ভগবানের ভাগনে

ভগবানের ভাগনে

স্কুল ছুটি হতে আর দু-দিন বাকি। সুকোমল মা-বাবার সঙ্গে হিমাচল প্রদেশে যাচ্ছে। ধ্রুবরা মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজম-এর ট্যুওর নিয়ে মধ্যপ্রদেশে যাচ্ছে। ভেড়াঘাট, কানহা-কিলি, অজন্তা ইলোরা, ওর্ঘা, শিভপুরী। প্যানারা যাচ্ছে রাজস্থান, জয়পুর, উদয়পুর, চিতোর, বান্ধবগড়, সারিসকা। প্যানারা খুব বড়োলোক, ওরা যাচ্ছে বিরাট দলে দু-খানা গাড়ি নিয়ে। প্যানা ছেলে খুব ভালো। আমাকে ওদের বাড়িসুষ্ঠু সবাই খুবই ভালোবাসেন। মাসিমা বলেছিলেন, তপু, তুমিও চলো না আমাদের সঙ্গে। তোমার মাকে ফোন করে বলি?  

তুই কী বললি?

আমি বলেছিলাম না, না মাসিমা। আমি তো একা নই, আমার ছোটোবোন সুপি আছে, তা ছাড়া বাবা সামনের মাসে রিটায়ার করবেন। মা-বাবা খুব চিন্তাতে থাকেন এখন। মা-ও তো রিটায়ার করবেন আট মাস পরে। আমি তো বড়ো ছেলে, আমারও চিন্তা হয়।

মাসিমা হেসে ফেললেন। বললেন, সবে তো ক্লাস এইট তোমার। নাইন হবে। পাস তো তুমি করবেই। আরও অনেক বড়োনা হলে বাবাকে এবং মাকেও সাহায্য করবে কী করে!

তা তো জানি মাসিমা। আপনি কিন্তু মাকে এসব কথা বলবেন না। মা জানলে আমার উপর রাগ করবেন।

মাসিমা বলেছিলেন, না, না। আমি কেন বলতে যাব। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।

বাড়ি ফিরে, আমি নিজেই মাকে বললাম, প্যানা আর প্যানার মা মাসিমার কথা।

মা বলল, নিজে জীবনে বড়ো হও, পায়ে দাঁড়াও, তারপর নিজেই যাবি, সুপিকেও নিয়ে যাবি, আমরা যদি বেঁচে থাকি তবে আমাদেরও হয়তো নিয়ে যাবি।

তারপর বলল, প্যানার বাবা মস্ত ডাক্তার। এম আর সি পি এফ আর সি এস না কী সব যেন। বিলেত ফেরত। ওঁরা খুবই বড়োলোক। গুণও আছে, অর্থও আছে। অবশ্য আজকাল অর্থই একটা গুণ হয়ে গেছে। গুণ তো বটেই, নিজের অর্থ যদি দশ জনের উপকারে লাগাতে পারিস তবে তা গুণই হয়ে ওঠে আর শুধু নিজের ভোগবিলাসে যদি খরচ করিস তবে সেটা দোষই হয়ে ওঠে। তবে তপু, কখনো ওপরে তাকাবি না। কারণ, ওপরে তাকাবার কোনো শেষ নেই। আমাদের চেয়েও যাদের অবস্থা খারাপ তাদের দিকে তাকাবি, তাহলেই দেখবি আনন্দে আছিস। এই কথাটা সবসময়ে মনে রাখবি। সুখ আর আনন্দ এক নয়। জীবনে আনন্দর প্রার্থনা করবি, সুখের নয়, বুঝলি।

তারপর মা বলল, প্যানার বাড়ির সকলে তোকে কত ভালোবাসে, তোকে কত কী খাওয়ায়, কত জিনিস উপহার দেয়। ওকথা কখনো ভুলবি না। যদি কারো বাড়িতে এক গেলাস জলও খাস, চিরদিন তা মনে করে রাখবি। অকৃতজ্ঞতার মতো পাপ আর দু-টি নেই।

আমি চুপ করে মায়ের কথা শুনছিলাম।

তারপর মা বলল, তার চেয়ে বড়দার কাছে ঘুরে আয় তুই হাসনপুরে। সেই কবে ছেলেবেলাতে একবার গেছিলি আমার সঙ্গে। বড়দার বয়সও হয়ে গেছে পঁচাত্তর। কবে চলে যাবেন ঠিক নেই। সেখানে নদী আছে, গাছগাছালি, পাখপাখালি। আর নদীর কী সুন্দর নাম, পিয়াসী। ভালো লাগবে। আর তোর বড়ো মামা, সারাজীবন ছাত্র পড়িয়েছেন, কত জ্ঞান তাঁর। তাঁর সঙ্গে কয়েকদিন কাটালে কত কী শিখবি। বই পড়ে আর কতটুকু শেখা যায়–একজন পণ্ডিত মানুষের কাছ থেকে গল্পে গল্পেও যা শেখা যায়, তা বই পড়ে কখনোই শেখা যায় না। তোকে আমি দু শো টাকা দেব। যাতায়াতের ভাড়া হয়ে যাবে। আর ওখানে তো তোর কোনো খরচই নেই। সপ্তাহের শেষেই চলে যা।

২.

ছোট্ট স্টেশন হাসনপুর। দু-মিনিট দাঁড়ায় সেখানে এক্সপ্রেস ট্রেন। লাল কাঁকরের প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্মে কটা আতা গাছ। আমার ছোট্ট স্যুটকেসটা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামতেই দেখি বড়োমামা নিজে নিতে এসেছেন আমাকে। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মা এস টি ডি বুথ থেকে ফোন করে দিয়েছিল আগেই।

বললেন, কী রে, ছোঁড়া। তুই যে দেখছি ইয়াং ম্যান হয়ে গেছিস, আর ছোট্টটি নেই।

স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে একটি সাইকেল-রিকশাতে উঠলাম আমরা। খুব ছেলেবেলাতে মায়ের সঙ্গেই একবার এসেছিলাম। বড়োমামা ব্যাচেলর। এখনও খুব সুন্দর চেহারা। বড়ো বড়ো সাদা চুল আর সাদা দাড়ি। রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে অনেকটা। আগে যখন দেখেছিলাম, তখন চুল দাড়ি ছিল না। একাই থাকেন। তাঁর দেখাশোনা করে কালু নামের একটি ছেলে। তার তখন জ্বর চলছে, বড়োমামা নিজেই আমার জন্যে রান্না করে রেখেছেন পিয়াসী নদীর কুচো মাছের ঝোল-ঝাল তরকারি, লাল চালের ভাত আর মুসুরির ডাল।

বড়োমামা বললেন, খাওয়া-দাওয়ার পর একটু ঘুমিয়ে নে তারপর তোকে নিয়ে বেড়াতে যাব।

এখানে বেড়াবার জায়গা কী কী আছে বড়োমামা?

ঘরের বাইরে বেরোলে আর চোখ-কান খুলে রাখলেই তো বেড়ানো হয়। চলই না।

জায়গাটা এখনও নির্জন। লাল মাটির পথ। দু-একটা সাইকেল-রিকশা যাচ্ছে ক্যাঁচোর কোঁচর শব্দ করতে করতে। দেখলাম, বড়োমামাকে প্রত্যেক মানুষই খুব শ্রদ্ধা করে।

এইটা কী গাছ জানিস?

না তো।

এটা কদম গাছ। বর্ষাকালে হলুদ হলুদ গোল গোল ফুল হয় নরম টেনিস বল এর মতো।

আর ওই গাছটা?

আমি বললাম।

আরে! ওটা তো কুর্চি। কুর্চি গাছ। সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে যায় বসন্তের সময়ে। কুর্চিবনে গান উপন্যাসটা পড়িসনি?

না, কার লেখা?

সম্ভবত বুদ্ধদেব-এর?

বসু? তিনি তো অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন?  

আরেকজন বুদ্ধদেবও আছেন?

আরে! তাকে তো চিনি। সে বুদ্ধ নয়, বুদ্ধু। একবার এসেছিল এখানের সাহিত্য-সভাতে।

আর ওই গাছটা দেখছিস, ওটার নাম বসন্তী।

বাসন্তী তো জানিই। বাসন্তী তো জানতামই, বসন্তী তো শুনিনি!

কেন? তোর মায়ের গলায় সেই রবীন্দ্রসংগীতটা শুনিসনি? একলা বসে হেরো তোমার ছবি এঁকেছি আজ বসন্তী রঙ দিয়া। সেই বসন্তী। এর ফুলগুলো হয় ফিকে হলুদ। দোলের আগে ফোটে। গাছের পাতা ঝরে যায় সব–তখন শুধুই ফুল। তবে বসন্তকালেরই মতো, এরা বেশিদিন থাকে না। ফুটেই ঝরে যায়। যা কিছু সুন্দর তাই-ই ক্ষণস্থায়ী।

তাই?

হ্যাঁ রে।

আর ওইটা কী গাছ বলত?

আমি আর কী জানি?

ওটা সুন্দরী গাছ। যে গাছের নামে সুন্দরবন।

সুন্দরবনে তো সব ম্যনগ্রোভ ফরেস্টস। নোনা জলের গাছ। সুন্দরী এখানে হল কী করে?

আমি পণ্ডিতি দেখিয়ে বললাম।

সুন্দরী সব জায়গাতেই হয়। আমার এক ছাত্র এখন বন বিভাগের মস্ত অফিসার, অতনু রাহা। সেই এনে দিয়েছে গাছ-পাগল আমাকে। অনেকেই একথা জানে না যে, সুন্দরী শুধু সুন্দরবনেই নয়, সব জায়গাতেই হয়। মানে, হতে পারে।

তা ওসব দুষ্প্রাপ্য গাছ আপনি পথে-ঘাটে লাগিয়েছেন কেন? নিজের বাড়ির বাগানে লাগালে ভালো হত না?  

হয়তো ভালো হত, কিন্তু সে তো আমার নিজস্ব হত। একারই। এই যে পথে-ঘাটে এত গাছ। লাগিয়েছি এ তো সকলের হয়ে গেছে। সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার যে আনন্দ তা কি নিজে একা ভোগ করলে হয়? আমার নাম কী জানিস এই হাসনপুরে?  

কী?  

গাছবাবু। নিজের হাতে লাগানো গাছগুলো আজ বড়োবড়ো হয়ে গেছে। এখনও লাগাই। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই। আমার দেখাদেখি স্কুলের ছাত্র থেকে রিকশাওয়ালা, সরকারি অফিসের কর্মচারী, মাস্টারমশাইরা সকলেই নিজেদের বাড়িতে আর পথে ঘাটে গাছ লাগান আজকাল। হাসনপুরে কারো সাধ্য নেই যে একটাও গাছ কাটে। আমরা এতদিন ধরে যে গাছ কেটেছি, প্রকৃতি-বিনাশ করেছি, তারই জন্যেই তো এত বন্যা, ভূমিকম্প, সুনামি, সাইক্লোনের বাড়বাড়ন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে। প্রকৃতিকে আবার সবুজ করে দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করা হবে, তবেই হয়তো আমরা বাঁচতে পারব। হাসনপুর একটি ছোট্ট জায়গা, সারা পৃথিবীকে যেদিন হাসনপুর করে তুলতে পারব। আমরা সেদিনই হয়তো আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী বেঁচে যাবে। এই গাছের সমারোহর কারণে আমাদের এখানে তখন পাখিরও রাজত্ব হবে।

একটি ছোট্ট পাখির চকিত ডাক, এক রাশ শিউলি ফুলের গন্ধে মনের মধ্যে যে ভাব ফোটে তা দশ খণ্ড দর্শনের বই পড়েও ফোটে না। তাই না?

আমি চুপ করে রইলাম।

পথের দু-পাশে আতা, পেয়ারা, চেরি এবং আরও কত গাছ লাগিয়েছি পাখিদের ফল খাওয়ার জন্যে। পথে ফললেও হাসনপুরের কেউই এসব ফলে হাত দেয় না।

তারপর বললেন, আজ তোকে গাছ চেনাব কিছু। সব তো একদিনে হবে না। আর কাল সকালে বেরিয়ে পাখি চেনাব, নদীর ধারে নিয়ে যাব, দেখবি নানা গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া। আমাদের শান্ত পিয়াসী নদীটির কী রূপ!

তারপর বললেন, দেশময় দৌড়ে বেড়ালে, বুড়ি ছুঁয়ে এলে নিজের জায়গাতে ফিরে, যেসব বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনেরা ওই সব দূরের ভালো ভালো জায়গাতে যেতে পারেন না, তাঁদের কাছে জাঁক করে গল্প করা যায় অবশ্যই কিন্তু আমাদের হাতের কাছে যে কত জায়গা আছে। তারই খোঁজ রাখি না আমরা। আমার নিজের ছেলে-মেয়ে নেই, এই গাছগাছালি, পাখপাখালি, এই নদী, এই হাসনপুরের মানুষজনই আমার ছেলে-মেয়ে।

আমি আমার জ্ঞান দেখিয়ে আবৃত্তি করলাম। দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া একটি ধানের শিষের ওপর একটি শিশিরবিন্দু।

বাঃ। রবীন্দ্রনাথ। সেই দাড়িওয়ালা ছাড়া আমরা অচল।

গাছ চিনতে চিনতে সন্ধ্যে হয়ে এল। বড়োমামা ডাক্তারখানাতে ঢুকলেন। ডাক্তারবাবু দাঁড়িয়ে উঠে আসুন মাস্টারদা, বলে বড়োমামাকে চেয়ার এগিয়ে দিলেন।

বললেন, কালু কেমন আছে?

তোমার চিকিৎসাতে কি খারাপ থাকতে পারে? জ্বর কমেছে কিন্তু গা হাত পায়ে বড়ো ব্যথা,

মাথাতেও। এবং খুব দুর্বলও।

আপনার রান্না-বান্না কে করছে? আমি কি আমার বাড়ি থেকে খাবার পাঠিয়ে দেব। যতীন কম্পাউন্ডার সাইকেলে করে পৌঁছে দিয়ে আসবে টিফিন ক্যারিয়ার।

আরে না না। আমি নিজে অত বুড়ো হইনি। নিজেরটা নিজেই এখনও করতে পারি।

সঙ্গে ও কে?

ও আমার ভাগ্নে। ক্লাস নাইনে উঠবে এবারে। গাছগাছালি পাখপাখালি চিনিয়ে ওকে নরানাং মাতুলক্রম করার চেষ্টা করছি। তবে ক-দিনই বা থাকবে এখানে? কেবল টিভি নেই, সিনেমা হল নেই, এখানে কি শহুরে মানুষদের মন বসবে?

আপনার কাছে থাকলে অবশ্যই বসবে, আমরা এত মানুষ আপনার চেলা হয়েছি আর ও কি হবে? নাম কী তোমার খোকা?  

খোকা বোলো না। আজকালকার ছেলেরা খোকা সম্বোধন একেবারেই পছন্দ করে না। ওর নাম তাপস। ডাক নাম তপু। ওরা সব জন্ম-বুড়ো। বুড়ো বরং বলতে পার, খোকা একদম নয়।

কালুর জন্যে কটা প্যারাসিটামল দিয়ে দিচ্ছি। ছ-ঘন্টা অন্তর খাওয়াবেন। দেখবেন কাল-পরশু নাগাদ আবার আপনার খিতমদগারিতে লেগে গেছে।

খাওয়া-দাওয়া?

প্রথম দিনই তো বলে দিয়েছি। খাওয়া-দাওয়া নরমাল। সবই খেতে পারে। তবে দেখবেন। পেটটা যেন আপসেট না করে।

ও ছোঁড়া টিয়াপাখির মতো কাঁচালঙ্কা খায়। দেখি, বলব। আমার খিতমদারির চেয়েও বড়ো কথা গাছগুলোর পরিচর্য্যা। বুড়ো হয়েছি তো, কুঁয়ো থেকে এত বালতি জল তুলতে পারি না আর।

আমি বললাম, আমি তুলে দেব বড়োমামা।

তুই মামার কাছে বেড়াতে এসে এত খাটাখাটনি করবি?

এ তো আনন্দের খাটাখাটনি। এতে কষ্ট হবে না।

বাঃ! তপু বেশ বলেছ।

ডাক্তারবাবু বললেন।

৩.

রাতে আমাদের দুজনের জন্যে তো বটেই কালুর জন্যেও মুগের ডালের খিচুড়ি, আলু ভাজা আর ডিমভাজা করলেন বড়োমামা। কোনো সাহায্য তো করতে পারলাম না, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। হাসনপুর থেকে রান্না করাটা অন্তত শিখে গিয়ে মাকে চমকে দেব একেবারে। মাকে প্রয়োজনে সাহায্যও করতে পারব। রান্না যে চিরদিন শুধুমাত্র মেয়েদেরই করতে হবে এই বাজে নিয়মটা ভাঙা দরকার।

আমি বড়োমামা আর কালু একই সঙ্গে টেবিলে বসে খিচুড়ি খেলাম।

ডিমটা হাঁসের ডিম। বুঝলি তপু।

বড়োমামা বললেন।

আমার পুকুরেই চরে হাঁসগুলো, থাকেও আমারই বাগানে, ওদের ঘরে। চোদ্দো পনেরোটা হাঁস আছে। আরও ছিল। শেয়ালে নিয়ে গেছে কটা। আহা! ওরা কী করবে। ওদেরও তো খেতে হবে। শেয়ালরাও তো কেষ্টর জীব।

তারপর বড়োমামা বললেন, তোর জ্যাঠতুতো দাদা, কী যেন নাম? ন্যাপানা ক্ষ্যাপা, যে পড়াশোনাতে খুব ভালো ছিল, সে কী করছে রে এখন?  

সে তো আমেরিকাতে চলে গেছে। চার বছর। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। অ্যামেরিকান মেয়ে বিয়ে করেছে। বিরাট বাড়ি, দুটো গাড়ি দুজনের।

আরে ওখানে গাড়ি হচ্ছে পা। গাড়ি নইলে অচল। প্রত্যেকের একটা করে গাড়ি থাকতেই হবে। প্রয়োজন সেটা সেখানে, বিলাস নয়। তুই তা বলে যাস না আমেরিকাতে। সবাই টাকার লোভে আমেরিকাতে গেলে নিজের দেশের কী হবে! কত কী করার আছে তোদের প্রত্যেকের, দেশের জন্যে।

তারপর বড়োমামা বললেন, ওই যে মণীশডাক্তারকে দেখলি, সে এম আর সি পি। দ্যাখ, শহরে। থাকলে বড়ো বড়ো গাড়ি করতে পারত সহজেই। খুব সুখে থাকতে পারত। না করে, গ্রামে থেকে গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করছে। খুব ভালো ডাক্তার মণীশ।

তারপর বললেন, কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল গড়িয়ে কালুকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দে তো তপু।

কালু হাঁ হাঁ করে উঠল।

চুপ কর। তুই এখনও অসুস্থ। ভালো হয়ে উঠে তপুকে কচি পাঁঠার ঝোল আর পোলাও রান্না করে খাওয়াস। এখন ও তোর একটু সেবা করুক।

একটু চুপ করে থেকে বড়োমামা বললেন, জানিস তপু, এত ছেলে-মেয়ে পশ্চিমে যায় কিন্তু আসল শিক্ষাটা নিয়ে আসে না।

কী শিক্ষা বড়োমামা?  

মানুষকে মানুষজ্ঞান করার শিক্ষা। আর স্বাবলম্বনের শিক্ষা। এসবই হচ্ছে আসল শিক্ষা। দু-পাতা বই পড়াটা কোনো শিক্ষার মধ্যেই পড়ে না। অধিকাংশই চটকদারি শিখে আসে, চালিয়াতি শিখে আসে, মানুষের মতো মানুষ হয়ে আসে না। প্যান্ট পরে আসে, যার ডান পা-টা লাল আর বাঁ-পা টানীল। আহা শিক্ষার কী বাহার!

তারপর বড়োমামা বললেন, চল পাশের ঘরে তোর বিছানাটা করে দিয়ে আসি। কালুও ওই ঘরেই শোয়। ওর বিছানা তো করাই আছে। কাল খুব ভোরে তোকে চা করে তুলে দেব। তুই তো ক্যালকেশিয়ান, বেড-টি ছাড়া তোর তো ঘুম ভাঙবে না। তারপর আমরা নদীর দিকে যাব। আশা করি, কালু কালকে ভালো হয়ে যাবে। কী রে কালু?  

আমি তো আজই ভালো হয়ে গেছি। আমিই চা করে দেব কাল সকালে।

না। ভালো হওনি। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তবেই কাজ করবে। আমি যা বলছি তাই হবে। কাল তপুই জল তুলে দেবে কুঁয়ো থেকে, গাছেদের জল দেবার জন্যে। কী বলিস তপু?  

নিশ্চয়ই।

আমি বললাম।

লণ্ঠনের ফিতেটা কমিয়ে দিল কালু। বলল, এখানে মশা নেই। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো দাদাবাবু। কাল থেকে আমিই রান্না করব। বাবু আমাদের মানুষ নন, ভগবান।

আধো-অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান ওসব জায়গাতে না হয় পরেই যাওয়া যাবে বড়ো হয়ে। এখন মায়ের কথা শুনে হাসনপুরে এসেই ভালো করেছি। দারুণ লাগছে আমার। ভগবানের ভাগ্নে তো আর অন্য কোথাওই গেলে হওয়া হত না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *