ভগবানের খেয়াল
একটা লোকের সঙ্গে আর একটা লোকের দেখা হলো পথের ধারে বটতলায়। গ্রামের নাম আমতলী। এই জায়গার নাম ছায়া বটতলী। আমতলীর ভিতরে বটতলী। আমগাছ যত বড় হোক, বটের মতো তো হয় না। বট ঝুরি নামিয়ে নামিয়ে, অনেকটা জায়গা জুড়ে আমতলীর নান্টুবাবুর পিসির মতো থুপিয়ে বসে। হুঁ, সেই বুড়ি যে বসে থাকে তো বসেই থাকে। ঐটাই তার রোগ। কত কবরেজ দেখেছে তাকে, বলে গেছে ভগবানের মার। তিনিই যদি ইচ্ছে করেন, তাঁর যদি খেয়াল হয়, তবে সারতে পারে অসুখ।
একটা কথা বলে নিই, এই আমতলীর ভিতরে বটতলী পৃথিবীর নবম আশ্চর্যের দশম বলা যায়। সেই বটতলীতে একটা লোকের সঙ্গে আর একটা লোকের দেখা হলো। একটা লোক বেঁটে আর অন্য লোক? না, যা ভেবেছি তা নয়, আর একটা লোকও বেঁটে। তাদের একজন কালো, অন্য জন? হুঁ, সে ফর্শা হলেই আলাদা হতো, কিন্তু না, সেও কালো। বারমুডা প্যান্ট আর লাল গেঞ্জি দুজনেরই। দুজনের চোখেই নীল লাল চশমা। দুজনের পায়েই কালো বুটজুতো। বটতলীতে বটের ছায়ায় বসে একটা লোক আর একটা লোককে দেখছে। এই তোর নাম কীরে?
কেন লালচাঁদ।
আরিব্বাস আমার নামও যে লালচাঁদ।
ইস, বললেই হলো, আমার নাম আমার ঠাকমা দিয়েছিল।
তো, আমার কি দেয়নি?
একটা লোক দেখল তার মতো আর একটা লোক সামনে এসে বসেছে।একেবারে তার মতো।এ কখনো হয়,না হতে পারে? কিন্তু হয়েছে যে। এই তুই কী করিস?
বিজিনেস। অন্যজন উত্তর দিল।
আরিব্বাস, আমিও তো বিজিনেস করি।
কী বিজিনেস?
বলতে পারি, তুমি কাউরে বলবা না বলো।
বলব না। এক লালচাঁদ বলল।
মা কালীর কিরে?
হুম, মা কালীর কিরে।
সে হেসে বলল, আমি এখন আর কিছুই করিনে।
অন্য লালচাঁদ অবাক, আরে আমিও তো কিছুই করিনে।
কী অবাক করা কাণ্ড বলো। দুজনের সব মিলে যাচ্ছে। একেবারে অঙ্কের উত্তর মেলার মতো। দশে দশ। একশোয় একশো। কিন্তু এখন কিছু করে না মানে আগে কিছু করত কি? এই আগে কী করতে? এক লালচাঁদ জিজ্ঞেস করে অন্য লালচাঁদকে। অন্য লালচাঁদ বলে, ইছেমতী গাঙের ঢেউ গুনতাম।
যাহ বাবা, আমিও তো তাই করতাম, কত পেতে ঢেউ পিছু?
অন্য লালচাঁদ বলল, পেলামই না।
আমিও তো পাইনি।
ঢেউ পিছু এক পয়সা দেবে বলেছিল, কিন্তু…। কথা শেষ করে না লালচাঁদ।
তাই। দুই লালচাঁদই মনে করে একই কথা। তখন তার বাবা মরে গেছে। মা তো আগেই গেছে। একা দুঃখী লালচাঁদ বেরিয়ে পড়েছিল যদি কাজকম্মো কিছু পাওয়া যায়। বাবা মরে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিল, কাজকম্মো করে খা বাপ, তাই করতে হয়। গাঙ ধারে বসেছিল সে। তখন একটা লোক এল। লম্বা মতো। বলল, তুমি লালচাঁদ।
ইয়েস স্যার। লালচাঁদ উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দিল। ইস্কুলের অভ্যাস তো।
সিট ডাউন, এই লালচাঁদ, কাজ করবে? লোকটা জিজ্ঞেস করল।
ইয়েস স্যার, কাজ করতেই তো বেরিয়েছি। লালচাঁদ বলল।
তাহলে গাঙের ঢেউ গুণতে হবে, পারবে?
আঁজ্ঞে!লালচাঁদ অবাক।এইরকম কাজ হয়? হয়তো হয়। না হলে বলছে কেন?
ঢেউ পিছু এক পয়সা, লেগে পড়, এই খাতায় লিখে রাখ।
বাহ!বেশ তো।গাঙে ঢেউয়ের শেষ নেই।সে খাতায় চিকে দিতে লাগল। আচ্ছা ঢেউ গুণে কী হবে? লোকটা বলল, ভগবান বলেছে গুণতে।
ভগবান, সত্যি? লালচাঁদ কপালে বুকে হাত ঠেকালো।
ইয়েস সত্যি।
ভগবানের কিরে?
ইয়েস ভগবানের কিরে…।
লালচাঁদ জিজ্ঞেস করল, ভগবান ঢেউ গুণতে বলল কেন?
লোকটা বলল, ভগবানের খেয়াল।
তখন বিকেল হয়ে আসছে। লোকটা বসেছে কয়েক হাত দূরে। মাথায় অনেক চুল। তার মতো। বাতাসে ঢেউয়ের মতো দুলছে সে। গরমের দিনে বিকেল বেলা গাঙের ধার খুব ভালো। কত হাওয়া। হাওয়ায় জল ছলছল করছে। ঢেউ উঠছে আবার ঢেউ নামছে। ওই ওপারের মানুষ আবছা দেখা যাচ্ছে। ওপারটা নাকি অন্য দেশ। গাঙ পার হয়ে গেলেই ওদেশের পুলিশ ধরবে।আবার ওপার থেকে এপারে এলে এপারের পুলিশ ধরে।অথচ ওপারের লোক আর এপারের লোকে কোনো তফাৎ নেই। ওরা তাদের ভাষাতেই কথা বলে। তাদের মতোই পান্তাভাত লেবুপাতা দিয়ে ডলে শুকনো লঙ্কা মেখে খায়। গাঙে মাছ ধরে আবার ঢেউও গণে। সে লোকটাকে বলেছিল, ঢেউ তো অনেক।
হু,অনেক বলেই তো গুণতে হচ্ছে, একটা দুটো হলে কি একাজ করতে হতো? বলে লোকটা গাঙের দিকে তাকিয়ে বলল, এক পয়সায় একটা ঢেউ। ভোর থেকে সন্ধে অবধি। রাত্তিরে ছুটি। কি পারবে তো?
লালচাঁদ জিজ্ঞেস করল, ঢেউ গুণে কী হবে ভগবানের?
বললাম না খেয়াল।
এ কী রকম খেয়াল? লালচাঁদ জিজ্ঞেস করে।
সে তিনিই জানেন, তবে বিজিনেসও হবে।
লালচাঁদ বলল, ঢেউ দিয়ে বিজিনেস, না বিজিনেসের খেয়াল?
লোকটা বলল, তিনি খেয়ালি তো বটেই, খেয়ালি না হলে অদ্ভুত সব কাণ্ড ঘটান।
তাইই। নাহলে গাঙের এপার এক দেশ, ওপার আর এক দেশ। দিন চলতে চলতে রাত এসে যায়। রাত চলতে চলতে ভোর হয়ে যায়। বাতাস দেখা যায় না, কিন্তু বোঝা যায়। ভগবানের খেয়ালে ঝড় হয়। বন্যা হয়। রেলগাড়ি উলটে পড়ে। মাটি কাঁপিয়ে ভূমিকম্প হয়। আবার বসন্ত কালে ফুল ফোটে, শীত কালে পাতা ঝরে। তাঁর যা খেয়াল হবে তাই করবেন। এখন মনে হয়েছে ঢেউ গুণে দেখতে হবে, তাই হবে, আবার ঢেউ দিয়ে বিজিনেস হবে, তো তাই হবে।
লালচাঁদ বলে, হুঁ, বুঝলাম, আমার পয়সা ঠিক মতো পাই যেন।
পাবে পাবে। বলতে বলতে লোকটা গাঙপাড়ে বাঁধা একটা ডিঙি নৌকোয় উঠে ভেসে গেল। লালচাঁদ পরদিন ভোর থেকে কাজে লেগে পড়ল। ঢেউয়ের পর ঢেউ। সে গুণে খাতায় লিখে রাখছে। তবে সে তো খুব চতুর, শেষের দিকে খাতায় আগডুম বাগডুম লিখে রাখতে লাগল। ধুর ভগবানের কি সাধ্য আছে কত ঢেউয়ে কত গাঙ হয়। সেদিন বেলা পড়লে আগের দিনের লোকটা এল, বলল, ভগবান পাঠালো, কত ঢেউ হলো?
অনেক।
অনেক মানে কত?
লালচাঁদ বলল, কয়েক হাজার।
ক’হাজার?
লালচাঁদ বলল, অনেক হাজার।
কত বল না।
পয়সা এনেছ?
পয়সা হবে, আগে হিশেব নিই লোকটা বলল।
লালচাঁদ জিজ্ঞেস করে, ঢেউ কখন বন্ধ হবে বলো দেখি।
লোকটা বলল, ভগবান বন্ধ করলে তো বন্ধ হবে।
লালচাঁদ অবাক হয়ে বলল, ভগবান ঢেউ দেন?
ইয়েস, তিনি গাঙের মুখে বসে ঢেউ দিচ্ছেন বলেই তো ঢেউ হচ্ছে।
লালচাঁদের মনে হলো তাহলে তো ভগবানের কাছে হিশেব আছে কত ঢেউ হচ্ছে গাঙে, তার ফাঁকিবাজি ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু ভগবান যদি ঢেউ দেন,তাহলে অহেতুক এই ঢেউ গুণতে বসা কেন? তাঁর কাছে তো সব হিশেব আছে। তার প্রশ্নে লোকটা বলল, অঙ্ক করেছ পাটিগণিত, বীজগণিত?
ইস্কুলে ছিল।
উত্তর দেখতে করার পর?
লালচাঁদ বলল, আগেই দেখে নিয়ে বসিয়ে দিতাম, অঙ্কে আমি নম্বর পেতাম কম।
কত পেতে?
লালচাঁদ বলল, সে আর কী বলব, সব রাইট উত্তর, কিন্তু দশে এক, একশোয়ও এক, সঠিক উত্তর ঠিক লেখার জন্য।
লোকটা বলল, ভগবান হলো উত্তরমালা, ইস্কুলে যে ফাঁকি মেরেছ তার দাম দিতে হবে এখন, উত্তর দেখে বসাতে পারবে না, তোমাকে তোমার হিশেব দিতে হবে, বল কত গুণেছ, কড় গুণে বলো, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ করে বলো।
লালচাঁদ বলল, ভগবান যত ঢেউ দিয়েছে, আমি ততো গুণেছি।
কিন্তু তা কত?
চতুর লালচাঁদ বলেছে, সাত হাজার সাতশো সাতাত্তর।
লোকটা বলল, হয়নি।
কেন হয়নি?
ভগবানের হিশেবের সঙ্গে মেলেনি, উত্তরমালা না দেখলে তুমি ডাহা ফেল।
লালচাঁদ বলেছিল,মোটেই না, উত্তর মিলেছে, তুমি জান না।
লোকটা হে হে করে হেসেছিল, আমি জানব না তো তুমি জানবে।
ভগবান উত্তর বলে দিয়েছে? জিজ্ঞেস করেছিল লালচাঁদ।
আমি উত্তর মেলাতেই এসেছি। লোকটা বলেছিল।
তুমি কে গো,দাও না উত্তরটা,দেখে লিখে দিই, পয়সা ভাগ করে নেব।
লালচাঁদ,আমিই ভগবান।বলতে বলতে লোকটা নদীর অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছিল। লালচাঁদ হতভম্ব। যাহ, বাবা! এই হলো ভগবান। ভগবানের মতো দেখতে নয় অথচ বলল ভগবান। মোটেই না। তার পয়সা মেরে দিয়ে উত্তর নিয়ে চলে গেল। অবশ্য উত্তরটা মিথ্যে। নিজের মতো বানিয়ে বলেছে লালচাঁদ। সে ঢেউ গোণা বন্ধ করে মুড়ি খেতে খেতে আমতলীর এই বটতলীতে এসে তার মতো আর একজনকে ভগবানের জন্য ঢেউ গোণার কথা বলল। শুনতে শুনতে অন্য লালচাঁদ বলল, একেবারে আমার গল্প।
তোমারও এই হয়েছে? লালচাঁদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ইয়েস,কিন্তু যে লোকটা ঢেউ গোণাতে এসেছিল, সে একেবারে তোমার মতো। তাই তো ভাবছি এত চেনা চেনা লাগছে কেন?
ইস, আমি কি না ফালতু ঢেউ গুণে এক পয়সাও পেলাম না, আর বলছ আমি তার মতো, বরং তুমিই অবিকল সেই লোক।
মোটেই না, আমি লালচাঁদ।
না,তুমি সেই সেই ভগবানের লোক, খাটিয়ে নিয়ে একপয়সাও দাওনি।
আমি কেন হবো, আমি তো ঢেউ গুণে গুণে হদ্দ হয়ে গেছি। বলে সেই লালচাঁদ এই লালচাঁদের দিকে এগিয়ে এল, বলল, ঠিক সেই লোক, এবার কী, গুণতে না মাপতে বলবে, ছায়া মাপব না গাছের পাতা গুণব?
আমিও বলি, কী করব বল, ঘাস গুণব না মেঘ মাপব আকাশে?
অন্য লালচাঁদ বলে, আমার হিশেবের পয়সা দাও, খাটনির পয়সা, ভগবানের নাম করে খাটিয়ে নিলে আমাকে।
লেগে গেল দুই লালচাঁদে। লড়াই। এ ওকে তুলে আছাড় দেয় তো ও একে তুলে ছুড়ে ফেলে। উফ, সে কী ভীষণ লড়াই। ধুলো উড়তে লাগল। গাছের পাতা কাঁপতে লাগল, ঝড় হতে লাগল। পাখিরা সব কিচিরমিচির করতে করতে ডানা ঝাপটে পালিয়ে গেল। গরু মোষ লেজ তুলে মাঠের দিকে দৌড়ে গেল ভয়ে। লড়াই চলল সারাদিন। বেলা পড়তে লড়াই করতে করতে দুই লালচাঁদ অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকল বটের ছায়ার বাইরে। তারপর দেখা গেল একটি উঠে বসেছে। উঠে অন্যটির দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, শুয়ে থাক লালচাঁদ, আমি যাই, আমিই ভগবান, তোমারে আগে বলিনি।
যে লালচাঁদ শুয়ে ছিল সেও তৎক্ষণাৎ উঠে বসে, ইস, তুই ভগবান না মুই ভগবান।
দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দুজনেই হি হি করে হেসে কুটিপাটি। একজন অন্যজনের দিকে আঙুল তুলল, বলল, তুই ভগবান মুই জানি।
অন্যজন হেসে বলল, না তুই ভগবান মুই জানি।
মুই না তুই…মুই না তুই…কথা চলতে লাগল। দুজনেই লালচাঁদ হলে হবে কী, দুজনের মতে মিল হয় না একটুও যে তা বুঝতে পারল দুই জনাতেই। বুঝতে পেরে হাত বাড়াল, বুক বাড়াল, এই লালচাঁদ আয় দেখি।
তারপর? দুজনে হিংসা ভুলে গলা জড়াজড়ি করে লালচাঁদ ভগবান হয়ে বটের তলার অন্ধকার ছেড়ে মাঠের ভিতরে নামল। তারা দুজনেই নাকি ভগবান, জেনেছে এই মাত্র, ঝগড়া করতে করতে। মুই না তুই করতে করতে। হ্যাঁ, দুজনের ভিতরেই ভগবান আছেন। সন্ধে নামল, আকাশ তারায় তারায় ভরে উঠল।তারা দুজনে সেই অবারিত প্রান্তরে হাওয়ায় ডুবে অন্ধকারে তারার আলোয় বসে তারা গুণতে লাগল। এমনি। ভগবানের খেয়াল। তারা তারা গুণতে গুণতে বাতাসে যেন বৈঠা মারতে লাগল হাত দিয়ে। আর তখন গাঙে ঢেউ ভাঙতে লাগল, তারার আলো ঢেউয়ের উপর নাচানাচি করতে লাগল। আর নান্টুবাবুর পিসি, যে কিনা বটের মতো থুপিয়ে বসে থাকে সারাদিন, এমন রোগের কোনো দাওয়াই নেই বলে, সে উঠে দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে যাত্রা করল। একা একা। কেন তা সেই বুড়িও জানে না। কিন্তু তার কোমর ছেড়েছে সত্যি। ভগবানের খেয়াল।