ভগবানের মুখ
দুঃখেই ভগবানের অবস্থান। সাধু সেন্ট ফ্রান্সিস বলছেন : “তোমার কাছে সুখ চাই না ভগবান। তোমার ভাণ্ডারে যত দুঃখ আছে, উজাড় করে দাও; কারণ দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে আমি জানি, তুমি আমাকে সহ্যশক্তিও দেবে।” কুন্তী শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিলেন : “তুমি আমাকে দুঃখে রাখ, বিপদে রাখ, যন্ত্রণায় রাখ, মৃত্যুতে রাখ, কারণ তাহলেই তুমি আমার পাশে থাকবে। সুখের দিন এলেই তো তোমার প্রস্থান!” সংসারের যাবতীয় চুষিকাঠি—যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, স্ত্রী, পুত্র, পরিবার—একটু একটু চুষছে আর হুঙ্কার ছাড়ছে : ‘জানে না আমি কে?” আবার কেউ শত্রুতা করলে হুঙ্কার——দেখিয়ে দেব মজা। একবার ফোন তুলব, সব ফিউজ! আমার বউমার খুড়শ্বশুরের ছোটশালার মেসোমশাইয়ের ছোট ছেলের বন্ধুর কাকা ডি আই জি ছিলেন। বেশি ট্যাফোঁ করলেই অ্যায়সা টাইট দিয়ে দেব যে, ফ্যাকট্রিতে গিয়ে খোলাতে হবে!’
উপাধি! ঠাকুর বলছেন : “এক-একটি উপাধি হয়, আর জীবের স্বভাব বদলে যায়।” বলছেন : “যে কালাপেড়ে কাপড় পরে আছে, অমনি দেখবে, তার নিধুর টপ্পার তান এসে জোটে; আর তাস খেলা, বেড়াতে যাবার সময় হাতে ছড়ি, এইসব এসে জোটে। রোগা লোকও যদি বুট জুতো পরে সে অমনি শিস দিতে আরম্ভ করে, সিঁড়ি উঠবার সময় সাহেবদের মতো লাফিয়ে উঠতে থাকে। মানুষের হাতে যদি কলম থাকে, এমনি কলমের গুণ যে, সে অমনি একটা কাগজ-টাগজ পেলেই তার ওপর ফ্যাসফ্যাস করে টান দিতে থাকবে। টাকাও একটা বিলক্ষণ উপাধি। টাকা হলেই মানুষ আরেকরকম হয়ে যায়, সে মানুষ থাকে না। এখানে একজন ব্রাহ্মণ আসা-যাওয়া করত। সে বাইরে বেশ বিনয়ী ছিল। কিছুদিন পরে আমরা কোন্নগরে গেছলুম! হৃদে সঙ্গে ছিল। নৌকা থেকে যাই নামছি, দেখি সেই ব্রাহ্মণ গঙ্গার ধারে বসে আছে। বোধ হয়, হাওয়া খাচ্ছিল। আমাদের দেখে বলছে, ‘কি ঠাকুর! বলি আছ কেমন?’ তার কথার স্বর শুনে আমি হৃদেকে বললাম, ‘ওরে হৃদে! এ লোকটার টাকা হয়েছে, তাই এইরকম কথা।’”
প্রসঙ্গটিকে আরো একটু বিস্তারিত করে ঠাকুর একটি গল্প বলছেন : “একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। গর্তে তার টাকাটা ছিল। একটা হাতি সেই গর্ত ডিঙিয়ে গিছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিকে লাথি দেখাতে লাগল। আর বললে, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস! টাকার এত অহঙ্কার!”
তাহলে দুঃখের স্থান কোথায়? দুঃখের কোলে বসে আছেন ভগবান। ঠাকুর একদিন বসে আছেন পঞ্চবটীতে। ধ্যান চিন্তা কিছুই করছেন না। বসে আছেন। এমনিই বসে আছেন। প্রায়ই যেমন থাকেন। নিজের হাতে তৈরি পঞ্চবটী। যত্নে এবং নিয়মিত জলসিঞ্চনে তুলসী ও অপরাজিতা গাছগুলি এত বড় ও নিবিড় হয়েছে যে, ভিতরে বসে যখন তিনি ধ্যান করতেন, তখন বাইরে থেকে তাঁকে দেখা যেত না। বসে আছেন তিনি। আপন ভাবে। আপন মনে। “এমন সময় নিরুপমা জ্যোতির্ময়ী স্ত্রীমূর্তি অদূরে আবির্ভূতা।” পঞ্চবটীর উত্তরে। যেখানে গাছপালা, ঝোপঝাড়ের জন্য আলো কম; কিন্তু সেই নারীমূর্তির আবির্ভাবে স্থানটি আলোকিত হয়ে উঠল। ঠাকুর শুধু যে সেই মূর্তিটি দেখছেন তা নয়, সবই দেখতে পাচ্ছেন—পঞ্চবটীর গাছপালা, গঙ্গা। মূর্তিটি মানবীর। দেবী হলে ত্রিনয়না হতেন। কিন্তু প্রেম, দুঃখ, করুণা, সহিষ্ণুতায় পূর্ণ সেই মুখের মতো অপূর্ব ওজস্বী গম্ভীরভাব দেবীমূর্তিতেও বিরল। প্রসন্ন দৃষ্টিপাতে মোহিত করে ঐ দেবী-মানবী ধীর ও মন্থর পায়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে ঠাকুরের দিকে এগিয়ে আসছেন। ঠাকুর স্তম্ভিত হয়ে ভাবছেন—কে ইনি? এমন সময়ে একটা হনুমান কোথা থেকে সহসা উ-উপ শব্দ করে এসে তাঁর (সেই নারীর) পদপ্রান্তে লুটিয়ে পড়ল। ঠাকুর বলছেন : “ভেতর থেকে মন বলে উঠল, সীতা, জনম-দুঃখিনী সীতা, জনকরাজনন্দিনী সীতা, রামময়জীবিতা সীতা!” ঠাকুর তখন ‘মা’ ‘মা’ বলে অধীর হয়ে তাঁর চরণে প্রণত হতে যাবেন, এমন সময় তিনি বিদ্যুৎচমকের মতো ঠাকুরের শরীরে প্রবেশ করলেন। আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত ঠাকুর বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। ঠাকুর বলছেন : “ধ্যান-চিন্তাদি কিছু না করে এমনভাবে কোন দর্শন আগে আর হয়নি। জনম-দুঃখিনী সীতাকে সর্বাগ্রে দেখেছিলাম বলেই বোধ হয় তাঁর মতো আজন্ম দুঃখভোগ করছি!”
চারটি কথা—প্রেম, দুঃখ, করুণা, সহিষ্ণুতা। এই চারটি ঠাকুরের শরীরে প্রবিষ্ট হলো। ঠাকুরের প্রেম কেমন? সে বুঝেছিলেন দুজন। নরেন্দ্রনাথ আর জননী সারদা। নরেন্দ্রনাথ লিখছেন : “রামকৃষ্ণের জুড়ি আর নাই, সে অপূর্ব সিদ্ধি, আর সে অপূর্ব অহেতুকী দয়া, সে intense sympathy বদ্ধজীবনের জন্য—এজগতে আর নাই।” লিখছেন : “তাঁহার জীবদ্দশায় তিনি কখনো আমার প্রার্থনা গরমঞ্জুর করেন নাই। আমার লক্ষ অপরাধ ক্ষমা করিয়াছেন— এত ভালবাসা আমার পিতামাতায় কখনো বাসেন নাই। ইহা কবিত্ব নহে, অতিরঞ্জিত নহে, ইহা কঠোর সত্য এবং তাঁহার শিষ্যমাত্রেই জানে।”
আর মা কি দেখলেন? ঠাকুরের প্রেম, intense sympathy বদ্ধজীবনের জন্য! ঠাকুর কাশীপুর উদ্যানবাটীতে। লীলাসংবরণের আর বিশেষ দেরি নেই দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়ি। মসৃণ। মা আড়াই সের দুধের বাটি নিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন একদিন। আহত মা অচল। ঠাকুর তাঁর সহধর্মিণীকে জাগতিক ভাবে কী গভীর ভালবাসতেন, আধ্যাত্মিক ভাবে কতটা শ্রদ্ধা করতেন ও নির্ভরশীল ছিলেন তার একটি উদাহরণ। ঠাকুর তাঁর অন্যতম পার্ষদ বাবুরামকে বলছেন : “ও বাবুরাম, ঐ যে ওকে তুই ঝুড়ি করে মাথায় তুলে এখানে নিয়ে আসতে পারিস!” মা তখন নথ পরতেন। ঐ রোগযন্ত্রণায়ও ঠাকুর রসিকতা হারাননি! মাকে বোঝাতে গিয়ে ঠাকুর নাকে হাত দিয়ে নথের আকারে আঙুল ঘুরিয়ে ইঙ্গিতে বোঝালেন, মাকে তুলে আনতে হবে। অসুস্থ ঠাকুর তখন শিশুর মতো অসহায়। প্রকৃত প্রেম, দিব্য প্রেম। সেই প্রেমে স্ত্রী প্রয়োজনে মাতা। আবার স্বামী সময় সময় পিতা। দেশের বাড়িতে ঠাকুর। পল্লীরমণীরা ঠাকুরকে ঘিরে বসতেন। ঠাকুর তাঁদের উপদেশ দিতেন। মা থাকতেন সেই সভায়। কখনো কখনো মা হয়তো ঘুমিয়ে পড়তেন। তখন কিশোরী মা আমাদের। ঘুমিয়ে পড়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্য মেয়েরা মাকে ঠেলে তোলার চেষ্টা করলে ঠাকুর স্নেহশীল পিতার মতো বাধা দিতেন: “না গো না, ওকে তুলো না। ওকি সাধে ঘুমোচ্ছে?” এইটুকু তাঁরা বুঝলেন, পরের কথাটি রহস্যময় : “এসব কথা শুনলে ও এখানে থাকবে না—চোঁচা দৌড় মারবে!”
কাশীপুর উদ্যানবাটীতে মাকে ঝুড়ি করে তুলতে হলো না। বাবুরাম মহারাজকে ঝাঁকা মুটেওলা হতে হলো না। তিনদিনের বিশ্রামে পা ঠিক হয়ে গেল। কিন্তু তিনি ইঙ্গিতে, রসিকতা করে বুঝিয়ে গেলেন—আমার অবর্তমানে মাকে তোমরা মাথায় রেখো।
একদিন মা নিজেই ঠাকুরের পথ্য নিয়ে ঘরে ঢুকছেন, ঠাকুর শয্যায় শুয়ে আছেন চোখ বুজে। মা ডাকলেন : “এখন খাবে যে, ওঠ।” ঠাকুর চোখ মেলে তাকালেন, যেন কোন দূরদেশ থেকে ভেসে ভেসে এলেন। সেই ভাবের ঘোরে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন : “দ্যাখ, কলকাতার লোকগুলো যেন অন্ধকারে পোকার মতো কিলবিল করছে। তুমি তাদের দেখো।” সেই অভূতপূর্ব প্ৰেম, সেই অহৈতুকী সহানুভূতির জিম্মাদার করলেন মাকে। মা বললেন : “আমি মেয়েমানুষ!” তিনি বললেন : “এ (শ্রীরামকৃষ্ণ) আর কি করেছে! তোমাকে এর অনেক বেশি করতে হবে।” অর্থাৎ তিনি বললেন : না, তুমি শুধু মেয়েমানুষ নও, তুমি রামকৃষ্ণের শক্তি। ঠাকুর সুর করে গাইতেন—
“এসে পড়েছি যে দায়, সে দায় বলব কায়
যার দায় সে আপনি জানে, পর কি জানে পরের দায়?”
অপরের দুঃখের বোঝা নিজে বহন করা। কাশীপুরে ঠাকুরের শয্যার পাশে বসে নরেন্দ্রনাথ বলছেন : “মহাপুরুষ নিজে উদ্ধার হয়ে গিয়ে জীবের উদ্ধারের জন্যে থাকেন। দেহের সুখ-দুঃখ নিয়ে থাকেন। যেমন মুটেগিরি, আমাদের মুটেগিরি on compulsion। মহাপুরুষ মুটেগিরি করেন সখ করে।”
স্বামীজী ঠাকুরকে একদিন ভীষণ বকছেন : “কেন আপনি অন্নদা গুহর কাছে ওসব কথা বললেন!” ঠাকুর অন্নদাকে বলেছিলেন : “নরেন্দ্রর বাবা মারা গেছে, ওদের বড় কষ্ট, এখন বন্ধুবান্ধবরা সাহায্য করে তো বেশ হয়!”
নরেন্দ্রনাথের তিরস্কারে ঠাকুর কেঁদে ফেলেছেন, কাঁদতে কাঁদতে বলছেন : “ওরে, তোর জন্যে যে আমি দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে পারি!” নরেন্দ্রনাথ মাস্টারমশাইকে একদিন সারের সার কথাটি বলেছিলেন : “অনেক দুঃখকষ্ট পেয়ে তবে এই অবস্থা হয়েছে—মানি, দুঃখকষ্ট না পেলে resignation হয় না- absolute dependence on God ।”
শ্রীরামকৃষ্ণ হলেন জীবন্ত গীতা। তাঁর এক-একটি সন্তান এক-এক অধ্যায়- জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম, মোক্ষ, যোগ! শ্রীভগবানের পুরুষমুখ দেখিনি আমি, শ্রীরামকৃষ্ণের মুখ আমি দেখেছি। দেখেছি তাঁর স্ত্রীমুখ, জননী সারদা। দেখেছি তাঁর জ্ঞানিমুখ, স্বামী বিবেকানন্দ!