেকার মুখমন্ডল ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তার চেয়ে অনেক বড়ো কাজ আমি এবার আপনার ক্ষেত্রে করলাম। তিনি করেছিলেন, ‘অটোগ্রাফট’ আর আমি করলাম, ‘অ্যালোগ্রাফট’! শেষের কথাগুলো যেন অনেকটা স্বগতোক্তির ঢঙে বেশ আত্মপ্রসাদের সঙ্গে তিনি বললেন। সুস্নাত বলল, ‘অটোগ্রাফট আর অ্যালোগ্রাফট মানে?’

ডাক্তার হাজরা বললেন, ‘এই সব মেডিক্যাল টার্মস। আপনি ঠিক বুঝবেন না।’

জিনিস হাতে উঠে এল সুস্নাতর। কিছুটা পুরোনো একটা ফোটোগ্রাফ। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের এক অপরিচিত যুবকের ছবি। খুব সুন্দর মুখ। ঠিন যেন, কোনও সিনেমার নায়ক। এ কার ছবি? সুস্নাতর ব্যাগে এল কীভাবে? কিন্তু কিছুতেই সেস্মরণ করতে পারল না ব্যাপারটা। এক সময় তার মনে হল, মাথায় চোট লেগে স্মৃতিশক্তি লোপ পায়নি তো? ছবিটা নিশ্চয়ই তার পরিচিত কারও হবে, বা কেউ তাকে দিয়েছিল। নইলে এটা তার ব্যাগে এল কীভাবে! ঠিক এমন সময় পার্টিশনের ওপাশের কেবিন থেকে গতকালের সেই কন্ঠস্বর আবার ভেসে এল, ‘দাদা কি ঘুমিয়ে পড়েছেন?’ মুখের ব্যাণ্ডেজ খোলার উত্তেজনায় সুস্নাত ভুলেই গিয়েছিল লোকটার কথা। সেবলে উঠল, ‘না, আমি জেগেই আছি। কাল তো ডাক্তারবাবু চলে আসায় আর কোনও কথাই হল না। তা আপনি কেমন আছেন?’ লোকটা যেন অস্পষ্ট হেসে পালটা প্রশ্ন করল, ‘আপনি বলুন কেমন আছেন?’

সুস্নাত বেশ উৎফুল্লভাবে বলল, ‘জানেন আজ আমার মুখের ব্যাণ্ডেজ খোলা হয়েছিল। আমি তো তার আগে খুব আতঙ্কে ছিলাম। ডাক্তারবাবু অসাধ্যসাধন করেছেন! একটা ছবিতে দেখলাম কী বীভৎস মুখ হয়েছিল আমার! বিশেষত ডান কানের কোনও অস্তিত্বই যেন ছিল না। কিন্তু ডাক্তারবাবু চমৎকারভাবে সবকিছু জুড়ে দিয়েছেন। ডাক্তারবাবুর হাত দু’টো সত্যিই ভগবানের হাত! উনি না থাকলে এ মুখ নিয়ে রাস্তায় বেরোতাম কীভাবে কে জানে? বাকি জীবনটা তো পড়েই আছে!’ লোকটা সামান্য চুপ করে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যি ভগবানের হাত। যে হাত ভগবানের তৈরি মুখের উপর হাতের খেলা দেখাতে পারে সেহাত তো ভগবানের হাত। আপনি ভাগ্যবান। তবে এবার থেকে একটু সাবধানে গাড়ি চালাবেন।

সুস্নাত বলল, ‘সাবধানেই তো সেদিন গাড়ি চালাচ্ছিলাম, কিন্তু … ‘সুস্নাত প্রায় বলেই ফেলতে যাচ্ছিল কথাটা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসঙ্গ পালটাবার জন্য বলল, ‘আচ্ছা অ্যাক্সিডেন্ট হলে কী স্মৃতিবিভ্রম হয়?’

‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয় বলে শুনেছি। কিন্তু কেন? আপনার কি কোনও ঘটনা মনে আসছে না?’ লোকটা জিজ্ঞেস করল। সুস্নাত বলল, ‘এমনি ঘটনা তো আমার সবই মনে আছে। আসলে অ্যাক্সিডেন্টের সময় আমার সঙ্গে যে ব্যাগটা ছিল তার ভিতর থেকে একটা পোস্টকার্ড সাইজের ফোটোগ্রাফ বেরল। এক সুন্দর যুবকের সাদা-কালো ছবি। কিন্তু আমি কিছুতেই ধরতে পারছি না ছবিটা কার, বা কীভাবে এটা আমার ব্যাগে এল?’

ওপাশে সামান্য কিছুক্ষণের নীরবতা। লোকটা তারপর বলল, ‘আপনার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে পারলে ভালো হত। আমি আজ রাতেই নার্সিংহোম থেকে চলে যাব। হয়তো আপনার সঙ্গে আমার আর দেখাই হবে না। কিছু কথা বলার ছিল।’

সুস্নাত বলল, ‘বা:! আপনারও ছুটি হয়ে যাচ্ছে। তা আপনি চলে আসুন না আমার ঘরে। আপনি বললে আমি যেতে পারি আপনার ঘরে।’

লোকটা বলল, ‘এখানে পেশেন্টদের অন্য ঘরে যাওয়ার নিয়ম নেই। ডাক্তারবাবু জানলে রাগ করবেন। রাতে করিডর ফাঁকা হয়ে গেলে আমি যাওয়ার আগে আপনাকে ডাকব। প্লিজ একবার আসবেন।’

লোকটার গলার স্বরে একটা আন্তরিক আহ্বান ফুটে উঠেছে। সেবলল, হ্যাঁ, অবশ্যই আসব। তা আপনার কী হয়েছিল? তা কিন্তু এখনও আমার জানা হয়নি। কী হয়েছিল আপনার?’

লোকটা জবাব দিল, ‘আমারও আপনার মতো মুখেরই ব্যাপার। সার্জারি হয়েছে।’

সুস্নাত বলল, ‘আপনারও কি প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে নাকি?’ ‘অটোগ্রাফট’ না ‘অ্যালোগ্রাফট?’ ডাক্তার হাজরার মুখে শোনা শব্দ দুটো চালিয়ে দিল সুস্নাত। লোকটা যেন একটু হেসে বলল, ‘শব্দ দুটোর মানে জানেন?’

সুস্নাত এবার একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘না, আসলে ডাক্তারবাবুর মুখেই শব্দ দুটো শুনেছি।’

লোকটা বলল, ‘আমি কিন্তু শব্দ দুটোর অর্থ জানি। আরও আছে, ‘আইসোগ্রাফট’, ‘জেনোগ্রাফট’… এসব প্লাস্টিক সার্জারির পরিভাষা। নিজের দেহের ত্বক বা চামড়া কেটে যখন সেদেহেরই অন্য কোথাও বসানো হয় তখন তাকে বলা হয় ‘অটোগ্রাফটিং’ বা ‘অটোগ্রাফট’, ‘আইসোগ্রাফটে’র ক্ষেত্রে যমজ কোনও মানুষের একজনের ত্বক অন্য জনের দেহে বসানো হয়। আর ‘জেনোগ্রাফটের’ ক্ষেত্রে এক প্রজাতিরটা অপর প্রজাতিতে বসান হয়,’ একটানা কথাগুলো বলে থামল লোকটা। বিস্মিত সুস্নাত বলল, ‘আপনি এসব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন নাকি? অনেক জানেন, দেখছি! আচ্ছা আপনি ‘অ্যালোগ্রাফটের’ মানেটা বলবেন? ডাক্তারবাবু বললেন আমার নাকি ‘অ্যালোগ্রাফট’ করেছেন তিনি’। লোকটা বলল, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেব। আচ্ছা, আপনি কিছু মনে না করলে দয়া করে বলবেন, অপারেশনের জন্য ডাক্তারবাবুকে কত পেমেন্ট করতে হচ্ছে?’

সুস্নাত একটু ইতস্তত করে বলল, ‘কলিগদের সঙ্গে ডাক্তারবাবুর কথা হয়েছে দেড় লাখ টাকা দিতে হবে। আজ বিকেলে তারা এসে টাকাটা মিটিয়ে দেবে। আমার অফিসই টাকাটা দিচ্ছে আসলে…’

সুস্নাত শুনল, লোকটা যেন অস্পষ্টভাবে বলল, ‘তার মানে পনেরো হাজার…’

সুস্নাত বলল, ‘কী বললেন?’

কিন্তু ঠিক সেই সময় বারান্দায় পদশব্দ শোনা গেল। ডাক্তারবাবু! সঙ্গে-সঙ্গেই পাশের লোকটা চুপ হয়ে গেল সেই শব্দে। ডাক্তার হাজরা সুস্নাতর দরজা পেরিয়ে পাশের কেবিনে গিয়ে ঢুকলেন।

এরপর খুব চাপাস্বরে যেন দীর্ঘক্ষণ ধরে পাশের কেবিনের লোকটার সঙ্গে কথা চলতে লাগল ডাক্তার হাজরার। একটা কথাই একবার স্পষ্টভাবে কানে এল সুস্নাতর। পাশের ঘরে লোকটা যেন একবার উত্তেজিতভাবে বলল, ‘এত কম!’

সারাদিন লোকটার আর কোনও সাড়া-শব্দ পায়নি সুস্নাত। বিকেলের পর থেকেই বৃষ্টি নেমেছিল। সুস্নাত খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল। বেশ রাতে ঘুম ভাঙল তার। বাইরে থেকে ভেসে আসা শব্দ শুনে সেবুঝতে পারল বৃষ্টি আরও বেড়েছে। বাতাসও বইছে। তার আঘাতে জানলার কাচের শার্সি কাঁপছে। শব্দ হচ্ছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে বাইরে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগল সুস্নাত। হঠাৎ প্লাইউডের দেয়ালে মৃদু টোকা দেওয়ার শব্দের সঙ্গে সেই কন্ঠস্বর শোনা গেল, ‘আপনি জেগে আছেন?’

সুস্নাত সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, আমি জেগে আছি।’

‘দয়া করে একবার বাইরে আসবেন।’

সুস্নাত উঠে বসে বলল, ‘হ্যাঁ, আসছি।’

লোকটা বলল, ‘আমার আর একটা অনুরোধ আছে। দয়া করে আপনার ব্যাগের অচেনা লোকটার ফোটোটা সঙ্গে আনবেন। তার কারণটা বাইরে এলে বুঝতে পারবেন। সুস্নাত এবার বেশ অবাক হল লোকটার কথা শুনে। ও ছবির সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? সুস্নাত জবাব দিল, ‘ঠিক আছে, নিচ্ছি।’

মিনিটখানেকের মধ্যেই ছবিটা নিয়ে করিডরে বেরিয়ে এল সুস্নাত। অন্ধকার বারান্দা। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি, তার সঙ্গে দমকা হাওয়া। শুধু বাইরের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের একটা আলো বারান্দার কোণে এসে পড়েছে। হলদেটে বর্ষণসিক্ত, ম্যাটম্যাটে আলো। সুস্নাত দেখতে পেল সেই কোণে, কয়েক হাত দূরে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার পরনে মাথা ঢাকা টুপি, লম্বা ঝুলের বর্ষাতি। সুস্নাতর উপস্থিতি বুঝতে পেরে একই ভাবে দাঁড়িয়ে লোকটা বলল, ‘আপনাকে ডাকলাম বলে আপনি রাগ করবেন না। যাওয়ার আগে কিছু কথা বলতে চাই আপনাকে?’

‘না রাগ করব কেন? বলুন, কী কথা?’

লোকটা বলল, ‘আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা কীভাবে হয়েছিল, তা আমি জানি। সেদিন ঝড়-জলের রাতে রাস্তায় হঠাৎই আপনি আপনার গাড়ির সামনে এক ভয়ংকর মুখ দেখতে পেয়েছিলেন। তাই দেখে আতঙ্কে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা মারেন…’ এ পর্যন্ত শুনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল সুস্নাত।

বিস্মিত সুস্নাত বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই। বীভৎস সেই মুখ! ও মুখ কোনও মানুষের হতে পারে না! কিন্তু ব্যাপারটা আপনি জানলেন কীভাবে?

মুহূর্ত খানেকের নিস্তব্ধতা। লোকটা এরপর সুস্নাতর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বর্ষাতির টুপিটা খুলে ফেলল। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে লোকটার মুখে। সুস্নাত দেখতে পেল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেদিনের রাস্তায় দেখা বীভৎস সেই মূর্তি! লোকটার মুখমন্ডলে কোনও নাক নেই! ঠোঁটহীন মুখের বাইরে বেরিয়ে এসেছে দাঁতের পাটি। পলকহীন চোখ, সারা মুখে ছড়িয়ে আছে অজস্র কাটাকুটির দাগ। এরকম মুখ কোনও মানুষের হতে পারে না! আর একটু হলেই সুস্নাত জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, দেয়াল ধরে কোনওমতে সেসামলে নিল নিজেকে। তার অবস্থা দেখে লোকটা করুণস্বরে বলে উঠল, ‘দোহাই আপনার, আপনি ভয় পাবেন না। বিশ্বাস করুন, আমিও মানুষ। এসবই সার্জারির চিহ্ন। যে ভগবানের হাত আপনার মুখ ফিরিয়েছে এ সবই তার হাতের দাগ। সেই একই হাত।’

সুস্নাত এবার একটু ধাতস্থ হয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, ‘তার মানে?’

লোকটা পলকহীন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক্তার হাজরা প্লাস্টিক সার্জারির অনেক জটিল পরীক্ষা করেন আমার এই মুখ নিয়ে। আপনার মতো অনেকের মুখ ফিরিয়ে দিতে আমার এ মুখ কাজে লাগে তাঁর। আমি গরিব মানুষ, পরিবার-ছেলেপুলে আছে। এর বিনিময়ে যে পয়সা পাই তাতে সংসার চলে। এবার যেমন পেলাম হাজার পনেরো। মাসছয়েক সংসার চলে যাবে। তারপর আবার …’ এরপর একটু থেমে লোকটা বলল, ‘ছবিটা আমাকে দিন। ওটা আমারই ছবি ছিল। সেদিন রাস্তায় ওই জায়গায় পড়ে গিয়েছিল। লোকেরা আপনার ছবি ভেবে ব্যাগে পুরে দিয়েছে। জানেন, আপনারা তো আয়নাতে মুখ দ্যাখেন। আর আমি দেখি ওই ছবিটা। ওটাই আমার আয়না।’

নির্বাক সুস্নাত ছবিটা এগিয়ে দিল তার হাতে। ছবিটার উপর পরম মমতায় হাত বোলাতে-বোলাতে লোকটা বলে যেতে লাগল, ‘আমার খুব কষ্ট জানেন, নিজের সন্তানরা পর্যন্ত তাকাতে পারে না মুখের দিকে। দিনের আলোতে বাইরে বেরলে লোকে ঢিল ছোঁড়ে। তাই রাত ছাড়া বাইরে বেরতে পারি না। কেউ কেউ বলে আমি নাকি মানুষ নই, পিশাচ! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমিও মানুষ, মানুষ…’ লোকটার কথাগুলো আর্তনাদের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল বাতাসে। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তারপর লোকটা বলল, ‘আমার জন্যই আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা হল। পারলে এই হতভাগ্য লোকটাকে ক্ষমা করবেন। যাওয়ার আগে আপনাকে ‘অ্যালোগ্রাফট’ কথার অর্থটা বলে যাই। এখন একজন মানুষের দেহ থেকে কিছু নিয়ে সম্পর্কহীন ভিন্ন কোনও মানুষের দেহে তা বসানো হয়, তখন তাকে বলে ‘অ্যালোগ্রাফট’। তবে, ডাক্তারবাবু একটা অসাধ্য সাধন করলেন। সত্যিই ওঁর হাত ‘ভগবানের হাত!’ একটা দুর্বোধ্য হাসি ফুটে উঠল লোকটার মুখে। আর কথা না বাড়িয়ে সুস্নাতকে নমস্কার করে তার পাশ কাটিয়ে এগোল লোকটা। ঠিক সেই সময় বাইরে প্রচন্ড বিদ্যুৎ চমকে মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে উঠল বারান্দা। সেই আলোয় সুস্নাত স্পষ্ট দেখতে পেল, লোকটার ডান কানের জায়গাটা পাতলা একটা স্টিকিং প্লাস্টার দিয়ে ঢাকা! অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ছাটে ভিজতে লাগল সুস্নাত। ভেজা বাতাসে তখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই হাহাকার, ‘বিশ্বাস করুন, আমিও মানুষ, মানুষ…’ সুস্নাত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সেই আর্তনাদ। কিন্তু কার কানে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *