ভগবদগীতা-সমালোচনা – ৩য় পরিচ্ছেদ
কখন বা কর্ম্মযোগের, কখন বা কর্ম্ম সন্ন্যাসের(১) প্রশংসা শুনিয়া অর্জ্জুন কিংকর্ত্তব্য বিমূঢ় হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে গোবিন্দ, কর্ম্মত্যাগ এবং কর্ম্মযোগের মধ্যে যাহা শ্রেয়স্কর, তাহাই আমাকে অবধারিত করিয়া বল। কৃষ্ণ বলেন,–কর্ম্মত্যাগ এবং কর্ম্মযোগ উভয়ই মুক্তির কারণ, কিন্তু তন্মধ্যে কর্ম্মযোগই শ্রেষ্ঠ। তয়োস্তু কর্ম্মসন্ন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে। দীর্ঘজটা-শ্মশ্রুধারী, গঞ্জিকা সেবী, অলস কর্ম্মশূন্য সন্ন্যাসীগণের উপর গীতাকার বড়ই বিরক্ত। স্থানান্তরে তিনি বলিয়াছেন,–
অনাশ্রিত্য কর্ম্মফলং কার্য্যং কর্ম্ম করোতি সঃ।
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নি র্ন চাক্রিয়ঃ।।
“যিনি ফলে আকাঙ্খা না করিয়া কর্ত্তব্য কর্ম্ম করেন, তিনিই সন্ন্যাসী এবং তিনিই যোগী; কিন্তু যিনি, অগ্নি সাধ্য ইষ্ট (যজ্ঞাদি) ও পুর্ত্ত (পুষ্করিণী খননাদি) প্রভৃতি কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়াছেন, তিনি সন্ন্যাসীও নন, যোগীও নন।”
গৈরিক বসনধারী, পরভোগ্যোপজীবী জ্ঞানানন্দ স্বামী, প্রেমানন্দ স্বামী, বগলানন্দ স্বামী প্রভৃতি ঊণবিংশতি শতাব্দীর ধূমপায়ী পরম হংসগণ, এবং তাহাদের ভক্ত এবং প্রতিপালক হিন্দু মহোদয়গণকে আমরা গীতার এই শ্লোকটী স্মরণ রাখিতে অনুরোধ করি।
“জ্ঞানের ন্যায় পবিত্র বস্ত ইহ জগতে আর নাই।” “জ্ঞানাগ্নি সমস্ত কর্ম্মকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলে।” সেই জ্ঞান লাভের উপায় কি? কৃষ্ণ বলিলেন,–কর্ম্ম দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হয় এবং চিত্ত শুদ্ধ হইলে, জ্ঞান আপনা হইতে আসিয়া পড়ে। যুদ্ধ একটা কর্ম্ম, আর অর্জ্জুনও ক্ষত্রিয়, সুতরাং উক্ত বিহিত কর্ম্মের অনুষ্ঠান দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ করিলেই, তিনি জ্ঞানবান্ এবং কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারিবেন। পিতা, পিতামহ, শ্বশুর, শ্যালক, গুরু প্রভৃতিকে হনন কর্ম্ম দ্বারা সহজেই যে চিত্ত শুদ্ধ হয়, এবং তদ্দ্বারা সাংখ্য অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠগণের প্রাপ্য মোক্ষ নামক স্থানও লাভ করা যায়, বীরশ্রেষ্ঠ সব্যসাচী তাহা জানিতেন না। সুতরাং সাক্ষাৎ ভগবানের আশ্বাস বাক্যেও তাহার সংশয় ছিন্ন না হওয়ায় কৃষ্ণ পুনরায় বলিলেন,–“কর্ম্মের বন্ধন শক্তি আছে সত্য,” কিন্তু “বিশুদ্ধ চিত্ত আত্মদর্শী জ্ঞানী ব্যক্তি, সংসার যাত্রা নির্ব্বাহার্থ কর্ম্মানুষ্ঠান করিলেও তাহাতে লিপ্ত হয় না। তত্ত্ববিদ্ ব্যক্তি, দর্শন, শ্রবণ, স্পর্শন, ঘ্রাণ, ভোজন, শয়ন, মল মূত্রাদি ত্যাগ করিয়াও ‘আমি কিছুই করি নাই’ মনে করেন। তিনি ভাবেন, ইন্দ্রিয়গণ স্ব স্ব বিষয়ে প্রবৃত্ত হইতেছে। কর্ম্ম সকল ব্রহ্মে সমর্পণ করিয়া ফলাভিলাষ পরিত্যাগ পূর্ব্বক যিনি কর্ম্ম করেন, তিনি বন্ধন হেতুভূত পাপ পুণ্যাত্মক কোন কর্ম্মেই লিপ্ত হয় না।” (৫ম–৭-১০)। অষ্টাদশ অধ্যায়ে এই তত্ত্বটী বিশদরূপে বিবৃত আছে। “শরীর, বাক্য বা মন দ্বারা আমরা যে সকল কর্ম্ম করি, আমাদের আত্মা অর্থাৎ আমরা তাহার কর্ত্তা নহি।” “অধিষ্ঠান (অর্থাৎ শরীর) অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়গণ, প্রাণাপানাদি বায়ুর ব্যাপার, এবং দৈব অর্থাৎ চক্ষুরাদির অনুগ্রাহক আদিত্যাদি দেবতা; এই পাঁচটীই আমাদের সকল কর্ম্মের কর্ত্তা। দুর্ম্মতিগণই নিরুপাধি আত্মার কর্ত্তৃত্ব নিরীক্ষণ করেন। যিনি আপনারে কর্ত্তা বলিয়া মনে না করেন, যাঁহার বুদ্ধি কার্য্যে আসক্ত হয় না, তিনি লোক সমুদায় বিনষ্ট করিলেও বিনাশ করেন না, এবং তাঁহারে বিনাশজনিত ফল ভোগও করিতে হয় না।” (১৮অ–১৩-১৭) (২)
আমাদের বুদ্ধি আজিও অসংস্কৃতাবস্থায় আছে; তদ্ধেতু ‘আমাদের কর্ম্মের জন্য আমরা বা আমাদের আত্মা ঈশ্বরের নিকট দায়ী’, এই ঘোর অহঙ্কার ভাব আমাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল রহিয়াছে। কিন্তু হে ‘তত্ত্বজ্ঞানী’ মহাপুরুষ, তুমিই ধন্য। কেননা, তুমি আহার, বিহার, শয়ন ও ভ্রমণ করিয়াও অম্লানবদনে বলিতে পার, ‘আমি করি নাই’। যাহা তুমি কর, তাহার কর্ত্তৃত্ব তুমি স্বীকার কর না, সুতরাং তোমার কর্ম্মের বন্ধন শক্তি নাই; তোমার পুনর্জন্ম কোথায়? তুমি জ্ঞানী, সুতরাং পাপপুণ্যের পার্থক্য তুমি দর্শন কর না। ব্রহ্মে কর্ম্মফল সমর্পণ করিয়া। পাপ পুণ্যাত্মক যে কোন কর্ম্মই কর না কেন। পদ্মপত্রে জলের ন্যায়, পাপ তোমাতে লিপ্ত হয় না। তুমি স্বহস্তে জগতের সমস্ত লোক বিনাশ করিয়া বিনাশ জনিত ফল ভোগ কর না। তোমার ন্যায় ভাগ্যবান কে? কিন্তু ভাই তত্ত্বজ্ঞানী, সময় বড় খারাপ পড়িয়াছে; এখন তোমার কিঞ্চিত সাবধানে চলা উচিত। খ্রীষ্টীয়ানদের আদালতে তোমার তত্ত্ব-জ্ঞানের সমুচিত সম্মান রক্ষা হইবার সম্ভাবনা নাই। সমস্ত লোকের কথা দূরে থাকুক, একটী বালকের প্রাণ নাশ করিলেই ফাঁসি কাষ্ঠে চড়াইয়া দেবে। তখন শ্রীধর স্বামীর টীকা পড়াইয়াই শুনাও, আর শ্রীপ্রসন্ন কুমার বিদ্যারত্ন স্বয়ং যাইয়াই বলুন–“আত্মার কখন বিনাশ নাই, আত্মাকে কেহ কখন বিনাশ করিতে পারে না, অজ্ঞানী ব্যক্তি মনে করেন হনন করিয়াছেন, জ্ঞানী ব্যক্তি দেখেন যে, কেহ হত হয় নাই,” বিবেক জ্ঞানবিহীন ম্লেচ্ছ বিচারপতি কি তাঁহাদের কথায় কর্ণপাত করিবেন? (৩)
শ্রুতিতে লিখিত আছে,–ঈশ্বর যাহাকে ইহলোকে উন্নীত করিতে ইচ্ছা করেন, তাহাকে সৎকর্ম্ম করান, এবং যাহাকে ইহলোক হইতে অধোনীত করিতে ইচ্ছা করেন, তাহাকে অসৎকর্ম্ম করান,” ইহা শুনিয়া কেহ হয় ত ভাবিতে পারেন, পুরুষ, পরমেশ্বর কর্ত্তৃক শুভাশুভ ফলপ্রদ কর্ম্মে প্রযুজ্যমান হন, সুতরাং তাহার স্বাধীনতা নাই। এই আশঙ্কা নিরাকরণার্থ কৃষ্ণ বলিলেন, “ঈশ্বর জীব লোকের কর্ত্তত্ব সৃষ্টি করেন নাই, কর্ম্ম সমূহও সৃষ্টি করেন নাই। স্বভাব অর্থাৎ মায়াই কর্ত্তৃত্বাদি রূপে প্রবৃত্ত হয়।” (৫ অ–১৪)। কৃষ্ণের ভক্তবৃন্দ কিন্তু তাঁহার মস্তকে সমস্ত ভার অর্পণ করিয়া বলিয়া থাকেন,–
ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদি স্থিতেন।
যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি।।
যাদব শ্রেষ্ট পুনরায় বলিলেন,–ঈশ্বর কাহার পাপ বা পুন্য গ্রহণ করেন না। নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং নচৈবং সুকৃতং বিভুঃ। অথচ গীতায়, আমাদের পাপ পুণ্য সমুদায় কর্ম্ম, ঈশ্বরকে অর্পণ করিতে পুনঃ পুনঃ আদেশ আছে।
যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।
যত্তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব মদর্পণম॥ (৯ অ–২)
“হে কৌন্তেয়, যাহা ভক্ষণ কর, যাহা হোম, যে বস্তু দান ও যেরূপ তপঃ সাধন করিয়া থাক; তৎসমুদায় আমারে সমর্পণ করিও।”
এই অধ্যায়ে কতকগুলি সুন্দর উপদেশ পূর্ণ শ্লোক আছে–
তদ্বুদ্ধয় স্তনাত্মান স্তন্নিষ্ঠাস্তৎ পরায়ণাঃ।
গচ্ছন্ত্য পুনরাবৃত্তিং জ্ঞাননির্ধূতকল্মষাঃ।।(৫ অ–১৭)
ঈশ্বরেই যাঁহাদিগের সংশয়রহিত বুদ্ধি, ঈশ্বরেই যাঁহাদিগের পরম আশ্রয়, তাঁহারা জ্ঞান দ্বারা নিষ্পাপ হইয়া মোক্ষ লাভ করেন।
শক্নোতীহৈব যঃ সোঢুং প্রাক্ শরীর বিমোক্ষণাৎ।
কাম ক্রোধোদ্ভবং বেগং স যুক্তঃ স সুখী নরঃ।।(৫ অ–২৩)
যিনি ইহ লোকে শরীর পরিত্যাগের পূর্ব্বে কাম এবং ক্রোধের বেগ সহ্য করিতে পারেন, তিনিই যোগী ও তিনিই সুখী।
লভন্তেঃ ব্রহ্ম নির্বাণমৃষয়ঃ ক্ষীণ কল্মষাঃ।
ছিন্ন দ্বৈধা যতাত্মানঃ সর্বভূতহিতে রতাঃ।।(৫ অ–২৫)
যাঁহারা পাপকে বিশাশ করিয়াছেন, সংশয়কে ছেদন করিয়াছেন, চিত্তকে বশীভূত করিয়াছেন, এবং সকলের হিতানুষ্ঠানে ব্যাপৃত আছেন, সেই তত্ত্বদর্শীগণই মোক্ষ লাভ করিবেন।
বিদ্যা বিনয় সম্পন্নে ব্রহ্মণে গবিহস্তিনি।
শুন চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিন।।(৫ অ–১৮)
পণ্ডিতগণ, বিদ্যা বিনয় সম্পন্ন ব্রাহ্মণ, গো, হস্তি, কুক্কুর ও চণ্ডালকে তুল্যরূপ দেখেন।
সুহৃন্মিত্রার্যুদাসীনমধ্যস্থদ্বেষ্যবন্ধুষু।
সাধুষ্বপি চ পাপেষু সমবুদ্ধির্বিশিষ্যতে।।(৬ অ–৯)
সুহৃৎ, মিত্র, অরি, উদাসীন, মধ্যস্থ, দ্বেষ্য, বন্ধু, সাধু ও অসাধু এই সকলের প্রতিই যাঁহার সমান জ্ঞান, তিনিই সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের নাম, ধ্যান যোগ। কি প্রণালী অবলম্বন করিলে অনায়াসে যোগাভ্যাস করা যায়, এবং কিরূপেই বা প্রশান্তত্মা সংযতচিত্ত ব্রহ্মচারী অন্তঃকরণকে সমাহিত করিয়া মোক্ষরূপ পরম শান্তি লাভ করিতে পারেন, তাহার সদুপায় এই অধ্যায়ে বর্ণিত আছে। “যোগী ব্যক্তি একাকী নির্জ্জনে নিরন্তর অবস্থান এবং আশা ও পরিগ্রহ পরিত্যাগপূর্ব্বক, অন্তঃকরণ ও দেহ বশীভূত করিয়া চিত্তকে সমাধান করিবেন। পবিত্র স্থানে, ক্রমান্বয়ে কুশ, ব্যাঘ্রাদি চর্ম্ম ও বস্ত্র দ্বারা প্রস্তুত অনতি উচ্চ, অনতি নীচ স্থিরতর আসন সংস্থাপন করিয়া তাহাতে উপবেশন করতঃ যোগাভ্যাস করিবেন। শরীর, মস্তক, গ্রীবা সরল ভাবে ধারণ এবং দৃষ্টিকে অন্যান্য দিক হইতে আকর্ষণ পূর্ব্বক স্বীয় নাসিকার অগ্রভাগে সন্নিবেশিত করিয়া যোগাভ্যাস করিবেন।”
যোগে আমাদের আদৌ বিশ্বাস নাই। বিজ্ঞান শাস্ত্র ইহার সমর্থন করে না। যোগশাস্ত্রোক্ত ক্রিয়া দ্বারা, আত্মার উন্নতি এবং অমানুষিক শক্তি লাভ হইতে পারে, তাহার কোনই প্রমাণ নাই। যোগ সম্বন্ধে আমাদের দেশের মুখোজ্জ্বলকারী শ্রী রমেশ চন্দ্র দত্ত C.I.E বলেন :–
“As a system of Philosophy, Yoga is valueless. Patanjali tried to blend the idea of the supreme Deity with the Philosophy of Kapil; but unfortunately he also mixed it up with much of the superstition and mystic practices of the age. In later times, the Philosophy of the Yoga is lost sight of, and the system has degenerated into cruel and indecent tantric rites, or into the impostures and superstition of the so-called Yogins of the present age.” এবং যোগ শাস্ত্র সম্ভূত তন্ত্রশাস্ত্র এবং তদুক্ত ক্রিয়া সম্বন্ধে বলেন :–
“Ignorance is credulous and feebleness bankers after power, and when a superstitious ignorance and senile feebleness had reached the last stage of degeneracy, men sought by unwholesome practices and unholy-rites, to acquire that power, which Providence has rendered attainable only by a free, open and healthy exercise of our faculties, moral, intellectual, and physical. Tantric literature represents the diseased state of human mind.”
Monier Williams বলেন :–
Yoga is scarcely worthy of the name of a system of Philosophy. All those mortifications (i.e., those undergone by the gogins) are explicable by their fancied attainment of extraordinary sanctity and super-natural powers.
পণ্ডিতবর A. Barth, The religions of India নামক গ্রন্থে যোগ সম্বন্ধে বলেন :–
Conscientiously observed, they can only issue in folly and idiocy; and it is, in fact, under the image of a fool or an idiot, that the wise man is often delineated for us in the Purans.
Gough সাহেব বলেন :–
ভারতের আদিম নিবাসী অসভ্যগণের নিকট হইতে আর্য্যগণ যৌগিকক্রিয়া সকল শিক্ষা করেন :–“It was from the semi savage race, with which they were coalscing, which they were elebating, that they now adopted the practice of fixing the body and the limbs in status-like repose and inducing cataleptic rigidity and insensibility as a higher state than the normal state of human life–the practice known as Yoga–union, the ectacy, the melting away of the consciousness into a state of characterless indetermination. The process seem to be accompanied with intervals of morbid nervous and cerebral exaltations in which the self-torturer loses all distinction between percception and imagination and appears to himself and others to be invested with super-human powers. The practice of self-torture is alien to the cheerful spirit of Vedic Worshippers, aspiring to health and wealth and length of days.” (Philosophy of Upanishads.)
“Among lower races and high above their level morbid ecstasy brought on by medication, fasting, narcotics, excitement or disease, is a state common and held in honor among the very classes specially concerned with Mythic idealism.” (Taylor’s Primitive culture, Vol. I.)
গীতায় এবং পাতঞ্জলের যোগশাস্ত্রে যোগাভ্যাস করিবার যে সকল উপায় বর্ণিত আছে, তাহাতে জানা যায় যে, যোগ এবং এক্ষণকার Mesmerism, Hyprotism বা Spiritualism একই পদার্থ। যোগ কেবল ভারতবর্ষে নয়, অতি প্রাচীন কাল হইতে প্রায় সকল অসভ্য ও অর্দ্ধসভ্য জাতির মধ্যে প্রচলিত আছে। পারস্যের মেজাইগণ, এমন কি গ্রীক চর্চ্চ সম্প্রদায়ভুক্ত খ্রীষ্টীয়ান পুরোহিতগণও যোগাভ্যাস করিতেন। বর্ত্তমান শতাব্দীতে এই যোগই Mesmerism, Animal Magnetism, Will power ইত্যাদি নামে অভিহিত হইয়া ইউরোপে দেখা দেয়। তথায় বিজ্ঞানবিৎ পণ্ডিতগণ কর্ত্তৃক পরীক্ষিত হওয়ায়, যোগের ফল সম্বন্ধে আমাদের কোন সন্দেহ নাই।(৪) পুনঃ পুনঃ পরীক্ষা দ্বারা স্থির হইয়াছে যে, যদি কেহ একদৃষ্টে কোন পদার্থের প্রতি চাহিয়া থাকেন বা কোন বিষয় প্রগাঢ়রূপে ভাবিতে থাকেন, তবে তাঁহার মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের ব্যাঘাত জন্মে; এবং তদ্ধেতু তিনি কৃত্রিম নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়েন। ইহাই, Hypnotic sleep বা যোগের সমাধি অবস্থা। ক্লোরোফরম্ আঘ্রাণ বা গঞ্জিকা প্রভৃতি সেবন দ্বারাও উক্ত অজ্ঞান অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায়। পাতঞ্জল দর্শনশাস্ত্রের অনুবাদক, পণ্ডিতবর শ্রীকালীবর বেদান্তবাগীশ ইহা স্বীকার করিয়াছেন। তিনি অবররণিকায় লিখিয়াছেন যে,–“ডাক্তারেরা মিস্মরাইজ (Mesmerise) করিয়া, অর্থাৎ কৌশলে অথবা (Chloroform) ক্লোরোফরম্ আঘ্রাণ করাইয়া ব্যাধিগ্রস্ত ব্যক্তির অঙ্গাদিকর্ত্তন করিয়া থাকেন। পরন্তু তাঁহারাও জানেন না যে, আমরা রোগীকে যোগীর তুল্য করিয়া কার্য্য সমাধা করিতেছি।” Hypnotic sleep বা কৃত্রিম নিদ্রা এবং যোগ, একই পদার্থ। স্বাভাবিক নিদ্রার ন্যায় কৃত্রিম নিদ্রাতাবস্থায়ও স্বপ্ন দেখা যায়। উক্ত অবস্থায় যে সকল স্বপ্ন দেখা যায়, বা ইঙ্গিত দ্বারা মনোমধ্যে যে সকল ভাব উদিত করা যায়, তাহা সত্য ঘটনা বলিয়া দৃঢ় বিশ্বাস হয়। স্বপ্নে যেমন কোন নূতন বিষয় জানা যায় না, কেবল পূর্ব্ব স্মৃতির উদয় হয় মাত্র, সেই রূপ Hypnotic sleep বা যোগাবস্থায় কোন নূতন জ্ঞান লাভ করা যায় না। পূর্ব্বে যাহা জানা ছিল, কিম্বা ইঙ্গিত দ্বারা যে বিষয় জানান যায়, কেবল তাহাই বলিতে পারা যায়। বিশেষ পরীক্ষা দ্বারা স্থিত হইয়াছে যে, Clairvoyance বা অদৃশ্য পদার্থ দর্শন করা, Clairaudience অন্যের শ্রুতির অগোচর শব্দ শ্রবণ করা, Will power ইচ্ছা শক্তি, Animal Magnetism বা মানবের আকর্ষণীশক্তি, Spiritualism, প্রেতাত্মাকে আহ্বান ইত্যাদি বিশুদ্ধ জুয়াচুরি। কোন লোকের উক্ত ক্ষমতা সকল নাই। ১৮৩৭ সালে ফ্রান্স দেশে এবং ১৮৬০ সালে ইংলণ্ডে বিদ্বান মণ্ডলী ঘোষণা করেন যে, যদি কেহ চক্ষু বদ্ধ করিয়া পড়িতে পারেন, তবে তাঁহাকে ৫০০০ পাঁচ সহস্র মুদ্রা পারিতোষিক দেওয়া যাইবে। ইউরোপে তখন Hypnotismএর বিশেষ চর্চ্চা হইত, এবং Mediumগণ, অজ্ঞলোকদিগকে নানা প্রকার বুজ্রুকী দেখাইয়া প্রভূত অর্থ উপার্জ্জন করিত। পুরস্কারের লোভে অনেকগুলি বিখ্যাত Medium পরীক্ষার্থ উপস্থিত হইয়াছিল, কিন্তু কেহই উক্ত কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া পুরস্কার লাভে সক্ষম হয় নাই।
একটী বিষয় বিবেচনা করিলে যোগের অলৌকিক ক্ষমতা সম্বন্ধে সকল ভ্রান্তি দূর হইতে পারে। যোগ দ্বারা আমরা কোন্ তত্ত্ব জানিতে পারিয়াছি? বিজ্ঞানানুশীলন দ্বারা মানব সমাজের প্রভূত উপকার হইয়াছে। কিন্তু যোগ আমাদের কোন্ উপকারে আসিয়াছে? কলিকাতায় আজ কাল অনেক যোগী দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহারা গোপনে গোপনে ভ্রান্ত লোককে নানা বুজ্রুকী দেখাইয়া আপনাদের অলৌকিক ক্ষমতার পরিচয় দেন। ভাল, তাঁহারা এরূপ কার্য্য না করিয়া প্রাচীন ভারতের প্রকৃত ইতিহাস। কিম্বা যে সকল মহামূল্য সংস্কৃত গ্রন্থ লুপ্ত হইয়াছে; যোগবলে সেই সকল লুপ্তরত্নের উদ্ধার করিয়া ভারতের গৌরব বৃদ্ধি এবং জনসমাজের প্রভূত উপকার সাধন করিলে ত হয়। কত শত হিন্দু সন্তান দুশ্চিকিৎস্য রোগে আক্রান্ত হইয়া ম্লেচ্ছ-চিকিৎসক-প্রণীত জাতি ধর্ম্ম বিনাশক সুরা সংশ্লিষ্ট ঔষধাদি দ্বারা প্রাণ রক্ষা করিতেছেন। উক্ত রোগ সমূহের শাস্ত্রসম্মত অব্যর্থ ঔষধ বাহির করিলে ত কত উপকার হয়! অনেক যোগী বিদ্যালয় স্থাপন, ব্যবসায় অবলম্বন এবং শিষ্যবর্গের মস্তকে পদধূলি প্রদান করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করেন, অথচ ঐরূপ তাঁহারা প্রকৃত হিতকর কর্ম্মে প্রবৃত্ত হন না। সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, যোগীগণের জুয়াচুরি শিক্ষাবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পরিমাণে কমিয়া আসিতেছে। মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ ৩০ বৎসর পূর্ব্বে বলিয়া গিয়াছেন, “পূর্ব্বে এ সকল অদৃষ্টচর ব্যাপারের (যৌগিক ক্রিয়া) যে রকম প্রাদুর্ভাব ছিল, এখন তাহার আধ্ গুণও নাই। আমরা সহরে কদিন কটা অবধূত দেখিয়ে পাই। ক্রমে হিন্দু ধর্ম্মের সঙ্গে সঙ্গে এ সকল জুয়াচুরীরও লাঘব হোয়ে আস্চে; ক্রেতা ও লাভ ভিন্ন কোন ব্যবসায়ই স্থায়ী হয় না। উৎসাহ দাতার বিহনে এ সকল ধর্ম্মানুষঙ্গিক প্রবঞ্চনা উঠিয়া যাইবে।” (হূতোম পেঁচার নক্সা)। “কিন্তু কলিকাতা সহরের প্রসব ক্ষমতা এত অধিক” যে এস অকল জুয়াচোরের সংখ্যা শীঘ্র কমিবে বলিয়া বোধ হয় না। কেহ কেহ হয় তো বলিতে পারেন যে, যোগীগণের অসাধারণ ক্ষমতার পরিচায়ক দুই একটী সত্য ঘটনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। রনজীৎ সিংহের হরিদাস যোগী ৪০ দিন অনাহারে মৃত্তিকাভ্যন্তরে বাস করিয়াছিলেন। আহার বন্ধ করিবা মাত্র প্রাণীগণ মারা যায় না। অনাহারে কুকুর প্রভৃতি ইতর জন্তুগণকেও প্রায় ৩০ দিন পর্য্যন্ত জীবন ধারণ করিতে দেখা যায়। (Kirk’s Physiology)(৫) সংবাদ পত্রে প্রকাশ যে, একজন জৈন পুরোহিত অনেক দিন অনাহায়রে কাটাইতে পারেন। যোগের একজন প্রধান ভক্ত ডাক্তার নবীন চন্দ্র পাল বলেন যে, যোগীগণ বায়ুভুক্ (Hybernating) প্রাণীগণের অনুকরণ করিয়া বহুদিন অনাহারে থাকিতে সক্ষম হয়।
সর্প বা ভেক বৃত্তি অবলম্বন করাই বুঝি যোগের চরম উদ্দেশ্য!!
নিরীশ্বর সাংখ্যদর্শন দেশে নাস্তিকতার স্রোত বৃদ্ধি করিতেছে দেখিয়া, ঈশ্বরে ভক্তি ও বিশ্বাস স্থাপন করিবার জন্য মহর্ষি পাতঞ্জল যোগশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। কিন্তু আমরা তাহার উত্তমাংশটুকু পরিত্যাগ করিয়া অধম অংশ গ্রহণ করিয়াছি। Chamber’s Encyclopediaর “যোগ” প্রবন্ধলেখক বলেন,–But the great power it (Yoga Philosophy) has at all periods excercised on the Hindu Mind is less derived from its philosophycal sepculations or its moral injunctions, than from the wonderful effects which Yoga practices are supposed to produce.
যোগানুশীলন দ্বারা মস্তিষ্কের পীড়া জন্মে, ইহা আমরা যোগ শিক্ষার্থীগণকে স্মরণ রাখিতে অনুরোধ করি।
অতঃপর কৃষ্ণ বলিলেন,–অতিভোজনশীল বা একান্ত অনাহারী ব্যক্তির সমাধি হয় না (৬ অ–১৪)। কিন্তু যোগীশ্রেষ্ঠ বুদ্ধদেব অনাহারে বহুবৎসর তপস্যা করিয়া সমাধিলাভ করেন। মধুসূদন ভোজনের কিঞ্চিত পক্ষপাতী ছিলেন। “যাহারা উপবাসাদি দ্বারা শরীরস্থ ভূতগণকে এবং আত্মাকে ক্লেশিত করিয়া তপস্য করেন।” তাঁহাদিগকে তিনি “ক্রূর স্বভাবাপন্ন লোক বলিয়া নিন্দা করেন।” (১৭ অ–৬)। সমাধিস্থ হইবার উপায় সকল শ্রবণ করিয়া অর্জ্জুন বুঝিতে পারিলেন, যোগটা বড় সহজ ব্যাপার নয়।
তজ্জন্য তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন,–“যে ব্যক্তি প্রথমে যোগে প্রবৃত্ত হইয়া পরে যত্নহীন হইয়া যোগভ্রষ্টচেতা হয়, সে যোগ সিদ্ধি প্রাপ্ত না হইয়া কি অবস্থা প্রাপ্ত হয়? সে কি যোগ ও কর্ম্ম (মোক্ষ ও স্বর্গ) উভয় হইতে ভ্রষ্ট হয়? কৃষ্ণ দেখিলেন, তাঁহার যোগটা যেরূপ গুরুতর ব্যাপার, কেবল ব্রহ্ম নির্ব্বাণের আশায় কেহই তাহাতে প্রবৃত্ত হইবে না, কিঞ্চিৎ ঐহিত সুখেরও প্রলোভন চাই। তজ্জন্য তিনি বলিলেন, “যোগ ভ্রষ্ট ব্যক্তি (অশ্বমেধাদি) পুণ্যকারীদিগের প্রাপ্য লোকে বহুবৎসর অবস্থান করিয়া পরে সদাচার ধন সম্পন্ন লোকের গৃহে জন্ম গ্রহণ করেন।” (৬অ–৪১)।
অবশেষে বাসুদেব বলিলেন, “যোগী তপস্বী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, জ্ঞানী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, এবং কর্ম্মিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; কিন্তু হে পার্থ, যে ব্যক্তি আমাতে অন্তঃকরণ সমর্পণ করিয়া শ্রদ্ধা পূর্ব্বক আমারে ভজনা করেন, তিনি আমার মতে সকল যোগী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম।”
যদি ব্রহ্মোপাসক যোগী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন,–যদি কেবল মাত্র ঈশ্বরের উপাসনা যোগাপেক্ষা অধিকতর ফলপ্রদ হয়, তবে কষ্ট সাধ্য পীড়াদায়ক এবং বুদ্ধিভ্রংশকারী যোগাভ্যাসের আবশ্যক কি?
———-
(১) জ্ঞানাগ্নি দগ্ধ কৰ্ম্মাণং তমাহুঃ পণ্ডিতং বুধাঃ। জ্ঞানাগ্নি সর্ব্বকর্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে তথা, ইত্যাদি। জ্ঞানলাভ হইলে হিতাহিত বিচারশক্তি এবং কর্ত্তব্য কর্ম্ম করণেচ্ছা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, ইহাই লোকে জানে; কিন্তু গীতার গান এমনই পদার্থ যে, তাহা প্রাপ্ত হইলে কর্ত্তব্য কর্ম্মের অনুষ্ঠান করা আবশ্যক হয় না, ভালমন্দ বিচার না করিয়া যে কর্ম্ম করিতে পারা যায়; অর্থাৎ অন্যে যাহাকে বুদ্ধিভ্রংশাবস্থা বলে, তাহাই গীতার জ্ঞানের চরমসীমা।
(২) সকল ধর্ম্মেই নিষ্কাম ভাবে কর্ম্ম করিতে উপদেশ দেয়। কিন্তু গীতার নিষ্কাম ধর্ম্মটা কিছু নূতন রকমের। নিষ্কাম ভাবে মন্দ কর্ম্ম এমন কি নরহত্যা পর্য্যন্ত করিলেও পাপ হয় না। ধার্ম্মিক লোকের পক্ষে অসৎ কর্ম্মও দোষাবহ নয়, এ কথা কেবল হিন্দুধর্ম্মেই শোনা যায়। কাশীর এক পরমহংস এরূপ পবিত্র ছিলেন, যে তাঁহাকে মদ্ গোমাংসাদি প্রদান করিলেও ভক্ষণ করিতেন; তাহাতে নাকি তাঁহার পবিত্রতা নষ্ট হইত না। শ্রীমদ্ ভাগবতে লিখিত আছে যে, “তেজস্বীদিগেরা গর্হিতাচরণ করিলেও দোষ হয় না।” অগ্নি যেমন সকলই ভোজন করে; তেমনি সাধুগণের কোন বিষয়ে দোষ স্পর্শ সম্ভব না।” যেমন, শ্রীকৃষ্ণের ব্যাভিচারাদি পাপকর্ম্মের দ্বারাও কোন দোষ হয় নাই। (দশম স্কন্ধ ৩৩ অধ্যায়)। ইহাই আমাদের ধর্ম্মশাস্ত্রের উপদেশ!!! নৈতিক অবনতির চরম সীমায় উপনীত না হইলে কেহ এরূপ কথা বলিতে পারে না।
(৩) ইণ্ডিয়ান নেসনের সুযোগ্য সম্পাদক ১৮৯৫ সালের ২৫শে মার্চ্চ তারিখের পত্রে লেখেন যে,–Anglicised বাবুরাই ১৮ অধ্যায়ের ১৭ শ্লোকের দোষ দেখিয়া থাকেন। তিনি বলেন,–“A work done under Divine inspiration is certainly neither a good work nor a bad work. If Cromwell Slew a whole army, he neither claimed merit for victory, nor felt himself tainted by sin.” “আদেশ” বাদে আমাদের বিশ্বাস নাই। প্রত্যেক মানবই তৎকৃত কর্ম্মের জন্য দায়ী। Cromwell বা বাবু কেশন চন্দ্র সেন যখন বলেন, “আমরা ঈশ্বরের আদেশে Charles I-এর মস্তক ছেদন, বা অবিধিপূর্ব্বক রাজ-জামাতা করিয়াছি, উক্ত কর্ম্ম সকলের জন্য আমরা দায়ী নহি,” জগৎ কি তাঁহাদের কথায় বিশ্বাস করে?
(৪) Read “Animal Magnetism” by Binet and Fero “International Science” series and “Hypnotism” by Heidenhain, translated by Wooldridge.
(৫) মৃত্তিকাভ্যন্তর হইতে তুলিবার পর দেখা যায় যে–“His body (হরিদাস যোগীর) was dried like a stick, and the tongue, which had been turned back into the throat had become like a piece of horn”–Monier William’s Buddhism